এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  অপার বাংলা

  • অমৃতসমান : উদ্যোক্তা কৃষক সোমনাথ মাইতি

    Suchetana Mukhopadhyay লেখকের গ্রাহক হোন
    অপার বাংলা | ০৬ জানুয়ারি ২০২৩ | ৮৩০ বার পঠিত
  • রাত আড়াইটে। নার্সিংহোমের আই.সি.ইউ একটু শান্ত এখন। কিন্তু ঘুম নেই এক তরুণ ওয়ার্ডবয়ের চোখদুটোয়। অনেকদিন ধরে কয়েকটা প্রশ্ন কেবল ঘুরপাক খেয়ে চলেছে ওর মগজে। আর.এম.ও কে কিছু ফাঁকা দেখে সেই প্রশ্নগুলো ও শুধিয়েই ফেলেছে আজ। জবাবে উপস্থিত আর.এম.ও ডাক্তারবাবু বলছেন, "এত রোগব্যাধির বাড়বাড়ন্তের মূল তো আমাদের খাবারদাবার। সারাদিন যা যা খাচ্ছি, সবেই তো ভরে ভরে ছড়ানো আছে বিষ। কেমিক্যাল সার, কীটনাশক, হরমোন.."। বলে চলেন ডাক্তারবাবু…!

    বাকি রাতটুকু কাজ করতে করতে তরুণ ওয়ার্ডবয়টির মাথায় কেবল তুমুল ধাক্কা দিতে দিতে পাক খেতে থাকে ডাক্তারবাবুর বলা কথাগুলো। জেগে জেগেই এক প্রায়-অসম্ভব স্বপ্ন দেখতে থাকে সেই ছেলেটি। 
    নাঃ এই কাজ আর নয়। তাকে ফিরতে হবে নিজের ''দুই বিঘা জমি" খানিতে। সে জমির ফসল তাকে তুলতে হবে ঘরে। তবে ওইসব বিষ তেলটেল দিয়ে নয়, আগাগোড়া প্রাকৃতিক উপাদানে ফলবতী হবে সেই জমি…..

    সেই রাত আড়াইটের কয়েক ঘন্টা পর, নতুন এক পথে এগোনোর অস্থির তাগিদ বুকে নিয়ে চাকরি ছেড়ে দিয়ে জমিতে ফিরেছিল ওয়ার্ডবয় সোমনাথ মাইতি।
    …..
    কিন্তু জমিতে ফিরলেই কি চাষের মাটিতে ফেরা সহজ হয়? সোমনাথের বাবার বিঘা দুই জমি রয়েছে বটে, তবে অলাভজনক চাষের কাজে যাননি তিনি। সোমনাথ তাই চাষের তেমন কিছুই জানেনা। শূন্য নয়, বরং ঋণাত্মক কোন আবছা প্রান্ত থেকে শেখার কাজ শুরু করে সে। আর দশজন চাষীর মতো চেনা রাস্তায় নয়, বরং বীজ, সার, কীটনাশক থেকে শুরু করে চাষের প্রতিটি ছোটবড় পর্যায়ে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করে নামমাত্র খরচে ফসল ফলানোর জেদ তখন সোমনাথকে ঘুমোতেও দিচ্ছেনা প্রায়…। 

    কৃষিবিজ্ঞানের কোন কোন ক্লাস, কোর্স, ছোট্ট প্রশিক্ষণ হোক বা সেমিনার, সোমনাথ খবর পেলে ঠিক পৌঁছে যায় সবখানে। কিছুটা শিক্ষকদের দিকদর্শন আর বাকিটা নিজের তুখড় কমনসেন্স কাজে লাগিয়ে সোমনাথ দেখে 'দশ ছাব্বিশ' টাব্বিশ সার নয়, বরং গাঁয়ের পুকুরের আকাজের  একগাদা কচুরিপানা শেকড় কেটে, রাজ্যের ঘাসপাতার সঙ্গে জমিতে ঢেলে দিয়ে পচালে ক্ষেত তো উর্বর হয়ই, সঙ্গে মাটিতে অতিরিক্ত কেমিক্যাল সারের বয়ে আনা 'নোনা' ধরার সমস্যা থেকেও মুক্তি মেলে অনেকটাই। প্রথাগত ভার্মি সার তৈরি করতে গিয়ে ততদিনে ও জেনে গেছে, বাজারচলতি ভার্মি সারের বিলিতি কেঁচো যে আসলে আমাদের দিশি মাটির ''বন্ধু কেঁচোকে'' মেরে ফেলে দীর্ঘমেয়াদে মাটির ঠিক কতখানি ক্ষতি করে থাকে…তা বা এমন আরো কত কিছুই।

    কৃষিপাঠের অভিজ্ঞতা থেকে শিখে গাছের খাদ্যগ্রহণ ক্ষমতা সম্পর্কে যেমন সোমনাথের স্পষ্ট ধারণা জন্মায়, তেমনি সে বোঝে উৎপাদনের খরচ কমিয়ে কৃষিকে দীর্ঘমেয়াদি ভাবে লাভজনক স্তরে নিয়ে যেতে হলে একান্তভাবে নিজস্ব এলাকার সার, কীটনাশক, বীজ, বা অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদানগুলোর ওপরেই ভরসা রাখতে হবে। তাই কচুরিপানা সারের পাশাপাশি কীটনাশক হিসেবে নিমতেলের সঙ্গে হলুদ, তুলসী, থানকুনি, আকন্দ'র পাতা, কাঁচালঙ্কা ইত্যাদি বহুল পরিচিত উপাদানের মিশেলে সে বানিয়ে ফেলে জোরালো এক পোকামাকড় নাশক ওষুধ। বহুশত বছরের দেশের পরম্পরাগত কৃষিপদ্ধতি অনুসারে ক্ষেতের চারপাশে লাগিয়ে দেওয়া বারোমাসি গাঁদাফুল গাছের দেওয়াল গড়ে পোকার প্রাথমিক উপদ্রব আঁটকানোর পথ অবশ্য আগেই নিয়েছিল সে। 
    ……
    যদিও এই যে এত অভিনব সব উদ্যোগ, সে সমস্ত ফলবতী হয়ে উঠেছিল দীর্ঘ এক ধূসর সময় পার করতে হয়েছিল সোমনাথকে। তার নিজের কথায়, " অর্গানিক চাষ নিয়ে এখন এমন একটা ট্রেন্ড চলছে, যেন এই অর্গানিক চাষ করলেই সব কৃষকের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে আর সব কৃষক বড়োলোক হয়ে যাবে। সব জীবিকাতেই বিভিন্ন সমস্যা আছে। কৃষক বলে আলাদা এডভান্টেজ নেবার দরকার নেই….।" 

    শুধু ১ বা ২ নয়, পর পর ৫বছর সোমনাথ ১০০% জৈব পদ্ধতিতে চাষ করার পরেও লাভ করা তো দূর, কখনো সখনো চাষের জন্য বিনিয়োগ করা সামান্য খরচটুকুও ওঠাতে পারেনি। কখনো বাজার থেকে কিনে আনা বীজের গুণমানে দোকানি তাকে, ঠকিয়েছে, নাহলে কখনো ফসল নষ্ট হয়েছে পোকায়। কোন বছর উৎপাদন যৎসামান্য তো কোন মরশুমে তার সবজি বাজারে ঢুকেছে সেটির চাহিদা চলে যাওয়ার সময়….।

    যেমনটা সে শুনেছিল, অর্গ্যানিক ফসল ফলানো সোজা আর মার্কেটও তার আজকাল ভালোই। তবে কেন তার এমন ক্ষতি হচ্ছে? একদিকে হতাশ পরিবার, উৎসুক পাড়াপড়শী তো বটেই নিজের উদ্যমী মনটার জন্য যুৎসই একখান উত্তর খোঁজার পাশাপাশি সোমনাথ ক্রমাগত তার দুবিঘে জমিতে চাষবাস নিয়ে একদম বাস্তবভিত্তিক পরীক্ষানিরীক্ষা করেই চলে। এই ট্রায়াল-এরর পদ্ধতি ওর, প্রত্যাশিত ভাবেই বিফলে যায়নি। সময় ঠিক একসময় জরুরি উত্তরগুলো নিয়ে আসতে থাকে ওর কাছে! আর লম্বা ৫বছরের পর, চাষের মাঠে প্রথম লাভের মুখ দেখতে শুরু করে সোমনাথ মাইতি।

    গাঁয়ের নতুনতম তরুণ এই চাষীর জৈবচাষের নটে - গিমে - ধনে - পটল - বেগুন -ঢ্যাড়স-কপি-সিম- মূলোর সুস্বাদ যে সেই হারিয়ে যাওয়া দিনের সব্জিগুলোর মতোই! প্রথমদিকে শুধু কৌতূহলের কারণে নিলেও, এবার  তার খেতের পাশ থেকেই সোজা নিজেদের বাড়ির জন্য সোমনাথের সব্জি কিনে নিয়ে যাওয়া শুরু করেন, গ্রামবাসীরা। ক্রমে আগ্রহ দেখায় গাঁয়ের দোকানগুলোও। হাটে নিয়ে যাওয়ার আগেই সোমনাথের ছোট্ট খেতের দৈনিক উৎপাদন ফুরিয়ে যেতে শুরু করে ব্যাপক চাহিদায়। 

    ৫বছরের আগুনে পোড় খাওয়া চাষি সোমনাথ "গেল বছরের" সংরক্ষিত বীজকে ঘরোয়া কচুরিপানার উর্বর জমিতে বিছিয়ে, ঘরে তৈরী কীটনাশক গাছপালায় ছড়িয়ে আর প্রশিক্ষণ ও নিজস্ব মগজ কাজে লাগিয়ে একই জমিতে ফলাতে থাকে ৩/৪ রকমের 'সাথীফসল' অর্থাৎ শাকসবজি। ফলে এক ফসলের দাম বাজারে কম পেলেও, বাকি ফসলের বিক্রিবাটায় আয় যতটা হয়, তাতে সাথের দুজন মজুরের 'চার্জ' আর কিছু উৎপাদনব্যয়কে ভালোভাবে পুষিয়ে লম্বা অপেক্ষার 'লাভ'কে ঘরে তুলতে সক্ষম হয়ে ওঠে সে, বোধকরি আজীবনের মতোই।
    …...
    এই পর্ব শুরু করছি সোমনাথেরই কথা ধার করে। "এই জৈব চাষ তখনই লাভজনক হবে, যখন আমরা সবাই জীবনটাকে প্রকৃতি সাথে মিশিয়ে দিতে পারবো। আমি কৃষক হিসাবে চাষ করি কারণ এখন একটু কষ্ট হলেও এই পদ্ধতিতেই খালি আগামীদিনে চাষের খরচ কমতে পারে। ….ক্রেতারা আজকাল এমন ভাব দেখাচ্ছে যেন, সব অর্গ্যানিক না খেলে অনেক বড়ো বিপদ হয়ে যাবে। তাই নুন পর্যন্ত অর্গানিক চাইছে ।
    এটা অবশ্যই খুব ভালো লক্ষণ। তবে বাজার ধরতে গিয়ে অনেকেই নিজেদের কাজকাম ছেড়ে চাষ করতে নেমে গেছে। আর দুদিন চাষ করে লাভ এর হিসাব কষতেও শুরু করেছে। ... এটা কিন্তু একদিনের কাজ নয়। ক্রেতা যেদিন সত্যিই বুঝবে, জৈবচাষের ফসল তার সুস্থ থাকার জন্য জরুরী, সেদিন চাহিদা বাড়বে…আর মাঠ থেকে ফড়ে হয়ে নয়, বরং ক্রেতার কাছে সরাসরি ফসল পৌঁছতে হবে।… তাই আলোচনা আসুক কৃষক কেনো এখনো জৈব চাষ এ ফিরছে না।"

    তবে পুরোপুরি জৈবচাষ করে সফল হওয়া সোমনাথ মাইতি তো আর চাষবাস করে একলা ধনী হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে ওয়ার্ডবয়ের চাকরি ছাড়েনি। শুরু থেকেই তার বুকে লুকানো ছিল সাথী চাষিভাইরা সহ বৃহত্তর সমাজকে সঙ্গে নিয়ে জৈবকৃষির পথ ধরে সামনের দিকে এগোনোর আরো কিছু নাছোড় স্বপ্ন। তাই ও একদিকে তৈরি করে ফেলে 'ইনোভেটিভ অ্যাগ্রো ফার্ম' আর অন্যদিকে এবাংলা হোক বা ওপার বাংলা; 'আপনজন যৌথ সমবায়ের' মতো প্রাকৃতিক চাষ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত নানান প্রতিষ্ঠান, সমাজকর্মী আর চাষীদের সঙ্গেও এক নিবিড় সমন্বয় গড়ে তুলতে শুরু করে। চাষ হোক বা অন্যত্র জলের অপব্যবহার আর নদীদূষণ বন্ধ করার উদ্যোগগুলোতে সোমনাথ সামিল হয়ে যায়। সামিল হয়ে যায় লোকশিল্পের প্রসারের মাধ্যমে গ্রামস্তরে রোজগার তৈরির চেষ্টাতেও। 

    আসলে নিজেকে 'চাষা' বললেও সোমনাথ নিজে এক পুরোদস্তুর সমাজকর্মী। তাইতো ২২এর অক্টোবরে বাল্যবিবাহরোধ আর দেশীয় বীজ সংরক্ষণের বার্তা জনমানসে ছড়িয়ে দিতে সাইকেলে চেপে নিজের গ্রাম, দক্ষিণ ২৪ পরগণার পাথরবেড়িয়া থেকে পাঁশকুড়া পর্যন্ত দীর্ঘপথ পাড়ি দেওয়ার আগে ও লিখে যায়,
    "প্রয়োজন তো এইটুকুই ছিল। খাবার - পোষাক আর একটু মাথা রাখার ঠিকানা। কিন্তু এর জন্য এতোটাই কী আধুনিক হবার প্রয়োজন ছিল? যার জন্য আজ বাতাস দূষিত, জলের জন্য হাহাকার, একটু পুষ্টিযুক্ত খাবারও নেই। জীবনে যতটা এগিয়েছি, তার থেকে হয়তো অনেকটাই পিছিয়েছি আমরা। … তাই চেষ্টা করছি সবার পাতে একটু পুষ্টিযুক্ত খাবার কীভাবে মিলবে। পরিবর্তন কতটা করতে পারব জানিনা, তবু আমার শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে চেষ্টা করে যাব আমি…"।
    …….
    সোমনাথ বা ওদের মত তরুণ উদ্যমী চাষীরা, যাঁরা কৃষিকে আর পরিবেশ-প্রকৃতিকে ভালোবেসে চাষের ক্ষেতে নেমেছেন, তাঁদের সঙ্গে কথা বলে কয়েকটি লক্ষ্য খুব স্পষ্টভাবে বোঝা যায়—--
    প্রথমত, এঁরা নিজেদের কাজের মধ্যে দিয়ে সমাজে কৃষকদের হারিয়ে যাওয়া সামাজিক সম্মানকে আবার ফিরিয়ে আনতে চান।
    দ্বিতীয়ত, ছোট কৃষকরা গরিবদুঃখী, অসহায়,ঋণগ্রস্ত, সর্বদা পরকৃপাপ্রার্থী… শহুরে জনতার এই ভুলভাল ধারনাকে এঁরা আগাপাশতলা বদলে দিতে চান।
    তৃতীয়ত, এঁরা নিজস্ব কৃষিপণ্যের প্ৰাকৃতিক গুণমানের বজায় রাখার পাশাপাশি জরুরী জোর দিয়ে থাকেন, পণ্যের বিপণন কৌশল আর গোটা প্রক্রিয়ার বাস্তবভিত্তিক ম্যানেজমেন্টের ওপর।

    এই যেমন সোমনাথ বলে, "কৃষক চাষ করতে পারে না বলে লাভ পায় না এমনটা নয়। আমরা যদি, ফসল চক্র, জমির চাষ নকশা আর বীজ সংরক্ষণ ও বপন ব্যবস্থার প্রতি একটু মনোযোগ দিতে পারি, তাহলেই আমরা অনেকটা সফল হতে পারি…"। 
    আসলে এই নতুন চাষীরা চাষের সমস্ত অনিশ্চয়তা স্বত্ত্বেও নিজেদের পেশাটিকে নিয়ে যতখানি গর্বিত, ততখানিই প্ৰাকৃতিক কৃষিক্ষেত্রের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁরা ভরপুর আত্মবিশ্বাসী। তাইতো এঁদের একজন হিসেবে সোমনাথ নিজেকে এক সফল ''উদ্যোক্তা কৃষক'' রূপে পরিচায়িত করতে চেয়েছে সবসময়।
    …….
    তবে , এই নবীন কৃষকটি কিন্তু নিজের ধারালো চিন্তার মতোই স্পষ্টবাক। ফলে চাঁচাছোলা ভাষায় ও জিজ্ঞেস করে, "গ্রামে অর্গ্যানিক চাষ হলেও এখন সমস্ত ফসলই শহরে চলে যায়। তাহলে আমরা গ্রামের লোকগুলো খাব কি? হাটবাজার থেকে কিনে আনা সেই বিষ দেওয়া খাবার?..." এই ব্যতিক্রমী নীতিবোধ থেকেই সোমনাথ তার ফসলের সিংহভাগ প্রতিটা দিন বিক্রি করে থাকে পাথরবেড়িয়া গ্রামবাসীদেরকেই। 

    সঙ্গে অবশ্য আমাদের মতো শহুরে লোকদের পাতেও নিখাদ পুষ্টিকর খাবার পৌঁছনোর কথাও ভেবেছে সোমনাথ। সেই লক্ষ্যে দক্ষিণ কলকাতা আর শহরতলীতে 'প্রকৃতির ঝুড়ি' নামের একটি অভিনব প্রকল্প চালিয়ে যাচ্ছে ও। গাঁ থেকে দীর্ঘ রাস্তা সাইকেলে পাড়ি দিয়ে 'প্রকৃতির ঝুড়ি' নামের দুখান ব্যাগে ভরে সপ্তায় দুদিন নির্বিষ শাক-থোর-মোচা-অন্য সবজি-কাঁঠালি কলা-মাশরুম-ওর নিজের হাতে তৈরি করা ফার্মের হাস-মুরগীর ডিম বা কখনো সখনো দিশি মাছ-মাংসও স্বল্পদামে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসে সোমনাথ আর ওর সঙ্গীরা। কেবল জৈবচাষের ফসল বিক্রিই নয়, এই প্রকল্পের মধ্যে দিয়ে শহুরে ক্রেতারা তাঁদের পাতের ভাত-সবজি-ফল-ডিম উৎপাদকদের নাম-সাকিনের খুব জরুরি তথ্যগুলোও জানতে পারেন, সে দিকেও নজর রাখে আমাদের এই চাষীভাইটি ।
    ……

    সঙ্গে অবশ্য রয়েছে ছাদবাগানও। হ্যাঁ, এই শহর আর শহরতলীর বুকে সোমনাথের সেই উদ্যোগও চলছে হৈ হৈ করে। ও নিজেকে যেমন ছাত্র বলতে ভালোবাসে, তেমনি আগ্রহী শহুরে মানুষের ডাকে সে প্রায় রোজই নানান স্কুল-কলেজ-প্রতিষ্ঠান,গৃহস্থের ঘরে ঘরে কৃষিবিজ্ঞান শিখিয়ে বেড়ায় বড় যত্ন করে মতে। সোমনাথ প্রশ্ন করে, খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া এই ২১ শতকে এসেও কেবল চাষীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে কেন? কেন প্রতিটি ঘরে মানুষ নিজস্ব খাদ্যের কিছুটা অন্তত উৎপাদন করতে সক্ষম হবেনা? ফুল বা শৌখিন ফলগাছের বাইরের প্রকৃতিকে কেনই বা তার খাদ্যের নিখাদ সম্ভার সহ ছাদে-বারান্দায় আদরের বসত করে দেবেনা শহরের লোক?

    সোমনাথ পরম যত্নে ছবি আঁকে শহুরে ছাদের শাকসবজি বাগানের। ছবি এঁকে ও সামান্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে আনাড়ি বাগানিদের শিখিয়ে দেয়, ফ্ল্যাটের এককুচি বারান্দাতেও হরাইজন্টাল-ভার্টিকাল-এমনকি ফোল্ডিং বাগিচার প্রায় অসম্ভব এক কৃষিক্ষেত্র কিভাবে সস্তা, সহজ অথচ সম্পূর্ণ জৈব পথে, সামান্য খরচে ভরপুর ফলবতী হয়ে উঠবে! 

    যেমন নিজের দেহটাকে সোমনাথ মানুষের জন্য দিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকারে সই করে ফেলেছে সেই কবে, ঠিক তেমনই অবাক করা সমাজ সচেতনতা আর আন্তরিক শ্রমের পুঁজি নিয়ে সোমনাথ আগামীর স্বপ্ন দেখে। ও স্বপ্ন দেখে চাকরিবাকরিহীন এই 'নেই রাজ্যে' কৃষিকে ভালোবেসে কৃষির পথে নিকট আগামীতে ওর প্রশিক্ষণে ওর মতো করেই এক "গর্বিত উদ্যোক্তা কৃষক" হিসেবে স্বচ্ছল-স্বনির্ভর উঠবে অজস্র তরুণ-তরুণী। তবে বলি, কেবল স্বপ্ন দেখাতেই কিন্তু থেমে নেই ও, বরং সত্যিই শিখিয়ে পড়িয়ে বেশ কিছু উদ্যমী ছেলেমেয়েকে সোমনাথ রোজগেরেও বানিয়ে ফেলেছে ইতিমধ্যে।
    ……

    আমার মতোই আজ বহু মানুষ আজ এক ডাকে চেনেন, সম্মান করেন দক্ষিণ ২৪ পরগণার পাথরবেড়িয়া গ্রামের 'এন্টারপ্রেনিওর ফার্মার' তথা এক আদ্যন্ত ব্যতিক্রমী চরিত্র সোমনাথ মাইতিকে। একদিকে ছাদে-বারান্দায় সফল কৃষিক্ষেত্র গড়ে তোলার এক প্রায় অসম্ভব প্রয়াসকে বাস্তবায়িত করে নিরাপদ উদ্ভিজ্জ খাদ্যের যোগানকে মানুষের হাতের মুঠোয় এনে দেওয়ার প্রয়াস আর অন্যদিকে বহু কষ্টের বিনিময়ে নিজের অধীত প্রাকৃতিক কৃষিবিদ্যাকে অল্পবয়সীদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে অতি সামান্য পুঁজিতে বড়সড় কর্মসংস্থান করার জোড়া লক্ষ্যের ধক নিয়ে সোমনাথ মাইতি এগিয়ে চলুক এ বাংলার শহরে-গ্রামে-সমতলে-পাহাড়ে। আমরাও আসুন না, কিছুটা নড়েচড়ে বসি আর প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে ওর-ওদের যাত্রাপথের সঙ্গী হই।।
    …..

    আমার সঙ্গে অজস্র কথা মনে খুলে বলে যাওয়ার জন্য আমি সোমনাথ ভাইয়ের কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই।

    এই লেখার প্রতিটি তথ্য আর সঙ্গের ছবি সোমনাথের অনুমতিক্রমেই দেওয়া হয়েছে কিন্তু।

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • অপার বাংলা | ০৬ জানুয়ারি ২০২৩ | ৮৩০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • aranya | 2601:84:4600:5410:5d32:ea30:6a6e:859 | ০৬ জানুয়ারি ২০২৩ ২৩:২০515028
  • খুব ভাল লাগল। দারুণ উদ্যোগ। এর সাথে কোনভাবে জড়িত হতে পারলে খুশী হব 
  • Suchetana Mukhopadhyay | ০৭ জানুয়ারি ২০২৩ ০০:০৪515032
  • অরণ্য আপনাকে স্বাগত। সোমনাথকে যোগাযোগের নম্বর দিচ্ছি। 
  • aranya | 2601:84:4600:5410:710a:ee70:14dc:b1b4 | ০৮ জানুয়ারি ২০২৩ ০৭:৫৯515070
  • ধন্যবাদ সুচেতনা, এবং পরে যিনি লিঙ্ক দিলেন 
  • dc | 2401:4900:1f2b:c0:3169:1ebb:1a5a:24fc | ০৮ জানুয়ারি ২০২৩ ১০:৪৩515074
  • সোমনাথবাবুর উদ্যোগ খুব ভালো লাগলো। 
     
    চেন্নাইতেও এরকম কিছু কোম্পানি আছে, যারা শহরের বাইরে বেশ বড়ো জায়গায় ফার্ম বানিয়ে শাক সবজি মুর্গি ছাগল ইত্যাদির চাষ করে আর সেগুলো হোম ডেলিভারি দেয়। আমরা এরকম একটা ফার্মের থেকে কিনি, সেটা এক দম্পতি চালান। ওনারা দুজনেই এগ্রি সায়েন্স নিয়ে পড়েছেন, তারপর নিজেদের ব্যবসা শুরু করেছেন। ওনাদের কয়েকটা টেম্পো সপ্তাহে দুদিন করে হোম ডেলিভারি দেয়, আগে থাকতে অর্ডার দিয়ে রাখতে হয়। 
     
    অর্ডার এর ইউনিট হলো বাস্কেট, অর্থাত সপ্তাহে অন্তত পাঁচশো টাকার একটা বাস্কেট নিতে হবে। দুটো ডেলিভারি চাইলে হাজার টাকা। ভেজিটেবিল-মাংস-ডিম ইত্যাদির একটা লিস্ট ওনারা সপ্তাহে দুবার করে হোয়াতে দিয়ে দেন, সেইমতো অর্ডার দিতে হয়। আর রোববার করে ওনাদের ফার্মে যাওয়ার ব্যবস্থা আছে, গেলে ওনারা সব কিছু ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখান। আমরা দুয়েকবার গেছি, ওনাদের সাথে অনেক কথাও হয়েছে। ওনারা "অর্গ্যানিক ফার্মিং" বলতে চান না, বলেন "ন্যাচারাল ফার্মিং", অর্থাত কিনা আগে যেভাবে চাষ হতো কেমিক্যাল ইত্যাদি না দিয়ে, সেরকম চাষ ব্যবস্থা। 
     
    আশা করি সোমনাথবাবুরও ব্যবসা আরও অনেক বড়ো হবে।   
  • Suchetana Mukhopadhyay | ০৯ জানুয়ারি ২০২৩ ১৮:০৫515093
  • আপনার বিস্তৃত মন্তব্যের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ।
    পশ্চিম বাংলায় বা বলা ভালো গোটা দেশে, গোটা উপমহাদেশেই এমন নানা উদ্যোগ যে অনেক বেশি করে, অনেক সফল ভাবে উঠে আসছে, তা খুবই সদর্থক কথা। তবে প্রচার দরকার আরো বড় মাত্রায়। এজন্য ক্রেতাদেরও সমভাবে এগিয়ে আসতে হবে।
     
    সোমনাথ নিজে কখনো এ প্রসঙ্গে অর্গ্যানিক, কখনো প্রাকৃতিক, কখনো বা জৈব চাষ শব্দবন্ধ ব্যবহার করে থাকেন। সেমতই লেখায় আমি ব্যবহার করেছি।
     
    প্রাকৃতিক চাষের শহুরে সংগঠক বা সমবায় প্রতিষ্ঠানগুলো প্রচার পেলেও উৎপাদকরা অনেক ক্ষেত্রে সেই আড়ালেই রয়ে যান। লেখার মাধ্যমে তাঁদের সামনে আনার প্ৰচেষ্টা চলবে আগামীতেও। 
    অনুগ্রহ করে লেখার সঙ্গে থাকবেন।
     
     
     
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে মতামত দিন