অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন শহরে সাম্প্রতিক কালে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল এমনই এক আয়োজন, 'মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়া সিজ়ন ১৩'। আমাদের ভারতবর্ষের মতোই এখানেও অনুষ্ঠানটির মোটামুটি ভাবে একই ফরম্যাট - শেফের ডিগ্রী বা 'স্কিল সেট' না থাকা সাধারণ ঘরোয়া রাঁধুনেরা তাঁদের রন্ধন প্রতিভা দেখাতেই মূলতঃ উপস্থিত হন এখানে। প্রায় ছয়মাস ধরে চলা এই অনুষ্ঠানে বিভিন্ন বিশ্ববরেণ্য শেফেদের কাছ থেকে এরপর নানা কসরত শিখে এবং তাঁদের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে নিজেদের প্রতিভায় শান দিতে দিতে একসময় এঁদের মধ্যে কেবলমাত্র একজন বিচারকদের বিচারে শ্রেষ্ঠ হয়ে 'মাস্টারশেফ' শিরোপা ও দু লাখ পঞ্চাশ হাজার অস্ট্রেলিয়ান ডলার নিয়ে বাড়ি ফেরেন। ... ...
- মা, শ্বেত পাথরের টেবিলের গল্পটা বলবে বলেছিলে! - টেবিলের গল্প? টেবিলের তো আর আলাদা কোন গল্প হয়না রে বাবু, এ হল টেবিলের চারপাশের মানুষের গল্প। - সেটাই বল শুনি। - শোন তবে। আমাদের ছোটবেলায় খুব রেডিওতে নাটক শোনার চল ছিল। যেদিন যেদিন সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের শ্বেত পাথরের টেবিল নাটকটা হত, সেদিন মা, মামা, মাসিরা সব কাজ ফেলে রেডিও ঘিরে বসত আর নানান মন্তব্য করত। নাটকটা শেষ হয়ে যাবার পরেও অনেকক্ষণ সেই আড্ডা চলতেই থাকত। আলোচনার মূল কথা হল, এ তো আমাদের বাড়ির গল্প, সঞ্জীব বাবু কীভাবে জানলেন? ইত্যাদি। সেই সব গল্প থেকেই প্রথম জানতে পারি যে, আমার মামার বাড়িতে এককালে বিশাল এক নকশাকাটা শ্বেত পাথরের টেবিল ছিল। - নাটক থুড়ি গল্পটার সঙ্গে মিলটা কী? - গল্পটা তোকে পড়তে হবে, তবে তো? মোবাইলে খোল, গুগলে আছে। - আচ্ছা, ওয়েট, দেখি, ... ...
উমমম, দারুণ জিনিস এনেছে আজ, মাঝারি সাইজের একেবারে টাটকা জীয়ন্ত চিংড়ি মাছ। পুরোনো স্মৃতি মনে আসে। ওয়েটল্যান্ডে যখন দু’জনে চাকরি করতাম, কর্তা একবার পুকুরের গলদা চিংড়ি রান্না করে অফিসে নিয়ে গিয়েছিল। চিংড়িগুলো এতটাই তাগড়া ছিল, যে দুটো চিংড়ি ছ’ টুকরো করে আমরা ল্যাবের ছ’জন প্রোজেক্ট সায়েন্টিস্ট টিফিনে হাপুস হুপুস করে খেয়েছিলাম। সে গলদার দাঁড়াগুলো একেবারে নেভি ব্লু আর মোটা মোটা। কাঁকড়ার দাঁড়ার মতো দাঁতে চেপে ভেঙে খেতে হয়েছিল। কিন্তু এগুলো গলদা নয়, চাপড়া চিংড়ি। রান্নার বৌদের হাতে ছাড়লে ওরা সেই একটাই জানে – সেটাই করবে। ডুমো ডুমো আলু, নারকেল বাটা, আর সেই কাঁচা কাঁচা পেঁয়াজ বাটা দিয়ে মিষ্টি মিষ্টি ঝোল। ওরা যা পারে করুক। আমি একটু চিংড়ি আলাদা করে চিংড়ি থেঁতো বানাব। ... ...
মনিপিসি এগিয়ে দিল ডুমো করে কাটা ভাপিয়ে রাখা মানকচু। কড়াইয়ে আরো খানিক সর্ষের তেল পড়লো। তাতে তেজপাতা ফোড়ন। দেরি না করে তাতে পড়লো ভাপিয়ে রাখা মানকচু। হলুদ লবণ দিয়ে নেড়েচেড়ে তাতে ঠাকুমা বাটি থেকে মিহি করে বাটা জিরে আর শুকনো মরিচ বাটা দিয়ে দিল। এরপর বাটি ধুয়ে খানিক জলও। জল পেয়ে কড়াইয়ের তেলমশলা ধোয়া ছেড়ে দিল। খুন্তি দিয়ে খুব ভালো করে সেই মশলা কষাতে লাগল ঠাকুমা। ... ...
সারাদিনে এই একটা সময় যখন ঠাকুমার ডাকে আমার সারা দিতে ইচ্ছা হয় না। এই সময়ে ঠাকুমাও খুব কঠোর। আমার সকল অনিচ্ছাকে অবহেলা করে নির্দ্বিধায় আমার হাতে ধরিয়ে দেয় পেতলের ছোট গ্লাসে শেফালি পাতার রস আর চিরতার রস। চোখ ভরা অভিমান আর নি:শ্বাস আটকে আমি শেষ করি সেই তিতকুটে রস। ফাঁকা গ্লাস ঠাকুমার হাতে পৌঁছে যেতেই আমি আবার ফিরে পাই আমার সেই ঠাকুমাকে, যে ঠাকুমা কারণে অকারণে আমার হাত ভরে দেয় আনন্দ আর আস্বাদে, - ও ঠাকুমা, কোথায় পেলে রাঘবসই? দাদু এনেছে? ... ...
আজ আকাশের গায়ে অন্ধকার একটুও বসতে পারছে না। সুপারি বাগানের মাথায় বসে থাকা চাঁদটা এরইমধ্যে আরোও বড় হয়ে উঠেছে। সেই চাঁদের আলো সন্ধ্যা আকাশের গা থেকে ঠিকড়ে পড়ছে আমাদের উঠোনে। উঠোনে এবার পাঁচ প্রদীপ জ্বলে উঠল। কলার মাইজে একমুঠো ধান, একগোছা দূর্বা আর ক’খানা কড়ি রাখল ঠাকুমা। আর কলার খোলে পড়ল তালের ক্ষীর, তালের ফুলুরি, তিলের ক্ষিরশা আর পাতাপোড়া পিঠা। ... ...
আমি মহা উৎসাহে বলতে শুরু করলাম – “আরে তোমার মনে নেই – ওই যে কুমড়ো পাইকের গৌরাঙ্গ কাকু গো! চোট খেয়ে দাগি হয়ে যাওয়া কুমড়োগুলো যেগুলো কেউ কিনতে চাইত না আর ঠাকুমা বসে বসে চুন লাগাতো – সেই কুমড়ো একমাত্র কিনত গৌরাঙ্গ-কাকু। আজ বুঝতে পারলাম সেই পচা কুমড়ো নির্ঘাত বিদেশে পাচার করত এমন স্যুপ বানাবার জন্য”। “এই রোমান্টিক সেট-আপে ডিনার করতে এসে তোমার পচা কুমড়োর কথা মনে আসছে! ধন্য চাষা মাইরি”। ... ...
সপ্তদশ শতক। শাহ জাহান বাদশার হেঁশেল। মুঘলাই খিচুড়ির রোশনাই। আর তারই মধ্যে একটির নাম খিচড়ি দাউদখানি! সে নাম যেমন রহস্যময়, তেমনই বিচিত্র সে খানা—বলছে খিচড়ি, কিন্তু চাল নেই! নীলাঞ্জন হাজরা ... ...
টকে তরিবত বলতে শেষে একটু ভাজা মশলার গুঁড়ো দেওয়া যায়। আর কাঁচা তেল ছড়িয়ে নামানো হয়। আসলে মাছ কাটার সময়ে বলে দিতে হয়, ক’পিস হবে। তোর বাবা বাজার এনেই খালাস। কিছু দেখে না। তুই শিখে নে। আস্তে আস্তে চেষ্টা করতে করতে দেখবি হেঁশেলের কন্ট্রোল হাতে চলে এসেছে। আর এখানেও অনেক লোক তো। বড় পিস করে ভাপা করা মুশকিল। তাই এখানেও ছোট পিস কাটা হয়। তবে আমি তোর সঙ্গে একমত। ইলিশ না খেলে না খাব। একদিন খাব তো বড় টুকরো খাব। ... ...
বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। ফুরিয়ে গেছে অগ্রহায়ণের নগরকীর্তনও। তবে বাড়ি ফেরার কড়ে গোনা দিন এখনো শেষ হয়নি আমার। ক-দিন আগেই পিয়ন চাচা লাল ঝুলি থেকে দিয়ে গেছে চিঠি। পোস্টকার্ডে লেখা চিঠি। গোটা শব্দের সে চিঠিতে যতটুকু বাড়ি আর নিজের কথা লেখা তারচেয়ে অনেক বেশি লেখা আমার কথা। কেমন হল আমার পরীক্ষা, কতটুকু বড় হলাম আমি, এখনো পাতের খাবার না ফুরাবার অজুহাত খুঁজি কিনা, বাড়ির কথা মনে করে মনমরা হয়ে থাকি কিনা—কতশত প্রশ্ন! সেই পোস্টকার্ড আমি বারবার পড়ি, অনেকবার পড়ি। বিছানার তোষকের তলা থেকে সুযোগ পেলেই বের করে সামনে ধরি সেই পোস্টকার্ড, মা… ও মা…. ঠাকুমা আর কী লিখেছে? বাইরবাড়ির অর্জুন গাছে ফল এসেছে এবার? গোলেনূর দাদীর তেজপাতা গাছে নতুন পাতা এল? এবার কি পাটাই ব্রত করবে ঠাকুমা? ... ...
বড়দাদীর ভাষায়, রিজিকে যা আছে তা জুটে যাবেই। তাই আজ এই দু-পদের সাথে যুক্ত হলো মাছ সুক্তোও। আর এই পদের যোগানদার – স্বয়ং মুসা। এমনিতে স্কুলে যাবার কথা শুনলে মুসা পালিয়ে যায়। কিন্তু আজ কোন ফাঁকে চলে গেছে স্কুলের উঁচু মাঠে – তা কারো জানা নেই। সেখান থেকে তুলে এনেছে এক গোছা বথুয়া শাক। আর এনেই বড়দাদীর কাছে বায়না ধরেছে বিক্রির। বড়দাদীও কম বোদ্ধা ক্রেতা না। বড়দাদী দরদাম করে এক টাকার বথুয়া শাক তিরিশ পয়সায় কিনেছে মুসার কাছ থেকে। সেই শাকই ভাগযোগ হলো বড়বাড়ির দুই ঘরে। ... ...
বারান্দায় আজ পাত পড়েছে আমার একার। আর উঠোনে বসেছে মুসা। আমার পাতে আউশের লাল ভাত, উচ্ছেপাতার বড়া আর কাজলি মাছের আদাঝোল। আমার অনিহায় আড়ি দিতে মা নিজেই ক’দিন হলো খাইয়ে দেয় আমাকে। আজও তার ব্যত্যয় হল না। লালভাতে উচ্ছেপাতার বড়া মেখে আমার মুখের সামনে ধরতেই নাকে ধাক্কা দিল উচ্ছেপাতার তিতকুটে ঘ্রাণ। ভাতের গ্রাসটুকু মুখে পুরতেই সোঁদা একটা স্বাদ ছড়িয়ে গেল মুখে, ও মা, আরেকটু বড়া ভেঙে দাও… ... ...
ঠাকুমা কচুপাতা নেবার আগে এ-গাছ ও-গাছের গোড়ার মাটি আলগা করে দিচ্ছে। ঠাকুমার বাগানে মাচা ভরা ঝিঙে ধুন্দল ঝুলছে। আর শিউলি গাছ বেয়ে উঠে গেছে পুঁইয়ের লতা। তবে এসবে আমার মন বসে না। আমি শ্বেতকাঞ্চনের ঝাড় ঘেঁষে দাঁড়ালাম। মাটি থেকে দেবদারুর ফল কুড়িয়ে পুকুরের জলে ছুঁড়ে মারলাম। পড়ন্ত আগবেলায় রোদের তাপে ঝিমিয়ে থাকা পুকুরটায় ঢেউ উঠল, কোণায় কোণায় নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকা সবুজ মাথা তোলা হেলেঞ্চা শাকগুলো নড়েচড়ে উঠলো। আর ঠিক তখনি তাঁতঘর ঘেঁষা নিমগাছটা থেকে ডেকে উঠল কুটুম পাখি, কুটুম আসুক, কুটুম আসুক… ... ...
বাংলা লিখিত সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদের যুগ থেকে কোম্পানি-রাজের পত্তন পর্যন্ত রচিত নানা বাংলাগাথা চর্ব্যচোষ্যলেহ্যপেয়র রঙিন বিবরণে ভরপুর। উঠে আসে বাঙালির রসনা-সংস্কৃতির বিবর্তনের ছবি। এ কিস্তিতে নিরামিষ ভূরিভোজ। লিখছেন ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়। ... ...
মনুর ধর্মশাস্ত্র সহ নানা শাস্ত্রে খাদ্যকে একটি বিশেষ আর্থসামাজিক ব্যবস্থা কায়েম রাখার অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের যে নির্দেশ রয়েছে খিচুড়ির ইতিহাস খুঁজতে বসলেই মেলে পুরাণগুলোতেও ঠিক সেই চতুর কৌশল। নীলাঞ্জন হাজরা ... ...
রান্নাঘর থেকে গোলারুটি, সুজির মোহনভোগ এখন বড়ঘরের লাল বারান্দায় চলে এসেছে। আর সেখানে কেরোসিনের স্টোভে বসেছে খাবড়ি ভরা চায়ের জল। তা না করে উপায় আছে? আজ কতদিন পর সন্ধ্যায় বড়ঘরে চায়ের আড্ডা বসবে। সেখানে কি আর শুধু এ বাড়ির মানুষ থাকবে? ওই তো জ্যেঠি ঠাকুমা সন্ধ্যার পূজা সেরে চলে আসবে, চলে আসবে শুক্লার ঠাকুমা আর তাঁতঘর বন্ধ করে মানিক কাকুও। ... ...
খিচুড়ির পূর্বজ কৃসর-র খোঁজে ভরতমুনির রুদ্ধশ্বাস নাট্যশাস্ত্র পার করে এবার পার করতে হবে মনুর ধর্মশাস্ত্র—মনুষ্য রসনাকে একদিকে ভয় অন্যদিকে লোভ দেখিয়ে শৃঙ্খল-বদ্ধ করার সে রোমহর্ষক প্রয়াস। খাবার রইল না কেবলই পেট-ভরানোর বস্তু, তা হয়ে গেল একটা বিশেষ আর্থসামাজিক ব্যবস্থা কায়েম রাখার অন্যতম হাতিয়ার। সেই খাদ্যাস্ত্র হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে কৃসর। নীলাঞ্জন হাজরা ... ...
বাংলা লিখিত সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদের যুগ থেকে কোম্পানি-রাজের পত্তন পর্যন্ত রচিত নানা বাংলা গাথা চর্ব্যচোষ্যলেহ্যপেয়র রঙিন বিবরণে ভরপুর। উঠে আসে বাঙালির রসনা-সংস্কৃতির বিবর্তনের ছবি। এই শেষ কিস্তিতে রইল বাঙালির ‘টিফিন’ আর শেষপাতে ‘অম্বল’ ও পিঠে-পায়েস-মেঠাইয়ের মেলা। লিখছেন ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় ... ...
ষোড়শ শতক। বাধার বিন্ধ্যাচল টপকে মধ্যযুগীয় দক্ষিণি খিচুড়ির খোঁজ। এক আশ্চর্য কুকবুক সুপশাস্ত্র। কন্নড় ভাষায় রচিত। রচনাকার তৃতীয় মঙ্গরস। বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সেরা সময়ের খানদানি খানাদানার সাক্ষী সে কুকবুক। আর আমরা যাকে খিচুড়ি বলে চিনি, কন্নড়ে তাই হুগ্গি! নীলাঞ্জন হাজরা ... ...
- মেয়েদের ইসকুলে মারপিট হয়? কই আমাদের নিবেদিতা ইসকুলে তো এমন হত না। - তুমি হাসালে মা। মারপিট শুধু ছেলেরা করবে? মেয়েরা পারবে না? এমন প্যাঁচ আমি জানি, একদম শুইয়ে দেব। ইসকুলে সুরক্ষার ভিডিও দেখিয়েছে। অনেক বন্ধু কারাটে শেখে। আমরা দল করে প্র্যাকটিস করি। চুটিয়ে মারপিট করি। - ভগবান! মন্দ বলতে পারছি না। এ বেশ ভাল কথা। তবে কেউ আহত না হয়, সেটা দেখতে হবে। আমি কী বলছিলাম সব গুলিয়ে গেছে। - সেনবাড়ি আর মিত্র বাড়ির সম্পর্ক আর তার সঙ্গে মোহনবাগান - এটাই বলছিলে। ... ...