অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডস ঘোষণার প্রাক্মুহূর্তে প্রকাশিত হল একটি বুলবুলভাজা, চলচ্চিত্রচঞ্চরী। আগের কিস্তির সূত্র ধরে ফিরে আসি টলিউডে। লেখার একদম শেষের দিকে উল্লেখ করেছিলাম যে সত্তর দশকেও আমরা পেয়েছি "নিশিপদ্ম', "থানা থেকে আসছি', "এখানে পিঞ্জর', "ধন্যি মেয়ে'র মতন সিনেমা যেগুলি তথাকথিত আর্টহাউস্ ফিল্ম না হয়েও পেয়েছিল সমালোচকদের প্রশংসা এবং সাথে বক্স-অফিস সাফল্য। সত্তরের "এখানে পিঞ্জর' (প্রফুল্ল রায়), "শ্রীমান পৃথ্বীরাজ' (বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় ), আশির "দাদার কীর্তি'র (শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়) মতন প্রভূত জনপ্রিয় সিনেমাগুলি স্বনামধন্য সাহিত্যিকদের কালজয়ী ছোট গল্প বা উপন্যাস আবলম্বনে তৈরি । "নিশিপদ্ম' বা "ধন্যি মেয়ে'র চিত্রনাট্য তৈরি করেছিলেন অরবিন্দ মুখার্জ্জী যিনি নিজে সাহিত্যিক ছিলেন এবং "দেশ' বা "নবকল্লোল'এ তাঁর একাধিক ছোট গল্প প্রকাশিত হয়েছিল। সাহিত্যিকদের রূপোলী পর্দার জগতে বিচরণের যে ট্র্যাডিশন প্রেমেন্দ্র মিত্র-শৈলজানন্দরা তৈরি করে দিয়ে গেছিলেন, সত্তর-আশির দশকে সেটাই বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিলেন অরবিন্দ। যাই হোক্, মূল প্রসঙ্গে ফিরি - বাংলা চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগে অ্যাডাপ্টেড স্ক্রিনপ্লের-ই রমরমা, অরিজিনাল স্ক্রিনপ্লে সেভাবে এল কই? সত্যজিৎ রায় থেকে তপন সিনহা, অগ্রদূত থেকে তরুণ মজুমদার - জনপ্রিয় সিনেমাগুলি প্রায় সব সময়েই অ্যাডাপ্টেড স্ক্রিনপ্লের ওপর তৈরি। ... ...
সত্য, ত্রেতা ও দ্বাপর এই তিন যুগে তপস্যা ক্রমান্বয়ে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এই তিন বর্ণকেই আশ্রয় করিয়াছিল। কিন্তু এই তিন যুগে শূদ্রের তাহাতে অধিকার হয় নাই। এই নীচ বর্ণ ভবিষ্যতে ঘোরতর তপস্যা করিবে। কলিযুগই তাহার প্রকৃত সময়। শূদ্রজাতির দ্বাপরে তপস্যা করা অতিশয় অধর্ম। সেই শূদ্র আজ নির্বুদ্ধিতাবশত: তোমার অধিকারে তপস্যা করিতেছে। সেই জন্য এই বিপ্রবালক অকালে কালগ্রাসে পতিত হইয়াছে। রাজা রাম তখন এর নিরসনে গেলেন পঞ্চসপ্ততিতম সর্গে। কোথায় ঘটছে এই শূদ্রের তপস্যা তার তদন্তে গিয়ে রাম শেষ অব্দি খুঁজে পেলেন। দেখিলেন শৈবল পর্বতের উত্তর পার্শ্বে একটি সুপ্রশস্ত সরোবরের তীরে কোন এক তাপস বৃক্ষে লম্বমান হইয়া আছেন এবং তিনি অধোমুখে অতিকঠোর তপস্যা করিতেছেন। তদ্দৃষ্টে রাম তাঁহার সন্নিহিত হইয়া জিজ্ঞাসিলেন, তাপস! তুমি ধন্য, বল, কোন্ যোনিতে জন্মিয়াছ। ষট্সপ্ততিতম সর্গে আমরা পাই কাহিনীর শেষটুকু। ... ...
মহাদেব কবিয়ালের গানে এর পরবর্তী অংশে যে প্রসঙ্গগুলি এসেছে তার দু-একটা এখানে উল্লেখ করে রাখি। এর পরেই মহাদেব কবিয়াল উল্লেখ করবে নিতাইয়ের জাত-ব্যবসার কথা। সেটা বলতে এখানে চুরি-ডাকাতির কথা তুলেছে মহাদেব। যেমন নিতাইয়ের বাবার কথা বলেছে সে, সিঁদ কেটে বাড়ি বাড়ি চুরি করত, বা তার ঠ্যাঙাড়ে ঠাকুর্দার কথা, এবং তার মায়ের বাবার কথাও যে কিনা দ্বীপান্তরে মরেছে। এছাড়া নানা জায়গায়, ডোমদের আর একটা পেশা ছিল শ্মশানে। ডোমদের এই ধরনের পেশাগুলির একটা ইতিহাস ছিল। বাংলার সামাজিক ইতিহাস নিয়ে কোনও খুব স্পষ্ট মতামত দেওয়ার যোগ্যতা আমার নেই। কিন্তু নানা সময় যা কিছু শুনেছি বা পড়েছি, তার থেকে এইটুকু মাথায় আসছে যে, বোধহয় ব্রিটিশ আমলে ডোমদের এইসব অপরাধ ও মৃত্যুকেন্দ্রিক পেশার সূচনা প্রাকব্রিটিশ বাংলায়। সেখানে ডোমরা ছিল একটি যোদ্ধা জাতি। বিভিন্ন রাজার হয়ে যুদ্ধ করত এই ডোমরাই। এই ইতিহাসই বোধহয় ধরা আছে ওই ছেলেভোলানো ছড়ায়: "আগে ডোম, বাগে ডোম, ঘোড়াডোম সাজে'। আগে এবং পিছনে ডোম সৈন্যদের নিয়ে, অশ্বারোহী ডোম যোদ্ধাদের নিয়ে, "ঢাক মেঘর ঘাঘর' ইত্যাদিতে যুদ্ধের বাজনা বাজাতে বাজাতে যুদ্ধে যেতেন তখনকার বাংলার রাজারা। তারপর রুল ব্রিটানিয়ার দোর্দণ্ডপ্রতাপে, রাজশেখরের ভাষায়, "আন্ডার দি সুদিং ইনফ্লুয়েন্স অফ দি বিগ রড', রাজারা ভ্যানিশ, রাজায় রাজায় যুদ্ধও ভ্যানিশ। ফলত বহু জায়গাতেই ডোমরা তাদের যুদ্ধবিদ্যা সম্পৃক্ততা থেকে সহজেই রত হল চুরি-ডাকাতি ইত্যাদি পেশায়। ডোমদের যেটা পোষাকি নাম, "রাজবংশী' বা "বীরবংশী', যার একটি মহাদেব কবিয়ালের গানে এর পরেই এসেছে, অন্যটিও এসেছে চলচ্চিত্রের অন্যত্র, তারও শিকড়টা তাই রাজা বা বীর, যা এদের সেই লুপ্ত হয়ে যাওয়া পেশাকেই চিহ্নিত করে। ... ...
আঞ্চলিক চলচ্চিত্র জগতে মারাঠি সিনেমার ঘুরে দাঁড়ানো আমাদের কিছু শিক্ষা দিতে পারে হয়ত।যে সিনেমা ৩ কোটির ব্যবসা করছে স্থানীয় বক্সঅফিসে, সেটিই আবার প্রদর্শিত হচ্ছে বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভালে - সুখের কথা একাধিক মারাঠি সিনেমা এই গোত্রে পড়ে।লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হল প্রায় সব কটি সফল সিনেমারই একটি নির্দিষ্ট স্ট্র্যাটেজি আছে - "আউট অফ্ দ্য বক্স' কাহিনীসূত্রকে একটি সাবলীল চিত্রনাট্যে ফেলে ভীষণ ঘরোয়া একটি পটভূমিকায় উপস্থাপন করা।এর ফলে তথাকথিত "নেইভ' দর্শকদের সঙ্গেও পরিচালকের কোনো দূরত্ব তৈরী হয় না; প্রেক্ষাপটও এমন যে পেশাদার অভিনেতার অসংলগ্ন অভিনয়ের সুযোগই নেই। এমনই একটি সিনেমা হল "ভালু'(দ্য বুল্) - এই গল্পের প্রটাগোনিস্ট একটি ধর্মের ষাঁড় (আক্ষরিক অর্থেই); নিরুপদ্রব একটি গ্রামে (যেটি আসলে অচলায়তনের প্রতীক)এর উপস্থিতি ধুন্ধুমার কান্ড বাধিয়ে তোলে।গ্রামবাসী থেকে শহুরে সরকারী বড়কর্তা, যে গুঁতো খেয়েছে আর যে খায়নি, যে স্বচক্ষে দেখেছে অথবা যে শুধুই গুজব রটাচ্ছে সবাই এই উটকো ঝামেলায় বিব্রত।আপাততুচ্ছ একটি ঘটনা নিয়ে ক্ষমতার দ্বন্দ,রাজনীতি ও কুসংস্কার নিয়ে গ্রাম্য চাপানউতোর মুন্সিয়ানার সঙ্গে ফুটে ওঠে পর্দায়।মারাঠি দর্শকের গ্রহণক্ষমতা কত সে নিয়ে কোনো বক্তব্যপ্রকাশের অবকাশই থাকে না। ... ...
অটোগ্রাফ ছবির নির্দেশক সৃজিৎ মুখার্জীর সাক্ষাৎকার নিলেন ঋতব্রত ঘোষ - স: প্রথমেই বলে রাখি .. শুরু থেকেই চেয়েছিলাম এই ছবির গানগুলোর মধ্যে পর্যাপ্ত ভ্যারাইটি রাখতে। যাতে একটা অ্যালবাম হিসেবেও গানগুলো একটা বিশেষ জায়গায় পৌঁছয়। ছোটবেলা থেকে যে গান শুনে বড় হয়েছি, বিশেষত হিন্দি, সেগুলো কিন্তু ফিল্ম অ্যালবামই। আবার আমি লিপ-সং রাখতে চাইনি.. গানগুলো সিনেমাতে জাস্ট আইটেম হিসেবে না থেকে যাতে গল্পকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে সেদিকেও নজর দিতে হয়েছে। দেবুদা অসামান্য কাজ করেছেন, আর লোকজনের ভালো লাগছে মোস্ট ইম্পর্টান্টলি ডাউনলোড না করে অনেকেই অ্যালবামটা কিনছেন, বাড়িতে একটা ওরিজিনাল কপি রাখা প্রয়োজন মনে করছেন এটাও যথেষ্ট আনন্দের। ... ...
সেই যে রেলের প্রসঙ্গ থেকে শরত্চন্দ্র আসতে শুরু করল, বারবার মাথায় এসেই যাচ্ছে এগুলো। এই বাবুর শরত্চন্দ্র সংস্করণটা মনে পড়ছে? এলএ পাশ করার পর ডেপুটি হওয়ার অপেক্ষারত নতুনদা? নতুনদা নামে যদি মনে নাও পড়ে, পাম্পশু থেকে নিশ্চয়ই পড়বে। এই বাবুটিরই নিকট কেউ হওয়ার সম্ভাবনা আছে নতুনদার। নভেম্বর বিপ্লবের বছরে শ্রীকান্ত ছাপা, তার বেশ কিছু বছর আগে ঘটেছিল নতুনদা উপাখ্যান, শ্রীকান্তর কিশোর বয়সে। ১৯০০ সালে শরত্চন্দ্রের বয়স ১৪, তার মানে ১৯০২ নাগাদ ধরে নিতে পারি নতুনদা মাঘের শীতে বরফশীতল নদীর জলে ডুব দিয়ে বসে কুকুরের হাত থেকে বেঁচেছিলেন, তখন যদি তার বয়স বাইশ-চব্বিশ ধরে নিই, তাহলে ১৯৩৮-এ তার বয়স প্রায় ষাট। তাহলে তারাশঙ্করের এই বাবুটির পিতা তিনি হতেই পারেন। এবং এই বংশধারা তো আবহমান ছিলই। শ্রীকান্তর বন্ধু ইন্দ্রর দাদা নতুনদা উপাখ্যান অন্তে একটি অনাবিল অপ্রতিরোধ্য ভাঁড়ে পর্যবসিত হয়েছিলেন, কিন্তু সে তো শরত্চন্দ্রের পোয়েটিক জাস্টিস, কাব্যিক ন্যায়বিচার, আদতে ঘটনাটা ছিল এই যে, যদি এমনকি ভাঁড় হয়েও থাকে, সেই ভাঁড়ই, সেইরকম ভাঁড়েরাই, ফিরে গিয়ে ডেপুটির চাকরি পাবে, ইন্দ্র জানিয়েছিল শ্রীকান্তকে। ... ...
দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে ব্রিটিশের কালো বুটের কাজলকালো ছায়ায় নির্মীয়মান ঔপনিবেশিক পুঁজির মরডান (অনেক লোকেই দেখেছি, কিছুতেই র-টা ড-এর পরে বলে না, শত ধরিয়ে দিলেও, একটু ডর লাগে বলে? সেরকম বানানই লিখলাম।) হতে থাকে ভারতরাষ্ট্রে যে ঐতিহ্যটা আমরা পাচ্ছি তা আর আধুনিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন বিশ্লিষ্ট কর্তিত কিছু নয়, তারা এ অন্যের মধ্যে প্রথম থেকেই বসে আছে, সম্রাট কণিষ্ক যার নাম দিয়েছিলেন অতিনির্ণয় বা ওভারডিটারমিনেশন। ঐতিহ্য আর আধুনিকতার এই গোড়া থেকেই শোয়াশুয়িটা উপন্যাস "কবি' ধরতে পারেনি, কিন্তু ফিল্ম "কবি' পেরেছিল। উপন্যাস যেখানে শুধু বংশ ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করেই থেমে গেছিল, ফিল্মকে সেখানে ঠিক তার পাশাপাশি উল্লেখ করে দিতে হয় তার আধুনিকতার তকমা মানে চাকরির পদকেও। শুধু তার ডোম বংশ নয় কুলিগিরির চাকরিকে একই সঙ্গে জানিয়ে দিয়ে সেই একই নাটককে নতুন চেহারায় হাজির করে দেয় "কবি' ফিল্ম। একটু পরে ঠিক এটাই দেখব আমরা কবিগানের আসরে। চণ্ডীর থানের মহান্ত আর স্টেশনমাস্টার তারা পাশাপাশি চেয়ারে আসীন থাকবেন। কর্তৃত্ব এবং ক্ষমতা আর ঐতিহ্য দিয়ে হচ্ছে না, তাকে আধুনিকতার আশ্রয় নিতেই হচ্ছে। তার পাশাপাশি আরও একজন থাকবেন। বর্গসঙ্করের কুলতালিকায় আমাদের বাঙালিদের আর একটা নিজস্ব সংযোজন। সে কথায় পরে আসছি। ... ...
আমি খুব নিশ্চিত নই, সাউন্ডট্র্যাকের সমস্যার কথা তো আগেই বলেছি, বাংলায় যে আন্দাজটা আমি অনেকটা করতে পারছি, অন্য ভাষায় সেটা হচ্ছে না। তবে আমি আমার হিন্দিভাষী সহকর্মীদেরও শুনিয়ে দেখেছি। তাদেরও বাক্যটা ওরকমই লাগছে। তবে বাক্যটা এখানে তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়ও। কী বলতে চাইছে সেটা বোঝা যাচ্ছে খুব সহজেই। গুরুত্বপূর্ণ এখানে গোড়া থেকেই এই অবাংলাভাষী রেলকর্মীর অস্তিত্বটা উচ্চারিত হয়ে যাওয়া। উপন্যাস থেকে চিত্রনাট্যে খুব সচেতন বদলগুলোর এটা একটা। উপন্যাসে এই চরিত্রটাই নেই। এমনকি উপন্যাসের শেষে নিতাই যখন ফের ফিরে এল চণ্ডীতলা ইস্টিশনে, সেখানের লোকজন তাকে ঘিরে এল। এক সময় মিছে শিরোপার গল্পে যে সম্মান নিজেই নিজেকে দিতে চেয়েছিল, সেই সম্মান এল আপনা থেকেই। উপন্যাসে এটা উল্লেখিত আছে নিতাইয়ের নিজের কেনা মিছে শিরোপা, ফিল্মে সেটা আর বলা হয়নি, শুধু শিরোপাটাই দেখানো হয়েছে। এটাও একটা বদল, কিন্তু তেমন জরুরি কিছু নয়। ... ...
সত্যিই "কবি' ফিল্মটা আমার বিরাট একটা কিছু লেগেছে। তুলসী চক্রবর্তীর অলৌকিক ঐ অভিনয় নিয়ে অবাক হওয়ার কিছু নেই, সবসময়ই তিনি ঐরকম অভিনয়ই করে এসেছেন। কিন্তু, তার চোখের মুদ্রায়, কদর্য নাচের ভঙ্গীতে, যে ভাবে উঁচু জাতের দম্ভ এবং হিংস্রতাটা এসেছে, সেটা বোধহয় তুলসী চক্রবর্তীর পক্ষেই সম্ভব। নীলিমা দাশের কথা আগেই বললাম। অনুভা গুপ্তা, নীতিশ মুখোপাধ্যায়, হরিধন, এদের সকলেরই অভিনয়, সঙ্গে রবীন মজুমদারের গান, এবং অনিল বাগচীর সঙ্গীত পরিচালনা, এর একটাও যদি সঠিক মানে না-পৌঁছত, "কবি' বোধহয় তার নিজের জায়গায় পৌঁছতে পারত না। নৃত্য পরিচালকের নাম দেখলাম প্রহ্লাদ দাস। তাঁর সম্পর্কে আর কিছুই আমি জানি না, কিন্তু প্রত্যেক বারই তুলসী চক্রবর্তীর ঐ বিকট নাচ দেখতে দেখতে আমার নৃত্যপরিচালকের কথা মাথায় আসে। একজন পঞ্চাশোর্ধ ভারি চেহারার মানুষের শরীরের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ঐ নাচের ভঙ্গীর উদ্ভাবন তো সহজ কাজ ছিল না। এই রকম অজস্র টুকরো টুকরো কথা মাথায় আসে আমার। আক্ষরিক অর্থেই এগিয়ে পিছিয়ে এগিয়ে পিছিয়ে "কবি' ফিল্ম আমি অজস্রবার দেখেছি। আপনারা দেখুন, আমার প্রতিক্রিয়া যদি আপনাদের প্রতিক্রিয়ায় স্থানান্তরিত হতে পারে, সেটাই এই কাজের সাফল্য। ... ...
এভাবেই দর্শকদের প্রথম পরিচয় ঘটে কৃষ্ণা বর্মার সাথে, যাকে আপাত দৃষ্টিতে স্বামীসোহাগে তৃপ্ত, ঘরকন্নায় পারদর্শী, সাধারণ উত্তর ভারতীয় গ্রাম্য গৃহবধূ ছাড়া আর কিছুই মনে হয়না। বলা বাহুল্য, এই ভ্রান্তি সাময়িক। কৃষ্ণার চরিত্রটি প্রকৃতপক্ষে noir ধারার femme fatale-এর দক্ষ রূপায়ণ। সিনেমার ইতিহাসে অনেক ক্ষেত্রেই এ ধরণের চরিত্র পিতৃতান্ত্রিকতার হাতের পুতুল, কিন্তু কৃষ্ণা বহির্জগতের কার্য্যকারণ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত, এবং এ ছবির নায়কদের থেকে সে সবসময়ই এক ধাপ এগিয়ে। নায়কের প্রসঙ্গে চলে আসে মুখ্য জুটির কথা। ছিঁচকে অপরাধী এবং ইফতিকার ও বব্বনের সঙ্গে দর্শকের পরিচয়ের মুহূর্তটিও বিশেষ উল্লেখের দাবী রাখে - ছবির তথাকথিত নায়কদের আমরা আবিষ্কার করি মদ্যপ এবং প্রায় উন্মত্ত অবস্থায়, এবং পেছনে বেজে চলে কোনো এক তৃতীয় শ্রেণীর ব্যান্ডের গলায় গাওয়া "অজীব দাস্তাঁ হ্যায় ইয়ে' গানটি। এই ভবিষ্যদ্বাণীকে সত্য প্রমাণিত করতে নায়কদ্বয়ের দ্রুত ভাগ্য পরিবর্তন হয়। জীবন্ত সমাধিস্থ হওয়ার হাত থেকে এক চুলের জন্য বেঁচে যাওয়া নাসিরুদ্দিন-আরশাদ পালিয়ে যায় গোরখ্পুরে, আশ্রয় নেয় পূর্বপরিচিত বিদ্যাধর বর্মাঞ্চর (আদিল হুসেন) বাড়িতে। ... ...
গল্পটা চেক দেশের গন্ডগ্রামের এক রেলস্টেশন আর সেই স্টেশনের লোকজনদের নিয়ে। মেনলি এক বয়:সন্ধিপ্রাপ্ত কিশোরের। সময় WWII , তাই রেলগাড়িতে করে জার্মান(নাৎসি)দের ছাগল, গরু, নার্স ও বন্দুক-গোলাবারুদ যায়। কিন্তু কেউই প্রায় পাত্তা না দিয়ে হুশ করে স্টেশনের উপর দিয়ে বেরিয়ে যায়। এখন কিশোরের নাম মিলোস হ্র্মা। তার বাপ রেলের ইনজিন চালাতো, আর দাদু ছিলো সম্মোহনকারী। মিলোস বললো ল্যাদ খাওয়ার সুপ্রাচীন অভ্যাসের জন্যই নাকি দাদুর অমন পেশা গ্রহণ। সেও ল্যাদ খেতে চায় ... ...
তিরুবনন্তপুরমের চৌকাঠে সিনেমা পা রাখে ডিসেম্বরে। ডিসেম্বর মাসে এখানে শীতলহরের প্রচ্ছায়াতেও আসে না শহর। মৌসুমী বৃষ্টির পরে সুতীব্র নীল আকাশ আর উষ্ণ সূর্যতাপে দিনগুলি ক্ষয়ে যায়। আবারও, এই ডিসেম্বরের মাঝামাঝি-ই, সিনেমার উৎসব আসে শহরে। এবারের বারোতম ইন্টারন্যাশানাল ফিল্ম ফেস্টিভাল অফ কেরালা'র নির্ধারিত দিনগুলি ছিলো সাত থেকে চোদ্দই ডিসেম্বর। ... ...
শনিবার বিকেলে ন্যাশনাল ফিল্ম থিয়েটারের বক্স অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। এখন লন্ডন ফিল্ম ফেস্টিভাল চলছে দুই সপ্তাহ ধরে। আমার সামনে এক ভারতীয় ভদ্রমহিলা, তারও সামনে আলজিরিয়ায় জাত দুই ফরাসী, আরও আগে দুই ইজরায়েলি ছাত্রী। পিছনে বৃটিশ দম্পতি। আমি লাইনের পনেরো কি ষোলো নম্বর স্থানে। লাইনের একদম সামনে যারা তারা গ্যাঁট হয়ে মেঝেতে বসে বই পড়ছেন। বাইরে ঝিম্ঝিম্ বৃষ্টি। লন্ডনের তুলনায় বেশ জোরে। আমার পিছনে লেজের মতো লাইন বেড়েই চলেছে। অনেকেই উদ্বিগ্ন হয়ে ভলান্টিয়রদের জিজ্ঞাসা করছেন টিকিট আদৌ পাওয়া যাবে কি না। ... ...
এই সিনেমাটা আসলে আমেরিকায় যাওয়া বিভিন্ন কিসিমের ভারতীয়দের জীবনের টুকরো টুকরো কোলাজ। সিনেমাটা সম্ভবত স্লোডাউনের সময়ে বানানো। একটা অ্যাপার্টমেন্টে কিছু ব্যাচেলর ছেলে থাকে, ঐ বডি শপিংয়ের মাধ্যমে আমেরিকায় চাকরি করতে এসেছে, এবং সফ্টওয়্যারের চাকরি। স্লো ডাউনের জেরে তারা চাকরি খোয়ায়। ভুলভাল কিছু ফান্ডা দিয়ে তাদের চাকরি খেয়ে নেয় বস। এর মধ্যে দুটো ছেলে একদম বিন্দাস টাইপের, চাকরি গেছে তো কি হয়েছে, আমাদের ট্যালেন্ট আছে, ওর'ম চাকরি আবার পাবো টাইপের। ইন্টারভিউয়ের জন্য কল এলেও বেজায় রোয়াব দেখায়, কত মাইনে দেবেন, কিসের ওপর কাজ, টিম সাইজ কত বড়, ক্লায়েন্ট দেসি না আমেরিকান, এই সব জিজ্ঞেস করে ফোন কেটে দেয়। ... ...
বলার বেশি কিসু নাই। কল্পনা লাজমী একটি নাটক বানায়েছেন - স্টেজ ভাড়া করা আর মহড়া প্রদর্শণী ইত্যাকার স্বল্পস্থায়ী নশ্বর ঝামেলায় না গিয়ে ক্যামেরার পিছনে দাঁড়িয়ে বলে দিলেন - লে:, নাচ। চিত্রনাট্য লিখিয়ে ভদ্রলোক নেহাৎ কবি, অন্তত তাঁর মনে এই বুজকুড়ি অবিরাম উদ্বেল - আমি কবি যত বেশ্যার আর পিওনের আর পুরোহিত গোদা-লেঠেলের। ক্বচিৎ আগেও সিনেমার চিত্রনাট্য লিখেছেন, নাটক বা কবিতা ছাড়া, জানতে পারলে মাক্কালীর কিরা ফ্যাতাড়ুর বোম্বাচাক লেগে যাবে। সিকি ল-অ-অ-অ-অ-ম্বা ডায়লগ রে কাকু! বলেই যাচ্ছে বলেই যাচ্ছে, রেগে যাচ্ছে, কেঁদে যাচ্ছে, ফুলে-ঝুলে-তুলতুলে তবু দাঁড়ি নাই, সব আছে, শুধু থামা নাই - নদী আপনবেগে পাগলপারা। আর গাঁত? পাগোল !! ... ...
ফিল্মটি অতি সিম্পল। কোনো বিপজ্জনক খাঁজ টাজ নেই, যা দেখে টলে যেতে পারে মানবশরীর। এবং সরলতাই ইহার বিউটি। একগুচ্ছ পুরুষ ও মহিলা চরিত্র নিয়ে গড়ে উঠছে আখ্যান, যাদের কারোরই কোনো গন্তব্য জানা নেই। আছেন প্রেসিডেন্সি কলেজের এক বিদগ্ধা অধ্যাপিকা, যিনি সারাদিন ইংরিজিতে কথা বলেন। এছাড়াও তিনি ডিভোর্সি এবং বয়ফ্রেন্ড বিদ্যমান, কিন্তু বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে তিনি আমেরিকা যাবেননা বলে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। অতএব প্রেম আছে ও পরিণতি নেই। আছেন এক ডাক্তারবাবু যিনি প্রচন্ড ব্যস্ত হলেও রোগির দিদির সঙ্গে ডিনারে প্রচুর সময় কাটান, হুট করে ব্রেক নিয়ে চলে আসেন শৈলশহরে, রণ ও বন থেকে রোগিনীর দিদিকে উদ্ধার করবেন বলে। পরিষ্কার বোঝা যায় ছিপ ফেললেও মাছ তিনি ধরবেননা, কারণ বাড়িতে আছে না ছুঁই পানি বৌ। এখানেও প্রেম আছে কিন্তু হাফসোল নাই। আর আছে এক লালুভুলু প্রেমিক, মানসিক রোগগ্রস্তা প্রেমিকাকে দশ (নাকি বিশ?) বছর পরে দেখে তিনি বৌ-বাচ্চা ফেলে তার সঙ্গে সময় কাটান। এবার যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে তা প্রেম নয়, অতএব তারও কোনো গন্তব্য নেই। ... ...
আসল কথাটা হল - মার্কেটিং। কি ভাবে বেচবে? সহজ উপায় - সমস্ত বিজ্ঞাপণওলারাই কোনো না কোনো সময় ব্যবহার করে করেই সহজ করেছেন যদিও - একটা কিনলে আর একটা ফ্রী। মানে কলেজপ্রেম দেখতে এলে সাইকেল রেস ফ্রী, ইংরেজের সাথে চাষীদের মাথাফাটাফাটি দেখতে এলে ক্রিকেট ম্যাচ ফ্রী। এমনকি জ্যাকি চ্যন ও এই মাত্র "দি মিথ" ছবিতে মল্লিকা শেরাওয়াতকে টেনে হিঁচড়ে শেষতক আর্কিওলজিস্টের খোঁজাখুঁজির সঙ্গে রাজা রানী সেনাপতি আর ঘোড়া তীর তলোয়ার যুদ্ধ ফ্রীতে দিয়েছেন। রং দে বাসন্তি দেখতে গিয়েও - ২৬শে জানুয়ারি - ভগৎ সিং পেলাম মিনি মাগনা। পয়সা উসুল। মার সিটি। অ্যায়স্শালা। ... ...
বেশি ঘ্যানাপ্যাচালিতে যাবো না, কাজের কথা বলি। ফ্রান্সে যারা উত্তর আফ্রিকা থেকে এসেছে, তাদের জীবনযাত্রা একটু অন্য, ঠিক প্রান্তিক কেস নয়, তবে তার থেকে খুব দূরেও নয়। গত কয়েক বছরে এ নিয়ে কতগুলি ভালো সিনেমা হয়েছে। নাম দিলাম। এই জেনারের সিনেমা একসাথে দেখলে ভালো লাগবে। আমি এই মুহূর্তে তিনটে নাম দেই যা দেখে ভালো লেগেছে, আর প্রতিটা নিয়ে এক দু কথা। ... ...
শহরে একটি সিনেমা-উৎসব চলছে। এই শহরের সিনেমা-পাগল মানুষ উপছে পড়ছেন থিয়েটারে। কাল ছিলো সরকার-সমর্থিত বন্ধের দিন--রাস্তা-ঘাট শুনশান। পেদ্রো আলমোদোভার এর 'ভোলভার' এর দ্বিতীয় শো এও জায়গা পেলাম না। সিট ছাপিয়ে মাটি তেও বসে পড়েছে সবাই। অন্য থিয়েটারে দেখতে গেলাম একটি সিংহলা সিনেমা, প্রসন্ন জয়াকোডি'র 'সঙ্কারা' ... ...
শিকাগোতে উনিশে অক্টোবরের সকাল। শিকাগো এয়ারপোর্টে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ এসে পৌঁছেছেন। শিকাগো ইকোনমিক ক্লাবের মিটিঙে ভাষণ দেবেন। প্রেসিডেন্টের কনভয় শেরাটন হোটেলের দিকে রওনা দিয়েছে। অন্যদিকে সেইদিন শিকাগো শহর বুশবিরোধী সমাবেশ, মিছিল ও ধর্নায় উত্তাল। শিকাগোর পুলিশ চিফের কথায়- "বুশ যেখানেই যান সাধারণত: সেখানে বিক্ষোভ দেখানো হয়। কিন্তু এই প্রথম মনে হল বিক্ষোভকারীদের চোখমুখ দিয়ে যেন ঘেন্না ঠিকরে পড়ছে।" রাস্তার দুপাশের বিক্ষোভকারীদের সারি একসময় পুলিশ কর্ডন ভেঙে ফেলে। কেউ কেউ রাস্তার মধ্যে এসে যায়। ... ...