আমি রুকু বিনায়ক। সবাই বলে আমি বুদ্ধু। ভোঁদাই। মা আমাকে গাধা বলে না মুনা বলে। পাপা বলে পুচাই। আমার দুটো হাত,দশটা হাতের আঙ্গুল,দুটো চোখ আছে,যা দিয়ে আমি ছবি আঁকা। পাপা মা বলে আমার অটিজম আছে। অটিজম কী আমি জানিনা। তবে আমি একটু কেমন যেন। আমার গাড়ীর চাকা,টেবিল ফ্যান,ছোট ছোট রবারের পুতুল ,রং,তুলি পেন্সিল ভালো লাগে। আমি লাফাতে ভালোবাসি। এ দেয়াল থেকে ও দেয়াল। সব দেয়ালে হাতের চাপ,সব দেয়ালে সর্দি,নাকের পোঁটা লাগে। মা বলে যাতা। আর মোছে। এই শিশুদিবসে বিনায়করুকু গুরুচণ্ডা৯কে ছাপতে দিয়েছে তার ডায়েরির কিছু পাতা, বেড়ানোর গল্প, আর ছবি। বিনায়করুকুর সঙ্গে একটু বেড়িয়ে আসি এদিক ওদিক। ... ...
বাঙালিরা, বিশেষ করে শহর কলকাতার উচ্চ ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত বাঙালি নিজেকে উদার এবং সহিষ্ণু বলে গর্ব অনুভব করে। সেটা খুব একটা মিথ্যেও নয়, কারণ অন্য জাতে বা ধর্মে বিয়ে করার মতো যেসব কান্ড ভারতের অন্যান্য জায়গায়, বিশেষ করে তথাকথিত গোবলয়ের মতো জায়গায় হলে গোলযোগের চূড়ান্ত হত, সেসবও কলকাতায় হামেশাই হয়ে থাকে। এই উদাতার অনেকটাই আসলে বাঙালি নবজাগরণের ফল, যার নেতৃত্বে ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং রাজা রামমোহন রায়ের মতো ব্যক্তিত্বরা| স্বাধীনতা-উত্তর যুগেও বিশেষ করে ৩৪ বছরের নাস্তিক, কমিউনিস্ট শাসনও রাজনীতিতে জাত-পাত যাতে না ঢোকে তার শক্তপোক্ত বন্দোবস্তো করেছিল। কিন্তু, বলাবাহুল্য, অবস্থা চিরকালই এমন ছিল না| উনবিংশ শতকের শুরুতে, কলকাতা যখন টানা পশ্চিমী প্রভাবের আওতায়, তখনও, হিন্দু সমাজ, এমনকি কলকাতার হিন্দু সম্প্রদায়ও ছিল ভয়ংকরভাবে রক্ষণশীল। আর এই সময়েই ঘটেছিল শহরের বৃহত্তম কেচ্ছাটি। কালীপ্রসাদী হাঙ্গামা নামে কুখ্যাত এই কেলেঙ্কারিটির জল গড়িয়ে গিয়েছিল বহুদূর। এতে জড়িয়ে গিয়েছিল শহরের অনেক নামীদামী পরিবার, জল গড়িয়েছিল নানা ধর্মের উপাসনাস্থলে, যার মধ্যে কলকাতার বিখ্যাত হিন্দু মন্দির কালিঘাটও ছিল| ... ...
বাংলায় দুর্গাপুজোর প্রচলনের ইতিহাস বহু পুরনো। মোগল আমল থেকেই। রমেশ শাস্ত্রী মহাশয়ের পরামর্শে রাজশাহী জেলার তাহেরপুরে রাজা কংসনারায়ণ ষোড়শ শতাব্দীতে সাড়ে আট লক্ষ টাকা ব্যয় করে প্রথম শারদীয় দুর্গোৎসবের প্রচলন করেন। পরে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাজশাহী জেলারই ভাদুড়িয়ার রাজা জগৎনারায়ণ প্রায় ন'লক্ষ টাকা ব্যয় করে বাসন্তী দুর্গোৎসব করেন। তারপর থেকে বিভিন্ন হিন্দু রাজা ভুঁইয়ারা এই দুই পুজো আরম্ভ করেন। আস্তে আস্তে শারদীয় দুর্গোৎসব বাংলার গ্রামসমাজের একটা লোকোৎসবে পরিণত হয়। সেই সময়ের যৌথ পরিবারের একটা মিলনোৎসব ছিল এই দুর্গা পুজো। যেখানে যারা যারা থাকত সবাই এসে মিলিত হত এই পুজো উপলক্ষ্য। প্রথমে হত পারিবারিক মিলন সমাবেশ, তারপর গ্রামের সকলেরই সেই পুজোতে সারা পড়ে যেত। প্রত্যেকেই কেউ না কেউ কোনো না কোনো কাজের দায়িত্ব নিয়ে নিত তা পুজো যার বাড়িতেই হোক না কেন। উৎসবের সেই পরিবেশে ওই একটা দিনের জন্য যেন জাতপাতের বাধনটা কিছুটা হলেও শিথিল হয়ে যেত। পরবর্তীতে এই যৌথতা থেকেই বারোয়ারি পুজোর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হয়। ... ...
রঞ্জনরা ফিরে আসার পর বাবুর বাড়ির ছেলে দুপুরে খেতে বসেছে। হ্যাঁ ঠিক, এ একেবারে ধ্রুব যে, জীবনের শেষ সুখাদ্যটি আমি সেদিন রঞ্জনের জননীর হাতে খেয়েছিলাম। অথচ গৃহস্বামীর কী কুণ্ঠা! "এ মানুষে খায় নাকি? এ তো আমরা খাই। এ তুমি কী করিকি খাব গো?" কাদা কাদা ভেজা মাটির ওপর পেতে দেওয়া রঞ্জনের মায়ের পরণের শাড়ির ওপর খেতে বসেছে তিনটি মানুষ। সামনে গালে হাত রঞ্জনের মা। লাল আকাঁড়া ডুমোচালের ফেনাভাত। ঝড়ে ভেঙে পড়া পেঁপেগাছের ডগার কোঁড়ের তরকারি। তেঁতুলফুল পাতার চচ্চড়ি আর ডোবা-ভাসা ধেনো চিংড়ির টক। এই মাত্র খাদ্যতালিকা। চিরজাগরুক অমৃতের জিহ্বাস্নান। স্বাদ কী বস্তু? রন্ধনশৈলী কেমন হলে স্বাদকে জাপটে ধরা যায়? রন্ধন কাকেই বা বলে? ... ...
ভুঁইপটকা ছিল দেওয়ালে বা মেঝেয় ছুঁড়ে মারার জন্য - জোর আওয়াজ। কম্বাশন বাই প্রেশার, অর্থাৎ ভুঁইপটকা আর পেটোর মশলায় তফাৎ ছিলো না কোনো, পুলিশ তাই বেআইনি করে দেয়। এবছরে, আশ্চর্য, আবার সেগুলিকে বাজারে দেখছি, তা প্রায় তিরিশ বছর বাদে। চপেরই মতো, পেটো ইন্ডাস্ট্রিও কি কুটির শিল্প হিসাবে সরকারি তকমা পেলো তাহলে? ... ...
'বেজাতে' বিয়ে বলে নিজ মহল্লায় দামামা বেজেছিল। পাত্র ডাক্তার এই কথাটা কর্পূর হয়ে 'হিন্দু ছেলে' এটাই প্রচার হয়েছিল। তো, এই কালী পুজো নিয়ে আমার এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। কালীমা আমার প্রতিদিনের। ছাত্রজীবন থেকে কলেজ টানা সময় জুড়ে আমায় 'মা কালী' বলে পথে ঘাটে ডেকে দিত কেউ। অবশ্যই পুরুষকণ্ঠ। কখনো পেছন ফিরে দেখিনি। দেখতে নেই এটাই ছিল পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষা। তখন অবশ্য আমি খুব ভয় পেতাম এই ডাকে। লজ্জা হত খুব। কী এমন আছে এই চেহারায়? নিজের মাও মাঝে মাঝে কেঁদে ফেলতেন, আমার পেটের মেয়ে এমন কালো কীকরে?বুঝতাম না এই সমাজে মেয়েদের কেন কালোরঙ হওয়া বারণ ? কেন এত নেগেটিভ? তারপর মাথায় সিঁদুর চড়ানোর পর আমায় কেউ কোনদিন 'মা কালী' বলে ডাকেনি। সিঁদুর ছাড়ার পরও। জানিনা, বিবাহিত মেয়েদের বুঝি সব মাফ। ধীরে ধীরে নিজের গায়ের রং ও চেহারার সঙ্গে কম্ফর্টেবল হয়ে গেলাম। নিজেকেই ভালবেসে ফেললাম। বিয়ের আগেই জানতাম আমার স্বামী কালীভক্ত। বিয়ে রেজেষ্ট্রির আগের দিনই সে নিয়ে যায় আমায় দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি পুজো দিতে। সেখানেই লাইনে দাঁড়িয়ে সে জানায় আমার কাছে তার একটিই দাবি। মন্দিরে তার পাশে দাঁড়িয়ে পুজো দিতে হবে ও প্রসাদ খেতে হবে। তার এই ভক্তি একইভাবে সন্তানের মধ্যে জন্ম নিল । প্রতিদিনই ড্রাইভার অভিযোগ করত মেয়ে স্কুলের পথে যেখানেই মন্দির দেখছে গাড়ীর কাচ নামাতে বলছে। নেমে পড়ে প্রণাম করছে। এরপর আমার নিজের বাড়িতে মেয়ের পছন্দের কালী মায়ের ওয়াল হ্যাঙ্গিং লাগানো হল। তার নিজের পূজা করার জায়গা ক'রে দেওয়া হল। আনা হল লাল কাপড়,ঘণ্টা,কর্পূর, সিদুর,গঙ্গাজল,ধূপকাঠি। কাছের মন্দিরের পুরোহিতের কাছে গিয়ে লিখে আনা হল মন্ত্র। আমার মা এখানেই কখনো কখনো কোরান পাঠ করতেন, নামাজ পড়তেন। আমার বাবা কালীপুজোর জন্য চারটে করে জবাফুল এনে দিতেন বাজার থেকে প্রতিদিন। ... ...
এরপরে এল আমার টিউশনকাল। কালীপুজোর দিন সব ক্লাসই ছুটি থাকত। অতএব পরের দিন থেকে ভাই-ফোঁটা অব্দি ফিরতি পথে চলত আমাদের টো-টো সফর। তবে সমস্যা হল, বারাসত আজও যে কারণে বি(?)খ্যাত, উন্নয়নের মত যেখানে সেখানে দাঁড়ানো মাতাল আর কন্যাশ্রী হারে উড়ে আসা ইভটিজিং, এসবের কল্যাণে মায়ের টেনশন এবং সে চক্করে রাতে প্যান্ডেল ঘোরা প্ল্যান ছিল এক্কেরে নট অ্যালাউড। ... ...
দীপাবলীতে পরিচিতদের বাড়িতে আমন্ত্রিত হয়ে ছাদে কচিকাঁচাদের নিয়ে ফানুশ ওড়াতে ওড়াতে পরিবারের একজন হয়ে যাওয়ার মধ্যে যে প্রাপ্তি, জমিয়ে খাওয়াদাওয়ায় যে আত্মীয়তা, তা ধর্মের উর্ধ্বে অবস্থান করে। ভাতৃদ্বিতীয়ার মঙ্গলফোঁটা যমের দুয়ারে সত্যিই কাঁটা না দেয় কিনা সেই তর্ক উসকে দেওয়া আড্ডায় বসে দেখেছি, এইসব রীতি-রেওয়াজ সামাজিক মেলবন্ধনের জায়গা তৈরী করে দিয়েছে অজান্তেই। অর্থনৈতিক বৈষম্য, ধর্মীয় চিন্তাভাবনার পৃথক অবস্থানের মধ্যেই রুনুরা নিজের বোনের মতো হয়ে উঠেছে। ... ...
রুবির বাঘের নাম শান্তনু। বাঘ যেমন হয়-পেল্লায়, ডোরা কাটা, বিশাল খণ্ড ত ল্যাজ। ভারি বলিষ্ঠ থাবা ঘিরে সাদা নরম রোঁয়া। বিষণ্ণ পোখরাজ চোখ। কানের পিছনে, থাবায় গভীর ক্ষতচিহ্ন। এখন রাত বারোটায় মোড়ের মিষ্টির দোকানের ঝাঁপ বন্ধ - দু ধাপ সিঁড়ির নিচে ভাঙা ফুটপাথ-সেখানে এক ছটাক ঘাসের দখল নিয়ে কাড়াকাড়ি স্ট্রীটলাইট আর জ্যোৎস্নার; দুটো লাল গাড়ি পর পর পার্ক করা। মিত্র সুইটস আর গাড়ির মাঝখানে ঐ জ্যোৎস্নার ওপর হিসি করছিল শান্তনু - আকাশের দিকে মুখ, সামনের দুপায়ে শরীরের সম্পূর্ণ ভর, পিছনের পা ভাঁজ করা এবং লম্বা ল্যাজ মাটির সঙ্গে সমান্তরাল-ওর পিঠের ডোরা এই মুহূর্তের চাঁদের আলোয় সিপিয়া আর সাদা। রুবির হাতে একটা বড় কালো চাদর ভাঁজ করা; সে শান্তনুর পিঠে হাত রেখে সটান দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক দেখছিল। রুবি যেন এক বন্ধ দরজার পাল্লা-যার আড়ালে বসে, প্রকৃতির ডাকে নিশ্চিন্তে সাড়া দিচ্ছিল শান্তনু- ঝাঁঝালো বুনো গন্ধ সিঁড়ির ধাপ বেয়ে পৌঁছোচ্ছিল মিত্র সুইটসের সাইনবোর্ড অবধি, ঘাসের ওপর চাঁদের আলো তরল আর হলুদ হয়ে যাচ্ছিল ক্রমশঃ। ... ...
সে অনেক দিন আগের কথা। বছর ত্রিশ তো হবেই। আমরা থাকতাম ময়মনসিংহ শহরের আমলাপাড়া এলাকায়, তখ্নও সেই শহরে কিছু বাংলো বাড়ি অবশিষ্ট ছিল, তাদের সামনে ছিল মাঠ, পেছনে বাগান, বড় আঙ্গিনা বা পুকুর। আমরা যে বাড়িতে ভাড়া থাকতাম সে বাড়িটা ছিল দোতলা, পুরনো জমিদার বাড়ি, সামনে প্রায় বিঘাখানেক ফাঁকা জমি। ঐ শহরে অ্যাপার্টমেন্ট বা ফ্ল্যাটবাড়ির ধারণা তখনও আসে নি, কিন্তু আমাদের বাড়িতে তিনটে পরিবার ভাড়া থাকত। ওপরে একটি, নিচে দুটি। বাড়িওয়ালা এমনভাবে নিচের তলাটি ভাগ করে দিয়েছিলেন যাতে অন্য অংশটির ভাড়াটেদের দেখা না যায়। বাড়ির সামনে একদিকে একটা বড় আম গাছ, অন্যদিকে গাঁদা আর জবার ছোট বাগান। তারকানাথ রায় রোড থেকে শুরু করে ঘাসের মধ্যে দিয়ে পায়ে চলা পথটা একটা ছোট সিঁড়ির তিন চারটা ধাপ বেয়ে উঠে এসেছে নিচু বারান্দায়। ... ...
রুমিকে শেখাই। দুজনে খেতে এলে মুখোমুখি বসতে হয়। কার্টেসি। এসেই ধপ করে পাশে বসে পড়ছিলো। যা যা বলি, যে সিকোয়েন্স-এ খেতে বলি, রুমি মন দিয়ে শোনে। আমার ওকে নতুন করে তোলার ইচ্ছেটাকে বুঝেই যেন শুষে নেয়। একটুও যেন বাদ না যায়, এমন অতন্দ্র হয়ে শোনে। ... ...
স্যার, এইবার আমি আমার পিতার কথা বলব, আমার মনে হচ্ছে যে মানুষের জীবনের সাথে তার পিতার জীবন জড়িত, ফলে আমার বিষয়ে বলতে গেলে আমার পিতার কথা আসবে, আমার বিষয়ে বুঝতে আমার পিতার বিষয়ে বুঝতে হবে। আপনি কি মনে করেন এই ব্যাপারে? বলব কি স্যার? হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলুন। আমার পিতার নাম ছিল আরশাদ মিয়া। তবে লোকে তাকে ডাকত কাবিল কবিরাজ নামে। তিন গ্রাম গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়াইতেন আর অনেক অনেক লতাপাতা সংগ্রহ করতেন। আর আমাদের বাড়ির পাশে ছিল সামান্য ধান্য ক্ষেত। সেখানে চাষবাসও করতেন অল্প অল্প। আচ্ছা এই মুহুর্তে, এই ধান্য জমির কথা স্মরণে আসায় আমার দাদাজির কথা মনে হলো আমার। তিনি আমার পিতার পিতা। ফলে তিনিও আমার সাথে সংযুক্ত, তাই ধান্য জমি সংশ্লিষ্ট অদ্ভুত ঘটনাটি আমার বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, বলব কি স্যার? ওকে বলুন। ... ...
বিরতির সময় পলাশের সাথে দুই সেকশনের কয়েক জন খেলোয়ারের মধ্যে কী কথা হয়েছে সেটা হারাধন জানে না। কিন্তু খেলা আবার শুরু হবার পর থেকে দেখা গেলো বল বার বার তার প্রান্তে চেপে আসছে। হারাধন প্রাণপনে বল ফেরাতে থাকে। একপর্যায়ে বলের দখল নিয়ে সৃষ্ট এক জটলায় কেউ একজন হারাধনকে খুব জোরে ধাক্কা মারে। তাল সামলাতে না পেরে সে পড়ে যেতে হঠাৎ কে যেন তার বাঁ হাতের উপর লাফিয়ে পড়ে। সেটা কি সেকশন-এ’র মোটকা সাদমান নাকি সেকশন-বি’র বখা বাদল সেটা বোঝা যায় না, তবে হারাধনের কবজিতে কড়াৎ করে একটা শব্দ হয়। তারপর তীব্র ব্যথায় তার আর কিছু মনে থাকে না। ... ...
“এই দ্যাখ, এমনি করে ক্যাপটা দু আঙ্গুলে ধরে দেয়ালে চট করে ঘষে দে” - চাপা একটা ফট শব্দ -মেয়েটা ভুরু কুঁচকে ধোঁয়ার রেশটা তাকিয়ে তাকিয়ে দ্যাখে। ... চেষ্টা করি? যদি আঙ্গুলে ছ্যাঁকা লাগে? না থাক বাবা ... উল্টে সে মাটিতে ক্যাপের রোলটা ফেলে হাওয়াই চটি দিয়ে পিষে দেয়, বারুদের আওয়াজ টা আরও চেপে গিয়ে কিরম ম্যাদামারা মত শোনায়। মরুক গে যাক! নতুন ক্যাপ বন্দুকটা কিনেছে কি করতে, সেই যদি হাতে-পায়ে করে ফাটাবে? গেলবার সেই যে বাপির সাথে বন্দুক কেনা নিয়ে দারুণ ঝগড়া হল- বলে কি না পুরনোটাতে তেল দিয়ে দিচ্ছি, ওটাই ফাটা! পুজোয় নতুন জামা পরে পুরনো ক্যাপ বন্দুক? এ আবার কেমনধারা কথা! বাপির মনখারাপ করছে বুঝতে পেরেও জেদ করে কথা বলেনি দু-দিন। তারপর তো সেই জ্যেঠু আর বড়দাদার হাত ধরে গিয়ে দোকান থেকে পছন্দ করে নতুন বন্দুক কেনা হল। ... ...
বজ্রডঙ্কুশ বা উদংষ্টিট্টিভ। এর মানে কী? শশীশেখর তাঁর ছেলের নাম রেখেছিলেন মৃগাঙ্কভূষণ। স্কুলে একদিন ছাত্রের মুখে বাবার নাম শুনে শিক্ষক বললেন,‘সেকী! শশীশেখরের ছেলের নাম মৃগাঙ্কভূষণ কেন? বাবাকে বল নাম বদলে মৃগাঙ্কশেখর করে দিতে। ছেলে বাবাকে বাড়ি ফিরে সেকথা বলতে শশীশেখরের জবাব, ‘মাস্টারকে বলিস আমার ছেলের নাম আমি বজ্রডঙ্কুশ রাখব না উদংষ্টিট্টিভ রাখব, তাতে মাস্টারের কী। এরকমই নতুন শব্দ সুকুমার রায়ের হিজবিজবিজ, কুমড়োপটাশ, কাঁকড়ামতী নদী বা ল্যাগব্যাগর্নিস পাখি। এরা কেউ বাস্তবে নেই, কিন্তু নাম থেকেই এদের কী কোনও ছবি মনে আসে? বা সুকুমার এই সব চরিত্রের চেহারার যে বর্ণনা লিখে গেছেন, মনে হয় নাকি, সেসব এক্কেবারে সঠিক! শব্দের এটাই শক্তি, এটাই জোর। ... ...
ফুচকার জন্মরহস্য কেউ জানে না। এমনকি তা জানতে কারুর সেরকম আগ্রহও দেখিনা। সাবেকি ফুচকার তিনটি বাসস্থান। বম্বে, থুড়ি মুম্বাইতে তার নাম পানিপুরি, দিল্লিতে গোলগাপ্পা আর কলকাতায় ফুচকা। পানিপুরি নামটি সমগ্রতই ব্যাকরণসম্মত। যে পুরির ভেতর পানি থাকে - এরকম ব্যাসবাক্য করলে স্বয়ং পাণিনিও বোধহয় রুষ্ট হতেন না। গোলগাপ্পা অন্ততঃ আধা ব্যাকরণসম্মত। আকারে এটি গোলই বটে। গাপ্পার ব্যাকরণগত ব্যুৎপত্তির হদিশ আমার কাছে নেই। কিন্তু ফুচকা? কোন মানেই হয়না। ব্যাকরণপরীক্ষায় ফুচকা ডাহা ফেল। এমনকি মার্কেটিঙেও। গুগুল বাজার গরম করার আগে জ্ঞানসমুদ্রে যার কদর ছিল রাশভারী জ্যাঠামশাইয়ে, সেই এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার অনলাইনে চাটের এন্ট্রিতে গোলগাপ্পা ও পানিপুরির উল্লখ থাকলেও ফুচকার নেই। এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে মমতা ব্যানার্জি থেকে আমরা বাঙালি - সবাইকার যে গর্জে ওঠা উচিত, সে ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করি। ... ...
মাথায় কাপড়ের মস্ত গাঁঠরি, তাতে শুধু গোলাপি নয় আছে কতো বান্ডিল বান্ডিল নানা রঙের জামাকাপড় । সে হল আমাদের বিমলা আন্টি । আমি আন্টি বলি, বলতে ভালো লাগে । বিমলা আন্টি আমাদের পাড়ার ধোপানি । ওর একটা খিটকেল বর আছে, রামস্বরূপ। কোন জামাকাপড় তাড়াতাড়ি ইস্ত্রি করতে হলে রামস্বরূপকে ফোন করতে হয় । সে বলে এখখুনি নিয়ে আসছি । আমি বলি বিমলা আন্টি আসবে? তাকেই পাঠাও না কেন? তোমার ওই হাঁড়িচাচার মতো মুখটা কি না দেখলেই নয়? বিমলা আন্টি এসেই তার গুছিয়ে পরা কোটা শাড়ির ঘোমটা একটু টেনে গলা তুলে বলে, কাপড়া । তারপর গাঁঠরি খুলে বলে, গিনলো। আবার নতুন কাপড় দেওয়া শুরু হয়। এবার টাকা দেবার পালা । আমি ফস করে বলে বসি, তুমি কী সুন্দর দেখতে, বিমলা আন্টি । মাথা নিচু করে টাকা গুনছে বিমলা আন্টি । আমার এই কথায় তার নিচু চোখের পাতা,বসা গাল ,টিকলো নাক, গর্বিত চিবুক, কোথাও এতটুকু পরিবর্তন দেখতে পাই না । চোখ দুটো তুলে বলে, সত্তর রুপিয়া, ইয়ে লো তিস রুপিয়া ওয়াপস । ... ...
অণুগল্প ... ...
দেখুন দাদা, ওঁর প্রথম বইটির জন্যই উনি বাংলা সাহিত্যে থেকে যাবেন, খুব ইমপরট্যান্ট লেখক। অচিন এবার কোনো মন্তব্য করল না। প্রথম বই আসলে দ্বিতীয়। তার আগের পুস্তিকায় ছিল দুটি গল্প। পুস্তিকার গল্প দুটির কথা কি জানে শুভ্রাংশু? গল্পদুটির কথা মনে পড়ল অচিনের। ত্র্যস্ত নীলিমা এবং শবযাত্রা। পুস্তিকাটি হাতে হাতে ঘুরেছিল। তারাই পুস্তিকা প্রকাশের খরচ দিয়েছিল। কী আবেগ সেই সময়! কতকাল আগের কথা। কিন্তু এখন মনে হয় ওসব ছেলেখেলা। কম বয়সের অপরিণত চিন্তা। পৃথিবীতে দুঃখ, কষ্ট, কখনো দূর হয়েছে ? দারিদ্র সভ্যতার সঙ্গে আছে। সেই পশুপালনের যুগ থেকেই তার আরম্ভ। গুহামানবের ভিতরে হয়তো সাম্য ছিল। সবই নানা ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন মহাজ্ঞানীরা। তারপর সব যেমন ছিল তেমনি আছে। দীপেন কী এমন গল্প লিখেছিল ! তারপর কী করতে পারল, কিছুই না। ... ...
এলারামের ঘড়িকে রবীন্দ্রনাথ অমর করে রেখে গেছেন। ঘড়িটি না বাজা পর্যন্ত সুখশয্যা ত্যাগ করতে কর্তাবাবুর ঘোরতর আপত্তি ছিল, এমনকি ঘরে আগুন লাগলেও না! কিন্তু আমাদের মহারানীমাতার আপাতত সমস্যা হল, ঘড়ি বেজে, বেজে, বেজে কেলান্ত হয়ে থেমে গেলেও গোবুরাজা, বড়কুমার বা ছোটকুমার কেউই নয়নপদ্ম উন্মীলন করার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করেন না, এমনকি গোবুরাজার নাক যেমন ইমন রাগ ও কাহারবা তালে খরবায়ু বয় বেগের সুরে ডাকছিল, তেমনই ডাকে, ডেকেই যায়, সেই অসাধারণ গীত যে সারাদিনে থামবে তার কোন লক্ষণ দেখা যায় না। গোবুমহারাজ ও কেবলীরানীর সঙ্গে গুরুর অনেক পাঠিকা ও পাঠকরা পূর্ব পরিচিত। তাঁদের অবগতির জন্য বলি, এনারা আর সেই সংসার অনভিজ্ঞ যুবক যুবতী নেই। দিল্লিতে এঁরা মোটামুটি একটি সংসার পেতে বসেছেন। বন্ধুবান্ধবরা অবশ্য সর্বদাই এই সাধের ফেলাটটিকে রেলওয়ে প্লাটফর্মের সঙ্গে তুলনা করে থাকেন, তাতে মহারাজ বা রানীমা কারো কিছুই এসে যায় না।চতুর্দিকে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত বই, বই এবং আরো বই, দুটি নয়নতারা, একটি কাঁঠালিচাঁপা ও সাতটি নাম না জানা গাছ, বড়কুমার ও ছোটকুমারের অজস্র ভাঙা খেলনা, একটি ছোট খাওয়ার টেবিল,বেতের সোফা ইত্যাদি নিয়ে তাঁরা দিব্যি আছেন। ... ...