প্রাণিজগতের সকল বর্গের মধ্যে কেবল মানুষকে স্বাতন্ত্র্যতা দান করেছে ভাষা। ভাষার প্রশ্নেই সে স্বাধীনতা দাবি করার পুরোহিত্য লাভ করে। আবার জাতিতে জাতিতে ভাষাই তাকে আলাদা করে তোলে। তাই ভাষার প্রশ্নে সচেতন মানুষ মাত্রই প্রতিক্রিয়াশীল।
বাঙালির জাতীয়তাবোধ গঠনে পাটাতন হিসেবে কাজ করেছে বাংলা ভাষা। বিশেষত ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সালের রাজপথের আন্দোলন মূলত ভাষাকেন্দ্রিক। কঠিন প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে পাকিস্তান আন্দোলনে সফলতা লাভের পরপরই এই অঞ্চলে পুনরায় জনস্ফূর্ত আন্দোলন তাই বিশেষ আলোচনার দাবি রাখে।
সাধারণের কাছে যদিও ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট, প্রক্রিয়া, প্রতিক্রিয়া এবং সফলতা একটি মীমাংসিত বিষয়, ভাষার উদ্দেশ্য, প্রবাহমানতা, ব্যবহার, ব্যবহারবিধি এবং উপযোগিতার প্রেক্ষিতে ভাষা আন্দোলন এবং পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের কাটাছেঁড়া আবশ্যক।
নিঃসন্দেহে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতির অতীব গর্বের বিষয়। বাঙালির জাতীয় আন্দোলনসমূহে বিশেষত স্বাধীনতা সংগ্রামে এই আন্দোলনের ভূমিকা অনবদ্য। মূলত নবগঠিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভিত্তিমূল হিসেবে এই আন্দোলন অবিসংবাদিতভাবে প্রতিষ্ঠিত। ভাষা আন্দোলনের এই দিকটি সরিয়ে রেখে যদি আমরা একটু ভিন্নদিক থেকে দেখার চেষ্টা করি তবে এখনও অনেকগুলো বিষয় নিয়ে একাডেমিক-বুদ্ধিজীবী মহলে তর্ক চালু রয়েছে। যেমন- বর্তমানকালেও পাকিস্তান আন্দোলনে নিজেদের বিশ্বাস অক্ষুণ্ণ রাখা গোষ্ঠী নিরন্তর প্রশ্ন এবং অভিযোগ তুলে যাচ্ছেন যে, পাকিস্তান রাষ্ট্রে ভাঙার পেছনে মূলত রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নই জোরালো ভূমিকা রাখে। তাদের মতে উর্দু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়াই উচিতব্য যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠের মাতৃভাষা না হওয়া সত্ত্বেও হিন্দি ভারতের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করেছে।
উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা- এমন বক্তব্যই ছিল পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর। যদিও তিনি উর্দুতে পারদর্শী ছিলেন না। তাই রাষ্ট্রভাষা বাংলা দাবি করা জনগোষ্ঠীকে এই পক্ষ জিন্নাহর সাথে বেইমানীর দায়ে অভিযুক্ত করে থাকেন।
হিন্দি ভারতের দাপ্তরিক ভাষা হলেও রাজ্য ভিত্তিতে আঞ্চলিক ভাষাসমূহের স্বাধীনতা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। তবুও হিন্দির বিরুদ্ধে এখন অবধি সোচ্চার রয়েছেন দক্ষিণভারতের জনগোষ্ঠী। আর আসামে তো ১৯৬১ সালের ১৯ মে ১১ জন যুবক অসমীয়া ভাষাকে রাজ্যের একমাত্র দাপ্তরিক ভাষা করার প্রতিবাদে পুলিশের গুলিতে প্রাণদান করেন। তাই বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন যদিও বাঙালির গর্বের বিষয়, ভাষা প্রশ্নে একক আন্দোলন নয়।
রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি আদায়ে আপামর জনতা তৎকালে রাজপথে নামে। কারণ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার লাভের ক্ষেত্রে মাতৃভাষার বিকল্প নেই- এমনটাই বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাষা বিশেষজ্ঞের মত। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশে এমনটাই প্রচলিত আছে যে ভাষা সংগ্রামীরা মূলত মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদার জন্যই আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন। ইউনেস্কোর ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান জনসাধারণের মনে এই বয়ান আরও দৃঢ় করে তোলে। আদতে ব্যাপারটি কিন্তু তা নয়। আর নয় বলেই রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, পেশাজীবী, আমলারাসহ প্রায় প্রত্যেক বাঙালি-ই মনে করেন যে মাতৃভাষার সম্মান রক্ষা করা সমাপ্ত হয়েছে, এখন আর কোনো দায়িত্ব অবশিষ্ট নেই। তাই শিক্ষার মাধ্যম, আদালতে ব্যবহার্য ভাষা, ভাষার প্রবাহমানতা, আলাপ-আলোচনার ভাষা ইত্যাদি প্রশ্নে সবাই এক রকম উদাসীন থাকে।
তাবৎ জ্ঞান-বিজ্ঞানের দুনিয়ায় প্রধানতম ভাষা এখন ইংরেজি। আর ধ্রুপদী ভাষা হওয়ায় গ্রিক, ল্যাটিন নিজেদের সনাতনী অবস্থান ধরে রাখতে পারছে। কিন্তু ভাষাভাষীর দিক থেকে বাংলা পঞ্চমে থাকা সত্ত্বেও জ্ঞান-বিজ্ঞান হতে শুরু করে বিশ্বসাহিত্য, শিল্প-কলাসহ ভাষাভিত্তিক বিষয়াদিতে বাংলার হিস্যা অতি নগণ্য।
কেবল বাংলা পড়তে পারা একজন যখন ইংরেজিতে লেখা বিজ্ঞাপন, দিকনির্দেশনা, প্রতিষ্ঠানের নামসহ তাবৎ শব্দ, বাক্য দেখেন তখন তার অনুভূতি নিশ্চয়ই ইংরেজি প্রেমে বুঁদ হয়ে থাকা "আলোকিত গোষ্ঠীর" চেতনায় ধরা দেয় না। তাই রাষ্ট্রভাষা বাংলা, মাতৃভাষা বাংলা ইত্যাদি শব্দবন্ধ নিয়ে বিশদ আলোচনায় সামিল হওয়া জরুরি। রাষ্ট্রভাষা বাংলার স্বীকৃতি আদায় সমাপ্ত হয়েছে। এবার জীবনঘনিষ্ঠ কাজকর্মে মাতৃভাষা বাংলার প্রয়োগ নিয়ে সকলকে কলমপথে নামতে হবে।