আপেল পাই জিনিসটার সাথে যদি আগে পরিচিত না থাকেন, এবং আমস্টারডামে গিয়ে প্রথমবার ট্রাই করেন, তাহলে হয়তো আপনার মনে এটা হালকা ভাবে ভেসে উঠতে পারে, যে – এটা কি আর এমন ব্যাপার, যার জন্য এত নামডাক? খুব বেশি কারিকুরি তো দেখতে পাচ্ছি না এই আপেল পাই-এ! এই ভাবনাটা মনের মধ্যে এলেই নিজেকে একটু ক্যালিব্রেট করে নেবেন – ভেবে নিন আপনাকে কেউ চ্যালেঞ্জ করছে প্যারামাউন্ট-এর সরবত, নকুড়ের সন্দেশ বা আমিনিয়ার বিরিয়ানি নিয়ে! এইসব খাদ্য এমন সুউচ্চ স্তরে পৌঁছে গেছে, যে পার্থিব তর্ক করে কিছু হবে না – যার হয়, তার হয় টাইপের কেস। ... ...
আমাদের ইস্কুলের একশ পঁচিশ বছর এসে পড়েছে। বিভিন্ন প্রাক্তনী ব্যাচের ব্যস্ততা তুঙ্গে। আমরা সাতাশির ব্যাচ ঠিক করলাম, কলকাতায় প্লেগ মহামারী আর বর্তমান করোনা মহামারীর তুলনা করে একটা আন্তর্জাতিক ওয়েবিনার করব। ১৮৯৮ সালে ইস্কুল প্রতিষ্ঠার সময়ে প্লেগের থাবায় আহত হয়েছিল শহরটা, তাই এই আলোচনার উদ্যোগ। বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা বন্ধুরা মিলে সময় বের করে আমরা কাজ শুরু করলাম। মাতাজীরা বললেন, নিবেদিতার ডাকে সেযুগের যুবকেরা, মহিলারা প্লেগ নিবারণে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। এই করোনা মহামারীতে নবীন প্রজন্ম কীভাবে অংশ নিয়েছে, সেটা তাঁরা শুনতে চান। ... ...
- এই দেখ, মধ্যবিত্ত গৃহস্থ বাঙালি বিয়ের ভোজ নিয়ে কী লিখছেন মহেন্দ্রনাথ দত্ত: ‘কলাপাতায় বড় বড় লুচি আর কুমড়োর ছক্কা। কলাপাতার এক কোণে একটু নুন। মাসকলাই ডালের পুরে আদা মৌরি দিয়ে কচুরি, নিমকি, খাজা, চৌকো গজা, মতিচুর এইসব সরায় থাকিত। আর চার রকম সন্দেশ থাকিত। আগে গিন্নিরা নিজেরাই রাঁধিতেন। কিন্তু একদল লোক খুঁত ধরে ভোজ পণ্ড করে দিত বলে মেয়েরা আর রাঁধিতেন না। ’ - একদল লোক খুঁত ধরে খাওয়াদাওয়া পণ্ড করে দিত? - হ্যাঁ রে, নিন্দেমন্দ, খুঁত ধরা, গাল পাড়া, ঘোঁট পাকানো, জাতপাত তুলে ভোজ বয়কট – এইসব নষ্টামি খুব ছিল। - এ বাবা! - আবার এটা কি জানিস, কলকাতার বিয়েবাড়িতে অনেক দুষ্ট লোক যেত জুতো চুরি করতে। সেই জন্য গৃহকর্তার সঙ্গে চাকরও যেত জুতো পাহারা দিতে। বিয়েবাড়ির সামনে ঘোড়ার গাড়ি আর পালকির পার্কিং প্লেস বানাতে হত। - হি হি। ... ...
সেই কুকিং ইভেন্টের আয়োজন হয়েছিল আমস্টারডাম শহরের একপ্রান্তে, মানে মূল শহর কেন্দ্র থেকে কিছু দূরে ‘দি কুকফ্যাব্রিক’ (বাই ফার্ম কিচেন) নামে সেই কুকিং ওয়ার্কশপ। আইডিয়া বেশ সিম্পল – সব অংশগ্রহণকারী একসাথে রান্নাবান্না করবে। নিজেদের মধ্যে টিম বানিয়ে কম্পিটিশন করবে, পুরো কোর্স মিল বানিয়ে বা বেশি সময় হাতে না থাকলে এক একটা টিম ডিনার/লাঞ্চ-এর এক একটা পদ বানিয়ে। আমার যেখানে গিয়েছিলাম, কুকফ্যাব্রিক-এর সেই ওয়ার্কশপটা বেশ বড়সড় জায়গা জুড়ে আছে – প্রায় ১২০০ বর্গমিটার। বিখ্যাত ডাচ টিভি শেফ জুলিয়াস জেসপার এই মুহুর্তে জড়িয়ে আছেন এই সংস্থার সঙ্গে। তাঁর তৈরি মেনুই এখানে রান্না করা হয়। মোটমাট ১৮টি কুকিং স্টেশন আছে, আর আছে ৩টি ডেমোনস্ট্রেশন কিচেন। সব মিলিয়ে ২৭০ জন মত পাবলিক এখানে বসে খেতে পারে। আর মর্ডান কিচেনে যা যা থাকে, সবই পর্যাপ্ত সাপ্লাই দেওয়া হয় – তাই ছানা কেটে গেলে বলতে পারবেন না, যে হাতের কাছে নাড়ার কিছু ছিল না বলে এমন হল! ... ...
গাঁজা গাছের ডগার কচি পাতাগুলোকেই সিদ্ধি পাতা বলে। সেই পাতা সরবত করার আগে বারবার খুব চটকে চটকে ধুয়ে নিতে হয়। সব কষ বেরিয়ে গেলে পাতা ধোয়া জল একেবারে স্বচ্ছ হয়ে যায়। তখন সেই পাতা বেটে সরবত বানানো হয়। পাতা বাটার সঙ্গে আরও কয়েকটা জিনিস বাটতে হয়, যেমন – গোলমরিচ, চারমগজ আর মৌরি। এই বাটাটা একেবারে চন্দনের মত মিহি করে বাটতে হয়, তারপর ছেঁকে নিতে হয়, যাতে কোনো দানা না থাকে। এখন মিক্সার গ্রাইন্ডারের যুগে মিহি করে বাটা খুব সহজ, তবে যে যুগের কথা বলছি, তখন তো যন্ত্রের ব্যাপার ছিল না। শিলনোড়ায় মেয়েদের হাতের জোরেই এসব কিছু করতে হত। এর সঙ্গে পরিমাণমত দুধ, চিনি আর জল মিশিয়ে পাতলা সরবত বানানো হত। এতে ওষধি গুণ আছে, ঘুম এসে যায়। দশমীতে এই সিদ্ধির সরবত বানানো খুব প্রাচীন প্রথা। কি জানি, আমার মনে হয়, .... ... ...
ভারি মুশকিল হল তো। অনেক বছর আগে একবার যেদিন সংসদে জঙ্গি হামলা হল, সেদিন সবাই মিলে ঘরে ঘরে, ল্যাবরেটরিতে আঁতিপাঁতি খুঁজে সব ছাত্রছাত্রীকে বাইরে বার করে বাড়ি পাঠিয়েছিলাম। ছেলেমেয়েগুলো অনেকেই রেলপথে দূর থেকে আসে। কখন কী ঘটে যায় আশঙ্কা ছিল। এখন তো সেসব কিছু হয়নি রে বাবা। দাঙ্গা-হাঙ্গামা দূর, মারপিটও হয়নি কোথাও। চারদিক শান্ত। অসুখের জন্য কলেজ বন্ধ হয় – এ কেমন অসুখ! আশ্চর্য তো। ... ...
সে ছেলে দাবি করেছিল, যে তারা নাকি পরিবেশপন্থী, খুব সন্তর্পণে সব কিছু বাছাই করে। খুব ভালো লাগল শুনে – অর্ডার করেছিলাম। কিন্তু যে ডিশ নামাল সামনে, তাই দেখে আমি সেই ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম – “এই তোমাদের পরিবেশের প্রতি ভালোবাসা?” বাঁধাকপিগুলোকে বাড়তে দেয়নি পর্যন্ত! কুঁড়ি ছিঁড়ে নিয়ে প্লেটে সাজিয়ে দিয়েছে! আর সিদ্ধ বাঁধাকপি – সে কেমন খেতে? তা আর নাই বা বললাম! আমাদের কালো জার্সি গরুটা পর্যন্ত শেষ বয়েসে মুখ ঘুরিয়ে নিত এ জিনিস দেখে! ডিসক্লেমার: অনেকে আবার দাবি করেন, এগুলোকে বাঁধাকপির কুঁড়ি না, ব্রাসেলস্ স্প্রাউট বলে! চাষার ছেলে তো, অত কি আর বুঝি! ... ...
বড়দাদীর রান্নার স্বাদ এ পাড়ার সবার কাছেই অনন্য। আর বড়দাদী রাঁধেনও খুব যত্ন করে। সবার আগে উনুনে বসল একটা মাটির বড়মুখের হাঁড়ি। তাতে বড়দাদী ঢেলে দিল অনেকটা সর্ষের তেল। সেই তেলে ফোড়নে পড়ল তেজপাতা আর পাঁচফোড়ন। একটু নেড়েচেড়ে তাতে বড়দাদী মুঠো ভরে পেঁয়াজ কুচোনো দিয়ে দিল। এদেরকে লাল করে ভাজার ফাঁকে কতগুলো কাঁচামরিচও দিয়ে দিল বড়দাদী। পেঁয়াজের সাথে সাথে হাঁড়ির মরিচগুলোও রঙ বদলাতে শুরু করলো। বড়দাদী এবার আদা, রসুন বাটা দিয়ে দিল। একটু সময় পরেই তাতে পড়ল জিরাবাটা। সাথে লাল টকটকে শুকনো মরিচ বাটাও পড়ল খানিকটা। ... ...
সভ্যতার বহু অর্জনই দারিদ্রের দান। পরিমিত সম্বলকে বাঁচিয়ে গুছিয়ে কালকের দিনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মানুষ কালাতিপাত করেছে এযাবৎ ইতিহাস জুড়ে। আর তার মধ্যে দিয়েই বিকশিত হয়েছে তার সংস্কৃতির বিভিন্ন ধারা। মানুষের ইতিহাসের সেরকমই এক উপাদান পান্তাভাত। উপনিষদের ঋষি ব্রহ্মের অন্নরূপে আরাধনার মন্ত্র দর্শন করেছিলেন, সূর্যের আহ্নিক গতির পর্যায় অতিক্রম করে ব্রহ্মের সেই তেজ বিচ্ছুরিত হয়েছে হাঁড়িতে তুলে রাখা পান্তায়, তার আমানি জলে। আধুনিক বিশ্বের দরবারে পান্তাকে পেশ করে সেই ইতিহাসের এক ঝাঁকি দর্শন করিয়েছেন মাস্টার শেফ কিশোয়ার চৌধুরী। এই পর্বে খানিক অবগাহন করা গেল পান্তার পাতিলে। ... ...
আচ্ছা জেঠিমা, আমরা তিনজন যে মোহনবাগানের মেয়ে হলাম, সেটা কি ধোপে টিকবে? কেন? টিকবে না কেন? আমরা যে খুব ইলিশ খাই। তাতে কী? মোহনবাগানীরাও ইলিশ খায়, ইস্টবেঙ্গলীরাও চিংড়ি খায়। তাতে ভালবাসা কমে না। লাবণ্যর হাতের একটা রেসিপি করতে পারি, খাবি? কৃষ্ণার কাছে শিখেছি, কাঁচা ইলিশের ঝাল। মা, রান্নাটা কিন্তু দেখব, কীভাবে কর। কুমুদিনী-লাবণ্য-কৃষ্ণা-শারদা – আর একটা নাম জুড়ে যাবে রঞ্জাবতী। মানুষ থাকবে না, রান্নার ঘরানা চলতে থাকবে। কাল কাঁচা ইলিশের ঝাল করলে পরশু ডাব চিংড়ি করবে জেঠিমা। ঠিক হ্যায়, করতেই হবে। আজ ইস্টবেঙ্গলী ইলিশ রান্না হলে কাল তো মোহনবাগানী চিংড়ি রান্না হতেই হবে। তাহলে আমি ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে দিচ্ছি, কাল, পরশু বাড়িতে ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানের নামে ফুটবল – খাদ্য উৎসব হবে, অরগানাইজড বাই আওয়ার টু প্রিন্সেসেস। ... ...
বিয়ের পরে নতুন বউ, শ্বশুর বাড়িতে দুর্গাপুজো, শাশুড়ি বরণ শেখাচ্ছেন, সিঁদুর খেলা, বরের ক্যামেরায় সিঁদুর মাখা মুখের ছবি, মত্ত হয়ে ছিলাম। বাড়িসুদ্ধ সবাই মাতোয়ারা। হঠাৎ চোখে পড়লো, সবার প্রিয় বড়দি, আমার বড় ননদ ঘরে মুখ চেপে ডুকরে কাঁদছে। বিধবা বলে এই আনন্দে তার অধিকার নেই, নিজের বাড়িতেও। সেদিন বিজয়ার আর একটা নির্মম মানে বুঝলাম - সধবার স্বীকৃতি আর আনন্দের তলায় বিধবার দুঃখ। সধবার অধিকারের উলটো দিকে রয়েছে বিধবার নিঃসঙ্গতা - একরকম সামাজিক বহিষ্কার। এ চাবুক চোখে দেখা যায়না, তাই আসল চাবুকের চেয়ে অনেক কঠিন আর ধারালো, চামড়া কেটে গভীরে বসে যায়। ঐ দৃশ্য দেখার আগে বিজয়া দশমী যে কিছু মেয়ের জন্য এতটা অপমানের তা বুঝতে পারিনি। এখন দশমীর বরণে পারুল কে ডাকি। অল্প বয়সে পারুলের বর সুরাটে কাজ করতে গিয়ে এইডসে মারা যায়। তিনটি শিশু সন্তানসহ একঘরে পারুলকে শাশুড়ি আশ্রয় দেন। পারুল বলে, "হ গো বৌদি, মো কি ঘরো পূজা করিনা? শুধু সিন্দুর দিবানি, প্রদীপ, ধূ্প, মিষ্টি, জড়ো, পানো সবু দিবা"। প্রথাগত শিক্ষার নাগালের বাইরে থাকা আত্মবিশ্বাসী নারীকে বড় ভালো লাগে। ... ...
.... এই পাতুরি ভাজার সব চেয়ে সুবিধে হল, কোনো সুতো, দড়ি কিচ্ছু লাগবে না। এমনিই সুন্দর মুড়ে থাকবে, কিন্তু মচমচে হবে। পরে আমার এক অধ্যাপিকা বন্ধু একটা খুব দরকারি পরামর্শ দিয়েছিলেন। সেইমত বাড়িতে ইলিশের পাতুরি করতে গেলে আমি আর বাজারওলাদের পিছনে পড়ি না একটু কলাপাতার জন্য। আমার কর্তামশাইয়ের বাগানের শখ। ফ্ল্যাটের বারান্দায়, জানলায় মাচা বেঁধে শাকপাতি, শসা সব ফলান। তাই চালকুমড়ো, কুমড়ো, লাউ যখন যেমন পাই, টুক করে পাতা কেটে নিয়ে ওতেই পাতুরি বানাই। একেবারে পাতাসমেত খাওয়া যায়। শহরে কলাপাতা পাওয়া ভীষণ মুশকিল। তাই ইলিশ পাতুরির জন্য অন্তত আমার বাড়িতে এখন নো কলাপাতা বিজনেস। ... ...
পখাল একটা বিরাট লেভেলার। রাজা প্রজা, ধনী নির্ধন, সাধু ভণ্ড, সৎ অসৎ, সাহসী দুর্বল, মন্ত্রী জনগণ সব্বাইকে এক পাল্লায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সেটা কী? নিঃশর্ত পখালপ্রীতি। এই একটিমাত্র বিষয় যেখানে কোন মতপার্থক্য চলবে না। রাজার ঘরে যে ধন আছে, টুনটুনির ঘরেও সেই ধন আছে! নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ, পখালরাজের চরণে। এমনকি স্বয়ং শ্রীজগন্নাথদেবও স্নেহ করেন তাকে। ... ...
— চল্লিশ পঞ্চাশ বছর আগে শহুরে সংস্কৃতি গ্রামে খুব একটা ঢোকেনি। টিভিও খুব কম ঘরে ছিল। তাই ব্যাপারটা লেখাপড়ার জন্য নয়। লেখাপড়ার চর্চা ওসব জায়গায় খুব ভালো ভাবেই ছিল। তারিণীপ্রসাদ আর তাঁর বয়স্যরা মিলে স্বাধীনতার পরে তৈরি করেছিলেন ঐ এলাকার ছেলেদের জন্য প্রথম হাইস্কুল। আর মেয়েদের ইস্কুল শুরু হয়েছিল তোর ঠাকুমা বেলারানীর তত্ত্বাবধানে, তোদেরই বাড়ির দাওয়াতে। — এই তো, এবার ইস্কুলের গল্প চলে এসেছে। বল, বল পুরোটা। কিন্তু আমি তো জানতাম ইস্কুল, হাসপাতাল সব কিছু বুড়ো ঠাকুরদা তারিণী করেছেন। এর মধ্যে ঠাকুমাও ছিল! ঠাকুমা লেখাপড়া জানতো? একটু খুলে বল দেখি। ... ...
অ্যাটলাস ছাতার কল্যাণে আমি কাকভেজা হতে বেঁচে গেলেও, মুসার মা আর বড়দাদী ভিজে স্নান করে উঠেছে। বৃষ্টির তোড় বেড়েছে আরও। তাই ভাদুড়ী বাড়ি ছেড়ে দ্রুত পায়ে বড়দাদী নিজের বাড়ি গিয়ে উঠলো আর মুসার মা ঢুকে পড়লো আমাদের কলঘরে। বারান্দায় আজ বৃষ্টিভেজা বাতাসে কেরোসিনের স্টোভে নীল আঁচ উঠছে এলোমেলো। সেই আঁচে বসেছে থোড়ের ঘণ্ট। আর হবে আলুর ঝুড়ি ভাজা, পাঁচ ডাল। খুব অল্প আয়োজন আজ দুপুরের খাবারে। ... ...
তরকারিতে নুন কম বেশি হলে কী করতে হয় গো মা? – কম হলে খুব একটা অসুবিধে নেই, দিয়ে খাওয়া যায়। বেশি হলে বিপদ। – বেশি হলে কী করব? – রান্না অনুযায়ী হবে। ধর, মাংসের ঝোলে নুন বেশি হয়েছে। তখন গরম জল মিশিয়ে ঝোল পাতলা করতে পারিস। যদি দেখিস আর জল মেশালে গামছা কাঁধে ঝোল পুকুরে নামার অবস্থা হবে, তখন এক দেড় চামচ টক দই, এক চিলতে হলুদ, লঙ্কা গুঁড়ো আর ময়দা মিশিয়ে দিতে পারিস। টকে নুন টেনে নেবে, ঝোলও পাতলা হবে না। দইয়ে হলুদ, লঙ্কা মিশিয়ে দিলে রংটাও হাল্কা হবে না। আবার ধর ঘুগনি জাতীয় কিছুতে নুন বেশি হলে তেঁতুল গোলা জল বা লেবুর রস মেশানো যেতে পারে। যদি টমেটো দেওয়া রান্না হয়, তবে টমেটো ঘিসনিতে ঘষে পিউরি বানিয়ে আলাদা ফোড়ন কড়ায় একটু ফ্রাই করে মিশিয়ে দেওয়া যেতে পারে। হাল্কা ফ্রাই না করলে আবার কাঁচা টমেটোর গন্ধ উঠবে। ... ...
আমার কর্তা বলে, যে ওরা প্রায়ই ছোটবেলায় নারকেল তেলে ভাজা লুচি খেত। খুবই স্বাভাবিক। কারণ উপকূল অঞ্চলে নারকেল খুব সুলভ। বাড়িতেই তেল বানানো হত। আমার খুব আগ্রহ ছিল – এই তেল বানানোর পদ্ধতিটা নিজের চোখে দেখব। আমাদের রান্নাঘরের মতি বৌ নারকেল তেল বানিয়ে আমার সেই ইচ্ছে পূরণ করেছে। ব্যাপারটা দেখলাম তেমন শক্ত কিছু নয়। নারকেল কুরে গরম জলে ফেলে দুধ বের করতে সকলেই জানে। এক্ষেত্রে খুব ঝুনো নারকেল যেগুলোর জল শুকিয়ে ফোঁপর বেরিয়ে যায়, অঙ্কুরোদ্গম হয়ে যায়, তেমন কয়েকটা নারকেল ধৈর্য ধরে কুরে নিতে হবে। তারপরে রাঁধুনিরা সেই কোরা নারকেল গরম জলে কিছুক্ষণের জন্য ভিজিয়ে রাখল। আধঘণ্টা-খানেক পর, ঐ জলেই বেশ দু’-তিনবার ভাল করে কোরা নারকেল চটকে দুধ বার করে নিল। এইবার এই দুধটুকু কড়ায় ফোটাতে ফোটাতে জল সব বাষ্প হয়ে উড়ে যাবে, তেলটুকু ভেসে উঠবে। রাঁধুনিদের অনুরোধে তেল থেকে ছেঁকে নেওয়া বাদামি রঙের নারকেলের ছিবড়ে খেয়ে দেখলাম। এখানে বলা হয় নারকেলের চড়া। মিষ্টি মিষ্টি বেশ খেতে। ... ...
রাস্তাগুলো দিয়ে খরস্রোতে বৃষ্টি আর জোয়ারের জল চলল খলবলিয়ে। চারিদিকে নদী আর মাঝখানে বাড়িগুলো যেন দ্বীপ। এমন জিনিস তো দেখিনি বাপের জন্মে। ল্যান্ডফোন বন্ধ, বিদ্যুৎ নেই, তখন তো আর মোবাইল ফোন ছিল না। কেবল উপকূলের মানুষের অভিজ্ঞতার জোরে সে যাত্রা বেঁচে গেলাম সকলে। বৃষ্টি একটু কমতে, রাস্তার ধারে গিয়ে দেখি চুনো মাছের স্রোত চলেছে রাস্তা দিয়ে। সবাই জলের স্রোতে ঝুড়ি আড় করে দাঁড়িয়ে আছে জায়গায় জায়গায়। কয়েক মিনিট পরে পরে তুলে নিলে আধঝুড়ি করে মাছ উঠছে। আমিও ঝুড়ি পাতলাম। হঠাৎ দেখি সবাই চেঁচিয়ে কী একটা ইশারা করছে আমাকে। তাকিয়ে দেখি আমার খুব কাছে কিছু একটা গোল্লা পাকিয়ে ঘুরে ঘুরে চলে যাচ্ছে। আমি কি আর জানি ছাই যে ওটা চিংড়ি মাছের ঝাঁক। ... ...
পালো একটা কন্দ জাতীয় ছোট গাছ, হলুদ গাছের মত দেখতে, পাতাটা হলুদের থেকে সামান্য মোটা। তার থেকে লম্বাটে গোল একধরণের কন্দ বেরোয়। ঐ কন্দ তুলে কুচি কুচি করে কেটে জলে চটকে তার ক্বাথটা বের করে নেওয়া হয়। অনেকটা নারকেল থেকে দুধ বার করার মতন। তারপর ঐ জলটা রেখে দেওয়া হয়। ধীরে ধীরে সাদা একধরণের পদার্থ মানে পালোর শ্বেতসারটা নিচে থিতিয়ে পড়ে। তারপর রোদে শুকিয়ে নেওয়া হয়। মাটি ফুটিফাটা হলে যেমন দেখতে লাগে, সেই আকারে ঐ সাদা অধঃক্ষেপটা অসমঞ্জস টুকরোতে ভেঙ্গে যায়। কেউ আবার ঐজলে একটু এলাচ বা অন্য কোন মশলা মিশিয়ে দেয়। তাতে একটা সুন্দর ফ্লেভার চলে আসে। এবারে ঐ টুকরোগুলো বয়ামে ভরে রাখা হয়। জলে মিশিয়ে এর শরবত আমার ভীষণ প্রিয়। আর পৈটিক গোলমালে একেবারে ঘরোয়া অব্যর্থ টোটকা। পুজোয় অবশ্য এটা সুজির মত রান্না করা হয়, কাচের অস্বচ্ছ ক্রিস্টালের মত দেখতে লাগে। ... ...
- উড়িষ্যার ভিতরকণিকায় অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ড থেকে হাজার হাজার অলিভ রিডলে প্রজাতির কচ্ছপ আসে ডিম পাড়তে – সেটা জানিস তো? - হ্যাঁ। - কিছু কচ্ছপ জেলেদের জালে ধরা পড়ে যায়। আর চোরাশিকারিরা তো আছেই। তারা ঐ কচ্ছপ ধরে। এই এলাকার লোক কচ্ছপ খায়, মানে এমনি তো পায় না। কচ্ছপ ধরা, বিক্রি নিষিদ্ধ। কিন্তু পেলে ছাড়ে না। আর বড় অলিভ রিডলেকে বলে বালিগড়। একটা বালিগড় চোরাগোপ্তা পেয়ে গেলে এদিকের মানুষের ঘরে উৎসব লেগে যায়। গতকাল আমাদের যে দুর্গাবৌদি রান্না করে, সে খুব হেসে হেসে নাতিকে কোলে নিয়ে বলছিল, “তুমি কী খেয়েছ?” বাচ্ছাটা আধো আধো করে বলছে – বালিগল। ... ...