প্রতিটি দিনই তো দেবীপক্ষ ভাবতে ভালো লাগে – কেবল সেই ভোরে ওঠা নিয়ে সূর্যের সাথে রাগারাগি না হয় মাথার কাছে বাজুক চেনা সুর আধোঘুমে গুন গুন নিবিড় হয়ে এসে বাড়ি ফেরার প্রতীক্ষা ... ...
মালতী আর কোনোদিনও উল্টোদিকে যায়নি। বর্ডার পেরিয়ে বাপের বাড়ি যাওয়া হয়নি কোনদিন। বাইশ বছরের প্রায় প্রতিটা ভোর ঝড় জল কনকনে উত্তরে হাওয়া ভ্যাপসা পচা গরমে ডাউন বনগাঁ লোকালে কেটেছে মালতীর । দেশের বর্ডার পেরিয়েছিল সেই একবার। তারপর রোজ জেলার বর্ডার পেরিয়ে কোলকাতা। মালতীর হাতের শাঁখার খাঁজে খাঁজে কালো কালো ময়লা জমে দাগ দাগ দাগ। চুলের তলা গুলো অনেকদিন ছাঁটা হয়নি। সব চুলগুলো তিন খানা প্যাঁচে ভাগ হয়ে ঝুলছে। খানিক ভেজা খানিক শুকনো। আধা কাঁচা আধা পাকা চুলে দু চারটে শাকের পাতা লেগে আছে। ... ...
ঘর বানানো বিষয়ক প্রস্তাবনা ঘর বানানোর জন্য প্রথমেই লাগবে একটুকরো জমি। আপনাকে দেখে নিতে হবে যে জমিটা যেন বৃষ্টিতে ভেসে না যায় এবং ডুবে না যায় বন্যায়। ফলে জমি বিষয়ক সাধারণ জ্ঞানের সাথে আপনার লাগবে প্রাকৃতিক কিছু প্রবৃত্তি। জমিটি নির্বাচিত হলেই আপনি তখন চারটি দেয়ালের কথা ভাববেন; এবং অতি অবশ্যই চার দেয়াল আপনি জমিনের ওপর স্থাপন করবেন না। ঝড়ো বাতাস আর প্রকৃতির বিভিন্ন গজব থেকে রক্ষার স্বার্থেই আপনি চারটি দেয়ালকে আসলে প্রোথিত করবেন মাটির ভেতরে। ঠিক গাছ যেভাবে নিজেকে রাখে। তবে আপনি কোনো শেকড়, কখনোই, স্থাপন করতে পারবেন না। ... ...
অথচ, চিনিনা তাকে হাতের আড়াল হলে নিভৃতচারিনী স্নেহ ছলে, আলো ছলে বারবার দেখি... বিষণ্ণ আদল মেয়ে স্তন পেতে বলি ' ক্ষুধা নিবি...' ... ...
উৎসব হয় কোথায়? মণ্ডপে রাস্তায় বাড়িতে মসজিদে গির্জায় কোন বাড়িতে। উৎসব আসে কোথায়? উৎসব আসে মনে। মন না জাগলে মন না মাতলে উৎসবের কোনো মূল্য নেই। প্রকৃতি সুন্দর। ততক্ষণই, যখন আপনার চোখ ও চোখের ভিতরে থাকা মন প্রস্তুত তাকে দেখতে। ... ...
মোচ্ছব কাকে বলে? যখন কলকাতা ডুবুডুবু, গ্রামে খরা। যখন মুখ্যমন্ত্রী গান গাইছেন, এক পুরোনো মেয়র ফোটোশুট করছেন, আরেকজন মামলা। যখন কাশফুল বাড়ন্ত, দিগ্বিদিকে দেদার ডিজে-বক্সের কলধ্বনি। যখন বিচারক টিভিতে টিআরপি বাড়াচ্ছেন, যখন আন্দোলনরতরা রাস্তায়, আর পাবলিক সেজেগুজে পথে নেমেছে।যখন শারদসম্মানে ঢুকে যাচ্ছে "সেরা সেলফি জোন"এর পুরষ্কার, মেয়েরা আক্ষেপ করছে, কেন এবারই "সেরা রিল এলাকা"টা হলনা। চিন্তার কিছু নেই, আসছে বছর নিশ্চয়ই হবে। তখন রিলে রিলে কিলবিল করবে নেট-দুনিয়া। টিকটককে পিছনে ফেলে মেটা আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে। একে কেউ কেউ ফালতু ক্যাকোফনি বলেন, আমরা বলি বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য। এইসবই আমাদের উৎসবের যুগলক্ষণ। উৎসব তো আকাশ থেকে পড়বেনা, জীবন যেরকম, তেমনই হবে। এরই মধ্যে কলকাতার পুজো আবার হেরিটেজ তকমা পেয়ে গেছে। রাস্তার শিল্পে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ সম্ভার, নিঃসন্দেহে কলকাতারই। আমাদের দীনতা আর হীনতার মধ্যেও, আমাদের পারা আর না পারার মধ্যে, আমাদের যুদ্ধ আমাদের স্বার্থপরতার মধ্যে, থাকনা আমাদের ভালোটুকুও, থাক না, আমাদের হুল্লোড়, আমাদের ক্যাকোফনি। ... ...
‘রাইনার, এই যে সব মানুষ তোমাদের ব্যাঙ্কের হলঘরে বসেছিলেন, এঁরা কারা? এদের কাউকে ব্যাঙ্কার কেন, এমনকি শিল্পপতি বলেও তো মনে হল না?’ রাইনার বললে, চুপ কর দেখি (জাই রুহিগ)। তুমি কি মনে কর তোমাদের গোষ্ঠীবদ্ধ ঋণের পারিশ্রমিক নিয়ে আমাদের ব্যাঙ্ক চলে? ঘরভাড়া ওঠে না। এখানকার খরচা জান? যাদের দেখলে, তারা আমাদের প্রাইভেট ব্যাঙ্কের গণ্যমান্য মক্কেল। সোজা বাংলায় (এর সরাসরি জার্মান আছে – আউফ ডয়েচ গেজাগট) করপ্রদানের পরিমাণ কমানোর জন্য আমাদের সঙ্গে এখানে কারবার করে। অ্যাকাউন্ট খোলে। টাকা তোলে। জমা দেয়। তারাই আমাদের রুটি রুজির মালিক’। আমার প্রশ্ন তখনো ফুরোয়নি। আমি বললাম, রাইনার, এদের পোশাক-আশাক, এমনকি সম্পূর্ণ বেমানান স্পোর্টস জুতো দেখলে তো হাঘরে মনে হয়। এরা তোমাদের মূল্যবান মক্কেল? কী গুল দিচ্ছ?’ ... ...
কিন্তু আজ থেকে সহস্রাধিক বছর আগেও কি পৌরুষ আর নারীত্ব আজকের মতো একইরকম বিপ্রতীপ মাপকাঠিতে নির্ধারিত হতো, নাকি এই দুই সমান্তরাল রেখা মিলেমিশে সেসময় গড়ে উঠেছিল প্রাচীন মানবের অন্যতর কোন পরিচয়? গত দশকে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে শুরু করেছিলেন নিউ ইয়র্কের ম্যানহ্যাটানভিল কলেজের অধ্যাপিকা তথা শিল্প ঐতিহাসিক মেগান সিফারেলি। প্রাপ্ত যে কোন প্রাচীন দেহাবশেষকে নারী ও পুরুষ নামক দুটি লিঙ্গে দেগে দেওয়ার বাঁধা গতকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে নতুন এক উত্তরের আশায় গবেষণার জন্য ইরানের মরু-মালভূমির গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নকেন্দ্র তথা লৌহ-ব্রোঞ্জযুগের বাণিজ্যনগরী টেপ হাসানলুর প্রাচীন সমাধিগুলিকে বেছে নিয়েছিলেন তিনি এবং খুঁজে বেরও করেছিলেন মানব যৌনতার তৃতীয় স্বরের বেশ কিছু অসামান্য নিদর্শন। ... ...
প্রায় এক হাজার বছর আগের বাংলা। ১০৭৫ খ্রিষ্টাব্দ, পাল রাজবংশের অন্ধকার যুগ চলছে। সিংহাসন নিয়ে ভাইয়ে ভাইয়ে লড়াই শুরু হয়েছে। সাম্রাজ্যের পরিধি ক্রমশই ক্ষুদ্র হচ্ছে। বাঙালীর গর্ব অতীশ দীপঙ্কর বিক্রমশিলা মহাবিহার ছেড়ে তিব্বতে চলে গেছেন প্রায় ত্রিশ বছর হলো। চারদিকে শুধুই অন্ধকার। তার মধ্যে একটি প্রদীপের দীপ্ত শিখার মতো জ্ঞানের আলো জ্বালিয়ে রেখেছেন চিকিৎসক চক্রপাণি দত্ত। প্রথম বিখ্যাত বাঙালি চিকিৎসক, যার রচিত পুস্তক এক হাজার বছর পরেও আজও সমস্ত ভারতবর্ষের আয়ূর্বেদিক কলেজগুলিতে পড়ানো হয়। সে দীপ শিখাও কি নিভে যাবে? ... ...
কিন্তু কাল রাতে একটা জব্বর নাম এসেছে মাথায়। সেটা নিনিকে বলতে হবে। আর দশটা কাজে জড়িয়ে পড়ার আগে। তাই অপেক্ষা করে পৃথা। মেপে মেপে ক্যারাফেতে জল ঢালে। বসিয়ে দেয় বার্নারে। তারপর গ্যাসের নব ঘোরায়। খোলা জানলা দিয়ে চুইয়ে আসে ভোরের তরল, পাতলা অন্ধকার। এক দৈবী আলোর মত গ্যাসের শিখারা লাফিয়ে লাফিয়ে ওঠে। হাইড্রোকার্বনের অণুগুলো ক্যারাফের তলা ছোঁয়। পৃথার মনে পড়ে যায়, ওর মায়ের কথা। প্রথম যেদিন ওকে কাঁচের ক্যারাফে গ্যাসের আগুনে বসাতে দেখেছিল, কি ভয়টাই না পেয়েছিল! যদি আগুনের শিখায় কাঁচ ফেটে যায়! ওই ভয়টা! ভয়টাও ওদের পোর্টফোলিওতে চাই। মনে মনে নোট করে পৃথা। হয়ত এক্ষুণি কাজে লাগবে না। কিন্তু ইটস ইউনিক। কিছুটা না-জানা, ফ্লেম প্রুফ ব্যাপারটাই মা বোঝে না, কিছুটা মেয়েকে সব বিপদ থেকে বাঁচিয়ে রাখতে চাওয়া, সব কিছুর একটা পারফেক্ট পাঞ্চ। ... ...
পারমিতার অবিশ্বাস্য লাবিয়ার তুলতুলে কুচুরমুচুর গোলাপি অনায়াস ঠোঁটের মাঝে চারভাঁজ করা দুটো দু’হাজার টাকার করকরে পিঙ্কি-পিঙ্কি নোট কালো বেঁটে কদমছাঁট চাপদাড়ি সোনার বোতাম হাফকুর্তা হেটোধুতি কুলীন খদ্দের চার্বাক টিরিনচাগা (বংপুং) গুঁজে দেবার পর ব্যাপারটা স্পষ্ট হল গলা খ্যাঁকারির পর দরোজায় তিনটে টোকা পড়তে ফুলকলি ওরফে নিভা ওরফে রানি ওরফে মৌসুমী ওরফে পারমিতা সন্ধ্যা হলে যার নাম রোজই পালটে যায় ... ...
"আদ্যাশক্তি মহামায়া" বা "দুর্গা দুর্গতিনাশিনী" এইসব নামে ছবি হত এককালে। আরো অনেক ছবিতেই মা দুর্গা থাকতেন। মাটির মূর্তির পেছন থেকে জলজ্যান্ত মা দরকারে অদরকারে আসতেন। কিছুটা আবছা মনে আছে। কারণ সেইসময় আলেয়া সিনেমা নামে একটি হল ছিল আর দিদু ম্যাটিনি শো' তে নাতনীকে নিয়ে আদ্যাশক্তির শক্তি দেখতে যেতেন। আমার কিন্তু মনে আছে "অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি"। তনুজা গরদ পরে বেশ বাংলার বধূ হয়ে পিদিম জ্বালাচ্ছেন, গ্রামের লোক ঘরে আগুন লাগাচ্ছে, অ্যান্টনি বাইরে বাইরে কবিগান করে বেড়াচ্ছেন। দুর্গাপূজা এইছবিতে ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল না। একটা ইস্যু ছিল। যে ফিরিঙ্গির বাড়িতে তার একদা বাঈজী এখন বধূ দুর্গাপূজার আয়োজন করতে পারে। এটা, এখন মনে হয় একটা গুরুত্বপূর্ণ বৈপ্লবিক ঘটনা। দুর্গাপূজার একটা বিশাল সামাজিক দিক আছে। একটা প্রিজম যেন। অনেক অনেক আলোর বিচ্ছুরণ। তার কিছুটা অ্যান্টনি সাহেবের দুর্গাপূজার আয়োজনে ধরা পড়ে। তাও প্রায় একক আয়োজন। সেটা কতদূর সম্ভব জানি না। মানে কে তাঁকে প্রতিমা গড়ে দিল? কেই বা জোগাড় দিল এই বিশাল পূজার? তবু নাহয় গল্পের খাতিরে মানা গেল যে স্বামী স্ত্রী মিলে একটা যেন আনন্দোৎসব করছেন, ঘটনা তো আসলে উত্তমকুমার। ... ...