এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বই

  • কুট্টনীমতম

    দীপ্তেন
    আলোচনা | বই | ১৩ জানুয়ারি ২০০৭ | ৬৪১ বার পঠিত
  • কুট্টনীমতম। লিখেছিলেন কাশ্মীরের মন্ত্রী ও কবি দামোদর গুপ্ত। সুখের বিষয় যে তার ব্যক্তিজীবন সম্বন্ধে বিশেষ কিছু না জানা গেলেও তাঁর রচনাকাল ও ঐতিহাসিকত্ব নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। অষ্টম শতাব্দীর শেষ ভাগে এই আগাগোড়া শৃংগাররসাত্মক কাব্যটি লেখা হয়। কিতাবটি নিশ্চিত ভাবে খুব জনপ্রিয় ছিলো কেনো না পরবর্তী যুগের অনেক বইতেও এর রেফারেন্স দেওয়া আছে।

    মুলত: শৃংগাররসাত্মক হওয়ায় এটিকে খন্ডকাব্য, কেলিকাব্য বলা হয়।
    তিনজন নায়ক, তিনজন নায়িকা। নায়ক তিনজন সম্ভ্রান্ত ও ধীরললিত,তাদের নাম চিন্তামণি,সমরভট ও সুন্দর সেন। আর নায়িকারা সকলেই গণিকা, মালতী, মঞ্জরী ও হারলতা। তিনটি আলাদা উপাখ্যানের পরিণতি ও রসাভাসও আলাদা।
    কিতাবটি আগাগোড়াই আদিররসাত্মক যদিও একেবারে শেষে কিছু উপদেশ রয়েছে। কবি না কি এই কাব্যটির মধ্য দিয়ে যুবসমাজকে গণিকাগমনের কুফলটি দেখাতে চেয়েছেন। হবেও বা। দামোদর গুপ্ত ছিলেন মন্ত্রী আর তার রাজা জয়াপীড় খুবই ইন্দ্রিয়াসক্ত ছিলেন, তাই হয়তো কবিকে খুব পলিটিকালি কারেক্ট হতে হয়েছিলো।

    কেমন ছিলো সেই সমাজ? দু:খের বিষয় গণিকাগমন ও রতিবিলাস ছাড়া কবি প্রায় আর কিছুই উল্লেখ করেন নি। তাও যেটুকু খুঁটে নেওয়া। যেমন তখনকার নায়কদের পোষাক ও আচরণবিধি।
    মাথায় পাঁচ আঙুল লম্বা চুল, সেগুলিতে আবার কয়েকটি বিনুনী করা। খুব মোটা টিকি। বড় হাতলওয়ালা করাতের মতন চিরুনী গোঁজা মাথায়। গলায় সরু সোনার হার। আঙুলে আংটি। সারা গায়ে কুমকুম ঘষার ফলে একটু হলদেটে ভাব। পায়ে মোম দিয়ে ভিজানো, জরির কাজ করা লোহার নাল লাগানো জুতো। কানে দুটো দুল, দলবীটক আর সীসপত্রক। পরনে হলুদ রঙের কাপড়।
    আর তার "তাম্বুলবাহী' চাকর? তার গলায় মোটা পুঁতির মালা,নখ রঞ্জিত, হাতে শাঁখের মোটা বালা।
    নায়ক হয়তো তেমন সুক্ষ্ম ভাবে পান কাটতে পারেন না, তো কি? হাতে একটা জাঁতি সব সময়েই থাকা চাই। নইলে লোকে তো রসিক ভাববেন না। আর বসে যখন আড্ডা মারছেন , তখন কোনো এক চামচা আহ্লাদে তার পিঠ বাড়িয়ে দেন, তাতে হেলান দিয়ে বাবু আরেকটি পান খান।

    তুলনীয় মহারাষ্ট্রের রাজকুমার সমর ভটের বেশভুষা। মাথার পাগড়ীটা ছোটো ও মাথার তিন চতুর্থাংশ ঢেকে রাখে। গায়ে কুম্‌কুম খুব মৃদুভাবে লেপিত (আদেখলার মতন এক গাদা নয়),জুলফীতে খুব ঘন করে জাফরানের পেস্ট লাগানো আছে,কপালে সাদা সর্ষে দিয়ে তারকাকার তিলক কাটা,গলায় টিটির পাখীর আকারে সোনার হার, হাতে লাক্ষা দিয়ে বদ্ধ সোনার কবচ, wrist এ প্রবাল ও সোনার বালা,হাতে হাতল ওয়ালা বেতের লাঠি। জংঘায় কাপড়ের পট্টি ( বছর ত্রিশ চল্লিশ আগেও কনেস্টবল,চাপরাসীরা ঐরকম পট্টি বাঁধতেন),কোমরে ছুরিকা আর তরোয়াল। পায়ে "চুর্চুর শব্দকারী পাদুকা"।

    কি কি বই পড়েন তখনকার আঁতেলরা? বাৎসায়ন তো অবশ্যই, আরো পড়েন দত্তকের মদনোদয়,ভরতের নাট্যশাস্ত্র, বিশাখিলের কলাশাস্ত্র,দন্তিলের সংগীতশাস্ত্র,বৃক্ষ আয়ুর্বেদ, চিত্রকলা,সুচীশিল্প,পত্রছেদবিধান, ভ্রমকম (টীকাকার বলেছেন যান মানে রথ চালনা বিদ্যা) পুস্তকর্ম (কাঠ,মাটি, চামড়া দিয়ে পুতুল বানানোর বিদ্যে),পাকশাস্ত্র ও আতোদ্য বাদ্যাদি (বীণা,মুরজ,বংশী ও কাংস্য এই চারটে বাদ্যযন্ত্র)বিদ্যা।
    আশ্চর্য্য যে অস্ত্রশিক্ষা নেই। পরে আরেক জায়গায় আছে চর্ম ও অসিধারী রক্ষীরা তাদের প্রহরায় থাকতো। মানে যুদ্ধবিদ্যাটি পুরোটাই আউটসোর্স করা হতো।

    এদের সাথে তুলনীয় একটি গরীব পেশাদার। এক কুরিয়ারের বর্ণনা আছে। সেই পত্রবাহক বারবার সেলাই করা বহু জীর্ণ বস্ত্র দিয়ে তৈরী কাঁথায় আবৃত, হাতে লাঠি তাতে তালপাতার পাখা বাঁধা আছে, কোমরে একটি চামড়ার বটুয়ায় তেল আর একটা বড় লাউএর খোলায় জল,ধুলিধুসরিত সেই লোকটি আসছে, তার পায়ে ফোস্কা আর ছেঁড়া চটি। রাজপুরুষ তাকে দেখে খুব খুসী, বয়স্যকে বল্লেন "এই হনুমান আসিয়াছে"। ঠাট্টা !!

    কাশ্মীর ছাড়াও উল্লেখ আছে পাটলিপুত্র,বারাণসী ও দেবরাষ্ট্রের (মহারাষ্ট্র অঞ্চল)। এ ছাড়া আর কোনো নগরের/দেশের উল্লেখ নেই।

    মুদ্রার নাম "কিদার"। সেটি ভ্রমাত্মক। কারণ গল্পটি বারাণসীতে উপস্থাপিত। কিন্তু কিদার নামের মুদ্রাটি একটি পারসীক মুদ্রা যেটি কাশ্মীরেই প্রচলিত ছিলো। বারাণসীতে নয়।

    তবে মৃগয়ার উল্লেখ রয়েছে বেশ কয়েক জায়গায়। ঘোড়ার পিঠে চড়ে শিকারী কুকুরের সাহচর্য্যে দ্রুত ধাবমান শিকারকে বাণবিদ্ধ করবার যে মজা - সেই কথা উল্লেখে রাজকুমারের যে গদগদ ভাব , তাতে মনে হয় মৃগয়াও খুবই প্রচলিত ছিলো। তবে শিকারের মধ্যে ছিলো শুকর,খরগোস ও হরিণ। ভয়ংকর কিছু নয়।

    আছে পুতুলনাচের কথা, আর রত্নাবলী নাটক অভিনয়ের বিশদ বর্ণনা।

    আর আছে অবিরল পন্ডিতি। নানান লিস্ট , তাদের সব ভয়ানক ক্লাসিফিকেশন। বেশ্যা কর্ত্তব্যের মধ্যে যেমন সহায় গমাগম্যচিন্তা, গম্য কারনানি, অর্থাগমপায়:, বিরক্ত প্রতিপত্তি, ইত্যকার বারো রকমের কর্ম রয়েছে, তার মধ্যে একটিরই ব্যাখ্যা করছি; বর্তমান নায়ককে দোহন করে নি:স্ব করে দেওয়ার পরে আবার প্রাক্তন প্রেমিকের কাছে ফিরে যাওয়ার নাম বিশীর্ণ প্রতিসন্ধান। এই কিতাবে ঐ বারোটি শাস্ত্রমত আচরণের বেশীর ভাগই উল্লেখিত হয়েছে।

    প্রায় বছর পঞ্চান্ন আগে লেখাটি অনুবাদ করেছিলেন ত্রিদিব নাথ রায়।
    যখন সংগ্রহ করেছিলাম তখনই সামনের কয়েকটি পাতা ছিলো না, তাই প্রকাশকের নাম জানা নেই।

    জানুয়ারী ১৩, ২০০৭
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ১৩ জানুয়ারি ২০০৭ | ৬৪১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। কল্পনাতীত মতামত দিন