- বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ লড়ছে এমন কিছু মুক্তিসেনা লুকিয়ে আছে ঐ ক্যাম্পগুলোতে। অস্ত্র চালান করা, আন্তর্জাতিক রেডিও স্টেশন অপারেট করা, সবেতে আছে ছেলেগুলো। শিতলখুচি বর্ডার দিয়ে ওরা পারাপার করে। আজ যাদের দেখছো, কাল গেলে দেখবে তাদের মুখগুলো পালটে গেছে। সে যাক, ওদের দেশের স্বাধীনতার লড়াই ওরা কেমনভাবে লড়বে ওরা বুঝবে। কিন্তু খুকি... - খুকি কী ? খুকি কেমন কইরা আসলো এইসবের মধ্যে ? মা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে। - শোনো, তোমার খুকি না হাতে এতোদিন হাতকড়া পরতো, যদি ইন্দিরা গান্ধীর হুকুমে পুলিশ অন্যদিকে তাকিয়ে না থাকতো। রিলিফ দেবার নাম করে চরে যায়, ছেলেগুলোর সঙ্গে মেলামেশা করে। একটি মুসলমান ছেলের সঙ্গে নাকি সম্পর্কও হয়েছে। সারা টাউনে ঢি ঢি পড়ে গেছে তো। আর তার সঙ্গে তুমি মেয়েকে পাঠিয়ে দিলে! ... ...
থকথক করে কেঁদে ফেলে ছেলেটি , আমি মোছলমান বলি মা আমারে বাঁচায় নাই স্যার— যাতি আসতি কতবার ভালো ভালো কলা দিছি দুগগা মার পায়ের তলায়—বলাইকাকার সাথি কতবার ডাকিছি মা, ওমা জগজ্জননী আমারে একটু বুদ্ধি দাও মা -- প্রাণ খুলে শ্বাস নেন নূরতাজ মন্ডল। যাক বলাই সাহা্রা তাহলে মিথ্যে বলেনি কাল মাঝরাতে। ছেলেটা সত্যি নিরীহ। বলাই সাহার বউ কি যেন বলেছিল, গোপাল। তা গোপালই বটে ! একটু বেশি ভালো মানুষ। সমাজের লোকেরা যাদের বোকা বলে তেমন সোজা সরল মানুষ। কৃস্টালের পেপার ওয়েটটা টেবিলের কাঁচের উপর ঘুরাতে ঘুরাতে নূরতাজ মন্ডল উপলব্ধি করেন, এই ছেলেটার ভালোমানুষি মনে এবার পাপ ঢুকে পড়বে। জেল বাস হয়ত তিনি রক্ষা করতে পারবেন। কিন্তু ছেলেটা এবার সাম্প্রদায়িক হয়ে যাবে। ওর মনে মানুষকে সহজে বিশ্বাস করার সরলতা মুছে গিয়ে অন্যদের মত জেঁকে বসবে আল্লাহ, ঈশ্বর, ভগবানকে ভাগ করে নেবার শিক্ষা। জন্ম নিবে ঘৃণা । মানুষকে ধর্ম দিয়ে ভাগ করতে শিখে যাবে ছেলেটা। এক হাতের চেটো দিয়ে অন্য হাত মুছে নিয়ে তিনি মনে মনে হাসেন, এই তো এই জগতের বাস্তব শিক্ষা। ছেলেটার বুদ্ধির কমতি ছিল। এবার তা পূর্ণ হলো ... ...
তোমায় আমি লিখতে পারছি না, বাজার দোকান রান্নাবান্না বাসনকোসনের জঙ্গলে যেন এক বাঘ, বোঁটকা সোঁদা গন্ধের ভিতর এক নিভৃত অঞ্চল যাতে আমি শুয়ে শুয়ে বিছানায় নক্ষত্র শুঁকি, খেয়ে ফেলি তার মিষ্টি আর সুস্বাদ, টক সব গন্ধগুলো পিতলের পাত্রে রাখি,কল্পে যাবার কল্পিত... ... ...
গতকাল সারারাত আমি ঘুমোতে পারিনি। এক দুশ্চিন্তায়। শেষ মুহূর্তে এখানে চলে আসার দুর্ভাবনা আমাকে পেয়ে বসেছিল। কেন না আমরা মুসলমান। হিন্দু এলাকায় থাকব। নিরাপত্তাহীন এক ভয় আমাকে গ্রাস করেছিল। কেন না এখন গুজরাতে ভয়াবহ দাঙ্গা চলছে। বীভৎস সব খবর বেরোচ্ছে সংবাদপত্রে। আমার স্ত্রী নাসিমা খবরের কাগজ পড়ে না, তার এ নিয়ে কোনও দুশ্চিন্তা ছিল না। আমি একা একা নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করেছি, স্ত্রী পরিবারকে মহিষবাথানে যে নিয়ে যাচ্ছি, ঠিক করছি কি? এখানের পরিস্থিতি যে খারাপ হবে না, তার নিশ্চয়তা কি আছে। গ্রামে মুসলমান এলাকায় থাকি, খানিকটা মনে জোর পাই। মহিষবাথানে তো সবাই হিন্দু, আমরা একমাত্র মুসলমান। জায়গা কেনার সময় এ কথা মাথায় আসেনি। মানুষজন যেভাবে জায়গাজমি কেনে, বাড়ি ঘরদোর করার স্বপ্ন দেখে, আর পাঁচজনের সঙ্গে আমার কোনও তফাত ছিল না। বরং মনে হয়েছিল হিন্দু এলাকায় মুসলমানরাও থাকবে। সহাবস্থানের প্রেম খুঁজেছিলাম। আর সেই প্রেমকে শেষ পর্যন্ত লালন করতে পেরেছিলাম বলে গতরাত দুর্ভাবনায় কাটিয়েও আজ মহিষবাথানে চলে আসতে পেরেছি। গুরুচণ্ডা৯ প্রকাশিত "নির্বাচিত গল্পপাঠ' গ্রন্থ থেকে। ... ...
“জানি না”, অস্থির সীতাপ্রসাদ মাথার চুল খামচে ধরল। “কিন্তু গত বছরের সব কটা ঘটনা পর পর খেয়াল করে দেখো। মে মাসে প্রভুজির হুকুম আসল। আমরা ত্রিশূল নিয়ে গ্রাম ঘুরে ঘুরে কবরখানায় হামলা চালালাম। এখানে, ঠিক এই জায়গাতে,” সীতাপ্রসাদ এলোমেলো হাত চালাল চারপাশে, “এখানে আমাদের গোটা দল এসে কবরগুলো একটার পর একটা খুঁড়লাম। এমনকি পচে গলে যাওয়া বডিগুলোকেও ছাড়িনি । যেসব জেনানারা কংকাল হয়ে গিয়েছিল তাদের বাদ দিলাম শুধু। তারপর কাজ হয়ে গেলে লাশগুলো সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখলাম যাতে সকলে দেখতে পায়। পরদিন থেকে টেনশন শুরু হল। বলা হল ওরা অ্যাটাক করবে, তাই পার্টি অফিস থেকে রাত্রিবেলা তলোয়ার আর ত্রিশূল বিলি হল। আমরা হামলা চালালাম। খুনখামারি যা হবার তা তো হল, ওদের সবাই চলে গেল রিফিউজি ক্যাম্পে। সব কিছুই জুন মাসের মধ্যে মিটে গেছে। ভোটার লিস্ট চেক করে দেখো, যে কয়খানা ঘর এখনো টিকে আছে তাদের একটাতেও কোনো জোয়ান মদ্দ নেই। আগাছা সাফ করে দেবার মত উপড়ে ফেলেছি। তাহলে এতদিন বাদে এই মার্চ মাসে এমন কাজ করল কে? কে এমনভাবে খুন করল তিনজনকে? আশেপাশের গাঁও গুলোর কেউ নয় কারণ এই কাজ করবার জন্য গায়ের যা শক্তি লাগে তা ওই কয়েকঘর বুড়োহাবড়াদের মধ্যে নেই। আর এমনভাবে বডিগুলো সাজিয়ে রাখল ঠিক যেভাবে আমরা ঐ লাশগুলোকে সাজিয়ে রেখেছিলাম। ... ...
তখন আমাদের ছোট শহর যেন নতুন সভ্যতার আলো দেখা আফ্রিকার কোনো গহীন জনপদ। পাহাড় থেকে নেমে আসা দাঁতাল হাতি শহরের রাস্তায় নেমে হুটোপাটি করে, নাম তার গনেশ। আদিবাসী দেবতার পূজার রাত্রে শহরের রাস্তায় কেউ বেরোলে প্রাণদন্ড হয়। রাজার রাজত্ব গেলেও তাঁকে সবাই মহারাজ বলে, তাঁর স্ত্রীকে মহারাণী। সে যাই হোক, আসল গল্পটা এটা নয়। এরও অনেকটা আগের ঘটনা। আমার বাবা তখন বালক। বাবার ছোটবেলা কেটেছে চা বাগান এলাকায়। দিনদুপুরে বাঘ বেরোয়। সপ্তাহে একবার স্থানীয় ডাক হরকরা ছাতুয়া বুড়ো আসে চিঠি নিয়ে। মোড়ের মাথায় তার তালপাতার তৈরি ছাতাখানা দেখতে পেলে 'চিঠি চিঠি' করে দৌড়ে যাওয়া তখন বাবাদের একমাত্র বিনোদন। সময়টা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশপাশ হবে। আমার ঠাকুর্দা কলকাতায় চাকরি করতে গেলেন। সঙ্গে নিলেন আমার বাবাকে। কলকাতায় পিতাপুত্রের সংসার কিছুটা দাঁড়িয়ে যাবার পর ঠিক করলেন ঠাকুমা আর কাকা পিসিদের নিয়ে যাবেন। ... ...
রমজান মাস পড়ল। সে সময় চলছে বাগদি পাড়ার পুন্যি পুকুরে জবকার্ড থেকে মাটি কাটার কাজ। বেলা বারোটা। সব পাড়া থেকেই দু-চারজন করে কাজে লেগেছে। যারা রোজা রেখেছে, খালি পেটে টলছে। তখন বাগদি পাড়ার কেউ একজন বলে উঠল, তুমরা যারা রোজা রেখেছ, ঘর যাবে তো চলে যাও। বাকি কাজ আমরাই করে দিব। এত রোদে খালি পেটে আর খাটতে হয় না। দুগি বাগদির মেয়েটার বিয়ে লেগেছে মাছডোবায়। জামাইকে দিতে হবে একখানা নতুন সাইকেল, হাত ঘড়ি, আর নগদ পনেরো হাজার টাকা। কোথায় পাবে দুগি! খালেবিলে, নদীতে, মুয়ানে মাছ ধরে সে। দুগি গেল মল্লিকপাড়ার ঝড়ো মল্লিকের কাছে। গিয়ে সব কথা বলে আবদার করে বসল, ও চাচা, দুগিটার বিয়ে লাগাইছি। তুমি কিছু দিবে নাই? ঝড়ো মল্লিক বলল, ও মা, এ তো খুশির খবর! মেয়ের বিয়ে দিচ্ছিস, কিছু দিতে হবে বইকি। তা কী দিলে খুশি হবি বলত? আবদুল চাচা তো সাইকেলটা দিচ্ছে, তুমি একখানা ভালো হাত ঘড়ি কিনে দিও তাইলে। ... ...
আরে ধুর, ছেলেটা হাত দিয়ে যেন হাওয়া তাড়ায়। এক জায়গায় দুবার কখনও হবে না, টেররিস্টরা কি ঘাসে মুখ দিয়ে চলে? আবার কোথাও করবে, পুলিশ টিকিও ছুঁতে পারবে না। পুলিশও কোন ঘাসে মুখ দিয়ে চলে না। দুই টেররিস্ট তো পরশুদিনই এনকাউন্টারে মারা গেছে। একটা তৃপ্তির হাসি ছড়িয়ে পরে সুবিমলের মুখে। কিন্তু কি অডাসিটি , তারপরেও আবার ব্লাস্ট হয়েছে। তার মানে বুঝতে পারছ? গমগম করে ওঠে সুবিমলের গলা। পাকিস্তানের মদত আর ট্রেনিং। সবকটা মুসলমানকে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিলে তবে যদি কিছু হয়। কিন্তু এনকাউন্টার করল কেন? খবরের কাগজ থেকে মুখ সরাল উপরের বার্থের লোকটা এবার। ওদের ধরতে পারলে তো বরং কিছু খবর জানা যেতো। হয়তো পরের ব্লাস্টটা হত না। সবাইকে চমকে দিয়ে সালমা বলে ওঠে, আল্লা জানেন, পিছন থেকে গুলি করে মেরেছে ছেলেটাকে, ওদের হাতে তখন কোন হাতিয়ার ছিল না। তার জলভরা চোখ বোরখার সীমানা ছাড়ায়। হঠাত কামরাটা এক মুহূর্তের জন্য নিস্তব্ধ হয়ে গেল। কিন্তু পর মুহূর্তে সুবিমল ঝাঁঝিয়ে ওঠে, বেশ করেছে, এতগুলো নিরীহ লোকের জান নিতে ওদের তো হাত কাঁপেনি। দেশের দুষমন সব। ধরে ধরে সবাইকে গুলি করে মারা উচিত। সালমার কান্না আর নিঃশব্দ রইল না। বাধ্য হয়ে রমাকে বলতে হল , তুমি থামো তো একটু। সব জায়গায় গিয়ে তোমাকে পুলিশগিরি করতে হবে না। ... ...
সিন্ধু নদকে ছেড়ে ইসমত আর কীর্তনখোলা নদীকে ছেড়ে সআদত এসে পড়েছিল এক নতুন দেশে, যেখানে তারা সংখ্যালঘু। তবু তারা বেছে নিয়েছিল এই দেশটাকে, কেন-না, মাঝখানের এই দেশটাই জুড়ে রেখেছিল পরস্পরের জন্মভূমিকে। পালানোর আগে স্থির হয়েছিল, দু'জনের দেখা হবে দিল্লিতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে─সবে পঁচিশ বছর বয়স তখন তার, সেভাবে সেজে ওঠেনি তখনও, ওরা চিঠিতে জানিয়েছিল, জেনেছিলও এমন-কি, সেই প্রায় সদ্যোজাত বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের সামনেই থাকবে তারা; সেখানেই দেখা হবে তাদের, বহুদিনের দাবদাহের পর বৃষ্টি নামবে চোখের পাতায়─আনন্দজল। সআদত তাকে বাংলা ভাষাশিক্ষার কিছু প্রাইমার রেজিস্ট্রি ডাকে পাঠালেও ইসমত তখনও বাংলা ভাষাটা পুরোপুরি আয়ত্তে আনতে পারেনি, কারণ যেহেতু তার বাড়িতে সবাই উর্দুতে কথা বলে, ফলত তার বাংলা বলার অক্ষম চেষ্টায় ক্রিয়াপদ গুলিয়ে যায় এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই এসে পড়ে উর্দু শব্দ। সআদত যে তাকে বাংলা শেখার জন্য জোরাজুরি করেছিল, তা নয়; বরং ইসমত নিজেই চেয়েছিল ভাষাটা শিখতে : ওদের বিয়ের পর সআদতের আম্মি-আব্বুর সঙ্গে সম্পর্ক সহজ করে তোলার উপায় হিসাবেই বিষয়টাকে দেখেছিল ইসমত আর তাই বছর ঘুরতে-না-ঘুরতেই মোটামুটি চলনসই একটা কথোপকথনের ভাষা, নিজের মতো করে, তৈরি করে নিতে পেরেছিল সে। ... ...
ছেলে বলেছিল আজ মায়ের হাতের রান্না খাবে।তাতেই নয়নতারার মাথাটা ধরেছিল। পার্টিশন! যত দোষ পার্টিশনের। না হলে এক গামলা ভাত রান্ধনের জন্য নয়নতারাকে ছেলে বৌ খোঁচা দিতে পারে? তাও যদি আরেকটা ছেলেপুলে হত। একটা মেয়ে নিয়ে দ্যাবাদেবী সারাক্ষণ আদিখ্যেতা করছে! মাণিকগণ্জের বাড়িতে নয়নতারা নিজের সাতটা ব্যাটা বেটির সঙ্গে কতগুলো ভাগ্নে ভাগ্নীও মানুষ করে ফেলেছেন। তবে ভাত রাঁধতে হত না। অতগুলো মানুষের ভাতের হাঁড়ি কি তেরো বছরের নতুন বউ সামলাতে পারে না মাড় গালতে পারে? বড় জা আর শাশুড়ি প্রায় সমবয়সী। তাঁরাই বলেছিলেন , এ বাড়িতে বউরা ভাতের মাড় গালে না। অত বড় হাঁড়ির ওজন বউ মানুষের নেওয়া নিষিদ্ধ। মাড় গালে মইনা নাগী। মণিভূষণ নিয়োগী।বাপ মা মরা ছেলে। ভাতের মাড় গালা থেকে শুরু করে তরতর করে নারকেল গাছে উঠে নারকেল পাড়া, সব পারে।এমনকী ইজারা নেওয়া পদ্মার বুকে জাল ফেলে যে কটি ইলিশ ওঠে, সবকটি ঘরে এনে তুলতে পারে মইনা নাগি। ... ...
প্রতিবেশী সবজে বা ক্যাটক্যাটে নীল চেক-লুঙ্গি যে শুধু পোষাক নয়, পুরোনো ঢাকার রিকসার মত একটা পশচাদমুখী, মধ্যযুগীয়, অন্ধকারাচ্ছন্ন মানসিক অবস্থা। সর্বস্তরের নতুন বাঙ্গালি নারী তাই পুরুষকে সাথে নিয়েই আর পিছিয়ে থাকতে রাজি নন। দৈনন্দিনে, সামাজিক অনুষ্ঠানে,সদর্থে খেলানো বা হাতে নেওয়া কুচি ধুতি বা নানা কাট পাজামারা তাই এগোচ্ছে। কিছু কিছু প্রযুক্তি যেমন প্রগতির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে না, লুঙ্গিও পারলো না। দুটি সুবিধে কিন্তু ছিল। উত্থান সংক্রান্ত। প্রথমটি হল সম্প্রীতির আবহে খোলা আকাশের নীচে শিশিরে ভেজা গ্রাম বাংলায় প্রাত:কৃত্য। দ্বিতীয়টি হল ঘটনাচক্রে অনিচ্ছামৃত্যুর পূর্ব মুহুর্তে কোনো কোনো পুরুষের প্রাথমিক সামাজিক পরিচয় জেনে নেওয়ার সর্বজনীন সুবিধে। এই পদ্ধতি ১৯৪৬ নাগাদ মধ্য কলকাতায় আবিষ্কৃত হবার পর থেকেই জনপ্রিয়তার কারণে প্রায় জাতীয় ঐতিহ্য হয়ে উঠেছিল। অপিমোড-পুরনারীর বাচ্চা তথ্য সংগ্রাহক দের এতোটা জানার কথা নয়। যাই হোক লুঙ্গির বিরুদ্ধে এই প্রবল জনমত প্রতিষ্ঠার পরের নয়, তার অল্প পূর্বের ঘটনা নিয়েই আমাদের সুশান্ত-অনিতার গল্প। তখনো সমাজে তর্ক চলছিল। বিবর্তনের গতি তখনো হয়তো কিছুটা সহমর্মী-শ্লথ ছিল। ... ...
গোপন কথাটি রবে না গোপনে এমন তো নয় যে আমেরিকা সারা বিশ্বের শান্তিরক্ষার ইজারা নিয়েছিল কোনোদিন। কিন্তু বাংলাদেশ নিয়ে যখন দুনিয়া উত্তাল তখনও আমেরিকা একবারও মুখ ফুটে কোনো প্রতিবাদের ধার কাছ দিয়েও যায়নি কেন? সামান্য হিপোক্রেসিও কি আশা করা যেত না? লেখক বাস তিনটি কারণ বলেছেন। প্রথম দুটি গৌণ। প্রথমত, নিকসন আর ইয়াহিয়া, দুজনের কেউই যখন নিজের নিজের দেশের প্রেসিডেন্ট নন, তখন থেকেই দুজনের মধ্যে একটা সখ্যতা ছিল। নিকসনের অন্তরঙ্গ কথোপকথনের যে টেপ পাওয়া যায় তাতে দুজনের সুসম্পর্কের কথা উল্লেখ হয়েছে একাধিক বার। দ্বিতীয়ত, নিকসন, ইন্দিরা গান্ধিকে রীতিমতন অপছন্দ করতেন। রাশিয়ার সাথে মাখামাখি, ইন্দিরা সোস্যালিস্ট ঝোঁক—শুধু এগুলিই নয়। মানুষ হিসেবেই ইন্দিরাকে নিকসন পছন্দ করতেন না। এর আগে একবার দুজনের মিটিং হয়েছিল দিল্লিতে মিনিট কুড়ির জন্য। ইন্দিরা নাকি যথেষ্ট উৎসাহ তো দেখানইনি, তায় তাঁর এক সহকর্মীকে হিন্দিতে প্রশ্ন করেন, “এ আরও কতক্ষণ টাইম নেবে?” নিকসনের আর-এক পরামর্শদাতার মতে নিকসন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে কোনো মহিলাকে হজম করতে পারতেন না। তো সে কথা বলতে কী, নিকসন গোটা ভারতীয় জাতিকেই অপছন্দ করতেন, বলেছিলেন ভারতীয়রা ‘Slippery and treachorous’। পাকিস্তান ও তার অধিবাসীদের ক্ষেত্রে কিন্তু প্রশংসাই বরাদ্দ ছিল। ... ...
দীপকদা হলে কেমন ভাবে এই খেলাটা দেখাতেন ? তিনি প্রথমে মঞ্চের মাঝখানে এসে দাঁড়াতেন। নিজের নাম বলতেন। তারপর বলতেন-- ম্যাজিক ব্যাপারটা আর কিছুই নয়, হস্তকৌশল বা চাতুরী। তারপর নিজের খালি-হাত দেখিয়ে বলতেন, এই যে আমার খালি-হাত, যেখান থেকে জাদুকরেরা বের করে আনেন টাকা, রুমাল বা সিগারেট। যেমন, এই মুহূর্তে আমার হাতে এসে গেছে ফুল। তেমনি আরেক ধরনের মানুষ আছেন, যাঁরা মুঠো থেকে বের করেন তাবিজ, কবচ, মাদুলি। আর সেসব সাধারণ মানুষের হাতে দিয়ে বলেন, আপনার ছেলে পাশ করে যাবে, আপনার স্বামী সুস্থ হয়ে উঠবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এঁরাও কিন্তু আমার মতই জাদুর কারবারি। কিন্তু এঁরা কিছুতেই তা স্বীকার করেন না। বদলে নিজেদের বাবা, যোগী বা গুরু বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন। জাদুকর মাত্রেই জানেন, ব্লেন্ডো খেলাটি হল চারটে ছোটো রঙিন রুমালকে মিলিয়ে, একটি চাররঙা বড়ো রুমালে পরিণত করার ম্যাজিক। কিন্তু দীপকদা চারটি চাররঙা রুমালকে, একটি কাগজের রোলের মধ্যে ভরে দিয়ে ,যখন ম্যাজিক করে তাদের জুড়ে দিয়ে একটা মস্ত বড় রুমাল বের করেন, যাতে ওই সব রঙই রয়েছে, তখন ভারতবর্ষের একজাতি-একপ্রাণ- একতার গান বেজে ওঠে। তাই এইসব ম্যাজিক মানুষ বহুকাল ভালবেসে মনে রাখেন। ... ...
‘বউদি অত টাকা পাবে কোথায়—।’ ‘বউদি আর পাবে কোথায়!’ মানিক হাসে, ‘বউদির অনেক কাজের বাড়ির বাবু ধরা আছে। তাদের কাছ থেকে পাঁচ দশ করে কালেক্ট করবে। মাসে মাসে আমি দিলে তাদের শোধ করে দেবে। আর সুদটা বউদির পকেটে ঢুকবে। প্ল্যান আমার ছকা ছিল। ওই হারামির বাচ্চা বাবু সাহা সব লাগিয়ে দিল মল্লিক ঠিকেদারকে। নইলে আমার সব প্ল্যান পাক্কা।’ মানিক আবারও হাসল। ‘আমাকে চুরির বদনাম দিয়ে বাড়ি চলে এল—থানায় গেল না। চুরির মাল খুঁজল না। শুধু হল্লা, নে সাহস থাকে আমাকে পুলিসে দে। দু দুটো টুলু পাম্প, আচ্ছা আমিও ছাড়ব না। ওরা ভয় পেয়ে গেছে রূপা বুঝেছে—আমি যদি ঠিকেদারি লাইনে নামি ওরা আমার সঙ্গে পারবে না।’ রূপার মনে হল, মানিক ঠিক কথাই বলেছে, সত্যি সত্যি চুরি হলে ওরা থানা পুলিশ করত না—ছেড়ে দিত? কেউ ছেড়ে দেয়? ... ...
দরজার বেল বেজেছিল একটু পরেই । পর্দার তলার ফাঁকটুকু দিয়ে সদর দেখা যায় না; নারীকণ্ঠ শোনা যাচ্ছিল- ' নমস্কার , আমি শান্তি। শান্তিলতা।' কণ্ঠস্বর ক্রমশঃ এগিয়ে আসছিল বসার ঘরের দিকে- ' আপনাদের পাড়া আমাদের আগের পাড়ার তুলনায় কত আলাদা! জানেন, ঐ মোড়ের মাথায় যেখানে অনেক দোকান টোকান - মিষ্টি কিনতে গেলাম একটু আগে- দেখি একটা কুকুরছানাকে খাওয়াচ্ছে একটা বাচ্চা ছেলে- বিস্কুট টিস্কুট দিচ্ছে আর হাত নেড়ে কুকুরছানার গায়ের মাছি তাড়াচ্ছে - আমরা যেমন অতিথির খাওয়ার সময় করি আর কি- খেতে খেতে কুকুরটা তাকালো আর ছেলেটা বলল, আগে তুই খা! উনি কী বলবেন জানি না- কিন্তু এও তো এক গল্প, বলুন?' ... ...
"দরজার উল্টোপ্রান্তে দাঁড়িয়ে ওর নাম ধরে ওরা ডাকছিল। “দরজা খুলে দে আমাদেরর না হলে ওটা ভেঙে ফেলব আমরা”। সে দরজা খুলেছিল। অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অনেক লোকজন ঘরে ঢুকে পড়েছিল। ওদের মাথা ঢাকা। বাচ্চারা ভয়ে জেগে উঠতেই চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করেছিল। রোসা বাচ্চাকে এক হাতে নিয়েছিল আর মেয়েটাকে দু পায়ের ফাঁকে। যে লোকটা আলো জ্বালিয়েছিল তার পরনে অন্যদের মতই কালো পোশাক। বুট জুতো পরা। কারো কারো মুখে লাল রঙের রুমাল বাঁধা আর কালো টুপি দিয়ে মুখ ঢাকা। " ... ...
ছোটো থেকেই রবি আর শশী এমন করেই বড়ো হয়েছে। নিজেরাই জঙ্গলে ঘুরে খাবার জোগাড় করে, নিজেরাই রান্না করে আর বাবাকেও খাওয়ায়। কোনোদিন কিছু কিনতে গ্রামে গেলে সবাই কেমন থাকায়। ওরা বোঝে লোকে ওদের ভয় পায়। পছন্দ করে না একদম। ওরাও রেগে রেগে থাকে। শুধু বাবাকে ভালোবাসে। কারণ কোনো কোনোদিন বাবা ওদের সঙ্গে আদর করে কথা বলে। মায়ের কথা শোনায়। রবি আর শশী মায়ের কথা ভাবে আর ঘুমিয়ে পড়ে। ওদের কেউ নেই তো! ... ...