ছবি আঁকতে আমি পার্কে যেতাম প্রায়ই, এবং সবদিনই আমার সাথে মালেক আব্দুর রহমানের দেখা হতো। মালেক আব্দুর রহমান একজন সত্তুর বছর বয়স্ক লোক, এবং বলাবাহুল্য যে, অন্যসব মানুষের ব্যাপারে আমার যেমন কোন আগ্রহ ছিল না তেমনি তার ব্যাপারে আমার কোনরূপ আগ্রহ ছিল না। তিনি রীতিমত আমাকে আমার কাজে বিরক্ত করতেন। এই বিরক্তি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই আমি তার গল্পে ঢুকে যাই। সেই গল্পই এক্ষণে প্রকাশ করছি। ... ...
‘রাইনার, এই যে সব মানুষ তোমাদের ব্যাঙ্কের হলঘরে বসেছিলেন, এঁরা কারা? এদের কাউকে ব্যাঙ্কার কেন, এমনকি শিল্পপতি বলেও তো মনে হল না?’ রাইনার বললে, চুপ কর দেখি (জাই রুহিগ)। তুমি কি মনে কর তোমাদের গোষ্ঠীবদ্ধ ঋণের পারিশ্রমিক নিয়ে আমাদের ব্যাঙ্ক চলে? ঘরভাড়া ওঠে না। এখানকার খরচা জান? যাদের দেখলে, তারা আমাদের প্রাইভেট ব্যাঙ্কের গণ্যমান্য মক্কেল। সোজা বাংলায় (এর সরাসরি জার্মান আছে – আউফ ডয়েচ গেজাগট) করপ্রদানের পরিমাণ কমানোর জন্য আমাদের সঙ্গে এখানে কারবার করে। অ্যাকাউন্ট খোলে। টাকা তোলে। জমা দেয়। তারাই আমাদের রুটি রুজির মালিক’। আমার প্রশ্ন তখনো ফুরোয়নি। আমি বললাম, রাইনার, এদের পোশাক-আশাক, এমনকি সম্পূর্ণ বেমানান স্পোর্টস জুতো দেখলে তো হাঘরে মনে হয়। এরা তোমাদের মূল্যবান মক্কেল? কী গুল দিচ্ছ?’ ... ...
মিষ্টিমহলের আনাচাকানাচে ঘোরাঘুরিতে একটা জিনিস মনে হয়েছে। প্রাচীন বাংলায় মিষ্টি বা মিষ্টান্নের প্রধান উপকরণ ছিল তিনটি। গুড়, দুধ আর ধান। গুড়ের সঙ্গেই ছিল শর্করা। মানে চিনি। এই চিনি কিন্তু এখনকার চিনির মতো নয়। তৈরি করাও বেশ শ্রমসাধ্য ছিল। দানা যুক্ত সার গুড় পাত্রে রেখে তার উপরে পাটা শ্যাওলা চাপা দেওয়া হত। সাত-আট দিনের মধ্যে চাপা দেওয়া গুড়ের উপরিভাগের কিছুটা অংশ চিনি হত। সেই চিনি তুলে নিয়ে বাকি গুড় আবার শ্যাওলা চাপা দিয়ে রাখতে হত। কয়েকদিন পরে বাকিটাও চিনি হত। এই চিনি শুধু খাওয়া হত। সেটাই ছিল মিষ্টি। নয়তো অন্য উপকরণ যোগে মিষ্টান্ন তৈরি হত। ... ...
বাবা হঠাৎ মারা গেলে কী হবে জানত না নবনীতা, কিন্তু মা-ও যে জানত না সেটা ও বুঝল পরে। কষ্টেসৃষ্টে সংসার চলত, কিন্তু চলত তো। মারা যাবার পর মা বলল, বাবার মরদেহ হাসপাতালে দান করা হবে, সেটাই বাবার ইচ্ছে ছিল। রাণীকুঠিতে কর্পোরেশনের ময়লা ফেলার ভ্যাটের পিছনে প্রায়-পড়া-যায়-না এরকম দেওয়াল লিখন একটা মাঝে-মাঝেই দেখেছে নবনীতা, সেখানেই একটা ফোন নম্বর দেখেছিল ও, মরণোত্তর দেহদানের জন্যে। নম্বরটা দেখে এসে সেখানে ফোন করল নবনীতা, এক ভদ্রলোক এসে দেখে গেলেন, তারপর ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে একজন ডাক্তার আর দলবল নিয়ে এসে নিয়ে গেলেন দেহটা। ওর ভয় ছিল ওরা হয়তো পয়সা-কড়ি চাইবে কিছু; চাইল না কিন্তু, একটা ছাপা কাগজে শুধু সই করাল মাকে দিয়ে। নবনীতাকে ওরা বলেওছিল ওদের সঙ্গে হাসপাতালে যেতে, ও যেতে চায়নি। ওদের মুখ দেখে মনে হল একটু অবাক হয়েছে ওরা, কিন্তু বলল না কিছু। সেদিনই সন্ধ্যেবেলা ওদের একজন এসে হাসপাতালের সার্টিফিকেট একখানা দিয়ে গেল, বলল, এটা দিয়ে কর্পোরেশন থেকে ডেথ-সার্টিফিকেট পাওয়া যাবে। তা ছাড়াও ব্যাঙ্কে, অফিসে, নানা জায়গায় কাজে লাগবে এটা, কাগজটা যেন হারিয়ে না ফেলে ওরা। ... ...
জামাই আয়েশ করে হেলান দিয়ে বসে বলে ‘যাক এলাকা থেকে প্রায় সবকটাকে ভাগানো গেছে। শয়তানের ছাওয়ালগুলো, পুড়িয়ে মারতে পারলে শান্তি হত!‘ প্রমদা ঠিক না খেয়াল করেই বলেন ‘হ্যাঁ যত গুন্ডা সব জেল থেকে ছেড়ে দিয়েছে মনে হয়।‘ জামাই উত্তেজিত হয়ে ওঠেন, ‘না না আপনি জানেন না বাবা এই শেখের ব্যাটারা শয়তানের ছাওয়াল সব, আমাদের কটা ছিঁচকে চোরের সাধ্য কি ওদের মত হিংস্র জানোয়ার হয়? দ্যাখেননি ওদের দেশে ওরা কী করছে? যাক দূর হয়ে যাক ওরা নিজেদের জায়গায়।‘ প্রমদা থতিয়ে যান – জামাইরা তো আজ পঁচিশ ত্রিশ বচ্ছর হাওড়াতেই থিতু, তাঁর জানা মতে ওদের তো কিছু ক্ষতি হয় নি! ... ...
স্বপ্নে যে মেয়েটিকে দেখেছিলাম লাইটহাউসের দিকে চলে যেতে ঘুম থেকে উঠে তাকে অনেকটা নীল মনে হল। ... ...
এবার পুজো ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পেয়েছে। মন্ডপরা পেয়েছে অনেক পুরষ্কার। কিন্তু পুজো মানে তো কেবল মন্ডপ বা প্রতিমা না। মানুষও। তাঁদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কে? কে পাচ্ছেন শারদ সম্মানের শিরোপা? জানতে হলে পড়তে থাকুন। একমাত্র গুরুচণ্ডালিতে। ... ...
শিখা পায়েসের বাটিটা নিয়ে ছাদে উঠল। দোতলা বাড়ির ছাদ। চিন্তিত মুখে এদিক ওদিক তাকিয়ে, একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে, একবার পাশের বাড়ির দিকে তাকিয়ে, সবদিক নজর করে শেষে পায়েসের বাটিটা সে ছাদের পাঁচিলে রাখল। তারপর গলার মঙ্গলসূত্রটা চেপে ধরে কি যেন ভাবা শুরু করল। পাশের বাড়ির ছাদে সপ্তর্ষি, বছর চোদ্দর ছেলে হবে, হাতে খাতা, মুখে পেন। খাতা উল্টেপাল্টে দেখছে আর পাশে বসে থাকা পায়রাটাকে কীসব পড়ে শোনাচ্ছে। ছেলেটি একঝলক শিখাকে দেখল, শিখা সেটা খেয়াল না করে তাড়াতাড়ি করে নিচে নেমে এল। ... ...
প্রায় এক হাজার বছর আগের বাংলা। ১০৭৫ খ্রিষ্টাব্দ, পাল রাজবংশের অন্ধকার যুগ চলছে। সিংহাসন নিয়ে ভাইয়ে ভাইয়ে লড়াই শুরু হয়েছে। সাম্রাজ্যের পরিধি ক্রমশই ক্ষুদ্র হচ্ছে। বাঙালীর গর্ব অতীশ দীপঙ্কর বিক্রমশিলা মহাবিহার ছেড়ে তিব্বতে চলে গেছেন প্রায় ত্রিশ বছর হলো। চারদিকে শুধুই অন্ধকার। তার মধ্যে একটি প্রদীপের দীপ্ত শিখার মতো জ্ঞানের আলো জ্বালিয়ে রেখেছেন চিকিৎসক চক্রপাণি দত্ত। প্রথম বিখ্যাত বাঙালি চিকিৎসক, যার রচিত পুস্তক এক হাজার বছর পরেও আজও সমস্ত ভারতবর্ষের আয়ূর্বেদিক কলেজগুলিতে পড়ানো হয়। সে দীপ শিখাও কি নিভে যাবে? ... ...
অথচ, চিনিনা তাকে হাতের আড়াল হলে নিভৃতচারিনী স্নেহ ছলে, আলো ছলে বারবার দেখি... বিষণ্ণ আদল মেয়ে স্তন পেতে বলি ' ক্ষুধা নিবি...' ... ...
প্রতিটি দিনই তো দেবীপক্ষ ভাবতে ভালো লাগে – কেবল সেই ভোরে ওঠা নিয়ে সূর্যের সাথে রাগারাগি না হয় মাথার কাছে বাজুক চেনা সুর আধোঘুমে গুন গুন নিবিড় হয়ে এসে বাড়ি ফেরার প্রতীক্ষা ... ...
ঘর বানানো বিষয়ক প্রস্তাবনা ঘর বানানোর জন্য প্রথমেই লাগবে একটুকরো জমি। আপনাকে দেখে নিতে হবে যে জমিটা যেন বৃষ্টিতে ভেসে না যায় এবং ডুবে না যায় বন্যায়। ফলে জমি বিষয়ক সাধারণ জ্ঞানের সাথে আপনার লাগবে প্রাকৃতিক কিছু প্রবৃত্তি। জমিটি নির্বাচিত হলেই আপনি তখন চারটি দেয়ালের কথা ভাববেন; এবং অতি অবশ্যই চার দেয়াল আপনি জমিনের ওপর স্থাপন করবেন না। ঝড়ো বাতাস আর প্রকৃতির বিভিন্ন গজব থেকে রক্ষার স্বার্থেই আপনি চারটি দেয়ালকে আসলে প্রোথিত করবেন মাটির ভেতরে। ঠিক গাছ যেভাবে নিজেকে রাখে। তবে আপনি কোনো শেকড়, কখনোই, স্থাপন করতে পারবেন না। ... ...