‘এই বয়সেই মানুষ মারা শুরু করেছিস? সারেঙ্গায় খুনটা কে করেছে?’ এসডিপিও মির্জা’র প্রশ্নে কিছু বলে না সিংরাই। সে জানে সারেঙ্গায় সিপিএম নেতা খুন হয়েছে, কিন্তু সেটা এমসিসি নয়, করেছে জনযুদ্ধ। কিন্তু তা বলল না সে, চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। ‘তুই নাকি এখানে কাজের খোঁজে এসেছিস, তা কী কাজ করবি এখানে?’ কথা বলতে বলতেই চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায় এসডিপিও। এবারও চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে সিংরাই। ‘হাতের আঙুলগুলো টেবিলের ওপর পেতে রাখ।’ একটুও না নড়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে সিংরাই। ‘কী হল, হাতটা রাখ টেবিলে,’ চিৎকার করে ওঠে খাতরার এসডিপি। ভয়ে ভয়ে বাঁ হাতটা এগিয়ে হাতের চেটোটা ওপর দিকে করে টেবিলের ওপর রাখে সিংরাই। টেবিলের পাশে দাঁড় করানো লাঠিটা নিয়ে কালো টি শার্ট, নীল জিন্স এগিয়ে আসে। ওর হাতের পাতাটা উল্টে দেয়, তারপর লাঠিটা রাখে সিংরাইয়ের আঙুল চারটের ওপর। সিংরাই কিছু বুঝে ওঠার আগেই সিংরাইয়ের কড়ে আঙুলটা উল্টে দেয় জোরে। মট করে একটা আওয়াজ হয় শুধু, পাট কাঠির মতো ভেঙে যায় সরু কড়ে আঙুলটা। আঃ করে চিৎকার করে ওঠে সিংরাই, যন্ত্রণাটা ছড়িয়ে পড়ে গোটা হাতে, হাত থেকে শরীরে। হাতটা সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না। লাঠিটা শক্ত করে সিংরাইয়ের আঙুলের ওপর চেপে রেখেছে মির্জা। চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে আসে সিংরাইয়ের। ... ...
‘দিনের বেলা ঘর থেকে বেশি বেরনোর দরকার নেই, এদিকে হাওয়া ভালো না।’ মনোহরের কথায় চুপ করে থাকে সিংরাই। কাল রাতে ঘরে ঢোকার পর ধনঞ্জয় কাকাও একই কথা বলেছে। মাঝে মাঝেই সিপিএমের লোকজন নানা অছিলায় গ্রামে ঘুরছে, খোঁজ নিচ্ছে কারও ঘরে বাইরের কেউ এসে থাকছে কিনা। কারও বাড়িতে আত্মীয়স্বজন এলে তারা কোথা থেকে এসেছে, কেমন আত্মীয়, নানা খোঁজ নিচ্ছে সিপিএমের লোকজন। মাস ছয়েক ধরে এই ব্যাপারটা শুরু হয়েছে। বিনপুর, রানিবাঁধ, খাতরায় এমসিসি’র আর গোয়ালতোড়, সারেঙ্গায় পিপলস ওয়্যার গ্রুপ বা জনযুদ্ধের গতিবিধি যত বাড়ছে, সংগঠন যত বাড়ছে ততই গ্রামে নজরদারি বৃদ্ধি করছে সিপিএম। ... ...
এতদিন ধরে যে দিনের জন্য অপেক্ষা করছিল, তা যখন সত্যিই এসে হাজির হয়েছে তখন এক অদ্ভুত অনুভূতি হয় সিংরাইয়ের। বাবা-মা’র মাঠ থেকে ফিরতে প্রায় তিনটে বেজে যাবে। বাড়ি ছাড়ার সময় ওদের সঙ্গে দেখা হবে না, প্রথম যখন ভাবনাটা মাথায় আসে মুহূর্তের জন্য একটু খারাপ লাগে সদ্য কৈশোরে পা রাখা ছেলেটার। কিন্তু তারপরই ওর মনে হয়, এর জন্য তো মানসিক প্রস্তুতি সে অনেকদিন ধরেই নিচ্ছে। আজ না হয় কাল তো চলেই যেত বনমালীর সঙ্গে। আজ যে বাড়ি ছাড়ার সময় দেখা হচ্ছে না বাবা-মা’র সঙ্গে তাতে কীই বা এসে যায়! বাড়ি ছাড়ার সময় দেখা হলেই বা কী এসে যেত! ... ...
তাকে থামিয়ে সুভাষ মাহাতো বলে ওঠে, ‘একটা কথা বলুন তো, এই এলাকার কথা উঠলেই আপনারা মাওবাদী সমস্যা বলেন কেন? মানুষের সমস্যা আছে বলেই তো মাওবাদী আছে। মাওবাদীরা সমস্যা হবে কেন?’ সুভাষ মাহাতোর প্রশ্নে থতমত খেয়ে যায় অরিন্দম। কিছু একটা বলার চেষ্টা করতে গিয়েও থেমে যায়, চুপ করে থাকে। ফের বলে ওঠে সুভাষ মাহাতো, ‘আসলে আপনাদের দোষ নেই, সরকার সব সময় বলে মাওবাদী সমস্যা, মাওবাদী সমস্যা, মিডিয়াও বলছে মাওবাদী সমস্যা। আপনারা মানুষের সঙ্গে কথা বলে দেখুন, মানুষ মাওবাদীদের সমস্যা বলে মনে করে কিনা। যেদিন মানুষ মাওবাদীদের সমস্যা বলে মনে করবে, সেদিন সরকার, পুলিশ কিছু লাগবে না, খুন, সন্ত্রাস এমনিই থেমে যাবে। কিন্তু মানুষ যদি মাওবাদীদের সমস্যা বলে মনে না করে, তবে পুলিশ দিয়ে সরকার কিছু থামাতে পারবে না।’ ... ...
এরপর প্রায় এক মাস ধরে এই পরিবারগুলো কীভাবে আবার নিজেদের ঘর মেরামত করল, এই শীতের দিনে কীভাবে নিজেদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরল সেই ঘটনা পুরো জানতে গেলে আজ কিছুক্ষণ আগে সহদেব সিংহ সর্দারের বাড়িতে যে মিটিং শুরু হয়েছে তা শেষ হয়ে যাবে। তাই এক মাস আগের ঘটনা ছেড়ে এবার আমাদের দ্রুত ফিরতে হবে বাঁশলাটা গ্রামে। এক মাসের পথ পেরোতে হবে এক নিমেষে। কারণ, এই মিটিংয়ে কী সিদ্ধান্ত হল তা জানা না গেলে বোঝা যাবে না ঠিক কবে, কীভাবে চাকাডোবার এই শান্ত আদিবাসী গ্রামে পা ফেলল মাওয়িস্ট কমিউনিস্ট সেন্টার বা এমসিসি। ... ...
কার ক্ষতি হল, কতটা? ক্ষতিপূরণে কার লাভ হবে? কতটা? ... ...
এই গরিব মানুষ যখন নিজের জমিতে, নিজের খাটনিতে ফলন হওয়া ফসল কেটে নিজের বাড়িতে নিয়ে যায়, তখন তাকে চুরি বলে না। তাকে বলে বড়লোকের দখল করে রাখা সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা, যা কাল রাতে এখানকার মানুষ করেছে। ... ...
‘তুমি বাজেয়াপ্ত শব্দের মানে জান?’ প্রশ্নটা করে লোকটা সোজা তাকিয়ে আছে তার দিকে, চোখ নামাতে পারল না সিংরাই। আশপাশে বসে থাকা সাত-আটজন পুরো চুপ, কারও মুখে কোনও কথা নেই। কিন্তু সিংরাই কী জবাব দেবে এই প্রশ্নের, শব্দটাই শোনেনি সে কোনও দিন। ... ...
পূর্বপুরুষের কৃত অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত কি এভাবে করা যায়? নাকি সবটাই স্বপ্ন? ... ...
বীরেন শা'য়ের বাড়ীর দুইঘর ভাড়াটে নাকি গিয়ে সাতুদের দোতলায় উঠেছে। এদিকে দাদুদের গোয়ালঘরেও ভালই জল উঠেছে, প্রথমদিন তো লালি আর আকাইম্যা সারাদিনরাত দাঁড়িয়ে রইল। পরেরদিন ভোররাতে লালি কেমন অদ্ভুত আওয়াজ করে ডাকতে লাগল। তখন দাদু গিয়ে ওদের দড়ি ধরে এনে দাদুদের দিকের ভেতরের বারান্দায় তুলল। সে বেচারাদের কি ভয় সিঁড়ি দিয়ে উঠতে, অর্ধেক সিঁড়ি তো জলে ডোবা, তড়বড় করে আসতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে আকাইম্যা একেবারে দাঁড়িয়ে গেল শক্ত হয়ে, কিছুতেই নড়েচড়ে না। দাদু শেষে ওকে পাঁজাকোলা করে বারান্দায় তুলে দিল। লালি বেচারীর শিগগিরই বাছুর হবে, পেটটা ফুলে একেবারে ঝুলে গেছে, প্রায় মাটি ছুঁইছুঁই। খুব কষ্ট করে বারান্দায় উঠল। বারান্দার কোণায় ছোট গামলা করে ওদের জাবনা দেবার ব্যবস্থা হল। লালি উঠেই সেই যে বসে পড়ল, সারাদিনে আর উঠে দাঁড়াল না। শেষে দাদু আর দিদা সন্ধ্যের আগে অনেকক্ষণ ধরে ছোবড়ার আগুন জ্বালিয়ে লালিকে সেঁক দেওয়ার পরে বেচারী একটু ধাতস্থ হয়ে জাবনায় মুখ দেয়। পরেরদিনটাও লালিরা বারান্দায়ই রইল, তার পরের দিন জল অনেক নেমে গেল; উঠোনে আধহাঁটু, গোয়ালে গোড়ালি ভেজে কি ভেজে না। লালি আর আকাইম্যা আবার গোয়ালে ফেরত গেল। বারান্দায় দুই বোতল ফিনাইল ঢেলে ধোয়া শুরু করল বড়মামীমা। লালির জন্য গোয়ালে একটা ভাঙা দরজা পেতে দেওয়া হল, যাতে শুকনো জায়গায় বসতে পারে। পাড়া থেকে কারা যেন জিটিরোডে গিয়ে ইলেকট্রিক অফিসে খবর দিয়ে এল। এই সময় শুরু হল উঠোনে মাছের আনাগোণা। এদিকে শ্রীপল্লীর মাঠের পেছনের অংশের পুকুরটা ভেসেছে, ওদিকে শ্রীদুর্গা মিলের পুকুর। এই শিউলি গাছের গোড়া বাটামাছের ঝাঁক তো নারকেল গাছের গোড়ায় কইমাছ কানে হাঁটছে। বাবু, সুবীর, রতন, বুম্বারা ছেঁড়া মশারি, গামছা আর মাটির হাঁড়ি নিয়ে হইহই করে সারাপাড়া জুড়ে মাছ ধরে বেড়াচ্ছে। বুড়ীর মা মাসি আজ কাজে এসেছে, পেয়ারাগাছের সামনে থেকে খপ করে একটা মাঝারি সাইজের শোলমাছ ধরে ফেলল। বড়মামীমা মাছ কাটতে কাটতে মা'কে বলে 'কালিয়া করব, ওদের জন্য দেব, আগেভাগেই ওদের ভাত খাইয়ে দিস না দিদি।' ভাই শুনতে পেয়ে মুখ বেজার করে, ও মাছ খেতে একদম ভালবাসে না। ছবিমাসি দিদাকে বলে ‘মাসিমা আফনে রান্ধেন, আফনের রান্ধা কালিয়ার সোয়াদ মুহঅ লাইগ্যা থাহে।' দিদা হাসিহাসিমুখে বলে ‘হ বৌমা তুমি অন্যটি দ্যাহ, মাছটা আমি দেখ্তাসি।' ... ...
সওয়ারী সাইকিল কি ... ...
গণিতের সঙ্গে লেখকের প্রেম ও অপ্রেমের এক বর্ণময় ব্যক্তিগত আখ্যান — যার পর্বে পর্বে উন্মোচিত হবে হাজারো জিজ্ঞাসা, ফিরে ফিরে আসবে নানান স্মৃতিভার। সুপাঠ্য ঝরঝরে ভাষায় গণিতের আলো-আঁধারি পথে এ এক নতুন পদচারণার অভিজ্ঞতা। ... ...
হাইস্কুলের মণীষাদি খুবই মারকুটে ছিলেন, তিনিও আর বেত মারেন না, তবে অদ্ভুত অপমানজক শাস্তি উদ্ভাবনে এঁর দক্ষতা ছিল অপরিসীম। ক্লাসে কথা বলায় দুজনকে দোতলার বারান্দায় নিয়ে একে অপরের কান ধরে দাঁড় করিয়ে দেওয়া ও পাশে মিনুদিকে পাহারাদার হিসাবে বসিয়ে রাখা, অঙ্ক না পারলে জুতো হাতে নিয়ে ক্লাসের বাইরে দাঁড় করিয়ে দেওয়া, দুজন ছাত্রীর মধ্যে ঝগড়া ও মারামারির অভিযোগ পেয়ে নিজের নিজের জুতো দিয়ে একে অপরের গালে মারতে বাধ্য করা ইত্যাদি ছিল তাঁর উদ্ভাবন। ... ...
বনমালী দেশোয়ালিরা জানে, জল, হাওয়া পেলে পাথরেও গাছ জন্মায়, আর এখানে তো উর্বর জমি প্রস্তুত! জল, হাওয়াও আছে যথেষ্টই, শুধু সলতে পাকানোর কেউ ছিল না এতদিন। সেই শূন্যস্থানও পূরণ হয়ে যেতেই জঙ্গলমহলে গ্রামের পর গ্রামে মানুষ সাড়া দিতে শুরু করল। যদিও লোকসভা নির্বাচনের প্রস্তুতির জন্য সেদিকে আর বিশেষ নজর দেওয়ার সময় পেল না পুলিশ প্রশাসন। ... ...
কোন কোন সময় আমাদের সমাজ কী মুখোসে মুখ ঢাকে না? ... ...
ঝাড়গ্রামের বিভিন্ন গ্রামে ২০০৩-২০০৪ সালের পর থেকে মাওবাদী আন্দোলনের যে প্রভাব, তার বীজ তো নিশ্চয় পোঁতা হয়েছিল তার অনেক আগে কোনও না কোনও দিন। যদিও ঠিক কবে তা অরিন্দম জানে না। কিন্তু একটা জায়গার আর্থিক পরিস্থিতি ঠিক কেমন হলে সেখানে এই ধরনের বীজ শত পুষ্পে বিকশিত হয় তাও অরিন্দমের পুরোপুরি জানা নেই। আজ ঘটনাটা শোনার পর থেকে ওর বারবারই মনে হচ্ছে, এই যে একটা এলাকার একটা বছর দশেকের ছেলে আপেল চেনে না, তা কি সেখানকার আর্থিক অবস্থার বা মাওবাদী আন্দোলনের বিকশিত হওয়ার একটা সূচক হতে পারে! ... ...
সমাজ সংসার মিছে সব... মিছে এ জীবনের কলরব? ... ...
সমাজ সংসার তবে কি সত্যিই মিছে...? ... ...