বাবার গাল শক্ত হলেই আমি সাধারণত দৌড় দিতাম। আজ অসতর্ক। পেয়েছে। কিন্তু চড় খেয়েই সজাগ হয়ে, দে দৌড় দে দৌড়। ৫০০ মিটার দৌড়ে এসে ধরেছে। ধরেই গলায় পা, তোকে আজ মেরেই ফেলবো। আমি কাঁদছিও না, ছাড়তেও বলছি না। চুপ করে শুয়ে আছি। এদিকে পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। আমি ক্লাসের ফার্স্ট বয়। কোনোদিন স্কুল কামাই করি না। পরীক্ষা দিচ্ছি না। মোবাইল না থাকলেও সেযুগেও খবর বাতাসের চেয়ে দ্রুত ছড়াত। খবর পেয়ে হেডমাস্টার মশাই এসে গেলেন। বাবা ছাড়বেন না, ওর খুব অহঙ্কার। আমি চাই ফেল করুক। আমি ওর মধ্যেই বলছি, ইতিহাসে আমি কোনোদিন ফেল করবো না। বাবা বললেন, তোকে যেতেই দেবো না। এদিকে অন্য শিক্ষকরাও হাজির। আধঘন্টা পর হলে গেলাম পরীক্ষা দিতে। ধুলোটুলো ঝেড়ে। স্যাররাই কেউ কলম এনে দিলেন। এই বাবার মতো অসাধারণ মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। ... ...
যতদূর শুনেছি গলা (গোলাস) খোলার অধিকার বা বাক স্বাধীনতার নাম গ্লাসনস্ত এবং পুনর্গঠন বা পুনর্নির্মাণের নাম পেরিসত্রইকা। অভিপ্রায় নিঃসন্দেহে ছিল সাধু – কেন্দ্রীয় নির্দেশ দ্বারা ব্যক্তিকে উপেক্ষা করে সমষ্টির শুভ সাধনা করার যে আপাত প্রয়াস চলে এসেছিল স্তালিনের সময় থেকে, সেটির ব্যর্থতা স্বীকার করলেন গরবাচভ। লক্ষ্য – এক স্বচ্ছ সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলে দেশের নবনির্মাণ ব্রতে ঝাঁপিয়ে পড়া। এবার ব্যক্তি তার মত প্রকাশের অধিকার পেল। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ, মতান্তরে কেজিবি নিরুদ্দেশ। অন্ধের নগরী, চৌপট রাজা। বাজার থেকে অদৃশ্য হল খাবার। ১৯৯০-এর আগে লাইন দিলে কিছু জুটত। যদিও মস্কোর বাজারে একটা রসিকতা চালু ছিল – কোথাও লাইন দেখলেই মানুষ দাঁড়িয়ে পড়তেন, পরে জানতে চাইতেন এটা কিসের লাইন। জনজীবন বিপর্যস্ত, তার কিছুটা আগেই দেখেছি সেন্ট পিটার্সবুর্গে। ... ...
আমার ভাবনা ছোটো চাষীদের নিয়ে। একদিক থেকে দেখলে তাদের এখনো কিছু স্বাধীনতা আছে জানো। তারা চাষবাস এখনো অনেকটা বৈচিত্র্যময়। ফসলচক্র মেনে চলে মোটামুটি। সার বিষের ব্যবহার খুব কম করে। এরকম চাষীর সংখ্যা অবশ্য কম। অনেকেই বাজারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ধীরে ধীরে কৃষি পাঠশালায় ডেকে এনে সকলে মিলে বুঝতে চাইছি যে সার বিষ ছাড়া চাষ সম্ভব। তাতে খাবার খরচ, স্বাস্থ্য খাতে খরচ অনেক কমে যাবে। চাষীরা অনেকটাই বোঝেন। সমস্যা তাদের অন্য জায়গায়। তাদের একটু আর্থিক সুরক্ষা প্রয়োজন কারণ মাটির স্বাস্থ্য খারাপ হলে ঠিক হতে সময় লাগে। সেসময় ফলনে সমস্যা হতে পারে। রোজগার কমে যাবে। সেই সময়টুকু তাদেরকে কে সাহায্য করবে? পুরো বাজারটাই তো উৎপাদক বিরোধী। ... ...
অনেক দিন পর কবিতা বেরোল হাত থেকে। বেশ কয়েকবার কবিতাটা পড়ে কাজি নিজে। বেশ হয়েছে, ভালই হয়েছে!– নিজের মনেই বলে কাজি, তারপর ব্যাগ থেকে বের করে একটা লুঙ্গি। মাথা দিয়ে গলিয়ে দেয় লুঙ্গিটা, এবার জামাকাপড় বদলিয়ে পুকুরে নামবে সে। এমন সময় দ্রুতপদে দেখা যায় দুলিকে, সে আসছে পুকুরের দিকেই, নিশ্চয়ই তাকেই ডাকতে আসছে। একটু অপেক্ষা করে কাজি, দুলি এসে পৌঁছোয়, তাড়াতাড়ি আসায় একটু জোরে জোরে শ্বাস টানছে সে। কাজি বলে, আমি একটা ডুব দিয়ে আসি, তু্মি ততক্ষণ পড় এই কবিতাটা, খাতাটা দেয় দুলির হাতে। ... ...
দু’দিকে দুটো লোক – সামনে আর পিছনে দুটো হ্যাজাক ধরে আছে। মালকোঁচা মেরে পরা ধুতি বা গামছা, প্রায় আধ-ন্যাংটা কালোকোলো সন্ন্যাসীরা পরস্পরের এক হাত আর তাদের হাতের দণ্ড ধরে অর্ধ গোলাকৃতি একটা বেড় তৈরি করেছে। নাচছে ভূতের মত। মাঝে মাঝে – বল গঙ্গাধরের চরণের সেবা লাগি, বল তারকনাথের চরণের সেবা লাগি মহাদেব – ইত্যাদি শিবের নানান নাম করে টেনে টেনে বলে চলেছে। যেটা সবচে’ আশ্চর্য লাগে, তা সন্ন্যাসীদের অমন গলা ছেড়ে মহাদেব – ডাকও নয়, ছায়া-ছায়া ভূতুড়ে নাচও নয়। আশ্চর্য হল – সেই বেড়ের মাঝখানে আমাদের ক্ষুদিরাম মাস্টারমশাই যে! এবং তিনি নাচছেন! এগিয়ে – পিছিয়ে। তিনি তাড়াতাড়ি সামনে এগিয়ে পথ শেষ করতে চাইছেন, কিন্তু সেই উপবাসী, আধন্যাংটা সন্ন্যাসীরা – কোথা থেকে এত জোস পেল কে জানে, তারা কিছুতেই এগোতে দিতে চায় না। সামান্য পথ আসতেও তাই দীর্ঘ সময় লাগে। রাগী, ছাত্র-পেটানো অথচ ছাত্র-দরদী, স্নেহ বৎসল মাস্টারমশাই-এর সব গাম্ভীর্য ওই গাজনের সন্ন্যাসীরা ঘুচিয়ে দিয়েছে। ধুলো হয়ে উড়ছে হ্যাজাকের আলোয় – তাঁরই অটল গম্ভীর মুখোশখানা। ... ...
সৌম্য বলল, “ওয়েট ওয়েট। একটু ধৈর্য ধরুন। বলছি। তবে তার আগে বলি, আমন মানে হল শান্তি। তুহিন ওর ধাঁধায় আমাদের বলেছে যে যদি কখনো তদন্তের প্রয়োজন পড়ে তাহলে আমরা যেন আমনকে খুঁজি। খুঁজব কোথায়? সেটারও ক্লু ও দিয়ে রেখেছিল। বলেছিল জীবনে শান্তি খুঁজতে। আনন্দ শর্মা ওরফে আমন উঠেছিল জীবন লজেই। তুহিনের কোনও কারণে মনে হয়েছিল যে আমাদের হয়তো যখন তদন্তের প্রয়োজন হবে তখন আমাদের ক্লু দিতে ও আর এই পৃথিবীতে থাকবে না। কিন্তু ও সেই ব্যাপারে সিওর ছিল না। তাই পৃথাকে সব কিছু খুলে বলে নি ওকে মিছিমিছি চিন্তায় ফেলবে না বলে। কিন্তু ও যদি নিজের বিপদ বুঝেই ছিল তাহলে জীবন লজে গেল কেন?” ... ...
মনে করুন, বিমলা দেবী নামে ২১ বছর বয়সী এক মহিলা আছে। যিনি পাঁচ মাস ধরে অন্তঃসত্ত্বা। তাঁকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর পরিবারের সদস্যরা কোনো এক আত্মীয়ের বাড়ি যাচ্ছেন। যাওয়ার জন্য সবাই একটা ট্রাকে উঠেছেন। হঠাৎ একদল লোক গাড়িটিকে থামাল। গাড়ির মধ্যে থাকা সকল পুরুষ সদস্যকে খুন করা হল! বিমলা দেবীর চোখের সামনে তাঁর তিন বছরের কন্যাকেও রাস্তায় নামিয়ে নৃশংসভাবে খতম করা হল! একে একে গণধর্ষণ করল বিমলা দেবীকে! অবশেষে তারা বিমলা দেবীর নগ্ন শরীরটিকে ফেলে রেখে চলে গেল! ... ...
এরপর তাড়াতাড়ি বারবেলা আসার অদম্য ইচ্ছে নিয়ে আমি ঢুকে পড়লাম স্কুলের গণ্ডিতে। ঊষাদি, মঞ্জুদি, অশোকাদি, আল্পনা-আপা, নুরজাহান-আপা – যত না পড়া ধরে, তারচেয়ে বেশি গল্প করে। কার বাসা গতবছরের বন্যায় ডুবে গিয়েছিল, কে যুদ্ধের বছরে শরণার্থী হয়ে ক্যাম্পে গিয়েছিল, কার বাড়ির আতা গাছে ফল ধরেছে — সে সব গল্পে গল্পে যতটুকু পড়া বাদ পড়ে, তার সবটুকুই ষোলোআনায় পুষিয়ে দেয় দীপঙ্কর স্যার। কড়া ধাঁচের ছোটখাটো মানুষটি শুধু স্কুলে পড়িয়েই ক্ষান্ত হয় না, প্রতিদিন বিকেলে বাসাতেও যায় আমাকে পড়াতে। কিন্তু আজ বিকেলে আমি কী ভাবে দীপঙ্কর স্যারের কাছে পড়ব? আমি মনে মনে পণ করে ফেলি, স্যার যতই বকা দিক, আজ আমি ছুটি নেবই নেব। ... ...
এখানে বা কলকাতায় সরভাজা, সরপুরিয়া পাওয়া যায় না? আমি খেতাম তবে। - এখানে না, তবে কলকাতায় পাওয়া যায়। উত্তর কলকাতার বিখ্যাত দোকান নদীয়া সুইটস, আমার মায়ের হট ফেভারিট। সেখানে পাওয়া যায়। - ও, তাহলে তো কলকাতাতেই খেয়ে নেব। কৃষ্ণনগর যেতে হবে না। - আরে পাগলি, এক এক জায়গার এক এক স্পেশালিটি। অধর দাসের সরপুরিয়ার সোয়াদ কোনোদিনই অন্য দোকানে পাওয়া যাবে না। - কেন পাওয়া যাবে না? একই তো মিষ্টি। - না রে বাবু। কোনো জায়গার মিষ্টি সোয়াশ’ বছর ধরে জনপ্রিয় – এ কি কখনও এমনি এমনি হয়? আমরা তো সার্ভের কাজে গিয়েছিলাম। তখন এই দোকানের বিষয়ে অনেক কাহিনী শুনেছিলাম। এই দোকানটা উত্তম-সুচিত্রার সবার উপরে সিনেমাতেও আছে। - তাহলে তো ঐতিহাসিক দোকান বলা যায়। মিষ্টিটা কেমন খেতে? কী দিয়ে তৈরি? কীভাবে বানানো হয়? ... ...
যদি তাঁর চরিত্রের ধর্মীয় দিকটি বিবেচনা না করি, ডাঃ লিভিংস্টোনকে জানা সম্পূর্ণ হবে না। তাঁর ধর্ম তাত্ত্বিক ধর্ম নয়, বরং এ এক ধ্রুব, অকপট, আন্তরিক অনুশীলন। কাউকে দেখানোর জন্যও না, উচ্চকিতও না, শান্ত, ব্যবহারিক জীবনে এই সদাজাগ্রত বোধের প্রকাশ। একেবারেই আক্রমণাত্মক নয়। এই বিষয়টা কখনও কখনও বিরক্তিকরও বটে, যদি অপ্রাসঙ্গিক না হয়। তাঁর মধ্যে ধর্মের মাধুর্য বিরাজমান; কেবল ভৃত্যদের সঙ্গে তাঁর ব্যবহারই না, স্থানীয় গোঁড়া মুসলমান বাসিন্দাদের প্রতি, তাঁর সংসর্গে আসা সকল মানুষের প্রতি আচরণেই তাঁর ধর্মভাবের প্রকাশ। তীব্র মেজাজ, উদ্যম, প্রাণবন্ত স্বভাব আর সাহসের অধিকারী লিভিংস্টোন এটা ছাড়া অবশ্যই নিঃসঙ্গ, কঠোর প্রভু হয়ে উঠতেন। ধর্ম তাঁকে পোষ মানিয়েছে, তাঁকে একজন খ্রিস্টান ভদ্রলোক বানিয়েছে: অমার্জিত, একগুঁয়েমিকে পরিমার্জিত, অবদমিত করেছে; ধর্মের প্রভাবেই তিনি হয়ে উঠেছেন একজন অতি কাম্য সঙ্গী ও অতি-প্রশ্রয়দাতা প্রভু - এমন একজন মানুষ হয়েছে যাঁর সঙ্গ বেশ ভাল মাত্রায় উপভোগ্য। ... ...
ফিল্ম আর্কাইভের প্রতিশ্রুতি থাকতো প্রত্যেক বুধবার করে। প্রত্যেক বুধবার সন্ধ্যা ছ-টায় দেখানো হত ওয়ার্ল্ড ক্লাসিক, নন্দন তিন-এ। তবে সব বুধবার হত না। আর্কাইভের একটা ফোন নম্বর জোগাড় করেছিলাম আমরা। বুধবার শো-য়ের ঘণ্টা তিনেক আগে ফোন করে কি ছবি এবং তার থেকেও বড় হল আজ দেখানো হবে কিনা সেটা নিশ্চিত করে নেওয়া হত। ৯৮-৯৯ সাল ও শূন্য দশকের শুরুর দিকে নন্দনের অধিকর্তা ছিলেন অংশু শূর। কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসব, সিনে সেন্ট্রাল, আইজেন্সটাইন সিনে ক্লাব, আর্কাইভের শো ও আরো অনেক ফিল্ম সোসাইটি - এসব মিলিয়েও আমরা পরিমিত আহার পাচ্ছি না মনে করেই সম্ভবত নন্দনে শুরু হল মাসিক রেট্রোস্পেক্টিভ! নন্দনের অধিকর্তা বদলে গিয়ে তখন নীলাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়। প্রত্যেক মাসে না হলেও মোটামুটি নিয়মিতভাবেই মাসের শেষে নির্দিষ্ট পরিচালকের এক-গুচ্ছ ছবি দেখানো হত। নন্দনের মূল গেট দিয়ে ঢোকার আগে বাঁ-দিকের কাঁচের শোকেসে নতুবা ডান দিকে দাঁড় করানো স্ট্যান্ডে আটকানো থাকতো এই কর্মসূচির কাগজ। ছবিগুলি দেখানো হবে নন্দন দুই-এ। যারা দেখতে ইচ্ছুক তাদের উদ্দেশ্যে নির্দেশ থাকত নন্দনের লাইব্রেরি থেকে বিনি পয়সার পাস জোগাড় করে নেওয়ার! প্রথম রেট্রোস্পেক্টিভ দেখানো হয় অ্যালফ্রেড হিচককের (১৮৯৯-১৯৮০)! চারটি ছবির কথা পরিষ্কার মনে আছে, 'রোপ'(১৯৪৮), 'রিয়ার উইন্ডো'(১৯৫৪), 'সাইকো'(১৯৬০) এবং 'দা বার্ডস'(১৯৬৩)! ... ...
১৯১৮ সালে ঠাকুরদা যখন পূর্ববঙ্গের ঢাকা জেলার লৌহজং গ্রাম থেকে এসে ভর্তি হলেন স্কটিশ চার্চ কলেজে ঠিক সে বছরেই সে কলেজ থেকেই গ্র্যাজুয়েট হলেন নেতাজী। যতটুকু শুনেছি ঢাকার স্কুলের ছেলেটি কলেজে নেতাজীকে বেশিদিন দেখবার সুযোগ পান নি। হয়ত সে কারণেই তাঁর প্রভাব ঠাকুরদার উপরে ততখানি পড়তে পারে নি। তিনি আজীবন গান্ধিবাদী কংগ্রেসী রয়ে গিয়েছিলেন। এমনকি বহু বছর পরে বিবাহিত জীবনে সন্তানদের জন্ম হলে ছোট পুত্রের ডাক নামেও তার পরিচয় লেগে ছিল। আমার বাবাকে সবাই ‘গান্ধী’ নামেই সম্বোধন করত। ১৯০৫ সালে ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে সরিয়ে দিল্লি নিয়ে যাওয়া হলেও স্বাধীনতা লাভের সময় পর্যন্ত নাগরিক গুরুত্বে তা ছিল অবিভক্ত বাংলায় সর্বোচ্চ স্থানে। অতএব লেখাপড়া করাই হোক বা কেরিয়ার তৈরী করা- তখন তরুণদের ঢল থাকত কলকাতামুখী। ঠাকুরদা ১৯২০ সালে স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে স্কলারশিপ নিয়ে গ্র্যাজুয়েট হন। ... ...
আমার ছোটবেলা ইতিহাসের এক ক্রান্তিকাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের চূড়ান্ত অবস্থা, ৫০-এর দুর্ভিক্ষ(খ্রীষ্টাব্দ ধরলে ১৯৪৩), ভারতের স্বাধীনতা, নেতাজীর যুদ্ধ প্রচেষ্টা, বোম্বাই-এর রাজকীয় নৌসেনার বিদ্রোহ, দেশভাগ(বাংলা ও পাঞ্জাব), পাঞ্জাবের-তত-নয় কিন্তু বাংলার অকথ্য দুর্দশার শুরু – যা এখনো এই ৭০-৭১ বছর পরেও চলছে। এতে বাংলার সাধারণ মানুষের কিছু ভুল থাকলেও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ভুল, স্বার্থপরতা, চিন্তার দৈন্য, দলাদলিও কম দায়ী নয়। তাই ভাবলাম, ওই সময়ে আমাদের বাড়ির, পাড়ার, গ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে যতটুকু লেখা সম্ভব, চেষ্টা করব। মনে রাখতে হবে যে এই লেখা ইতিহাস লেখা হয়। বরং কৈশোরে পা দেওয়া আট বছরের ছেলে যা দেখেছিল ও নিজের মত বুঝেছিল, তার বর্ণনা। তবে এটাও ঠিক বয়স বাড়লে বুদ্ধি সামান্য পেকেছে, আর তাই আগের দেখাগুলি কখনো কখনো অন্যরকম মনে হয়েছে। তাই একটু “ইধার উধার” হলেও আশ্চর্যের কিছু নেই। ... ...
‘হোয়াই গুজরাট’? তিস্তা শেতলবাদ তাঁর বই ‘ফুট সোলজার অফ কন্সটিটিউশন’ এ জিজ্ঞাসা করেছিলেন। কেন গুজরাটকেই সংঘ পরিবার হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ল্যাবরেটরি হিসাবে বেছে নিয়েছিল? তিস্তা উত্তরে বলছেন গুজরাট হচ্ছে মহাত্মা গান্ধীর রাজ্য, অহিংসা, শান্তির পীঠস্থান। তাঁর এই মতাদর্শকে নিশ্চিহ্ন করার এটাই তো আদর্শ জায়গা! আরবি শ্রীকুমার, গুজরাটের ভূতপূর্ব ডিজি, যিনি সুপ্রিম কোর্টের নজিরবিহীন রায়ের কারণে জাকিয়া জাফরি মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন, তিনি তাঁর বই ‘গুজরাতঃ বিহাইন্ড দ্য কার্টেন্স’ এ লিখছেন এগারশো শতাব্দীতে সোমনাথ মন্দিরে গজনির সুলতান মাহমুদের আক্রমণের স্মৃতি সচেতন ভাবে হিন্দু মানসিকতায় জিইয়ে রাখা হয়েছে। এর ফলে অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে রাজ্যে বারবার সাম্প্রদায়িক হানাহানি দেখা গেছে। ১৭১৪ খ্রিস্টাব্দে আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর মাত্র সাত বছর বাদে সেখানে বড় দাঙ্গা হয়। ১৯৬৯, ১৯৮৫, ১৯৯২, প্রায় প্রতি দশকেই গুজরাটে ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক হিংসা দেখা গেছে। ১৯৬৯ সালে তো ৬০০ জনের মৃত্যু হয়। ... ...
পড়া হতো। তার চেয়েও গল্প হতো বেশি। এই গল্পই একবার আমার প্রাণ বাঁচায়। পূজার ছুটি। কলেজ হোস্টেলে আমি একা। জ্বর চলছিল। বিকেলের দিকে মনে হল জ্বর ছেড়েছে। গায়ে হাত দিয়ে কোনো উষ্ণতা টের পাচ্ছি না। বিকেলে হোস্টেলে ফিস্ট। কৌশিক লাহিড়ী কৌস্তভ সায়ন ওদের আসার কথা। শরীরটা খুব দুর্বল লাগছে। কৌশিক এলো সবার আগে। এসে দেখে বলল, বাবুর্চি সাহেব, শুয়ে কেন? বললাম, জ্বর এসেছিল। এখন নেই। কৌশিক তখন ডাক্তারি পড়ছে। গায়ে হাত দিয়ে বলল, গা তো জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে ছোটাছুটি। ... ...
রজত যখন তুহিনদের বাড়ি গিয়ে পৌঁছল, তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামছে। তুহিনদের বাড়িতে এখনো একটা চাপা শোকের ছায়া। রজত চারিদিকে তাকিয়ে দেখল। ঘরটা প্রথম দিনের মতই আছে। শুধু দেওয়ালে ঝুলছে তুহিনের একটা হাসিমুখের বড় ছবি। গলায় রজনীগন্ধার মালা। রজত বসার খানিক পরে ঘরে ঢুকল পৃথা। আজকে পরনে একটা হাল্কা সবুজ রঙের চুড়িদার, সাদা ওড়না। চেহারায় শোকের ছায়া অনেকটা কম। সম্ভবত খানিক আগেই স্নান করে বেরিয়েছে। রজত লক্ষ্য করে দেখল, চুল থেকে এখনও অল্প অল্প জল ঝরছে। ... ...
কলেজজীবনের সময় থেকেই প্রদীপ হাংরি জেনারেশন সাহিত্য আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েন। কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় প্রদীপকে হাংরি আন্দোলনের সাথে পরিচয় করান। প্রতিষ্ঠানবিরোধী এই সাহিত্য আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে ১৯৬১ সালে পাটনা থেকে প্রথম ম্যানিফেস্টো প্রকাশের মাধ্যমে। আন্দোলনের মূল স্রষ্টা ছিলেন কবি-সাহিত্যিক মলয় রায়চৌধুরী। কবিতা সম্পর্কে হাংরিদের বক্তব্য ছিল, “…it is a holocaust, a violent and somnambulistic jazzling of the hymning five, a sowing of the tempestual hunger.”। হাংরিরা মনে করতেন পঞ্চাশের দশক অবধি বাংলা কবিতায় যে স্থিতাবস্থা চলে আসছে, কবিতার ভাষাকে সেই স্থিতাবস্থার শেকল ভেঙে বেরিয়ে আসতে হবে। একইসাথে স্বাধীনতা পরবর্তী উত্তর ঔপনিবেশিক ভারতে এবং বিশেষ করে দেশভাগের পর পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের ব্যর্থতা ও কায়েমি স্বার্থসিদ্ধির জন্য মানুষের যে স্বপ্নভঙ্গ ঘটেছে হাংরিদের আন্দোলন সেসবের প্রতিই এক কাউন্টার ডিসকোর্স। ... ...
আমার জন্ম অবিভক্ত ভারতে। বর্তমান বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায়। গ্রামের নামটি নাগর পাড়া। বাবা শিক্ষকতা করতেন প্রথমে নাগর পাড়া, তারপর টাঙ্গাইলে। নাগর পাড়ায় ছিল পূর্বপুরুষদের স্থায়ী বাড়ি, তাই আয়তনেও বেশ বড়। জমি-জায়গা, গাছগাছালি প্রচুর ছিল। পাঁচটা বড় ঘর ছিল আমাদের। দক্ষিণমুখী বড় শয়ন ঘর – মেঝে ও দেওয়াল ইটের তৈরি, উপরে ত্রিভুজাকৃতি টিনের ছাদ। পূর্বদিক, পশ্চিমদিক আর দক্ষিণদিকে আরো তিনটি ঘর আর মাঝখানে বড় উঠান। পুবদিকের ঘরের পাশে বড় রান্নাঘর ছিল। আর ছিল কুয়ো পায়খানা। ... ...