এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • ইন্দ্রলেখা ভট্টাচার্য | 2345.110.015612.29 | ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ১৯:২৫377704
  • নরকনন্দিনী।।

    যে কাহিনীটি আজিকে বিবৃত করিতে যাইতেছি তাহার পটভূমিকাল আধুনিক নহে, ইহা আজি হইতে বহুকাল পূর্বে, প্রায় ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের মাঝামাঝি সময়ে, অর্থাৎ ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দের আশেপাশে সঙ্ঘটিত হইয়াছিল। হুগলী জিলার অন্তর্গত দুই চারিটি গ্রাম ও কিছু ক্ষুদ্র জনপদ লহিয়া একটি স্বচ্ছল জমিদারি গড়িয়া তুলিয়া ও তৎকালীন ইংরাজ কোম্পানির ঘরে মোটারকমের কড়ি জমা করিয়া, 'রায়বাহাদুর' খেতাব অর্জন করিয়াছিলেন জমিদার পাঁচকড়ি লাহা।
    দোর্দণ্ডপ্রতাপ, ও কঠোর প্রকৃতির ভূস্বামী বলিয়া প্রজামধ্যে পাঁচকড়িবাবুর বিলক্ষণ দুর্নাম ছিলো। কিন্তু জমিদারপত্নী বিধুসুন্দরী দেবী ছিলেন যারপরনাই শান্তস্বভাবের, মমতাময়ী ও কোমলহৃদয়া রমণী; অর্থাৎ তাঁহার স্বামীর প্রকৃতির সম্পূর্ণ বিপরীত। অতি উচ্চবংশের কন্যা, ও প্রভূত বিত্তশালী পরিবারের একচ্ছত্র সাম্রাজ্ঞীস্বরূপা গৃহিণী হইয়াও তাঁহার মধ্যে অহমিকার লেশমাত্র দৃশ্যমান হইতনা। মোটের উপর পাঁচকড়িবাবু তাঁহার সুন্দরী, ও বুদ্ধিমতী, সতী স্ত্রীকে লহিয়া নিজ সংসারে যথেষ্টই সুখভোগ করিতেছিলেন। তাঁহারা চম্পাবনিতে তাঁহাদের ভদ্রাসনে তিনমহলা পৈতৃক বাটীটিতে বিস্তর লোকলস্কর লহিয়া বসবাস করিতেন।
    গার্হস্থ্যধর্মে ও পরিচালনাকার্যে জমিদারপত্নী তাঁহার দক্ষতার পরিচয় দিয়া শুধু তাঁহার স্বামী নহেন, আত্মীয়স্বজন ও চারিপার্শ্বস্থ আরো পাঁচজনের সমীহ ও ভালোবাসা আদায় করিয়াছিলেন। কিন্ত তথাপি তাঁহার অন্তরে বড় একটি সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা ছিল। তাঁহাদের বিবাহের ফলশ্রুতি, দুইটি বড় আদরের পুত্রসন্তান, যাহারা ইতোমধ্যে বাল্যকাল প্রায় অতিক্রম করিয়া কৈশোরের প্রবেশদ্বারে উপনীত হইয়াছিল, উভয়েই তাহাদের পিতামাতার ইচ্ছানুযায়ী আধুনিক ইংরাজি শিক্ষায় দীক্ষিত হইবার নিমিত্ত কলিকাতায় তাহাদের মাতুলালয়ে থাকিয়া একটি নামী বিলিতি বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করিত।
    তাহা বলিয়া এমন নহে যে বিধুসুন্দরী দেবী ও তাঁহার স্বামী তাঁহাদের প্রাণাধিক প্রিয় পুত্রদ্বয়ের দর্শনলাভ একেবারেই করিতে পাইতেন না; তাঁহাদের নিত্য কলিকাতায়, ও বিধুসুন্দরীদেবীর পিত্রালয়ে যাতায়াত ছিল; তাহা ব্যতীত পুত্রগণও বিদ্যালয়ে ছুটি পড়িলে চম্পাবনিতে পিতামাতার নিকট নিয়মিতই আসিত। কিন্তু সমস্যা তাহা নহে, বিধুসুন্দরীদেবীর অন্তরে বহুকাল ধরিয়া একটি কন্যাসন্তানের জননী হইবার বড়ই আকাঙ্ক্ষা ছিল, যাহা পুত্রসন্তান দ্বারা পূরণ হইবার নহে।
    অনেকের কাছে হয়ত ইহা বড় অদ্ভুত কথা বলিয়া মনে হইতে পারে। কারণ কে না জানে, রমণীগণ সচরাচর কোনো এক অমোঘ প্রকৃতির বিধানে, অথবা মনুষ্যরচিত কিছু সামাজিক বদ্ধমূল ধারণার দ্বারা চালিত হইয়া স্বীয় গর্ভে পুত্রসন্তান ধারণেরই আকাঙ্ক্ষা করিয়া থাকেন। কিন্তু বালিকাবস্থায় অধিকাংশের বাল্যলীলার পুত্তলীটি কিন্তু একটি কল্পিত শিশুকন্যাই হইয়া থাকে, যাহাকে ইচ্ছানুরূপ বেশভূষাদি প্রসাধন ও বেণীবন্ধনাদি কেশসজ্জা করাইয়া নারীমনের একটি অপূর্ব রকমের তৃপ্তিসাধন হইয়া থাকে।
    প্রকৃতপক্ষে উহাই হয়ত কিছু পরিমাণে নারীর অবচেতন আকাঙ্ক্ষা হইতে পারে, যাহা পরবর্তীকালে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের তাড়নায় পুত্রলাভাকাঙ্ক্ষায় পরিবর্তীত হইয়া থাকে (বিতর্কযোগ্য)। যাহা হউক, সেইরকম বালিকাসুলভ প্রবৃত্তির তাড়নাতেই হয়ত বিধুসুন্দরী তাঁহার জীবনে একটি কুসুমকোমল, স্ফূরিত রক্তিম ওষ্ঠ, ও ততোধিক স্ফূরিত গোলাপী গণ্ডদেশ যুক্ত, দুগ্ধফেননিভ শিশুকন্যার অভাব সতত বোধ করিতেন। কিন্তু তিনি তাঁহার স্বামীর দিক হইতে এমন কোনো ঈপ্সার ইঙ্গিত কখনোই পাহেন নাই বলিয়াই হোক, বা কঠোরহৃদয় ও কিঞ্চিৎ উগ্রস্বভাব স্বামীর কন্যাজাতির প্রতি অবজ্ঞার, ও কন্যাজন্মের ব্যাপারে অনীহার ভাব দেখিয়াই হোক, মুখ ফুটিয়া কখনো মনের কথা কাহারো নিকট প্রকাশ করেন নাই।
    যাহা হউক, অধিক মনোস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে অনেকটা দূরে সরিয়া যাইতেছি ও সেইসাথে পাঠকের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙ্গিতেছে। এবার মূল গল্পে ফেরাই শ্রেয়। এ হেন বিধুসুন্দরী দেবী একদা কিয়দ্দূরে বাঁশগাছি গ্রামে কোনো এক জ্ঞাতির বাটীতে তাহার কন্যার বিবাহের নিমন্ত্রণ খাইয়া পালকিতে চড়িয়া গৃহাভিমুখে প্রত্যাবর্তন করিতেছিলেন। তাঁহার সঙ্গে বেশ কয়েকটি বেহারা ও কয়েকটি লেঠেল পাইক ছিল। বর্তমানে এদেশের অরণ্যানী প্রায় বিলুপ্ত হইয়া আসিলেও সেযুগে তা এই গাঙ্গেয় অঞ্চলেও যথেষ্টই ছিল। অতএব তাঁহাদেরকে পথিমধ্যে কিছু কিছু ছোটোখাটো বনজঙ্গলও পার হইতে হইতেছিল ইহাতে সন্দেহ নাই। তাহার প্রস্তুতিও উপযুক্তই ছিল।
    বেহারাগণ যতই হুমহুনা শব্দে উৎসাহ জাগাইবার চেষ্টা করুক, দলের দুই সর্দার বুঝিতে অপারগ হয় নাই যে, পশ্চিমাকাশের ঘনায়মান গোধূলির সঙ্গে সঙ্গে পালকি শিয়ালচরার মাঠের যতই সমীপ হইতেছে, দলের সাহস ততোই নিভিয়া আসিয়া সকলের কন্ঠ, জিহ্বা ও মুখমণ্ডলের ঔজ্জ্বল্য ততোই শুকাইতেছে। কোনোরকমে অভিশপ্ত জায়গাটা পার হইতে পারিলে তাহারা বাঁচে, এমনই কুখ্যাতি, বহু অপার্থিব ভয়ের ঠিকানা সেই মাঠের। কোনোমতে রামনাম লহিয়া বেহারারা সেই অরণ্যবেষ্টিত মুক্তভূমি পার হইতেছে এমন সময় সকলে একটি শিশুকণ্ঠের মৃদু, অথচ সুস্পষ্ট, মিষ্ট ক্রন্দনধ্বনি শ্রবণ করিল। বেহারা দলের সর্দার হারু ডোম তৎক্ষণাৎ পালকির গতি বাড়াইলো, ও ইশারায় সঙ্গীদেরও তদ্রূপ নির্দেশ করিল। ভীতচকিত পাইকগণও তাহাদের সর্দার ছিদাম মাঝির চক্ষুর ইশারায় লাঠি-বল্লম আরো বাগাইয়া ধরিয়া পালকি ঘিরিয়া অনুরূপ সতর্কতায় সবে ছুটিতে শুরু করিয়াছে, এমন সময় পালকির ভিতর হইতে জমিদারগৃহিনীর দৃঢ় নির্দেশ ধ্বনিত হইল, "পালকি থামা।" সকলে থমকে থামিল।
    তিনি পালকি হইতে নামিলেন। শিশুক্রন্দনে উদ্বেলিত হয়না, এমন মাতৃহৃদয় পাওয়া দায়। তিনিও সে মাতৃজাতিসুলভ দুর্বলতার ঊর্ধ্বে উঠিতে পারেন নাই। এই দুর্গম, পাণ্ডববর্জিত স্থানে এমন শিশুক্রন্দনধ্বনি তাঁহারও চিত্তকে শিশুটির সম্ভাব্য কোন বর্তমান বিপদের আশঙ্কায় উৎকণ্ঠিত করিয়া থাকিবে ইহাতে আশ্চর্য কী! "ওরে ছিদাম, হারু, তোরা দেক দেকি বাবারা, এমন বনে কার বাছা কাঁদে!" - "এঁজ্ঞে নিচ্চয় মাঠাকরেন, আপনি নিচ্চিন্তে বসেন, মোরা দেকচি এঁজ্ঞে।"- ব্যস, শিশুর সন্ধান শুরু হইয়া গেল।
    বেহারা ও পাইকগণের এই ভরসন্ধ্যার মুখে এমন প্রতিকূল ও নিতান্তই অসম্ভব স্থানে শিশুক্রন্দনের ন্যায় অচিন্তনীয়, অলীক ঘটনাকে যথেষ্টই ভীতিপ্রদ বলিয়া বোধ হইলেও, এবং আসন্ন কোনো অলৌকিক অমঙ্গলের সূচক বলিয়া এক পঞ্চেন্দ্রিয় বহির্ভূত অনুভূতি হইলেও, কর্ত্রীর ভয়ে তাহারা তা প্রকাশ করিতে পারিলনা ও সেই স্থানে আকাশ-পাতাল এক করিয়া শিশুর সন্ধান আরম্ভ করিল।
    কিয়ৎক্ষণ পশ্চাৎ হারু সঙ্গীদের নিকট ছুটিয়া আসিয়া সংবাদ দিলো, শিশুটিকে পাওয়া গিয়াছে, কিন্তু তাহাকে স্পর্শ করিতে তাহার ভয় হয়। তাহার মুখমণ্ডল বিবর্ণ হইয়াছিল। ইহা শুনিবামাত্র কর্ত্রী বাহির হইয়া সকলকে লহিয়া হারুর প্রদর্শিত স্থানে উপস্থিত হইলেন ও বনপ্রান্তস্থ মাঠের একটি কোণে একটি অগভীর ক্ষূদ্র গর্তের ন্যায় স্থানে দেবকন্যার ন্যায় সুন্দর একটি অতিক্ষুদ্র, আন্দাজ ছয়-সাত দিবস বয়সের অনাবৃতা শিশুকন্যাকে আবিষ্কার করিলেন।
    তাহার প্রস্ফূটিত পদ্মের ন্যায় সুন্দর মুখমণ্ডল, আয়ত ও অশ্রুপূর্ণ পলাশ লোচন ও দুগ্ধ হইতে সদ্য আহরিত ননীর ন্যায় কোমল, নধর শরীরের বর্তমান ধূলিধূসরিত, ক্লেদাক্ত অবস্থা ইত্যাদি সব অদ্ভুত ও বিচিত্র দৃশ্য অবলোকন করিয়া জমিদারপত্নী যেন মুগ্ধ, সম্মোহিতবৎ হইয়া পড়িলেন। তৎক্ষণাৎ তাঁহার সঙ্গগামিনী দাসী যশোদাকে দিয়া পালকি হইতে একটি পরিষ্কার গরদের উত্তরীয় আনাইয়া শিশুকন্যাটিকে তাহার মধ্যে উত্তমরূপে আবৃত করিয়া ক্রোড়ে তুলিয়া লইলেন।
    সকলে অবাক হইয়া কর্ত্রীর মুখপানে চাহিলে পর তিনি ত্বরায় সকলকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, "ওরে, তোরা চেয়ে চেয়ে কী দেকচিস, তাড়াতাড়ি চ' সব। এ বাছাকে একন আমি সঙ্গে নে যাচ্চি। একানে এমন একা ফেলে গেলে তো এই শেয়ালচরার শেয়ালেরা ছিঁড়ে খাবে। আহা, কোন অভাগী মায়ের বাছা গা! এমন করে যমের মুকে ফেলে যেতে হয়! মা ষষ্টি তাঁর চোকের মণি দেচেন, তার কদর নেই গা! চ' চ' সব, পরে এর মা-বাপের খোঁজ করবো একন। ওনাকে বললেই হব- না না, ওনাকে বলিসনি কেউ কিচু, ওনার যা রাগ। একান থেকে নে গেচি শুনলে আবার কী বলবেন, বকবেন, থাক, যা বলার আমি বলবো, বুজলি সব? তোরা আগ বাড়িয়ে কত্তাকে কেউ কিচু বলবিনে, বুজলি? খপদ্দার! সকলে মাথা নাড়িলো। গিন্নীমা-ঠাকরুনের উপর, বা তাঁর মতের বিরুদ্ধে কথা বলে, সেকালে দাসদাসী, বা অধস্তন কর্মচারীদিগের এমন সাহস কাহারোই ছিলনা।
    কিন্তু তাহারা সকলেই মনে মনে দারুণ ভয় পাহিয়াছিল, একথা তাহারা সকলে নীরবে পরস্পরের সহিত দৃষ্টি বিনিময় করিয়াই বুঝিয়াছিল। একে গোধূলিবেলায় এমন অলক্ষণ ও অমঙ্গলময় স্থানে বিচরণ, তাহার উপর সে স্থল হইতে এই পরিত্যক্ত ও অজ্ঞাতকুলশীল নবজাতক শিশু সংগ্রহ। সত্যই, বড় মানুষের বিচারবুদ্ধি অর্থাগমের সহিত ব্যস্তানুপাতিক হিসাবে চলে, এমনই কিছু একটা হয়ত তাহারা ভাবিতেছিল। কিন্তু কথায় বলে স্নেহ নিম্নগামী। বুদ্ধিমতী, বিচক্ষণা বিধুসুন্দরী ততক্ষণে নবলব্ধ উদ্ধারককর্ত্রী, পালিকামাতার ভূমিকায় নিজেকে সম্পূর্ণরূপে ঢালিয়া ফেলিয়াছেন, ও কন্যারত্নটিকে এমনভাবে ঈশ্বরপ্রদত্ত গুপ্তধনের ন্যায় স্বীয় ক্রোড়স্থ করিতে পাহিয়া যেন দীর্ঘকালের লালিত স্বপ্নপূরণের আনন্দে আত্মহারা হইয়া উঠিয়াছেন।
    তিনি শিশু ও দাসী সমেত পুনরায় পালকিতে উঠিলেন, শিয়ালচরার মাঠ পিছনে ফেলিয়া পালকি দ্রুতবেগে ছুটিতে শুরু করিল। পালকির ভিতরে বিধুসুন্দরী বিভোর হইয়া তাঁহার ক্রোড়ে অধুনা শান্তিতে নিদ্রিতা সদ্যলব্ধা কন্যা মাণিক্যটির মুখচন্দ্র অবলোকন করিতে থাকিলেন। এক বিচিত্র আনন্দে ও বিস্ময়ে তাঁহার যেন চক্ষুর পলক পড়িতে ছিলনা। অন্য কোনোদিকে আর তাঁহার হুঁশ ছিলনা। যদি হুঁশ হইত, তাহা হইলে নিশ্চয় দেখিতে পাহিতেন যে, তাঁহার পার্শ্বোপবিষ্টা যশোদাও আনমনে ভ্রূকূটিযুক্ত দৃষ্টিতে শিশুটির দিকে তাকাইয়া আছে, এবং কিছু যেন একমনে ভাবিতেছে।
    যদি খেয়াল করিতেন তবে আরেকটি বিচিত্র বিষয় লক্ষ্য করিতেন; পালকির চলার পথে যথাক্রমে কয়েকটি সারমেয়, বিপরীত দিক হইতে চারকের সহিত আগত একপাল শূকর ও তাহার পশ্চাৎ দুটি হৃষ্টপুষ্ট বলদ দ্বারা বাহিত একটি শকট পড়িল, যাহাদের মধ্যে সারমেয় গুলি দারুণ চীৎকার করিতে করিতে একবার পালকির দিকে ধাবিত হইয়া আসিয়াই কী কারণে একেবারে থমকিয়া থামিয়া পড়িল, ও তৎক্ষণাৎ কাঁদিতে কাঁদিতে উল্টাদিকে দৌড় মারিল। শূকর ও বলদেরা যথাক্রমে তাহাদের চারক ও গাড়োয়ানকে একেবারে হতবুদ্ধি করিয়া দিয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াইতে লাগিল।
    পালকি বেহারা ও পাইকগ কিন্ত সকল দেখিল, সকল ঘ্রাণ করিল। কিন্ত কিছুক্ষেত্রে মনুষ্যপ্রজাতি পশুগণের অপেক্ষা অনেক বেশী অসহায় ও দুর্ভাগা। পশু আপনার প্রবৃত্তির নির্দেশ অনুসারে পরিস্থিতি অনুযায়ী তৎক্ষণাৎ উপযুক্ত আচরণ করিতে পারে। মানুষের বুদ্ধি সকল জীবমধ্যে সর্বাপেক্ষা অধিক বুদ্ধিমান বলিয়া তাহার বিভিন্ন কর্তব্যবন্ধন ও সাংসারিক দায়বোধও সব জীবের চেয়ে বেশি। তাই তাহার আচরণের স্বাধীনতাও কম, না হইলে পালকি বেহারাগুলিও তাহাদের অন্তরাত্মার তীব্র আহ্বান শুনিয়া পালকি নামাইয়া পলায়ন করিত। কিন্ত এমন হইলনা; তাহারা যে মানুষ। পালকি রাত্রির পূর্বে গন্তব্যে পঁহুছিল।
    পালকী বাহিরবাটীতে প্রবেশ করিতেই জমিদারবাবু ব্যস্তসমস্ত হইয়া আসিয়া পড়িলেন। তিনি কিছু কঠিন প্রকৃতির, সাহসীপুরুষ হওয়া সত্ত্বেও স্ত্রীর আগমনে বিলম্ব দেখিয়া কিছু উৎকণ্ঠিত হইয়া পড়িয়াছিলেন। জ্ঞাতিবাটীতে পতিপত্নী উভয়ের নিমন্ত্রণ থাকিলেও সেরেস্তার বিশেষ একটি কার্য পড়িয়া যাওয়ায় তিনি স্ত্রীর সহিত যাইতে পারেন নাই। সহস্র হউক, বিধু একা মেয়েমানুষ হইয়া যাত্রা করিয়াছে, তাহার উপর পথঘাট নিরাপদ নহে। কোম্পানিবাহাদুর আইনকানুনের কড়াকড়ি রাখিলেও এদেশে অদ্যাবধি দস্যু-তস্করের ভয় প্রবল। পাইকগণের উপরে তাঁহার ভরসা থাকিলেও তাহা চরম নহে। যাহা হউক, পত্নী নিরাপদে ফিরিয়াছেন দেখিয়া পরম নিশ্চিন্ত হইতে যাইতেছেন এমনসময় বিধুসুন্দরীকে শিশুক্রোড়ে পালকি হইতে নামিতে দেখিয়া তাঁহার খানিক চমক লাগিয়া গেলো।
    "ও আবার কাকে আনলে গো?" - কর্তা প্রশ্ন করিলেন। বিধুসুন্দরী পূর্বেই প্রস্তুত ছিলেন, তিনি সঙ্গস্থ লোকজনকে কৌণিক দৃষ্টিতে দেখিয়া লহিয়া স্বামীকে বলিলেন, আচ্চা চলুন, সেসমস্ত বলচি একন, আগে হাতপা ধুয়ে ঘরে উটি। আপনি ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করেচেন তো? বলি অ টেঁপী, কত্তাবাবুকে বেলাবেলি খেতে দিইচিস তো, মা?" -"আঁইজ্ঞা হ, মাঠান", ত্রস্ত টেঁপী ঝি ভিতরবাটি হইতে ছুটিয়া আসিল। "অরে অ মানদা, কুথা গেলি, মাঠানের হাতপা ধুইবার জল আন। তাড়াতাড়ি করনা, মুখপুড়ী!"- টেঁপী ঝি প্রভৃতিগণ ব্যস্ত হইয়া পড়িল। নিজে হস্তপদ ধুইয়া, শিশুকন্যাটিকে পরিচারিকাগণের সাহায্যে উত্তম সতর্কতায় পরিষ্কার করাইয়া, তাহার জন্য দুগ্ধ, ঔষধ ও বস্ত্রাদির ব্যবস্থা করিয়া পরিশেষে তাহাকে লহিয়া স্বামীস্ত্রী মিলিয়া অন্দরমহলে প্রবেশ করিলেন।
    একান্তে বিশ্রামশয্যায়, তিনি শিশুটিকে কীরূপে নিমন্ত্রণবাটীর সূত্রে, জ্ঞাতির এক অতি দরিদ্র, সদ্যপত্নীহারা প্রতিবেশী ব্রাহ্মণের কাছ হইতে দয়াপরবশ হইয়া পালনার্থে লহিয়া আনিয়াছেন, মাতৃহারা নবজাতকের রক্ষয়িত্রী খোদ ভূস্বামিনী হইবেন জানিয়া কীরূপ কৃতজ্ঞচিত্তে শিশুপালনে অসমর্থ মানুষটি তাঁহাকে বারবার প্রণাম করিয়াছে, এই সকল কল্পবৃত্তান্ত স্বামীকে বুঝাইয়া বলিলেন। এই প্রথমবার স্বামীকে এতবড় মিথ্যা বলিলেন। তাঁহার মনে বড় ভয় ছিল, স্বামী হয়ত তাঁহার কথায় সন্দেহপ্রকাশ করিতে পারেন, অথবা বিশ্বাস করিলেও অমত করিতে পারেন, ও শিশুটিকে দত্তক রাখিতে অস্বীকার করিতে পারেন। রায়বাহাদুর আর যাই হোন, বড় একটা স্নেহপ্রবণ বা কোমলচিত্ত, দয়ালু মানুষ ছিলেননা। বিশেষত পরোপকারেচ্ছা ব্যাধিতে তিনি কখনোই ভুগিতেননা।
    কিন্তু কিমাশ্চর্যম, এহেন রুক্ষপ্রকৃতির পুরুষও যেন শিশুকন্যাটির মিষ্ট মুখাবয়ব দেখিয়া কিঞ্চিৎ গলিয়া গিয়াছিলেন। তিনি কোনোরূপ অসন্তোষ বা অসম্মতি প্রকাশ করিলেননা। শুধু একবার গৃহিণীকে বলিলেন, "তোমার হাজার কাজ। তার উপরে আবার এটিকে আনলে; এতো চাপ কি সইবে? ওর দেকাশোনা যশোকে করতে দাও। বিধুসুন্দরী স্বামীর কথা শুনিয়া মনেমনে হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিলেন। মুখে শুধু বলিলেন "আচ্চা, আপনি যেমন বলচেন তেমনই হবে।" তাঁহাদের পালঙ্ক হইতে কিছুদূরে, সুবিশাল শয্যাকক্ষের অপর একটি কোণে ছোটখোকার শৈশবের একটি দোলনায় আপাতত শিশুকে শোয়ানো হইয়াছিল, এবং বিধুসুন্দরী থাকিয়া থাকিয়া সেদিকে সতর্ক দৃষ্টিনিক্ষেপ করিতেছিলেন। যদিও দোলনা হইতে শিশুর পতনের সম্ভাবনা ছিলনা, তবুও যেন ঠিক নবমাতৃকারই ন্যায় তাঁহার মন ক্ষণেক্ষণে সদ্য আহরিতা কন্যার নিমিত্ত আশঙ্কিত হইতেছিল, কখন শিশুর কী অসুবিধা হয়। স্বামীর সহিত বার্তালাপ ও শিশুপ্রাপ্তির মিথ্যা বিবৃতি দিয়া তাঁহার অনুমোদন লাভের পশ্চাৎ আশ্বস্তচিত্তে শিশুর দিকে দৃষ্টি ঘোরাইতেই বিধুসুন্দরী যেন দারুণ চমকাইয়া গেলেন। ও-ওকী! নবজাতিকার ক্ষুদ্র রক্তিম ওষ্ঠাধরে যেন ঈষৎ আশ্বাসের ব্যাঞ্জনাময় একটি কৌতুকপূর্ণ হাসি খেলিয়া গেলো না!! যেন সে তাঁহার সুচতুর ছলনা, ও তদ্দ্বারা বিজয়লাভকে সস্নেহে অভিনন্দিত করিতেছে, যেন একধরণের শয়তানিপূর্ণ আশ্বাস ও সমর্থন জোগাইয়া কহিতেছে, "বাহ এইতো চাই! ভয় কী, আমিতো আছি!" আন্দাজ মাত্র হপ্তাখানেক বয়সের নবজাতিকা! মূহুর্তেরও ভগ্নাংশ সময়ের জন্য বিধুসুন্দরীর বুকের রক্ত আকস্মিক ত্রাসে জল হইয়া গেল। কিন্ত তাঁহার পার্শ্বেই স্বামী। তিনি নিজেকে সংযত করিয়া পুনরায় তাকাইতেই আর তেমন দৃশ্য দেখিলেননা। কোথায় কী, শিশু পরিপূর্ণ উদরে নিশ্চিন্তে ঘুমাইয়া আছে।
    নিজের এই আকস্মিক দৃষ্টিবিভ্রমে বিধুসুন্দরী প্রথমে অত্যন্ত হতবাক হইলেও অতঃপর সারাদিবসের পথশ্রমের ক্লান্তি ও বিচিত্র, ও আশাতীত ঘটনাপরম্পরায় মস্তিষ্ক ও স্নায়ুর উপর সৃষ্ট চাপকেই এর জন্য দায়ী মনস্থ করিয়া, সে রাত্রির মতো, নবলব্ধা কন্যার মুখপদ্মটি পুনরায় নিরীক্ষণ করিয়া পরম আনন্দিত ও তৃপ্ত হইয়া নিদ্রার কোলে নিজেকে সমর্পণ করিলেন। চক্ষু মুদিবার পূর্বে অবশ্য তাঁহার ইষ্টদেবতা গোপালকে, তাঁহার প্রদত্ত এই স্বর্গীয় উপহার, অর্থাৎ যেন ইন্দ্রলোকের দেবশিশুর ন্যায় এই শিশুকন্যা প্রদান ও বিধুসুন্দরীর দীর্ঘদিনের স্বপ্নপূরণের নিমিত্ত শতকোটি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করিতে ভুলিলেননা। মিথ্যাচরণের জন্য নিদ্রিত স্বামীর নিকট মনেমনে ক্ষমাপ্রার্থনাও করিলেন, তবে অধিক অনুতপ্তচিত্তে নহে।
    নিদ্রা যাইবার পূর্বে, কথিত মিথ্যার পৃষ্ঠদেশ সুরক্ষার ব্যবস্থাও ভাবিয়া লইলেন। কল্য প্রাতেই ছিদাম মাঝির হস্তে গোপনে জ্ঞাতিভ্রাতাকে কিছু তথ্য ও অনুরোধ লিখিয়া প্রেরণ করা শ্রেয়, নাকি শুধু মৌখিকরূপে জ্ঞাপন করানোই অধিকতর নিরাপদ, ইহাই মনেমনে তুলনা করিতে করিতে কর্ত্রী নিদ্রাচ্ছন্ন হইলেন। শিয়রে তৈলপ্রদীপটি খানিক আরো জ্বলিয়া অবশেষকালে তৈলনিঃশেষিত হইয়া নির্বাপিত হইল। বৈদ্যুতিক আলোক তখনো বঙ্গদেশে পঁইছায় নাই। কক্ষ গাঢ় অন্ধকারে নিমজ্জিত হইল ।
    সেরাত্রিতে যত নিশি-বায়স, গৃধ্র-গৃধিনীর দল, এবং পেচকাদি নিশাচর পক্ষীগণ চক্রাকারে জমিদারবাটীর চূড়া প্রদক্ষিণ করিতে করিতে সম্মিলিত কর্কশনিনাদে আকাশ-বাতাস মুখরিত করিয়া তুলিল। শিবাগণ, ও অন্যান্য প্রজাতির হিংস্র জন্তুসকল আশেপাশের বনভূমি হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া লোকালয়ের সন্নিকটে আসিয়া তীক্ষ্ণ গর্জন করিতে লাগিল। উহারা যেন কাহারো আগমনের সংবাদ পাহিয়া, তাহার রাজ্যাভিষেকভূমিপ্রাঙ্গণে সম্মিলিত জয়ধ্বনি দিয়া অভ্যর্থনাসঙ্গীত গাহিতেছিল, অথবা সেই নবাগত মহাশক্তিধর রাজার ভীতিতে রাজ্যত্যাগ করিয়া পলায়ন করিবার জন্য সকলকে সতর্কবার্তা ও আহ্বান জানাইতেছিল।
    নিদ্রাভিভূত ভূস্বামী ও নিদ্রাচ্ছন্না তাঁহার পত্নী সেসকল অস্বাভাবিক পরিস্থিতির কথা কিছুই জানিতে পারিলেন না। কিন্ত জমিদারবাটীর চৌকিদারগণ কিছু ভৃত্য ও পরিচারিকাদি ঘুমায় নাই। তাহারা সকল শুনিল। জমিদারবাটী সন্নিকটস্থ চম্পাবনির লোকালয়ের যে সকল মানুষজন ছিল, তাহাদেরও অনেকেই জাগ্রত, অর্ধজাগ্রত অবস্থায় সেই ভয়ানক, পাশবিক নিনাদসমূহ শুনিয়া বিমূঢ় ও ভীত হইয়া কম্পিতহৃদয়ে পরমেশ্বরকে স্মরণ করিতে করিতে ভাবিতেছিল যে, চম্পাবনিরূপ হস্তিনাপুরে কি তবে পুনরায় কোনো দুর্যোধনের জন্ম হইল, এবং ইহাসকল তাহারই ইঙ্গিত!!
    এই নিশুতি রাত্রে পশুপক্ষীগণের কলরোল শুনিয়া জমিদারবাটীর বাহিরদালানে যে চৌকিদার ও পাইকগণ শয়ন করিত তাহারা সকলে মশাল, বাতি, বল্লম ইত্যাদি অস্ত্রশস্ত্র বাগাইয়া ধরিল। কিন্ত যদিও বাহিরের জন্তুজানোয়ার, শ্বাপদাদি হইতে অন্তত মহলের প্রহরার আর অধিক প্রয়োজন ছিলনা, তবুও সকলে ত্রস্তব্যস্ত ও সতর্ক হইয়া নিশিযাপন করিল। কেবল হারু সর্দার প্রমুখ দিবসকালের যাত্রার দলবল শেষরাত্রিতে ক্লান্তশরীরে ভৃত্যমহলের দালানের একটি কোনায় পাটি বিছাইয়া নিদ্রা যাইলো।
    ঊষাকালের ঠিক পূর্বে অকস্মাৎ হারু চোখ খুলিয়া দেখিল যশোদা তাহার সামনে দাঁড়াইয়া আছে ও তাহাকে অঙ্গুলিবিভঙ্গে নিজসমীপে আহ্বান করিতেছে। হারু অর্ধজাগরণেই ভারি আহ্লাদিত ও রোমাঞ্চিত হইলো। আজি পুনরায় নিয়তি প্রসন্ন। সে অর্ধচেতন হইয়া সম্মোহিতের ন্যায় যশোদার পশ্চাতে দ্রুত শিকারী মার্জারের পদচারণায় চলিল, নিদ্রিত লোকজন না উঠে। তাহারা বাটীর ছাতের দিকে উঠিয়া গেলো। প্রাতঃকালে বাটীময় খবর হইলো, ছাত হইতে পড়িয়া হারু সর্দার মরিয়া গিয়াছে।
    দেশে হারুর পরিবারকে অবিলম্বে সংবাদ প্রেরণ করা হইল। তাহারা কাঁদিতে কাঁদিতে আসিয়া পড়িল। তবে অতিদীর্ঘকাল অবধি কিনা মৃতদেহ রাখিয়া দেওয়া সম্ভব নহে, তাই ততক্ষণে শেষকৃত্য সম্পন্ন হইয়াছিল। যাহা হউক হারুর স্ত্রীপুত্রগণ তাহার দেহাবশেষ ও নায়েবমহাশয়ের নিকট হইতে তাহার বকেয়া পাওনাগণ্ডা বুঝিয়া লহিয়া দেশে ফিরিয়া গেল। তবে বিদায়কালে কর্ত্রীর নির্দেশে, নায়েবমহাশয় তাহাদিগকে আশ্বাসপ্রদান করিলেন যে, দেশে হারুর শ্রাদ্ধশান্তি মিটাইয়া তাহার জ্যেষ্ঠপুত্রটি চম্পাবনিতে ফিরিয়া আসিলে জমিদারবাটী বা সেরেস্তায়, সে একটা ছোটোখাটো ভৃত্যপদে নিযুক্ত হইতে পারে। বেহারাপদে নিযুক্ত হইবার পক্ষে আপাতত তাহার বয়স ও শক্তি কিছু কম ছিল। যাহা হউক, বিধুসুন্দরী দেবী এইভাবে তাহাদের একটা উপায় করিবার আশ্বাস দিয়া আপন ব্যথিত মনকে কিছু শান্ত করিলেন।
    কিন্ত তাঁহার অন্তরে কী যেন একরূপ অপরাধবোধের কাঁটা বিঁধিয়া রহিল, তাহা তিনি কিছুতেই সম্যকরূপে উপলব্ধি করিতে পারিলেন না। হারুর মৃত্যুর কারণ আপাতদৃষ্টিতে যাহা বোধগম্য হইয়াছে, তাহা হইল, বাটীর ছাত হইতে তাহার পতন, যাহাতে বিধুসুন্দরীর বা অন্য কাহারো, কোনোমতেই দায় থাকিতে পারেনা। তবু কর্ত্রীর হৃদয় হইতে কোনো একটি দুর্বোধ্য খচখচানি যাইলোনা। আচ্ছা, হারু হঠাৎ অমন ভোররাত্রিকালে ছাতে উঠিল কেন?! সে ব্রাহ্মণ নহে যে সূর্যপ্রণাম করিবে; কবি-সাহিত্যিক বা শিল্পী বা শিল্পপ্রেমী শ্রেণীর কেহই নহে যে ঊষাকালীন আকাশের সৌন্দর্য তাহাকে একেবারে শয্যা হইতে উত্তোলিত করিয়া ছাতে লহিয়া যাইবে! তবে!
    বিধুসুন্দরী সেযুগের স্ত্রীলোক হইলেও একেবারে অশিক্ষিতা বা কুসংস্কারাচ্ছন্না, মুখ্যু মেয়েমানুষ ছিলেননা। কলিকাতায় তাঁহার পিত্রালয়ে ভ্রাতাদিগকে পড়াইবার নিমিত্ত নিত্য সায়েবমাস্টার আসিত, এবং কিছু কিছু পাঠ হইতে তিনিও বঞ্চিত হয়েন নাই। অবশ্য তাঁহার চরিত্রের এই আলোকোজ্জ্বল দিকটির সহিত পাঠকের অগ্রেই পরিচয় হইয়াছে। তাই অধিক কথন বাহুল্য মাত্র। মোটের উপর হারুচরিত্র সম্পর্কে কর্ত্রী যতটুকু জানিতেন তাহাতে রাত্রিকালে নিদ্রিতাবস্থায় পদচারণা বা কোনোরূপ নেশাভাঙের ঝোঁকে ছাতে উঠিয়া তথা হইতে লম্ফপ্রদান অথবা আত্মহননেরও কোনরূপ সম্ভাবনা তাহার প্রকৃতির সহিত মেলাইতে পারিলেননা।
    অতএব অতিপ্রাকৃত বা অপদেবতা সম্পর্কিত তত্ত্বটুকুই বাকি থাকিয়া যায়, যাহাতে ভূস্বামিনীর বড় গভীর বিশ্বাস নাহি। কেন যেন তাঁহার সচেতন অবচেতন হারুর মৃত্যুর সহিত তাঁহার সেইদিবসের শিশুকন্যা আনয়নের কার্যটিকে সংযুক্ত করিতে লাগিল, তাহা তাঁহার সচেতন চেতনা সম্যকরূপে অনুধাবন করিতে পারিলনা। যাহা হউক অবশেষে সাংসারিক কর্তব্যের আহ্বানে ও পালিতা শিশুকন্যার সেবাযত্নের প্রয়োজনে চিন্তাজগত হইতে বাহির হইয়া যশোদা প্রভৃতিকে লহিয়া পুনরায় গৃহকার্যচালনায় ব্যস্ত হইয়া পড়িলেন। মৃত হারুর স্মৃতি বাটী হইতে ধীরে ধীরে বিলীয়মান হইতে লাগিল। কিন্ত না, অচিরেই প্রমাণ হইল যে, রায়বাহাদুর বাটীতে যে অন্ধকারের সূত্রপাত হইয়াছিল, হারুর অপঘাতমৃত্যু তাহার প্রথমাঙ্ক মাত্র।
    যে সন্ধ্যায় শিশুকন্যাটিকে লহিয়া বিধুসুন্দরী পালকিসমেত বাটীতে প্রত্যাবর্তন করেন, সেই মূহুর্ত হইতে অদ্যাবধি তাঁহার পোষ্য মার্জারশাবকদ্বয় ও তাহাদিগের মাতার দর্শন পাওয়া যায় নাই, ইহা উপলব্ধি করিতে স্বয়ং কর্ত্রীর বিলম্ব হইতে পারে; একে নবাগতা কন্যার নবস্নেহের মোহ, তদুপরি বিশ্বস্ত পালকিবাহকের আকস্মিক মৃত্যু; কিন্তু উহা যশোদার সদাসতর্ক দৃষ্টিকে লঙ্ঘন করিতে পারে নাই।
    তাহার একটি মুখ্য কারণ অবশ্য এই যে মার্জারপরিবারটিকে সে দুইচক্ষে দেখিতে পারিতনা। তাই প্রথমটায় উহাদের আকস্মিক অন্তর্ধানে সে প্রায় উৎফুল্লই হইয়া উঠিয়াছিল, কিন্তু অচিরেই যখন সে, হারুর মৃত্যু, ছাতের পোষ্য কবুতরকুলের আকস্মিক গৃহত্যাগ, জমিদারবাটীর নিত্য অতিথি কাক, চিল, সারমেয় ইত্যাদি সদাবুভুক্ষু অপাংক্তেয় প্রাণীগণেরও রাতারাতি সে বাটীর অন্নে অরুচি ইত্যাদি নানা অদ্ভুত উপসর্গ লক্ষ্য করিতে লাগিল, তখন তাহার হর্ষ ত্রাসে পরিণত হইয়াছে। তবে আরো একটি ঘটনা ছিল, যাহা তাহার নিকট এই সকল বিচিত্র পরিবর্তনের অপেক্ষাও অধিক ভয়াবহ লাগিয়াছিল, তাহা হইল বাটীর সর্বাধিক বাচাল প্রাণী, জমিদারবাবুর পোষ্য, দিনভর 'হরেকৃষ্ণ' বুলিতে বাটী মুখরিত করিয়া তোলা, পিঞ্জরের তোতাপাখিটির অকস্মাৎ মৌনাবলম্বন।
    বুদ্ধিমতী যশোদা দাসীর একটি বৃহৎ গুণ ছিল এই, যে সে ছিল অত্যন্ত স্বল্পবাক ও সংযতভাষিণী। সে মনে যতটা ভাবিত, মুখে তাহার প্রায় কিছুই কহিতনা, বা প্রয়োজন ও পরিস্থিতি অনুসারে যতটুকু না কহিলেই নয় ততটুকুই কহিত। তাহার মনের সবটুকু আশঙ্কা ও অনুমানাদি সে অদ্যাবধি মনেই চাপিয়া রাখিয়া সাংসারিক কর্তব্য করিয়া যাইতেছিল। অর্থাৎ শিশুকন্যার প্রতি তাহার বিশেষ যত্ন ও সতর্কতায় যে কোনো খুঁত ছিলনা তাহা বলাই বাহুল্য। এমনকি ইহা দেখিয়া কর্ত্রী যৎপরোনাস্তি সন্তুষ্ট হইয়া উঠিতেবসিতে, সময়ে অসময়ে তাহার বেতনের অতিরিক্ত পারিতোষিকও দিতে লাগিলেন, যাহার আভাষ পাহিয়া অন্যান্য পরিচারিকাগণ তাহাকে কিঞ্চিৎ ঈর্ষা করিতেও শুরু করিয়াছিল, যদিচ তাহা বাহিরে প্রকাশ করিবার সাহস কাহারো ছিলনা।
    শিশুকন্যাও ভূস্বামিনীর ক্রোড়ে, তাঁহার আদরে যতটা শান্তি পাহিত বলিয়া তিনি ভাবিতেন, যশোদার ক্রোড়ে যেন আপাতদৃষ্টিতে তাহার চাহিতে কিছু অধিকই শান্ত ও সন্তুষ্ট থাকিত, ও অধিক দ্রুত ঘুমাইত বলিয়া তাঁহার মনে হইত, এবং ইহাতে তিনি আশ্বস্ত হইলেও যেন সামান্য ঈর্ষাও বোধ করিতেন। মুখে কৌতুক করিয়া বলিতেন, "সত্য বল যশো, ও তোর মেয়ে নয়তো?" যশোদাও কর্ত্রীর এই কৌতুকে খানিক সৌজন্যবশত, ও খানিক স্বামিনীর চিত্তবিনোদনের নিমিত্ত যোগ দিয়া কহিত, "আজ্ঞে মাঠান। দেকেননা, মুকের কেমন মিল!" দুইজনাই হাসিত। কিন্তু যশোদা মনে কী ভাবিত?
    তাহার যেন মনে হইত, শিশুকন্যা তাহার মন পড়িতে পারে। তাহার ক্রোড়ে আসিয়া সে শিশু যেন সতর্ক হইয়া যায়। স্নেহান্ধ পালিকা মাতার ক্রোড়ে সে যতটা চঞ্চল, ও স্বচ্ছন্দভাবে তাহার ক্ষুদ্র হস্তপদাদি সঞ্চালন করিয়া, ক্ষুদ্র মস্তক ও মিষ্ট মুখখানি বিভিন্ন দিশায় ঘুরাইয়া পৃথিবীতে তাহার নবলব্ধ জীবনের চলমান প্রবাহ ও নবতর মাতৃক্রোড়ের সুখকর আশ্বাস উপভোগ করিত, যশোদা দাসীর ক্রোড়ে আসিলে যেন সেসকল স্বচ্ছন্দ অঙ্গসঞ্চালন ও আশ্বস্ত আচরণ পরিবর্তিত হইয়া একপ্রকার স্থির, শান্ত অথচ সতর্ক ভাব আসিত শিশুটির মধ্যে।
    অন্যদিকে, তাহার শান্ত, বশীভূত আচরণ কিন্তু যশোদা দাসীর মধ্যেওও কোনপ্রকার আশ্বাস নহে, এক উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগে সতর্ক, টানটান, প্রায় যুদ্ধকালীন প্রতিরোধের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা জাগাইয়া তুলিত। আরো স্পষ্ট করিয়া বলিতে গেলে, শিকারের উপর ঝাঁপাইয়া পড়িবার পূর্বে ব্যাঘ্র যেরূপ নিশ্চল, উদ্যত শারীরিক অবস্থায় আসে, সম্মুখস্থ অবস্থায় তাহা দেখিয়া ফেলিলে শিকারের যেরূপ মানসিক অবস্থা হইতে পারে, যশোদার ঠিক তদ্রূপ হইত।
    শিশুটিকে ক্রোড়ে লইবার মূহুর্তে যশোদার অনুভব হইত সে যেন এক বিশালদেহী পার্বত্য অজগরকে নিদ্রিতাবস্থায় ক্রোড়ে ধারণ করিতে যাইতেছে; যাহা যেকোনো মূহুর্তে জাগিয়া উঠিবে। শিশুর কোমল, রেশমোচিত স্পর্শে তাহার শরীরের ত্বক ও তাহার প্রতিটি রোম কী এক আদিম, অমোঘ আতঙ্কে শিহরিয়া উঠিত। অন্তরাত্মা প্রবলকণ্ঠে বিদ্রোহ ও প্রতিবাদ ঘোষণা করিয়া শরীরকে অবিলম্বে সেই স্থান ত্যাগ করিয়া পলায়ন করিতে নির্দেশ দিত। অথচ কর্তব্য তাহার পদশৃঙখল হইয়া তাহাকে সেস্থানে দৃঢ়ভাবে বাঁধিয়া রাখিত।।
    যাহা হউক যশোদা দাসীকে কোনো একটি সঙ্কল্প বা সিদ্ধান্তে পঁহুছিবার নিমিত্ত আর অধিক কালক্ষেপ করিতে হইলনা। বাটীতে ও বাটীর চারিপার্শ্বে সে যেসকল পরিবর্তন সে অদ্যাবধি লক্ষ্য করিয়াছিল সেসকল এমন সুস্পষ্ট বা অলৌকিক ছিলনা, যে তাহা লহিয়া সে স্বামিনী ও আর পাঁচজনের সহিত সভা করিতে পারে; কিন্তু যেইদিবস প্রাতে সে দেখিল মানদা দাসীর দ্বারা দৈনিক জলসিঞ্চন সত্ত্বেও অঙ্গণের তুলসী শুকাইয়াছে, তদুপরি নবনির্মিত তুলসীমঞ্চে ফাটল ধরিয়াছে। আবার সেই দিবসেরই সন্ধ্যায় জমিদারবাটীর অভ্যন্তরস্থ মদনমোহনের মন্দিরে কুলপুরোহিতমহাশয়কর্তৃক আরতি চলাকালীন অকস্মাৎ আগুন লাগিয়া গেল। পুরোহিত মহাশয় মন্দিরদ্বারপ্রান্তে মূর্ছিত হইয়া পড়িয়াছিলেন, তাঁহাকে ভৃত্যগণ উদ্ধার করিয়া তাঁহার প্রাণরক্ষা করে, এবং অন্যদিকে কলসী কলসী জল আনিয়া অগ্নি নির্বাপণ করা হয়। সংবাদ পাহিবামাত্র রায়বাহাদুর ও তাঁহার লেঠেলবৃন্দ বাহির হইতে দস্যুহানা অথবা কোনোরূপ অন্তর্ঘাত সন্দেহে ঘটনাস্থলে দৌড়াইয়া আসিলেন। ততোক্ষণে ব্রাহ্মণ ঠাকুর সেবা শুশ্রূষা পাহিয়া মূর্ছা ভাঙ্গিয়া উঠিয়াছেন। তাঁহাকে লহিয়া ভূস্বামী ব্যস্তসমস্ত হইয়া পড়িলে ব্রাহ্মণ তাঁহাকে আশ্বস্ত করিয়া কহিলেন, তাঁহাকে লহিয়া রায়বাহাদুরের ব্যস্ত হইবার প্রয়োজন নাহি, তিনি বর্তমানে অপেক্ষাকৃত সুস্থ। আরতিকালে মাথাটা ঘুরিয়া গিয়া তাঁহার হাত হইতে পঞ্চপ্রদীপ স্খলিত হইয়া ভূপতিত হইয়াছিল এবং তাহার তৈল ভূমিতে পড়িয়া দীপশিখা হইতে অগ্নিসংযোগ হইয়া যায়। অন্যধারে তিনি অসুস্থদেহে, ভৃত্যদিগের নিকট সাহায্য চাহিবার নিমিত্ত ছুটিয়া নিষ্ক্রমণকালে দ্বারপ্রান্তে মূর্ছিত হইয়া পড়েন। বহিরাগত কোনো অনিষ্টকারীর হাত এই অগ্নিকান্ডে নাই। তবে আজি তাঁহাকে একটু ঔষধপথ্যাদি করিবার নিমিত্ত গঞ্জের কবিরাজবাটী পঁহুছাইয়া দিলে উত্তম হয়। চিকিৎসককে দেখাইয়া, ঔষধ লহিয়া একটু সুস্থ হইবামাত্র তিনি রায়বাহাদুরের নিকট আসিয়া কয়েকটি জরুরি ও গোপন আলোচনা করিবেন। তবে যজমানের সঙ্গে তাঁহার ধর্মপত্নী, অর্থাৎ বিধু বধূমাতা থাকিলে শ্রেয়তর হয়। শুনিয়া রায়বাহাদুর অতিশয় ব্যস্ত ও উদ্বিগ্ন হইয়া, "হাঁহাঁ, নিশ্চয় ঠাকুর, একনি পালকি নে যান; ওরে কে কোতা আচিস?" ইত্যাদি বলিয়া পুরোহিত ঠাকুরকে পালকিসহ নিকটস্থ মহুলগঞ্জে চিকিৎসকগৃহে প্রেরণ করিবার নিমিত্ত তৎপর হইয়া পড়িলেন। অন্যদিকে অর্ধদগ্ধপ্রায়, অবিন্যস্ত মন্দিরাভ্যন্তর পুনরায় সুসজ্জিত করিবার দলের সহিত যোগ দিতেই যশোদা দাসী প্রথম যে দৃশ্য দেখিল, তাহা হইল, মদনমোহনের স্বর্ণসিংহাসন হইতে তাঁহার দুইহাতপ্রমাণ স্বর্ণমূর্তিটি কিয়দ্দূরে ছিটকাইয়া পড়িয়াছে।
    ~ ক্রমশ~
  • pi | 2345.110.894512.169 | ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ২০:০৯377715
  • তারপর?
  • Ela | 342323.176.90012.63 | ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ১৫:৩৬377726
  • তার্পর তার্পর?
  • ইন্দ্রলেখা ভট্টাচার্য | 2345.110.674512.125 | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০২:৩২377737
  • নরকনন্দিনী~ (৬ষ্ঠ হইতে ৭ম ভাগ)

    বুদ্ধিমতী যশোদা দাসীর একটি বৃহৎ গুণ ছিল এই, যে সে ছিল অত্যন্ত স্বল্পবাক ও সংযতভাষিণী। সে মনে যতটা ভাবিত, মুখে তাহার প্রায় কিছুই কহিতনা, বা প্রয়োজন ও পরিস্থিতি অনুসারে যতটুকু না কহিলেই নয় ততটুকুই কহিত। তাহার মনের সবটুকু আশঙ্কা ও অনুমানাদি সে অদ্যাবধি মনেই চাপিয়া রাখিয়া সাংসারিক কর্তব্য করিয়া যাইতেছিল। অর্থাৎ শিশুকন্যার প্রতি তাহার বিশেষ যত্ন ও সতর্কতায় যে কোনো খুঁত ছিলনা তাহা বলাই বাহুল্য। এমনকি ইহা দেখিয়া কর্ত্রী যৎপরোনাস্তি সন্তুষ্ট হইয়া উঠিতেবসিতে, সময়ে অসময়ে তাহার বেতনের অতিরিক্ত পারিতোষিকও দিতে লাগিলেন, যাহার আভাষ পাহিয়া অন্যান্য পরিচারিকাগণ তাহাকে কিঞ্চিৎ ঈর্ষা করিতেও শুরু করিয়াছিল, যদিচ তাহা বাহিরে প্রকাশ করিবার সাহস কাহারো ছিলনা।
    শিশুকন্যাও ভূস্বামিনীর ক্রোড়ে, তাঁহার আদরে যতটা শান্তি পাহিত বলিয়া তিনি ভাবিতেন, যশোদার ক্রোড়ে যেন আপাতদৃষ্টিতে তাহার চাহিতে কিছু অধিকই শান্ত ও সন্তুষ্ট থাকিত, ও অধিক দ্রুত ঘুমাইত বলিয়া তাঁহার মনে হইত, এবং ইহাতে তিনি আশ্বস্ত হইলেও যেন সামান্য ঈর্ষাও বোধ করিতেন। মুখে কৌতুক করিয়া বলিতেন, "সত্য বল যশো, ও তোর মেয়ে নয়তো?" যশোদাও কর্ত্রীর এই কৌতুকে খানিক সৌজন্যবশত, ও খানিক স্বামিনীর চিত্তবিনোদনের নিমিত্ত যোগ দিয়া কহিত, "আজ্ঞে মাঠান। দেকেননা, মুকের কেমন মিল!" দুইজনাই হাসিত। কিন্তু যশোদা মনে কী ভাবিত?
    তাহার যেন মনে হইত, শিশুকন্যা তাহার মন পড়িতে পারে। তাহার ক্রোড়ে আসিয়া সে শিশু যেন সতর্ক হইয়া যায়। স্নেহান্ধ পালিকা মাতার ক্রোড়ে সে যতটা চঞ্চল, ও স্বচ্ছন্দভাবে তাহার ক্ষুদ্র হস্তপদাদি সঞ্চালন করিয়া, ক্ষুদ্র মস্তক ও মিষ্ট মুখখানি বিভিন্ন দিশায় ঘুরাইয়া পৃথিবীতে তাহার নবলব্ধ জীবনের চলমান প্রবাহ ও নবতর মাতৃক্রোড়ের সুখকর আশ্বাস উপভোগ করিত, যশোদা দাসীর ক্রোড়ে আসিলে যেন সেসকল স্বচ্ছন্দ অঙ্গসঞ্চালন ও আশ্বস্ত আচরণ পরিবর্তিত হইয়া একপ্রকার স্থির, শান্ত অথচ সতর্ক ভাব আসিত শিশুটির মধ্যে।
    অন্যদিকে, তাহার শান্ত, বশীভূত আচরণ কিন্তু যশোদা দাসীর মধ্যেও কোনপ্রকার আশ্বাস নহে, এক উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগে সতর্ক, টানটান, প্রায় যুদ্ধকালীন প্রতিরোধের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা জাগাইয়া তুলিত। আরো স্পষ্ট করিয়া বলিতে গেলে, শিকারের উপর ঝাঁপাইয়া পড়িবার পূর্বে ব্যাঘ্র যেরূপ নিশ্চল, উদ্যত শারীরিক অবস্থায় আসে, সম্মুখস্থ অবস্থায় তাহা দেখিয়া ফেলিলে শিকারের যেরূপ মানসিক অবস্থা হইতে পারে, যশোদার ঠিক তদ্রূপ হইত।
    শিশুটিকে ক্রোড়ে লইবার মূহুর্তে যশোদার অনুভব হইত সে যেন এক বিশালদেহী পার্বত্য অজগরকে নিদ্রিতাবস্থায় ক্রোড়ে ধারণ করিতে যাইতেছে; যাহা যেকোনো মূহুর্তে জাগিয়া উঠিবে। শিশুর কোমল, রেশমোচিত স্পর্শে তাহার শরীরের ত্বক ও তাহার প্রতিটি রোম কী এক আদিম, অমোঘ আতঙ্কে শিহরিয়া উঠিত। অন্তরাত্মা প্রবলকণ্ঠে বিদ্রোহ ও প্রতিবাদ ঘোষণা করিয়া শরীরকে অবিলম্বে সেই স্থান ত্যাগ করিয়া পলায়ন করিতে নির্দেশ দিত। অথচ কর্তব্য তাহার পদশৃঙখল হইয়া তাহাকে সেস্থানে দৃঢ়ভাবে বাঁধিয়া রাখিত।।
    যাহা হউক যশোদা দাসীকে কোনো একটি সঙ্কল্প বা সিদ্ধান্তে পঁহুছিবার নিমিত্ত আর অধিক কালক্ষেপ করিতে হইলনা। বাটীতে ও বাটীর চারিপার্শ্বে সে যেসকল পরিবর্তন সে অদ্যাবধি লক্ষ্য করিয়াছিল সেসকল এমন সুস্পষ্ট বা অলৌকিক ছিলনা, যে তাহা লহিয়া সে স্বামিনী ও আর পাঁচজনের সহিত সভা করিতে পারে; কিন্তু যেইদিবস প্রাতে সে দেখিল মানদা দাসীর দ্বারা দৈনিক জলসিঞ্চন সত্ত্বেও অঙ্গণের তুলসী শুকাইয়াছে, তদুপরি নবনির্মিত তুলসীমঞ্চে ফাটল ধরিয়াছে। আবার সেই দিবসেরই সন্ধ্যায় জমিদারবাটীর অভ্যন্তরস্থ মদনমোহনের মন্দিরে কুলপুরোহিতমহাশয়কর্তৃক আরতি চলাকালীন অকস্মাৎ আগুন লাগিয়া গেল। পুরোহিত মহাশয় মন্দিরদ্বারপ্রান্তে মূর্ছিত হইয়া পড়িয়াছিলেন, তাঁহাকে ভৃত্যগণ উদ্ধার করিয়া তাঁহার প্রাণরক্ষা করে, এবং অন্যদিকে কলসী কলসী জল আনিয়া অগ্নি নির্বাপণ করা হয়। সংবাদ পাহিবামাত্র রায়বাহাদুর ও তাঁহার লেঠেলবৃন্দ বাহির হইতে দস্যুহানা অথবা কোনোরূপ অন্তর্ঘাত সন্দেহে ঘটনাস্থলে দৌড়াইয়া আসিলেন। ততোক্ষণে ব্রাহ্মণ ঠাকুর সেবা শুশ্রূষা পাহিয়া মূর্ছা ভাঙ্গিয়া উঠিয়াছেন। তাঁহাকে লহিয়া ভূস্বামী ব্যস্তসমস্ত হইয়া পড়িলে ব্রাহ্মণ তাঁহাকে আশ্বস্ত করিয়া কহিলেন, তাঁহাকে লহিয়া রায়বাহাদুরের ব্যস্ত হইবার প্রয়োজন নাহি, তিনি বর্তমানে অপেক্ষাকৃত সুস্থ। আরতিকালে মাথাটা ঘুরিয়া গিয়া তাঁহার হাত হইতে পঞ্চপ্রদীপ স্খলিত হইয়া ভূপতিত হইয়াছিল এবং তাহার তৈল ভূমিতে পড়িয়া দীপশিখা হইতে অগ্নিসংযোগ হইয়া যায়। অন্যধারে তিনি অসুস্থদেহে, ভৃত্যদিগের নিকট সাহায্য চাহিবার নিমিত্ত ছুটিয়া নিষ্ক্রমণকালে দ্বারপ্রান্তে মূর্ছিত হইয়া পড়েন। বহিরাগত কোনো অনিষ্টকারীর হাত এই অগ্নিকান্ডে নাই। তবে আজি তাঁহাকে একটু ঔষধপথ্যাদি করিবার নিমিত্ত গঞ্জের কবিরাজবাটী পঁহুছাইয়া দিলে উত্তম হয়। চিকিৎসককে দেখাইয়া, ঔষধ লহিয়া একটু সুস্থ হইবামাত্র তিনি রায়বাহাদুরের নিকট আসিয়া কয়েকটি জরুরি ও গোপন আলোচনা করিবেন। তবে যজমানের সঙ্গে তাঁহার ধর্মপত্নী, অর্থাৎ বিধু বধূমাতা থাকিলে শ্রেয়তর হয়। শুনিয়া রায়বাহাদুর অতিশয় ব্যস্ত ও উদ্বিগ্ন হইয়া, "হাঁহাঁ, নিশ্চয় ঠাকুর, একনি পালকি নে যান; ওরে কে কোতা আচিস?" ইত্যাদি বলিয়া পুরোহিত ঠাকুরকে পালকিসহ নিকটস্থ মহুলগঞ্জে চিকিৎসকগৃহে প্রেরণ করিবার নিমিত্ত তৎপর হইয়া পড়িলেন। অন্যদিকে অর্ধদগ্ধপ্রায়, অবিন্যস্ত মন্দিরাভ্যন্তর পুনরায় সুসজ্জিত করিবার দলের সহিত যোগ দিতেই যশোদা দাসী প্রথম যে দৃশ্য দেখিল, তাহা হইল, মদনমোহনের স্বর্ণসিংহাসন হইতে তাঁহার দুইহাতপ্রমাণ স্বর্ণমূর্তিটি কিয়দ্দূরে ছিটকাইয়া পড়িয়াছে।
    যশোদা যখন বিধুদেবীর অন্দরমহলে প্রবেশ করিল, তিনি তখন শিশুকন্যাকে লহিয়া তাহাকে ঝুমঝুমি দিয়া খেলাইতে ব্যস্ত। কর্তাবাবু গিয়াছেন কাছারিবাটীতে তাঁহার কার্যে। বাটীতে সন্ধ্যাদীপ দেওয়া হইয়াছে বহুক্ষণ। বিধুসুন্দরী একদিকে খুকিকে ঝুমঝুমি খেলিতে দিয়া অন্যদিকে স্বীয় ঘন, কুঞ্চিত কেশদামের যত্ন ও সজ্জা স্বহস্তে করিতে গিয়া কিঞ্চিৎ অসুবিধা ভোগ করিতেছেন। দেখিয়া যশোদা ব্যস্ত-বিব্রত হইয়া বলিল, ওকি মাঠান, এই যশোঝি থাকতি আপনি নিজহাতে চুল বাঁদতি নেগিচেন কেন মা! ওগো ছি গো, ছি গো, নোকে আমায় কী বলবে! একটা হাঁক পাড়তি হয় মা। দিন, আমি চুলকটা বেঁদি দিই", বলিয়া দ্রুত তাঁহার নিকটে আসিয়া বসিয়া কেশতৈল, ও চিরুনি টানিয়া লইল।
    কক্ষে দুইটি বৃহৎ তৈলদীপ জ্বলিতেছিল, তাহাদিগের উজ্জ্বল আলোয় ও কক্ষের আলোকমণ্ডলবহির্ভূত অংশের অন্ধকারে মিশিয়া, প্রাচীরগাত্রে পড়িয়া বিরাট বিরাট সব অদ্ভুতাকৃতি ছায়াচিত্রের নির্মাণ করিয়াছিল। কর্ত্রীর পশ্চাতে সরিয়া আসিয়া যশোদা তাঁহার সুন্দর কেশগুচ্ছ তাহার দুইহস্তের অঙ্গুলির চারিপার্শ্বে সুকৌশলে জড়াইয়া লহিয়া অতি সন্তর্পণে ও কোমলভাবে তাহাদের একে অন্যের জটিলতা হইতে মুক্ত করিতে করিতে তাহার বক্তব্য আরম্ভ করিল। "মাঠান, যদি অনুমতি করেন তবে দুটো কতা কইতি চাই আজ্ঞে। তবে কি, ছোটো মুকে বড় কতা, কইতি ভয় লাগে। ঠাকরুন সাহস দেন তো তবেই কই আজ্ঞে।"
    - "বেশতো। ক' না যশো! তোর কতায় আবার রাগ কল্লুম কবে!" এইবারে যশোদা বুকে কিঞ্চিৎ বল পাহিয়া কহিতে আরম্ভ করিল। মার্জারপরিবারের অন্তর্ধান হইতে শুরু করিয়া, কাকপক্ষী ও সারমেয়াদির জমিদারগৃহের প্রতি বিতৃষ্ণ আচরণ, বাটীর পোষ্য তোতা বাবুলালের আকস্মিক ও অদ্যাপি অটুট নীরবতা, অথবা পোষ্য কবুতরবর্গের সদলে গৃহত্যাগ অবধি কিছুই সে বলিতে বাদ রাখিলনা।
    কথার মধ্য মধ্য সে পার্শ্ববর্তী দোলনায় শায়িতা ও ঝুমঝুমি লহিয়া ক্রীড়ারতা খুকির প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপ করিতেছিল, ও উত্তেজনাহেতু মধ্য মধ্য দ্রুত শ্বাস লহিতেছিল। খুকির হস্তে ঝুমঝুমি থাকিলেও, এবং সে তাহা নাড়াইয়া চাড়াইয়া সেটির মিষ্ট ঝঙ্কারে ক্রমান্বয়ে যশোদার আলোচনার নেপথ্যসঙ্গীত রচনা করিয়া গেলেও তাহার দুইটি সুন্দর চক্ষুর স্থির দৃষ্টি কিন্তু শুধুমাত্র যশোদার উপরেই নিবদ্ধ ছিল। একমূহুর্তকালও তথা হইতে চ্যুত হয় নাই, ইহা যশোদা তাহার দিকে সর্বদা না তাকাইয়াই অনুভব করিতেছিল ও তাহার শরীর গোপনে কণ্টকিত হইতেছিল। কিন্তু তাহার এই ভীষণ ত্রাসের সহিত কোথাও এক দুর্বোধ্য ও দুর্নিবার আকর্ষণও মিশিয়াছিল, যাহা না চাহিতেও তাহাকে পুনর্বার খুকীটির মুখের দিকে তাকাইতে বাধ্য করিতেছিল, এবং সে যেন প্রতিবার খুকীর দুই ঘোর উজ্জ্বল চক্ষুর স্থির, প্রায় মস্তিষ্কভেদী দৃষ্টির সহিত, খুকীর কমনীয়, রক্তিমোষ্ঠের প্রান্তে যেন একপ্রকার অত্যন্ত পরিণত, ক্রূর ও ব্যঙ্গপূর্ণ বক্রহাস্য দেখিতে পাহিতেছিল, যাহা প্রতিবার তাহার ধমনীর রক্তপ্রবাহকে থমকাইয়া থামাইয়া দিতেছিল।
    যাহা হউক যশোদা অনেককথা একনাগাড়ে বলিয়া যাইলেও, এক্ষণাবধি মধ্য মধ্য বিধুদেবীর নিকট হইতে দুই একটা হ্যাঁ-হুঁ ব্যতীত বিশেষ প্রতিক্রিয়া পাহে নাই। তাঁহার কেশসেবায় প্রবৃত্ত যশোদার সম্মুখে বিধুসুন্দরীর পৃষ্ঠদেশ থাকায় তাহার বাক্যাবলী শ্রবণকালে তাঁহার মুখমণ্ডলের অভিব্যক্তিও যশোদা দেখিতে পাহে নাই। কিন্তু এইবারে যখন যশোদা তাহার কথনের উপসংহারে কহিল, "আমি কই কি মাঠান, এইসব অলুক্কুণে ব্যাপারের পর আবার আজকেও যকন ঠাকুরথানে অমন সব্বোনেশে ঘটনাটা ঘটল, তকন আপনার ও খুকীটাকে নে আসাটা ঠিক ভালো হইচে কিনা, তা বেরাম্মন ঠাকুরকে একবার শুদিয়ে নেলে হয়না?", তৎক্ষণাৎ স্বামিনী তাহার মুখোমুখি ঘুরিয়া বসিয়া উত্তর করিলেন, "কোন কাজটে শুদাবি রে বকুলফুল? আমাকে যে সেই গঙ্গা নাইতে গে গাঙের জলে ডুবায়ে এলি সেইটে?" তৈলনিঃশেষিতপ্রায়, কম্পমান অত্যুজ্জ্বল দীপালোকে সেই মূহুর্তে যশোদার দুই বিস্ফারিত চক্ষু যাহা প্রত্যক্ষ করিল, তাহা হইল তাহার জীবনের এক ঘনকৃষ্ণ অন্ধকার। বয়ঃসন্ধিকালের অবোধ উদ্দাম অসূয়াপরবশতায় কৃত এক অতি গোপন অপরাধের মুখপচ্ছবি। তাহার বাল্যসখী সরলা, তাহার বকুলফুল, যাহাকে সে অত্যন্ত ভালোবাসিত, এবং যুগপৎ ঈর্ষা করিত, সরলার অপূর্ব, নৃপকন্যাসুলভ সৌন্দর্যের কারণে। সখীর সৌন্দর্যে বাল্যে সে গর্বিত এবং মোহিত থাকিলেও, যখন হইতে প্রথম কৈশোরের পদধ্বনি শুনিয়া দুই বালার মন উদ্বেলিত ও চঞ্চল হইয়া উঠে, এবং কালক্রমে নিয়তির অমোঘচক্রে উভয় কন্যারই হৃদয় গ্রামস্থ একই পুরুষের প্রেমপ্রত্যাশায় ভ্রমরের ন্যায় তৃষ্ণার্ত হইয়া উঠে, তখন যশোদার সম্মুখে কন্টক হইয়া উঠে তাহার নিজের বাল্যবৈধব্য, এবং অপরদিকে তদ্যাপি অনূঢ়া, এবং বিবাহযোগ্যা সরলার পরম চিত্তাকর্ষক সৌন্দর্য, যাহা তাহার সন্দেহানুসারে ইতোমধ্যই প্রার্থিত পুরুষটিকে সরলার পাণিপ্রার্থনায় বিবশ করিয়া তাহার পরিবারের সম্মুখে প্রস্তাবস্থাপন অবধি লহিয়া যায়। যশোদা তাহার অন্ধ ঈর্ষার দ্বারা চালিত হইয়া, আর কালক্ষেপ না করিয়া সন্তরণাপটু সখীর সহিত তাহার সাহায্য নিমিত্ত গঙ্গাস্নানে যাইবার অছিলায় তাহাকে গঙ্গায় লহিয়া গিয়া কৌশলে ডুবাইয়া হত্যা করে। কার্যসম্পাদন করিয়া পল্লীতে প্রত্যাবর্তনের পশ্চাৎ তাহার ভূয়সী ক্রন্দন ও হাহাকারাদির অভিনয় দেখাইয়া সকল অপরাধকে সেদিবসে সরলার সহিত সলিলসমাধি লাভ করায়। আজি ত্রিশবর্ষ পশ্চাৎ এই গহীন, আলোকান্ধকারময়ী সন্ধ্যায়, মোহময় দীপালোকে, সেই সুন্দরী দ্বাদশবর্ষীয়া সখী তাহার দিকে তাকাইয়া হাসিতেছে। তাহার মুখমণ্ডলের শোভা ও যৌবন কিছুমাত্র কমে নাই, কিন্তু শুধু তাহার গাত্রবর্ণটি যেন কেমন পাণ্ডুর, অপার্থিব বোধ হয়। একী! এতো জল আসিল কোথা হইতে!! সরলার গাত্র ও উন্মুক্ত কেশ হইতে হুহু করিয়া ঝরিতেছে! ঘরে এতো জল, সে এতোক্ষণ দেখে নাই কেন!! সরলার মস্তক, মুখমণ্ডল, সর্বশরীর সিক্ত। তাহার কেশদামে উহা কী!! কচুরিপানা আলিঙ্গন করিয়া সর্প!! চক্ষু?? সরলার চক্ষুর স্থানে চক্ষু নাহিতো! উহার চক্ষুগহ্বর শুধুই যেন গঙ্গামাটির দ্বারা পরিপূর্ণ নহে?!! সরলা কিন্তু হাসিতেছে। তাহার দন্তগুলি অবশ্য আর পূর্ববৎ মুক্তার সারি নাহি। দীপালোকে যশোদা স্পষ্ট দেখিল, উহারা মসীবৎ কলুষবর্ণ এবং জীবাশ্মপ্রতিম দর্শন ধারণ করিয়াছে। তাহাদের শেওলাখচিত শোভার ফাঁকফোকর হইতে নদীগর্ভের কীটসমূহ ঘোরাফেরা করিতেছে। যশোদা ততোক্ষণে আতঙ্কে, ত্রাসে হাঁসফাঁস করিতেছে, কিন্তু কোনোক্রমেই চীৎকার করিতে পারিতেছেনা, বা সেই স্থান হইতে উঠিয়া পলাইতে পারিতেছেনা। সে যেন সম্মোহিতবৎ হইয়া আকণ্ঠ জলমগ্ন দশায় আপন মুখগহ্বর উন্মুক্ত করিয়া কেবলই বহমান এক ভীষণ জলস্রোতকে গবগব শব্দে গলাধঃকরণ করিতে লাগিল, যতক্ষণ না তাহার উদর, শ্বাসনালী ও ফুসফুস সম্পূর্ণ জলপূর্ণ হইয়া যায়। ক্রমে তাহার কর্ণনাসিকাদি সকলই জলপূর্ণ হইয়া গেলো। কিন্তু আশ্চর্য, তাহার মধ্য দিয়াও যেন তাহার বাল্যসখীর কণ্ঠস্বর তাহার কর্ণকুহরে প্রবেশ করিতে লাগিল; "ওলো সই, দ্যাক দিকিনি চেয়ি, এই কেতকীফুলের মালাখান আমায় কেমন মানিইচে! সেই বুদুয়ার হাট হতি একটা পয়সা দিই কিনিচি। ডাঁড়া, খুলে রেকি জলে নাবি।"

    ~ ক্রমশ~
  • স্বাতী রায় | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ১৪:৪৬377748
  • ইস এমন জায়গায় থামতে আছে? পরের পর্বের অপেক্ষায়
  • শঙ্খ | 2345.110.783412.254 | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ১৯:২৮377759
  • ওফ যাতা হচ্ছে এটা। দমবন্ধ করে পড়ছি। লিখুন লিখুন হাত চালিয়ে। আরো খেলিয়ে খেলিয়ে।
  • i | 891212.211.450123.25 | ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ১০:৪৭377770
  • ভাষার ওপর দুরন্ত দখল; এরকম দখল নেটজগতে খুব কম দেখেছি। লিখুন আপনি।
  • Du | 7845.184.1256.215 | ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০১:০৬377773
  • কে কে ঘুমনোর আগে পড়েছ? টইয়ে নাম থাকলে কিছুতেই ক্লিক করতাম না কিন্তু খোলার পর আর বন্ধ করতে পারলাম না
  • SD | 340123.99.7890012.168 | ০৫ অক্টোবর ২০১৮ ১৭:০৩377774
  • রুদ্ধশ্বাস বললে বোধহয় কম বলা হয়। বহুদিন বাদে এরকম লেখা পড়ছি। আর আপনার ভাষাগত দ্ক্ষতাকে কুর্ণিশ না জানিয়ে পারলাম না। পরের পর্বের অধীর অপেক্ষায় রয়েছি।
  • pi | 785612.40.455623.90 | ০৫ অক্টোবর ২০১৮ ১৯:৩৯377705
  • চুম্বক!
  • ইন্দ্রলেখা ভট্টাচার্য | 2345.110.454512.177 | ০৭ অক্টোবর ২০১৮ ২১:৫০377708
  • #নরকনন্দিনী~ ৮ম ভাগ।

    তাহার পর? তাহার পর যেন এক বিশাল জলধির শ্বাসরোধী আলিঙ্গনে যশোদাদাসীর চেতনা শেষবারের মতো অন্ধকারে মুছিয়া গেল।
    বিধুসুন্দরী খুকীকে ক্রোড়ে লহিয়া যতক্ষণে খাজাঞ্চিখানায় নায়েবের সহিত সন্নিকটস্থ দুর্গাপূজার খরচ-খরচাদির হিসাবপত্রের আলোচনা করিয়া ভিতরবাটীতে প্রত্যাবর্তন করিয়াছেন ততক্ষণে পরিচারিকাদি কর্তৃক যশোদার মৃতদেহ আবিষ্কৃত হইয়া গিয়া সমগ্র বাটীতে হুলূস্থূলূ ত্রাস ছড়াইয়া পড়িয়াছে। সে মরিয়া পড়িয়াছিল স্বয়ং স্বামিনীরই কক্ষের অভ্যন্তরে। বোধহয় তথায় তাঁহাকে কোন বিশেষ কারণে সন্ধান করিতে গিয়াছিল। কোনকারণে সেইখানেই সে পড়িয়া মরিয়াছে। বিধুসুন্দরীর সম্মুখে সমগ্র পৃথিবী দুলিয়া উঠিল। কীকরে কী হইল, তিনি কিছুই অনুধাবন করিতে না পারিলেও তাঁহার ও তাঁহার পরিবারের সুখশান্তিময় আকাশে এই আকস্মিক ও ক্রমবিস্তারমান ঘনঘটার অস্তিত্ব আর অস্বীকার করিতে পারিলেননা। গৃহচিকিৎসক আসিয়া মৃতদেহ নিরীক্ষণ করিয়া রায় দিলেন, কোন কারণে একটা বড় রকমের ভয় পাহিয়াই হউক, বা যেকোনো কারণেই হউক, হৃদস্পন্দন বন্ধ হইয়া যাওয়াই মৃত্যুর কারণ বলিয়া বোধ হইতেছে।
    একবার সদর হাসপাতালে মৃতদেহ প্রেরণ করিবার কথা উঠিলে রায়বাহাদুর হাঁহাঁ করিয়া উঠিলেন, এবং চিকিৎসক ও অন্যসকলকে এমন ধমক দিলেন যে ভয়ে সকলে চুপ করিয়া গেল। তাঁহার যুক্তি বড়ই সরল, ও নির্মম হইলেও অকাট্য। ঝি-চাকর মরিলে হাসপাতাল, মর্গ, থানাপুলিশের ঝামেলা করিবার কথা কে কবে শুনিয়াছে! তাহা ব্যতীত, বাটীর আভ্যন্তরিক বিষয় পাঁচকান হওয়াও ভালো নহে, ইত্যাদি। যাহা হউক, সকলে মিলিয়া আপাতত মৃতদেহের গতি করিবার কথা মনস্থ করিল।
    কিন্ত যশোদার সৎকারের ক্ষেত্রে এক অদ্ভুত কাণ্ড ঘটিল। তাহার মৃতদেহ সজ্জিত করিয়া বাটী হইতে বাহির করিবার পূর্বেই প্রহরীগণ আসিয়া সংবাদ দিলো, জমিদারবাটীর দুয়ারে একজন আগন্তুক মেয়েমানুষ আসিয়া যশোদার সহিত দেখা করিতে চাহিতেছে। সে কহিতেছে, সে উহার গ্রামসম্পর্কিতা নিকট আত্মীয়া হয়। শুনিয়া প্রথমটায় সকলে ভারি বিব্রত ও কিঞ্চিৎ সন্ত্রস্ত হইয়া পড়িল। কিন্তু রায়বাহাদুর সে ধাতুর মানুষই নহেন। তিনি আদেশ করিলেন এই ক্ষণেই উহাকে যশোদার মৃত্যুসংবাদ ও বর্তমান পরিস্থিতি জানানো হউক। প্রহরীরা আদেশ পালন করিল। সে রমণী যশোদাকে শেষ দেখা দেখিতে চাহে কিনা তাহা জিজ্ঞাসা করিতেই সে অবগুণ্ঠনের পশ্চাৎ হইতে শান্তকণ্ঠে বলিল, সে গ্রামসম্পর্কে যশোদার নিকটতমা আত্মীয়া। যশোদার সহিত শুধু শেষ দেখাই নহে, সে যশোদার শেষকৃত্যও তাহার পরিবারের সহিত মিলিয়া নিজহস্তে করিতে চাহে, ও সে অধিকার তাহার বিলক্ষণ আছে। এইকথা কহিয়া সে প্রমাণস্বরূপ বস্ত্রের ভিতর হইতে যশোদা দাসীর অপটু হস্তের স্বাক্ষরিত দুইটি বিবর্ণ হইয়া আসা পুরাতন পত্র প্রহরীদিগকে দেখাইল, যাহা নাকি পত্রলেখিকার ভ্রাতার প্রতি সম্বোধিত। দলের মধ্য মাধব সাঁপুই একটু লেখাপড়া জানিত, এবং যশোদার হস্তাক্ষরের সহিতও ঘটনাচক্রে তাহার পরিচিতি ছিল। পাঠকগণকে ইহা বলা অনাবশ্যক যে, যশোদা সম্পূর্ণ পুরুষসঙ্গবিমুখা ছিলনা। যাহা হউক মাধব আসিয়া রায়বাহাদুরকে এই ঘটনা জানাইতেই তিনি উৎফুল্ল হইয়া বলিলেন, এই রাতদুপুরে মৃতদেহের গতি করিবার ও সকল ঝঞ্জাট হইতে মুক্তি পাহিবার ইহার অধিক উত্তম অবসর আর নাহি। ওই আত্মীয়া রমণীর হস্তে প্রথমে কিঞ্চিৎ অর্থ উৎকোচ ধরাইয়া, তাহার পশ্চাৎ যশোদার মৃতদেহ ও তাহার অধিকারের যাবতীয় বস্তু ও অর্থাদি সমর্পণ করিলেই সকল ঝামেলা মিটে। কিন্ত তাঁহার ও বাকি সকলের মনে তৎক্ষণাৎ প্রশ্ন জাগিল, রমণী কীরূপে এমন রাত্রির অন্ধকারে, অসময়ে, সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত ও একাকিনী অবস্থায় মৃতদেহ লহিয়া যাহিবে ? বহন করিবে কে?!! লোক কোথায়?! সেকথা কহিতেই অবগুণ্ঠিতা কহিল, সে পদব্রজে আসে নাই, তাহার সঙ্গে শকট আছে। তাহা কিঞ্চিৎ দূরে রাখা আছে। দুই চারিটি সঙ্গীও আছে। প্রহরীগণ যেন যশোদার দেহ বাটীর ফটক অবধি আনে। তাহা হইলেই সে লোক লহিয়া তাহাকে লহিয়া যাইবে। প্রহরীগণ দেহ আনুক। সে ইত্যবসরে সঙ্গস্থ লোকজনকে ডাকিতেছে। ব্যস, ইহা শুনিয়াই রায়বাহাদুর সন্তুষ্ট হইয়া যশোদার মৃতশরীর তাহার সহিত প্রেরণ করিতে আদেশ করিলেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই, যে, সে রমণী প্রহরী-পাইকগণের অনেক অনুরোধেও ফটকের ভিতরে আসিতে সম্মত হইলনা, অথবা যশোদার বস্ত্রালঙ্কারাদি কোনরূপ সম্পত্তি বা তাহার প্রাপ্য ও অপ্রাপ্য কোনরূপ অর্থই লহিতে সম্মত হইলনা। না হউক, তাহাতে রায়বাহাদুরের কী? শুধুমাত্র বিধুসুন্দরীই স্বামীর পশ্চাতে দাঁড়াইয়া অশ্রুবিসর্জন করিতে করিতে প্রিয় দাসী, ও একাধারে ছায়াসঙ্গিনীকে বিদায় দিলেন। ফটকের বাহিরে রমণীর সঙ্গে চারিজন প্রায় অন্ধকারাচ্ছাদিত বাহক অপেক্ষা করিতেছিল। ছিদাম ও মাধব, দুইজন মিলিয়া যশোদার মরদেহ তাহাদের স্কন্ধে তুলিয়া দিতে সাহায্য করিতে করিতে পরস্পরের মধ্য একবার নিঃশব্দ ভীতচকিত দৃষ্টিবিনিময় করিল। তাহাদের উভয়েরই, এবং উপস্থিত আরো অনেকেরই হয়ত এমন বোধ হইতেছিল, যেন ইহারা প্রথম হইতে কোনো অলৌকিক মাধ্যমে যশোদার মৃত্যুসংবাদ পাহিয়াই আসিয়াছে। যাহা হউক তাহারা মৃতদেহ বহন করিয়া যখন অবগুণ্ঠিতার পশ্চাতে পশ্চাতে নিঃশব্দে পাড়ি জমাইবার উদ্যোগ করিতেছে, তখন শুধু অশ্রুমুখী মানদা ঝি মুখে আঁচল চাপা দিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে রমণীকে পশ্চাৎ হইতে ডাকিয়া কহিল, "ও বউ, তোমার নামটে মাদবের কাচে শুনেও ভুলে গেলুম গা, আর একটিবার বলে যাও বাচা।"- রমণী অবগুণ্ঠণের আড়াল হইতে চকিতে পশ্চাতে ঘুরিয়া দেখিয়া কেমন এক অদ্ভুত ফ্যাসফ্যাসে কণ্ঠে উত্তর করিল, "সরলা।" তাহার কণ্ঠস্বর শুনিয়া ঘোর বৈষ্ণব বধূ মানদার মন যেন কেমন ছমছম করিয়া উঠিল। তথাপি সে সাহস সঞ্চয় করিয়া কহিল, তোমার নোকেদের মুকে হরিদ্দনি নেই কেন গা? এ কেমন শ্মশানযাত্তিরি?" এইটুকু সময়ের মধ্য অবগুণ্ঠিতা ও তাহার দল যেন হুহু করিয়া অস্বাভাবিক দূরে আগাইয়া গিয়াছে। সেইখান হইতে সে ও শববাহকগণ হাহা শব্দে বিকট সমবেত অট্টহাস্য করিয়া উঠিল। মানদার কানে তাহা বন্য শ্মশানে ক্ষুধিত হায়নাদিগের হাস্যধ্বনির ন্যায় ভাসিয়া আসিল। সে শিহরিয়া উঠিল। শুনিল, অবগুণ্ঠিতা দূর হইতে এক টঙ্কারের ন্যায় অনুরণনযুক্ত, উচ্চ, অদ্ভুত, ধাতব কণ্ঠে কহিতেচে, আমাদের ওসব সয়না গো, সয়না।" মানদার মেরুদণ্ড বাহিয়া তৎক্ষণাৎ এক উচ্চবেগা হিমবাহিনী স্রোতস্বিনী বহিয়া গেল। সে চকিতে ঘুরিয়া দেখিল, সে দলের পিছু লহিয়া বাটী হইতে বেশ খানিক দূরে আসিয়া পড়িয়াছে। বাটীর সকলে অগ্রেই বাটীমধ্য অন্তর্হিত হইয়াছে। সে একা।

    ~ক্রমশ~
  • ইন্দ্রলেখা ভট্টাচার্য | 2345.110.454512.177 | ০৭ অক্টোবর ২০১৮ ২১:৫০377707
  • #নরকনন্দিনী~ ৮ম ভাগ।

    তাহার পর? তাহার পর যেন এক বিশাল জলধির শ্বাসরোধী আলিঙ্গনে যশোদাদাসীর চেতনা শেষবারের মতো অন্ধকারে মুছিয়া গেল।
    বিধুসুন্দরী খুকীকে ক্রোড়ে লহিয়া যতক্ষণে খাজাঞ্চিখানায় নায়েবের সহিত সন্নিকটস্থ দুর্গাপূজার খরচ-খরচাদির হিসাবপত্রের আলোচনা করিয়া ভিতরবাটীতে প্রত্যাবর্তন করিয়াছেন ততক্ষণে পরিচারিকাদি কর্তৃক যশোদার মৃতদেহ আবিষ্কৃত হইয়া গিয়া সমগ্র বাটীতে হুলূস্থূলূ ত্রাস ছড়াইয়া পড়িয়াছে। সে মরিয়া পড়িয়াছিল স্বয়ং স্বামিনীরই কক্ষের অভ্যন্তরে। বোধহয় তথায় তাঁহাকে কোন বিশেষ কারণে সন্ধান করিতে গিয়াছিল। কোনকারণে সেইখানেই সে পড়িয়া মরিয়াছে। বিধুসুন্দরীর সম্মুখে সমগ্র পৃথিবী দুলিয়া উঠিল। কীকরে কী হইল, তিনি কিছুই অনুধাবন করিতে না পারিলেও তাঁহার ও তাঁহার পরিবারের সুখশান্তিময় আকাশে এই আকস্মিক ও ক্রমবিস্তারমান ঘনঘটার অস্তিত্ব আর অস্বীকার করিতে পারিলেননা। গৃহচিকিৎসক আসিয়া মৃতদেহ নিরীক্ষণ করিয়া রায় দিলেন, কোন কারণে একটা বড় রকমের ভয় পাহিয়াই হউক, বা যেকোনো কারণেই হউক, হৃদস্পন্দন বন্ধ হইয়া যাওয়াই মৃত্যুর কারণ বলিয়া বোধ হইতেছে।
    একবার সদর হাসপাতালে মৃতদেহ প্রেরণ করিবার কথা উঠিলে রায়বাহাদুর হাঁহাঁ করিয়া উঠিলেন, এবং চিকিৎসক ও অন্যসকলকে এমন ধমক দিলেন যে ভয়ে সকলে চুপ করিয়া গেল। তাঁহার যুক্তি বড়ই সরল, ও নির্মম হইলেও অকাট্য। ঝি-চাকর মরিলে হাসপাতাল, মর্গ, থানাপুলিশের ঝামেলা করিবার কথা কে কবে শুনিয়াছে! তাহা ব্যতীত, বাটীর আভ্যন্তরিক বিষয় পাঁচকান হওয়াও ভালো নহে, ইত্যাদি। যাহা হউক, সকলে মিলিয়া আপাতত মৃতদেহের গতি করিবার কথা মনস্থ করিল।
    কিন্ত যশোদার সৎকারের ক্ষেত্রে এক অদ্ভুত কাণ্ড ঘটিল। তাহার মৃতদেহ সজ্জিত করিয়া বাটী হইতে বাহির করিবার পূর্বেই প্রহরীগণ আসিয়া সংবাদ দিলো, জমিদারবাটীর দুয়ারে একজন আগন্তুক মেয়েমানুষ আসিয়া যশোদার সহিত দেখা করিতে চাহিতেছে। সে কহিতেছে, সে উহার গ্রামসম্পর্কিতা নিকট আত্মীয়া হয়। শুনিয়া প্রথমটায় সকলে ভারি বিব্রত ও কিঞ্চিৎ সন্ত্রস্ত হইয়া পড়িল। কিন্তু রায়বাহাদুর সে ধাতুর মানুষই নহেন। তিনি আদেশ করিলেন এই ক্ষণেই উহাকে যশোদার মৃত্যুসংবাদ ও বর্তমান পরিস্থিতি জানানো হউক। প্রহরীরা আদেশ পালন করিল। সে রমণী যশোদাকে শেষ দেখা দেখিতে চাহে কিনা তাহা জিজ্ঞাসা করিতেই সে অবগুণ্ঠনের পশ্চাৎ হইতে শান্তকণ্ঠে বলিল, সে গ্রামসম্পর্কে যশোদার নিকটতমা আত্মীয়া। যশোদার সহিত শুধু শেষ দেখাই নহে, সে যশোদার শেষকৃত্যও তাহার পরিবারের সহিত মিলিয়া নিজহস্তে করিতে চাহে, ও সে অধিকার তাহার বিলক্ষণ আছে। এইকথা কহিয়া সে প্রমাণস্বরূপ বস্ত্রের ভিতর হইতে যশোদা দাসীর অপটু হস্তের স্বাক্ষরিত দুইটি বিবর্ণ হইয়া আসা পুরাতন পত্র প্রহরীদিগকে দেখাইল, যাহা নাকি পত্রলেখিকার ভ্রাতার প্রতি সম্বোধিত। দলের মধ্য মাধব সাঁপুই একটু লেখাপড়া জানিত, এবং যশোদার হস্তাক্ষরের সহিতও ঘটনাচক্রে তাহার পরিচিতি ছিল। পাঠকগণকে ইহা বলা অনাবশ্যক যে, যশোদা সম্পূর্ণ পুরুষসঙ্গবিমুখা ছিলনা। যাহা হউক মাধব আসিয়া রায়বাহাদুরকে এই ঘটনা জানাইতেই তিনি উৎফুল্ল হইয়া বলিলেন, এই রাতদুপুরে মৃতদেহের গতি করিবার ও সকল ঝঞ্জাট হইতে মুক্তি পাহিবার ইহার অধিক উত্তম অবসর আর নাহি। ওই আত্মীয়া রমণীর হস্তে প্রথমে কিঞ্চিৎ অর্থ উৎকোচ ধরাইয়া, তাহার পশ্চাৎ যশোদার মৃতদেহ ও তাহার অধিকারের যাবতীয় বস্তু ও অর্থাদি সমর্পণ করিলেই সকল ঝামেলা মিটে। কিন্ত তাঁহার ও বাকি সকলের মনে তৎক্ষণাৎ প্রশ্ন জাগিল, রমণী কীরূপে এমন রাত্রির অন্ধকারে, অসময়ে, সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত ও একাকিনী অবস্থায় মৃতদেহ লহিয়া যাহিবে ? বহন করিবে কে?!! লোক কোথায়?! সেকথা কহিতেই অবগুণ্ঠিতা কহিল, সে পদব্রজে আসে নাই, তাহার সঙ্গে শকট আছে। তাহা কিঞ্চিৎ দূরে রাখা আছে। দুই চারিটি সঙ্গীও আছে। প্রহরীগণ যেন যশোদার দেহ বাটীর ফটক অবধি আনে। তাহা হইলেই সে লোক লহিয়া তাহাকে লহিয়া যাইবে। প্রহরীগণ দেহ আনুক। সে ইত্যবসরে সঙ্গস্থ লোকজনকে ডাকিতেছে। ব্যস, ইহা শুনিয়াই রায়বাহাদুর সন্তুষ্ট হইয়া যশোদার মৃতশরীর তাহার সহিত প্রেরণ করিতে আদেশ করিলেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই, যে, সে রমণী প্রহরী-পাইকগণের অনেক অনুরোধেও ফটকের ভিতরে আসিতে সম্মত হইলনা, অথবা যশোদার বস্ত্রালঙ্কারাদি কোনরূপ সম্পত্তি বা তাহার প্রাপ্য ও অপ্রাপ্য কোনরূপ অর্থই লহিতে সম্মত হইলনা। না হউক, তাহাতে রায়বাহাদুরের কী? শুধুমাত্র বিধুসুন্দরীই স্বামীর পশ্চাতে দাঁড়াইয়া অশ্রুবিসর্জন করিতে করিতে প্রিয় দাসী, ও একাধারে ছায়াসঙ্গিনীকে বিদায় দিলেন। ফটকের বাহিরে রমণীর সঙ্গে চারিজন প্রায় অন্ধকারাচ্ছাদিত বাহক অপেক্ষা করিতেছিল। ছিদাম ও মাধব, দুইজন মিলিয়া যশোদার মরদেহ তাহাদের স্কন্ধে তুলিয়া দিতে সাহায্য করিতে করিতে পরস্পরের মধ্য একবার নিঃশব্দ ভীতচকিত দৃষ্টিবিনিময় করিল। তাহাদের উভয়েরই, এবং উপস্থিত আরো অনেকেরই হয়ত এমন বোধ হইতেছিল, যেন ইহারা প্রথম হইতে কোনো অলৌকিক মাধ্যমে যশোদার মৃত্যুসংবাদ পাহিয়াই আসিয়াছে। যাহা হউক তাহারা মৃতদেহ বহন করিয়া যখন অবগুণ্ঠিতার পশ্চাতে পশ্চাতে নিঃশব্দে পাড়ি জমাইবার উদ্যোগ করিতেছে, তখন শুধু অশ্রুমুখী মানদা ঝি মুখে আঁচল চাপা দিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে রমণীকে পশ্চাৎ হইতে ডাকিয়া কহিল, "ও বউ, তোমার নামটে মাদবের কাচে শুনেও ভুলে গেলুম গা, আর একটিবার বলে যাও বাচা।"- রমণী অবগুণ্ঠণের আড়াল হইতে চকিতে পশ্চাতে ঘুরিয়া দেখিয়া কেমন এক অদ্ভুত ফ্যাসফ্যাসে কণ্ঠে উত্তর করিল, "সরলা।" তাহার কণ্ঠস্বর শুনিয়া ঘোর বৈষ্ণব বধূ মানদার মন যেন কেমন ছমছম করিয়া উঠিল। তথাপি সে সাহস সঞ্চয় করিয়া কহিল, তোমার নোকেদের মুকে হরিদ্দনি নেই কেন গা? এ কেমন শ্মশানযাত্তিরি?" এইটুকু সময়ের মধ্য অবগুণ্ঠিতা ও তাহার দল যেন হুহু করিয়া অস্বাভাবিক দূরে আগাইয়া গিয়াছে। সেইখান হইতে সে ও শববাহকগণ হাহা শব্দে বিকট সমবেত অট্টহাস্য করিয়া উঠিল। মানদার কানে তাহা বন্য শ্মশানে ক্ষুধিত হায়নাদিগের হাস্যধ্বনির ন্যায় ভাসিয়া আসিল। সে শিহরিয়া উঠিল। শুনিল, অবগুণ্ঠিতা দূর হইতে এক টঙ্কারের ন্যায় অনুরণনযুক্ত, উচ্চ, অদ্ভুত, ধাতব কণ্ঠে কহিতেচে, আমাদের ওসব সয়না গো, সয়না।" মানদার মেরুদণ্ড বাহিয়া তৎক্ষণাৎ এক উচ্চবেগা হিমবাহিনী স্রোতস্বিনী বহিয়া গেল। সে চকিতে ঘুরিয়া দেখিল, সে দলের পিছু লহিয়া বাটী হইতে বেশ খানিক দূরে আসিয়া পড়িয়াছে। বাটীর সকলে অগ্রেই বাটীমধ্য অন্তর্হিত হইয়াছে। সে একা।

    ~ক্রমশ~
  • ইন্দ্রলেখা ভট্টাচার্য | 2345.110.454512.177 | ০৭ অক্টোবর ২০১৮ ২১:৫০377706
  • #নরকনন্দিনী~ ৮ম ভাগ।

    তাহার পর? তাহার পর যেন এক বিশাল জলধির শ্বাসরোধী আলিঙ্গনে যশোদাদাসীর চেতনা শেষবারের মতো অন্ধকারে মুছিয়া গেল।
    বিধুসুন্দরী খুকীকে ক্রোড়ে লহিয়া যতক্ষণে খাজাঞ্চিখানায় নায়েবের সহিত সন্নিকটস্থ দুর্গাপূজার খরচ-খরচাদির হিসাবপত্রের আলোচনা করিয়া ভিতরবাটীতে প্রত্যাবর্তন করিয়াছেন ততক্ষণে পরিচারিকাদি কর্তৃক যশোদার মৃতদেহ আবিষ্কৃত হইয়া গিয়া সমগ্র বাটীতে হুলূস্থূলূ ত্রাস ছড়াইয়া পড়িয়াছে। সে মরিয়া পড়িয়াছিল স্বয়ং স্বামিনীরই কক্ষের অভ্যন্তরে। বোধহয় তথায় তাঁহাকে কোন বিশেষ কারণে সন্ধান করিতে গিয়াছিল। কোনকারণে সেইখানেই সে পড়িয়া মরিয়াছে। বিধুসুন্দরীর সম্মুখে সমগ্র পৃথিবী দুলিয়া উঠিল। কীকরে কী হইল, তিনি কিছুই অনুধাবন করিতে না পারিলেও তাঁহার ও তাঁহার পরিবারের সুখশান্তিময় আকাশে এই আকস্মিক ও ক্রমবিস্তারমান ঘনঘটার অস্তিত্ব আর অস্বীকার করিতে পারিলেননা। গৃহচিকিৎসক আসিয়া মৃতদেহ নিরীক্ষণ করিয়া রায় দিলেন, কোন কারণে একটা বড় রকমের ভয় পাহিয়াই হউক, বা যেকোনো কারণেই হউক, হৃদস্পন্দন বন্ধ হইয়া যাওয়াই মৃত্যুর কারণ বলিয়া বোধ হইতেছে।
    একবার সদর হাসপাতালে মৃতদেহ প্রেরণ করিবার কথা উঠিলে রায়বাহাদুর হাঁহাঁ করিয়া উঠিলেন, এবং চিকিৎসক ও অন্যসকলকে এমন ধমক দিলেন যে ভয়ে সকলে চুপ করিয়া গেল। তাঁহার যুক্তি বড়ই সরল, ও নির্মম হইলেও অকাট্য। ঝি-চাকর মরিলে হাসপাতাল, মর্গ, থানাপুলিশের ঝামেলা করিবার কথা কে কবে শুনিয়াছে! তাহা ব্যতীত, বাটীর আভ্যন্তরিক বিষয় পাঁচকান হওয়াও ভালো নহে, ইত্যাদি। যাহা হউক, সকলে মিলিয়া আপাতত মৃতদেহের গতি করিবার কথা মনস্থ করিল।
    কিন্ত যশোদার সৎকারের ক্ষেত্রে এক অদ্ভুত কাণ্ড ঘটিল। তাহার মৃতদেহ সজ্জিত করিয়া বাটী হইতে বাহির করিবার পূর্বেই প্রহরীগণ আসিয়া সংবাদ দিলো, জমিদারবাটীর দুয়ারে একজন আগন্তুক মেয়েমানুষ আসিয়া যশোদার সহিত দেখা করিতে চাহিতেছে। সে কহিতেছে, সে উহার গ্রামসম্পর্কিতা নিকট আত্মীয়া হয়। শুনিয়া প্রথমটায় সকলে ভারি বিব্রত ও কিঞ্চিৎ সন্ত্রস্ত হইয়া পড়িল। কিন্তু রায়বাহাদুর সে ধাতুর মানুষই নহেন। তিনি আদেশ করিলেন এই ক্ষণেই উহাকে যশোদার মৃত্যুসংবাদ ও বর্তমান পরিস্থিতি জানানো হউক। প্রহরীরা আদেশ পালন করিল। সে রমণী যশোদাকে শেষ দেখা দেখিতে চাহে কিনা তাহা জিজ্ঞাসা করিতেই সে অবগুণ্ঠনের পশ্চাৎ হইতে শান্তকণ্ঠে বলিল, সে গ্রামসম্পর্কে যশোদার নিকটতমা আত্মীয়া। যশোদার সহিত শুধু শেষ দেখাই নহে, সে যশোদার শেষকৃত্যও তাহার পরিবারের সহিত মিলিয়া নিজহস্তে করিতে চাহে, ও সে অধিকার তাহার বিলক্ষণ আছে। এইকথা কহিয়া সে প্রমাণস্বরূপ বস্ত্রের ভিতর হইতে যশোদা দাসীর অপটু হস্তের স্বাক্ষরিত দুইটি বিবর্ণ হইয়া আসা পুরাতন পত্র প্রহরীদিগকে দেখাইল, যাহা নাকি পত্রলেখিকার ভ্রাতার প্রতি সম্বোধিত। দলের মধ্য মাধব সাঁপুই একটু লেখাপড়া জানিত, এবং যশোদার হস্তাক্ষরের সহিতও ঘটনাচক্রে তাহার পরিচিতি ছিল। পাঠকগণকে ইহা বলা অনাবশ্যক যে, যশোদা সম্পূর্ণ পুরুষসঙ্গবিমুখা ছিলনা। যাহা হউক মাধব আসিয়া রায়বাহাদুরকে এই ঘটনা জানাইতেই তিনি উৎফুল্ল হইয়া বলিলেন, এই রাতদুপুরে মৃতদেহের গতি করিবার ও সকল ঝঞ্জাট হইতে মুক্তি পাহিবার ইহার অধিক উত্তম অবসর আর নাহি। ওই আত্মীয়া রমণীর হস্তে প্রথমে কিঞ্চিৎ অর্থ উৎকোচ ধরাইয়া, তাহার পশ্চাৎ যশোদার মৃতদেহ ও তাহার অধিকারের যাবতীয় বস্তু ও অর্থাদি সমর্পণ করিলেই সকল ঝামেলা মিটে। কিন্ত তাঁহার ও বাকি সকলের মনে তৎক্ষণাৎ প্রশ্ন জাগিল, রমণী কীরূপে এমন রাত্রির অন্ধকারে, অসময়ে, সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত ও একাকিনী অবস্থায় মৃতদেহ লহিয়া যাহিবে ? বহন করিবে কে?!! লোক কোথায়?! সেকথা কহিতেই অবগুণ্ঠিতা কহিল, সে পদব্রজে আসে নাই, তাহার সঙ্গে শকট আছে। তাহা কিঞ্চিৎ দূরে রাখা আছে। দুই চারিটি সঙ্গীও আছে। প্রহরীগণ যেন যশোদার দেহ বাটীর ফটক অবধি আনে। তাহা হইলেই সে লোক লহিয়া তাহাকে লহিয়া যাইবে। প্রহরীগণ দেহ আনুক। সে ইত্যবসরে সঙ্গস্থ লোকজনকে ডাকিতেছে। ব্যস, ইহা শুনিয়াই রায়বাহাদুর সন্তুষ্ট হইয়া যশোদার মৃতশরীর তাহার সহিত প্রেরণ করিতে আদেশ করিলেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই, যে, সে রমণী প্রহরী-পাইকগণের অনেক অনুরোধেও ফটকের ভিতরে আসিতে সম্মত হইলনা, অথবা যশোদার বস্ত্রালঙ্কারাদি কোনরূপ সম্পত্তি বা তাহার প্রাপ্য ও অপ্রাপ্য কোনরূপ অর্থই লহিতে সম্মত হইলনা। না হউক, তাহাতে রায়বাহাদুরের কী? শুধুমাত্র বিধুসুন্দরীই স্বামীর পশ্চাতে দাঁড়াইয়া অশ্রুবিসর্জন করিতে করিতে প্রিয় দাসী, ও একাধারে ছায়াসঙ্গিনীকে বিদায় দিলেন। ফটকের বাহিরে রমণীর সঙ্গে চারিজন প্রায় অন্ধকারাচ্ছাদিত বাহক অপেক্ষা করিতেছিল। ছিদাম ও মাধব, দুইজন মিলিয়া যশোদার মরদেহ তাহাদের স্কন্ধে তুলিয়া দিতে সাহায্য করিতে করিতে পরস্পরের মধ্য একবার নিঃশব্দ ভীতচকিত দৃষ্টিবিনিময় করিল। তাহাদের উভয়েরই, এবং উপস্থিত আরো অনেকেরই হয়ত এমন বোধ হইতেছিল, যেন ইহারা প্রথম হইতে কোনো অলৌকিক মাধ্যমে যশোদার মৃত্যুসংবাদ পাহিয়াই আসিয়াছে। যাহা হউক তাহারা মৃতদেহ বহন করিয়া যখন অবগুণ্ঠিতার পশ্চাতে পশ্চাতে নিঃশব্দে পাড়ি জমাইবার উদ্যোগ করিতেছে, তখন শুধু অশ্রুমুখী মানদা ঝি মুখে আঁচল চাপা দিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে রমণীকে পশ্চাৎ হইতে ডাকিয়া কহিল, "ও বউ, তোমার নামটে মাদবের কাচে শুনেও ভুলে গেলুম গা, আর একটিবার বলে যাও বাচা।"- রমণী অবগুণ্ঠণের আড়াল হইতে চকিতে পশ্চাতে ঘুরিয়া দেখিয়া কেমন এক অদ্ভুত ফ্যাসফ্যাসে কণ্ঠে উত্তর করিল, "সরলা।" তাহার কণ্ঠস্বর শুনিয়া ঘোর বৈষ্ণব বধূ মানদার মন যেন কেমন ছমছম করিয়া উঠিল। তথাপি সে সাহস সঞ্চয় করিয়া কহিল, তোমার নোকেদের মুকে হরিদ্দনি নেই কেন গা? এ কেমন শ্মশানযাত্তিরি?" এইটুকু সময়ের মধ্য অবগুণ্ঠিতা ও তাহার দল যেন হুহু করিয়া অস্বাভাবিক দূরে আগাইয়া গিয়াছে। সেইখান হইতে সে ও শববাহকগণ হাহা শব্দে বিকট সমবেত অট্টহাস্য করিয়া উঠিল। মানদার কানে তাহা বন্য শ্মশানে ক্ষুধিত হায়নাদিগের হাস্যধ্বনির ন্যায় ভাসিয়া আসিল। সে শিহরিয়া উঠিল। শুনিল, অবগুণ্ঠিতা দূর হইতে এক টঙ্কারের ন্যায় অনুরণনযুক্ত, উচ্চ, অদ্ভুত, ধাতব কণ্ঠে কহিতেচে, আমাদের ওসব সয়না গো, সয়না।" মানদার মেরুদণ্ড বাহিয়া তৎক্ষণাৎ এক উচ্চবেগা হিমবাহিনী স্রোতস্বিনী বহিয়া গেল। সে চকিতে ঘুরিয়া দেখিল, সে দলের পিছু লহিয়া বাটী হইতে বেশ খানিক দূরে আসিয়া পড়িয়াছে। বাটীর সকলে অগ্রেই বাটীমধ্য অন্তর্হিত হইয়াছে। সে একা।

    ~ক্রমশ~
  • শঙ্খ | 340112.242.90090012.230 | ০৭ অক্টোবর ২০১৮ ২২:৫৯377709
  • অতি অল্প হইল। তাহাই সহি।
  • Du | 237812.58.450112.152 | ১১ অক্টোবর ২০১৮ ০০:৩৮377710
  • ওগো এ পোস্ট ঠিক তিনবার করেই হচ্ছে কেন গা?
  • de | 90056.185.673423.57 | ১১ অক্টোবর ২০১৮ ১৪:২০377711
  • কেয়া বাত!

    চলুক চলুক - খুবই সুন্দর বাঁধুনি -
  • শঙ্খ | 340112.242.90090012.230 | ১৭ অক্টোবর ২০১৮ ১৭:৫৪377712
  • দিনদশেক হয়ে গেল, আরেকটা কিস্তি এলে বেশ হোতো।
  • NiPa | 780123.188.45900.14 | ১৮ অক্টোবর ২০১৮ ০২:১০377713
  • এবাবা - এই গল্পটা থেমে গেলো কেন? কী ভালো হচ্ছিলো। ভাগ্গিস নাম ছিলোনা তাই পড়লুম - নাহলে আমি কক্ষণো ভয়ের গল্প পড়িনা। কিন্তু - তাপ্পর লো হলো? তাপ্পর তাপ্পর???
  • | 670112.210.674512.47 | ১৮ অক্টোবর ২০১৮ ০৮:৫০377714
  • হ্যাঁ অনেকদিন হয়ে গেল। তারপর?
  • Atoz | 125612.141.5689.8 | ২৬ অক্টোবর ২০১৮ ০১:০৮377716
  • দু দি, এই নাও, তুলে দিলাম। ঃ-)
  • ইন্দ্রলেখা ভট্টাচার্য | 2345.110.454512.147 | ২৬ অক্টোবর ২০১৮ ০৩:৩৭377717
  • নরকনন্দিনী~ ৯ম ভাগ।
    তৎক্ষণাৎ সে চকিতা হরিণীর ন্যায় দ্রুতপদে বাটী অভিমুখে ছুটিতে লাগিল। বহুদূর হইতে শববাহকগণের অপার্থিব, খলখল অট্টহাস্য তদ্যাপি তাহার কর্ণে ভাসিয়া আসিতেছিল। কোনক্রমে বাটীর দ্বারপ্রান্তে পঁহুছিয়া সে কিঞ্চিৎ আশ্বস্ত হইয়া সবে শ্বাস লহিতেছে, এমন সময় মাধব ও ছিদাম তাহাকে দেখিয়া ছুটিয়া আসিল। বেপথুমানা, ত্রস্তা, ক্লান্ত মানদা তাহাদিগকে দেখিয়া সেইস্থানেই বসিয়া পড়িল। মাধব কম্পিতকণ্ঠে বলিল,"অ মানদাদিদি, তুমি কী গা, কেদের পেচুনে গিচিলে!! অদের পেচুনে কি যাতি আচে? অরা কি মনুষষি জেতের?! অ বউটার গায়ে ভকভক করতিচে পচাজল আর শেওলার বুনো গন্দো!! অ কি মানষের গায়ের গন্দো! রাম রাম! আমি আর কত্তাকে কী বোজাবো? তিনি তো দুব্বাসা মুনি। কিচু বুজবেন?!! রাম রাম।" মাধব কম্পিত যুক্তহস্ত বারংবার মাথায় ঠেকাইতে লাগিল, এবং চক্ষু মুদ্রিত করিয়া অস্ফুটকণ্ঠে রামনাম জপিতে লাগিল। ছিদাম কহিল, "কত্তাবাবু আর গিন্নিমার সামনে এ কতা কইতে পারলুমনা গ, আমি কিচুদিন কলকেতায় মুদ্দেফরাশের কাজ করেচিলুম। উনাদের কাচ থেকে আমি যে বাস পেইচি, মাকালীর দিব্যি দে বলচি, তা বহুদিনের বাসি মড়ার কাচ থিকেও আসেনি কককনো।" কোনমতে কথা শেষ করিয়াই ছিদাম ধপ করিয়া মানদার পার্শ্বে বসিয়া পড়িল। তাহারা তিনজন কিয়ৎকাল চিন্তামগ্ন ও নিশ্চুপ হইয়া থাকিবার পর মানদা কিঞ্চিৎ ধাতস্থ হইয়া বাকি দুইজনকে মৃতদেহ স্পর্শোত্তর করণীয় স্নান ও মঙ্গল দ্রব্যাদি দ্বারা শুদ্ধিকরণের কথা মনে করাইয়া ও স্বয়ং সেসকল আচারপালনের প্রয়াসে সদ্য উঠিতেছে, এবং অপরদিকে ভোরের আলো প্রস্ফুটিত হইতেছে, এমনসময় নকুল বেহারা ও চরণদাস পাইক প্রায় ছুটিতে ছুটিতে, ও হাঁপাইতে হাঁপাইতে বাটীতে এক বার্তা আনিল। কুলপুরোহিত ঠাকুরমহাশয় গতপরশ্ব রাত্রিকালে চিকিৎসকগৃহ হইতে প্রত্যাবর্তনকালে পালকিমধ্যই কোনো অজ্ঞাত উপায়ে প্রাণ হারাইয়াছেন। রায়বাহাদুরকর্তৃক প্রেরিত বেহারা ও লেঠেলগণ ব্রাহ্মণঠাকুরের অনুমতি লহিয়া একটু পালকি নামাইয়া ক্ষণকাল বিশ্রাম ও তামুক সেবন করিতে বসিয়াছিল। ব্রাহ্মণঠাকুর পালকির অভ্যন্তরেই অবস্থান করিতেছিলেন, নামেন নাই। কিয়ৎক্ষণ পশ্চাৎ তিনি অকস্মাৎ যেন রুদ্ধকণ্ঠে আর্তনাদ করিয়া উঠেন। বেহারাগণ কিঞ্চিৎ দূরত্ব রাখিয়া বসিয়াছিল। তথাপি তাহারা পালকির অভ্যন্তর হইতে ঠাকুরমহাশয়ের সেই অস্ফুট আর্তনাদ শ্রবণ করিতে বিফল হয় নাই। তৎক্ষণাৎ সকলে তামাকু ইত্যাদি ফেলিয়া পালকি অভিমুখে ছুটিয়া যায়। কিন্তু শেষরক্ষা হয় নাই। ততক্ষণে সেই অজ্ঞাত বিভীষিকার ছোবলে আপাতদৃষ্টিতে ব্রাহ্মণ ঠাকুরের মৃত্যু হইয়াছে বলিয়াই তাহাদের নিকট প্রতীত হয়; তাহা কোনো বিষধরই হউক অথবা হৃদরোগাদি ব্যাধিই হউক, তাহা তাহারা বুঝে নাই, কিন্তু তাহাদিগের উপস্থিত বুদ্ধির বলে কর্তব্যটুকু বিলক্ষণ বুঝিয়াছিল। সেই মূহুর্তেই তাহারা দুইদলে বিভক্ত হইয়া, একদল ঠাকুরমহাশয়ের দেহসমেত পুনরায় চিকিৎসক বাবুর বাটীর উদ্দেশে, অর্থাৎ গঞ্জের দিকে গমন করে; অপর দল ভীতচকিত চিত্তে ঠাকুরমহাশয়ের গৃহে কোনমতে সংবাদ পঁহুছাইয়াই ছুটিতে ছুটিতে রায়বাহাদুরকে সংবাদ দিতে আসিয়াছে। প্রভু ব্যতীত থানাপুলিশের ক্রূরহস্ত হইতে গরীবকে আর কে রক্ষা করিতে পারে! সকল বিবৃত করিয়া, সত্যই তাহাদিগের কোনো দোষ নাই, ইত্যাদি বলিয়া চরণদাস ও নকুল রায়বাহাদুরের পদপ্রান্তে কাঁদিয়া পড়িল। ততোক্ষণে সংবাদবাহক ও সাক্ষ্যসঙ্গী বাকি বেহারা-পাইকেরাও আসিয়া পড়িয়াছে। তাহারাও চরণদাসদিগের ন্যায় চরণবন্দনার পথ ধরিল। রায়বাহাদুর সব শুনিয়া প্রথমটায় বেশ খানিক হতবুদ্ধি ও ভীত হইয়া পড়িলেও ক্রমে তাঁহার স্বাভাবিক স্বত্বা ও বুদ্ধি ফিরিয়া আসিল। ভূস্বামী তাঁহার লোকলস্করদিগকে বিলক্ষণরূপে জানিতেন। দ্রুতই ইহা অনুধাবন করিয়া লহিলেন যে, উহারা তামাকু নহে, গঞ্জিকা সেবন করিতে গিয়াছিল। সে যাক। ভৃত্যজাতি বাটীর বাহিরে বাহির হইলে আর তাহাদিগের ছোটোখাটো বিনোদনসমূহ প্রভুর আয়ত্তে থাকা কঠিন। কিন্তু এ সর্বনাশের পশ্চাতে তাঁহার ভৃত্যগণের কোনো ভূমিকা নাহি, এবং কোথাও বা কিঞ্চিৎ অতিরঞ্জন হইলেও তাহারা সত্যই কহিতেছে, ইহা রায়বাহাদুর সম্যকভাবেই বুঝিলেন। তাঁহার হস্তে অধিক চোটপাট করিবার সময়ও ছিলনা। কুলপুরোহিতের অপঘাতমৃত্যু যেকোনো সম্ভ্রান্ত বংশ বা পরিবারের পক্ষেই সুসংবাদ নহে। তাহার উপর জমিদার মহাশয়ের তত্ত্বাবধানে, তাঁহার পালকিতেই যাত্রা করিয়া প্রত্যাবর্তনকালে এরূপ ঘটনা। রায়বাহাদুর হইলেও পাঁচকড়িবাবুকে অল্পবিস্তর থানাপুলিশের ঝক্কি তো পোহাইতেই হইবে। সুতরাং বেহারা-পাইকাদির প্রতি দুই চারিটা লঘু শ-কার ব-কার ও দায়সারাগোছের মোলায়েম চড়থাপ্পড় নিক্ষেপ করিয়াই তিনি স্বয়ং নায়েব মহাশয়কে লহিয়া প্রথমে পুরোহিতমহাশয়ের বাটী অভিমুখে পালকিযোগে বাহির হইয়া গেলেন। তথা হইতে গঞ্জে চিকিৎসকবাবুর দাওয়াখানায় যাইবার পরিকল্পনা করিলেন। তাঁহার মনের মধ্যে আজিকে অসম্ভব কু গাহিতেছিল। বিপত্তির যে ঝঞ্ঝাবাত তাঁহার পরিবারকে ঘিরিয়া বেশকিছুদিন হইতে ঘুরপাক খাইতেছিল, আজ তাহার একটি সুস্পষ্ট ভয়াবহ অবয়ব যেন তাঁহার চক্ষুর সামনে দানা বাঁধিয়া, শির উচ্চ করিয়া দাঁড়াইয়াছে। যাত্রাপথে নায়েব বাবু তাঁহাকে যে কয়টি কথা কহিতেছিল তাহার উত্তরে তিনি কয়েকটি মামুলি হুঁ হ্যাঁ ব্যতীত কিছুই কহিলেননা। ঠাকুর মহাশয়ের গৃহে পঁহুছিয়া দেখিলেন বেহারাগণ চিকিৎসকগৃহ হইতে সামান্য পূর্বেই দেহ আনয়ন করিয়াছে। সে বাটীতে কান্নার রোল ও শোকের ঝাপটা সামলানো দুষ্কর হইয়া উঠিয়াছে। পুরোহিতপত্নী বারংবার মূর্ছা যাহিতেছেন। যাহা হউক সকলকে কোনমতে সান্ত্বনাবাক্য কহিয়া পুরোহিতপুত্র যুবক সতীশকে সঙ্গ লহিয়া, তথা হইতে গঞ্জে চিকিৎসকবাটী যাহিবার জন্য নিষ্ক্রান্ত হইলেন। ডেথ সার্টিফিকেটটি চিকিৎসক বাবু বেহারাগণের হস্তে সঙ্গতভাবেই প্রেরণ করেন নাই। গঞ্জে চিকিৎসকের দাওয়াখানা হইতে উহা সংগ্রহ করিবার অগ্রে ব্যাপারটি পুলিশ রিপোর্ট করা হইবে কিনা, এবং পোস্ট মর্টেম হইবে কিনা, জমিদারবাবু এবং মৃতের পরিবারকে তাঁহা সম্যক বিবেচনা করিয়া সিদ্ধান্ত লহিতে বলিয়া এক চিরকুট পাঠাইয়াছেন। মৃত্যুর আপাত কারণ হিসাবে চিকিৎসক বাবু এযাবৎ কোনো বিষধর সর্প বা কীট দ্বারা দংশন বা তেমন কিছু চিহ্ন খুঁজিয়া পাহেন নাই। মৃতদেহ পোস্টমর্টেমে প্রেরণ করার দায়িত্ব মৃতের পরিবারের। কিন্তু যেহেতু রায়বাহাদুরের পালকিতে চড়িয়া, তাঁহার অনুচরগণের দ্বারা পরিবেষ্টিত হইয়া গমনকালে পুরোহিত মহাশয়ের মৃত্যু হয়, সেইহেতু এক্ষেত্রে ভূস্বামীর এই ঘটনা বা দুর্ঘটনার সহিত আইনানুসারে জড়াইয়া পড়িবার পূর্ণ সম্ভাবনা। সহস্র হউক, তিনি এ জিলার সর্বাপেক্ষা নামী ও প্রতাপশালী ব্যক্তি। সামান্য চিকিৎসকের ক্ষমতা কি, যে তাঁহাকে আইন দর্শায়। ইহা শুধুই নিয়মরক্ষার নিমিত্তে বলা, ইত্যাদি বিনয়বচন চিকিৎসক মহাশয় সংক্ষেপে ঈষৎ পরোক্ষ ভাষায় লিখিয়া চিরকুট স্বাক্ষর করিয়াছেন। সতীশের পাঠ পশ্চাৎ রায়বাহাদুর চিরকুট পাঠ করিয়া প্রথমে যথেষ্টই অপ্রসন্ন মুখ করিয়া দুই একটা উত্তপ্ত হইতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু চিরকুটের একেবারে নিম্নে স্থানসঙ্কুলানের নিমিত্ত অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র হরফে লিখিত এমন একটি বাক্য পড়িলেন, যে তাঁহার মানসিক শান্তি ও স্থিতির পুষ্করিণীর ইতোমধ্য যথেষ্ট তরঙ্গায়িত জল একেবারে তোলপাড় হইয়া উঠিল। সেই নিম্নতম অংশে চিকিৎসক লিখিয়াছিলেন, যে সন্ধ্যায় পুরোহিত মহাশয় তাঁহার দাওয়াখানায় নিজ অসুস্থতার চিকিৎসা করাইতে আসেন, তিনি রায়বাহাদুরগৃহমন্দিরে ঘটিত দুর্ঘটনার বিবৃতি চিকিৎসককে সবিস্তার দিয়া তাহার সহিত সে তাঁহার অভিজ্ঞতার অন্তর্ভুক্ত একটি ক্ষুদ্র, কিন্তু উৎকট, ও ভয়াবহ, অতিপ্রাকৃত তথ্যও উন্মোচিত করেন, যাহা একবার রায়বাহাদুরকে বলা তাঁহার অবশ্য কর্তব্য। ভূস্বামী একবার কষ্ট করিয়া তাঁহার আলয়ে দর্শন দিলে উত্তম হয়। ~ক্রমশ
  • amit | 340123.0.34.2 | ২৬ অক্টোবর ২০১৮ ০৫:৪২377718
  • দারুন এগোচ্ছে গল্প। একটু "ওমেন" সিনেমাটার আভাস পাওয়া যাচ্ছে যদিও পরের দিকে, কিন্তু ভাষার ওপর দখল অতুলনীয়।
  • শঙ্খ | 2345.110.564512.248 | ২৬ অক্টোবর ২০১৮ ১০:৪৩377719
  • ওহ, শুক্কুর বারের বাজারে নরক নন্দিনী ইজ ব্যাক। কোন কথা হবে না।
  • Du | 7845.184.6734.44 | ০১ নভেম্বর ২০১৮ ০৯:০০377720
  • লগ ইন করে নিন তাহলে সহজে পাবেন।
  • ... | 342323.233.3412.118 | ০৩ নভেম্বর ২০১৮ ১৪:১৩377721
  • তারপর কি হল?????
  • ¥ | 457812.254.453412.15 | ০৬ নভেম্বর ২০১৮ ০১:০৬377722
  • আজকের দিনে তাঁরা যদি এই কাহিনীর একটা কিস্তিও না এগিয়ে দিতে পারেন, তবে তেনাদের থাকা না থাকা সমান!
  • সিকি | 894512.168.0145.123 | ০৬ নভেম্বর ২০১৮ ০৯:৫৭377723
  • পড়ব বলে বসে আছি যে!
  • শঙ্খ | 2345.110.015612.62 | ০৬ নভেম্বর ২০১৮ ১৪:০০377724
  • আজকে অন্ততঃ একটা পর্ব আসুক। জাতি জানতে চায় 'ক্ষুদ্র, কিন্তু উৎকট, ও ভয়াবহ, অতিপ্রাকৃত তথ্য' টি কী?
  • .... | 342323.233.5645.236 | ০৭ নভেম্বর ২০১৮ ১২:২৭377725
  • ছ তারিখ ঘুরে সাত তারিখ চলে এলো যে! সেই তথ্য এখনো সামনে এলো নাঃ(
  • Indralekha Cleopatra Bhattacharya | ১৬ নভেম্বর ২০১৮ ০১:৫৩377727
  • #নরকনন্দিনী ~১০ম ভাগ~
    পত্রটি পাঠ করিয়া শুষ্ক, ও চিন্তিত আননে সতীশের হস্তে তাহা পুনঃপ্রদান করিয়া রায়বাহাদুর সেইস্থানেই ভূমির উপর বসিয়া পড়িলেন। সতীশ তাহা দেখিয়া ব্যস্ত হইয়া হাঁহাঁ করিয়া উঠিল, "ওকী কাকাবাবু, অমন ভূঁয়ে বসলেন কেন! ওরে ছোটু, ইদিকে শীগগির জলচৌকিটে আন!"- ভূস্বামী তাহাকে ইঙ্গিতে আশ্বস্ত করিলেন। তাঁহার পশ্চাতে দণ্ডায়মান বটুকলাল পাইক কিন্তু অভ্যাসবশত বুঝিল, হুজুরের সহসা কোন জটিল চিন্তার বিষয় উপস্থিত হইয়াছে, এবং তাঁহার একছিলিম তামাকুর ব্যবস্থা সে সঙ্গ করিয়াই আনিয়াছিল। গড়গড়াটি সে কেবলমাত্র আগাইয়া দিতে যাহিবে, এমন সময় রায়বাহাদুর অকস্মাৎ গাত্রোত্থান করিয়া বলিলেন, "চল বটকু, বেরোই।" এপর্যন্ত রায়বাহাদুর ও সতীশের একত্রে যাহিবার যোজনা হইয়াছিল বলিয়াই সহসা রায়বাহাদুরকে এরূপে স্বীয় গতিপথ বিচ্ছিন্ন করিতে দেখিয়া সতীশ প্রথমে কিঞ্চিৎ আহত হইলেও, পরক্ষণেই বুদ্ধিমান যুবক চিকিৎসক বাবুর সহিত ভূস্বামীর পৃথক, নিভৃত সাক্ষাতের প্রয়োজন অনুধাবন করিয়া, ও ভূস্বামীর পদমর্যাদা ও বয়োজ্যেষ্ঠতার সম্মানের নিমিত্ত তাঁহার গন্তব্য বা কার্যসূচি সম্পর্কে আর অধিক প্রশ্ন করিলোনা। একবার শুধু তাঁহাকে গমনের পূর্বে কিঞ্চিৎ ফলমিষ্টান্নাদি দিয়া জলপান করিতে অনুরোধ করিলে রায়বাহাদুর তরুণের স্কন্ধে একরূপ সস্নেহ সান্ত্বনা ও সন্তুষ্টিসূচক মৃদু চপেটাঘাত করিয়া, সতীশকে সঙ্গ না লহিয়াই একাকী, নিজ দলবলসমেত সেই গৃহ হইতে বিদায় লহিলেন। অতঃপর হুজুরের নির্দেশে পালকি গঞ্জাভিমুখে ধাবিত হইল।
    যে সময়টুকু যাবৎ চিকিৎসকবাবুর দাওয়াখানায় বসিয়া রায়বাহাদুর আসন্ন বিস্ফোটক তথ্যসংবাদাদি শুনিবার নিমিত্ত ব্যাকুল উৎকণ্ঠার সহিত প্রতীক্ষা করিতেছিলেন, তার মধ্যই অপরদিকে দিগন্তে দিননাথ অস্তাচলে গিয়াছেন, ও চরাচরে সন্ধ্যা নামিয়াছে। দাওয়াখানায় একটি বড়মাপের গ্যাসবাতি জ্বলিয়া ঘনায়মান অন্ধকারকে দূরীভূত করিতেছে। চিকিৎসক বাবুর কম্পাউন্ডার ও একাধারে ভৃত্যস্থানীয় মনোময় ব্যতীত দাওয়াখানায় বর্তমানে অপর কাহাকেও না দেখিতে পাহিয়া রায়বাহাদুর কিঞ্চিৎ আশ্চর্য হইলেন। তবে কি আজিকে কোনোই রোগী হয় নাই!
    কিয়ৎক্ষণ পূর্বে মনোময় চিকিৎসক বাবুর বাটীমধ্য যাহিয়া তাঁহাকে নাকি রায়বাহাদুরের আগমন সংবাদ দিয়া আসিয়াছে। দাওয়াখানার উপরতলাতেই তাঁহার গৃহ।' শালা জোচ্চোর ডাক্তার খুব দুপয়সার পসার করেচে যাহোক, দোতলা বাড়ি হাঁকিয়েচে', রায়বাহাদুর মনে মনে বলিলেন। যদিও চিকিৎসক যদুনাথ সেন তাঁহাকে পত্রে স্বগৃহেই আমন্ত্রণ জানাইয়াছিল, তথাপি বিনা খাতিরসম্ভাষণে সে অপরিচিত বাটীতে পাদপ্রবেশ করিতে জমিদারবাবুর রুচি হইলনা। সহস্র হউক, এ পরগনার বৃহদাংশ তাঁহার জমিদারির অধীনস্থ। তিনি প্রকৃত মান্যব্যক্তির ন্যায়, সঙ্গস্থ পালকি ও দলবল, অনুচরবর্গকে দাওয়াখানা হইতে কিঞ্চিৎ দূরে রাখিয়া আসিয়া নীচতলায় অবস্থিত দাওয়াখানাতেই অপেক্ষা করিতেছিলেন।
    দাওয়াখানার বৃহদাকৃতি ওয়ালক্লকের প্রহরনির্দেশক কাঁটাটি যখন সন্ধ্যা প্রায় সাতটা ছুঁই ছুঁই, তখন মনোময় কম্পাউন্ডার আসিয়া যেন একপ্রকার মিচকা হাসিয়া বলিল, "ডাক্তারবাবু এয়েচেন। আপনাকে ভেতরে ডেকেচেন আজ্ঞে।" রায়বাহাদুর অন্যমনস্ক হইয়া বসিয়া নানা চিন্তা করিতেছিলেন। সহসা যেন তাঁহার ঘোর কাটিল। বক্ষমধ্য হৃদপিণ্ডটি যেন মূহুর্তে ধড়াস করিয়া লাফাইয়া উঠিল এবং ধমনীর রক্তপ্রবাহ তৎক্ষণাৎ দ্রুততর হইয়া উঠিল। কেন!! ডাক্তার কী বলিবে এই ভয়?! রায়বাহাদুর নিজ স্নায়ুমণ্ডলীর এই অস্বাভাবিক আচরণ নিজেও বুঝিলেননা। মনোময় তাঁহাকে 'ওইদিকে,' বলিয়া ডাক্তারের কক্ষটির দিক নির্দেশ করিয়া দিলো। আলো আঁধারির প্রভাবে মনোময়ের মুখটি ভারি এক অপার্থিব ও রহস্যাবৃত ধরণের লাগিতেছিল। রায়বাহাদুর তড়িঘড়ি যদুনাথ ডাক্তারের চেম্বার অভিমুখে চলিলেন। যদুনাথবাবুর চেম্বারের দ্বার ভিতর হইতে আলতোভাবে রুদ্ধ ছিল। করাঘাত করিতে যাইতেই ভিতরদিকে খুলিয়া গেলো। "আসুন আসুন জমিদারবাবু, গরীব ডাক্তারের দাওয়াখানায় পদধূলি দিলেন, কি সৌভাগ্যি।" এ কক্ষে একটি অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র ও ম্রিয়মাণ গ্যাসবাতি জ্বলিতেছিল। হয়তবা অদ্য ডাক্তারবাবুর তেমন কোন রোগী দেখিবার কার্য ছিলনা বলিয়া তিনি আর অধিক আলো জ্বালিবার প্রয়োজন অনুভব করেন নাই, ভুস্বামী ইহা বুঝিলেন। যদুনাথ ডাক্তার স্বয়ং তড়িঘড়ি কুরসি ছাড়িয়া উঠিয়া আসিয়া শশব্যস্তভাবে জমিদার পাঁচকড়ি লাহাকে তাঁহার কাঠের টেবিলের বিপরীত দিকের, তাঁহার সম্মুখস্থ রোগী বসিবার মধ্যমাকৃতির বেঞ্চখানিতে এরূপ সমাদরে বসাইলেন যেন সিংহাসনে বসাইতেছেন। ইত্যবসরে জমিদারবাবু তীক্ষ নজরে যদুনাথ ডাক্তারকে জরিপ করিতে লাগিলেন। ব্যক্তি দীর্ঘাঙ্গ, এবং সুগঠিত, মেদহীন কায়ার অধিকারী। কিন্ত কৃশকায় নহে। চক্ষু দুইটি অত্যুজ্জ্বল এবং ধারালো। খড়্গ নাসিকার দুইপার্শ্বে তাহারা দুই শাণিত ছুরিকার ন্যায় অবস্থান করিতেছে। ইহার অবয়ব দেখিয়া ইহার চিন্তাপ্রবাহের গতিপথ কোনোমতেই নির্ধারণ করা যায়না। আবার ইহাকে নিরস্ত্র বা নির্ধন বলিয়া কোনোমতে এরূপ দুর্বল বা অসহায় বলিয়াও বোধ হয়না, যে কোনো পরিস্থিতিতেই লেঠেল বা ভাড়াটে খুনি পাঠাইয়া সাবাড় করিবার কথা কল্পনা করা যাহিতে পারে। "আহা, ডেকে এনে বড় কষ্ট দিলুম আপনাকে, তাইনা জমিদারবাবু!"- এরূপ সবিনয় সৌজন্যের ধাক্কায় ডাক্তারকে হত্যার কল্পনা শুরু হইবার পূর্বেই হোঁচট খাইয়া ভাঙ্গিয়া যাওয়ায়, মনেমনে কিঞ্চিৎ বিরক্ত হইলেও মুখে সে ভাব আনিতে দিলেন না পাঁচকড়ি জমিদার। এখানে আসিবার পূর্বে যে ভয় বা উৎকণ্ঠা অনুভব করিয়াছিলেন তাহা পূর্বেই অনেকাংশে অন্তর্হিত হইয়াছে। আপাতত সেইস্থানে একপ্রকার বিরক্তি জন্মাইয়াছে। লোকটা নিশ্চয় একটা ধূর্ত বিশেষ, তাহাতে সন্দেহ নাহি। একটা আকস্মিক মৃত্যুকে অবলম্বন করিয়া ও একটা মিথ্যা, স্বকপোলকল্পিত কাহিনী বানাইয়া, এবং তাহাকে মৃত পুরোহিত মহাশয়ের শেষ বয়ান বলিয়া চালাইয়া জমিদারবাবুকে ভয় খাওয়াইয়া কিছু কপর্দক কামাইতে চাহে। "হ্যাঁ, এবারে বলুন দিকিনি ডাক্তারবাবু, কী বলবেন। শেষদিনটেয় কী বলেচিলেন ঠাকুরবাবা?! কী দেকেচিলেন আমার বাড়িতে?"- রায়বাহাদুরের কন্ঠে অধৈর্য পরিস্ফুট হইয়া উঠিলো। গ্যাসবাতির ফ্যাকাসে রঙের হালকা আলোয় যদুনাথ ডাক্তারের চক্ষুদুইটি আরো উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। তাঁহার অবয়বের একাংশ কিন্তু তদ্যাপি অন্ধকারাবৃত ছিল। ধীরে ধীরে ডাক্তারের ওষ্ঠপ্রান্তে একরূপ বিচিত্র হাস্য প্রস্ফুটিত হইল। যদুনাথ সরাসরি বলিলেন, "ঠাকুর মশায় বলেচিলেন, আপনাদের মন্দিরের ঠাকুরের সোনার সিংহাসনে ঠাকুরের আসনে একটা ছোট্ট খুকী বসেচিলো। যেইনা ঠাকুর মশায় ব্যস্ত হয়ে তাকে ধরতে গেলেন, অমনি সে তুড়ুক করে দেওয়ালে চড়লো।"- ব্যস, এই অবধি শুনিয়াই রায়বাহাদুর তেলেবেগুনে জ্বলিয়া উঠিলেন। "মানে?!! বলো কি হে তুমি ডাক্তার!! বাচ্চা বসেচিলো, আবার দেওয়ালে চড়লো?!! তাই বললেন ঠাকুরবাবা?!! বলি তুমি কি সন্দের পর গাঁজা টাজা টানো নাকি হে?!"- উত্তপ্ত রায়বাহাদুর এরূপ উৎকট মস্করায়, আর সামান্য ডাক্তারের তাঁহার সম্মুখে ফাজলামি করিবার ধৃষ্টতা দেখিয়া যে ক্রোধে একেবারে রুদ্ররূপ ধারণ করিয়াছিলেন তাহা পাঠককে বলাই বাহুল্য। কিন্তু তাহাতে যদুনাথ ডাক্তারের কোনো ভাবান্তর হইলোনা। তিনি শান্তভাবে হাসিয়া বলিলেন, জানি আপনি বিশ্বাস করবেন না। আপনাকে বরঞ্চ হাতেকলমে দেকাই, দেকুন।"- এইকথা বলিয়া তৎক্ষণাৎ, রায়বাহাদুরের দুই নশ্বর চক্ষুর সম্মুখে ডাক্তার যদুনাথ সেন সম্মুখস্থ খাড়া দেওয়ালখানি বাহিয়া খদ্যোতের ক্ষিপ্রতায় তাহাতে আরোহণ করিতে লাগিল। তাহার হস্তপদগুলি যেন সরীসৃপের স্বাচ্ছন্দ্যে দেওয়ালের গাত্রে অচ্যুতভাবে সংযুক্ত রহিলো ও সড়সড় করিয়া উপরের দিকে উঠিতে লাগিলো। আরোহণকালে মধ্যমধ্য সে পশ্চাতে ভূস্বামীর দিকে মস্তক ঘুরাইয়া তাহার শ্বেতশুভ্র ক্ষুদ্রাকৃতি অসীর ন্যায় ধারালো দন্তগুলি খিঁচাইয়া একপ্রকার হিংস্র হাসি হাসিতে লাগিলো। ইতোমধ্য তাহার দুই চক্ষুর মণি অবলুপ্ত হইয়াছে, ও সেই স্থানে দুইটি হরিতাভ আলো জ্বলিতেছে। আর পাঁচকড়ি লাহা? তিনি যেন কোনো অজানা মন্ত্রে আচ্ছন্ন, মুগ্ধবৎ হইয়া, চিত্রার্পিতের ন্যায় সেইস্থানে বসিয়া এই দৃশ্য অবলোকন করিতে থাকিলেন। অবশেষে যদুনাথ খদ্যোৎ তাহার দীর্ঘ অমানুষিক জিহ্বা বাহির করিলো। অতি প্রাচীন মহাবৃক্ষের কোনো দীর্ঘায়ত উপশাখা, কিংবা ঝুরির ন্যায় উহা প্যাঁচালো, সর্পিল হইয়া ভূস্বামীর দিকে আগাইয়া আসিতে থাকিলো।~ক্রমশ~
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে মতামত দিন