ফিরিয়ে আনলুম 'আবার এসেছি ফিরে' পত্রিকার সম্পাদক মশায়কে যিনি করোনায় মারা গেছেন ... ...
শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের প্রেমের কবিতাগুলোর কেন্দ্রে যে যুবতী ... ...
মামা শুধু গল্প বলত এমন না। মামা গল্প বলার সময় তা পরিবেশন করত। চোখ, মুখ, হাত পা, কণ্ঠস্বর সব মিলিয়ে গল্প বলত মামা। ক্লাইম্যাক্সে যাওয়ার আগে থামত চোদ্দবার, আরও কয়েক দিক থেকে গল্পটা বুঝাত, পরিস্থিতিটা বর্ণনা করতেন, যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি পরিষ্কার না হচ্ছেন যে আমরা পুরোপুরি বুঝছি কী পরিস্থিতি ছিল সেই সময়, অন্ধকার কত গাঢ় ছিল, বাতাস কেমন ছিল, উনার ঠিক কত সামনে ঘন কালো পাহাড়ের মত কী জানি একটা দাঁড়িয়ে আছে, ওইটা দেখে উনি তাৎক্ষনিক কী চিন্তা করলেন, তারপর কী করলেন ইত্যাদি ইত্যাদি তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে বর্ণনা করে, হাত নেড়ে, গলার স্বর উঠিয়ে নামিয়ে আমাদেরকে পরিষ্কার বুঝিয়ে দেওয়ার পরে তিনি যেতেন পরের ধাপে। এরপরে কী হইল শোনো...! ... ...
সেবারে ইংল্যান্ড এসে প্রশান্ত মহলানবীশ গেলেন রামানুজনের সাথে দেখা করতে কেমব্রীজে, তখন ১৯১৯ সালের শেষদিক। রামানুজনের স্বাস্থ্য তখন ভেঙে পড়েছে – শরীর খুব একটা সুবিধার নয়। পরের বছরেই মারা যাবেন তিনি। কিন্তু অঙ্ক নিয়ে মেতে থাকলেই তিনি ভালো থাকেন বলে ডাক্তারে সেই নিয়ে আর নিষেধ করেন নি। প্রশান্ত মহালনবিশও ভাবলেন হাওড়া ব্রীজের সমস্যাটা শুনিয়ে যদি রামানুজন-কে চিয়ার আপ করা যায় একটু। খুব মন দিয়ে শুনলেন ব্যাপারটা রামানুজন – বললেন, “আমাকে দুদিন সময় দাও প্রশান্ত। খুবই ইন্টারেষ্টিং এটা”। ... ...
সেদিনের অনুষ্ঠানে শচীন দেব গান গাইতে উঠলেন। রবি বাবুর ততক্ষণে চলে যাবার কথা, আর শচীন দেব সরাসরি গ্রীন রুম থেকে এলেন বলে তিনি আর খেয়াল করেন নি শ্রোতাদের মধ্যে রবি ঠাকুর বসে আছেন। গান শুরু হল – শচীন দেব সেদিন গাইলেন ঠুমরি। সেই কি গাইলেন – পুরো অনুষ্ঠান শেষ হলে শচীন দেব পেয়েছিলেন গোল্ড মেডেল। রবি বাবু খুব মন দিয়ে গান শুনছিলেন – মজে গিয়েছিলেন, একসময় জিজ্ঞেস করলেন, " হ্যাঁরে, দিনু, ছেলেটা কে রে? ভারী সুন্দর গাইছে তো।" ... ...
সেই হিসেবে দেখলে সুভাষ শেষ দিন পর্যন্ত মোটামুটি ফিট ছিলেন গড়পড়তা বাঙালির থেকে। তার পিছনেও ছিল বিধান রায়ের তৈরী করে দেওয়া ডায়াট চার্ট। বিধান রায় বুঝিয়েছিলেন যে সুভাষ যদি ওই সেনার পোষাক পরে ইমেজ গড়ে তুলতে চান, তাহলে নিজের ভুঁড়ির ব্যাপারটা কন্ট্রোলে রাখতে হবে। কারণ ভুঁড়িওলা যুদ্ধ সেনা প্রধান খুব এক দৃশ্য সুখকর নয়। বিধে-দার সেই পরামর্শ মেনে চলেছিলেন আজীবন সুভাষ। কেবল সেবারে এমিলি-র সাথে বিয়ের পর অষ্ট্রিয়াতে যে দুই মাস ছুটি কাটিয়ে এলেন তখন বেশ খানিকটা ওজন বেড়ে গিয়েছিল। ... ...
সত্যেন বোসের এস্রাজ শুনে বাবা খুব খুব খুশী। বললেন, “তুমি আমার সাথে মাইহার চলে আইসো। শিখাবো যত্ন করে”। সত্যেন বোস বললেন, একটু ভেবে জানাবেন। এবার এই খবর কি করে যে রবীন্দ্রনাথের কানে চলে যায়। সত্যেন বোসের মতন ছেলে বিজ্ঞান চর্চা ছেড়ে সংগীত চলে যাবে পুরোপুরি, এটা তাঁর কেমন যেন লাগলো। জগদীশের কাছে তিনি শুনেছিলেন যে সত্যেনের ভিতরে পোটেনশিয়াল কি রকম। আর সত্যেন যত ভালোই এস্রাজ বাজান না কেন, তার থেকেও বেশী ভালো অঙ্ক আর ফিজিক্স করতেন। রবি ঠাকুর তাই সরাসরি বাবা আলাউদ্দিনের সাথে দেখা করে সব খুলে বললেন, "দেখুন আপনি হয়ত সত্যেনের থেকে আরো ভালো সংগীতের ছাত্র খুঁজে পাবেন, কিন্তু ওর থেকে ভালো বিজ্ঞানী এই বাংলা হয়ত পাবে না" ... ...
১৯১২ সালে তৃতীয় বারের জন্য ইংল্যান্ড যান প্রফুল্ল রায়। এডিনবাবা ইউনিভার্সিটি-তে কি সব সেমিনার এবং আলোচনা ছিল। সেদিন কাজ শেষ করে বেরিয়ে খুব চা তেষ্টা পেয়ে গেল প্রফুল্ল রায়ের। এডিনবারাতে শুধু চায়ের দোকান পাওয়া খুব চাপের – সামনের এক বার-এ ঢুকে জিজ্ঞেস করলেন সেখানে কফি সার্ভ করে কিনা ওরা। হ্যাঁ বললে, তিনি তখন জিজ্ঞেস করলেন কফি পাওয়া গেলে, চা-ও পাওয়া যাবে কিনা? ইংল্যান্ডে তখন চা পান বেশ বেশ জনপ্রিয় হয়ে গেছে। প্রফুল্ল রায়কে অবাক করে এই পাব মালিক বলল চা পাওয়া যাবে। পাবে বসে প্রফুল্ল রায় তাঁর ব্যাগ থেকে বের করলেন ড্যানিয়্যাল অলিভারের ১৮৬৯ সালে লেখা বই “ফার্ষ্ট বুক অফ ইন্ডিয়ান বোটানি” – কারণ তিনি তখন হাত দিয়েছেন ভারতীয় ভেষজ ইত্যাদি নিয়ে কিছু গবেষণায়। একমনে পড়তে পড়তে চা-য়ে চুমুক দিচ্ছেন, এমন সময় শুনলেন এক সাহেব জিজ্ঞেস করছে, “উড ইউ মাইন্ড ইফ আই জয়েন ইউ”। ... ...
তখন দক্ষিণ কোলকাতায় একটা বড় ক্লাবের প্রথম শীতের সময়ে ফাংশন। অনেকের সাথে টেক্কা দেবার চেষ্টা এদের – কিন্তু পয়সা থাকলেই তো হবে না, বনেদীয়ানা দেখাতে হলে ভালো শিল্পী-কে এনে আর্ট-কালচার লাইনে নাক গলাতে হবে। এই ক্লাবের একজনের সাথে হেমন্ত মুখার্জী-র চেনাশুনা। সেই ভদ্রলোক গিয়ে হেমন্ত-বাবুকে ধরলেন – বোম্বে থেকে লতা-দিদিকে বলে কয়ে আনতেই হবে ফাংশনে। হেমন্ত বাবু আবার এমন অনুরোধ ফেলতে পারেন না। লতাকে ফাংশানে আনবেন বলে কথা দিলেন। ... ...
সেদিন খুব ভোর ভোর সৌমিত্র হাজির হলেন উত্তমকুমারের বাড়ি। সেখান থেকে দুজনে গড়ের মাঠে যাবেন উত্তমকুমারের গাড়িতে করে। এমনটাই চলছিল বেশ কয়েকদিন। এমনিতে উত্তমকুমার আর সৌমিত্র দুইজনাই একদম সাহেবী টাইম মেনটেন করতে ভালোবাসেন। সৌমিত্র পৌঁছালে দুজনে এককাপ করে চা খেয়েই বেড়িয়ে যেতেন গাড়ি নিয়ে। অন্যদিনের মত বাড়ি ঢুকেই সৌমিত্র হাঁক দিলেন, “বৌদি, চা দাও”। কিন্তু সেদিন আশেপাশে উত্তমকুমারকে দেখা গেল না। বরং বাড়ির ভিতর থেকে দাদার আওয়াজ ভেসে এল, “পুলু, তুই খানিক বসে চা খা – আমি আসছি”। ... ...
তখন সারা ভারত জুড়ে চলছে ডিস্কো জ্বর, ফলতঃ বিডিও-কে ঘেরাও করা হল একদিন এই দাবী জানিয়ে যে বোম্বে থেকে বাঙালীর ছেলে ডিস্কো সম্রাট বাপ্পি লাহিড়ি-কে আনা হোক। সে সব দাবী শুনে বিডিও তো কোন ছাড়, স্থানীয় হোমড়াচোমড়া ব্যক্তিদের মাথায় হাত পড়ে গেল! আমাদের দৌড় বলতে হাওড়া ব্রীজ পেরিয়ে চিৎপুরে যাত্রা পার্টি খুঁজতে যাওয়া পর্যন্ত! এখন বোম্বে থেকে আর্টিষ্ট কিভাবে আসবে কেউ বুঝতে পারছে না! ... ...
এই ধরুণ যেমন আমরা সবাই জানি নায়ক সিনেমায় উত্তমকুমারকে হাওড়া-বর্ধমান মেন লাইনের খন্যান স্টেশনে চা-খেতে নামিয়ে মাষ্টার স্ট্রোক দিয়েছিলেন। কিন্তু কোনদিন ভেবে দেখেছেন কি এত স্টেশন থাকতে খন্যান কেন? এখনকার খন্যান স্টেশন আর সেই ১৯৬৫-৬৬ সালের খন্যান স্টেশনের মধ্যে যদিও অনেক পার্থক্য, কিন্তু তখনো খন্যান স্টেশনের একদিকে ছিল তালান্ডু আর অন্যদিকে পান্ডুয়া। তাহলে খন্যান কেন? ... ...
হোটেলের রেষ্টুরান্টের বোরিং মাপাজোপা খাবার খেতে খেতে ক্লান্ত হয়ে এই ভাবেই একদিন ধর্মতলার ছোলে-বাটোরা-র প্রেমে পড়ে গেল রাসেল। হয়েছে কি একদিন বিকেলে প্র্যাক্টিস থেকে ফিরে হোটেলের বাইরে একটু ঘুরতে বেরিয়েছে, একটা দোকানে দেখে লোকজন বিশাল ফুলো ফুলো বান্-এর মতন কি খাচ্ছে! ইন্টারেষ্ট লেগে গেল রাসেলের – জয় মা বলে ঢুকে পড়ল দোকানে, আঙুল দিয়ে দেখালো যে ওই খাবার তার চাই। দোকানে যে ক্যাশে বসেছিল সে অনেক কষ্টে ভাঙা ভাঙা ইংরাজীতে জানালো যে ওই খাবারের নাম “ছোলে-বাটোরে”। ব্যাস, সেই খাবার খেয়ে রাসেল ফিদা! নামটা মুখস্ত করে নিল কয়েকবার আউড়ে নিজের মনে মনেই। ... ...
হাঁটতে হাঁটতে তিনি পোঁছে গেলেন সেই জায়গাটায় এখন যেখানে গেলে গঙ্গার উলটোদিকে মেটিয়াবুরুজের ফেরিঘাট দেখা যাবে। আর বোটানিক্যাল গার্ডেনের ভিতরে তখন এই পাশের পুরো জায়গাটা জুড়ে চাষ হত গাঁজার। হাঁটতে হাঁটতে জগদীশ বসু ভাবতেও পারেন নি সেদিনের থেকে প্রায় ১২০ বছর পরে এই বোটানিক্যাল গার্ডেন তাঁর নামেই নামাঙ্কিত হবে। আগেকার দিনের শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেন এখন পরিচিত “আচার্য জগদীশ চন্দ্র বোস ইন্ডিয়ান বোটানিক গার্ডেন”। ভারতের সবচেয়ে বড় বোটানিক্যাল গার্ডেনের নাম ভারতের সবচেয়ে বিখ্যাত বোটানিষ্টের নামে হবে সে আর আশ্চর্য কি! তবে হালকা আশ্চর্যের বিষয় এটাই যে বোটানিক্যাল গার্ডেনে জগদীশ বসু-র প্রথম পদার্পণ কোন স্পেশাল গাছ গাছালি দেখতে নয় – গাঁজার চাষ দেখতে! গাঁজার চাষ এবং গাঁজা গাছের ব্যাপারে আলোচনার জন্যই কিউরেটর ডেভিড প্রেইন ডেকে পাঠিয়েছিলেন জগদীশ বোস-কে। একদম সরাসরি তাঁর অফিসে চলে যেতে বলেছিলেন, কিন্তু জগদীশ বোস ভাবলেন আলোচনায় ঢোকার আগে নিজের মত করে গাঁজা গাছগুলিকে দেখে নেওয়া যাক! ... ...
সেদিন নৈহাটি থেকে বেশ দেরী করেই আনন্দবাজারের অফিসে ঢুকলেন সমরেশ বসু। দেশ পত্রিকার সেকশনে ঢুকতেই সাগরময় ঘোষের সাথে দেখা। সাগরবাবু মাত্র কিছু দিন আগেই দেশ-এর সাব-এডিটরের দায়িত্ব থেকে প্রধান সম্পাদক হয়েছেন। তবে সাব-এডিটর থাকা কালীনও দেশ-র বেশীর ভাগ সিদ্ধান্তের পিছনে সাগরবাবুই ছিলেন শেষ কথা। সমরেশ বাসুর সাথেও তাঁর চেনা শুনে বহু বছর ধরেই – আজ পুরী, কাল কুম্ভ মেলা, পরশু কেঁদুলি – এই সব জায়গায় সমরেশ বাবুকে ঠেলেঠুলে তিনিই পাঠাতেন লেখা বের করার তাগিদে। ... ...
নীলরতন বাবু বয়েসে প্রায় বছর কুড়ি বড় ছিলেন বিধান রায়ের থেকে। ভালোবেসে তিনি বিধান রায়কে ‘বিধে’ বলে ডাকতেন আর একদম ভাইয়ের মত ভালোবেসে তুই বলেই সম্বোধন করতেন। সেই ভালোবাসা ছিল রেসিপ্রোক্যাল – কুড়ি বছরের বড় হওয়া সত্ত্বেও বিধান রায় ডাকতেন ‘নীলুদা’ বলে। প্রথম থেকে আলাপের পরেই নীলরতন বাবু বুঝে গিয়েছিলেন যে বিধান রায় খুবই প্রতিশ্রুতিবান ছাত্র এবং কালে কালে খুব নামকরা ডাক্তার হবে যদি ঠিক ঠাক গাইড করা যায়। তাই তিনি নিজে থেকেই বলেছিলেন, “বিধে, সময় পেলেই বিকেলের দিকে আসিস হাসপাতালে আমার রুমে। রাউন্ড দেবার আগে তোর সাথে চা খেতে খেতে বিশেষ কেস গুলো নিয়ে আলোচনা করব”। তা এমন সুযোগ কি আর হাতছাড়া করেন বিধান রায়! তাঁরও শেখার আগ্রহ প্রচুর, প্রায় প্রতিদিন সময় পেলেই ছুটতেন ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল কলেজে – যাকে আপনারা আজকে নীলরতন মেডিক্যাল কলেজ বলে চেনেন। ... ...
তা ব্রজেন বাবু হেল্প করলেন। উনার কথাতেই অন্নপূর্ণা যাত্রা অপেরা ডেকে পাঠালো অরুণ কুমারকে একদিন। অরুণকুমার গিয়ে দেখলেন একদমই নতুন ধরণের যাত্রা – নাম “শের আফগান”। সেখানে আলি কুলী খাঁ-য়ের চরিত্রে অভিনয় করছে কম বয়সী, কিন্তু তুখড় একজন ছেলে। সেই ছেলেই পরে শান্তিগোপাল নামে বাংলার ঘরে ঘরের নাম হয়ে ওঠে। অরুণের জন্য ওঁরা ভেবেছিলেন কুতুবউদ্দিন কোকা-র চরিত্র। তবে চরিত্রে ফাইন্যাল করার আগে যাত্রার পরিচালক অরুণকুমারকে টেষ্ট করে নিতে লাগলেন – একটা অন্য কোন যাত্রাপালা থেকে বড় ডায়লগ তাঁকে পড়তে দিলেন, আরো বললেন অভিনয় করে দেখাতে। ... ...
কুরোসাওয়া ক্রমশঃ মানিক বাবুর পারিবারিক বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। উনি বিজয়া রায়-কে ডাকতেন “জয়া – সান” বলে। ‘সান’ হল জাপানী ভাষায় এক সম্ভ্রম সূচক সম্বোধন – পুরুষ, মহিলা দুই দলকেই বলা যায়। যেমন প্রথম প্রথম কুরোসাওয়া সত্যজিৎ রায়কে ডাকতেন “মাষ্টার-সান” বলে। কিন্তু মানিক বাবু বেশ অপ্রস্তুত হয়ে একদিন বললেন, “আপনি আমাকে প্লীজ এই ভাবে মাষ্টার বলে ডাকবেন না সবার সামনে – বেশ লজ্জা লাগে”। তারপর থেকে কুরোসাওয়া উনাকে সবার সামনে ‘মিঃ রায়’ আর একান্তে ‘মাষ্টার-সান’ বলে ডাকতেন। ... ...