নব্বই সালের পর বিশ্ব রাজনীতিতে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। সে পরিবর্তনের আঘাত এত দ্রুতগতি সম্পন্ন ছিল যে বিশ্বের তাবড় বড় অনেক রাষ্ট্র ঝাপটে পড়েছে। অর্থনীতি মুচড়ে গেছে। রাষ্ট্রের সীমানা আর জনগণের নাগরিকত্ব বদলের সঙ্গে সঙ্গে দেশহারা হয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। পুঁজিবাদ নিপাত যাক বলে লাল ঝাণ্ডার পাণ্ডারা আর ফান্ডা দেখাতে পারছে না। বিপ্লব হিমঘরে। নেতাদের চরিত্র পালটে সম্পূর্ণ বিপরীতে এসে ঠেকেছে। সমাজতন্ত্র ভাগাড়ে আর ধর্মনিরপেক্ষতার মরণ হয়েছে। গণতন্ত্র সেজে উঠেছে ভোগবাদী আভিজাত্যে। এর সঙ্গে ধম্মো ধম্মো বোল উঠেছে আকাশ বাতাস মাটিতে, নদীতে। আজকাল দেখি অনেকেই স্ত্রী সহবাস, স্বামী সহবাসের দোআ মুখস্থ করার পাশাপাশি হাগতে যাওয়ার দোআও মুখস্থ করে ফেলছে। মন্দিরা শঙ্খ বাজিয়ে তিন বেলা সাড়ম্বরে পূজা করছে। পাঁচ বেলা পড়ে নামাজ পড়ে কপাল ঘষে ঈমানী ছাপ বসাচ্ছে। তবে ধর্ম যত জোরে শোরে দেশে দেশে, জাতিতে জাতিতে, ঘরে ঘরে, ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে দাঁত শূলাচ্ছে তারচে বেশী জোরে নৈতিকতা পালিয়ে গেছে। মানুষ বেশি বেশি মুসলমান হয়েছে। বেশি বেশি হিন্দু হয়ে গেছে। ... ...
রাঢ়ের এই অঞ্চলের অতীতের ইতিহাস আমরা মঙ্গলকাব্যগুলোতে পাই। ... তারা কি দুর্যোধনের মত মারাত্মক? ব্যাপক সামাজিক ধ্বংস, হত্যালীলার নায়ক? মাহুদ্যা আর ভাঁড়ুদত্তের মধ্যে প্রথম জন কেমন যেন মাথা গরমের, আর দ্বিতীয় জন লোভী, কুচুটে। যারা ঝিল বোজাতে চায়, তারা ব্যাপকভাবে অন্ধকারের মানুষ এমনটা নয় কিন্তু! চরম ধ্বংসাত্মক মনোভাব এখানকার মানুষের তেমন নেই। উচ্চকিত মন্দ নেই, গড়পরতা ভাল, গড়পরতা মন্দ।” বলতে বলতে আচমকা হেসে ফেললেন তিনি। বললেন, “তোমরা যদি কখনও উপন্যাস লেখ, এই এলাকার পটভূমিতে মহৎ উপন্যাসের সাদা মানুষ কালো মানুষ নিয়ে মুশকিলে পড়বে। আপাদমস্তক “কালো” মানুষ বোধহয় আঁকতে পারবে না, যদি বাস্তব থেকে চরিত্র খোঁজো। আবার সব ভাল মানুষের পো যদি সেই লেখার চরিত্র হয়, তবে পাঠকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হবে না নিশ্চিত। কৃত্রিমতার অভিযোগ উঠতে পারে কিন্তু! ... ...
য়োখেন আমার গভীর সংশয়ের আখ্যান শুনে বললে, জ্ঞান দিও না। .... এই যেমন তোমরা সিটি ব্যাঙ্ক থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে ডলার যোগাড় করে আফ্রিকার ঘানা কোকো বোর্ডকে ধার দিচ্ছ, আর সেটা ফেরত পাচ্ছ কোকো বোর্ডের নেসলে প্রমুখ খ্যাতনামা ইউরোপীয় চকোলেট প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে। ঘানা কোকো বোর্ডকে চেনে দুনিয়ার কোন বান্দা? কিন্তু এক বিলিয়ন ডলার দিতে বাজার পিছপা হচ্ছে না – কারণ তারা চেনে নেসলেকে, যারা কোকো থেকে চকোলেট বানায়। কোকো গেছে নেসলের ঘরে। তোমার আমার ছেলেমেয়ের দাঁতের সর্বনাশকারী চকোলেট বেচে তারা ঠিক টাকা দেবে। আমরা সেরকম একটা কিছু করতে চাইছি। ... ...
সৌম্য বলল, “এটাকে আসলে বলে ইন্টার্নালাইজড হোমোফোবিয়া। অনেক হোমোফোবিক মানুষ আসলে নিজেরাই গে বা লেসবিয়ান। নিজেদের ওরিয়েন্টেশনকে ঢাকতে এরা ওভার কম্পেনসেশন করে আরো বেশি বেশি হোমোফোবিক হয়ে যায়। এরা সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকে, যে যদি এরা কুইয়ার মানুষজনকে সাপোর্ট করে, তবে লোকে এদের কুইয়ার ভাববে। তুষারবাবুও তাদের মধ্যে একজন। তার সাথেই ছিল কনজারভেটিভ ভোটব্যাংক হারানোর ভয়। সব মিলিয়ে উনি ওই রকম হোমোফোবিক হয়ে উঠেছিলেন। তবে শুধু তুষারবাবু নন, মনে রাখিস আমাদের পলিটিশিয়ানদের অনেকেই এর শিকার। আমি ধরে ধরে এরকম বেশ কয়েকজন পলিটিশিয়ানের নাম বলে দিতে পারি। বিশেষত দিল্লি আর ব্যাঙ্গালোরের। আর আনন্দের মত এরকম অল্পবয়সী, আকর্ষক ছেলেরা এইসব হাই এন্ড ক্লায়েন্টদের গোপনে সার্ভিস দেয়, ফর সাম ক্যুইক ক্যাশ। অল গোজ ওয়েল যতক্ষণ না কোনও গোপন ক্যামেরায় কিছু রেকর্ড হয়ে যায়।” ... ...
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহের 'লালসালু' পড়লেও বোঝা যায়, মানুষের আসল ধর্ম বেঁচে থাকা। ধর্মব্যবসায়ীরা তাকে বদলে ধর্মান্ধ করে তুলতে চায় ধান্দায়। গ্রামে ধর্ম ছিল ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি ছিল না। ১৯৭০ এ গ্রামে কোনো মসজিদ ছিল না। ২০২০র আগে গ্রামে আলাদা করে কোনো স্থায়ী দুর্গামন্দির ছিল না। গ্রামে একটা ছোট্ট শিবমন্দির ছিল। গাজন বা চড়কে হিন্দু মুসলমান সবাই অংশ নিত। বারোয়ারি পুজো একটা ছিল। দুর্গা নয় ওলাইচণ্ডী পূজা। তাকে ঘিরে মেলা যাত্রা হতো। হিন্দু মুসলমানের মিলিত উৎসব। তালবড়া, তালের ফুলুরি জেলার খাওয়া হতো তার সঙ্গে কৃষ্ণের কোনো সম্পর্ক আছে কলকাতা না এলে জানতে পারতাম না। গরিব মানুষ তো ভাদর আশ্বিন মাসে তাল খেয়েই বেঁচে থাকতেন। তাল আর শাকপাতা। ভাত, আলু ডাল তো দূরের কথা জুটতো কতজনের? সামান্য জাও বা ফ্যানভাত জুটলেই তাকে উৎসব বলে মনে হতো অনেকের। মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মানোয় খাওয়ার কষ্ট পাইনি। কিন্তু অনেকের তো দেখেছি। ... ...
সবার মুখের ওপর চোখ বুলিয়ে রজত বলতে থাকল, “পৃথাদেবীর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে ধারণা পেতে আমি ওঁর সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইলগুলো খুঁটিয়ে দেখা শুরু করলাম। সেটা করতে গিয়েই ইনস্টাগ্রামে দেখতে পেলাম তুহিন আর পৃথার মানালি বেড়াতে যাওয়ার ছবি। খুব আনন্দে ভরা ছবি সব। আর সেই সব ছবির মধ্যেই আমার চোখে পড়ল আরেকটা জিনিস। চৌঠা নভেম্বরের ছবিতে পৃথার হাতে ছিল ওদের বিয়ের আংটি, যে আংটির ছবি এই ঘরে টাঙানো ছবিতে রয়েছে। পাঁচই নভেম্বর আঙুল খালি। ছয় নভেম্বর ওই আঙুলে আবার আংটি ফেরত এল। কিন্তু এবার অন্য আংটি। তবে দেখতে অনেকটা আগেরটার মতনই। ফলে খুঁটিয়ে না দেখলে সবার চোখে চট করে ধরা পড়বে না। কী মহেশবাবু, ওই দিনই তো আপনাদের ইনফর্ম্যাল এনগেজমেন্ট ছিল, তাই না?” ... ...
বাবার গাল শক্ত হলেই আমি সাধারণত দৌড় দিতাম। আজ অসতর্ক। পেয়েছে। কিন্তু চড় খেয়েই সজাগ হয়ে, দে দৌড় দে দৌড়। ৫০০ মিটার দৌড়ে এসে ধরেছে। ধরেই গলায় পা, তোকে আজ মেরেই ফেলবো। আমি কাঁদছিও না, ছাড়তেও বলছি না। চুপ করে শুয়ে আছি। এদিকে পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। আমি ক্লাসের ফার্স্ট বয়। কোনোদিন স্কুল কামাই করি না। পরীক্ষা দিচ্ছি না। মোবাইল না থাকলেও সেযুগেও খবর বাতাসের চেয়ে দ্রুত ছড়াত। খবর পেয়ে হেডমাস্টার মশাই এসে গেলেন। বাবা ছাড়বেন না, ওর খুব অহঙ্কার। আমি চাই ফেল করুক। আমি ওর মধ্যেই বলছি, ইতিহাসে আমি কোনোদিন ফেল করবো না। বাবা বললেন, তোকে যেতেই দেবো না। এদিকে অন্য শিক্ষকরাও হাজির। আধঘন্টা পর হলে গেলাম পরীক্ষা দিতে। ধুলোটুলো ঝেড়ে। স্যাররাই কেউ কলম এনে দিলেন। এই বাবার মতো অসাধারণ মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। ... ...
যতদূর শুনেছি গলা (গোলাস) খোলার অধিকার বা বাক স্বাধীনতার নাম গ্লাসনস্ত এবং পুনর্গঠন বা পুনর্নির্মাণের নাম পেরিসত্রইকা। অভিপ্রায় নিঃসন্দেহে ছিল সাধু – কেন্দ্রীয় নির্দেশ দ্বারা ব্যক্তিকে উপেক্ষা করে সমষ্টির শুভ সাধনা করার যে আপাত প্রয়াস চলে এসেছিল স্তালিনের সময় থেকে, সেটির ব্যর্থতা স্বীকার করলেন গরবাচভ। লক্ষ্য – এক স্বচ্ছ সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলে দেশের নবনির্মাণ ব্রতে ঝাঁপিয়ে পড়া। এবার ব্যক্তি তার মত প্রকাশের অধিকার পেল। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ, মতান্তরে কেজিবি নিরুদ্দেশ। অন্ধের নগরী, চৌপট রাজা। বাজার থেকে অদৃশ্য হল খাবার। ১৯৯০-এর আগে লাইন দিলে কিছু জুটত। যদিও মস্কোর বাজারে একটা রসিকতা চালু ছিল – কোথাও লাইন দেখলেই মানুষ দাঁড়িয়ে পড়তেন, পরে জানতে চাইতেন এটা কিসের লাইন। জনজীবন বিপর্যস্ত, তার কিছুটা আগেই দেখেছি সেন্ট পিটার্সবুর্গে। ... ...
আমার ভাবনা ছোটো চাষীদের নিয়ে। একদিক থেকে দেখলে তাদের এখনো কিছু স্বাধীনতা আছে জানো। তারা চাষবাস এখনো অনেকটা বৈচিত্র্যময়। ফসলচক্র মেনে চলে মোটামুটি। সার বিষের ব্যবহার খুব কম করে। এরকম চাষীর সংখ্যা অবশ্য কম। অনেকেই বাজারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ধীরে ধীরে কৃষি পাঠশালায় ডেকে এনে সকলে মিলে বুঝতে চাইছি যে সার বিষ ছাড়া চাষ সম্ভব। তাতে খাবার খরচ, স্বাস্থ্য খাতে খরচ অনেক কমে যাবে। চাষীরা অনেকটাই বোঝেন। সমস্যা তাদের অন্য জায়গায়। তাদের একটু আর্থিক সুরক্ষা প্রয়োজন কারণ মাটির স্বাস্থ্য খারাপ হলে ঠিক হতে সময় লাগে। সেসময় ফলনে সমস্যা হতে পারে। রোজগার কমে যাবে। সেই সময়টুকু তাদেরকে কে সাহায্য করবে? পুরো বাজারটাই তো উৎপাদক বিরোধী। ... ...
অনেক দিন পর কবিতা বেরোল হাত থেকে। বেশ কয়েকবার কবিতাটা পড়ে কাজি নিজে। বেশ হয়েছে, ভালই হয়েছে!– নিজের মনেই বলে কাজি, তারপর ব্যাগ থেকে বের করে একটা লুঙ্গি। মাথা দিয়ে গলিয়ে দেয় লুঙ্গিটা, এবার জামাকাপড় বদলিয়ে পুকুরে নামবে সে। এমন সময় দ্রুতপদে দেখা যায় দুলিকে, সে আসছে পুকুরের দিকেই, নিশ্চয়ই তাকেই ডাকতে আসছে। একটু অপেক্ষা করে কাজি, দুলি এসে পৌঁছোয়, তাড়াতাড়ি আসায় একটু জোরে জোরে শ্বাস টানছে সে। কাজি বলে, আমি একটা ডুব দিয়ে আসি, তু্মি ততক্ষণ পড় এই কবিতাটা, খাতাটা দেয় দুলির হাতে। ... ...
দু’দিকে দুটো লোক – সামনে আর পিছনে দুটো হ্যাজাক ধরে আছে। মালকোঁচা মেরে পরা ধুতি বা গামছা, প্রায় আধ-ন্যাংটা কালোকোলো সন্ন্যাসীরা পরস্পরের এক হাত আর তাদের হাতের দণ্ড ধরে অর্ধ গোলাকৃতি একটা বেড় তৈরি করেছে। নাচছে ভূতের মত। মাঝে মাঝে – বল গঙ্গাধরের চরণের সেবা লাগি, বল তারকনাথের চরণের সেবা লাগি মহাদেব – ইত্যাদি শিবের নানান নাম করে টেনে টেনে বলে চলেছে। যেটা সবচে’ আশ্চর্য লাগে, তা সন্ন্যাসীদের অমন গলা ছেড়ে মহাদেব – ডাকও নয়, ছায়া-ছায়া ভূতুড়ে নাচও নয়। আশ্চর্য হল – সেই বেড়ের মাঝখানে আমাদের ক্ষুদিরাম মাস্টারমশাই যে! এবং তিনি নাচছেন! এগিয়ে – পিছিয়ে। তিনি তাড়াতাড়ি সামনে এগিয়ে পথ শেষ করতে চাইছেন, কিন্তু সেই উপবাসী, আধন্যাংটা সন্ন্যাসীরা – কোথা থেকে এত জোস পেল কে জানে, তারা কিছুতেই এগোতে দিতে চায় না। সামান্য পথ আসতেও তাই দীর্ঘ সময় লাগে। রাগী, ছাত্র-পেটানো অথচ ছাত্র-দরদী, স্নেহ বৎসল মাস্টারমশাই-এর সব গাম্ভীর্য ওই গাজনের সন্ন্যাসীরা ঘুচিয়ে দিয়েছে। ধুলো হয়ে উড়ছে হ্যাজাকের আলোয় – তাঁরই অটল গম্ভীর মুখোশখানা। ... ...
সৌম্য বলল, “ওয়েট ওয়েট। একটু ধৈর্য ধরুন। বলছি। তবে তার আগে বলি, আমন মানে হল শান্তি। তুহিন ওর ধাঁধায় আমাদের বলেছে যে যদি কখনো তদন্তের প্রয়োজন পড়ে তাহলে আমরা যেন আমনকে খুঁজি। খুঁজব কোথায়? সেটারও ক্লু ও দিয়ে রেখেছিল। বলেছিল জীবনে শান্তি খুঁজতে। আনন্দ শর্মা ওরফে আমন উঠেছিল জীবন লজেই। তুহিনের কোনও কারণে মনে হয়েছিল যে আমাদের হয়তো যখন তদন্তের প্রয়োজন হবে তখন আমাদের ক্লু দিতে ও আর এই পৃথিবীতে থাকবে না। কিন্তু ও সেই ব্যাপারে সিওর ছিল না। তাই পৃথাকে সব কিছু খুলে বলে নি ওকে মিছিমিছি চিন্তায় ফেলবে না বলে। কিন্তু ও যদি নিজের বিপদ বুঝেই ছিল তাহলে জীবন লজে গেল কেন?” ... ...
পড়া হতো। তার চেয়েও গল্প হতো বেশি। এই গল্পই একবার আমার প্রাণ বাঁচায়। পূজার ছুটি। কলেজ হোস্টেলে আমি একা। জ্বর চলছিল। বিকেলের দিকে মনে হল জ্বর ছেড়েছে। গায়ে হাত দিয়ে কোনো উষ্ণতা টের পাচ্ছি না। বিকেলে হোস্টেলে ফিস্ট। কৌশিক লাহিড়ী কৌস্তভ সায়ন ওদের আসার কথা। শরীরটা খুব দুর্বল লাগছে। কৌশিক এলো সবার আগে। এসে দেখে বলল, বাবুর্চি সাহেব, শুয়ে কেন? বললাম, জ্বর এসেছিল। এখন নেই। কৌশিক তখন ডাক্তারি পড়ছে। গায়ে হাত দিয়ে বলল, গা তো জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে ছোটাছুটি। ... ...
রজত যখন তুহিনদের বাড়ি গিয়ে পৌঁছল, তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামছে। তুহিনদের বাড়িতে এখনো একটা চাপা শোকের ছায়া। রজত চারিদিকে তাকিয়ে দেখল। ঘরটা প্রথম দিনের মতই আছে। শুধু দেওয়ালে ঝুলছে তুহিনের একটা হাসিমুখের বড় ছবি। গলায় রজনীগন্ধার মালা। রজত বসার খানিক পরে ঘরে ঢুকল পৃথা। আজকে পরনে একটা হাল্কা সবুজ রঙের চুড়িদার, সাদা ওড়না। চেহারায় শোকের ছায়া অনেকটা কম। সম্ভবত খানিক আগেই স্নান করে বেরিয়েছে। রজত লক্ষ্য করে দেখল, চুল থেকে এখনও অল্প অল্প জল ঝরছে। ... ...
যে পানীয় প্রস্তুত করার গৌরবে এ দেশ অমরত্বের দাবি রাখে, অকস্মাৎ ছোট ছোট গ্লাসে রাশিয়ার সেই শ্রেষ্ঠ পানীয় আমার সামনে উপনীত হল। গ্লাসের আকৃতি দেখে ভাবলাম, ভদকা তুমি এত ছোট কেনে? সকলেই সেটি দ্রুত পান করলেন। গ্লাসগুলি টেবিল থেকে অদৃশ্য হল মুহূর্তের মধ্যে। গরুর ঘাস থেকে মানুষের স্টেজে উঠলাম। এবার আগমন আলুসেদ্ধ গোছের কিছু, তার সঙ্গে বাঁধাকপি। সেগুলো টেবিলে রাখা হয়েছে কি হয়নি, কে বা কারা আবার আমার সামনে হাজির করলেন ভদকার ছোট গ্লাস। মানে কী? এঁরা কি এইভাবে কিস্তিতে কিস্তিতে ভদকা পান করেন? প্রশ্নটা ডাক্তার সাহেবের জন্যে জমিয়ে রাখলাম। ... ...
একদিন ক্ষুদিরাম মাস্টারমশাইএর পাঠশালায় পড়তে গেলাম। তিনি গাঁয়ের ভেতর শিব মন্দিরের গায়ে একটা চাতালে পড়ান। আমাদের বাড়ির কাছাকাছি সেটা। তার আগে হাতেখড়ি হল ক্ষুদুবাবুর কাছে। পিসি আর কাকু আমায় নিয়ে গিয়েছিল ওঁর বাড়ি। নিশ্চয়ই সেটা সরস্বতী পুজোর দিন। আমার ঠিক মনে নেই। ঠাকুমা পিসির হাতে সিধে পাঠাল। একটা পাথরের থালায় আতপ চাল, আনাজ আর ষোলো আনা পয়সা। কাকুর হাত ধরে গেছি। আমার বগলে শ্লেট, হাতে পেনসিল। এরপর ওঁর কাছে একদিন আসন বগলে পড়তে গেলাম গ্রামের ভেতরের শিবতলায়। মাস্টারমশাই যেন স্বয়ং যমদূত! সেই যমদূত যদি ভিক্টিমের জাগ্রত অবস্থায় হাতে ডাঙশের বদলে মার্বেল গুলি আর মণ্ডা-মিঠাই নিয়ে যমপুরীতে নিয়ে যাবার জন্য আসে, তাহলেও ছেলের দল নির্ঘাৎ মাটিতে পায়ের আঙুল পুঁতে দিয়ে শরীরটা শক্ত করে পিছন দিকে ঠেলুনি দিয়ে পরিত্রাহি চিৎকার ছাড়ত “আমি যাব না গো–ওওওও” বলে! ছেলেদের গাধা থেকে ঘোড়া বানাবার জন্য আর শাসনে রাখার জন্য অভিভাবকেরা সেই যমদূতসম “মাস্টামশায়”-এর কাছেই পাঠাতেন। ... ...
আমাদের গ্রামে ডাকাতি কম হয়েছে। আমার মামাদের বাড়িতে একবার হয়। কংগ্রেসের গোষ্ঠী দ্বন্দ্বের ফসল। বড় মামাকে ডাকাতির নামে মেরে ফেলাই ছিল লক্ষ্য। সবাই জানত, কারা ডাকাতি করিয়েছে, কাদের দিয়ে, কিন্তু কিছু প্রতিকার হয়নি। বড়মামা সেদিন 'নীলরক্ত' যাত্রা শুনতে তিন কিলোমিটার দূরের বুড়ুল গ্রামে গিয়েছিলেন। এই ঘটনার পর মামার বাড়িতে দু নলা বন্দুক এল। কোনা বলে গ্রামের কংগ্রেসের এক বড় নেতা ডাকাতদের আসল সর্দার। আমাদের গ্রামের কয়েকজন ছিল আলাদা ডাকাত দলে। যে বন্দুক দিত, ডাকাতির ৫০% টাকা তার। পরে ডাকাতি আমাদের এলাকায় উঠে যায়। ১৯৭৭-এ বামফ্রন্ট সরকার আসার পরে। তার আগে ডাকাতির খুব ভয় ছিল। ডাকাতি ছেড়ে দেওয়া একজন মানুষ আমাকে খুব ভালোবাসতেন। আমিও তাকে খুব পছন্দ করতাম। অনেক ডাকাতির গল্প শুনেছি। কিন্তু সব লিখতে পারব না। ডাকাতের দলে থাকা লোকদের ছেলেমেয়েরা কষ্ট পাবে। ... ...
জীবন লজের বাইরে দাঁড়িয়ে, দিব্যেন্দুকাকুর সাথে ফোনে কথা বলা শেষ করে, সিগারেট ধরিয়েছিল সৌম্য। ফাঁকা রাস্তা দেখে এক হাতে রজতের ঘাড়ে আঁকিবুঁকি কাটছিল। হঠাৎ একটা গাড়ি প্রচণ্ড জোরে কোথা থেকে এসে হুশ করে বেরিয়ে গেল। শেষ মুহূর্তে রজত সৌম্যকে ধরে এক ঝটকায় সরে না গেলে একটা বড়সড় অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে যেত। রজতের মুখ আতঙ্কে সাদা হয়ে গিয়েছিল। একটু সামলে নিয়ে বলল, “আমাদের কেউ খুনের চেষ্টা করছে।” সৌম্য মৃদু হেসে বলল, “এগুলো রাতের শহরে বড়লোকের বখাটে ছোঁড়াদের কাজ। রাত বাড়লে সবাই সলমন খান হয়ে যায়।” রজতকে এই বলে প্রবোধ দিলেও সাদা ইনোভার পাশের আঁচড়ের দাগটা সৌম্যর চোখ এড়ায়নি। অর্থাৎ কেউ এখন আর শুধু ওদের ওপর নজর রেখে ক্ষান্ত দিচ্ছে না, সরাসরি খুন বা আহত করার চেষ্টা করছে। ... ...
আমার দেখা প্রথম টিভি, টেপ রেকর্ডার, এইচ এম ভি ফিয়েস্তার কলের গান, মোটর সাইকেল--সব কালামদের বাড়িতে প্রথম। টিভি আর ভিডিও দেখতে ওদের খামার লোকে লোকারণ্য হয়ে যেতো ১৯৮২ তে। ১৯৭৮/৭৯ ঠিক মনে পড়ছে না, টেপ এলো। শোলের গব্বর সিংয়ের সংলাপ শোনা যাচ্ছে। বিরাট ব্যাপার। আমাদের নিজেদের গলাও শোনা যাবে! লাইন পড়ে গেল। আমিও পচাশ পচাশ মাইল সে, আমজাদ খানের সংলাপ বলে নিজের গলা শুনে চমকিত। ... ...