মহাত্মা গান্ধীর রাজনৈতিক, দার্শনিক এবং জীবনবোধের বিশিষ্টতা এমন সর্বব্যাপী যে তাঁর এ দিকগুলোকে নিয়ে চর্চা অনেক উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক, সমাজতাত্ত্বিক এবং দার্শনিকেরা করেছেন। এদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে দুটি বিষয় সহজেই চোখে পড়ে – প্রথম, তাঁর ধারণায় ও বীক্ষণে অহিংসার স্থান এবং দ্বিতীয়, তাঁর লেখা “হিন্দ-স্বরাজ” পুস্তিকাটি ও এ পুস্তিকায় নিহিত ধারণার ব্যাপ্তি। তুলনায় গান্ধীর বোধে মেডিসিনের দৃষ্টিকোণ থেকে চিকিৎসা, দেহ, দেশজ চিকিৎসা, জনস্বাস্থ্য ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা কম। ... ...
১৯০২ এর সেপ্টেম্বরে, মৃত্যুর মাস তিনেক আগে, কাশ্মীরে থাকাকালীন,কর্নেল জেমস টডের ‘অ্যানালস অ্যান্ড অ্যানটিকুইটিস অফ রাজস্থান’ বইটি দেখে সহচরদের বিবেকানন্দ বলেছিলেন, “বাঙলার আধুনিক জাতীয় ভাবসমূহের দুই তৃতীয়াংশ এই বইখানি হইতে গৃহীত।” ভুল কিছু বলেননি। রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে মাইকেল মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র হয়ে জ্যোতি-রবি-অবন ঠাকুর, কার কল্পনাকেই-বা প্রভাবিত করেনি টডের বই-এর মুসলমান শাসকদের বিরুদ্ধে রাজপুত পৌরুষ ও নারী সতীত্বের আপোষহীন লড়াইয়ের চিত্র? ‘কেতুনপুরে বকুল-বাগানে/কেসর খাঁয়ের খেলা হল সারা।/যে পথ দিয়ে পাঠান এসেছিল/সে পথ দিয়ে ফিরল নাকো তারা’ পড়েছি রবীন্দ্রনাথের ‘হোরিখেলা’ কবিতায়। “বিধর্মী শত্রু সোনার মন্দির চূর্ণ করে বল্লভীপুর ছারখার করে চলে গেল,” পড়েছি অবন ঠাকুরের রাজকাহিনীতে। ... ...
অনেক দূরের যে দুর্গ সেদিন দেখা হয়নি, জুন মাসের এক সূর্যকরোজ্বল দিনে তার প্রাকারে দাঁড়িয়ে ওলেঙ্কা আমাকে ব্লেদ লেকের আখ্যান শোনাচ্ছিলেন। ব্লেদের দুর্গ হাজার বছর আগে জার্মান সম্রাট দ্বিতীয় হাইনরিখের বানানো। ‘আহা, ১৮৭১ সালের আগে জার্মানদের কোনো দেশ ছিল না গো’ এই গল্প আমরা করে থাকি, কিন্তু ভুলে যাই যে তথাকথিত পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য আসলে ছিল একটি বিশাল জার্মান জমিদারি – সেখানে দাগ ও খতিয়ান নম্বর আলাদা করা ছিল না এই মাত্র। প্রত্যেক সম্রাট জার্মান। তারা সুন্দর জায়গা পেলে মহল বানান, উঁচু জায়গা পেলে প্রতিরক্ষার জন্য দুর্গ। ব্লেদ এই দুইয়ের আশ্চর্য সমন্বয়। ... ...
ছাত্র ফেডারেশনের হয়ে সদস্য করতে বা ক্লাস ডায়াসিংয়ে গেলে গভীর চোখে তাকাত শোভা। ২৫ পয়সা দিয়ে এসএফআই-য়ের সদস্য পদ নিয়েছিল সবার আগে। সে সময় ২৫ পয়সা অনেক। তিনটে চপ বা পাঁচটা আইসক্রিম হতে পারতো। একটা পাঁউরুটির দাম তখন ১৫ পয়সা। বাপুজী কেক তখন বাজারে আসেনি। আরামবাগের পপুলার বা কোহিনূর কেকের দাম ২০ পয়সা। শোভা এখন ঝাড়া হাত পা। বর অবসরে। বন্ধুদের গ্রুপে কবিতা লেখে আর সবাইকে তাগাদা দেয়, চলো দেখা করি। সে এক্কেবারে তিনদিনের দীঘা ট্যুর ফেঁদেছে। কয়েকজন জুটেও গেছে। প্রসেনজিৎ রায়, সস্ত্রীক নবকুমার, সস্ত্রীক রমেশ, সস্ত্রীক আজম, সস্ত্রীক পীযূষ, নন্দিনী, মালা। প্রসেনজিৎ চুপচাপ ছেলে। পুনর্মিলনে বিরাট ভুমিকা নেয় অনন্তদা, জ্যোতির্ময়, সুবীর রক্ষিতদের সঙ্গে। ... ...
সব ধর্মেরই ধর্মীয় গোঁড়ামি কাজির অপছন্দ, সমাজের নানা রকমের মনুষ্যকৃত ভেদাভেদের সে বিরোধী, সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে অক্ষম বা দুর্বলের উপর দমননীতির বিবর্তিত কায়দা-কানুনগুলো ধ্বংসের জন্যে লড়াই করতে সে সদাপ্রস্তুত; মানুষের প্রতি ভালোবাসা তার সীমাহীন, এবং তাই সে স্বাধীনতার লড়াইয়ে সৈনিক হয়েছে, অথচ নির্দিষ্ট কোন আদর্শের পথে অবিচলিত পথিক কোনদিনই হতে পারেনি। গান্ধীর মতাদর্শ অনুসরণ করে সে লড়াই করেছে যেমন, বাঘা যতীনের পথ বা বলশেভিকদের পথও তাকে অনুপ্রাণিত করেছে। সাম্যের গান গাইতে গাইতে যখন সে শ্রমিক-কৃষকের লড়াইয়ে অংশ নিচ্ছে, শ্রমিক-শ্রেণীর আন্তর্জাতিক সঙ্গীতের বাংলা-অনুবাদ করছে, ঠিক তখনই কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় মুসলমানদের জন্যে সংরক্ষিত আসনে কংগ্রেস-প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেও তার অসুবিধে হয়নি। ... ...
আমি দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলাম, ''ক্যা সচ হ্যায়? '' দোকানদার কোন উত্তর দিল না। আমাদের মালপত্র গুছিয়ে দিয়ে একটা প্লাস্টিকের কাগজের ব্যাগে ভরল। তারপর টাকার হিসেব করছিল। লোকটা মাঝবয়সী আর মাঝবয়সীদের প্রত্যয় ওর ছিল আরো নানা কিছু ছিল যা দোকানটার আনাচে কানাচে ভরা তাকে মালপত্রের মধ্যে ছড়ানো ছেটানো। তার গন্ধ কি সারা দোকানটায় ছড়িয়ে রয়েছে? সেই গন্ধ আশপাশের জঙ্গলের দিকে রওনা দেওয়ার আগেই আমাদের লেনদেন শেষ হয়ে গেছে। বাঘ আসল না নকল বাঘ, আদমখোরের গল্পটা লোকমুখে ছড়িয়ে থাকা গল্প না আসল কথা, সে সব দোকানদাররের কাছ থেকে যাচিয়ে নেবার কোন অবকাশ না পেয়ে আমরা আবার মালপত্র নিয়ে রিসর্টের দিকে রওনা দিলাম। ঠিক যে ভাবে এসেছিলাম সেভাবে রাস্তা দিয়ে ফেরার সময় আবার রাজ বাতাস শুখতে থাকে। বারবার শোখে । আমি জিজ্ঞেস করি, বাঘা জিজ্ঞেস করে, 'কিছু পেলি?' রাজু কোন উত্তর দেয় না। তারপর ওরা দুজনে দাঁড়িয়ে পড়ে একটা কালভার্টের ওপর জলেদের যাতায়াত দেখে। একটু পেছনে থাকি আমি আর পার্থ। ... ...
অ্যাটলাস ছাতার কল্যাণে আমি কাকভেজা হতে বেঁচে গেলেও, মুসার মা আর বড়দাদী ভিজে স্নান করে উঠেছে। বৃষ্টির তোড় বেড়েছে আরও। তাই ভাদুড়ী বাড়ি ছেড়ে দ্রুত পায়ে বড়দাদী নিজের বাড়ি গিয়ে উঠলো আর মুসার মা ঢুকে পড়লো আমাদের কলঘরে। বারান্দায় আজ বৃষ্টিভেজা বাতাসে কেরোসিনের স্টোভে নীল আঁচ উঠছে এলোমেলো। সেই আঁচে বসেছে থোড়ের ঘণ্ট। আর হবে আলুর ঝুড়ি ভাজা, পাঁচ ডাল। খুব অল্প আয়োজন আজ দুপুরের খাবারে। ... ...
দশম দিন সকালে আমি দলের সবাইকে আশ্বস্ত করলাম যে আমরা খাবারের কাছেই আছি; অঢেল খাবারের প্রতিশ্রুতি তাদের মধ্যে বিনীতদের উত্সাহিত করেছিল। আমার ধৈর্যের পরীক্ষা না নিতেও সতর্ক করা হয়েছিল - পাছে আমি রাগের মাথায় মেরে বসি! তাতে সবথেকে পাজিগুলোকে চুপ করানো গিয়েছিল। তারপর বনের মধ্য দিয়ে উত্তর-ঈশান দিক বরাবর চললাম। ক্লান্ত মানুষের দল দুর্বলভাবে, বেদনাদায়কভাবে আমার পিছু নিল। খুবই বেপরোয়া অবস্থা তখন, বেচারাদের নিজেদের জন্য যতটা না দুঃখ হচ্ছিল, আমার তার চেয়েও বেশি করুণা হচ্ছিল; আর তারা হাল ছেড়ে শুয়ে পড়লে তাদের সামনে প্রচুর রাগারাগি চেঁচামেচি করলেও, তাদের গায়ে হাত তোলার কথা তখন স্বপ্নেও ভাবিনি। তাদের জন্য খুবই গর্বিত ছিলাম; কিন্তু সেই পরিস্থিতিতে এটা খুবই বিপজ্জনক ছিল। ... ...
ইতিহাসের কোন বিশেষ ক্ষণে এসে ব্যক্তির কণ্ঠের প্রসঙ্গ কি আলাদা গুরুত্ব পায়? কোন বিশেষ ঐতিহাসিক মুহূর্তে ব্যক্তির স্বর কি চাপা পড়ে যায় কৌম কিংবা সমষ্টির কণ্ঠের আড়ালে? রাজনৈতিক ইতিহাসের কোন বাঁকে এসে ব্যক্তির উন্মেষের “discrete identity” একটি “concrete reality” হয়ে ওঠে? উনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপে – “আধুনিকতা” যখন মধ্যগগনে – তখন অন্তত দুটি বিষয় বৌদ্ধিক স্তরে আলোচ্য বিষয়ের তালিকাভুক্ত হল। ... ...
এঁরা কোন সবজান্তা একপক্ষীয় আলোচনা না করে সমস্যার উপর বহুকৌণিক আলো ফেলেছেন। দেখিয়েছেন সমস্ত হাতে গরম সমাধানের সীমাবদ্ধতা। অথচ সবগুলোই প্রাসঙ্গিক। জমির মালিকানার একচেটিয়া অধিকারের ভিত্তিতে সামন্ততান্ত্রিক শোষণ যেমন কৃষির উন্নতির বাধা, কিন্তু আজকে তার চেয়ে বড় বাধা ভারতের কৃষকসমাজের ছোট এবং প্রান্তিক চাষিদের (ভারতে গড় ৮০% এবং বাংলায় ৯০%) জন্য সরকারি ব্যাংকের সেকেলে আইন এবং গরীবকে তাচ্ছিল্য করার সংস্কৃতি; যার ফলে ওদের জন্যে সুলভ সার, বীজ, এবং ট্রাক্টর বা হাল বলদের জন্য ঋণ পাওয়ার দরজা বন্ধ হয়ে থাকে। ... ...
আফ্রিকার সঙ্গে আমার কাব্যিক পরিচয়, আমার চেতনার ঊষাকালে। কোন কোন রোববার, রবি ঠাকুরের সঞ্চয়িতা খুলে আমার পিতৃদেব আমাদের কিছু কিছু কবিতা পাঠ করে শোনাতেন। তার মধ্যে অন্যতম ছিল “আফ্রিকা”। মা বলতেন, “ওইটুকু ছেলে এই কবিতার মর্ম কী বুঝবে?” বাবা বলতেন, “মর্ম এখন নাই বা বুঝল। এই অমোঘ শব্দ-চয়ন, অন্ত্যমিলহীন ছন্দের এমন ঝংকার, বিষয়ের ব্যাপ্তি, নিষ্ঠুর সভ্যতার মুখোমুখি দাঁড়িয়েও এমন মানবিক আবেগ। এগুলোই আপাততঃ ওর মনে বসত করুক না - মর্ম উদ্ধারের সময় তো পড়েই রইল আজীবন”। আমার প্রতি তাঁদের উভয়ের বিবেচনায় এতটুকু ফাঁকি ছিল না। আর বড়ো বিলম্ব হলেও, ওই কবিতার মর্মোদ্ধার হল, হীরেন সিংহরায় মহাশয়ের “আমার আফ্রিকা” গ্রন্থটি পড়ে। ... ...
বাইরে থেকে রোপণ করা বা এনগ্র্যাফটেড আধুনিকতার যে যাত্রা ১৯৪৭ পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রিক উদ্যোগে শুরু হয়েছিল সেখানে সমস্ত ভারতবাসী হয়ে উঠলো নাগরিক, খানিকটা হঠাৎ করেই। লক্ষণীয় যে যেখানে ইউরোপের একটি বড়ো অংশ প্রায় ৩০০ বছর ধরে ধীরে ধীরে জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠেছে, ভারতে তা অর্জিত হয়েছে মাত্র কয়েকটি দশকে। ইউরোপীয় দেশগুলোতে যেভাবে ব্যক্তির অভ্যুদয়, রাষ্ট্রের সাথে ব্যক্তি-নাগরিকের সহাবস্থান, সমাজ বা কৌমের অবস্থান বিলুপ্ত হওয়া এবং সমাজ জীবনে ধর্ম-নির্লিপ্ততার (সেক্যুলারিজম) পরিসর তৈরি হয়েছে ভারতে তা হয়নি। ... ...
আমাদের ভারতবর্ষ যখন ‘আজাদির অমৃত মহোৎসব’-এ বুঁদ হয়ে আছে সেসময়ও কি ভারতের টুকরো হয়ে যাওয়াকে বাদ দিয়ে কোনভাবে লেখা যায় এ দেশের টুকরো হয়ে যাবার কোন কাহিনী? জ্ঞানেন্দ্র পাণ্ডে তাঁর Remembering Partition: Violence, Nationalism and History in India (২০০৩) গ্রন্থের গোড়াতেই দু’টি প্রশ্ন তুলেছেন – (১) সরকারি সহস্র-অযুত বয়ানের মধ্য থেকে ‘ইতিহাস’ কিভাবে ‘সত্য’-কে (১৯৪৭-এর হিংসার সত্যকে) জন্ম দেবে, (২) সেদিনের সেই চরম মুহূর্তগুলোকে আজকের ইতিহাসে কিভাবে “struggle back into history” ঘটাবে? (পৃঃ ৪) এ গ্রন্থেরই অন্তিমে লেখক এক জরুরী প্রশ্ন রেখেছেন – “What would it mean to imagine India as a society in which the Muslim does not figure as a ‘minority’, but as Bengali or Malayali, labourer or professional, literate or non-literate, young or old, man or woman?” (পৃঃ ২০৫) ... ...
১৯৭৭-এ বামফ্রন্ট এল রাজ্যে। দেশে তখন জনতা সরকার। দিল্লিতে বামফ্রন্ট জনতা সরকারকে সমর্থন করছে। রাজ্যে জনতা দল ও কংগ্রেসের সঙ্গে জোর লড়াই। বলাই হয়, ১৯৭৭-এ জনতা দলের প্রফুল্লচন্দ্র সেন এবং সেই দলে থাকা সঙ্ঘ পরিবারের হরিপদ ভারতীরা গোঁয়ার্তুমি না করে কয়েকটি আসন বেশি ছাড়লেই রাজ্যে জনতা দল ও বামফ্রন্টের কোয়ালিশন সরকার হতো। এবং সেই সরকারে জ্যোতি বসু এবং হরিপদ ভারতী দুজনেই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী হতেন। বর্ধমানে কিন্তু জনতা দল, কংগ্রেস, এবং আর এস এস একযোগে সিপিএম বিরোধী। এর প্রতিফলন দেখা গেল, ১৯৮২-র কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচনে। ... ...
মোটের ওপর চন্দ্রদেব এখন মহাজাগতিক বিশ্বের কসমিক সেলিব্রিটি। পেজ থ্রি পুরো কাঁপিয়ে দিয়েছেন। চন্দ্রযানে চেপে মিডিয়ার মেগা প্রজেক্ট এখন চাঁদের বাড়ি অভিযান। paparazziরা এবার সোজা ধাওয়া করেছে টিম নিয়ে। আর কোনো ছাড়ানছেড়েন নেই। চন্দ্রদেব সেখানে বসে বসে ঠিক কী যে করে তা দেখবে, শুনবে আর জানবে বলে। সে পূর্ণিমার আলোয় বসে পা ছড়িয়ে রোমান্টিক কবিতা লেখে না জাল নোট ছাপে? না কী অমাবস্যার অন্ধকারে মেয়েদের ফুঁসলিয়ে প্রেম করে না ড্রাগ পেডলিং করে? চাঁদ বা সোম হয়ত সেখানে বসে illicit সোমরস বানাতে বানাতে মশগুল হয়ে থাকে দ্রাক্ষারসের মদিরায়। সব খোঁজ নেবে ওরা। এমনিতেই অনেক allegations চন্দ্রদেবের বিরুদ্ধে। ... ...
জীবনের অন্ধকারমালাই সুবিমলের পাঠক্রম। খুন, জখম, সন্ত্রাস, ধর্মীয় বিভেদ, বিস্ফোরণ, পুলিশি অত্যাচার অন্যদিকে যৌনতার নন্দনকানন। যৌন মিলনের যে পরম তৃপ্তি তা নারী-পুরুষ উভয়ই ভোগ করে কিন্তু পরক্ষণেই জাগে সামাজিক গ্লানি। এই দ্বন্দ্বই সুবিমলের টার্নিং পয়েন্ট। কেন জাগে পাপবোধ? কেন দঃশিত হয় নরনারীর সামাজিক বোধ, কেন স্বীকার করে না পরকীয়া? কেন মেনে নেয় না জীবনের স্বাভাবিক দাবিকে। এই যে সেক্স করা ও তাকে সামাজিক পরিমণ্ডলে স্বীকৃতি না দেওয়া এই আলো অন্ধকার নিয়ে তিনি আখ্যানের ভেলা ভাসান। এমনকি তিনি মারাত্মক ভাবে চেতনার গান বাজান। তা বিপ্লব হোক বা মধ্যবিত্ত বিবেক হোক। চেতনা না থাকলে নতুন জোয়ার সম্ভব নয় তা কেবল আয়োজন সর্বস্ব। অথচ আজ আয়োজন সর্বস্ব পরিমণ্ডলের রমরমা। উৎসবের ফানুস উড়িয়ে চেতনাহীনতার মধ্য দিয়ে নতুন সৃষ্টির যে ডাক তা যে যথার্থই ভিত্তিহীন তা তিনি প্রয়োগ করে দেখান। সমাজের বিবিধ স্তরের বয়সের নারীর দৈহিক চাহিদাকে সামনে রেখে নারী মনস্তত্ত্বের নিপুণ বিশ্লেষণে অবতীর্ণ হন। এত বড় সমাজ, এত বড় পরিমণ্ডল, এত শ্রেণি, বয়স বিভাজনে সকলেরই কম বেশি যৌনতা আছে। তার নানা রকমফের প্রক্রিয়া, চাহিদা, সম্পর্ক। বেশিরভাগই আড়ালে আবডালে। বিভাজনোত্তর সমাজে নারী পুরুষ পারিবারিক সম্পর্ককে অস্বীকার করে আড়ালে মিলিত হয়েছে। কোথাও ক্লেদ নেই, গ্লানি নেই। আছে এক তৃপ্তির আনন্দ। তার বহুবিধ বয়ান নিয়ে এই আখ্যান। ভাষা আগ্রাসন থেকে জাতি খণ্ডীকরণ, বাঙালির হুজুকে প্রবণতা থেকে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের শূন্য অবয়ব কোন কিছুই নজর এড়িয়ে যায় না। জগাখিচুরি হিন্দি, ইংরেজি মিডিয়াম, বাংলা ভাষা-সংস্কৃতির আদ্যশ্রাদ্ধ, পক্ষ-বিপক্ষে কোন্দল, সংস্কৃতির নষ্টচরিত্র, আধিপত্যবাদের সংস্কৃতি মিলিয়ে দিনের আলোর পরিমণ্ডলের উপর সুবিমল বুলডোজার চালান নিজস্ব ভঙ্গিতে। ... ...
কাঞ্চনমূল্যে প্রতিভা তৈরি অজস্র ছোটবড় কারখানা এখন আর কোনো বিসদৃশ, লজ্জার ব্যাপার নয়, বরং, সমাজ এই ব্যবস্থাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে মস্তিষ্কে জায়গা করে দিয়েছে। যারা এই বাজারে প্রবেশাধিকার পাচ্ছে, তাদের অনুপাতটি কম হতে পারে, কিন্তু, অর্থ ও রাজনৈতিক প্রতিপত্তির জোরে তারা সংখ্যাগত লঘুত্বকে সহজেই অতিক্রম করে গোটা সমাজকে নিজেদের প্রতাপে প্রভাবিত করে। সেই প্রভাব নামতে থাকে দেশের হাজার হাজার সরকারি, এমনকি অনেক বেসরকারি স্কুলেও। যেমন উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার একটি উচ্চ-মাধ্যমিক স্কুল। ছাত্রছাত্রীরা খেতমজুর, গরিব চাষি, ভ্যান চালক, বা ছোট ব্যবসায়ী বাড়ির সন্তান। স্কুলে নিয়মিত ক্লাস হয়, শিক্ষকের সংখ্যা তুলনায় কম হলেও কাজ চালিয়ে যাওয়া যাচ্ছে। অথচ, এখান থেকে পাস করার পর, কতজন যে শিক্ষাব্যবস্থায় টিকে থাকবে তার “গ্যারান্টি নেই।” “কেন নেই?” “এরা ফার্স্ট জেনারেশন লার্নার, তার ওপর সবার মা-বাবা ট্যুশন দিতে পারে না, পারলেও কমজোরি মাস্টার দেয়, ভাল মাস্টার দেওয়ার ক্ষমতা নেই।” “স্কুলে কি লেখাপড়া হয় না?” “হয়, কিন্তু আমরা কী করতে পারি? এরা প্রাইমারিতে কিছু শিখে আসে না, এখানে আর কতটা শেখাব?” এ সবে সমস্যার তালিকা দেওয়া শুরু। পর্যবেক্ষক যত এগোবেন, ততই তিনি দেখতে পাবেন, এক বিশ্বাসের প্রতিমূর্তি, “টাকা ছাড়া বাচ্চার লেখাপড়া হবে না”। ... ...
প্রকাশন জগতের মানুষ, নজরুল বিস্ময় দেখায়, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরী জাহানারাকে চোখে দেখেননি! বলেন কী! গল্প লেখেন, সেই গল্প ছাপানোর জন্যে কোন পত্রিকার সম্পাদককে ধরাধরি করেন না, নিজেরই পত্রিকা আছে। অসাধারণ সুন্দরী সে তো বললুমই, ধনীর দুলালী; মালদা থেকে বাংলার সমস্ত উত্তর দিক হয়ে পশ্চিমে বিহারের মিথিলা পর্যন্ত যে ভূমি, তার প্রধানতম জমিদার বংশ – জমিদার না বলে রাজবংশই বলা উচিত – তার সন্তান। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে হাল আমলের কল্লোলের লেখকগোষ্ঠীর অনেক লেখকের সঙ্গেই এঁর যোগাযোগ। সাধারণত থাকেন কলকাতায়। আপনার মতো আমিও চিনতুম না গত বছর পর্যন্ত। ... ...
বিসমার্ক দূরের কথা, এঁরা কেউ সাম্প্রতিক ইতিহাসটুকু পড়ে আসেননি। আপাত স্বাধীনতার লম্বা দড়ি ছেড়ে দিয়ে টিটো তো ঠিক সেটাই চেয়েছিলেন – রাজনীতি নয়, অর্থনীতি। লগে রহো ক্রোয়াট আউর সার্ব ভাই। চল্লিশ বছর যাবত হয়তো সেই কারণে শান্তি বজায় ছিল। এবারের বিবাদ অর্থনীতির নয়, জাতীয়তাবাদের। স্লোভেনিয়ার স্বাধীনতা বাকি ইয়ুগোস্লাভিয়া না হয় মেনে নিল; কিন্তু আসল সমস্যা সার্ব বনাম ক্রোয়াটদের পারস্পরিক শোধ তোলার বাসনা। ... ...
বামপন্থী মহলে তাঁর খুব বদনাম। গ্রামে থাকতেই শুনেছি। কিন্তু পরে আলাপ হতে দেখলাম, দারুণ প্রশাসক। বিজ্ঞান ক্লাব করতে গিয়ে দেখলাম, তিনি আমাকে খুবই পছন্দ করছেন এবং ভরসা করছেন। সুধীর দাঁ সিএমএস স্কুলে একদম পড়াশোনা হয় না, এই বদনাম ঘুচিয়ে স্কুলকে খুব শৃঙ্খলাবদ্ধ করে তুললেন। শিক্ষক হিসেবে খুব সুনাম ছিল না, কিন্তু প্রশাসক হিসেবে অসাধারণ হিসেবে ১৯৮২-তে দেখা দিলেন সুধীর দাঁ। স্কুলের বামপন্থী শিক্ষকদের ডেকে বললেন, আমাদের রাজনৈতিক মত আলাদা কিন্তু স্কুলে কোনও রাজনীতি নয়। স্কুলের উন্নয়নই আসল। সিএমএস স্কুল তখন লোকে কানাকানি করতো আলু পটল বেচনেওয়ালেদের ছেলেরা পড়ে। ওমা, সুধীরবাবুর দক্ষ পরিচালনায় শহরের দুই সেরা স্কুল মিউনিসিপ্যাল স্কুল এবং টাউন স্কুলকে ছাপিয়ে উঠল। ১৯৮৪-তে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় আজিজুল হক চতুর্থ স্থান পেলেন। হইহই পড়ে গেল শহরে। ... ...