এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  স্মৃতিচারণ  আত্মজৈবনিক

  • কাপালিক The Skull Man

    সে
    স্মৃতিচারণ | আত্মজৈবনিক | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ৪২৬৬ বার পঠিত | রেটিং ৪.৭ (৩ জন)
  • খেই ধরানো

    যে কোনও বই পড়বার সময় ভূমিকাটুকু বাদ দিয়ে পড়া আমার বরাবরের স্বভাব। ঐটে মূল পাঠ্যাংশের তুলনায় কম আকর্ষণীয় লাগে। কিন্তু নিজে লিখবার বেলায় খেয়াল হলো যে কিছু কৈফিয়ৎ আগেভাগেই জানিয়ে না দিলে পাঠকদের ওপর অন্যায় করা হবে।
    "কাপালিক" আমার নিজের জীবনের ঘটনা, যদিও চরিত্রদের নাম বদলাতে হয়েছে। এর সময়কাল উনিশশো ছিয়ানব্বই সালের মধ্যেই সীমিত। এই সময়টা আমার বিদেশ থেকে ভারতে ফিরে আসার সন্ধিক্ষণ।
    আমি ভেঙে যাওয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের তাশখন্দ থেকে ফিরেছিলাম কলকাতায়। যে কলকাতাকে ছেড়ে আমি দশ বছর আগে সোভিয়েত ইউনিয়নে গেছলাম উচ্চশিক্ষার্থে, ফিরে আসবার পরে সেই কলকাতাই কেমন যেন অচেনা ঠেকছিল। অথচ দশটা বছরে আমি কতবার ঘুরে গেছি আমার শহর থেকে, যদিও সেসব ছিল ছুটি কাটানোর মত শর্টট্রিপ, এবার এলাম পাকাপাকি থাকতে। অর্থাৎ আমার একটা উপার্জনের ব্যবস্থা চাই, অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত দম ফেলবার সময় নেই। না, আমার কাছে কোনও নিজস্ব সঞ্চয় ছিল না।তাশখন্দে আমি ছিলাম শুধুই ছাত্র, কোনও চাকরি করিনি সেখানে।আমার সঙ্গে ফিরেছিল আমার বয়ফ্রেণ্ড, সেও সবে পাশ করেছে, সেও ভারতীয়, সেও বাঙালী, তবে তার বাড়ি কলকাতা থেকে বহুদূরে পাহাড়ে ভরা মেঘালয় রাজ্যের শিলং শহরে। ছবছর আমরা একসঙ্গে থেকেছি তাশখন্দে। এই ছবছরে আমাদের একটা সন্তান জন্মেছে, মেয়েসন্তান, অবশ্য বিয়ে করি নি আমরা। আমাদের মেয়েকে কলকাতায় আমার মায়ের কাছে রেখে গিয়েছিলাম কিছু বছর আগে। তার বয়সও সবে পাঁচ হয়েছে। সে আমার মায়ের কাছেই থাকে। আমার বয়ফ্রেণ্ড তার বাড়িতে সব খবরই গোপন রেখেছিল। তাদের রক্ষণশীল পরিবার, তার দিদির তখনও বিয়ে হয় নি। ছোটভাই বান্ধবীর সঙ্গে থাকে, সে বিয়ে না করেই বাবা হয়েছে, এসব লজ্জার ঘটনা বলেই ধরা হয় তাদের পরিবারে, বলা হয় স্ক্যাণ্ডাল। এসব খবর জানাজানি হলে দিদির বিয়ে আটকে যেতে পারে। ভারতীয় অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ প্রথায় শুধু পাত্রপাত্রীই নয়, তাদের পরিবারের ব্যাকগ্রাউন্ড চেক বিরাট ভুমিকা পালন করে। অন্যদিকে, আমার মা আমার মেয়েকে নিজের কাছে রাখতে রাজি হলেও আমাদের দুজনের সম্পর্ককে মেনে নিতে পারে নি।এর পেছনে যে আমাদের দুজনের বিয়ে না করে একসঙ্গে বসবাস করাটাই একমাত্র কারণ, তা কিন্তু আমার মনে হয় না। আমরা দুইবোন, বাবা মারা গেছে শৈশবে, আমিই বড়। মা আমাকে কোনওদিনও আদর করেছে কি ভালোবেসে কিছু বলেছে বলে আমার মনে পড়ে না, আমার বোনের প্রতি অবশ্য তার ব্যবহার ছিল খুবই নরম। এর কারন ছিল স্পষ্ট। আমার গায়ের রং এজন্য দায়ী। বোনের তুলনায় আমার গায়ের রং বেশ কয়েক পোঁচ কালো। ছোটবেলা থেকেই গায়ের রং কালো হবার কারণে আমি তার কাছ অপ্রিয় হয়ে থেকেছি। আমাদের সমাজে এখনও ফর্সা মেয়ের চাহিদা বিয়ের বাজারে সবচেয়ে বেশি।মেয়েদের দৈহিক সৌন্দর্যের মাপকাঠিতে অগ্রাধিকার পেত গায়ের রং, সেই প্রথম রাউন্ডেই আমি ফেল মেরেছি। আর কে না জানে, যতই পড়াশোনা করে চাকরি বাকরি নিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াই না কেন, বিয়ে তো একসময় করতেই হবে। এ সমস্তই আমার অবচেতনে গেঁথে গেছল স্বতঃসিদ্ধের মত। কিন্তু সব কিছু আমূল পাল্টে দিল আমার সোভিয়েত ইউনিয়নে যাওয়া। সিলেবাসের পড়ার থেকেও অনেক বেশি শিখেছি সেখানে পারিপার্শ্বিক থেকে। এ কেবল অন্য দেশে যাওয়া নয়। এ ছিল টাইম ট্র্যাভেল। টাইম মেশিনে করে যেন কোন এক স্বপ্নের মত ভবিষ্যতে চলে যাওয়া। যেখানে গিয়ে জানলাম আশৈশব জেনে আসা অনেক স্বতঃসিদ্ধ আসলে ভুল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমি দ্রুত বদলে যেতে থাকি। গায়ের রং সম্পর্কে, বিয়ে সম্পর্কে, জীবনের নানান ব্যাপারে আমার চিরাচরিত ধারণা এবং সংস্কার টুপটাপ খসে খসে পড়ে যেতে থাকে, যেমনটা সীতাহরণের ঘটনায় পুষ্পক রথে করে লঙ্কার পথে উড়ে যেতে যেতে সীতা তার সমস্ত অলংকার এক এক করে ত্যাগ করেছিল। জীবনে প্রেম এসেছে একের পর এক। বিয়ে সম্পর্কে প্রথমে দোটানায় থাকলেও ক্রমশ বিয়ে আমার কাছে আর আকর্ষণীয় মনে হয় নি। অবিবাহিতা মা দেখলে সেই সময়ে অনেকেই মনে করত এ সন্তান কোনও দুর্ঘটনার পরিণতি। নিরাপত্তাহীন যৌন জীবনের জ্যান্ত দলিল। এই সন্তান যেন একটা দায়, একটা লজ্জার ব্যাপার। বিয়ের অপশন থাকা সত্ত্বেও কেন তুমি বিয়ে না করে মা হবে? এ তোমার কেমন বেয়াড়া আবদার, এত বড়ো দুঃসাহস! সকলেই এর পেছনে একটা বঞ্চনার ইতিহাস খুঁজতে চেয়েছে, দেখতে চেয়েছে একটা করুণ কাহিনি। এটা যে আমার নিজের পছন্দে, চয়েসের ফলেই হয়েছে, তা আমার সমাজের অধিকাংশ মানুষই মেনে নেয় নি। তারা ভাবত, আমি মিথ্যে বলছি, প্রেমে ঠকে গিয়ে লজ্জায় আঙুর ফলকে টক বলে চালাতে চাইছি। যদি তখন তাদের কথাই শিরোধার্য করে মাথা নুইয়ে বলতাম যে তাদের গণনাই ঠিক, আমি সত্যিই অভাগিনী, তাহলে হয়ত তারা সন্তুষ্ট হতো। দেশে ফিরবার পরে তাই প্রথমে নিজের মায়ের কাছে উঠলেও সেখানে বেশিদিন ঠাঁই হয় নি। ঘনিষ্ঠ আত্মীয় স্বজন সব রাতারাতি পর হয়ে যাচ্ছিল। কলকাতা শহরে আমাদের থাকবার কোনও জায়গা ছিল না। পর্য্যাপ্ত টাকার অভাবে কোনও ফ্ল্যাট ভাড়া নিতে পারি নি, ফলে বাধ্য হয়ে নিজেদের স্বামীস্ত্রী হিসেবে পরিচয় দিয়ে একটা বস্তিতে ঘর ভাড়া নিই। জীবনে সেই প্রথম বস্তিতে বাস করা। যারা আগে কখনও বস্তিতে থাকে নি তাদের জন্য একেবারেই সহজ নয় সেই নতুন পরিবেশে বসবাস করা। সেখানে জলের কল থেকে শুরু করে বাথরুম টয়লেট সমস্তই কমন। একটি মাত্র আসবাবহীন স্যাঁৎসেতে ড্যাম্প ধরা ঘরের মেঝেয় চাদর পেতে শোবার ব্যবস্থা। টাকা পয়সার তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে নানান ধরণের চাকরি করেছি ন্যূনতম খরচ জোটাতে। আমার বয়ফ্রেণ্ডের পরিবারকেও ক্রমে জানানো হয় সব। আমরা চলে যাই শিলং এ। কিন্তু সেখানে পরিস্থিতি আয়ত্ত্বের বাইরে চলে যায়। তারা আমাকে দুটো অপশনের মধ্যে একটা বেছে নিতে বলে। এক, ঐ সম্পর্কের ইতি টেনে কলকাতায় একা ফিরে যাওয়া, দুই, ওখানে থাকতে চেয়ে খুন হয়ে যাওয়া। ওখানে জোর করে থাকবার চেষ্টা করলে আমাকে তারা মেরে ফেলে ওয়ার্ডস লেকের গভীর জলে বস্তায় পুরে ফেলে দেবে। আমার পায়ে বেঁধে দেবে ভারীভারী বাটখারা। আমার মৃতদেহ অদূর ভবিষ্যতে ভেসে উঠবে না কিছুতেই। হয়ত এটা ভয় দেখানোর জন্যই তারা বলেছিল। কিন্তু প্রতিদিন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে শহর গ্রাম নির্ব্বিশেষে কোনও না কোনও বিবাহিত মেয়ের অস্বাভাবাবিক মৃত্যু ঘটে চলেছে, সেসব খবর তো আমাদের অগোচরে থাকে না। আর এক্ষেত্রে আমি বিবাহিত মেয়ে না হলেও এই বাড়ীর ছেলের সঙ্গে আমার সম্পর্ক স্থাপন হয়েছে যা তাদের মনোনয়ন পায় নি, পাবেও না, সেক্ষেত্রে আমার প্রাণেরও বেশ ঝুঁকিই রয়েছে তা বুঝে ফেলি। বুঝি প্রাণ নিয়ে পালানো ছাড়া খুব বেশি অপশন আমার হাতে নেই। জনবল নেই, লোক নেই। আমি প্রথমটাই বেছে নিয়েছিলাম। কারন সেই প্রেমটার মৃত্যু ঘটেছে তখনই। জোর করে সেই মৃত প্রেমের কাছ থেকে কিছুই পাওয়া যাবে না, বরং নিজের প্রাণটিও খোয়া যেতে পারে।ফলে ভাগ্যের এই বিড়ম্বনায় পুরোপুরি নিঃস্ব হয়ে নিজের জন্মভূমিতেই নির্বাসিতের জীবন বেছে নিয়েছি। আমার সন্তানকেও নিজের কাছে এনে রাখতে পারিনি। মধ্যনব্বইয়ের সেই দিনগুলোয় অবিবাহিত মায়েদের জন্য এই ধরণের শাস্তিই হয়ত বরাদ্দ ছিল। আমাদের এই নীল গ্রহটায় অনেকগুলো পৃথিবী আছে, সেই পৃথিবীগুলোয় যেতে হলে সবসময় যে টিকিট কেটে যেতে হবে তেমন নয়। আমাদের চারপাশেই রয়েছে সেই সব পৃথিবী। তাদের একটার সঙ্গে অন্যটার ব্যবধান সময়ে, ভাবনায়, মূল্যবোধে, শিক্ষায়, ভালোবাসায়, নিষ্ঠুরতায়, আরও অনেক কিছুতে। স্রোতের বিপরীতে চলার কারণে বিভিন্ন জীবিকার পেছনে ছুটতে হয়েছে। ফলতঃ বেঁচে থাকার চেষ্টায় একের পর এক নানান জীবিকা নিতে হয়েছে। কখনও পড়ানোর কাজ নিয়েছি, তো কখনও মডেলিং করেছি। টাকার অঙ্কে মজুরি পড়তায় না পোষালেও অভিজ্ঞতার ঝুলি এমন ভরেছে, যে হিসেব কষলে সব মিলিয়ে লাভের অঙ্কই বেশি মনে হয়। এমনি নানান সব চাকরির মধ্যে একটা চাকরির কিছু অভিজ্ঞতা ধরা রইল এইখানে।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:5195:1112:5618:e0b3 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৭:৪৫735635
  • তিন

    সুরঞ্জনার এক্স বয়ফ্রেন্ড একদিন দেখা করতে চলে এলো অফিসে। মানে আগে থেকেই প্ল্যান করা ছিল যে সে আসবে। ও আমাকে রিসেপশন থেকে ফোন করে বলল, আজ একজন আসবে, লাঞ্চব্রেকে নীচে আসিস, দেখতে পাবি।
    একটু পেড়াপিড়ি করতেই বলে দিল, কে আসছে, যে আসছে সে ওর আগের বয়ফ্রেন্ড, জাপানি, নাম ফুরুতা। ফুরুতা আসবে, আমরা অপেক্ষা করে রয়েছি, সুরঞ্জনা বলে যাচ্ছে ওর পুরোনো প্রেমের কথা, প্রেম ভেঙে যাবার গল্প। আমি ভাবছি মনে মনে, পুরোনো প্রেমিক কেন ফিরে এল জাপান থেকে? তবে কি প্রেমে জোড়াতালি লাগতে চলেছে? এমন টগবগে বাবলু ছোঁড়াটার কী হবে তাহলে? মানে ওর বর্তমান প্রেমিক বাবলু কি এমনি এমনি ছেড়ে দেবে ফুরুতাকে?
    সুরঞ্জনার সঙ্গে গল্প করবার সময় ভুলেই গেছলাম যে লাঞ্চব্রেকের ঠিক আগে আমি একটা উপহার পেয়েছি। সাশা এমনিতে আমার সঙ্গে কথা টথা বিশেষ বলে না আজকাল, কিন্তু লাঞ্চের আগে একটা মাঝারি মাপের প্যাকেট নিয়ে এগিয়ে এলো আমার কাছে, বলল এর মধ্যে উপহার আছে, সের্গেই পাঠিয়েছে, নিজে হাতে দিতে চায় নি সবাই দেখে ফেলবে বলে, তাই সাশার হাতে পাঠিয়েছে। লোকে তো দেখতে পায় সাশার সঙ্গে আমার বেশ বন্ধুত্ব আছে, তাই সাশার হাত থেকে জিনিস নিচ্ছি দেখলে কেউ কিছু মনে করবে না।
    ―কী আছে এর ভেতরে?
    সাশা বলল তুমি নিজেই খুলে দেখো। তোমার যদি মনে হয় জিনিসটা পাল্টে আনতে হবে আমাকে বোলো।
    ―কিন্তু কী আছে এর ভেতরে?
    ―আমি জানি কিন্তু বলব না, তুমি নিজেই দেখে নিও।
    আমার তখন সময় ছিল না মোড়ক খুলে সব দেখবার। জিনিসটা আমার নিজস্ব দেরাজে চালান করে দিয়ে দৌড়ে চলে গেছলাম নীচে সুরঞ্জনার কাছে। ওর বয়ফ্রেন্ড দেখা হয়ে গেলে আমায় দৌড়তে হবে মেয়েকে ইস্কুল থেকে আনতে। মেয়েকে তার দিদিমার কাছে পৌঁছিয়ে দিয়ে অফিসে ফিরে ফের লেগে পড়ব কাজে।
    সুরঞ্জনা যত্ন করে বলছে ওর প্রেমকাহিনি। ওরা ঢাকুরিয়ায় থাকে। ব্রীজ পেরোলেই বিদেশি ভাষা শিখবার ব্যবস্থা আছে। ও শখ করে রাশিয়ান ভাষা শিখছিল এমএ পড়বার পাশে পাশে। অধিকাংশ লোকেই ফ্রেঞ্চ শেখে বা জার্মান, কেউ কেউ স্প্যানিশ, তুলনায় নাকি রাশিয়ান শিখবার হিড়িক অনেক কম। ভাষা শেখার ইনস্টিটিউটে বিদেশিরা আসে নানান কারনে, সেখানেই ফুরুতার সঙ্গে আলাপ ও ক্রমে প্রেম।
    জাপানি ছেলেকে বিয়ে করতে কোনও আপত্তি ছিল না সুরঞ্জনার। ছেলেটিও বাংলা ভাষা নিয়ে উৎসাহী ছিল। ইংরিজি বলত ভাঙা ভাঙা, সুরঞ্জনাকে বেশ কিছু জাপানি শব্দ শিখিয়েছিল, জাপানি ভাষায় যুক্তাক্ষর প্রায় নেই বললেই চলে, ট্যাক্সিকে ওরা নাকি বলে তাকুসি। এইটে শুনে আমার হাসি পেয়ে গেল। কিন্তু প্রেমের গল্পটা বিয়োগান্তক, তাই মন দিয়ে শুনছি। বেশি নয় বছর দু তিন আগের কথা। বাড়ি থেকে ওর বিয়ের জন্য পাত্র দেখাদেখি চলছে। সুরঞ্জনার তেমন কোনও জেদ নেই যে জাপানি প্রেমিককেই সে বিয়ে করবে। ভালো বাঙালি পাত্র পেলে সে অ্যারেঞ্জড ম্যারেজেই যাবে। এক পাত্র দেখতে এল তাকে। সুচাকুরে, গোলপার্কে নিজস্ব ফ্ল্যাট, কোনও ভাই বোন নেই, বিয়ের মার্কেটে এর থেকে লোভনীয় পাত্র হতেই পারে না। সুরঞ্জনার মা ও মাসী মিলে পাত্রপার্টির জলযোগের ব্যবস্থা করছে রান্নাঘরে এবং সুরঞ্জনা একটার পর একটা শাড়ি পাল্টাচ্ছে, কোনোটাই মনের মত হচ্ছে না। ওর বাবাও সেদিন অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে ফিটফাট হয়ে রেডি। ফাইনালি পাত্রপার্টি এল। পাত্রের সঙ্গে গোটা তিনেক গার্জেন, বাবা কাকা মা। সুরঞ্জনা ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে খাবারের প্লেট হাতে ঘরে ঢুকছে, টেবিলে রাখছে, ফের অন্য প্লেট আনতে দৌড়চ্ছে। পাত্র বেচারা মাথা হেঁট করে বসে রয়েছে, অনেকক্ষণ পরে সুরঞ্জনা দেখল পাত্র পিটপিট করে আড়চোখে তাকে দেখে নিচ্ছে। মন থেকে সে এই পাত্রকে নাকচ করে দিল। যে লোক সোজাসুজি তাকাতেই পারছে না তার সঙ্গে বাকি জীবনটা কাটানোর প্ল্যান করা ঝামেলার ব্যাপার হবে। কদিন পরে পাত্রপক্ষ জানালো যে তাদেরও পছন্দ হয় নি ওকে। ভেরি গুড, ল্যাঠা চুকে গেল। গোলপার্ক এলাকায় তখন সে চুটিয়ে প্রেম করতে লাগল জাপানি প্রেমিকের সঙ্গে। এর কিছুদিন পরেই সে রাশিয়া যাবে ভেবে রেখেছে, যদি জাপানি প্রেমিক দেশে ফিরে যায়, ফিরে গিয়ে যদি তাকে ভুলে যায়, তখন রাশিয়ায় গিয়ে চাকরি করার প্ল্যানটা কাজে লাগবে। ফুরুতা লোকটা কখনও বেশ রক্ষণশীল মানসিকতার আবার কখনও পুরোপুরি খোলামেলা।
    এদিকে পাত্রপক্ষ করছে কি, সুরঞ্জনার গতিবিধির ওপর নজর রাখছে। তাদের বাড়ির জানলা থেকে দুবেলা দেখা যায় সুরঞ্জনা জাপানি প্রেমিকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে ঘোরাফেরা করছে। মাস তিনেক এরকম দেখে টেখে তারা বিয়ের সম্বন্ধ পুনর্বিবেচনা করবার প্রস্তাব দিল। দুই পক্ষই আরেকবার ভেবে দেখবে ইত্যাদি। সুরঞ্জনার বাড়ির লোকও রাজি হয়ে গেল। ফের কয়েক প্রস্থ পাত্রী দেখানোর পালা। একেকবার একেকরকমের আত্মীয় স্বজন আসে, পাত্র আর আসে নি, সে যে সেই প্রথমবারে পিটপিটিয়ে আড়চোখে দেখেছিল, ব্যস, আর দেখাদেখির মধ্যে যায় নি। সুরঞ্জনা কিন্তু তখন আর ফুরুতার সঙ্গে তেমনভাবে মিশছে না। এবার পাত্রপক্ষ বলল আমতা আমতা করে, দেখুন আপনাদের মেয়ের ক্যারাকটার তেমন ইয়ে নয়, আমরা তো রোজই দেখি, একটা মোটকামত চাইনিজ ছেলের সঙ্গে ঘোরে। সুরঞ্জনা শুনতে পেয়ে দৌড়ে এসে কারেকশান করল ― চাইনিজ নয়, জাপানি বয়ফ্রেন্ড। তারপর বলে দিল, দেখুন আপনাদের ছেলে তো সরাসরি চোখের দিকে তাকাতেই পারে না, ও পাত্র আমার পছন্দ নয়, নমস্কার।
    বাড়িতে হৈ হৈ পড়ে গেল, পাত্রপক্ষকে ইনসাল্ট করবার কী প্রয়োজন ছিল, কিন্তু সুরঞ্জনাও দমবে না, সে বলল ওরা আমাকে আগে ইনসাল্ট করেছে এবং আমার ওপর গোয়েন্দাগিরিও করেছে, ওদের তাড়িয়েছি বেশ করেছি।
    এরপরে শুরু হলো ওর বাঁধনহীন প্রেম। জাপানি ছেলে কেবল শুতে চায়, কিন্তু ও ব্যাপারটায় সুরঞ্জনা খুব সাবধানী, বিয়ে আগে শুতে রাজি নয়। ফেল কড়ি মাখো তেল, আগে বিয়ে কর তারপরে ওসব করতে পাবে। বিয়ের আগে সব করে টরে তারপরে যদি পালায়, তখন? 
    ―হুঁ হুঁ বাবা আমি অত কাঁচা কাজ করবার লোক নই।
    ―বুঝেছি, তারপরে বল না কী হলো?
    একদিন প্রেমিক তাকে নেমন্তন্ন করল রেস্টুরেন্টে ডিনার খাওয়াবে বলে। পার্কস্ট্রীট বা ধর্মতলা এলাকায় দামি রেস্টুরেন্ট ঠিক করা আছে, ফুরুতার পয়সা কড়ি দেদার, সে ধনী পরিবারের ছেলে। বড়োলোক বলেই এমনি যখন তখন কলকাতায় এসে মাসের পর মাস থাকে, বাংলা শেখে, ঘুরে বেড়ায় নিশ্চিন্তে। সুরঞ্জনা বাড়িতে বলে দিল, আজ রাতে বাড়িতে খাচ্ছি না, বন্ধু খাওয়াবে রেস্টুরেন্টে।
    সেজেগুজে সন্ধেবেলায় ফের সেই গোলপার্কের মোড়ে ফুরুতার সঙ্গে দেখা করে একটা ট্যাক্সি নিয়ে দুজনে চলল মধ্য কলকাতার দিকে। চমৎকার গল্প করছে দুজনে, ফুরফুরে মেজাজ ফুরুতার, পার্কস্ট্রীটের কাছাকাছি প্রায় চলে এসেছে ট্যাক্সি, সুরঞ্জনা ফস করে একটা সিগারেট ধরিয়েছে। ব্যস ফুরুতা রেগে গেল। আগেও সে কয়েকবার বলেছে সুরঞ্জনাকে যে সিগারেটখোর মেয়ে তার পছন্দ নয়। ফুরুতা যে রেগে গেছে তা সে মুখে প্রকাশ করে নি। ট্যাক্সি যেই থেমেছে ট্র্যাফিক জ্যামে, সে দরজা খুলে হাঁটা দিয়ে ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে গেল। সুরঞ্জনাও বের হতে চায়, কিন্তু ট্যাক্সির ড্রাইভার ভাড়ার টাকা না আদায় করে তাকে যেতে দেবে না। ভাড়া মিটিয়ে বাইরে গিয়ে দেখল তখনও জ্যাম, সেই জ্যামের মধ্যে ফুরুতা উধাও।
    এখন কী করবে সে? বাড়ি ফিরে গেলে প্রেস্টিজে গ্যামাক্সিন হয়ে যাবে। ট্যাক্সিভাড়া মিটিয়ে খুব বেশি পড়ে নেই তার কাছে। মেট্রো ধরে চলে গেল রাসবিহারি, এদিকে ক্ষিদেও পেয়েছে খুব। ব্যাগে যা টাকা ছিল সব টাকার ফুচকা খেয়ে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরল। ঐভাবেই প্রেমটা কেটে গেল। তারপরে অনেকটা সময় গড়িয়েছে, সে মস্কো গেছল, চাকরি করেছে, এখন কলকাতায় ফিরে এই নতুন চাকরি। ফুরুতাও জাপানে চলে গেছল, ফের এসেছে, এখন প্রশ্ন হচ্ছে ও কী চায়?
    এইসব আলোচনার মধ্যিখানে দেখলাম জাপানি প্রেমিক এসে গেছে। একটু প্রাথমিক ভদ্রতা টদ্রতার পরে, আমি ওখান থেকে কেটে পড়তে চাইলাম, মেয়ের ইস্কুলে নইলে যেতে দেরি হয়ে যাবে। ওরা দুজনে ঢুকে গেল সেই মখমলের কার্পেটে মোড়া ঘরটাতে।
     
    (চলবে)
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:5195:1112:5618:e0b3 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৭:৪৬735636
  • চার

    মেয়েকে ইস্কুল থেকে তুলে তার বাড়িতে পৌঁছিয়ে অফিসে ফিরছি আর ভাবছি, কত চট করে বাতিল হয়ে গেছল সুরঞ্জনা প্রেমিকের পছন্দের তালিকা থেকে। এমনি করে মেয়েরাও যদি সিগারেটখোর প্রেমিকদের হুটহাট মাঝরাস্তায় ছেড়ে দিতে শুরু করে তখন কী হবে?
    ফিরতে একটু দেরি হয়ে গেছে, সবাই ফিরে এসেছে লাঞ্চের পরে, নিজের জায়গায় বসতে গিয়েই খেয়াল হলো একটা উপহারের প্যাকেট আছে, খোলা হয় নি। খচর মচর শব্দ করে খুলেই ফেললাম সেটা। বাক্সের ভেতর থেকে জ্যান্ত সাপ বের হলেও এতটা আঁতকে উঠতাম না। ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো দু সেট সাদা ব্রা ও ম্যাচিং প্যান্টি ― লেস দিয়ে বানানো, খুব দামি জিনিস হবে মনে হচ্ছে, কিন্তু আমার মাথা দপদপ করছে ওগুলো দেখে। ঝপ করে জিনিসগুলো ফের দেরাজের মধ্যে পুরে ফেলি। এতো রীতিমতো অপমানজনক উপহার! কী কর্তব্য এখন আমার? জিনিসগুলো ফিরিয়ে দেব? সোজা গিয়ে সের্গেইয়ের মুখের ওপরে ছুঁড়ে মারব? জানলার ধারে সাশা বসে বসে কীসব কাজ করছে, সাশাকে গিয়ে ধমকাব নাকি ইউরি আন্দ্রেইভিচকে আড়ালে ডেকে নিয়ে পরামর্শ করে ঠিক করব কী করা উচিৎ আমার?
    নিঃশ্বাস চেপে উঠে ইউরি আন্দ্রেইভিচের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। 
    ― কাজে খুব ব্যস্ত আপনি?
    ― হ্যাঁ তা একটু ব্যস্ত আছি, কিন্তু তোমার কথা শুনবার জন্য আমার কাছে সবসময় সময় আছে, বলো কী বলবে।
    ― মানে ঠিক এখানে নয়―
    উনি উঠে পড়লেন চেয়ার থেকে, চলো বাইরে গিয়ে কথা বলি।
    ঠিক এমনি সময়ে ঘরে ঢুকে পড়ল সের্গেই। আমার কাছে এগিয়ে এসে যেন কিছুই জানে না, কিছুই হয় নি এমন ভাবে বলল, তোর কোনও কাজের চাপ না থাকলে এখুনি চল আমার সঙ্গে, নীচে একগাদা লোক এসেছে মীটিং রুমে, তোকে একটু হেল্প করতে হবে কাজে।
    ইউরি আন্দ্রেইভিচ বসে পড়লেন নিজের জায়গায়। সের্গেই আমাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। যাবার পথে বলছে, সুইপারকে এখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, ওদিকে অতিথি যারা এসেছে তাদের ড্রিংক্স দিতে হবে, আমি তোকে ড্রিংক্সের ট্রে টা দিচ্ছি, তুই নীচের ঐ মীটিং রুমটায় তাদের পরিবেশন করে দে প্লীজ। কীরে, পারবি তো?
    আমরা দোতলায় নেমে যাই, সেখানে মস্ত বড়ো দুটো ট্রে তে গোটা আষ্টেক করে কাচের বোতলে কোল্ড ড্রিংক এবং গোটা আষ্টেক করে কাচের গেলাস। দুবারে নিয়ে যেতে হবে। প্রথম ট্রে টা নিয়ে আমি ধীরে ধীরে ব্যালেন্স করে একতলায় নামি, সিঁড়ি শেষ হলে গোটা দশ বারো পা পরেই বাঁ হাতে সেই মখমলের কার্পেটমোড়া মিটিং রুম, কিছুক্ষণ আগে যেখানে সুরঞ্জনা অতিথি সৎকার করছিল। দরজাটা ভেজানো। আমার দুহাত জোড়া, ট্রে ধরে আছি। আশেপাশে কেউ নেই। ট্রে দিয়ে ঠেলা দিতেই পাল্লাদুটো খুলে যাচ্ছে, সন্তর্পনে ভেতরে ঢুকতেই কেমন করে যেন দরজার পাল্লার ধাক্কায় বোতলগুলো পড়ে গেল, একটা বোতলের ঠেলায় অন্যগুলো, সেই সঙ্গে কাচের গ্লাস। ব্যাপারটা এত তাড়াতাড়ি হল যে আমি বুঝতে পারছি না কী করব। সেই প্রকান্ড গোল টেবিল ঘিরে যেসব সায়েবেরা বসে ছিল সব আমার দিকে তাকিয়ে, বিস্ফোরণের মত শব্দ, যত নরম আর পুরু কার্পেটই হোক না কেন, বেশ উঁচু থেকে পড়েছে আটটা কোকাকোলার বোতল, আটটা কাচের গেলাস। সবাই হাঁ করে এদিকে তাকিয়ে, কেউ এগিয়ে আসছে না হেল্প করতে। শব্দ শুনে সের্গেই ছুটে চলে এসেছে, সে এক ঝলক দেখে নিয়ে হাঁক দিল ড্রাইভারদের। সের্গেই আমাকে ধমকাতে থাকে, তোর মাথায় কোনও বুদ্ধি নেই? হাতে ট্রে নিয়ে কেউ সোজা দরজা দিয়ে ঢোকে? সবসময় পেছন ফিরে ঠেলে ঢুকতে হয়, তুই না মেয়ে, মেয়েদের তো এসব প্র্যাক্টিক্যাল জিনিস জানতে হয় সংসারে, একটুও কমন সেন্স নেই তোর?
    মান্যগন্য অতিথিরা ফের তাদের মিটিংএর জরুরি আলোচনায় মনোনিবেশ করে। সুইপার ল্যাগবাগ করতে করতে এসে কাচ তুলে নিচ্ছে ট্রে তে। দরজার পাল্লা দুটো এখন হাট করে খোলা, একজন ড্রাইভার দ্বিতীয় ট্রেটা নিয়ে ঢুকে যায় সেখানে। 
    আমার খালি কান্না পায়, আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না, একদম না।
     
     
    (চলবে)
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:5195:1112:5618:e0b3 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৭:৪৯735637
  • সপ্তম অধ্যায়

    বলেপদ্মরাণি, বদনখানি, রেতে রাখে ঢেকে।
         ফুটায় কলি, ছুটায় অলি, প্রাণপতিকে দেখে।।
    আবারবনের লতা, ছড়িয়ে পাতা, গাছের দিকে ধায়।
         নদীর জল, নামলে ঢল, সাগরেতে যায়।।
    ছি ছিসরম টুটে, কুমুদ ফুটে, চাঁদের আলো পেলে।
         বিয়ের কনে রাখতে নারি ফুলশয্যা গেলে।।
    মরিএ কি জ্বালা, বিধির খেলা, হরিষে বিষাদ।
          পরপরশে, সবাই রসে, ভাঙ্গে লাজের বাঁধ।।
     
    ― কপালকুণ্ডলা, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
     
    আমার পাশের ঘরের কালো বৌ যে প্রেগন্যান্ট তা অনেকদিন ধরেই শুনেছি, অথচ ওর শরীরের কোনও পরিবর্তন দেখে বোঝা যায় না, হয়ত খুব রোগা বলেই এরকম হবে ভেবেছি। এরই মধ্যে একদিন বিচ্ছিরি ঝামেলা হয়ে গেল পাশের ঘরে। বৌয়ের দুই ভাই এসেছিল, একজন মনে হয় দাদা ― সে গম্ভীর লোক, অন্যজন ভাই। সঙ্গে ছিল বৌয়ের বিধবা মা। বছর পঞ্চাশেকের বেশি মনে হয় না দেখলে। ঝামেলা বলতে হুটোপুটি মারপিট। চশমা পরা লোকটাই মার খেল, তার ছোটোশালার গলার জোর তেমন না থাকলেও গায়ের জোর আছে। লোকটা যে মাঝরাতে আমার ঘরে ঢুকে পড়েছিল সে খবর সম্ভবত তার বৌ শাশুড়ি বা শালারা পায় নি। অন্ততঃ চেঁচামেচির সময় যে যে প্রসঙ্গগুলো উঠে আসছিল তার মধ্যে এই ঘটনাটা কেউ উল্লেখ করে নি। লোকটা চশমার দোকানে আর কাজ করছে না, তাকে ছাড়িয়ে দিয়েছে না নিজেই ছেড়ে দিয়েছে সেটা স্পষ্ট নয়। সে শখের বাজারের দিকটায় ফুটপাথের ওপর একটা দোকান দিতে চায়। সেই বাবদ খরচ আছে, চশমার দোকান থেকে মাসে মাসে হাজার বারোশো যা পাচ্ছিল তা থেকে ঘর ভাড়া বাদ দিলে প্রায় কিছুই থাকে না হাতে। এবার জানা গেল বৌয়ের অ্যাবর্শন করিয়ে এনেছে। অ্যাবর্শনের পর বৌয়ের শরীর একেবারেই ভেঙে পড়ে, তাই সে বাপের বাড়ি গিয়ে থাকছিল। অর্থাৎ সেই সময়েই লোকটা আমার ঘরে রাতে ঢুকেছিল এতক্ষণে পরিস্কার হল ব্যাপারটা।
    মার খেলেও সে টাকা দাবি করে যাচ্ছে ক্রমাগত, নইলে বৌয়ের খরচ পেরে উঠবে না। বৌএর মা বেশ গুছিয়ে ঠান্ডা মাথায় কথা বলতে পারে, সে বলছে তাহলে বিয়েতে যে খাট আলমারি লেপ তোশক বাসন ঘড়ি আংটি যা যা দেওয়া হয়েছে সব ফেরৎ নিয়ে যাবে তারা আজই। লোকটা তাতেও রাজি। বলছে, নিয়ে যান না, সব নিয়ে যান, আমি একা হলে তো আমার এরকম ঘরভাড়া দিয়ে থাকতে হয় না, আমি অন্য জায়গায় অনেক কম খরচে থাকতে পারি। বৌএর মা এবার আমার ঘরের রোয়াকে এসে বসল। খুব মিষ্টি করে বলল, আপনারা সব আসুন, দেখে যান, এই হচ্ছে আমার কালো মেয়ের সংসার।
    ঘরের মধ্যে বচসা মাঝে মাঝেই হাতাহাতিতে পরিণত হচ্ছে, শেষে কিছু একটা মিটমাট হলো। কিছু টাকা শালারা তাকে দেবে, কিন্তু বৌয়ের ওপর যেন সে ভুলেও অত্যাচার না করে, নইলে তারা আবার আসবে। বৌটাকে এবার দেখা গেল, বরাবরের মত সে চুপ করেই আছে। ভায়েদের মধ্যে একজন বোধহয় মিষ্টি কিনতে গেছে, কেরোসিনের স্টোভে চায়ের জল চাপিয়ে সে কলতলায় স্টেনলেস স্টিলের থালা জলে ধুয়ে নিচ্ছে।
    ঝগড়া ঝামেলা সামনের ঘরেও হয়, কিন্তু তার প্রকৃতি অন্যরকম। সামনের ঘরের বৌটার বাপের বাড়ি থেকে কেউ আসে না। ওর বরেরও আত্মীয় স্বজন কেউ নেই মনে হয় আশেপাশে। ওদের ঘরে যখন ঝগড়া হয় তখন বৌটাই খুব চেঁচায়, বরটা চড় থাপ্পড় মেরে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। এরকম সময় আমি থাকলে সামনের ঘরের বৌকে ডেকে নিই নিজের রোয়াকে, ওকে অরেঞ্জ স্কোয়াশ খেতে দিই, ও মিষ্টি জল খেতে খেতে ঝগড়ার কথা ভুলে যায় বাচ্চাদের মতন। কয়েকদিন ওর বাচ্চার জন্য অফিস থেকে ফিরবার পথে ফল এনেছি, বেশি কিছু নয়, হয়ত দুটো কলা, কি একটা আপেল বা গোটা চারেক সবেদা। বৌটা নিতে চায় না, বলে বর এসে দেখলে রাগারাগি করবে, বলবে কে দিল, কেন দিল। আমি এরপরে আর ফল আনি নি। হয়ত মনে ছিল না, বা সময় পাই নি।
    আমায় তো রোজ রোজ মেয়েকে ইস্কুলে দেওয়া নেওয়াও করতে হচ্ছে। এত দূর থেকে অফিস যাওয়া, সেখানেও মানুষের অদ্ভূত আচরণ, মেয়ে সন্ধেবেলা কী পড়াশুনো করছে টরছে, কিছুই জানি না। 
    এর মধ্যে একদিন অসুখে পড়লাম। সেদিন ছিল রবিবার, মেয়ে আসছে না আজকাল এখানে, তার নতুন ইস্কুলের পড়ার চাপ আছে, তাছাড়া আমাদেরতো রোজই দেখা হচ্ছে। রবিবার খুব ভোর থেকেই পেটের অসুখ শুরু হল, সঙ্গে বমি, জ্বর। মাথা ঘুরে যেন পড়ে যাচ্ছি। ঐ বদ্ধ ঘরটার মধ্যে শুয়ে রয়েছি মেঝেয়। আমার ঘরে আসবাবের অবস্থা বাকি সবকটা ঘরের চেয়ে খারাপ। ওদের সবারই খাট আছে, আমি মেঝেয় শুই। কীভাবে যেন সময় কেটে যাচ্ছে, একসময় ঘড়িতে দেখলাম দশটা বাজে, আবার যখন ঘুম ভাঙছে দেখছি দেড়টা। আবার ছুটতে হচ্ছে টয়লেটে, ফিরে এসে শুয়েই ঘুমিয়ে পড়ছি। এই করতে করতে সন্ধে হয়ে গেল। ওষুধ খাবার কথা মাথায় এলো না। ওষুধ ঘরে ছিলো ও না। এর আগে গত দশ বছর যখন বিদেশে থেকেছি কখনও ওষুধ খেয়েছি বলে তেমন মনে পড়ে না, পেটের অসুখও হয়নি ওদেশে গত দশ এগারো বছরে। সন্ধের অন্ধকারে মনে হল, যদি মরে যাই এভাবে, কেউ তো জানতেও পারবে না। পাশের ঘরের কারোকে জানাতে ইচ্ছে করে না, খালি ভয় হয়, এই ঘরটার মধ্যে একদিন আমি মরে পড়ে থাকব। তেষ্টায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে, একটু জল নেই ঘরে। আমি উঠতে পারি না, ওভাবেই আবার ঘুমিয়ে পড়ি।
    শুনেছি নিজের মৃত্যু নিয়ে চিন্তা আমার মত বয়সে সাধারণত হয় না, তবু মৃত্যুর চিন্তা আমাকে পেয়ে বসে। মাঝে মাঝে ঘুম ভাঙে তখনও ঐ চিন্তা মাথার মধ্যে, শক্তি নেই উঠে বসবার, দাঁড়ানোর, এই ভাবেই আবার ঘুম আবার জাগা করতে করতে রাত ফুরিয়ে সকাল হয়। সকাল মানে সোমবার, আমায় অফিসে যেতে হবে। ছুটি নেবার কথা ভাবতে পারি না। এই চাকরিতে আমি বাঁধা পড়ে গেছি কেমন একটা ক্রীতদাসের মত। দিন শুরু হলেই চাকরিতে ছুটতে হবে, চাকরির সময় ফুরোলে বাধ্য হয়ে ফিরতে হবে ঘরে, এর বাইরে তেমন কিছুই আর নেই আমার। হয়ত আছে, তা মনের ভেতরে, সেসব হচ্ছে সুদূরপ্রসারী প্ল্যান। আমি উঠে পড়েছি। ঐ শরীরেই রেডি হয়ে গেছি অফিসে যাবার জন্য। একটা ঘোরের মধ্যে অফিসে পৌঁছেও গেলাম। বাইরে থেকে দেখে কেউ টের পেল না আমার অসুস্থতা। মানুষজনকে সেধে সেধে নিজের অসুখের কথা না বললে তারা কি সত্যিই টের পায়? খুব আপনজন না হলে বোধহয় পায় না। বোধহয় কেন, সত্যিই পায় না। গোড়ার দিকে যখন দিনের পর দিন প্রায় উপোস করে কেটেছে, মুখ দেখে কেউ কি জিজ্ঞেস করেছে কিছু? করেনি। নিজের মৃত্যুর চিন্তা আর মৃত্যুভয় কি অভিন্ন? তা কী করে হবে, মৃত্যু হইতে ভয় হচ্ছে মৃত্যুভয়, পঞ্চমী তৎপুরুষ সমাস বা কর্মধারয় টারয় ও হতে পারে। তা এই মৃত্যু হইতে ভয় কি কেবল নিজের মৃত্যু হইতে? খুব প্রিয়জনের অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর জন্যও তো ভয় থাকতে পারে মানুষের মনে। সেটার জন্য কোন শব্দ প্রযোজ্য? আছে তেমন কোনও শব্দ? থাকলেও আমার জানা নেই। আমার মস্তিষ্কের মধ্যে ঠিক ভয় নয়, চিন্তা ঘোরে, নিজের মৃত্যুর চিন্তা। অসুস্থ শরীরে যখন বাসে করে অফিসের দিকে যাচ্ছিলাম, কেমন যেন মনে হচ্ছিল মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছি। এ কথা অন্য কারোকে বলা যায় না। বললে হয় সে হেসে উঠে বলবে সব পথই তো শেষটায় মৃত্যুতে গিয়েই শেষ হয়, আমরা সকলেই এক পা এক পা করে এগিয়ে চলেছি মৃত্যুর দিকে― এ নিয়ে এত ভাবনার কী আছে? হয়ত সে বলবে, জন্মানোর পর থেকে আমাদের প্রত্যেকের একটাই অবশ্যম্ভাবী গন্তব্য ― মৃত্যু। আমাদের ফাইনাল ডেস্টিনেশন। সে এরকম না ও বলতে পারে। হয়ত বলে দিল তোমার মাথায় গোলমাল হয়েছে, এত কিছু ভাবছ কেন? পেট খারাপ হয়েছে, ওষুধ খেলে সেরে যাবে, ব্যস। অত মৃত্যু টিত্যু নিয়ে ভেবে লাভ কী? দেয়ার আর সো মেনি থিংস টু ডু, সেসব করো। আমি বাসের দরজায় মজা করে ঝুলতে ঝুলতে যাওয়া কন্ডাক্টরকে দেখছিলাম। এমনি করে ঝুলে ঝুলে কাজল যাচ্ছিল একটা ট্রেনে, সিনেমার দৃশ্য, ড্রিম সিকোয়েন্সে― জ্যারা সা ঝুম লু ম্যাঁয়, আরে নারে নারে না! আমার সত্যিই মেনি থিংস করবার শক্তি নেই, এই পৃথিবীর সব দরজা বন্ধ হয়ে গেছে আমার জন্য। নিজেকে ভোলাচ্ছি ― আই হ্যাভ মেনি থিংস টু ডু। আসলেই কি তাই? আমারও তো ঐ কন্ডাকটরের মতো এক পা পাদানিতে রেখে বাকি এক পা শূন্যে উড়িয়ে হু হু করে হাওয়া কেটে যেতে ইচ্ছে করে। সেসব কি ঐ মেনি থিংস টু ডু এর লিস্টে ঢোকানো যায়? যায় না। সিনেমার সিমরানই পারেনি, তাকেও ড্রিম সিকোয়েন্সে যেতে হয়েছিল বা মাতাল হতে হয়েছিল। আমাকেও হয়ত ড্রিম সিকোয়েন্সেই বেঁচে থাকতে হবে।
     
     
     
    (চলবে)
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:5195:1112:5618:e0b3 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৭:৫০735638
  • দুই

    অনেক ভেবে টেবে দেখলাম অত দুর থেকে রোজ রোজ অফিসে যাতায়াত করা এবং বাচ্চাকে ইস্কুলে দেওয়া নেওয়া করাটা আমার শরীরে পোষাচ্ছে না। একটা সমঝোতায় পৌঁছনোর সময় এসেছে। আমার জন্য সবচেয়ে সুবিধেজনক দূরত্ব ঐ মায়ের ফ্ল্যাট― তার নিজের কেনা নয়, ভাড়ার ফ্ল্যাট। মেরে ধরে লোকেরা তাড়িয়ে দিয়েছে তো কী হয়েছে। আমার তো আত্মসম্মান বলে কিছু নেই, ঐখানেই আবার যাব। ঐ ফ্ল্যাট ভাড়া নেবার সময় আমাকেও একটা সদস্য হিসেবে, সম্ভাব্য বাসিন্দা হিসেবে দেখানো হয়েছিল। লেটার বক্সে আমার নাম লেখা আছে। ও পাড়ার লোকে আমায় রাস্তার খানকি বলেই চেনে, তা চিনুক, আমি ওদের দিকে তাকাবো না। আই হ্যাভ মেনি মোর থিংস টু ডু। যেমন, ড্রিম সিকোয়েন্সে ভেবে রাখা কাজ গুলো এক এক করে বাস্তবে করে ফেলতে হবে। তার জন্য চাই অপরিসীম ধৈর্য এবং সহ্যশক্তি। আশেপাশের সবকিছুকে অগ্রাহ্য করে শুধু নিজের কাজটুকু করে যাওয়া। বাধা আসবে, আসবেই। চোখ কান বন্ধ রাখতে হবে, মনে রাখতে হবে আমার লক্ষ্য অন্য। সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে বেঁচে থাকাটা সবার আগে প্রয়োজন। এখন যে রেটে পরিশ্রম করতে হচ্ছে, তাতে খুব বেশিদিন সুস্থ থাকতে পারব না, মেয়েকেও যেমন সময় দেওয়া দরকার, তেমনি নিজের জন্যও সময় চাই। যাতায়াতের সময় ও পরিশ্রম বেঁচে গেলে আমি অনেক কিছু করতে পারব, মেয়েকে নতুন নতুন জিনিস শেখাবো, জীবন আমার অন্যরকমের হয়ে যাবে। নাঃ, বাড়ী পাল্টাতেই হচ্ছে। যদি ওরা আবার আক্রমণ করে, তবে টুক করে মরে গেলেই হল। অন্যথায় এরকম করেই এগোতে হবে।
    আমি সুরঞ্জনার কাছে হেল্প চাইলাম, বাড়ী বদল করবার সময় ও যেন জিনিস পত্র গুছোতে, সরিয়ে আনতে সাহায্য করে। হ্যাঁ এইবারে ও জেনে যাবে কোথায় থাকি আমি, বস্তির প্রতিবেশিরাও অনেক প্রশ্ন টশ্ন করবে ওকে, কিছুই শিখিয়ে পড়িয়ে নিয়ে যাবার দরকার নেই, ও জানুক আমার বর্তমান, ওর যেমন খুশি ভেবে নিক।
    শনিবার ছাড়া সুরঞ্জনার টাইম হবে না, শনিবার হলে আমারও সুবিধে হয়, তবে খুব তাড়াহুড়ো করবারও দরকার নেই, মধ্যিখানে একটা দুটো শনিবার কেটে যাক, তার আগে আমি জিনিসপত্র ছাড়াই আগে গিয়ে দেখি, থেকে দেখি। সবার আগে জানাতে হবে যে আমি যাচ্ছি, থাকতে যাচ্ছি। সেইমত টেলিফোন করলাম, জানিয়ে দিলাম যে আবার যাচ্ছি থাকতে।
    না, কোনও বাধা পেলাম না এবার। সম্ভবত এখন চাকরি করি বলে, অর্থোপার্জনের একটা উপায় আছে বলে, এবং তারা তো জানে কোথায় আমার অফিস, মাস গেলে ছ হাজার টাকা পাচ্ছি তা হয়ত জানে না, কিন্তু দেখতে শুনতে তো অফিসটা পেল্লায় একটা বাড়ি, যাকে বলে বেশ প্রেস্টিজিয়াস ব্যাপার।
    বাড়ীটা পাল্টালে আরেকটা সুবিধে হয় আমার, রোজ রোজ অফিসে গিয়ে টয়লেটের কাজ করা কি পোশাক বদলানোর ঝামেলাও আর থাকে না। আমি অবিলম্বে পুরোনো পাড়ায় ঢুকে পড়ি। তখন সন্ধের অন্ধকার, হয়ত বৃষ্টি পড়ছে বা পড়ছে না, শাঁখ টাখ বাজিয়ে সন্ধে দেওয়ার কাজ সব বাড়িতেই কমপ্লিট, এ সময়টা লোকে ঘরের ভেতরের কাজেই ব্যস্ত থাকে বেশি। খুব বেশি কারোর চোখে পড়ার চান্স নেই। আর পড়লেই বা কী? আমার তো খুব কম অপশন জীবনে, হয় বাঁচব নয় মরব, সিম্পল। কেউ আমায় দেখতে পেল না, বা দেখলেও লক্ষ্য করে নি, যে, যে মেয়েছেলেটাকে মাত্র কমাস আগে মারতে মারতে বের করে দেওয়া হয়েছে, সে আবার এসেছে ফিরে।
    টানা দশ কি বারো দিন থাকার পরে আমি সব জিনিস নিয়ে আসব, এই ই আমার প্ল্যান। একটা শত্রুপরিবেষ্টিত পরিবেশে আমায় থাকতে হবে, ঘুমোতে হবে, এখান দিয়েই বেরিয়ে কাজে যেতে হবে রোজ এবং কাজের শেষে এখানেই ফিরে আসতে হবে। যে কোনও মুহূর্তে অসম্ভব কিছু ঘটে যেতে পারে জেনেও আমার কোনও দুশ্চিন্তা হচ্ছে না। ইংরিজিতে একেই বোধহয় বলে ডেসপারেট, এর নিশ্চয় বাংলা প্রতিশব্দ আছে কিছু, মরিয়া কি? আমি কি মরিয়া? আবার মরে গেলেও মরিয়া... হাহা।
    তুমি যখন বাড়ী থেকে বের হচ্ছ কি ঢুকছ, অনেক চোখ তাকিয়ে রয়েছে তোমার দিকে, তুমি সেসব অগ্রাহ্য করে চলেছ, যেন সেসব কিছুই নেই, সব কিছু যেন স্বচ্ছ, তুমি তাদের দেখতে পাচ্ছ না, যে সিঁড়িতে কমাস আগেই তুমি খুন হয়ে যেতে পারতে, সেই সিঁড়ির ধাপ দিয়ে তুমি অবলীলাক্রমে নেমে যাচ্ছ বা উঠছ। সেসব ঘটনা যেন তোমার মনেই নেই, বা যেন সেসব কখনও ঘটে নি, যেন তোমার কাছে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি জরুরী এইটুকুই যে আজ তোমার পোশাকের রঙের সঙ্গে নেলপলিশের রং ঠিকঠাক ম্যাচ করেছে কি না। আসলে তুমি ইগনোর করছ চারপাশের সমস্ত কিছু, তুমি ভাবছ যে ইগনোর করাটাই বেস্ট অপশন। অবশ্য এর থেকে বেটার অপশন তোমার কাছে নেইও। তুমি কারও দিকে তাকাচ্ছ না, কারোর চোখে চোখ মেলাচ্ছ না। তারপরে রাস্তায় বেরিয়ে তুমি ভীড়ে মিশে যাচ্ছ। এ ও এক ধরণের ড্রিম সিকোয়েন্স।
    অনেক কিছু ফেলে আসতে হয়েছিল বস্তি থেকে জিনিসপত্র নিয়ে আসার সময়ে। মানুষের অভ্যাসই হচ্ছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জিনিসের বোঝা বাড়ানো। এই কমাসেই তাই অনেক জিনিস হয়ে গেছে। নাঃ, বোঝা হাল্কা করে ফেললাম, জিনিসের মায়া করলে চলবে না, যারা এখানে থাকে তারা নিয়ে নিক, তাদের কাজে লাগবে, তারা চায়ও। সামনের ঘরের বৌটা বাচ্চা কোলে করে দাঁড়িয়ে ফ্যালফ্যাল করে দেখল আমার চলে যাওয়া। বাড়িওয়ালি জানতে চাইছিল অ্যাডভান্সের যে টাকাগুলো জমা করা আছে সে সব ফেরৎ নিতে কবে আসব আবার। বললাম, ও আপনি রেখে দিন মাসীমা, ফেরৎ লাগবে না। কে যেন বলে উঠল, ভাদ্র মাস পড়ে গিয়েছে না!
    আমি তো ইংরিজি ক্যালেন্ডারে অভ্যস্থ, মনে মনে হিসেব করে দেখলাম অগস্ট যখন শেষ হতে চলেছে ভাদ্র টাদ্রই হবে ― এরা বাংলা মাস গুণছে কেন?
    সুরঞ্জনা পরে বলেছিল, কী সব নিয়ম টিয়ম আছে ভাদ্র মাসে নাকি বাড়ী বদল করতে নেই।
    আর আমার ফেরার রাস্তা নেই, ও বাড়ীতে এবার যদি ভয়ঙ্কর কিছু হয় তাহলে এখানে আর ফিরতে পারব না। আজকাল থাকার জন্য একটা আস্তানার এত ডিম্যান্ড যে কালই এরা নতুন ভাড়াটে পেয়ে যাবে।
    পুরোনো বাড়িতে ফিরে আসার পরে ঘরের মধ্যেও সহজ হল না জীবন। সেই পার্ক স্ট্রীটের দামি ইংরিজি ইস্কুলে আমার মেয়ে আর যেতে চাইল না। আগে তবু যা যাচ্ছিল, আমি থাকতে শুরু করবার পরে একেবারেই যাবে না। বুঝতে পারি যে তার খুব অসুবিধে হচ্ছে, একে তো ইংলিশ মিডিয়াম, যে ভাষা সে একেবারেই জানে না, দুই ক্লাস ওয়ানের বদলে তাকে ভর্তি করানো হয়েছে টু তে। এর পরে আছে ইস্কুলের নতুন নিয়ম কানুনের সঙ্গে মানিয়ে নেবার ব্যাপার। তাকে বলি, বেশ তো দুটো দিন যাস না, ঘরে বসে থাক, ফেল করলেও ক্ষতি নেই, আবার নাহয় রিপিট করবি একটা বছর। তবু সে শোন না। তার পুরোনো ইস্কুলই ভাল, সেখান থেকে ছাড়ানো হয় নি, সে সেখানেই পড়বে, সে রোজ দিদিমার সঙ্গে ইস্কুলে যাবে, দিদিমাও সেই ইস্কুলে পড়ায়, ছুটির পর দিদিমার সঙ্গে ফিরবে। ইংরিজি ইস্কুল তার পছন্দ নয়। এত ঝামেলা করে তাকে নতুন ইস্কুলে ভর্তি করিয়েছিলাম নিজের কাছে রাখব বলেই তো, কিন্তু সেই চেষ্টাটা ঠিক কাজে দিল না। অন্যদিকে নিরঞ্জনদা এরই মধ্যে তিন চারবার ফোন করেছে, তার উদ্দেশ্য তো আমি জানি। মীট করতে চায়, মেয়েকে ইংরিজি ইস্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে, তার দাম না নিয়ে কি আর ছাড়বে? যেন একটা হেরে যাওয়া যুদ্ধ আমি লড়ে চলেছি। যে যুদ্ধের ফল ইতোমধ্যেই বেরিয়ে গেছে, সেই যুদ্ধই আমি একা একা লড়ে চলেছি। নাঃ এভাবে নিজেকে বোকা বানিয়ে ড্রিম সিকোয়েন্সে কতক্ষণ মুখ গুঁজে থাকব আমি? মেয়েকে বলে দিলাম, বেশ, আর যেতে হবে না ইংলিশ স্কুলে, দিদিমাও চাচ্ছে না তুইও চাচ্ছিস না, ওখানেও তোকে নতুন পেয়ে উঁচু ক্লাসের ছেলেরা মারে, যাস না আর, পুরোনো ইস্কুলেই যা দিদিমার সঙ্গে।
    নিরঞ্জনদাকেও এবার ফোনে বলে দিলাম সরাসরি, মেয়ে আমার ইংলিশ ইস্কুল ছেড়ে দিয়েছে, হ্যাঁ টাকা পয়সা কিছু গচ্চা গেল ঠিকই, তা যাকগে, জোর করে কি সব কিছু হয় বলুন?
    সে আর আমায় বাগুইআটির ফ্ল্যাটে নিয়ে যাবার কথা তোলে না, এতটাই অবাক হয়। একবার বলেও ফেলে যে আমার মাথায় ছিট আছে, নইলে এত ঝক্কি ঝামেলা পুইয়ে, এত খরচ করে মেয়েকে ইস্কুলে ভর্তি করবার পরেও কিনা তাকে ইস্কুল থেকে ছাড়িয়ে নেওয়া? আমার মুখের কথা সে এমনিতে বিশ্বাস করে নি, ইস্কুলে খোঁজ নিয়ে কনফার্মড হয়, ফের ফোন করে জানতে চায় অন্য কোনও ইস্কুলে যদি ভর্তি করে দিতে পারে, এ বছর না হোক, সামনের বছরে।
    নিরঞ্জনদা একবার বলেছিল, তোমার মা তোমার মেয়েকে ইংরিজি ইস্কুলে কেন পড়তে দিচ্ছে না জানো? তাহলে সে একটু একটু করে তোমার মেয়ের ওপর থেকে কন্ট্রোল হারাবে, ঐ মেয়েকে সে ছাড়বে না, ছাড়তে চাইছে না। তোমার মাকে বুড়ো বয়সে কে দেখবে? ঐ মেয়ে। এরকমই তার ইচ্ছে। তাই নিজের মত করে তাকে মানুষ করছে, তোমার বিরুদ্ধে মন বিষিয়ে দিচ্ছে।
    এসব কথা আমার কাছে নতুন লাগে। আমার মেয়ে কেন? আমি নিজেই তো আমার মাকে তার বৃদ্ধ বয়সে দেখে রাখতে পারতাম, সেসব ভেবেই তো বিদেশে থেকে না গিয়ে দেশে ফিরে এসেছিলাম। নিরঞ্জনদা বলে, উঁহু, তোমার মা তোমাকে চায় না।
    - সে আমি নিজেও জানি, কিন্তু কেন? আমি কালো বলে? সেতো ছোটবেলা থেকেই আমায় কালোকুচ্ছিত বলে বলে ঘৃণা করেছে। বর্ণবিদ্বেষ কি শুধু সাদাদের সঙ্গে কালোদের? আমাদের সমাজে তো ঘরে ঘরে ভুরি ভুরি এমন ঘৃণা।
    - হতে পারে। কুৎসিত সন্তানকে অনেক মা ই কম পছন্দ করে। এরকম তো প্রায়ই দেখা যায়।
    - দেখেছি নিরঞ্জনদা। ইস্কুলে পড়তে বন্ধুদের মধ্যেই এমন দেখেছি।
    নিরঞ্জনদা বারবার জানতে চায়, সামনের বছরে মেয়েকে আবার ইস্কুলে ভর্তি করাতে চাই কি না। সামনের বছর মানে অনেক অনেকগুলো মাসকে পেরিয়ে যাওয়া। অত সুদূর ভবিষ্যতের প্ল্যান নিয়ে আমি ভাবতেই পারি না, কিন্তু নিরঞ্জনদাকে তো অত সব বলার দরকার নেই, বলি ও না, হুঁ হাঁ করে ছেড়ে দিই ফোন।
     
     
     
    (চলবে)
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:5195:1112:5618:e0b3 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৭:৫১735639
  • তিন

    সত্যিকথা বলতে কি একের পর এক ছোট বড় ধাক্কার মধ্যে দিয়ে যেমন টের পাওয়া যায় যে জীবনে তরঙ্গ আছে, তেমনি বারবার একইরকমের ধাক্কা যখন আসতে থাকে তখন তরঙ্গমুখের ওপর দাঁড়িয়ে থেকেও খুব বেশি ভয় বা রোমাঞ্চ হয় না। শুধু ব্যালেন্স করে নেবার কায়দাটুকু যা রপ্ত করবার ব্যাপার। চতুর্দিকে গোল হয়ে ঘিরে রয়েছে দর্শকেরা, সার্কাসের দড়ির খেলা দেখাবার সময় যেমন সব উদগ্রীব হয়ে দেখতে থাকে। একটার পর একটা খেলা তুমি দেখাতে থাকবে, তারা হাততালি দেবে, আরও কঠিন কিছু দেখবার অপেক্ষায় থাকবে, বলবে বাহ বাহ কী দারুন কী ট্যালেন্ট হাউ ব্রেভ ইউ আর। 
    সেদিন বড়োসায়েবের নতুন বৌ এবং সেক্রেটারী সজ্ঞানে একটি পুত্রসন্তান প্রসব করলেন উডল্যান্ডসে। সকাল থেকেই বড়োসায়েব নেই, তবু সেই ঘরের সামনের ঘরটায় সেক্রেটারীর কাজ আমাকেই সামলাতে হচ্ছে। মুহূর্মুহু আসছে শুভেচ্ছাবার্তা ফুল মদ উপহারের প্যাকেট। বড়োসায়েবের চেয়েও তার মোসায়েবদের আহ্লাদ কয়েক গুণ বেশী।
    এক এক সময় থমকে যাই, ভাবি, এই মোসায়েবরা কি নিজেদের সন্তানের জন্মের সময়ও এতটাই উৎফুল্ল হতো? স্বয়ং বড়োসায়েবের আনন্দের বহর কি এর চেয়েও বেশি না কম? তাঁকে তো দেখা যাচ্ছে না, তিনি উডল্যান্ডসে বসে রয়েছেন গিন্নির বেডের পাশে। খবরে প্রকাশ নবজাতকের দৈর্ঘ্য ওজন স্বাস্থ্য সবই পারফেক্ট। পুত্রসন্তান জন্মানোর কারনে মোসায়েবের দল তাদের উল্লাসে অতিরিক্ত একটা মাত্রা জুড়ে দিল। বড়োসায়েবের ঘরের দরজা হাট করে খোলা, আমার সামনে দিয়েই লোকজন সেখানে ঢুকছে বের হচ্ছে। সবাই সায়েব, এদের কারোকে এর আগে কখনও দেখিনি। কোত্থেকে সব খবর পেয়ে এসেছে কে জানে! মিঠুবাবু খুব ব্যস্ত। ব্যস্ত মিঠুবাবুর গিন্নিও। ফ্লুরিজ থেকে ইয়াব্বড় কেক এনে রাখা হয়েছে বড়ো সায়েবের টেবিলের ওপর। আজ আমায় কেউ ট্রে হাতে ধরিয়ে অতিথি আপ্যায়নের দায়িত্ব দেয় নি। আমি জাস্ট দর্শক। লোকগুলো সকাল দশটা সাড়ে দশটার মধ্যেই মদ খেয়ে মাতাল হয়ে গেল। টেলিফোনে কনফারেন্স কল বসেছে হাসপাতালের ঘর থেকে বড়োসায়েবের ঘরে। লাউডস্পীকারে কথা শোনা যাচ্ছে। গদোগদো হয়ে সায়েবেরা তাদের আনন্দের অভিব্যক্তি জানাচ্ছে বড়োসায়েব ও বড়োগিন্নিকে। একজন তো কথা বলতে বলতে কেঁদেই ফেলল, আনন্দাশ্রু। টানা দুঘন্টা এ জিনিস চলার পর লাঞ্চব্রেক হয়ে গেল। মিঠুবাবু আমাকে বলে গেলেন যে ঘরটা যেন বেয়ারাদের ডেকে একদফা গুছিয়ে দিই। টিপিনের পর আবার এরকম হবে, তবে তখন যদি বড়োসায়েব হুট করে এসে পড়ে তবে কেলেঙ্কারির শেষ থাকবে না, তাই ঘরটা নীট অ্যান্ড ক্লীন করে রাখা জরুরি। এর মধ্যে কয়েকজন মাতাল মেয়েদের টয়লেটে চলে গেছে, তাদেরকে সামলানোর জন্য সাশাকে দরকার, মিঠুবাবু চেঁচাচ্ছে ― সাশা, প্লীজ ওদের লেডিস টয়লেটে পেচ্ছাপ করতে বারণ করো।
    সাশা চোয়াল শক্ত করে হনহনিয়ে লেডিস টয়লেটের দিকে ছুটে গেল। সুইপার ঘর পরিস্কার করতে এসে বলল, ম্যাডাম এই কেক কি রেখে দেব না ফেলে দেব? কেকের হয়ত বিশ শতাংশ খাওয়া হয়েছে। বাকিটা একটু কেৎরে পড়ে আছে। বললাম, এখন সরিয়ে রাখ, মিঠুবাবু যদি চায় তো বের করে দিস। তারপর ভাবলাম ভুল বললাম কি? এই ফেলে যাওয়া কেক কি ওরা আর ফিরে খেতে চাইবে? সে কেক নিয়ে চলে যাচ্ছে, আমি দৌড়ে যাই পেছন পেছন, তোরা খেয়ে নে বাকিটা, ও কেক আর এখানে আনতে হবে না।
    আমি লাঞ্চের আগে তিনতলায় নিজের জায়গায় যেতে গিয়ে দেখলাম চাকরির প্রথম দিনে যে ঘরটায় বসতাম, তার উল্টোদিকের তালাবন্ধ ঘরটা আজ খোলা, শুধু খোলাই না, সেই ঘরের দরজার পাল্লা ঠেলে বেরিয়ে এল এক যুবক। আমার চেয়ে সামান্য ছোট হবে বয়সে। দেখে মনে হচ্ছে বাঙালি। আমি এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, নতুন নাকি?
    ছেলেটা হাসল। না মানে আমি অল্প কদিনের জন্য এসেছি।
    ― কেন? অল্প দিনের জন্য কেন? কী কাজ?
    ― অডিটের জন্য।
    ― অডিট মানে?
    ছেলেটা হোহো করে হাসে। আমি ওকে আমার ঘরে নিয়ে যাই। বলি, চলো ঐ ঘরে, চা খাবে তো? ওখানে চা আছে বিস্কুট আছে। আড্ডাও দেওয়া যাবে।
    সে আমায় বোঝায় অডিট কী বস্তু ও কতপ্রকার। আমরা অল্প সময়েই বন্ধু হয়ে উঠি। ছেলেটি একটা অডিটিং ফার্মের হয়ে এসেছে, এমনিতে সে চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সীর ছাত্র, প্রায় শেষ হয়ে এসেছে পড়াশোনা, বেকবাগানের মোড়ে যে বাড়িটা বিয়ের জন্য ভাড়া দেওয়া হয় তার পাশেই ওদের ফার্ম। অনেক কথা বলে যায় ও। হাসতে হাসতেই বলে যদিও, কিন্তু শুনলে একটু ভয় ভয় করে।
    মানুষ যখন আনন্দে থাকে, সে তার চারপাশের সব কিছু দেখতে পায়, নিজেকে নিয়ে খুব বেশি ভাবনা চিন্তা করে না। কিন্তু যখন আনন্দের পাল্লা খালি, চারদিক থেকে নিরানন্দ চেপে ধরছে তাকে, কোণঠাশা হতে হতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে তার, তার আর কিছু দেখতে পাবার ফুরসৎ থাকে না। তখন কেবল নিজেকে নিয়ে ভাবনা আর দুশ্চিন্তা। প্রত্যেক দিন প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে কত কম মানুষ আমি, একজন সম্পূর্ণ মানুষের থেকে কত হীন, সবাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে আমার নিকৃষ্টতা। এক এক সময়ে মনে হত, আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি, না কি পাগল হয়েই গেছি? আবার নিজেকে প্রবোধ দিয়েছি তা কী করে হবে, পাগল হয়ে গেলে রোজ সেজেগুজে অফিসে যাই, মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত টিপটপ থাকে নিখুঁত সাজগোজে কী করে? অফিসে আমার কাজে সবাই সন্তুষ্ট, কখনও কোনও অভিযোগ করে নি কেউ, অবশ্য যদিনা সেই গ্লাস বোতল ভেঙে ফেলার ঘটনাটা ধরা না হয় তবেই। কিন্তু সেটা তো আমার দোষ ছিল না। আমার ব্যবহারেও সবাই খুব খুশি, যত কাজই দেওয়া হোক না কেন সব করে দিই সময়মত, কখনও কারোকে ফিরিয়ে দিই নি। এতসব যে করে চলেছে সে পাগল হবে কেমন করে? পাগলে এত সব পারে? কিন্তু আমার মন নিরানন্দে ভরা, অথচ কত খুশিতে থাকার কথা ছিল, মেয়েকে কাছে পেয়েছি, লোকে শুনলে বলবে তোমার আর কী চাই? এক এক করে যা চেয়েছ সবই তো পেলে। আমি যুক্তিতে এসব খণ্ডাতে পারব না। আমি গুছিয়ে তর্ক করতে পারব না এমন যুক্তির সামনে। কেমন যেন লোকে সুযোগ পেয়ে অপমান করে যায়, যেটা ধরতে পারলেও সময় মত প্রতিবাদ করে উঠতে পারি না।
    এই যেমন সেদিন হঠাৎ সাশা এসে আগবাড়িয়ে বলল, তুমি পারফিউম মাখো না?
    আমি সহজ প্রশ্ন ভেবে সঙ্গে সঙ্গে হাসি মুখে উত্তর দিয়েছিলাম ― নাহ।
    উত্তর শুনে সাশা গম্ভীর মুখে বলল, এবার থেকে মেখো।
    ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আমি অবাক হয়ে গেলাম, তা ও বললাম, কেন? 
    সাশা মুখ গম্ভীর রেখেই বলল, পারফিউম মেখো, তোমার গায়ে একটা গন্ধ আছে।
    এটা অপমান কি না সেটা বুঝতে বুঝতেই বেশ কয়েক সেকেন্ড কেটে গেছে। তার মধ্যে সাশা আরও একটা বাক্য যোগ করে ফেলেছে ― সের্গেই বলে পাঠিয়েছে আমাকে, তোমার কাছে এলেই ওর নাকে গন্ধ লাগে। একটা ভাল দেখে পারফিউম কিনে নিও, সুন্দর গন্ধওয়ালা।
    সাশা চলে গেল। আমি কোনও উত্তর দিতে পারি নি। পুরো ব্যাপারটার প্রতিক্রিয়া ধীরে ধীরে হতে শুরু করল আমার ভেতরে। সেটা ক্রমশ বাড়তে শুরু করল, বাড়তে বাড়তে সেটা কোথায় গিয়ে থামবে তা আমি জানি না। আমার মাথার ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে, হয়ত চোখ দিয়ে জল পড়ছে, আমি জানি না পড়ছে কি না, আমি বুঝতে চেষ্টা করছি এটার নাম কি অপমান করা, নাকি এরকমই নিয়ম এই সমাজে।
    মানুষ কি তার নিজের শরীরের দুর্গন্ধ বুঝতে পারে? কতদিন যাবদ এরকম দুর্গন্ধ আমার গায়ে? ইশ্, আমি জানতামই না! কী লজ্জার কথা। কিন্তু কেন এমন দুর্গন্ধ হল আমার শরীরে? আমি বুঝতে পারি না লজ্জা কেন পাচ্ছি, দুর্গন্ধের কারনে না অপমানিত হবার জন্য। আমি বাথরুমে ঢুকে পড়ি, আয়নায় সব ঝাপসা, তবু যতটা সম্ভব নিজের শরীর শুঁকে চলেছি গন্ধের উৎস খুঁজতে, খুঁজে পাচ্ছি না, কেন পাচ্ছি না? আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি? কাকে জিজ্ঞেস করব? কাকে জিজ্ঞেস করা যায়? নীচে রিসেপশনে গিয়ে সুরঞ্জনাকে বলব কি, সুরঞ্জনা একটা সত্যি কথা বলবি, আমার গায়ে কি খুব দুর্গন্ধ? হ্যাঁ, লাঞ্চ ব্রেকে জিজ্ঞেস করব। কিন্তু লাঞ্চ ব্রেকে তো ও রাশিয়ানদের বৌদের ইংরিজি পড়াতে চলে যাবে, তাহলে কাকে জিজ্ঞেস করব? তেমন বিশ্বস্ত কে আছে আমার, যে এই প্রশ্ন শুনে হাসাহাসি করবে না? যতক্ষণ না এই প্রশ্নের ঠিকমত উত্তর পাচ্ছি স্থির থাকতে পারছি না, আমার ভয়ানক লজ্জা করছে এই ভেবে যে, সবাই জানে আমার সর্বাঙ্গে দুর্গন্ধ, সবাই জানে, তারা এতদিন আমাকে কিছু বলে নি, উহ।
    অডিট ফার্মের সেই ছেলেটা আমাদের ঘরে ঢুকেছে, আমার দিকেই এগিয়ে আসছে, হয়ত কিছু জিজ্ঞেস করতে চায়, আমি পিছু হটতে থাকি, আমার পিঠ সত্যি সত্যিই দেয়ালে ঠেকে যায়, ছেলেটা দাঁড়িয়ে পড়ে, কী সব যেন চাইছে আমার কাছে, কিছু স্টেশনারি, কাগজ, রাইটিং প্যাড, ডটপেন, স্কেল, পেন্সিল। আমি দৌড়ে গিয়ে ওগুলো নিয়ে নিরাপদ দূরত্ব থেকে একটা টেবিলের ওপর রেখে দিই সব, অন্তত একজন নাহয় না জানল আমার সর্বাঙ্গে দুর্গন্ধ। কাজে মন বসাতে পারছি না আমি। আচ্ছা ওরা যে আমাকে এই কথাটা বলল, মানে একজন বলে পাঠাল, অন্যজন এসে বলল, ওরা কি এরকম কথা অন্য কারোকে বলতে পারত, যদি অন্য কেউ, ধরা যাক বড়োসায়েব, কি মেজসায়েব বা বড়োসায়েবের বৌয়ের গায়ে যদি আমার মত দুর্গন্ধ থাকত? এমনি করে বলতে পারত? কীসব ভাবছি আমি, তাদের কী করে বলবে? তারা এমনিতেই দামি দামি সেন্ট মাখে, তাদের গায়ে গন্ধ থাকলেও দামি সাবান সেন্টের গন্ধে চাপা পড়ে যাবে, তাদের কেউ এসব বলবার সাহস পাবে না।
    সের্গেই বলে পাঠিয়েছে সাশাকে দিয়ে! তার মানে আমাকে নিয়ে ওরা আলোচনা করে। কদিন আগে ব্রা-প্যান্টির সেট পাঠিয়েছিল এখনও পড়ে আছে আমার দেরাজে। আমায় নিয়ে রৌরকেল্লা যাবে বলেছিল, এখন গায়ের গন্ধ নিয়ে দুজনে আলোচনা করছে। কিন্তু এই যে গন্ধের ব্যাপারটা আমার মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে দিল, লজ্জায় অপমানে এমন অবস্থা হয়েছে আমার যে সত্যাসত্য যতক্ষণ না প্রমাণ হচ্ছে আমি কিচ্ছু করতে পারছি না। ঝনঝন করে ফোন বেজে উঠল, বস ডাকছে নাকি? এখন বসের ঘরে গেলে সের্গেইয়ের সঙ্গে দেখা হবেই, বসকে বলে দেব তখন যে সের্গেই আমার গায়ের গন্ধ নিয়ে সাশাকে এসব বলেছে? ফোনটা ধরলাম, বস নয়, বাইরের কল ―নিরঞ্জনদা। নিরঞ্জনদা আমার খবর নিল, কেমন আছি, কী করছি ইত্যাদি, আমি পুরোনো বাড়িতে ফিরে যাবার পর কোনও সমস্যা হচ্ছে কি না, ― আমি হুঁ হাঁ করে উত্তর দিয়ে যাচ্ছি হঠাৎ কী যেন হয় আমার মধ্যে, ধাঁ করে বলে বসি, আচ্ছা নিরঞ্জনদা একটা প্রশ্ন করব আপনাকে, সত্যি করে উত্তর দেবেন তো? বলুন তো, আপনার কি মনে হয় আমি পাগল?
    ― না। একদম মনে হয় না। এসব কথা ভাবছ কেন? শক্ত সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছ, পাগল তুমি নও।
    ― আরেকটা প্রশ্ন করব?
    ― কী?
    আমি আমতা আমতা করে বলি, আচ্ছা আপনি কি কখনও আমার… মানে বলতে চাইছি যে আমার গায়ে কি কোনও বাজে গন্ধ আছে? কখনও পেয়েছেন?
    নিরঞ্জনদা একটু চুপ করে থেকে বলল, তা একটু আছে। 
    আমি বুঝে যাই, আমার গায়ে দুর্গন্ধ তা সবাই জানে। আর কী বলব এখন আমি? আমি চুপ হয়ে গেছি, কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে নিরঞ্জনদা আমায় উপায় বাৎলে দেয়, তুমি ডিও ব্যবহার করতে পারো, আজকাল তো সবাই মাখে। 
    কেউ পারফিউম মাখতে বলছে তো কেউ ডিও। মানুষের জীবনে অল্প কিছু অহংকার থাকে তার একান্ত নিজস্ব, আমি বুঝতে পারি, আমার কিচ্ছু নেই। নাথিং।
     
    (চলবে)
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:5195:1112:5618:e0b3 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৭:৫১735640
  • চার

    এই গন্ধের ব্যাপারটা কিছুতেই মাথার ভেতর থেকে যেতে চায় না। একই সঙ্গে জেদ চেপে যায় মনে, কিছুতেই পারফিউম মাখব না। অডিট ফার্মের ছেলেটা মাঝে মাঝেই চলে আসত আমাদের ঘরটায়, অনেক রকমের গল্প করত, মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করত, তুমি কেন এখানে পড়ে আছ?
    আমি বলতাম, আর কোথায়ই বা নেবে আমায় বল?
    ও তো আসলে জানত না আমার বর্তমান বা অতীত, আমি যে রোজ সবার জন্য গুছিয়ে চা বানাই, সেসব কাপে কাপে ঢেলে ট্রে তে করে ঘরে ঘরে নিয়ে যাই, এটাতেই যেন ওর খুব আপত্তি। এদের ভাষা জানেনা ও একফোঁটা তবু কেমন করে যেন ক্যাশিয়ারকে গিয়ে বলে বুঝিয়েছে ওর কথা, বলেছে আপনারা সবাই একটা জায়গায় জড়ো হয়ে সকালে চা খেতে পারেন না?
    সেই বোঝানোয় কাজও হল। যে ড্রাইভারের চাকরি চলে গেছল আমার টাইপ করা চিঠিতে, তারই বৌ ক্যাশিয়ার আমায় এসে মিষ্টি করে বলল, তোকে আর রোজ রোজ ঘরে ঘরে গিয়ে চা দিতে হবে না, এইখানেই এই টেবিলে চা বানানো থাকবে, যার যার খাবার এসে খেয়ে যাবে। ক্যাশিয়ার মেয়েটি আমার চেয়ে বড়ো, কেমন একটু স্নেহের চোখে দেখতে শুরু করে আমাকে। ওর চাকরির মেয়াদ শেষ হয়ে এল প্রায়, ও চলে যাবে ওর বরকে নিয়ে মস্কোয়, পরের ফ্লাইটে আসবে নতুন ক্যাশিয়ার, সে কে, কী তার নাম, কিছুই আমি জানি না। আর জেনে হবেটাই বা কী!
    ক্যাশিয়ার খুব কায়দা করে আমায় সঙ্গে নিয়ে ফোটো তোলে অফিস ঘরে, যেন কত গভীর বন্ধুত্ব আমাদের। আসলে ওকে বড্ড দেরিতে চিনলাম, বা ও আমাকে। ওর নাম লুদমিলা, ছোট করে ডাকলে ল্যুদা। অডিটের ছেলেটা, ল্যুদা আর আমি তিনজনে মাঝে মধ্যে সেই দূরের ঘরটায় গিয়ে গল্প করি। কত যে চুরি, সেই চুরি ঢাকতে আরও ভুল হিসেব, সব বলে যায় ছেলেটা, ল্যুদা বলে, হ্যাঁরে আমার কোনও ক্ষতি হবে না তো? আমি কিন্তু কোনও পয়সাই সরাই নি। ওরা আমায় যেমন যেমন হিসেবের কাগজ দেয়, আমি তেমন তেমন করে সব গুছিয়ে রেখেছি। 
    চুরির কিছু কিছু ঘটনাতো আমি নিজেও জানি, তার একটা দুটোর আভাস দিলে ঐ ছেলেটা হেসে উড়িয়ে দেয়, বলে ওসব হচ্ছে পীনাটস্‌, মানে খুচরো ব্যাপার, আসল হিসেবের খাতায় যে কত গরমিল তা দেখতে দেখতে মাথা গরম হয়ে যায়। আচ্ছা, তোমাদের এই কোম্পানীতে যদি বাইরে থেকে অডিট করতে আসে, এরা সামলাবে কেমন করে?
    ল্যুদা একদিন আমায় বলল, শোন এই ছেলেটাকে পটিয়ে পাটিয়ে একটু বল না, হিসেবগুলো সব সুন্দর করে মিলিয়ে দেবে বরং। ল্যুদা ওকে ছোটোখাটো ঘুষ দেবার মতলবও আঁটে, নিজে বলতে লজ্জা পায়, আমাকে দিয়ে বলাতে চায়।
    আমি বলব কী? ছেলেটার দিকে তাকিয়ে কথা শুরু করতেই সে হেসে ফেলেছে, বলছে রক্ষা করো আমাকে, আমি এসবে নেই, এরকম করলে কালই আমার ফার্মে গিয়ে বলে দিচ্ছি অন্য কারোকে পাঠিয়ে দিতে আমার জায়গায়। তারপর আবার বলে, তুমি এখানে থেকো না, আরও কত কত ভাল ভাল জায়গা আছে, ক’টাকা মাইনে দেয় এরা তোমাকে?
    ― তুই আমাকে খুঁজে দে তবে নতুন চাকরি।
    ― চেষ্টা করতে পারি, আমাদের অফিসে বলে রাখব, তুমি একদিন এখান থেকে বেরিয়ে ইন্টারভিউ দিতে যেতে পারবে না আমাদের অফিসে?
    ― তোদের অফিসে লোক নিচ্ছে বুঝি?
    ছেলেটা থতমত খেয়ে যায়, বলে, না এখন হয়ত নিচ্ছে না, কিন্তু বলে রাখতে তো ক্ষতি নেই।
    আমার মাথাতে নতুন চাকরি খুঁজবার চিন্তা ঢুকিয়ে দেয় ও। আসলে আমি এই চাকরিটা ছেড়ে যাবার কথা কখনও ভাবতামই না, তা সে ছহাজারের জায়গায় যখন চারহাজার করে দিচ্ছিল তখনও ভাবিনি। তারপরে তো যাতায়াতের সমস্যাও লাঘব হয়ে গেছে, বাথরুমের সমস্যা নেই, বাচ্চার জন্য চিন্তাও কমে গেছে, তবু আমি দিন কে দিন কেমন ঝিমিয়ে যাচ্ছি। 
    আমার খুব পুরোনো এক বান্ধবীর ফোন নম্বর মনে ছিল, ছোটবেলার বন্ধু, আমরা কায়দা করে গঙ্গাজল পাতিয়েছিলাম। কলকাতার দুটো আলাদা প্রান্তে থাকলেও নিয়মিত চিঠি লিখতাম। আমার বাড়িতে ফোন ছিল না, তাই চিঠি। সেই চিঠিতে কত গোপন কথা অনায়াসে লিখে ফেলতে পেরেছি, একে অন্যকে কত মূল্যবান মতামত দিয়েছি, সেই টিন এজ বয়সে এরকমই হয়। দুম করে মনে পড়ে গেল তার কথা, প্রায় দশ এগারো বছর ধরে কোনও যোগাযোগ নেই, হয়ত এতদিনে বিয়ে টিয়ে করে ফেলেছে। পুরোনো ফোন নম্বর পাল্টে গেছে, ছয়ের জায়গায় সাত নাকি আট ডিজিটের নম্বর এখন, তাহলে একমাত্র উপায় টেলিফোন ডিরেক্টরি, ঠিকানা খুঁজে নতুন নম্বর বের করে সেই নম্বর ডায়াল করা হয়ে গেল। হ্যাঁ সত্যিই বিয়ে হয়ে অন্য বাড়িতে চলে গেছে, তবে ছোটোখাটো সেলিব্রিটি বনে গেছে, প্রথমে সিনেমা, তারপরে টিভি সিরিয়াল ইত্যাদি করে, অবশেষে ফিল্ম বানাচ্ছে ― কর্পোরেট ফিল্ম।
    অফিসের সময় থেকে লুকিয়ে চুরিয়ে দেখা করলাম ওর সঙ্গে। আজকাল কোনটা বসবাসের বাড়ি কোনটা অফিস, চেনা শক্ত। নরম পাপোষ, নীচু নীচু গদি দিয়ে সাজানো অফিস। হস্তশিল্পের কাজ করা সব চাদর বালিশের ওয়াড়। যেন খুব রুচিপূর্ণ পরিবারের ড্রয়িং রুম। একটা আবাসিক অ্যাপার্টমেন্টের পুরোটাই ওর এই অফিস। তারই মধ্যে টেলিফোন বাজছে, তারই মধ্যে কম্পিউটারও রয়েছে এবং একটা নতুন ব্যাপারও হচ্ছে, ইমেইল পাঠানো এবং রিসীভ করা। তখন টেলিফোন কেউ ছুঁতে পারবে না। ইমেইল জিনিসটা আমাদের সিলেবাসের পাঠপুস্তকে ছিল, সবটাই থিয়োরি, এই প্রথম দেখলাম চর্মচক্ষে সেই ঘটনা।
    মেয়েটি চমৎকার সেট-আপ বানিয়েছে। একজন পার্টনার ভদ্রলোকও আছেন দেখলাম, সেই পার্টনারের বাড়ির একতলাটাতেই এই অফিস। কতরকমের ব্যবসা আছে এই পৃথিবীতে। আমি চাইছি একটা পেস্ট কন্ট্রোলের ব্যবসা খুলতে, যেখানে সুইপার ছেলেটার সঙ্গে বাড়ি বাড়ি গিয়ে মশা ইত্যাদি মারবার জন্য বিষ ছড়িয়ে আসব। আবার আমার ছোটোবেলার সই গঙ্গাজল খুলেছে সিনেমা বানানোর বিজনেস। ওর মূলধন বেশি, প্রচুর যোগাযোগ আছে নানান কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে, ওর বরও ফিল্মের ডিরেক্টর, তবে সেগুলো সম্ভবত টিভি সিরিয়াল। এসব লাইনে ওদের শৈশব থেকে অভিজ্ঞতা। হঠাৎ আমাকে বলল, তুই তো টিভি সিরিয়ালে অ্যাকটিং করতে পারিস। আমি কনফিডেন্সের অভাব বোধ করি, তবু আগ্রহের সঙ্গে বলি, এখনও পারব বলছিস?
    ― তোর ফিগার ঠিক আছে, হাইটও। পয়সা কড়িও এরা খুব খারাপ দেয় না।
    ― আর অ্যাকটিং?
    ― তোর অ্যাকটিং আমি দেখিনি আগে? তুই তো আমার থেকেও ―
    ― শোন না, শোন না, কার সঙ্গে কোথায় দেখা করব একটু বলে দে। আমি কিন্তু ঠিক সময় বের করে নিয়ে সেসব লোকেদের সঙ্গে দেখা করব।
    গঙ্গাজল বলল, আমার ঘরেই তো আছে এক পীস ডিরেক্টর। যদিও তার সঙ্গে আমার দেখাই হয় না বলতে গেলে।
    আমি বললাম, তোর বরের সঙ্গে একটু আলাপ করিয়ে দিবি না? কী নাম তার?
    গঙ্গাজল নামটা বলল। এমন করে বলল যে বুঝলাম ভদ্রলোকের মোটামুটি ভালই নাম আছে ইন্ডাস্ট্রিতে, লোকে যখন পদবী ছাড়াই বিখ্যাত হয়ে যায়, সেই লেভেলের নাম। 
    তারপরে আমরা একটা করে সিগারেট ধরালাম। ও দু একটা টান দিয়েই নিভিয়ে দিল, বলল, অনেকদিন খাই নি তো, খেলেই পটি পাচ্ছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ও তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে পড়ল― ওর ছেলের ইস্কুল ছুটি হবে তখন। আমাকেও তুলে নিল গাড়িতে। এই সুযোগে ওর ছেলেকেও দেখা হয়ে যাবে। অল্প একটু ড্রাইভ করেই লতাপাতা ঘেরা শান্তশিষ্ট একটা বাড়ীতে গঙ্গাজলের ছেলের ইস্কুল। ছোট্ট ছেলেকে হাত ধরে ধরে এনে গাড়িতে বসিয়ে দিল সে। একদম আমার মেয়ের বয়সি। খুব স্মার্ট। মিষ্টি দেখতে। নাম জিজ্ঞেস করতেই প্রথমে ডাকনাম বলল। এসব নতুন রেওয়াজ, আমরা নাম জিজ্ঞেস করলে ভালোনামটাই বলতাম বরাবর, আমার মেয়েও তাই বলে। তার টিফিন বক্স চেক করল গঙ্গাজল। টিফিন পুরোটা খায় নি। বকাবকি চলছে, গাড়িও চলছে, ও আমাকে কতকটা এগিয়ে দেবে। আমি অন্যমনস্ক। ভাবতে চেষ্টা করে যাচ্ছি, আমার মেয়ে কী টিফিন নেয়? আদৌ কি টিফিন নেয়? এটা খেয়াল করিনি তো এত দিনে। অবশ্য ও আজকাল ইস্কুলে যাচ্ছে কি না, সেটাও জানা হয়ে উঠছে না। ও তো বাড়িতে আমার সঙ্গে সেরকম কথা টথা বিশেষ বলে না। রাতেও আমার সঙ্গে শুতে চায় না। ভুলিয়ে ভালিয়ে গল্প শোনানোর ছল করে পাশে এনে শোয়ালেও সে কিছুতেই ঘুমোয় না। গল্প শেষ হওয়া পর্যন্ত জেগে থাকে। তারপরে বালিশ নিয়ে পালিয়ে যায় আমার পাশ থেকে।
     
    (চলবে)
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:5195:1112:5618:e0b3 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৭:৫৩735641
  • পাঁচ

    কেন আমি ক্ষণে ক্ষণে ওর ছেলের সঙ্গে আমার মেয়ের তুলনা টানতে চাইছি? ওর জীবন ওর, আমারটা আমার। ওকে কি আমি হিংসে করি? এই প্রশ্নের সরাসরি হ্যাঁয়ে নায়ে উত্তর হয় না। ওর আর্থিক স্বচ্ছলতা, বাড়ি গাড়ি স্বাচ্ছন্দ্য, এসবের দিকে তাকালে লোভ হয় বৈকি। দামি দামি জামাকাপড় পরছে, একটা কাঠের পুঁতি দিয়ে বানানো মালা পরেছে গলায়, ওটা নাকি এখন ফ্যাশন, ঐ কাঠ চন্দন কিনা জানতে চেয়েছিলাম, বলল, না এটা হচ্ছে রোজ উড। গোলাপের কাঠেও কি সুগন্ধ থাকে? এর উত্তর হচ্ছে, না, থাকে না। তাহলে লোকে এই রোজ উড নিয়ে এত মাতামাতি করছে কেন? এমনিই করছে, ফ্যাশনের কি আর কোনও সলিড কারণ থাকে নাকি!
    চন্দন, গোলাপ, এসবের আলোচনা শুরু হতেই আমার মাথায় আবার সেই গন্ধের ব্যাপারটা শুরু হয়ে যাচ্ছিল। একবার ভাবলাম ওকে জিজ্ঞেস করব না কি। নাহ থাক। ও ওর বরের সঙ্গে কথা বলে দেখবে আমাকে নেওয়া যায় কি না টিভি সিরিয়ালে। এখন এসব গন্ধ টন্ধের প্রশ্ন তুললে ও কনফিউজড হয়ে যেতে পারে।
    বললাম, তুই তোর বরকে বলবি কিন্তু।
    ― হ্যাঁ হ্যাঁ বলব, তোকে ফোন করে জানাবো। তবে সে আমার কথা কতটা শুনবে জানি না।
    ― বাহ, তুই তার বৌ না! বৌয়ের কথা কি লোকে ফেলতে পারে?
    ― সেরকম বৌ হওয়া আমার ধাতে নেই রে।
    আমাকে নামিয়ে দেয় ওরা অফিসের মোটামুটি কাছেই। অগস্টের টগবগে গরমে আমি অনেক স্বপ্ন দেখতে দেখতে অফিসের দিকে হাঁটছি। ফিল্ম স্টার বনে গেছি। দামি সানগ্লাস আমার চোখে, খুব সুন্দর একটা সাদা সিল্কের শাড়ি পরেছি, নাহ শাড়ি নয়, একটা ড্রেস। সাদার ওপরে, সিল্কের। গয়না টয়না একদম পরিনি, একটা সাদা মোটর গাড়িতে করে যাচ্ছি এই রাস্তা দিয়ে, গাড়ির ভেতরটা এয়ার কন্ডিশান্ড, ঠিক যেমন গঙ্গাজলের গাড়ির ভেতরটা ঠাণ্ডা ছিল। দারুন অভিনয় করি আমি, ইন্ডাস্ট্রি জোড়া আমার নাম, লোকে পদবী ছাড়াই এক ডাকে চেনে।
    অফিসের গেট এসে যায়, লাফিয়ে লাফিয়ে ঢুকছি আমি, সুরঞ্জনা দেখতে পেয়ে ডেকে বলে, কীরে, কোথায় গেছলি? মুড খুব ভালো মনে হচ্ছে।
    ওকে কিছু বলি না। এখন কিছু না বলাই ভালো, হুঁ হুঁ বাবা কয়েক বছরের মধ্যেই দেখবে আমি টেলিভিশনের পর্দা কাঁপিয়ে দিয়েছি, তার পরে রূপোলি পর্দাতেও দেখতে পাবে আমাকে। মিঠুবাবুর শালার বৌয়ের জায়গায় আমাকে দেখতে ভিড় হবে। জাস্ট ওয়েট অ্যান্ড সী।
    নবীনা সিনেমার অপোজিটে যে গলির মত রাস্তাটা ঢুকে গেছে, ওখানেই কয়েক পা হেঁটে ডানহাতে মস্ত লোহার গেট। গেটের ওপারে স্টুডিও। সেই খানেই দেখা করতে বলেছে আমায় গঙ্গাজল, ওর বরের সঙ্গে। ভাবা যায় না, এত তাড়াতাড়ি সব ব্যবস্থা হয়ে গেল। গতকাল ওকে সব বলেছি, আর আজ সকালেই ও ফোন করে বলছে দশটা এগারোটা নাগাদ স্টুডিওতে গিয়ে দেখা কর আমার বরের সঙ্গে। এই মেইন রোডটা অবশ্য আমি ভালো করেই চিনি, প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোড। এই রাস্তায় অনেক রকমের স্মৃতি, তার মধ্যে একটা তো মাত্র এক দেড় মাস আগে ঘটেছে, স্বরাজ-মাজদা গাড়ি কিনবার নাটক। আজ প্যাচপ্যাচে গরম। সকাল থেকেই বৃষ্টি কাদা এসব দেখে একটা গার্ডেন সিল্কের হলদে শাড়ি পরেছি, নীল ব্লাউজ। কোনও মেক আপ সাজগোজ কিচ্ছু নেই আজ, মাথার চুল ভিজে। অফিসের গাড়ি নেবার চেষ্টাও করি নি। ইউরি আন্দ্রেইভিচকে একটা মিথ্যে অজুহাত দেখালাম, বললাম মেয়ের জন্য একটা দরকারে একটু বেরোতে হবে, আপনি একটু ম্যানেজ করে দেবেন যদি আমার বস আমায় খুঁজতে আসে? উনি সঙ্গে সঙ্গে রাজি। হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই, তুমি বেরিয়ে যাও, আমি বুঝিয়ে দেব তোমার বস কে।
    সাশাকেও বলা যেত, কিন্তু সাশার সঙ্গে যেচে আলাপ করতে ইচ্ছে করে না, দিনকে দিন ওর ব্যবহার, আমার প্রতি ওর মনোভাব, এসব তিক্ততার সৃষ্টি করেছে মনের ভেতরে। ওকে বললে হয়ত ও নিজেই গিয়ে সের্গেইকে বলে দেবে আমি অফিস টাইমে বাইরে বেরিয়েছি। সের্গেই জানতে পারলে আমার বসকে না বলে দিলেও, নিজে সুযোগ খুঁজবে আমার কাছে এসে সর্দারি ফলানোর। সে সুযোগ আমি ওদের দেব না। যদি আজ ভাগ্যের চাকা একটু ঘুরে যায়, তবে তো আর এখানে থাকতে হবে না বেশিদিন। তাই খুব সাবধানে ফেলতে হবে পা।
    নির্ধারিত সময়ের আগেই পৌঁছে গেছি লোহার গেটটার সামনে। দারোয়ানকে বলতেই সে আমায় ভেতরে নিয়ে গেল। খানিকটা এবড়ো খেবড়ো জমি পেরিয়ে মূল বাড়িটার ভেতরে ঢুকতেই স্টুডিও। এই প্রথম আমি কোনও ফিল্ম স্টুডিওর ভেতরে ঢুকলাম। খুব উঁচু সীলিং , একটু দূরেই একটা সেট। সম্ভবত শুটিং শুরু হবে। অভিনেতা অভিনেত্রীদের দেখা যাচ্ছে না, যারা ঘোরাঘুরি করছে সবই টেকনিশিয়ান মনে হয়, বা হেল্পার। গঙ্গাজলের বর আমায় আগেই দেখতে পেয়েছে, সে গটগটিয়ে এগিয়ে এলো সোজা আমার সামনে। হ্যান্ডসাম লোক, ঝট করে রিস্টওয়াচটা দেখে নিয়ে বলল, আপনার বন্ধু বলেছে আমাকে আপনার কথা।
    আমি চুপ করে রয়েছি। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে বললাম, হ্যাঁ মানে আমরা কিশোর ইয়ে ছোটোবেলা একসঙ্গে কাজ করেছি টিভিতে। তারপর...
    সে আর একবার ঘড়ি দেখল। কী একটা যেন ভাবছে। আমার কথা অদৌ শুনছে কিনা বোঝা সম্ভব নয়। আমি বলতে থাকি, তারপরে মধ্যিখানে কিছুটা সময় অভিনয় করবার সুযোগ ছিল না, তবে এমনিতে কলেজের অনুষ্ঠানে কম্পিটিশানে অংশ নিয়েছি, প্রাইজ টাইজও―
    ভদ্রলোক দূরে কাকে যেন ইশারা করে ডাকল, আমার কি একা একা কথা বলে যাওয়াটা ঠিক হচ্ছে? আবার বললাম, চার পাঁচমাস আগে একটু মডেলিংও করেছি।
    ― মডেলিং? কোথায়?
    ― একটা ক্লাবে। হিন্দুস্থান ক্লাব।
    দূরের লোকটা কাছে এসে গেছে, তার হাতে কিছু খাবারের প্যাকেট, গঙ্গাজলের বর তাকে হাতের ইশারায় ভেতরে কোথাও একটা যেতে বলে দিল। লোকটা চলে যাচ্ছে, গঙ্গাজলের বর আর একবার রিস্ট ওয়াচ দেখে নিয়ে বলল, ঠিক আছে, আমার জানা রইল, দরকার হলে খবর দেব আপনাকে।
    গেট দিয়ে বেরিয়ে যাবার সময় খেয়াল করলাম এই স্টুডিওতে ঢোকা থেকে বের হবার ভেতরে তিন মিনিট কেটেছে বড়জোর। তবে কি এটাই আমার ইন্টারভিউ ছিল? এত শর্ট? আগে যখন টিভিতে কাজ করেছি, কমপক্ষে পনের মিনিট তো কেটেই যেত টেস্ট দিতে। ভদ্রলোক কীরকম আলগা আলগা মত। কাজে নিক বা না নিক, একটু কথা টথা বলা... কী জানি নাম করা ডিরেক্টর তো, আড় চোখে দেখে নিয়েই বুঝে গেছে যে আমায় দিয়ে টিভি সিরিয়ালের অভিনয় হবে না। 
     
    (চলবে)
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:5195:1112:5618:e0b3 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৭:৫৪735642
  • ছয়

    হবে না তো হবে না, কত কিছুই তো হয় নি, হবে না। ওসব ভেবে কোনও লাভ নেই। তবে বাল্যবন্ধুকে জানিয়ে দেব যে গেছলাম। বলব, তোর বর তো খুব লাজুক লোক রে। আমার দিকে সোজাসুজি তাকালই না।
    ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছে, শাড়ি ভিজছে জলে এবং কাদায় মাখামাখি হচ্ছে পায়ের দিকটা। আবার নতুন করে ভাবতে হবে। তবে পুরোপুরি জলে আমি পড়ে যাই নি, একটা চাকরি এখনও আছে। অফিসে ফিরে এসে দেখি লাঞ্চটাইম সবে শুরু হয়েছে। ড্রাইভারেরা গাড়িতে সায়েবদের নিয়ে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। সাশা পোর্টিকোতে সিঁড়ির একদম নীচের ধাপে দাঁড়িয়ে, ওখানে বৃষ্টির ছাঁট নেই। তার হাতে এক তাড়া নোটের বাণ্ডিল। আমি সিঁড়িতে উঠতে যেতেই সে আমাকে ডাকল। হাতে ধরিয়ে দিল দেড়শো টাকা, তার হাতে একটা খাতাও রয়েছে, বলল এইখানে সই করো।
    ― হঠাৎ টাকা কীসের?
    ― স্বাধীনতা দিবসের।
    ― তার মানে?
    ― পরশু তোমাদের স্বাধীনতা দিবস না? তাই কোম্পানী থেকে এই টাকা দিচ্ছে।
    এই প্রথম শুনলাম, স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে টাকা পাওয়া যায়। সব দারোয়ান ড্রাইভার মালি সুইপার রিসেপশনিস্ট সেক্রেটারি, মানে যাদের চাকরি মিঠুবাবু নামক ঠিকাদারের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, তারা সবাই ভারতের নাগরিক। এদেরকে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে দেড়শো টাকা করে বকশিস দেওয়া হচ্ছে। আমিও বকশিস পেলাম। শুধু এই টাকাই নয়, আরো বাহাত্তর টাকা বকেয়া পাওনা ছিল তোয়ালে বাবদ, সেটাও দিয়ে দিল। এখনই আনন্দের চোটে এগুলো খরচ করে ফেলা ঠিক হবে না। যে কজন ড্রাইভার তখনও গাড়ি নিয়ে বের হয় নি তারা খুব হাসছে টাকা পেয়ে। 
    সুরঞ্জনা বলল, দেখেছিস ওদের আনন্দ? এই টাকা পরশু অবধি থাকবে নাকি, আজই যাবে সব মদ কিনতে।
    ― ঠিক বলেছিস, এরা জানে অল্প মাইনে দিয়েও কেমন করে হাতে রাখতে হয় এমপ্লয়িদের। বকশিস। অল্প কটা টাকা। বোনাস নয়। কিন্তু মানুষকে খুশি করে দেয় নিমেষে।
     
    (চলবে)
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:5195:1112:5618:e0b3 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৭:৫৬735643
  • অষ্টম অধ্যায়

    হায় মাগো জগদম্বা, বিপাকে ফেলিলি,
    ছায়ে পোয়ে সর্বনাশ, প্রাণে ধনে নিলি
    কি করি উপায় মাগো কি করি উপায়
    জগদম্বা! এই তোর মনে ছিল হায়!

    ― ঠাকুমার ঝুলি, দক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজুমদার
     
    সেপ্টেম্বরের এক বিকেলে সাশা ভয়ঙ্কর সব কথাবার্তা বলছিল। পরের দিন বিশ্বকর্মা পুজো, তাই অফিস চলছিল ঢিমে তালে। যদিও এই অফিসে বিশ্বকর্মা পুজো হয় না, কিন্তু ড্রাইভারদের সেদিন ছুটি। শুধু ছুটি নয়, আরও অনেক কিছু। তারা দুশো টাকা করে বকশিস পেল মদ খাবার জন্য, এটা কোম্পানীর তরফ থেকে, তাছাড়া মিঠুবাবুর সেই মোটর গ্যারেজ কোম্পানীর মধ্যেও বিরাট পুজো হয় সেদিন। আমাদের দূর থেকে "এসো কিন্তু" বলে গেছে সে, ড্রাইভারেরাও যাবে, বিরিয়ানি হয় ঐদিন। মদের টাকা আগেই পেয়ে গেছে তারা। বড়ো বড়ো বসেদের জন্য মিঠুবাবুর আলাদা ব্যবস্থা, উঁচুপদের সায়েবরা যাবে মিঠুবাবুর বাড়িতে, একটু সন্ধে করে, ড্রাইভার মিস্তিরি এরা যখন চলে গেছে, তখন। সায়েবদের জন্য থাকে দামি দামি মদ, উচ্চাঙ্গের খাবার দাবার। মদের পেছনেই আসল খরচ। মিঠুবাবু জানে সায়েবদের কেমন করে খুশি রাখতে হয়। তারা সপরিবারে আমন্ত্রিত হয়ে আমোদ আহ্লাদ করে। সুরঞ্জনা ও আমি আমন্ত্রিত হয়েও বিপদে পড়ে গেছি। আমরা ইনভাইটেড, কিন্তু ঠিক অতিথি বলতে যা বোঝায় তা নয়, সম্মানিত অতিথিও নয়। ঐ জোরে হাঁক পেড়ে "এসো কিন্তু" ডাকে সাড়া দিতে আমাদের প্রেস্টিজে লাগে। আমরা ড্রাইভার নই, চাকর বাকর শ্রেণীর লোক নই যে ডাকলেই বিরিয়ানি খেতে ছুটব। আবার আদর যত্ন করে এসোরে বসোরে করে কেউ আমাদের ডাকবে না। যেতে হলে ঐ গ্যারেজের বেঞ্চিতেই ড্রাইভারদের পাশে বসে হাতে প্লেট নিয়ে বিরিয়ানি খেতে হবে। আমরা কনফিউজড হয়ে যাই। মিঠুবাবুকে খুব যত্ন করে বলে দিই, যেতে পারলে ভালই লাগত কিন্তু ঠিক ঐ দিনেই সন্ধেবেলা অন্য একটা জায়গায় যাব, আগে থেকে সব প্ল্যান করা আছে। মিঠুবাবুও জোর করে না, আমরা যাই বা না যাই তাতে তার কিছু এসে যায় না।
    নীচে এসব কথাবার্তা বলে ওপরে আমাদের ঘরটায় এসে দেখি সাশাকে ঘিরে রয়েছে কয়েকজন। সে খুব ইন্টারেস্টিং কিছু বলছে। যারা শুনছে, তাদের মধ্যে একজন হচ্ছে সের্গেই। আরও দুজন ওকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে,  আলিওশা এবং ইউরি আন্দ্রেইভিচ। সের্গেই হাত বাড়িয়ে ডেকে নিল আমাকে ওর পাশে। সাশা খুব সিরিয়াস। মুখখানায় এক ফোঁটা হাসি নেই, হাত ফাত নেড়ে যুক্তি সহকারে বুঝিয়ে চলেছে কাস্ট সিস্টেম। এ আমাদের বর্ণাশ্রম প্রথার থিয়োরি নয়, এ সব অন্য কথা, হতে পারে সাশার গুরুপ্রদত্ত বাণী। সাশা বোঝাচ্ছে এক ব্রাহ্মণের ঔরসে শূদ্রনারীর গর্ভে যে সন্তান জন্মায় তাকে কী বলে। কী একটা অদ্ভূত নাম বলল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কে এসব বলেছে তোকে, তোর গুরু?
    ― হ্যাঁ।
    এমনভাবে তাকায় আমার দিকে যেন চোখের দৃষ্টিতে ভষ্ম করে দেবে। আবার জিজ্ঞেস করি, আর শূদ্রের ঔরসে ব্রাহ্মণ নারীর গর্ভে যদি কেউ জন্মায় তাহলে তার জাত কী হবে? তাকে কী বলা হবে সেটা বল।
    এই প্রশ্নটা ওর কমন পড়ে নি। একটু অপ্রতিভ হল। কিছু একটা ওকে বলতেই হবে তা বুঝেছে। আমরা গোল হয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি ওর উত্তরের, এই সময় হঠাৎ কেউ আমার হাতটা ধরেছে। চমকে দেখলাম পাশেই সের্গেই, সেই ধরেছে আমার হাতটা, আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি কিন্তু সে আমার দিকে দেখছে না, তবে হাতটা ছেড়ে দিল।
    সাশা একটু ভেবে নিয়ে ঝট করে রেগে গেল, বলল ওরকম হয় না, কোনও শূদ্র কখনও ব্রাহ্মণ নারীকে ভোগ করতে পারে না। এইটে শুনে ইউরি আন্দ্রেইভিচ বলে উঠলেন, পারে কি পারেনা সেটা নিয়ে পরে কথা হবে, হাইপোথেটিক্যাল সিচুয়েশন ধরে নিয়ে প্রশ্নটার উত্তর দাও, সব অপশন খোলা থাকুক।
    আলিওশা কাস্ট সিস্টেমের টপোলজিটাই জানে না, সে মজা দেখবার জন্য বসে ছিল। তার মাথায় সব কিছু ঢুকছেও না। সাশার উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করে ইউরি আন্দ্রেইভিচ উঠে পড়লেন সেখান থেকে, আমিও সরে যাচ্ছিলাম, ফের আমার হাত ধরে নিয়েছে সের্গেই, আমি ফের তার দিকে তাকাতে বলল ― একটু দাঁড়া না, কী এত কাজ তোর? সাশা কী বলছে শুনি একটু আমরা, তুই ওকে প্রশ্ন কর, আমরা তো এতসব ইন্টারেস্টিং জিনিস আগে শুনিনি।
    সাশা এত জোর দিয়ে এসব কথা বলছিল যে গলার জোরেই ওর কথার সত্যতা প্রমাণ করিয়ে ছাড়বে। আমি যেহেতু জাতিভেদের অস্তিত্বটাকেই অস্বীকার করি, তাই, ও কতটা ঠিক বলছে কতটা বেঠিক বলছে সবটাই আমার কাছে মূল্যহীন। শুধু একটা জিনিস ভাবাচ্ছে, নিজের গাঁটের কড়ি খরচ করে করে নিয়মিত বেনারস গিয়ে গুরুসঙ্গ করে এসব নিকৃষ্ট জিনিস কেন শিখছে ও? ওর নিজের কোনও যুক্তি বুদ্ধি বা ভাল কোনও হবি নেই? এ তো দেখছি ক্রমাগত ঘৃণার কথা বলে চলেছে।
    আমি এঘরে ঢুকবার আগেও ও কিছু কিছু জিনিস বলেছে, যেটার দিকে পয়েন্ট করে আরও জানতে চায় আলিওশা। আলিওশা বলে, তুই যে সেই তন্ত্র সাধনা আর কী যেন একটা নিয়ে বলছিলি, সেটা বল। সাশা খেই ধরে নেয়, বলে ওটা হচ্ছে সিদ্ধিলাভ। এই সিদ্ধিলাভ যারা করতে পারে তারা একজন নারীকে মেরে ফেলতে পারে।
    ― মেরে ফেলতে পারে মানে?
    আমরা তিনজনেই প্রায় সমস্বরে এক কথা জিজ্ঞেস করে ফেলেছি। সাশা প্রাঞ্জল করে বুঝিয়ে দেয়, তন্ত্র সাধনায় নারী সম্ভোগ একটা বড় অংশ, সেই সাধনায় সিদ্ধ হলে সেই তান্ত্রিকের এমন শক্তি হবে যে সে কোনও নারীকে জাস্ট সম্ভোগ করতে করতে মেরে ফেলতে পারে।
    এইটে শুনে সবাই চুপ। ইউরি আন্দ্রেইভিচ দূর থেকে কতটা শুনেছেন জানিনা, কিন্তু এবার চেঁচিয়ে বললেন, সাশা তোমার কথাগুলো ঘরের বাইরে গিয়ে বললে ভাল হয়, আমার কাজে ডিস্টার্ব হচ্ছে।
    এরকম ধমক খাবার পরে এই আলোচনা চলতে পারে না। তবু আলিওশা ফোড়ন কাটল, ওহ্‌ তাই তুই এসব শিখছিস, যাতে খুব ... বাকীটা ও সাশাকে হাতের মূদ্রায় বুঝিয়ে দিল।
    সাশা খচ করে আমার ওপর রেগে গিয়ে ওর আক্রোশ উগরে দিল ― আর তোমার, তোমার তো মরে যাওয়াই ভাল, তুমি শূদ্রের চেয়েও ঘৃণ্য, তেমনি ঘৃণার পাত্র তোমার বাচ্চা। তোমাদের কোনও কাস্ট নেই।
    আলিওশা ওকে জাপটে ধরে ঘর থেকে বের করে নিয়ে গেল, সের্গেই আমার কাছে এসে একটু চুপ করে থেকে স্বগতোক্তি করল, উন্মাদ! তারপরে আমাকে বলল, ওর কথায় কিছু মনে করিস না প্লীজ, ও একটু ফ্যানাটিক আছে, কিন্তু মনটা ভাল, মনটা খুব ভাল।
    এসব বলবার পরও সে চলে যায় না, আমার সীটের কাছে দাঁড়িয়ে আশেপাশে আড়চোখে দেখে নেয়, নীচুস্বরে বলে, সাশা তোকে কিছু বলেছে?
    ―কী?
    ―নাঃ, ঠিক আছে।
    সে চলে যেতে গিয়েও আবার ফিরে আসে। বলে ঝিদকভকে বল, তোর ছুটি পাওনা হয়েছে, দিন তিনেকের ছুটি নিয়ে নে, আমি তাহলে তোর টিকিটও কাটিয়ে রাখব রৌরকেল্লার জন্য।
    সে আর আমার উত্তরের অপেক্ষা করে না। ঘর থেকে চলে যায়। আমি ইউরি আন্দ্রেইভিচের কাছে গিয়ে দাঁড়াই। উনি আসলে তেমন জরুরি কিছুই করছিলেন না। বলি, জানেন ইউরি আন্দ্রেইভিচ, আমি মরে যাব। খুব শিগগির। দেখে নেবেন।
     
    (চলবে)
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:5195:1112:5618:e0b3 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৭:৫৭735644
  • দুই

    ব্রীজের ঠিক মধ্যিখানে ওরা বাস থামায়, কোনও বাসস্টপ নেই তবুও থামায় লোক তুলবার জন্য। ব্রীজের ওপরের ফুটপাথে হাঁটছিলাম। এই সেই ব্রীজ, যে ব্রীজের পাশে ফুটপাথের ওপর আমি বসেছিলাম তিরিশে জানুয়ারী। নীচে তাকালেই পরপর অনেকগুলো রেললাইন, নীচে বালিগঞ্জ স্টেশন। আমি অবশ্য বাস থেকে নামিনি, হেঁটেই ফিরছি অফিস থেকে, খুব বেশি দূরত্ব তো নয়, হয়ত তিন কিলোমিটার হবে কি আরও কম। হাঁটতে গেলে পথ ভোলার উপায় থাকে না। ইদানীং বাসে উঠলেই বরং সব ভুল হয়ে যাচ্ছে। হয় ভুল বাসে উঠছি, নয় কোথায় নামব মনে থাকছে না। জল কাদা বৃষ্টি যা ই থাকুক না কেন চিনে চিনে ঠিক গন্তব্যে পৌঁছে যাব, আমার তো কোনও তাড়া নেই, আমার জন্য কোথাও কেউ অপেক্ষা করে নেই।
    ―আরেঃ আপনি এখানে?
    বাস থেকে নেমে পড়ে একটা লোক আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
    প্রথমে একটু থতমত খেলেও লোকটাকে চিনতে পেরে গেছি, আমার সেই বস্তির বাড়িওয়ালার ছোট ছেলে।
    ― আমি তো এদিকেই থাকি।
    ― এদিকে? আচ্ছা।
    ― হ্যাঁ, ঐ যে ব্রীজের শেষে ঐ যে ঐ বাড়িটা দেখতে পাচ্ছেন, ঐটা নয়, ওর পেছনে, আসুন না আমার বাড়ি।
    আমি ডেকে নিই তাকে। লোকটা আসলে কী একটা কাজ সেরে বাড়ি ফিরছিল, বাসের ভেতর থেকে আমায় দেখতে পেয়ে হুড়মুড়িয়ে নেমে পড়েছে।
    ― বাহ, এতো ফার্স্ট ক্লাস জায়গা। আমাদের ওখানে থাকতে আপনার তো খুব কষ্ট হয়েছে তাই না? জলের কষ্ট, বাথরুমের কষ্ট... আমরা জানি, আমরা বুঝতে পারতাম।
    লোকটা আমার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটে। তাকে জিজ্ঞেস করি বাকি ভাড়াটেদের খবর।
    ― ওরে বাবা, জানেন না তো কত কী হয়ে গেছে এর মধ্যে। আপনার পাশের ঘরে যে লোকটা থাকত না রোগা করে একটা বৌ নিয়ে…
    ― হ্যাঁ সেই কালো করে বৌটা তো?
    ― হ্যাঁ হ্যাঁ তারাই, ভাড়া ফাড়া দেয় না। নোটিস দিয়েছি, ভাড়া এবারেও না দিলে রাস্তা দেখে নেবে। আর আপনার সামনের ঘরে যে ফ্যামিলিটা ছিল ―
    ― সেই ছোট একটা বাচ্চা নিয়ে স্বামী স্ত্রী তো?
    ― আমরাও সেরকমই জানতাম। ঐ ঘরটাও খালি এখন। প্রথমে তো বুঝি নি মেয়েটা বিয়ে করা বৌ নয় ও লোকটার। শুনুন, লোকটা হচ্ছে পুরো দুনম্বরি। ঐ মেয়েটাকে তার শ্বশুরবাড়ি থেকে ফুঁসলে বের করে এনেছে, ঠিক আছে? বাচ্চাটা ঐ বৌটার নিজের। বৌটার নিজের টাকাও ছিল, আশি পঁচাশি হাজার টাকা। সেই টাকা সব ঐ লোকটার হাতে তুলে দিয়েছে। আমাদের এখানে এসে ধরুন বছর খানেক তো ছিলই, বেশিই হবে।
    ― ছিল মানে, উঠে গেছে?
    ― আরে শুনুনই না। কেলেংকারি কাণ্ড। আপনার মনে আছে কিনা জানি না, লোকটা একদিন হোলনাইট ঘরে ফেরে নি।
    ― আলবাৎ মনে আছে আপনি গিয়েছিলেন তার অফিসে খোঁজ করতে।
    ― আমি গেছলাম। সেই লার্সেন অ্যান্ড টুব্রোর অফিস। বাইকের ক লিটার তেল পুড়িয়ে লোকের উপকার করতে গেছলাম। গিয়ে কী জানলাম বিশ্বাস করবেন? ঐ নামে কেউ কাজ করে না ঐ অফিসে। সেই রাত্রে অফিসে এক দুজন লোক ছিল, আমি গেট থেকেই সব খোঁজ খবর নিয়ে তাজ্জব বনে গেছি। তখনই বুঝে গেছি লোকটা ফ্রড। বাড়ি ফিরে তাই কিছু বলিনি। আমার মা কে বললে তো তক্ষুনি চেঁচামিচি শুরু করে দিত, তাই চুপ ছিলাম। কিন্তু সাবধান হয়ে গেছলাম।
     
    (চলবে)
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:5195:1112:5618:e0b3 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৭:৫৯735645
  • তিন

    কথায় কথায় আমরা বাড়ির দরজায় পৌঁছে গেছি। তাকে ভেতরে নিয়ে যাই, সিঁড়ি বেয়ে টপ ফ্লোরে, পাঁচতলায়। এই প্রথম আমার অতিথি সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফেরা। আমার মেয়ে তাকে দেখেই চিনে ফেলে, সেও আমার মেয়েকে দেখে হেসে বলে ― বাবা এই কটা দিনের মধ্যে কত বড়ো হয়ে গেছে। চায়ের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে সে আমায় গল্পের বাকি অংশটা শোনায়। সেই ফ্রড লোকটা মেয়েটির থেকে পঁচাশি হাজার টাকা নিয়ে তাকে বাচ্চাসহ এনে তুলল এই বস্তিতে। লুকিয়ে থাকার জন্য ওটাই সুবিধেজনক জায়গা। মেয়েটির শ্বশুরবাড়ি ঠাকুরপুকুরে, বাপের বাড়ি জোকা। তারা তো সমানে খুঁজে চলেছে এদেরকে। ব্যাঙ্ক থেকে পুরো টাকা তুলে নিয়েছিল মেয়েটি যাতে কেউ ওদের গতিবিধি ট্র্যাক করতে না পারে। লোকটা মেয়েটিকে বুঝিয়েছিল সে ভাল চাকরি করে, কিন্তু গা ঢাকা দেবার জন্যই থাকতে হচ্ছে বস্তিতে। পরিস্থিতি আয়ত্ত্বে এলেই সে মেয়েটিকে নিয়ে অপেক্ষাকৃত ভাল জায়গায় চলে যাবে। লোকটা রোজ সকালে অফিসে যাবার নাম করে বেরিয়ে যায়, মেয়েটির পয়সাতেই একটা বাইক কিনেছে, মোটামুটি টাকা দেয় সংসার খরচার জন্য। এদিকে নিজে কোনও চাকরি বাকরি কি বিজনেস কিছুই করে না। এমনিতেই সকলে লক্ষ্য করেছিল যে ছোট্ট বাচ্চাটার প্রতি লোকটার টান জিনিসটা নেই। বাচ্চাটার অসুখ করলে ওষুধ আনতে যায় না, ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যেতে চায় না। বেবিফুড ফুরিয়ে গেলে কিনে আনতে ভুলে যায়। এই নিয়ে নিয়মিত খিটির মিটির লেগেই থাকত। প্রথম দিকে প্রায় রোজই মাংস রান্না হতো, তার পরে কেবল ডিমের ডালনা। বৌটাতো এমনিতেই ঘরের বাইরে সেরকম বের হত না, সেটা চেনাশোনা কেউ দেখে ফেললে ধরা পড়ে যাবার ভয়ে। এক বছরের মত সময় ঐ ঘরে তারা ছিল, বৌটাকে এক বারও বাইরে বের হতে দেখা যায় নি, সিনেমা পর্যন্ত নিয়ে যেত না। ওদিকে কত কম পয়সা রোজগার করত কালো বৌয়ের বাংলাদেশি বর, তারা কিন্তু নিয়ম করে মাসে একটা সিনেমা দেখবেই নাইট শোতে। এমনকি সেই রাত্রের ঘটনার পরে বাড়িওয়ালার ছেলে একদিন লোকটাকে ফলো করে। ফলো করে সে যা জানতে পারে তা হল লোকটা পাকা জুয়াড়ি। কলকাতা শহরে জুয়ার ঠেকের কমতি নেই, সেসব জায়গাতেই এর নিয়মিত আসা যাওয়া। কখনও জেতে কখনও হারে, হারেই বেশি। পকেট ফাঁকা হয়ে গেলে বৌকে এসে বলবে এমাসে মাইনে পেতে দেরি হচ্ছে, বৌটার এসব বিশ্বাস না করে উপায়ও নেই। পুরো খরচই চলছিল বৌটার দেওয়া সেই পঁচাশি হাজার টাকা ভাঙিয়ে ভাঙিয়ে। এইজন্যই বৌটার মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে থাকত, লোকটা কিন্তু মেজাজ খুব বেশি খারাপ করত না, কন্ট্রোলে রাখত, যাতে রাগের মাথায় আসল কথাগুলো বেরিয়ে না পড়ে। যে রাতে সে ফেরেনি, সে রাতে তাকে জুয়ার ঠেকে বন্দি করে রাখা হয়েছিল হেরে যাওয়া টাকা মিটিয়ে দেবার জন্য। সে কীভাবে সেটা ম্যানেজ করেছিল জানা নেই, তবে ম্যানেজ নিশ্চয় করেছিল কোনওভাবে, নইলে ওসব জায়গা থেকে এমনি এমনি বেরিয়ে আসা যায় না। আমি ঐ বস্তি থেকে চলে আসবার পরে লোকটার ঘনঘন রাতে ফেরা বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। তারপরে একবার নাকি টানা দুদিন ফেরে নি। বস্তির লোকেরা খবর দিতে চেয়েছিল পুলিশে, বা হাসপাতালে খোঁজ নিতে চেয়েছিল। বৌটা বাধা দেয়। তার ভয় ছিল তাদের সম্পর্কের ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেলে অনর্থ হবে। বস্তির লোকেরা তো আসল ব্যাপার কিছুই জানত না, যেমন তারা আমার ব্যাপারেও কিছুই জানত না, হয়ত ভাবত পয়সাকড়ির বিপাকে পড়ে বস্তিতে এসে থাকছি আমি। এর বেশি এরা আমার সম্পর্কেও জানতে পারে নি। আমি যেমন ভয় পেয়েছি, ঐ বৌটাও তেমনি এক বছরের মত সময় ভয়কে নিত্যসঙ্গী করে বেঁচেছে। সমস্তটাই ছিল সাজানো নাটক। আমারটাও ছিল সাজানো, আমারটাও ছিল নাটক। এই সব নাটকের জন্য কোনও স্ক্রীপ্ট, রিহার্সাল, ডিরেক্টর ফিরেক্টর কিস্যু লাগে না। জীবন আমাদের শিখিয়ে দেয় সব।
    শেষের দিকে বৌটার চেঁচামেচিতে টুকরো টুকরো যে সব কথা ওদের কানে ভেসে আসছিল তাতে ও পাড়ার সবার মনেই সন্দেহ ঢুকতে থাকে। অবশেষে একদিন সেই লোক আর ফিরলই না। বৌটা কাঁদে নি। চার পাঁচ দিন পরে কোনও খাবার ছিল না ঘরে। গয়নাগাটিও সব আগেই বেচে দেওয়া হয়ে গেছে। বৌটা তখন সব খুলে বলে। শ্বশুরবাড়িতেতো ওকে ফেরৎ নেয়ার প্রশ্নই ওঠে না, বাপের বাড়িতে খবর দেওয়া হয়েছিল যদি ভায়েরা কেউ এসে নিয়ে যায় তাকে। ভায়েরা রাজি হয় নি বোনকে ফেরৎ নিতে। একদিন দুপুরে সকলে ঘুমোচ্ছিল যখন, মেয়েটি চলে গেছে কোথায় বাচ্চা কোলে করে। জিনিসপত্র তেমন কিছু ছিল না, তবু যেটুকু ছিল সবই পড়ে রইল। একটা আলমারি, চৌকি, কিছু বাসন, স্টোভ, আলনা। এসব নেওয়া যায় না সঙ্গে। তা ও প্রায় মাস খানেক হতে চলল। বাড়িওয়ালা আর ভাড়া দেবে না ঘর, বাকি লোকেদের চলে যেতে বলবে, সাড়ে পাঁচ কাঠা জমির ওপর এই সব ঘর টর। বাড়িওয়ালার ছোটো ছেলে চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বলে, আমাদের এরিয়ায় জমির দাম হুহু করে বাড়ছে, দেখি কী করা যায়।
     
     
    (চলবে)
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:5195:1112:5618:e0b3 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৮:০০735646
  • চার

    বিশ্বকর্মা পুজোর হৈহট্টগোল আর পার্টির পরেই শোনা গেল মিঠুবাবু এবছরও কার র‌্যালিতে অংশ নেবে। কার র‌্যালি জিনিসটা কী আমি ভাল বুঝি না। একটা দেখেছি টিভিতে ফর্মূলা ওয়ান রেসিং, আর অন্য একটা দেখতাম ছোটবেলায় রেড রোডের দিকটায় হত ভিন্টেজ কার র‌্যালি, পুরোনো সব গাড়িতে পুরোনো যুগের মত পোশাক টোশাক পরে মেয়েপুরুষ গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যেত, পরের দিন স্টেটসম্যানে তাদের ফোটো ছেপে বের হত।
    মিঠুবাবুর কার র‌্যালি এদুটোর একটাও নয়। সাধারণ একটা গাড়ি কোনও নির্দিষ্ট কোনও একটা পথে সবচেয়ে তাড়াতাড়ি যে চালাতে পারবে, সে ই জয়ী। গত দুতিন বছর ধরে, মিঠুবাবু অপ্রতিদ্বন্দ্বী, অজেয়। ইংরিজি ইনি জানুন বা না জানুন, গাড়িটা খুব ভালো চালাতে জানেন। এসব খবর হাওয়ায় রটে যায়। সেদিন সকালে অফিসে ঢুকবার সময়ই বহুদিন পরে পার্থবাবুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। আমার বিরুদ্ধে ওঁর অনেক অভিযোগ। আমি নাকি বাড়ি বদলের পর পুরো পাল্টে গিয়েছি, ওঁকে পাত্তাই দিই না। আগে কত গল্প টল্প করতাম সব বাদ দিয়ে দিয়েছি। আমার নাকি পদোন্নতি হয়েছে।
    যত বলি যে পদোন্নতি হয় নি, বড়োসায়েবের বৌয়ের প্রসবের কারনে ঐ ঘরে টেম্পোরারিলি বসতে হচ্ছিল। এই কথার উত্তরে পার্থবাবুও আদিরস ঘেঁষে একটা রগড় করতে যাচ্ছিলেন, শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, আপনার মুখটা এত শুকনো দেখাচ্ছে কেন বলুন তো? শরীর টরির খারাপ নাকি?
    ― নাহ, কিছু টের পাই না তো।
    উনি একটু থেমে রিসেন্টলি ঘটে যাওয়া বিশ্বকর্মা পুজোর পার্টির ব্যাপারে আমি কিছু জানি কিনা জানতে চান। ―আমি যাই নি মিঠুবাবুর বাড়ি। তবে শুনেছি পার্টি ভালই হয়েছে।
    উনি রেশ টেনে বলেন, আমিও তাই শুনেছি খুব মোচ্ছব হয়েছে, এখান থেকে দুজন হেল্পারকে নিয়ে গেছল তো কাজ করাতে। সন্ধে আটটার পরে নাকি সব মদ খেয়ে আউট। টেনে টেনে ধরে ধরে গাড়িতে তুলে সবকটাকে আলিপুর রোডে পৌঁছে দিয়ে আসতে হয়েছে। তবে আপনাদের একজন সায়েব মদটা কম খায়, সে ই শেষ পর্যন্ত নিজের পায়ে ভর করে দোতলা থেকে একতলায় নেমেছে।
    ― কে বলুন তো? সাশা?
    পার্থবাবু সাশাকে চিনতে পারেন না ভালো করে, তখন বোঝাতে যাই, ঐ যে ছেলেটা বাংলা জানে।
    ― না, না ও নয়। ও তো যায় ই নি। ওকে ডাকেনি ঐ পার্টিতে। ও যায় নি, আপনাদের ঐ বুড়ো সায়েবও যায় নি। গেছে বড়ো মেজ সেজ অ্যাকাউন্টেন্ট আর আপনার ঐ, হ্যাঁ মনে পড়েছে, সের্গেই। ঐ লোকটাই বুঝেশুনে লিমিট রেখে মদটা খায়, হ্যাঁ সের্গেই।
    আমি ইতস্তত করি। পার্থবাবুর সঙ্গে আগে কত খোলাখুলি আলোচনা করা যেত, মাঝখানের এই কটা দিনের ব্যবধানে কত কিছু ভুলে যাচ্ছি, কত কী ঘটে গেছে। বললাম, আচ্ছা আপনি একটা কথা বলুন তো, সের্গেই লোকটা কি ভালো?
    ― ভালো বলতে?
    ― মানে, কী বলব আপনাকে, লোকটা আমাকে ক্রমাগত বিরক্ত করে চলেছে।
    ― আপনি ঠিক বলছেন তো? বিরক্ত করছে মানে, বুঝতে পারছি... গায়ে হাত টাত দেয় নি তো?
    ― না। আপনি বলুন না, লোকটা কেমন প্রকৃতির কিছু জানেন?
    ― ও আপনাকে বিরক্ত করবে কেন সেটাই বুঝতে পারছি না। এত সুন্দরী বৌ রয়েছে সঙ্গে, কী জানি..., দেখে তো দিব্যি হ্যাপিলি ম্যারেড মনে হয়। সুন্দর একটা বাচ্চা ছেলেও আছে দেখেছি, মাঝে মাঝে আসে তো এখানে। আপনি হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর যে লোকটা বদ?
    ― টু হান্ড্রেড পার্সেন্ট।
    ― বলেন কী! আরে যাচ্ছেন কোথায়, বসুন, বসুন।
    ― পরে একদিন বলব আপনাকে সব।
    পার্থবাবু হতাশ হলেও আমার তখন সময় নেই। সায়েবদের নিয়ে গাড়ি চলে এলো বলে। অবশ্য ওপরে খুব বেশি কাজ এখন নেই। আর সেই কাজ না থাকাটাই ভয়ের হয়ে ওঠে। কাজ না থাকলে সেটা সের্গেই জেনে যাবেই, তখনই চেষ্টা করবে কোনওভাবে আমাকে রাজি করাতে, রৌরকেল্লায় সঙ্গে করে নিয়ে যাবার জন্য।
    আমি গঙ্গাজলকে ফোন করতে ভুলেই গেছলাম এতদিন। ওর বরের সঙ্গে দেখা করবার পর ওকে খবরই দেওয়া হয় নি, একদিন ফোন করেছিলাম, ফোন বেজেই গেছল একটানা।
    আজ একবার চেষ্টা করতেই ওকে পাওয়া গেল। খুব ব্যস্ত, কোথায় যেন একটা বের হবে, ছেলেকে ইস্কুলে পৌঁছে দিয়ে একটুক্ষণের জন্য বাড়ি ফিরেছে। কথা যেন বলতেই চায় না। তবু আমি জোর করে বলি। ওর সঙ্গে আমার ভদ্রতা করে কথা বলবার সম্পর্ক নয়, সেই চোদ্দ পনর বছর বয়স থেকে আমরা বন্ধু। জীবনের প্রথম প্রেমগুলোর বর্ণনা আমরা একে অপরকে বিনা দ্বিধায় জানিয়েছি, একে অপরের কথা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনেছি, গায়ে পড়ে উপদেশ দিয়েছি। মাঝের এই কটা বছরের ব্যবধান আমাদের মধ্যিখানে ভদ্রতার পর্দা টাঙিয়ে দিতে পারেনা। বললাম খুলে যে ওর বরের আচরণ অদ্ভূত লেগেছে , বেশ রূঢ়ই লেগেছে । ও যেন প্রস্তুতই ছিল এটার জন্য। বলল, আমিও ওর সব কিছু আজকাল বুঝতে পারি না।
    ― বাহ, এরকম করে বললে কী করে হবে?
    ― আর কিছু হবে না রে। আমি অন্য ব্যবস্থা দেখছি এখন।
    আমি একটু চুপ করে যাই। ও কী অন্য ব্যবস্থা দেখবে আমার জন্য, আমি জানি না। দুম করে বলে বসলাম, জানিস তো আমাদের এখানে একটা লোক, মহা বদ, পেছনে পড়ে রয়েছে কবে শোবে সেই আশায়। খালি রৌরকেল্লা যেতে বলে।
    ― কেন রৌরকেল্লা কেন? কী আছে সেখানে, খুব রোম্যান্টিক জায়গা নাকি? একটা ভাল কোনও জায়গা সাজেস্ট করে দে লোকটাকে।
    ― ঠাট্টা নয় রে গঙ্গাজল।
    ― তোর প্রেমে ট্রেমে পড়ল নাকি। খুব সাবধান। আমি ভুক্তভোগী, তুই নিজেও কম ভুক্তভোগী নোস।
    ― লোকটা ম্যারেড। যাকে বলে হ্যাপিলি ম্যারেড। একটা ছেলে আছে, কিন্তু বদমাইসি ষোলো আনা, আমাকে ব্রা-প্যান্টির সেট প্রেজেন্ট করেছে, সেন্ট মাখতে বলে পাঠিয়েছে একজনের মারফৎ।
    ― ওহ। আমি এই কেস বুঝে গেছি। হয় কাটিয়ে দে, নয় রাজি হয়ে যা। এক্ষেত্রে কাটিয়ে তুই দিতে পারবি না, লোকটার হাতে পাওয়ার আছে, সেই পাওয়ার খাটিয়ে ও তোকে চাকরি থেকে তাড়িয়ে দিতে পারে।
    ― পারে।
    ― তুই রাজি হয়ে যা। তবে বোকামি করিস না। এই সম্পর্কের মধ্যে যখন প্রেম ভালোবাসাটাসা বলে কিছু নেই… নাকি আছে? সে যাকগে, যদি না থেকে থাকে তবে ভুলেও মন নরম করবি না। টাকা চাইবি পারিশ্রমিক, প্রেজেন্ট নিবি।
    ― টাকা? প্রেজেন্ট? মানে?
    ― ন্যাকামি করিস না, বলবি তুই ঘন্টায় তিন হাজার টাকা নিস, এবং ভালো রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ বা ডিনার। দরকার হলে গিফট চাইবি, ভালো ভালো ড্রেস কি দামি ভ্যানিটি ব্যাগ, জুতো।
    ― তুই এসব কী বলছিস রে?
    আমি স্তম্ভিত হয়ে গেছি।
    ― আবার ন্যাকামো? তুই কি ধোওয়া তুলসী পাতা মনে করিস নাকি নিজেকে? শোন, তোকে অন্য জায়গায় চাকরির জন্য পাঠাতে পারতাম আমি, কিন্তু সেই লোকটাও একটা বিশুদ্ধ শুয়োরের বাচ্চা। তোকে চাকরি পাইয়ে দেবার জন্য আমার আর লোকটার সঙ্গে শুতে ইচ্ছে করছে না।
    ― তুই এসব কী বলছিস আমায় মাথায় ঢুকছে না রে।
    ― টেনে এক থাপ্পড় মারব। বাচ্চার মা হয়ে গেছ, আর ভাব দেখাচ্ছ যেন কিছুই জানো না। লোকে কি এমনি এমনি কিছু দেয়? দেয় না। যে লোকটা তোর সঙ্গে যেতে চাচ্ছে তার যেমন স্বার্থ আছে, তোরও থাকবে। ওর কাছ থেকে তুই টাকা, গিফট এসব ছাড়া কিছুই পাবি না। সম্পর্ক টম্পর্ক সব ভুলে যা। ভালোবেসে বিয়ে করেই স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক টেঁকে না। আমাকে দেখছিস না? তোর নিজের জীবনে কম ভুগেছিস? আর যেসব মেয়েরা বিবাহিত পুরুষদের ডিভোর্স করিয়ে নিজেরা বিয়ে করে, তুই বা আমি, আমরা সেরকম না। আমরা সেই জাতের না। শোন, আমার আর সময় নেই তোর সঙ্গে ফোনে গল্প করবার। আমি একটা ফ্ল্যাট খুঁজছি, বেরতে হবে।
    গঙ্গাজল ফোন কেটে দেয়। আমি থম মেরে বসে আছি। অফিসের কাজকর্ম সব শুরু হয়ে গেছে। গঙ্গাজলের প্রত্যেকটা কথা মাথার মধ্যে ধাক্কা খাচ্ছে। আসলে ও আমাকে অনেক কিছু বলেছে আজ। সব কিছু সরাসরি বলেনি, কতকটা ধাঁধার মত লাগছে। তবে সব ধাঁধা সল্ভ করবার মত অবস্থায় এখন নেই আমি।
    সব কিছুই একটা অপশনের দিকে নিয়ে চলেছে আমায়। তাড়া নেই, যাব।
     
    (চলবে)
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:5195:1112:5618:e0b3 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৮:০১735647
  • পাঁচ

    এর পর থেকে ঘোরের মধ্যে কাটছিল দিনগুলো আমার। কেমন একটা আচ্ছন্ন হয়ে থাকার মত। সেই ঘোরের মধ্যেই বুঝে নিয়েছিলাম আমার গন্তব্য মৃত্যু। সেই গন্তব্য আসছে, খুব বেশি দূরে নেই, কেবল পথটা আমায় জেনে নিতে হবে, সহজ পথ। খুব ক্লান্ত হয়ে গেছি তো, বেশি ঘুরপথে যেতে পারব না, কষ্টকর যন্ত্রণাদায়ক পথে যাবার শক্তি নেই। সেই ঘোর লাগা অবস্থাতেই মাঝে মাঝে ভেবে দেখি, কারও ক্ষতি হবে না তো আমি মরে গেলে? কোনও টান বা মায়া আছে কি এই পৃথিবীতে আমার? কোনও কিছুর জন্য আফশোস? সব ব্ল্যাঙ্ক। কিছুই নেই। এমনি ভাবতে ভাবতেই দিন কেটে যায়, সপ্তাহ। কারা যেন বলাবলি করছে পুজো আসছে, অক্টোবর মাস পড়ে গেছে। পুজো মানে উৎসব। উৎসব মানে ছুটি, আনন্দ। সেসব দিন খুব ভয়ঙ্কর। লোকে ভিড় করে পুজোর জন্য নতুন শাড়ি জামা জুতো কিনছে। কতরকমের আলোচনা সেই নিয়ে, দাম, ফ্যাশন, রং, বেড়ানোর প্ল্যান, সব আবছা আবছা কানে আসে। আমি ইনভলভড হতে পারি না সেসবে।
    কার র‌্যালী হয়েছিল খড়গপুরের দিকে কোথায় একটা যেন। দল বেঁধে আমন্ত্রিত ছিল উঁচুপদের সায়েবেরা। কানে যেসব কথা ভেসে এসেছিল তাতে মনে হয়েছিল এই র‌্যালীটা দিনের বেলায় নয়, রাতের বেলায় হয়েছে। কিন্তু মিঠুবাবুকে যখন দেখলাম তার পরে, সে এক অদ্ভূত ব্যাপার। থমথমে চেহারা মিঠুবাবুর, হুট করে দেখলে যেচে কথা বলতে সঙ্কোচ হয়, দেখে মনে হচ্ছে যেন কোনো নিকট আত্মীয় বা বন্ধুবিয়োগের দুঃখের ছাপ মুখে। সে তো আমাদের ঘরে রোজ রোজ আসে না, এলেও আমার সঙ্গে সরাসরি কথা বলবার ব্যাপার নেই। সে যে আমার সরাসরি মনিব সে ব্যাপারে আমরা উভয় পক্ষই বেশ সচেতন। তাই অন্যরা যেভাবে মাই-ডিয়ার ভঙ্গীতে তার সঙ্গে আলাপ জমায় সেটা আমায় মানাবে না। ইচ্ছে করেই দূরত্ব বজায় রাখি। হয়ত কখনও এই ঘরেই জটলা করে আড্ডা হচ্ছে মিঠুবাবুকে নিয়ে, তখন দূর থেকে অংশগ্রহন করলাম, এই রকম আর কি। নয়ত মাসের শেষে তো ওপরতলার খুপরি ঘরে ডাক পড়েই রেভিনিউ স্ট্যাম্পের ওপর সই করে ক্যাশ টাকায় মাইনে নেবার টাইমে। দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করে মনে হল কেউ মারা গেছে তার, নিকটজন কেউ হবে। এরকম মুখ না হলেও, এর কাছাকাছি দুঃখী দুঃখী মুখ করে সেপ্টেম্বরেও ঘুরে বেড়াতে দেখেছি, তখন নিজে থেকেই সবাইকে বলে দিচ্ছিল ― কুকুরটাকে ঘুম পাড়িয়ে দিলাম।
    "ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া" ব্যাপারটার অর্থ প্রথমে বুঝি নি। ওদের অনেকদিনের পোষা কুকুর, খুবই ভালো জাতের কুকুর অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, পশু চিকিৎসক জবাব দিয়ে দেবার পরে তাকে বাঁচিয়ে রাখার ঝামেলায় না গিয়ে ইউথেনাইজ করা হয়েছে। কুকুরকে তো জিজ্ঞেস করা হয় না, তুমি অসুস্থ শরীর নিয়ে আরও কিছু সময় বেঁচে থাকতে চাও কি চাও না। তার মালিকই তার হয়ে এসব সিদ্ধান্ত নেয়। মিঠুবাবুরাও তাই করেছে। মিঠুবাবু বারবার বলছিল "বড্ড কষ্ট পাচ্ছিল কুকুরটা, উঠে দাঁড়াতে পারত না, চোখে দেখা যায় না সেই কষ্ট"। এই কথাগুলো শুনে আমার মনে হতো, কুকুরটাকে মৃত্যুর ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেবার পর, সে যেন নিজেকে এই কথাগুলো বলে নিজের বিবেককে বুঝ দিচ্ছে ― ওকে তো আমি ওর ভালোর জন্যই মেরে ফেলেছি। 
    কুকুরটা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, দাঁড়াতে কষ্ট হতো তার। হয়ত ওভাবেই ধুঁকতে ধুঁকতে আরও মাস তিন চার, কি বছর দেড় দুই বেঁচে নিতে পারত। তবে কুকুরের মনিবের পক্ষে সেই কুকুরের দেখ ভাল করার ঝামেলা বওয়া সম্ভব হয় না। টগবগে কুকুর যে কিনা দু বেলা বল নিয়ে খেলত, যাকে পার্কে ঘোরাতে নিয়ে গেলে অন্য কুকুর-মালিকদের ঈর্ষা হয়, সেই কুকুর মাসের পর মাস অকেজো হয়ে পড়ে থাকলে মেনে নেওয়া যায় না। তাকে তার কষ্ট থেকে মুক্তি পাওয়ানোর জন্য মালিককেই ব্যবস্থা করতে হয় ইউথেনেশিয়ার।
    এরকম মৃত্যুর পরে অবধারিত ভাবে একটা বাক্য কেউ না কেউ বলবেই ― কুকুরই মানুষের বেস্ট ফ্রেন্ড। যারা শুনবে তারা মাথা নেড়ে সায় দেবে। বেস্ট ফ্রেন্ডের দুরারোগ্য ব্যাধিতে ঘুম পাড়ানোই সুবিধেজনক পন্থা। এর কিছুদিন পরে বন্ধু বিয়োগের দুঃখ কমে গেল, ঘরে নতুন বন্ধু, নতুন বেস্ট ফ্রেন্ড আনা হল। সে কুকুরতো শুনেছি একেবারে বাচ্চা, সেও খুব ভালো পেডিগ্রি, তার কিছু হয়ে গেল নাকি হুট করে? গায়ে পড়ে তো এসব জিজ্ঞেস করা যায় না। উৎসাহ কৌতুহল এসবও দিনকে দিন কমে কমে আসছে। হয়ত অনেকক্ষণ চুপ করে বসে আছি, কী ভাবছি নিজেই জানি না। আগে সর্বক্ষণ মাথার মধ্যে এটা ওটা সেটা কত চিন্তা ঘুরত, এর পরে কী করব, এটা না হলে আর কী করা যেতে পারে... এখন কত কী ভুলে যাই।
    গতমাসে প্রায় জোর করেই ড্রাইভিং এর ক্লাসে নাম লিখিয়েছি। চন্দ্রশেখরদাকে সঙ্গে নিয়ে লাঞ্চব্রেকে বেলতলায় গিয়ে ভগওয়ান দাসের মোটর ট্রেনিং স্কুলে টাকা জমা দিয়ে এসেছি। বেশ কদিন সকাল সকাল অফিসে এসেছি তখন, জোর করে এসেছি, ট্রেনিং স্কুলের গাড়ি অফিসের সামনে এসে দাঁড়াত। আমি ড্রাইভিং শিখতে শুরু করে দিলাম। কিছু তো একটা করতে হবে। যদি কিছু না হয়, ড্রাইভিং শিখে ট্যাক্সির পারমিট বের করে যাহোক কিছু একটা করতেই হবে। মোটামুটি কয়েকদিন চালানোর পরে গীয়ার টিয়ার গুলো শিখে যাই, ক্লাচ, ব্রেক সবই পারছি, কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ মন যেন কোথায় চলে যাচ্ছিল। নেহাৎ পাশে বসে থাকে ট্রেইনার, নইলে কলকাতার রাস্তায় অ্যাক্সিডেন্ট হতে আর কতক্ষণ!
    যেদিন মাথার মধ্যে কেবল গন্ধ আর গন্ধ, যেদিন বুঝতে পারলাম যে কদিন ধরেই কেমন একটা গন্ধ যেন আমায় ঘিরে রয়েছে, অথচ গন্ধটা যে কীসের তা ধরতে পারছি না। গন্ধটা কি শুধু আমার নাকেই ধরা দিচ্ছে? কই অন্য কেউ তো কিছু বলছে না আমায়। অন্য কারও কাছে গেলে তো এরকম গন্ধ আমি পাচ্ছি না। এর নামই কি উন্মাদ হয়ে যাওয়া? এই চিন্তা বাকি সব কিছুকে ঢেকে দেয়, আমি গাড়ি চালানো শিখতে গিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছি তা ট্রেইনারও বুঝতে পারে। সে জিজ্ঞেস করে, আপকি তবিয়ৎ ঠিক হ্যায়?
    মাঝখানে কিছুদিনের জন্য তাকে আসতে বারন করেছিলাম। তারপরে সে যেদিন এসেছিল আমিই সেকথা ভুলে গেছলাম। অফিসে ঢুকবার সময় গেটের দারোয়ান বলেছিল, ম্যাডাম আপনার ড্রাইভিংএর লোক আজ সকালে কতক্ষণ ধরে ওয়েট করে করে চলে গেল, আপনি কি আজকেই আসতে বলেছিলেন?
    কবে কাকে আসতে বলেছি খেয়াল থাকছে না। এরই মধ্যে জেনে গেছলাম নাকে সেই গন্ধটা লাগার মূল কারণ। একটা কেমন যেন কেমিক্যাল বা ওষুধ ওষুধ লাগত গন্ধটা, দীর্ঘদিন আগের কোনও স্মৃতি, যে কেমিক্যালের গন্ধ আমি জানি, কিন্তু নামটা মনে পড়ছে না। অনেক অনেক বছর এই গন্ধ আমার নাকে লাগে নি, কিন্তু চিনি। সেই গন্ধ আমার শরীরে কেন পাচ্ছি? কাপড়ের আলমারি খুলেই গন্ধটা আবার পেয়েছিলাম। আমার প্রত্যেকটা জামায় শাড়িতে প্রতিটি পোশাকে ঐ গন্ধ। আমি জিজ্ঞেস করি, এরকম ডেটলের গন্ধ কী করে হলো? আমার কাপড় জামা কি ডেটল দিয়ে কাচা হয়েছে?
    আমার মেয়ে সেখান থেকে ছুটে পালায়। মনে হয়, সে হয়ত কিছু জানবে। আমার গলার স্বর চড়তে থাকে, আমার সব কাপড়ে ডেটলের গন্ধ কেন?
    যা জবাব পাই, আমার গায়ের গন্ধ সব কাপড়ে জামায়, সেই দুর্গন্ধ থেকে রক্ষা পেতে সব কাপড়ে জামায় ডেটল ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে। দেবার আগে মেয়েকে দিয়ে যাচাই করিয়ে নেওয়া হয়েছে ― তোর মায়ের এই জামাকাপড়গুলোয় কী বিচ্ছিরি গন্ধ না? ইশ্‌ কী দুর্গন্ধ! দ্যাখ শুঁকে দ্যাখ।
    মেয়ে সায় দিয়েছে শুঁকে, ইশ্‌ কী গন্ধ!
    ব্যস হয়ে গেল। সব কাপড়জামা ডেটলগন্ধী। আমার শরীরে দুটো গন্ধের অপশন, নিজস্ব দুর্গন্ধ বা ডেটলের গন্ধ।
    আমার ইচ্ছে করে সব জামাকাপড় তক্ষুনি বালতি বালতি সার্ফের জলে চুবিয়ে সারারাত ধরে কেচে কেচে ঐ ডেটলের গন্ধ বের করে দিই। তাতে ঝামেলা বাড়বে। ঝামেলা নয়, ঝামেলার উপসর্গ বাড়বে। মূল ঝামেলা আমি নিজেই। আমি নেই হয়ে গেলে এসব গন্ধ বা অন্য সব সমস্যা শেষ। সেইজন্যই মরে যাবার একটা রাস্তা খুঁজছি। পোষা কুকুরদের দেখ। মরে যাওয়া খুব সহজ এদের। তোমার প্রয়োজন ফুরোল, ব্যস বাকি ব্যবস্থা মালিক করে দেবে। একটা ইন্ট্রাভেনাস ইন্জেকশান ঘুম পাড়িয়ে দেবে। মানুষও ঘুমিয়ে যেতে পারে। ঘুমের ওষুধ পাওয়া যায় কিনতে। কতগুলো ঘুমের ওষুধ লাগে একেবারে ঘুমিয়ে পড়তে? কুড়িটা? চল্লিশটা? একশো? দুশো? কত? আমি ব্যবস্থা করে নেব।
    ঘুমের ওষুধ জোগাড় করার কথা ভাবছিলাম, ভারতবর্ষের কত মেয়ে রোজ ঘুমের ওষুধ খেয়ে মরবার চেষ্টা করে, কেউ সফল হয় তো কেউ বিফল। বিফলই বেশি হয়, অল্প কটা খেলে কদিন টানা ঘুমোবে, ফের বেঁচে যাবে। আমি ওরকম চাই না।
    কোন দিকে তাকিয়ে এরকম ভাবছিলাম জানি না, মিঠুবাবুর মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম হয়ত, কিন্তু মিঠুবাবুকে আমি দেখছিলাম না। লোকটা ভেবেছে তাকেই দেখছি, সে সেই কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এসে করুণ স্বরে বলল, এক মিনিট পনেরো সেকেন্ড, ওয়ান মিনিট ফিফটিন সেকেন্ডস, হুঁঃ।
    চোখদুটো ছলছল করছে মিঠুবাবুর। এ কি সত্যি সত্যি কাঁদবে না নাটক করছে রে বাবা। কী বলতে চায় ও?

    (চলবে)
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:5195:1112:5618:e0b3 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৮:০৩735648
  • নবম অধ্যায়

        to die: to sleep
    To sleep, perchance to dream ay, there's the rub,
    For in that sleep of death what dreams may come
    When we have shuffled off this mortal coil
    Must give us pause: there's the respect
    That makes calamity of so long life.
    Hamlet, William Shakespeare

    সেদিন অফিসের সিঁড়িতে ওঠার মুখে বাঁদিকে তাকিয়ে দেখি পার্থবাবুর ঘর খোলা, চেয়ার খালি। ওঁর সঙ্গে একটু কথা বলবার ছিল। উনি টয়লেট গেছলেন, আমায় এক মিনিটও অপেক্ষা করতে হয় নি। আমায় দেখতে পেয়েই উৎসুক প্রশ্ন ― তারপর? কীরকম চলছে সব ব্যাপার স্যাপার আপনাদের ওপরতলায়? বড়োসায়েবের গিন্নি কি আর জয়েন করবে বলে মনে হচ্ছে?
    ― আচ্ছা পার্থবাবু আপনাকে দুটো প্রশ্ন করবার আছে, আগেই এত প্রশ্ন করবেন না, সব ভুলে যাব।
    উনি চায়ের অর্ডার করলেন। তারপর ফিসফিসিয়ে বললেন, মিঠুর ঘটনাটা জানেন তো?
    ― আরে দাদা, আপনি তো টেলিপ্যাথি জানেন মনে হয়। এইটাই আমার এক নম্বর প্রশ্ন ছিল। শুনুন, খুলে বলি। কাল বিকেলে আপনাদের এই মিঠুবাবু―
    ― আমাদের মিঠুবাবু মানে? ও আমার কেও না। বরং আপনাদের কোম্পানীর দালাল, শালা চোর এক নম্বরের―
    ― হ্যাঁ সেই। সে আমার টেবিলের কাছে চেয়ার টেনে নিয়ে বসে খুব ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদল। বিশ্বাস করুন, কাঁদল। ঐ যে গাড়ির রেস হয়েছিল, তাতে এক মিনিট পনেরো সেকেন্ডের ব্যবধানে ওর নাকি জেতা উচিৎ, ও ই ফার্স্ট, অথচ ওকেই প্রাইজ দেয় নি। ব্যাপারটা কী জানেন নাকি? প্রাইজ দেবে না কেন? ফার্স্ট না হলে অন্ততঃ সেকেন্ড প্রাইজ পাবে। সেসব জিজ্ঞেস করতেই কথা ঘুরিয়ে পালিয়ে গেল।
    ― ওরেব্বাবা! আপনাকে এই গল্প বলেছে? শুনুন তবে, প্রথমে অনেক বাড়িয়ে বলেছিল তিন মিনিটের ডিফারেন্স ওর সেকেন্ডের থেকে এবং ও ই ফার্স্ট। তিন মিনিট শুনে সকলে অবাক হয়েছে, তখন ওটা কমিয়ে এনে এখন এক দেড় মিনিট বলে বেড়াচ্ছে।
    আমি অধৈর্য হয়ে উঠি, তাহলে সবটাই মিথ্যে? ও ফার্স্ট সেকেন্ড কিছুই হয় নি?
    ― আহা, অত সোজা নয়। ও গাড়ি চালিয়ে অনেক পথ ঘাট যেমন যেমন ওদের রুট থাকে, সেই সব বন বাদাড় পাথুরে রাস্তা সমতল এইসব ঘুরে টুরে সব্বার আগেই পৌঁছেছিল। সেটা তিন মিনিট আগে হোক কি পাঁচমিনিট, মানে যেমন ও রটিয়ে বেড়াচ্ছে, সেসবের সাক্ষীও আছে। ওর র‌্যালা দেখতে গেছল তো আপনার বড়ো সায়েব এবং অ্যাকাউন্টেন্ট, হ্যাঁ যার আগের বৌ মিঠুর সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করতে গিয়ে কেস খেয়ে গেল, আজ্ঞে হ্যাঁ সেই অ্যাকাউন্টেন্টও মিঠুর গাড়ির র‌্যালাবাজি দেখতে গেছল, ওরা তো এই রেসের স্পনসর।
    ―বলেন কী!
    ― তো? মিঠু এমনি এমনি সারাগাড়িতে ডিজাইন করে করে আপনাদের কোম্পানীর নাম এঁকে রেখেছে নাকি? অলরেডি বেশ কয়েক লাখ ঝেঁপেছে তো সায়েবদের ভুজুংভাজুং দিয়ে। যাইহোক, আসল যেটা নিয়ে বলছিলাম, সবার আগে গাড়ি চালিয়ে পৌঁছলেই ফার্স্ট হওয়া যায় না। 
    ― কেন? ও ফাঁকি দিয়ে শর্টকাট রাস্তা দিয়ে গিয়ে, সেই আমীর খানের জো জিতা ওহি সিকন্দর সিনেমার সাইকেল রেসে এরকম কী একটা ছিল না? সেরকম ব্যাপার?
    ― আরে বাদ্দিন তো! ওসব নয়। এ হচ্ছে ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। খেলা যখন শেষ, তখন ওরা চেক করে দেখল ব্যাটা মিঠুর গাড়িটাই জালি, তৎক্ষণাৎ ডিসকোয়ালিফায়েড। ওকে তো ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে। জানেন না?
    পার্থবাবু জানালেন যে যার যেরকম ব্র্যান্ডের গাড়ি সেইরকম জানিয়েই প্রতিযোগিতায় অংশ নেবার কথা। স্পোর্টস কার হলে চলবে না, কি তারও একটা বিশেষ ক্যাটেগোরি আছে। কিন্তু মিঠুবাবু এই গাড়ির পার্টস ভেতর থেকে খুলে নিয়ে অন্য পার্টস লাগিয়ে গাড়িটা এমন করে তুলেছিল যেটা এইসব প্রতিযোগিতার নিয়ম বহির্ভূত। আয়োজকরা সম্ভবত আগে থেকেই খবর পেয়েছিল বা সন্দেহ হয়েছিল, তারা চেক করে দেখে যে পার্টস মূল গাড়ির নয়। তাই ডিসকোয়ালিফায়েড করে দিয়েছে।
    মিঠুবাবুর জব্দ হবার খবরে আমরা সবাই খুশি, একেই বলে শাডেনফ্রয়েডে, শব্দটা জার্মান থেকে ধার করা ― অন্যের দুঃখে আনন্দ পাওয়া যাকে বলে আর কি।
    কথায় কথায় আমার দ্বিতীয় প্রশ্নটা করবার কথা ভুলেই যাই। এদিকে সায়েবরা সব এসে গেছে, তারা সিঁড়িতে ওঠার আগে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে নিচ্ছে আমি পার্থবাবুর ঘরে বসে আড্ডায় ব্যস্ত, উঠবার জন্য তেমন গা ও করছি না। আজ ওরা আগে ঢুকুক, আমি পরে যাব। আজ অবধি কোনওদিনও তো দেরি করে অফিসে আসি নি, একদিনের তরেও ছুটি নিই নি, আজ পাঁচমাসের ওপর হয়ে গেল কাজ করছি, জল ঝড় রোদ বৃষ্টি মাথায় করে রোজ এসেছি। আজ ইচ্ছে করে দেরিতে ঢুকব। আজ পার্থবাবুর কাছে দ্বিতীয় প্রশ্নটার উত্তর জেনে নিতে হবে। একটু ক্যাবলা সেজে বলি, ― আপনাকে যেটা বলব বলে বসে আছি, জানেন তো রাত্রে ঘুমটা সেরকম ভাল হচ্ছে না। ঘুমের ওষুধ কিছু জানেন নাকি? একটা নাম বলুন তো, কদিন খেয়ে দেখি।
    পার্থবাবু গম্ভীর হয়ে যান।
    ― ঘুমের ওষুধ কি আর একটা বাজারে? তবে ওসবের ওব্যেস না করাই ভাল। কেন? ঘুম কেন হচ্ছে না আপনার? হজমের গন্ডগোল, নাকি প্রেশার টেশারের গোলমাল? বেশি চিন্তা টিন্তা করেন নাকি? আমার ওয়াইফ ঘুমের ওষুধ ধরেছিল কয়েক বছর আগে, এখন নেশায় দাঁড়িয়ে গেছে, ওটা না খেলে ঘুমই হবে না। ও জিনিস ভালো নয়, হ্যাবিট হয়ে গেলে ছাড়ানো যায় না।
    ― না না, হ্যাবিটের প্রশ্নই নেই। কী নাম ঐ ওষুধের?
    পার্থবাবু নামটা বলে দেন। এগুলো হচ্ছে আসলে সব ডায়াজেপাম ফাইভ এমজি। মানে ওটাই কম্পোজিশান, বাজারে নানান নামে পাওয়া যাচ্ছে।
    আমার কাজ হয়ে গেছে। নামটা যাতে ভুলে না যাই, মনে মনে প্রায় জপ করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে যাই। এই যন্ত্রণার দুনিয়া থেকে আমায় যে করেই হোক চলে যেতে হবে। সিঁড়ির নীচ থেকে পার্থবাবু পেছু ডাকেন ― এই যে শুনুন শুনুন, একটু শুনে যান।
    নীচে নেমে এলাম।
    ― আপনার কী হয়েছে আমাকে বলবেন?
    ― আপনি তো সবই জানেন পার্থবাবু। নতুন করে খুব বেশি কিছু আর কী হবার আছে?
    ― না মানে হঠাৎ ঘুমের ওষুধের খোঁজ করছেন কিনা।
    ― কেন? আপনি ভাবছেন আমি একগাদা ঘুমের বড়ি খেয়ে আত্মহত্যা করব?
    আমি হাসতে শুরু করি।
    ― না না, তা কেন করবেন? আত্মহত্যা মহাপাপ। সেসব নয়, ... আচ্ছা ঠিক আছে, পরে কথা হবে।
    আত্মহত্যা মহাপাপ। হা হা। পার্থবাবু আমায় ভয় দেখাচ্ছেন, পাপ পুণ্যের হিসেব দিয়ে আমি কী করব এখন। যে করে হোক ঐ ওষুধ জোগাড় করতে হবে, যতদিন লাগে লাগুক, এই দুনিয়ায় আর নয়। মহাপাপ করলে নরকে গিয়ে থাকতে হবে, সেই নরক কি এই বর্তমান অবস্থার থেকে খারাপ? হোক খারাপ। লোকে জানে পুণ্য করলে স্বর্গবাস, পাপ করলে নরকবাস, অতৃপ্ত আত্মা, এটসেট্রা। ওরা স্বর্গে নরকে ঘুরে দেখে এসেছে সব। এর নাম জীবন? এর চেয়ে মরে যাওয়া ঢের ভালো। নামটা যেন ভুলে না যাই।
     
    (চলবে)
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:5195:1112:5618:e0b3 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৮:০৪735649
  • দুই

    অক্টোবরের বারো তারিখে পড়েছে মহালয়া। শনিবারে । ঐদিন অফিস ছুটি নেই, এমনিতে যেমন হাফছুটি থাকে তেমন। পুজোর দিনগুলোয় কদিন ছুটি পাওয়া যাবে সেই নিয়ে সুরঞ্জনা উৎসুক। ছুটি কম থাকাই ভাল। ছুটির দিনও কম ভয়ঙ্কর নয় এখানে। মেয়ের ইস্কুলে যাওয়া অনিয়মিত, মাঝে একটা ছবি আঁকার ক্লাসে ভর্তি করেছিলাম, সেখানেও অনিয়মিত। সব দিন যেতে চায় না। রবিবার রবিবার এই আঁকার ক্লাস, এই একই আঁকার ইস্কুলে আমি ছোটবেলা ভর্তি হয়েছিলাম, টানা দশ বছর গেছি নিয়মিত। ওখানে মাস্টারমশাই তিনজন। তিনজনের মধ্যে দুজনই আমার চেনা, তাদের ছাত্রী ছিলাম। শিল্পী হবার জন্য নয়, শিল্পকে বুঝবার জন্য ছিল ঐ ক্লাস করা। মেয়ের জন্যও সেরকমই ভেবে রেখেছিলাম, তাই খুব বেশি নিয়মিত হবার তাড়া আমাদের ছিল না। আরও জানতাম, ছুটির দিন হলেও কিছু একটা করবার আছে সেই দিনে। তবুও নানা বাধা আসে, ড্রাইভিং শেখার মত, অনিয়মিত হয়ে যাই।
    মহালয়ার আগের দিন সাশাকে গিয়ে বললাম, জানিস আমি ঠিক করে ফেলেছি যে মরে যাব। আত্মহত্যাই একমাত্র পথ আমার সামনে।
    সাশার মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে কিন্তু সে হাসে না। সে সিরিয়াস হয়ে বলে, ― খুব ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছ। এটাই আমি তোমাকে গোড়া থেকে বারবার বলে এসেছি। আমি সোজাসুজি কথা বলায় বিশ্বাসী। সামনে একরকম বলব আর পেছনে অন্যরকম ভাবব, সেরকম লোক নই। তোমার জীবনে কিচ্ছু নেই ভবিষ্যৎ বলতে যা বোঝায়। আজ সের্গেই তোমাকে নানারকমের প্রস্তাব দিচ্ছে, আমি তো দেখছি জানছি সবই। অন্য অনেকেই এরকম করবে তোমার সঙ্গে। কেন জান? এটাই নিয়ম। এখন তুমি যদি তাদের সঙ্গে যেতে চাও, যাবে। গেলেও কোনও ভবিষ্যৎ নেই তোমার, না গেলেও নেই। তুমি মরে গেলে কারও ক্ষতি হবে না এই পৃথিবীতে। কেউ দুঃখ পাবে না, একটা প্রাণীও কাঁদবে না, শোক করবে না। অর্থাৎ এই পৃথিবীতে তুমি একটা অতিরিক্ত। তোমার থাকা বা না থাকায় কারোর কিছু এসে যাবে না।
    আমি চুপচাপ ওর কথাগুলো শুনলাম। কেমন যেন মনে হতে লাগল, ও তন্ত্র টন্ত্র শিখছে, মেয়েদের বেসিক্যালি খুবই ঘৃণা করে, জাতিভেদের শিক্ষা ওর রন্ধ্রে রন্ধ্রে, কিন্তু আর যা ই হোক আমার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে যে কথাগুলো বলছে সেগুলো শুনতে মিষ্টি না হলেও তেমন ভুল তো শোনাচ্ছে না।
    সাশা আমার কাছে জানতে চাইল, তাহলে কোন পদ্ধতিতে মরতে চাও তুমি?
    ― বিষ খাব।
    ― বিষ! সেতো খুব পেইনফুল হবে।
    ― না। বিষ নয়, ঘুমের ওষুধ, হাই ডোজে।
    ― হ্যাঁ সেই ভাল। সব ব্যবস্থা করা হয়ে গেছে? লোক জানাজানি যেন না হয়, তাহলে কিন্তু সব ভণ্ডুল হয়ে যাবে। তা কোথায় গিয়ে মরবে ঠিক করেছ?
    ― জায়গা তো ঠিক করা হয় নি। ভাবছি।
    ― সেকী! জায়গাটাইতো সবচেয়ে জরুরি। শোনো, আমি বলে দিচ্ছি তুমি এখন কী করবে। অফিস ছুটির পরে তুমি এই শহর থেকে দূরে কোথাও চলে যাবে, সেখানে গিয়ে একটা হোটেলে ঘর ভাড়া নেবে দিন দুয়েকের জন্য। ঐ ঘরেই মরে থাকবে, কেউ জানতেও পারবে না। যদি বাড়ি গিয়ে মর, তবে তোমার ঘুম দেখেই লোকে ডাক্তার ডাকবে, বাঁচিয়ে দেবে।
    আমি ওখান থেকে সরে যাই। একটা একা মেয়েকে ঘর ভাড়া দেয় এমন কোনও হোটেল আছে নাকি? সাশা এত জানে আর এইটুকু জানে না?
    আমার বোন ডাক্তার। সে যখন এসেছিল এই বাড়িতে, তার কাছে চাইলাম ঘুমের ওষুধের প্রেসক্রিপশন। সে পাঁচটা লিখে দিল। তার অজান্তেই তার কাছ থেকে নিয়ে নিলাম বেশ কটা প্রেসক্রিপশন লিখবার পাতা। এখন সময় বুঝে কুড়িটা কুড়িটা করে গোটা ছয়েক প্রেসক্রিপশন নিজেই বানিয়ে নিতে পারব। সে চলে গেলে সেই প্রেসক্রিপশনেই পাঁচকে পনেরো করে নিয়ে মেয়েকে সঙ্গে করে চললাম ওষুধ কিনতে। সেতো আর এমনি এমনি তখন বেড়াতে যেতে চাইছে না, কিন্তু এই প্রথম ওষুধের দোকানে যেতে আমার দ্বিধা হচ্ছে, যদি তারা বুঝে ফেলে। তাকে অনেক চুইংগাম কিনে দেব কথা দিয়েছি। কিনেও দিলাম, অনেক অনেক চিকলেটস এবং আমার জন্য পনেরোটা বড়ি।
    সেদিন অফিস থেকে ফেরার সময় বাসে উঠতে ইচ্ছে হয় নি। সবাই চলে যাবার পরে নীচে নেমেছিলাম। কেন জানি না একটা গাড়ি তখনও ছিল নীচে, কোনও সায়েব হয়ত আগে চলে গিয়েছে, তাকে পৌঁছিয়ে গাড়ি ফিরে এসেছে।
    চন্দ্রশেখদাই ছিল তখন ড্রাইভারের সীটে, বলল আপনাকে একটু এগিয়ে দিই?
    ― দিন।
    আমি পেছনে বসি না, সামনেই বসি যদি তা ফাঁকা থাকে। ফার্ণ রোডের কাছটায় এসে গাড়ি ছেড়ে দিয়েছিলাম। বাকিটুকু হেঁটেই যাই। মোটামুটি ভেবেই রাখা ছিল যে পুজোর আগেই চলে যেতে হবে, খুব ভাল হয় যদি মহালয়ার দিনেই কাজটা হয়ে যায়। এবং সব ব্যবস্থা অদ্ভুতভাবে হয়ে গেল। প্রেসক্রিপশনের কাগজ থেকে শুরু করে প্রথম দফার ওষুধ কেনা। সব নির্বিঘ্নে। আমি আর বাইরের পোশাক বদলাইনি সেরাতে। যে জামা পরে অফিস করেছি, ঘুরেছি, সেই জামা পরেই ঘুমিয়ে পড়লাম। একটা পুরোনো ভ্যানিটি ব্যাগ তৈরী রাখলাম পরের দিনের জন্য। ডাক্তার সেজে ওষুধ কিনব একটা ভ্যানিটি ব্যাগ সঙ্গে না রাখলে কি চলে?
    মহালয়ার দিনে আর পোশাক বদলাই নি। যা পরেছিলাম তা পরেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম, যাবার আগে বাড়িতে বলে গেলাম যে অফিসের কাজে কদিনের জন্য বাইরে যাচ্ছি। কেউ জিজ্ঞেস করেনি কোনও জিনিসপত্র ছাড়াই কেমন করে কদিন চলবে আমার। এই বলে দেওয়াটুকু, জানিয়ে দেওয়াটুকু সেইজন্যই যাতে রাতে না ফিরলে জানে যে ফিরব না। চিন্তা বা দুশ্চিন্তার কোনও প্রশ্ন ওঠে না এই পরিবেশে, সে জিনিস কোনওদিনই হয়েছে বলে স্মৃতিতে নেই।
    আমি অফিসে যাব, আজ আমাদের হাফ ডে, মানে দেড়টা দুটোর মধ্যে সবাই বেরিয়ে যাবে। ঐ তল্লাটে প্রচুর ওষুধের দোকান। গোটা ছয়েক অনায়াসে পেয়ে যাব। এই প্রথম জীবনে এই প্রথম অফিস যাবার জন্য ট্যাক্সি নিলাম। আজ তো অনেক অফিসই ছুটি, স্কুল কলেজও ছুটি, ট্র্যাফিক সকাল সাড়ে সাতটা আটটার দিকে খুবই কম। ফাঁকা ট্যাক্সি সামনেই ছিল। উঠে পড়লাম গাড়িতে। অল্প কিছুক্ষণ পরেই অফিসের দরজার সামনে উপস্থিত হয়েছি। ভাড়া হয়েছে তিরিশ টিরিশ, ড্রাইভার কীসব চার্ট মিলিয়ে নিখুঁত হিসেব বলে দিচ্ছে, আমি পঞ্চাশ টাকার নোটটা তার হাতে দিয়ে নেমে যাই। সে কুণ্ঠিত হয়ে বলে বাকি চেঞ্জটা নেবেন না? বলি, রেখে দিন ওটা।
    কী হবে আমার আর গুছিয়ে গুছিয়ে হিসেব মিলিয়ে? লোকটার মুখে একটু হাসি ফুটুক, বকশিস হাসি ফোটাতে পারে। না, আমি ঠিক করেই রেখেছি অফিস ছুটি হয়ে গেলে ঐ প্রকাণ্ড ঘরটার এক কোণে যেখানে আমার বসবার ডেস্ক, ওখানেই ওষুধগুলো খেয়ে ঘুমিয়ে থাকব। সোমবারের আগে কেউ জানবে না। সাশার কথা মত কোন চুলোয় হোটেল খুঁজে মরব আমি? নটা নাগাদ বেরিয়ে ওষুধগুলো কিনে আনলাম। প্রায় কোনও দোকানেই সন্দেহ করে নি। ওদের সামনেই খশখশ করে প্রবল ব্যক্তিত্ব দেখিয়ে প্রেসক্রিপশন লিখেছি, একটা দুটো অতিরিক্ত ওষুধও নিয়েছি, বা এক প্যাকেট চকোলেট সঙ্গে। কোথাও একটা দামি সাবান। একটা দোকানে একটু সন্দেহ করেছিল, রেজিস্ট্রেশন নম্বরটা লিখতে বলল, খশখশ করে বানানো নম্বর মন থেকে লিখে দিয়েছি তাদের সামনেই। একটু খোশগল্পও করেছি দোকানদারের সঙ্গে, কোন মেডিকেল কলেজ, কে আমাদের প্রোফেসর ছিলেন, এইসব। যদিও ভ্যানিটি ব্যাগের মধ্যে স্টেথোস্কোপ নেই, তবে দোকানদার তো সেসব জানে না, মুগ্ধ হয়ে কথা শুনছিল। জিনিস কেনার পরেও, দাম টাম দেবার পরেও, মিনিট খানেক দাঁড়িয়ে কথা বলেছি, কোনও সন্দেহ যাতে তার মনে না ঢোকে। একটা বড় বোতলের পেপসি কিনলাম। এটা সাশা বলে দিয়েছিল। অতগুলো বড়ি গিলবার সময় যদি বমি হয়ে সব বেরিয়ে যায়? তাই সাবধানে গিলতে হবে।
    অফিসে ফিরতে ফিরতে প্রায় সাড়ে দশটা পৌনে এগারোটা বেজে গেছে। আজ কোনও লাঞ্চ ব্রেক নেই। একটু বেশিক্ষণ থেকে নিয়েই সব সায়েবেরা বেরিয়ে যাবে। তাদের পৌঁছে দিতে যেতেও পারে ড্রাইভারেরা, আবার নাও যেতে পারে। অনেক সময় তারা উইকেন্ডের জন্য গাড়ি রেখে দেয় নিজেদের কাছে। ফলে অনেক ড্রাইভারদেরই শনিবারের দুপুর থেকেই ছুটি শুরু হয়ে যায়। তারা মেইন গেট বন্ধ করে শেড দেওয়া জায়গায় গুলতানি করবে, রান্না হবে উৎসবের মত, শনিবারের দুপুর থেকে গোটা রবিবার তাদের অবাধ স্বাধীনতা। অবশ্য ওপরের অফিসঘরের দিকে কেউ যাবে না। যাবে কী করে? মেইন বিল্ডিঙের কাচের দরজা চাবি ঘুরিয়ে বন্ধ হয়ে যাবে। সেই দরজা সোমবারের আগে খুলবার নিয়ম নেই।
     
    (চলবে)
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:5195:1112:5618:e0b3 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৮:০৫735650
  • তিন
     

    জানলার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরেটা দেখছিলাম। নীচে বয়ে চলেছে প্রমথেশ বড়ুয়া সরণী। রাস্তার ওপারে উঁচু পাঁচিলে ঘেরা আর্মি পাবলিক স্কুল। প্রচুর গাছ সেই পাঁচিলের ওপারে, বড়ো মাঠ, স্কুল বিল্ডিং। সকালে স্কুলবাসে করে ছেলে মেয়েরা সেখানে পড়তে যায়। এত বেশি গাছে ঢাকা সামনের দিকটায় যে প্রায় কিছুই দেখা যায় না এই তিনতলার ওপর থেকেও।
    আজ আমি এদেরকে চা বানিয়ে দিই নি। চায়ের সময় বাইরে গেছলাম। সাশাকে বলে দিতে হবে যে সব রেডি, শুধু মরবার জায়গাটা ওকে বলব না। আর কিছু ভুলে যাচ্ছি কি? নাঃ ভুলে যাবার আর কী আছে? অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর তো আর কোনও অঙ্গ, চোখের কর্নিয়া বা কিছু, সেসব দান করা যায় না। অনেক টাকা পয়সা সম্পত্তি থাকলে সেসবও মরতে যাবার অনেক আগেই বিলিয়ে দিয়ে যেতাম, এরা যখন সব বেরিয়ে যাবে তখন কোথাও একটা লুকিয়ে পড়তে হবে, যাতে টের না পায় যে আমি বের হই নি। বাথরুমে গিয়ে লুকিয়ে থাকা যায়, তবে তাতে সমস্যা, দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে রাখতে হবে, সেটা সহজেই প্রত্যেকের নজরে পড়বে― সিঁড়ির পাশেই তো বাথরুম। এইবারে মনে পড়েছে, সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট জিনিসটাই ভুলে গেছি ― সুইসাইড নোট! দেখেছ কাণ্ড! ঐটা না থাকলে পুলিশ এসে হাজার সমস্যায় ফেলবে সবাইকে। আমি জানি কী লিখতে হয়― আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।
    ঝপ করে নিজের টেবিলে একটা ফুলস্ক্যাপ কাগজে লিখে ফেললাম শব্দগুলো। তলায় সই করলাম। বাংলায়। বাংলায় সই করাটা কি ভ্যালিড হবে? পাসপোর্টের সইয়ের সঙ্গে যদি মিলিয়ে দেখে পুলিশ? সইটা কেটে ইংরিজিতে করব নাকি তলায় আরেকবার ইংরিজিতে করে দেব? সবচেয়ে ভাল হতো যদি নোটটা ইংরিজিতে লিখতে পারতাম। কিন্তু লজ্জা করে যদি বানানে কি গ্রামারে ভুল হয়, মিঠুবাবুর ইংরিজি নিয়ে এত হাসাহাসি করি, অথচ নিজেও বেশ কাঁচা আমি ইংরিজিতে। নো ওয়ান ইজ রেসপনসিবল ফর মাই ডেথ হবে নাকি নো ওয়ান শুড বি হেল্ড রেস্পনসিবল ফর মাই ডেথ? কোনটা ঠিক? দুটোর মধ্যে একটা নির্ঘাৎ ভুল। ইশ্‌ ছি ছি মরবার পরে লোকে আমার সুইসাইড নোট নিয়ে হাসাহাসি করবে শেষে? বাংলাতেই লিখি। এত ছোট নোট এত বড়ো একটা পাতায় মানাচ্ছে না। ভালো করে গুছিয়ে কিছু লিখি। অনেকদিন কিছু লেখাই হয় নি।
    খুব সুন্দর করে গুছিয়ে একটা চিঠির মত লিখলাম, সেখানে স্পষ্ট করে বলা আছে কেন চলে যেতে চাইছি, তবে কারোকে দোষারোপ করিনি, লিখেছি যে অন্য জগৎটাতে যাবার জন্য এত তোড়জোড় সেখানে আমার অনেক প্রিয় মানুষেরা আগেই চলে গেছে। হয়ত সেখানে তাদের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। হয়ত কেন? আমার দৃঢ় বিশ্বাস। এই সব কথা ভাষা টাশা দিয়ে লিখতে লিখতেই গোটা পাতাটা শেষ হতে চলল। নীচে বাংলা এবং ইংরিজি দুটোতেই সই করা রইল। চিঠিটার ভাষা কেমন হয়েছে কারোকে দিয়ে একবার পড়িয়ে নিতে পারলে খুব ভালো হতো। বাংলা জানে সাশা, ওকেই ডেকে পড়তে দিলাম নোটটা। খুব সুন্দর করে গোটা গোটা অক্ষরে লিখেছি, হাতের লেখার জন্য যাতে কোনও সমস্যা না হয় কারো।
    সাশা চোখ বুলিয়ে নিল একবার। হয়ত সব শব্দের অর্থ ও জানে না, যতই ইণ্ডোলজি নিয়ে পাশ করে আসুক না কেন, বা যতই বাংলা জানি বলে জাহির করে বেড়াক না কেন, এটা হচ্ছে আমার মাতৃভাষা, এতে আমার দখল ওর চেয়ে ঢের বেশি।
    বারবার জিজ্ঞেস করছে কোথায় যাবে ঠিক করে ফেলেছ তো?
    আমি ওকে আশ্বাস দিই, হ্যাঁরে বাবা, সব ঠিক করা আছে। ওষুধ মজুদ আছে, চিঠিও। আর কী চাই?
    ―ইউরি আন্দ্রেইভিচ, আজ শনিবার, হয়ত সোমবারে আপনার সঙ্গে আর দেখাই হবে না। শুনেছি এবছর পুজোর জন্য ছুটি থাকতে পারে, আপনি তো কলকাতাতেই থাকবেন, তাই না?
    ―হ্যাঁ, এখানেই টানা বিশ্রাম নেব। তুমি কি সোমবারে মানে আগামি সপ্তাহে ছুটি নিচ্ছ? সে তো খুব ভাল কথা।
    ―হয়ত মরেই যাব এর মধ্যে, কে বলতে পারে বলুন?
    ―না, না, মরবে কেন? মরার কথা ভাববার সময় এখন নয়।
    আমি নীচে গেলাম, পার্থবাবু আজ নেই। সুরঞ্জনা বলল, তুই কি এখনই বেরিয়ে যাচ্ছিস নাকি?
    ―নাহ একটু পরে বেরবো। ওপরে এখনও সবাই রয়েছে।
    ―ঐ দেখ! ঐ দেখ! সের্গেইয়ের বউ ঢুকছে ― দেখেছিস আগে?
    একটা সাদা মারুতি নিয়ে ঢোকে কোম্পানীর ড্রাইভার। গাড়ি থেকে নেমে ভেতরে ঢুকছে সের্গেইয়ের বউ, স্বামীকে নিয়ে যেতে এসেছে, ছেলেও আসছে পেছন পেছন। সুরঞ্জনা চুড়ান্ত তৎপরতার সঙ্গে ফোন করে জানিয়ে দেয় ওপরে যে বৌ এসে গেছে। সের্গেইয়ের বৌ ও ছেলেটা রিসেপশনের কাছে এসে দাঁড়াতেই সুরঞ্জনা এক গাল হেসে জানিয়ে দেয়, সের্গেই নীচে আসছে, খবর দেওয়া হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। বৌ নিশ্চিন্ত হয়ে হালকা একটু হেসে পায়চারি করতে থাকে করিডোরে।
    সুরঞ্জনার আজ কোথায় যেন বেড়াতে যাবার আছে, পুজোর শপিং নাকি বাবলুর সঙ্গে কোথাও যাবে, মন দিয়ে শুনতে পারি না, আবার উঠেও যেতে পারছি না। সের্গেই যতক্ষণ না চলে যাচ্ছে, ততক্ষণ ওদিকে যাব না। এখন ওপরে যেতে গেলেই মুখোমুখি দেখা হবে, আবার কী বলতে কী বলবে, তার চেয়ে সুরঞ্জনার এখানেই বসে থাকি পাঁচ মিনিট। আমার তো কোনও তাড়া নেই এখন।
    সের্গেই প্রায় তখুনি চলে এল, হাতের ইশারায় ডাকল ড্রাইভারদের, কোন গাড়িটা এখন নেবে সেই নিয়ে বাছাবাছি চলছে। রিসেপশনের দিকে এসে সুরঞ্জনাকে কী সব নির্দেশ দিল, বৌ অধৈর্য হয়ে নেমে চলে যাচ্ছে গেটের দিকে, সের্গেই পা চালিয়ে তাকে ধরে নিতে চায়, আমি ওপরের দিকে রওনা দিলাম। সুরঞ্জনা ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছে, পাঁচ মিনিটের মধ্যে বেরিয়ে পড়বে সেও। ওপরের ঘর খুব তাড়াতাড়ি ফাঁকা হয়ে গেল। সাশা চলে যাবার সময় বলছিল, তুমি কেন বসে আছ এখনও? চলে যাও।
    আমি যাচ্ছি বলে বেরিয়ে বাথরুমে গিয়ে কিছুক্ষণ রইলাম, ফিরে এসে দেখলাম ঘরের দরজা বন্ধ, চাবি দেওয়া। চাবি আমার কাছেও আছে। ভেতরে ঢুকে ভেতর থেকে চাবি দিয়ে তবে শান্তি। ঘরের আলো এখন আর জ্বালানো যাবে না। জানলা দিয়ে যেটুকু সূর্যের আলো আসছে আসুক। একটু অপেক্ষা করি। সবকটা গাড়ি বেরিয়ে যাক। শান্ত হয়ে গেছে পুরো জায়গাটা।
    সমস্ত কিছু রেডি করে বড়িগুলো খেতে শুরু করব, করিডোরে একটা শব্দ। কারও পায়ের আওয়াজ। সুইপার? অফিস ছুটি হতে না হতেই, এরই মধ্যে টয়লেট সাফ করতে এসে গেছে? না, শব্দটা এই ঘরের দরজার দিকেই এগিয়ে আসছে। দরজার একদম সামনে এসে থামল, দরজা ঠেলে খুলতে না পেরে চাবি বের করছে। আমি নিমেষে ওষুধগুলো লুকিয়ে নিঃশব্দে পাশের ছোট্ট ঘরটায় চলে গেলাম, ওটা ফোটোকপি করবার ঘর। ফোটোকপি মেশিনের পেছনে চুপ করে গুটিসুটি মেরে লুকিয়ে বসে আছি। লোকটা বড় ঘরে ঢুকেছে। ঘরটার মধ্যে ঘোরাফেরা করছে।
    এর পরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত। বড়ো ঘরে একটু ঘোরাফেরা করেই লোকটা ছোট ঘরে ঢোকে। ঢুকেই ক্যাননের সেই ফোটোকপি মেশিনটা অন করে দেয়। আমি প্রায় নিঃশ্বাস চেপে মেশিনের পেছনে লুকিয়ে। মেশিন অন হতে একটু সময় নেয়, লোকটা বেশ কয়েক পাতা ফোটোকপি করে, তারপরে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে আবার ফিরে এসে মেশিনটার সুইচ অফ করে গটগটিয়ে চলে যায়। বড়ো ঘরের দরজাটা চাবি ঘুরিয়ে বাইরে থেকে বন্ধ করে দেয়। তার চলে যাবার আওয়াজ ক্ষীণ হতে হতে ক্রমশঃ মিলিয়ে যায় সিঁড়ির দিকে।
    উঃ! বাঁচা গেল।
    লুকিয়ে থাকবার সময়ও উঁকি মেরে তার জুতো প্যান্ট দেখে নিয়েছি, মেশিন সুইচ অফ করে চলে যাবার সময়ও পেছন থেকে দেখে চিনেছি ― সের্গেই।
    একটু সময় অপেক্ষা করে ওখান থেকে বেরিয়ে জানলা দিয়ে নীচে উঁকি মেরে দেখে নিলাম সের্গেই ই। সে গাড়ি নিয়ে ফেরৎ এসেছিল অফিসে, কী মহামূল্যবান কাগজপত্তর ফোটোকপি করে নিয়ে গেল জানি না। মোটকথা আর কেউ আসবে না। আমি ধীরে ধীরে বড়িগুলো খেয়ে নিলাম। ঝপ করে সন্ধে নেমে আসবার মত চারিদিক অন্ধকার হয়ে আসছে, কম্পিউটারের কীবোর্ডটা ঠেলে সরিয়ে টেবিলে মাথা রাখলাম।
     
     
     
    (চলবে)
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:5195:1112:5618:e0b3 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৮:০৭735651
  • উপসংহার

    খুদা কি কসম মজা আ গয়া
    মুঝে মার কর বেসরম খা গয়া।
    খা গিয়া? লেকিন আপ তো জিন্দা হ্যায়!
    লেকিন এ জীনা ভি কোয়ি জীনা হ্যায় লাল্লু?

    মিঃ নটবরলাল, আনন্দ বক্সী

    সফল আত্মহত্যা হলে এই কাহিনি লেখা সম্ভব হতো না। কীভাবে বাঁচালাম, কে বাঁচালো, কখন বাঁচালো, তা মূল কাহিনির অংশ নয়। প্রতিপাদ্যও নয়।
                         
                                                            শেষ
     
  • জয় | ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০১:০৪735659
  • টপড়ে ফেলেছি সেদি। এক নিশ্বাসে প্রায়। এখন স্তব্ধবাক হয়ে বসে আছি! কমেন্টরুদ্ধ অবস্থা!!
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:111:8305:1c1c:a3e8 | ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০১:১২735661
  • যাচ্চলে! টপড়ে?
  • জয় | ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০১:১৯735662
  • বিশ্বাস করুন ট টা আমি টাইপাই নি! গুরুর রেসিডেন্ট ভুত!!
  • Amit | 220.240.134.33 | ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০২:১৭735663
  • এগুলো পড়ে আর ভালো খারাপ বলার অবস্থায় নেই। জাস্ট ভেবে যাচ্ছি এখনো এগুলো কি সব সত্যি হতে পারে ? মানে আমাদের রোজকার মধ্যবিত্ত ডালভাত খাওয়া জীবনের কাছে এগুলো এতটাই আলাদা যে বুঝে উঠতেও সময় লাগছে। 
     
    আপনার জীবনে যেসব ঝড় ঝঞ্জা সামলেছেন জানিনা তার 10% সামলাতে হলেও আমি আজকে কোথায় থাকতাম বা আদৌ থাকতাম কিনা। 
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:111:8305:1c1c:a3e8 | ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০২:২০735664
  • তাহলে আতান্তর টা একটু রয়ে সয়ে লিখি? ;-)
  • Amit | 121.200.237.26 | ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০২:৩৩735665
  • না না - আপনি ঝটাঝট লিখে ফেলুন। আমরা রয়ে সয়ে পড়বো ঠিক :) 
  • kaktarua | 192.82.150.101 | ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৮:১০735669
  • অনেকে দিন্ আগে একটা চাগ্রীর গল্প বলে একটা টই পড়েছিলাম। এটা কি সেই গল্প গুলোই? 
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:111:8305:1c1c:a3e8 | ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৫:০১735676
  • না। এটা সেখানে ছিল না।
  • Ranjan Roy | ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ২০:০৯735677
  • এই হাড়হিম করা গল্প ওই টই বা সে'র লেখা দুটো প্রকাশিত বই--কোথাও নেই।
  • kk | 2600:6c40:7b00:1231:34f0:5dbd:cf1b:f487 | ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৬:৪১735682
  • এটা খুব নাড়া দেওয়া একটা লেখা। কিন্তু আমি তো দেখছি নাড়া খেলামনা। তার বদলে লেখাটা মনের অনেক ভেতর অব্দি সেঁধিয়ে গেলো। বললে বিশ্বাস করবেন কিনা জানিনা, কিন্তু অনেক স্তরে আমি আপনার অনুভূতি খুব ভালো করে ছুঁতে পারলাম। একদম হাতে ধরে দেখার মত করে। এ'রকম ভাবে কমেন্ট লিখলে মনে হয় হাসির পাত্র হতে হয়। হাসির পাত্র হওয়া আমার অভ্যেস আছে অবশ্য। যা মনে হলো সৎ ভাবে লিখলাম।
    আমি একজন আলেকসান্দর কে চিনতাম। শান্তিনিকেতন, গার্লফ্রেন্ডের নাম রশ্মী এগুলোও মিলে যাচ্ছে (আমরা অবশ্য ভাবতাম 'রেশমী')। তার পদবী ছিলো প্রখোরভ।
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:f51d:2122:131b:f246 | ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৭:০৩735683
  • kk,
    হ্যাঁ। একদম ঠিক। 
  • | ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৬:১০735684
  • এই লেখাটা এখানে বোধয় আমিই একমাত্র যে আগে পড়েছি।  সেই বিদঘুটে গ্রুপটায়।  গোটা লেখাটায় আমার ওই কাপড়ে ডেটল ছেটানোটাই মারাত্মক হিংস্র আচড়ণ মনে হয়েছিল। 
  • | ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৬:১০735685
  • আচরণ
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল মতামত দিন