বৃষ্টি এখানে কম। এখানে বিশ্বচরাচর নিঝুম করে শুরু হয় স্নোফল। কিন্তু কুছ পরোয়া নেহি। বরিষণমুখরিত দিনে যারে খাওয়া যায়, নিঃশব্দ তুষারপাতেও তারে পাওয়া যায়। ধুমায়িত খিচুড়ির কোনো জবাব নেই। মৌমিতা ভৌমিক ... ...
ছোট বেলায় দেখতাম, মায়ের তেমন কোন ভাল শাড়ি ছিলনা। কোথাও নেমন্তন্ন থাকলে মা কোন বন্ধুর থেকে শাড়ি চেয়ে নিয়ে পরত। সেকালে এমন চল ছিল অবশ্য। ইমিটেশন গয়না পরত। একজোড়া কানের রিং ছাড়া মায়ের আর কোন সোনার গয়না ছিলনা। ব্যাপারটা আমার খারাপ লাগত। একটু বড় হতে একদিন মাকে জিজ্ঞেস করলাম - ‘এত বড়ো বংশের মেয়ে লাবণ্য। বড় ঘরের বৌ! গয়না ছিলনা মা? বন্ধুরা সব গল্প করে, ঠাকুমার বালা, দিদার বিছে হার। তোমার তো কিছু নেই। তোমাকে দেয়নি? - সব গেছে, দেবে কী করে? - গেছে মানে, কীকরে গেল সব? প্রথমে বললে হারমোনিয়াম গেছে, তারপর বললে, দিদার হাতের কাজগুলো গেছে। এখন বলছ গয়না গাঁটি গেছে। গেল কীভাবে, সেটা তো বলো। মা বলল, - আজ কথায় কথায় অনেক বেলা হয়ে গেল মা, আবার একদিন হবে। মেলা কাজ পড়ে আছে।’ - যাঃ জানা হলনা তবে? ... ...
- ওহ, রুশ ভাষায় মাকে বুঝি নেনকো বলে? আর কী কী শিখেছিলে? - বাড়িতে বাংলা ইংরেজি মিলিয়ে অনেক গুলো ডিকশনারি ছিল। সেখান থেকে এ টি দেবের ইংরেজি থেকে বাংলা ডিকশনারির শেষে দেখলাম গ্রিক আর রুশ বর্ণমালা রয়েছে। ব্যাস আর আমায় পায় কে? দিনরাত নতুন বর্ণমালা মকশো চলল রাফ খাতায়। প্রগতি প্রকাশনের রুশ গল্পের বাংলা অনুবাদ যত আছে, সব নিয়ে খাটে ছড়িয়ে বসলাম। মলাটের পরের পাতায় বাংলার নিচে ছোট ছোট করে রুশ ভাষাতেও লেখা থাকত। উভচর মানুষ বইটার লেখক আলেকজান্ডার বেলায়েভ। রুশ বর্ণমালা মিলিয়ে দেখলাম, লেখা আছে, এ বেলায়েভ। বাংলায় মস্কোর নিচে যা লেখা আছে, তা বাংলা মতে উচ্চারণ করলে দাঁড়ায় মস্কভা - মানে মস্কো। হায় কপাল! ইস্কুলের ভূগোল বইতে লেখা আছে, মস্কো শহর মস্কোভা নদীর ধারে। ভুল, এ যা দেখছি, তাতে মস্কো শহর মস্কো নদীর ধারে। দৌড়লাম, মাকে এই নতুন আবিষ্কার জানানোর জন্য। মা শুনে বেশ অবাক হল, বলল - - ‘বাবা! পড়ে ফেললি তুই। তুই যেমন রুশ ভাষা শেখার চেষ্টা চালাচ্ছিস, আমার মাও এভাবে ইংরেজি শেখার চেষ্টা করত।’ ... ...
- "মা, তুমি গান জানো, আমাকে তো কোনদিন বলোনি। - গান জানিনা তো। - তাহলে বাজাচ্ছো কি করে? - আমার মায়ের কাছে শিখেছি। শুরু করেছিলাম। তারপর আর হলনা। - হলনা কেন? - হারমোনিয়ামটা হারিয়ে গেল। - কীকরে? - সে অনেক কথা, পরে বলব।" ছোটো করে একটা ধাক্কা লাগল মনে। লাবণ্যর হারমোনিয়াম হারিয়ে গিয়েছিল? কি এমন কথা আছে, মা বুকে চেপে আছে? ... ...
ঠাকুমা কলতলা থেকে এসেই স্টোভের আঁচ বাড়িয়ে দিল। পুঁইয়ের কচি ডগাগুলো হাত দিয়ে ভেঙে নেয় ঠাকুমা। লোহার কড়াইয়ে সেই পুঁইয়ের পাতাডগা, হলুদ, লবণ আর কাঁচামরিচ ফেলে ঠাকুমা তাতে ঢেলে দিল অনেকটা সর্ষের তেল। আলতো নয়, বেশ জোর দিয়েই ঠাকুমা তা মাখাতেই পুঁইয়ের পাতাডগা সব এলিয়ে পড়ল। ঠাকুমা এবার তার উপরে শুইয়ে দিল কতগুলো ইলিশমাছের চাকা। হাত-ধোয়া জল জড়িয়ে গেল মাছগুলোর গায়ে। ... ...
এর মধ্যে আবার শুনলাম মতির ছেলেরা ফের বাবার কাছে গিয়েছিল বলতে যে অভিযোগ যেন তুলে নেয়। বাপ বলে পাঠিয়েছে, তোদের মাকে বল আমাকে নিঃশর্ত আইনি বিচ্ছেদ দিয়ে দিতে, তবে মামলা তুলব। সপ্তাহ খানেক পর কোর্টের খবর আসে, জানা যায় কাগজটা ভুয়ো। এমন কোন কাগজ আদালতে জমাই পড়েনি। সবই মতির বরের চালাকি। মা আর তিন ছেলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। পুলিশ আসবে শুনে সকলেই প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিল। ওরাও তো আর সব সময়ে সোজা পথে চলে না। তবে ডামাডোলে রেশন কার্ড ফেরৎ পাবার কথাটা ধামাচাপা পড়ে যায়। শহর থেকে বিস্তর ফোনাফুনি করে মতি যাতে চাল গম পেতে পারে তার ব্যবস্থা করা হয়। মতি অনেক জ্বালিয়েছে ঠিকই, ওর এই দুর্দশার দিনে মোটেই খুশি হতে পারি না। বরঞ্চ কপালে করাঘাত করে ভাবি, এই মতি এখনও স্বপ্ন দেখে যে তার যোগ্য বর ওকে আবার ঘরে নেবে, আবার ও তার সঙ্গে সংসার করবে। ... ...
কখনও মনে পড়ে – সরস্বতী পুজো হচ্ছে, সদর দরজার কাছে বাঁদিকে প্রথম ঘরে ঠাকুর। ঘর জুড়ে অনেক কিছু সাজানো। দূরে ঠাকুরের পাশে কয়েকটা বই রাখা, ওপরেরটা আমার। নীল মলাটের ওপর লাল আর সাদা দিয়ে লেখা। আমার বইটা নিয়ে নিয়েছে সবাই। এত জিনিস টপকে আমি যেতেও পারছি না যে তুলে আনব। মা সমানে বোঝাচ্ছে, যে, ঠাকুরের কাছ থেকে বই তুলে নিতে নেই। কিন্তু আমার ভবি ভোলার নয়। বারবার দরজা দিয়ে বইটা দেখছি, সদর দরজা অবধি দৌড়োচ্ছি আর প্রচণ্ড চেঁচিয়ে কাঁদছি। আচ্ছা, কী বই ছিল ওটা? দেওয়ালে ক্যালেন্ডার, মা কোলে করে ক্যালেন্ডারের সামনে আমায় নিয়ে গিয়ে বলছে, ‘এটা কে? আমি বলছি বিবেকান্দ-নন্দ।’ মা হাসছে, আমি হাততালি দিচ্ছি। ... ...
ইসলামি শাসনকালে প্রাচীন হিন্দু বিজ্ঞানশাস্ত্রের চর্চা গলা টিপে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল এই হিন্দুত্ববাদী প্রচারের গালে একটি বিরাশি সিক্কার চড় ভাবপ্রকাশ নিঘণ্টু। মুঘল আমলে রচিত এ কেতাবকেই পণ্ডিত ও গবেষকেরা মনে করেন ‘আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের মেটেরিয়া মেডিকা’। আর তাতেই রয়েছে আধুনিক খিচুড়ির প্রথম রেসিপি। নীলাঞ্জন হাজরা ... ...
সারাদিনের মধ্যে এই ফুলতোলার সময়টুকুতেই তো ঠাকুমাকে আমি আমার মতো করে পাই। এ-কথা ও-কথায় আমরা দু-জনকে বারবার জানাই—আর কেউ না, তুমিই আমার সব আবদারের জায়গা। তবে শহরে যাবার পর অবশ্য ঠাকুমার আবদার আমার থেকেও বেড়ে গেছে। ফুলের সাজি হাতে বাইরবাড়িতে যেতে যেতেই ঠাকুমার আবদার, ও দিদি, এবার বার্ষিক পরীক্ষায় খুব ভালো করতে হবে কিন্তু তোমার। শহরে বাবা নিয়ে গেছে তো ভালো করে পড়াতে। বাবার কথা মানতে হবে দিদি। ... ...
এরপর তাড়াতাড়ি বারবেলা আসার অদম্য ইচ্ছে নিয়ে আমি ঢুকে পড়লাম স্কুলের গণ্ডিতে। ঊষাদি, মঞ্জুদি, অশোকাদি, আল্পনা-আপা, নুরজাহান-আপা – যত না পড়া ধরে, তারচেয়ে বেশি গল্প করে। কার বাসা গতবছরের বন্যায় ডুবে গিয়েছিল, কে যুদ্ধের বছরে শরণার্থী হয়ে ক্যাম্পে গিয়েছিল, কার বাড়ির আতা গাছে ফল ধরেছে — সে সব গল্পে গল্পে যতটুকু পড়া বাদ পড়ে, তার সবটুকুই ষোলোআনায় পুষিয়ে দেয় দীপঙ্কর স্যার। কড়া ধাঁচের ছোটখাটো মানুষটি শুধু স্কুলে পড়িয়েই ক্ষান্ত হয় না, প্রতিদিন বিকেলে বাসাতেও যায় আমাকে পড়াতে। কিন্তু আজ বিকেলে আমি কী ভাবে দীপঙ্কর স্যারের কাছে পড়ব? আমি মনে মনে পণ করে ফেলি, স্যার যতই বকা দিক, আজ আমি ছুটি নেবই নেব। ... ...
কড়াইয়ের জল ফুটে উঠতেই তাতে মা দিয়ে দিল মাসকলাইয়ের ডাল। সঙ্গে খানিকটা লবণ মিশিয়ে ঢাকনা দিল কড়াইয়ে। পুঁইয়ের লতা বেছে কেটে ধুয়ে নিল মা। মুসার মা আজ তাড়াহুড়ো করে কাজ সেরে গিয়ে উঠেছে মসজিদের মাঠে। সেখানে গুড়ের শিন্নি। রান্না করতে হবে তাকে। বড়দাদীর বাড়ি থেকে পাঠানো হয়েছে ডেকচি ভরা গুড়, চালের গুঁড়া আর নারিকেল কুরোনো। আসরের নামাজের পর মসজিদের মাঠে কলাপাতায় বিলানো হবে শিন্নি। ... ...
চলছে খিচুড়ি মহারহস্য অ্যাডভেঞ্চার। আগের কিস্তিতে দেখেছিলাম খাঁটি ভারতীয় খিচুড়িতে কীভাবে আফগানিস্তান পার করে এসে মিশেছিল ইরানি ‘শোলে’। এ কিস্তিতে আমরা সেই জাহাঙ্গিরি খিচড়ি আর বাজরা খিচড়ির রহস্যভেদের তাগিদে নেতি নেতি করতে করতে হাজির হব ইরান ফিরতি দিল্লি হয়ে সোজা বর্ধমান! নীলাঞ্জন হাজরা ... ...
আজ গুজার কাটা মাছের রসা হবে। আর হবে পুঁটি মাছের জ্বালের ঝোল। ডালে এবার কাটা পড়ল, তা ঘুরানো হল নরম হাতে। যেন কিছু ডাল আস্ত থেকে যায়। জলে ভালোভাবে সেদ্ধ ডাল মিশে যেতেই তাতে পড়ল কতগুলো বুক-চেরা কাঁচামরিচ। কাঁচামরিচ আর ডাল ফুঁটে হাওয়ায় মিশতে শুরু করল ঘ্রাণ। রান্নাঘরের কালো ঝুল কালি মাখা কালো জানালা পেরিয়ে সেই ঘ্রাণ গিয়ে দাঁড়াল উঠোনে। উঠোনে তখন বারবেলার রোদ সবে গা মেলেছে। সেই রোদে পেয়ারা গাছের ডাল দুলে দুলে ছায়ার আল্পনা আঁকতে। ... ...
বাংলা লিখিত সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদের যুগ থেকে কোম্পানি-রাজের পত্তন পর্যন্ত রচিত নানা বাংলা গাথা চর্ব্যচোষ্যলেহ্যপেয়র রঙিন বিবরণে ভরপুর। উঠে আসে বাঙালির রসনা-সংস্কৃতির বিবর্তনের ছবি। এ কিস্তিতে রইল যাকে বলে মৎস মারিব খাইব সুখে! আর সে রন্ধন মাতোয়ারা করে রেখেছে জলের ঈশ্বর! লিখছেন ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়। ... ...
ভাষাতত্ত্বের কম্পাস নিয়ে খিচুড়ির পূর্বজর খোঁজ করতে গিয়ে আমাদের পথ আটকে গিয়েছে কৃসর বা কৃসরা-য়। তার চাল আর তিলের পাক। আজকের খিচুড়ির ইভ কে, সে খোঁজ করতে হলে, খেলা ঘুরিয়ে হাতে নিতে হবে রসনাতত্ত্বের কম্পাস। আর তাতেই খুলে যাবে চাল-ডালের প্রথম পাকের আশ্চর্য এক দুনিয়া। নীলাঞ্জন হাজরা ... ...
ষোড়শ শতক। বাধার বিন্ধ্যাচল টপকে মধ্যযুগীয় দক্ষিণি খিচুড়ির খোঁজ। এক আশ্চর্য কুকবুক সুপশাস্ত্র। কন্নড় ভাষায় রচিত। রচনাকার তৃতীয় মঙ্গরস। বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সেরা সময়ের খানদানি খানাদানার সাক্ষী সে কুকবুক। আর আমরা যাকে খিচুড়ি বলে চিনি, কন্নড়ে তাই হুগ্গি! নীলাঞ্জন হাজরা ... ...
কিছুদিন পরে ল্যাবের বড় দাদা মানে জগাদা আমাকে ডাকল – - কি রে! TUMPA-র সঙ্গে এত গল্প করছিস, ব্যাপার কী? - টুম্পার সঙ্গে গল্প মানে? আমার নাম তো টুম্পা। - কী! তোর ডাকনাম টুম্পা? তুই তাহলে টুম্পা ওয়ান। অমনি সবাই হো হো হা হা করে হাসতে লাগল। - কী ইনোসেন্ট রে, তুই TUMPA জানিস না?.... ... ...
আমার সুযোগ না হলেও ভোরের বাতাস গায়ে মাখতে বাবা বের হয়ে গেছে এরই মধ্যে। সাথে রহিম চাচা। যমুনার ধার ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে বাবা চলে যায় বটতলার শ্মশান ঘাটের দিকে। ওই ঘাট পার হলেই জেলখানার ঘাট। সেখানে সারারাত জাল ডুবিয়ে বসে থাকা জেলেদের জালে এসময় মাছের বাড়বাড়ন্ত। বেলা উঠলেই ঘাটের পাড়ে শুরু হয় সদ্য নদী থেকে তোলা মাছের বিকিকিনি। সেখানে খালুই ভরা—কখনো আইড়-ভেউশ, কখনো রূপালী পাবদা। সেসব খালুই থেকে বেছে বেছে সেরা মাছ বাবার জন্য তুলে নেয় রহিম চাচা। ... ...
সাবুধানার দুধে এবার পড়ল ছোট করে কেটে রাখা বড়দাদির গাছের কচি তালশাঁস। আবার অনবরত নাড়া পড়ে দুধ-সাবুতে। তালশাঁসগুলো একটু জল ছেড়ে ছোট হয়ে আসতেই ঠাকুমা কোরানো নারিকেল ছড়িয়ে খাবড়ি নামিয়ে ফেলে। তাঁলশাসের পায়েস পাথরের বাটিতে ঢেলে ঠাকুমা নিবেদন করে দেয়ালে ঝুলানো রাধাকৃষ্ণের ছবির সামনে। কমলা রঙের পদ্মজবা পড়ে সেখানে। ঠাকুমা দু’হাতে তালি দিয়ে গেয়ে ওঠে, “হে কৃষ্ণ করুণা সিন্ধু দীনবন্ধু জগৎপথে। গোপেশ গোপীকা কান্ত রাধা কান্ত নমহস্তুতে…” ... ...
জাহাঙ্গিরি খিচড়ি বাংলায় প্রবেশ করে বিপ্লবের মুখোমুখি হল! তাতে এই প্রথম চাল পড়ল। দম পড়ল। এবং খুব সাবধানে আধুনিক রান্নার প্রথম অধ্যায়ে আলতো করে পা রাখায় ‘পরিমিত লঙ্কা’ পড়ল। আর আমরা জানলাম ‘খেচরান্ন’ এক ছোকরা শব্দ—অর্বাচিন সংস্কৃত, যার সঙ্গে খেচর বা পাখির কোনো সম্পর্ক নেই! নীলাঞ্জন হাজরা ... ...