এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ইস্পেশাল  পুজো ২০০৬

  • আমার পুজো

    দেবশ্রুতি রায়চৌধুরী
    ইস্পেশাল | পুজো ২০০৬ | ০১ অক্টোবর ২০০৬ | ৮২৮ বার পঠিত
  • সাত তলার অ্যাপার্টমেন্ট থেকে দুড়দাড় করে লিফ্‌টের দিকে এগোতে এগোতে আকাশ দেখার চেষ্টা করি আমি -- আর রোজের মতো আরও একবার বুঝতে পারি কার্পেটে মোড়া এই করিডোরে কোথাও এমন ফাঁক নেই, জানলা তো দূর অস্ত, যেখান দিয়ে একফালি আকাশ দেখা যায়! অথচ দেশে থাকতে পুজো মানেই তো আগে আকাশের দিকে চোখ রাখা- ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমীর হিসেবে আকাশের রং গাঢ় বা হাল্কা হওয়ার হিসেব কষে নেওয়া- শরতের আকাশের "নীলত্ব" আর বাঙালির "পুজোত্ব"কে এক করে দেওয়ার সে অভ্যেস বিলেতের এই এত বছরের বসবাসের অভ্যেসেও অনভ্যাস হয়ে ওঠে না কোন তাগিদে? ভাবতে ভাবতে পেন্টন রাইসের রাস্তা বেয়ে কিংস ক্রসের মোড়ে চলে এসেছি। কখন, টের পাই নি। টের পেতে চাইও নি বোধহয়! বৃষ্টিভেজা, মেঘকালো লন্ডনের সকালে সকালের কোনো রংই লাগে নি তা মরমে মরমে টের পেয়েছি বলেই বোধহয় বাইরের পৃথিবীটাকে অস্বীকার করে ক্যামডেন টাউনের পুজোর দিকে দ্রুতপায়ে এগিয়ে যাওয়ার এই অক্লান্ত চেষ্টা আমার -- আমার পুজো তো কংক্রিটের এই চারদেওয়ালের, বিলেতি ধোপদুরস্ত কমিউনিটি হলের মধ্যেই -- হোক না বাইরের ছবিটা বেমানান -- মনের পুজো আর পুজোর মন এই দুইয়ের মিলই তো বড় কথা! নিজেকে আরও একবার সান্ত্বনা দিই যেন!

    ক্যামডেন হলে যখন ঢুকলাম তখন বৃষ্টিতে কোতের হাতা প্রায় সপ্‌সপে! হলের বাইরের দৈত্যাকার নিরাপত্তারক্ষীদের সৌজন্যমূলক হাসি পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই সামনে মা দুর্গা! সপরিবারে এবং সমহিমায়! এত সকালে লোকজন বিশেষ নেই- আমার মতো দু'একজন যাদের পুজো উপলক্ষে কাজে ফাঁকি দেওয়ার উপায় নেই -- ইচ্ছেও নেই নাকি! আবার প্রশ্নের জালে আটকে পড়তে হবে ভেবেই ভয়ে ভয়ে প্রতিমার একেবারে আমনে গিয়ে দাঁড়াই। হাতজোড় করে কিছু চাওয়ার অভ্যেস কোনোকালেই নেই -- শুধু নির্নিমেষ চেয়ে থাকি প্রতিমার মুখের দিকে, টানা টানা চোখ, সুডৌল হাতে ধরা অস্ত্ররাশি আর বৈপরীত্যে ভরা গহনাসম্ভারের দিকে। গবেষক মন কি আরও একবার প্রতিমার এই রূপের ঐতিহাসিক বিবর্তন আর নারীপূজার অতীতকে হাতড়ে বেড়াতে চায়? নিজেকে আবার সংযত করি আমি -- বলি পুজোটাকে পুজোর মতো করে দেখো না একটু। সারাক্ষণ মনের মধ্যে এত প্রশ্নের কচকচানির দরকার কি?

    কিন্তু কি সেই পুজো? কি খুঁজি আমি পুজো থেকে? কিসের টানে পড়াতে যাওয়ার আগে সকালে দু'ঘন্টা বেশি ঘুমের অমোঘ আকর্ষণ ত্যাগ করে ছুটে যাই এমন একটি আবহের পুজোয় যার সঙ্গে আমার পুজোর কোথাও কোনো মিল খুঁজে পাই না? কিন্তু আমার পুজো কি? ঠিক কোন পুজোকে আমি নিজের ভাবতে পারি? এ কি শুধুই পরবাসে থাকার নস্টালজিয়া -- দেশের মাটির টানকে নতুন করে আবিষ্কার করা? আবারও নানা প্রশ্ন ভিড় করে আসে যেন।

    ক্যামডেন হল থেকে বেরিয়ে পড়ি, হাঁটতে শুরু করি। আমার কর্মস্থলের দিকে! বড় অশান্ত লাগে কোথাও! মনে হয় যেন ভিজে কোটের হাতা, শনশনে ঠান্ডা হাওয়া, লন্ডনের মেঘলা আকাশ সব ছাপিয়ে মনের ভেতর থেকে একটা গোমড়ানো কষ্টই যেন মুখ্য হয়ে ওঠে! পুজোর প্রশ্ন থেকে নিজের অস্তিত্বের প্রশ্নে মিশে যাই যেন!

    দেশে থাকতেও আমার পুজো বলে কিছু কি ভেবেছি কখনও? মন্দপে মন্ডপে প্রতিমাদর্শনের হুড়োহুড়ি, নতুন জামা কেনার আবেগ, ভিড়ের মধ্যে নিজেকে মিশিয়ে দেওয়ার আবেগ কোনওকালেই তো স্পর্শ করে নি আমাকে -- তাহলে? একেবারে ছোটোবেলায় নতুন জামা পড়ার স্মৃতি নেই তা নয় কিন্তু পুজো বলতে স্কুল ছুটি আর বাড়িতে মায়ের সাথে গল্প করা -- বা আরও বড়ো বেলায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা ছাড়া ওই সময়ের আনন্দ বা অন্য অনুভূতি কিসে আলাদা? কিভাবে তা ছুঁয়ে গেছে আমার একেবারে শিকড়ের আমিকে যার না-পাওয়া পরবাসে আমাকে তাড়া করে বেড়ায়? মনে পড়ে যায় কলকাতার পুজোতেও আমার মনখারাপের মূহুর্তগুলো -- নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে অতৃপ্তির আশ্লেষে নিজেকে আরও জড়িয়ে ফেলা --! ধর্মীয় অনুষঙ্গ দিয়ে এই উৎসবের বিচার তো কোনোদিনই করি নি আমি -- তবে কি খুঁজেছি পুজো থেকে? যা খুঁজেছি তা যদি দেশের মাটির গন্ধেই সম্পৃক্ত থাকতো তাহলে নিজের শহরের, নিজের পাড়ার প্রতিমার মুখখানিও বছরের পর বছর দেখে ওঠার ইচ্ছেটুকু জাগিয়ে তুলতে পারি নি কেন? কি খুঁজি আমি পুজো থেকে -- আদৌ খুঁজি কি? কি পেতে চাই এই খোঁজার মধ্য দিয়ে? মন ভার হয়ে আসে আরও -- নিজেকে অসম্পূর্ণ মনে হওয়ার একটা বৃত্ত নিজেই এঁকে ফেলি নিমেষে! এবং তখনই যেন কোথাও একটা উত্তর খুঁজে পাই -- আসলে আমার যাবতীয় অসম্পূর্ণতাকে ঢেকে দেওয়ার চেষ্টাই আমার পুজো -- পুজোর সময়, পুজোর আকাশ, পুজোর আবহ।

    একটা আদর্শ জীবন -- অতৃপ্তিমুক্ত, অসম্পূর্ণতারহিত আমার মতো করে বাঁচার প্রতিশ্রুতি পুজোর এই দিনগুলো। আর পাঁচটা স্বপ্নের মতো সে স্বপ্নও অবাস্তব -- অপূর্ণ থেকে যায়। তাই দেশের পুজোর মনখারাপ পরবাসে সঞ্চারিত হয় -- কিন্তু তারপরেও বিলেতের মেঘে ঢাকা তথাকথিত পুজোর সকালে দ্রুত হেঁটে চলি কোনও এক পুজো মন্ডপের সন্ধানে। এ যেন স্বপ্নের পিছনে ছোটা -- যে স্বপ্ন পূরণ হওয়ার নয়। পুজো তাই একটা স্বপ্ন -- পুজোর আকাশে এই অবাস্তব স্বপ্ন বড়ো বাস্তব মনে হয় -- অন্তত: কয়েকটা মূহুর্তের জন্য। তারপরেই অতৃপ্তি, অসাফল্য, অসহিষ্ণুতা এসে ভিড় জমায় কিন্তু সেই স্বপ্নের পেছনে ছোটা থামে না আমার। মূহুর্তের মধ্যে বুঝতে পারি পুজো নিয়ে আমার এক অব্যক্ত অনুভূতি যেন আমার জীবনদর্শন হয়ে গেছে কখন -- না চাইতেই হয় তো!
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ইস্পেশাল | ০১ অক্টোবর ২০০৬ | ৮২৮ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    মতি - asiskumar banerjee
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। হাত মক্সো করতে মতামত দিন