১৯৭১-এ ভয়ের বাতাবরণ কেটেছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে। বরুণ সেনগুপ্ত লিখলেন সাতক্ষীরে অভিযানের কথা। আমরা সাতক্ষীরের লোক। বাড়ির সকলে হুমড়ি খেয়ে বরুণ সেনগুপ্তর প্রতিবেদন পড়লাম। বাঙালি লড়াই করছে স্বাধীনতার জন্য। ছেড়ে আসা মাটি, দেশ, গ্রাম, ভিটে কেমন ছিল তা আমার অজানা ছিল। ১৯৬৫ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের পর দুই দেশে বৈরিতা আরও বেড়েছিল। পূর্ববঙ্গের খবর আসা ক্রমশ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। খবরের কাগজ এবং রেডিও খবর দিতে লাগল। পাকিস্তান ভেঙে যাচ্ছে। উদ্বাস্তু স্রোত আসছে সীমান্ত পার হয়ে। আমি তখন কী করব কী করব ভেবেই দিন কাটাচ্ছি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শামিল হতে চাই। একটা দেশ স্বাধীন হবে। সেই দেশটি আমার পিতৃকুল, মাতৃকুলের দেশ। ... ...
আমি গেলেই ডাকতেন, ও খোকা, মিত্তিরবাবুর বাড়ির ছেলে না ? হ্যাঁ, বলতে তাঁর একের পর এক প্রশ্ন ধেয়ে আসত আমার দিকে। “ভাত খেয়েচ? কী দিয়ে ভাত খেলে ? মাছ খেইলে ? কী মাছ। মাছের কালিয়ায় কি ফুলকপি ছিল। টমটমের চাটনি ছিল কি ? ক্ষীর খেয়েচ কাঁটাল দিয়ে। মাংস কবে খেয়েচ খোকা…” এখন বুঝতে পারি ক্ষুধার্ত মানুষের জিজ্ঞাসা ওসব। গরিব কাহার পাড়ার মানুষের না ছিল জমি, না ছিল কাজ। অন্ন সংস্থান হবে কী করে ? ভোটো কাহার রিকশা করেছিল, তা তার নিজের না অন্য কারোর টাকায় কেনা তা জানতাম না। গ্রামের বাঁড়ুজ্যে বামুনের সঙ্গে ভোটো কাওরার খুব বিবাদ ছিল। রিকশায় চেপে তিনি এক টাকা ভাড়া হলে আট আনা দিতেন। আট আনা বাকি থাকল। বাকিটা শোধ দিতেন না। বাঁড়ুজ্জ্যে মশায়ের ছেলেদের নাম ছিল, ধরুন, অমলকিশোর, বিমলকিশোর, কমলকিশোর, কুনালকিশোর...। ভোটো কাহার কী করল, তার ছেলেদের নাম সব বদলে অমলকিশোর, বিমলকিশোর...। করে দিল। সেই নামে ডাকা শুরু করল। বাঁড়ুজ্জ্যে মশায় রেগে কাঁই। একদিন বেজায় খাপ্পা হয়ে রাস্তায় ঝগড়া, তাঁর ছেলের নামে নিজের ছেলের নাম রেখেছে কেন ভোটো ? ভোটো উদাসীন হয়ে জবাব দিয়েছিল, নাম কি কারোর নিজের সম্পত্তি। মেয়ের নামও বাঁড়ুজ্জ্যে মশায়ের মেয়ের নামে রেখেছিল, ছায়া, মায়া... ... ...
ঠাকুমাকে পেছনে ফেলে আমি দৌড়ে নামি কাঠের দোতলা থেকে। সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে সঞ্জীব কাকু। বুকের কাছের আদর্শলিপি ধরে আমাকে ইশারায় ডাকে, কই স্লেট নিয়ে আয়। আমি দৌড়ে গিয়ে দাদুর রেডিও'র পাশ থেকে স্লেট হাতে নিয়েই কাকুর সামনে গিয়ে দাঁড়াই, আমি সব স্বরবর্ণ লিখতে পারলে সন্দেশ বিস্কুট দেবে তো? ঘাড় নেড়ে 'হ্যাঁ' বলে সঞ্জীব কাকু বড়ঘরের মেঝেয় পাটি পাড়ে। সন্দেশ বিস্কুট দেবো, তার আগে সবগুলো স্বরবর্ণ লিখে শুদ্ধ উচ্চারণে আমাকে শোনাতে হবে। আমি দেরী না করে পাটিতে বসেই কালো স্লেট সাদা দাগে ভরিয়ে তুলি। আর মুখে বলি, অ আ ই ঈ উ ঊ ঋ ৯(লী)। দেখেছো সঞ্জীব কাকু আজ কিন্তু ৯ (লী) লিখতে ভুল করিনি। ... ...
‘মাঠ ভাঙে কালপুরুষ’ ছাপার জন্য আমি ঝাড়গ্রাম কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্ক থেকে ২০০০ টাকা ঋণ নিয়েছিলাম। সেই ঋণ দুবছর কয়েক মাস ধরে সুদসহ শোধ করেছিলাম। তখন মাইনে পেতাম শ’পাঁচেক টাকা। আমি তখন একেবারেই অচেনা এক নবীন লেখক। অমৃত পত্রিকায় লেখার সুযোগ পেয়েছি সদ্য। গল্প যা বেরিয়েছে, লিটল ম্যাগাজিনে। কবিপত্র, অনুক্ত, পরিচয়, সংক্রান্তি---ইত্যাদি পত্রিকায়। লিখে উপার্জন হয়ই না প্রায়। বই ছিল ৭ ফর্মা মানে ১১২ পাতার। অ্যান্টিক নামের একটি মূল্যবান কাগজে লেটার প্রেসে ছেপে বেরিয়েছিল সেই বই। খুব সম্ভবত সুকিয়া স্ট্রিটের হরিপদ পাত্রের ছাপাখানা সত্যনারায়ন প্রেসে কম্পোজ হয়েছিল। আমি এইসব কথা বলছি এই কারণে যে সেই লেটার প্রেস, অ্যান্টিক কাগজ, সীসের অক্ষর, কাঠের গালি এখন হারিয়ে গেছে। এক একটি খোপে এক এক অক্ষর। ই-কার, আ-কার, উ-কার, এ-কার সব আলাদা আলাদা খোপে। কম্পোজিটরের সব মুখস্ত থাকত। কী দ্রুতই না সিসের অক্ষর সাজিয়ে সাজিয়ে গোটা বই নির্মাণ করে ফেলতেন। হ্যাঁ, সেই লেটার প্রেস, সেই ছাপাখানা উঠে গেছে। ... ...
ফার রাইট বা উগ্র দক্ষিণপন্থী দলের অ্যাজেন্ডায় যা আছে, সেইসব দলের মুখ্যনেতৃত্ব প্রথাগত লিবারাল সমাজের প্রতি যেসব অভিযোগগুলি করেছেন, বা নিজ নিজ দেশে তাঁরা যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন ও হচ্ছেন, সেগুলোর সবই মিথ্যাচার বা অতিরঞ্জন নয়। যেমন অর্থনৈতিক সংকট ও তজ্জনিত ধুঁকতে থাকা কর্মসংস্থান, উদ্বাস্তু সমস্যা, সেন্ট্রিস্ট আদর্শের মূলধারার রাজনৈতিক নেতৃত্বের দুর্নীতি, বা একরকমের সাংস্কৃতিক যুদ্ধ, যা নিজদেশে মানুষকে পরবাসী করে দিচ্ছে। এগুলোর কোনোটাও গালগল্প নয়, সাধারণ মানুষ বলে যে বহুস্তরীয় পদার্থটিকে নেতারা ভোটব্যাংক ভাবেন, তারা এইসব সমস্যা তাদের দৈনন্দিন জীবনে দেখতে পায়। কেন এই সমস্যাগুলি তাদের জীবনে মূর্তিমান উপদ্রবের মতো আসছে সে কথা ভাবতে গিয়ে তাদের অনেক সময়ই মনে হয় এইসব সমস্যার অনেকগুলোই জনবিস্ফোরণের ফল। ... ...
আগের পর্বের আলোচনাটা অনেক বেশী দিল্লী-কেন্দ্রিক ছিল। এই পর্বে বিজাপুর, লক্ষ্ণৌ এবং মাইসোরের আলোচনা হল। এবার বলব বাংলার কথা। অর্থনৈতিকভাবে মুঘলযুগে বাংলার বিশেষ স্থান ছিল, কিন্তু যে কারণেই হোক, বাংলায় খুব আড়ম্বরপূর্ণ সমাধি নেই। বাংলার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সমাধিসৌধ হল ত্রিবেণীর জাফর খাঁ গাজী মসজিদ, মালদহের একলাখি সমাধিসৌধ আর ফতে খাঁর সমাধিসৌধ, এবং মুর্শিদাবাদের আজিমুন্নিসা বেগমের সমাধি। এর মধ্যে প্রথম দুটি সুলতানি যুগের, শেষের দুটি মুঘল বা মুঘল-পরবর্তী যুগের। প্রথমটি সমাধির থেকেও দরগা এবং মসজিদ হিসাবে বেশী পরিদৃষ্ট হয়। দিল্লীতে আমরা যেরকম দেখেছি, বাংলায়ও একইরকম বিবর্তন দেখা যায়। ... ...
আপনি যে একদিন বিখ্যাত হবেন তা আমার জানা ছিল, আমি মুজফ্ফর সাহেবকে বলছিলুম, আমার বিশ্বাস ছিল আপনি একদিন দেশবিখ্যাত এক লেটোশিল্পী হবেন। এখন তো দেখছি আপনি একজন দেশবিখ্যাত লেখক কবি এবং গায়ক, প্রায় ঠিকই ছিল আমার ধারণাটা। কিন্তু আপনি কি জানেন, ছেলেবেলায় আলাপ না হওয়া সত্ত্বেও আমি কেন আপনাকে মনে রেখেছি? আমার মায়ের কাছে শুনেছিলুম আমি নাকি এক ফকিরের আশীর্বাদে জন্মেছিলুম। ফকির মানে কী, আমি জানতুম না তখন। কিন্তু আপনার বাবা তো অজয়ের দুপারেই বিখ্যাত ছিলেন। আমি যখন শুনলুম তাঁর নাম ফকির আহ্মদ, কেউ না বলা সত্ত্বেও আমি ধরে নিলুম, ইনিই নিশ্চয়ই সেই ফকির, এঁর আশীর্বাদেই আমি জন্মেছি। ... ...
কথাটা পরিহাসের ছলে বলা কিন্তু এর ভেতরে একটি গভীর সত্য নিহিত ! ইউরোপের হাজার বছরের ইতিহাসে ইহুদি হবার অপরাধে সরকারি বা অন্যান্য ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে কর্ম গ্রহণ নিষিদ্ধ ছিল বহুকাল । সে কারণেই ওকালতি , ডাক্তারি জাতীয় বিবিধ স্বাধীন পেশা এবং আপন ব্যবসাতে ইহুদির ভূমিকা বহু বছরে সুপ্রতিষ্ঠিত । মহাজনি কারবারের জন্য তাঁরা বিশেষ দুর্নাম কুড়িয়েছেন , শেক্সপিয়ারের শাইলক যার এক প্রতীক । এক দরোজা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বলে জীবন ধারণের উদ্দেশ্যে অন্য দ্বারে করাঘাত করেছেন। আপন বুদ্ধি ও কর্ম বলে সফল হয়েছেন। ... ...
খবর শুনে মা কাঁদল না, তবে পরের দিন আমাদের বস্তিতে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা হল। পেট পুরে খেল ওই দুজন লোক, তারপর চলে গেল। আমি ততদিনে সেকেণ্ড ক্লাশ, মানে ক্লাশ নাইন-এ উঠেছি। মা আমাকে বলল, আমাকে যুদ্ধে যেতে হবে। আর যেতে হবে মেসপটমা না কী বলে, সেই আরব দেশেই। শুধু আমাকে বলেই ক্ষান্ত হল না মা, বস্তির সবাই জানল পিংলাকে তার মা যুদ্ধে পাঠাবে। আমাদেরই বস্তির মাতব্বর গোছের একজন শুধু মাকে সাবধান করে দিল, এখনই কিছু কোরো না, কেউ যদি বলে দু পয়সা খরচ করলেই সে তোমার ছেলেকে যুদ্ধে পাঠাবার ব্যবস্থা করে দেবে, বিশ্বাস কোরো না তাকে। আঠের বছর অন্তত বয়েস না হলে যুদ্ধে নেয় না। আর তা ছাড়া সাহেবরা সব দেশের ছেলেদের নেয়, কিন্তু বাঙালিদের নেয় না যুদ্ধে। বাঙালিদের জন্যে শুধু ইশকুল আপিস আর কোর্টের কাজ, সাহেবরা বাঙালির হাতে বন্দুক দেবে না। ... ...
সত্যি কথা বলি কাজীদা, আস্তে আস্তে কেমন ভালই লেগে গেল শিবপুরকে। ননী জেঠুর অনুমতি নিয়ে আরও দুয়েকটা বাচ্চাকে পড়াই, হাতখরচের টাকা উঠে যায়। নানা মানুষের সঙ্গে মিশি, সাহিত্য সভায় যাই, লাইব্রেরিতে কিছু কাজের দায়িত্ব পাই, গান্ধি বিফল হলে যে লড়াই লড়তে হবে, তার আঁচ গায়ে লাগে, মিছিল-মিটিংয়েও যাই। পিংলার সঙ্গে তো সেইভাবেই বন্ধুত্ব হয়ে গেল একদিন। করাচির কথা, আপনার কথা সব শুনেছি। একদিন বলল আপনার ‘নবযুগ’-এর কথা। মাঝেমধ্যে গঙ্গা পেরিয়ে ‘নবযুগ’ কিনেও আনে। সেই ‘নবযুগ’ পড়িয়েছি একজনকে। আপনার সঙ্গে তিনি আলাপ করবেন। কাল আসবেন একবার? ... ...
অনেক রোগী খুপরিতে ঢুকে প্রথমেই স্যানিটাইজারের বোতল থেকে দু-চার ফোঁটা তরল বসার চেয়ার, আমার টেবিলে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। আজ এক ভদ্রমহিলা গঙ্গাজল এর মত আমার গায়ে কয়েক ফোঁটা স্যানিটাইজার ছিটিয়ে দিলেন। মানে চেয়ার-টেবিলের সাথে তিনি ডাক্তারকেও স্যানিটাইজ করে নিলেন। ওদিকে রোগীর সংখ্যা রোজই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। অধিকাংশই জ্বরের রোগী। জ্বর আসলেই এখন অনেকে গন্ধ শুঁকছেন। একজন বললেন, 'ডাক্তারবাবু, খাবার-দাবারের গন্ধ পাচ্ছি না। কিন্তু ডেটলের গন্ধ, ডেনড্রাইটের গন্ধ এগুলো দিব্যি পাচ্ছি।' একজন রোগী দুদিন আগেই দেখিয়ে গেছেন। জ্বর কমছে না। আবার এসেছেন। তার পুরোনো প্রেসক্রিপশন পুরো সাদা। আমি অবাক হয়ে বললাম, 'এ কি? আমি কোন ওষুধপত্র লিখিনি নাকি?' উনি বিব্রত মুখে জানালেন, 'হ্যাঁ লিখেছিলেন। কিন্তু বাড়ি গিয়ে প্রেসক্রিপশন স্যানিটাইজ করতেই সব লেখা উবে গেছে।' ... ...
শ্যামলবাবুর সঙ্গে মেশা আমার জীবনের এক মহার্ঘ স্মৃতি। তা ছিল অম্ল এবং মধুরতায় মেশানো। প্রথমে শ্যামলবাবু ধরেই নিয়েছিলেন আমার দ্বারা তেমন লেখা হবে না। বন্ধুরাই বলে। আর শৈবাল বলে। একদিন তো আমাকে বলেই বসলেন, লেখা অভ্যাস করো, প্রতিদিন লেখো, তবে তুমি এদের সঙ্গে মেলামেশার উপযুক্ত হয়ে উঠবে। ভয় করতাম খুব। একদিন তুষার সমীরের সঙ্গে সন্ধ্যায় গিয়েছি শ্যামলদার বাড়ি। ওরাই টেনে নিয়ে গিয়েছিল। পান করা হল। শ্যামলদা আমাকে নিয়ে পড়লেন। আমার কাছে কুলটিকরির খবরাখবর নিলেন। হাটের খবর, চালের দর, সবজির দর ইত্যাদি। সুবর্ণরেখা এবং ডুলং নদীর কথা শুনলেন। তিনি বললেন বিদ্যাধরীর মৃত্যুর কথা। দক্ষিণ ২৪ পরগনায় যা দেখেছিলেন। তাঁর রাখাল কড়াই, চন্দনেশ্বরের মাচানতলায় ইত্যাদি গল্পে আর কুবেরের বিষয়আশয় উপন্যাসে যা আছে। ... ...
হাজার বছর ধরে ইহুদি পেটানো, পোড়ানো এবং খ্যাদানো এক জনপ্রিয় ক্রীড়ায় পরিণত হয়েছে। যিশু খ্রিস্টকে ক্রুসে চড়ানোর অপরাধের কলঙ্ক ইহুদিদের মাথায় লাগানো রইল। তার ওপরে ইউরোপের গ্রামে গঞ্জে পাড়ায় পাড়ায় কেউ রটিয়ে দিলো ইহুদিরা খ্রিস্টান শিশুর রক্ত দিয়ে তাদের পুজো আচ্চা করছে (ব্লাড লাইবেল) অথবা তারাই ভয়ঙ্কর প্লেগের (ব্ল্যাক ডেথ) কারণ। আম জনতা ক্ষিপ্ত হয়ে লাঠি সোঁটা নিয়ে ইহুদি হত্যায় লেগে গেলো। খুন কা বদলা খুন। নাৎসিরা কোনমতেই এই খেলাটির পেটেন্ট দাবি করতে পারে না। বরং ক্রিকেট বা ফুটবল খেলার মত আরেকটি নতুন ক্রীড়া উদ্ভাবনের সম্পূর্ণ কৃতিত্ব ইংল্যান্ডের প্রাপ্য। জাতি ধর্ম দিয়ে চিহ্নিত করে কি ভাবে একটা গোটা টিমকে রেড কার্ড দেখিয়ে মাঠ থেকে বের করা যায় সে খেলা দেখাল ইংরেজ। সিনাগগ বন্ধ হয়েছে, আত্ম পরিচিতির জন্য ইহুদিদের বিশেষ ব্যাজ পরা আবশ্যক (সাড়ে ছশো বছর বাদে নাৎসিরা এঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করবে)। ... ...
মোড় থেকেই বিশ্বনাথ মন্দিরে যাওয়ার লোহার রেলিং-ঘেরা হাঁটার রাস্তা, লোকে ডালি-ফালি নিয়ে লাইন দিয়ে চলেছে। এদিকে একইরকম আরও একটা রাস্তার মসজিদে ঢোকার মুখে, যদিও সেখানে কেউ নেই। পাশে কয়েকজন পুলিশ জটলা করছে। পূর্বঅভিজ্ঞতা থেকে বুঝলাম জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। তাই হেলতে দুলতে ওই রেলিং-ঘেরা জায়গাটা দিয়ে চলতে শুরু করলাম। কয়েকপা এগোতেই জটলাকারী পুলিশের দল ছুটে এসে জেরা শুরু করে দিল। ততক্ষণে বেশ রাগ হচ্ছে। কোথায় যাচ্ছেন, কেন যাচ্ছেন এসবের উত্তরে বললাম আর্কিওলজিকাল সাইট, তাই দেখতে এসেছি। খুব বিশ্রীরকম সন্দেহজনক দৃষ্টিতে দেখে নিয়ে, যাওয়ার নিয়ম নেই, বলে ভাগিয়ে দিল ওখান থেকে আমাদের। ... ...
সোনালী কাবিন কাব্যে ছিল যে তীব্র প্রেম আর আদিমতা, আল মাহমুদ আসলে সেই কবিই। রক্তমাংসের এমন নোনা গন্ধ বাংলা সাহিত্যে বিরল নিশ্চয়। আল মাহমুদের গল্প সেই গল্পই। নর নারীর জৈবিক প্রেম, আদিমতার সাহসী উচ্চারণ যেমন তাঁর কাব্যে দিয়েছিল অচেনা এক সুষমা, গল্পেও তাই। পানকৌড়ির রক্ত, কালো নৌকো, রোকনের স্বপ্নদোলা, নীল নাকফুল, বুনো বৃষ্টির প্ররোচনা… আল মাহমুদ যে গল্প লিখেছেন, সেই গল্পে সোনালী কাবিনের কবিকে চেনা যায়। চেনা যায় তীব্র প্রেম, যৌনতা, আদিমতার এক অচেনা রূপ। আমি যতবার পড়েছি পানকৌড়ির রক্ত কিংবা জলবেশ্যা, পেয়েছি নতুন মাত্রা। জলবেশ্যার কথা নতুন করে বলি। নতুন করে বলি পেঁয়াজ, রসুন, লঙ্কার গন্ধ জড়ান মেঘনা তীরের লালপুর হাটের কথা। সেই হাট আমার অচেনা। আমি দেখিনি। মেঘনা ফেলে এসেছি ওপারে, লালপুর হাটও। কী করে চিনব? চিনেছি আল মাহমুদ এ। ... ...
পিপলস বুক সোসাইটি আমাকে বলেছিল, অতিবৃষ্টিতে বাঁধাইখানায় জল ঢুকে ফর্মা নষ্ট হয়ে গেছে। যারা নতুন লিখতে এসেছিলেন, তাঁরা বইটি পড়তে চান, পি বি এস-এ গিয়ে খুঁজে পান না। আমি হতাশ হয়ে গিয়েছিলাম। এরপর সরকার বদলেছে। ২০১৩ সালে বইমেলায় আমাকে পি বি এস-এর একজন ডাকলেন, আসুন আসুন। আমি পি বি এস-এ যেতাম না বই নিয়ে ঐ ব্যাপার হয়ে যাওয়ার পর। বিরক্ত হয়েই ওঁদের প্যাভিলিয়নে ঢুকে দেখি নিরুদ্দিষ্টের উপাখ্যান স্বমহিমায় বিরাজমান। সেই চল্লিশ টাকা দাম। দশ বছর আগের দাম। ঝকঝকে ফর্মা। সেই পুরোন ছাপা। কী হয়েছিল এতদিন? তাঁরা বললেন ফর্মা হারিয়ে গিয়েছিল, খুঁজে পেয়েছেন আবার। ভুল জায়গায় রক্ষিত হয়েছিল। মিসপ্লেসড। এমন হয় আমি শুনিনি আগে। না কি বইটি তাঁরাই বাজার থেকে তুলে নিয়েছিলেন অদৃশ্য চাপে। কিন্তু পি বি এস-এর মানুষগুলি আমার প্রিয়জন। প্রত্যেকে আদর্শবাদী। ত্যাগী। আমি অনীক পত্রিকায় তিরিশ বছর এক নাগাড়ে লিখেছি। দীপঙ্কর চক্রবর্তী এবং রতন খাসনবিশ পরম শ্রদ্ধার মানুষ। অনীকের সঙ্গে পি বি এস সরাসরি যুক্ত না হলেও অনীক পত্রিকা পি বি এস থেকেই বিক্রি হয়। ওঁদের ভিতরে বন্ধুতার সম্পর্ক। অনীক এবং পি বি এস-কে আমি আলাদা করে দেখতাম না। এই ঘটনায় সব গোল পাকিয়ে গিয়েছিল। মনে পড়ে যায় তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই কথা, যাঁরা পার্টি করেন, তাঁদের কাছে সাহিত্য শিল্পের চেয়ে দলের মূল্য বেশি। নিরুদ্দিষ্টের উপাখ্যান উপন্যাস কিন্তু এক দলের নিন্দা করে অন্য দলের সমর্থনে লেখা তথাকথিত পার্টির লেখা নয়। এই উপন্যাস বামপন্থী দলের প্রতি বিষোদ্গারের নয়। কিন্তু ভিখারী পাশোয়ানের নিরুদ্দেশের ঘটনা সেই সময় হিমালয়ের চেয়ে ভারি হয়ে উঠেছিল সরকারের কাছে। পার্টির কাছে। একটি মানুষ যে কত তুচ্ছ, কত অবহেলার-- প্রশাসন, পুলিশ এবং বিত্তবানের কাছে, সেই লেখাই এই লেখা। উপন্যাসটি মুখে মুখে রটেছিল। এক সংবাদপত্রে এর আলোচনা করেছিলেন বিখ্যাত এক লেখক। মুখে আমাকে বলেছিলেন অনেক কথা, মা লিখ। ২৫০/৩০০ শব্দ কোনোরকমে লিখেছিলেন। এই রিভিউ নিয়ে সেই ভবিষৎবাণীই করেছিলেন পি বি এস কর্ণধার প্রশান্তবাবু। মৃণালবাবুর ছবি করা নিয়েও তিনি বলেছিলেন, হবে না। ... ...
বর্ধমান ছাড়াবার পর নজরুল গান ধরেছে আবার, এমন সময় কামরায় উঠল তিন-চারজন বাউলের একটা দল। শান্তিনিকেতনের পথে রেলের কামরায় এই বাউলরা প্রায়ই ওঠে, আর উঠেই গান গায়। সঙ্গে থাকে তাদের একতারা, আর কোন কোন সময় পায়ে ঘুঙুরও। বাউল, ভিক্ষে করাই এদের পেশা, যাত্রীসাধারণেরও সেটা জানা। ফলে, ঠিক ঠিক চাইতেও হয়না ভিক্ষে, গান শেষ হলে অনেক যাত্রী নিজেরাই ডেকে সাধ্যমতো যা পারে, দেয়। আজ এই বাউলরা উঠে নজরুলের গান শুনে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। একটু পর, তাদের মধ্যে একজন গানের সঙ্গে একতারায় মৃদু আওয়াজ তোলে, ঘুঙুরের শব্দে তালও রাখে কেউ। নজরুল চোখ মেলে হাসে, তারপর চোখ বুজে গাইতে থাকে আবারও। ... ...
আসল কারণটা অন্য। গতকাল ওই যে খিলাফৎ কমিটির নোটিশটা ছাপানো হয়েছিল, সেটার জন্যেই বন্ধ করল কাগজটা, রাগ আর সামলাতে পারল না। আপনি কি লক্ষ্য করেছেন ওই নোটিশ কাল বসুমতীতেও বেরিয়েছে? কই, তাদের তো বন্ধ করেনি। কিন্তু, সে যাই হোক, করেছে, ভালোই হবে। আজকের কাগজের জন্যে যে এডিটরিয়ালটা লিখেছিলাম – দুর্যোগের পাড়ি – সেটা মোসলেম ভারতে ছাপিয়ে দেবার ব্যবস্থা করছি। নবযুগকে আজ জুলুম করে বন্ধ করার খবরটা নিশ্চয়ই বেরোবে দুয়েকটা অন্য কাগজেও। যারা এতদিনেও নবযুগ পড়েনি, বাংলা খবরের কাগজের সেই পাঠকদেরও নবযুগের ব্যাপারে কৌতূহল বাড়বে। এখন যতদূর তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের কাগজটা আবার বের করা চাই। আমার তো মনে হয় একটু কষ্ট করে হলেও ওই দুহাজার টাকা আজই জমা দিয়ে দেওয়া উচিত। ... ...
প্রথম যেদিন সাকিনা মেজদিকে ওইরকম থুতনি নিয়ে দেখল এবং মেজদির মুখে শুনল যে ওর ক্যানসার হয়েছে সে কী কান্না বুড়ির। শুধু বলে, “ও মা, তাহলে তো তুই বাঁচবি না রে মেয়ে৷” মেজদিই বরং ওকে সান্ত্বনা দিত। এরপরই সাকিনা বিবি এমন একটা কাজ করেছিল যা আমি কোনোদিন ভুলব না। মেজদিকে, যবেই আসত গোটা তিনেক করে ডিম দিত খেতে। পয়সা নিত না। কিছুতেই নিত না৷ বলত, “তোর শরীর খারাপ রে মেয়ে৷ রোজ খাবি একটা করে। দিশি ডিম। উপকার হবে৷” অবাক হতাম। এক হতদরিদ্র গ্রাম্য মহিলা কোন্ মনের জোরে এমন কাজ করতেন!! ... ...
আমি আর ঠাকুমা পা চালিয়ে সাহাপাড়া ছেড়ে গৌর-নিতাই আঙিনার দিকে এগোই। রাস্তার দু-পাশে তাঁতঘরে মাকুর টানা ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে। বসাকপাড়া ঢুকতেই পিসিঠাকুমার আঙিনা দেখা যায়। ওই তো কুটিপিসি উঠোনে চরকি নিয়ে বসে গেছে। কুটিপিসির কাছে এলেই সোনালি জরির ভাঙা ববিনটা আমার হয়ে যায়। ... ...