বিজু স্কুলে এসে জানতে পারলো হেডস্যার আসতে পারেনি। তার নাকি জ্বর। কাল কোন এক স্যার চাল বিলির ব্যবস্থা করবে। কিন্তু আজ তারা খাবে কী? রান্না হবে কি দিয়ে? এইসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে বিজু যখন বাড়ি ফিরলো বাবাকে দেখে সে অবাক হয়ে গেল। বাবা দাড়ি কামিয়ে, চান করে, আলমারী থেকে জামা কাপড় বের করে, পরে, রেডি হয়ে বসে আছে। বিজুকে দেখতেই বাবা বললো তাড়াতাড়ি চান করে নে বিজু। একটু পরেই আমরা বেরিয়ে যাবো। গনেশ কাকু গাড়ি নিয়ে আসবে। বিজু তো অবাক। কোথায় যাবো আমরা বাবা? বাবা বলে সেও জানে না। কোন একটা জায়গা। শ্যুটিং দেখবো। বিজুর চোখ বড় বড় হয়ে যায়। ফিল্মের শ্যুটিং বাবা? বাবা ঘাড় নাড়ে, হ্যাঁরে ফিল্মের শ্যুটিং। বলেছে নাকি শ্যুটিং দেখাবে। খেতে দেবে। চল চল দেরি করিস না। ... ...
দারিয়াবান্দা, কুতকুত (এইটা সম্ভবত আন্তর্জাতিক খেলা, অনেক বিদেশি সিনেমায় দেখছি তারাও কুতকুত খেলে! নিয়ম কানুনে হয়ত পার্থক্য আছে কিন্তু খেলে।) ফুলটোকা বা গোলাপ টগর, রুমাল চোর, কানামাছি, মোরগ লড়াই, ইচিং বিচিং, ওপেন টু বাইস্কোপ , আজকে আর কেউ খেলে না। এর মধ্যে দারিয়াবান্দা খুব জনপ্রিয় একটা খেলা। ব্যাডমিন্টন কোর্টের মত করে কোর্ট কাটা হত। একদল দাগে দাঁড়িয়ে থাকত অন্য দল ঘর গুলাতে। এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যেতে হবে। দাগে যারা দাঁড়িয়ে রয়েছে তারা দাগে পা রেখে ঘরের ভিতরে যারা আছে তাদের ছোঁয়ার চেষ্টা করবে। এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যাওয়ার সময়ও যদি ছোঁয়া যায় তাহলেও চলবে। এক ঘর থেকে অন্য ঘর এভাবে পুরোটা যেতে হবে আবার আসতে হবে। সবাই মরে গেলে অন্য দলের সুযোগ। এই খেলার একটা আলাদা বিশেষত্ব রয়েছে। দারিয়াবান্দা খেলা একটু নরম প্রকৃতির, মেয়েরাও অংশ নিতে পারত। এটার একটা পুরুষালি ধরণ ছিল। এতে হাত পা যেমন খুশি তেমন ছুঁড়ে বিপক্ষকে ঘায়েল করা যেত। কেউ হয়ত লাফ দিয়ে পার হওয়ার চেষ্টা করল, অন্য জন হয়ত সোজা লাথি মেরে ফেলে দিল! বেশ ভয়ংকর একটা ব্যাপার ছিল। এর নাম ছিল চিক। আমরা দারিয়াবান্দা খেললে কেউ কেউ মেয়েদের খেলা খেলছি বলে খেপানোর চেষ্টা করত। কিন্তু চিক খেলছি দেখলে! হুম, এবার হচ্ছে খেলা! কতদিন যে চিক খেলে হাত পায়ে ব্যথা পেয়েছি তার কোন ইয়াত্তা নেই। সেই ব্যথাও এখন সুখের মনে হয়। কী অদ্ভুত সময় পার করে এসেছি। এখন ভাবলে পরাবাস্তব কিছু বলে মনে হয়। ... ...
সকালগুলো মনোরম এ সময়। বাতাসের গায়ে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়তে শুরু করে। উৎসবের ফুল শিশিরভেজা ঘাসে ছড়িয়ে দেয় গাছ, একটা মনকেমনের সুগন্ধ শরীরময় আনচান করে। এসময় সূর্য ওঠার আগে বিছানা ছাড়তেও আলস্যি নেই। গ্রামের বাড়িতে থাকলে পুকুরঘাটের ভাঙা পাথরের ধাপে বসে জলে ভাসা কুয়াশা দেখতাম। সেই কুয়াশা কেমন মৃদু বাতাসে ধোঁয়া কেটে কেটে উড়ে গিয়ে স্থির হত ওপারে শুরু হওয়া হৈমন্তী ধান-জমির এক মাথায়। রাতের জল লেগে আছে ধানের শিষের আনত শিরে, যেন ঘুমভার জড়িয়ে আছে সারা খেতে । কবে পড়া ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’-র লাইনগুলি মনে পড়ে, ‘কোলে ধান, কাঁখে ধান নিয়ে একেকটি গাছ নিঃসাড়ে ঘুমায়। কুয়াশা চুঁইয়ে শিশিরের একেকটি বিন্দু শীষের ওপর স্বপ্নের তরল ফোঁটার মতো পড়লে ধানগাছের ঘুম আরও গাঢ় হয়।’ সদ্য কচি ধানে দুধ আসার সময় ধানের ভারী ঘুম হয়। তার আগে দীর্ঘ শ্রমের ইতিবৃত্ত। মাটি তৈরি হবে বলে কৃষক তার ভাঙা গাল নিয়ে নীচে নয় আকাশের দিকে তাকায়। শুরুতে কয়েক পশলা বৃষ্টি পেলে মাটির কঠোর বুক ভেজে, নরম হয়। লাঙল দিতে সহজ তখন। এক ফসল তুলে নিয়ে আর-এক বোনার আগে জমিতে থেকে যায় কেটে নেওয়া ফসলের অবশেষ। খড়ের নড়ার গোড়ায় জল পেলে সে মাটি চষতে কষ্ট নেই। তবু এক-এক শীতের সন্ধ্যায় জমির পর জমিতে ধু ধু আগুন জ্বলে, নড়ায় ধরানো আগুন। চাষির অন্ধবিশ্বাসে নড়ার ছাই জমিতে মিশে উর্বর হয়! সন্ধে-নামা বাতাসে তার ধোঁয়া কুয়াশার মতোই স্থির হয়ে থাকে বহুক্ষণ। ... ...
কারোর মনে হতে পারে কলকাতা শহরটি - উত্তর দক্ষিণে লম্বাটে, পূর্ব-পশ্চিমে কম চওড়া শহরটি তার জালিকাটা রাস্তা ও জায়গাগুলি সমেত - যেন একটি বৃহদাকার জাল যে জালের মধ্যে কোন মানুষ পড়ে যেতে পারে, পড়ে গিয়ে কলকাতা শহরের মধ্যে হারিয়ে যেতে পারে! এরকম হয়ত পুরোটা নয় যে এই জালের কেন্দ্রে মিনোটরের মতো কেউ আছে যার কাজই হল এক এক করে কলকাতার মানুষদের শুধুই গ্রাস করে যাওয়া আর সেই কাজ থামানোর জন্য থিসিউসের ম্তো কারোর দরকার, শহরটা হয়ত অতখানি কুটিল বা বিভ্রান্তিকর নয়, বিভিন্ন মানুষ তো বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কারণে কলকাতায় এসেছে, অনেকেই জন্মাবধিই এই শহরে থেকেছে যে শহর তাদের আশ্রয় দিয়েছে, ফলে সব চরিত্রই এই শহরের মধ্যে হারিয়ে যায়নি, কেউ নিশ্চয়ই সেখানে নিজেকে খুঁজেও পেয়েছে। কিন্তু এমনও বোধ হয়, এই শহরের এক কালো আত্মা আছে যাকে পুরোপুরি বুঝে ওঠা যায়নি, যে নিজেকেও ক্রমাগত বদল করেছে, যে এক কুহক তৈরী করে যার নিয়ন্ত্রণে চরিত্ররা থাকতে বাধ্য হয়; মূলতঃ এই শহর হয়ত ক্রীতদাস -ক্রীতদাসীদের শহর হয়েই রয়ে গেছে, সেই সময় থেকেই যেদিন থেকে গ্রামগুলো শহর হিসেবে গড়ে উঠেছে, ফলে কিছু মানুষ ও মানুষী এই শহরের কালো আত্মার গ্রাস থেকে চেষ্টা করেও মুক্ত হতে পারেনি। ... ...
ধরা যাক, সন্ধের কালবৈশাখীর পর ঝিরঝিরে বৃষ্টিটাও থেমে গিয়েছে। এখন শুধু ক্লান্ত পাতাগুলো থেকে টিপটিপ করে জলের ফোঁটা পড়ছে। বাগান ছন্নছাড়া। ভেঙে পড়া পাখির বাসায় ইঁদুরেরা হামলা চালিয়েছে। আর ঠিক এসবের মধ্যিখানে, একটি মা মরা ছেলে, ঘুম থেকে উঠে দেখছে, তার বাবা ও মা কোনো একটি গাছের মগডালে নবদম্পতির সাজে পা ঝুলিয়ে বসেছে। খুনসুটি করছে। সরষে রঙের আলো এসে পড়েছে তাদের শরীরে। তারা রস ও রতিতে বিভোর। এতই বিভোর যে তাদের ক্রিয়া মসলিনের মতো গাছের ডালপালায় বিঁধে গিয়ে বারবার ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছে। তবু সন্তানের দিকে তাদের খেয়াল নেই। ... ...
মেধাবী ছাত্র চঞ্চলকে এভাবে বছর বছর ফেল করতে দেখে তার বাবা চিন্তিত হলেন। তিনি যথেষ্ট অভিজ্ঞ চিকিৎসক। ফলে রোগ নির্নয় করতে ভুল করলেন না। তিনি রাগা রাগী করলেন না। পঞ্চমীদের বাড়িতে গিয়ে শাসিয়ে এলেন না। শুধু মেডিকেল কলেজের হোস্টেল সুপারের সাথে আলোচনা করে মেন হোস্টেলে চঞ্চলের জন্য একটি বেডের বন্দবস্ত করলেন। নিজে গাড়ি করে বিছানা পত্তর আর বই খাতা সমেত চঞ্চলকে হোস্টেলে রেখে এলেন। ... ...
“আপনার ভূতের ভয় নেই?” প্রশ্ন করল মায়া। “না, আমার কোনদিন-ই ভূত প্রেতের ভয় নেই। আমি বরং খুশি হতাম ওর ভূত যদি এসে বলে যেত ও আত্মহত্যাটা করল কেন।” হালকা সুরে বলল অনন্ত। কাণ্ডটা দেখো, ভাবল সত্যার্থী, গল্প শুরু হতেই সেই ত্রিদিব সামন্তর কথা এসে পড়ল। না কি মায়াই সূক্ষ্ম কৌশলে গল্পকে সেই পথে ঠেলে দিচ্ছে! "সেই, ওনার ভূতই সম্ভবতঃ বলতে পারবে কেন করেছিলেন ঐ কাণ্ড,” বলল অপালা, “সাধারণ মানুষের ব্যাখ্যার অতীত।" "হ্যাঁ, ওটা আর কোনদিন জানা যাবে না। বহুবার আলোচনা করেও এ ঘটনাটার কোন ব্যাখ্যাই আমরা কখনো খুঁজে পাই নি। একেবারে ব্যাখ্যার অতীত যাকে বলে।" - হাত পা নেড়ে প্রবল ভাবে নিজের মত জানালেন সমর। "তাই ভাবছেন?" উস্কে দিল মায়া। "ভাবাভাবির কিছু নেই আর।” বলল সমর, “পুরো ঘটনাটাই অভাবনীয়। হাসিখুশি, প্রাণচঞ্চল একটি লোক, সাফল্যের চূড়ান্তে রয়েছে, পুরনো বন্ধুরা মিলে দিব্যি গল্প-গুজব করছি সবাই, হ্যাঁ অন্তত পাঁচ-ছজন ছিলাম আমরা সেই রাতে। ভবিষ্যতে কী কী করতে চলেছে তাই নিয়ে তার কত স্বপ্ন, কত পরিকল্পনা। সেই লোক ডিনার টেবিল থেকে উঠে তিনতলায় নিজের ঘরে চলে গেল। কিসের জন্য? খোলা বারান্দা টপকে নীচে লাফিয়ে পড়ে ঘাড় মটকে মরে যাওয়ার জন্য! কেন? কিসের জন্য? কোনদিন আর সেটা জানা যাবে না। কোনদিন না।" "কোনদিন জানা যাবে না কথাটা কি একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যায় না, সমরবাবু?" হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করল মায়া। সমর অবাক হয়ে তাকাল ওর মুখের দিকে। "বুঝলাম না। কী বলতে চাইছেন আপনি?" "একটি সমস্যা এক সময় সমাধান করা যায়নি মানে কি কোনদিনই আর সমধান করা যাবে না?" "হাঃ! দেখুন মিস মূর্তি, যে সমাধান সেইদিন বের করা যায়নি, আজকে, দশ বছর বাদে সেই সমাধান আপনি খুঁজে বার করবেন?" মায়ার মুখের মৃদু হাসি একটু ছড়িয়ে, কৌতূকী বাঁক নিয়ে আবার আগের অবস্থানে ফিরে এলো। “ইতিহাস কিন্তু তাই বলে সমরবাবু। আমাদের দেখাগুলো একান্তই আপেক্ষিক। ঘটনাকে ঠিকভাবে বুঝতে হলে তাকে ছাড়িয়ে এগিয়ে যাওয়ার দরকার পরে। তিনটে মাত্রায় ঘটনাকে পুরো দেখা যায় না। চতুর্থ মাত্রাটিকে জুড়তে লাগে – সময়। চার মাত্রার ক্যানভাসে সমস্ত উপাদানগুলো ঠিকঠাক মতন বসে পুরো ছবিটা ফুটিয়ে তোলে।” অলক সেন এই সময় সামনের দিকে ঝুঁকে এল, যেন বিলাপ করে গলা ভেঙ্গে গেছে এমন হাহাকারের স্বরে বলে উঠল - ... ...
"ঘরে চল, এইখানেই দাঁড়ায়ে থাকবি নাকি ছেমড়ি?" হানিফার ডাকে হুঁশ ফেরে সাকিনার। ব্যাগটা তুলে হানিফার পিছন পিছন ভিতরে ঢোকে সে। ঘরের ভিতরটা কিছুটা বদলেছে বটে। উঠোনের ওপারে আগে কাঁটাগাছের বেড়া ছিল, মাঝে মাঝে ফাঁকা। ওখানটায় একটা ঘর উঠেছে। পাকঘরটা ছিল ডান দিকে, বাম দিকে খালপাড়ে খাটা পায়খানা। এখন ওখানে পাকা পায়খানা হয়েছে, রাস্তাটায় একটু সিমেন্ট দেওয়া। রান্না হচ্ছে এদিকের বারান্দার এক কোনে, সেখানে দুটি বউ কাজ করছে। সম্ভবতঃ জলিল আর খলিলের বিবি ওরা। ওদের আসতে দেখে একটু অবাক হয় দুজনেই। তাদের কাছে ডাকে হানিফা, "এই দেখ ছেমড়িরা, আমার একখান মাইয়া আছে কইছিলাম না? এই হইল সাকিনা বানু - আমার সই জারিনার মাইয়া। কিন্তু আসলে আমারই। ছালাম কর" ... ...
যদিও সব কাঠই চালান যায় এক শহর থেকে অন্য শহরে, যদিও সব করাতই সরবরাহ করে শহর, যদিও শহুরে মুনাফা কোনোদিনই সংগত করে না এখানকার সস্তা শ্রমের, তা বলে কোনো শহরকে তো কাঠচোর শহর বলা যায় না! কেন-না শহর মানেই সভ্যতা। সভ্যতা মানেই বিপ্লব। বিপ্লব মানেই অগ্রগতি। অগ্রগতি মানেই মানুষের ক্রমমুক্তি। তাকে তো আর যা-ই হোক কাঠচোর উপাধি দেয়া যায় না। দিলে নিজের মুখেই থুতু পড়ে, উত্তর পুরুষের বাড়া ভাতে ছাই পড়ে, পূর্ব পুরুষের কথাসাগর নিমিষে বাষ্পীভূত হয়ে যায়। ফলে, শিক্ষা, সংস্কার, মূল্যবোধ, সংস্কার, স্বাস্থ্যসূচি, গণতান্ত্রিক বাতাবরণ, মেহনতি ঐক্য, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, সূর্য অভিযান, ইত্যাদি প্রভৃতি যাবতীয় শব্দ হয়ে পড়ে মূল্যহীন। ... ...
“পরব হল, এই ধর আমোদ, নাচ গান। সোহরাইতে ঠাওর করিসনি, কেমন নাচ করে বিটিছেলারা?” ধাতুরির ফ্যাসা কণ্ঠে চঞ্চল জীবের কামজ্বর চিতাধূমচালিত চৈত্রের বিশুদ্ধ পাতার ন্যায় অন্তর্হিত হইবার পূর্বে যেরূপ অবশেষ রাখিয়া যায়, ধাতুরি সেমতো চক্ষু উন্মীলন করিয়া বুধনিকে অবলোকন করিল, সে দংশনে শীতপত্রের বিশুষ্কতা, ফলত নিষ্ফল—“এই, এই যে সারদাপ্রসাদ আর বুধনি, উয়াদের বাপলা হবেক সব্ব অগ্রে। উয়ারা বর বউ হবেক, গাঁও জুড়ে বসবেক ভোজ, উয়ার অন্তে আসবেক বারুনি পরব। কিত্তে মজা! মজাই মজা!” হাহাকার করিয়া বুড়া বাতাস ধাতুরির জিহ্বা চুম্বন করিল। ... ...
মারাঠীতে নাকুশা মানে নাকি অবাঞ্ছিত বা অপয়া, বিনীতা বলেছিল। নাকুশার মা তখন ওদের ঘর ঝাড়ুপোছা আর বাসন সাফ করত। তারপর তো মা’টা মরেই গেল আর নাক্কিকে এলাকার এক কর্পোরেটার লাগিয়ে দিল পাহাড় পাতলা করার কাজে। চুপচাপ গিয়ে রাস্তা থেকে একটু উপরে উঠে মাটি কেটে কেটে জমা করবে আর হপ্তায় একদিন কর্পোরেটারের গাড়ি এসে নিয়ে যাবে জমা করা মাটি। এমনি করে করে পাহাড়টা যখন রোগা হয়ে যাবে, বেঁটে হয়ে যাবে, পাহাড় বলে আর চেনা যাবে না, তখন কর্পোরেটার এসে সেখানে মস্ত আলিশান সব বাড়ি বানিয়ে ফেলবে। নাক্কিয়া তদ্দিনে বড়সড় হয়ে সেই সব বাড়িতে কামওয়ালি বাঈ হয়ে কাজে লেগে যেতে পারবে, চাই কি বিয়ে শাদিও হয়ে যেতে পারে। ... ...
আমার ফুলফুল ছিটওয়ালা জামায় নোংরা লেগেছে। হাত দিয়ে জামার ধুলো পরিষ্কার করছিলাম আমি। নিচু হয়ে জামার ওপর দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে দেখলাম যেখানে আমার শরীর ভয়ঙ্করভাবে ক্রমশ পাহাড়চুড়া হয়ে উঠছে, সেখানে কালো রং লেগে রয়েছে। কখন ? কখন এখানে কালো রং লেগেছে, কিছুই টের পাইনি। কাল রাতে এই কালো রং দিয়েই তো ফরেস্ট বাংলোর দেয়ালে বীরু লিখেছে – ওয়েলকাম টু গোর্খাল্যান্ড। আমার হঠাৎ মনে হল এই শরীর, শরীরে ফুটেওঠা লালিগুরাস, ঝাউপাতার মত আমার মাথার চুল, পাহাড়ি ঝোরার মত কখনও শুকনো, কখনও ভরাট আমার হাসিকান্না, শরীরের উপত্যকাজুড়ে চা-বাগান, অর্কিড-ক্যাকটাসের নার্সারি, মকাই-এর খেত – আমিই গোর্খাল্যান্ড। ... ...
সে এক ঝলমলে দিন ছিলো গ্রীষ্মকালে। বাকেট্লিস্টের একটা বাক্সে টিকচিহ্ন দেবার জন্য আমি সাঁতার কাটতে গেছিলাম । গ্রেট লেকগুলোর মধ্যে একটায়। মিশিগান। গভীর অন্ধ্কার জল, তার মধ্যে আস্তে আস্তে নিজের বল্গা খুলে দিতে হয়। আমি টের পেয়েছিলাম জল আমার সাথে কথা বলছে। না, ওর কথা 'শোনা' যায়না। তোমায় বুঝতে হবে, সারা শরীর দিয়ে। ও স্রোতের ভাষা বলে। ঢেউ এর ভাষা। অতলের ভাষা। তরলের। আর আরো কতকিছুর, পৃথিবীর শব্দ দিয়ে যার নাম বলা যায়না। বিশাল গভীর মিশিগান, আমার সাথে কথা বলেছিলো। আপনজনের মত। সেই থেকে আমি জলের সঙ্গে কথা বলতে পারি। মিসিসিপি নদী ভয়ানক রেগে থাকে। মানুষরা ওকে এমন বিষিয়ে দিচ্ছে। রাগবে না তো কি করবে? হুরন লেক আবার খুব লক্ষ্মী মতো। মিশুকে, হাসিখুশি। মস্ত লেক সুপিরিয়র কি গম্ভীর! আমার সেই কঠিন নিষ্ঠুর শিকারী কাকুর মত। যিনি এককথায় আমার জন্য নিজের প্রাণটা দিয়ে দিতে পারতেন! ডেড সী ও চুপচাপ খুব। ইন্ট্রোভার্ট। সমাহিত। অথচ ভূমধ্য সাগর? ভূমধ্য সাগর আমাকে বলেছিলো ওকে 'খাতুনা' বলে ডাকতে। এক নম্বরের ফ্লার্ট একটা! না, এসব আমি বলতে যাইনা কারুর কাছে। বলে কী হবে? আমি যে জলের সঙ্গে কথা বলতে পারি কেউ তো আর বিশ্বাস করবে না? ... ...
ছড়া মূলত গ্রাম্য সাহিত্য, মানুষ তাদের বাচিক ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে ছন্দোবদ্ধ ভাবে কথা বা মনের ভাব প্রকাশ করে এই ছড়ার মাধ্যমে। আবার এই ছড়াগুলি পরম্পরায় প্রচলিত ও প্রচারিত। আঞ্চলিক প্রভাবের কারণে এইসব ছড়ার পাঠভেদও দেখা যায়। আশ্চর্যের বিষয় এই যে এইসব ছড়া গুলি কে, কবে রচনা করলেন তা কেও জানে না, কিন্তু সমাজে এগুলি চিরকাল ধরে প্রচলিত। ব্যক্তিক সৃষ্টির এরকম সার্বিক স্বীকৃতি খুবই বিরল। এই ছড়ার রূপরেখা দেখলে বোঝা যায় প্রায় সব এলাকাতেই ছড়া মূলত দু’রকম- ছেলে ভুলানো ছড়া ও সর্বজনীন ছড়া। এখানে আমাদের আলোচ্য বিষয় ছেলে ভুলানো ছড়া, আরও নির্দিষ্ট করে বললে বলতে হয় পুরুলিয়াতে প্রচলিত ছেলে ভুলানো ছড়া। ... ...