এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  স্মৃতিচারণ  আত্মজৈবনিক

  • কাপালিক The Skull Man

    সে
    স্মৃতিচারণ | আত্মজৈবনিক | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ৪২৬৭ বার পঠিত | রেটিং ৪.৭ (৩ জন)
  • খেই ধরানো

    যে কোনও বই পড়বার সময় ভূমিকাটুকু বাদ দিয়ে পড়া আমার বরাবরের স্বভাব। ঐটে মূল পাঠ্যাংশের তুলনায় কম আকর্ষণীয় লাগে। কিন্তু নিজে লিখবার বেলায় খেয়াল হলো যে কিছু কৈফিয়ৎ আগেভাগেই জানিয়ে না দিলে পাঠকদের ওপর অন্যায় করা হবে।
    "কাপালিক" আমার নিজের জীবনের ঘটনা, যদিও চরিত্রদের নাম বদলাতে হয়েছে। এর সময়কাল উনিশশো ছিয়ানব্বই সালের মধ্যেই সীমিত। এই সময়টা আমার বিদেশ থেকে ভারতে ফিরে আসার সন্ধিক্ষণ।
    আমি ভেঙে যাওয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের তাশখন্দ থেকে ফিরেছিলাম কলকাতায়। যে কলকাতাকে ছেড়ে আমি দশ বছর আগে সোভিয়েত ইউনিয়নে গেছলাম উচ্চশিক্ষার্থে, ফিরে আসবার পরে সেই কলকাতাই কেমন যেন অচেনা ঠেকছিল। অথচ দশটা বছরে আমি কতবার ঘুরে গেছি আমার শহর থেকে, যদিও সেসব ছিল ছুটি কাটানোর মত শর্টট্রিপ, এবার এলাম পাকাপাকি থাকতে। অর্থাৎ আমার একটা উপার্জনের ব্যবস্থা চাই, অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত দম ফেলবার সময় নেই। না, আমার কাছে কোনও নিজস্ব সঞ্চয় ছিল না।তাশখন্দে আমি ছিলাম শুধুই ছাত্র, কোনও চাকরি করিনি সেখানে।আমার সঙ্গে ফিরেছিল আমার বয়ফ্রেণ্ড, সেও সবে পাশ করেছে, সেও ভারতীয়, সেও বাঙালী, তবে তার বাড়ি কলকাতা থেকে বহুদূরে পাহাড়ে ভরা মেঘালয় রাজ্যের শিলং শহরে। ছবছর আমরা একসঙ্গে থেকেছি তাশখন্দে। এই ছবছরে আমাদের একটা সন্তান জন্মেছে, মেয়েসন্তান, অবশ্য বিয়ে করি নি আমরা। আমাদের মেয়েকে কলকাতায় আমার মায়ের কাছে রেখে গিয়েছিলাম কিছু বছর আগে। তার বয়সও সবে পাঁচ হয়েছে। সে আমার মায়ের কাছেই থাকে। আমার বয়ফ্রেণ্ড তার বাড়িতে সব খবরই গোপন রেখেছিল। তাদের রক্ষণশীল পরিবার, তার দিদির তখনও বিয়ে হয় নি। ছোটভাই বান্ধবীর সঙ্গে থাকে, সে বিয়ে না করেই বাবা হয়েছে, এসব লজ্জার ঘটনা বলেই ধরা হয় তাদের পরিবারে, বলা হয় স্ক্যাণ্ডাল। এসব খবর জানাজানি হলে দিদির বিয়ে আটকে যেতে পারে। ভারতীয় অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ প্রথায় শুধু পাত্রপাত্রীই নয়, তাদের পরিবারের ব্যাকগ্রাউন্ড চেক বিরাট ভুমিকা পালন করে। অন্যদিকে, আমার মা আমার মেয়েকে নিজের কাছে রাখতে রাজি হলেও আমাদের দুজনের সম্পর্ককে মেনে নিতে পারে নি।এর পেছনে যে আমাদের দুজনের বিয়ে না করে একসঙ্গে বসবাস করাটাই একমাত্র কারণ, তা কিন্তু আমার মনে হয় না। আমরা দুইবোন, বাবা মারা গেছে শৈশবে, আমিই বড়। মা আমাকে কোনওদিনও আদর করেছে কি ভালোবেসে কিছু বলেছে বলে আমার মনে পড়ে না, আমার বোনের প্রতি অবশ্য তার ব্যবহার ছিল খুবই নরম। এর কারন ছিল স্পষ্ট। আমার গায়ের রং এজন্য দায়ী। বোনের তুলনায় আমার গায়ের রং বেশ কয়েক পোঁচ কালো। ছোটবেলা থেকেই গায়ের রং কালো হবার কারণে আমি তার কাছ অপ্রিয় হয়ে থেকেছি। আমাদের সমাজে এখনও ফর্সা মেয়ের চাহিদা বিয়ের বাজারে সবচেয়ে বেশি।মেয়েদের দৈহিক সৌন্দর্যের মাপকাঠিতে অগ্রাধিকার পেত গায়ের রং, সেই প্রথম রাউন্ডেই আমি ফেল মেরেছি। আর কে না জানে, যতই পড়াশোনা করে চাকরি বাকরি নিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াই না কেন, বিয়ে তো একসময় করতেই হবে। এ সমস্তই আমার অবচেতনে গেঁথে গেছল স্বতঃসিদ্ধের মত। কিন্তু সব কিছু আমূল পাল্টে দিল আমার সোভিয়েত ইউনিয়নে যাওয়া। সিলেবাসের পড়ার থেকেও অনেক বেশি শিখেছি সেখানে পারিপার্শ্বিক থেকে। এ কেবল অন্য দেশে যাওয়া নয়। এ ছিল টাইম ট্র্যাভেল। টাইম মেশিনে করে যেন কোন এক স্বপ্নের মত ভবিষ্যতে চলে যাওয়া। যেখানে গিয়ে জানলাম আশৈশব জেনে আসা অনেক স্বতঃসিদ্ধ আসলে ভুল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমি দ্রুত বদলে যেতে থাকি। গায়ের রং সম্পর্কে, বিয়ে সম্পর্কে, জীবনের নানান ব্যাপারে আমার চিরাচরিত ধারণা এবং সংস্কার টুপটাপ খসে খসে পড়ে যেতে থাকে, যেমনটা সীতাহরণের ঘটনায় পুষ্পক রথে করে লঙ্কার পথে উড়ে যেতে যেতে সীতা তার সমস্ত অলংকার এক এক করে ত্যাগ করেছিল। জীবনে প্রেম এসেছে একের পর এক। বিয়ে সম্পর্কে প্রথমে দোটানায় থাকলেও ক্রমশ বিয়ে আমার কাছে আর আকর্ষণীয় মনে হয় নি। অবিবাহিতা মা দেখলে সেই সময়ে অনেকেই মনে করত এ সন্তান কোনও দুর্ঘটনার পরিণতি। নিরাপত্তাহীন যৌন জীবনের জ্যান্ত দলিল। এই সন্তান যেন একটা দায়, একটা লজ্জার ব্যাপার। বিয়ের অপশন থাকা সত্ত্বেও কেন তুমি বিয়ে না করে মা হবে? এ তোমার কেমন বেয়াড়া আবদার, এত বড়ো দুঃসাহস! সকলেই এর পেছনে একটা বঞ্চনার ইতিহাস খুঁজতে চেয়েছে, দেখতে চেয়েছে একটা করুণ কাহিনি। এটা যে আমার নিজের পছন্দে, চয়েসের ফলেই হয়েছে, তা আমার সমাজের অধিকাংশ মানুষই মেনে নেয় নি। তারা ভাবত, আমি মিথ্যে বলছি, প্রেমে ঠকে গিয়ে লজ্জায় আঙুর ফলকে টক বলে চালাতে চাইছি। যদি তখন তাদের কথাই শিরোধার্য করে মাথা নুইয়ে বলতাম যে তাদের গণনাই ঠিক, আমি সত্যিই অভাগিনী, তাহলে হয়ত তারা সন্তুষ্ট হতো। দেশে ফিরবার পরে তাই প্রথমে নিজের মায়ের কাছে উঠলেও সেখানে বেশিদিন ঠাঁই হয় নি। ঘনিষ্ঠ আত্মীয় স্বজন সব রাতারাতি পর হয়ে যাচ্ছিল। কলকাতা শহরে আমাদের থাকবার কোনও জায়গা ছিল না। পর্য্যাপ্ত টাকার অভাবে কোনও ফ্ল্যাট ভাড়া নিতে পারি নি, ফলে বাধ্য হয়ে নিজেদের স্বামীস্ত্রী হিসেবে পরিচয় দিয়ে একটা বস্তিতে ঘর ভাড়া নিই। জীবনে সেই প্রথম বস্তিতে বাস করা। যারা আগে কখনও বস্তিতে থাকে নি তাদের জন্য একেবারেই সহজ নয় সেই নতুন পরিবেশে বসবাস করা। সেখানে জলের কল থেকে শুরু করে বাথরুম টয়লেট সমস্তই কমন। একটি মাত্র আসবাবহীন স্যাঁৎসেতে ড্যাম্প ধরা ঘরের মেঝেয় চাদর পেতে শোবার ব্যবস্থা। টাকা পয়সার তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে নানান ধরণের চাকরি করেছি ন্যূনতম খরচ জোটাতে। আমার বয়ফ্রেণ্ডের পরিবারকেও ক্রমে জানানো হয় সব। আমরা চলে যাই শিলং এ। কিন্তু সেখানে পরিস্থিতি আয়ত্ত্বের বাইরে চলে যায়। তারা আমাকে দুটো অপশনের মধ্যে একটা বেছে নিতে বলে। এক, ঐ সম্পর্কের ইতি টেনে কলকাতায় একা ফিরে যাওয়া, দুই, ওখানে থাকতে চেয়ে খুন হয়ে যাওয়া। ওখানে জোর করে থাকবার চেষ্টা করলে আমাকে তারা মেরে ফেলে ওয়ার্ডস লেকের গভীর জলে বস্তায় পুরে ফেলে দেবে। আমার পায়ে বেঁধে দেবে ভারীভারী বাটখারা। আমার মৃতদেহ অদূর ভবিষ্যতে ভেসে উঠবে না কিছুতেই। হয়ত এটা ভয় দেখানোর জন্যই তারা বলেছিল। কিন্তু প্রতিদিন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে শহর গ্রাম নির্ব্বিশেষে কোনও না কোনও বিবাহিত মেয়ের অস্বাভাবাবিক মৃত্যু ঘটে চলেছে, সেসব খবর তো আমাদের অগোচরে থাকে না। আর এক্ষেত্রে আমি বিবাহিত মেয়ে না হলেও এই বাড়ীর ছেলের সঙ্গে আমার সম্পর্ক স্থাপন হয়েছে যা তাদের মনোনয়ন পায় নি, পাবেও না, সেক্ষেত্রে আমার প্রাণেরও বেশ ঝুঁকিই রয়েছে তা বুঝে ফেলি। বুঝি প্রাণ নিয়ে পালানো ছাড়া খুব বেশি অপশন আমার হাতে নেই। জনবল নেই, লোক নেই। আমি প্রথমটাই বেছে নিয়েছিলাম। কারন সেই প্রেমটার মৃত্যু ঘটেছে তখনই। জোর করে সেই মৃত প্রেমের কাছ থেকে কিছুই পাওয়া যাবে না, বরং নিজের প্রাণটিও খোয়া যেতে পারে।ফলে ভাগ্যের এই বিড়ম্বনায় পুরোপুরি নিঃস্ব হয়ে নিজের জন্মভূমিতেই নির্বাসিতের জীবন বেছে নিয়েছি। আমার সন্তানকেও নিজের কাছে এনে রাখতে পারিনি। মধ্যনব্বইয়ের সেই দিনগুলোয় অবিবাহিত মায়েদের জন্য এই ধরণের শাস্তিই হয়ত বরাদ্দ ছিল। আমাদের এই নীল গ্রহটায় অনেকগুলো পৃথিবী আছে, সেই পৃথিবীগুলোয় যেতে হলে সবসময় যে টিকিট কেটে যেতে হবে তেমন নয়। আমাদের চারপাশেই রয়েছে সেই সব পৃথিবী। তাদের একটার সঙ্গে অন্যটার ব্যবধান সময়ে, ভাবনায়, মূল্যবোধে, শিক্ষায়, ভালোবাসায়, নিষ্ঠুরতায়, আরও অনেক কিছুতে। স্রোতের বিপরীতে চলার কারণে বিভিন্ন জীবিকার পেছনে ছুটতে হয়েছে। ফলতঃ বেঁচে থাকার চেষ্টায় একের পর এক নানান জীবিকা নিতে হয়েছে। কখনও পড়ানোর কাজ নিয়েছি, তো কখনও মডেলিং করেছি। টাকার অঙ্কে মজুরি পড়তায় না পোষালেও অভিজ্ঞতার ঝুলি এমন ভরেছে, যে হিসেব কষলে সব মিলিয়ে লাভের অঙ্কই বেশি মনে হয়। এমনি নানান সব চাকরির মধ্যে একটা চাকরির কিছু অভিজ্ঞতা ধরা রইল এইখানে।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:d5ee:e24d:c118:83 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৩:০৩735599
  • প্রথম অধ্যায়
    শিক্ষাবিধি দিয়ে এরা ছাঁচ বানিয়েছে—কিন্তু ছাঁচে-ঢালা মনুষ্যত্ব কখনো টেঁকে না—সজীব মনের তত্ত্বের সঙ্গে বিদ্যারতত্ত্ব যদি না মেলে তা হলে হয় একদিন ছাঁচ হবে ফেটে চুরমার, নয় মানুষের মন যাবে মরে আড়ষ্ট হয়ে, কিম্বা কলেরপুতুল হয়ে দাঁড়াবে।
    ― রাশিয়ার চিঠি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

    গত শতাব্দীর শেষ কটা বছর তখনও বেঁচে। কলকাতার পথে পথে হন্যে হয়ে চলছিল আমার চাকরি খোঁজা। এর আগে গোটা দুয়েক জায়গায় কাজ করলেও টিকে থাকতে পারিনি। বস্তির ঘরভাড়া আগাম এক মাসের দেওয়া ছিল বলে নিশ্চিন্ত। কিন্তু হাতে ছিল মাত্র ছ সাতশো টাকা। প্রত্যেকটা পয়সা যদি গুণে গেঁথেও খরচ করি, শুধু বাসভাড়া দিতে দিতেই যে আমার ঐ টাকাটা একমাসে খরচ হয়ে যাবে তা বুঝতে পারতাম, কিন্তু মাসের শেষ অবধি কী করে টানবো সে নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করত না। একটা বাগানঘেরা হলদে রঙের বাড়িতে চাকরি জোগাড় করেছিলাম―অফিস সেক্রেটারির কাজ। কেবলই ভাবতাম কতটা কম খেয়ে একটা গোটা মাস চালিয়ে দেওয়া যেতে পারে, কতগুলো দিন টানা না খেয়ে কাজ করা যায় ― এমনই সব হিসেব আমার মাথার মধ্যে ঘুরত। একবার ভেবেছিলাম চাকরিতে ঢোকার হপ্তাদুয়েক পরেই সায়েবের কাছ থেকে শপাঁচেক কি আটশো মত ধার চেয়ে নেব আগাম হিসেবে, মাইনে দেবার সময় কেটে নিলেই হবে। তার পরে জড়ো সড়ো হয়ে সেসব চাইতে খুব লজ্জা পেলাম, ভাবলাম সায়েব যদি হাঘরে ভেবে বসে আমায়, সে কি আমায় পরবর্তীকালে সম্মান করবে? কে না জানে, মানুষকে সম্মান করবার জন্য কিছু পয়সাকড়ি থাকা একটা আবশ্যিক প্রাথমিক শর্ত।
    সায়েব সায়েব করে উল্লেখ করছি যাকে, সে সত্যিই টকটকে ফর্সা বিদেশি সায়েব, কারণ কোম্পানিটাই রাশিয়ান।আমি যদিও কোম্পানির সরাসরি চাকুরে ছিলাম না, ঠিকেদারের ওপর আমার মাইনে-ছুটি-বহাল-ছাঁটাই, এসবের দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল। শুধু আমার কেন? চাকর, ড্রাইভার, জমাদার, রিসেপশনিস্ট এবং মালি। সংখ্যাটা কম নয়। ঠিকেদার নিজে একটা মাসিক মাইনে নিত এবং কোম্পানির থেকে যে থোক টাকাটা আমাদের মাইনে বাবদ বরাদ্দ ছিল, সেটা থেকে তার নিজস্ব কমিশন কেটে রেখে, বুদ্ধি বিবেচনার ওপর নির্ভর করে প্রত্যেকের মাইনে ধার্য হয়েছিল।আমি ড্রাইভারদের থেকে কিছু বেশিই পেতাম। আর বাকিরা তো সবাই সায়েব, তাদের জন্য ঠিকেদার নেই, তাদের ব্যবস্থা এবং নিয়ম কানুন সম্পূর্ণ আলাদা।
    চাকরির পদটি অফিস সেক্রেটারি হলেও আমাকে পিওনের কাজও করতে হতো পাশাপাশি, আবার দরকার পড়লে অনুবাদকের কাজও। উল্লেখ করা দরকার, এরা সবাই রাশিয়ান, এদের ইংরিজি ভাষার ওপরে দখল খুব কম এবং বাংলার জ্ঞান একেবারে শূন্য। অবশ্য একজনকে বাদ দিয়ে, সে সায়েব হয়েও বাংলা জানত খুব ভাল। সেই বাংলা জানা সায়েবটির নাম সাশা। সাশা তার ডাকনাম। ভালো নাম আলেকসান্দার। রাশিয়ানদের প্রত্যেকেরই একটা করে ডাকনাম থাকে, ভালো নাম থেকে উদ্ভব হয় এই ডাকনামের, যেমন লিওনিদ থেকে লিওনা, তাতিয়ানা থেকে তানিয়া, মিখাইল থেকে মিশা, ইত্যাদি। সাশা ছিল কাগজে কলমে সেই কোম্পানির দোভাষীর পদে, যদিও তার কাজকর্মের প্রকৃতি খানিকটা অন্যরকম। ঠিকেদার লোকটির সঙ্গে কথাবার্তা বলা, মালিকপক্ষের কী কী দরকার, কোন কোন কাজ তাদের পছন্দ হচ্ছে না বা তাতে উন্নতি করা জরুরি, কাদের কখন কী উপলক্ষে বকশিস দিতে হবে, অফিসের প্রয়োজনে কোন কোন জিনিস কিনতে হবে, এসব ব্যাপার নিয়ে সে সর্বদা ব্যস্ত থাকত।
    সোমবার, মাসের ছ তারিখে যেদিন আমি কাজে জয়েন করি, হলদে বাড়ির তিনতলায় একটিমাত্র জানলাওয়ালা একটা ঘরে আমার বসবার ব্যবস্থা হয়েছিল। জানলা অবশ্য বন্ধ করা ছিল, এয়ারকন্ডিশনার চলছিল সর্বনিম্ন তাপমাত্রায়। মে মাসের ঐ গরমেও একটু পরে শীতে কাঁপতে শুরু করলাম। সে ঘরে আর একজন প্রৌঢ় সায়েবেরও বসবার জায়গা। সায়েবটি অবশ্য আমার সঙ্গে বিশেষ কথাবার্তা বলেনি, ঘরেও সে খুব কমই থাকত, অফিসে এসেই কোথায় যে বেরিয়ে যেত কে জানে। আমার টেবিলের ওপরে রাখা ছিল একটা রাশিয়ান টাইপরাইটার। জীবনে সেইপ্রথম আমি টাইপরাইটারে হাত রাখলাম। আমার সরাসরি মনিব, মানে যার কাছে ইন্টারভিউ দিয়ে চাকরিটা পেয়েছিলাম, সে কোম্পানির এই অফিসের মেজকর্তা। সকাল সকাল আমাকে একটা চিঠি টাইপ করতে দিল সে।এমনিতে সিনেমা টিনেমায় যা দেখেছি, একজন কর্তা গোছের লোক ডিকটেশন দেয়, সেক্রেটারি সেটা নোট করে নেয়, তারপরে টাইপ করে আনে। এক্ষেত্রে ডিকটেশনের বালাই নেই। বস মোটামুটি বুঝিয়ে দিল কী লিখতে হবে চিঠিতে― একজন কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র। কর্মচারীটি রাশিয়ান এবং সে ড্রাইভারদের দলটার ইনচার্জ।লোকটি কয়েকদিন আগে মদ টদ খেয়ে বিস্তর ঝামেলা মাতলামি করেছে, তাকে অবিলম্বে তাড়াতে হবে। ‘খুব বুঝেছি’, এইরকম ভাব করে আমি চিঠি টাইপ করতে রাজি হয়ে গেলাম। গোটা পাঁচেক বাক্য লিখলেই চলবে।অপরিচিত যন্ত্রে সেই বাক্যগুলো লিখতে হবে, টাইপরাইটারে কাগজ কেমন করে ঢোকাতে হয়, অক্ষর গুলো কোথায় কোথায় রয়েছে সবই প্রথমবার করছি, সমস্ত খুঁজে খুঁজে চিঠিটা শেষ করতে করতে প্রায় ঘন্টাখানেক সময় লাগিয়ে দিলাম। সায়েব নিজেই এসে চিঠিটা দেখে দু একটা বানান ভুল পেল, সেগুলো শুধরে দেবার পরে আবার গোটা চিঠি টাইপ করতে করতে প্রায় বারোটা বাজতে চলল। টিফিনের ছুটির সময় তখন। আড়াই থেকে তিনঘন্টার লাঞ্চ ব্রেক।তিনটের পর থেকে অফিস চলবে সন্ধে সাড়ে ছটা সাতটা অবধি। সায়েবরা সব অফিস ঘর বন্ধ করে দিয়ে বাড়িতে চলে যায় দুপুরের খাবার খেতে সেই আলিপুর রোডে। আমাকেও ঘর থেকে বের করে প্রৌঢ় সায়েব বাইরে থেকে চাবি ঘুরিয়ে দিল। সেই লাঞ্চব্রেকে নীচে নেমে এসে দেখলাম মূল বিল্ডিং এর বাইরে গ্যারেজগুলোর গা ঘেঁষে একটা শেড দেওয়া জায়গায় গনগনে কয়লার উনুনে রান্না হচ্ছে। মোটা চালের ভাত নেমে গেছে, হাঁড়ি উপুড় করে ফ্যান গালা হচ্ছে, একটা কড়াইয়ে তরকারি নাড়া হচ্ছে লম্বা খুন্তি দিয়ে, তার গন্ধেই বোঝা যাচ্ছে যে এরা খুব ঝাল খায়। ড্রাইভারেরা যারা তখন ডিউটিতে নেই, একটা কাঠের বেঞ্চিতে বসে গল্প করছিল, যে লোকটা রান্না করছিল সে মালি।
    ওখানে গিয়ে দাঁড়ালে ওরা হয়ত ভাববে খাবার গন্ধ পেয়ে লোভে লোভে এসেছি, আমি সরে গিয়ে ফের হলদে বাড়িটার মধ্যে ঢুকে পড়লাম। রিসেপশানিস্ট কল্যাণবাবুর টেবিলে খোলা টিফিন কৌটোয় রুটি তরকারি দেখা যাচ্ছে। কোথায় যাই এখন আমি? এখানে দাঁড়ানো ঠিক নয়। হনহন করে ওখান থেকে বেরিয়ে গিয়ে বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড ধরে অনেকটা হেঁটে গেলাম। প্রচণ্ড গরম লাগছে। মিনিট কুড়ি ঘুরে আবার ফিরে আসি। কল্যাণবাবুজিজ্ঞেস করেন, কী! লাঞ্চ করে এলেন? আমি সম্মতিসূচক প্রথম অধ্যায়
    শিক্ষাবিধি দিয়ে এরা ছাঁচ বানিয়েছে—কিন্তু ছাঁচে-ঢালা মনুষ্যত্ব কখনো টেঁকে না—সজীব মনের তত্ত্বের সঙ্গে বিদ্যারতত্ত্ব যদি না মেলে তা হলে হয় একদিন ছাঁচ হবে ফেটে চুরমার, নয় মানুষের মন যাবে মরে আড়ষ্ট হয়ে, কিম্বা কলেরপুতুল হয়ে দাঁড়াবে।
    ― রাশিয়ার চিঠি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
    গত শতাব্দীর শেষ কটা বছর তখনও বেঁচে। কলকাতার পথে পথে হন্যে হয়ে চলছিল আমার চাকরি খোঁজা। এরআগে গোটা দুয়েক জায়গায় কাজ করলেও টিকে থাকতে পারিনি। বস্তির ঘরভাড়া আগাম এক মাসের দেওয়া ছিলবলে নিশ্চিন্ত। কিন্তু হাতে ছিল মাত্র ছ সাতশো টাকা। প্রত্যেকটা পয়সা যদি গুণে গেঁথেও খরচ করি, শুধু বাসভাড়াদিতে দিতেই যে আমার ঐ টাকাটা একমাসে খরচ হয়ে যাবে তা বুঝতে পারতাম, কিন্তু মাসের শেষ অবধি কী করেটানবো সে নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করত না। একটা বাগানঘেরা হলদে রঙের বাড়িতে চাকরি জোগাড় করেছিলাম―অফিস সেক্রেটারির কাজ। কেবলই ভাবতাম কতটা কম খেয়ে একটা গোটা মাস চালিয়ে দেওয়া যেতে পারে, কতগুলো দিন টানা না খেয়ে কাজ করা যায় ― এমনই সব হিসেব আমার মাথার মধ্যে ঘুরত। একবার ভেবেছিলামচাকরিতে ঢোকার হপ্তাদুয়েক পরেই সায়েবের কাছ থেকে শপাঁচেক কি আটশো মত ধার চেয়ে নেব আগাম হিসেবে, মাইনে দেবার সময় কেটে নিলেই হবে। তার পরে জড়ো সড়ো হয়ে সেসব চাইতে খুব লজ্জা পেলাম, ভাবলাম সায়েবযদি হাঘরে ভেবে বসে আমায়, সে কি আমায় পরবর্তীকালে সম্মান করবে? কে না জানে, মানুষকে সম্মান করবারজন্য কিছু পয়সাকড়ি থাকা একটা আবশ্যিক প্রাথমিক শর্ত।
    সায়েব সায়েব করে উল্লেখ করছি যাকে, সে সত্যিই টকটকে ফর্সা বিদেশি সায়েব, কারণ কোম্পানিটাই রাশিয়ান।আমি যদিও কোম্পানির সরাসরি চাকুরে ছিলাম না, ঠিকেদারের ওপর আমার মাইনে-ছুটি-বহাল-ছাঁটাই, এসবেরদায়িত্ব ন্যস্ত ছিল। শুধু আমার কেন? চাকর, ড্রাইভার, জমাদার, রিসেপশনিস্ট এবং মালি। সংখ্যাটা কম নয়।ঠিকেদার নিজে একটা মাসিক মাইনে নিত এবং কোম্পানির থেকে যে থোক টাকাটা আমাদের মাইনে বাবদ বরাদ্দছিল, সেটা থেকে তার নিজস্ব কমিশন কেটে রেখে, বুদ্ধি বিবেচনার ওপর নির্ভর করে প্রত্যেকের মাইনে ধার্য হয়েছিল।আমি ড্রাইভারদের থেকে কিছু বেশিই পেতাম। আর বাকিরা তো সবাই সায়েব, তাদের জন্য ঠিকেদার নেই, তাদেরব্যবস্থা এবং নিয়ম কানুন সম্পূর্ণ আলাদা।
    চাকরির পদটি অফিস সেক্রেটারি হলেও আমাকে পিওনের কাজও করতে হতো পাশাপাশি, আবার দরকার পড়লেঅনুবাদকের কাজও। উল্লেখ করা দরকার, এরা সবাই রাশিয়ান, এদের ইংরিজি ভাষার ওপরে দখল খুব কম এবংবাংলার জ্ঞান একেবারে শূন্য। অবশ্য একজনকে বাদ দিয়ে, সে সায়েব হয়েও বাংলা জানত খুব ভাল। সেই বাংলাজানা সায়েবটির নাম সাশা। সাশা তার ডাকনাম। ভালো নাম আলেকসান্দার। রাশিয়ানদের প্রত্যেকেরই একটাকরে ডাকনাম থাকে, ভালো নাম থেকে উদ্ভব হয় এই ডাকনামের, যেমন লিওনিদ থেকে লিওনা, তাতিয়ানা থেকেতানিয়া, মিখাইল থেকে মিশা, ইত্যাদি। সাশা ছিল কাগজে কলমে সেই কোম্পানির দোভাষীর পদে, যদিও তারকাজকর্মের প্রকৃতি খানিকটা অন্যরকম। ঠিকেদার লোকটির সঙ্গে কথাবার্তা বলা, মালিকপক্ষের কী কী দরকার, কোন কোন কাজ তাদের পছন্দ হচ্ছে না বা তাতে উন্নতি করা জরুরি, কাদের কখন কী উপলক্ষে বকশিস দিতে হবে, অফিসের প্রয়োজনে কোন কোন জিনিস কিনতে হবে, এসব ব্যাপার নিয়ে সে সর্বদা ব্যস্ত থাকত।
    সোমবার, মাসের ছ তারিখে যেদিন আমি কাজে জয়েন করি, হলদে বাড়ির তিনতলায় একটিমাত্র জানলাওয়ালাএকটা ঘরে আমার বসবার ব্যবস্থা হয়েছিল। জানলা অবশ্য বন্ধ করা ছিল, এয়ারকন্ডিশনার চলছিল সর্বনিম্নতাপমাত্রায়। মে মাসের ঐ গরমেও একটু পরে শীতে কাঁপতে শুরু করলাম। সে ঘরে আর একজন প্রৌঢ় সায়েবেরওবসবার জায়গা। সায়েবটি অবশ্য আমার সঙ্গে বিশেষ কথাবার্তা বলেনি, ঘরেও সে খুব কমই থাকত, অফিসে এসেইকোথায় যে বেরিয়ে যেত কে জানে। আমার টেবিলের ওপরে রাখা ছিল একটা রাশিয়ান টাইপরাইটার। জীবনে সেইপ্রথম আমি টাইপরাইটারে হাত রাখলাম। আমার সরাসরি মনিব, মানে যার কাছে ইন্টারভিউ দিয়ে চাকরিটাপেয়েছিলাম, সে কোম্পানির এই অফিসের মেজকর্তা। সকাল সকাল আমাকে একটা চিঠি টাইপ করতে দিল সে।এমনিতে সিনেমা টিনেমায় যা দেখেছি, একজন কর্তা গোছের লোক ডিকটেশন দেয়, সেক্রেটারি সেটা নোট করেনেয়, তারপরে টাইপ করে আনে। এক্ষেত্রে ডিকটেশনের বালাই নেই। বস মোটামুটি বুঝিয়ে দিল কী লিখতে হবেচিঠিতে― একজন কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র। কর্মচারীটি রাশিয়ান এবং সে ড্রাইভারদের দলটার ইনচার্জ।লোকটি কয়েকদিন আগে মদ টদ খেয়ে বিস্তর ঝামেলা মাতলামি করেছে, তাকে অবিলম্বে তাড়াতে হবে। ‘খুববুঝেছি’, এইরকম ভাব করে আমি চিঠি টাইপ করতে রাজি হয়ে গেলাম। গোটা পাঁচেক বাক্য লিখলেই চলবে।অপরিচিত যন্ত্রে সেই বাক্যগুলো লিখতে হবে, টাইপরাইটারে কাগজ কেমন করে ঢোকাতে হয়, অক্ষরগুলো কোথায়কোথায় রয়েছে সবই প্রথমবার করছি, সমস্ত খুঁজে খুঁজে চিঠিটা শেষ করতে করতে প্রায় ঘন্টাখানেক সময় লাগিয়েদিলাম। সায়েব নিজেই এসে চিঠিটা দেখে দু একটা বানান ভুল পেল, সেগুলো শুধরে দেবার পরে আবার গোটা চিঠিটাইপ করতে করতে প্রায় বারোটা বাজতে চলল। টিফিনের ছুটির সময় তখন। আড়াই থেকে তিনঘন্টার লাঞ্চ ব্রেক।তিনটের পর থেকে অফিস চলবে সন্ধে সাড়ে ছটা সাতটা অবধি। সায়েবরা সব অফিস ঘর বন্ধ করে দিয়ে বাড়িতেচলে যায় দুপুরের খাবার খেতে সেই আলিপুর রোডে। আমাকেও ঘর থেকে বের করে প্রৌঢ় সায়েব বাইরে থেকে চাবিঘুরিয়ে দিল। সেই লাঞ্চব্রেকে নীচে নেমে এসে দেখলাম মূল বিল্ডিং এর বাইরে গ্যারেজগুলোর গা ঘেঁষে একটা শেডদেওয়া জায়গায় গনগনে কয়লার উনুনে রান্না হচ্ছে। মোটা চালের ভাত নেমে গেছে, হাঁড়ি উপুড় করে ফ্যান গালাহচ্ছে, একটা কড়াইয়ে তরকারি নাড়া হচ্ছে লম্বা খুন্তি দিয়ে, তার গন্ধেই বোঝা যাচ্ছে যে এরা খুব ঝাল খায়।ড্রাইভারেরা যারা তখন ডিউটিতে নেই, একটা কাঠের বেঞ্চিতে বসে গল্প করছিল, যে লোকটা রান্না করছিল সেমালি।
    ওখানে গিয়ে দাঁড়ালে ওরা হয়ত ভাববে খাবার গন্ধ পেয়ে লোভে লোভে এসেছি, আমি সরে গিয়ে ফের হলদেবাড়িটার মধ্যে ঢুকে পড়লাম। রিসেপশানিস্ট কল্যাণবাবুর টেবিলে খোলা টিফিন কৌটোয় রুটি তরকারি দেখাযাচ্ছে। কোথায় যাই এখন আমি? এখানে দাঁড়ানো ঠিক নয়। হনহন করে ওখান থেকে বেরিয়ে গিয়ে বালিগঞ্জসার্কুলার রোড ধরে অনেকটা হেঁটে গেলাম। প্রচণ্ড গরম লাগছে। মিনিট কুড়ি ঘুরে আবার ফিরে আসি। কল্যাণবাবু জিজ্ঞেস করেন, কী! লাঞ্চ করে এলেন? আমি সম্মতিসূচক সামাজিক হাসি দিই। উনি আবার জিজ্ঞেস করেন, কোথায় খেলেন? ঐ মোড়ের ধাবাটায় গেছলেন নাকি? আমি কথা ঘুরিয়ে বলি, আপনার বাড়ি কোথায় বলুন তো কল্যাণদা? উনি বলেন উত্তরপাড়া। এমনি করতে করতে এক দুদিনেই আমরা বন্ধু হয়ে যাই।
     
    (চলবে)
  • জয় | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৩:৫৬735600
  • @সেদি
    অসাধারন অকপট। দুর্নিবার জীবনের প্রতি ভালোবাসব। ভালো লাগছে।
     
    একটা পোর্সন কি দুবার চলে এসেছে। এডিট করা যাবে নিশ্চই। 
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:d5ee:e24d:c118:83 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৪:১২735602
  • এডিটিং করা যায় না। আমাকে তো ব্লগ খুলতে দেয় না। টইতে এডিটিং অপশন নাই। এখন অফিস করছি। বাকি পার্ট পরে লিখব।
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:f9ef:33cd:7196:b2c | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৪:৫৮735603
  • দুই

    প্রথম দিনেই আমাকে পুরোটা সময় কাজ করতে হয় নি। সাড়ে ছটার বদলে, সাড়ে পাঁচটায় আমার ছুটি করিয়ে নিয়ে সাশা বলল, চল তোমাকে একটা জায়গায় নিয়ে যাই। রাস্তায় নেমেই সে ট্যাক্সি নিল। 
    লোয়ার সার্কুলার রোডের ওপরে পশ্চিমদিকে পূরবীদির বাড়িতে যখন ঢুকছি তখন সন্ধের অন্ধকার একটু একটু করে নেমে আসছে। এদিকে বেশ কয়েকটা এমন পুরোনো দিনের বাগানওয়ালা বনেদি অভিজাতদের বাড়ি আছে, আগে নজর করিনি। পূরবীদি যাদবপুর ইউনিভার্সিটির অধ্যাপিকা ছিলেন, আগে এঁদের কারোকেই চিনতাম না, সাশার দৌলতেই এতসব জানতে পারছি। এঁর বাড়িতে প্রতি মাসে একটা করে সোমবারে বিশেষ আসর বসে, যেখানে রাশিয়া নিয়ে স্মৃতিচারণা হয় এবং সেই আসরে প্রবেশাধিকারের অ্যাডমিট কার্ড একটাই― রাশিয়ার সঙ্গে কোনও না কোনও রকমের যোগসূত্র থাকতে হবে। যেমন, কেউ হয়ত কখনও ওদেশে বেড়াতে, পড়াশুনো করতে কি চাকরি করতে গেছল, বা কেউ ওদেশ থেকে সদ্য এসেছে কলকাতায়― এক্ষেত্রে সাশা এবং আমি দুজনেই কোনও না কোনও গোত্রে পড়ছি। সাশা তো রাশিয়ান, তবে আমি তো ঠিক রাশিয়ার সঙ্গে কখনই সরাসরি যুক্ত ছিলাম না, ১৯৮৫ থেকে ১৯৯৫ এই দশটা বছর কেটে গেছে মধ্য এশিয়ার উজবেকিস্তানে। ১৯৯১ এর অগস্ট মাস পর্যন্ত উজবেকিস্তান ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের পনরোটা রিপাবলিকের একটা, কিন্তু এদের সংজ্ঞায় সেটাই ঘুরে ফিরে হয়ে যায় রাশিয়া। রাশিয়ান ভাষাটা মোটামুটি জানি সেটাই রক্ষাকবচ। ঐ ভাষায় আলোচনা চললে বুঝতে টুঝতে কোনও সমস্যা হবে না। সবচেয়ে আশার কথা এখানে কিছু খেতে টেতে দেবে নিশ্চয়। যদি কিছু খেয়ে নিতে পারি তবে আজ রাতে উপোস করে ঘুমোতে হচ্ছে না, তারপরে কাল অফিসে গিয়ে চা তো ফ্রিতেই পাবো। একটা চিন্তা কমল।
    ভেতরে ঢুকে দেখি সিনেমার সেটের মত পরিপাটি বাড়ি। ড্রয়িংরুমের ভেতর দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে ওপরে। খুব যত্ন করে সাজানো― আভিজাত্য, শিক্ষা, রুচির ছাপ স্পষ্ট সবখানে। অনেকেই এসে গিয়েছে, অধিকাংশই মেয়ে, ছেলে বলতে একজনই― সাশা।
    সে ঐ মজলিশে ঢুকে আমায় আর বিশেষ পাত্তা দিল না। আমাদের চেয়ে কম বয়সি মেয়েরা তাকে ঘিরে ধরল, তাদের অনেকের চোখেই ভালোবাসার আকুতি। জানা গেল এর আগেও সাশা এমন মজলিশে এসেছে, তার মনের ইচ্ছা পূরবীদিকে জানিয়েওছে― সে একটি বাঙালি মেয়েকে বিয়ে করতে চায়। নিজে ভাল বাংলা জানে, ইন্ডোলজি নিয়ে মস্কো থেকে প্রাথমিকভাবে এম এ পাশ করে শান্তিনিকেতনেও কয়েক বছর থেকেছে বিশ্বভারতীর ছাত্র হিসেবে। বাংলা ভাষাকে সে ভালোবেসেছে, এখন একটা বাঙালি বৌ পেলেই ষোলোকলা পূর্ণ হবে। কিন্তু এসব ব্যাপার তো কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে করা সম্ভব হচ্ছে না, ঘরোয়া পরিবেশে স্বয়ম্বর সভা গোছের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে, সেখানেই সে বৌ খুঁজছে। স্বয়ম্বর শব্দটা ঠিক হলো না, স্বয়ংকনে হলে বরঞ্চ জুতসই হতো, কিন্তু তেমন শব্দ কি আদৌ আছে অভিধানে? অবশ্য সেই সন্ধ্যায় মূল টপিক থেকে কেউ বিচ্যুত হয় নি, তা হলো রাশিয়া সংক্রান্ত স্মৃতিচারণা। মেয়েরা নানারকমের খাবার এনেছিল, একটা টেবিলের ওপর থরে থরে সাজিয়ে রাখা ছিল সেসব। প্রথমটায় কেউ ওদিকে ঘেঁষছিল না, ডাইনিং টেবিলের দিকে তাকাচ্ছিল না পর্যন্ত, নিপুণভাবে খাবারের উপস্থিতিকে অগ্রাহ্য করে সবাই মনযোগী হয়ে রাশিয়ার গল্প শুনছিল। আমি আড়চোখে লক্ষ রাখছিলাম টেবিলের দিকে, সেখানে কচুরি, আলুর দম, মাছের চপ, পুডিং, কিছু একটা ঘরে বানানো মিষ্টি।
    আলোচনা পর্ব চুকে যাবার পরে খেতে খেতে সাশাকে একবার জিজ্ঞেস করলাম, এতগুলো মেয়ের মধ্যে কোন মেয়ে তোমার পছন্দ হল সঙ্কোচ না করে আমায় বলেই ফেলো। সে বলে, একজনও নয়, একজনও প্রকৃত সুন্দরী না। বলো কী হে! ঐ দেখো ঐ কোণে যে দুজন দাঁড়িয়ে আছে তারা তো ডাকসাইটে সুন্দরী। কিংবা আর একজন, ঐ যে চপ খাচ্ছে, ...
    সে অপছন্দের ভঙ্গীতে মাথা দুলিয়ে বলে, একজন মেয়েকে আমার পছন্দ হয়েছে, এখানে বলা যাবে না, তোমাকে পরে বলব, অফিসে।
    খাবারের চিন্তায় আমার মাথায় অন্য কোনও বিষয় বেশিক্ষণ জায়গা করতে পারে না। পরের দিনও আবার খিদে পায়, চা খাবার পরে সেই প্রৌঢ় আবারও বেরিয়ে যায় ঘর থেকে, এবং ঠিক যেন এক দৈবযোগে দেয়াল আলমারির একটা তাক থেকে আমি খুঁজে পাই বিস্কুটের খোলা প্যাকেট। পুরোনো হয়ে গেছে, কেউ হয়ত খায় নি সবকটা, পড়ে আছে ভেতরে গোটা কতক, অল্প মিইয়েছে কিন্তু সেসবে গুরুত্ব দেবার দরকার নেই। যদি চার পাঁচটাও থেকে থাকে তা আমার আজকের দিনের জন্য যথেষ্ট। মাত্র তো চার সপ্তাহ, নাকি আরও কম সময় বাকি আছে মাস ফুরোতে।
    সেই দিনটা আমি চার পাঁচটা বিস্কুট দিয়েই চালিয়ে নিলাম। লাঞ্চের ঐ আড়াই তিন ঘন্টা সময় ঘুমোলেও কাজে দিত, কিন্তু ওরা তো আমাকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে দরজায় চাবি ঘুরিয়ে চলে যায়, বাইরে অসহ্য গরম, টানা দশ বছরের অনভ্যাস, তাশখন্দের গ্রীষ্ম অন্যরকম ছিল― যদিও নীচে গেলেই কল্যাণবাবুর সঙ্গে গল্পসল্প করা যায়। কল্যাণবাবুর চাকরিটা বেশি দিন থাকবে না ওঁকে বলে দেওয়া হয়েছে। ওঁর জায়গায় আসবে স্মার্ট চটপটে অ্যাকসেন্ট দিয়ে ইংরিজি বলতে পারা সুন্দরী অ্যাট্রাকটিভ অল্পবয়সী কোনও মেয়ে। 
    ― তাহলে আপনি কী করবেন কল্যাণদা? আপনার সংসার চলবে কেমন করে?
    ― দেখি।
    এই হচ্ছে কল্যাণবাবুর সংক্ষিপ্ত উত্তর।
    এরপরে আমাকে এরা গাব্দা গাব্দা সাইজের হিসেবের খাতার অঙ্ক মেলানোর কাজ দিয়ে দিল। যোগ বিয়োগে কোনও গরমিল আছে কি নেই, সেসব খতিয়ে দেখতে হবে। একটা বড়ো সাইজের ক্যালকুলেটরও দিয়েছে, সারাক্ষণ শয়ে শয়ে হাজারে হাজারে সংখ্যা নিয়ে যোগ মেলাতে মেলাতে মাথা ঘুরে যায়, সঠিক অঙ্কে ভুল বেরোয়, ফের সেটা মেলাতে বসি। মাঝে মধ্যে একটা দুটো চিঠি দেয় টাইপ করতে, নয়ত বলে, নীচে গিয়ে দেখে এসো অমুক ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে ফিরেছে কি না, সুইপারকে বলো সিঁড়ির ধাপগুলো আরেকবার মুছে দিয়ে যেতে, টয়লেটে হাত ধোবার সাবান ফুরিয়েছে লিকুইড সোপ যেন ভরে দিয়ে যায়, ইত্যাদি ইত্যাদি।
    আমি নীচে গিয়ে সুইপারকে খুঁজতে থাকি, তার নাম ধরে ডাকলে সে খুব লজ্জা পায়, বিশ বাইশ বছরের ছোকরা, বাংলা একেবারেই পারে না, উড়িষ্যা থেকে এসেছে বছর খানেকের একটু বেশি। সুইপার খালি পায়ে দৌড়ে এলেই কল্যাণবাবু দেখতে পেয়ে সতর্ক করে দেন, অ্যাই অ্যাই শিগগিরি পায়ে জুতো পর, সায়েব দেখতে পেলে বের করে দেবে কিন্তু!
    সেই সুইপার মানে সুরথ একদিন লাঞ্চব্রেকে গা মুচড়ে আমার পাশে এসে দাঁড়াল। যা হবার হবে, পরে দেখা যাবে ভেবে নিয়ে তখন দিনে একবার মুড়ি কিনে খেতাম এবং সেটা লাঞ্চব্রেকে। সুরথ কাছে এসে কয়েকটা কথা বলল, ওর হাতে কয়েকটা কাগজ। কাগজে হিসেবপত্র লেখা রয়েছে, একটা চিঠি, সবই ইংরিজিতে। ওর কথা না বুঝলেও বুঝলাম কাগজে কী লেখা আছে ― ও একটা ব্যবসা খুলতে চায়, পেস্ট কন্ট্রোলের। বাড়ি বাড়ি গিয়ে কীটনাশক স্প্রে করবার ব্যবসা। আমার কাছে কিছু টাকা ধার চাইছিল সেটাও বুঝলাম। হাজার চারপাঁচ। গম্ভীর হয়ে বললাম সেসব পরে দেখা যাবে, কিন্তু এমনি এমনি টাকা ধার দেব কেন আমি?
    ― তোমার কাছে কত টাকা আছে, দাও না ধার।
    ― কে বলেছে যে আমার অনেক টাকা?
    সে উল্টে বলে, তুমি পার্টনার হয়ে যাও। দূর থেকে এসব দেখতে পেয়ে ড্রাইভারদের মধ্যে থেকে চন্দ্রশেখরদা এগিয়ে এসে আমায় সাবধান করতে চায়, ভুলেও ওর কথা বিশ্বাস করবেন না, মহা খচ্চর ছেলে। অ্যাই বিল্ডিং এর পেছনের দিকে একগাদা শুকনো পাতা, জঞ্জাল সব জড়ো করে রেখেছিস কেন? কে সাফ করবে ওগুলো?
    সুরথ ল্যাগব্যাগ করতে করতে জঞ্জাল সরাতে চলে যায়।
    চন্দ্রশেখরদা বলে, কী বলছিল ও? টাকা পয়সা চাইছে নাকি আপনার কাছে? ভুলেও দেবেন না, খুব চালু ছেলে ও। এক বছর হল কলকাতায় এসেছে আর এর মধ্যেই বিজনেস খুলে ফেলেছে। আমাকে দেখুন দশ এগারো বছর বয়সে পায়ে হেঁটে এসেছি ইন্ডিয়ায়, এই শহরেই আজ বিশ বছরের ওপর হয়ে গেল, এখন ড্রাইভারি করে পেট চালাচ্ছি।
    ― আপনি কোথা থেকে এসেছেন চন্দ্রশেখরদা?
    ― বার্মা চেনেন? সেই বার্মা মানে মিয়ানমার থেকে। ইয়াংগুনে জন্ম আমার। আমার জন্ম, আমার বাপ দাদা সবার। আমরা ওরিজিনালি তামিল, কিন্তু কয়েক পুরুষ ধরে ইয়াংগুনেই সেটলড। থাকতে পারলাম না, ওখানে প্রচুর ঝামেলা। পালিয়ে এসেছি।
    কথায় বার্তায় বুঝতে পারলাম চন্দ্রশেখরদা বর্মামুলুক থেকে উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে এসেছে ১৯৭৫/৭৬ সাল নাগাদ। কিন্তু চন্দ্রশেখরদার গল্প শুনবার আগ্রহ আমার তখন নেই, সুরথ যে আমায় পার্টনার করবে বলে অফারটা দিল সেটাই মাথার পেছনে খেলছে। কথা বলতে হবে ওর সঙ্গে। মাস ফুরোলে তো মাইনে পাব, সে টাকার সবটাই তো খাবার খরচে শেষ হয়ে যাবে না, কিছু তো বাঁচবে, সেটুকু ব্যবসায় লাগালে কেমন হয়?
    খিদে ফিদে সব ভুলে যাই তৎক্ষণাৎ। ভাবতে বসি কী নাম দেওয়া যাবে এই নতুন কোম্পানির। হুশ করে কেটে যায় লাঞ্চব্রেক। সায়েবরা সব গাড়ি করে করে ফিরে আসছে। আমায় সিঁড়িতে বসে থাকতে দেখে তারা একটু আশ্চর্য হয়। অন্য দিন সিঁড়িতে বসতাম না, কল্যাণদার ঘরে বেতের সোফায় বসে অপেক্ষা করতাম কখন শেষ হবে লাঞ্চব্রেক।
    সায়েবদের পেছন পেছন ওপরে যাবার পথে রিসেপশনে উঁকি মেরে বলি, কল্যাণদা, সুরথ মানে সুইপারকে দেখতে পেলে ওপরে আমার কাছে একটু পাঠিয়ে দেবেন?

     
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:f9ef:33cd:7196:b2c | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৪:৫৯735604
  • তিন
    সেদিন সন্ধেবেলাতেই আমি অফিস ঘরের ডুপ্লিকেট চাবি হাতে পেয়ে গেলাম। সারাটা লাঞ্চব্রেক এভাবে বাইরে বাইরে কাটাতে হয় বুঝতে পেরে আমার বস এই ব্যবস্থা করে দিল। পরের দিন থেকে লাঞ্চের সময় এয়ার কন্ডিশনারওয়ালা ঘরে টানা ঘুমিয়ে নিতে পারব, যত খুশি চা বানিয়ে খেতে পারব, চাই কি নতুন বিস্কুটের প্যাকেট থেকে দু তিনটে খেয়েও নিতে পারি। ওরা কি আর গুণে গেঁথে বিস্কুটের হিসেব মেলাতে যাবে নাকি!
    পরেরদিন আমায় নীচে নামতে না দেখে কল্যাণদা নিজেই চলে এল ওপরে। সঙ্গে সলজ্জ রিকোয়েস্ট― আমার ছেলেটার এবার ক্লাস ফাইভ হল, ইস্কুলের খাতাবইয়ের মলাটের ওপরে লেবেল সাঁটতে হয় তো, ওটা টাইপ করে দেবেন? গোটা বারো কি চাইলে কুড়িটা মত।
    ― আমার তো রাশিয়ান টাইপরাইটার কল্যাণদা!
    ― আরে না না, দেখুন ছোটো ছোটো করে ইংরিজিও আছে, আপনার আগে যিনি এখানে কাজ করতেন তিনি প্রতিবার টাইপ করে দিতেন আমাকে। 
    ছেলের নাম ক্লাস সেকশন সব জেনে নিয়ে আমি টাইপ করতে থাকি লাঞ্চব্রেকে। টাইপ করতে করতে আমার চোখ কটকট করে, প্রত্যেকটা অক্ষর টাইপ করি আর শুধু মনে হয়, আমার মেয়েরও তো এখন মন্তেস্যরিতে নতুন সেশন শুরু হয়ছে, তার নতুন নতুন খাতা-বইয়ে মলাট দিয়ে এমনি করেই তো লেবেল টাইপ করে দিতে পারতাম আমি। অথচ এমনই দুর্ভাগা মা আমি, যে নিজের মেয়েকে দেখবার পথটুকুও বন্ধ। কল্যাণদার ছেলের জন্য টাইপ করি আর মনটা হু হু করে ওঠে। মনে হয় কী লাভ এভাবে বেঁচে থেকে? মরে যাই। আর বাঁচব না। আর না। কল্যাণদাকে লেবেলগুলো দিয়ে দিয়েই সোজা বেরিয়ে যাব রাস্তায়। বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের ওপর দিয়ে হরদম বাস যায়, চলন্ত বাসের তলায় লাফিয়ে পড়তে যতটুকু মনোবল লাগে ঠিক ততটুকুই পেয়ে গেছি এতক্ষণে। টাইপ করা কাগজগুলো হাতে নিয়ে ঘর থেকে বেরোতে যাচ্ছি, ঘরের কোণে টেলিফোনটা বেজে ওঠে ঝনঝন করে। প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় ফোনটা ধরতেই হয়, ওপারে কল্যাণদা, ― কী? হয়ে গেছে নাকি? আসব ওপরে?
    আমি নীচে গিয়ে কাগজগুলো দেবার পরে হনহন করে বেরিয়ে যাচ্ছি, পেছু ডাকে কল্যাণদা― জানেন তো আমাকে বলে দিয়েছে সায়েব, জুনের শেষ অবধি মেয়াদ এই চাকরির, ... একী! আপনার মুখটা এত শুকনো দেখাচ্ছে কেন? টিফিন খাওয়া হয় নি বুঝি এখনও? ইশ্‌, আমার জন্য টাইপ করতে গিয়ে আপনার খাওয়াই হলো না এতক্ষণ।
    ― আমি আসলে সুইসাইড করতে যাচ্ছিলাম কল্যাণদা!
    ― অ্যাঁ! সেকি, কেন? আরে আপনার কোনও দোষ নেইকো। বসুন, বসুন তো এখানে। দেখুন, চাকরি আমার এমনিতেই যেত। আমার পোস্টে তো ওরা আপনাকে নেয় নি। আমার জায়গায় নতুন মেয়ে আসছে, কালকেই ইন্টারভিউ দিয়ে গেল, আপনি দেখেন নি? আমার চাকরি চলে যাওয়া নিয়ে আপনি নিজেকে একদম দোষী ভাববেন না। ছি ছি, সুইসাইড করতে যাচ্ছিলেন কেন... ইশ্‌, এহে...
    কল্যাণদার কথাগুলো সব আমি শুনতেও পাই না। সব কিছু বোঝানোও সম্ভব নয়। জল এনে দিল কেউ একজন। সেই সুরথ। সুরথকে আমি কোনও একটা প্রয়োজনে খুঁজছিলাম মনে আছে, কিন্তু কেন খুঁজছিলাম সেটা আপাতত আবছা। একটা ফোন এল কল্যাণদার বোর্ডে, ইপিয়েবিএক্স বোর্ড। কল্যাণদা বাংলায় বলছে, না সায়েবরা এখন কেউ নেই, এখন লাঞ্চটাইম, তিনটে সাড়ে তিনটে নাগাদ ফোন করুন, না, কেউ নেই, সকলে বেরিয়ে গেছে লাঞ্চ খেতে...
    আমি ওপরে চলে যাই আমার অফিস ঘরে। টেলিফোনটার দিকে তাকিয়ে মনে হয় একটা ফোন করতে পারলে বেশ হতো। একটা মাত্র টেলিফোন নম্বরই আমি জানি, সেই নম্বরটাই ঘোরাই। এখন মে মাসের মাঝামাঝি, সব ইস্কুল কলেজে গরমের ছুটি চলছে। ফোনটা ওপাশে বাজছে, কয়েকবার বাজার পরে একটা শিশুকণ্ঠ বলে, হ্যালো―
    আমি চুপ করে গেছি। সে আবার বলে, হ্যালো আপনি কে বলছেন? আমার গলা শুকিয়ে কাঠ, কী উত্তর দেব বুঝতে পারি না। ওপারে লাইনটা কেটে দেয়। কিছু একটা বলা উচিৎ ছিল আমার। একটা দুটো কথা অন্তত। ওপাশে সম্ভবত ব্ল্যাঙ্ক কল ভেবেছে। ব্ল্যাঙ্ক কলই তো করেছি আমি। আবার ট্রাই করব? টেনশনে পেট কামড়াচ্ছে। আবার ডায়াল করি নম্বরটা। এবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফোন ধরে ওপ্রান্তে। আবার শিশুকণ্ঠ, হ্যালো আপনি কে! নাম বলুন, নাম বলছেন না কেন?
    ― আমি মা।
    ওপাশে একটু চুপ করে থাকে। ফের বলে, কে?
    ― তোমার মা।
    সে খটাশ করে লাইনটা কেটে দেয়।
     
    (চলবে)
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:f9ef:33cd:7196:b2c | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৫:০১735605
  • চার
    আমার বসের কামরায় আর একজন বসে, তার নাম সের্গেই। বস যখন থাকে তখন সে আমার দিকে ফিরেও তাকায় না, যেন আমি সেখানে নেই এমনি ভাব করে সে নিজের কাজ করতে থাকে, কিন্তু যদি বস না থাকে তখন সে আমার সঙ্গে অনেক কথা বলে। অনেক কিছু জানতে চায়, যেমন, কোথায় থাকি, কে কে আছে আমার বাড়িতে, অফিস থেকে কত দূরে আমার বাড়ি।
    আমি বলেছিলাম, কলকাতা শহর তুমি কতটা চেন?
    সের্গেই বলেছে সে আলিপুর চেনে, কারণ সেখানেই থাকে, লেক মার্কেট চেনে, নিউ মার্কেট চেনে, আর চেনে টলিক্লাব। এরা প্রত্যেকে টলিক্লাবের মেম্বার। আমি যদিও কোনওকালেই কোনও ক্লাবের মেম্বার ছিলাম না, তবু আমার যেটুকু জ্ঞান সেই মতো জানি টলিক্লাব বেশ উঁচুদরের ক্লাব এই কলকাতা শহরে। এর চেয়েও উঁচুদরের কিছু ক্লাব অবশ্যই আছে, যেমন কৌলিন্যের শ্রেষ্ঠতায় বেঙ্গল ক্লাব সবার ওপরে। সম্ভবত সেসব ক্লাবের মেম্বারশিপ পাবার পদ্ধতি অপেক্ষাকৃত জটিল, দক্ষিণ কলকাতায় এদের বাসস্থানের কাছাকাছি যে কটা অভিজাত ক্লাব রয়েছে সেগুলোর মধ্যে টলিক্লাব একটা। এরা মাঝে মধ্যে লাঞ্চব্রেকে বাড়ি না গিয়ে ক্লাবে যায়, বিয়ার খায় ফিশ অ্যান্ড চিপস্‌ দিয়ে। এই কোম্পানিতে যে যত উঁচু পোস্টে তার তত বেশি ক্লাবমেম্বারশিপ। ক্লাব মেম্বারশিপ প্রত্যেকের আছে, এমনকি সাশারও, বা যে লোকটি ছাঁটাই হয়েছিল, মিখাইল কেরেনকভ্‌, তারও হয়ত ছিল মেম্বারশিপ।
    সের্গেই আমাকে জিজ্ঞেস করে, ক্লাবে যাবে একদিন? নিয়ে যাব নাকি তোমাকে?
    যার দিনে একবেলাই খাবার জোটে না তাকে ফিশ অ্যান্ড চিপসের লোভ দেখায়! আমি মনে মনে ভাবি, ওসব ক্লাবে টাবে যেতে হলে তো খুব ঝিনচ্যাক ড্রেস পরে যেতে হবে। আমার বস্তিতে প্রত্যেক ভাড়াটেই নিম্নবিত্ত। দামি পোশাক পরা দূরে থাক, তাদের সাজগোজের অভ্যাস ও রুচি আমার নিজস্ব রুচি থেকে অনেকটাই ভিন্ন। আমার কাছে যেসব পোশাক আছে, তার অধিকাংশই আমি বস্তির পরিবেশে পরতে পারি না। সাধারণ শাড়ি বা সালোয়ার-কামিজ ছাড়া অন্য পোশাক দেখলেই বাকি বাসিন্দারা আমায় সন্দেহ করবে। ভাবতে পারে আমি ইচ্ছে করে গরীব সেজে সেখানে আত্মগোপন করে রয়েছি, নয়ত ভাববে আমি মন্দ মেয়ে। এ এমন একটা পরিবেশ, যেখানে কোনও মেয়ে একা থাকলে, তাকে সহজেই মন্দ মেয়ে বলে দাগিয়ে দেওয়া যায়। রোজ সকালে খুব তাড়াতাড়ি বের হই বস্তি থেকে, তখন ওখানে জলের কল আর বাথরুম পায়খানা কোনোটাই ফাঁকা পাওয়া যায় না। গোটা ছয়েক পরিবারের জন্য স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে একটাই টয়লেট, এবং একটি মাত্র জলের কল। বস্তির অন্য বাসিন্দারা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে টয়লেট এবং জলের কলের জন্য। খুব তাড়াতাড়ি অফিসে এসে সমস্ত কাজ সারি অফিসের বাথরুম-টয়লেটে। অত সকালে কল্যাণদাও আসে না। কেবল এই বাড়িটার যারা মালিক, তাদের কর্মচারি একজন ভদ্রলোক, পার্থবাবু ভোরের দিকে একটা ঘরে বসে কীসব হিসেব টিশেব করে। পার্থবাবুর ঘরে দু মিনিট দুটো কথা বলেই আমি ওপরে চলে যাই। আধঘন্টার মধ্যেই ঝকঝকে হয়ে বেরিয়ে আসি। এসব ব্যাপার যদি সাশা কি সের্গেই জেনে ফেলে, তাহলে আমার মানসম্মানটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেটা ভাববার বিষয়।
    মানসম্মান। বড়ো অদ্ভূত জিনিস। অবশ্য, মানসম্মানের খুব বেশি কিছু তো অবশিষ্টও নেই। নিজের শিশু সন্তানের কাছে যেতে পারছি না, চোখের দেখাটুকুরও পথ বন্ধ। একটা অসীম আবর্তের মধ্যে, যাকে ইংরিজিতে বল ইনফাইনাইট লুপ, সেইটের মধ্যে ঘুরে চলেছি - এক আদিম অনুভূতির বন্ধনে আমি আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা, নিজের শিশু সন্তানকে দেখতে পাবার, কাছে রাখার প্রবল ইচ্ছে। এখন তো মে মাস, সেই জানুয়ারি মাসে এই চাকরিটাতে ঢুকবার অনেক আগে, শিলং যাবার আগে আমি গিয়েছিলাম মায়ের বাড়ি আমার সন্তানকে দেখব বলে। আমার মায়ের বাড়ির এলাকা থেকে কিছু লোক আমাকে মেরে পিটিয়ে বের করে দিয়েছে, শাসিয়ে রেখেছে যেন ত্রিসীমানার মধ্যে আমাকে দেখা না যায়। সেদিন ছিল তিরিশে জানুয়ারি। তখন আমি শ্যামবাজারে একটা নাটকের দলে কাজ শিখছি। আমার বস্তি থেকে শ্যামবাজের দূরত্ব প্রায় বিশ কিলোমিটার হলেও কলকাতার যানবাহনে বার তিনেক বাস পাল্টে প্রায় ঘন্টা দুয়েক লেগে যেত পৌঁছতে। যাবার পথে মেয়ের ইস্কুল দেখতে পেতাম, যে ইস্কুলে আমি নিজে পড়েছি, যে ইস্কুলে আমার মা ও পড়ায়। ঐ লাল রঙের ইস্কুল বাড়িটা দেখলেই আমার মাথার ভেতরে অলীক সব চিন্তা খেলে যায়। ভাবি কোনও এক মন্ত্রবলে একদিন আমার মেয়েকে ওখান থেকে নিয়ে যেতে পারব। বিদেশ থেকে ফেরার পরে তিন মাসও থাকতে পারি নি মায়ের ফ্ল্যাটে। নভেম্বরে আমাকে এবং আমার বয়ফ্রেণ্ডকে ঐ ফ্ল্যাট থেকে মা বের করে দিয়েছিল। তখন থেকেই বস্তিতে বাস আমার। দু মাসের ওপর হয়ে গেছে। আমার মাথায় ভূত চেপেছে মেয়েকে দেখবার। একদিন বিকেলে মায়ের ফ্ল্যাটে পৌঁছে গেছলাম বিকেলে। আমার মা এবং মেয়ে তো ছিলই, ছোটবোন তখন সেখানে এসেছে।
    যেন কিছুই হয়নি, এইরকম ভাব ছিল সকলের। আমি ওখানে কিছুক্ষণ বসতে চেয়েছিলাম, কথা বলতে চাইছিলাম মেয়ের সঙ্গে, ভাব করতে চাইছিলাম কিন্তু সেসব সুযোগ পেলাম না, চেঁচামেচি ঝামেলা শুরু হয়ে গেল। বোন শান্ত স্বভাবের তাই চুপ করে থাকে। মায়ের সঙ্গে আমার যে বোঝাপড়াটা হচ্ছে, তাতে সে অংশগ্রহণ করতে চায় না। নির্লিপ্তের মতো থাকলেও, চেঁচামেচিতে বিরক্ত হয়। দরজাটা খোলাই ছিল মনে হয়। সামনের ফ্ল্যাটের থেকে একটা লোক এসে ঢুকে পড়ল এই ফ্ল্যাটে। এই বাড়ির প্রতিবেশিদের আমি বিশেষ চিনি না। এ আমার চেনা পাড়াও নয়। লোকটার হাবভাব ভালো নয়। ঘরে ঢুকেই লোকটা আমার গায়ে হাত তুলল। আমাকে চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে ফ্ল্যাটের বাইরে বের করল। সিঁড়িতে নিয়ে গিয়ে সেই চুলের মুঠি ধরা অবস্থাতেই হিড়হিড় করে অনেকটা নামিয়ে নিল, আমার পা ওপরে, মাথা নিচে। পাঁচতলার আরও দু’টো ফ্ল্যাট থেকে লোকজন বেরিয়ে এসেছে, তারা ঝুঁকে পড়ে দেখছে এই কাণ্ড। আমার মা দেখছে, আমার পাঁচ বছরের মেয়েও দেখছে ওপর থেকে। বোনকে দেখতে পাচ্ছি না। সে শান্তিপ্রিয় মানুষ, বাইরে বেরোয়নি। আমি গলা ছেড়ে চেঁচাচ্ছি আপ্রাণ কিন্তু কেউ আসছে না আমাকে সাহায্য করতে। যারা বেরিয়ে এসে মজা দেখছে, তারা অধিকাংশই মহিলা। তাদেরও প্রচ্ছন্ন সায় আছে এই ব্যাপারে। আমার বাড়ির লোকেরা তো আমাকে বাঁচাবেই না। শুনতে পাচ্ছি সকলে বলাবলি করছে, কী অসম্ভব বাজে মেয়ে জানেন তো, বিয়ে না করে বাচ্চা হয়েছে, ওর মার খাওয়াই উচিৎ। বেশ করে দু’ঘা খেলে যদি উচিৎ শিক্ষা হয়।
    আমি নিজেকে ছাড়াতে চাইছি কিন্তু এতটাই বেকায়দা অবস্থায় রয়েছি, যে কিছুতেই কিছু করতে পারছি না। লোকটা আমার কামিজটা ধরে এমন টানল, যে একটা দিকের সেলাই পুরো খুলে গেল, ফলে পেট, বুক, সব অনাবৃত হয়ে গেল। কানের দিকে এমন খামচে দিল যে কানের দুলটা খুলে পড়ে গেল সিঁড়িতে। এর মধ্যে নিচের ফ্ল্যাটের থেকেও লোকজন সব এসে ভিড় জমিয়েছে। সবাই ঝুঁকে ঝুঁকে দেখতে চায়, সবার মনে কৌতুহল, অন্ধকার হয়ে আছে সিঁড়িটা। আশেপাশেই কোনও বাড়িতে সন্ধের শাঁখ বাজল কি? আমার মেয়ে ভয় পেয়ে গিয়েছিল এইসব দেখে, তাকে সরিয়ে নিয়ে গেল পাঁচতলার ফ্ল্যাটের এক মহিলা। এদের নাম পর্যন্ত আমি জানি না। যে লোকটা আমাকে মারছিল, সে বলল, তোকে এবার সবার সামনে চুদব। ওপরের থেকে একজন মহিলার গলা শুনছি― এসব মেয়েদের রেপ করাই উচিৎ!
    ***
    আমি কি স্বপ্ন দেখছি? এটা ১৯৯৬ সালের তিরিশে জানুয়ারি! এই শহরটার নাম কলকাতা, ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী? লোকটা বোধহয় রেপ করার জন্যই আমার চুলের মুঠিটা খুলেছে। আমি গড়িয়ে যাই আধসিঁড়িতে। আমাকে প্রাণ নিয়ে পালাতে হবে এখান থেকে। ছেঁড়া কামিজ, মাথার চুল ওঠা, এক কানের দুল হারিয়েছে, আরও কী কী হয়েছে বুঝতে পারছি না, তবু আমি উঠে দাঁড়াই। লোকটাকে ধাক্কা দিয়ে ঠেলে সিঁড়ির ভিড় ঠেলে খালি পায়ে আমি নেমে যাচ্ছি নিচে, কানে আসছে লোকজন বলছে, বাবা, কী অসভ্য মেয়ে দেখেছেন? যাচ্ছেতাই একেবারে, কোনও লজ্জা শরম নেই, নির্লজ্জ বেহায়া একেবারে!
    নামার সময় একবার বলেছিলাম, আমি পুলিশে যাব, রিপোর্ট করব।
    তাতে কে আবার যেন সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল, যাও না পুলিশে, কেউ সাক্ষী দেবে না। পুলিশ আমরাই ডাকব, সামনেই তো থানা। এটা ভদ্রলোকের পাড়া এখানে এইসব চলে না। থাকতে হলে খারাপ পাড়ায় গিয়ে থাকো, এখানে কেন? আমরা ভদ্র ফ্যামিলি চারদিকে ছেলেপুলে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে থাকি, এখানে এসব বেলেল্লাপনা চললে ছোটছোট বাচ্চাকাচ্চারা কী শিক্ষা পাবে?
    আমি আবার চেঁচাই, আমার বাচ্চাকে আটকে রেখেছো কেন তোমরা? আমার বাচ্চাকে দিয়ে দাও! আমার বাচ্চাকে আমি নিয়ে যাব।
    ওদের মধ্যে একজন মহিলা খিলখিলিয়ে হেসে বলে, আগে প্রমাণ করো যে তোমার বাচ্চা। বিয়ে না করেই বাচ্চা। কী সাহস! শুনুন, শুনুন, আবার বলে কি না নিয়ে যাবে।
    কেউ কেউ বলে ওঠে, ও মা! তাই না কি? এ সব নতুন ফ্যাশান হয়েছে, আমরা বাবা এরকম কোনও দিন দেখিনি, এসব জানিও না।
    রাস্তায় বেরিয়ে আমি ফুটপাথের ধারে বসলাম একটু। পা রেখেছি রাস্তায়। বিজন সেতুর ওপর দিয়ে হু হা বাস যাচ্ছে। কোণাকুনি থানাটা দেখা যাচ্ছে। যাব একবার? গিয়ে রিপোর্ট করব? কার নামে রিপোর্ট করব? লোকটার নাম আমি জানি না, তবে মা একদিন বলেছিল, ও না কি এই এলাকার কাউন্সিলার।
    একগাদা মেয়েপুরুষের ঘৃণার দৃষ্টি ও মন্তব্যের ভেতর দিয়ে আমি চলতে শুরু করি আমার বাড়ির দিকে। পথ চলতি লোকজনের কথার টুকরো কানে আসে, বুঝতে পারি কলকাতা বুকফেয়ার শুরু হয়ে গেছে কি শুরু হবে আজকালের মধ্যে। লোকজন আমায় দেখতে দেখতে যায়। আমার ছেঁড়া কামিজ আমি ধরে রেখেছি হাত দিয়ে চেপে নইলে গা দেখা যাবে। মেয়েদের গা দেখা যাওয়াটা খুব লজ্জার ব্যাপার। যদিও তখন আমার এক ফোঁটাও লজ্জা করছিল না।
     
    (চলবে)
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:f9ef:33cd:7196:b2c | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৫:০৪735606
  • দ্বিতীয় অধ্যায়
    I was within and without, simultaneously enchanted and repelled by the inexhaustible variety of life.
    The Great Gatsby, F. Scott Fitzgerald
    ঠিকেদার লোকটির এটাই একমাত্র কাজ নয়। তার নিজস্ব বিজনেস আছে গাড়ির। একটা মোটর গ্যারেজ আছে, সেখানে এই কোম্পানির যাবতীয় গাড়ি সারাই হতে যায়। দামি দামি সব গাড়ি, কিন্তু নিয়মিত সারাই হচ্ছে। লোকটির নাম মিঠু। এ ও ডাকনাম। ভাল নাম আছে একটা, মৃণাল, তবে সে নামে একে কেউ চেনে না। মিঠুবাবুর বয়স চল্লিশের শেষের দিকেই হবে, বা পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই, চুলে কলপ দেয় না বলেই বোঝা যায় কতকটা। চন্দ্রশেখরদা বলেছে মিঠুর গ্যারেজে গাড়ি পাঠাতে পাঠাতে গাড়িগুলোর নিজস্ব কলকব্জা যন্ত্রপাতি সব এক এক করে রিপ্লেস হয়ে গেছে, যেটুকু পড়ে আছে তা কেবল খোলসটুকু, বাইরে থেকে দেখে টের পাওয়া যায় না যদিও। কিন্তু যারা গাড়ি চালায়, সেই ড্রাইভারেরা জানে গাড়িগুলোর কী হাল হচ্ছে। মিঠুবাবু আবার কার-র‌্যালিতেও অংশ নেয়, এটা তার হবি। কার রেসিং, কার-র‌্যালি, সবেতেই সে অনেক পুরস্কার পেয়েছে। লোকটাকে যখন তখন অফিসের বিভিন্ন জায়গায় দেখা যায়, কখনও সাশাকে দিয়ে চিঠি লেখাচ্ছে তো কখনও ড্রাইভারদের দাবড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে দোতলায় বড়সায়েবের খাসকামরার সঙ্গে লাগোয়া যে রিসেপশানরুম আছে সেখানেও সে ঢুকে পড়ে, বড়সায়েবের সেক্রেটারির সঙ্গে খোশগল্প করে। ঐ ঘরে একটা কালার ফোটোকপি মেশিন আছে, আমার যাবতীয় কাজের মধ্যে গোছা গোছা কাগজ কি মোটা মোটা বই ফোটোকপি করাও একটা কাজ। যেদিন তিনতলার ব্ল্যাক-অ্যান্ড-হোয়াইট ফোটোকপি মেশিনের টোনার ফুরিয়ে যায়, সেদিন দোতলায় বড়সায়েবের সেক্রেটারির সামনে দাঁড়িয়ে ফোটোকপি করি। ঐ ঘরে গেলে আমার একটু জিরিয়ে নেবার কি দুদণ্ড কাজে ফাঁকি দেবার উপায় থাকে না। বড়সায়েবের সেক্রেটারির মেজাজ খুব চড়া, সে অন্তঃসত্ত্বা এবং প্রসবের সময় হতে খুব বেশি দেরি নেই। তার গর্ভের সন্তানটি বড়সায়েবের, এবং শোনা যাচ্ছে খুব শিগগিরি এরা সই সাবুদ করে সম্পর্কটাকে আইনের আওতায় এনে ফেলবে। 
    এসব জেনে বুঝেই মিঠুবাবু যখন তখন সেক্রেটারির ঘরে ঢুকে পড়ে, মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে তেল দেয়, এটা সেটা উপহার দেয়। আমি পেছন ফিরে অনবরত ফোটোকপি করলেও কানে তো সবই আসে।
    মাসের চব্বিশ তারিখে মিঠুবাবু আমায় ডেকে পাঠাল তার ঘরে। ঘরটা ছোটো খুপরি মত, অধিকাংশ দিনই বন্ধ পড়ে থাকে। সুরথ এসে আমায় বলল মিঠুবাবু ডেকে পাঠিয়েছে। দুরুদুরু বুকে গেলাম, জানিনা, হয়ত তাড়িয়ে দেবে। সম্পূর্ণ অবাক করে দিয়ে সে আমায় গোটা মাসের মাইনেটা ক্যাশ টাকায় হাতে ধরিয়ে দিল। মাসের গোড়া থেকে জয়েন করিনি বলে একটা পয়সাও কাটল না। বরং হেসে হেসে বলল, কী? কেমন লাগছে কাজ করতে? সায়েব তো আপনার ওপর খুব সন্তুষ্ট।
    আমি একা নই, গোটা অফিসের সবাই আজ মাইনে পেয়েছে। সব ক্যাশ। কারোর টাকা হাতে গুণে দিচ্ছে ঠিকাদার মিঠুবাবু, তো কেউ পাচ্ছে ক্যাশিয়ারের কাছ থেকে। সেই ছাঁটাই হওয়া লোকটির বৌ ল্যুদমিলা কেরেনকভা এই কোম্পানীর ক্যাশিয়ার। দেড় দুলাখ টাকার ক্যাশের বাণ্ডিল হাতে নিয়ে সাশা ইত্যাদিরা দোতলা থেকে তিনতলায় উঠে গেল। সেখানে বসে আছে নিপাট ভদ্র চেহারার এক বাঙালি। ব্ল্যাকমার্কেটে ডলারের রেট আজকে যত, সেই হিসেবে সায়েবেরা ডলার কিনছে লোকটার কাছ থেকে। কেউ হাজার, কেউ দেড় হাজার, দুহাজার। বড়সায়েবের ঘরে আলাদা করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, এখানে হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে, ফার্স্ট কাম ফার্স্ট সার্ভ বেসিসে কেনাকাটি চলছে। লোকটা অবশ্য আশ্বাস দিচ্ছে যে ডলার আজ শর্ট পড়লে কাল আবার সে এনে দেবে, যদিও কালকের রেট কীরকম হবে সে ব্যাপারে কোনও গ্যারান্টি নেই। বলা যায় না কাল হয়ত রেট বেড়ে গেল।  ডলার। ম্যাজিকের মত এক কারেন্সি। এই ডলার কেনার হুড়োহুড়ি দেখে আমার মনে পড়ে সোভিয়েত দেশে বাস করবার বছরগুলোর কথা। আমি যখন ওদেশে পড়তে গেছলাম তখনও পেরেস্ত্রৈকা শুরু হয় নি। তখন থেকেই ওদেশে গোপনে ডলার কেনাবেচা দেখেছি। ভাবতাম, ডলার দিয়ে এরা করেটা কী? কোত্থেকে আসে এত ডলার ওদেশের চোরাবাজারে? সব ডলার শুধু বিদেশি ছাত্ররাই আনছে? বিদেশী ছাত্ররা তো ধনী দেশ থেকে আসে না, ধনী পরিবার থেকেও না, তাদের সামর্থই বা কতটুকু। হিসেব কেমন যেন গুলিয়ে যেত মাথার মধ্যে। সরকারি রেট একরকম ছিল তখন দু ডলার এক রুবলের সমান, কিন্তু চোরাবাজারে হাতে হাতে বেচলে এক ডলারের দাম পনের ষোলো রুবল হয়ে যেত, সময় বিশেষে তিরিশ রুবলের বেশি উঠতে দেখেছি ডলারের দাম। তখন সোভিয়েত ইউনিয়নে একজন যে কোনও অ্যাভারেজ চাকুরিজীবির আয় ছিল মেরেকেটে দেড়শো রুবল। সেই দেড়শো রুবলের মূল্য ব্ল্যাকমার্কেটে বিশ ডলারের বেশি ছিল না। আজ এরা হাজারের হিসেবে ডলার কিনছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রচুর সরকারি কোম্পানি হয় আধাসরকারি বা ব্যক্তিগত মালিকানাধীন হয়ে পড়েছে। কিন্তু সেরকম হল কী করে? ব্যক্তিগত মালিকানাধীন হতে গেলে তো মূলধনের দরকার। দেড়শো রুবল মাস মাইনের চাকুরিজীবিরা কী করে এত অর্থ জমিয়ে ফেলল যে তারা রাতারাতি ব্যবসায়ী হয়ে পড়ল? সেই আমলে সোভিয়েত ইউনিয়নে ঢুকবার সময় কাস্টমসে “ফ্রিলি কনভার্টেবল কারেন্সি” কত নিয়ে ঢুকছি তা ডিক্লেয়ার করতে হতো, এবং দেশ থেকে বের হবার সময় তার থেকে বেশি কারেন্সি নিয়ে বের হওয়া যেত না।
    সাশা ঝপ করে হাজারখানেক ডলার কিনে অবলীলাক্রমে প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে নিয়ে আমার দিকে ফিরে বলল, তুমি আমাদের সঙ্গে লাঞ্চে যাবে?
    ―টলিক্লাব?
    আমার স্বতস্ফূর্ত প্রশ্ন।
    ―না। আমরা টলিক্লাবে যাবো না, আমরা ধাবায় যাব। 
    পেছন থেকে মিঠুবাবু সঙ্গত করে, ইয়েস, কাম কাম! কাম উইথ আস। লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। উই ঈট টিপিক্যাল ইন্ডিয়ান ফুড, উইথ লটস অফ স্পাইসেস অ্যান্ড পেপার, হা হা।
    মাঝে মাঝে ভাবি মিঠুবাবু কেন যে হঠাৎ হঠাৎ ইংরিজি বলতে যায়। সাশার ঐ ডলার পকেটে ঢোকানোর ভঙ্গীটুকু দেখে আমার মনে পড়ে ১৯৮৮তে রিলিজ হওয়া "মালিঙ্কাইয়া ভেরা" (“Little Vera”) সিনেমার সেই দৃশ্যগুলো, যেখানে কিশোরী নায়িকা ভেরার কাছে একটা বিশ ডলারের বিল দেখতে পাওয়ায় তার মধ্যবিত্ত পরিবারে কী ঝামেলাটাই না হয়েছিল। সাধারণ মানুষদের কাছে ডলার তখন ছিল এক নিষিদ্ধ বস্তু।
     
    (চলবে)
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:f9ef:33cd:7196:b2c | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৫:০৬735607
  • দুই
    ইদানীং লাঞ্চব্রেকে আমার অন্য কাজ থাকে। প্রায় হপ্তাখানেক যাবদ লাঞ্চব্রেকে আমি খুব ব্যস্ত থাকছি। কিন্তু সেটা সাশা বা মিঠুবাবুকে খুলে বলা যাবে না। আমায় ইতস্ততঃ করতে দেখে এরা সন্দেহ করে হয়ত কিছু লুকোচ্ছি। বলে, আপনার অন্য কোনও তাড়া নেই তো?
    ―নাঃ, তাড়া কেন? লাঞ্চব্রেক তো, তাড়ার কী আছে?
    মাইনের টাকাটা সঙ্গে করে ওদের সঙ্গে হাঁটতে থাকি উত্তরমুখো। মনের মধ্যে খচ খচ করে, হয়ত সে এখন অপেক্ষা করে রয়েছে আমার জন্য। আজ আমি মনে মনে বেশ কতগুলো গান ঠিক করে রেখেছিলাম তাকে গেয়ে শোনাবো বলে। বেশ, কতক্ষণই বা লাগবে এই খাওয়াদাওয়ার পাট চুকে যেতে, আধঘন্টা বড়জোর। কড়কড়ে কতগুলো টাকা মাইনে পেয়েছি, সব তো হুশ করে উড়িয়ে দিলে চলবে না। প্রায় পনের দিন অনাহারে বা অর্ধাহারে থেকেছি, মশলাওয়ালা রোগন জোশ পেটে সইবে কি?
    ধাবার কাছাকাছি পৌঁছনর সময় একটা টুকটুকে লাল রঙের দামি গাড়ি আমাদের পাশ দিয়ে চলে গেল, গাড়ি যে চালাচ্ছিল তার মাথার চুল সব পাকা, গায়ে লাল টিশার্ট। তার পাশে বসে ছিল ছোট্ট একটা ছেলে, বছর তিন চারেক বয়স হবে। গাড়ির চালক মিঠুবাবুকে হাতের ইশারায় সম্ভাষণ জানাল। মিঠুবাবু সাশাকে বলল, হ্যাভ ইউ সীন দ্যাট ম্যান? ঐ যে লোকটা মার্সেডিজ চালাচ্ছিলো, বুড়ো, পাকাচুল। হি ইজ সেভেন্টি ইয়ার্স ওল্ড, অ্যান্ড ইউ নো হু ইজ দ্যাট কিড? ঐ বাচ্চাটা কে জানো? গেস হু।
    সাশা বলল, ওর নাতি মানে গ্র্যান্ডসান।
    ―উঁহু! হলো না। দ্যাট লিটল বয় ইজ হিজ সান। হি ইজ স্টিংকিং রিচ, প্রচুর টাকা, ওর বৌকে দেখলে তোমার মনে হবে ওর নাতনি। হে হে, একদম ইয়াং পঁচিশ ছাব্বিশ কি খুব বেশি হলে আঠাশ বছর হবে।
    সাশা হাসতে থাকে। মিঠুবাবু টেবিল দখল করে আমাদের চেয়ার দেখিয়ে দেয়, বলে, মানি ক্যান বাই এভরিথিং, প্রচুর পয়সা লোকটার।
    তারপরে আমার দিকে ফিরে বলে, কী! ভুল বললাম কিছু?
    মিঠুবাবু আমাকে খাবারের দাম দিতে দিল না, সাশাকেও না। দীর্ঘদিন কম খেয়ে থাকবার কারণে আমি খাবারটা পুরো খেতে পারলাম না। ওখান থেকে বেরিয়ে ওরা গেল পান সিগারেটের দোকানের দিকে। আমি ফিরতে লাগলাম একা। ঐ ধাবাতে বসেই জেনেছিলাম কতগুলো ব্যাপার, সাশা পান খেতে খুব ভালোবাসে, এদেশে থাকতে থাকতে জিভছোলা ব্যবহারের অভ্যেস হয়েছে এবং ও হিন্দু। এমনি মুখে নিজেকে হিন্দু বলে প্রচার করছে তা নয়, ওর গুরু আছে বেনারস না কোথায় যেন, রীতিমতো দীক্ষা টিক্ষা নিয়েছে, নিয়মিত ধর্মের ব্যাপারে পড়শোনা করে।
    মিঠুবাবু তক্ষুনি শুরু করে দিল হিন্দু ধর্মের নানান রকম সম্প্রদায় নিয়ে, শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব ইত্যাদি। হরেকৃষ্ণ, ইসকন নিয়েও বলল। সাশা চুপ করে সব শোনে, কিছু বলে না। খাওয়া দাওয়ার শেষে যখন আমরা কোল্ড ড্রিংসের বোতল খালি করছি, সাশা বলে ওর আগে একটা গুরু ছিল, তাকে ছেড়ে এখন তান্ত্রিক গুরুর শিষ্যত্ব নিয়েছে।
    মিঠু বাবু বিষম খায়, হাসি চেপে বলে, তান্ত্রিক মানে কাপালিক, নাকি এমনি জাস্ট তন্ত্র টন্ত্র সাধনা করে?
    সাশা স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে মিঠুবাবুর দিকে।
    ―কাপালিক তো আমাদের এই ওয়েস্ট বেংগলেও ছিল, নরবলি টলি দিত। কত হবে হার্ডলি দুশো তিনশো বছর আগের ঘটনা। তার পরেও থেকে থাকতে পারে। কপালকুণ্ডলা পড়েছেন তো আপনি?
    আমি সায় দিই মাথা নেড়ে।
    ―নরবলি! সাশা জিজ্ঞেস করে মিঠুবাবুকে, নরবলি এখন হয়?
    ―নাঃ এখন আর কোথায়, সেসব বহুৎ আগের ব্যাপার... অনেকদিন বন্ধ হয়ে গেছে। ব্রিটিশ আমলেই নিয়ম টিয়ম করে ওটা ব্যান করে দিয়েছে, রামমোহনের ইনিশিয়েটিভেই তো, নাকি? না না, সরি রামমোহনেরটা তো সতীদাহ বন্ধ করা, এনিওয়ে আমার নামটা এখন মনে পড়ছে না, তবে ব্রিটিশরাই ল পাস করে এগুলো বন্ধ করেছে।
    ওরা উল্টোপথে হাঁটতে থাকে, আমি এক ঝলকে আমার নতুন ব্যবসার জন্য যে নামটা খুঁজছিলাম তা পেয়ে গেছি― কাপালিক! রোম্যান হরফে লিখব সি দিয়ে। সি এ পি এ এল আই কিউ ইউ ই। বেশ ফ্রেঞ্চ ফ্রেঞ্চ দেখতে হবে শব্দটা। সুরথকে বলতে হবে।
    অফিসে ফিরেই দৌড়ে উঠে যাই তিনতলায় আমার অফিস ঘরে। ভেবেছিলাম আধঘন্টার মধ্যেই খাওয়া দাওয়ার পর্ব চুকবে, কিন্তু একঘন্টারও বেশি সময় কেটে গেছে, আর বেশি সময় নেই আমার হাতে। সে হয়ত অপেক্ষা করে করে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে, যা গরম এখন। আমার ঘরে নাহয় সর্বক্ষণ এয়ারকন্ডিশনার চলছে। আমি ফোন তুলে নিই, নম্বর ডায়াল করবার পরে বেশ কিছু সময় কেটে যায়, আজ সে ফোন তোলে না, আমার মা ধরে লাইন, কাকে দরকার?
    আমি মেয়ের নাম করে বলি, তাকে ডেকে দিতে। মেয়ে আসে। বলে, তুমি কাল ফোন কোরো, আজ আমরা একটু ব্যস্ত আছি।
    পাঁচ বছরের মেয়ে কেমন সুন্দর করে গুছিয়ে বলল, আমরা আজ একটু ব্যস্ত আছি। খুব সুন্দর করে বাংলা বলতে শিখছে সে। নিশ্চয় ভালো ভালো বই পড়ে। আমায় দেখিয়েছিল একবার, উপেন্দ্রকিশোর সমগ্র দুখণ্ড পড়া হয়ে গেছে বলেছিল। পড়ুক আরও। আমি কাল ওকে আবার ফোন করব, কাল একের পর এক অনেক গান শোনাব ফোনে। ওর সঙ্গে আমায় যোগাযোগ রাখতে ফোনই একমাত্র অবলম্বন। এজন্য কম চেষ্টা করতে হয়েছে এ কদিন? প্রথমে তো সে ফোন করলেই লাইন কেটে দিত। ধৈর্য ধরে রোজ নম্বর ডায়াল করতাম, এখন গরমের ছুটি, এখনইতো দুপুরে তাকে বাড়িতে পাবার সময়।
    সে একদিন জিজ্ঞেস করল― তুমি কোথা থেকে ফোন করছ?
    আমি বললাম, খুব ঠান্ডা একটা জায়গা থেকে।
    অত গরমের মধ্যে সে উৎসাহী হয়ে শুধোয়, ঠান্ডা জায়গাটা কোথায়?
    আমি বলি খুব উঁচুতে, মেঘের খুব কাছে। আমি যে খুব উঁচু একটা গাছের ওপরে থাকি। এখানে খুব হাওয়া দেয়, খুব ঠান্ডা, একদম গরম নেই। চারিদিক নিরিবিলি শান্ত।
    সে ধীরে ধীরে এসব বিশ্বাস করতে শুরু করে দেয়। আমি তাকে ফোনে গান শোনাতে থাকি, একটা দুটো তিনটে, যেদিন যতটা পারি। এমনি করতে করতে সে অভ্যস্থ হয়ে পড়ে আমার ফোনের ওপর। তাকে কোনও কথা জিজ্ঞেস করি না। একবারের জন্যেও বলি না, কেমন আছ, কী খেলে আজ, কজন বন্ধু তোমার, কবে ইস্কুল খুলবে। কিচ্ছু জিজ্ঞেস করি না আগবাড়িয়ে। বলবার হলে সে নিজে থেকে বলবে। ওসব জেনে তো আমি কিছু করতে পারব না। তার প্রাথমিক ভয়টা কাটিয়ে দেওয়া দরকার, সে আমাকে ভয় পায়। তাকে শেখানো হয়েছে আমায় ভয় পেতে, ঘৃণা করতে। আজ হপ্তা দেড় দুই কি আরও একটু বেশি সময় ধরে, রোজ ফোন করে করে তার সেই ভয় আমি কাটিয়ে দিয়েছি। এখন তার নেশা ধরেছে, টেলিফোনে গান শোনার নেশা। রেডিও-টিভি নয়, রাস্তার লাউডস্পিকারও নয়, এ তার একান্ত নিজস্ব গানের অনুষ্ঠান, অনুরোধের আসর, কোনও তবলা হারমোনিয়ামের সঙ্গত লাগে না, সুরে ভুল হলে কি গানের কথা এদিক ওদিক হলেও ক্ষতি নেই, সে একটা একটা করে গানের নাম বলবে আর আমি গাইব। টিফিনের ছুটির শেষে সায়েবদের ফিরে আসবার সময় ঘনিয়ে এলে, আমি তাকে বলি রাক্ষসেরা ফিরে আসবে এখন। সেও বোঝে, রূপকথার গল্প পড়ে সেও জেনে গেছে যে রাক্ষসেরা ফিরে আসবার আগেই লুকিয়ে পড়তে হয়।
     
    (চলবে)
  • Amit | 220.240.134.33 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৫:৪৬735612
  • অদ্ভুত লাগছে পড়তে পড়তে। মানে এটা কারোর রিয়েল লাইফের কাহিনী হতে পারে - এইটা বুঝতে বুঝতেই পড়া শেষ হয়ে যাচ্ছে। 
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:5195:1112:5618:e0b3 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৬:৫৮735613
  • তিন

    সাশা আমাকে অনেক কিছু বলেছিল। বড়ো মেজ সেজ সায়েবরা ওকে তেমন পাত্তা দিত না কিনা, কাজেই সাশার মেলামেশার এরিয়াটা ছিল মিঠুবাবু ও আমার দিকে। মিঠুবাবুর শালার বৌ তখন মারকাটারি নায়িকা বাংলা সিনেমায়। টিভি সিরিয়াল দিয়ে তার কেরিয়ার শুরু হলেও সিনেমার জগতে সে তখন দাপুটে অভিনেত্রী। অনেকেই অনুরোধ করত, ও মিঠুবাবু আপনার শালার বৌকে একদিন এখানে নিয়ে আসুন না, সামনা সামনি দেখতে ইচ্ছে করে। মিঠুবাবু হচ্ছে-হবে করে ঠেকিয়ে রাখত আমাদের আবদার। আমরা মানে আমি, কল্যাণদা, ড্রাইভারেরা। সায়েবরা তো বাঙালি নায়িকাকে চেনে না, সিনেমার জগৎ নিয়ে তাদের কোনও কৌতুহল নেই।
    যে মেয়েটিকে সাশার পছন্দ হয়েছিল, সে থাকত গাঙ্গুলীবাগানে। সেই মেয়ে যাদবপুরের ছাত্রী, ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসেই পূরবীদির তত্ত্বাবধানে সেই মেয়ের সঙ্গে সাশার আলাপ। আমায় তার ফোটো দেখাল। আমাদের বাঙালিদের চোখে ঐ মেয়ের রূপ খুবই সাদামাটা, অ্যাভারেজ। কিন্তু সাশার চোখে সে অপরূপা। সে মেয়েটিকে অ্যাপ্রোচ করেছে, মেয়েটিরও সম্মতি আছে, উনিশ-কুড়ি বছরের মেয়ে, হয়ত জীবনে এই প্রথম প্রেম করছে। কিন্তু ওর বাড়ির লোক জানতে পেরে মারাত্মক রেগে গেছে, তাদের ঘোর আপত্তি এই সম্পর্কের ব্যাপারে, বিশেষ করে মেয়ের বাবা মেয়েকে নিষেধ করে দিয়েছেন সাশার সঙ্গে মিশতে। এই পরিস্থিতিতে সাশার খুব ইচ্ছে করে মেয়েটির সঙ্গে কথা বলতে, দেখা করতে। ফোন করলে ওর বাড়ির লোক জেনে ফেলবে, তাই আমায় বলল, তুমি ওর বন্ধু সেজে ওর বাড়ি গিয়ে ওকে বাইরে ডেকে আনো।
    আমি রাজি হয়ে গেলাম। অফিসের শেষে সাশার সঙ্গে ট্যাক্সি করে পৌঁছে গেলাম গাঙ্গুলীবাগান। সাশা বাড়িটা দেখিয়ে দিল। আধুনিক স্টাইলের নতুন একটা বাড়ি, সামনে বাগান। কলিং বেল টিপতে মেয়েটির বাবা দরজা খুলে দিতেই আমি মেয়েটির ডাকনামে ওর খোঁজ করলাম, নিজেরও একটা অন্য নাম যেটা সাশা বলে দিয়েছিল সেই নামে পরিচয় দিলাম। মেয়েটি বসার ঘরেই ছিল। ও আমার কাছে এলে নীচু স্বরে বললাম, চল না একটু বাইরে, সাশা ওয়েট করছে। মেয়েটি বেরিয়ে এল, ব্যস আমার কাজ শেষ।
    গাঙ্গুলীবাগান থেকে আমার বাসস্থান অনেক দূর। শিলপাড়া স্টপেজে নেমে ভেতরে যেতে হয় রিকসা করে ষষ্ঠীর মোড় পেরিয়ে, ঐ অঞ্চলে তখনও বাস চালু হয় নি। ওসব দিকের রাস্তায় তখন পাশাপাশি দুটো গাড়ি যাবার মত জায়গা ছিল না। লোকে বলাবলি করত নতুন একটা বাস রুট নাকি শিগগিরি চালু হবে, বাসের নম্বর হবে আঠেরোর বি। সাশা আমাকে টাকা দিতে চেয়েছিল, বাড়ি ফিরবার জন্য ট্যাক্সি ভাড়া। নিই নি। 
    পরের দিন থেকে রোজ আমরা গল্প আলোচনা করতাম অফিসের কাজের ফাঁকে ফাঁকে। সমস্তই সাশার নিজের গল্প। শান্তিনিকেতনে থাকাকালীন ওর প্রেম হয়েছিল রশ্মি বলে একটা মেয়ের সঙ্গে, তারপরে দেশে ফিরে গিয়েছিল সে, ফের ফিরে আসে এই চাকরিটা নিয়ে। ততদিনে রশ্মির সঙ্গে ওর ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। এর পরে ও নতুন করে মেয়ে দেখতে শুরু করল বিয়ে করবার উদ্দেশ্যে। 
    এই সময়ে পরপর অনেকগুলো ছোট ছোট ঘটনা ঘটে যাচ্ছিল। কল্যাণবাবু যেদিন শেষবারের মত অফিসে এল সেদিন আমরা অনেকক্ষণ নীচে বসে গল্প করেছিলাম। চাকরি চলে যাবার জন্য কোনও দুঃখের ছাপ সেভাবে নজরে পড়েনি অভিব্যক্তিতে। ইপিয়েবিএক্স যন্ত্রে টুকটাক টেলিফোনের কানেকশান করে দিচ্ছিল সায়েবদের ঘরে ঘরে, এবং বাকি সময়টুকু মামুলি কথাবার্তা বলছিলাম আমরা। আয়োজন করে কোনও ফেয়ারওয়েল দেওয়া হল না, কেউ এসে সেভাবে বিদায় টিদায়ও জানায় নি। আমার খুব আগ্রহ ছিল জানার এর পরে কে এসে বসবে এই ঘরে। তার সঙ্গে কি আমার এমনই সহজে আলাপ হয়ে যাবে যেমনটা হয়েছে কল্যাণদার সঙ্গে? সেই সঙ্গে মনের ভেতরে একটা অস্বস্তি হচ্ছিল, এর পরে কেমন করে চলবে ওর সংসার? টাকার অভাব কাকে বলে সে তো আমি জানি। নাহয় ইদানীং কড়কড়ে চল্লিশটা একশো টাকার নোট গুণে নিয়েছি রেভিনিউ স্ট্যাম্পের ওপর সই করে, কিন্তু টাকা পয়সা রোজগারপাতি না থাকলে ঠিক কী হয় সেতো হাতে নাতে জানি। কল্যাণদা সাবলীলভাবে হেঁটে বেরিয়ে গিয়েছিল অফিসের মেইন গেট দিয়ে, এমন নয় যে পেছন ফিরে একটিবারের জন্যে তাকায় নি আমাদের দিকে। চাকর ড্রাইভার মালি জমাদার আমি, সবাই গেট থেকে বেরিয়ে ফুটপাথের ওপরে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম সেই চলে যাওয়া। এও এক ধরণের ফেয়ারওয়েল।
    পরদিন সকালে অফিসে ঢোকার মুখে দেখেছিলাম রিসেপশান ফাঁকা, নতুন রিসেপশানিস্ট হয়ত একটু পরে জয়েন করবে। সিঁড়ির মুখটায় পৌঁছোনোর আগেই পার্থবাবু ডাকল আমায়, নাম ধরে নয়, ভাববাচ্যে― কী খবর? কল্যাণকে তো ছাড়িয়ে দিল। কেমন লাগছে কাজকর্ম পরিবেশ?
    সেদিন আমরা সিনেমার গল্প নিয়ে কিছুক্ষণ আড্ডা দিলাম। ঋতুপর্ণ ঘোষ বলে একজন নতুন ডিরেক্টর সিনেমা বানিয়েছে, উনিশে এপ্রিল, খুব নাকি হিট বই, হাউসফুল যাচ্ছে। বহু দিন কলকাতার সিনেমা হলে গিয়ে বাংলা সিনেমা দেখা হয় নি আমার। পার্থবাবু গল্প করতে শুরু করলে থামতেই চায় না। ট্যাংরায় থাকে, কলকাতার চায়না-টাউন। সেখানকার চাইনিজ ফুডের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আমি উঠে আসবার সময় বারবার বলে, এখন থেকে তো কথা বলবার লোক একজন কমে গেল, পারলে সময় করে নীচে চলে আসবেন, আমি দশটা সাড়ে দশটা অবধি থাকি, সপ্তাহে দুদিন, সোম আর বেস্পতি।
     
    (চলবে)
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:5195:1112:5618:e0b3 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৬:৫৯735614
  • চার

    চাকরির প্রথম দিনের শেষে সন্ধেবেলায় যাঁর বাড়িতে সাশা আমায় নিয়ে গেছল, তাঁকে আমি সেই প্রথমবার দেখলেও নাম শুনেছি আগেই। শুধু নাম শোনা নয়, তিনি পরোক্ষে আমায় একটা ঠিকে কাজও জোগাড় করে দিয়েছিলেন যার ফলে কিছু টাকা রোজগার করে ফেলেছিলাম অপ্রত্যাশিতভাবে।
    সেই ব্যাপারে বলতে হলে মাস দুয়েক আগের ফ্ল্যাশ ব্যাকে যেতে হয়। তখন মার্চ মাস। দোলের ঠিক পরেই। শিলং থেকে একা ফিরে এসে হন্যে হয়ে খুঁজে চলেছি যে কোনও জীবিকা। ডিগ্রীর যে কাগজগুলো রয়েছে সঙ্গে, সেসব দিয়ে দরখাস্ত করবার মতন সময় বা সঙ্গতি কোনওটাই নেই তখন হাতে। মাত্র দিন কয়েক আগে একটা মৃত্যুযোগ থেকে সামান্যের জন্য বেঁচে গেছি, শিলং এ হয়ত ওরা আমাকে মেরেই ফেলত। সাময়িকভাবে প্রাণে বাঁচলেও, প্রাণটাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যেসব রসদ লাগে, যেমন বাসস্থান, অন্ন, সেসব জোগাড় করতে টাকার দরকার, তা আমার কাছে ছিল না। ঠিক যেন ভিন গ্রহ থেকে আগত এলিয়েন আমি, মানুষের ছদ্মবেশে আশ্রয় খুঁজছি কলকাতা শহরে।
    তখন শ্যামবাজারে যে নাটকের দলটায় কাজ করছিলাম, সেই দল মারফৎ পূরবীদি খবর দিয়েছিলেন, যে জলদি এমন একজন দোভাষীর দরকার যে রাশিয়ান থেকে বাংলা বা ইংরিজিতে, এবং বাংলা বা ইংরিজি থেকে রাশিয়ানে তাৎক্ষনিক ভাষান্তর করতে পারবে, লেখালেখি নয়― মৌখিক কাজ। কাজ করবার পরেই হাতে হাতে পেমেন্ট হয়ে যাবে। দোভাষীর এত অভাব পড়বার কথা নয় কলকাতা শহরে, তবে এই কাজের জন্য কেউ এগিয়ে আসতে চাইছে না। কারণটাও জানা গেছল। লাতভিয়া থেকে এসেছে এক রাশিয়ান মহিলা। সে রাশিয়ান ছাড়া আর কোনও ভাষা জানে না, তার অবিলম্বে দোভাষী চাই খুব জরুরি প্রয়োজনে। তার স্বামী জেলে রয়েছে, ক্রিমিনাল কেস, সে চলে এসেছে তার স্বামীকে বাঁচাতে। এইসব কারণে তাকে প্রচুর ঘোরাঘুরি করতে হবে, উকিলের সঙ্গে পরামর্শ করবার ব্যাপার আছে, স্বামীর সঙ্গেও হয়ত সে দেখা করতে যাবে জেলখানায়। অর্থাৎ দোভাষীকে খানিকটা গাইডের ভূমিকা নিয়ে সব জায়গাতেই যেতে হবে সেই রাশিয়ান মহিলাটির সঙ্গে সঙ্গে। এইসব শুনেই অন্য দোভাষীরা পিছিয়ে গিয়েছে। আমি তখনই কাজটা নিয়ে নিলাম।
    ১৯৯৫ এর ডিসেম্বরে পশ্চিমবঙ্গে একটা অস্ত্রপাচারের ঘটনা ঘটেছিল। পরে এর নাম দেওয়া হয় পুরুলিয়া আর্মস ড্রপ কেস। বিদেশ থেকে বিমান করে অস্ত্র এনে রাত্রিবেলায় ফেলা হয়েছিল পুরুলিয়ার একটা জায়গায়। অস্ত্রপাচারকারী যে বিমানটা ভাড়া করে নিয়ে এসেছিল, তার চারজন পাইলটই কিছু সময় পরে গ্রেফতার হয় কলকাতা বিমানবন্দরে। সংবাদপত্রে এই খবরের ব্যাপারে ডিটেলে বেশি কিছু দেয় নি, এবং আমি প্রথম জানতে পারি ১৯৯৬এর মার্চের গোড়ায়, দোভাষীর কাজ করতে গিয়ে।
    ঐ পাইলটদের ক্যাপ্টেন আলেকসান্দার ক্লিশিন-এর বৌ ওলগা ক্লিশিনা আমার মক্কেল। কাজের জন্য ঘন্টা প্রতি রেট ধার্য হল যদ্দূর মনে পড়ে ৭৫ বা ১০০ টাকা। পার্ক স্ট্রীটে কুইন্স্ ম্যানশনে বেঙ্গল চেম্বার অফ্ কমার্সের গেস্ট হাউসে গিয়ে উপস্থিত হলাম সকাল নটা দশটা নাগাদ। ওলগা সেখানেই রয়েছে। একা। উপেক্ষিত। ঘৃণার চোখে তাকে দেখছে সকলে। দেখে মনে হয় মধ্য চল্লিশ। প্রথমে আমাদের গন্তব্য হাইকোর্টের কাছে উকিলপাড়া, কিরণশঙ্কর রায় রোড। ক্রিমিনাল লইয়ার খুঁজতে হবে। রাস্তাটা নোংরা। ঘিঞ্জি। তারই মধ্যে খুঁজতে হলো উকিলের ঠিকানা। বাক্সের মতো ঘর, চেম্বার। এসি। উকিলের ফি মাত্র দশ পনেরো মিনিট কথা বলার জন্য ৩৫০০টাকা। তারই মধ্যে ওলগার সারা শরীরে দৃষ্টি বুলিয়ে চলেছে সবাই। সঙ্গে নানান মন্তব্য। ও যেহেতু বাংলা জানে না, সুতরাং খোলাখুলিই অশালীন কথা বলে চলেছে সে ঘরের লোকজন। সেসব আমি অনুবাদ করে দিইনি ওলগাকে। ওর থেকে টাকা নিয়েছি বটে, কিন্তু সব কথা অনুবাদ করে দিইনি।
    এরকমও শুনেছি― ওর স্বামী জেল খাটুক না, ওর চিন্তা কী, এখানেই জুটে যাবে কেউ। ওকে পয়সা নিয়ে এত চিন্তা করতে বারণ করে দিন, এখনও যা চেহারা আছে, ভালই কামিয়ে নেবে।
    হ্যাঁ এইভাবেই ওরা বলছিলো সেদিন। ওলগা আমার দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিলো অনুবাদের আশায়; আমি মিথ্যে কথা বলে যাচ্ছিলাম তাকে যাহোক কিছু বানিয়ে বানিয়ে। মিথ্যে অনুবাদ।
    ওখান থেকে কিছু পয়েন্ট কাগজে লিখে নিই, কারণ এরপরে আমাদের অজান্তেই তো টিকটিকি বা গোয়েন্দা ঘুরবে আমাদের পেছন পেছন। দুপুর দুপুর পৌঁছে গেছি প্রেসিডেন্সি জেল। আলেকসান্দার ও তার বাকি তিনজন সহকর্মীর সেটাই ঠিকানা।
     
    (চলবে)
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:5195:1112:5618:e0b3 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৭:০০735615
  • পাঁচ
    এদিকে লাতভিয়ার রাজধানী রিগায় ওদের বড়ো মেয়ের বিয়ের দিন ঠিক হয়ে রয়েছে। সামনেই বিয়ে― এই মার্চেই। ওলগা বলছিল নানাজনের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে সে এসেছে। বাকি তিনজন সহকর্মীর বৌয়েরাও টাকা তুলেছে ধারধোর করে, এদেশে আসবার টিকিট, ভিসা, থাকা খাওয়া ঘোরার খরচ, উকিলের খরচ, সমস্ত এই থেকেই চালাতে হচ্ছে।
    ওর থেকে টাকা নিতে মন চায় না, কিন্তু আমি যে নিরুপায়। মেয়ের বিয়ের জন্যে অল্প কিছু শপিং করতে চায় সে। সাদা সিল্কের ড্রেস মেটিরিয়াল কিনবার ইচ্ছে আছে বলল। ভারতীয় সিল্কের দুনিয়াজোড়া খ্যাতি।
    আমি বলি, জেল থেকে ফিরবার পথে সময় থাকলে নিউমার্কেটে নিয়ে যাব, কেমন?
    প্রেসিডেন্সি জেলে সেই বেষ্পতিবার ছিল "দেখা করবার" দিন। বিকেলে। সাইডের গেট দিয়ে ঢুকে ঘাসহীন মাঠে একটা গাছতলায় দাঁড়াই। বড্ড গরম সেদিন। উল্টো দিকে একটা চাতালে অপেক্ষা করবার শেড। তার দেয়াল বেঞ্চি ছাদ সমস্তই সিমেন্টের। দেয়ালে জলের কল। সেই জল ওলগা খেতে পারবে না।
    সময় হলে আমাদেরই সবার আগে ডেকে নেয় ভেতরে। হাই প্রোফাইল কেস্।
    সবার আগে বিপদে পড়ে গেলাম আমি। আমাকে ক্রমাগত প্রশ্ন করে চলে ওখানকার কর্মকর্তারা। কোথায় থাকি, ভাষা শিখলাম কোথায়, কেন আমি অনুবাদকের কাজ নিয়েছি? কেন একজন দেশদ্রোহীর হয়ে, ইত্যাদি ইত্যাদি… এবং সবশেষে "ভেতরের খবর" যেন ওদের দিই।
    ওলগা এসবের কিছুই জানলো না। এই পুরো সময়টুকুর খরচ ওকেই দিতে হবে, ওর "ভেতরের খবর" আমি বলে দেবো কর্তৃপক্ষকে - তার খরচও ও-ই দেবে।
    প্রশ্নগুলোর উত্তর যথাসম্ভব সংক্ষেপে দিই।
    বললাম, টাকার জন্যে দোভাষীর কাজ করছি, রাশিয়ান ভাষাটা অনেকদিন ধরে শিখেছি। দেখুন এরা অভিযুক্ত, অপরাধ করেছে সেটা কি প্রমান হয়ে গিয়েছে? হয় নি তো এখনও। আর দেশদ্রোহী কথাটা আমায় বলবেন না প্লীজ, আমায় দেখে কি দেশদ্রোহী মনে হচ্ছে আপনার? বলুন তো, অনুবাদ করাটা কি পাপ? জেলের কর্তাব্যক্তি ফস করে হেসে ফেলেন।
    ভেতরে হেঁটে গিয়ে একটা বড়োসড়ো উঠোনের সাইজের জায়গা, সেখানে বন্দীরা সব খেলছে, ঘুরছে, কথা বলছে। পাশের সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসে চারজনে, তখনও তাদের পরণে পাইলটের পোষাক। সকলে মিলে সেই সামনের অফিস ঘরটায় বড়ো টেবিলের চারপাশে চেয়ার নিয়ে বসেছি। এখন তো ওলগা কথা বলবে তার স্বামীর সঙ্গে, এখন তো আমার অনুবাদের কাজ থাকতেই পারে না। তবু থাকে। আমায় বাধ্য করা হয়― ওরা কী বলছে বলুন, কান পেতে শুনে বলুন।
    এরা হাঁ করে চেয়ে থাকে আমার মুখের দিকে। ওলগা-আলেকসান্দারের দিকে না তাকিয়ে আমি ওদের বলে যাই বাংলায়, যা শুনছি। ওরা তো সংসারের কথা বলে, মেয়ের বিয়ের কথা, কে কে টাকা দিলো এদেশে আসতে, কে কে দেয় নি, হবু জামাই কী বলেছে, আলেকসান্দার বলে― আমার কোমরের ঘের সরু হয়ে গেছে, বেল্ট নিয়ে এসো পরেরবার ছোটো সাইজ দেখে।
    আমি এগুলোই বলে যাচ্ছি ক্রমাগত বাংলায়। একটু ভেবে বলবার ও অবকাশ পাচ্ছি না। এরা অধৈর্য হয়ে উঠছে― অস্ত্র পাচারের কথা বলছে না? ভালো করে শুনুন, ওদের দলের পালের গোদাটা কোথায় গেল বলছে না?
    ঐ ব্যাপারে আলেকসান্দার মনে হলো কিছু জানে না। শুনে মনে হচ্ছে সে পুরোপুরি প্রতারিত। প্রাইভেট প্লেনের পাইলট হয়েছিলো বেশি অর্থ উপার্জনের জন্যে। বউয়ের সামনে সে হুহু করে কাঁদে। ফাঁকা চোখে তাকিয়ে থাকে। এই সব পারিবারিক কথার অনুবাদ পছন্দ হয় না এদের। এরা তথ্য চায়। আমি তথ্য বানাতে পারি না। যা যা বলে হুবহু অনুবাদ করে দিই। সন্ধে প্রায় ঘনাবে এমন সময় জেল থেকে বের হলাম আমরা, বেরোনোর আগে ওলগা ও আলেকসান্দার চুমু খেলো।
    একজন কর্মচারী বলে― এসব জিনিস এখানে অ্যালাও করা হয় না, ওদের স্পেশাল ছাড় দেয়া হয়েছে, বুঝলেন? ভাবখানা এমন, আমি যেন ওদের পক্ষের লোক। সেদিন আর নিউমার্কেটে যাই নি, গেস্ট হাউসে ফিরিয়ে দিই ওলগাকে, গুণে গেঁথে নিই আমার রোজগারের কড়কড়ে নোটগুলো। ফের আসতে হবে পরের দিন সকালে।
    জেলার জানতে চেয়েছিল, এত ভালো রাশিয়ান বলি, বুঝি কেমন করে। সংক্ষেপে বলি, শিখেছি।
    ― আপনি ছিলেন নাকি রাশিয়ায়?
    ― না।
    সত্যি কথাই বলেছি, কারণ আমি ছিলাম সোভিয়েত দেশের উজবেকিস্তানে, সেটাতো কোনক্রমেই রাশিয়া নয়।

    (চলবে)
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:5195:1112:5618:e0b3 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৭:০২735616
  • ছয়
    পরের দিন। আরো সব দেখা সাক্ষাৎ। খুব বেশি কাজ নয়। মেয়ের বিয়ের জন্য সামান্য শপিং। দিনশেষে টাকা গুণে নিতে নিতে প্রশ্ন করি আচ্ছা তোমাদের দেশ তোমাদের সাহায্য করে না?
    ― দেশ! কোনটা দেশ আমার?
    ― কেন লাতভিয়া? তোমরা লাতভিয়ার নাগরিক নও? নাকি রাশিয়ার নাগরিক?
    ― রাশিয়া আর আমাদের দেশ নেই; দেশ ভাগের সময় আমরা হারিয়ে ফেলেছি আমাদের নাগরিকত্ব।
    ― তাহলে লাতভিয়ার নাগরিক হিসেবে, তারা কি কিছু…
    ― লাতভিয়ার নাগরিক হিসেবে একজন রাশিয়ানের কী অধিকার থাকতে পারে? কিচ্ছু নেই। আমাদের পরিচয় অকুপান্তি (occupant)।
    ― মানে অধিগ্রহনকারী?
    ওলগা আর কোনও কথা বলতে চায় না। আমি এসব কিছুটা জানতাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বাল্টিক সাগরের কূলবর্তী তিনটি দেশ লাতভিয়া, লিথুয়ানিয়া ও এস্টোনিয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ হয়ে পড়েছিল। এই তিনটি দেশকে নাৎসি আগ্রাসন থেকে রক্ষা করেছিল সোভিয়েত দেশ, কিন্তু যুদ্ধজয়ের পরে সোভিয়েত দেশের অংশ বনে যাওয়াটা তারা বরদাস্ত করতে পারে নি। ভেতরে ভেতরে চলছিল অন্তর্দ্বন্দ্ব, রাশিয়ানদের তারা বলত অকুপান্ত, দখলকারি। অবশেষে নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় ঐ তিনটি রিপাবলিক স্বাধীন হয়ে যায়, কিন্তু ততদিনে অসংখ্য রাশিয়ান সেসব রিপাবলিকে রীতিমতো বাস করছে দুই কি তিন প্রজন্ম ধরে। রাশিয়ায় তাদের ফিরে যাবার কোনও জায়গা নেই, উপায়ও নেই। এদের নাগরিকত্ব নিয়ে প্রচুর সমস্যা তৈরী হয়। এ হচ্ছে গণহারে নাগরিকত্ব হারানোর ঘটনা। আগে সকলেই ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের নাগরিক। ১৯৯১এ সোভিয়েত ইউনিয়নের ১৫টি রিপাবলিক ভেঙে ১৫টি নতুন দেশ তৈরি হবার পরে স্বাভাবিকভাবেই প্রতিটি দেশেই নিজস্ব নাগরিকতা, নিজস্ব সংবিধান ইত্যাদি তৈরি হলো। ওলগারা ঐ সময়ে লাতভিয়ায় থাকত, ফলে তারা যেমন সোভিয়েত দেশের নাগরিক রইল না, তেমনি রাশিয়ার নাগরিকও নয়, ভৌগলিক অবস্থানের কারণে তারা হয়ে গেল লাতভিয়ার নাগরিক। যদিও তারা জাতে রাশিয়ান, কিন্তু তাদের মাতৃভাষা লাতভিয়ান নয়। এতটা কাল রাশিয়ান ভাষাই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে গোটা সোভিয়েত ইউনিয়নে, কিন্তু ১৯৯১ এর পর নতুন তৈরী হওয়া দেশগুলোতে স্থানীয় ভাষার গুরুত্ব বেড়ে তো গেলই, সেই সঙ্গে শুরু হল ইংরিজি ভাষা শিখবার হিড়িক। ওদেশের সরকারি ভাষা লাতভিয়ান। ওলগাকে লাতভিয়ায় নিজের দাবী প্রমাণ করতে ভালোভাবে জানতে হবে লাতভিয়ান ভাষা এবং সেটা মোটেই সহজ কাজ নয়।
    আর কী বলব? একটু সান্ত্বনা দিই। কাঁদিস না ওলগা। তোর স্বামী নিরপরাধ সেটা বুঝতে পারছি। কিন্তু তা প্রমাণ করতে কত সময় যে লেগে যাবে তা বলা যাচ্ছে না― তবু জানবি সত্যের জয় হবেই।
    সত্যের জয় হওয়াটা একটু গুরুগম্ভীর বাক্যবন্ধ হয়ে গেল, তবু এটাই হয়ত ওকে কিছুটা মনের জোর দেবে। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে ওলগা। ব্যাগ গুছোতে হবে তাকে। অসহায় মেয়েটা। একবার ভাবি ওকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি? উকিলরা তো ওকে ঠকিয়ে লুটে নেবে, যা দেখে এলাম। নয়ত ছিঁড়ে খাবে কিছু লোক। ওলগাকে দেখে এমনিতেই লোভে জ্বলজ্বল করছে তাদের চোখ। ও মোটেই নিরাপদ নয় এই শহরে, ওর ফিরে যাওয়াই উচিৎ।
     
    (চলবে)
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:5195:1112:5618:e0b3 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৭:০৩735617
  • তৃতীয় অধ্যায়
    এর মধ্যে হঠাৎ রাজা বলে উঠলেন, পক্ষীরাজ যদি হবে, তাহলে ন্যাজ নেই কেন? শুনে পাত্র মিত্র ডাক্তার মোক্তার আক্কেল মক্কেল সবাই বললে, ভালো কথা! ন্যাজ কি হল? কেউ তার জবাব দিতে পারে না, সব সুড়সুড় করে পালাতে লাগল।
    ― হ-য-ব-র-ল, সুকুমার রায়


    মেয়েটির নাম সুরঞ্জনা। ওর চোখের মণিদুটো নীলচে, অসম্ভব রোগা এবং সবসময় সিগারেট খায়। মেয়েটির ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি আছে এবং রাশিয়ান ভাষাও জানে। এ সমস্ত সে আমায় বলেছিল প্রথম আলাপেই। গোলপার্কের দিকটায় থাকত ও, অনেক দিনই ফিরবার সময়ে ড্রাইভারদের বলত ট্যাক্সি ডেকে দিতে। ওরও তো আমারই মতন স্যালারি, বরং একটু কমও হতে পারে, অথচ কী করে ট্যাক্সির খরচ, এত এত সিগারেটের খরচ, বাইরে থেকে টিফিন কিনিয়ে আনা সমস্ত ঐ টাকায় চালায় বুঝে উঠতে পারিনি। হয়ত রোজগারের পুরোটাই ওর হাতখরচ, সেইজন্যই হয়ত পারে।
    মেয়েটি প্রথম দিনেই আমাকে আপন করে নিল। গোড়া থেকেই তুইতোকারি শুরু হয়ে গেল আমাদের মধ্যে। দিন দুয়েকের মধ্যেই জেনে ফেললাম ওর অনেক কথা। একবার ছমাসের কড়ারে মস্কো গিয়েছিল চাকরি করতে। ওর প্রেমের কথা, প্রেম ভেঙে যাবার গল্প, আরও প্রেম, আরও গল্প, সব ও নির্দ্বিধায় বলে চলে। কল্যাণদা থাকাকালীন যত না রিসেপশনে গেছি, তার থেকেও বেশি ঘনঘন সুরঞ্জনার কাছে যাই। 
    লাঞ্চ ব্রেকে ফোন করবার যে নেশাটা আমার ধরেছিল, তা প্রায় জোর করেই কেটে গেল। গরমের ছুটি শেষ, ইস্কুল কলেজ সব আবার খুলে যাচ্ছে, ফলে মেয়েকে প্রত্যেক দুপুরে ফোন করে করে মেঘের ওপর থেকে গান শোনানোর পালা শেষ। এর ফলে সায়েবরা বেরিয়ে গেলেই আমি নীচে চলে যাই, সুরঞ্জনা এক হাতে জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে অন্য হাতে একটা গল্পের বই ধরে রেখে খুব মন দিয়ে পড়ছে দেখতে পাই। আমায় দেখতে পেলেই অবশ্য ও বইয়ের পাতা ভাঁজ করে আমাকেই মনযোগ দেয়, লক্ষ্য করেছি ওর মধ্যে যেটা আছে সেটা হচ্ছে গাম্ভীর্য, যেটা খুব সম্ভবত আমার মধ্যে নেই। নিজেকে তো আমি দেখতে পাচ্ছি না। কোনও মানুষই নিজেকে দেখতে পায় না সরাসরি, নিজেকে মানে নিজের মুখটুকু। সেই মুখটুকু দেখবার জন্য আমাদের সম্বল প্রতিবিম্ব। তা স্থির জল হতে পারে, আয়না হতে পারে, বা অন্য কোনও মানুষও হতে পারে। অথবা কোনও ফোটো, নয়ত হাতে আঁকা ছবি। আমার সামনে তেমন কিছু নেই, এমন কি আয়নাও নেই আমার ঘরে― অফিসের ঘরে বা বস্তির ঘরে। একটা আয়না অবশ্য আছে, সেটা তিনতলার টয়লেটে, মেয়েদের টয়লেটে, যে টয়লেটটা একাই ব্যবহার করছি কারণ তিনতলায় আর কোনও মেয়ে নেই আমায় বাদ দিলে। আরও দুজন মেয়ে যারা কাজ করে এই অফিসে, তারা দোতলায়। টয়লেটের আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বকে খুঁটিয়ে দেখে গাম্ভীর্যটুকু খুঁজবার সময় পেয়ে উঠিনি। সেখানে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে সেজে গুজে বিদেশি সওদাগরি অফিসের কনিষ্ঠ কেরাণী, কীরকম ক্লিশে শোনাচ্ছে যদিও, তবুও, সেটাই আমায় হয়ে উঠতে হয়। নাঃ গাম্ভীর্য আমার নেই। সুরঞ্জনাকে ওরা ম্যাডাম ম্যাডাম করে ডাকে, দরকারের চেয়ে বেশি কথা একটাও বলে না। আমার সঙ্গে এন্তার হাসি মস্করা করছে, এমনকি পার্থবাবুও আমাকে কত রসালো গল্প শোনান কোনও ভদ্রতার তোয়াক্কা না করেই, সেসব গল্প এই হলদে বাড়িটার পুরোনো সব ঘটনা। সে সব গল্পে সায়েব আছে, মেম আছে, আছে তাদের অদ্ভুত অদ্ভুত সব কাণ্ডকারখানার বিবরণ, যে বিবরণের অনেকটাই হয়ত পার্থবাবুর মনগড়া, শুনলেই বোঝা যায়, কিন্তু বলবার সময় বাধা দিতে নেই, তাতে রসভঙ্গ ঘটে।
    রিসেপশনের ঠিক উল্টোদিকে একটা বন্ধ দরজা ছিল, সেই দরজার ওপারে আসলে একটা মস্ত হলঘর, যাকে এরা মিটিং রুম বলত। ঐ ঘর খুলিয়ে এয়ার কন্ডিশনার চালিয়ে সুরঞ্জনা ও আমি গল্প করতাম। আড়াই ঘন্টা কি কখনও আরও লম্বা লাঞ্চব্রেক, আমাদের ঘুম পেয়ে যেত। সারাটা মেঝে জুড়ে মখমলের পুরু কার্পেট পাতা। আমরা সটান ঐ কার্পেটের ওপরে ঘুমিয়ে পড়তাম। ড্রাইভারদের আগে থেকেই বলা থাকত। সায়েবদের গাড়ি ঢুকছে জানতে পারলেই যেন আমাদের সতর্ক করে দেয়।
    এমনই একটা দিনে একটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার ঘটে গেল। সেদিন শনিবার ছিল না। শনিবার মানেই হাফছুটির দিন। শনিবার তো ঐ ঘরে গিয়ে মখমলের ওপর শুয়ে শুয়ে গল্প করবার দিন হতে পারে না। অথচ সেদিন কোনও কারনে ইস্কুল ছুটি ছিল, যা আমি জানতে পারি নি। সবে আমরা ঐ ঘরে ঢুকে এয়ার কন্ডিশনার চালিয়ে মস্ত টেবিলটার নীচে লুকিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে গল্প শুরু করেছি, দরজায় টোকা না দিয়েই পাল্লাদুটো কে যেন খুলে দিল। আমরা দুজন হুড়মুড়িয়ে টেবিলের নীচে আরও একটু ভেতরে সরে গেলাম। ঘরের মধ্যে কেউ ঢুকেছে। যে ঢুকেছে সে তো বুঝতেই পারছে যে ঘরে আলো না জ্বললেও এয়ারকন্ডিশনার চলছে। একজন নয়, একাধিক ব্যক্তি ঢুকেছে ঐ ঘরে। টেবিলের তলা থেকে দেখতে পাচ্ছি বাইরে থেকে যে আলোটুকু আসছে তাতে গোটা চারেক পায়ের সিলুয়েত। অন্তত দুজন মানুষ। তারা নিজেদের মধ্যে কোনও কথা না বলে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আছে হয়ত, হয়ত আমাদের খুঁজছে। হঠাৎ ঘরের লাইট জ্বালিয়ে দিল। অর্থাৎ এবার আমরা ধরা পড়ে যাব। আর পালানোর কোনও পথ খোলা নেই। আমি সেই চারটে পা একটু ভালো করে দেখলাম টেবিলের তলা থেকে। দুটো পা একজন ফুলপ্যান্ট পরা ব্যক্তির। অন্য দুটো পায়ে ফুলপ্যান্ট নেই, সরু সরু পা হাঁটু অবধি দেখা যাচ্ছে, দেখে মনে হয় কোনও শিশু হতে পারে। হ্যাঁ শিশুই। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে শিশুটি টেবিলের তলায় উঁকি মেরে আমাদের দেখতে পেয়ে গেল। সেই সঙ্গে ফুলপ্যান্টও টেবিলের নীচে উঁকি দিয়ে বলল― ওঃ তাই বলুন আপনারা টেবিলের তলায়! অত ভেতরে ঢুকে বসেছেন কেন, কেউ যদি দেখতে না পেয়ে বাইরে তালা মেরে দিয়ে চলে যেত!
    চন্দ্রশেখরদা। আমাদের অফিসের ড্রাইভার। সঙ্গের শিশুটিকে দেখে আমার হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাবার জোগাড়। তার হাতে একটা মস্ত ঠোঙা, সম্ভবত ফলের। সে ঠোঙা হাতে টেবিলের নীচে ঢুকে পড়ছে, আলোটা জ্বালিয়ে রেখেই চন্দ্রশেখরদা চলে গেল দরজা ভেজিয়ে দিয়ে। শিশুটি ফলের ঠোঙা নিয়ে আমাদের থেকে একটু তফাতে বসে বলল― নাও, আম খাবে?
    একটা আম সে ঠোঙা থেকে বের করেছে। আমি তার দিকে চেয়ে সুরঞ্জনাকে দেখিয়ে বলি, দাও, এই মাসীকে দাও।
    সুরঞ্জনাও আমাকে নকল করে অবিকল আমার মত করে বলে ওঠে, না না, আমাকে নয়, ঐ মাসীকে দাও।
    শিশুটি হতবম্ব হয় একটু, তার পরে খল খল করে হেসে সুরঞ্জনাকে বলে, মাসী নয়, মাসী নয়, ওটা তো আমার মা।
     
    (চলবে)
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:5195:1112:5618:e0b3 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৭:০৪735618
  • দুই
    সন্ধের অন্ধকারে ঠিক খেয়াল করতে পারিনি চুপচাপ একটা গাড়ি ফুটপাথের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে। দেখতে পাবার কথাও নয়। হলদে বাড়ির সদর দরজা থেকে বেরিয়ে আমার ডান দিক ধরে হাঁটার কথা। গাড়িটা দাঁড়িয়ে ছিল বাঁ দিকে। মধ্য-জুনের সন্ধেয় আমি হাঁটতে শুরু করে দিয়েছি আমার আস্তানার দিকে। খানিকটা সোজা হেঁটে বেলতলার দিকে ঘুরে আরও কিছুক্ষণ হাঁটব। হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে যখন খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়ব, তখন বাড়ি ফিরবার এক তৃতীয়াংশ কি আরও বেশি রাস্তা পেরিয়ে এসেছি। ততক্ষণে সন্ধে বাড়তে বাড়তে রাত হয়ে যায়, বাসে ভিড় কমে যায়, আমি চেষ্টা করি আঠেরোর বি বাসটা ধরতে। আমার বাড়ি থেকে অফিসের দূরত্ব মেরেকেটে পনের কিলোমিটার হবে, কিন্তু কলকাতার রাস্তায় এই দূরত্ব বাসে ট্রামে অতিক্রম করতে দেড় থেকে দুঘন্টা লেগে যাবে। তার ওপর ভিড়ের বাসে উঠতে আমার খুব কষ্ট হয়, দম বন্ধ লাগে, ভিড়ের সুযোগে গায়ের বিভিন্ন জায়গায় হাত দেয় কিছু লোক। এই ধরণের অসভ্যতা নতুন কিছু নয় কলকাতার ট্রামে বাসে মেট্রোয়, ছোটবেলা থেকেই এসবে আমরা অভ্যস্থ। কিন্তু মধ্যিখানের ঐ দশটা বছরের অনভ্যাসের পর এখন ভিড়ের বাসে যৌন হেনস্থা সহ্য করতে ওপারি না। এক একটা রাস্তায় এমন ট্র্যাফিক জ্যাম, আর বাস তো শর্টকাট মেনে চলে না, সে সারা দুনিয়া ঘুরে সব স্টপে দাঁড়িয়ে প্যাসেঞ্জার নামিয়ে উঠিয়ে নিজের রুটে চলে। তার ওপর বড্ড ট্র্যাফিক জ্যাম থাকে এই অফিস টাইমে। এ একটা সুবিধে হয়েছে বটে, নতুন রুট অনেকেই জানে না, অন্য বাসের তুলনায় আঠেরোর বি তে ভিড় কম হয় এবং আমার ঘরের খুব কাছে পৌঁছে দিয়ে যায়। ষষ্ঠির মোড়ে।
    এই ষষ্ঠির মোড় যার নামে তাকে আমি চিনি। না, এটা পার্থবাবুর রং চড়ানো সায়েব-মেমের রসালো গল্প নয়, এ একেবারে সত্যিকারের ঘটনা। এ পাড়ায় যখন প্রথম থাকতে আসি, মোড়ের মাথায় ছিল ষষ্ঠির চায়ের দোকান। মধ্যবয়সী লোক সে, খুব মন দিয়ে চা বানাত। সকালে সন্ধেয় পাড়ার লোকে তার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে কাচের গ্লাসে চা নিয়ে আড্ডা মেরেছে। সত্যনারায়ন পল্লীর মুখটায় তার দোকান, দোকানের উল্টোফুটে একটা ইলেকট্রিকের দোকান যেখানে তখনও গরম কালে ইলেকট্রিক ফ্যান ভাড়ায় পাওয়া যেত।
    ও পাড়ার ধারে কাছেও বাসের রাস্তা ছিল না। বাস ধরতে হলে অনেক হেঁটে বা ছটাকা রিক্সা ভাড়া দিয়ে শিলপাড়া অবধি যেতেই হবে, শিলপাড়া বলতে ডায়মন্ড হারবার রোড। ঐ রোডেই যত বাস। অটো রিক্সাও আসত না এদিকে। তা হঠাৎ শুনি নতুন বাসরুট চালু হচ্ছে, খুব ঘটা করে এক রবিবার নাকি ষষ্ঠির দোকানের সামনে থেকে মাইক টাইক বাজিয়ে নতুন বাসরুটের উদ্বোধনও হয়ে গেল। এটাই লাস্ট স্টপ, মানে টার্মিনাস। বাসের ওপরে পরিষ্কার লেখা ― ষষ্ঠির মোড়। কে বলেছে যে বিখ্যাত হতে গেলে মস্ত মস্ত কাজ করতে হবে জীবনে? জ্বলজ্যান্ত ষষ্ঠি চা বানাতে বানাতে দেখতে পায় তার নামে বাস টার্মিনাস। আরও মন দিয়ে চা বানায় সে। তার চেহারাতেও আজকাল দেখা যাচ্ছে গাম্ভীর্য। লীভিং লেজেন্ড সম্ভবত একেই বলে।
    সেদিনও আমি ডানদিক ধরে হাঁটছিলাম, রাস্তা সব মুখস্থ হয়ে গিয়েছে একরকম। দশ বারো পা যেতে না যেতেই কে যেন ডাকল আমার নাম ধরে। একেবারে নির্ভুল উচ্চারণে। আবার ডাকল। আমি পেছন ফিরে তাকাতে এবার দেখতে পেলাম সেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা ফিয়াট গাড়িটাকে। একটা সেকেন্ড কি থার্ড বা ফোর্থ হ্যান্ড ফিয়াট, মেরুন রঙের। এই মেরুন ফিয়াট আমি চিনি। আর যে আমার নাম ধরে ডাকছে, তাকে আমি বিলক্ষণ চিনি। 
    আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সে নির্ভীক সাবলীল ভঙ্গিমায় গটগট করে এগিয়ে এল কয়েক পা। সপ্রতিভ ভঙ্গিমায় জিজ্ঞেস করল, হেই ইয়ু ওয়র্ক হিয়ার? ইয়ু ডিডন্ট টেল মি!
    আমি ঠাওর করে পড়তে চেষ্টা করি তার চোখ মুখের ভাবসাব। যেন কত দিনের চেনা, যেন কতকালের পুরোনো বন্ধু, এমনি ভাবে কথা বলছে সে। মিস্টার ভৈশ। আমার পুরোনো এমপ্লয়ার। এর ট্র্যাভেলিং এজেন্সীতে আমি কাজ করেছি একমাসের কিছু বেশি। মাইনে দেয় নি আমায়, ঠকিয়েছে। এ আমাকে হোটেলের ঘরে নিয়ে গেছল বদ মতলবে, সেখান থেকে অতি কষ্টে পালিয়েছি। তার পর আর ওমুখো হই নি। লোকটা আমাকে খুঁজে বের করল কেমন করে? সবে দেড়মাস হল এর কবল থেকে পালিয়ে নতুন চাকরি নিয়েছি, এ জানলই বা কী করে  কোথায় আমার অফিস, কখন আমি অফিস থেকে বের হই?
    ভৈশ বলল, কাম, আই উইল গিভ ইয়ু অ্যা লিফ্ট, কাম অন, ...
    সে ফিয়াটের দরজা খুলতে এগিয়ে যায়। যেন ধরেই রেখেছে ওর সঙ্গে এখন আমি গাড়িতে উঠব। হলদে বাড়ির সদর দরজা বন্ধ প্রায়, আমি জানি এখন ড্রাইভারেরা কেউ নেই সকলে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেছে সায়েবদের বাড়ি পৌঁছে দিতে, চট করে ফিরবে না কেউ। সায়েবরা বাড়ি ফিরে হয়ত শপিং এ যাবে, নয় ক্লাবে, রেস্টুরেন্টে, বারে। ড্রাইভারদের ছুটি হতে হতে মাঝরাত হয়ে যায়। এটা আমার অফিস, আমার নিজের এলাকা, কিন্তু চেনা লোকগুলো এখন কাছাকাছি নেই।
    রাস্তার উল্টোফুটে একজন ধুতিপরা লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে, এই কোম্পানীর মালি। রাতকানা। ওকে ডাকব?
    ঠিক এমনি সময়ে হুড়মুড় করে একটা ট্যাক্সি এসে দাঁড়ায় গেটের কাছে। মেরুন ফিয়াট ও মিস্টার ভৈশকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে সেই ট্যাক্সি থেকে বেরিয়ে আসে দুই যুবক এবং সুরঞ্জনা। কিছু একটা ভুলে ফেলে গিয়েছে সে রিসেপশানে, সম্ভবত টিফিন বক্স। আমাকে দেখে সুরঞ্জনা বলে, তুই এখন বেরোচ্ছিস? দাঁড়া, আমাদের সঙ্গে যাবি?
    দৌড়ে ভেতরে গিয়ে টিফিন বক্স নিয়ে এসে সে আমায় প্রায় ঠেলে ঢুকিয়ে নেয় ট্যাক্সিতে। মেরুন ফিয়াট ও ভৈশকে ফেলে রেখে ট্যাক্সিতে উঠতে উঠতে আমার মনে পড়ে একটা কবিতার লাইনঃ
    অইখানে যেয়োনাকো তুমি, বোলোনাকো কথা অই যুবকের সাথে
    সুরঞ্জনা আমায় আলাপ করিয়ে দেয় সেই যুবকদের সঙ্গে, ওরা সবাই মিলে চলেছে এখন পার্ক স্ট্রীট, সিলভার গ্রিল রেস্টুরেন্ট। আমিও রয়েছি সঙ্গে।
    সিলভার গ্রিলের সামনে ট্যাক্সি থেকে নেমে যুবকদ্বয় ভাড়া মেটালো, আমরা মেয়ে, আমাদের ওরা ট্যাক্সিভাড়া শেয়ার করতে দেবে না, ওরা দুজনেই সুরঞ্জনার বন্ধু, একজনকে মনে হচ্ছে ওর প্রেমিক হলেও হতে পারে। রেস্টুরেন্টের সামনেটায় দাঁড়িয়ে মনে হল ঠিক এখানে আগে কখনও এসেছি, অথচ তখন এখানে এই রেস্টুরেন্টটা ছিল না। ওরা গটগটিয়ে ভেতরে ঢুকে যায়, আমি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে মনে করতে চেষ্টা করি কী ছিল এখানে আগে। কিছু একটা স্মৃতি যেন আছে এই অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশের ছেদবিন্দুতে। এখন ১৯৯৬র জুন, তা প্রায় উনিশ বছর আগে এখানে এই রেস্টুরেন্ট বার ছিল না, তখন সবেমাত্র তৈরী হচ্ছিল একটা স্ন্যাকবার, একতলায়। ১৯৭৭ এর গ্রীষ্মে তখন শৈশব থেকে কৈশোরের পথে চলেছি, একটা দুপুরে, সেই সদ্য তৈরী হওয়া স্ন্যাকবারের সামনে মাথা ঘুরে পড়ে গেছলাম। তখন আমার বাবা মৃত, মায়ের সঙ্গে গরমের ছুটিতে মিডলটন রো এর একটা সরকারি অফিসে দুইবোনে এসেছিলাম। খুব ঘোরাচ্ছিল সেই অফিসের লোকজন, বাবার সাকসেশন সার্টিফিকেটের কাগজপত্র কিছুতেই এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে সরছিল না। ঘুষ চাইছিল তারা আভাসে ইঙ্গিতে। বাবার মৃত্যুর পর এক বছরের ওপর কেটে গিয়েছিল এইরকম ঘুরতে ঘুরতে। এখন এই সিলভার গ্রিল যেখানে সেইদিন তার সামনে হঠাৎ মাথা ঘুরে চোখে অন্ধকার দেখেছিলাম কয়েক সেকেন্ডের জন্য। স্ন্যাকবারের দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছিল এক যুবক। তার বয়স তখন হয়ত বিশ বাইশ কি চব্বিশ হবে। সে সেই স্ন্যাকবারে কাউন্টারে কাজ করত। কোনও এয়ারকন্ডিশনার লাগেনি তখনও সেখানে। একদম নতুন আসবাব পত্র, নতুন রঙের গন্ধ পর্যন্ত টের পাওয়া যাচ্ছিল। কোনও বসবার ব্যবস্থা ছিল না, তবু সেই যুবক কোত্থেকে যেন একটা লোহার ফোল্ডিং চেয়ার এনে আমায় বসতে দিয়েছিল, দাঁড়ানো ফ্যানটা ঘুরিয়ে দিয়েছিল আমার দিকে, চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিয়েছিল, আর হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল সদ্য ছিপি খোলা এক বোতল গোল্ড স্পট। সব ছবির মত স্পষ্ট। গোল্ড স্পটটা ঠান্ডা ছিল না তা পর্যন্ত মনে আছে। প্রথম দিকে দাম পর্যন্ত নিতে চায় নি, মা জোর করে দাম দিয়েছিল, সম্ভবত কয়েকটা প্যাটিশ কিনেছিল। ছেলেটা ঐ সময়ের মধ্যেই খুব গল্প করছিল মায়ের সঙ্গে, বলছিল এই স্ন্যাকবারের চাকরিটুকু তার জীবনের স্ট্রাগলিং পিরিয়ডের একটা অংশ মাত্র, আসলে তো সে গায়ক হতে চায়, মানে নাম করা গায়ক। বিভিন্ন ফাংশানে গান করছে নিয়মিত, সবই মহম্মদ রফি আর মুকেশের গাওয়া গান। রোজ ঘন্টার পর ঘন্টা রেওয়াজ করে। কোনও টিচারের কাছে তালিম নেয় নি, নিজে নিজেই শুনে শুনে গান শিখেছে, মহম্মদ রফিকে মনে মনে গুরু মানে। বলছিল রেডিওতে গান গাইতে চায়, অডিশন দেবার ইচ্ছে আছে, চেনাশোনা কেউ আছে নাকি আমাদের আকাশবাণীতে সেসব প্রশ্নও করছিল। বেশ মনে আছে সে তার নাম বলেছিল হাবিব। 
    উনিশ বছর কেটে গিয়েছে, আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছিল সেই হাবিব এখন কী করে, সে কি একলব্যের মত নিষ্ঠায় যা শিখতে চেয়েছিল তাতে পারঙ্গম হয়ে উঠেছে? সত্যিই নামকরা গায়ক হয়ে গেছে এতদিনে, নাকি এখনও এখানেই কাজ করছে? সুরঞ্জনা আমার হাতে ধরে টেনে ভেতরে নিয়ে যায়, সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে উঠতে জিজ্ঞেস করে, তোর কোনও প্রবলেম নেই তো বারে বসতে? 
    আমি ভাবি কাকে জিজ্ঞেস করব হাবিবের কথা, উনিশ বছর পরে তার বয়স নিশ্চয় চল্লিশ পেরিয়ে গিয়েছে, চেহারাটাও ভালো করে মনে নেই, এই সিলভার গ্রিলের ওয়েটারদের জিজ্ঞেস করলে তারা কি কিছু বলতে পারবে?
    সুরঞ্জনা ওর বন্ধুদের কাছে আমার সম্পর্কে আগে কিছু বলেছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না, অন্তত ওদের হাবে ভাবে স্পষ্ট করে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। ওরা ড্রিংক করবে বলে এসেছে। ড্রিংক করবে মানে হার্ড ড্রিংক্স, যথা হুইস্কি, রাম, বা ভোদকা। কিছু একটা স্ন্যাক্স জাতীয় খাবারের অর্ডার দিয়েছে, যেটাকে বলা হয় স্টার্টার। আমি এই গরমে মদ খাব না। ওরা পেড়াপিড়ি করেনি, না খেলে খরচ কম সেটুকু বোঝে। 
    খেয়াল হল জীবনে কত পরিবর্তন ঘটছে দ্রুত। কদিন আগে আম নিয়ে আমার মেয়ে এসেছিল। সে মেঘের ওপরে যাবার টানে টানে এসেছে, তার মানে আমি ছলা কলা করে সফল হয়েছি তার মন ভোলাতে। সে আবারও আসতে চায়, সামনের মাসে তার জন্মদিন, জন্মদিনের উপহারও বায়না করে রেখেছে আমার কাছে, ডাকব্যাকের স্কুলব্যাগ, নীল রঙের। দেব। নিশ্চয় কিনে দেব। এখন তো আমার কাছে টাকা আছে। আড়াইশো টাকা দাম ঐ ব্যাগের, অনায়াসে কেনা যায়। কিন্তু ভৈশ লোকটা কী করে আমার হদিস পেল? কী চায় ও?
    সুরঞ্জনা তার প্রেমিকের সঙ্গে গল্পে মজে রয়েছে, হুইস্কি খাচ্ছে আর খুব হাসছে। অন্য যুবক আমার দিকে একটু ঘেঁষে এসে বসল, ফ্লার্ট করবার চেষ্টা চালাচ্ছে, তবে আমাদের কথা বলবার কোনও টপিক নেই। একটা প্লেটে কিছু সল্টেড বাদাম, আর একটা প্লেটে কাবাব জাতীয় কিছু দিয়ে গেছে।
    আমাদের পাশের টেবিল থেকে একজন মহিলা উঠে গেল ভ্যানিটি ব্যাগ নিয়ে টয়লেটের দিকে, সেখানে একজন লোক বসে রইল, সুরঞ্জনার প্রেমিক সেদিকে দেখিয়ে কুইজ মাস্টারের স্টাইলে প্রশ্ন করল― ঐ দুজনের মধ্যে সম্পর্ক কী বলত, হাজবেন্ড ওয়াইফ না অন্য কিছু? সুরঞ্জনা ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে রয়েছে, কিছু বলছে না। প্রেমিক নিজেই উত্তর দিয়ে দেয় কুইজের, এরা স্বামী-স্ত্রী নয়, স্বামী-স্ত্রী হলে ঐ মহিলা ভ্যানিটি ব্যাগ রেখে টয়লেটে যেত। এবার সুরঞ্জনা আরম্ভ করে দিল ও টয়লেটে গেলে ভ্যানিটি ব্যাগ রেখে যাবে, না সঙ্গে করে নিয়ে যাবে। ওর মনে হয় নেশা হতে শুরু করেছে।
    আমার গা ঘেঁষে বসা যুবক জানতে চাইছে আমি কোন দিকে থাকি, আমায় ড্রপ করে দেবে কিনা বাড়ি অবধি, এইসব টুকটাক কথা। আমি সম্ভবত প্লেট থেকে তুলে তুলে কিছু খাচ্ছি, অভ্যাসের মত, কী খাচ্ছি নিজেই জানি না।
     
    (চলবে)
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:5195:1112:5618:e0b3 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৭:০৬735619
  • তিন
    চাকরিতে জয়েন করবার প্রথম দিনে, প্রথম যে চিঠিটা আমায় টাইপ করতে দিয়েছিল, যেটা ছিল ড্রাইভারদের লিডারকে বরখাস্ত করবার ফিরিস্তিতে ভরা, সেই চিঠির জোরেই চাকরি চলে গেছল কেরেনকভের। তাকে আর অফিস তল্লাটে বিশেষ দেখা যায় নি, তার বউ অবশ্য অনেক উচ্চপদস্থ কর্মচারি, ক্যাশিয়ার। কেরেনকভ এর পরে মস্কোয় ফিরে গেছে না কলকাতাতেই রয়ে গেছে বউয়ের সঙ্গে সে নিয়ে কখনও ভাববার সময় পাই নি, কিন্তু কেরেনকভের বউ কেরেনকভা একদিন সকালে হাসিমুখে ঘরে ঘরে ঢুকে আলাপ করিয়ে দিতে লাগল নতুন এক কর্মচারির সঙ্গে, তার নাম আলেক্সেই, সংক্ষেপে আলিওশা। আলিওশা বিশাল মোটা প্রায় হোঁৎকা গোছের, হাসিখুশি দেখতে এবং সব সময় দরদর করে ঘামছে। সে এসেছে কেরেনকভের পোস্টে। এক বর্ণও ইংরিজি জানে না, প্রথম আলাপেই সে জানতে চাইল বিয়ার কোথায় পাওয়া যাবে।
    সাশা, আলিওশা, আমি ― আমরা প্রায় সমবয়সী। দুই এক দিনের মধ্যেই আলিওশা টলিক্লাবের মেম্বারশিপের আবেদনপত্র ফিল-আপ করে ফেলল সাশার সহযোগিতায়।
    শুধু আলিওশা নয়, এসেছে আরও দুজন মানুষ, চিফ অ্যাকাউন্টেন্ট লবানভ, সঙ্গে তার তিন চার মাস আগের বিয়ে করা বউ। বউটি ভারতীয়, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। এরা দুজনেই আগে এ অফিসে কাজ করেছে, এখানে কাজ করতে করতেই দুজনের মধ্যে প্রেম হয়, তারপরে ওরা মস্কো চলে গিয়েছিল, সেখানেই বিয়ে হানিমুন ইত্যাদি সেরে চারমাস পরে জয়েন করেছে কলকাতার অফিসে। লবানভের বউকে এখন লবানভা বলেই সকলে উল্লেখ করছে। আগে সে ছিল আমার পোস্টে, এখন ফিরে এসে আমাকে তার জায়গায় বসে থাকতে দেখে সে অসন্তুষ্ট হয়ে রেগে মেগে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
    এইবারে আমি একটু ঘাবড়েছি। তাহলে কি এরা আমায় বরখাস্ত করে দেবে? আসল লোক যখন ফিরেই এসেছে তখন একজন অতিরিক্ত কর্মচারিকে মাসে মাসে চার হাজার টাকা দিয়ে এরা কি আর পুষতে চাইবে? অর্থাৎ যে কোনও মুহূর্তে আমার চাকরি নট হয়ে যেতে পারে। আমি কিছুদিন যাবদ একটা কম্পিউটার পেয়েছি, একটা নতুন বড় ঘরে আর তিনজন লোকের সঙ্গে বসে কাজ করি, আমার বসবার জায়গার পেছনেই আছে একটা দরজা, সেই দরজা দিয়ে একটা ছোট্ট ঘরে যাওয়া যায়― ফোটোকপি মেশিন আছে সেই ঘরে, দিনের অনেকটা সময় ফোটোকপি করতে করতে কেটে যায়, আমি ফোটোকপি রুমে ঢুকে একটু একা হয়ে ভাবতে আরম্ভ করলাম এখন কী আমার কর্তব্য, কীভাবে চাকরিটা বাঁচাব? সোজা মেজসায়েবের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করব কি? নাকি ধৈর্য ধরব এরা কী সিদ্ধান্ত নেয় তার অপেক্ষায়? কারও সঙ্গে একটু আলোচনা করতে পারলে ভাল হয়, বিশ্বস্ত কেউ, যেমন সাশা। সাশার সঙ্গে আমি কত গল্প করি, সাশাকে আমি বিশ্বাস করি, কিন্তু সাশা নেই অফিসে, অপেক্ষা করতে হবে। সমস্ত উদ্বেগ চেপে রেখে কম্পিউটারের সামনে বসে রাশিয়ান টেকস্ট এডিটর লেক্সিকন দিয়ে টাইপ করতে থাকি চিঠি, একটার পর আরেকটা। আমায় যেমন এরা একটা কম্পিউটার দিয়েছে, বড়সায়েবের সেক্রেটারিরও আছে আর একটা কম্পিউটার। ব্যস এই দুটো ই। সারা অফিসে এই দুটো ছাড়া আর কোনও কম্পিউটার নেই কারণ আমরা দুজন ছাড়া আর কারওকে চিঠি টাইপ করতে হয় না। হিসেব টিশেবের ব্যাপার সব কাগজে কলমে, সেসবে কম্পিউটারের কোনও ভূমিকা নেই।
    সাশা অফিসে ঢুকল প্রায় এগারোটা সাড়ে এগারোটা নাগাদ। সঙ্গে মস্ত সব প্যাকেট, তাতে রয়েছে হরেক রকমের অফিস স্টেশনারি, ডটপেন, পোস্ট-ইট স্টিকার, সুন্দর সুন্দর ডিজাইনের ইরেজার, পেন্সিল, পেপারওয়েট, এক গাদা লোভনীয় জিনিস। ও নিজের টেবিলে বসে সব জিনিস বের করে করে কয়েকটা ভাগে জড়ো করে করে রাখল। এগুলো কিছু কিছু যাবে বড়সায়েবের ঘরে, কিছু মেজসায়েবের ঘরে, কিছু চীফ অ্যাকাউন্টেন্টের জন্য, বাকি অন্যান্যরা ভাগাভাগি করে নেবে নিজেদের প্রয়োজন মত। সাশা কেনাকাটির রসিদগুলো একের পর এক গুছিয়ে একটা কাগজে মোট খরচের যোগফলটা লিখে নেয়, তারপর শার্টের বুকপকেট থেকে টাকা পয়সা বের করে হিসেব করে। আমি ওর পাশে দাঁড়িয়ে সব দেখছি। ওর কাজ হয়ে গেলে আমার সমস্যার কথাটা বলব বলে অপেক্ষায় রয়েছি। সব হিসেব টিসেব করে সাশা বাংলায় বলে, প্রায় সাতশো টাকা লাভ করলাম। আমি ওর দিকে চেয়ে আছি দেখে বুঝিয়ে দেয় যে দোকানদারদের থেকে বেশি বেশি অঙ্কের রশিদ লিখিয়ে এনেছে। এখন সাতশো টাকার মত ওর নিজের পকেটে ঢুকে যাবে। আর কিছুদিন পরে ও বেনারস যাবে, ট্রেনের টিকিটের খরচ অনেকটাই উঠে আসবে এই টাকা থেকে।
    ―বেনারস যাবে তুমি বেড়াতে?
    ― বেড়াতে নয়, আমি অনেকবার গেছি ওখানে। ওখানে আমার গুরু আছে। 
    ―হ্যাঁ, তুমি বলেছিলে, সেই কাপালিক না কী যেন...
    ―তান্ত্রিক!
    সাশা আমায় কারেক্ট করে দেয়।
    ―সাশা শোন, আমার একটা কথা বলবার ছিল। যে মেয়েটি আগে আমার পোস্টে চাকরি করত, সে ফিরে এসেছে জানো?
    ―হ্যাঁ জানি তো, আমরা তো সবাই আলিপুর রোডে একটা বাড়িতেই থাকি। ওরা কাল এসেছে।
    ―তাহলে কি আমার চাকরি থাকবে না?
    ―তোমাকে বলেছে কি যে চাকরি থেকে বাদ দিয়ে দেবে?
    ―এখনও বলেনি।
    ―তাহলে ভাবছ কেন? তবে তোমাকে বাদ দেবে না। চীফ অ্যাকাউন্টেন্টের বৌকে দিয়ে তোমার বস সেক্রেটারির কাজ করাতে পারবে না। ও কি আগের মত কাজ এখন করতে চায়? ওর বর খুশি থাকবে না। চুপ করে দেখে নাও কী করছে ওরা। ও রাশিয়ানও লিখতে কি বলতে পারে না। শুধু ইংরাজি পারে, বাংলাও বলতে পারে না। ওকে দিয়ে তোমার কাজ করাবে না।
    একটু ভরসা পেলাম ওর কথা শুনে। সত্যিই তো, মাত্র চার হাজার টাকার জন্য কি চীফ অ্যাকাউন্টেন্টের বউ সারাটা দিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফোটোকপি করবে, ঘরে ঘরে টাইপ করা চিঠি পৌঁছে দেবে, ডিক্টেশন নেবে? সবার জন্য চা বানিয়ে ঘরে ঘরে চায়ের কাপ পৌঁছে দিতে গেলে চীফ অ্যাকাউন্টেন্টের মান থাকবে? লবানভাকে দেখে তো মনে হল খুবই গর্বিত সে, বিয়ের পর নিশ্চয় সে পদোন্নতি আশা করে, এরা সব জেনে বুঝে হিসেব করেই আমায় কাজে নিয়েছে।
    সাশা ট্র্যাভেল এজেন্সিকে ফোন করে বেনারসের হোটেল বুকিংএর জন্য। একটু পরে হাসতে হাসতে আমায় বলে, কী নামে হোটেল বুকিং হল জানো? আলোক সুন্দর। আমি বলছি আমার নাম আলেকসান্দর, ওদিকে লোকটা বলছে, হ্যাঁ হ্যাঁ বুঝেছি আলোক সুন্দর। আবার বলছি আলেকসান্দর আলেকসান্দর। তখন লোকটা বলছে ঠিক আছে স্যার লিখে রেখেছি আলোক সুন্দর। হা হা আলোক সুন্দর। আমি হিন্দু। এটা আমার হিন্দু নাম। ভালো নাম।
     
    (চলবে)
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:5195:1112:5618:e0b3 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৭:০৭735620
  • চার

    যে কোনও আলোচনায় সেক্স টেনে আনা পার্থবাবুর অবসেশন। এটা ক্রমাগত লক্ষ্য করেছি যে আলোচনাগুলো একটু পরে পরেই রসালো হতে হতে আদিরসকে ছুঁয়ে ফেলে। পর দিন অফিসে এসে সিঁড়িতে উঠবার আগেই বাঁ হাতের ঘরটায় দেখলাম দরজা রোজকার মত খোলা এবং উনি টেবিলের ওপর ঝুঁকে খাতাপত্র খুলে হিসেব টিসেব নিয়ে ব্যস্ত। কয়েক ধাপ উঠে গেছি ওপরে, ডাক পড়ল― আরে কী খবর, হন হন করে কোথায় চললেন, সায়েবদের আসতে ঢের দেরি আছে, আসুন আসুন একটু গল্পগুজব করি।
    লবানভ দম্পতির ফিরে আসার খবর পার্থবাবুর কানে এর মধ্যেই পৌঁছে গেছে। উনি এই বাড়িটাকে অনেক বছর ধরে চেনেন, সেই সোভিয়েত জমানা থেকে। তখন এটা ছিল ইনফরমেশন সেন্টার। ১৯৯১ এ যখন দেশটা টুকরো টুকরো হয়ে গেল, রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটল, ইনফরমেশন সেন্টারের প্রয়োজনীয়তা রইল না। সমাজতন্ত্রের মুখপত্র প্রোপাগান্ডামূলক পত্রিকাগুলো বন্ধ হয়ে গেল দুনিয়ার সব জায়গা থেকে। সোভিয়েত দেশ, সোভিয়েত নারী, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ইত্যাদি― ঝকঝকে মলাট, দামি কাগজ, ভেতরে সুন্দর সুন্দর ছবি ও লেখা, কখনও যৌথ-খামারের ছবি, হাসিখুশি কৃষক, ট্র্যাডিশনাল পোশাক পরা প্রাণবন্ত সোভিয়েত রমণী, কিংবা নীল আকাশের পটভূমিকায় শস্যের স্তূপ ও ট্র্যাকটর, কখনও বলিষ্ঠ শ্রমিকের ঝকঝকে হাসিমুখ। পৃথিবীর প্রায় সমস্ত ভাষাতেই প্রকাশিত হতো এই পত্রিকাগুলি, বলতে গেলে প্রায় বিনামূল্যেই পৌঁছে যেত পাঠকের কাছে। কিন্তু এই সমস্ত প্রকাশনার পেছনে ছিল বিরাট ব্যয়ভার। উনি সে সব ঘটনার সাক্ষী। এখন ভাড়া দেওয়া হয়েছে আধাসরকারি একটা বিদেশি কোম্পানীকে, তাও পুরো বাড়িটা তারা ব্যবহার করে উঠতে পারছে না। হলদে বাড়ির পেছনে বড় বড় গাছ আছে, সেই গাছগুলোর আড়াল থেকে দেখা যায় আর একটা বাড়ি, সেই বাড়িটা ছিল আগের জমানায় সায়েবদের রেসিডেন্স। ইয়া বড় বড় আদ্যিকালের জানলা কাচের শার্সি দেওয়া। পার্থবাবু চশমার কাচ রুমাল দিয়ে পরিষ্কার করে মুছে নিয়ে চোখ বড় বড় করে বলতে থাকেন সেই জমানায় সায়েব-মেমদের ফষ্টিনষ্টির কাহিনি। 
    ―তখন বুঝলেন তো আমি বসতাম ওপরের একটা ঘরে। ঐ ঐদিকটায়, সিঁড়ি দিয়ে উঠেই বাঁহাতে। এখন আপনার বস যে ঘরটায় বসে, ওটা তখন আমার ঘর ছিল। তা একটা সায়েব ছিল হুমদো মত, তার আবার সবেতেই একটু বেশি বেশি।
    পার্থবাবু মুচকি হাসলেন।
    ―আমার ঘরের জানলা থেকে সায়েবের রেসিডেন্সের ড্রয়িং রুমটা পরিষ্কার দেখা যেত। সেই ঘরে ছিল মস্ত একটা পিয়ানো, পুরোনো দিনের দামি দামি ফার্নিচার, সবই তো ওদের সরকারি পয়সায় কেনা, ওরিজিনাল বার্মা টিক, ওসব আজকাল পয়সা ফেললেও পাওয়া যাবে না। তা একদিন দেখছি সায়েব সেই পিয়ানোর কাছে ঘুরঘুর করছে, আমার সঙ্গে আরও কোলিগ ছিল পাশে, আমরা সব জানলা দিয়ে মজাটা দেখছি। মোটামুটি আন্দাজ করে ফেলেছি এর পর কী হতে চলেছে। এসব বলতে গেলে নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা, সায়েব যখন তখন রেসিডেন্সে চলে যেত, ওদের তো লজ্জা শরম বলে কিছু নেই, মেমসায়েবকে নিয়ে ঐ টেবিলের কাছে গিয়ে, কী আর বলব আপনাকে, বুঝে নিন। তা সেদিন হয়েছে কি অত্যধিক বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে টেবিলটা নড়ে গেল, অমনি কাত হয়ে পড়ে গেল, আর পড়বি তো পড় সায়েবও পড়েছে টেবিলের সঙ্গে। এসব দেখে আমরা এখান থেকেই প্রায় ধর ধর করে উঠেছি, তবে সামলে নিলাম। ওয়েট করছি, এর পরে কী হয় দেখার জন্য। দু মিনিটের মধ্যে টেলিফোনে ডাক পড়েছে আমার, ― পার্তো, কাম হিয়ার! গিয়ে দেখি সায়েব ইনজিওর্ড, বেশ ভালোরকমেরই আহত, মাজায় চোট লেগেছে, টেবিলের পায়া একটা খুলে গিয়েছে, মেম সায়েবকে ঘটনাস্থলে দেখা যাচ্ছে না। কোনোমতে হাসি টাসি চেপে বললাম, এমন কী করে হলো! সায়েবতো ঢপ দিয়ে যাচ্ছে, টেবিল সরাতে গিয়ে নাকি টেবিলের ওপর চড়ে দেয়ালে ফোটো টাঙাতে গিয়ে এসব হয়েছে বলে যাচ্ছে। আমার তো কথা বাড়িয়ে লাভ নেই, সবই স্বচক্ষে দেখা, সায়েব যা বলছে মাথা হেঁট করে মেনে নিলাম। মিস্তিরি ডাকার ব্যবস্থা করলাম। তবে হ্যাঁ কথা শুনিয়ে এসেছিলাম, সায়েব এরপরে দেয়ালে কিছু টাঙাতে হলে খবর দিও, লোক পাঠিয়ে দেব। এরকম আরও কত গল্প আছে। ঐ যে কাল সাদা সায়েব কালো মেম নিয়ে ফিরল, ওদের গল্পটা জানেন তো? সেকি! জানেন না? ওদের ঘটকালি করেছে কে বলুন তো?
    ―কে? আপনি!
    ―আরে না না, আমি তুচ্ছ মানুষ, আমার কি বামন হয়ে চাঁদে হাত দেয়া মানায়?
    ―তবে কে?
    ―হুঁ হুঁ, পারলেন না তো? মিঠু। সহজ সরল ঘটকালি নয় এ। ঐ যে লবানভকে দেখলেন, খুব শান্ত শিষ্ট লেজ বিশিষ্ট চুপচাপ মিচকেপানা লোক। ওর তো আগের একটা বৌ ছিল এখানে।
    ―তাই?
    ―তবে আর বলছি কী আপনাকে? বৌ কাজকর্ম চাকরি বাকরি কিছু করত না, রাশিয়ান বৌ দিনরাত শপিং করে বেড়াত, ভাল ভাল রেস্টুরেন্টে খেত, খুব সুন্দর দেখতে ছিল সেই বৌ, এই কালোমেম তার ধারে কাছেও আসতে পারবে না। এদিকে মিঠু তক্কে তক্কে থাকত, হাড়বজ্জাত লোক ঐ মিঠু, এক নম্বরের শয়তান। তা সে তখন মেমসায়েবকে শপিং এ নিয়ে যায়, বেড়াতে নিয়ে যায়, হরদম ব্যস্ত। মেমসায়েব তো বাংলা জানে না, ইংরিজিতেও তথৈবচ, এদিকে মিঠু সুযোগ খুঁজছে। আস্তে আস্তে মেমসায়েবের সঙ্গে লটঘট শুরু হয়ে গেছে, মেমসায়েবও মিতু মিতু করে অজ্ঞান। এসব খবর তো চাপা থাকে না, একদিন সায়েব ওদের হাতেনাতে ধরে ফেলল।
    ―বলেন কি! হাতেনাতে? তারপর?
    ―তারপর আবার কী? ডিভোর্স। এই যে চারমাস ছিলো না, বিয়ে করতে চারমাস লাগে নাকি? প্রথমে আগের বৌটাকে ডিভোর্স দিয়েছে, তার পরে এই কালো মেম কে বিয়ে করেছে। এই মেয়েও তক্কে তক্কে ছিল। সাধারণ টাইপিস্ট ছিল। তাকে নহাজার টাকা মাইনে, রোজ সকালে অফিসের গাড়ি তাকে বাড়ি থেকে পিক আপ করছে, বিকেলে বাড়ি ড্রপ করে দিচ্ছে, ড্রাইভারদের জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবেন। সাজগোজও তেমনি, দামি দামি পোশাক আশাক, সায়েবদের সঙ্গে টক্কর দিয়ে ওঠা বসা, দামি রেস্টুরেন্টে খানা পিনা, দেখলে তাজ্জব বনে যেতেন। 
    ―কিন্তু মিঠুবাবুর কিছু হল না?
    ―নাঃ! মিঠু রয়ে গেল। রয়ে তো গেলই, বরং ওর ক্ষমতা দিনকে দিন আরও বাড়ছে। সায়েবদের কেমন করে বাগে আনতে হয় সব ওর নখদর্পনে। আছেন তো এখানে, সব দেখতে পাবেন এক এক করে। সায়েব যে ঐ মেয়েটার মধ্যে কী দেখেছে ভগবান জানে। না আছে মুখশ্রী, না আছে এক ফোঁটা লাবন্য। আর ঐ ফিগার। দেখেছেন তো প্যাঁকাটির মত দেখতে, নারকোলি পাছা। সরি ইয়ে কিছু মনে করবেন না, কিন্তু আমার মুখে কিছু আটকায় না। সাবধানে থাকবেন, খুব সাবধানে।
    ওপরে গিয়ে টয়লেটের কাজ সেরে আমি ঝাপসা আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে সাজগোজ সেরে নিই। আয়নাটা ছোট, আমার পুরো শরীরের প্রতিবিম্ব এতে ধরবে না। আমার ফিগার কেমন? আমি কি দেখতে সুন্দর, নাকি মাঝারি? নাকি কুৎসিত? নতুন মেমের চেয়ে ভালো না খারাপ? আমার কপালে কী লেখা আছে?
     
    (চলবে)
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:5195:1112:5618:e0b3 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৭:০৯735621
  • পাঁচ

    সুরঞ্জনাকে বেশ কদিন যাবদ লাঞ্চ ব্রেকে খুঁজে পেলাম না। আমি একা একা একতলার বাগানে উঠোনে কয়েক চক্কর মেরে ফিরে যাই নিজের অফিসরুমে। ড্রাইভাররাও তখন গাড়ি নিয়ে সায়েবদের সঙ্গে চলে গেছে, কয়েকজন চাকর বাকর মালি এরা রান্না করে। বিকেলের দিকেও সুরঞ্জনা আমার আগে আগেই বেরিয়ে যায়, রিসেপশান রুম ফাঁকা দেখি বাড়ি ফেরার সময়ে। একদিন সকালের দিকে ওকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলাম ― কোথায় থাকিস বল তো তুই লাঞ্চব্রেকে?
    ও প্রথমে একটু গাঁইগুঁই করে, সোজা উত্তর দিতে চায় না, পরে একটু চেপে ধরতেই বলে দিল যে লাঞ্চের সময় ও সায়েবদের সঙ্গেই গাড়িতে করে আলিপুর চলে যায়, সেখানে রাশিয়ান বৌদের ইংরিজি শেখানোর কাজ নিয়েছে। এতো খুব ভালো কথা, ও লুকোচ্ছিল কেন?
    ―হ্যাঁ, এতে আমার কিছুটা একস্ট্রা ইনকাম হচ্ছে, আওয়ারলি বেসিসে টাকা নিই।
    একদিন দেখলাম চন্দ্রশেখরদা লাঞ্চের সময় নীচেই রয়েছে, সঙ্গে একটা সাইকেল।
    ―আপনি আজ গাড়ি নিয়ে বেরোন নি?
    ―নাঃ, আজ ঐ মোটাসায়েব নিজেই ড্রাইভ করতে চাইল, অন্য গাড়িগুলো বাকি ড্রাইভাররা নিয়ে গেছে।
    আমার কিছু একটা শিখতে ইচ্ছে করে মাঝে মাঝে, যেমন গাড়ি চালানো, কি সাইকেল চালানো। তাই চন্দ্রশেখরদাকে বলি, এই বয়সে কি আমি সাইকেল চালানো শিখতে পারব? শুনেছি একেবারে ছোটোবেলায় শিখতে হয়। চন্দ্রশেখরদা খুব সিরিয়াস হয়ে বলে, কেন পারবেন না, আপনার সাইকেল আছে?
    ―নেই।
    ―তাহলে সাইকেল কিনুন একটা।
    ―কেমন দাম পড়ে?
    ―ভাল জিনিস কিনতে চাইলে দেড় হাজার টাকা পড়বে। হিরো সাইকেল। আপনি কিনে আনুন, আমি শিখিয়ে দেব আপনাকে।
    ―সায়েবরা যদি দেখে ফেলে?
    ―ওরা কি আর সবসময় থাকছে নাকি, আপনি যখন টাইম পাবেন তখন শেখাব, ও নিয়ে চিন্তা করবেন না।
    ―আর যদি ড্রাইভিং শিখি?
    ―সেটার জন্য আপনাকে ড্রাইভিং ইস্কুলে যেতে হবে, কাছেই আছে ভগওয়ান দাসের মোটর ট্রেনিং ইস্কুল, খুব ভালো করে শেখায়, শেখা হয়ে গেলে লাইসেন্সের জন্যে পরীক্ষা দিতে হবে মোটর ভেহিকলসে। ওটা ম্যানেজ হয়ে যাবে।
    ―আপনি আমায় নিয়ে যাবেন ড্রাইভিং ইস্কুলে, আমি ঠিক চিনি না।
    ―যেদিন বলবেন।
    কথা হয়ে রইল আমাদের, কিন্তু আবার আমার মনের মধ্যে দোটানা, এসব শিখতে গেলে খরচ আছে, সবে এক মাস ভালো মাইনে পেয়েছি, এখনই কি এতগুলো টাকা খরচ করে ফেলা ঠিক হবে? চন্দ্রশেখরদা কেমন একটু উশখুশ করে কিছু বলবার জন্য, তার পরে জিজ্ঞেস করেই ফেলে আমাকে।
    ―আচ্ছা দিদি, বেশ কদিন আগে একটা ফিয়াট গাড়ি এই গেটের সামনে রাখা ছিল, গাড়িটা তার আগেও কয়েকবার এখানে দেখা গেছে।
    আমি বুঝতে পারি কোন গাড়ির কথা বলছে সে, তবু চুপ করে অপেক্ষা করি পরবর্তী বাক্যের জন্য।
    ―একটা লোক কি আপনাকে ডিস্টার্ব করছিল?
    ―হ্যাঁ ঠিক বলেছেন, কিন্তু কেমন করে জানলেন?
    ―আমরা ছিলাম না তখন, কিন্তু আমাদের লোকেরা নজর রেখেছিল। শুনুন একটা কথা বলে দিই, কেউ যদি আপনাকে ডিস্টার্ব করে আমাকে বলে দেবেন, আমরা সবাই আছি এখানে, এমন সাইজ করে দেব যে এই রাস্তায় গাড়ি ঢোকাবার হিম্মৎ থাকবে না।
    মনে হয় সব খুলে বলি চন্দ্রশেখরদাকে। ভৈশ বলে ঐ লোকটা, যে আমাকে ফলো করতে করতে এই অফিসের গেট অবধি চলে এসেছে, সে আসলে আগে আমার এমপ্লয়ার ছিল। লোকটা আরেকজনকে সঙ্গে করে আমায় হোটেলের ঘরে পর্যন্ত নিয়ে গেছল বদ মতলবে। সেখান থেকে পালিয়েছি ঠিকই কিন্তু লোকটা সম্ভবত হার স্বীকার করতে পারছে না, ওর উদ্দেশ্য সফল হয় নি, তাই খুঁজে খুঁজে এই অবধি এসেছে।
    নাঃ, এত কথা চন্দ্রশেখরদাকে বলা যাবে না, বললেও সে কতটা কীরকম করে বুঝবে সেসবেরও ঝুঁকি আছে। বড় সহজেই মেয়েদের গায়ে কলঙ্ক লেগে যায়। আমি শুধু ধন্যবাদ দিই চন্দ্রশেখরদাকে। আমার মেয়ের ব্যাপারেও কিছুটা আঁচ করেছে সে। বলছে, সেদিন যে বাচ্চাটা এসেছিল, আপনার নিজের বাচ্চা, তাই না? আপনার মা নিয়ে এসেছিল, খুব স্মার্ট বাচ্চা, জেদ ধরে দাঁড়িয়েছিল আপনার সঙ্গে দেখা করবে বলে। ঐটুকু হলে কী হবে, একদম ভয় না পেয়ে আমার সঙ্গে ভেতরে এল, ওর দিদাকে বলল একটু পরে এসে নিয়ে যেতে।
    ―ও আবার আসবে চন্দ্রশেখরদা, সামনের মাসের দশ তারিখে, ওর সেদিন জন্মদিন।
    চন্দ্রশেখরদা হাসে। যদি কোনও কাজে আসি আপনার বলবেন দিদি। যদি গাড়ি লাগে কোথাও যেতে আমাকে বলবেন।
    ―না না, গাড়ি করে আর কোথায় যাব, আমি তো হেঁটে কিছুটা, বাকিটা বাসে করে যাই। আর গাড়ি যদি আপনার নিজের হতো, অবশ্যই বলতাম, আবদার করে চড়তাম গাড়িতে।
    ―গাড়ি কোম্পানীর ঠিকই, কিন্তু চালাই তো আমরা। যতক্ষণ স্টিয়ারিং ধরে রেখেছি, যতক্ষণ পাইলটের সীটে বসে আছি, গাড়ির কন্ট্রোল কিন্তু আমার হাতে, অ্যাটলিস্ট এটুকু মানেন তো?
     
    (চলবে)
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:5195:1112:5618:e0b3 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৭:১০735622
  • ছয়
    এমনই ভবিতব্য এর এক দুদিন পরেই চন্দ্রশেখরদার মাজদা গাড়িতে চড়বার সুযোগ এসে গেল, এবং পুরোপুরি অফিস টাইমে। চীফ অ্যাকাউন্টেন্ট আমায় ডেকে পাঠিয়েছিল তার ঘরে, আলিওশাকে সঙ্গে করে যেতে বলল প্রিন্স আনোয়ার শা রোডে, স্বরাজ-মাজদার এক ডীলারের দোকানে, আরও গাড়ি কেনা হবে কোম্পানীর জন্য, অন্ততঃ আরও দুটো মাজদা না হলে চলছে না। 
    গাড়িতে আলিওশা আর আমি বসে পড়েছি, শেষ মুহূর্তে প্রায় দৌড়ে এল লবানভ, চন্দ্রশেখরদার পাশে বসে পড়ল সে। আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবার কারণ হচ্ছে ভাষা, এই দুই সায়েব বাংলা হোক কি ইংরিজি বা হিন্দি কোনোটাই এক বর্ণ বলতে পারে না, বুঝতেও পারে না, আমি হব এদের দোভাষী।
    দোভাষীর কাজ এর আগেও করেছি আমি, তবে সম্পূর্ণ ভিন্ন পটভূমিকায়। কিন্তু আমাকে নিল কেন এরা? গাড়ি চলছে, আমি ভাবছি সাশাকে নিলেই তো পারত নয়ত মিঠুবাবুকে, মিঠুবাবু গাড়ির ব্যাপারটা তো আমার চেয়ে অনেক বেশি ভালো বোঝে, আমি তো নভিস। তবে কি খুব আর্জেন্ট কিছু? তবে কি মিঠুবাবু আসেনি আজ? হবেওবা। আনোয়ারশা রোডের মোড়টায় গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে ট্র্যাফিক সিগনালে, আমার মনের মধ্যে আরেকটা প্রশ্ন বিদ্যুতের মত ঝিলিক মারে, লবানভ ওর বৌয়ের সঙ্গে কোন ভাষায় কথা বলে? ওদের তো কোনও কমন ল্যাঙ্গুয়েজই নেই, আশ্চর্য ব্যাপার তো! লবানভকে তো জিজ্ঞেস করা যাবে না, তবে কাকে জিজ্ঞেস করব এই ধাঁধার উত্তর? সাশাকে, সুরঞ্জনা, নাকি পার্থবাবুকে?
    ফুটপাথে ডাব বিক্রি হচ্ছে, ডাব দেখেই নারকোল মনে পড়ে গেল, হাসি চেপে রাখা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে, পার্থবাবুর মুখটা মনে পড়ছে। পার্থবাবুকে জিজ্ঞেস করলে আদিরসাত্মক উত্তর আসবেই। হয়ত বলে বসবে, কথাবার্তা বলবার দরকার পড়ে না, আসল কাজটুকু হলেই হল।
    এয়ারকণ্ডিশান্ড শো রুমে ঢোকা সত্ত্বেও আলিওশা দরদর করে ঘামতে লাগল। আমাদেরকে ঢুকতে দেখে শোরুমের ভেতরে হালকা উত্তেজনা, শত হলেও দু-দুজন সায়েব এসেছে, সেলসের এক ব্যক্তি গড়গড়িয়ে অনেক কিছু বলে গেল ইংরিজিতে। আমি তাকে যত বলি যে সায়েব হলেও এরা কেউই ইংরিজি বোঝে না, আমি এদের ইন্টারপ্রেটর, আমরা দুটো গাড়ি কিনবার পরিকল্পনা নিয়ে এসেছি― আমার বক্তব্য তার মাথায় ঢোকে না। হয়ত ভাবে, সায়েব যখন, একেবারেই কি ইংরিজি জানবে না? কিছু ইংরিজি নিশ্চয় বুঝবে।
    সে সায়েব দুজনের সঙ্গে অনেক কিছু বলে যায় ইংরিজিতে। আলিওশা ওরকম ঘামছে দেখে কে একজন কোল্ড ড্রিংক্সের বোতল ধরিয়ে দেয় তার হাতে। কাচের দেয়ালের বাইরে ফুটপাথের ডাবওয়ালার দিকে তাকায় আলিওশা। সেলসম্যানের নির্দেশে একের পর এক ডাব আসতে আরম্ভ করল শোরুমে। দোভাষীর কাজটা যে আমিই করব এই ব্যাপারটা হজম হতে হতে মিনিট দশেক কেটে গেল। আলিওশাকে ইঙ্গিতে ওখান থেকে সরে যেতে বলল লবানভ। কথাবার্তা দরদাম যা হবে সবই লবানভ ও সেলসম্যানের মধ্যে। ম্যানেজার তখন দোকানে নেই, তবুও ম্যানেজারের ঘরে গিয়ে কথা শুরু হল। এবার আমার চমকাবার পালা। দাম কমাতে নয়, বাড়াতে বলছে লবানভ। আমার চোখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ওদের বলো দুটো গাড়িতে তিন লাখ বাড়িয়ে দিতে।
    ―বাড়িয়ে দিতে? নাকি কমাতে?
    ―বাড়াতে।
    আমি ব্যাপারটা বাংলা করে সেলসম্যানকে বলে দিলাম। তারও আমার মত দশা, তিন লাখ কী করে কমাবো বলুন? অত মার্জিন আমাদের থাকে না।
    ―কমাবেন না, বাড়াবেন।
    লোকটা ঘাবড়ে গিয়ে অদ্ভূত দৃষ্টিতে যুগপৎ তাকায় আমাদের দুজনের দিকে। পাগল টাগল ভাবছে কিনা জানি না। তারপরে বলে, এই ধরণের ডীল তো আগে কখনও করিনি, কাইণ্ডলি একটু ওয়েট করুন আমাদের ম্যানেজার একখুনি এসে যাবেন।
    লবানভ হাতের ঘড়ির দিকে তাকায়, তার তাড়া আছে।
    ―নো নো স্যার, প্লিজ ওয়েট ফর ফাইভ মিনিটস।
    সত্যিই ম্যানেজার এসে পড়ে মিনিট পাঁচেকের মধ্যে, দাম তিন লাখ বাড়ানোর ব্যাপারটা সে বুঝে নেয় সহজেই, কিন্তু রাজি হতে চায় না। লবানভও ছাড়বার পাত্র নয়, সোজা বলে দিলাম আমরা― এরকম করলে অন্য ডীলার দেখে নেব।
    উঠে আসছি দেখে ম্যানেজার পথ আটকায় আমাদের। একটু কনসিডার করতে বলে, তিন লাখের জায়গায় যদি ওটা এক লাখ করা যায়। এখন আর আমাকে দোভাষীর ভূমিকা পালন করতে হচ্ছে না। একটা গাবদা ক্যালকুলেটরে ম্যানেজার সংখ্যাটা টাইপ করে লবানভ কে দেখাচ্ছে, অমনি লবানভ মাথা নেড়ে তা মেনে নিতে অস্বীকার করছে। বার্গেইন হচ্ছে। ভাষা টাশা কিছু লাগছেই না। এবার লবানভ আমাকেও ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বলল। ছোট ঘর থেকে বেরিয়ে দেখলাম আলিওশা ফুটপাথের ডাবওয়ালার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে এবং চন্দ্রশেখরদাও সেখানে। ডাবওয়ালা খাওয়া ডাব কাটারি দিয়ে দুভাগ করে দিল, চন্দ্রশেখরদা ইশারা করে করে বোঝাচ্ছে আলিওশাকে শাঁস কেমন করে চেঁছে চেঁছে তুলে খেতে হয়। 
    সেই আগের সেলসম্যান আমার কাছে এগিয়ে এসে বলে, আপনি কী কাজ করেন এই কোম্পানীতে? সারাক্ষণ এদের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরতে হয়?
    ―না না, সারাক্ষণ নয়, অন্য কাজও আছে।
    ―কমিশন বেসিসে? আপনিও একটা পার্স্টেন্টেজ পাবেন এই ডীল থেকে, তাই না ম্যাডাম?
    ফিরবার পথে লবানভ বেশ খুশি খুশি। ওদেরকে পেছনে বসতে দিয়ে আমি চন্দ্রশেখরদার পাশে বসতে যাব, দেবেই না আমায় সামনে বসতে, বলে― না না তুমি মেয়ে, তুমি পেছনে বোসো, ড্রাইভারের পাশে বসবে না একদম। ভাগ্যিস চন্দ্রশেখরদা রাশিয়ান বোঝে না, শুনে বুঝতে পারলে আমি মরমে মরে যেতাম। আমাকে খুব ধন্যবাদ দিল লবানভ, বলল, ঐ ডীলারের দোকান থেকে এবার লোক আসবে আমাদের অফিসে তখনও আমায় থাকতে হবে দোভাষীর কাজ করবার জন্য। 
    সেদিন বিকেলের পরে আমার ডাক পড়েছে লবানভের ঘরে। গিয়ে দেখি ওর বৌ লবানভাও ঐ ঘরে বসে, তার টেবিল একটু দূরে, যদিও সে নিজের টেবিলে ছিল না, বরের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি ঢুকতেই সে সরে গেল। তারপরে খুব অনিচ্ছার ভঙ্গীতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। লবানভ ফোন করল রিসেপশানে, নীচে কেউ সম্ভবত অপেক্ষা করছে, তাকে ওপরে ডেকে পাঠাল। সুরঞ্জনা রাশিয়ান জানে বলে লবানভের বেশ সুবিধে হয়েছে। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই একজন মিস্তিরি গোছের লোক এসে হাজির। সায়েবকে দেখে একটু কাঁচুমাচু ভাব। সায়েব কিছু বলছে না তাকে, কেবল পিটপিট করে তাকাচ্ছে। লোকটি কাঁদোকাঁদো হয়ে আমার দিকে ফিরে বলল, ঐ ডিশটা কিন্তু খারাপ হয় নি, আপনি বিশ্বাস করুন, আমি টেস্ট করে দেখিয়ে দিতে পারি। সায়েবকে বুঝিয়ে বলুন না একটু।
    কীসের ডিশ, কী বৃত্তান্ত কিছুই বুঝতে না পেরে আমি বললাম, দাঁড়ান না, আগে কথা বলতে দিন না সায়েবকে।
    লবানভ বলছে, ঐ ডিশ অ্যান্টেনা বেচে দিতে হবে, নতুন ডিশ কেনা হবে। পুরোনো ডিশের কত দাম পাওয়া যাবে?
    ও হরি, এতক্ষণে বুঝলাম, ডিশ অ্যান্টেনা। পার্থবাবু কথিত হলদে বাড়ির পেছনের বাড়ির ছাদে মস্ত ডিশ অ্যান্টেনা আছে, কিন্তু সেই অ্যান্টেনা তো ব্যবহার করবার কেউ নেই এখন এই বাড়িতে, ওটা বেচে নতুন ডিশ কেনার দরকার কী? অবশ্য আমার এসব প্রশ্ন করা মানায় না। আমি আদার ব্যাপারী, দোভাষীর কাজ করব, ব্যস, অত জাহাজের খবর নিয়ে কাজ নেই।
    লোকটিকে ডিশের ব্যাপারটা বাংলায় বলতেই সে বলে, পুরোনো ডিশ এখন কোথায় বেচব বলুন? পুরোনো ডিশ কেউ কিনতে চায় না, যদিও কন্ডিশান খুব ভালো আছে, অত বড় ডিশ অ্যান্টেনা কে নেবে বলুন? কেবল অপারেটরদের বলে দেখতে পারি, নেবে কিনা সে গ্যারান্টি দিতে পারব না।
    লবানভকে সে কথা জানাতে সে রেগে যাচ্ছে। নতুন ডিশের দাম কীরকম সেটাও জানতে চায়। লোকটা দু রকমের দাম বলল, একটা ছোটো ডিশের অন্যটা একটু বড় ডিশের। লবানভ আবার সকালবেলার মত আচরণ শুরু করেছে। বলে ডিশের দামের ওপর তিরিশ হাজার টাকা বেশি দাম লিখে রসিদ নিয়ে এসো, বড় ডিশ কিনব। 
    কী আর করব, ঐ কথাই বাংলা করে লোকটাকে বললাম। লোকটা শুনে কেমন হকচকিয়ে গেছে, বলছে, বাপরে বাপ এসব কী বলছে! এরকম খদ্দের দেখিনি আজ অবধি।
    লবানভকে সেই কথা রাশিয়ানে অনুবাদ করে বলতে হবে, বললাম, লোকটা বলছে ও ভেবে দেখবে।
    ―ভেবে দেখার কী আছে? তিরিশ হাজার আমাকে ক্যাশ দেবে, ওকে বলে দাও। তারপরে চেক লিখে দেব পুরো টাকার।
    বলে দিলাম, ক্যাশে দিয়ে দেবেন ওকে তিরিশ হাজার, কেমন? পুরো অ্যামাউন্টটা চেক এ পেমেন্ট হবে তো, সায়েব তিরিশ হাজার আগে হাতে হাতে নেবে।
    ডিশের লোকটা ফ্যাক করে হেসে দিয়েছে, লবানভ কিন্তু টোটাল গম্ভীর। লোকটা বলছে, বাবাগো, এরকম খোলাখুলি পুকুর চুরি আগে দেখিনি। এমনিতে দেখলে বোঝা যায় না কিন্তু, কে বলবে এমন চোর!
    ―প্লীজ হাসবেন না, আমার অবস্থাটা একটু বুঝুন।
    লবানভকে অনুবাদ করে বললাম, ও ব্যবস্থা করবে, এক দুদিন সময় লাগবে।
    যাবতীয় জালি রসিদ, তৎসংক্রান্ত চিঠিপত্র লেখা সবই আমাকে করতে হচ্ছিল এর পরে, এ সমস্তই সেক্রেটারির কাজ। গাড়ির ব্যাপারেও লবানভ তিন লাখের থেকে এক টাকাও কম করতে রাজি হল না।
    এই ধরণের লেখাপড়ার কাজের জন্য লোক এলেই ও বৌকে ঘর থেকে বের করে দিত। হয়ত বৌয়ের সামনে চুরি করতে লজ্জা পায়। আমায় খুব বিশ্বাস করে, দরাদরির ব্যাপারেও বলে, লোকটাকে চাপ দাও, একদম কমাবে না টাকার অঙ্ক।
    লোকগুলো মনে করে আমারও বুঝি কিছু বখরা আছে এতে। একজন বলেছিল, ম্যাডাম আপনার কমিশন থাকে না এতে?
    আমার খালি ইচ্ছে করে এসব কথা ফাঁস করে দিই, কিন্তু ফাঁস করলে তো তখুনি চাকরি নট হয়ে যাবে। আমার জায়গায় আরেকজন এসে এই চুরিতে সাহায্য করবে, চুরি বন্ধ হবার নয়। কার সঙ্গে আলোচনা করব এ বিষয়ে? সুরঞ্জনা? পার্থবাবু? সাশা?
    উঁহু সুরঞ্জনাকে ট্রাস্ট করা যায় না। কখন কোথায় কাকে লাগিয়ে দেবে। সাশাও লবানভের বন্ধু কিনা জানি না। ও নিজেও তো খুচরো চুরি চামারি করে। উঁহু ওকে নয়। পার্থবাবুকে বললাম ঘটনাগুলো। উনি কিছুমাত্র আশ্চর্য হলেন না। এর আগে এমন ঘটনা যে একেবারেই হয় নি তা নয়, উনি অনেক কিছু জানেন, একটু রং চড়িয়ে বলেন হয়ত, তবে ওঁর অভিজ্ঞতা অনেক, সব কথা হুট করে উড়িয়ে দেবার মত নয়।
    ―আচ্ছা পার্থবাবু, লবানভ এসব জোচ্চুরির কাজ আমাকে দিয়ে করায় কেন বলুন তো? মিঠুবাবুকে বলতে পারে না? মিঠুবাবু তো এসব কাজে এক্সপার্ট।
    ―মিঠুকে বলবে লবানভ! ভুলে গেলেন ও বৌয়ের সঙ্গে মিঠুর কেলেঙ্কারির কথা? চুরিতে মিঠুকে টেক্কা দেবে বলে মাঠে নেবেছে ও। আমাদের কী!
     
    (চলবে)
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:5195:1112:5618:e0b3 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৭:১২735623
  • চতুর্থ অধ্যায়

    বাঁধাব চুলের রাশ,         পরাব চিকন বাস,
              খোঁপায় দোলাব তোর ফুল।
    কপালে সীঁথির ধার,       কাঁকালেতে চন্দ্রহার,
             কানে তোর দিব যোড়া দুল।।
    কুঙ্কুম চন্দন চুয়া,          বাটা ভরে পান গুয়া,
               রাঙ্গামুখ রাঙ্গা হবে রাগে।
    সোনার পুত্তলি ছেলে,      কোলে তোর দিব ফেলে,
           দেখি ভাল লাগে কি না লাগে।।
    ― কপালকুণ্ডলা, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
     
    আমার ডিরেক্ট বসের নাম ঝিদকভ* (ঝ এর উচ্চারণ genre শব্দে g যেভাবে উচ্চারণ করা হয় তেমন)। ইনি এই অফিসের মেজসায়েব। সেভাবে দেখতে গেলে অনেকগুলো মেজসায়েব এই অফিসে ক্ষমতার পর্যায়-সারণীতে। লবানভও মেজসায়েব, ঝিদকভও মেজসায়েব, আরও কেউ কেউ আছে তারাও মেজসায়েব হতে চায়। কিন্তু কাগজে কলমে অর্থাৎ অফিশিয়ালি ঝিদকভই একমাত্র মেজসায়েব। আমার বস লোকটা গম্ভীর প্রকৃতির, মধ্যবয়স্ক, দরকারের বাইরে একটা কথাও বলে না, খুঁতখুঁতে নয়, মেজাজ দেখায় না, এবং যতদূর বুঝতে পারি আমার কাজে সন্তুষ্ট।
    বসের ঘরে আরেকটা লোক বসে, তার নাম সের্গেই, ডাকা হয় সিরিওঝা* বলে, রাশিয়ান ভাষায় ওরকমই নিয়ম, আলেক্সেই হয় আলিওশা, আলেকসান্দর হয় সাশা, ইত্যাদি ইত্যাদি। তা এই সের্গেই একজন উচ্চপদস্থ অফিসার, বয়স আমাদের মতই মনে হয় দেখলে। ঝিদকভ ঘরে থাকলে সের্গেই আমার দিকে ফিরেও তাকায় না, কিন্তু অন্য সময় সে দিব্যি অনেক কথা বলে আমার সঙ্গে। হয়ত কোনও কিছু টাইপ করে প্রিন্ট আউট নিয়ে ঝিদকভের টেবিলে রেখে দিতে ঢুকেছি, সের্গেই আমার সঙ্গে আলাপ শুরু করে দেয়। সে অনেক কথা হয় আমাদের মধ্যে, কোথায় থাকি, কে কে আছে আমার, কতক্ষণ লাগে সকালে অফিসে পৌঁছতে। কথাবার্তার মধ্যিখানে ঝিদকভ ঘরে ঢুকে পড়লেই সের্গেই চুপ, সে খুব মন দিয়ে নিজের কাজ করতে থাকে। আবার অনেক দিনই সে অফিসে আসে না, ড্রাইভারেরা বলাবলি করে যে সে অন্য শহরে গেছে। অন্য শহর বলতে দুর্গাপুর, কি রৌরকেল্লা, বা ভিলাই, হয়ত ভাইজ্যাগ। এসব জায়গাতেই ইস্পাত তৈরী হচ্ছে, এবং সেই ইস্পাতের কারখানাগুলোয় ইঞ্জিনিয়ার হোক কি প্রযুক্তি ― জোগাচ্ছে রাশিয়া, যা এককালে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। দেশটা ভেঙে গেছে ঠিকই, কিন্তু প্রোজেক্টগুলো চলছে, সবই এই কোম্পানীর মাধ্যমে।
    সাশার সঙ্গে সের্গেইয়ের ভালই সদ্ভাব। অন্ততঃ দেখলে সেরকমই মনে হয়। এদের এখন নতুন বন্ধু জুটেছে আলিওশা ― ড্রাইভারদের বস। সায়েবরা গরমের দিনে খুব সাঁতার কাটতে ভালোবাসে, বড় বড় ক্লাবের সুইমিং পুলগুলোয় তাদের সপরিবারে মেম্বারশিপ রয়েছে। এদিকে হয়েছে কি আলিওশার বৌ এদেশে আসবার সময় তাড়াহুড়োয় জিনিস গুছোতে গিয়ে সুইমিং কস্টিউম আনতে ভুলে গেছে। ব্যস, সে বেচারি সাঁতার কাটতে পারছে না। 
    অগতির গতি হচ্ছি আমি, আমাকে আলিওশার সঙ্গে নিউ মার্কেটে যেতে হল তার বৌয়ের জন্য বিকিনি কিনতে। এ সমস্তই অফিস আওয়ারের কাজ। একটা অফিসের গাড়ি নিয়ে আলিওশা, সের্গেই ও আমি পৌঁছে গেলাম নিউ মার্কেট। খুব বেশি দোকান ভালো সুইমিং সুট রাখে না। বিকিনিও প্রায় নেই বললেই চলে, যা পাওয়া যাচ্ছে সেগুলো ওয়ান পিস সুট এবং কোমরের একটু তলা থেকে চওড়া বহরের ফ্রিল দেওয়া। সুইম সুট কে একটু ঢাকাঢুকি দিয়ে আব্রু বাড়ানোর চেষ্টা তাতে স্পষ্ট। দোকানদার যেই সেগুলো বাক্স থেকে বের করে করে সায়েবকে দেখাচ্ছে, সায়েব রেগে আগুন হয়ে যাচ্ছে। এই করতে করতে অনেক সময় নষ্ট হল। শেষ কালে একটা বিকিনি পাওয়া গেল, যেটা খুব তেতো মুখ করে কিনল আলিওশা। তার আগে একা একাই বৌয়ের বোকামি নিয়ে অনেক রাগারাগি করেছে। বিকিনি কিনে সে সন্তুষ্ট হল না, আরও কিছু কিনতে চায়, বৌয়ের জন্য একটা ড্রেস কিনল এবং প্রায় জোর জবরদস্তি করে আমার জন্যেও একটা ড্রেস কিনে ফেলল সে। সুতির একটা জামা হালকা নীল রঙের, সেটা আমায় নিতেই হবে। এতক্ষণ ধরে ওর জন্য শপিং এর হাঙ্গামা পোয়ালাম, তাই আমাকে পুরস্কৃত করতে চায়। উপহার দিচ্ছে।
    শপিং সেরে আমরা যখন অফিসে ফিরলাম, বেশ দেরি হয়ে গেছে বারোটা সাড়ে বারোটার মধ্যে সব সায়েবেরা বেরিয়ে গেছে লাঞ্চ করতে, ড্রাইভারেরাও কেউ বিশেষ নেই, এরা আর বাড়ি গিয়ে লাঞ্চ করতে আগ্রহ দেখালো না, আলিওশা সের্গেইয়ের সঙ্গে কীসব আলোচনা করল একটু দূরে গিয়ে, তারপর আমার দিকে ফিরে বলল, লাঞ্চে যাবি আমাদের সঙ্গে?
    ―কোথায়?
    ―চল চল…
    উত্তর টুত্তর দেবার তোয়াক্কা করে না ওরা, গাড়িতে পেছনের সীটে বসি আমি, ওরা থাকে সামনে, আলিওশা গাড়ি চালায়। কলকাতার ট্র্যাফিকের চোদ্দপুরুষের গুষ্টি উদ্ধার করতে করতে সে ড্রাইভ করে, তাকে রাস্তা চিনিয়ে দিচ্ছে সের্গেই। অবশেষে যেখানে গিয়ে আমরা উপস্থিত হই সেটা টলিক্লাব। একটা সবুজ ঘাসে মোড়া ছোটোখাট মাঠমত জায়গার পাশে শেড দেওয়া জায়গায় খাবার ব্যবস্থা। জায়গাটা দেখেই আমার চোখের সামনে সীমাবদ্ধ সিনেমাটার একটা সীন ভেসে ওঠে।
    আজকে সকালে ঘুম থেকে উঠে কার মুখ প্রথম দেখেছিলাম? মনে পড়ছে না। হয় বাড়িওয়ালি, নয় তার ছেলে নয় আমার পাশের ঘরের বৌ কি তার বর হবে। এই চারজনের মধ্যে একজনের মুখই দেখি সকালে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। আজ দিনটা চমৎকার ভালো কাটছে। এতক্ষণ অবধি এক পাতাও ফোটোকপি করতে হয় নি, একটা লাইনও টাইপ করিনি, কোনও চুরি চামারিতে সাহায্য করবার জন্য কেউ ডাকেনি। বরং একটা নতুন জামা উপহার পেলাম, টলিক্লাবে বসে কোল্ড ড্রিংক সহকারে ফিশ অ্যান্ড চিপস খাচ্ছি, সঙ্গে আবার একটা মেয়োনেজ দিয়ে মাখা স্যালাদ দিয়েছে। যতকাল সোভিয়েত দেশে থেকেছি, অলিভিয়ে নামেই চিনতাম এই স্যালাদকে। এখন মেন্যুকার্ডে এর অন্য নামের সঙ্গেও পরিচয় হলো― রাশিয়ান স্যালাদ, অলিভিয়ে নামটা কোথাও লেখা নেই। ফুরফুর করে হাওয়া দিচ্ছে, অফিসে ফিরবার তাড়া নেই, এরা যখন যাবে আমিও যাব সঙ্গে। চিন্তামুক্ত হয়ে কেবল ফিশ অ্যান্ড চিপস খেয়ে যাওয়াই এ মুহূর্তে আমার একমাত্র কর্তব্য। ছেলে দুটো নিজেদের মধ্যে গল্প করছে। আমি ওসব দিকে কান দিচ্ছি না। বেশ খানিকটা তফাতে এক বৃদ্ধ দম্পতি বসে আছে। সের্গেই ও আলিওশা একটার পর একটা বিয়ার খাচ্ছে, খাবারও খাচ্ছে প্রচুর। ওদের গল্প আস্তে আস্তে কথা কাটাকাটিতে বদলে গেল, একটু অন্যমনস্ক ছিলাম, কী নিয়ে কথা কাটাকাটি বোঝা গেল না। দুজনের বিয়ারের গেলাসই ফাঁকা, বোতলে আরও বিয়ার রয়েছে, বললাম― ঢেলে দেব?
    এটুকু বলে হাতে বোতলটা নিয়ে যেই একটা গেলাসে ঢালতে গিয়েছি, আলিওশা আমার হাত থেকে বোতলটা ছিনিয়ে নিল, নিজেই ঢালল বিয়ারটা গেলাসে। আমাকে বলল, কখনও মদ কারোকে ঢেলে দিবি না, কখনও না!
    ―কেন?
    ―না! দিবি না!
    রীতিমতো রেগে আছে আলিওশা। আমিও দমবার লোক নই, কারণটা আমায় জানতে হবে। তাই ফের প্রশ্ন করি, কেন ঢালতে পারব না বিয়ার? তুই তো নিজেই ঢাললি এবার।
    ―না! ঢালবি না। ভালো মেয়েরা বিয়ার ঢেলে দেয় না অন্যদের গেলাসে।
    অন্য কেউ এরকম বললে ঝগড়া হয়ে যেত, কি উঠে চলে আসতাম ওখান থেকে। এখন তা পারা যাচ্ছে না। শত হলেও চাকরি বলে কথা। সহ্য করতে হয় অনেক কিছু। অথচ আপাতদৃষ্টিতে ও কিন্তু আমায় অপমান করে নি। পরের দিন পার্থবাবুকে বলেছিলাম ব্যাপারটা। জানেন, এরকম কিছু নিয়ম আছে কি সমাজে যে মেয়েরা অন্যলোকের গেলাসে বিয়ার ঢেলে দিলে খারাপ হয়ে যায়? না পার্থবাবু ভুল বললাম, মানে ভালো মেয়েরা বিয়ার ঢালে না কারো গেলাসে।
    পার্থবাবু প্রশ্নটা ঠিকমত ধরতে না পারলেও দমে যাবার লোক নন। বললেন, বিয়ার ফিয়ার যত কম ঢালাঢালি করা যায় ততই ভাল। তবে ওদের, মানে রাশিয়ানদের হয়ত এরকম কিছু নিয়ম থেকে থাকবে।
    ―কিন্তু কই আমাদের তো এরকম কিছু কখনও শুনিনি।
    ―আমাদের সোসাইটিতে মেয়েরা কি হরদম মদ খায় না ঢালে? বাঙালি মেয়েরা ঢালাঢালি করলে আমাদেরও অমন নিয়ম তৈরি হতো। দুটো সোসাইটি আলাদা, কালচার আলাদা, সব কিছু কি অগ্রাহ্য করা যায়?
    ―তা অবশ্য ঠিক। 
    মুখে "তা অবশ্য ঠিক" বললেও সারাটা দিন আমার মনের মধ্যে খচখচ করতে থাকে, ভালো মেয়েরা বিয়ার ঢেলে দেয় না অন্যদের পাত্রে। তার মানে আলিওশা আমাকে ভালো মেয়ে বলতে চেয়েছে, অথচ কোথায় যেন একটা খটকা লেগেছে আমার। নাকি উল্টোটা বলতে চাইল ও? সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে।

    (চলবে)
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:5195:1112:5618:e0b3 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৭:১৪735624
  • দুই

    আজ মঙ্গলবার, আঠারোই জুন উনিশশো ছিয়ানব্বই সাল। ভোরের দিকে ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছিল একটু, তারপরেই গুমোট শুরু হয়েছে। গরম বলেই এবং আমার ঘরে সিলিং ফ্যান নেই বলেই আমি বিশেষ ঘুমোতে পারি না রাতে। এরকম করেই চলছে, সিলিং ফ্যান ভাড়া পাওয়া যায়, কিন্তু তাতে ঘরভাড়া বেড়ে যাবে মাসে আরও একশ টাকা, তার ওপরে ফ্যানের ভাড়াও গুণতে হবে। শুনেছি ভাড়ার ফ্যান নাকি নিয়মিত খারাপ হয়ে যায়, তখন দোকানে খবর দাও রে, মিস্তিরি কখন আসবে তার ঠিক ঠিকানা নেই, এই সমস্ত ঝামেলায় আমি যেতে চাই না। সর্বোপরি ফ্যানের দোকান যখন খোলা থাকে তখন তো আমি ঘরেই থাকি না। আমার ঘরে ফিরতে ফিরতে কম করে রাত নটা বেজে যায়। তারপরে রান্না করে খেয়ে বাসন মেজে ঘুমোতে যাই। অপেক্ষা আর একটা নতুন দিনের, যে দিনগুলোয় অবশ্যম্ভাবী ভালো সময় আমার অপেক্ষায় থাকবে বলে আশায় আশায় থাকি। কদিন আগে একটা নতুন জামা উপহার পেয়েছি, সেটা অফিসেই রাখা আছে, ওটা পরে এই বস্তি থেকে বের হলে লোকে কী ভাববে কে জানে!
    লোকে কী ভাববে, লোকে কী বলবে, এসবের তোয়াক্কা না করাই উচিৎ, কিন্তু ভাবা আর বলার বাইরে থাকে করা নামক ক্রিয়াপদ। লোকে ভাববে, বলবে এবং ফাইনালি করবে। কী করবে সেটা আমার জানা নেই। এত কম সামাজিক ক্ষমতা এবং আর্থিক সঙ্গতি নিয়ে লোকের ভাবা বলা করার তোয়াক্কা না করাটা মূর্খামি। তাই আমি গুড গার্ল সেজে শাড়ি পরলাম, খুব পুরোনো একটা তাঁতের শাড়ি। পুরোনো কিন্তু যত্নে রাখা, সোনালী সুতোর চওড়া পাড় এবং লাল কালো চেক চেক খোলের শাড়ি। খড়মড়িয়ে সিঙাড়ার মত ফুলে আছে শাড়িটা, কিন্তু তাতে কিচ্ছু এসে যাবে না, অফিসে গিয়েই এটা বদলে আকাশি নীল কটনের ফ্রকের মধ্যে ঢুকে যাব।
    আঠারোর-বি বাসে কয়েকজন নিত্যযাত্রীর মুখ চেনা হয়ে গেছে। আজ একটা মেয়ে যেচে কথা বলল। নমিতা। আমার পাশেই বসেছে সে লেডিস সীটে। আমার মতই বয়স, এখনও বিয়ে হয়নি। চাকরি করে সুকিয়াস স্ট্রীটে একটা কারখানায়, সেখানে রবারের গ্লাভস তৈরি হয়, বিশেষ করে সার্জিকাল গ্লাভস। বহুদূরে ওর কাজের জায়গা। আমার ডবল ডিসট্যান্স ওকে রোজ যেতে হয় কাজ করার জন্য। এই সরশুনা থেকে সুকিয়াস স্ট্রীট মেয়েটি দুবার না তিনবার যেন বাস বদল করে করে যেত, এখন এই নতুন বাস হওয়ায় সুবিধে হয়েছে কিছুটা, আর আমি কি না বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড অবধি যেতেই কাতর হয়ে যাচ্ছি। আজ সম্ভবত বৃষ্টি হবে, অন্তত হবার সম্ভাবনা আছে। সেই আশাতেই মেয়েটি সঙ্গে এনেছে নতুন একটা লাল ফোল্ডিং ছাতা, মহেন্দ্রলাল দত্তর দোকান থেকে কেনা। দামি জিনিস, দেড়শ টাকা দাম, বারবার করে বলছে। 
    মেয়েটি বড্ড বেশি বকবক করছে, একটু পরে মনে হল হয়ত মাথায় একটু ছিট টিট আছে, নইলে সম্পূর্ণ অপরিচিত একজনের সঙ্গে প্রথম আলাপেই কেউ গড়গড়িয়ে এত কথা বলে যায়? টিফিনে রুটি তরকারি নিয়ে যায় রোজ সেটা পর্যন্ত বলতে বাকি রাখে নি। আমার মতই আর কোনও একটা বস্তিতে থাকে আশেপাশে, মা বাবা আছে, ছোট ভাই বোন আছে, ওর ঘর ভাড়াও আমারই মত সাতশো টাকা হবে কম করে, একটার বেশি ঘর থাকলে আরও বেশি হতে বাধ্য, তার ওপরে ভাড়ায় যদি সিলিং ফ্যান নেয়, ... ভাড়ায় হয়ত নেবে না, হয়ত কেনা ফ্যানই আছে, তাহলে তো ইলেকট্রিকের খরচ বাবদ ভাড়া আরও বাড়বে, সব খরচ এই মেয়েটির একার ঘাড়ে, কত আয় করে ও মাসে মাসে? আড়াই হাজার? তিন হাজার? ম্যাক্সিমাম সাড়ে তিন, না না সাড়ে তিন দেবে না ওকে সুকিয়াস স্ট্রীটের সার্জিকাল গ্লাভস ফ্যাক্টরি। এই এত কম আয় সত্ত্বেও দেড়শো টাকার লাল ছাতা কিনে ফেলাটা ওর কাছে চুড়ান্ত বিলাসিতার নিদর্শন, তাই অতবার করে ছাতাটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখাচ্ছিল, প্রশংসা আশা করছিল আমার কাছ থেকে। সেরকম বাড়াবাড়ি কিছু প্রশংসা করি নি যদিও, মনে হল মেয়েটি একটু মনে কষ্ট পেয়েছে, যেচে আগ বাড়িয়ে ঐ ছাতাটার প্রসঙ্গ তুলে একটু প্রশংসা করে দেব কিনা ভাবতে ভাবতেই তারাতলা ছাড়িয়ে গেল, আমাদের লেডিস সীটে তখন চারজনের জায়গায় চেপে চেপে পাঁচজন বসেছে, সামনে প্রচুর লেডিস দাঁড়িয়ে, সবাই ওৎ পেতে রয়েছে কখন সীট খালি হবে সেই আশায়। নমিতাও এখন নামবে না, আমিও না, ভেবে নিই কাল বাসে দেখা হলে ওর ছাতাটার অনেক প্রশংসা করব, রং, কাপড়ের কোয়ালিটি, আরও যা যা সম্ভব সব কিছুর। 
    চক্রবেড়িয়া থেকে হেঁটে দশ মিনিট আমার অফিস। সোনালী পাড় পায়ে জড়িয়ে জড়িয়ে যায়, কী একটা টিভি চ্যানেলের অফিস পড়ে ডান হাতে, প্রচুর প্রাইভেট টিভি চ্যানেল তৈরি হয়েছে গত ক বছরে। দূরদর্শনের আধিপত্য করবার যুগ শেষ হয়ে গিয়েছে, সবাই «কেবল» লাগাচ্ছে, ঐ নমিতা মেয়েটির ঘরেও হয়ত কেবল আছে, বা হয়ত নেই। এই যে টিভি চ্যানেলের অফিসের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি তারা একটা ইংরিজি সিরিয়াল বানায়, নামটা শুনেছি, A mouthful of sky না কী যেন, রাহুল বোস অ্যাকটিং করে, কোথায় দেখলাম যেন সিরিয়ালের নামটা, টিভি তো দেখি না, কোথায় দেখলাম? মনে করতে পারছি না। অনেক কিছুই মনে করতে পারি না আজকাল। অফিসের কাজের চাপে এসব হচ্ছে হয়ত। সেদিন বড়সাহেবের সেক্রেটারি কাম গার্লফ্রেন্ড আমায় শিখিয়ে দিয়েছিল কী করে কোনও কাগজের এপিঠ ওপিঠ ফোটোকপি করা যায় অটোম্যাটিকালি। শেখালো, তখন পারলামও, কিন্তু তার পরে ভুলে গেছি। ইদানীং মেয়েকে ফোন করা হচ্ছে না, রোজ ভুলে যাই এটা, আজ ফোন করব। দুপুরে পাবো না জানি, সন্ধেবেলায় ফোন করব, সাড়ে ছটা কি সাতটা নাগাদ। সন্ধেবেলায় ফোন করা যাবে না এমন তো কোনও মাথার দিব্যি নেই।
    সারাটা দিন অফিসে কেমন একটা থমথমে ভাব। বেনারস থেকে ফিরে আসবার পরে সাশা ক্রমশ একটু গম্ভীর স্বতন্ত্র টাইপ হয়ে গেছে। ইদানীং এক নতুন লোক যিনি জয়েন করেছেন তিনিও বিশেষ কথা টথা বলেন না। ইনি এককালে অধ্যাপক ছিলেন মস্কোর কোনও এক বিশ্ববিদ্যালয়ে বা ইন্সটিটিউটে, মেটালার্জির অধ্যাপক। রিটায়ার করে এই কোম্পানীতে জয়েন করেছেন কিছু বেশি রোজগারের আশায়। প্রোফেসর ফ্রালোভ― ইয়ুরি আন্দ্রেইভিচ ফ্রালোভ। ইনি সারাক্ষণ খশখশ করে নানান ফর্মুলা লিখছেন কাগজে, কাটাকুটি করছেন, ফের কীসব ভেবে নিয়ে লিখছেন, তারপরে কয়েক পাতা টেক্সট, ফের ফর্মুলা, ফের টেক্সট, এবং অবশেষে সেটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেন কম্পিউটারে টাইপ করে দাও। অসম্ভব খারাপ হাতের লেখা ওঁর, কিচ্ছু পড়তে পারি না, আন্দাজে টাইপ করি। কোনও দিনও টাইপিং শিখি নি, এক আঙুলে টাইপ করি। দেরি হয়ে গেলে ফ্রালোভ আমার পেছনে এসে দেখতে চান কতদূর এগোলো কাজটা, সেই দেখতে গিয়ে বানানের ভুল ধরা পড়ে যায়, উনি ধৈর্য ধরতে পারেন না, আমায় উঠে যেতে বলেন সীট থেকে, নিজেই শুরু করে দেন টাইপিং, উনিও আমারই মত প্রায়, আমি এক আঙুলে টাইপ করি তো উনি দু আঙুলে টাইপ করেন। 
    ফ্রালোভ যতক্ষণ টাইপ করবে ততক্ষণ আমি অন্য কিছু করতে পারি, সন্ধে হয়ে গিয়েছে, আমি মেয়েকে ফোন করলাম। সে তখন বাড়িতে একা রয়েছে, ইস্কুলে যায় নি সেদিন। সেকী! ইস্কুলে যাস নি কেন? মেয়ে বলে দেয়, আজ মাসীকে নিয়ে দিদিমা নার্সিং হোম চলে গেল, মাসীকে নার্সিং হোমে ভর্তি করা হয়েছে।
    আমার বুকের ভেতর ধড়াস ধড়াস, নার্সিং হোম কেন?
    ―মাসীর বেবি হবে তো, সেইজন্য।
    কোন নার্সিং হোম গড়গড় করে বলে দেয় মেয়ে।
    ফ্রালোভ নিজের হাতের লেখা নিজেই পড়তে পারছে না, আলোর সামনে ধরে এগিয়ে পিছিয়ে নানানরকম করে কাগজটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ল, তারপরে নিজেই খশখশিয়ে কেটেকুটে অন্য কীসব লিখল। ফের ভাবতে বসল। তারপরে রণে ভঙ্গ দিয়ে বলল, ওহো তুমি এখনও দাঁড়িয়ে আছো? বোসো বোসো, এটা কালকে ভালো করে লিখব, আজ অফিস ছুটি হতে চলেছে।
    ফ্রালোভ আলিপুরে থাকে না, থাকে গোর্কি সদনে, এই অফিস থেকে বেশ কাছে। ফ্রালোভকে ঝপ করে পৌঁছিয়ে দিয়ে গাড়ি ফিরে আসবে অফিসে, নানান সায়েব নানান জায়গায় যাবে, কেউই সরাসরি বাড়ি ফিরতে চায় না। ঝপাঝপ পোশাক বদলে খড়মড়ে শাড়িতে নীচে নেমে ড্রাইভারদের একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, দাদা বলতে পারেন প্রেসিডেন্সী নার্সিং হোমটা কোনদিকে?
    ―একদম সিধে রাস্তা ম্যাডাম। হাজরার মোড়েই প্রায় বলতে পারেন, ল কলেজটা চেনেন তো? আচ্ছা চিনবার দরকার নেই। এক কাজ করুন, এই রাস্তাটা ধরে সোজা বালিগঞ্জ ফাঁড়ি অবধি চলে যান, মোড়ের মাথায় ডানদিকে ফার্স্ট যে রাস্তাটা ঘুরেছে, ওটায় ঢুকেই বাঁহাতে দুতিনটে বাড়ি ছেড়েই আপনার ঐ নার্সিং হোম। চলুন, পৌঁছে দিয়ে আসছি একখুনি।
    ―আরে না না, গাড়ি লাগবে না।
    ড্রাইভারেরা কথা শুনতে চায় না, সায়েবদের সবার নেমে আসতে আসতে গাড়ি আমায় পৌঁছিয়ে ফিরে আসবে সে গ্যারান্টি তারা দিচ্ছে। দামি গাড়ি নার্সিং হোমের সামনে নামিয়ে দিয়ে গেল। ভিজিটিং আওয়ার প্রায় শেষ হতে চলেছে। কী অদ্ভুত ব্যাপার, আমি যে মাসী হতে চলেছি এটা কেউ আমায় জানালো না পর্যন্ত! এমন কি বাইরে থেকে চেহারা দেখেও কিছু বুঝে উঠতে পারিনি। অবশ্য বুঝবই বা কেমন করে, লাস্ট দেখেছি তিরিশে জানুয়ারি, সাড়ে চারমাস আগে, তখন দেখে বোঝা সম্ভব ছিল না। তাও, কেউ কিছু বলেনি আমায়, কখন ডেলিভারি হবে? ডাক্তার কে? নর্ম্যাল ডেলিভারি, নাকি সেজারিয়ান সেকশান? এই সমস্ত ভাবতে ভাবতে নার্সিং হোমের ভেতরে ঢুকে পড়ি।
    আকাশটা লাল হয়ে আছে, প্রচণ্ড গুমোট, ভিজিটররা সব বেরিয়ে গেছে মনে হয়, আমায় আটকে দেয় রিসেপশনে। আমি পেশেন্টের নাম বলি, তারা বলে এখনও লেবার শুরু হয় নি, ঠিক আছে যান আপনি দেখা করে আসুন। একতলার ঘর, দেখা করে নিই। লেবার শুরু করবার জন্য ফ্লুইড চলছে, আমি কি চলে যাব? নাকি থাকব? একটু পরে যদি লেবার শুরু হয়ে যায়? যদি রাত বাড়তে থাকে, ডাক্তার কি এখানেই আছে, নাকি তাকে ডেকে আনতে হবে? প্রথম লেবার, আমায় কি আবার ঢুকতে দেবে এরা একবার বেরিয়ে গেলে? ভিজিটরেরা চলে গেছে। আমি পেশেন্টের পায়ের দিকে দেখি একটা মস্ত জানলা, তার পাল্লাগুলো কাঁচের শার্সি দেওয়া। নার্সিংহোমের ভেতরে যে ছোট বাগান সহ খোলা জায়গাটা রয়েছে সেটা জানলার ঠিক বাইরে। একটা অল্টারনেটিভ উপায় রইল পেশেন্টকে দেখতে পাবার। রিসেপশানে গিয়ে জানলাম ডক্টর বোস বেরিয়ে গেছেন, লেবার বাড়লে নার্সিং হোম থেকে ওরা ফোন করবে।
    তবু মনের ভেতরে খচ খচ করে, যদি খুব রাতে লেবার বাড়ে? গভীর রাতে কিংবা শেষ রাতে? তখন কোথায় থাকবে আয়া বা নার্সেরা? এখনই যা দেখছি ওরা দূরে একটা জায়গায় গল্পে আড্ডায় মশগুল। বোনের বর কোথায়? আসবে জানিয়েছে একটু পরে, অফিসে কাজের চাপ চলছে, তবে এসে যাবে। আর ডাক্তারবাবু? ওঁর ফোন নম্বরটা আমার দরকার, রিসেপশানে একটু রিকোয়েস্ট করতেই নম্বর দিয়ে দিল। আমি বাইরে খোলা জায়গায় বাগানে দাঁড়িয়ে পায়ের আঙুলের ওপর ভর দিয়ে উঁচু হয়ে দেখতে চেষ্টা করলাম পেশেন্টকে দেখা যায় কিনা। যায় না। এক ফুট মত উঁচু হলে ভাল হত। মানে গোটা তিন চার বড় ইট পরপর চাপালেই চলবে। ফুলের কেয়ারির পাশে আড়াআড়ি কিছু ইট দিয়ে লাইন করা আছে। শুকনো ইট। গোটা চার পাঁচ তুলে এনে একটা দাঁড়াবার জায়গা মত বানিয়ে ফেললাম। ইটের ওপরে দাঁড়ালে ঘরের ভেতরটা দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে লেবার শুরু হয়েছে। এখন আমার কর্তব্য ডাক্তারবাবুকে একটা ফোন করে রাখা। গেটের দিকে দেখলাম বোনের বর আসছে। বোনের বরকে সঙ্গে নিয়ে টেলিফোন বুথে গিয়ে নম্বর ঘোরাই ডাক্তারের, অনেকক্ষণ ধরে বাজে, শেষে ডাক্তারবাবুই ধরেন, গলাটা কি একটু ভারি ভারি শোনালো? বোনের বরকে দিই কথা বলতে, সে খুব নম্রতার সঙ্গে বলছে, ডাক্তারবাবু যেন রেডি থাকেন আর কিছুক্ষণ পরে আবার ফোন করা হবে। আমি ছিনিয়ে নিই ফোন তার হাত থেকে হুবহু প্রিটি ওম্যান সিনেমায় জুলিয়া রবার্টসের বান্ধবী যেভাবে নামী হোটেলের রিসেপশনিস্টের হাত থেকে ফোন প্রায় কেড়ে নিয়েছিল সেই ভঙ্গিমায়। শুনুন ডক্টর বোস, আপনি চলে আসুন লক্ষ্মীটি, প্লীজ প্লীজ প্লীজ―
    ―এখনও তো দেরি আছে, সময় লাগবে।
    গলাটা একটু জড়ানো জড়ানো শোনালো না কি? শুনেছি উনি নিয়মিত সন্ধেবেলা মদ্যপান করেন। সেরেছে! এখন শুরু করে দিলে তো ঘন্টা দুয়েক পরে ডাক্তার বেহুঁশ হয়ে যাবে!
    ―না না, তেমন সময় আর কোথায় লাগবে? মানে সেরকম বেশি সময় লাগবে বলে আমার মনে হচ্ছে না, আমারও তো এক্সপিরিয়েন্স আছে, চলে আসুন প্লীজ, এখানে এসে বসবেন, আমি থাকব আপনার সঙ্গে যতক্ষণ ওয়েট করতে হবে।
    ―ওকে, আই অ্যাম কামিং ইন হাফ অ্যান আওয়ার।
    যাক বাবা, বাঁচা গেল। ডাক্তারবাবুকে রাজি করানো গেছে, ইংরিজিতে যেভাবে বললেন তাতে পরিষ্কার যে উনি তখুনি বেরিয়ে পড়বেন। কটা বাজে এখন? সাড়ে আটটা, নাকি নটা?
    টিপ টিপ করে ছোটো ছোটো দু এক ফোঁটা জল গায়ে পড়ছে। এর নাম বৃষ্টি নয়। বৃষ্টি আজ সারাটা দিনে পড়েনি, নমিতাও তার নতুন ছাতা ব্যবহার করবার সুযোগ পেল না আজ। কেমন বারবার করে বলছিল, দেড়শো টাকা নিয়েছে, ফিক্সড প্রাইস।
    এখন বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলে বাগানে দাঁড়ানো যাবে না। ডক্টর বোস এসে পড়লে ওঁর কাছাকাছি থাকতে হবে, যত রাতই হোক না কেন, জাগিয়ে রাখতে হবে ডাক্তারকে।
    নতুন শিশু ভূমিষ্ঠ হতে হতে রাত প্রায় শেষ, ভোরই বলা চলে, সাড়ে তিনটে বেজে গেছে। এখন শিশুর রক্ত পরীক্ষা করা হবে, তার ব্লাডগ্রুপ যদি পজিটিভ হয়, তবে তার মায়ের জীবন সংকট হতে পারে। মায়ের রক্তের গ্রুপ নেগেটিভ, জীবনদায়ী ইনজেকশন দরকার হবে মায়ের। কিন্তু এসবে এরা আমায় থাকতে দেবে না, আমায় এখন ফিরতে হবে, সেই সরশুনা পেরিয়ে ষষ্ঠির মোড়। ভোরের বাস এখনও চালু হয় নি, বোনের বরের স্কুটারের পেছনে বসি আমি, প্রায় যানবাহনহীন কলকাতার রাস্তা দিয়ে হুহু করে সে আমায় পৌঁছে দেয় আমার ডেরায়। আর তো ঘুমিয়ে কোনও লাভ নেই। একটু জিরিয়ে, পোশাক বদলে ফের আমায় বেরোতে হবে অফিসে। আশেপাশের ঘর থেকে উঁকি মারে কৌতুহলী মুখ।
    ―তুমি এই ফিরলে বুঝি? কাল রাতে ফেরো নি? তাই দেখছি ঘর বন্ধ, ভাবছি গেল কোথায়, কোনও বিপদ আপদ...
    ―নাহ, কোনও বিপদ আপদ নয়।
    পায়খানার বাইরে লাইন পড়েছে। এক এক করে সকলে আমায় দেখে যাচ্ছে পায়খানার দিকে যাবার সময়। আজ একটু আগে আগেই যাই বরং অফিসে। বস্তির প্রতিবেশীরা জেনেছে যে কাল সারারাত আমি বস্তির ঘরে ফিরিনি, ভোরের দিকে একজন লোক বাইকে করে আমায় পৌঁছে দিয়ে গেছে। "ভাল" মেয়েরা রাত্রিবেলায় ঘরের বাইরে কাটায় না। এরা আমাকে নিয়ে অবশ্যই কিছু ভেবে রেখেছে। ভেবেছে বলেই তো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রশ্ন করছিল কোথায় ছিলাম আমি জানবার কৌতুহলে। এখন আমার ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত নেবে সেটা আপাতত জানা নেই।
     
    (চলবে)
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:5195:1112:5618:e0b3 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৭:১৫735625
  • তিন

    জুলাই মাসের মাঝামাঝির পর আমার শনিরবিবারগুলো আমূল বদলে গেল। জন্মদিনের প্রেজেন্ট মেয়েকে কিনে দিয়েছিলাম ডাকব্যাকের পিঠব্যাগ। সেটা ছিল তুঁতে নীল রঙের। ফাউ হিসেবে ছিল ক্যাডবেরি। এর পরে সে প্রতি শনিবারে আমার অফিসে চলে আসত। হাফছুটির পরে তাকে নিয়ে চলে যেতাম নিজের ডেরায়, সেখানে শনিবারের রাতটা সে থাকত আমার সঙ্গে, রবিবার বিকেলে তাকে ফিরিয়ে দিতাম গড়িয়াহাটের মোড়ে আনন্দমেলা দোকানটার সামনে। 
    তবে এর আগেরও কিছু কথা আছে। অফিস থেকে ঘরে ফেরার পথে সদ্যপ্রসূতিকে ও নতুন শিশুটিকে দেখতে যাওয়া আমার একটা অভ্যাসেই প্রায় দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল প্রথম কয়েকটা দিন। অফিস ছুটির পর হেঁটেই চলে যাই বালিগঞ্জ ফাঁড়ি অবধি, যে শিশুকে সদ্য জন্মাতে দেখেছি তাকে দেখতে খুব ইচ্ছে হয়। সেই ঘরে তখন আরও অনেক ভিজিটর থাকলেও আমার অফিস ছুটির টাইম ভিজিটিং আওয়ারের প্রায় শেষে। অতএব ভিজিটরদের তখন ফিরে যাবার পালা। তারা প্রায় সকলেই আত্মীয় ও জ্ঞাতি। আলিওশা আমায় ভালো মেয়ে বলতে চাইলে কী হবে, এই ভিজিটরদের অভিমত সম্পূর্ণ বিপরীত। আমার এই দেখা করতে আসা তারা ভালো চোখে নেয় না যদিও, তবে মুখে খুব মিষ্টি হাসি হেসে একটা দুটো কথা বলে নেয়। একটা অনুভূতি আমার হয়, যে আমি ঐ ঘরে ঢুকতেই যেন ঘরটা মুহূর্তে অপবিত্র হয়ে গেল। যদি কেউ বলে, এ আবার কেমন কথা, ও সব তোমার নিজের মনগড়া আদিখ্যেতা, সব তোমার মনে, ওরা তোমায় মোটেই অমন ভাবে না ― তবে আমি বলব, উঁহু অত সহজ উত্তর নেই এই অনুভূতির, এ তৈরী হয়েছে ক্রমাগত তোমাদেরই ব্যবহারের প্রতিক্রিয়ায়, তোমরা লিবারাল সেজে রয়েছ সবার সামনে, কারণ সেটাই পোলিটিক্যালি কারেক্ট, কিন্তু সেটাতো তোমাদের মনের ভাব নয়, তোমাদের মনের ভাব সম্পূর্ণ বিপরীত ― সেই বৈপরীত্য ঢেকে রাখতে তোমরা মিষ্টি হেসে দুটো কথা বলে নাও আমার সঙ্গে তা আমি বুঝতে পারি, এ এক খুব সূক্ষ্ম অনুভূতি যা যার সঙ্গে ঘটে কেবল সে ই অনুভব করতে পারে, বাইরে থেকে যারা দেখছে তারা বিন্দুমাত্র টের পাবে না।
    তবু আমি যাই রোজ। দেখা করে আসি, সম্পূর্ণভাবে সরিয়ে রেখে পূর্ব অভিজ্ঞতা, কারণ যে শিশুটি জন্মেছে তার বয়স হয়ত কয়েক ঘন্টা বা কয়েক দিন, সে সম্পূর্ণ নতুন এই দুনিয়ায়, তার সঙ্গে আমার কোনও বিরোধ নেই।
    শিশুর বাবারও দেখা করতে দেরি হয়ে যায়, তারও চাকরির জায়গায় অনেক বাধ্যবাধকতা আছে। ফলতঃ ফিরে যাবার সময়টায় আমরা দুজনে একসঙ্গে ফিরি, সবাই চলে গেছে ততক্ষণে। সে আমায় তার স্কুটারে করে বেশ খানিকটা পথ এগিয়ে দেয়, আমারও সুবিধে হয় অন্ততঃ একটা ভিড়ের বাসে কম উঠতে হয় বলে। আমার ঘরে যাবার রুটেই এক জায়গায় তার বাসস্থান, ফলে তাকে অতিরিক্ত একটুও যেতে হয় না। 
    এরকম হয়েছে পরপর দুদিন। তৃতীয় দিনে আমায় একাই ফিরতে হলো, আমাদের একসঙ্গে ফেরার খবর এর মধ্যেই রটে গেছে। ভয় ধরে গেছে সকলের মনে। তারা ভালো চোখে দেখছে না এই ব্যাপারটা। সম্পর্কে যদিও আমি বড়ো, কিন্তু আমার সংস্রব এরা নিরাপদ মনে করে না। আমায় পরিষ্কার করে জানিয়ে দেওয়া হল যে এই একসঙ্গে ফিরতে চাইবার পেছনে কাজ করছে আমার দুরভিসন্ধি, যে ছলাকলায় আমি পটু তার প্রয়োগ যেন এক্ষেত্রে করবার চেষ্টাও না করি। কোনও প্রয়োজন নেই ন্যাকামি করে নার্সিং হোমে দেখা করতে আসার। দেখা করতে এলেও নিজের ফেরার ব্যবস্থা যেন নিজেই করে নিই। এবং এর পরের দিনও আমি গিয়েছি নার্সিং হোমে। 
    এ সবই জীবনের অভিজ্ঞতা। জীবন আমাকে জানালো, এই করলে এই হয়। সেইখানেই মজা, "এই"টুকু না করলে "এই হয়"টুকু চিরকাল অজানা থেকে যেত।
     
    (চলবে)
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:5195:1112:5618:e0b3 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৭:১৭735626
  • চার

    মেয়েকে যেদিন প্রথম নিয়ে গেছলাম আমাদের বস্তিতে সেদিন সবার চক্ষু চড়কগাছ। সবাই বলছে, এই বাচ্চা ছেলেটা কে? কোত্থেকে এলো? কে হয় তোমার?
    প্রশ্নে প্রশ্নে আমরা কাহিল। মেয়ে মুচকি মুচকি হাসে। তার চুলে বয়কাট, পরণে হাফপ্যান্ট টি-শার্ট, সে খুব মজা পাচ্ছে। আমি ধীরে ধীরে কৈফিয়ৎ দিই, ছেলে নয়, মেয়ে।
    ― অ্যাঁ! মেয়ে! তা এমন ছেলেদের মত সাজিয়েছে কে?
    তারপরে বলি, ও থাকে আমার মায়ের কাছে, আমার মেয়ে।
    এসব শুনে তো সবাই অজ্ঞান হবার জোগাড়। মানবেই না। মেয়েকে জিজ্ঞেস করে, হ্যাঁ রে ও যা বলছে সব ঠিক?
    মেয়েও মুচকি হেসে বলে ―ঠিক।
    সেদিনকে আমরা ঘরে ফেরার আগে অনেক খাবার দাবার কিনে এনেছিলাম সঙ্গে করে। অরেঞ্জ স্কোয়াশ, কয়েক রকমের বিস্কুট, ময়দা, এবং মাংসের কিমা। আমার খুব ইচ্ছে ছিল মেয়েকে মোমো বানিয়ে খাওয়াব। খাসীর মাংসের কিলো একশো চল্লিশ টাকা, কখনও কখনও একশো আশিও হয়ে যায়, মুদিয়ালিতে দেখি প্রায় প্রায়ই। ও সব আমার সাধ্যের বাইরে। তাই নিউ মার্কেট থেকে আমরা কিনে আনলাম গরুর মাংসের কিমা। হাড়গোড় না থাকাই বাঞ্ছনীয়। এঁটোকাটার থেকে হাড়গোড়ের আকৃতি দেখে অনায়াসেই প্রতিবেশীরা ধরে ফেলবে যে নিষিদ্ধ মাংস রান্না হয়েছে এই হিন্দুপল্লীতে। মানুষজন সবসময় কীরকম একটা ক্ষেপে রয়েছে মনে হয়, সামান্য কোনও অজুহাত পেলেই ঝগড়াঝাটি পাকানোর চেষ্টা করে। হয়ত অন্য কোনও চাপা অসন্তোষ বা ক্ষোভের প্রকাশ এরা এভাবে করে। এখন ধর্মাবেগে ছোঁয়া লাগলে আর দেখতে হচ্ছে না। আমার ঠিক সামনের ঘরে যে সংসারটা থাকে, স্বামী-স্ত্রী একটা ছোট শিশুপুত্র, হয়ত দশমাস কি এক বছর বয়স বাচ্চাটার, ছুটির দিনে দেখেছি মাংস কিনতে না পারলে বৌটা মনমরা হয়ে থাকে। এক রবিবারে খুব পেঁয়াজ রসুন গরম মশলার গন্ধ বেরিয়েছিল দেখে বাড়িওয়ালি এসে জিজ্ঞেস করল বৌটাকে, কী রানছো আজ, খুব গন্ধ ছেড়েছে, মাংস? বৌটা কড়াইয়ে হাতা ঘোরাতে ঘোরাতে নির্লিপ্তের মত বলে, নাঃ, আজ ডিমের ডালনা।
    এই অবস্থায় আমি যদি গরুর মাংস রাঁধতে বসি তো ওরা কি আমায় আস্ত রাখবে? বাজারে মাংস কিনতে গিয়েও আরেক ঘটনা। দোকানিকে বললাম, এক কিলো কিমা দিন। এক কিলোর দাম চল্লিশ টাকা। সে মাংস কেটে কিমা বানাতে লেগেছে। আমার মেয়ে এসব দেখে জিজ্ঞেস করছে ― এটা কীসের মাংস? আমি ভাবছি, কী বলি এখন। সোজা বলে দেওয়াই যায়, গরুর মাংস, কিন্তু বাচ্চারা তো সব কথা চেপে রাখতে পারে না, কখন কে জেনে ফেলবে, আবার ঝামেলা শুরু হবে। নিজের ইচ্ছে মত, নিজের পছন্দের জীবন বাঁচতে হলে সবার আগে যেটা লাগে, তার নাম টাকা। অনেক টাকা। সে যখন আমার নেই, আমায় মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে বেঁচে বর্তে থাকতে হবে। বীরত্ব দেখিয়ে সত্য বলতে যাওয়া মূর্খামি। ভাবছি কী বলব। মেয়ে আবার জিজ্ঞেস করল, কীসের মাংস এটা?
    কিমা বানাতে বানতে দোকানি তাকে বলে দিল ― খাসী বেটা, বড়া খাসী।
    ওঃ খাসী! তাহলে ঠিক আছে। মেয়ে নিজেই নিজেকে বলে। এটা শুনে আমার ভেতরে একটা অজানা আশঙ্কা তৈরী হয়, তার মানে ও এইটুকু বয়সেই সমস্ত শিখে ফেলছে! এই গোঁড়ামি, বাছবিচার, এত অল্প বয়সে ওকে কে শেখালো? পরিবেশ? সম্ভব। শিশুদের আমরা বলে বলে যত না শেখাই, তার চেয়ে ঢের বেশি তারা শিখে নেয় নিজে নিজে চারপাশের পরিবেশ থেকে ―অনেক কিছু তারা শুষে নেয় চোখ কান দিয়ে নিজেদেরই অজান্তে। আমরা শিখিনি কত কিছু ছোটোবেলায়? শিখেছি তো। আমার মেয়েও এই কচি বয়সে জানে নিষিদ্ধ মাংস কাকে বলে, এ রকম হোক তা আমি চাই নি, কিন্তু এখনই ওকে সব কিছু যুক্তি দিয়ে বোঝানো যাবে না। বোঝানো যেত ― সে যদি আমার আওতার মধ্যে থাকত, তাকে এই ধরণের বিচার বুদ্ধির বিরুদ্ধে অনেক কিছু বোঝাতে পারতাম, কিন্তু মাত্র কয়েক ঘন্টার জন্য এসেছে সে আমার কাছে, এখনই উপযুক্ত সময় নয় এসবের জন্য। ধৈর্য ধরতে হবে আমাকে, সময় লাগবে, কত সময় সে যদিও জানা নেই।
    আমি ময়দা মেখে মোমো বানাতে বসি রোয়াকে, পেঁয়াজকুচি দিয়ে মাংসের কিমা মাখি, সে মনযোগ দিয়ে দেখে সেই প্রক্রিয়া। গুণে গেঁথে ঊনপঞ্চাশটা মোমো মায়ে ঝিয়ে চেটেপুটে খাই কেরোসিনের স্টোভের পাশে বসে। এঁটোকাঁটা বলে কিছু নেই, নিষিদ্ধ মাংসের চিহ্ন লোপাট। মনের মধ্যে কেবলই কিচ কিচ করছে কয়েক দানা বালি, ঐটুকু শিশু কত অবান্তর জিনিস স্বতঃসিদ্ধের মত শিখে ফেলেছে। ভালোমন্দের বিচার করতে শিখে গেছে। তার বিচারে, তার মা ভালো মেয়ে নয়। সে আসছে যদিও আমার কাছে, হয়ত জিনিসপত্র পাবার লোভে লোভে, কিন্তু আমরা যেটাকে বলি নাড়ির টান সেরকম কিছু আদতে হয় না। সবই অভ্যেস― স্বাচ্ছন্দ্য, ভয়, ভালোবাসা, নির্ভরতা, নিরাপত্তার জালে জড়ানো। মেয়ে আমার কাছে থাকতে চাইবে না। নাঃ, চাইবে না।
     
     
    (চলবে)
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:5195:1112:5618:e0b3 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৭:১৮735627
  • পাঁচ

    সামনের ঘরের বৌটার স্বামী যে রাতে ফিরল না, সে রাতে আমায় কেউ কোনও খবর দেয় নি। ওরা এমনিতেই আমায় একটু আলাদা ভাবে― আমি হচ্ছি চাকরি করা মেয়ে, আমার কাপড়চোপড় অন্যরকম, কদিন আগে ঝোলার ভেতর থেকে একটা বাচ্চা বের করে তাক লাগিয়ে দিয়েছি ওদের। সারাটা বস্তি অপেক্ষা করছিল কখন ঐ বৌটার স্বামী ফিরে আসবে। অনেক রাতে আমি আওয়াজ পাই, হয়ত তখন রাত দুটো কি তিনটে বা আরও বেশি। কারা সব কথা বলছে ফিসফিসিয়ে, একটু পরপরই গলার আওয়াজ বেড়ে যাচ্ছে, বাড়িওয়ালার ছোটো ছেলে স্কুটার নিয়ে ফিরল সে আওয়াজও পেয়েছি, ওদের বড়ো ছেলেটা মানসিকভাবে অসুস্থ, সে মনে হয় জেগে নেই। সামনের ঘরের বৌটা চাপা স্বরে খনখনিয়ে কিছু বলল, নাকি কেঁদে উঠল? আমি কান পাতলাম দেয়ালে। আমার পাশের ঘরের স্বামীস্ত্রীও বেরিয়েছে ঘর থেকে। পাশের ঘরের বৌটাকে আমি কখনও কথা বলতে শুনিনি। আরেকটা মেয়েলি গলার স্বর শুনতে পাচ্ছি, চেনা লাগছে না, অবশ্য এদের কজনের কণ্ঠস্বরই বা আমি চিনি? আমি কি মিশি এদের সঙ্গে? সমস্যাটা ঠিক কী? সামনের ঘরের লোকটা ফেরে নি, তার বৌ চিন্তিত। আরও খবর জানা যাচ্ছে, লোকটা একটা বড় কোম্পানীতে চাকরি করে। ভাড়া জমার হিসেব বাড়িওয়ালা যে খাতাটায় লিখে রাখে, সেখানে লোকটা লিখেছে নিজের কোম্পানীর নাম, লার্সেন অ্যান্ড টুব্রো। অ্যাঁ! বলে কী! কান পেতে শুনছি, কী একটা ইঞ্জিনিয়ার। বৌটা খনখনিয়ে বলল ক্যামাক স্ট্রীটে অফিস। বাড়িওয়ালার ছোটো ছেলে শুধরে দিচ্ছে, না ক্যামাক স্ট্রীট নয়, ক্যামাক স্ট্রীট নয়, আমার অফিসইতো পুনম বিল্ডিং এর পাশে, আমি চিনি ক্যামাক স্ট্রীট। 
    সবাই ভয় পাচ্ছে, কোনও অ্যাক্সিডেন্ট হল কি না। হাসপাতালে খোঁজ করা হবে কি? কোন হাসপাতাল থেকে শুরু করা হবে খোঁজাখুঁজি? অ্যাই ধর ধর ধর... বৌটা অজ্ঞান হয়ে গেছে। আমি দরজা খুলে নাইটি পরা অবস্থাতেই বাইরে রোয়াকে এসে দাঁড়ালাম। বৌটার চোখে মুখে জলের ছিটে দেয় ওরা। বাইরে টিমটিমে আলোয় দেখা যায়, ওর কপালের, সিঁথির সিঁদুর ধুয়ে যাচ্ছে।
    আমার পাশের ঘরের বৌটা ফ্যালফ্যাল করে এসব দেখছে। ওর মাথাভর্তি স্প্রিংএর মত কোঁকড়া কোঁকড়া চুল, কুচকুচে কালো গায়ের রং। আমার কাছে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল আপনার কাছে শরবৎ আছে?
    ―শরবৎ?
    মেয়েটি যেন জানেই যে আমার কাছে শরবৎ আছে, কেবল পাবার অপেক্ষা। আমি একটু ভেবে অরেঞ্জ স্কোয়াশের বোতলটা ওকে এনে দিলাম। ও একটা গেলাসে জলের সঙ্গে কিছুটা মিশিয়ে সামনের ঘরের বৌটাকে দিল। সবাই বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ শরবৎ খেয়ে নাও, শরীরে বল পাবে। 
    বৌটা শরবতে চুমুক দিচ্ছে আর কী যেন ভাবছে। ও কিন্তু কাঁদে নি, ওর গলার স্বরটাই অমন খনখনে। পাশের ঘরের লোকটার সঙ্গে বাড়িওয়ালার ছোটো ছেলে একটু আড়ালে চলে গেল কলতলার পাশ দিয়ে। পাশের ঘরের লোকটা বাংলাদেশি, এটা সবাই জানে। হিন্দু। ওদেশ থেকে পালিয়ে চলে এসেছে, হয়ত অভাবের তাড়নায়, কিন্তু বলে বেড়ায় সংখ্যালঘুদের ওপর খুব অত্যাচার ওখানে। লোকটা একটা চশমার দোকানে কাজ করে শুনেছি শখের বাজারের কাছে। নিজেরও একটা চশমা আছে যেটা বাইরে বের হবার সময় পরে নেয়। কালো বৌকে ওর পছন্দ নয়, সব সময়ই দূরছাই করছে। লোকটাকে বাঙালি স্ট্যান্ডার্ডে মোটামুটি ফর্সাই বলা যায়। ওর মাইনে নশো টাকা, ঘর ভাড়া ছশো, ওদের ঘর আমারটার চেয়েও ছোটো। কী করে  সংসার চালায় গড নোজ। কালোবৌ নাকি এখন প্রেগন্যান্ট। আমি এত ভাবছি কেন? আমি কি নিজেই খুব হিসেব করে অর্গ্যানাইজড পদ্ধতিতে নিজের জীবনটাকে প্ল্যান করেছি কোনওদিন? 
    ওরা কলতলার ওধারে গিয়ে গুজগুজ করে কী আলোচনা করছে এদিক থেকে শুনবার উপায় নেই। এত গরম, তবু মশা কামড়ায়। আকাশটা একটু পরেই ফর্সা হবে। আমরা থমকে রয়েছি, কেউ ঘুমোতে যাই না। বাড়িওয়ালা অথর্ব লোক, সে ভেতর থেকে গোঙানির মত আওয়াজ করে ডাক দেয়, বাড়িওয়ালার বৌ ধীরে সুস্থে ঘরের মধ্যে ঢুকে যায়।
    আমি কি তবে ঘরে চলে যাব? এখানে বসে বা দাঁড়িয়ে থেকে তো কিছু করবার নেই। তবু কে আগে চলে যাবে সেই নিয়ে যেন একটু অস্বস্তি মত হচ্ছে।
    সবার আগে দেখতে পেয়েছিল বাড়িওয়ালার বড়ো ছেলে, সে কথা বলতে পারে না ভালো করে, মাথার গণ্ডগোলও আছে। সে দেখতে পেয়েছিল ওদের ঘরের জানলা দিয়ে, ওদিক থেকে গলির ভেতরটা দেখা যায়। লাফ মেরে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে জড়ানো গলায় বলল ― আসছে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দেখা গেল সামনের ঘরের বৌটার স্বামীকে। ভোর হয়ে এসেছে তখন, একে ঊষাকাল বলে। লোকটার ক্লান্ত চেহারা। বিদ্ধস্ত, মলিন। অন্যদিন স্কুটারে করে আসে, আজ স্কুটার নেই।
    ওকে দেখে ডুকরে কেঁদে ওঠে ওর বৌ। সবাই হাঁ করে দেখছে ঘটনা। বাড়িওয়ালার ছোটছেলে বলে, কি দাদা কোথায় ছিলেন? বৌদি চিন্তা করছে, আমরা সবাই চিন্তা করছি, একটা খবর তো দিতে হয়!
    লোকটা জুতো খুলে রোয়াকে উঠতে গেলে তার বৌ উঠে দাঁড়িয়ে শার্ট খামচে ধরে বলে, খবর দাও নি কেন? কেন খবর দাও নি? ছোটো বাচ্চা নিয়ে সারা রাত আমি চিন্তা করে যাচ্ছি, একটা কান্ডজ্ঞান নেই তোমার!
    বৌটা চেঁচাতে থাকে। লোকটা পাত্তা দেয় না। বলে, আগে থেকে জানতাম নাকি যে দেরি হবে? কাজ ছিল।
    ― কাজ ছিল তো ছিল, খবর পাঠাতে পারতে না?
    ― স্কোপ ছিল না।
    এটুকু বলে সে গম্ভীরভাবে ঘরে ঢুকে যায়।

    (চলবে)
     
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:5195:1112:5618:e0b3 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৭:১৯735628
  • পঞ্চম অধ্যায়

    Nothing in this world is harder than speaking the truth, nothing easier than flattery.
    ― Crime and Punishment, F.M. Dostoevsky

    প্রোফেসর ফ্রালোভকে বাড়ি নিয়ে যেতে মাঝে মাঝে আসে তার বৌ― ফ্রালোভা। মিঞাবিবি দুজনেরই মাথার চুল ধপধপে সাদা। এদিকে একদিন হয়েছে কি ফ্রালোভ অফিসঘরে ঢুকতেই সবাই হাসতে শুরু করেছে তাকে দেখে। আমিও তাকিয়ে দেখলাম, হাসবার মতই ব্যাপার ― ফ্রালোভের মাথা রাতারাতি খয়েরি হয়ে গেছে। লাজুক লাজুক মুখ করে এই রং পরিবর্তনের ব্যাপারে সে নানান কৈফিয়ৎ দিচ্ছে। লাঞ্চের সময় ফ্রালোভা এল স্বামীকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে, সবাই যাতে বারে বারে ফ্রালোভকে একই প্রশ্ন করে বিরক্ত না করে, সেজন্য পরিস্কার করে বলে দিল যে গতকাল সন্ধেবেলা সে ফ্রালোভকে শ্যাম্পু করাচ্ছিল। এটুকু শুনে সাশা হাসি চাপবার জন্য যেরকম মুখ করল, সেটা দেখলে হাসি চাপা মুশকিল। রঙের মূল রহস্য হলো সাধারণ শ্যাম্পুর বদলে ফ্রালোভা ব্যবহার করেছে হেনাযুক্ত এমন একটা শ্যাম্পু, যে কিছুক্ষণের মধ্যেই ফ্রালোভের মাথায় বিভিন্ন জায়গায় হালকা বাদামি, কমলা ও কাছাকাছি শেডের ছোপ ফুটে উঠল। এরকম ছোপ কুকুর কিংবা গরুর গায়ে হলে কোনও ঝামেলা ছিল না। আয়নায় নিজের চেহারা দেখে ফ্রালোভ ঠিক করেছিল নেড়া হয়ে যাবে। তা বৌ বলল অল্টারনেটিভ সলিউশনও আছে, এখুনি পুরো মাথায় ব্রাউন রঙের ডাই দিয়ে একটা শেষ চেষ্টা করা হোক। সেটা ফেইল করলে নেড়া করে দেওয়া হবে। মাথা ডাই হয়েছে ভালোভাবেই, কিন্তু যারা ধপধপে মাথার ফ্রালোভকে দেখতে অভ্যস্থ তারা প্রথমবারে একটু হকচকিয়ে যাচ্ছে। সবই অভ্যাসের ব্যাপার, চোখ সয়ে যাবে। ব্যস প্রবলেম সলভড, এর পর থেকে আর কেউ ফ্রালোভকে দেখে হাসাহাসি করল না। 
    সম্ভবতঃ সেদিনই বিকেলের দিকে আমাদের অফিসঘর ফাঁকা হতে শুরু করল। ফাঁকা বলতে ঘরে চারপাঁচজন থাকি, তারমধ্যে চারজনই উধাও। সাশা নেই, কখন উঠে চলে গেছে লক্ষ্য করিনি। আর একজন লোক মাঝে মাঝে বসে, গম্ভীর প্রকৃতির লোক সে। প্রত্যেক দিন আসে না, তবে সেদিন এসেছিল স্পষ্ট মনে পড়ছে― সে ও নেই, মাঝে মধ্যে আলিওশাও থাকে, তার কোনও পার্মানেন্ট অফিসরুম নেই যেহেতু সে ড্রাইভরদের সর্দার, আলিওশা যখন বেরিয়ে যাচ্ছিল বেশ হৈ হৈ করতে করতে, ফ্রালোভকেও ডেকে নিয়ে গেল, আমাকেও ডাকছিল, কিন্তু আমি কী একটা টাইপ করছিলাম, বললাম আসছি এক মিনিটের মধ্যে। হয়ত এক মিনিটের বেশিই কেটে গিয়েছে, টাইপ করতে আমার সময় বেশি লাগে, এক আঙুলে যতটা স্পীডে টাইপ করা যায় আর কি। একটু পরে ঘরে ঢুকে পড়েছে সের্গেই, বলছে চল চল নীচে চল কাজ পরে হবে। সে আমায় প্রায় হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় আর কি!
    দরজা দিয়ে বেরোতে যাব দেখি ফ্রালোভ ফিরে এসেছে, তাকে দেখেই সের্গেই আমার হাত ছেড়ে দিয়ে চুপচাপ বেরিয়ে গেল। ফ্রালোভ উত্তেজিত। রেগে রয়েছে। বলল, খবরদার নীচে যাবি না।
    ― কেন? কী হয়েছে?
    ― কী হয়েছে? ঐ দ্যাখ জানলা দিয়ে।
    জানলা দিয়ে উঁকি মারলাম নীচে। ডুগডুগি বাজিয়ে বাঁদরের খেলা দেখানো শুরু হয়েছে। সবাই গোল করে ঘিরে রয়েছে, ওপর থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। রাশিয়ানরা খুব মজা পাচ্ছে ঐ খেলা দেখতে। ছোটবেলায় আমরাও কত দেখেছি। সেই একই খেলা। সায়েবদের প্রতি সম্মান দেখিয়ে ড্রাইভারেরা একটু তফাতে দাঁড়িয়ে। লাল সবুজ প্রিন্টেড ছাপের জামা পরা বাঁদরেরা ডুগডুগির তালে তালে ঘুরছে লাফচ্ছে। একে বলে বাঁদরের নাচ। তিনটে বাঁদর। স্ট্যান্ডার্ড খেলা। বাঁদর গিয়ে মালিকের কানে কানে কীসব বলবে, তারপরে বাঁদরদের বিয়ে হবে, অল্প মজার কথা হবে, অনেকবার দেখেছি ছোটবেলায়। জানলা থেকে সরে এলাম।
    নিরীহ পশুদের ওপর অত্যাচার! ফ্রালোভ বলল আমাকে। আর এতগুলো লোক সেটা দেখছে, এনজয় করছে! ছি ছি।
    আমি আগে কখনও এভাবে ভাবিনি। ফ্রালোভ বলল, ওরা দেখুক, তুই যাস না, যাস না।
    বুড়ো মানুষটা চশমা খুলে ফেলে। বলে, আমার এই প্রথম বিদেশে আসা। মন খারাপ হয়ে যায় আমার। মাথায় করে করে ইট বয়ে নিয়ে যাচ্ছে মেয়েরা, আমি দেখেছি। ভারি ভারি জিনিস বওয়াচ্ছে মেয়েদের দিয়ে, কোনও পুরুষমানুষ তাকে সাহায্য করতে আসে না।
    ― কিন্তু ওটা তো ওদের কাজ ইয়ুরি আন্দ্রেইভিচ। ইট না বইলে রোজগার থাকবে না।
    ফ্রালোভ ঠিক যুক্তিতে পেরে ওঠে না আমার সঙ্গে। আমি বলে চলি, আপনার দেশে মেয়েরা ভারি কাজ করে না? করত না আগে? বা এখনও?
    ― করবে না কেন? করে, কিন্তু এভাবে নয়। 
    ― আমাদের দেশ গরীব, এখনই সেভাবে যন্ত্রপাতি দিয়ে সব করানো যায় না, মানুষ কাজ করে।
    ― হ্যাঁ, তা বুঝেছি, কিন্তু... কিন্তু... আমার এখানে না এলেই ভালো হতো।
    ― তাহলে এলেন কেন এদেশে?
    ― বেশি টাকা রোজগারের জন্য। একটাই তো কারণ। কিন্তু বড্ড অবিচার, বড্ড চোখে লাগে, বড্ড ভেদাভেদ। ফ্রালোভ চশমা পরে নেয় ফের। আর কথা বলে না। কাগজের ওপর কীসব ক্যালকুলেশন করতে থাকে।
    বাঁদরের খেলা শেষ। সবাই উঠে এসেছে ওপরে। কিছু একটা অন্য ঝামেলা শুরু হয়েছে সেই সুইপারকে নিয়ে। ওর সঙ্গে আমি নতুন ব্যবসা খুলব ভেবেছিলাম, কোম্পানীর নামও পছন্দ করে রেখেছিলাম― কাপালিক। সুরথ, সুরথই তো, সবাই ওকে সুইপার বলে ডাকে, আসল নামটাই মনে থাকে না অনেক সময়, ওর আরও একটা সাইড বিজনেস আছে জানা গেল। মোট চারটে টয়লেট আছে এই অফিসে দোতলায় দুটো তিনতলায় দুটো, দুটো ছোটো দুটো বড়ো। ছোটোগুলো মেয়েদের, বড়োগুলো ছেলেদের। প্রত্যেক টয়লেটে তোয়ালে আছে হাত মোছার জন্য। মেয়েদেরগুলোয় একটা করে, ছেলেদেরগুলোয় দুটো করে। মোট ছটা তোয়ালে সপ্তাহে দুবার কেচে বদলে দেবার নিয়ম। সুরথ এই তোয়ালে কাচার জন্য টাকা নেয়, কিন্তু সময়মত তোয়ালে বদলায় না। এইটে ধরা পড়ে গিয়েছে। ওকে বকাঝকা করছে সের্গেই। সের্গেই ভয়ঙ্কর ইংরিজিতে ধমকাচ্ছে, এদিকে সুইপার ইংরিজি জানে না। তবে সে বিলক্ষণ জানে তার অপরাধ কী। আমাকে দেখতে পেয়ে বলল, আগেরবারে তোয়ালে কেচে দেবার পরে শুকোয় নি বলে সময়মত বদলাতে পারে নি।
    সে কথা সের্গেইকে বুঝিয়ে বলতে সে আরও রেগে যাচ্ছে, বলে এসব একবার নয় বারবার হচ্ছে। কোনও কোনও সপ্তাহে একবারও তোয়ালে বদলায় নি, ওরা নজর রেখেছিল।
    সুইপার মাথা হেঁট করে ঘাড় চুলকোতে লাগল। ফ্রালোভ আমাকে জিজ্ঞেস করে কাছাকাছি আর কোনও লন্ড্রি আছে?
    ―আমি কী করে জানব! হ্যাঁরে আছে কোনও লন্ড্রি?
    আমি সুইপারকে জিজ্ঞেস করি। সে নেতিবাচক মাথা নাড়ে। সের্গেই সুইপারকে বের করে দেয় ঘর থেকে। আমায় বলে, তুই একটা ব্যবস্থা করে দে।
    ―আমি? কত টাকা নেবে লন্ড্রি আমি জানি না, চিনিও না সেরকম কিছু, কত দিনে ডেলিভারি দেবে তাও বলতে পারব না। আমি সত্যিই চিনি না এই শহর সেভাবে। সের্গেই তৎক্ষণাত বলে দেয়, ছটাকা করে প্রতি তোয়ালে, ছয়ে ছয়ে ছত্রিশ।
    ―ছাত্রিশ টাকা!
    ―হ্যাঁ, তুই নিজেও নিতে পারিস যদি কেচে দিস।
    আমি একটু চিন্তা করি, সত্যিইতো আমার টাকার দরকার। আমি কেচে দেব। কোনও কাজই তো ছোট নয়। মুখে বলে বেড়াব সব কাজই সমান আর কাজের বেলায় পিছিয়ে যাব, এতো ঠিক নয়। আমার তো টাকার দরকার আছেই। রাজি হয়ে যাই। ফ্রালোভ একটা ঝোলা ব্যাগ দেয় আমায়, ছটা তোয়ালে তাতে ভরে নিই আমি।
     
    (চলবে)
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:5195:1112:5618:e0b3 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৭:২০735629
  • দুই

    যেসব দিনে সুরঞ্জনা ইংরিজির টিউশন দিতে যেত না, সেসব দিনে টিফিনের ছুটিতে আমরা আড্ডা দিতাম। আমার যেমন ব্যবসা করবার শখ, ওরও আছে তেমন শখ ব্যবসার। ও চাইছিল একটা হাসপাতাল খুলতে। মানে ও একা নয়, ওর কে একজন দাদা গোছের ভদ্রলোক আছেন যাকে ও খুবই শ্রদ্ধা করে, এটা সেই দাদার প্ল্যান। সঙ্গে যোগ দেবে সুরঞ্জনা এবং সেই সেদিন যে ছেলেটাকে ওর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে দেখেছিলাম, বাবলু নাম সম্ভবত, সে। আমার ধারণা ছিল যে একটা প্রাইভেট হাসপাতাল বানানো খুবই খরচের ব্যাপার ব্যাংক লোন লাগে প্রচুর, অনেক ঝামেলার কাজ। কিন্তু সুরঞ্জনার সেই দাদার মাথায় প্রচুর বুদ্ধি এবং তিনি খোঁজখবরও রাখেন অনেক কিছুর। 
    প্রথমেই যেটা করতে চাইছে এরা সেটা হচ্ছে, জিনিসটা জনসেবামূলক হওয়া দরকার। লাভজনক ব্যবসার গঠনে ফেললে কেউ লোন দেবে না অত সহজে। 
    ―তাহলে তোরা লোন পেলেও শোধ করবি কী করে ?
    সুরঞ্জনা বোঝাতে থাকে আমায়, শোধ ঠিক হয়ে যাবে, আর পুরো টাকা লোন নিতেও হবে না, ডোনেশন না হলে হবে না। ম্যাক্সিমাম অ্যামাউন্টই ডোনেশন থেকে আসবে। দামি দামি ইন্সট্রুমেন্ট চাই, এক একটা ডায়াগনোস্টিক ইন্সট্রুমেন্টের দাম সম্পর্কে কোনও ধারণা আছে তোর?
    ― আছে। ব্লাড প্রেশার মাপার যন্ত্র কি স্টেথোস্কোপের দাম আন্দাজে বলে দিতে পারি।
    ― ওসব না। বী সিরিয়াস। যেমন ধর সিটি স্ক্যান মেশিন, আল্ট্রা সাউন্ড, ল্যাপারোস্কোপ, এক্স রে, আচ্ছা এক্স রে নাহয় ছেড়ে দিলাম। তারপরে বিল্ডিং, ডাক্তারদের খরচ, নার্স, টেকনিশিয়ান, অফিসের কাজ সামলাবার লোক, সুইপার, দারোয়ান এদের স্যালারি।
    ―এরকম ব্যবসায় যাচ্ছিস কেন? তোদের কি কোনও এক্সপিরিয়েন্স আছে? বিজনেস দাঁড় করাতে করাতেই তো কয়েক বছর লেগে যাবে।
    ―হ্যাঁ প্রচুর খাটুনি আছে।
    ―তারপর ধর কলকাতার ওপরে একটা দোতলা বাড়ি যদি ভাড়াও নিস হাসপাতাল বানাতে তাহলে…
    আমার মুখের কথা কেড়ে নেয় সুরঞ্জনা।
    ―কলকাতায় করবার প্রশ্নই ওঠে না। রুরাল এরিয়ায় না করলে লোন বা ডোনেশনের কথা ভুলে যেতে হবে। এটা সমাজসেবামূলক প্রোজেক্ট। গরীব মানুষদের সেবায়। যাদের কাছে চিকিৎসা পৌঁছয় না, তাদের কাছে সফিস্টিকেটেড চিকিৎসা পৌঁছে দেওয়া।
    ―তাহলে কোথায় করবি তোদের ঐ হসপিটালটা? বাঁকুড়ার ভেতর দিকে জানিস তো ছোটোবেলায় দেখেছি, কিম্বা মনে কর পুরুলিয়া সাইডে, ওসব দিকে করতে পারিস।
    ―না না, অত দূরে আমরা পেরে উঠব না, কলকাতার জাস্ট বাইরে হলেই রুরাল বেঙ্গল হয়ে গেল, জানিসতো বারুইপুর মল্লিকপুর এসবই রুরাল বেঙ্গল। ফরেন এইড পেতে হলে কলকাতা কর্পোরেশনের বাইরে হতে হবে।
    আমার মনে পড়ে যায় যে এরকমই একটা হাসপাতাল আমি নিজের চোখে দেখে এসেছি কিছু মাস আগে। সুরঞ্জনাকে বলা যায় কি সেসব কথা? বলব? না থাক। ওকে তো আমি সেভাবে চিনি না। সুরঞ্জনার সিগারেট ফুরিয়েছে, ও হাতের ইশারায় কাচের দেয়ালের বাইরে একজন ড্রাইভারকে ডাকে। লোকটা দৌড়তে দৌড়তে আসছে এদিকে। সুরঞ্জনা ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একটা ওয়ালেট বের করল।
    আমার সেরকম কোনও ওয়ালেট নেই। রুমালে টাকা পয়সা গিঁট মেরে রাখি। ভ্যানিটি ব্যাগ বলতে একটা আছে বটে প্রেজেন্ট করেছিল একজন, পোড়ামাটি রঙের, চামড়ার জিনিস, দামি জিনিসই হবে। ওটা খুব রেয়ার ব্যবহার করি, এমন একটা রং, যেটা কাপড়জামার সঙ্গে ম্যাচ করে না, ম্যাচিং ও নয়, কন্ট্রাস্টও নয়। ওরকম রঙের সঙ্গে হয়ত মানাবে সবুজ। সবুজ পোশাক আমার নেই, কি হয়ত আছে, দেখতে হবে। আমি যখন স্কুলে পড়তাম, আমাদের ইস্কুলের লাইব্রেরীতে সার সার কাচের আলমারি ভর্তি সবুজ কাপড়ের বাইন্ডিং এর বই ভরা থাকত, অদ্ভূত একটা কালচে মত সবুজ, আর থাকত মেরুন রঙের কাপড়েই বাঁধাই। ওগুলো অধিকাংশই রচনাবলী গোত্রের বই। কত সব লেখক দশ বারো কি কুড়ির বেশি খন্ড বই লিখে গেছেন সেই সব বইয়ে ঠাশা থাকত আলমারিগুলো। আমাদের, মানে ছাত্রীদের সেসব বই পড়বার কোনও সুযোগই ছিল না। ওগুলো বড়দের বই। তা বড়দের বইই যদি হবে তবে ইস্কুলের লাইব্রেরি বোঝাই করেছে কেন ওসব দিয়ে? কারণ ছিল। ওসব বই টিচাররা ধার নেবে, পড়বে। ছাত্রীদের জন্য বাছাই করা কিছু শিশু ও কিশোর সাহিত্য, পেপারব্যাক টাইপ নয়ত পিচবোর্ডের বাঁধাই। ওই সবই নিতাম আমরা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। তা এতসব কথা কেন মনে পড়ছে সুরঞ্জনার ভ্যানিটি ব্যাগ দেখে? ঐ সময় এক শিশুসাহিত্যিকের লেখা বই নিয়ে একটু কাড়াকাড়ি পড়ে গেছল ক্লাসে। পাহাড়ের গল্প। বইটার নাম উহ্যই থাক। লেখক ডাক্তার। এই ক মাস আগে ঘটনাচক্রে ঘুরে এসেছি ওঁর নিজস্ব হাসপাতাল। কলকাতা থেকে একটু বাইরে, দক্ষিণে। সুরঞ্জনা যেমন বলল, কলকাতার বাইরে হওয়া চাই, সেই হিসেব মেনে।
    ঝকঝকে মার্বেল দিয়ে বাঁধানো হাসপাতাল। সামনে অনেকটা খোলা জায়গা এবং বাগান ফুলে ফুলে ভরে রয়েছে। বাড়িটার স্ট্রাকচার ভালো। চওড়া দেওয়াল, চওড়া সিঁড়ি, উঁচু সিলিং। মস্ত বড়ো একটা হলঘর, যেখানে রোগা পাতলা বেঁটে মত লেখক ডাক্তারবাবু আউটডোরের পেশেন্ট দেখেন। ঝকঝক তকতক করছে চতুর্দিক।
    ডাক্তারবাবু আমায় নিমন্ত্রণ করেছিলেন একটা উৎসবে, সেদিন ঐ হাসপাতালে বিদেশি অতিথিরা আসবে। আমিও তখন সদ্য ফরেন রিটার্ন্ড। জায়গাটা দেখেই মনে ধরে গেল। বললাম ডাক্তারবাবু আমি কিছু করতে পারি এই প্রতিষ্ঠানের জন্য?
    ―অবশ্যই পারো। লেগে যাও কাজে। থেকে যাও এইখানে। তবে দ্যাখো মাইনেপত্র কিছু দেবার মত সঙ্গতি আমার নেই, খাবার দাবারের খরচ লাগবে না, এখানেই সবাই যেমন খাচ্ছে দাচ্ছে, মানুষের সেবা করতে পারলে আমিও কিছু চাই না। আমাকে দেখ, সিম্পল লাইফ।
    তাকিয়ে দেখলাম, সাধারন সুতির একটা শার্ট, সুতির প্যান্ট। শার্টে ভালো করে ইস্তিরি করা নেই পর্যন্ত। আমি ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম হাসপাতালের ভেতরটা। দোতলায় যেতে দেয় না, ওটা ডাক্তারবাবুর রেসিডেন্স, যানা মনা হ্যায়। একতলায় করিডোরের দুদিকে মুখোমুখি গোটা চারেক ঘর, দুটো ছোটো, দুটো বড়ো। সেইসব ঘরে শিশু রোগীরা ভর্তি রয়েছে। ডাক্তারবাবু নিজেও শিশু চিকিৎসক। শিশুদের সঙ্গে শিশুদের মায়েরাও বর্তমান। রিকেট হওয়া শিশু, অনাহারে শুকিয়ে যাওয়া শিশু, যার বয়স আট তাকে দেখে মনে হবে আড়াই তিন বছর বয়স, মোট ছ সাতজন ইনপেশেন্ট ভর্তি আছে।
    ডাক্তারবাবু বড়ো হলঘরের দিকে চলে যান, স্থানীয় পাড়ার সুস্থ শিশুরা বিকেলে অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাবে, কিশোরীরা, বালিকারা চুল বেঁধেছে সব লাল রিবন দিয়ে। দোতলায় ডাক্তারবাবুর স্ত্রী অতিথি অভ্যর্থনার আয়োজন করছেন, ইনি আজ সকালেই কলকাতার বাড়ি থেকে এসে পৌঁছেছেন। হলঘরের বড়ো টেবিলটার ওপরে প্রচুর ওষুধ পত্র, অধিকাংশই ফিজিশিয়ানস স্যাম্পল নট ফর সেল। দেখে খুব ভালো লাগল।
    প্রশ্ন হচ্ছে, বিকেলে কারা আসবে? অতিথিরা কারা?
    ফের চলে গেলাম ইনপেশেন্ট বিভাগে। বাচ্চা রোগীগুলো ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে দেখছে আমার দিকে। প্রতিটি বেডের পাশে একটা করে ছোটো শেলফ, তার ওপরে রাখা রয়েছে ফল। কলা আপেল আঙুর কমলালেবু। বাচ্চা রোগীরা সেদিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে দেখে আমি উৎসাহ দিই, খাবে? খাও না, খাও।
    ওদের মায়েরা ভয়ের চোখে তাকায় আমার দিকে। এখন খেতে মানা করেছেন ডাক্তারবাবু। বাড়ি ফিরবার সময় সাথে করে নিয়ে যাব।
    ―বাড়ী ফিরবার সময় মানে? আপনারা কখন ফিরবেন?
    ―এই যখন ছেড়ে দেবেন, তখন। ছটা টটা হবে হয়ত। ঘরে গিয়ে কাজ আছে না? রান্নাবাড়া করবে কে?
    মায়েরা হাসতে শুরু করে।
    কবে ভর্তি হয়েছে এরা? আমি পেশেন্টদের দিকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করি।
    মায়েরা চুপ। বলতে চায় না প্রথমটায়। একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রশ্ন করবার পরে মুখ খোলে একজন।
    ―আমি আসছি বারোটা নাগাদ, ঐ ওরা আজ সকাল থেকেই আছে।
    খটকাটা আমার গোড়ার দিকেই একটু লেগেছিল। ঝকঝকে বাথরুম টয়লেট দেখে, নিপাট নিখুঁত বেড দেখে, যেন আলগা করে এনে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে রোগীদের। 
    অতিথিরা এসে গেছেন। একটা সুইস সংস্থা, তারা ডোনেশন পাঠায় ― হাজারে নয়, লাখে। সেসবের হিসেব বুঝিয়ে দিতে খাতা খুললেন ডাক্তারবাবু। পাড়ার বাচ্চাগুলোকে দেখিয়ে বললেন এরা সব আমারই রোগী, বিনে পয়সায় চিকিৎসা করি, ওষুধের আলমারি দেখালেন। সুইস মহিলাটি আলমারির কাছে গিয়ে দেখতে লাগল, খাতায় নোট করতে লাগল। আমার দিকে দেখালেন ডাক্তারবাবু, আমি নাকি ফরেন রিটার্ন্ড কী একটা স্পেশালিস্ট এই মাস থেকে জয়েন করেছি ওঁর হসপিটালে। বাধা দিতে পারিনি এতটাই স্তম্ভিত হয়ে গেছলাম। উনি আমাদের সঙ্গে করে নিয়ে চলেন ইনপেশেন্ট দেখাতে, প্রত্যেকেই অপুষ্টিতে ভুগছে তা এক নজরেই ধরা যায়। ভুরি ভুরি মিথ্যেকথা, এদের রোগের হিস্ট্রি, কত দিন যাবদ আছে, কত মাস আরও থাকতে হবে, কলা আপেল আঙুর সাজানো ট্রে তে, সুইস মহিলা নোট নিচ্ছেন, সঙ্গে আর এক জন ভদ্রলোক, ইনি অন্য কোনও একটা দেশের, মানে সায়েব।
    ডাক্তারবাবু নিজের মেয়েকে মস্কোয় পয়সা খরচ করে ডাক্তারি পড়তে পাঠিয়েছেন, একটু আগেই আমাকে বলছিলেন যে সোভিয়েত দেশ ভেঙে যাবার পর অনেক টাকা খরচ করে পড়তে পাঠাতে হচ্ছে, এখন এদের বললেন, মেয়েও আসবে কয়েক বছর পরে ডাক্তার হয়ে, সে ও সেবা করতে চায় গরীবদের।
    আমরা এবার দোতলার সিঁড়ির দিকে তাকাই, লালপেড়ে গরদের শাড়ি পড়ে লাল সিঁদুরের টিপে দুর্গা প্রতিমার মতো লাগছে ডাক্তারবাবুর স্ত্রীকে, উনি নেমে আসছেন সিঁড়ি দিয়ে পেছন পেছন ট্রে হাতে বেয়ারা। একটা সাজানো ঘরে বসে হাই-টি করা হলো। সবই ফ্লুরিজের খাবার, প্যাটিশ, পেস্ট্রি, ইত্যাদি ইত্যাদি, সঙ্গে বিশেষ সংযোজন ওঁর স্ত্রীর হাতে তৈরী চিকেন সুপ। সায়েব ও মেম কে সেই সুপ খেতে প্রায় বাধ্য করা হল। হাসিমুখে তত্ত্বাবধান করছিলেন ওঁর স্ত্রী, উনি কথা বলেন না, ইংরিজিতে সমস্যা, যেটা ডাক্তারবাবুর ভাষায়― শী ইজ শাই, ভেরি শাই।
    সুরঞ্জনারা কি এরকম কিছু বানানোর প্ল্যান করছে?
     
    (চলবে)
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:5195:1112:5618:e0b3 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৭:২১735630
  • তিন

    অগস্টের শেষেই আমি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে ফেলেছিলাম মাইনে পাবার পরে। মিঠুবাবু প্রথমদিকে আমায় চার হাজার করে দিলেও দুমাস পরে সেটা বেড়ে ছহাজার হয়ে গেছল। উঁহু ইনক্রিমেন্ট নয়, গোড়া থেকেই অমন দেবার কথা, সে ইচ্ছে করে দুহাজার কম দিচ্ছিল মাসে মাসে, ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যেতে সে একটু ঘাবড়ায় এবং আমায় একটা জোড়াতালি দেওয়া কারণ দেখায় মাইনে বাড়ানোর, বলে ― তুমি এত খাটছ, আমি নিজের কমিশন না নিয়ে তোমার মাইনে বাড়িয়ে দিলাম। তা দিকগে, আমার টিপে টিপে খরচ করা সঞ্চয় যা অফিসের ড্রয়ারে রেখে দিতাম ― সেসব গুণে দেখলাম ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা দরকার। 
    মার্কেন্টাইল ব্যাংক তাদের নাম পাল্টে হংকং ব্যাংক হয়ে গেছে, সেখানেই দশ হাজার নগদ জমা দিয়ে অ্যাকাউন্ট খোলা হল। এটাই মিনিমাম অ্যামাউন্ট। এরা চালু করেছে অটোমেটেড টেলর মেশিন, সেটার জন্য ক্রেডিট কার্ডের মত দেখতে কার্ডও দিল। টাকা পয়সা তুলবার জন্য অন্য ব্যাংকগুলোয় ঘন্টাখানেক লাইন দিতে হয়, সময় নষ্ট হয়, এ ভালই হল। এদের দেখাদেখি স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকও চালু করেছে টেলর মেশিন, কিন্তু সে ব্যাংকে পঁচিশ হাজারের কমে অ্যাকাউন্ট খুলতে দেয় না।
    টাকা পয়সা হাতে হাতে না রেখে ব্যাংকে ঢুকিয়ে ফেলাই যুক্তিযুক্ত মনে হয়।
    আলিওশার সঙ্গে সের্গেইয়ের সেই যে একটা ঝগড়া মতো হয়েছিল টলিক্লাবে, তার রেশ চলতেই থাকে। এদিকে আমার বসবার জায়গা আবার পাল্টেছে। এখন আমায় বসতে হচ্ছে বড়োসায়েবের সেক্রেটারির চেয়ারে। সেক্রেটারি কাম বড়োসায়েবের গার্লফ্রেন্ড, যাকে গোড়া থেকেই দেখেছি প্রেগন্যান্ট, তার খুবই অ্যাডভান্সড স্টেজ অফ প্রেগন্যান্সী, মাঝে মাঝেই শরীর এত খারাপ হয়ে পড়ে যে সে অফিসে আসে না। সেসব দিনে আমায় বসতে হয় তার ঘরে। এই ঘরটা দিয়ে বড়োসায়েবের ঘরে যাবার দরজা, সেক্রেটারিকে ডিঙিয়ে ভেতরে ঢুকবার উপায় নেই। অবিশ্যি বড়োসায়েবের ঘরের দরজাটা হাট করে খোলা থাকলে লোকে আমার পরোয়া করে না, উঁকি মেরে দেখে ঢুকে যায় সেখানে।
    এই ঘরে যেসব দিন বসি সেসব দিনে আমায় এক পাতাও ফোটোকপি করতে হয় না, টাইপিং করতেও বলবে না কেউ। আমার কাজ কেবল ঠায় বসে থাকা এবং কোনও ভিজিটর এলে বড়োসায়েবকে ফোনে জানানো। আবার বড়ো সায়েব ঘরে নেই জেনেও লোকে আসে এইখানে, এই নতুন সেক্রেটারির সঙ্গে রঙ্গ মশকরা করতে, হয়ত তাদের অভিপ্রায় অন্য। প্রথম দিকে বুঝতাম না, পরে জিনিসটা পরিস্কার হয়ে গেল। সেক্রেটারির টেবিলে যে টেলিফোনটা আছে সেটা দিয়ে সরাসরি বিদেশে ফোন করা যায়। বড়োসায়েব না থাকলেই সের্গেই খুব আসে এই ঘরে, এটা ওটা সেটা নিয়ে কথা বলে আমার সঙ্গে, তারপরে টুক করে টেলিফোন তুলে নেয় হাতে, নম্বর ঘোরায় এমন করে যেন লোকাল নম্বরে ডায়াল করছে। একদিন নজর করলাম প্রথম তিনটে সংখ্যা জিরো জিরো সেভেন... আহহা― এতো রাশিয়ার আইএসডি কোড!
    সের্গেই বুঝেছে আমি ধরে ফেলেছি, তখন বলছে, আমার বৌ ছেলে তো দেশে গেছে, তাই খবর নিচ্ছি একটু।
    সেই বাচ্চা ছেলেটার মুখ মনে পড়ে, অসম্ভব শান্ত ছেলেটা, কয়েকবার দেখেছি সের্গেইয়ের বৌয়ের সঙ্গে অফিসে এসেছে। একদম কথা বলতে চাইত না। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে চুপ করে থাকত, ধীরে ধীরে সরে যেত সেখান থেকে।
    সেই ছেলেটাই ফোন ধরেছে মনে হয় ওপ্রান্তে। আমাদের সাড়ে এগারোটা মানে মস্কোয় সকাল আটটা বেজে গেছে। ছেলেটার কথা বোঝা যায় না, কিন্তু সের্গেই খুব ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কিছু জানতে চাইছে ছেলেটার কাছে। এমনিতেই সে খুব তাড়াতাড়ি কথা বলে, তার ওপরে একটু উত্তেজিত মনে হয়, ফলে কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। ছেলেটা হয়ত শুনতে পাচ্ছে না ভালো করে, বা উত্তর দিতে চায় না, সের্গেই আবার রিপিট করে বাক্যটা, এবার আমি মন দিয়ে শুনি― লিয়োনা, তুই কি আগের মতই দিদার সঙ্গে ঘুমোচ্ছিস রাত্রে?
    ওপ্রান্ত থেকে লিয়োনা (লিওনিদ থেকে ছোটো করে লিয়োনা) কী বলল বোঝা যায় না, কিন্তু সের্গেই আবার জিজ্ঞেস করছে, না মানে সেই আগে যেমন দিদার সঙ্গে ঘুমোতিস, তেমনি এখনও কি দিদার সঙ্গেই ঘুমোচ্ছিস রাত্রে? ও আচ্ছা। মা কোন ঘরে ঘুমোচ্ছে? আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে। মা জিজ্ঞেস করলে বলবি আমি ফোন করেছিলাম।
    সের্গেই ফোন কেটে দেয় ঝট করে, ঘরে ঢুকেছে সাশা। বড়োসায়েবের ঘরে সাশার কী প্রয়োজন থাকতে পারে সেটা কল্পনা করা শক্ত। এ ঘরে তার আসবার কোনও প্রয়োজন থাকতে পারে না, কিন্তু এসেছে যখন তখন কারণটাও জানা যাবে। সের্গেই দু একটা কথা বলে সাশার সঙ্গে, কিছু সস্তা মন্তব্য আমাকে জড়িয়ে ― আমার খোঁজে খোঁজেই লোকজনের যাতায়াত বেড়ে গেছে এই ঘরে― এই ধরণের কথা বলে সে বেরিয়ে যায়। সাশা কিন্তু তার সামনে ভাঙে না নিজের দরকারের কথা।
    ওপরের ফোটোকপি মেশিন খারাপ হয়েছে, তাই সে এসেছে কিছু ডকুমেন্ট কপি করতে এই ঘরে। সাশা আমাকে জিজ্ঞেস করে, সের্গেই মস্কোয় ফোন করছিল না?
    ―করছিল, কিন্তু আমার কিছু করার নেই। ইন্টারন্যাশানাল কল, এখন যদি বড়োসায়েব আমাকে কিছু বলে―
    আমার দুশ্চিন্তায় আমল দেয় না সাশা, মাথা নীচু করে টেবিলের ওপর বেশ খানিকটা ঝুঁকে পড়ে বলে, কোম্পানীর অনেক টাকা নয় ছয় হচ্ছে, এরকম দুএকটা ফোন কল ওরা দেখতেও পাবে না, কিন্তু আসল ব্যাপারটা জানিস কি?
    ― কী ব্যাপার?
    ― সের্গেই ওর বৌ কে প্রচণ্ড সন্দেহ করে, বৌ মস্কো গেছে তো ছেলেটাকে নিয়ে, সের্গেই ভাবছে ওর বৌ অন্য লোকের সঙ্গে শুচ্ছে। আরও ব্যাপার কি জানিস তো, ছেলেটা ওর নিজের নয়, ওর বৌয়ের আগের বিয়ে থেকে জন্মেছে এই ছেলে। এই হচ্ছে ওদের ব্যাপার। এইজন্য আমি রাশিয়ান মেয়ে বিয়ে করতে চাই না, একটা মেয়েও ভার্জিন না।
    সাশার এই শেষের মন্তব্যটা শুনে আমি থ হয়ে গিয়েছি, আমার সমস্ত হিসেব গুলিয়ে গিয়েছে।
    ― এই দাঁড়া! কী বলতে চাইলি তুই?
    সাশা আবার ঝুঁকে পড়ে আমার দিকে, যেন খুব বিশ্বস্ত কারোকে বলছে এইভাবে বলে ― এইজন্যই আমার ভারতে আসা। এখানে আমি একটা পবিত্র মেয়ে পাব বিয়ে করবার জন্য। আমাদের দেশে মেয়েগুলোকে বিশ্বাস করা যায় না, কতজনের সঙ্গে যে শুয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।
    আমি ভুলে যাই যে এটা বড়োসায়েবের সেক্রেটারির ঘর, আমি ভুলে যাই যে এঘরে বসে এতসব আলোচনা করা উচিৎ নয়, কিন্তু সাশা আমাকে যেভাবে অবাক করে দিচ্ছে তাতে স্থান কালের হিসেব গুলিয়ে যাচ্ছে।
    ― তার মানে তুই বলতে চাস যে আমিও একটা খারাপ মেয়ে?
    একটু থমকায় সাশা। কিন্তু দমে না। খুব সিরিয়াস ওর মুখ। বলে, সেতো ঠিকই, তুই তো পবিত্র নোস, তোর তো কোনও ভবিষ্যৎ নেই, কী আছে তো জীবনে? 
    ― মানে!
    ― কেউ তোকে বিয়ে করবে না, কারণ তুই বিয়ে করবার যোগ্য নোস। অর্থাৎ সারাটা জীবন তোকে একা কাটাতে হবে, পুরুষেরা ঘন ঘন আসবে তোর জীবনে কিছু পাবার জন্য, তুই জানিস আমি কী পাবার কথা বলছি।
    আমি বুঝতে পারি না সত্যিই এসব ঘটছে নাকি দুঃস্বপ্ন, ও এসব বলে কী করে আমাকে? সাহস! সাহস যদি করেও থাকে, এই ই হচ্ছে ওর মনের কথা, হয়ত আরও অনেকেরই মনের কথা। ও নির্মমভাবে বলে দিল এখানেই পার্থক্য, অন্যরা মুখের ওপরে বলতে সঙ্কোচ বোধ করে।
    ও বলে চলে, ভুলে যাস না এটা ইন্ডিয়া, এখানে ভ্যালুজ আছে, এখানে অনেক কিছু শিখেছি আমি।
    ― ও! তোর গুরু তোকে শিখিয়েছে এইসব!
    ― আলবাৎ শিখিয়েছে। এখন আমি কাস্ট সিস্টেম জানি, মনে প্রাণে তাতে বিশ্বাস করি।
    ― তুই জাতপাতও মানিস।
    ― নিশ্চয়। এর পেছনে কাজ করছে হাজার হাজার বছরের সভ্যতা, সেসবের পেছনে কারণ আছে। এবং তোর জীবন সম্বন্ধেও আমি একটা কথা বলতে পারি, তোর কোনও ভবিষ্যৎ নেই। তোর মত মেয়ে যত কম থাকবে সমাজে তত পরিস্কার থাকবে সমাজ। তোর তো মরে যাওয়া উচিৎ।
    আবার দরজা খুলে যায়, সের্গেই ফের ঢুকেছে ঘরে। আমাদের দুজনের দিকে সন্দেহের চোখে তাকায়, তারপর বলে, সাশা যাবি না লাঞ্চে? নীচে গাড়ি ওয়েট করছে।
    ওরা চলে গেলে পরে আমি অবসন্ন হয়ে বসে থাকি। আমারও তখন লাঞ্চব্রেক, কিন্তু আমি চেয়ার থেকে উঠবার শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। ভাবছি সাশা এরকম কথা বলল কেন আমাকে? যে সোভিয়েত ইউনিয়নে আমি থেকেছি পেরেস্রৈকার আগে এবং পরে, সেখানে অনেক মানুষ দেখেছি। হ্যাঁ, ধর্মের প্রতি আসক্তি অনেকের ভেতরেই ছিল, বিশেষ করে তাশখন্দে আমি দেখেছি লুকিয়ে কোরাণ কিনবার হিড়িক। সেসব আরবী ভাষায় লেখা। যারা কিনত তারা একবর্ণও পড়তে পারত না সেই ধর্মপুস্তকের। তবু কিনত, কারণ ঐ বই তাদের কাছে পবিত্র। ঈশ্বরকে আঁকড়ে ধরবার একটা উপায়। যেহেতু দীর্ঘ সমাজতান্ত্রিক জমানায় তারা খোলাখুলিভাবে ধর্মাচরণ করতে সাহস পায় নি, রাষ্ট্রযন্ত্রকে ভয় পেয়েছে, তাই গোপনে ধর্মকে আগলে রেখে লালন করেছে। বইটা পড়তে না পারলেও তাকে আদর করে দামি কাপড়ে মুড়ে যত্ন করে রেখেছে, ঈশ্বরের সঙ্গে এ এক গোপন সংযোগ, ভালবাসা। সাশার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অন্যরকম। আধ্যাত্মিকতাও মানুষের একটা চয়েস, ও সেই চয়েসের জন্য গুরু খুঁজেছে, হিন্দুধর্ম ওর কাছে খুব আকর্ষনীয় লেগেছে, ও ইণ্ডোলজি পড়েছিল হয়ত সেজন্যই। কিন্তু কেমন গুরু খুঁজেছে ও? খালি ভেদাভেদ শেখাচ্ছে ওর গুরু। এসব তান্ত্রিক টান্ত্রিকদের কাছে যায় কেন ও, কীসের আকর্ষণে?
     
    (চলবে)
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:5195:1112:5618:e0b3 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৭:২২735631
  • চার

    মিঠুবাবুর দুটি সন্তান। বড়োটি মেয়ে, ছোটোটি মেয়ে না ছেলে মনে পড়ছে না। মিঠুবাবুর বড়ো মেয়ে ইংরিজি ইস্কুলে পড়ছে, লা মার্টিনিয়ার ফর গার্লস। কুচকুচে কালো কলপে রেশমি লম্বা বিনুনি করে মিঠুবাবুর বৌ মাঝে মাঝে আসে এই অফিসে। ইনি ইংরিজিতে চোস্ত, মিঠুবাবু বউকে দিয়ে নিজের অফিশিয়াল চিঠিপত্র কারেক্ট করিয়ে নেয়। একদিন শুনলাম বৌ রেগেমেগে দাঁতে দাঁত চেপে বলছে, এই চিঠিটা একদম হয় নি।
    সেদিন বড়োসায়েবের বৌ ফের জয়েন করেছেন কাজে, তবে শরীরের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে যে কোনওদিন লেবার শুরু হয়ে যেতে পারে। আমিও গেছি তখন ওঘরে ফোটোকপি মেশিনে একটা গোটা বই কপি করতে, ওপরের মেশিনটা বিগড়েছে। তখন শুনলাম বৌ খুব শাসাচ্ছে মিঠুবাবুকে বাংলায়। সে নরম স্বরে কাঁচুমাচু হয়ে বলছে, কোন জায়গাটায় কারেক্ট করতে হবে বলে দাও। বৌ রাগের চোটে প্রথমে কিছুই বলল না, তারপরে একটু দম নিয়ে বলল, চিঠিটা হয় নি, কারেক্ট করবার জায়গা নেই, পুরোটা নতুন করে লেখ, আচ্ছা তোমাকে লিখতে হবে না, আমি লিখে দিচ্ছি।
    এর পরে স্বামীস্ত্রীতে মিলে বড়োসায়েবের সেক্রেটারীকে তোয়াজ করতে লাগল, পেছনে যে আমি এসে দাঁড়িয়েছি এরা টের পায় নি। পেছন ফিরে দেখতে পেয়ে মিঠুবাবু একটু ভদ্রতার চেষ্টা করে আমায় দেখিয়ে স্ত্রীকে বলল, এই যে সেই মেয়েটি যার কথা তোমায় বলেছিলাম। আমি হাসিহাসি মুখ করলাম, নমস্কার বৌদি ভাল আছেন তো?
    বৌদি একটু হাসির মত মুখ করল, মানে খুবই আবছা হাসি মোনালিসার মত, প্রায় ধরাই যায় না এত সূক্ষ্ম এত ক্ষণস্থায়ী। আর হবে না ই বা কেন, আমাকে পাত্তা দেবার তেমন দরকার তো এদের নেই, বৌদির নিজের একটা বিজনেস আছে সেফটি ল্যাম্পের― যেগুলো খনির ভেতরে ব্যবহার করা হয়, তারপরে বৌদির ভায়ের বৌ হচ্ছে বাংলা সিনেমার ডাকসাইটে অভিনেত্রী, ড্রাইভার দারোয়ান থেকে শুরু করে সবাই আবদার করে, ও বৌদি একদিন আপনার ভায়ের বৌকে এখানে নিয়ে আসুন না, সামনা সামনি একটু চোখের দেখা দেখব। বৌদিও হুঁ হাঁ করে কাটিয়ে দেয়।
    বৌদিকে বাড়ি পৌঁছিয়ে দিয়ে মিঠুবাবু ফের হাজির অফিসে, আরও কিছু গাড়ি সারাই করাবার চেষ্টায় আমায় ধরে বলল, এই তুমি চট করে এই চিঠিটা একটু রাশিয়ানে ট্রান্সলেট করে টাইপ করে দাও তো, আমার খুব তাড়া এখন মেয়েকে স্কুল থেকে তুলতে হবে।
    আমি ট্রান্সলেট করতে করতে টাইপ করছি, মিঠুবাবু ঘাড়ের কাছে দাঁড়িয়ে তাড়া দিচ্ছে। বললাম, আমার মেয়েকে একটা ভালো ইস্কুলে ভর্তি করাতে চাই, আপনার মেয়ের ইস্কুলে হবে?
    মিঠুবাবু কপালে চোখ তুলে বলেন, আমার মেয়ের ইস্কুলে?
    ― হ্যাঁ। ইংলিশ মিডিয়াম তো? এই অফিসের থেকেও বেশ কাছে, কত করে নেয় ওরা মাসে মাসে? আমি তো ছহাজার পাচ্ছি, তেমন হলে পুরোটাই দিয়ে দেব, বলুন না কত মাইনে ওদের?
    ― না না, মাইনে অত না, কিন্তু তুমি পেরে উঠবে না। তাছাড়া তোমার বাচ্চাকে ওরা ভর্তি নেবেও না।
    ― আহা, এই বছর তো যা হবার হয়ে গেছে, সামনের বছরের কথা বলছি, ইংরিজি শিখিয়ে নেব এর মধ্যে।
    ― তোমার মাথাটা একদম খারাপ হয়ে গেছে দেখছি। ওরা এরকম যাকে তাকে অ্যাডমিশন দেয় না, অনেক বায়নাক্কা আছে। পেরেন্টের ইন্টারভিউ হয়, তাদের এডুকেশন, কত ইনকাম, ...
    আমিও লড়ে যাই, পেরেন্টের ইন্টারভিউ হলে আমি ইন্টারভিউ দেব, এডুকেশনও আছে, ইনকাম যা আয় করি তাইই দেখাব, আর কিছু লাগবে? আর ওখানে না হলে আর কোনও ইস্কুল যদি আপনার চেনা থাকে, বলুন না বাবা।
    মিঠুবাবু চিঠিটা হাতে নিয়ে ফশ করে পালিয়ে যায়। এরা কেউ আমাকে হেল্প করতে চায় না, মেয়েকে কাছাকাছি একটা ইস্কুলে ভর্তি করতে পারলে কত ভাল হতো। এক লাইন ইংরিজি লিখতে পারে না মিঠুবাবু তার মেয়ে যদি ভালো ইংরিজি ইস্কুলে পড়তে পারে তো আমার মেয়ে কেন ভর্তি হতে পারবে না? আমি কি ফ্রিতে পড়াতে চাচ্ছি নাকি? অদ্ভূত লোকজন সব।
    টেলিফোন ডিরেক্টরি খুলে পুরোনো চেনা লোকজনদের খুঁজবার চেষ্টা করতে লাগলাম। মেয়ে বন্ধুদের খোঁজা বৃথা, সব বিয়ে করে করে পদবী পাল্টে ফেলেছে, একজন দাদা গোছের পরিচিত ছিল, নিরঞ্জনদা, ব্যাঙ্কে চাকরি করত। ব্যাঙ্কের নামটাও মনে আছে। খুব বেশি ব্রাঞ্চ নেই এদের কলকাতায়। নিরঞ্জনদা এতদিনে চল্লিশ না হলেও কাছাকাছি হবে। দু তিনটে নম্বর ট্রাই করতেই সেই ব্যাংকের ডালহৌসী স্কোয়ার ব্রাঞ্চে নিরঞ্জনদাকে পাওয়া গেল। নাম শুনেই নিমেষে চিনে ফেলল সে আমায়। পারলে তখনই দেখা করবার জন্য ছুটে আসতে চায়। ফোনেই বলে দিলাম স্বার্থের জন্য যোগাযোগ করছি, মেয়েকে ভালো ইংরিজি ইস্কুলে ভর্তি করব, চেনাশোনা আছে কোনও? নিরঞ্জনদা তখনই গড়গড়িয়ে গোটা তিনেক ইস্কুলের নাম বলে ফেলল, সবকটাই পার্কস্ট্রীটের ওপর। কোএডুকেশনে পড়াতে আপত্তি আছে কিনা জানতে চাইল। একদম আপত্তি নেই, বরং কোএডুকেশনই বেশি পছন্দ করি বলে ফেললাম। এবছর তো হবে না, সামনের বছর হবে, এখন তো জুলাই মাস।
    ― তাতে কী? মাত্র তো এক দেড় মাস ক্লাস হয়েছে, গরমের ছুটি ছিল তো তার আগে। এই বছরেই তোমার মেয়েকে ভর্তি করে দাও, ক্লাস ওয়ান তো? এই কদিনের পড়া ঝপাঝপ তুলে নেবে তোমার মেয়ে, কী এমন শক্ত হবে! দাঁড়াও আমি কয়েকটা ফোন করে নিই তোমার জন্য। তাহলে আজ না, কাল দেখা করি তোমার সঙ্গে।
    আমি নিজের হাতে চিমটি কেটে দেখে নিলাম জেগে আছি না স্বপ্ন দেখছি। সব ভালোয় ভালোয় হয়ে গেলে মিঠুবাবুকে দেখিয়ে দেব যে আমিও পারি মেয়েকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াতে।
    নিরঞ্জনদার সঙ্গে দেখা করব যেদিন, ঠিক ছিল অফিস ছুটির সময়ে নিরঞ্জনদা নিজেই চলে আসবে, তারপরে কোথাও একটা গিয়ে বসব, ইস্কুলের ব্যাপারে আলোচনা করা যাবে। সাড়ে ছটা নাগাদ আসতে বলেছি তাকে, সেদিন আমার বসও নেই, কাজের চাপ কম, বেরোতে যাচ্ছি তখন সের্গেই ডাকল ওর ঘরে। গেলাম। ও তো আমাকে কোনও কাজ দেয় না কখনও, তবে বসের অনুপস্থিতিতে ও ই তার ডেপুটি কাজেই কাজ কিছু দিলেও দিতে পারে।
    সের্গেই আমাকে বলল, পরশু রৌরকেল্লা যাচ্ছি, তুই যেতে পারবি আমার সঙ্গে?
    ― রৌরকেল্লা? কেন?
    প্রতিবর্ত ক্রিয়ার মত প্রশ্নগুলো করে ফেলেছি আমি। প্রায় মাস তিনেক কাজ করছি, কখনও কলকাতার বাইরে যাবার কথা কেউ বলেনি আমায়। এরা তো হরদমই যায় নানান সাইটে। রৌরকেল্লায় আমার কী কাজ থাকতে পারে? টাইপিং? আজ বাদে কাল বড়োসায়েবের গার্লফ্রেন্ডের যদি প্রসব বেদনা ওঠে, আর আমি যদি তখন রৌরকেল্লায় থাকি তবে সেক্রেটারির কাজগুলো করবে কে? মুখে এসব বললাম না যদিও।
    সের্গেই বলল, কেনর আবার কী? আমি যেতে বলছি, আমি তো নিয়মিত যাই। তোর বাইরে বেড়াতে যেতে ইচ্ছে করে না?
    সেরকম কখনও ভাববার সময় পাইনি আমি, দুমুঠো খাবার আর তার থেকেও জরুরি জিনিস, মাথার ওপরে একটা ছাদ পাবার জন্য কী না করছি। টানা দুহপ্তা এদের ব্যবহার করা তোয়ালে কেচেছি। আমাদের বস্তিতে সন্ধেবেলা কলে জল থাকে না, একটা কল আছে মাটির নীচের লেভেলে গর্তের মধ্যে বসানো, সেখানে তির তির করে একটু একটু জল পড়ে। সারা সন্ধে সেখান থেকে জল তুলে তুলে কলতলায় বসে তোয়ালে কাচোরে, ধোওরে, ভারি ভারি তোয়ালে নিংড়োতে নিংড়োতে হাতে কাঁধে ব্যাথা হয়ে যায়, তারপরে সেসব শুকোনোও বিশাল ঝামেলা। সাধে সুইপার বলেছিল যে বর্ষার সীজনে অত চট করে তোয়ালে শুকোয় না! শেষে সেসব ঝামেলা চুকিয়ে ফেলেছি, পারব না বলে দিয়েছি ওদের। এখনও বাহাত্তর টাকা পাই দুবারের টাকা, আগের একবারের টাকা মোটে পেয়েছি। সাশার কাছে চাইতে হবে, কিন্তু ও যেমন সব কথা শুনিয়েছিল সেদিন যে চাইতে ইচ্ছে করে না। এই মুহূর্তে আমার মেয়েকে ইস্কুলে ভর্তি করবার প্ল্যান করছি। এখন হুট করে রৌরকেল্লা চলে গেলে তিন চারদিনের আগে তো ফিরতেই পরব না, এইই কি আমার বেড়াতে যাবার সময়? ও আমাকে ডাকে কেন? ঘরে বৌ রয়েছে বৌকে নিয়ে যাক বেড়াতে। না, বৌ অবশ্য এখন নেই, বৌ তো মস্কোয়। ওর উদ্দেশ্যটা কী?
    বললাম, আমার তো এখন যাওয়া হবে না, অনেক কাজ আছে।
    ― অফিসের কাজ? সে সাশা সামলে নেবে নাহয়।
    ― অফিসের কাজ নয়, অফিসের বাইরে, প্রাইভেট।
    ―ও আচ্ছা, তাহলে ঠিক আছে।
    সের্গেই এক কথায় মেনে নিল। আমিও হাঁফ ছেড়ে বেরিয়ে নীচে নেমে দেখলাম নিরঞ্জনদা অপেক্ষা করছে। দশ বছর আগে দেখেছিলাম লাস্ট। অনেক মোটা হয়ে গেছে। নাহ, দশ বছর আগে নয়, মাঝে একবার দেখেছি ১৯৮৯ সালে, মাত্র মিনিট পাঁচেকের জন্য, সেসব অন্য গল্প। নিরঞ্জনদা খুব পান খাচ্ছে, আমাকে দেখেই বলল, তোমার সব খবর আমার কানে আসে। দাঁড়াও একটু ভালো করে দেখি তোমাকে। শুনলাম খুব মডার্ণ হয়ে ফিরেছ বিদেশ থেকে, একেবারে নীনা গুপ্তা, নাকি সারিকা?
     
    (চলবে)
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:5195:1112:5618:e0b3 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৭:৪২735633
  • ষষ্ঠ অধ্যায়

    So, this is hell. I’d never have believed it. You remember all we were told about the torture-chambers, the fire and brimstone, the “burning marl.” Old wives’ tales! There’s no need for red-hot pokers. Hell isother people!
    ― No Exit, Jean-Paul Sartre

    তুই মরে যেতে পারিস না? তুই মরে গেলি না কেন? তোর তো মরে যাওয়াই উচিৎ ছিল। তোর বেঁচে থাকার কি কোনও অর্থ আছে? এই কথাগুলো এতজনের কাছ থেকে শুনেছি, কখনও জোরে বা মৃদুস্বরে, কখনও অনুচ্চারিত স্বরে, এতবার শুনেছি যে ক্রমশ মনের মধ্যে ধারণা জন্মে বেড়ে বদ্ধমূল হয়ে গেছে যে আমি বড্ড অনাহূত এই দেশে সমাজে শহরে। বাঁচতে যে একেবারেই ইচ্ছে করে না তা নয়, করে, আবার মাঝে মাঝে করেও না। একটা দোটানার মধ্যে দিন কাটাই। অনেক মৃদুভাষী লোকজন আমায় বলেছে, তোমার নিজের কথা ছেড়ে দাও, ঐ বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকিয়ে তোমায় বাঁচতে হবে, ওকে বড়ো করে তোলা ওকে মানুষ করে তোলাই তোমার এখন জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। হয়ত হুবহু এই বাক্যটাই বলে নি, কিন্তু এই কথাগুলোই ঘুরে ফিরে প্রতিধ্বণিত হয়েছে প্রত্যেকের মুখে। যেন আমার নিজের জীবনটা পুরোপুরি শেষ, ফিনিশড, আমি একটা জিন্দা লাশ। সেই জিন্দা লাশ একটা শিশুকে বড়ো করে তুলবে, মানুষের মত মানুষ বানাবে। অদ্ভূত যুক্তি না? কী আবদার মাইরি! একজন মৃত মানুষ এক শিশুকে বড়ো করে তুলছে বা তুলবে। এই মুহূর্তে মৃত মানুষটা শিশুটার খুব কাছে যেতে পারছে না, তবু সেটাই হবে তার মরে থাকার উদ্দেশ্য। এতগুলো লোক যখন এই কথাই বারে বারে বলছে, তখন এটাই নিশ্চয় সত্যি। এর বাইরে ভাবছে না কেউ। কেউ বলছে না যে তোমার একটা নিজের জীবন রয়েছে, তোমার সামনে বিশাল ভবিষ্যৎ অসীম সম্ভাবনা, তুমি সামনে এগোবে, কর্মক্ষেত্রে সফল হবে, উন্নতি করবে, প্রেম আসবে জীবনে, সুখ আসবে, সম্বৃদ্ধি আসবে, সেই আনন্দ সমাগমের দিনে আমরা সবাই থাকব তোমার পাশে, টুগেদার উই উইল সেলিব্রেট ইট। কেউ বলে না। নাকি আমিই পাগল? হয়ত মানসিক ভারসাম্য নেই আমার, তাই আর পাঁচজন লোকে যা ভাবে সেরকম ভাবতে পারছি না, অন্য জগতে রয়েছি, অলীক স্বপ্নের জগতে যা বাস্তব থেকে অনেক অনেক দূরে। আমি কি স্কিজোফ্রেনিক? আর পাঁচজন মানুষের যুক্তি বা সাজেশানকে কেন উপেক্ষা করতে চাই? কেন মনে হয় যে শিশুটার জন্য বেঁচে থাকা আমার জীবনের উদ্দেশ্য নয়? কেন মনে হয় যে নিজের জন্য বাঁচতে চাই, মাতৃস্নেহের প্রতিমূর্তি হয়ে, আত্মত্যাগের প্রতীক টাইপ একজাম্পল হবার বিন্দুমাত্র উৎসাহ নেই আমার ভেতরে। সন্তানের জন্ম দেওয়া কি পাপ? হোয়াটেভার ইট ইজ, আমার নিজের একটা আলাদা উদ্দেশ্য আছে জীবনে, লোকে সেটা শেষ করে দিতে চাইছে কেন? তাতে ওদের কী লাভ?
    নিরঞ্জনদা যখন আমার তুলনা টানল দুজন সেলিব্রিটির সঙ্গে তখন এই সমস্ত মনে পড়ছিল। আমি অন্যমনস্ক হয়ে গেছলাম। তার মধ্যে হয়ত সে আরও অনেক কথা বলেছে, শুনতে পাই নি, যেটা শুনতে পেলাম― আমি বাগুইআটিতে একটা ফ্ল্যাট কিনে রেখেছি, বন্ধই পড়ে থাকে এমনিতে, সামনের রোববারে চলে এসো।
    আমার বলতে ইচ্ছে করছিল, নিরঞ্জনদা আমি অনেক ফিল্মস্টারের অনুকরণে চুল বেঁধেছি, চুল কেটেছি, সেজেছি, কিন্তু অন্য কারও অনুকরণে নিজের জীবন চালাতে চাই নি। এমনকি কোনও মহাপুরুষ বা মহানারীর জীবনের আদলেও না। আজ আমার একটা বাচ্চা আছে বলে আপনি অনায়সে ফাঁকা ফ্ল্যাটে ডেকে শুতে চাচ্ছেন তো? বুঝতে পেরেছি। পনেরো মিনিট আগে একজন লোক রৌরকেল্লায় নিয়ে যেতে চাইছিল, তারও এরকমই উদ্দেশ্য। মুশকিল হচ্ছে যে আমি একটু বেকায়দায় আছি, আমার শক্তি কম, এই লড়াইয়ে পেরে উঠব না আপনাদের সঙ্গে। আমাকে পাশ কাটিয়ে চলতে হবে। আপনারা মনে করেন একটা মেয়েকে বেকায়দায় পেলে তার সঙ্গে শোওয়া যায়। যেখানে মেয়েটির কোনও বডিগার্ড বা মালিক বা আপনাদের কমন ল্যাঙ্গুয়েজে যাকে বলে গার্জেন ― সেই গার্জেন নেই। আমার বডিগার্ড বা গার্জেন লাগবে না। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ আমি, তাই গার্জেন ছাড়া যতগুলো দিন স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারি বেঁচে নেব, স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়ে বাঁচতে হলে সে মরে থাকারই সামিল। কিন্তু আপনি তো এতটা ঠিক বুঝতে পারবেন না, আপনার বোধ-বুদ্ধি এবং দেখার জানলা আলাদা।
    এর একটা কথাও উচ্চারণ করিনি। ন্যাকা সেজে রইলাম। বললাম খুব চেষ্টা করব, আসলে ভীষণ দূরে থাকি তো, এক্সট্রিম সাউথে। মেয়েটা স্কুলে ভর্তি হয়ে যাক, তখন অনেকটা ফ্রী হয়ে যাব, তারপর একদিন প্ল্যান ট্যান করে...
    মনে মনে খিস্তি করলাম, শালা তুই কী ভেবেছিস আমাকে? বছরের মধ্যিখানে ইস্কুলে ভর্তি করানোর জন্যে শুতে হবে তোর সঙ্গে? আমি কি ফরেস্ট গাম্পের মা! বেশ্যাবৃত্তি করতে হলে নিজের মর্জিতে করব রে, তোর মর্জিতে নয়।
    নিরঞ্জনদাকে আমার আরও অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করেছিল, ঠিক রেগে গিয়ে নয়, এমনিই। জানেন নিরঞ্জনদা, আমি চেরিফল চিনতাম না আগে। আপনি চেনেন কি? যখন কলকাতায় বেড়ে উঠেছি, জীবনের প্রথম ঊনিশ কুড়িটা বছর আমি মিষ্টির দোকানের শোকেসের ভেতর দিয়ে লাল কুচি বসানো সন্দেশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবতাম ওগুলোই চেরি বসানো সন্দেশ। টুকটুকে লাল গরগরে মিষ্টি কচকচে খেতে সেই ফলের টুকরোটাকে শুধু আমি নই, ঐ মিষ্টির দোকানদার থেকে শুরু করে সকলেই জানতাম চেরিফল। আন্তন চেখভের "দ্য চেরি অর্চার্ড" অর্থাৎ ইংরিজিতে অনুবাদ করা নাটকের নামে যে ফলটার কথা লেখা আছে সেই চেরি আর এই চেরি আমার কাছে অভিন্ন ছিল। অথচ এর দুটোর কোনওটাই আসলে চেরি নয় তা বুঝতে আমার অনেক সময় লেগেছে। প্রথম সত্যিকারের চেরি দেখি তাশখন্দের বাজারে। বেশ দামি ফল। কিনে খেয়ে দেখলাম এ সম্পূর্ণ অন্য জিনিস। কলকাতায় যা খেয়েছি তা আসলে চিনির রসে জারিয়ে রাখা লাল রং করা করমচার মোরব্বা। তাশখন্দের রাস্তায় ঘুরতে ফিরতে কোনও কোনও বাড়ির ফলের বাগানে থোকা থোকা লাল টুকটুকে ফল ঝুলে থাকত, হাত বাড়িয়ে টেনে ছিঁড়ে মুখে ফেলে দেখেছি মারাত্মক টক। তাহলে কি কাঁচা চেরি মুখে পুরলাম নাকি? পরে জেনেছিলাম, ওর নাম ভিশ্ন্যা, ও ফল কখনও মিষ্টি হয় না বরাবর টকই থেকে যায়। চেখভের নাটকের নামে আছে ঐ ভিশ্ন্যার বাগান, চেরি নয়। করমচার মোরব্বা থেকে শুরু করে আসল চেরি চিনে নেবার জন্য আমায় টক মিষ্টি অনেক স্বাদের ফল পরখ করতে হয়েছে। তেমনি আমার জীবনের পথ চলা। আমিতো ছোটবেলা থেকেই জানতাম আমি স্বাধীন একটা মানুষ। পায়ে যে বেড়ি পরানো রয়েছে তা টের পাই নি। বুঝলাম অন্য দেশে গিয়ে, টাইম মেশিনে চড়বার পরে। জানেন, ছোটবেলা আমার খুব ইচ্ছে ছিল বড়ো হয়ে ট্রাম চালানোর, ট্রামের ড্রাইভার হবার। অরণ্যদেবের পোশাকের মত লাগত আমার ট্রাম ড্রাইভারের ইউনিফর্ম।  বাবাকে বলেওছিলাম মনের কথা। বাবার বন্ধুরাও শুনেছিল, শুনে ঘুরিয়ে দিয়েছিল আমার কথা। অন্য কিছু হতে বলেছিল, আরও ভাল কোনও পেশা বেছে নিতে বলেছিল,  যেমন বড়ো অফিসার, কি প্রোফেসর, কি বৈজ্ঞানিক। তারা বলতে চায় নি যে কলকাতায় ট্রামের ড্রাইভারের চাকরিতে মেয়েদের নেয় না। বাসের ড্রাইভারের চাকরিতেও নয়। তারা বলতে চায় নি যে আমি সমান সমান নই। বড়ো হয়ে এসব দেখতে দেখতে চোখ সয়ে গেছল, কিন্তু অন্য দেশে পাড়ি জমিয়ে দেখলাম সেখানে মেয়েরা ট্রাম চালাচ্ছে মস্ত মস্ত বাস চালাচ্ছে, দেখে আমার মনের ভেতরটা তোলপাড় করে উঠল। করমচার মোরব্বাকে চেরি বলে আমায় আর চালিয়ে দেওয়া যাবে না। আমার ইচ্ছে, আমায় চয়েস, এগুলো ফের এগিয়ে এলো মনের সামনে। নিজের ইচ্ছে মত নিজের পছন্দের জীবন বেছে নেবার অধিকার। যাকে সংক্ষেপে আপনারা বলবেন স্বাধীনতা। তা তো এমনি এমনি আসে না, তাই না? তার জন্য দাম দিতে হয়, মূল্য চোকাতে হয়, সেই মূল্যই চোকাচ্ছি ধরে নিন। আপনি আমায় দুটো কটু মন্তব্য করলেন, আমি সয়ে নিলাম। এছাড়া তো আর কিছু করবার নেই আমার। আমার ক্ষমতা কম, তবু চেষ্টা করে যাচ্ছি টিকে থাকতে, কতদিন পারব তা জানি না।
    ভাবি এইসব বলব নিরঞ্জনদাকে পরের বার যখন কথা হবে, টেলিফোনে বা সামনা সামনি। কিন্তু পারি না। ভেতর থেকে অবশ লাগে নিজেকে।
     
    (চলবে)
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:5195:1112:5618:e0b3 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৭:৪৪735634
  • দুই

    একটা ট্রেন চলছে বনের ভেতর দিয়ে। এত গভীর বন যে ট্রেনের জানলায় গাছের ডালপালা ঢুকে যাচ্ছে, গাছ ঢেকে দিচ্ছে বাইরের আলো। অনেকটা যেন সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে ট্রেনে করে যাবার এক্সপিরিয়েন্স। ট্রেনের কামরায় কে কে রয়েছে তা যেন জানি, চেনা লোকেরাই আছে তবে তাদের স্পষ্ট করে চেনা যায় না। কোথায় চলেছি আমি? রৌরকেল্লা? না মনে হয়, অন্য একটা কোন জায়গার নাম বলছিল একজন যাত্রী। তার দিকে ফিরে তাকাতে যেতেই আলোয় ভরে গেল ট্রেনের ভেতরটা। চোখের ওপর যেন আলো পড়ছে। আমি ঘুম থেকে জেগে গিয়েছি। স্বপ্ন দেখছিলাম তবে এতক্ষণ? কিন্তু আলো পড়ছে আমার চোখে। ঠাওর করে দেখলাম লাইট জ্বলছে। আমার ঘরে নয়, পাশের ঘরে। যে ঘরটায় সেই কালো বৌ চশমা পরা বরের সঙ্গে থাকে। দুটো ঘরের মধ্যে একটা দরজা আছে, সেই দরজার পাল্লা দুটো খোলা। ধড়মড়িয়ে উঠে পড়লাম। ঐ দরজাটা প্রথম থেকেই বন্ধ থাকত, বাড়িওয়ালা বলেছিল ওটা পেরেক দিয়ে আটকানো আছে ওদিক থেকে কেউ খুলতে পারবে না। আমার ঘরের ভেতর থেকে এই দরজা বন্ধ করে দেবার মত কিছু নেই, হুড়কো কি ছিটকিনি, কিছুই না। উঠে বসতেই একটা লোক আমার ঘরের ভেতর থেকে লাফ দিয়ে ছুটে পাশের ঘরটায় চলে গেল। আমি চিৎকার করে উঠলাম, মাসীমা! মাসীমা! বাঁচাও―
    লোকটা পাশের ঘরে গিয়েই দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছে ভেতর থেকে। আমি দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে বাড়িওয়ালাদের ঘরের সামনে গিয়ে ডাকতে শুরু করেছি, শিগগিরি বাইরে আসুন সবাই।
    এতক্ষণে মাসীমার ঘুম ভেঙেছে, তার ছোটোছেলেও বেরিয়ে এসেছে। সব বললাম তাদের। এ কীরকম ব্যবস্থা আপনাদের? দুটো ঘরের মধ্যে দরজা, সেই দরজা আমার দিক থেকে বন্ধ করবার কোনও উপায় নেই, আর পাশের ঘরের লোক মাঝরাতে ঘরে ঢুকে পড়ছে! আমি আজই এই ঘর ছেড়ে দেব।
    বাড়িওয়ালার ছোটো ছেলে গিয়ে পাশের ঘরের দরজায় ধাক্কা মারে। এদিকে আশেপাশের সব ঘরের লোক বেরিয়ে এসেছে, উঁকিঝুকি মারছে, রাত দেড়টার ওপর তখন। পাশের ঘরের লোকটা দরজা খুলতে বেশ দেরি করল, তারপরে যেন সদ্য ঘুম ভেঙেছে এরকম একটা ভান করে বেরিয়ে এসে বলল, কী হয়েছে?
    ― কী হয়েছে মানে? আপনি নাকি পাশের ঘরে ঢুকে পড়েছিলেন একটু আগে!
    ― পাগল নাকি! আমি তো শুয়ে পড়েছি সেই দশটায়।
    লোকটা এমন ভাব দেখাচ্ছে যেন খুব বিরক্ত হয়েছে ওকে মাঝরাতে ডাকাডাকি করার জন্য। তাও বাড়িওয়ালার ছেলে চাপ দেয় একটু, চলুন চলুন, আপনার ঘরে চলুন, দেখব দরজাটা। আমিও পেছন পেছন গেলাম। পেরেক ফেরেক দিয়ে আটাকানোর কোনও ব্যবস্থাই নেই, ওপরে কেবল একটা শেকল দেওয়া, তাতে তালা পর্যন্ত নেই, যে কেউ যখন তখন ঢুকতে পারে। আমি যখন ঘরে থাকি না, তখনও ঢুকতে পারে ঐ দরজা দিয়ে, হয়ত ঢুকেওছে, ছোটোখাটো অনেক জিনিস মিসিং, একটা ওয়াকম্যান ছিল, সেটা অনেকদিন ধরে পাচ্ছিনা খুঁজে, আর খুব বেশি দামি জিনিস ছিল না যদিও। টাকা পয়সা সবই হয় অফিসের ড্রয়ারে নয় ব্যাঙ্কে রয়েছে, গয়নাগাটিও নেই, কিন্তু আজ রাতে ও ঢুকেছিল কোন উদ্দেশ্যে? ও তো জানত আমি ঘরে রয়েছি, ঘুমোচ্ছি। ওর বৌ ই বা কোথায় এখন?
    এত শত প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতেও ইচ্ছে করেনা, বাড়িওয়ালার ছেলেকে বলে দিই, আমার ঘরের ভেতর থেকেও শেকলের ব্যবস্থা করে দিন, নইলে কালকেই ঘর ছেড়ে দেব।
    কোনও কিছুকে বাইরে থেকে দেখে বা শুনে অনুভব করা আর সেই  জিনিস নিজের সঙ্গে ঘটলে সেটার যা এফেক্ট হয়, দুটোর মধ্যে কোনও তুলনা হয় না। যেমন আমরা খবরের কাগজে একটা খুনের খবর পড়লাম, তারপরে ব্রেকফাস্ট করবার তাড়া, জামাকাপড় ঠিকঠাক পরেছি কিনা এসব খুঁটিনাটিতে ঢুকে গেলাম। বা একটা রেপ হয়েছে, আহাউহু চুকচুক, তারপরেও চানাচুরের স্বাদ দিব্যি লাগে, আর লাগবে না ই বা কেন, যার সঙ্গে হয়, সে ই বোঝে, বাকিরা দর্শক, সহানুভূতিশীল দর্শক, তাদের গায়ে আঁচ লাগে নি, তারা ধরেই নিয়েছে যে আঁচ লাগবে না, তারা নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করছে।
    মাঝরাতে ঘরের মধ্যে লোক ঢুকে পড়লে কেমন লাগে বোঝানো শক্ত। আমি জোর করে শেকল লাগানোর ব্যবস্থা করে তারপরে অফিসে গেলাম।
    মেয়ের ইস্কুলে ভর্তির জন্য বারবার যেতে হচ্ছে পার্ক স্ট্রীট। অফিস কোনও ঝামেলা করে না, বরং বলে দেখ যদি গাড়ি ফ্রি থাকে নীচে, গাড়ি নিয়ে যাও। নিরঞ্জনদা বলে দিয়েছে কিনা, তাই মেয়ের একটা নাম কা ওয়াস্তে টেস্ট নেয় ওরা, কিন্তু মুশকিল অন্যখানে, ক্লাস ওয়ানে একটা সীটও ফাঁকা নেই, তিনটে সেকশনের কোনটাতেই নেই। তাহলে উপায়? ইস্কুলে যে ভদ্রমহিলা এসব কোঅর্ডিনেট করেন তিনি একটা নতুন অপশন দিলেন― ক্লাস টু তে ভর্তি করে দিন মেয়েকে। এমনিতেই ফেল করবে, পরের বছর আবার রিপিট করবে ক্লাস টু। মন্দ নয় অপশনটা। মোটামুটি একটা বন্দোবস্ত তো হল। কোনও চাপ থাকবে না পড়াশোনার। আস্তে ধীরে শিখবে। আমি ওকে ইস্কুলে পৌঁছে দেব, ছুটির সময় আনতে যাব। এরকম করতে করতে মেয়ে আমায় ভালো করে চিনবে। ক্লাস টুয়ের বুকলিস্ট নিয়ে বই কিনে ফেললাম, খাতা, দুসেট ইউনিফর্ম। আমি খুব খুশি। ইস্কুলের দারোয়ানকে পঞ্চাশ টাকা বকশিস দিয়ে ফেলেছি।
    এত তড়িঘড়ি করে তাকে ইস্কুলে ভর্তি করানোর পেছনে কারণও ছিল। ও যে শনিবার শনিবার করে আসছে আমার সঙ্গে থাকতে এবং রবিবারের বিকেলে আমি ওকে ফিরিয়ে দিয়ে আসছি গড়িয়াহাটের মোড়ে, এই সময়টুকু হয়ত চব্বিশ ঘন্টার কিছু বেশি, কিন্তু সেই সময়টুকু মসৃণ নয়। ও হঠাৎ করে চুপ করে যায়, ওবাড়ীতে কী করে, কী খায়, কী খেলে, এসব জিজ্ঞেস করলেই পুরোপুরি চুপ। আবার অন্য প্রসঙ্গ তুললে দিব্যি কথা বলছে। আমি কোথায় কাজ করি, কী কাজ করি, কত মাইনে পাই, আমার বন্ধুবান্ধব কে কে, আরও অনেক খুঁটিনাটি ও জিজ্ঞেস করে একেবারে প্রাপ্তবয়স্কদের মত। যেই তাকে জিজ্ঞেস করব, হ্যাঁরে এসব কথা তোকে কে শেখালো? অমনি সে চুপ হয়ে যাবে। 
    প্রথমদিকে তবু আমার সঙ্গে ঘুরত বেড়াতো, যা রাঁধতাম বা কিনে দিতাম সেসব আনন্দ করে খেত, গল্প করতাম কত কিছু নিয়ে। কিন্তু একটার পর একটা সপ্তাহ যেই কেটে যাচ্ছে, মেয়ে কেমন বদলে বদলে যায়, শনিবার সন্ধে হলেই সে বিষন্ন, তাকে গল্প বলে, বেড়াতে নিয়ে গিয়ে, কোনও কিছু কিনে দেবার লোভ দেখিয়েও খুশি করা যাচ্ছে না। সে উশখুস করছে ফিরে যাবার জন্য। কিন্তু কেমন করে তাকে ফিরিয়ে দেব আমি শনিবারে? আমার তো হাত পা বাঁধা। শনিবারের সন্ধেয় তাকে নিতে তো কেউ আসবে না গড়িয়াহাটের মোড়ে। আসবে রবিবারের বিকেলে। আমি তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে সুশীলা রেস্টুরেন্টে চপ কাটলেট খাওয়াই, খাবার সময়টা চুপ থাকে, একটু পরেই আবার উশখুস। লোকে দেখলে ভাববে আমি তার অচেনা, হয়ত বাচ্চা চুরি করে পালাচ্ছি। সে নতুন ইস্কুলে ভর্তি হয়ে গেছে জেনেও তার মনে আনন্দ নেই, সর্বক্ষণ কী যেন ভাবে। বলে, আমি কি ইংলিশ মিডিয়ামে পারব?
    ― কেন পারবি না? আর পাঁচটা ছেলেমেয়ে তো পারছে।
    তখন ছবছরের বাচ্চা বলে, ওসব ইস্কুল ভালো নয়, ওখানে পড়াশোনার চেয়ে কায়দা বেশি।
    কেমন যেন মনে হয়, নিশ্চয় কারও কথা নকল করে করে বলছে। একটা শনিবারে সন্ধের শুরুতেই মেয়ে কাঁদতে শুরু করল। কান্না আর থামে না। কেন কাঁদছে বুঝতে পারি না। বাড়িওয়ালার স্ত্রী বলে, ওর কি পেট টেট কামড়াচ্ছে নাকি, পেট খারাপ? যাও পায়খানা করে এসো।
    মেয়ে চুপ করে যায়, ফের কাঁদে। ওকে নিয়ে হাঁটতে বের হলাম। একটু পরে সে ভেঙে পড়ল পুরো।
    ― দিদিমা বলেছে আজ তোমার অফিসে দিয়ে যাবার সময়, আমায় আর ফেরৎ নেবে না!
    মেয়ে হুহু করে কেঁদে চলেছে। আর চেপে রাখতে পারে নি। প্রত্যেকবার তাকে আমার কাছে পৌঁছে দেবার সময় দিদিমা গা ছুঁইয়ে দিব্যি করিয়ে নেয়, ও বাড়ীর একটা কথাও মা কে বললে দিদিমা তখুনি মরে যাবে, মায়ের ওখানে কী কী হয়, কারা কারা আসে, সব খবর জেনে নিয়ে তাকে বলতে হবে, এটার জন্যও আলাদা করে গা ছুঁইয়েছে, শেষের সপ্তাহগুলোয় নতুন জিনিস শুরু করেছে, অন্যরকমের ভয় দেখানো, তার একটা হচ্ছে ইংলিশ মিডিয়াম খারাপ, ওখানে যারা পড়ে তারা খারাপ হয়ে যায়, এবং অন্যটা আরও সাংঘাতিক, দিদিমা আর ফেরৎ নেবে না ওকে। মেয়েটি এত বেশি নির্ভর করে দিদিমার ওপরে, সেই দিদিমাই ওকে ফিরিয়ে না নেবার ভয় দেখায় অনবরত। এই কারনেই ও আমার কাছে এলেও মনমরা হয়ে থাকে, কোনও আনন্দে অংশ নিতে পারে না।
    সব শুনে বুঝে আমিও ভয় পেয়েছি। সবার আগে ওর মনের ভয় কাটাতে হবে। সোজা নিয়ে গেলাম টেলিফোন বুথে, ফোন করালাম ওকে দিয়ে দিদিমাকে। মেয়ে ফোনে কথাই বলতে পারছে না এত কাঁদছে হাপুস নয়নে। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠছে, তবু কোনোমতে বলল, দিদিমা তুমি আমাকে ফেরৎ নেবে তো?
    ওপাশ থেকে কী বলল শুনতে পাই নি। তবে মেয়ে বলল, কালকে বিকেলে ঠিক আসবে তো নিতে?
    ফোন রেখে দিয়ে কান্না থেমেছে। আমরা সুশীলা রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসলাম কাটলেট খাবার জন্য। কাটলেট ভেঙে ভেঙে মিষ্টি সস মাখিয়ে খেতে খেতে তার মুখে হাসি ফুটল, সে কাটলেটের ভেতর থেকে সবজেটে একটা পেঁয়াজের টুকরো বের করে বলল, এই নীল নীল জিনিসগুলো খেলে কান্না কমে যায়। ওগুলোর মধ্যে একটা ওষুধ মেশানো আছে, তাই না মা?
     
    (চলবে)
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে প্রতিক্রিয়া দিন