চন্দ্রোদয়। ছোটদের সামনেই বলতে হবে, বুঝলে? ওদের মনটা এখন জলের মত স্বচ্ছ, আমাদের এই স্বচ্ছ স্বর্গভূমির মতো। ভালো খারাপ চিনতে শিখুক, আদর্শ কাকে বলে সেটা বুঝতে শিখুক, ওরাই তো আমাদের নতুন স্বর্গভূমির ভবিষ্যৎ। সামনের নির্বাচন থেকে আমরা সব অবোধ শিশুকে ভোট দেবার অধিকার দেব, জান না? শিশুরাই ভোট দেবে এখন থেকে, বিধর্মী আর না-ধর্মীরা সব বাতিল। হুঁঃ, দেশছাড়া করে ছাড়ব সব কটাকে। (বলরামকে) কী বলরাম, সেই ধর্ষণের কেসটা... মেয়েটাকে যখন হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল এক্স-রে করবার জন্যে, তখন সেই অ্যাম্বুলেন্সকে তোমার ওই নম্বরহীন লরিটা দিয়ে ধাক্কা মারার ব্যবস্থা করনি তুমি? বলরাম। আমিই করেছিলুম গুরুজি। কিন্তু সে তো আপনার পরামর্শেই। ... ...
বনের ধারে রাখালি দোচালাখানি, বড় নিজের মনে হয় বুনোলতা, বুনোলতানো ফুল গাছ উঠে গেছে চালার উপরে নিদাঘের ভিতর এই ছায়াকুঞ্জ ... ...
রহমান ৩০ বছর ধরে কামারহাটিতে থাকে। আজ থেকে ২৩ বছর আগে রহমানের আব্বা,আফজল, সুস্থ মানুষ,হজ করতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাকে আর পাওয়া যায় নি। রহমানের মা সাকিরা আগে খুব কাঁদত। তারপর আল্লার কাছে দোয়া করত, জলজ্যান্ত লোকটাকে ফিরিয়ে দাও। তারপর শুধু চিৎকার করত। একদিন চুপ করে গেল। সারাদিন ধরে ঘরে বসে থাকত। কোনো সাড়াশব্দ নেই। তিনবার পানি খেতো, একবার ভাত। তার চোখে পানি নেই.. সব শুকিয়ে গেছে। রহমান বাসায় ফিরে এলে তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকত। লোকে বলে রহমানকে দেখতে তার হারিয়ে যাওয়া আব্বা আফজলের মতো। সেই রকম চোখ মুখ ভুরু। ... ...
ঘরের ভিতরের ছিটকিনি জোরে ঠ্যালা দিতেই একরাশ বাতাস আকুলি বিকুলি করে বেরিয়ে এলো আটকে থাকা বাতাস নাকি খবর দিতে চাওয়া? ... ...
আলমারিটা তোলার সময় সেরকম কোন তোড়ফোঁড় হয়নি। কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে নামানোর সময় আলমারির ধাক্কায় একতলার একটা দেওয়ালের গা থেকে কিছুটা সিমেন্টের চটা উঠে গেছিল। তবে ঠিক সেদিন ফাটলটা অবধেশদের চোখে পড়েনি। চোখে পড়লে দুচারটে খিস্তি অবশ্যই দিত মজুরগুলোকে। আগে খুব মুখ খারাপ করত অবধেশ। এখন ছেলে বড় হতে গালি দেবার অভ্যেসটা খানিক কমিয়েছে। ... ...
এরপর কথা শুরু হতে গিয়ে দাগের ওপর দিয়ে আবার চলাচল করল। সুকুমারকে পাটা মারতে দেখা যায়। সব ঠিকঠাক থাকে। খালি পাটার আওয়াজ হয় ধুপ ধুপ ধুপ ধুপ থ্যাস। আর কোদালের আওয়াজ হয় খ্যারর খ্যারর। কর্নিকের আওয়াজ থ্যাস থ্যাস থুপুস। সব আওয়াজ থেমে গেলে নিঃশব্দ হয়। চারদিক নিঃশব্দ না হলেও একটুখানি জায়গা যেখানে কাজকাম হচ্ছিল নিঃশব্দ হয়ে পড়ল তারপর সেটা হয়ে উঠল এমন এক নরম সরম জায়গা যেখানে খুব শিগ্গির শক্তপোক্ত এক আস্তরণ গড়ে উঠবে। সে রোদ আসুক আর না আসুক। দিনের শেষে বা রাতের শুরু আস্তে আস্তে নরম সরম জায়গার সিমেন্ট জমাট হয়ে যাবে। সেখানে তখন দাগের সম্ভবনা তৈরি করতে তিনটে কুকুর ঘোরাফেরা করতে করতে নানান দাগ সত্যিই তৈরি করছিল। সে সব ঘুরে ঘুরে নরম জায়গার আসপাশে তৈরি করা দাগেরা। ... ...
এখন আর ঘর ছেড়ে এদিক ওদিক যাবার দরকার পড়ে না। পুঁটি তবু ঘরে থাকে না, অনেকদিনের অভ্যেস। তাছাড়া যত বড় হচ্ছে ততই এ ঘর যেন তার কাছে খুবই ছোট হয়ে যাচ্ছে, স্বপ্নগুলো এ ঘরে আর খেলে না। জানলা দিয়ে আকাশ দেখা যায় না, বরং পিঙ্কিদের কোঠার পাঁচিল দেখা যায় । ভাইকে নিয়ে লালবাতির বাল্যশিক্ষা কেন্দ্রে দিয়ে আসে পুঁটি, আর নিজে চলে যায় মন্টুদাদের ক্লাবে। সেখানে পট্টির বাকি ছেলেরা থাকে, ক্যারাম পিটায়, বিড়ি-সিগারেট-গাঁজা ফোঁকে, কেউ কেউ মদও খায়। পুঁটির সেখানে কোনও কাজ নেই, তবুও সেখানেই যায়, অকাজের ছেলেদের এই একটা যাবার জায়গা আছে এখানে। ... ...
শৈশবের যে সময়কালের বিচ্ছিন্ন কিছু স্মৃতি কেবল মানুষের মনে থাকে ঐ বয়স থেকে বাহ্রামের কাছে ‘পরী’ একটা আকর্ষণীয় বিষয়। বাহ্রামের মা বলতেন, বাহ্রাম যখন সবে হাত বাড়াতে শিখেছে তখনই সে কোন পরীর ছবি দেখলে খটখটিয়ে হেসে উঠে হাত বাড়াতো। সে কথা সত্যি হোক বা না হোক জ্ঞান হবার পর থেকে পরীর ব্যাপারে বাহ্রামের আকর্ষণ বিন্দুমাত্র কমেনি, বরং দিনে দিনে তা একটু একটু করে বেড়েছে। ... ...
নানা পণ্ডিতের নানা মত, তাও মোটামুটিভাবে বহুজন গ্রাহ্য টাইম লাইনটা এরকম- কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ, যদি সত্যি ঘটে থাকে, মানে একটা বড় রকমের যুদ্ধ, তবে সেটি হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব নবম শতকে (কম বেশি একশো বছর)। এবং মহাভারতের আদি রচনাকাল শুরু হয় খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে। প্রথমে ছিল জয় নামে এক নেহাতই যুদ্ধ কাহিনী, পরে নানান ধর্ম ও উপনিষদের সংস্পর্শে এসে একটা মহাকাব্যের রূপ নেয় খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকের আগেই। এটি দ্বিতীয় পর্যায়, যেখানে যুদ্ধ বিবরণীর সাথে যোগ হয়েছিলো নানান উপকথার। প্রায় এক পুরাণের মতন। ... ...
যাতায়াত কম হয়ে গেলে রাস্তাগুলো পথ হারিয়ে ফেলে ঘাস জঙ্গলে অজানা সাপখোপ, ভয় বেড়ে ওঠে। ... ...
৩০০ বছরের মধ্যে শল্য চিকিৎসার ধারা আয়ুর্বেদের মূল ধারা থেকে হারিয়ে যায়। এ জ্ঞান কালের স্রোতে এবং ঐতিহাসিক ঘটনাক্রমে জমা হয়ে থাকে নাপিত, কুমোর বা কামার সহ অন্য বর্গের মানুষের মাঝে। ফ্রান্সিস জিমারম্যান তাঁর “Terminological Problems in the Process of Editing and Traslating Sanskrit Medical Texts” প্রবন্ধে বলছেন যে শুধু এটুকু আমাদের মাথায় রাখলে চলবেনা যে সুশ্রুত-সংহিতা এবং চরক-সংহিতা-র দৃঢ়বদ্ধ টেক্সট হিসেবে স্বীকৃতি পেতে ১০ থেকে ১৫ শতাব্দী লেগেছে এবং মধ্যযুগের বিভিন্ন ভাষ্য এতে যুক্ত হয়েছে, এর সাথে এটাও মাথায় রাখতে হবে এত দীর্ঘ সময়কালে সমষ্টিগত চিন্তার জগতে প্রচুর ভাঙ্গাচোরা এবং পরিবর্তন ঘটেছে। ... ...
রাস্তার ধারে ঝুপসি গাছপালাগুলো অব্দি কুয়াশার কম্বল মুড়ি দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। একটু বাতাস বইলে দেখায় বিশাল দৈত্যের মাথা নাড়ার মতো। ধোঁয়া-ওঠা বুক নিয়ে এলিয়ে পড়ে থাকা নদীর দিক থেকে কেমন একটা গোঁওওও শব্দ ভেসে আসে, যেন কেউ কাঁদে, কষ্টে গা মোচড়ায়, নিজের গলায় নিজের দশ আঙুল চেপে ধরে। তাতে গা শিরশির করলেও অষ্টমী ভালোই জানে আসল বিপদ লুকিয়ে আছে পেছন বাগে। সে বিপদ যে কখন বিদ্যুতের মতো ঘাড়ের ওপর অব্যর্থ লাফিয়ে পড়বে কেউ জানে না। সে এক আশ্চর্য হলদে আগুনের শিখা, তাকে দেখার আগেই নিজের কানেই শুনতে পাবে নিজের ঘেঁটি ভাঙার মট মট শব্দ, আর কিছু বোঝার আগেই এতো আলহাদের শরীরখানা তেনার কষে ঝুলতে থাকবে। যেন তুমি আর মানুষ নও হে, দাঁত বার করা মরা বেড়াল একটা। শিউরে উঠে অষ্টমী তার কালো ফাটা হাতখানি কোঁকড়া চুলে ঢাকা ঘাড়ের ওপর আলগোছে বুলিয়ে নেয়। রক্ষে কর সোনার বন্ন বনবিবি, মা আমার! ভয় তাকে পেড়ে ফেলে, হঠাৎ এমন কাঁপুনি দেয় যে শরীরের সমস্ত রোঁয়া খাড়া দাঁড়িয়ে ওঠে। ... ...
চেম্বারটির সাথেই একটা জানালা ছিল, সে জানালাটা ধরে দাঁড়িয়ে ছিল মোরসালিন। শম্পা চলে যাওয়ার পর ফাইলগুলো নিয়ে বসেছিল, এর মধ্যে তো একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল, একটি বিশাল বিজনেস প্লান, কোম্পানির এই শাখা অফিসটার চেহারা একাই বদলে দেয়ার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু কিছুদূর যেয়ে মাথাটা গুলিয়ে গিয়েছিল! এত দিন ধরে মেহনত করেছে যার জন্য, যার পুরো রূপরেখাটা তার দেয়া, সেই কাঠামোটাই যেন খুব অচেনা লেগেছিল, আর মাথাটা ঘুরতে শুরু করেছিল। জানালাটার বাইরে তখন চলচ্চিত্রের রিলের মত ছুটে চলেছিল মানুষ, যানবাহন। এমনকি একটা নেড়ি কুকুরকেও রুদ্ধশ্বাসে দৌড়ুতে দেখা গেল, কি এক গুরুত্বপূর্ণ মিশনে রয়েছে যেন সে, কিসের যেন এক তাড়া! এমনই এক তীব্র চলার স্রোত জানালার নীচের রাস্তাটিতে যে মনে হয়, জড় দোকানপাট ও বিপনিবিতানগুলোরও চাকা গজিয়েছে! ... ...
৫ বছরের ছেলে হারিয়ে গেছিল হালদার বাড়ির। সবে রমতা সাধু ডেরা পেয়েছি শিব মন্দিরের ধারে তখন। রাম জানে ক মুহূর্ত নাকি ক মাস। ও বাড়ির উঠোনে আমাকে তুলে নিয়ে গিয়ে হালদার বাড়ির ছ'ভাই ছেলে ধরা ভেবে বিড়াল যেভাবে ইঁদুর ঝাঁকায় সেই ভাবে ঝাঁকাতে আমার ল্যাঙট থেকে দুটো বেলফুল পড়লো ভুঁয়ে। কষ থেকে রক্ত পড়ছে দরদর করে। মনটা আলাদা করে ফেলার চেষ্টা করছি শরীর থেকে। শুনেছি ব্যথা টের পাওয়া যায়না। কখনো কামড়ে ধরছি নিজের ঠোঁট। কোন জন্মে যেন পড়েছিলাম ব্যথার গেট থিওরি। জ্বলন্ত বাম কপালে লাগালে সুপারফিসিয়াল ব্যথার চোটে দপদপানি গভীর ব্যথা ফটক দিয়ে ঢোকার সুযোগ পায়না। ... ...
তবে এই সহজ ব্যাপারটাও কিন্তু সহজে রপ্ত হয়নি নিশিগন্ধার। সে এরমধ্যেই অনেক রঙ ঢঙ দেখিয়ে ফেলেছে। সেটা কিরকম? সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে লেখা বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণে যেমন লেখা থাকে স্মোকিং ইঞ্জুরিয়াস টু হেলথ তা সত্ত্বেও লোকে ফকফক করে সিগারেট খায় তেমনি রগচটা সুদীপের সঙ্গে সে একটু বেশি মাখামাখি করতে গেছে। তর্ক ঝগড়াও করতে গেছে। ভেবেছে এরপর ভাব হলে খুব মজা হবে। তা তো হয়ই নি। উলটে শঙ্কর মাছের লেজ উঠে এসেছে দীঘার সমুদ্র থেকে। ... ...
সর্বশেষ প্রশ্নপত্রটা বিলি করার পর পরীক্ষক যখন হলটির ডায়াসে এসে পৌঁছুলেন, চোখ পড়া মাত্রই দৌড়ে গেলেন দীপের দিকে, আর হাত থেকে বইটা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে সেখানে একটা প্রশ্নপত্র গুঁজে দিলেন। খাতা আগে থেকেই রাখা ছিল, সামনের পকেটটা অনেকক্ষণ ধরে কামড়ে থাকা জ্যামিতি বক্সটা কোনমতে বের করে দীপ তার জন্য নির্ধারিত আসনে সটান বসে পড়ল। হাঁটতে হাঁটতেই এক ঝলক দেখে নিয়েছিল, এখন পুরো প্রশ্নপত্রটা দেখে তো সে আনন্দে আটখানা হয়ে উঠলো। শতভাগ কমন! এমনকি ‘অথবা’ দেয়া বিকল্প প্রশ্নগুলোও তার ঝাড়া মুখস্ত। কোনটা রাখবে, আর কোনটা ছাড়বে, এ নিয়ে বেশ কিছুটা সময় ভাবলো সে। পরে জ্যামিতি বক্সটা খুলে যুৎসই একটি কলম বেছে নিয়ে লিখতে শুরু করলো। ... ...