এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • ধর্ম, মৌলবাদ ও আমাদের ভবিষ্যৎ : কিছু যুক্তিবাদী চর্চা

    Debasis Bhattacharya লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২৫ ডিসেম্বর ২০২২ | ৪৯০২৯ বার পঠিত | রেটিং ৪.৫ (২ জন)
  • ইসলাম সম্পর্কে আলাদা করে দু-চার কথা

    মৌলবাদ নিয়ে এই ধরনের একটা লেখায় যদি কেউ ঘোষণা করেন যে, এইবার ইসলাম নিয়ে আলাদা করে কিছু বলা হবে, তখন পাঠকের সে নিয়ে একটা প্রত্যাশা তৈরি হতে পারে। কাজেই, এখানে গোড়াতেই সে ব্যাপারে পরিষ্কারভাবে বলে রাখা দরকার, না হলে পাঠক হয়ত বিভ্রান্ত ও ক্ষুব্ধ হবেন। সম্ভাব্য প্রত্যাশাটি এই রকম যে, মৌলবাদের স্বরূপ নিয়ে যখন চর্চা হচ্ছে, এবং তার মধ্যেই আলাদা করে ইসলাম নিয়ে চর্চার ঘোষণা হচ্ছে, তখন নিশ্চয়ই দেশে দেশে ইসলামীয় মৌলবাদের উৎপত্তি ও বিকাশ নিয়ে ঐতিহাসিক বিবরণ পাওয়া যাবে এখানে, বিভিন্ন স্থান-কালে তার সাধারণ বৈশিষ্ট্য ও বিশেষ বিশেষ বৈচিত্র্যের উল্লেখ পাওয়া যাবে, এবং অন্যান্য ধর্মের মৌলবাদের সঙ্গে তার মিল ও অমিল এবং তার কার্যকারণ ইত্যাদি বিষয়ক অনুসন্ধান ও তার ফলাফলও পাওয়া যাবে। হ্যাঁ, এখানে তা করতে পারলে ভালই হত, কিন্তু তার উপায় নেই। সেটা করতে গেলে আগে বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন ধর্মের মৌলবাদের কার্যকলাপ নিয়ে একটা সুনির্দিষ্ট ও বিস্তারিত আলোচনা সেরে রাখতে হত, তবেই তার প্রেক্ষিতে ইসলামীয় মৌলবাদের বৈশিষ্ট্যগুলো স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠতে পারত। দুঃখের বিষয়, সে পরিসর এখানে ছিল না, এখানে তো এতক্ষণ মৌলবাদ নিয়ে শুধু কতকগুলো অতি সাধারণ কথাই বলেছি। বলে রাখা দরকার, এখানে আমি সরাসরি সেইসব নিয়ে আলোচনার চেষ্টা করব না, যদিও যা আসলে বলব তার মধ্যে এ বিষয়ে আমার মতামত ও চিন্তাভাবনারও কিছু ইঙ্গিত হয়ত মিলবে। এখানে আমি মূলত কথা বলব ইসলাম ধর্ম ও সংশ্লিষ্ট মৌলবাদ প্রসঙ্গে আমাদের সমাজের মূলস্রোত ধ্যানধারণা নিয়ে, এবং তার ঠিক-বেঠিক নিয়েও। এ নিয়ে কথা বলব কারণ, আমার ধারণা, ভারতের মাটিতে দাঁড়িয়ে যাঁরা ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে লড়তে চান, তাঁদের এ বিষয়টি এড়িয়ে যাবার কোনও উপায় নেই।
     
    ওপরে বলেছি, যাঁরা ধার্মিক নন বরঞ্চ ‘ধর্ম’ জিনিসটার সমালোচক, তাঁদের মধ্যে ইসলাম নিয়ে দু রকমের ভাবনা বেশ পরিচিত। অনেকে মনে করেন, এই ‘মৌলবাদ’ সংক্রান্ত সমস্যাটা আসলে শুধুই ইসলামের সমস্যা, আর কারুরই নয় --- ধর্মের নামে ফতোয়াবাজি আর মারদাঙ্গা মূলত মুসলমানেরাই করছে। অন্যদের যদি আদৌ কিছু সমস্যা থেকেও থাকে, তো সেটা শুধু ইসলামি জঙ্গিপনার প্রতিক্রিয়া মাত্র। আবার, এ অবস্থানটি অন্য অনেকের দুশ্চিন্তারও কারণ। ইসলামি জঙ্গিপনার বিপদ স্বীকার করেও তাঁরা মনে করেন যে, এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে নির্দোষ ও নিরীহ আম মুসলমানের ঢালাও খলনায়কীকরণ হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে ছড়ানো হচ্ছে ঘৃণা বিদ্বেষ ও হিংস্রতা। প্রথম ভাবনাটি ভুল, কেন তার কিছু ব্যাখ্যা নিচে আছে।
     
    আর ওই দ্বিতীয় প্রকারের যে দুশ্চিন্তা, আমি এবং আমার মত অনেকেই যার শরিক, তার এক প্রতিনিধি-স্থানীয় দৃষ্টান্ত আমার হাতে এসেছে কয়েকদিন আগে, আমার এক তরুণ বন্ধুর সাথে ফেসবুকীয় কথোপকথনে। তিনি কে, সেটা এখানে প্রাসঙ্গিক না, কিন্তু তিনি আমাকে যে সব প্রশ্ন করেছেন তা বোধহয় অতিশয় প্রাসঙ্গিক। এখানে সেগুলো হুবহু উদ্ধৃত করলে হয়ত আমাদের আলোচ্য প্রশ্নগুলোকে সুনির্দিষ্ট আকার দিতে সুবিধে হবে। অবশ্য, এখানে উদ্ধৃত প্রত্যেকটি প্রশ্নগুলোর সুনির্দিষ্ট ও নিষ্পত্তিমূলক উত্তর দেওয়া এ লেখার উদ্দেশ্য ততটা নয়, যতটা হল মূল প্রশ্নগুলোকে চিহ্নিত করার মাধ্যমে সমস্যাটাকে আরেকটু স্পষ্ট করে তোলা। নিচে রইল সেই তরুণ বন্ধুর দুশ্চিন্তা-জারিত প্রশ্নগুলো।
     
    দাদা,

    একটা বিষয় একটু বিস্তারিত জানতে চাই আপনার কাছে। আপনি যদি সময় করে একটু ডিটেইলসে উত্তর দেন, খুব উপকৃত হই। অনেকদিনই এটা আপনাকে জিজ্ঞেস করব করব ভেবেছি, কিন্তু করা হয়নি, কারণ বিষয়টা একটু সেন্সেটিভ, আর প্রশ্নটা একটু বিস্তারে করতে হবে।

    ছোটবেলা থেকেই (ক্লাস ওয়ান থেকে) আমি দেখে এসছি, আমার পরিমণ্ডলে শুধুমাত্র ধর্মে মুসলিম হওয়ার জন্য মানুষকে সন্দেহের চোখে, বিদ্বেষের চোখে দেখা হয়। ক্রিকেটে পাকিস্তান জিতলে "কীরে, খুব আনন্দ বল!" বলে টন্ট কাটা হয়, কেবল নাম দেখে বাড়িভাড়া দিতে অস্বীকার করা হয়, এমনকি মুসলিম ছাত্র ক্লাসে ভাল রেজাল্ট করলেও "আশ্রম থেকে শেষে মুসলিম ফার্স্ট হবে" এরকম কথা খোদ টিচারের মুখেই শুনেছিআমি ঘটনাক্রমে মুসলিম পরিবারে জন্মাইনি, কিন্তু একদম ছোটবেলা থেকেই আমার মুসলিম বন্ধু বা প্রতিবেশীদের এভাবে সামাজিক হেট ক্যাম্পেনিং এর মুখে পড়াটা ভীষণ দুঃখজনক লাগে। এই খারাপ লাগাটা ক্লাস ওয়ান থেকেই শুরু হয়েছিল, তো তখন তো আমি ধর্ম ভাল না খারাপ, যুক্তিবাদ ভাল না খারাপ, এতকিছু তো বুঝতাম না।

    এখন মুসলিমবিদ্বেষকে যারা জাস্টিফাই করে, তাদের থেকে যে যুক্তিগুলো উঠে আসে, সেগুলো -

    ১) আর কোন ধর্মে আইসিস, তালিবান, বোকোহারামের মত সন্ত্রাসবাদী সংগঠন আছে?

    ২) "ওরা" (মুসলিমরা) সংখ্যায় বাড়লেই ইসলামিক রাষ্ট্র চায়, সংখ্যায় কমলেই ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র চায়।

    ৩) সব ধর্মে সংস্কার হয়েছে, কিন্তু "ওরা" এখনও মধ্যযুগেই পড়ে আছে।

    ৪) সব ধর্মেই বহুবিবাহ বন্ধ হয়েছে, কিন্তু "ওদের ধর্মে" বহুবিবাহ আজও জায়েজ, ওদের ধর্মে নারীর অবস্থা সবচাইতে খারাপ।

    ৫) "ওরা" নিজেদের বাঙালি মনে করে না, মননে চিন্তনে আরব, ওদের কাছে ধর্মই সব।

    ৬) ধর্মের নামে মানুষ হত্যা "ওদের ধর্মের মত কোন ধর্মই করেনি।"

    ৭) "ওদের" বাড়াবাড়ির জন্যই বিজেপির মত দলের সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ, হিন্দু মৌলবাদ ইসলামিক মৌলবাদের প্রতিক্রিয়ার ফসল।

    ইত্যাদি ইত্যাদি। আপাতত এই কটাই মনে পড়ছে।

    এখন আমার প্রশ্ন

    ১) মুসলিমবিদ্বেষীদের এই দাবিগুলো কি তথ্যগতভাবে সত্যি?

    ২) সত্যিই কি ইসলাম আর পাঁচটা ধর্মের থেকে ব্যতিক্রমী ভায়োলেন্ট? এখন তো যুক্তি, তথ্য, পরিসংখ্যানের বিভিন্ন মেথডলজি দিয়ে অনেক বিষয় কম্পারেটিভ স্টাডি করা যায়। "ইসলাম অন্য পাঁচটা ধর্মের থেকে ভায়োলেন্ট" - এই বিষয়টা কি যুক্তি, তথ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা যায়? মানে আমার প্রশ্ন, দাবিটার গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু?

    ৩) ধরে নিলাম, ইসলাম সবচাইতে ভায়োলেন্ট ধর্ম। কিন্তু তাতে করেই কি মুসলিমবিদ্বেষ জায়েজ হয়ে যায়?

    ৪) একজন নাস্তিক হিসাবে মুসলিম সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার হরণ করা হলে তার প্রতিবাদ করা কি অন্যায়?

    ৫) হিন্দু মৌলবাদ কি সত্যিই ইসলামিক মৌলবাদের প্রতিক্রিয়ার ফসল? ইসলামিক মৌলবাদ না থাকলে সত্যিই কি হিন্দু মৌলবাদ বলে কিছু থাকত না?

    ৬) আইসিস বা তালিবানের মত মুসলিম লিগ বা বর্তমানে মিমকে কি মৌলবাদী বলা যায়? নাকি "সাম্প্রদায়িক, কিন্তু মৌলবাদী নয়"-এমনটা বলা উচিত?

    আমার প্রশ্ন করার মূল কারণটা কিন্তু কোনভাবেই ইসলামকে ডিফেন্ড করা বা তার ভয়াবহতাকে লঘু করা নয়। আমিও ধর্মহীন সমাজের স্বপ্ন দেখি, সব ধর্মের মত ইসলামের অবসানও আশা করি।

    কিন্তু মধ্যবিত্ত শিক্ষিত স্তরে ইসলামের সমালোচনাটা যেভাবে হয়, তার টোনটা ঠিক যুক্তিবাদের নয়, টোনটা বিদ্বেষের। এখন রিলিজিয়াস ক্রিটিসিজমকে ঢাল করে বুঝে বা না বুঝে অনেক প্রগতিশীল মানুষও বিদ্বেষের টোন ব্যবহার করছেন। এটা খুব আশঙ্কার।

    এখন, এই প্রশ্নগুলোর প্রত্যেকটাকে আলাদা করে উত্তর দেবার চেষ্টা না করে বরং এ প্রসঙ্গে কতকগুলো সাধারণ কথা ভেবেচিন্তে দেখি। তাতে করে সমাধান না আসুক, অন্তত সমস্যাটার চেহারাটা আরেকটু স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠতে পারে কিনা, দেখা যাক। হতে পারে, ভাবতে গিয়ে হয়ত ওপরের দু-একটা প্রশ্ন শেষতক বাদই পড়ে গেল, বা উল্টোভাবে, যে প্রশ্ন এখানে নেই তেমন কিছু এসে কথার মধ্যে ঢুকে পড়ল।

    প্রথমেই বলা দরকার, অনেকে আধুনিক মৌলবাদী উত্থানকে মুসলমান জঙ্গি উত্থানের সঙ্গে এক করে দেখেন, যা মোটেই সঠিক নয়। বর্তমান পৃথিবীর প্রধান ধর্মীয় ধারাগুলোর সবকটির মধ্যেই মৌলবাদী উত্থান ঘটেছে, বিভিন্ন মাত্রা, ভঙ্গী ও ধরনে। আমেরিকায় খ্রিস্টান মৌলবাদীদের কথা আমরা জানি, জানি ইসরায়েলের ইহুদী মৌলবাদীদের কথা, জানি ভারতের হিন্দু মৌলবাদীদের কথা, এবং জানি এই ভারতেই আশির দশকে তেড়েফুঁড়ে ওঠা শিখ মৌলবাদীদের কথাও --- যাদের হাতে ভারতের এক প্রধানমন্ত্রী নিহত হয়েছিলেন। ‘অহিংসার ধর্ম’ বলে কথিত বৌদ্ধধর্মও এ প্রবণতার বাইরে নয় মোটেই। থাইল্যান্ড, বর্মা ও শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধ ধর্মের তরফেও জঙ্গি প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছে। আজ অনেকেরই হয়ত আর মনে নেই, দুহাজার এক সালের কুখ্যাত ‘নাইন ইলেভেন’-এর ঘটনার আগে পর্যন্ত সবচেয়ে বড় ধর্মীয় নাশকতার ঘটনা বলে ধরা হত উনিশশো পঁচানব্বই সালের দুটি ঘটনাকে। তার একটি ঘটেছিল আমেরিকার ওকলাহোমা সিটি-র ‘ট্রেড সেন্টার’-এ, যাতে বিস্ফোরক-ভর্তি ট্রাক দিয়ে ওই ভবনটিতে ধাক্কা মেরে প্রায় দেড়শো লোকের প্রাণনাশ করা হয়েছিল, এবং সেটা ঘটিয়েছিল কতিপয় খ্রিস্টান মৌলবাদী। অন্যটি ঘটেছিল জাপানে, যেখানে পাতাল রেলের সুড়ঙ্গে বিষাক্ত সারিন গ্যাসের কৌটো ফাটিয়ে দেওয়া হয়, তাতে বিষাক্ত গ্যাসে সরাসরি যত না মারা যায় তার চেয়ে অনেক বেশি লোক মারা যায় এবং গুরুতরভাবে জখম হয় সুড়ঙ্গের ভেতরে আতঙ্কগ্রস্তদের দৌড়োদৌড়িতে পদপিষ্ট হয়ে --- এবং সেটা ঘটিয়েছিল কট্টরপন্থী বৌদ্ধদের একটি ক্ষুদ্র উপগোষ্ঠী। আমরা বৌদ্ধধর্মটা অন্তত অহিংস বলে জানতাম, তাই না? তার দু বছর আগে উনিশশো তিরানব্বই সালে ভারতে সংঘটিত কুখ্যাত ‘বম্বে বিস্ফোরণ’ অবশ্যই একটি বৃহৎ নাশকতা, এবং সেটা ঘটিয়েছিল মুসলমান জঙ্গিরাই। কিন্তু, মুসলমান মৌলবাদীদের বক্তব্য অনুযায়ী, সেটা ছিল তার এক বছর আগে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের প্রতিক্রিয়া। বলা বাহুল্য, এই বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনাটিকেও আবার মুসলমানদের অত্যাচারের প্রতিক্রিয়া বলেই দেখানো হয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, সেটা কোনও সাম্প্রতিক ‘অত্যাচার’-এর প্রতিক্রিয়া ছিল না। হিন্দু মৌলবাদীদের নিজেদের দাবি অনুযায়ীই, এটা নাকি মোগল সম্রাট বাবরের তরফে ঘটে যাওয়া পাঁচশ বছরের পুরোনো এক অন্যায়ের প্রতিকার মাত্র! এবং, এই বাবরি মসজিদের ধ্বংসও আবার এ দেশে ধর্মীয় নাশকতার প্রথম ঘটনা নয়, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাও নয়। এ দেশে আজ পর্যন্ত ধর্মীয় নাশকতার সবচেয়ে বড় ঘটনা বলে যদি কোনও বিশেষ ঘটনাকে ধরতেই হয়, তো সেটা সম্ভবত উনিশশো চুরাশি সালে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধিকে হত্যা করার ঘটনা। সেটা মুসলমানেরা ঘটায়নি, ঘটিয়েছিল শিখ মৌলবাদীরা।

    ধর্মের সমালোচনা যে আধুনিক পৃথিবীর অন্যতম প্রধান কাজ, তাতে সন্দেহ নেই। সমালোচনা মানে সব ধর্মেরই সমালোচনা, ইসলামেরও।  কিন্তু, ইসলাম ধর্মের সমালোচনায় একটি ভুল আমরা প্রায়শই করে থাকি। আমরা বলি, ইসলাম ধর্ম (এবং সেইহেতু ওই ধর্মাবলম্বীরাও) তো হিংস্র হবারই কথা, কারণ, ইসলামীয় ধর্মশাস্ত্রে হিংসার উপাদান খুব বেশি আছে। হয়ত সত্যিই আছে, কিন্তু যুক্তিটা তা সত্ত্বেও ভুল, এবং দুটো দিক থেকেই ভুল। কারণ, প্রথমত, সব ধর্মশাস্ত্রেই হিংসার উপাদান কমবেশি আছে। এবং দ্বিতীয়ত, যে ধর্মের শাস্ত্রে হিংসার উপাদান কিছু কম আছে সে ধর্মগোষ্ঠীর মানুষের আচরণে হিংসা কম থাকবেই --- এ প্রত্যাশার ভিত্তিটাও বোধহয় খুব পোক্ত নয়।
     
    হিংস্রতার বর্ণনা ও তার নৈতিক সমর্থন হিন্দু শাস্ত্রগুলোতে কোরানের চেয়ে কিছু কম নেই। কম নেই বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টেও, যদিও, হয়ত বা সত্যিই কিছু কম আছে নিউ টেস্টামেন্টে।  আবার, শাস্ত্রগ্রন্থে হিংস্রতার বর্ণনা কম থাকলেই যে ধার্মিকেরা কিছু কম হিংস্র হবেন, এমন নিশ্চয়তাও পাওয়া কঠিন। যুদ্ধলিপ্সা, হত্যা এবং হিংস্রতায় যিনি প্রবাদপ্রতিম, সেই চেঙ্গিস খান কিন্তু মোটেই মুসলমান ছিলেন না, 'খান' পদবী দেখে যা-ই মনে হোক।  খ্রিস্টানরা ষোড়শ-সপ্তদশ শতক জুড়ে আমেরিকাতে স্থানীয় অধিবাসীদের বিরুদ্ধে যেভাবে হত্যালীলা চালিয়েছে নিউ টেস্টামেন্টের যাবতীয় ক্ষমার বাণী সত্ত্বেও, তা ইতিহাসে বিরল। মধ্যযুগের শেষে এবং আধুনিক যুগের গোড়ায় 'ক্ষমাশীল' খ্রিস্টানদের ডাইনি পোড়ানোর হিড়িক দেখে আতঙ্কে শিউরে ওঠেন না, এমন কেউই কি আছেন এ যুগে? 'ইসলামিক স্টেট' তার ঘোষিত 'বিধর্মীদের' হত্যা করে হত্যার উদ্দেশ্যেই, বা প্রতিশোধের উদ্দেশ্যে, এবং সেটা সারা জগতের লোককে ডেকে দেখানোর জন্যেও বটে। দেখ হে, আমরা কত ভয়ঙ্কর, কত বড় বীর, এই রকম একটা ভাব। কিন্তু মধ্যযুগের খ্রিস্টানরা ডাইনি মারত ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা দিয়ে, এবং যন্ত্রণা দেওয়াটাই সেখানে মূল উদ্দেশ্য, যাতে অকথ্য অত্যাচার করে তার মুখ থেকে অন্য আরেক ‘ডাইনি’-র নাম বার করে আনা যায়। এই কাজটির জন্য তারা বিচিত্র ও বীভৎস সব কলা-কৌশল ও যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করেছিল। কাজেই, বিশেষ একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর ধর্মান্ধতা ও ধর্মীয় হিংস্রতার সঙ্গে তার শাস্ত্রীয় অনুমোদনের একটা সহজ সরল সম্পর্ক ধরে নেওয়াটা বোধহয় সব সময় খুব নিরাপদ নয়।

    মুসলমানদের হিংস্রতার মতই আরেকটি বাজে গল্প আছে মুসলমানদের জনসংখ্যাবৃদ্ধি নিয়ে। মুসলমানদের হুহু করে বংশবৃদ্ধি হচ্ছে, এবং দ্রুত তারা হিন্দুদেরকে ছাপিয়ে গিয়ে গোটা দেশটাকে দখল করে ফেলবে, এই মিথ্যে আতঙ্কটা হচ্ছে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রচারের অন্যতম প্রধান বিষয়বস্তু, বহু মানুষই যা সরলমনে বিশ্বাস করেন। এখানে বলে নেওয়া দরকার, মুসলিম জনসংখ্যা যে বাড়ছে এবং তার হার যে হিন্দুদের চেয়ে এখন পর্যন্ত কিছু বেশিই বটে, এটা কিন্তু মিথ্যে নয়। মিথ্যে হল এই প্রচারটা যে, এইভাবে বাড়তে বাড়তে হিন্দুদের চেয়ে তাদের সংখ্যা নাকি বেশি হয়ে যাবে, এবং তারাই দেশটাকে গ্রাস করে ফেলবে। আসলে ঘটনা হল, সব ধর্মের জনসংখ্যাই বাড়ছে, এবং সংখ্যালঘুদের জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার সব দেশেই সংখ্যাগুরুদের চেয়ে সামান্য একটু বেশি হয়, যদি সেখানে সংখ্যালঘু নিধন না চলে, এবং বিশেষত যদি সে সংখ্যালঘুরা অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া হয়। জনসংখ্যাবৃদ্ধির আসল যোগটা ধর্মের সঙ্গে নয়, অর্থনীতির সঙ্গে। হিন্দু জনগোষ্ঠীর মধ্যেও গরিবদের জনসংখ্যাবৃদ্ধি যদি আলাদা করে হিসেব করা হয় তো দেখা যাবে যে তা সচ্ছল হিন্দুদের চেয়ে অনেক বেশি। সম্পন্নরা ভাল রোজগার করতে চায়, ভালভাবে থাকতে চায়, এবং সন্তানের জীবনযাপনও যাতে সে রকমই হয়, সে ব্যবস্থা করতে চায়। তারা জানে যে সেটা করতে গেলে সন্তানকে উচ্চমানের শিক্ষাদীক্ষা দেওয়া দরকার, তার পেছনে ভাল করে যত্ন ও খরচাপাতি করা দরকার, এবং সেটা করার ক্ষমতাও তাদের আছে। ছেলেপুলে বেশি হলে তা সম্ভব নয়, এবং তাতে করে বাচ্চার মায়ের স্বাস্থ্যের বারোটা বাজবে, মা ঘরের বাইরে গিয়ে পেশাগত কাজকর্ম করে অর্থ উপার্জনও করতে পারবে না। ফলে, তারা বেশি সন্তান একদমই চায় না। উল্টোদিকে, গরিবরা এত কথা জানেও না আর তাদের সে ক্ষমতাও নেই। ফলে তারা যত বেশি সম্ভব সন্তান চায়, সেটা মায়ের স্বাস্থ্যহানি ও মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে হলেও। গরিবরা জানে তাদের সন্তান দুধেভাতে থাকবে না, এবং শেষপর্যন্ত কোনও শ্রমসাধ্য কাজেই যোগ দেবে যাতে শিক্ষা বা 'স্কিল' সেভাবে লাগে না। ফলে, সন্তানের সংখ্যা বেশি হলে দুরবস্থা আর অযত্নের মধ্যেও হয়ত রোগভোগ মৃত্যু এড়িয়ে কেউ কেউ টিঁকে যাবে, আর পরিশ্রম করে পরিবারের আয় বাড়াতে পারবে, যৎসামান্য হলেও। অথচ এদেরই যখন অর্থনৈতিক উন্নতি হবে, তখন এরা মেয়েদেরকে পড়াশোনা শেখাতে চাইবে, ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সন্তানকে কেরানি-আমলা-ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-উকিল এইসব বানাতে চাইবে, ফলে স্বল্পসংখ্যক সন্তান চাইবে, এবং মায়ের জীবন ও স্বাস্থ্যকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করবে। একটু ভাল করে খোঁজখবর করলেই জানা যাবে, অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ঘটছে কিন্তু আসলে ঠিক তাইই, হিন্দু ও মুসলমান উভয়ের ক্ষেত্রেই। এবং, মুসলমানরা পিছিয়ে আছে বলেই তাদের অগ্রগতিও দ্রুততর। তাদের জন্মহারের বৃদ্ধি কমছে কিছু বেশি দ্রুতলয়ে। এভাবে চললে আর দেড় দুই দশক পরেই হয়ত হিন্দু-মুসলমানের জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার সমান হয়ে যাবে, এবং মুসলমানদের ভারত দখলের কুৎসিত অশিক্ষিত গল্পতেও তখন আর কেউই পাত্তা দেবে না। ইতিহাসের স্বাভাবিক গতি এই দিকেই।
     
    এখানে 'অগ্রগতি' বলতে জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার কমিয়ে আনার কথা বুঝিয়েছি। মুসলমানদের ক্ষেত্রে এই কমিয়ে আনাটা হিন্দুদের চেয়ে বেশি হারে ঘটছে (বৃদ্ধির হার কমে যাওয়া মানে জনসংখ্যা কমে যাওয়া নয় কিন্তু, এ হার কমতে কমতে শূন্যের নিচে নামলে তবেই জনসংখ্যা কমতে শুরু করবে)। এই কমে আসাটা উন্নয়নের পরোক্ষ সূচক। এভাবে চলতে থাকলে কিছুদিন বাদে যে হিন্দু-মুসলমানের জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার সমান হয়ে যাবে তাতে সন্দেহ নেই।  পিছিয়ে আছে বলেই অগ্রগতি বেশি তাড়াতাড়ি হচ্ছে --- এ কথাটা হয়ত অনেককে বিস্মিত করতে পারে, কিন্তু কথাটা বলার কারণ আছে। নিশ্চয়ই জানেন, ভারত চিন ব্রাজিলের মত একটু এগিয়ে থাকা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার ইউরোপ আমেরিকার উন্নত দেশগুলোর থেকে বেশি। এর কারণ হচ্ছে, একবার উন্নত হয়ে গেলে একই গতিতে আরও আরও উন্নত হতে থাকাটা ক্রমশই আরও বেশি বেশি করে কঠিন হয়ে ওঠে, তাই উন্নয়নের প্রথম দিকে বৃদ্ধির যে গতি থাকে পরের দিকে আর তত গতি থাকে না। মুসলমানদের জনসংখ্যার ক্ষেত্রেও তাইই ঘটছে, এবং আরও ঘটবে (ও দুটোকে খুব নিখুঁতভাবে মেলানোর দরকার নেই, যদিও)।

    আমরা যারা এই বিষয়গুলোকে এইভাবে ভাবার চেষ্টা করি, তাদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ আসে প্রায়শই, ফেসবুকে সে গর্জন রোজই শোনা যায়। এখন, এটা তো সত্যি কথাই যে, পশ্চিমবাংলার যুক্তিবাদীদের লেখালিখিতে, এবং যথারীতি আমার নিজের লেখাতেও, হিন্দু মৌলবাদের সমালোচনাই বেশি আসে, মুসলমান মৌলবাদের কথা বাস্তবিকই আসে অনেক কম। ঠিক এই অভিযোগটি সেক্যুলারদের প্রতি হিন্দু মৌলবাদীরা করে থাকেন নিয়মিতই (বস্তুত, প্রত্যেক ধর্মের মৌলবাদীরাই তাদের নিজস্ব গোষ্ঠী বা সমাজের সেক্যুলারদের প্রতি এই একই অভিযোগ করে থাকে)। কিন্তু একটু ভাবলে বুঝবেন, এটাই প্রত্যাশিত ও স্বাভাবিক। এবং, অন্যরকম কিছু হলেই বরং অত্যন্ত অস্বাভাবিক ও অসঙ্গত হত, এমন কি অন্যায়ও হত। কেন, তার একাধিক কারণ আছে। প্রথমত, এ দেশের রাষ্ট্র ও সমাজ যে মৌলবাদী হুমকিটির মুখোমুখি, সেটা তো হিন্দু মৌলবাদই, অন্য কোনও মৌলবাদ নয়। শিক্ষা-প্রশাসন-বিচারব্যবস্থার ধর্মীয়করণ, সংবিধানকে পাল্টে দেবার পরিকল্পনা, ভিন-ধর্মীদের ওপর দমন-পীড়ন, ধর্মের জিগির তুলে তার আড়ালে সরকারি সম্পত্তি পাচার --- এ সব তো মুসলমানরা করছে না, হিন্দুত্ববাদীরাই করছে। অতএব, তাদের মুখোশ খোলাটাই এখানে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক। মুসলমান জঙ্গিরা নাশকতা ঘটালে তার মোকাবিলার জন্য পুলিশ-মিলিটারি আছে, কিন্তু নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসা মৌলবাদীদের রোখবার দায়িত্ব তো আর পুলিশ-মিলিটারি নেবে না, সেটা সাধারণ ভারতীয় নাগরিকের কাজ। আমি যে দেশে এবং যে ধর্মীয় সমাজের মধ্যে বাস করি, সেখানে যারা অন্ধত্ব ও হিংস্রতা ছড়াচ্ছে, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রকে বিনাশ করছে, তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোটাই তো আমার পক্ষে স্বাভাবিক, তাই না? বাংলাদেশি মুক্তমনারা যদি মুসলমান ধর্ম ছেড়ে হিন্দুদেরকে গালি দিতে থাকতেন, বা বার্ট্র্যান্ড রাসেল যদি 'হোয়াই আই অ্যাম নট আ ক্রিশ্চান' না লিখে 'হোয়াই আই অ্যাম নট আ হিন্দু' লিখে বসতেন, তাহলে যেমন উদ্ভট অসঙ্গত কাজ হত, এখানে আমরা হিন্দু ধর্ম ছেড়ে মুসলমান নিয়ে পড়লেও ঠিকই একই ব্যাপার হবে (যদিও বাংলাদেশি মুক্তমনারা ঠিক যা বলেন এবং যেভাবে বলেন, তার অনেক কিছুর সঙ্গেই আমার দ্বিমত আছে, তবে সেটা এখানে প্রাসঙ্গিক না)। দ্বিতীয়ত, আমরা পশ্চিমবঙ্গের বেশির ভাগ মুক্তমনা যুক্তিবাদী নাস্তিকেরা হিন্দু সমাজে জন্মেছি বলেই সে সমাজ ও তার ধর্ম শাস্ত্র রীতিনীতি আচার বিচার এইসব অনেক বেশি জানি, ফলে সে ব্যাপারে আমাদের সমালোচনা অনেক বেশি নিরেট, নির্ভুল এবং অর্থবহ হয়, যা ভিনধর্মী সমাজে যারা জন্মেছে তারা পারবেনা। ঠিক একই কারণে, মুসলমান সমাজ ও ধর্ম সম্পর্কে মুসলমান সমাজে জন্মানো যুক্তিবাদীদের সমালোচনা অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য ও ফলপ্রসূ হয়। যদিও, এর মানে মোটেই এই নয় যে এক ধর্মে জন্মানো লোক অন্য ধর্মের সমালোচনা করতেই পারবেনা --- যে কোনও মানুষের যে কোনও ধর্মের সমালোচনা করার অধিকার আছে, এবং করা উচিত। তবে কিনা, নিজের সমাজের অন্ধত্ব অযুক্তি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথমে সোচ্চার হওয়াটা যে কোনও মানুষেরই ‘স্বাভাবিক’ অধিকার, কর্তব্যও বটে।
     
    আচ্ছা, তা সে যা-ই হোক, মোদ্দা কথাটা তাহলে কী দাঁড়াল --- মুসলমানেরা ধর্মান্ধতায় অন্যদের চেয়ে এগিয়ে, না পিছিয়ে? এসব ঠিকঠাক বলতে গেলে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে পৃথিবীজোড়া সমীক্ষার নির্ভরযোগ্য ফলাফল চাই, না হলে সবটাই চায়ের দোকানের আড্ডা হয়ে যাবে। আপাতত আছে কি সে সব, আমাদের হাতে? সুখের বিষয়, সে সব আছে। এই কিছুদিন মাত্র আগেও সেভাবে ছিল না, কিন্তু এই একুশ শতকে বেশ ভালভাবেই আছে। বেশ কয়েকটি বিখ্যাত সংস্থা এখন মানুষের জীবনের নানা দিক নিয়ে প্রামাণ্য সমীক্ষা করে থাকে, তার মধ্যে ধর্মবিশ্বাসও পড়ে। এইসব সমীক্ষার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে বড় বড় বিশেষজ্ঞরা নানা গভীর গবেষণাও করে থাকেন, এবং তাতে তেমন চমকপ্রদ কোনও ফলাফল পাওয়া গেলে সারা পৃথিবীর গণমাধ্যমে সে নিয়ে আলোড়ন উঠে যায়। এই রকমই একটি সংস্থা হল ‘উইন গ্যালাপ’। তারা সারা পৃথিবী জুড়ে মানুষের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে এক বিখ্যাত সমীক্ষা চালিয়েছিল ২০১২ সালে, তাতে বিভিন্ন ধর্মগোষ্ঠীর মধ্যে ধর্মবিশ্বাসের প্রাবল্য, ধর্মবিশ্বাস ছেড়ে বেরিয়ে আসা মানুষের সংখ্যা, এইসবের হিসেব ছিল। তাতে কি দেখা গেল? নিচে দেখে নিন ২০১২ সালের পৃথিবীজোড়া সমীক্ষার ফলাফল, সুন্দর করে সারণিতে সাজানো। এখানে পরিষ্কারভাবেই দেখা যাচ্ছে, নিজেকে বিশ্বাসী বলে দাবি করেন অথচ ধার্মিক বলে দাবি করেন না --- এমন মানুষের অনুপাত মুসলমানদের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি। কারা কবে সমীক্ষাটি করেছে, এবং তা কোন নথিতে প্রকাশিত, সব তথ্যই পাবেন এখানে।
     
     
    এবার একটি ইসলামীয় দেশকে নিয়ে ভাবা যাক, যেখানে প্রায় সর্বাত্মক মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং ইসলামীয় রাষ্ট্র আছে। ধরুন, ইরান। এই  দেশটা সম্পর্কে আপনি কী জানেন? জানি, এ প্রশ্নের উত্তরে প্রায় সকলেই একই কথা বলবেন। ছিয়ানব্বই দশমিক পাঁচ শতাংশ (সরকারি সেন্সাসের তথ্য অনুযায়ী) মুসলমান অধ্যুষিত একটি ধর্মান্ধ দেশ, যার মধ্যে আবার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা শিয়া মুসলমানদের। কট্টর মৌলবাদীরা সেখানে দেশ চালায়, প্রশ্ন করলেই কোতল হতে হয়, মুক্তচিন্তা কল্পনাতীত। সম্প্রতি সেখানে হুলুস্থুলু ঘটে গিয়েছে, সে সব খবরাখবর আপনারা দেখেছেন। একটি মেয়েকে ইসলাম-সম্মত পোশাক না পরার অপরাধে সেখানে হত্যা করা হয়েছে, তাই নিয়ে প্রবল আন্দোলন হলে রাষ্ট্রের তরফে নেমে এসেছে দমন-পীড়ন, এবং সদ্য-সমাপ্ত ফুটবল বিশ্বকাপে সারা পৃথিবীর সামনে তার প্রতিবাদ করায় সে দেশের জাতীয় দলের এক খেলোয়াড়কে দেওয়া হয়েছে মৃত্যুদণ্ড। এখানে মৌলবাদের দাপটের ছবিটা একদমই স্পষ্ট, আবার গণমানুষের আপত্তিটাও খুব আবছা নয়।

    আসলে, এখানে ধর্মীয় রাষ্ট্রের দোর্দণ্ডপ্রতাপের তলাতেই লুকিয়ে আছে অন্য এক বাস্তবতা। নেদারল্যান্ডের একটি গবেষণা সংস্থা (GAMAAN), ইরানই যাদের অনুসন্ধানের বিষয়বস্তু, তারা ২০২০ সালে  ইরানে সমীক্ষা চালিয়ে দেখেছে। সে সমীক্ষার ফলাফল যদি বিশ্বাস করতে হয়, তো সেখানে সাঁইত্রিশ শতাংশ মত লোক নিজেদের মুসলমান বলে দাবি করেন (শিয়া-সুন্নি মিলিয়ে), যাঁরা কোনও ধর্মীয় পরিচয় দিতে রাজি নন তাঁরা বাইশ শতাংশ, যাঁরা পরিষ্কারভাবে নিজেকে নাস্তিক-অজ্ঞাবাদী-মানবতাবাদী এইসব বলে পরিচয় দেন তাঁরা সব মিলিয়ে প্রায় সতেরো শতাংশ, যাঁরা নিজেকে শুধুই 'স্পিরিচুয়াল' বলেন তাঁরা প্রায় সাত শতাংশ, এবং বাকিরা আরও নানা বিচিত্র ধর্মের মানুষ। নিচের ছবি দুটোয় সমীক্ষার ফলাফল এক নজরে পাওয়া যাবে। হ্যাঁ বন্ধু, একুশ শতকে পৃথিবী বদলাচ্ছে, এবং হয়ত বিশ শতকের চেয়েও দ্রুত গতিতে! এবং, ইসলামীয় দেশগুলো কোনওভাবেই এ প্রবণতার বাইরে নয়। নিচে সে সমীক্ষার ফলাফল দেখুন, চিত্রাকারে।
     
     
    ধর্ম, ঈশ্বর, স্বর্গ, নরক, মৃত্যু-পরবর্তী জীবন, অবতার ইত্যাদি ধ্যানধারণা বিষয়ে ইরান-বাসীদের বিশ্বাস (বা অবিশ্বাস) ঠিক কী রকম, সে চিত্রও উঠে এসেছে সমীক্ষা থেকে। নিচে দেখুন।
     
     
     
    তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, মুসলমানদের ধর্মপ্রীতি নিয়ে আমাদের অধিকাংশের মধ্যে যেসব জনপ্রিয় ধ্যানধারণা আছে, তার সমর্থন এইসব সমীক্ষার ফলাফল থেকে মিলছে না মোটেই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যে ইঙ্গিত এখান থেকে আমরা পাচ্ছি, সেটা সামগ্রিক বৈশ্বিক প্রবণতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, নাকি একটা সম্পূর্ণ আলাদা উল্টোপাল্টা কিছু। সেটা বুঝতে গেলে বর্তমান শতকের বিগত কয়েকটি দশকে গোটা পৃথিবীর ধর্মবিশ্বাসের গতিপ্রকৃতি এক নজরে দেখে নেওয়া দরকার। এমনিতে সেটা একটু মুশকিল, কারণ, তার জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সংস্থার করা অনেকগুলো সমীক্ষা-কর্ম খুঁটিয়ে দেখে সেগুলোর প্রাসঙ্গিক ফলাফলটুকু বেছে নিয়ে তুলনা করতে হবে। সেইজন্যে, আমি যতটা পেরেছি সেগুলোকে সাজিয়ে একটা মাত্র সারণিতে নিয়ে এসেছি, তাতে পাঠিকের কিছু সুবিধে হবার কথা। সেটা নিচে দিলাম, দেখুন। সারণির কোন সংখ্যাটি কোন সংস্থার করা কবেকার সমীক্ষায় পাওয়া গেছে, সেটা ওখানেই দেওয়া আছে। প্রথম সংখ্যাটি অবশ্য কোনও সংস্থার তরফে দেওয়া নয়। এটি দিয়েছিলেন সমাজতত্ত্ববিদ ফিলিপ জুকারম্যান, তখন পর্যন্ত প্রাপ্য সমস্ত টুকরো টুকরো সমীক্ষার ফলাফল এক জায়গায় করে।
     
     
     
     
    এবার নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছে, মুসলমানদের ধর্মবিশ্বাসের গতিপ্রকৃতি অন্য ধর্মাবলম্বীদের থেকে খুব বেশি আলাদা নয়। আসলে, এই একুশ শতকে দাঁড়িয়ে, সব ধর্মগোষ্ঠীর মধ্যেই ধর্মবিশ্বাস ছেড়ে বেরিয়ে আসার যে প্রবণতা রয়েছে, মুসলমানরা কোনও মতেই সে প্রবণতার বাইরে নয় (অবশ্যই, এ হিসেব সামগ্রিক ও বৈশ্বিক, এবং অঞ্চল ও অন্যান্য পরিস্থিতি-ভেদে মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য আছে)।

    কেন এই জগৎজোড়া প্রবণতা? আমাদের স্বাভাবিক বুদ্ধি বলবে, সবই যুগের হাওয়া। মানে, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অগ্রগতি এবং গণতন্ত্র-মানবতাবাদ-যুক্তিবাদ এইসবের প্রভাবই এর কারণ। কথাটা সত্যি, কিন্তু সমাজবিদেরা এর চেয়েও বড় কারণ আবিষ্কার করেছেন। তাঁরা আজ সুপ্রচুর তথ্য-যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছেন, মানব সমাজের উন্নতির সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক বিপ্রতীপ। দেশের মাথাপিছু আয় বাড়লে, সমাজকল্যাণে সরকার বেশি বেশি খরচা করলে, অর্থনৈতিক অসাম্য কমলে এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের হাল ভাল হলে ধর্মের রমরমা কমতে থাকে (এখানে আর বিস্তারে যাব না, যদিও আগে এ নিয়ে আলোচনা করেছি এবং পরেও করব)। সমাজ-বিকাশের এই সাধারণ নিয়ম মুসলমান সমাজের ওপরে প্রযোজ্য হবে না, এমনটা  ভেবে নেওয়ার কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। ইরানে যা ঘটছে, সেটা সমাজ-বিকাশের এই সাধারণ নিয়মের চাপেই। নেটে একটু খোঁজাখুঁজি করলেই দেখতে পাবেন, ইরানের মাথাপিছু উৎপাদন ভারতের প্রায় আটগুণ, বাজেটের শতাংশ হিসেবে স্বাস্থ্যখাতে সরকারি খরচ প্রায় সাতগুণ এবং শিক্ষাখাতে তা দেড়গুণেরও বেশি, এবং নারী ও পুরুষ উভয়েরই আয়ু আমাদের থেকে ভাল (গণতন্ত্র আর মানবাধিকারের দশা শোচনীয়, যদিও)। কাজেই, ইরানে মৌলবাদী রাজনীতি ও প্রশাসনের ওপর কেন গণ-অসন্তোষের চাপ আছে এবং পাকিস্তান আর আফগানিস্তানে কেন তা ততটা নেই --- এইটা বুঝতে পারা খুব কঠিন না।

    বলা প্রয়োজন, সমাজ-বিকাশজাত এই চাপের খেলা সুস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান উন্নত পশ্চিমী দেশগুলোতেও, বিশেষত এই একুশ শতকে। এই সেদিন পর্যন্ত আমেরিকা আর আয়ার্ল্যান্ডে ধর্মবিশ্বাসের প্রাবল্য ছিল অন্যান্য উন্নত দেশের চেয়ে অনেক বেশি। ধার্মিক সমাজবিদেরা তাই দেখিয়ে বলতেন, অর্থনৈতিক উন্নতি হলেই ধর্মের রমরমা কমবে, এটা হচ্ছে গিয়ে প্রগতিবাদীদের বানানো একটা মিথ্যে কথা। কিন্তু সময় যতই গড়াচ্ছে ততই বিষয়টা জলের মত স্বচ্ছ হয়ে আসছে, এবং আপত্তি তোলবার পরিসর হয়ে আসছে অতিশয় সঙ্কুচিত। মার্কিন সমাজে ধর্মবিশ্বাসের পরিবর্তনটা দেখতে পাবেন এক নজরেই, নিচের লেখচিত্রে। লক্ষ করে দেখুন, ১৯৫০ সাল থেকে ২০২০ পর্যন্ত আমেরিকাতে যখন খ্রিস্টানরা এসে ঠেকেছে ৮৫ শতাংশ থেকে ৬৯-এ, এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা যখন মোটের ওপর একই আছে, তখন ধর্মহীনদের শতকরা অনুপাত গিয়ে ঠেকেছে শূন্য থেকে একুশে (অন্য কিছু সমীক্ষায় এটি প্রায় তিরিশ বলে দেখানো হয়েছে, যদিও)।
     
     
     
    আর, এই শতকের প্রথম দশকে আয়ার্ল্যান্ড-বাসীর ধর্মবিশ্বাসে যা ঘটেছে, সেটা দেখে নিন নিচের সারণিতে। আয়ার্ল্যান্ড হল গোঁড়া ক্যাথোলিক অধ্যুষিত একটি দেশ। একটা উন্নত পশ্চিমী দেশের পক্ষে অবিশ্বাস্যভাবে, এই সেদিন পর্যন্তও এই দেশটিতে গর্ভপাত নিষিদ্ধ ছিল, এবং গর্ভপাতের দরকার পড়লে আইরিশ নারীদেরকে পার্শ্ববর্তী ব্রিটেনে গিয়ে হাজির হতে হত। তারপর উন্নত আধুনিক অর্থনীতির সঙ্গে রক্ষণশীল ধর্ম-সংস্কৃতির দীর্ঘ সংঘর্ষের ফলাফল তখনই সারা বিশ্বের নজরে এল, যখন দু হাজার আঠেরো সালে গর্ভপাত আইনসিদ্ধ হয়ে গেল (আয়ার্ল্যান্ড নিয়ে আমার আলাদা একটি লেখা ‘গুরুচণ্ডালি’-তে পাবেন)।
     
     
    বলা বাহুল্য, মোটের ওপর এই একই ঘটনা ঘটবার কথা মুসলমান-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতেও, এবং ঘটছেও তাইই। বেশ কয়েকটি ধর্ম-শাসিত রক্ষণশীল দেশে কমছে কঠোর ধর্মীয় বাধানিষেধ, বাড়ছে ধর্মহীনতা, এবং সাধারণ্যে কমছে ধর্মের প্রতি আনুগত্য, যদিও অনেক ক্ষেত্রেই তা  এখনও স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান নয়। বিষয়টাকে যদি খুঁটিয়ে নজর করা হয়, তাহলে এমন অনেক কিছুই হয়ত জানা যাবে, যে ব্যাপারে আমরা আগে সচেতন ছিলাম না। যেমন, ইরান-ইরাক-আফগানিস্তান যেভাবে ধর্মনিরপেক্ষ থেকে ধর্মীয় রাষ্ট্র হয়ে গেল, এবং যেভাবে তুর্কি দেশটিতে ক্রমেই শক্ত হচ্ছে মৌলবাদের মুঠি আর টলমল করছে ধর্মনিরপেক্ষতার আসন, সে নিয়ে আমরা প্রায়শই দুশ্চিন্তিত হই। ঠিকই করি। কিন্তু, আমরা কখনই খেয়াল করে দেখিনা যে, এই ধরাধামে একান্নটি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের মধ্যে একুশটিতে কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ সরকারই চলছে (সে ধর্মনিরপেক্ষতার দশা প্রায়শই আমাদের চেয়ে খুব একটা ভাল নয় যদিও, তবে সেটা তো অন্য চর্চা)। এবং, ধর্মনিরপেক্ষীকরণের প্রক্রিয়া এখনও চালু, সে তালিকায় এই সেদিনও যুক্ত হয়েছে সুদান।

    তবুও প্রশ্ন আসতেই পারে, এবং আসবেও, জানা কথা। ওপরে উদ্ধৃত আমার তরুণ বন্ধুর ভাষায়, সে প্রশ্নটা এ রকম --- “আর কোন ধর্মে আইসিস, তালিবান, বোকোহারামের মত সন্ত্রাসবাদী সংগঠন আছে?”। সত্যিই তো, প্রশ্ন হতেই পারে। ওপরে ব্যাখ্যা করেছি (এবং পূর্ববর্তী পর্বগুলোতেও), মৌলবাদী উত্থান সব ধর্মেই হয়েছে, শুধু ইসলামে নয়। এবং, জঙ্গি ক্রিয়াকলাপও কম বেশি হয়েছে সব ধর্মের তরফেই। সেই সত্যে ভর করে আমি হয়ত তর্ক করতে পারতাম, অন্যান্য ধর্মের মৌলবাদের সঙ্গে ইসলামের তফাতটা তাহলে গুণগত নয়, নিছকই পরিমাণগত। এরা কম, ওরা কিছু বেশি, এটুকুই মাত্র। কিন্তু, এ তর্ক শেষতক দাঁড়াবে না। পাথরের নুড়ির সঙ্গে পাথরের টিলার গুণগত পার্থক্যকে স্রেফ পরিমাণের দোহাই দিয়ে নস্যাৎ করাটা বোধহয় খুব একটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। ইসলামীয় জঙ্গিপনার নিবিড়তা, ঘনত্ব, প্রচণ্ডতা এবং আন্তর্জাতিকতা, এ সবকে নিছক কম-বেশির ব্যাপার বলে উড়িয়ে দেওয়া অসম্ভব। যদি বলি, মধ্যপ্রাচ্যে একাধিক আধুনিক রাষ্ট্র থেকে খামচে নিয়ে একটা গোটা এবং আনকোরা নতুন ধর্মীয় রাষ্ট্র বানিয়ে তোলা, অনেকগুলো দেশে ধর্মনিরপেক্ষ সরকার উল্টে দিয়ে মৌলবাদী রাজত্ব কায়েম করা, প্রায় সবকটি মহাদেশে বড়সড় নাশকতা চালানোর মত সংগঠন তৈরি করতে পারা --- এত সব শুধুই জঙ্গিপনার কম-বেশির ব্যাপার, তার মধ্যে আলাদা করে বলার মত গুরুত্বপূর্ণ গুণগত বৈশিষ্ট্য কিছুই নেই --- তাহলে অবশ্যই বোকামি হবে, বাস্তবকে অস্বীকার করার বোকামি। কাজেই, জঙ্গিপনার এই ভয়ঙ্কর নিবিড়তা আর ব্যাপকতাকে ইসলামীয় মৌলবাদের একটি স্বতন্ত্র গুণগত বৈশিষ্ট্য বলে স্বীকার করে নেওয়াই ভাল। কিন্তু মুশকিলটা হচ্ছে, সেটা মেনে নিলেও আসল সমস্যাটা রয়েই যায়। সব মুসলমানই তো আর মৌলবাদী জঙ্গি নন, তার এক অতি ক্ষুদ্র অংশই কেবল মৌলবাদী জঙ্গি। কাজেই, এই জঙ্গিপনাকে ইসলামীয় মৌলবাদের একটি স্বতন্ত্র গুণগত বৈশিষ্ট্য বলে মেনে নিলেও প্রশ্ন থাকে, ‘ইসলাম’ নামক ধর্মটির কোনও মৌল উপাদান থেকেই কি এই বৈশিষ্ট্যটি উৎসারিত হচ্ছে, নাকি, মুসলমান অধ্যুষিত সমাজ তথা রাষ্ট্রগুলোর  কোনও বিশেষ ঐতিহাসিক পরিস্থিতিই এ বৈশিষ্ট্যের নির্মাতা?
     
    কেউ কেউ এ প্রশ্নের উত্তর খুব দ্রুত দিয়ে ফেলতে ভালবাসেন। তাঁরা বলেন, এ বৈশিষ্ট্য অবশ্যই ‘ইসলাম’ নামক ধর্মটিরই মৌল উপাদান থেকে নিঃসৃত, কারণ, ইসলামীয় ধর্মশাস্ত্রে হিংসার অনুমোদন আছে। এ যুক্তিটি যে ভুল, সে আলোচনা ওপরে করেছি। কিন্তু কথা হচ্ছে, এ প্রশ্নের উত্তর তবে কীভাবে খোঁজা যায়? আজকের দিনে বিজ্ঞানে, বিশেষত সমাজবিজ্ঞান ও চিকিৎসাবিজ্ঞানে, এ ধরনের প্রশ্নের সমাধানের জন্য যা করা হয় তাকে বলে ‘কন্ট্রোল্‌ড্‌ এক্সপেরিমেন্ট’। সমাজের ওপর তো আর পরীক্ষা চলবে না, অতএব সেখানে দরকার ‘কন্ট্রোল্‌ড্‌ অবজার্ভেশন’ বা সুনিয়ন্ত্রিত পর্যবেক্ষণ। অর্থাৎ, পুরোপুরি একই রকম করে তৈরি (বা সংগ্রহ) করে রাখা দুটি ক্ষেত্রের মধ্যে একটিতে একটি সুনির্দিষ্ট নির্ধারক উপাদান যোগ করে (বা একটি সুনির্দিষ্ট নির্ধারক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে), এবং অপরটিতে তা না করে, শুধুমাত্র প্রথম ক্ষেত্রটিতে কোনও এক নির্দিষ্ট প্রত্যাশিত ফলাফল এলো কিনা তা পর্যবেক্ষণ করা, যাতে ওই নির্দিষ্ট উপাদানটির (বা প্রক্রিয়াটির) সঙ্গে ওই ফলাফলটির কার্যকারণ সম্পর্ক সন্দেহাতীতভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায়। কোনও ওষুধের কার্যকারিতা প্রমাণের জন্য যেমন একই ধরনের দু দল রুগির মধ্যে একদলকে সে ওষুধ দিয়ে এবং অন্যদলকে তা না দিয়ে পরীক্ষা করা হয় যে দ্বিতীয় দলের তুলনায় প্রথম দলের কিছু বেশি উপকার হল কিনা, এও তেমনি। মনে করুন প্রশ্ন উঠল যে, মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামের যে মৌলবাদী উত্থান দেখা গেল, ইরাকের খনিজ তেল এবং আফগানিস্তানের ভৌগোলিক অবস্থানগত সামরিক গুরুত্ব না থাকলেও কি তা ঘটতে পারত, শুধুমাত্র ইসলামীয় শাস্ত্র, সমাজ ও সংস্কৃতির একান্ত নিজস্ব আভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট্যের কারণেই? এ প্রশ্নের বিজ্ঞানসম্মত ও বস্তুনিষ্ঠ উত্তর বেরিয়ে আসতে পারে একমাত্র সেই ধরনের পদ্ধতিতেই, অর্থাৎ, ‘কন্ট্রোল্‌ড্‌ অবজার্ভেশন’ বা সুনিয়ন্ত্রিত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে। যেখানে ইসলামের প্রবল প্রভাব আছে অথচ কোনও বড়সড় অর্থনৈতিক বা সামরিক লাভালাভের পরিস্থিতি নেই, সে রকম সমস্ত জায়গাতেও কি মৌলবাদী জঙ্গিপনার উদ্ভব ঘটেছে? আবার, যেখানে ওই ধরনের পরিস্থিতি আছে অথচ ইসলাম নেই, সে রকম কোনও জায়গাতেই কি জঙ্গি আন্দোলনের উদ্ভব ঘটেনি? এই ধরনের অনুসন্ধান হয়ত আমাদেরকে এ ধরনের প্রশ্নের বস্তুনিষ্ঠ উত্তরের কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারত। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এ প্রসঙ্গে এ রকম গবেষণার কথা আমাদের জানা নেই।
     
    এই যে মুসলমান মৌলবাদের অস্তিত্বের কারণ হিসেবে ইসলামের আভ্যন্তরীণ কারণকে পুরোপুরিই দায়ী করা, ওপরের দুই অনুচ্ছেদে যার কথা বললাম, এর ঠিক উল্টো প্রবণতাটা হচ্ছে এর পেছনে ‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ’ (বা আরও সাধারণভাবে ‘পশ্চিমী চক্রান্ত’) বা ওই জাতীয় ইসলাম-বহির্ভূত কোনও কিছুকে পুরোপুরি দায়ী করা (এবং সেইহেতু ইসলামীয় সমাজ ও সংস্কৃতির আভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট্যগুলোকে এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক বলে সাব্যস্ত করা)। মুসলিম মৌলবাদের উত্থানের পেছনে পাশ্চাত্য শক্তি, বিশেষত আমেরিকার ভুমিকা অবশ্যই অত্যন্ত গুরুত্বের সাথেই আলোচনা করা উচিত। কিন্তু, বিশ শতকের পৃথিবীর ইতিহাসের সমস্ত ঘটনাই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অঙ্গুলিহেলনে ঘটছে, চোখ বুজে এইটা বলে দিলে আপাতদৃষ্টিতে হয়ত তাকে নিন্দা করা হয়, কিন্তু আসলে শেষ বিচারে তার ক্ষমতাকে অনেকখানি বাড়িয়ে দেখা হয়। আমেরিকা (বা সাধারণভাবে ‘পশ্চিম’) মুসলমান দেশগুলোর আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিল, শুধু এটুকু বললে প্রায় কিছুই বলা হয় না --- আসল প্রশ্ন হচ্ছে তারা তা পারল কী করে --- পৃথিবীর সব জায়গাতেই যে তারা যা চেয়েছে তাইই পেরেছে এমন তো আর নয়। মুসলমান সমাজ ও দেশগুলোর সুনির্দিষ্ট বিন্যাস ও ঐতিহাসিক পরিস্থিতি, বিকাশের সুনির্দিষ্ট অবস্থা, তাদের সামাজিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা, অন্তর্দ্বন্দ্ব, তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সংশ্লিষ্ট সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্তাদের তরফে নানা মতাদর্শ ও গোষ্ঠী-পরিচিতি নির্মাণের খেলা, এবং কখন ঠিক কোন তাড়নায় তারা কোন বৃহৎ শক্তির সঙ্গে বন্ধুত্ব বা শত্রুতার সম্পর্কে আবদ্ধ হচ্ছে, আর কোন বৃহৎ শক্তিই বা তাদেরকে সামলানো বা ব্যবহার করার জন্য ঠিক কী চাল চালছে --- এই সবের ভাল বিশ্লেষণ ছাড়া বিষয়টা ঠিকভাবে বোঝাই যাবে না। তাছাড়া, এই দেশগুলোতে 'সেক্যুলার' শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার পরেও প্রায়শই শাসকরা স্বৈরাচারি এবং দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে কেন, এবং, কেনই বা মৌলবাদীরা বারবার তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে জনগণের পাশে থাকার ভাণ করতে পারে, এটাও এ প্রসঙ্গে গভীরভাবে বোঝার বিষয়।  

    বলা বাহুল্য, এ সব প্রশ্নে যথার্থ ও যথেষ্ট বিশ্লেষণ এবং নিষ্পত্তিমূলক উত্তর এখনও আসেনি সমাজবিজ্ঞানীদের তরফ থেকে। যতদিন তা না আসে, ততদিন আমরা কী করতে পারি? ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে পারি, বিষয়টি সম্পর্কে ইতিমধ্যে যা জানা গেছে সে সব জানার চেষ্টা করতে পারি, যুক্তিসম্মত ও বস্তুনিষ্ঠ চিন্তার অভ্যাস করতে পারি …………… আর কিছু পারি কি?

    হ্যাঁ, পারি বোধহয়। মন থেকে অকারণ সন্দেহ ঘৃণা হিংসা বিদ্বেষ এইসব চিহ্নিত করে তা বর্জন করার অনুশীলনটা চালিয়ে যেতে পারি।

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ২৫ ডিসেম্বর ২০২২ | ৪৯০২৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • dc | 2401:4900:231c:128a:d5df:cc75:2a89:7bb7 | ১২ জানুয়ারি ২০২৩ ২২:৫৩515208
  • দেবাশীষবাবু, দিনরাত খাটি টাকা ইনকাম করার জন্য। টাকা না হলে খাবোটা কি, আর দেশ ঘুরবোই বা কি দিয়ে? কাজেই মুনাফার সমর্থক না হয়ে কি আর কোন উপায় আছে? laugh
  • Debasis Bhattacharya | ১২ জানুয়ারি ২০২৩ ২২:৫৬515209
  • dc-কে ধন্যবাদ, কথাটা পেড়ে রাখলেন। এর ফলে আলোচনার অনেক সুবিধে হবে পরের দিকে। ওপরে guru-কে ঠিক এই কথাটাই বলছিলাম, নেটে খুঁজলেই আজকাল এ সব বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া সম্ভব। এ রকম কিছু ক্ষেত্রে হয়ত এমন পালটা যুক্তি আসতে পারে যে, অনেক ক্ষেত্রেই ইউরোপ-বহির্ভূত যুদ্ধ ও হত্যাকাণ্ডগুলো ইউরোপ-প্রভাবিত। কিন্তু, প্রাগৈতিহাসিক হত্যাকাণ্ডও আছে আমাদের সংগ্রহে। 
     
    এবং, গণহত্যার মতই, দাসপ্রথা নিয়েও নির্দিষ্ট তথ্য আছে। 
     
    উইকির তথ্য বলে dc-র একটা লজ্জা লজ্জা ভাব দেখছি, তার কিন্তু কোনও কারণ নেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই। উইকি-র তথ্যে প্রায় সব সময়েই আসল উৎসের সন্ধান দেওয়া থাকে, সেগুলো একটু কষ্ট করে যাচিয়ে নিলেই হল। 
     
    আমি নিজে এই আলোচনাটায় যাচ্ছি না এখুনি, 'আধুনিকতার খোঁজে'-র প্রশ্নগুলো বাকি আছে বলে। কিন্তু, ইতিমধ্যে কারুর মনে কোনও কথা থাকলে, হয়ে যাক। সবই যথাসময়ে যথাস্থানে খাপে খাপে বসবে, আমার ধারণা। 
  • আধুনিকতার খোঁজে  | 2402:3a80:1cd3:822b:17c5:f81a:3829:8e2d | ১২ জানুয়ারি ২০২৩ ২৩:২৯515210
  • @ডিসি
    লালমোহন বাবু হলে আপনাকে নিশ্চয়ই বলতেন - আপনি রসিক লোক মাইরি! :) আমারো বিশুদ্ধ ইংলিশ পদ্ধতিতে টার্কির রোস্ট আর ফিশ এন্ড চিপ্স খেতে দারুন লাগে। :) চুপি চুপি আমিও বলে রাখি আধুনিক ইউরোপের বোদলেয়ার আমার সবচেয়ে প্রিয় কবিদের মধ্যে একজন। আর ইতিহাস নিয়ে আমার প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান-ও ওই মাধ্যমিক পর্যন্ত।

    জোকস এপার্ট। আপনার একটু বুঝতে ভুল হচ্ছে।  প্রথমত আমি জেনোসাইড ইউরোপীয়দের বৈশিষ্ট্য এটা বোধহয় বলিনি।  আমি জেনোসাইড কলোনিয়ালিজম-এর একটি বৈশিষ্ট্য বলেছিলাম।  আর আমার মতে holocaust -এর পর আধুনিকতাও পুরোপুরি দায় ঝেড়ে ফেলতে পারে না। এবং আমার কাছে কলোনিয়ালিজম-ও আধুনিকতার একটি অংগীভূত বিষয়। এতে প্রাগাধুনিক ইউরোপকে এক করে ফেলাটা ঠিক হবে না। ইউরোসেন্ট্রিক আধুনিকতা একটি বিশেষ সময়ের ইউরোপকে ধারণ করে আছে, প্রাগাধুনিক ইউরোপ এমনকি আধুনিক কালের পূর্ব ইউরোপও তার বাইরে ধরতে হবে। 

    দ্বিতীয়ত জেনোসাইড আর যুদ্ধ দুটো এক নয়। সে তো হাতের কাছে অশোকের কলিঙ্গ যুদ্ধই হাতে গরম উদাহরণ রয়েছে যার বীভৎসতা অশোককেই পরিবর্তিত করে দিয়েছিলো। কিন্তু যুদ্ধে যত লোক-ই মারা যাক তা জেনোসাইড নয়। জেনোসাইড একটা গোটা জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার প্রকল্প। যার নিদর্শন প্রাগাধুনিক যুগে হাতে গোনা। আপনি উইকির লিস্টেই হিসেবে করে নিতে পারেন।  

    তৃতীয়ত আফ্রিকা। আফ্রিকা কী আফ্রিকা আছে ? আফ্রিকা ধ্বংস হয়ে গিয়েছে কলোনিয়ালিজম-এর পায়ের তলায়। এই যে রোয়ান্ডার জেনোসাইড বলুন আর বাকিসব, সেসবের জন্য ডাইরেক্টলি দায়ী কলোনিয়ালিজম। আপনি ফ্রান্জ ফ্যাননের Wretched of the Earth বইটা পড়তে পারেন।  এই অধমের ৪ নং-এ আফ্রিকা নিয়ে একটা ধারাবাহিক আছে সেটাও পড়ে দেখতে পারেন। একটু ছোট হবে। কিন্তু সেটা বোধহয় আফ্রিকার ব্যাপারে জানতে একটু সাহায্য করতে পারে। 
     
     
  • Debasis Bhattacharya | ১৩ জানুয়ারি ২০২৩ ০০:৫৫515213
  • আরে, আমি বলে সরকারি চাগরি কোরি, না খেটে মাইনে কামাই। সমাজতন্ত্রের সমর্থক না হয়ে কোনো উপায় আচে মোয়ায় আমার? 
     
    এবং, তারপরও ডিসি-র সোজাসাপটাপনাকে অ্যাপ্রিসিয়েট করা সম্ভব। কতাটা বুইলেন্নাকো? 
  • r2h | 208.127.71.79 | ১৩ জানুয়ারি ২০২৩ ০১:৪৫515214
    • &/ | ১২ জানুয়ারি ২০২৩ ০৩:০৬
    • ...ক্যাপিটালিজম ও মুনাফাকে সত্যি সত্যি (সভায় সমিতিতে দেবার জন্য বানানো বক্তৃতায় নয়)অস্বীকার করার সেরকম কোনো জায়গা কি আছে? যেকোনো একটা মুভমেন্টের(সে প্রতিবাদ আন্দোলন হোক কিংবা বড় বিপ্লব চেষ্টা কিংবা অন্য কিছু) আয়োজন করতে গেলেই তো ফান্ডিং দরকার হচ্ছে, সেও তো আসছে ওই কোনো না কোনো ক্যাপিটালিজম ও মুনাফা নির্ভর ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে (মানে টাকা নাহলে কীভাবেই বা আসবে? ...
     
    টাকা আর পুঁজি, বড় পুঁজি ও ছোট পুঁজি, কর্পোরেট পুঁজি ও যৌথপুঁজি ইত্যাদিতে তফাত আছে। লক্ষ লক্ষ বছরের শিকার করা, জমানো, চাষবাষ, বিনিময় প্রথা থেকে টাকা পয়সা এসেছে। মুনাফা বাস্তব কিন্তু তার কোন বিকল্পের স্বপ্ন দেখা সম্ভব কিনা ইত্যাদি নানান ব্যাপার আছে।

    তুলকালাম রাজতন্ত্র, ব্রাহ্মণ্যবাদ, পিতৃতন্ত্র, সেগ্রিগেশনের যুগে লোকজন গণতন্ত্র, সমানাধিকার, মেয়েদের ভোটাধিকার, সাদাদের সঙ্গে কালোদের এক স্কুলে পড়া ইত্যাদির কথা ভাবতে পারতো না। সেসবও শত শত বছর চলেছে। এখন সব সর্বত্র ইম্প্লিমেন্টেড না হয়ে গিয়ে থাকলেও স্বপ্নগুলির মেরিট নিয়ে কারো কোন সন্দেহ নেই।
     
    বাস্তবকে অস্বীকার করার প্রশ্ন নেই, কিন্তু বর্তমান বাস্তবকে ধ্রুব না ধরে নিলেও ক্ষতি নেই।হতেও পারে, নাও হতে পারে। দুটো সম্ভাবনাই আছে।
  • Debasis Bhattacharya | ১৩ জানুয়ারি ২০২৩ ০২:৫৬515215
  • এত দ্রুত কথার পিঠে কথা হচ্ছে, খেই ধরে রাখা কঠিন। আর তার ওপর যুদ্ধ, গণহত্যা --- লোভনীয় সব উস্কানিতে থ্রেড ভরপুর! কিন্তু, পথ ছাড়ছি না। 'আধুনিকতার খোঁজে'-র প্রশ্নগুলো এখনও বাকি (একটা ছাড়া)। 
     
    "১ গুহাচিত্র আঁকিয়ে মানেই কেন উচ্চমেধা আর বোতাম টিপলেই কেন মধ্যমেধা,
    আধুনিক প্ৰযুক্তি কীভাবে স্বাভাবিক শিল্পকৃতিকে তার উচ্চতা থেকে ক্রমশ যান্ত্রিক মধ্যমেধায় নামিয়ে আনছে সে নিয়ে বিস্তৃত আলোচনার পরিসর এখানে নেই। ট্যাবলেটে ছবি এঁকে আর যাই হোক ভ্যান গফ হওয়া যায় না। এখন তাই ভ্যান গফের দেখাও পাওয়া যায় না।" 
     
    উত্তর --- আপনার বক্তব্য বুঝলাম না কিন্তু। প্রথমত, আমাদের সময়েও ছবি মূলত রঙ আর তুলি দিয়ে কোনও একটা ফিজিক্যাল মেটিরিয়ালের ওপরেই (কাগজ বা ক্যানভাস) আঁকা হয়, কম্পিউটরে ছবি আঁকা এখনও পর্যন্ত সিরিয়াস শিল্প নয় (AI কতদূর কী করবে তা এখনও ভবিষ্যতের গর্ভে)। দ্বিতীয়ত, উন্নত প্রযুক্তি এলে শিল্পের মান নামবে কেন? গুহাচিত্রশিল্পীরা যা দিয়ে ছবি আঁকত, পিকাসো বা দালি নিশ্চয়ই সেই সব উপকরণ দিয়ে আঁকতেন না। তাঁরা কি তবে গুহাচিত্রীদের চেয়ে নিম্নমানের শিল্পী ছিলেন? তৃতীয়ত, ভ্যান গঘ (বা গফ) যে ভীষণভাবেই এক আধুনিক চরিত্র, প্রাগাধুনিক নন মোটেই, সেটা আপনার মনে আছে তো? 
     
    "২ ​আধুনিকতার মানে কেন শুধুই ‘ভীমবেগে উদ্বৃত্ত সঞ্চয়  .................. 
    মডার্নিটিকে কলোনিলিটি থেকে আলাদা করে আদৌ দেখা যায় কি? স্টিমশিপ ডোঙার থেকে একটিমাত্র মৌলিক কারণে উন্নত বলা যায়, সেটা তার গতির কারনে। যে গতি কিনা সর্বাধিক কাজে লেগেছে কলোনি বিস্তারের কাজে। আর এই স্টিমশিপএ চড়েই  উপকূলীয় আফ্রিকা পার করে সাব সাহারান আফ্রিকার অভ্যন্তরের হৃৎপিণ্ড ছিঁড়ে খাওয়ার উপায় বের করে ফেলেছিল কলোনিয়ালিজম। যেখান থেকে শুরু হয় বহুচর্চিত ট্রান্স আটলান্টিক দাস ব্যবসার কালো ইতিহাস যার থেকেই সম্ভব হয়েছিল আপনার ধনতান্ত্রিক আধুনিকতার আদিম পুঁজির সঞ্চয়ন। আমার কথা নয়, বলেছেন মার্ক্স। আর স্টিমশিপ যে কতটা ফসিল ফুয়েলের শ্রাদ্ধ করে তার গতি পায়, সে আলোচনা থাক।" 
     
    উত্তর --- হ্যাঁ, আধুনিকতাকে ঔপনিবেশিকতা থেকে আলাদা করা যায়, অন্তত ধারণাগতভাবে (বাস্তবে ইতিহাসকে আবার ঘটিয়ে পরীক্ষা করে দেখা সম্ভব নয়, যদিও)। সেটা করা যায়, কারণ, আধুনিকতার সারসত্তাগত উপাদানগুলোর মধ্যে এমন কিছুই নেই, ঔপনিবেশিকতা যার অনিবার্য যৌক্তিক পরিণতি বলে গণ্য হতে পারে (এই তাত্ত্বিক সমস্যাটি দূর করার জন্যই সম্ভবত অনেকে খোদ বিজ্ঞানের মধ্যেই হিংস্রতা খুঁজতে প্রলুব্ধ হন)। এবং, গতিটুকু ছাড়াও স্টিমশিপ ডোঙার থেকে আরও বহু কারণেই উন্নত। আকার, গড়ন, উপাদান, সব দিক থেকেই। একটু ভাল করে খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন। তাছাড়া, এই যে বলছেন গতি, এইটা একটা মাত্র শব্দে বলে দিতে পারছেন বলেই কি খুব সোজা ব্যাপার? ওই গতিটা যন্ত্রে সৃষ্টি করার জন্য দীর্ঘদিন ধরে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে ইঞ্জিন বানাতে হয়েছে এবং জড় পদার্থ ও তাপের গতিপ্রকৃতি বুঝতে হয়েছে, যাতে ওই ইঞ্জিনটা বানানো যায় তার জন্য উপযুক্ত ধাতু বানাতে হয়েছে, সেই ধাতুটা কোথায় কীভাবে পাওয়া যায় সেটা বহু কষ্টে জানতে হয়েছে, সেখান থেকে ধাতুটা ঠিক যে অবস্থায় পাওয়া যায় তা থেকে ব্যবহারযোগ্য অবস্থায় আনার জন্য রসায়নবিদ্যা জানতে হয়েছে। এতকিছুর জন্য শুধু কলোনি-বিস্তারের প্রবল বাসনাটুকু থাকাই যথেষ্ট বলছেন? আমার তাতে দ্বিধা আছে। 
     
    আর, আদিম পুঁজির সঞ্চয়ন শুধু দাস ব্যবসা থেকেই হয়েছিল? ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দী থেকে ইউরোপে কৃষি ও কারিগরি উৎপাদন বেড়ে যাওয়া এবং আন্তঃ-ইউরোপীয় মার্কেন্টাইল বাণিজ্যের পুঁজি বেড়ে ওঠার কোনও ভুমিকা নেই বলছেন? একটু আলকিত করবেন প্লিজ, ব্যাপারটা ভাল জানিনা। 
     
    এখনও অনেক বাকি, ধীরেসুস্থে হবেখন! 
  • dc | 2401:4900:231c:128a:6968:71ff:f7be:2e63 | ১৩ জানুয়ারি ২০২৩ ০৮:২৮515216
  • "আমি জেনোসাইড কলোনিয়ালিজম-এর একটি বৈশিষ্ট্য বলেছিলাম।"
     
    "দ্বিতীয়ত জেনোসাইড আর যুদ্ধ দুটো এক নয়...জেনোসাইড একটা গোটা জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার প্রকল্প। যার নিদর্শন প্রাগাধুনিক যুগে হাতে গোনা"
     
    আধুনিকতার খোঁজের কথা মেনে নিয়ে আবার উইকিদাদুর কাছে গেলামঃ 
     
     
    এখানে বেশ কিছু এন্সেন্ট জেনোসাইডের উল্লেখ আছে। দুয়েকটা উদাহরনঃ এশিয়াটিক ভেস্পার্স, গলিক ওয়ারস, উ হু দের মেরে ফেলা (চীনের জেনারাল রান মিন এর নির্দেশে), ইত্যাদি। তাছাড়া ইজিপশিয়ানরা জিউদের সিস্টেমেটিকালি দাস বানাতো আর হত্যা করতো, যাকে এখানে প্রথম হলোকস্ট বলা হয়েছেঃ (https://www.jewishhistory.org/the-egyptian-holocaust/) (এই সাইটটির ক্রেডিবিইল্টি নিয়ে শিওর নই)। 
     
    আবারও বলি, য়ুরোপিয়ানরা দেশে দেশে গিয়ে বহুবার জেনোসাইড ঘটিয়েছে, তাতে কোন সন্দেহই নেই। কলোনিয়াল পিরিয়ডে বহু জেনোসাইড হয়েছে, এতে কোন সন্দেহ নেই। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, কলোনিয়াল যুগে বা য়ুরোপিয়ানদের দ্বারা যে জেনোসাইড হয়েছে, তা কি অন্যান্য পিরিয়ডে বা অন্যান্য সভ্যতার জেনোসাইড রেকর্ডের থেকে সিগনিফিক্যালি ডিফারেন্ট? আমার মতে, যদি "মানুষ মারার প্রযুক্তি" ফ্যাক্টরটিকে কন্ট্রোল করা হয় (বা ডেটা নর্মালাইজ করা হয়), তাহলে স্ট্যাটিস্টিকাল সিগনিফিক্যান্স পাওয়া যাবে না, বা এফেক্ট সাইজ ছোট হবে। 
     
    অবশ্যই, দুটো কারনে আমার মনে হওয়া ভুল হতে পারেঃ এক, চেরি পিকিং এর সম্ভাবনা। যেহেতু আমি নিজে জেনোসাইডের ইতিহাস প্রায় কিছুই জানিনা, তাই উইকির ওপর বা গুগল সার্চের ওপর ডিপেন্ড করছি। দুই, রিপোর্টিং বায়াস, অর্থাত প্রাচীন ইতিহাসে যা ঘটেছে তা কতোটা সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ হয়েছে সেটা আমার জানা নেই। ঐতিহাসিকরা এগুলো নিয়ে ভালো বলতে পারবেন। তবে এগুলো যদি কনফাউন্ডি ভেরিয়েবল হিসেবে ট্রিট না করা হয় তাহলে মনে হচ্ছে ইতিহাস জুড়ে জেনোসাইড এর অনেক নিদর্শন আছে, শুধু কলোনিয়াল পিরিয়ডেই হয়েছে, তা বোধায় না। 
  • দেবাশিস্ ভট্টাচার্য | 223.191.57.196 | ১৩ জানুয়ারি ২০২৩ ০৮:৫২515217
  • ঠিক। ভারতেও আছে। যেমন, স্বয়ং সম্রাট অশোক অজীবিক সম্প্রদায়ের আঠেরো হাজার মানুষকে হত্যা করেছিলেন (এ নিয়ে বিতর্ক আছে যদিও)। এটা কিন্তু কলিঙ্গ যুদ্ধের কেস নয়, একদম বিশুদ্ধ এবং নির্ভেজাল গণহত্যাই। 
     
    আর তার ওপর, 'আধুনিকতার খোঁজে' কেন হত্যার নিদর্শন বলতে শুধু গণহত্যাকেই ধরবেন, যুদ্ধ নয়, সেটাও পরিষ্কার নয়। সেটা হলে তো মডার্নিটি খুনোখুনির সবচেয়ে বড় দায়গুলো থেকেই মুক্তি পেয়ে যাবে!
  • আধুনিকতার খোঁজে | 122.177.190.61 | ১৩ জানুয়ারি ২০২৩ ০৯:০৭515218
  • @দেবাশিসবাবু 
    আপনার পুরো শেষ হলে আমি আমার আবার মতামত জানাবো। নইলে খেই হারিয়ে যাচ্ছে। শুধু একটু জানাবেন আমার ওই মন্তব্যটা ki আপনি খেয়াল করেছেন যেখানে বিজ্ঞান নিয়ে আমার ধারণা ba অবস্থান পরিষ্কার করেছি? হ্যাঁ ba নায়ে একটু জানাবেন প্লিজ।
     
  • dc | 2401:4900:231c:128a:6968:71ff:f7be:2e63 | ১৩ জানুয়ারি ২০২৩ ০৯:১৪515219
  • "আধুনিক প্ৰযুক্তি কীভাবে স্বাভাবিক শিল্পকৃতিকে তার উচ্চতা থেকে ক্রমশ যান্ত্রিক মধ্যমেধায় নামিয়ে আনছে সে নিয়ে বিস্তৃত আলোচনার পরিসর এখানে নেই।"
     
    এটা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হলে ভারি খুশী হবো। 
     
    "সর্বগ্রাসী টোটালিটেরিয়ান সো কল্ড পশ্চিমী আধুনিকতাও মানুষের চিন্তা, চেতনা, শিল্পকৃতিকে ক্রমশঃ এক মায়োপিক খর্বত্বের দিকে ঠেলে দিয়েছে? বিজ্ঞান নিজেই কি শুধুমাত্র টুল-এ পর্যবসিত হয়ে যাচ্ছে না কী? প্রকৃত সত্য যাপনের প্রয়োজনে প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনের যে সত্যনিষ্ঠা বিজ্ঞানের থাকা উচিত তা কি এই চূড়ান্ত ভোগবাদী, মুনাফাখোর এবং তাই একই সঙ্গে ক্রমশঃ বৈচিত্র্যহীন এবং অসহিষ্ণু আধুনিকতার নিগড়ে বেঁধে থেকে সম্ভব?"
     
    এই পুরোটা নিয়েই যদি বিস্তারিত আলোচনা হয় তো সাগ্রহে অংশগ্রহন করতে রাজি আছি। পশ্চিমী আধুনিকতার ফলে কি আমরা মায়োপিক খর্বত্বের দিকে যাচ্ছি? এর উত্তরে, একটা উদাহরন হিসেবে, এশারের কাজের দিকে আধুনিকতার খোঁজের দৃষ্টি আকর্ষন করতে চাই (আরও অজস্র উদাহরন আছে)। এগুলো মায়োপিক খর্বত্বের উদাহরন কিনা তা নিয়ে অনেক আলোচনার অবকাশ আছে মনে হয়। এ প্রসঙ্গে পেনরোজ টাইলিং এর আবিষ্কার নিয়েও দুচার কথা বলতে পারি, বা কেয়স থিওরি নিয়ে। অর্থাত কিনা, আধুনিকতার ফলে আমরা এই মুহুর্তে মায়োপিক খর্বত্বের দিকে যাচ্ছি কিনা, সে নিয়ে তর্ক তো করাই যায় :-) 
     
    "বিজ্ঞান কি শুধুমাত্র টুল-এ পর্যবসিত হয়ে যাচ্ছে না?" উত্তরে লাইগো অবজার্ভেটরির নাম উল্লেখ করতে চাই, যা দিয়ে স্পেসটাইম ফ্যাব্রিকের ডিসটার্ব্যান্স মাপা সম্ভব হচ্ছে। এই টুলটির পেছনে যে এক বাক্স বিজ্ঞান কাজ করছে সে নিয়ে আধুনিকতার খোঁজের সাথে আলোচনা করতে পারি। এ ছাড়াও কোয়ান্টাম মেকানিক্স, সুপারকন্ডাক্টিভিটি, জেনেটিক্স, ইনফরমেশান থিওরি, মেটিরিয়াল ফিজিক্স, মেডিসিন, ইত্যাদি নানান ফিল্ডে যে মৌলিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা হচ্ছে আর নতুন নতুন থিওরি তৈরি হচ্ছে, সে নিয়েও লিখতে পারি। 
     
    "প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনের" ক্ষেত্রে "যে সত্যনিষ্ঠা বিজ্ঞানের থাকা উচিত" - যদি বৈজ্ঞানিক রিগর আগের মতোই আছে কিনা এই প্রশ্ন করেন তো সে নিয়ে অবশ্যই আধুনিকতার খোঁজের সাথে আলোচনা করতে পারি। তেমন হলে 
    Sabine Hossenfelder এর দুয়েকটা য়ুটুব ভিডিওর সাহায্য নেবো। তবে এগুলো নিয়ে আলোচনা হলে য়ুকির সাহায্য অতোটা নিতে হবেনা, তাই আশা করি বিস্তারিত আলোচনা করতে আমারও খুব একটা অসুবিধে হবে না :-)
  • &/ | 107.77.236.35 | ১৩ জানুয়ারি ২০২৩ ০৯:২৫515220
  • ভীষণ ভালো হয় তাহলে . প্লীজ :)
  • dc | 2401:4900:231c:128a:6968:71ff:f7be:2e63 | ১৩ জানুয়ারি ২০২৩ ০৯:৩২515221
  • আধুনিকতার খোঁজে হয়তো বিশ্বাস করবেন না, তবে হিস্টোরি অফ সায়েন্স বা হিস্টোরি অফ ফিলোজফি ইত্যাদি নিয়ে আমার অতি যৎসামান্য ধারনা আছে (বাকি হিস্টোরিতে ডাহা ফেল)। কাজেই যদি বিভিন্ন হিস্টোরিক এজ বা বিভিন্ন সভ্যতার মধ্যে কম্পারেটিভ আলোচনা করতে চান, এন্সেন্ট, মিডল, আর মডার্ন পিরিয়ডের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মান আর বৈজ্ঞানিকদের মেধা নিয়ে আলোচনা করতে চান তো উইকির সাহায্য না নিয়েই দুচার লাইন লিখে দিতে পারবো :-) 
  • Debasis Bhattacharya | ১৩ জানুয়ারি ২০২৩ ১০:১৩515222
  • আধুনিকতার খোঁজে,
     
    বিজ্ঞান নিয়ে আপনার অবস্থান বুঝতে পেরেছি বলেই মনে হচ্ছে। বিজ্ঞানের আভ্যন্তরীণ গুণাবলী নিয়ে আপনার সমস্যা নেই, আপনার আপত্তি শুধু পশ্চিমী আধুনিকতা যে সমাজ ও সংস্কৃতি নির্মাণ করেছে তার মধ্যে বিজ্ঞানের ভূমিকা যা দাঁড়িয়েছে সেই নিয়ে। 
     
    আসলে, আধুনিকতার প্রতি সমালোচনাটা যাতে অগভীর না মনে হয়, সেজন্য অনেক সমালোচকই আপত্তিটা বিজ্ঞানের ভেতর অবধি টেনে নিয়ে যান।
     
    ডিসি-র সংযোজন চমৎকার, আবারও।
  • আধুনিকতার খোঁজে | 122.177.190.61 | ১৩ জানুয়ারি ২০২৩ ১১:২৫515224
  • @দেবাশিসবাবু 
    আর তার ওপর, 'আধুনিকতার খোঁজে' কেন হত্যার নিদর্শন বলতে শুধু গণহত্যাকেই ধরবেন, যুদ্ধ নয়, সেটাও পরিষ্কার নয়।
    আমি যুদ্ধ যতই হন্তারক হোক তা জেনোসাইড নয় বলেছি, হত্যার নিদর্শন নয় কখন বললাম?
  • guru | 103.211.133.184 | ১৩ জানুয়ারি ২০২৩ ১১:৪৪515226
  • @ডিসি 
     
              দেখুন সম্রাট অশোকের গণহত্যা বা অন্যান্য যেগুলো আপনি দেখাচ্ছেন উইকিপিডিয়া থেকে অ-পশ্চিমী গণহত্যার উদাহরণ দেখিয়ে তার সঙ্গে পশ্চিমী জেনোসাইড (বা আধুনিকতার খোঁজে এর ভাষাতে ইউরোসেন্ট্রিক কলোনিয়ালিজম ) এর মূল পার্থক্য হচ্ছে ইনটেন্ট এর ব্যাপারে | অতীতের যুদ্ধ বিগ্রহ যা অ-পশ্চিমী উদাহরণগুলো আপনি দেখাচ্ছেন সেগুলির মূল ইনটেন্ট একটি জাতির মূলোচ্ছেদ করা ছিলোনা রাজনৈতিক শত্রুকে একটি কড়া ভাবে পর্যুদস্ত করা ছিল | যে কারণে উ হু দের মেরে ফেলা (চীনের জেনারাল রান মিন এর নির্দেশে) যেটি আপনি বলেছেন সেখানে আপনার এই উইকিপেডিয়া সোর্স বলছে যে এই ঘটনার অনেক পরেও এই জাতির উল্লেখ অনেক চীনা ঐতিহাসিক করেছেন | "According to some sources more than 200,000 of them were slain.[22] Despite this, the Jie continue to appear occasionally in history over the next 200 years. Both Erzhu Rong and Hou Jing, two famous warlords of the Northern Dynasties, were identified as Qihu and Jiehu respectively and modern scholars have suggested that they could have been be related to the Jie.[23] "  (সোর্স : https://en.wikipedia.org/wiki/Jie_people#Cultural_influences)
     
    এশিয়াটিক ভেস্পার্স, গলিক ওয়ারস  এর সঙ্গে যেইসব রাজনীতিকদের নাম আসছে যেমন রোমান জেনারেল জুলিয়াস সিজার এরা মূলতঃ পশ্চিমী দের পূর্বসূরি হিসেবেই পরিচিত |
     
    ইউরোসেন্ট্রিক কলোনিয়ালিজম এর মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছেই যে একটি এশীয় বা আফ্রিকা ভূখণ্ড দখল করে সেইখানকার একটি জাতি ও তার সমস্ত অস্তিত্ব তথা সেই জাতির কালচারাল মেমোরি কে মূলোচ্ছেদ করে ফেলা ও তার মাধ্যমে একটি বিশাল পরিমান ক্যাপিটাল সারপ্লাস পুরোপুরি আত্মসাৎ করা তৎকালীন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার কাজে লাগিয়ে | 
     
    এটিই মূল পার্থক্য অ-পশ্চিমী ও ইউরোসেন্ট্রিক কলোনিয়ালিজম এর মধ্যে ইনটেন্ট এর ব্যাপারে যেইখানে প্রথমটির ক্ষেত্রে যুদ্ধ করা হতো শত্রুকে শিক্ষা দিতে কিন্তু  তার মূলোচ্ছেদ করা উদ্যেশ্য হতোনা  সেখানে ইউরোসেন্ট্রিক কলোনিয়ালিজম এর মূল লক্ষই ছিল একটি জাতির মূলোচ্ছেদ করে তার সম্পদ আত্মসাৎ করা |
     
    আধুনিকতার খোঁজে তাসমানিয়ার উদাহরণটি দেখিয়েছেন খুব ভালোভাবেই | আমি তো মনে করি আরো একটি ভালো  উদাহরণ হচ্ছে হিরেন সেনগুপ্ত বাবুর লেখা "আমার আফ্রিকা "বইটির নামিবিয়া অধ্যায় যেইখানে সেখানে হেরেরো উপজাতিকে মূলোচ্ছেদ করার বিবরণ আছে জার্মান কলোনিয়াল শক্তির দ্বারা | কয়েক দশকে আগেই আম্রিকি মন্ত্রী  ম্যাডেলিন অলব্রাইট বলেছিলেন যে ইরাকে প্রায় ২০ লক্ষ্য শিশুকে বেবি ফুডের উপরে নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে হত্যা করা একটি জেনোসাইড এবং তিনি সেটি করে গর্বিত |
     
    আশা করি ইউরোসেন্ট্রিক কলোনিয়ালিজম এর জেনোসাইড এর ব্যাপারে ইউনিকনেস বা স্বকীয়তা এর ব্যাপারটি বোঝাতে পেরেছি | আপনার মন্তব্যের অপেক্ষাতে রইলাম |
     
     
     
     
     
     
  • guru | 103.211.133.184 | ১৩ জানুয়ারি ২০২৩ ১২:৩৫515228
  • @দেবাশীষ বাবু 
     
                         দেখুন আমি এশীয় ও আফ্রিকার মানুষের ইউরোসেন্ট্রিক কলোনিয়ালিজমের কোর পেরিফেরি রিলেশনশিপ থেকে বেরিয়ে যাবার জন্য যেকোনো রকম বৈজ্ঞানিক আধুনিকতার আশ্রয় নেবার পক্ষে | কিন্তু আধুনিকতাকে গ্রহণ করতে হবে ও ইমপ্লিমেন্ট করতে হবে পুরোপুরি এশীয় ও আফ্রিকার মানুষের নিজেদের স্বার্থে ও নিজেদের প্রয়োজনের মতো করে | আমি বিশ্বাস করি "মারি অরি পারি যে কৌশলে "| তা এশিয়া ও আফ্রিকার মানুষের মূল অরি যে ইউরোসেন্ট্রিক কলোনিয়ালিজম তা তো গত কয়েক শতাব্দীর ইতিহাস বলে দেয় | আশা করি আমরা এই ব্যাপারটুকুতে একমত |
     
                        দেখুন এশীয় ও আফ্রিকার মানুষের পুরোপুরি আধুনিক হবার ব্যাপারে মূল প্রতিবন্ধকতা কিন্তু আম্রিকি ভূ রাজনীতি | এই ব্যাপারটা নিয়ে আপনি আর আমি একমত নই সেটা আমি জানি এবং আপনার প্রবল কটাক্ষের ও বিদ্রুপের মাধ্যমে আপনি সেটা বুঝিয়েও দিয়েছেন | আমি দুয়েকটি উদাহরণ দেখিয়ে বোঝাতে চাই যে এশিয়া ও আফ্রিকার মানুষ সত্যি কথা বলতে কি আধুনিকতাকে মেনে নিতে প্রস্তুত ও তা তারা করছেনও কিন্তু মূল প্রতিকূলতা আসছে আম্রিকি ভূ রাজনৈতিক স্বার্থের কাছ থেকেই | 
     
                        আমি এখানে আমার মতটি বোঝাতে চীনের উদাহরণ দিচ্ছি | চীন যে বর্তমানে পশ্চিমী আধুনিকতার পথে অনেকটাই এগিয়ে গেছে সেটা আমার মনে হয় আপনিও মেনে নিয়েছেন | চীনের নেতাদের বক্তব্য যে তারা ইংল্যান্ড ১৮ ও ১৯ শতকের যে শিল্পবিপ্লব হয়েছিলো বর্তমানে ২১ শতকে চীন এরম একটি শিল্পবিপ্লব আনতে চান তবে এই নতুন শিল্পবিপ্লব আসবে ডাটা টেকনোলজি এর হাত ধরে | চীন BRI OBOR CPEC প্রভৃতি প্রকল্পের মাধ্যমে এই শিল্পবিপ্লব ও তার সুফল সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে চায় যাতে আফ্রিকা ও এশিয়ার মানুষের লাভ হয় কিন্তু প্রবল প্রতিকূলতা আসছে সাম্প্রতিককালে যেহেতু আম্রিকি সেমিকন্ডাক্টর চিপের নিষেধাজ্ঞা চীনের বিরুদ্ধে চাপিয়ে দিয়েছে যেহেতু আম্রিকা এইখানে নিজস্ব ইকোনমিক মনোপলি বজায় রাখতে চাইছে | 
     
                    আমি বোঝাতে চাইছি যে এইভাবে চীন যে নিজস্ব আধুনিকতা আনতে চাইছে সেখানেও মূল অরি সেই আম্রিকি ভূ রাজনৈতিক স্বার্থ বা ইউরোসেন্ট্রিক ক্যাপিটালিজম এর লেটেস্ট ভার্সন | আশা করি আমরা এই ব্যাপারেও একমত হতে পারি |
     
     
  • আধুনিকতার খোঁজে  | 2402:3a80:1cd3:d641:208b:15c9:4c65:b45 | ১৩ জানুয়ারি ২০২৩ ১২:৪২515229
  • @ডিসি
    আপনি বোধহয় আমাকে ইউরোপ বিরোধী হিসেবে ঠাউরে চলেছেন।  তাই কতকগুলো কথা বলে নি।  প্রথমত আধুনিকতা বলতে একটি বিশেষ কালখণ্ডের পশ্চিম ইউরোপের ভূখণ্ডের ফেনোমেননের আলোয় ধরা উচিত। সেখানে প্রাচীন ইউরোপ, এমনকি আধুনিক কালের পূর্ব ইউরোপ-ও বাইরে থাকবে। 
    দ্বিতীয়ত প্রাচীন ও মধ্যযুগে সবটাই স্বর্গরাজ্য ছিল এমনও মনে করার কোনো কারণ ঘটেনি। জেনোসাইড-ও নিশ্চিতভাবেই তখনও ছিল। এমনকি ঠিক jani না, আদিম সমাজেও থেকে থাকবে। দেবাশিসবাবু যেমন সঠিক ভাবেই আজীবিকদের গণহত্যার কথা উল্লেখ করেছেন। সেসব ধরে নিলেও কিন্তু আধুনিকতার মাত্র কয়েকশো বছরের স্প্যানে organised জেনোসাইডের সংখ্যা ও ব্যাপকতা একেবারেই অনন্য একটা ব্যাপার।
    আসলে আমার মনে হয় একটু এভাবে দেখলে হয়। আধুনিক এনলাইটেনমেন্ট যেমন শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ যেমন কার্ল মার্ক্সের জন্ম দিয়েছে তেমনি এই এনলাইটেনমেন্ট বিকশিত হয়েছে কলোনিয়াল লুন্ঠন ও উপুর্যুপরি জেনোসাইডের মধ্য দিয়ে। একদিকে যেমন ফরাসি বিপ্লব হয়ে সাম্য-মৈত্রীর ধারণা ইউরোপের মূল ভূখণ্ডে ছড়িয়ে পড়ছে অন্যদিকে পেরিফেরিগুলোতে চলছে সংগঠিত ভাবে একের পর এক জাতি ও সংস্কৃতির নিশ্চিহ্নকরণের বিভীষিকা। সে আপনি উত্তর আমেরিকার ইন্ডিয়ানদের কথাই বলুন বা দক্ষিণের মায়া-ইনকা-ইন্ডিয়ানদের। অস্ট্রেলিয়া-তাসমানিয়ার aborigin দের ক্ষেত্রেও তাই।  আসলে কলোনিয়ালিজম ও ইউরোসেন্ট্রিক টোটালিটেরিয়ান হেজেমনির মধ্যেই এই বীজ বপন করা ছিল। তাই একদিকে যেমন সাম্যবাদের কথা উঠে আসছে তেমনি অন্যদিকে স্পেন্সারের হাত ধরে ডারউইনবাদ ও সেখান থেকে জোসেফ মেঙ্গেলের বৈজ্ঞানিক(?) অনুসন্ধানে পৌঁছনো inevitable ছিল। ওইখানেই ইউরোসেন্ট্রিক আধুনিকতা ও জেনোসাইডের সম্পর্কটা অনন্য।  যাকে খাপচা তথ্যের সরলীকরণে ভাসিয়ে দিলে বোধহয় হবে না। 
    বোদলেয়ার, ভ্যান গখকে বুকে রাখি বলে, ফিফ্থ সিম্ফোনি শুনতে দশ মাইলও হাঁটতে রাজি বলে ইউরোসেন্ট্রিক টোটালিটেরিয়ান হেজেমনির একপেশেমিকে সর্বাংশে প্রশ্নহীন মেনে নিতে আমার অসুবিধে আছে। এই হচ্ছে ইউরোপের সঙ্গে আমার সম্পর্ক।  আশা করি বোঝাতে পেরেছি।

    (চুপি চুপি এও বলে রাখি, এক ইউরোপীয় নারীর সঙ্গে সারাজীবন তুমুল প্রেম করে আসছি , অবশ্যই মনে মনে, তার নাম আনা কারিনা।)
     
    আপনি যে সব আলোচনা করতে আগ্রহী বললেন আমিও তাই। কিন্তু আমার জ্ঞানের পুঁজি এত কম যে একটু ভয়ই পাচ্ছি
  • আধুনিকতার খোঁজে  | 2402:3a80:1cd3:d641:208b:15c9:4c65:b45 | ১৩ জানুয়ারি ২০২৩ ১২:৫৩515230
  • @dc 
    আমার মনে হয় আমার এই লেখাটা একবার চোখ বুলিয়ে নিতে পারেন। কলোনিয়ালিজমের অনন্যতা ও আফ্রিকার বিষয়ে একটু সুবিধে হলেও হতে পারে। 
     
     
    ধন্যবাদ 
  • Debasis Bhattacharya | ১৩ জানুয়ারি ২০২৩ ১২:৫৯515232
  • আধুনিকতার খোঁজে,
     
    সবই তো বুঝলাম, কিন্তু guru যে আপনাকে সমর্থন করার প্রবল সদিচ্ছা সহকারে আপনার বিরোধিতা করে চলেছেন, সে বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী? 
  • আধুনিকতার খোঁজে  | 2402:3a80:1cd3:d641:208b:15c9:4c65:b45 | ১৩ জানুয়ারি ২০২৩ ১৪:৩১515233
  • চীন যে বর্তমানে পশ্চিমী আধুনিকতার পথে অনেকটাই এগিয়ে গেছে সেটা আমার মনে হয় আপনিও মেনে নিয়েছেন |
    চীন যখন ​​​​​​​পশ্চিমি ​​​​​​​আধুনিকতাকে adopt করতে ​​​​​​​পেরেছে ​​​​​​​এবং guru যখন ​​​​​​​আমেরিকার হাত থেকে তাকে বাঁচাতে চান তাহলে মনে হয় আমি যেমন বনমানুষের মতো উদোম হয়ে বা অন্যদেরও তাই দেখতে চেয়ে মহা রোমাঞ্চিত হই তাতে বোধহয় উনি সায় দিতে পারবেন না। ;) তবে ওনার সমর্থন ও বিরোধিতা দুই করার পূর্ণ অধিকার আছে। 
     
  • guru | 103.211.133.184 | ১৩ জানুয়ারি ২০২৩ ১৪:৩৬515234
  • @দেবাশীষ বাবু 
     
                        আমি আধুনিকতার খোঁজে র কোনোরকম বিরোধিতা করতে চাইনা | উনি যে খুব ভালো ভাবে ইউরোসেন্ট্রিক কলোনিয়ালিজম এর জেনোসাইড স্বকীয় ব্যাপারটিকে দেখিয়েছেন আমি তাতে সমর্থন করছি | লেখালেখির ভালো অভ্যাস নেই বলেই হয়তো ঠিকঠাক লিখতে পারছিনা সেটি আমার নিজস্ব গাফিলতি | 
     
                       আমি একটি ব্যাপার স্বীকার করছি | আমি হয়তো আগে বলেওছি যে আমি একজন ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস এর আগ্রহী ছাত্র | যেহেতু বাংলাতে এই বিষয়ে তেমন ভালো বই নেই তাই যখন কয়েক মাস আগে আমার হাতে এসেছিলো স্বনামধন্য বিখ্যাত বাঙালি ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকার হিরেন সেনগুপ্তর লেখা "আমার আফ্রিকা " বইটি তখন আমি সেটা এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলি | সেখানে "নামিবিয়া "ও "কঙ্গো " যে দুটি চ্যাপ্টার ছিল সেখানে এই ইউরোসেন্ট্রিক কলোনিয়ালিজমের জেনোসাইডাল ইনটেন্ট ও টেন্ডেন্সি নিয়ে যে মর্মস্পর্শী ছবি হিরেনবাবু দেখিয়েছেন পড়ে চোখে জল এসে গেছিলো | সেই থেকেই আমি এই  ইউরোসেন্ট্রিক কলোনিয়ালিজমের জেনোসাইডাল টেন্ডেন্সি এর ব্যাপারে ভীষণ আবেগী ও স্পর্শকাতর হয়ে গেছি | কাজেই এই বিষয়ে লিখতে গেলে অনেকসময়েই আমার আবেগ টি হয়তো প্রকাশ করে ফেলি |  আপনি হয়তো এই প্যাটার্নটি লক্ষ্য করেছেন আমার লেখার মধ্যে | সবসময়ে এইসব জায়গাতে আমার যুক্তি দিয়ে আবেগকে দমন করতে পারিনা |
     
                   পুনশ্চঃ আমিও কল্পবিজ্ঞান বিষয়ে আপনার ফিক্শন লেখাগুলি পড়তে চাই | এই লিংকগুলি দিন প্লিজ |     
                                 
  • আধুনিকতার খোঁজে  | 2402:3a80:1cd3:d641:208b:15c9:4c65:b45 | ১৩ জানুয়ারি ২০২৩ ১৪:৫৯515235
  • @dc 
    আপনি আমাকে বোধহয় ওভাররেট করে ফেলেছেন। আপনি যেমন বিনয় করে নিজেকে ইতিহাসে পাতিহাঁস বললেন আমি কিন্তু বিজ্ঞানে আক্ষরিক অর্থেই অজ্ঞান। অংকের ক্লাসে বেঞ্চের নিচে প্রানপন লুকিয়ে থাকতাম। আর বুনুর মতো অংকে তেরোই আমার চিরকালীন ভবিতব্য ছিল। কোনোক্রমে ক্লাস টেন চুকিয়ে নিস্তার পেয়েছি। তবুও আলোচনায় সমৃদ্ধ হওয়ার লোভেই থাকতে চাই। 
  • dc | 2401:4900:231c:128a:6968:71ff:f7be:2e63 | ১৩ জানুয়ারি ২০২৩ ১৫:৩৬515236
  • অধুনিকতার খোঁজেঃ আপনার লেখাটি পড়লাম। পড়তে পড়তে ছোটবেলায় পড়া একটা বইএর কথা মনে পড়লো, সিডনি শেল্ডন এর লেখা মাস্টার্স অফ দ্য গেম। আর বছর কয়েক আগে দেখা একটা সিনেমার কথাও মনে পড়লো, ব্লাড ডায়মন্ড। ঐ লেখা, আর এখানে আপনার বক্তব্যের সাথেও, এক জায়গায় একমত। কলোনিয়ালিস্ট অপ্রেশান, য়ুরোপিয়ানদের দ্বারা জেনোসাইড, ওয়েল্থ ট্রান্সফার ইত্যাদি নিয়ে আমার একেবারেই দ্বিমত নেই। তবে এই ধরনের অপ্রেশান, গণ্যহত্যা, সিস্টেম্যাটিক লুটপাট ইত্যাদি কি কলোনিয়াল যুগেই শুধু হয়েছে, নাকি অন্য সমস্ত যুগেও হয়েছে, অন্য সব সভ্যতাও এসব করেছে, সেটাই বুঝতে চাইছি। আবারও বলি, টেকনোলজির ব্যবহারের ফলে কলোনিয়ালিস্টরা আগের চেয়ে অনেক বেশী মানুষ মারতে পেরেছিল, বেশী করে ওয়েলথ এক্সট্র‌্যাক্ট করতে পেরেছিল - এই টেকনোলজির ব্যবহার ব্যাপারটা বাদ দিলে কি কলোনিয়ালিস্টদের সাথে অন্যান্য সভ্যতা, যেমন চীনে, জাপানি, এশিয়ান, আফ্রিকান, মেসোপটামিয়ান, ইগিপশিয়ান, মায়ান ইত্যাদি ইত্যাদিদের মধ্যে কোন তফাত আছে। বা এইভাবে যদি জিগ্যেস করি - কলোনিয়ালিস্টরা যেসব টেকনোলজি পেয়েছি, যেমন স্টিম পাওয়ার, উন্নত বন্দুক, আগের থেকে ভালো সাপ্লাই চেন ইত্যাদি, সেইসব টেকনোলজি যদি অশিয়ান বা আফ্রিকান বা ইজিপশিয়ান রুলারদের হাতে থাকতো, তাহলে তাদের লুটপাট বা গণহত্যার স্কেল কি কলোনিয়ালিস্টদের থেকে কোনরকম অন্য কিছু হতো? এই ব্যপারটাই বুঝতে চাইছি।  
     
    "আমি জেনোসাইড কলোনিয়ালিজম-এর একটি বৈশিষ্ট্য বলেছিলাম।"
     
    "দ্বিতীয়ত জেনোসাইড আর যুদ্ধ দুটো এক নয়...জেনোসাইড একটা গোটা জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার প্রকল্প। যার নিদর্শন প্রাগাধুনিক যুগে হাতে গোনা"
     
    আপনার এই দুটো মন্তব্য যথার্থ কিনা সেটা বোঝার জন্যই উইকির তথ্য ঘাঁটছি। আর উইকির তথ্য থেকে মনে হচ্ছে কলোনিয়ালিস্টদের সাথে আফ্রিকান, এশিয়ান, ইজিপশিয়ান ইত্যাদি শাসকদের খুব একটা ফারাক নেই। 
  • dc | 2401:4900:231c:128a:6968:71ff:f7be:2e63 | ১৩ জানুয়ারি ২০২৩ ১৫:৪৮515237
  • "আপনি বোধহয় আমাকে ইউরোপ বিরোধী হিসেবে ঠাউরে চলেছেন"
     
    সেরকম কিছু ভাবিনি, তাছাড়া ইউরোপের বিরোধিতা করাটাও তো খারাপ কিছু না! ধরুন আপনি ইউরোপের বিরোধিতা করেন আর আমি সমর্থন করি, তার মানে কি এই যে আমরা এক টেবিলে বসে কফি সহযোগে আলোচনা চালাতে পারবো না? (ইউরোপ বিরোধিতা মানে আমি ধরে নিচ্ছি ওয়েস্টার্ন পলিটিকাল, ইকোনমিক, আর ফিলোজফিকাল ফ্রেমওয়ার্কের বিরোধিতা)। 
     
    কিন্তু তার পরেও, "আধুনিক প্ৰযুক্তি কীভাবে স্বাভাবিক শিল্পকৃতিকে তার উচ্চতা থেকে ক্রমশ যান্ত্রিক মধ্যমেধায় নামিয়ে আনছে সে নিয়ে বিস্তৃত আলোচনার পরিসর এখানে নেই।" এগুলো নিয়ে আলোচনা করতে পারলে ভালো হতো। আমার মতে আধুনিক প্রযুক্তির ফলে মধ্যমেধা তো আসেইনি, বরং কোলাবোরেশান বা ডিসট্রিবিউটেড ডিসিশান মেকিং ইত্যাদির ক্ষেত্র আগের থেকে বেড়েছে। এখন আগের থেকে অনেক বেশী করে ইন্টারডিসিপ্লিনারি বিজ্ঞান এর চর্চা হচ্ছে, যার ফলে জেনেটিক্স বা ড্রাগ ডিসকভারি ইত্যাদি ফিল্ডে অভাবনীয় উন্নতি হচ্ছে। 
     
    এই সব আর কি :-)
  • guru | 146.196.46.16 | ১৩ জানুয়ারি ২০২৩ ২০:০৪515240
  • @আধুনিকতার খোঁজে
     
    আপনার আফ্রিকা নিয়ে লেখাটি পড়লাম | আমি অনেকদিন আগে এডওয়ার্ড গালিয়ানোর লেখা "ওপেন ভেইন্স অফ ল্যাটিন আমেরিকা " পড়েছিলাম এই লেখাটিতে অনেকটাই তার ছাপ আছে | আপনার শব্দ চয়ন বেশ ভালো আপনি শুধু ইতিহাস নয় সাহিত্যের অন্য এক দিককেও ফুটিয়ে তুলেছেন যাকে হাওয়ার্ড জিন বলেছেন "পিপল'স হিস্ট্রি "| চালিয়ে যান | আপনার এরকম আরো লেখা আছে ?
  • guru | 146.196.46.16 | ১৩ জানুয়ারি ২০২৩ ২০:৩২515242
  • @ডিসি 
     
               ইউরোপ ও অন্যান্যদের মধ্যে একটি বড়ো পার্থক্য ছিল ইনটেন্ট | এখন উইকিপেডিয়া সমস্যা হচ্ছে যে এটি শুধু কিছু তথ্য দেয় কিন্তু কোনো কনটেক্সট বা আমি যেটা বললাম সেই ইনটেন্ট তুলে ধরেনা | শুধু সংখ্যা দিয়ে কি কিছু বোঝা যায় ?
     
              আধুনিকতার খোঁজে মুসলিম শাসিত স্পেন এর উদাহরণ দিয়েছেন যেইখানে মুসলিম শাসনের অবসানের এতদিন পরেও স্প্যানিশ ভাষা টিকে আছে কিন্তু ল্যাটিন আমেরিকার স্প্যানিয়ার্ড কলোনী গুলিতে কেউ পরে-কলোনিয়াল ভাষা ব্যবহার করেনা | আরো একটা উদাহরণ দিতে পারি যে ধরুন অপারেশন বারবারোসা এর সময়ে সোভিয়েত ও নাত্সি দের অস্ত্রশস্ত্র সহ টেকনোলজি মোটামুটি একই ছিল কিন্তু নাজিদের হাতে অনেক বেশী সোভিএট্ সিভিলিয়ানের মৃত্যু হয় এবং নাত্সি অধিকৃত পূর্ব ইউরোপে প্রায় সর্বত্র দেখা যায় অনেক অনেক কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্পের | অর্থাৎ নাজিদের মধ্যে ইনটেন্ট ছিল জেনোসাইড করবার যেটি সোভিয়েতদের মধ্যে ছিলোনা | 
     
           বোঝাতে পারলাম কি ?
  • guru | 146.196.46.16 | ১৩ জানুয়ারি ২০২৩ ২০:৩৩515243
  • পরে-কলোনিয়াল  নয় এটি হবে প্রি-কলোনিয়াল | টাইপিং ভুল হয়েছে আমার |
  • আধুনিকতার খোঁজে | 2402:3a80:1cd3:d641:208b:15c9:4c65:b45 | ১৩ জানুয়ারি ২০২৩ ২০:৫০515244
  • @dc 
    আর উইকির তথ্য থেকে মনে হচ্ছে কলোনিয়ালিস্টদের সাথে আফ্রিকান, এশিয়ান, ইজিপশিয়ান ইত্যাদি শাসকদের খুব একটা ফারাক নেই। 
    উইকির পরিসংখ্যান দিয়ে বোধহয় সবটা বোঝা সম্ভব নয়। কলোনিয়ালিজম কেন চেঙ্গিস খাঁর থেকে স্বতন্ত্র সেটার জন্য আমাদের ইউরোসেন্ট্রিক মনস্তত্বের গভীরে ঢুকতে হতে হবে। তার জন্য হয়তো আমাদের আধুনিকতার উপজাত স্পেন্সারএর ডারউইনবাদ থেকে ইউজেনিক্স নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে হতে পারে। এখানেই ক্রমে বোধহয় সে উপক্রমণিকা আসবে। একটু সবুর করুন। 
     
    আর মধ্যমেধার ব্যাপারে আমি মানুষের স্বাভাবিক শিল্পকৃতির কথা মূলত বলেছিলাম। সোজা কথায় বললে আর্টের দিকটা ধরতে চাইছি। সেখানে সমকালীন সামাজিক মনস্তত্বেরও অনেকটা রূপরেখা পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান তো প্রভূত উন্নতি করে চলেছে। আমরা তো প্রযুক্তি বিপ্লবে মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। কোথায় যাচ্ছি সেটায় আমার প্রশ্ন থাকলেও মেধার ক্ষেত্রে নেই। (যদি মেধাকে নৈতিকতা নিরপেক্ষ ধরে নিতে পারি।) এটা নিয়ে আলাদা করে আলোচনা হলে ভালো হয়। আরো অনেকের মতামত পেলে ভালো হয়। আমার confusion গুলোও কাটিয়ে নিতে পারি। আগে বোধহয় দেবাশিসবাবুর এই থ্রেডটাকে এগোতে দেওয়া উচিত। 
     
     
  • dc | 2401:4900:231c:128a:6968:71ff:f7be:2e63 | ১৩ জানুয়ারি ২০২৩ ২০:৫৫515245
  • গুরু, আমি কি বলতে চাইছি সেটাই আপনি বুঝতে পারেন নি। কাজেই বোঝাতে পারার প্রশ্নই নেই। 
  • dc | 2401:4900:231c:128a:6968:71ff:f7be:2e63 | ১৩ জানুয়ারি ২০২৩ ২১:০০515247
  • আধুনিকতার খোঁজে, অবশ্যই অপেক্ষা করবো। 
     
    শুধু আর্টসের কথা যদি বলেন তো এখনকার, মানে গত কুড়ি তিরিশ বছরের শিল্পের কথা বলছেন কি? সেক্ষেত্রে আমি পিংক ফ্লয়েডের উল্লেখ করতে পারি, যদি গানের কথা বলেন তো। আর ছবি ইত্যাদি ধরলে Basquiat আর Banksey? এনারা হয়তো ভ্যান গখের সমান নয়, তবে পিকাসো বা ভ্যান গখ কিন্তু আউটলায়ার। আউটলায়ারদের ওপর বেস করে থিওরি দাঁড় করানো ভারি মুশকিল  :-)
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। কল্পনাতীত প্রতিক্রিয়া দিন