মাঠে মাঠে সরষের ফুল এসেচে। উঁচু,নিচু টিলা জমি। সব ইখন হলুদ। ইখন তো ফুলেরই পরব। সরু লিকলিকে আলপথ ধরে হেঁটে হেঁটে মেলা দিখতে যাচ্ছে বুড়ো,বুড়ি,ছেলে-ছুকরা। কেউ কেউ লাল মোরাম রাস্তা ধরে ক্রিং ক্রিং বেল বাজিয়ে সাইকেল চালিয়ে ছুটচে। বনের পাশেই ডাঙা টিলা মাঠ,উখানেই মেলা বসেছে। মনোহারি জিনিসের দুকান,বাচ্চাদের বাঁশি,ডুগডুগি খেলনা। কত রকমের খাবার দাবার,তেলে ভাঁজা,ঝিলাপি। কুথাও বা গাছের তলায় মাটির হাঁড়ি-কুড়ি বিচছে। এক জায়গায় সাইকেল,পিক-আপ ভ্যান দাঁড় করানো সারি সারি। ইকটো সাঁওতাল বুড়হা ঘুরে ঘুরে আড়বাঁশি বিচছে। লিজেই সুর তুলচে মন গেলে। লাল ধুলো উড়ছে আকাশে। সেই ধুলো মেখেই মেয়ে মরদ হাত ধরাধরি করে ঘুরছে। আশপাশের সব গিরাম থিকেই ভিড় জমিয়েছে। শুধু কি সাঁওতাল? বাবুরাও মজা লুটতে আইচে। ... ...
অজিত রায় দেখছেন কীভাবে ভদ্দরলোকের ভাষা আসলে ক্ষমতার ভাষা, এবং তারাই স্ল্যাংকে ছোটলোকের ভাষা বলে মুটেমজুর কুলিকামিন ,চাষি জেলে ও বেশ্যাদের মুখের ভাষাকে অপাংক্তেয় করে দেয়। দাগিয়ে দেয় নিকৃষ্ট, অপকৃষ্ট, ইতরদের ভাষা বা ছোটলোকদের ভাষা বলে। আমরা জানি, পাওলো ফ্রেরি তাঁর ‘পেডাগজি অফ অপ্রেসড্’ এ দেখিয়েছেন কীভাবে অভিজাতকুলের ভাষা আসলে ক্ষমতাকে ধরে রাখার হাতিয়ার হয় এবং বঞ্চিতেরা ভাষা নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগে, ভুগতে বাধ্য করা হয়। ... ...
টকে তরিবত বলতে শেষে একটু ভাজা মশলার গুঁড়ো দেওয়া যায়। আর কাঁচা তেল ছড়িয়ে নামানো হয়। আসলে মাছ কাটার সময়ে বলে দিতে হয়, ক’পিস হবে। তোর বাবা বাজার এনেই খালাস। কিছু দেখে না। তুই শিখে নে। আস্তে আস্তে চেষ্টা করতে করতে দেখবি হেঁশেলের কন্ট্রোল হাতে চলে এসেছে। আর এখানেও অনেক লোক তো। বড় পিস করে ভাপা করা মুশকিল। তাই এখানেও ছোট পিস কাটা হয়। তবে আমি তোর সঙ্গে একমত। ইলিশ না খেলে না খাব। একদিন খাব তো বড় টুকরো খাব। ... ...
‘মা দেখো বুকাই আবার বেডকভার চাপা দিয়েছে’ চেঁচিয়ে, ন্যায়বিচারের অপেক্ষায় না থেকে চাদর কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করত। পুকাই চিরকালই অস্বস্তিজনকরকম নর্ম্যাল। পরিবেশপরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সাজপোশাকে বিশ্বাসী। শীতে বেশি, গরমে কম, সমুদ্রস্নানে আরও কম। কালই দেখলাম, কার্লসবাড বিচে সপরিবারে উল্লসিত স্নানের ছবি আপলোড করেছে, বিকিনিপরিহিত। না, ফেসবুকে নিজের নামে নেই আমি। ফেক থেকে দেখেছি। ... ...
কোলকাতা বইমেলার আয়োজক পাবলিশার্স ও বুকসেলার্স গিল্ড এর মুখপত্র ‘পুস্তক মেলা’য় প্রকাশিত এই লেখাটিকে লোপাট করা হয়েছিল।পৃষ্ঠা কেটে সেখানে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল অন্য বইয়ের সমালোচনা।‘পুস্তক মেলা’য় একই সংখ্যার (ষষ্ঠ বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, বৈশাখ – আষাঢ় ১৪০৯ ) দুটি কপিই আমাদের হাতে আছে ঐতিহাসিক প্রমাণ হিসাবে। – তুষার ভট্টাচার্য সম্পাদিত ‘অপ্রকাশিত মরিচঝাঁপি’ থেকে। ... ...
ফিরে এসে দেখি আমার থার্মোডিনামিক্স, মেশিন ডিজাইন আর ফ্লুইড মেকানিক্স বই তিনখানা বেচুরা বেচে দিয়েছে। দরজা খুলে রেখে যাওয়াই আমার ভুল হয়েছিল। তিন তলায় বেচুর ঘরে গিয়ে দেখি বই বেচার পয়সায় জমিয়ে মেহফিল বসেছে। যেতেই সবাই হই হই করে ওঠে এসো এসো এসো। বেচু বলে থার্মোডিনামিক্স বইটা বেঁচে গেছে, নিয়ে যাবি? আমাদের এই তিনতলা হোস্টেলে সবকটা ছেলে জাতে মাতাল হলেও তালে আল্লারাখা, সুপার অব্দি। মাথা গরম করলে ফাঁকতালে মালটাও ফসকে যেতে পারে, তাই ওদের সঙ্গেই বসে যাই। ... ...
- কী হয়েছে? তোমরা কোনটা করতে পারনি? - সব পেরেছি মেডাম, কিচ্ছু ছাড়িনি। - তাহলে? ভাইভা কেমন হয়েছে? কে ভাইভা ধরেছেন, কোনো ম্যাডাম নাকি স্যার? - একজন স্যার, একজন মেডাম – দু’জন মিলে ভাগ করে। - যিনি ভাইভা ধরছিলেন, তিনি ঐ কলেজের ইন্টারনাল নাকি এক্সটার্নাল, সেটা জেনেছ? - সেটা জানি না মেডাম, বুঝতে পারিনি। - কী জিজ্ঞেস করেছিলেন? তোমরা কি ভালো করে উত্তর দিতে পারনি? মুখগুলো কেমন ভারভার ঠেকছে। (এবার সমস্বরে) - উত্তর কী দেব মেডাম? দু’জনের কেউ তো ভূগোলের প্রশ্ন তেমন করলেনই না। - সে কী! তাহলে কী ভাইভা হল? ... ...
বগটুই গণহত্যাকাণ্ডের অব্যবহিত পরে কবি জয় গোস্বামীর লেখা কবিতা নিয়ে ‘দগ্ধ’ নামে একটি পুস্তিকা আমরা প্রকাশ করেছিলাম। বগটুই এবং তার পরবর্তীকালে আরও কয়েকটি নারীনির্যাতন, ধর্ষণ এবং হত্যার প্রতিক্রিয়ায় জয় গোস্বামী আরও কিছু কবিতা লিখেছিলেন। সেই সবকটি লেখা নিয়ে আমরা প্রকাশ করতে চলেছি আরেকটি বই – ‘নিজের বিরুদ্ধে’। পার্টি-প্রশাসন-পুলিশের হাতে আক্রান্ত অসহায় নির্যাতিতা এবং তার পরিজনদের দুরবস্থার এক দলিল হয়ে থাকবে এই কবিতাগুলি। এই লেখাগুলির প্রেক্ষিত সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা হলেও, পরিসর আরও ব্যাপ্ত। যে শাসনকাঠামোয় আমরা জীবন কাটাচ্ছি, তার সুযোগ-সুবিধাগুলি নিয়ে দুধেভাতে সংসার প্রতিপালন করছি, সেই কাঠামোর নৃশংসতা নিশ্চিতভাবে আমাদের নিজেদের দিকেও আঙুল তুলে দেয়- এই উপলব্ধির আয়না আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন কবি। ... ...
আমি অবাক হয়ে আম্মার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম, কুড়ি টাকা! মাত্র কুড়ি টাকা দিয়ে আম্মা কী বলছে এসব! একটা পিস্তলের দাম ৮ টাকা, ১ টাকা করে বারুদ। একটা বাঁশি দুই টাকা, একটা প্লাস্টিকের চশমা ৫ টাকা। তারপর? ট্রলারখান কেনা হবে না! সে ভারি দাম, অতি দরাদরি করলেও ১৮ টাকার নিচে কুলাবে না। কিন্তু বাদবাকি জিনিস কেনার পর আমার হাতে থাকবে সাকুল্যে ৪ টাকা! তাহলে? তাহলে কী, সব বাদ দিয়ে শুধু ট্রলারখান কিনে ফেলব? ... ...
আমার অনেক ইদ ছিল। কৈশোর থেকে যৌবন। সেই বৃত্তান্ত যদি বলি, বলতে হয় আমার ইদ হারিয়ে যাবার বৃত্তান্তও। দুটোরই বড় অবশ্যম্ভাবী আগমন জীবনে। তারও আগে যে সত্য স্বীকার্য – একটা বয়সে যে উৎসবে নতুন জামা জুতোর রং, নির্ঘুম অপেক্ষা, বালিশের নিচে জুতো নিয়ে ঘুমানো আর রান্নাঘরে মায়েদের রাতভর সেমাই পিঠা – তাই ইদ, তাই উৎসব। এই রাতজাগা আনন্দে যতদিন ঘুম টুটে টুটে যায়, ততদিন উৎসব রঙিন। ... ...
স্পষ্ট সূর্যের আলোয় আবার বেরিয়ে আসার পরে, শিকারের সন্ধানে আরও খানিকটা হাঁটলাম। এই সময়ে দেখলাম, এমটাম্বু উপত্যকার বাঁদিক ঘেঁষা এই জঙ্গলে একটা বিশাল, লালচে রঙের, অতি ভয়ঙ্কর দাঁতওলা বুনো শুয়োর চড়ে বেড়াচ্ছে। কালুলুকে একটি গাছের আড়ালে মাটিতে শুয়ে থাকতে বললাম, আর আমার সোলার হ্যাট-টা কাছের আরেকটা গাছের পিছনে রেখে দিলাম... ... ...
তা এই নাটক নিয়ে লেগে গেল গণ্ডগোল। তখন সিপিএমের পরিচালন সমিতি পরাজিত। কংগ্রেস ও আর এস এস জোট জিতেছে। স্কুল চালান কার্যত আর এস এস নেতা জগজ্জ্যোতি মিত্র। তিনি ১৯৮৩তেই পুরস্কার হিসেবে বাছাই করতেন-- 'তাজমহল কি হিন্দু মন্দির' গোছের বই। বাংলায় প্রথম হলে এই বই বাঁধা পুরস্কার। তা জগজ্জ্যোতি বাবু বললেন এই নাটক রাষ্ট্রবিরোধী। করা যাবে না। সৌম্য সৌমেন ওরা কংগ্রেসি পরিবারের ছেলে। ওঁরা জেদ ধরল, এই নাটকই হবে। নাটকটা খারাপ কিনা বলুন। সৌমেন সৌম্য দুজনের বাবাই পরিচালন সমিতির সদস্য। তাঁরা পড়লেন ফাঁপড়ে। ছেলে বড় না কমিটি? শেষে প্রধান শিক্ষক অমলেন্দু চক্রবর্তী আসরে নামলেন। বললেন, নাটক হবে। তবে কিছু অংশ বাদ দিতে হবে। উনি বললেন, তুই এইগুলো কেটে দে। অমলেন্দুবাবুর বাংলা ক্লাস আমরা দুই পিরিয়ড ধরে করতাম। ছুটি হয়ে গেছে কখন। আমরা উঠছি না। উনিও থামতেন না। আমি বললাম, স্যার, আপনি কেটে দিন। বললেন, কী সমস্যায় ফেললি। ... ...
একটু বেলা পড়ার দিকে পদ্মপাতায় খাবার সময় ও জোরে জোরে নাক টানত, আর বলত, আঃ! কী সুন্দর গন্ধ গো বাবা! যেন ভোজ খাচ্ছি। অথচ গাছ কীই বা রাঁধতো তার পাতায়? আওতার গাছ, যতটুকু রোদ-জল রুক্ষ মাটি থেকে টেনে নিতে পারে, তা বইতো নয়? সেই তো শাক ডাঁটা, বিড়ির ডাল। বড্ড জোর চুনোমাছের চটচটে করে ঝাল। কোথাও জল ছিঁচে, নাহলে জাল টেনে ধরা। বিক্কিরি করার পর বাকিটা রান্না। বড্ড ভালো রান্না করতো। পদ্মপাতায় খেলে মনে হবেই ভোজবাড়িতে খাচ্ছো। ও আঙুল চেটে চেটে খেতো। পাত আঙুলের ডগায় পরিষ্কার হয়ে যেত। ওর খাওয়া দেখে ওরা দুজনে কী খুশিই না হতো! হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে থাকত ওর দিকে। তারপর তিনজনে একসঙ্গে হেসে উঠত। বড় সুন্দর ছিলো সেসব দিন। ... ...