শিক্ষাচার্য বিদ্যুৎকুমার মধ্যাহ্নের দিবাস্বপ্ন দেখছিলেন। এমন সময় প্রধানসেবক এসে কাঁচুমাচু মুখে জানালেন -- চারদিকে কি লেখা হচ্ছে জানেন স্যার? বিদ্যুতের বড্ড তেজ করে দেব লো ভোল্টেজ। শুনে বিদ্যুৎকুমারের স্থির ভ্রূ কিঞ্চিৎ কুঞ্চিত হল। তিনি দাঁত খিঁচিয়ে বললেন, লো-ভোল্টেজ? দেখাচ্ছি তোদের। যন্ত্রবিদ, ইধার আও। আজ থেকে গোটা বিশ্বভারতীতে সারা রাত গনগন করে আলো জ্বলবে। কোথাও কোনো আলো নিভলেই, তোমার চাকরি নট। ... ...
এই ন্যারেটিভের প্রথম লক্ষণ হল, আফগানিস্তানকে আফগানিস্তান বানানোর জন্য পাকিস্তান, চিন এবং কখনও সখনও দুষ্টু রাশিয়াকে দায়ী করা। আর আমেরিকাকে স্রেফ একটু ব্যর্থতার জন্য সমালোচনা করা। আমেরিকা আফগানিস্তানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে লাট করেছে, সে নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু উদ্দেশ্য তো ভালোই ছিল, গণতন্ত্রই তো গড়তে গিয়েছিল। মানুষকে ধর্মান্ধতা থেকে স্বাধীনতা দিয়েছিল, মেয়েদের দিয়েছিল ওড়ার আকাশ। কাইট রানার সেই পশ্চিমী স্বাধীনতার প্রতীক, মালালা হল মুখ। এখন আমেরিকার পিছিয়ে আসায় সে আকাশ ভেঙে পড়ে যাচ্ছে, এবার অ্যাসিড বৃষ্টি আসন্ন -- এরকম একটা ভাব। তো, এ ন্যারেটিভ এতই মোটাদাগের, এবং এতটাই অলীক, যে, আলাদা করে সমালোচনা করার এমনি কোনো কারণই নেই। তবু লেখা যখন হচ্ছে, তখন সংক্ষেপে, স্পষ্ট করেই বলা যাক, বাস্তবতা থেকে এসব অনেক দূরে। ইন্দোনেশিয়া থেকে আফগানিস্তান হয়ে আরব পর্যন্ত মৌলবাদীদের উত্থানে সক্রিয় ভূমিকা, মদৎ ছিল কাদের তা কোনো গোপন তথ্য নয়। আফগানিস্তানে মুজাহিদিনদের প্রশিক্ষণ, সৌদি আরবের অগাধ কনট্র্যাক্ট, এবং তালিবানদের সঙ্গে চলমান আলোচনা, এসব নিশ্চয়ই গণতন্ত্র এবং নারীর অধিকারের স্বার্থে করা হয়নি। বস্তুত জঙ্গী ইসলাম, মূলত প্রত্যক্ষভাবে পশ্চিমের তৈরি। ... ...
তথাগতবাবু এবং তিওয়ারিজির এইসব কাজকর্ম, বলাবাহুল্য, পাহাড়প্রতিম মূর্খামি ছাড়া আর কিচ্ছু না। তাঁরা জানেনই না, বিজেপি এবং আরএসএস তো হিন্দুত্বকে আদৌ কোনো ধর্ম মনে করেনা। সে কথা বহুবার সজোরে বলাও হয়েছে। আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত স্বয়ং বলেছেন, হিন্দুত্ব কোনো ধর্ম নয়, একটি জীবনচর্যা। অর্থাৎ জীবন যাপনের পদ্ধতি। যা আদৌ ধর্মই নয়, তাতে আঘাত করলে ধর্মীয় ভাবাবেগে কীকরে আঘাত করা হয়, মাননীয় তথাগত বা তরুণজ্যোতি কি তা বলতে পারেন? আরএসএস কী মনে করে, তাঁরা কি সেসবের ধার ধারেননা? নাকি আদৌ জানেনই না? ... ...
১৯৫৬ সালের কথা। বাংলা-বিহারকে জুড়ে দিয়ে পূর্বপ্রদেশ নামক একটি রাজ্য তৈরি করার প্রস্তাব আনল তৎকালীন রাজ্য সরকার। মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন বিধান চন্দ্র রায়। বাংলা ভাগের সর্বনাশ করার পর, পশ্চিমবঙ্গকে হিন্দি বলয়ের অংশ বানিয়ে ফেলার চেষ্টার সেই শুরু। সুভাষ চন্দ্র বসুর জন্মদিন, ২৩শে জানুয়ারি, ১৯৫৬, বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায় এবং বিহারের মুখ্যমন্ত্রী কৃষ্ণ সিংহ, এক যৌথ বিবৃতিতে এই সংযুক্তির প্রস্তাবকে সমর্থন করলেন। সর্বশক্তিমান কংগ্রেস হাইকম্যান্ড প্রস্তাবে শিলমোহর দিল। এ প্রস্তাব কার্যকরী হলে বাঙালিজাতির বিপর্যয়ের ষোলকলা পূর্ণ হত, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তখনও বিহার টুকরো হয়নি, চার কোটি বিহারবাসীর সঙ্গে, আড়াই কোটি বাঙালিকে যোগ করলে নতুন রাজ্যে বাঙালিরা সংখ্যালঘু হতেন। বাঙালিরা সব দখল করে নেবে, বিহারবাসীদের এই আতঙ্কের কথা তখনই শোনা যাচ্ছিল, বছর-বছর নিশ্চয়ই বাড়ত। তার উপর পূর্ব বাংলা থেকে আসছিলেন অসংখ্য উদ্বাস্তু। দেশভাগের দায় তাঁদের নয়, কিন্তু দায়িত্ব পুরোটাই নিতে হচ্ছিল। হিন্দুদের পরিত্রাতারা তখন কাঁথাকম্বল জড়িয়ে ঘুমোচ্ছিলেন। এই অবস্থায় আরেকটা আসাম তৈরির ছক একদম পাকা ছিল, যেখানে ভূমিপুত্রদের আতঙ্কের দোহাই দিয়ে দশকের পর দশক ধরে বাঙালি খেদানো চলবে এবং বছর পঞ্চাশ-ষাট পরে খানিক গণহত্যা, আর তারপর সর্বদলসম্মত এন-আর-সি করে পাকাপোক্তভাবেই খেদিয়ে দেওয়া হবে। ... ...
এর চেয়েও প্রলয়ঙ্কর হল গানের ব্যবহার। সহনায়িকা এখানে গুণগুণ করে গায় রবিবাবুর গান। মোটামুটি ১৮৯৫ সাল নাগাদ। কী গান? সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে। যে গান লেখা হবে এর বছর তিরিশেক পরে। বাঙালি হলেই একটু রবীন্দ্রনাথের পাঞ্চ দিতেই হবে, বাঙালি রবীন্দ্রনাথের জন্মের আগে থেকেই রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়, এ তো জানা কথা। যেকোনো দিন পলাশীর যুদ্ধের দৃশ্যায়নেও সিরাজদৌল্লাকে 'ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে' গুণগুণ করতে দেখা যেতে পারে। বলিউডি ওয়েবসিরিজ/সিনেমার কারবার বলে কথা। এর আগে একটি সিরিজে দেখা গিয়েছিল বাঙালি নায়িকা সঙ্গমকালে 'শেষের কবিতা' থেকে আবৃত্তি করে। বলিউডি প্রযোজক-পরিচালকদের নির্ঘাত ধারণা ওতেই বাঙালির অর্গ্যাজম। ... ...
কিন্তু ভিতরে বসে দেখলে অবস্থা এত আশাপ্রদ কিছু নয়। আমেরিকা কাঁপছে ঠিকই, কিন্তু ভেঙে পড়ার জন্য কিনা কেউ জানেনা। বহু শহরে রাত্রিকালীন কার্ফু। প্রেসিডেন্ট ন্যাশানাল গার্ড নামাতে বলেছেন সমস্ত গভর্নরদের। না নামালে নিজেই সৈন্য নামিয়ে দেবেন বলেছেন। আমেরিকায় বসে এই মুহূর্তে সেটা শুধু ফাঁকা আওয়াজ মনে হচ্ছেনা। কারণ প্রতিবাদের চেয়েও হিংসা ছড়াচ্ছে বেশি গতিতে। তার চেয়েও বেশি দ্রুত ছড়াচ্ছে 'খবর'। ছড়াচ্ছে ফোনে, ছড়াচ্ছে সোশাল মিডিয়ায়, ছড়াচ্ছে ফিসফিসিয়ে। আমাদের পাড়ার নেটওয়ার্কে মেয়রের সাবধানবাণী জ্বলজ্বল করছে। 'নির্ভরযোগ্য' সূত্রের খবর দিয়ে লোকজন পোস্ট করছে, আজ রাতে বাসে করে দাঙ্গাবাজরা আসছে। সতর্ক থাকুন। ইঙ্গিত ব্ল্যাকলাইভসম্যাটার আর অ্যান্টিফার দিকে। ... ...
লকডাউন উঠে গেলেই কি করোনা ফিনিশ? স্পষ্ট করে প্রথমেই বলে নেওয়া দরকার, না। এই ধুন্ধুমার লকডাউন উঠে গেলে পৃথিবী আদপেই পৃথিবী করোনামুক্ত হবেনা। একবার যখন এসে পড়েছে, ভাইরাসটি আছে এবং থাকবে। নির্মূল হবেনা। সে চেষ্টাও পৃথিবীর কোনো দেশের কোনো স্বাস্থ্যসংস্থা বা সরকার করছেনা। অতএব, যদি নেহাৎই প্রশান্ত মহাসাগরের কোনো দ্বীপে গিয়ে একাকী বসবাস না করতে পারেন, আজ হোক বা ছমাস পরে, এর সংস্পর্শে আপনি আসবেনই, যদি না ইতিমধ্যেই এসে গিয়ে থাকেন। তার মধ্যে কোনো টিকা বেরিয়ে যাবার সম্ভাবনা খুবই কম। (যখন বেরোবে তার পরেও, ফ্লুয়ের মতোই ভাইরাসের নতুন কোনো গোষ্ঠী সম্ভবত উদয় হবে, টিকা যার কোনো প্রতিষেধক নয়।) ফলে ভাইরাস নাকের ডগায় এলে আপনার ভরসা আপনার প্রতিরোধক্ষমতা। কোনো লকডাউন, কোনোভাবেই আপনাকে তার থেকে বাঁচাবেনা। ... ...
কিন্তু সমস্ত কিছু গা-সওয়া হয়ে যাবার পরও কিছু কিছু জিনিস তবুও চমকে দেয়। দিল্লির ঘটনা যেমন। স্রেফ এইজন্য নয়, যে, পুলিশ নৃশংসতা দেখাচ্ছে। এইজন্যও নয়, যে, হিন্দুত্ববাদীদের নারকীয় গুন্ডামি নতুন কিছু। কিন্তু যা এখানে চমকে দিচ্ছে, সেটা হল প্রকাশ্যে, ইন্টারনেট যুগে যে খুল্লামখুল্লাভাবে জিনিসটা ঘটানো হচ্ছে। সরাসরি হামলা, বোমা এবং অস্ত্রের অবাধ ব্যবহার, পুলিশের পক্ষপাতদুষ্ট সক্রিয়তা, অব্যর্থভাবেই মনে করিয়ে দেয় গুজরাতের নরমেধ যজ্ঞের কথা। পদ্ধতিটা সেই একই। এবং সেটা কোথায় ঘটানো হচ্ছে? ভারত রাষ্ট্রের রাজধানীতে। বছর দুই আগেও এ ঘটনা অবিশ্বাস্য মনে হত। কিন্তু আর হচ্ছে না। সুররিয়েল মনে হচ্ছে কেবল। ভিডিও গুলো দেখলে সকলেরই মনে হবে মনে হয়। ... ...