এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ভ্রমণ  দেখেছি পথে যেতে

  • একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে – উত্তরপূর্বের টুকটাক - ৪

    লেখকের গ্রাহক হোন
    ভ্রমণ | দেখেছি পথে যেতে | ২৬ জানুয়ারি ২০২৩ | ৭৮১ বার পঠিত | রেটিং ৪.৩ (৩ জন)
  • | | | | | |
    ত্রয়োদশ শতকে কামরূপ অঞ্চলের অধিবাসী বিভিন্ন জনজাতির মধ্যে সামাজিক ও রাজনৈতিক সংযোগ ও সংঘর্ষের ফলে কামতা,চুতিয়া, ডিমাসা ইত্যাদি রাজ্যের উদ্ভব হয়। ব্রিটিশরা ডিমাসা (বা কাছাড়) রাজ্যের সমতল অংশ ১৮৩২ আর পাহাড়ি অঞ্চল ১৮৩৪ এ দখল করে নাম দেয় সংযুক্ত কাছাড় জেলা। স্বাধীনতার পরে এই অঞ্চল তিনভাগে ভাগ হয়ে তিনটি জেলায় পরিণত হয়। ডিমা হাসাও, কাছাড় আর হাইলাকান্দি জেলা। ডিমাসা শব্দের মানে বড় নদীর সন্তান, এখানে বড় নদী বলতে ব্রহ্মপুত্রকে বোঝানো হয়েছে। ডিমাসাদের সাথে অহোমদের যুদ্ধ বিগ্রহ লেগেই থাকত। কখনো অহোমরা জেতে তো কখনো ডিমাসাদের জয় হয়।

    তা সপ্তদশ শতকের শুরুর দিকে  ডিমাসারাজ যশনারায়ণ অহোমদের হারিয়ে দেন একবার আর হারিয়েই নিজেকে হিড়িম্বাপুত্র ঘটোৎকচের বংশধর অর্থাৎ কিনা ভীম এবং পান্ডবদের বংশধর বলে ঘোষণা করেন। যা দেখছি ‘জানেন আমি কে?’ লক্ষণ পাঁচশো বছর আগেও দিব্বি ছিল। ডিমাসা রাজ্যের নাম বদলে হেড়ম্বরাজ্য আর নিজেকে হেড়ম্বেশ্বর উপাধি দেন। রৌপ্যমুদ্রাও চালু করেন হেড়ম্বেশ্বর নামে। যদিও ঐতিহাসিকেরা  ঘটোৎকচের সাথে সম্পর্কের আর কোন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রমাণ বা উল্লেখ পান নি। হেড়ম্বেশ্বরের নামাঙ্কিত এই মুদ্রা ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীন জনজাতিদের মধ্যে প্রথম প্রচলিত মুদ্রা বলে মনে করা হয়।

    ঈস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাগজপত্রেও হেড়ম্বরাজ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। তো এই ডিমাসা বা হেড়ম্বদের সাথে জাটিঙ্গারাজেরও ঝগড়াঝাঁটি ছিল। ডিমারুয়া অঞ্চলের অধিকার নিয়ে যুদ্ধ লেগে যায়। জাটিঙ্গারাজ ধনমাণিক যুদ্ধে হেরে যান ১৬১২ নাগাদ। ধনমাণিকের মৃত্যুর পর ডিমাসাকাছারি রাজা শত্রুদমন যশমাণিককে জাটিঙ্গার সিংহাসনে বসিয়ে যান। এই যশমাণিক চুপচাপ কিছু কলকাঠি নেড়ে অহোমদের সাথে ডিমাসাদের  ঝগড়া লাগিয়ে দেন। এতসব ঝগড়া লড়াইয়ের পাশাপাশি ডিমাসারা আস্তে আস্তে হিন্দুধর্মের মূলধারায় প্রভাবিত হয়ে পড়তে থাকেন। ব্রাহ্মণ কুলগুরু নিয়োগ, ব্রাহ্মণ ধরণের নাম নেওয়া ইত্যাদি চলতে থাকে।

    এই হিন্দু ব্রাহ্মণ প্রভাবের ফলেই মাইবঙে বেশ কিছু মন্দিরও রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠে। ষোড়শ থেকে অষ্টাদশ শতকের মধ্যে বেশ কিছু পাথর কাটা মন্দির মাইবঙে তৈরী করেছিলেন ডিমাসারাজারা। অধিকাংশই ধ্বংস হয়ে গেছে, খুব একটা হদিশ পাওয়া যায় না। এখনো যে মন্দিরখানা দেখা যায় বাইরে থেকে সেটা হল রণচন্ডী মন্দির, নদীর বেশ খানিক ভেতরে আগাগোড়া একটাই মস্ত বোল্ডার কেটে  বানানো মন্দিরের ভেতরে কোন মূর্তি নেই এখন আর। আগে রণচন্ডী অর্থাৎ গৌরী বা দুর্গার আরেকরূপের পুজো হত। মাইবং শহরেই আরেকটা প্রাচীন মন্দির আছে রামচন্ডী মন্দির নামে, এখানে পুজো হয় মন্দিরের অবস্থাও অনেক ভাল।

    তো আমার মাইবং যাবার মূল আকর্ষণ ছিল এই প্রাচীন মন্দিরগুলি ও কাছাড় রাজত্বের আরো কিছু চিহ্ন যদি থাকে। কোনও এক সাইটে দেখেছিলাম রাজপ্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ আছে ওখানে। এছাড়া  জলপ্রপাতও আছে বটে তবে ডিসেম্বরের শেষে সে জলপ্রপাত নিতান্তই শীর্ণকায়া হবার কথা। অন্তত জাটিঙ্গা ও মাহুর নদীকে দেখে সেরকমই মনে হল। এদিকে মাইবং যাব শুনে শুবজিৎ কেমন ঘাবড়েমত গেল। সেখানে নাকি বিশেষ কিছু দেখার নেই। তবে বারবার করে বলল খুব সকালে বেরোতে হবে  সে অনেক দূর। তিন চার ঘন্টা লাগবে যেতে, আমি গুগল দেখে বললাম নাহ দুই ঘন্টার মধ্যেই পৌঁছানোর কথা।

    ঠিক হল আমরা বেলা দশটায় বেরোব। সেইমত সকালে কফি আর পাঁউরুটি টোস্ট খেয়ে স্নান করে বেরোলাম। গিজারে কিছু একটা সমস্যা ছিলই, ম্যানেজার  ছেলেটি বাঙালি, সানি দত্ত নাম। এসে কিছু খুটখাট করে চালিয়ে দিয়ে গেল। এখানে সূর্য ওঠে ভোর সাড়ে পাঁচটা নাগাদ, ফলে দশটা মানে বেশ বেলা। শুবজিৎ বারোক্লাস অবধি পড়েছে বলল, তারপরেই কাজের খোঁজে শিলঙ পাহাড়ে চলে যায়। সেখানেই গাড়ি চালাত। লক ডাউনে গাড়ির চাহিদা শুন্যে নেমে আসায় আবার হাফলঙে ফেরত আসে। হাফলং থেকে একঘন্টা দূরত্বে এক পাহাড়ে ওর গ্রাম। হাফলঙে একাই থাকে। সকালে উঠে খাবার বানিয়ে খেয়ে কাজে বেরোয় আবার রাতে ফিরে বানায়।

    এইসব নানা বকবক করতে করতে চলেছে আর তার মধ্যে আসছে অজস্র ফোন। ফোনটা আবার গাড়ির স্পিকারে দেওয়া। ফলে কথোপকথন সবই ৫০ ডেসিবেলে চলছে। জানলাম যে ভাষায় কথা বলছে সেটা নাকি ডিমাসা ভাষা। অহমিয়ার সাথে কোনই মিল নেই মনে হল। অহমিয়া খেয়াল করে শুনলে অনেকটাই বোঝা যায়, এটা বিলকুল অচেনা। সড়কপথে হাফলঙ ও মাইবঙের মাঝে একখানা বড়সড় টানেল আসে, এক কিলোমিটার লম্বা। শুবজিৎ ভারী উৎসাহভরে আমাকে টানেলের বাইরে বা মাঝখানে থেমে ছবি তোলার প্রস্তাব দিল। পত্রপাঠ নাকচ করলাম, টানেলের সাথে ছবি নেবার ধারণাটাই কেমন অদ্ভুত বিচিত্র না?     
      
    টানেল নিয়ে শুবজিৎ বেজায় উচ্ছসিত। নানারকম গুণগান করার পরে জিজ্ঞাসা করেই ফেলল আগে আর কখনো এরকম টানেল দেখেছি কিনা। তা পুণে কাটরাজ টানেল এর চেয়ে বড়, তিন লেনের টানেল প্রায় এক কিলোমিটার দুশো মিটারের মত লম্বা। কাজেই এটা দেখে মোটেই অবাক টবাক হই নি, জেনে আরো মুষড়ে পড়ল বেচারি। একটা বাজার এলাকা দেখে থামা হল একটু। পাশেই একটা সাদা ধবধবে মন্দির। বাজারে যে জিনিষটা দেখে অবাক এবং খুশী হলাম সেটা হল একটা বোর্ডে পুলিশ, সেনাবাহিনী, হাসপাতাল, দমকল ইত্যাদি যাবতীয় জরুরী ফোন নাম্বার লিখে দেওয়া। নাগরিকদের সুবিধার্থে আর কোথাও এরকম বোর্ড দেখেছি বলে মনে করতে পারলাম না।
     
     

    মাইবঙে ঢোকার মুখে রঙচঙে গেট। গেটের উপরে ওই গ্রানাইট পাথরের মন্দিরটির ছোট্ট রেপ্লিকা বানানো। দুইপাশে ঐতিহ্যবাহী ডিমাসা পোষাকে সজ্জিত এক পুরুষ ও নারীর রেপ্লিকা। প্রথম যাওয়া গেল এক ভিউ পয়েন্টে। বেশ গাছপালা ঘেরা, প্রায় জঙ্গলের মধ্যে পাহাড়ি রাস্তায় খানিক ঘুরে ঘুরে উঠে তিনতলা সমান উঁচু টাওয়ার। চমৎকার রেলিংঘেরা মাথায় ছাদ দেওয়া চারিদিক খোলা বারান্দা। সামনে থেকে বিস্তৃত উপত্যকা, এঁকেবেঁকে চলা মাহুর নদী, উল্টোদিকের পাহাড়ের গায়ে ছড়িয়ে থাকা ডিমা হাসাও জেলা দেখা যায়, দেখা যায় গৌহাটি বদরপুর রেল লাইনটাকেও। আমরা ছাড়া আর চারটে বছর ১৮-১৯ এর ছেলে আর একটি ছোট পরিবার সেখানে।
     
    মাইবং গেট
     
       

    এই ডিসেম্বর মাসেও যেদিকে তাকাই সেদিকই সবুজে সবুজ। ঘন চিরহরিৎ অরণ্যে ঢাকা পাহাড়। এমন সুন্দর জায়গাটায় একটাও বসার জায়গা করা নেই। সিমেন্টের বেঞ্চ তো দূরস্থান একটা লোহা বা কাঠের বেঞ্চও নেই। বাচ্চা ছেলেকটা নানা ভঙ্গীতে সেলফি তুলে চলেছে। শুবজিৎকে দিয়ে কয়েকটা গ্রুপ ফোটোও তোলালো। শুবজিৎও তাদের দিয়ে নিজের বেশ কয়েকটা ছবি তোলালো। তারপর এলো আমার দিকে, ছবি তুলে দেবে। এযাত্রা আর ওকে ফেরালাম না। ইতোমধ্যে পরিবারটি নেমে গাড়ি নিয়ে চলে গেছে। নিজেদের ছবি তোলায় মগ্ন হয়ে থাকায় ছেলেগুলো খেয়ালই করে নি পরিবারটির চলে যাওয়া। ওঁদের সাথে বড় গাড়ি, সঙ্গে খানিকটা যাবে ভেবেছিল।
     
    মাইবং ভিউ পয়েন্ট   

    ছেলেগুলো নদীর ওপারের কোনও একটা পাহাড়ের কোনও একটা গ্রামে থাকে, বিভিন্ন গাড়ি ধরে হিচহাইক করে বেড়াতে এসেছে মাইবং। শুবজিৎ ওদের নিজের অল্টোতে চাপিয়ে নীচের নদীর ধারে ছেড়ে দেবে বলে। এই পুরো কথোপকথনটাই ওদের ডিমাসা ভাষায় হয়, শুবজিৎ এসে আমাকে হিন্দিতে জানায়। কয়েক মুহূর্তের জন্য মনটা একটু খুঁৎখুঁৎ করে --- এই নির্জন জায়গা আমরা কজন ছাড়া একটা মানুষ নেই, এদের কাউকেই আমি চিনি না, ওরা যে ভাষায় কথা বলছে তা একবিন্দুও বুঝি না --- কে জানে পুরোটাই এদেরই প্ল্যান করা কিনা। ইতস্তত করে বলি গাড়ি তো আমার রিজার্ভ করা, এতজন তো ধরবে না ছোট গাড়িতে।

    শুবজিৎ ব্যস্ত হয়ে বলে না না ওরা কোলে টোলে বসে যাবে, নাহলে এখান থেকে কী করে যাবে বলুন? কখন কোন গাড়ি আসবে, এই তো একটুখানি। একলা পথে বেরিয়ে অন্যদের সাহায্য করব না? থাক উঠুক  এই তো রোগা প্যাংলা কটা ছেলে! অবশ্য ওদের সাথে দুটো ব্যাকপ্যাকও ছিল, কে জানে তাতে বিপজ্জনক কিছু ছিল কিনা। পেছনে দুজন ওঠে আমার সাথে আর সামনের সিটে আরো দুজন, একজন আরেকজনের কোলে বসে যায়। কয়েক পাক ঘুরেই পৌঁছে যাই নদীর কাছাকাছি। রাস্তা তৈরী হচ্ছে এখানে, ফলে অসম্ভব ধুলো, কিছু কাদা। ছেলেগুলো নেমে যায় বোল্ডার ধরে নদীখাতে। শুবজিৎ আমাকেও নামতে বলে।

    আমি রাজী হই না, একে তো এত ধুলো তায় অমন নড়বড়ে রাস্তা দিয়ে নেমে  দেখবটা কী? কোথায় এক অনির্দেশ্য জায়গার দিকে হাত দেখিয়ে বলে ওইখানে রাজাদের বাড়ি আছে, ওই দেখতেই ট্যুরিস্টরা আসে তো। বলে কি রে বাবা! নাহ আমি নামতে রাজী হই না। গুগলে বা মাইবং সম্পর্কিত তথ্য যে সব সাইটে আছে কোথাও এখানে কোনও রাজার বাড়ির কথা বলা নেই। আমাকে সেসব যেখানে আছে সেখানেই নিয়ে চলো। শুবজিৎ কাকে যেন ফোন করে, রাস্তা বানানোর কাজে ব্যস্ত কর্মীদের জিগ্যেস করে। আমি গ্যাঁট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। তারপর কোত্থেকে কিসব বুঝে এসে বলে চলো আরেকটা অন্য রাস্তা আছে।

    ঘুরে ঘুরে নিয়ে গেল নদীর ওই পারে একটা ব্রিজের কাছাকাছি। সেদিকে নদীখাতে নামার  ঢালু রাস্তা আছে, বালিমাটির তবে নামা যায় দিব্বি।  সেখান থেকে দেখা গেল নদীর ভেতরে একটা মস্ত বোল্ডার ও মাথায় নৈবেদ্যের উপরে বাতাসার মত ছোট্ট পাথরের কুঁড়ে। আমাকে নামতে দেখে স্থানীয় একজন এগিয়ে আসেন, অহমিয়া ভাষায় বলেন এই খাত দিয়ে গাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবে ওই পাশে মস্ত গেট আছে সেখান দিয়ে ঢুকে ভাল করে দেখা যাবে।  তিনিই ব্রিজের পিলারে হলদে দাগ দেখান, মে মাসে বন্যায় জল ওই অবধি উঠেছিল। এখন এমনিই জল কম, তায় আবার রাস্তা বানানোর জন্য জল আরো খানিক সরিয়ে দেওয়া হয়েছে অন্যদিকে।


    জল উঠেছিল ওই অবধি। নদী বেঁধে রাস্তা হয়ে গেলে কী হতে পারে ভাবতেও ভয় লাগে। 
     
    গাড়ি নিয়ে যাওয়া হয় অন্যপাশে। এটা সেই জায়গা যেখানে আমায় নামতে বলছিল এবড়ো খেবড়ো বোল্ডার আর ছোট ছোট পাথরের ওপর দিয়ে। মানে ওদিকে দিয়ে নামলে শর্টকাট হত। এদিকে বেশ বড় গেট, তার দুদিকে কিছু লেখা। ভেতরে ঢুকে দেখা গেল সুন্দর বাঁধানো সিঁড়ি ধরে এগিয়ে ওঠা যায়, কাছে গিয়ে যতটা সম্ভব ভাল করে দেখা যায় পাথরের কুঁড়ে। এই সেই রণচন্ডী মন্দির, কুঁড়েতে বেশ দরজার মতো আছে। জলটুকু টপকে পাথর বেয়ে উঠলে দেখা যেতে পারে ভেতরে কিছু আছে কিনা। আমার দ্বারা তো হবে না, খুঁজে দেখতে হবে কেউ কিছু নেটে তুলে রেখেছে কিনা।


    রণচন্ডী মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ 

    কাছাড় রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ কোথায় আছে, আদৌ মাইবঙে আছে কিনা তার কোনও খোঁজ পেলাম না। দুই একটা সাইটে এটা দ্রষ্টব্য বলে লেখা ছিল, নোট করেছিলাম। কিন্তু ঠিকানা কোথাও নেই। কেউ খুব একটা বলতেও পারল না। সবাই খালি বলে সেসব তো ডিমাপুরে, এখানে নয়। শুবজিৎ কোনও এক পার্কে আর কিছু মন্দিরে নিয়ে যেতে চাইল, আমি খুব একটা আগ্রহ পেলাম না। একজন বললেন খাসপুরেও আছে কাছাড় রাজাদের বাড়ি। খুঁজে দেখি সে প্রায় আট দশ ঘন্টার দূরত্ব। অতএব চলো ফেরত যাই। কিন্তু তার আগে খেতে হবে, বেশ খিদে পেয়েছে। মাইবং গেটের ঠিক বাইরেই একটা ছোট ধাবামত, সেখানেই থামা।

    ‘আহার রেস্টুর‍্যান্ট এন্ড ধাবা’ দোকানটা চালান এক বাঙালি মহিলা নামটা উহ্য থাকুক বরং। সহাস্যে আহবান জানান, ভাত আছে রুটি হবে না। অগত্যা ভাতই সই। আর কী আছে? মাছ আছে, রুই, মাটন আছে আর হরিণ আছে। চমকে যাই, হরিণ মারা বেয়াইনি না? জিগ্যেস করি
    - হরিণ কী করে কোত্থেকে এলো?
    - নভেম্বর থেকে জানুয়ারি এই তিনমাস হরিণ পাওয়া যায়, তা সপ্তাহে দুই তিনদিন তো বটেই।
    -কোত্থেকে আসে?
    - কেন এই চারপাশের পাহাড় পুরোটাই তো জঙ্গল।
    - হরিণ মারলে কেউ কিছু বলে না?
    - নাহ কে বলবে? আর ওরা দিয়ে যায় আমি তো আনতে বলিনি। (প্রায় বাল্মিকী টাইপ ধারণা আর কি)
    মন তখন পুরো সেই টিনটিনের গল্পের কুট্টুসের মত, শয়তান বলছে খা খা খেয়েই দ্যাখ না কেমন লাগে, আর দেবদুত বলছে খবরদার খাস না এটা বেয়াইনি।



    তো শেষ পর্যন্ত শয়তানই জিতে গেল। হাফপ্লেট হরিণ আর ভাত অর্ডার করলাম। শুবজিৎও হাফ প্লেট হরিণই বলল। খাবার এলো মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই, ভাত ডাল, বেগুন আর শিদলের চচ্চড়ি, বাঁধাকপির তরকারি আর একটা কি এক অজানা শাক দেওয়া পাঁচমিশেলি তরকারি এলো। বাঁধাকপির তরকারি ফেরত দিলাম, ডালও সামান্য ঢেলে ফেরত দিয়ে খেতে বসলাম। শিদলের চচ্চড়িটা দুর্দান্ত। হরিণের মাংস একটু অন্যরকম স্বাদ, প্রচুর ফাইবার কিন্তু খসখসে ছিবড়েমত নয়। আবার চর্বিদার রসালোও নয়। মসৃণ টেক্সচার। খেয়েদেয়ে বেরিয়ে গাড়িতে শুবজিৎকে জিগ্যেস করলাম এইভাবে হরিণ মারে নিয়মিত বনদপ্তর ধরে না। বলল হ্যাঁ মাঝে মাঝে ধরে কিন্তু সে হয়ত বছর কি দুবছরে একবার।

    ফেরার পথে যাবো জাটিঙ্গা নদীর ধারে। জাটিঙ্গার সেই পাখীহত্যা হয়ে গেছে কিছুদিন আগেই। অকুস্থলে যাবার কোনও ইচ্ছে ছিল না আমার। শুধু নদী আর এলাকাটা দেখতে চাই। তা গেলাম, সেখানে কোথাও একটা জলপ্রপাতও আছে। শুবজিৎ কোনও কারণে সেদিকে যেতে চাইল না, বারেবারেই বলল সে অনেকখানি ওঠানামা তুমি পারবে না। আমিও আর তেমন জোর করলাম না। নদীর ধারে গিয়ে দেখি পাথরে পাথরে ঢাকা সে এক অতি শীর্ণ নদী চারপাশের পাহাড় ফাটিয়ে ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে নেমে এসেছে। সেখানে একটু দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই এক মাতাল এসে গপ্প জুড়ল। বুঝলাম ২৫শে ডিসেম্বর কাজেই এইবেলা ফেরত যাওয়াই ভাল।
     
    জাটিঙ্গা নদী,শুবজিৎ   

    পরেরদিন ভোর ৪.২০তে ট্রেন, বরাকভ্যালি এক্সপ্রেস ধরে শিলচর। শুবজিৎকে বলেই রেখেছিলাম, তা সে আবার শুরুতে সময় বোঝে না কিছুতেই। সকাল ৬ টা ৫টা করে করে পিছিয়ে গিয়ে সাড়ে তিনটেয় আমাকে নশরিং থেকে তুলতে বললাম। ব্যপারটা বুঝে শুবজিৎএর প্রথম কথা ‘আরে আপ তো ডেঞ্জার হ্যায় রে।‘ এত সকালে একলা একলা ট্রেনে করে যাব, একাই ঘুরে বেড়াচ্ছি এই নিয়ে তার বিস্ময় আর বিভ্রান্তি কাটতেই চায় না। অন্তত বার সাতেক বলল ওর দেখা যাবতীয় পর্যটকদের থেকে আমি ‘বিলকুল অলগ’। তা বিলকুল অলগ হবার পাপে পাপী আমি বারেবারে মনে করাই ভোর সাড়ে তিনটেয় যেন অবশ্যই আসে, না পারলে যেন আজই  জানায়।

    এদিকে ওদের নাকি আজ কি এক উৎসব, ২৫শে শুরু হয়ে ২৭ অবধি চলবে। অত সকালে আমাকে স্টেশানে ছাড়তে হবে, নাহলে আজই  চলে যেত। কাল আমায় নামিয়ে সোজা চলে যাবে। অত সকালে আর কেউ যদি না যেতে চায়, তাই ও-ই দায়িত্ব নিয়ে স্টেশানে নামাবে। বেশ ভাল কথা। এইবারে হাফলং বাজারে পৌঁছে কটা ফোটোকপি করাতে হবে। কাল মিজোরাম, আইএলপি হয় নি, করাতে লাগবে। তা একে রবিবার তায় খ্রীস্টমাসের দিন সবই বন্ধ প্রায়। অনেক খুঁজে একটা দোকানে নিয়ে গেল শুবজিৎ, সেখানে আবার দোকান রেখে দোকানি কোথায় যেন গেছেন। যাকে দেখতে বলে গেছিলেন সেই ছেলেটি আমরা যাওয়ায় নিশ্চিন্তে বেরিয়ে যায় ‘এক্ষুণি আসবেখন ‘ বলে।

    প্রায় মিনিট পনেরো বাদে দোকানী এলেন, ফোটোকপি করিয়ে গেস্ট হাউসে ফেরত। ঘড়িতে বাজে দুপুর ৩.৩৫। শুবজিৎ কাল হাফলং ঘোরাতে নিয়েছিল ২২০০/- টাকা। আজ  মাইবং অনেকটা দূর তাই ২৫০০/- টাকা। আর অত সকালে আগামী কাল স্টেশানে ছাড়তে ওরা ১০০০/-টাকা নেয় তবে আমি যেহেতু ‘বিলকুল অলগ’ তাই আমার থেকে ৫০০/-টাকা নেবে। ওদের এই উৎসবের নাম জুড়িমা (নাকি জুডিমা?) উৎসব, এবারে হবে গুঞ্জুং গ্রামে। সেখানেই শুবজিৎএর বাড়ি।  হাফলং থেকে ২৭ কিলোমিটার, আমি কি এখন সেখানে যেতে চাই? বুঝি বেচারার বাড়ির জন্য উৎসবের জন্য মন কেমন করছে। বলি বেরিয়ে যাক, আমি বলভদ্রকে  বলব আর কাউকে যোগাড় করে দিতে।

    সে ঘাড় দুদিকে নেড়ে নেড়ে বলে ‘তু ডেঞ্জার হ্যায় রে ম্যাডাম নেই নেই ম্যায় আ যাউঙ্গা’। ঠিক আছে বাবা, তাই হবে। একটু বিশ্রাম নিয়ে বিকেল ৪.১৫তে আবার বেরোই পায়ে হেঁটে এদিক ওদিক ঘুরতে। চারিদিক একেবারে শুনশান, সমস্ত দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে শুধু একটা সেলুনের একপাল্লা খোলা। মিনিট চল্লিশেক এদিক ওদিক হেঁটে ফিরি নশরিঙে আবার। কাল খুব সকালে বেরোন তাই আজকেই টাকাপয়সা মিটিয়ে রাখতে হবে। রাতের খাবারে অর্ডার করি ডিমাসা টাইপ ফ্রায়েড রাইস আর চিকেনের ঝোল। এই ফ্রায়েড রাইসে দেখি বেশ কয়েকরকম শাক দিয়েছে কুচিয়ে, পালং ছাড়া  বাকী শাকেদের চিনতে পারলাম না।   

    সকালে বেরোবার কথা শুনে সানি নিজেই বলে মূল ফটকে তালা দেওয়া থাকবে আমি যেন পাশের বড় ফটক দিয়ে বেরোই, ওইটে সবসময় খোলা থাকে। সে ফটক বাইরে দিয়ে দেখেছি বটে কিন্তু ভেতর দিয়ে সেদিকে যায় কীভাবে সেটা দেখে রাখা দরকার। ভোর সাড়ে তিনটেয় কাউকে ডেকে তোলাও অসম্ভব বলেই মনে হয়। সেসব দেখে খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ি রাত নটার মধ্যেই। পাশের ঘরের  গাঁকগাঁকে পরিবার চেক আউট করে হিন্দিভাষী এক দম্পতি এসেছেন এঁরা খুবই মৃদুভাষী। শিলচরে সকাল সাড়ে আটটা, সেখান থেকে আইজলে দুপুর তিনটের মধ্যে পৌঁছাব নির্ঘাৎ, তাহলে আর অত সকালে স্নান করে বেরোব না ভেবে ৩.১৫তে অ্যালার্ম দিই।

    তখন যদি জানতাম পরের দিনটা কিরকম ঝামেলাসঙ্কুল হতে চলেছে!

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    | | | | | |
  • ভ্রমণ | ২৬ জানুয়ারি ২০২৩ | ৭৮১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • kk | 2601:14a:500:e780:4474:c5a1:f96b:bdc6 | ২৬ জানুয়ারি ২০২৩ ২১:০০515917
  • পড়ছি। ভালো লাগছে। জরুরী ফোন-নাম্বার লেখা বোর্ডের আইডিয়াটা খুব ভালো লাগলো। আর জাটিঙ্গারাজের নামটা। ধনমানিক, এমনি নাম আজকাল আর কেউ রাখেনা কেন?
  • | ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১০:৫৩516583
  • থ্যাংকু কেকে। 
     
    পরের পর্ব দিলাম। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভালবেসে মতামত দিন