সবটাই দামোদর নদের বালি উত্তোলন নিয়ে। ও হলো সোনার খনি। তিনি এক ব্যবসায়ীকে নিষিদ্ধ করেছেন চিঠি দিয়ে, সেই ব্যবসায়ী দিন পনের বাদে গাড়ি হাঁকিয়ে আমাকে এসে বলছেন, স্যার বলে পাঠালেন, কাগজপত্র, চালানে সই করে আমার কাজ শুরু করিয়ে দিতে। বললাম, স্যার চিঠি দিয়ে বন্ধ করেছেন, স্যার চিঠি দিয়ে নিষেধাজ্ঞা রহিত না করলে তো আমি কোনো চালানে স্বাক্ষর করতে পারব না, লিজ অর্ডার দিতে পারব না। যাদব মশায় জোরাজুরি করতে লাগলেন। তিনি আমাকে হঠাৎ বলেছিলেন, আপনার বই কী বেরুলো স্যার, কত কপি ছাপা হয়, আমি কিনিয়ে নিবো। অপমানিত লেগেছিল। স্যরি। আপনি নিজেই তো বাংলা পড়তে পারেন না, আমি অফিসে বই বেচতে বসি না। তিনি না পেরে আবার জেলা সদরে ছুটলেন। বলে দিলাম, লিখিত অর্ডার যেন তিনি না নিয়ে আসেন। অফিসিয়াল চিঠি যেভাবে আসে, সেই ভাবেই আসে যেন। স্যার অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন, তাঁর পাঠানো ব্যবসায়ীকে আমি প্রত্যাখ্যান করায়। ... ...
আমার ক্যাম্প অফিসে। করণ্ডায়। মানুষের মুখের কথা বলি। যে মুখগুলি মনে আছে তার ভিতরে প্রধান মুখটি নিখিল প্রধানের। নিখিলবাবুকে আমি প্রথম যখন দেখি আমি তখন ২৩, তিনি ৫০। তিনি সেটেলমেন্টের ডি-গ্রুপ কর্মচারী। উপরওয়ালা স্যার, বাবুদের কাছে পিয়ন। এখন পিয়ন শব্দটি ধীরে ধীরে অবলুপ্ত হচ্ছে। কর্মচারীদের প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ —চার শ্রেণীতে ভাগ করে সেইভাবেই অভিহিত করা হয়। এর অন্যথা হলে প্রতিবাদ হয়। প্রতিবাদ এবং সংগঠিত থেকে তাঁরা কিছুটা সম্মান আদায় করে নিয়েছেন। তবে এখনো সামান্য হোমগার্ড জেলার এস,পি, র বাড়ির বাজার করেন কি না, জামা কাপড় কাচেন কি না, ফাই ফরমাস খাটেন কি না জানি না। হয়তো বদল হয়েছে, হয়তো বদল হয়নি, এ ঘটনা সামান্য কনস্টবলের মুখে শোনা। ... ...
যাঁরা কোলকাতায় ক্লাসে বসে ছাত্রছাত্রীর কাছে শিক্ষাতত্ত্ব (education theory) পরিবেশন করছেন আর যে মানুষটি রোজ ভোর চারটের সময় ঘুম থেকে উঠে তিনঘণ্টা দৌড়ে স্কুলে পৌঁছে একটা ছোটো বাচ্চার ভবিষ্যৎ গড়ার লক্ষ্যে সাধনা করছেন তাঁদের দর্শন এবং মতামত কিন্তু আলাদা। ভাগ্যবশত দু-বছর আগে পশ্চিমবঙ্গের কিছু জেলার বহু শিক্ষক-শিক্ষিকার সঙ্গে মতামত আদানপ্রদানের সুযোগ পেয়েছিলাম, সীমিত সুবিধা, সীমিত সংস্থান, সীমিত অর্থ সংস্থানের মধ্যেই, প্রত্যহ অনেক চ্যালেঞ্জের সঙ্গে লড়াই করেই তাঁদের অপ্রতিহত যাত্রা এবং সাফল্য। সেখানে পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল যে নতুন শিক্ষাব্যবস্থা ও উন্নত পরিকাঠামো অবশ্য প্রয়োজন। শিক্ষক-শিক্ষিকার সঙ্গে আমার আলোচনার একটা বড়ো অংশ জুড়েছিল, ‘Authentic learning'-এর প্রসঙ্গ, এই প্রক্রিয়ায় স্কুলে শ্রেণিকক্ষে এবং শ্রেণিকক্ষের বাইরে inquiry based learning, project based learning কীভাবে প্রয়োগ করা যায়? ... ...
কালিবাড়ির মোড় পেড়িয়ে বাড়ির রাস্তা ধরতেই আমার আবদার, দাদু রঙিন কাঠি লজেন্স নেবো। মোল্লা দাদুর দোকান থেকে আনারস আঁকা কাগজে মোড়ানো কাঠি লজেন্স হাতে নিয়ে দাদুকে পেছনে ফেলে আমি প্রায় দৌড়ে আমাদের তাঁতঘরের সামনে চলে আসি। ততক্ষণে প্রায় ফাঁকা আইনুল চাচার মোষের গাড়ি। দাদুকে রাস্তার কোণায় দেখা যেতেই আমি কাঠি লজেন্স মুখে পুড়ি, দাদু বস্তা আরোও আছে কিন্তু। আমি দাদুর হাত ধরে বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই বাড়ির উঠোনে মাষকলাই আর সরিষা গায়ে গা লাগিয়ে পড়ে আছে। আর বাটি ভরা মুড়ি, মুড়কি, গুড় নিয়ে আইনুল চাচা লাল বারান্দায় বসে আছে। ঠাকুমা গ্লাস ভরে চা এনে দিতেই আইনুল চাচার লাল দাঁতগুলো ঝিলিক দেয়, মা একটা পান দিয়েন। ... ...
আমার সদ্য প্রকাশিত শারদীয় সংখ্যার উপন্যাস তিনি করবেন কি না জিজ্ঞেস করতে গিয়ে দেখি সমরেশ বসু। বললেন, ভালো লিখেছ উপন্যাস, তবে আরও নিবিষ্ট হতে হবে, তুমি পারবে উপন্যাস লিখতে। আমার পক্ষে ওই কথাগুলি যেন আশীর্বাদ হয়েছিল। প্রকাশক, কলেজ স্ট্রিট পাড়ার কর্তৃত্বময় ব্যক্তিত্ব। গম্ভীর কন্ঠস্বর। সমরেশ বসুর কথা শুনে বললেন, দিয়ে যাও, ছাপব। তারপরের কাহিনি হৃদয় বিদারক। বই ছাপা আর হয় না। আমি থাকি শালতোড়া। কলকাতায় আসি। এসে খোঁজ নিই। হবে হবে শুনি। এক বছর গেল, দু-বছর গেল, তিন বছর গেল, বই আর বেরোয় না। ১৯৯০-এর বইমেলার পর ফেব্রুয়ারি এক হঠাৎ হয়ে যাওয়া তপ্ত দুপুরে গেছি তাঁর কাছে। তাঁর সামনে বসে আছেন এক অগ্রজ লেখক। খুব সিনিয়র ছিলেন না তিনি। আমি বইয়ের কথা প্রকাশক মশায়কে জিজ্ঞেস করতে তিনি ক্রুদ্ধ গলায় বললেন, আপনি প্রায়ই আসেন কেন বলুন দেখি, বিরক্ত করেন কেন? ... ...
সম্পূর্ণ ঘটনাচক্রে, একটি অখ্যাত গ্রামে ব্যাঙ্কিং শিক্ষাদানের সুযোগে, আমার যে শুধু পোল্যান্ড-সহ লৌহ-যবনিকার আড়ালে ঢাকা পূর্ব ইউরোপের দেশগুলির সঙ্গে প্রথম পরিচয় হল, তা-ই নয়, অ্যালান হার্স্টের মত এক অসাধারণ মানুষের কাছাকাছি আসার সৌভাগ্য অর্জন করলাম। সিটি ব্যাঙ্কে যোগ দেবার আগে তিনি আমেরিকার ডেমোক্রাট দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। হোয়াটসঅ্যাপ এবং আই টি সেল নামক আধুনিক জনসংযোগের তুখোড় মাধ্যম ভোটারদের তখনও অজানা। পার্টির ইস্তাহার, ম্যানিফেস্টো এবং বক্তৃতার ড্রাফট লিখতেন লেখাপড়া জানা ভদ্র মানুষজন। গুজব শুনেছি, উইলিয়াম জেফারসন ক্লিনটন নামক এক যুবকের নির্বাচনী ভাষণের খসড়া করেছেন অ্যালান। বত্রিশ বছর বয়েসে ক্লিনটন লিটল রক, আরকানসাসের (মতান্তরে আরকানস’) রাজ্যপালের অফিসে অধিষ্ঠিত হলে, আপন রাজনৈতিক কর্তব্য সমাপ্ত হয়েছে মনে করে অ্যালান ব্যাঙ্কিং-এ এলেন। সিটি ব্যাঙ্কে সিকি-শতাব্দী কর্ম করেন, মুখ্যত উন্নয়নশীল পূর্ব ইউরোপে। ... ...
কাজী উত্তর দেবার আগেই উঠে দাঁড়ান ডঃ শহীদুল্লাহ্, বলেন, আমার এবার যাবার সময় হল। যাবার আগে একটা কথা তোমাকে বলি কাজী। আমার মনে হয় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এখন তোমার পরিচয় হওয়া দরকার। সুধাকান্তবাবু বলেছেন রবীন্দ্রনাথ নিজেও তোমার সঙ্গে পরিচিত হতে চান। কবে যে ওঁকে পাওয়া যাবে আমি ঠিক জানি না। শুনেছি, বিদেশ থেকে কয়েকদিন আগে ফিরেছেন। ইদানীং প্রায়ই বিদেশে যাচ্ছেন, কাজেই এর পরের বিদেশ যাত্রার আগেই ধরতে হবে। আমি যোগাযোগ করছি, এক-দেড় মাসের মধ্যেই ধরতে চাই। জোড়াসাঁকোয় নয়, চেষ্টা করব শান্তিনিকেতনে গিয়ে দেখা করতে, সেখানে উনি অনেক খোলামেলা। তুমি আমার সঙ্গে আসবে তো? ... ...
সেই আঠেরোশো পঞ্চাশ-টঞ্চাশ থেকে আমাদের এই বাংলার গ্রাম থেকে – আর বাংলাই বা বলি কেন – বিহার উড়িষ্যা বা এমনকি যুক্তপ্রদেশ থেকেও দলে দলে গরীব মানুষ কাজের সন্ধানে আসছে এই কলকাতা সহরে। এদের মধ্যে হিন্দু মুসলমান দু' দলই আছে। মুসলমানই বেশি বলে আমার মনে হয়, কারণ তারাই অপেক্ষাকৃত বেশি গরীব। কলকাতায় এরা সব থাকে কোথায়? প্রথম-প্রথম ফুটপাতে, আর তারপর নানা বস্তিতে। আমি শুনেছি ভদ্রলোকদের চাপে আঠেরোশো ছিয়াত্তর-টিয়াত্তরে কলকাতার কর্পোরেশন নানারকমের নাগরিক সুখ-সুবিধের ব্যাপারে সহরবাসী মানুষদের একটা অধিকার দিয়েছে। কী অধিকার? একটা কর্পোরেশন পরিচালক সমিতি, যার আসল নাম কাউন্সিল, তার সভ্য হওয়া। তার মানে কাউন্সিলর হবার অধিকার। এবং অবশ্যই, ভোট দিয়ে সেই কাউন্সিলার নির্বাচন করা। এই ভোটের অধিকার কিন্তু আছে মাত্র তিন ধরণের লোকের। ... ...
আমি ঝুরিভাজার ঠোঙাটা সেই বারান্দায় রেখেই বাড়ির ভেতরে ঢুকি, ঠাকুমা আমাকে খুঁজছিলে কেন? বাড়ির উঠোনে ক'খানা ধামায় ভরা আধা ভানা ধান। ক'দিন আগেই মাদলা গ্রাম থেকে হিজলদিঘি, কাদম্বিনী আর ঝিঙেশাইল ধান এসেছে। এক রোদ দেওয়া ধানগুলো ঠাকুমা কালথেকেই ঢেঁকিতে ভানছে। আজ শেষবার ধান ঢেঁকির গড়ে পড়বে। চালের গায়ে লেপ্টে থাকা শেষ ধানের পরতটুকু উঠে গেলেই ধবধবে সাদা চাল ঠাকুমার মাটির ডোলে জায়গা করে নেবে। ঢেঁকিতলা পরিষ্কার করতে করতেই ঠাকুমা উত্তর দেয়, সকালের ভাত খেয়েই বেরিয়েছো দিদি; কোথায় ছিলে? আহ্লাদী আসকারার আভাস পেয়ে আমি পায়ে পায়ে ঠাকুমার কাছে যাই, ও ঠাকুমা শংকর জ্যাঠার দোকানে আর কাঠি বিস্কুট আসবে না, জানো? ... ...
পাইলটের আকাশবাণী হল আর কিছুক্ষনের মধ্যে আমরা ক্রাইস্টচার্চের বিমানবন্দরে অবতরণ করব, ঠিক এই সময়ে নজরে এলেন দক্ষিণ আল্পস, পাহাড়চূড়ায় তুষার, যেন সদ্য স্নান করে গায়ে ট্যালকম পাউডার মেখে স্থাণুবৎ গা এলিয়েছেন পশ্চিমতটরেখা বরাবর। তরঙ্গের মতন সাদা বরফের চূড়া, তার অনতিগভীরে কোথাও বা পাহাড়ের কোলে পান্না সবুজ ছোট হ্রদ, তারপরেই ক্যান্টারবেরির প্রশস্ত প্রান্তর জুড়ে এঁকেবেঁকে চলা অজস্র শিরা উপশিরার মতন নদী, দেখতে দেখতে ক্রাইস্টচার্চ ঘিরে আকাশপাখি গোল করে ঘুরতেই চোখ জুড়িয়ে গেলো প্রশান্ত মহাসাগরের নীল দিগন্তে ম্যাজিক। ... ...
গত শতকের ষাটের দশক থেকে আজকের দিন পর্যন্ত, প্রায় ছ'টি দশক ব্যাপ্ত শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস বৃত্তরৈখিক প্রকাশিত হচ্ছে ধারাবাহিক ভাবে। ... ...
আরও বেশ কবছর পরের কথা, মন্ডল সাহেবের বাগান বাড়িতে নেমন্তন্ন। অনেকটা পিকনিকের মেজাজ। লোকজন এদিক সেদিক ঘুরছে। সবেদা গাছগুলোর ছায়ার বেতের চেয়ারে কফি নিয়ে আমরা জনা পাঁচেক। আমার ঠিক উল্টোদিকে এক নম্বর। কিছুক্ষণ পর একজনের বাথরুম পেল, দুজন মাছধরা দেখতে গেলেন, রইল বাকি দুই, মুখোমুখি। উসখুস, গলা খাঁকারি,- মানে ইয়ে, আমি মনে হয় আপনার সঙ্গে কোথাও এক সঙ্গে কাজ করেছি। আমি গ্র্যানাইট পাথর, হবে হয়তো। আচ্ছা অমুক ব্র্যাঞ্চে আপনি একাশি বিরাশি সাল নাগাদ ছিলেননা? আমি বললাম, ছিলাম। - ও, হ্যাঁ মনে পড়েছে, ওখানেই তো আপনার সঙ্গে – আমি বললাম, হবে হয়তো, এত লোকের সঙ্গে কাজ করেছি, সবাইকে মনে রাখা সম্ভব? বাথরুম সেরে একজন ফিরলেন, মাছধরা দেখে বাকি দু জন, আলোচনা শেষ। ... ...
ঘাটের কিনারায় আস্তানা গাড়া হলো। একেবারে ফেলু মিত্তিরের কাশীবাসের মতই পরের দিন সকালেই আলাপ হয়ে গেল একজন অদ্ভুত লোকের সাথে। ভদ্রলোক বাঙালী, দক্ষিণ কলকাতায় বাড়ি, তন্ত্রসাধনা সম্পর্কিত বই লেখেন। বয়সে আমার থেকে কয়েক বছরের বড়, শিবপুর বা যাদবপুর থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে একদা বহুজাতিকে চাকরি করেছেন। এখন সেসবে মন নেই। সংসারী মানুষ, কিন্তু বছরের বেশিরভাগ সময় আজ হিমালয় তো কাল কাশী এইসব করেন। বললেন কয়েকটা বই বেরিয়েছে, ছদ্মনামে (আমি খুঁজে দেখেছি, ঐ নামে লেখক ও তন্ত্র ইত্যাদির বই আছে, তবে একই লোক নাও হতে পারে)। এরপর ভদ্রলোক আমায়, বললে বিশ্বাস করবেন না, ভোরবেলার স্নিগ্ধ রোদে দাঁড়িয়ে সিগারেট খেতে খেতে, কোয়ান্টাম এন্ট্যাঙ্গেলমেন্ট নিয়ে চাট্টি ভাট দিলেন। ... ...
উঠোনের সেই সাদা কুয়াশা এখন পেয়ারা গাছের পাতা চুঁইয়ে টুপটাপ ঝরছে। আর ভোরের নিস্তব্ধতায় বারবার আছড়ে পড়ছে দমকা হাওয়া। ও দিদি, ঘরে যাও; দেখো কেমন হাওয়া ছাড়ছে। হাওয়ার কনকনে ভাব সত্যিই জার বাড়িয়ে দিচ্ছে। আমি আচমকা সব আগ্রহ ফটকের সামনে রেখে বড়ঘরে চলে আসি। রান্নাঘরের বেড়ায় ঝুলতে থাকা বাতির টিমটিমে আলো উঠোন পেরিয়ে বড়ঘরে আসার আগে অন্ধকারে ধাক্কা খেয়ে আরোও ম্রিয়মাণ হয়ে যাচ্ছে। সেই আলোতে দাদুর কাঠের চেয়ারে আমি কুন্ডলী পাকিয়ে বসে আছি। গায়ে জড়ানো ঠাকুমার পাতলা চাদর। ... ...
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় অনেক টাকা বেতনের মুম্বই চলচ্চিত্র জগতের ডাক ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, তা শুনেছিলাম অগ্রজদের মুখে। ‘আমার সাহিত্যজীবন’ বইটি সংগ্রহ করে তখন পড়ি। কী অসামান্য ছিল তাঁর সংগ্রাম। একাগ্রতা। জীবনে ছাড়তে হয় লোভ। সাহিত্য সাধনার জায়গা। দশ রকমে মাথা দিলে সাহিত্য সরস্বতী লেখককে ত্যাগ করে চলে যাবেন। বরং আমিই ত্যাগ করি অবাঞ্ছিত কাজ। সেই যে ত্যাগ করলাম টেলিভিশনের ডাক, আর ওপথে যাইনি। হ্যাঁ, নিজের গল্পের রেডিও নাটক লিখেছি। নিজের উপন্যাসের চিত্রনাট্য লিখে দিয়েছিলাম পরিচালক রাজা সেনকে। সে ছবি এখনো হয়নি। ... ...
সবথেকে খারাপ লাগত যেটা, সেটা হচ্ছে এদের বেশির ভাগেরই বাংলা আর বাঙালিদের সম্বন্ধে একটা নিচু দৃষ্টিভঙ্গী পোষণ করে চলা। এদের কাছে বাংলায় কথা বলা যে-কোনও লোকই বাংলাদেশি, যারা সঙ্ঘের জয়যাত্রাকে রুখে দেবার ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে অবিরাম। আমি একবার শুনেছিলাম আশুতোষ ঝা নামে এক নামী ল কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রকে ভোপালের বাসিন্দা জনৈক ময়াঙ্ক জৈন টাস্ক দিচ্ছে, হয় অন্তত ৫০ জন বাংলাদেশিকে পিটিয়ে এসো, নয় তো সঙ্ঘ ছেড়ে দাও। এঁদের অনেকেই খোলাখুলি অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করে রাখতে উৎসাহ দিতেন, যাতে কিনা দরকার পড়লে মুসলমানদের আর রাজ্যের পুলিশদের সাথে টক্কর দেওয়া যায়। আমার ভাগ্য ভালো বলতে হবে, আমি কিছু সিনিয়র সঙ্ঘ সদস্যের সুনজরে পড়ে গেছিলাম। প্রশান্ত ভাট থেকে ডক্টর বিজয় পি ভাটকর, প্রায় যতজন সিনিয়র সঙ্ঘ ইন্টেলেকচুয়ালকে আমি জানতাম, প্রত্যেকেই হিন্দুত্বের ওপর আমার কাজকর্মের খুব প্রশংসা করেছিলেন। ... ...
লকডাউনের প্রথমদিকে রোগীর চাপ কম ছিলো। একটা যুদ্ধ যুদ্ধ আবহাওয়া ছিলো। খারাপ লাগছিলো না। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে তত অবসাদে ডুবে যাচ্ছি। করোনার বাড়বাড়ন্ত অবসাদকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। এ এক মহা জ্বালা। যুদ্ধে গো হারান হেরে গেছি। তবু যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হচ্ছে। রোজই একাধিক পরিচিত চিকিৎসকের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার খবর পাচ্ছি। একাধিক চিকিৎসক মারাও যাচ্ছেন। যে কোনো কারণেই হোক মৃত্যুহার আমাদের মত খুপরিজীবী চিকিৎসকদের মধ্যে অত্যন্ত বেশি। চিকিৎসক মৃত্যু হাফসেঞ্চুরি পেরিয়েছে। তার মধ্যে অন্তত চল্লিশ জন প্রাইভেট প্রাকটিশনার। সাধারণ মানুষের মধ্যে করোনায় মৃত্যু হার ২% এর কম, আর খুপরিজীবী চিকিৎসকদের মধ্যে ২০% এর বেশি। ... ...
তখন আমার কাছে লেখা ব্যতীত আর কোনো লক্ষ্য ছিল না। যে কাজ করলে লেখায় ক্ষতি হবে। সময় কম দিতে পারব, সেই কাজ করব না, হোক না ক্ষমতা এবং বেতন বেশি। নিজের ডিপার্টমেন্ট আমাকে সম্মান করত। অন্তত বেশিরভাগ উপরওয়ালারা। সে কথা যাক। একটা কথাও বলতে হয় বড় চাকরি করা আমার সাধ্য ছিল না। মেধাবী তো ছিলাম না। রেজাল্ট খারাপ। কেমিস্ট্রির ময়লার, ফিনার-এর বই না পড়ে বিভূতিভূষণ পড়েছি। সুতরাং হবে কী ? চেষ্টা চরিত্র করলে কীই বা হত। কম বেতনের চাকরি, আমার পরিবারের সকলে কৃচ্ছ সাধন করেছে সমস্তজীবন। স্ত্রী মিতালি হাসি মুখে সব মেনে নিয়েছে। বুঝেছে যদি সম্মান আসে এতেই আসবে। যার যেটা পথ, সেই পথেই তিনি যান। ... ...
লাবণ্যপ্রভা আমার বউদির দিদিমা । তিনি ছিলেন সাগরদাড়ির কন্যা। মাইকেল মদুসূদন দত্ত ছিলেন তাঁর সম্পর্কিত দাদু। মানকুমারী বসু তাঁর পিসিমা। বউদির বাবা আমার বাবার বাল্যবন্ধু। সেই সূত্রে তাঁর শ্মশ্রুমাতার বেলগাছিয়ায় আসা ছিল নিয়মিত। জামাইয়ের বন্ধু তো। আর পূর্ববঙ্গের শিকড়ও ছিল। অদ্ভুত তিনি। ওপার থেকে তেমন কিছুই আনতে পারেননি। অল্প বয়সে বিধবা। থাকতেন বসিরহাটে। তাঁর পুত্রটি তহসিলদার। খাজনা আদায় করেন। তখন এই বৃত্তি ছিল খুবই কষ্টের। তহসিলদার অন্য রাজ্যে তহসিলের শাসনকর্তা, এই রাজ্যে ছিল খাজনা আদায়ের কমিশিন এজেন্ট। যত আদায় তত আয়। যেতেন আবাদ অঞ্চলে। আবাদ অঞ্চল মানে সুন্দরবন এলাকা। মাসিক বেতন ছিল না। তো তিনি আবার ছিলেন আলাভোলা মানুষ। মুখখানি মনে পড়লে এখন মায়া জন্মায়। ... ...
এর আগের পর্বে কয়লাখনি নীলাম ও তাতে বিশাল বনভূমি ধ্বংসের কথা লিখেছি। লিখেছি কী ভাবে কর্পোরেটের সামনে থালায় সাজিয়ে দেওয়া হচ্ছে এদেশের সমস্ত খনিজ ও বনজ পদার্থ। যাতে তাদের কোনো অসুবিধে না হয়, সেজন্য আইন পালটে যাচ্ছে দেদার। অতিমারির অছিলায় শুধু ভিডিও কনফারেন্স করে পরিবেশ সম্পর্কিত অতি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। যদি আসামের বাঘজান তৈলকূপ ও বিশাখাপত্তনমের গ্যাস লিক আমাদেরকে কিছু শিক্ষা দিয়ে থাকে তাহলে তা হওয়া উচিত ছিল এইরকম- এদেশের মাটিতে পরিবেশের সর্বনাশ আটকাতে হলে আমাদের চাই ইন্ডাস্ট্রির তুমুল খিদেকে বশে রাখবার জন্য যথোপযুক্ত পলিসির আশ্রয় নেওয়া। কিন্তু বাস্তবে কী হচ্ছে? ... ...