কাজিদা, গান্ধীজী আর গুরুদেবের জোড়াসাঁকোর বাড়ির আলোচনার কথা তুমি তো জানই, গান্ধী তখন তাঁর অসহযোগিতার উপযোগিতা রবীন্দ্রনাথকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। অনেক কম বয়েসে জমিদারি চালাবার কাজ নিয়ে কবি যখন শিলাইদহে যান তখনই তিনি আমাদের দেশের গ্রামীণ দুর্দশার কারণ সম্যক বুঝেছিলেন। সেই কারণটাই তিনি বুঝিয়েছিলেন এল্ম্হার্স্ট সাহেবকে: এক, গ্রামের মানুষ এখন হারিয়েছে তার আত্মবিশ্বাস, সে নিজেই বিশ্বাস করে না যে তার বর্তমান দুর্দশার পরিবর্তন সম্ভব; আর দুই, তাদের বর্তমান অবক্ষয় রুখে দিয়ে প্রগতির পথে তাদের ফিরিয়ে আনতে হলে ফাঁকা রাজনৈতিক শ্লোগানে কাজ হবে না; দুর্দশার প্রতিটি ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক গবেষণার সাহায্যে দুর্দশার মূল কারণ নির্ধারণ করে একমাত্র প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির প্রয়োগই এই দুর্দশা বদলাতে পারে। ... ...
জল নয়। জল নয়। খটখটে রোদে চকচক করে ওঠা বালি ওখানে। সেই গল্পের মত। ওরকম জলের মত দেখতে লাগে। কাছে গিয়ে দেখা যায় বালি। বলে মরীচিকা। ঠা-ঠা-পোড়া রোদে গা-হাত-পা-সারা শরীর যেন জ্বলে জ্বলে উঠছে। এই কোথায় গেল! করকর করা চোখ দুটো গুনছে এবার। উনষাট, ষাট, একষট্টি, বাষট্টি… না একটা নেই তো। চারিদিকে যতদূর বালির ঢেউয়ের দিকে চোখ যায়, খোঁজার চেষ্টা করছে। তারপর ঝাপসা। আটষট্টি, ঊনসত্তর… না মিলছে না। কোনও একটা নাম ধরে চ্যাঁচাচ্ছে। আলম ইকবাল বা ইমরান…। ডাকছে। বারবার। মুখের ভেতর শুকনো জিভটা নড়ে নড়ে উঠছে। শুকনো গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোতে চাইছে না। বা-আ-বু…ল আ-বু…ল। না, সাড়া নেই। ... ...
ক্রোয়েশিয়ান চৌকির পুলিস কিঞ্চিৎ কৌতূহলী। আমার চেহারার সঙ্গে আমার পাসপোর্টের রঙ, গাড়ির নম্বর প্লেট এবং পার্শ্ববর্তিনীর মুখ কোনটাই মেলে না, প্রায় কখনোই। চার দশক কেটে গেছে, পুলিশের বিস্ময় আমাকে আর বিস্মিত করে না। এখন কেবল পরবর্তী সংলাপের অপেক্ষা। পরিচ্ছন্ন ইংরেজিতে জানতে চাইলেন ঠিক কোথায় যাচ্ছি—মস্তার? বললাম, মস্তার যাবো, তবে মেজুগরিয়ে হয়ে। রোদিকাকে দেখিয়ে বললাম ইনি যে অত্যন্ত ধর্মপ্রাণা মহিলা, একবার মা মেরির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান! ... ...
পত্রিকার নাম ধূমকেতু, তার সম্পাদককে বলা হল সারথি। উনিশশো বাইশের এগারই আগস্ট বেরল প্রথম সংখ্যা ধূমকেতু, রবীন্দ্রনাথের একটি বাণী তার শিরোভূষণ। এর এক বছর আগে, উনিশশো একুশের সেপ্টেম্বরে, জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে এক বহুল প্রচারিত আলোচনায় রবীন্দ্রনাথকে অসহযোগ আন্দোলন, বিদেশী বস্ত্র বয়কট এবং চরকাস্ত্র প্রয়োগে স্বরাজের ভাবনায় নিজের মতে আনতে ব্যর্থ হয়েছিলেন গান্ধী। এক বছর পর নজরুলের এই প্রয়াসকে প্রাণ-ভরে আশীর্বাদ জানালেন কবি! ... ...
বিগত তিরিশ বছরে নানান দেশের নানান ব্যাঙ্কিং প্যানেলে বহু জ্ঞানীগুণীর সঙ্গে একাসনে বসে ঘণ্টাখানেক বাক্যালাপ করে পাঁচজনের সঙ্গে আমিও ফিরিতে হাততালি কুড়িয়েছি। এইসব প্যানেল আমারই মত অন্যান্য ব্যাঙ্কের ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কিঙের ফিরিওলা, কর্পোরেট প্রধান, সরকারি অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের মাঝারি প্রবক্তা, খবরের কাগজের প্রতিনিধি (যাঁরা প্রশ্ন করেন কেতাবি, উত্তরের অর্থ অর্ধেক বোঝেন কিনা সন্দেহ) এমনি সব মানুষদের নিয়ে তৈরি হয়। নির্ধারিত অনুষ্ঠানের আগেই আমরা কনফারেন্স কল (জুম কল আসতে দেরি আছে) করে ঠিক করে নিই প্রশ্নাবলী কী হবে, কে কী বলবে। শ্রোতারা ভাবেন – চার-পাঁচ জন নারী পুরুষ একত্র বসে কোনো অর্থনৈতিক সমস্যা বা বিষয়ের ওপরে কোনো গভীর তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ দ্বারা মহতী সিদ্ধান্তে উপনীত হচ্ছেন। ... ...
ভালো লাগে না কাজির, সে স্বভাবতই খোলামেলা চরিত্রের মানুষ, এই-যে দুলির সঙ্গে এমন একটা ঘনিষ্ঠতার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ল সে, সেটাকে যে যথাসাধ্য গোপন করার চেষ্টা করতে হচ্ছে, এ তার ভালো লাগে না। কিন্তু গোপন না করেই বা কী উপায়? দুলি তো একেবারেই ছেলেমানুষ; নিজের ভালো যদি নিজে সে বুঝত! কাজির মতো একজন ছন্নছাড়া বিষয়আশয়হীন গৃহহীন অর্থসংস্থানহীন মানুষের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার অর্থ যদি সে বুঝত! বোঝে না, তাই কাজির দায়িত্ব আরও বেড়ে যায়। কিন্তু কাজির যে চিৎকার করে সারা পৃথিবীকে জানাতে ইচ্ছে করছে! ছন্নছাড়া হতে পারি, কিন্তু আমার মতো ভাগ্যবান কে আছে! ... ...
আরতুরোস বললে, ‘দেখতে থাক। পাঁচ মিনিটের বেশি যদি লাগে, হোটেলে ফিরে গিয়ে আমার পয়সায় বিয়ার খাওয়াব। কৌতূহল বেড়ে গেল। বিয়ারের জন্য নয়। সপরিবারে পরায়া গাড়িতে কারো লিফট পাওয়া অসম্ভব মনে হচ্ছিল। তিরিশ বছর আগে জার্মানিতে হাত দেখিয়ে লিফট জোগাড় করার ভীষণ চল ছিল। নিজে করেছি। তবে সেটা অটোবানে। শহরে নয় -সেখানে সরকারি পরিবহন ব্যবস্থা আছে, আমেরিকার মতন নয়। কথ্য জার্মানে বলা হয়, বুড়ো আঙ্গুল (প্যার দাউমেন) দেখিয়ে সফর করা। নিরাপত্তা পরিস্থিতির অনিশ্চয়তার কারণে হয়তো জার্মানিতে এই যানযাত্রার পদ্ধতি প্রায় বিলীন এখন। ... ...
আগুন জ্বললো পরের দিন, সম্পূর্ণ নতুন আবহে। এমনটা কাজি দেখেনি আগে; দোলের আগের দিন, সন্ধ্যে পেরিয়ে তখন রাত অনেকটাই। পরের দিন পূর্ণিমা, আজই আকাশ ভেসে যাচ্ছে আলোর বন্যায়। নানারকমের কাঠকুটো যোগাড় করে গ্রামের ছেলেরা এসে জমিদারবাবুর প্রাঙ্গনে আগুন জ্বালাল। ছেলের দল বলল নেড়াপোড়া, কিরণশঙ্কর বললেন চাঁচর। তারপর বললেন, ওদের নেড়াপোড়া কথাটাও কিন্তু বেশ যুক্তিযুক্ত। ধানকাটা হয়ে গেছে, পিঠেপায়েসের উৎসবও শেষ। এখন নতুন করে জমিতে কাজ শুরু হবে, তার আগে ক্ষেতে পড়ে-থাকা শস্যস্তম্ব, মানে, শস্য কেটে নেবার পর ক্ষেতে পড়ে থাকে যেটুকু, যাকে গ্রাম্য ভাষায় নেড়া বলে, তা পোড়ানো হবে। ... ...
আমরা কেউ অবশ্য পুরোপুরি সফল হই না! তাহলে পৃথিবীর চেহারাটা বদলে যেত। তবে একই জিনিসকে আলাদা দৃষ্টিকোণ থেকে জানার ও শোনার বিশেষ মূল্য আছে। আন্তর্জাতিক ঋণ প্রায় ৯৫% ইংরেজি আইনের আওতায় (ইংলিশ ল) পড়ে – (আমেরিকান ল বলে কিছু নেই)। তবু ঋণ গ্রহীতার দেশের আইনকানুনের খবর রাখতে হয়েছে। তার পূর্ণ দায়িত্ব আমার নয়। ... ...
গতকাল, কাজি বলে, ঘুম আসছিল না কাল রাতে; তারপর হঠাৎ কেমন মনে হল, একটা কবিতা লিখতে হবে। ওদিকে মুজফ্ফর তখন গভীর ঘুমে। আমি উঠে ভয়ে ভয়ে আলোটা জ্বালালুম, পাছে ওর ঘুম ভাঙিয়ে দিই। দেখলুম ও ঘুমিয়েই চলেছে, আলো বুঝতেও পারছে না। তখন লিখতে শুরু করলুম, পেনসিল দিয়ে। কেমন যে একটা তোলপাড় হচ্ছিল মনের মধ্যে বোঝাতে পারব না আপনাকে। মনে হচ্ছিল, দোয়াত-কলম দিয়ে পারব না লিখতে, কালি শুকিয়ে যাওয়া, দোয়াতে আবার কলম ডোবানো, এসব করতে পারব না, করার সময় হবে না। পেনসিল দিয়ে কিন্তু ঝর ঝর করে লেখাটা হয়ে গেল অবিনাশদা। লেখাটা দেখুন, বিশেষ কিছু কাটাকুটি নেই, যেন আমার মাথার মধ্যে ছিলই কবিতাটা। শুরু করতেই নিজেই নিজেকে যেন টেনে নিয়ে গেল। লেখা শেষ হতে, মুজফ্ফরকে ঘুম ভাঙিয়ে টেনে তুললুম। কাউকে একটা শোনাতেই হবে। ... ...
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পনেরো টুকরো হয়েছে। একদা এই পনেরোটি রিপাবলিকের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা ছিল রাশিয়ান। কালিনিনগ্রাদে যখন সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা বাজে, পুবে দিওমেদ দ্বীপে তখন পরের দিনের ভোর সাড়ে পাঁচটা – সর্বত্র ভাষা এক। লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া থেকে কাজাখ অবদি সবার নিজস্ব ভাষা আছে, ছিল। তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয় রাশিয়ান। নইলে রাজ্য শাসন অসম্ভব। যেমন আমাদের শাসকরা চাপিয়েছিলেন ইংরেজি, সেটিকে আমরা আঁকড়ে ধরেছি। বাইরের জগতের পাসপোর্ট এটি। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফ্রাঁসোয়া দুপ্লে রবার্ট ক্লাইভকে হারাতে পারলে ফরাসি আমাদের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা হত! ... ...
দেশত্যাগ বিয়ের কনে বিদায় দেবার মত ব্যাপার নয়। এখানে সবাইকে জানিয়ে যাওয়া যায় না। যথাসম্ভব চুপিচুপি চলে যেতে হয়। বিদায়ের কষ্টের চেয়েও ঢেড় বড় হচ্ছে নিরাপত্তা। ১৩৫৪ সনের পৌষের এক কুয়াশাঢাকা ভোরে খলিল আর জাহেরা পরিবার নিজেদের সামান্য পোঁটলাপুঁটলি নিয়ে বেলডুবি ছাড়লেন। পেছন ফিরে তাকাতে সারি সারি তাল, নারকেল আর সুপুরি গাছের মাথাগুলো দেখা গেল; তার নিচে বাকি গাছপালা আর গাঁয়ের বাড়িগুলো কুয়াশায় ঢাকা পড়ে গেছে। মনে হচ্ছিল তাঁরা সবাই যেন এক প্রাগৈতিহাসিক গুহার ভেতর থেকে বের হয়ে অজানা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে হাঁটছেন। ... ...
জোর? জোর করার কথা আসে কোথা থেকে? – বলেন আবুবক্র্, মোগল সম্রাট আকবরের জন্মের কথা জানেন তো? তাঁর জন্মের সময় তাঁর পিতা যুদ্ধপর্যুদস্ত হুমায়ুন কিছু পারিষদ এবং গর্ভবতী যুবতী সম্রাজ্ঞীসহ অমরকোটের রাণার দুর্গে আশ্রিত। সেই অবস্থায় পুত্র জালাল উদ্দিন মহম্মদ আকবরের জন্ম হয়। পারিষদদের কাছে মহার্ঘ কিছু আছে কিনা খোঁজ করতে করতে জৌহর নামক একজন পণ্ডিত আমীরের কাছে দু'শো খোরাসানী স্বর্ণমুদ্রা, একটি রজতনির্মিত রিস্টলেট এবং এবং খানিকটা মৃগনাভি হুমায়ুন পেয়ে গেলেন। স্বর্ণমুদ্রা বা রজতনির্মিত অলঙ্কারটি হুমায়ুন গ্রহণ করলেন না। মৃগনাভিটুকু স্বহস্তে বহু ছোট ছোট টুকরো করে উপস্থিত সকলকে একটি করে টুকরো তিনি উপহার দিলেন। নিজের শরীরজাত যে মৃগনাভির সুগন্ধে মাতোয়ালা মৃগটি নিজেই উন্মাদগ্রস্ত হয়, সেই গন্ধে বহু যোজন আমোদিত হল। মঙ্গলাচরণ করে হুমায়ুন উপস্থিত সকলকে বললেন, আপনারা প্রার্থনা করুন, এই আশ্চর্য সুগন্ধের মতো আমার এই সদ্যোজাত পুত্র আকবারের সুকর্মের ফল এবং যশ যেন দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে। ... ...
সপ্তাহে দুদিন তিনি আসেন। কৃষ্ণের নাম গান করতে করতে গ্রামে সবার বাড়ি ঘুরে তবে তাঁর নিজের বাড়িতে ফিরবেন। গুনগুন করতে করতে নেমে যাবেন আলপথে। সকালের নরম আলোয় স্নান করে পরম প্রশান্তিতে উন্মুক্ত ওই ঈশ্বরের মাঠ পেরিয়ে চলে যাবেন তিনি। আজ এ গাঁয়ে, কাল আবার অন্য গাঁয়ে নাম গান করতে যেতে হয় তাঁকে। মাস পোহালে ধামা চ্যাঙারি নিয়ে সিধে সংগ্রহ করতে বেরোন। বাড়ি বাড়ি ঘুরে সংগ্রহ করেন। কেউ তাঁকে নিয়োগ করেনি একাজে। কবে যেন তিনি কোন যুবক বয়সে প্রান্তরের বাধা অতিক্রম করে এসে পৌঁছেছিলেন এ গাঁয়ে খঞ্জনি বাজিয়ে কৃষ্ণের নাম গাইতে গাইতে। তারপর এত বছর পার করে আমার বালিকাবেলায় তিনি প্রৌঢ়। ... ...
একটা দল খুনোখুনিতে ছিল না, কিছু লুটও করেনি – তাদের লক্ষ্য ছিল ভেতর বাড়ি। প্রতিটি ঘর, রান্না ঘর, বারান্দায় তারা কী যেন খুঁজে শেষে ভাঁড়ার ঘরের ভেতরে জাহেরাদের তিনজনকে আবিষ্কার করে। এইবার এই দলটি ‘নেড়েটার মাগীগুলোকে পেয়ে গেছি রে!’ বলে উল্লাস করে ওঠে। তারা জাহেরাদেরকে টেনে হিঁচড়ে ভেতরের শোবার ঘরে নিয়ে এসে উপর্যুপরি ধর্ষণ শুরু করে। ধর্ষণ কি জিনিস তা জাহেরা বা ঝিয়ের জানা থাকলেও তেরো বছরের মাহিরার অজ্ঞাত ছিল। তাকে ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে চেপে ধরাতে সে চেঁচাচ্ছিল, কিন্তু প্রথমবার তাকে যখন বিদ্ধ করা হল তখন সে এক অপার্থিব জান্তব চিৎকার দিয়ে উঠল। ... ...
কোনো এক সুপ্রভাতে হয়তো মন ভালো ছিল, তাই প্রকৃতি কাজাখকে দিলেন ইউরেনিয়াম, তামা, শিসে, ক্রোমিয়াম, দস্তা, লোহা, হীরে এবং অগাধ খনিজ তেলের ভাঁড়ার। কিন্তু এই আশ্চর্য ধন সম্পদ খুঁজে দেখেননি, তার পরোয়া করেননি যাযাবর জনতা। সে অমৃত পড়ে রইল আসা যাওয়ার পথের ধারে। এ দেশের মানুষ স্থায়ী ভাবে বাস করতেন না কোথাও। মোঙ্গল রক্ত শরীরে আর মন উড়ু উড়ু। যাযাবরের মত আসা যাওয়া—আজ এখানে, কাল ওখানে। দেশটা এত বড়ো, যে, চরৈবেতি বলে চরে খাওয়ার কোনো অসুবিধে ছিল না। দীর্ঘ জনযাত্রায় তাঁদের চোখে পড়েছে দেশের বিস্তৃত প্রান্তরে একটি ক্ষিপ্র গতির প্রাণী এখানে ওখানে দৌড়ে বেড়ায়। হেঁটে ক্লান্ত যাযাবরেরা হঠাৎ কোনো এক সময়ে তার ওপর চড়ে বসলেন। সে প্রাণী খুব একটা প্রতিবাদ হয়তো করেনি, করলেও তার কথা লিখে রাখবার মতন ট্রাভেল রাইটার জোটেনি। ... ...
জাহেরা কসাই বাড়ির মেয়ে। তাঁর হাঁকডাক কম নয়, দরকারে ছুরি-চাপাতিও চালাতে পারেন। চাইলে তিনি প্রবল প্রতিরোধ করতে পারতেন, হৈচৈ করতে পারতেন, কিন্তু তিনি সেসবের কিছুই করলেন না। তাঁর সকল প্রতিরোধের শক্তি গত কয়েক মাসে একটু একটু করে নিঃশেষ হয়ে গেছে। যেদেশে নারীর পরিধেয় ব্লাউজ, পেটিকোট বা শেমিজ বিহীন শাড়ি আর পুরুষের পরিধেয় ধুতি বা লুঙ্গি—সেদেশে তাদের যৌনকর্মে লিপ্ত হতে বেশি আয়াসের দরকার হয় না, সম্পূর্ণ বিবস্ত্রও হতে হয় না। নাজির খাঁ’র ভারি দেহের নিচে নিষ্পেষিত হতে হতে জাহেরা ভাবলেন, উদয়াস্ত পরিশ্রম করলে তাঁদের তিন জনের দু’বেলার খাবার হয়তো জোটানো যাবে, কিন্তু সবার নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য বাড়তি কিছু মূল্য দিতে হবে। বাইরের দুনিয়ায় শেয়াল শকুনের খাবার হবার চেয়ে এটা হয়তো মন্দের ভালো হল। ... ...
কাগজখানা হাতে নিয়েই কাজি বলে, এ কী! প্রথমেই তো বানান ভুল। কেন, কোন্ বানানটা? এই যে, কাঠবেড়ালী। ঠিকই তো আছে; ক-য় আ-কারে কা আর ঠ কাঠ, ব-য় এ-কারে বে র-য় আ-কারে রা আর ল-য় দীর্ঘ ঈ, লী। কাঠবেরালী। আরে, এ তো বাঙালদের বানান হল, ভুল। তুমি কি তাহলে ইংরাজি বানান চাও? ইংরাজি নয়, ইংরিজি। কিন্তু সেটাই বা চাইব কেন? বিশুদ্ধ বাংলা বানান, কাঠবেড়ালী। ব-য়ে শূন্য র নয়, ড-য়ে শূন্য ড়-য়ে আ-কার, ড়া। বেড়ালী, কাঠবেড়ালী। ... ...
পিসি কাচের চুড়ি পরতে না পারলেও অঘ্রাণমাসের মেলায় কিনে ফেলল। তবে লুকিয়ে রাখল বেলোয়ারি চুড়ি। সুযোগ মতো পরা, যখন কাকু বাড়ি থাকবে না। সেবার শীত শেষের মুখেই হবে হয়তো, অত মনে নেই, বৃষ্টি হল বেশ। হতে পারে আমার কল্পনা প্রবণ মন ছবি বানাচ্ছে, তাই সেই ছবিতে সুন্দর করে মিলে যাবে যে দৃশ্য মন সেটাই দেখছে। দেখলাম, অকাল বৃষ্টির দিন পশ্চিম দুয়ারি ঘরের ধারিগোড়ায় বসে পিসি চুড়ি ঘুরিয়ে হাতখানা দেখছে। আচমকা কাকু হাজির বাইরে থেকে। এক লাথিতে পিসি ছিটকে পড়ল উঠোনে। বৃষ্টির জলের ভেতর পড়ল আছাড় খেয়ে, হাতের চুড়ি ভেঙে খানখান। যেন অপমানিত, অতৃপ্ত চুড়িগুলি চরম অভিমানে শীতের বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে চোখ ভরা জল নিয়ে তাকিয়ে আছে চরম বিস্ময়ে। ভাঙা চুড়িগুলি ভিজতে লাগল। ভিজছে পিসি। তার চোখ মুখ থেকে জলের ধারা নামছে। সে ধারা বৃষ্টির, না চোখের তা অবশ্য আমি বলতে পারব না। বৃষ্টির দিনে ভাঙা রঙিন চুড়ি খেলি কুঁড়িপিসির সঙ্গে, চুড়ির গায়ে কত কত সুখ দুঃখ লেগে থাকে সঙ্গোপনে। ... ...
বাংলা ১৩৪৬ সনে ভারত যখন মহাযুদ্ধে জড়াল, তখন থেকে একটু একটু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আক্রা হতে শুরু করল। ‘জাপানিরা বর্ম্মাতে এসে গেছে, দু’দিন পরে কলকাতায় চলে আসবে’। ‘জাপানি বিমান দুমদাম বোমা ফেলে সব শেষ করে দিচ্ছে’। এমনসব কথা যত বাড়তে থাকল, বাজার থেকে চাল-ডাল ততই উধাও হতে থাকল। বর্ম্মা থেকে আসা গরিবের খাবার ‘পেগু চাল’ একেবারেই মিলল না। মড়ার উপরে খাঁড়ার ঘায়ের মত ১৩৪৯ সনের আশ্বিন মাসের ঘূর্ণিঝড়ে বাংলার দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলো তছনছ হয়ে গেল। ঘুর্ণিঝড়ের পরে ধানের রোগবালাই আর পোকার আক্রমণ বেড়ে আমন ধান মার খেয়ে গেল। সে আমলে বোরো নয়, আমনই মূল ফসল ছিল। ফৌজি লোকজন বড় বড় নৌকা পুড়িয়ে দিতে আর গরুর গাড়ি ভেঙে দিতে থাকলে গাঁ থেকে ধানের চালান আর শহরে বা অন্যত্র যেতে পারল না। ১৩৪৮ সনের শীতকালে মোটা চালের দাম ছিল সাড়ে পাঁচ টাকা ছ’টাকা মণ, সেই চালের দাম এক বছরের মাথায় ১৩৪৯ সনের চৈত্র মাসে গিয়ে দাঁড়ায় ১৫ টাকা মণ দরে। ... ...