এটা ভালো লক্ষণ যে এবারের আন্দোলনে কলকাতা সহ আরো বহু বাইরের অঞ্চলের মানুষের সমর্থন পাওয়া যাচ্ছে। এই সমর্থনের প্রক্রিয়ায় যদি তাঁরা বুঝতে পারেন যে বন্ধ বাগান আর তাতে অনাহার মৃত্যুর বাইরেও চা বাগানের সমস্যাটা অনেক গভীর, তাহলে একটা কাজের কাজ হবে। মালিকদের ভয়াবহ মুনাফাখোরি নীতি, ফাটকাবাজ মালিকদের দৌরাত্ম্য আর তাতে সরকারের প্রচ্ছন্ন সমর্থন আর উদাসীনতাই যে মূলতঃ চা শিল্প আর শ্রমিকদের বিপর্যয়ের মূল কারণ, এই ভিত্তিটায় দাঁড়ানো দরকার। বন্ধ বাগান বা অনাহারে মৃত্যু সমস্যায় একটা সামান্য অংশ, ন্যূনতম মজুরি না দেওয়ার মত চা বাগানের সার্বজনীন সমস্যাগুলো ছড়িয়ে আছে কমবেশি সমস্ত বাগান জুড়ে। ... ...
প্রসঙ্গান্তরে, প্রতিবছর আমরা ১৫-ই আগস্ট তথা স্বাধীনতা দিবসের দিনটিতে যথেষ্ট পরিমাণ বেলপাতা-ফুল-পাঁজি-বাতাসা নিয়ে স্বাধীনতার গল্প শুনি। ২০১৭ সালে দুই দিনাজপুর এবং মালদার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ভয়ঙ্কর বন্যা শুরু হয়েছিল ১৫ আগস্ট। এক হাঁটু জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে গ্রামের এক স্কুলের প্রধান শিক্ষক আমাদের জাতীয় পতাকা তুলেছিলেন, সাথে কয়েকজন বাচ্চা শিক্ষার্থী ছিল। পরের দিন সংবাদপত্রের খবর হয়েছিল এ ঘটনা। সমস্ত বঞ্চনা, অনাদর, অবহেলা, অবান্তর মৃত্যু, বুভুক্ষা, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের হাজারো ঝড়ঝাপটা সত্ত্বেও মানুষের স্মৃতিতে নির্মিত হয় স্বাধীনতা দিবসের বর্ণময় চিত্রকাব্য – এমনকি জীবনে কোন বর্ণ না থাকা সত্ত্বেও। এখানে এসে বিভিন্ন তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা – হবসবম, হানা আরেন্ট, নর্বার্ট এলিয়াস, স্পিভাক, লাকাঁ আদি সমস্ত বিশ্ব তত্ত্বসাম্রাজ্যের শাসক সম্রাটেরা – ভেঙ্গে পড়তে থাকে মানুষের শরীরী অভিজ্ঞতা বা emobodied experience-এর কাছে। অদ্ভুতভাবে অনেকেরই সেদিন মনটাও হয়তো বা একটু উড়ুক্কু থাকে। ... ...
এক ছিল হনুমান। সে ছিল খুব রামভক্ত। মানে, প্রথম থেকে কি আর ছিল? এক সময় অবধি হনুমান দিব্যি জঙ্গুলে জীবন কাটাতো, হনুমতীদের সঙ্গে খুব ফস্টিনস্টি করতো, হনুমানোচিত নানারকম কাজ এমন দক্ষতার সঙ্গে করতো, যে গল্প ছড়িয়ে পড়েছিল হনুর কীর্তিকলাপের। বাপ পবনদেবের অর্থ আর প্রতিপত্তির সাহায্য নিয়ে অনেক গ্যাঁড়াকল থেকে বেঁচেও ছিল অবশ্য ছোকরা। প্রতিপত্তি না থাকলে কি আর সূর্য নিজে প্রাইভেট ট্যুশন পড়ায় কাউকে? বেয়াদপ হনু সেখানে আপেল-ফাপেল নিয়ে কী একটা কেত্তন করেছিল, পবনদেব নিজের উদ্যোগে সে খবর ধামাচাপা দেন। ... ...
কিন্তু এতদসত্ত্বেও শেষেশ বিজেপির ব্যর্থতা নিয়ে এ যাবৎ কালে বহু আলোচনা সামনে এসেছে। আদি-নব্য সংঘাত, মুখ্যমন্ত্রীর মুখ ঠিক করতে না পারা, মেরুকরণের তাস ঠিক মতো কাজে না আসা ইত্যাদি ইত্যাদি নানাবিধ ব্যখ্যা রয়েছে। শুভেন্দু অধিকারীর অতি হিন্দুত্ব, যোগী আদিত্যনাথের অ্যান্টি রোমিও স্কোয়াডের হুঙ্কার ইত্যাদি নানা কিছু। আমার মনে হয়েছে এর কারণ 'আরবিট্রারি মেকানিজম', খেয়ালখুশির নীতি। ২০১৪-এর আগে থেকেই বিজেপি আর স্রেফ রাজনৈতিক দল নয়, তার কর্মপরিচালন পদ্ধতি একটা কর্পোরেট হাউজের মতোই। ভোট পরিচালনার জন্য আইটি-সেল সহ নানা বিভাগের কর্মীদের দায়িত্ব দেওয়া হয়, টার্গেট ঠিক করে দেওয়া হয়। পাখির চোখটাও সুনির্দিষ্ট থাকে। ঠিক যেমন কোনও পণ্যের বাজারিকরণের ক্ষেত্রে প্রচার অভিযান যে ভাবে হয়, বিজেপিও সেইটাই করে। এমনটাই হয়ে এসেছে এ যাবৎ। বিজেপি ঘেঁষা বুদ্ধিজীবী সম্প্রতি আনন্দবাজার পত্রিকায় সম্পাদকীয় নিবন্ধে দুঃখপ্রকাশ করেছেন বিজেপির ভোট বিস্ফোরণ না হওয়া নিয়ে। তাঁর যুক্তি, বিজেপি যথেষ্ট হিন্দুত্বের প্রচার করেনি। মোহিত রায়ের যুক্তি একরকম ভাবে ঠিকই। বিজেপির নির্বাচন পটীয়ানরা এই একটা ইস্যুতে লক্ষ্য স্থির না করে যেখানে যেমন সেখানে তেমন নীতি নিয়ে প্রচার চালিয়েছেন। কোথাও চেয়েছেন শুভেন্দু অধিকারীকে মুসলিম বিরোধিতা ও হিন্দুত্বের মুখ করতে। কোথাও চেয়েছেন নতুন জেলার প্রতিশ্রুতিকে তুলে ধরতে। কোথাও আবার মতুয়া তাস, রাজবংশী তাস ফেলেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং তাঁর অভিন্নহৃদয় সহোদর। ভার্চুয়াল ক্যাম্পেনিংও হয়েছে তদনুসারী। ডিজিটাল মার্কেটিং নিয়ে ঈষৎ জ্ঞান আছে এমন ব্যক্তিমাত্রেই বলবে, বিপর্যয়ের কারণটাই এইটাই, একটি মূল ফোকাস ঠিক করতে না পারা। ... ...
সমস্ত ধরনের কাজের যন্ত্রায়ণ আজ এমন একটা পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে, কোন একটা কাজ মানুষের জ্ঞানবুদ্ধি ছাড়া হবে না এটা হয়তো আর বলা যাবে না। ফলে সমস্ত ধরনের কাজে মানব-শ্রমের প্রয়োজন কমতে কমতে একদম তলানিতে। এতে শিল্প ও ব্যবসা মহল আপাততঃ খুব খুশি। উৎপাদন বাড়ছে, খরচ কমছে, ঝামেলা কমছে। প্রাথমিক বিনিয়োগ বাড়ছে অনেকটাই। কিন্তু তার জন্য ব্যাঙ্ক আছে। কিন্তু সমস্যার শুরু সেখানেই। ব্যাঙ্ক কার টাকায় চলে ? সোজা উত্তর, সাধারণ মানুষের টাকায়। মানুষ ব্যাঙ্কে টাকা রাখে। সেই টাকা ব্যাঙ্ক নানান উদ্যোগে খাটায়। মানুষ যে টাকাটা ব্যাঙ্কে রাখে, সেটা কোথায় পায় ? রোজগার থেকে। মানুষের হাতে কাজ না থাকলে সে ব্যাঙ্কে জমা করার টাকা কোথায় পাবে ? কাজেই আজ না হলে কাল ব্যাঙ্কের পুঁজিতে টান পড়তে বাধ্য। ... ...
অনেকে আছেন যাঁরা হয়তো হ্যান্ডলুম ভালোবাসে, কিন্তু প্রথাগত টেক্সটাইলের শিক্ষা নেই। ফলে তারা নিজের অজান্তেই নকল কাপড় বিক্রি করে ফেলে। ২০১৫ সালের একটা ঘটনা বলি, দিল্লির একটি হস্তশিল্প এনজিও-র সাথে প্রদর্শনী করছিলাম। আমার পাশেই এক ব্র্যান্ড তাদের ‘পিচওয়াই’ আঁকা কাপড় ও হস্তশিল্প বিক্রি করছিল। সুন্দর দেখতে বলে বিক্রিও ভালো হচ্ছিল। দুদিন পরে দেখা গেল তারা যা বিক্রি করছে অধিকাংশই ডিজিটাল প্রিন্ট করা। তারা নাথদ্বার থেকে পিচওয়াই শিল্পীদের দিয়ে কিছু ছবি আঁকিয়ে নিয়ে সেগুলোর ডিজিটাল অনুকরণ করে কাপড়ে প্রিন্ট করেছে। জানতে পারার পর এনজিও-র কর্মীরা তাদের স্টলের সামনে ‘ডিজিটাল প্রিন্ট প্রোডাক্ট’ লিখে দিলেও তাতে ক্রেতাদের কোনো ভ্রূক্ষেপ ছিল না। ডিজিটাল প্রিন্ট করে তারা কীভাবে পিচওয়াই-এর মতো লুপ্তপ্রায় শিল্পের ক্ষতি করছে, তা তাদের শেষপর্যন্ত বলে বোঝানো যায়নি। ... ...
যাদবপুর, যাদবপুর, যাদবপুর….কান ঝালাপালা করছে… যেন পৃথিবীর আর কোথাও আমরা হেনস্তা করি না…. যেন আমাদের হাতে রক্ত লেগে নেই! আমার ছাদে গিয়ে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে….না-আ-আ-আ। এই হেনস্তা প্রতিনিয়ত, প্রতি মূহূর্তে হয়ে চলেছে। বিভিন্ন ফর্মে। আর তার ফলে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে কত কত জীবন। স্বপ্নদীপ মরে গেছে। সবাই মরে না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে কিছু বিশাল না শুকোনো ক্ষত নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ৱ্যাগিং আসলে ক্ষমতার ভাষা, জোর ফলানোর ভাষা। সে ভাষা কোথায় নেই? আমরা “অপর”কে সম্মান দিতে জানি? জানলে আভিজাত্যের প্রতিমূর্তি জয়া বচ্চন ফিল্মফেয়ারের মঞ্চে ঋতুপর্ণর হাতে বটুয়া ধরাতেন না। জানলে শিক্ষক থেকে অফিসের বস অব্দি আমরা সবাই আমাদের অধস্তনদের সঙ্গে ক্ষমতার ভাষা ব্যবহার করতাম না। আমাদের স্কুলে-কলেজে শারীরিক শাস্তি বন্ধ করার জন্য আইন আনতে হত না। ... ...
দু’কামরার ছ’শো তিরিশ ফুট ফ্ল্যাটে ততোধিক ছোটো ব্যালকনিটায় বসানো টব, ঝোলানো টবে নানান ফুল, পাতাবাহার গাছে এমন ভাবে ভরিয়ে রেখেছে যে দূর থেকে দেখলে যে কেউ ব্যালকনি না ভেবে ছোট্ট একটা বাগান বলেই মনে করবে। তাতানের ছ’বছর বয়েস পর্যন্ত সোনারপুরের একটা ভাড়া বাড়িতে থাকতো ওরা। ছোটোবেলায় খাওয়া নিয়ে খুব ঝকমারি ছিল। ভীষণ ঘ্যানঘ্যানে স্বভাবেরও ছিল তাতান। হঠাৎ তখন পাঞ্চালী আবিষ্কার করে গাছ-গাছালির কাছে নিয়ে গেলে ছেলে একদম চুপ করে থাকে। বড়ো বড়ো নরুনচেরা চোখদুটোয় গাছপালাদের অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতো। গাছ দেখতে দেখতে মুখের খাবার থুঃ করে ফেলে না দিয়ে বিনা বাধায় খেয়ে নিত। তাতানের পাঁচ বছর বয়েসে ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়। সে বছর সাংঘাতিক এক কালবৈশাখীর ঝড়ে শোভনদের সেই ভাড়াবাড়ির ছোট্টো বাগানটায় বেশ ক’টি গাছ উপড়ে ভেঙে পড়ে। ... ...
এখানেই একটা মৌলিক অধিকারের প্রশ্ন এসে যায়। গোপনীয়তা মানে কোনও কিছু লুকোনো নয়, উল্টে প্রতিটি নাগরিকের একটি নিজস্ব জায়গা থাকাটাই গোপনীয়তা, যা কোনওভাবেই অন্য কারো দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। যাঁরা ভাবছেন যে তাঁর ব্যক্তিগত ফোনে তো এই স্পাইওয়ার সরকার ঢোকায় নি, তাহলে তাঁর এই বিষয়ে না ভাবলেও চলবে, তাঁরা সম্পুর্ণ মুর্খের স্বর্গে বাস করছেন। যেহেতু কোনও একটি ব্যক্তির সমস্ত কিছুর নাগাল পাওয়া সম্ভব এই স্পাইওয়ারের দৌলতে, সুতরাং তাঁর কন্টাক্ট তালিকারও নাগাল পাওয়া এমন কিছু কঠিন নয়, সেই সুত্র ধরে তাঁদের অর্থনৈতিক লেনদেনও যে সরকার দেখছে না, তা কি নিশ্চিত করে বলা যায়? ... ...
ছেলেটা অর্ডার নিতে এলে – পিৎজা এদের স্পেশালিটি কিনা জিজ্ঞেস করলে, হ্যাঁ বলল। আমার কি মনে হল - এও না সেই অন্য রেষ্টুরান্টের মত পিৎজার ইতিহাস ব্যাখ্যা করা শুরু করে! তাই সে-ই কিছু বলার আগেই আমি বললাম – আমি জানি পিৎজা বলে আধুনিক কালে আমরা যে জিনিসটিকে চিনি তার জন্ম হয় ১৮৮৯ সালে ইতালির নেপলস্-এ। একসময়ে নেপলস্-এর বাজারে যা পরিচিত ছিল ‘পিৎজা আলা মোজারেল্লা’ নামে, সেই পিৎজা খেয়েই রাণী মার্গারিটা কুপোকাত – বিশাল ভালোবেসে ফেলে ডিক্লেয়ার করে দিলেন, যে এটাই তাঁর সবথেকে প্রিয় পিৎজা। ব্যাস, সেই থেকে এই পিৎজার নাম হয়ে গেল ‘পিৎজা মার্গারিটা’ সেই ওয়েটার দেখি আমার কান্ড দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে – ... ...
ক্লাস সিক্সের ঘরটা মস্ত বড় হল্, প্রায় ৭০ জন ছাত্রী অনায়াসে ধরে যায়, কিন্তু অত ছাত্রী তো হয় না এই স্কুলের সিক্সে| ফাইভে উঠে যারা পরীক্ষা দিয়ে অন্য কোনও স্কুলে চান্স পায়, তারা সবাই চলে যায়| যারা ফেল করে থেকে যায়, তাদের সাথে সাধনাদির প্রাথমিক বিভাগ থেকে আসা মেয়েরা আর কোনও স্কুলে ক্লাস সিক্সে কেউ তিনবার ফেল করলে যখন সেখান থেকে টিসি দিয়ে দেয়, তারা তখন এখানে এসে সিক্সে ভর্তি হয়| অন্য সব স্কুলেই নিয়ম হল একই ক্লাসে তিনব্ছরের বেশী থাকতে দেওয়া হয় না, তৃতীয়বারেও ফেল করলে টিসি দেওয়া হয়| ভাগাড়পাড়া স্কুলে অবশ্য এমন নিয়ম নেই, যতবার খুশী ফেল করে থাকা যায় এখানে| শুধু তিনবারের বেশী হয়ে গেলে সারা বছরের মাইনে ২৪ টাকার জায়গায় ৩৬ টাকা হয়ে যায়| এই হলঘরে বড়সড় পাঁচটা জানলা, মোটা মোটা লোহার শিক লম্বালম্বি বসানো| দুটো শিকের মধ্যের ফাঁক দিয়ে একটা রোগা মেয়ে দিব্বি গলে বেরিয়ে যেতে পারে| ক্লাসের পাশেই একটা কচুব্ন| আসলে ওটাও একটা মস্ত মাঠ, তবে শুধু মাঝ্খানে অনেকটা অংশ পরিস্কার আর পশ্চিম, উত্তর আর দক্ষিণে কচুবনে ভর্তি, পূবদিকে আমাদের স্কুলের মাঠ| দুপুরে ছেলেদের স্কুলের ছেলেরা নাকি দুটো মাঠজুড়েই খেলে| পশ্চিমের কচুবন ঘেঁষে একটা মস্তবড় শিমূলগাছ, এপ্রিল মাসভর লাল টকটকে ফুলে ভরে থাকে| কিন্তু নীচে পড়ে থাকা শিমূলফুলগুলো খেয়াল করলে দেখা যায় কেমন বিশ্রীমত দেখতে, উঁচুতে যখন ফুটে থাকে শুধু লাল টকটকে পাপড়ি দেখা যায়, তাই সুন্দর দেখায়, মাটিতে খসে পড়লে আসল রূপটা দেখা যায়| ক্লাসের পেছনে পাকা রাস্তা, রিকশা, সাইকেল চলে অনবরত| লোকজন বাজার করে ফেরে, ডোরাকাটা নাইলনের ব্যাগের মুখ দিয়ে উঁকি মারে কচুর লতি কি মুলোশাকের ডগা, ডেইলি প্যাসেঞ্জাররা উর্ধশ্বাসে দৌড়ায় ট্রেন ধরতে| রাস্তাটার পাশেই সেই যে সেই পুকুরটা, ক্লাস থ্রীয়ের জানলা দিয়ে যাকে দেখতাম| সোমবার সকালে এই পেছনের জানলা দিয়েই আমরা নজর রাখতাম রেখাদি আসছেন কিনা| রেখাদি আমাদের ক্লাসটিচার, সোমবারে কলকাতা থেকে আসেন তাই ট্রেন থেকে নেমে এদিক দিয়ে আসতে দেখা যায়, অন্যদিন বাড়ী থেকে আসেন, সে এদিক দিয়ে দেখা যায় না| ওঁকে আসতে দেখলেই আমরা লক্ষ্মী শান্ত হয়ে বই নিয়ে বসে যাই| উনি এসে ক্লাসে গন্ডগোল হতে দেখলে এলোপাথাড়ি বেত চালান, অনেকটা পুলিশের লাঠিচার্জ করার কায়দায়, কারুর চোখে লাগল কি নাকে ঢুকে গেল সেসব খেয়ালও করেন না| ... ...
শিক্ষার প্রথম সারিতে থাকা মানুষজন ক্রিয়েটিভ হবেন এটা স্বাভাবিক। আমার আপত্তি নেই। আমার আপত্তি অন্য জায়গায়। আমার এক পরিচিত মাস্টারমশাই সোশ্যাল গ্রুপে জ্বালাময়ী কবিতা আবৃত্তি করে ফাটিয়ে দিচ্ছেন। সাধু সাধু। গল্পটা হচ্ছে ব্লক লেবেল বা পাড়া লেবেল এও ওনার স্কুলের কোন ছাত্র বা ছাত্রীকে দেখেনি কোন আবৃত্তি প্রতিযোগিতায়। ওনার স্কুলের কয়েকজন ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানলাম ওরা জানেই না অমুক মাস্টারমশাই এত ক্রিয়েটিভ বলে। তা মশাই এই সোশ্যাল গ্রুপ ক্রিয়েটিভিটি সমাজের কি লাভ দিলো। মানে ধরুন আপনি হাসপাতালের ডাক্তার, কিন্তু আপনার হাসপাতালের লোকজন জানেনই না আপনি চিকিৎসা করেন। তা এতে কি সম্মান বাড়ে? কী জানি? ... ...
বীরেনবাবু ভূগোল পড়াইতেন। তিনি ম্যাপ লইয়া ক্লাসে আসিতেন। দেওয়ালে ম্যাপ টাঙ্গাইয়া তিনি একে একে ছাত্রদের ডাকিতেন এবং কোনো এক বিশেষ স্থান, নদী, রাজধানী, পর্বত ইত্যাদি খুঁজিতে বলিতেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছাত্ররা ব্যর্থ হইত। তখন বীরেনবাবু সস্নেহে সেই বিফল ছাত্রকে কাছে ডাকিতেন এবং শুধাইতেনঃ 'ফুচকা খাইবি?'বলাই বাহুল্য, ভীরু ছাত্র মাথা নাড়িত। অতপর, বীরেনবাবু সেই ছাত্রের জুলফিদ্বয় দুই হাতের আঙুলে ধরিয়া উপরের দিকে আকর্ষণ করিতেন। তখন, সেই অসহায় বালক দুই পায়ের আঙগুলে ভর দিয়া মাধ্যাকর্ষণ অগ্রাহ্য করিয়া দন্ডায়মান হইত। নীচে নামিলে অধিক ব্যথার উদ্রেক হইবে। জুলফির আকর্ষণে পদযুগল মাটি ছাড়িয়া উপরে যাইলে অধিকতর যাতনা! এইরূপ ত্রিশঙ্কু অবস্থায় শাস্তিপ্রাপ্ত বালক ত্রাহি ত্রাহি রব ছাড়িত। ইহাতে হাস্যরসের উপাদান থাকিলেও সহপাঠীরা ইহাতে আদৌ কৌতূক পাইত না। ঘুঁটে পুড়িয়া যাইত, কিন্তু গোবর হাসিত না। শরতের আমলকী বনের ন্যায় বালকদিগের বুক আশংকায় দুরুদুরু করিত। না জানি কখন কাহার ডাক পড়ে? কাস্পিয়ান সাগর বা রাইন নদী চিহ্নিত না করিতে পারিলে অদৃষ্টে বীরেনবাবুর ফুচকা রহিয়াছে। ... ...
ঠাকুমা তো জানে না—এগিয়ে চলা প্রতিটি মুহূর্ত আমার বুকের ভেতর দামামা বাজাচ্ছে। বুঝতে পারছি সব আকুতি বিফল হয়ে আমাদের আরেকটু পরেই শহরে ফিরে যেতে হবে। এমন সময়গুলোতে আমার কিচ্ছু ভালো লাগে না। এসব সময়ে আমি শুধু দেখি আমার বাড়িটাকে, দেখি বাড়ির মানুষগুলোকে, এমনকি উঠোনে দুলতে থাকা গাছের ছায়াগুলোকেও। শহরের বাসায় রোদতপ্ত নিরিবিলি দুপুরে মা যখন ভাতঘুম দেয়, তখন নির্ঘুম আমি মায়ের পাশে শুয়ে এসব আবার দেখি খোলা চোখের অন্দর পেরিয়ে বুকের কোঠর থেকে। ... ...
সেদিন আমরা সকাল থেকে আরবিক/মিডল-ইস্টার্ন খেয়ে যাচ্ছিলাম বলে আমাদের হোস্ট বাছল ইতালিয়ান রেস্টুরান্ট। আমাকে আর মুখ খোলার অবকাশই দিল না – কারণ ইতালিয়ান ক্যুজিন আমার সবসময়ই ফেভারিট, অবশ্য যদি ভালো করে বানাতে পারে তবেই! রেস্টুরান্টে গিয়ে দেখা গেল, দুটো অপশন আছে – ভিতরে বসে খাওয়া এবং আউটডোর ডাইনিং। অবশ্যই আউটডোর ডাইনিং বেশি আকর্ষণীয়, বাইরে ১২ ডিগ্রি ঠান্ডা এবং হালকা বাতাস বইছে। এই অবস্থায় আউটডোর ডাইনিং করার কী মানে কে জানে! আমি মৃদুভাবে ভাবপ্রকাশ করলাম, দাদা, বাইরে কি খেতেই হবে? এদিকে আমার হোস্টের সেই রেস্টুরান্ট খুব ভালো লেগেছে আগের বার খেয়ে, তাই এইবারেও অতিথিসৎকার করতে বাইরেই বসা ঠিক হল। আমাকে আশ্বস্ত করা হল এই বলে, যে দেশে প্রচুর গ্যাস – তাই নাকি খেতে বসে ঠান্ডা লাগলে আমার পিছনে গ্যাসবাতি জ্বেলে দেবে! তাহলে আর ঠান্ডা লাগার চান্স নেই। ... ...
মেগামার্টের চত্বরে বাইকটা পার্ক করতে করতেই বৃষ্টি এসে গেল। এখানে বৃষ্টি, হয় আকাশ থেকে বালতি উপুড় করে জল ঢালে নয়ত জলের গুঁড়ো স্প্রে করে। দুটোর কোনওটাতেই ছাতা কোনও কাজে লাগে না।আজকে অবশ্য বৃষ্টি মাঝারি গতিতে একদম সোজা নেমে আসতে লাগল, ছাতা থাকলে কাজেই লাগত। জিতু অল্প দৌড়ে মিঠাসের ভেল কাউন্টারের শেডের নীচে উঠে দাঁড়াল। হেলমেট খুলে মাথায় পেঁচানো বড় কাপড়টা খুলে হাত ঘাড় মুছে পিঠের ব্যাগটায় হাত দিয়েই চমকে ওঠে। হাতে চ্যাটচ্যাটে মত কি যেন লেগে যাচ্ছে। কাপড়ে ঘষে মুছে তাকিয়ে দেখে টমেটো কেচাপের মত রঙ আর গন্ধটা … গা গুলিয়ে ওঠা। ... ...
দীর্ঘদিন আমরা ইংরেজদের দাসত্বে থাকলেও, আমাদের বাল্যে বিলেত অর্থাৎ ইংল্যাণ্ড সম্বন্ধে বেশ সমীহ জাগানো একটা ধারণা তৈরি করেছিলেন, আমাদের বিলেত-ফেরত ডাক্তার ও ব্যারিষ্টাররা। তাছাড়া ইউরোপের যে কটি দেশ সম্পর্কে আমাদের কৌতূহল ছিল, সেগুলি হল, ফ্রান্স, ইটালি, জার্মানি, স্পেন, গ্রীস ইত্যাদি। আরও কিছু দেশ যেমন, পোল্যাণ্ড, রোমানিয়া, হাঙ্গেরি, চেকোশ্লোভাকিয়াকে চিনতাম সে দেশের ডাকটিকিট সংগ্রহের সুবাদে। এখনও মনে আছে, পোল্যাণ্ড, হাঙ্গেরি এবং চেকোশ্লোভাকিয়ার স্ট্যাম্পগুলি, ইংল্যাণ্ডের “মহারাণি” মার্কা একঘেয়ে স্ট্যাম্পগুলির তুলনায় অনেক বেশি আকর্ষণীয় এবং চিত্তাকর্ষক ছিল। আরেকটা দেশের নামও মনে আছে - “নিশীথ সূর্যের দেশ” নরওয়ে! আলোচ্য গ্রন্থদুটি পড়া শেষ করে মনে হল, লেখকের হাত ধরে ইউরোপের ওই অচেনা-অজানা-অস্পষ্ট দেশগুলি থেকে এইমাত্র যেন ঘুরে এলাম। ... ...
এমনই এক নির্মম বাস্তবতায় সবশেষ, ২৩ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি সদরের বলপাইয়া আদাম এলাকায় পাহাড়ি গ্রামের ভেতরে ঢুকে নয়জন সেটেলার বাঙালি হামলা ও লুঠপাঠ চালায়। এ সময় তারা বাড়ির প্রতিবন্ধী চাকমা মেয়েটিকে গণধর্ষণ করে। লক্ষ্যণীয়, সেপ্টেম্বরেই খাগড়াছড়ির দীঘিনালা ও মহালছড়িতে দুজন পাহাড়ি স্কুলছাত্রী এবং বান্দরবানে এক ত্রিপুরা নারী ধর্ষিত হয়েছেন, আদিবাসী বলে এ পর্যন্ত কোনো ঘটনারই সুরাহা হয়নি। ওই ঘটনার পর ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের একজন প্রতিনিধি নির্যাতিতা প্রতিবন্ধী মেয়েটির বাড়িতে যান। তিনি দেখেন, মেয়েটির মা বার বার মূর্ছা যাচ্ছেন। আর আহাজারি করে বলছেন, “আমরা কি এদেশের নাগরিক নই? তাহলে কেন আমাদের ওপর এমন অত্যাচার?” সাংবাদিক খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, কয়েক বছর আগে বাবা ও ভাই মারা যাওয়ার পর থেকে মেয়েটি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন, তিনি কিছুটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। পাহাড়ের আরো আট-দশটা নির্যাতনের ডামাডোলে প্রতিবন্ধী নারী গণধর্ষনের ঘটনাটিও হয়তো হারিয়ে যেতে পারতো। কিন্তু এক্ষেত্রে সোচ্চার হয় দেশ। করোনাক্রান্তির ভেতরেই পাহাড়ে তো বটেই, খোদ ঢাকার শাহবাগে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন একের পর এক প্রতিবাদী মানববন্ধন ও সমাবেশ করে। ... ...
ইন্দ্রনীলের স্কুলের বন্ধু গাই বিরনবাউম থাকতো ওয়েস্ট হ্যাম্পষ্টেডে। তাদের পরিবারের সঙ্গে আমাদের অসম্ভব নৈকট্য গড়ে ওঠে। অনেক সাবাথের সন্ধ্যা কাটিয়েছি তাদের সঙ্গে। বাংলায় আমরা যাকে ভুরি ভোজ বলি সেটা শুক্রবার ইহুদি সাবাথের সান্ধ্য ভোজনের তুলনায় জলখাবার মাত্তর! গাইয়ের মা বিরশেবাকে বলতাম শনিবারের দিনটায় কাজ কর্ম কেন যে মোজেস বারণ করে গেছেন এবারে বুঝলাম। আগের দিনের সেই বৃহৎ ভোজন উৎসবের পরে শনিবার শরীরকে ব্যস্ত না করাই ভালো! ... ...