বিচ্ছিন্নভাবে র্যাগিং হয়না। এবং কলেজের প্রতিটি ছাত্র সংগঠন ব্যাপারটা জানে। হ্যাঁ, প্রতিটা ঘটনা জানেনা, অংশগ্রহণ বা এনডোর্স করেনা, সবই সম্ভব, কিন্তু জানেনা, এটা হয়না। যদি কেউ বলে, জানতামনা, তাহলে হয় সেই সংগঠনটা নেই, অথবা গুল দিচ্ছে। বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। আর যদি কোনো সংগঠন বলে, জানেনা, কারণ এটা "বিচ্ছিন্ন ঘটনা", তাহলে সেটাও গুল। "বিচ্ছিন্ন র্যাগিং" হয়না। বিচ্ছিন্ন খুন-জখম-রাহাজানি-গুন্ডামি-শ্লীলতাহানি সবই হতে পারে, কিন্তু র্যাগিং না। কারণ, আপনি কল্পনা করে দেখুন, অন্য একটা ছেলেকে আপনি বলছেন, "এই, প্যান্ট খুলে রাত বারোটায় ইন্ট্রো দিয়ে যাবি" - এটা চুপি-চুপি হয়না, এবং এটা আপনার মাথাতেই আসবেনা, যদি না একটা কালচার চালু থাকে, এবং সেটার একরকম মান্যতা থাকে। ... ...
বাংলায় শিক্ষা-টিক্ষা চালু করার কথা এলে, প্রথমেই দুটো তর্ক উঠে আসে, যা সেই রবীন্দ্রনাথের আমল থেকে চলছে। এক, বাংলার পরিভাষাগুলো অদ্ভুত। ছোটো থেকে শুনে আসছি, গতিজাড্য, ভরবেগ, জ্যা, ব্যাসার্ধ, কূটাভাষ, চলগতিবিদ্যা, বস্তুবাদ, যুক্তিবাদ, তাত্ত্বিক প্রস্থানবিন্দু, এইসব নাকি খুব কঠিন কথা। 'উদস্থৈতিক কূট'? হ্যাহ্যাহ্যা সেটা আবার কী? আমরা মফঃস্বলবাসীরা এ জিনিস শুনে-শুনে পচিয়ে ফেলেছি। অথচ, কথাটা একেবারেই ফালতু। ইংরিজি দারুণ-দারুণ সোজা পরিভাষার ডিপো, তা নয়। যা আছে, তার বহু কিছুই ইংরিজিভাষীদের পক্ষেও কঠিন। মায়ের পেট থেকে পড়েই 'হাইড্রোস্ট্যাটিক প্যারাডক্স' কাকে বলে কেউ বুঝে যায়না, আর অ-ইংরেজভাষীদের পক্ষে, খুব অভ্যাস না থাকলে, বলতে দাঁত খুলেও যেতে পারে। স্ট্যালাগটাইট, স্ট্যালাগমাইট, ইন্টারডিসিপ্লিনারি-ডিসকোর্স, এসবই কঠিন জিনিস। বৈজ্ঞানিক নামগুলো তো, ওরে বাবা। পেরিপ্ল্যানেটা আমেরিকানা, মানে নাকি আরশোলা, হোমো-স্যাপিয়েন্স মানে মানুষ। তার আগে ছিল নিয়েন্ডারথাল, হোমো-ইরেকটাস। প্রচুর মুখস্থ না করলে মনে রাখা সম্ভব না। আমাদের পন্ডিতদের যেমন তৎসমের উপর একটা ঝোঁক ছিল, পশ্চিমের পন্ডিতদের ছিল লাতিনের উপরে। সব একই রকম খটোমটো। অভ্যাস করলেই অভ্যাস হয়ে যায়। নইলে হয়না। ... ...
অনুষ্ঠানের নাম ঘরের বায়োস্কোপ। কদিন আগে হয়ে যাওয়া টিভি নাইন আয়োজিত বাংলা সিরিয়াল, ওটিটি এসবের পুরস্কার-প্রদান অনুষ্ঠান। এইসব গুচ্ছের হয় জানি, দেখিনা, কিন্তু প্রদীপ্ত ভট্টাচার্যের প্রত্যাখ্যান করার ঘোষণার পর আগ্রহ বেড়ে যাওয়ায় খানিকটা দেখেই ফেললাম। পুরোটা দেখিনি, অনেক লম্বা, কিন্তু যেটুকু দেখিলাম, জন্ম-জন্মান্তরে না হলেও, অনেকদিন ভুলবনা। প্রদীপ্ত কিছু ভুল বলেননি। রাজনীতিকরা যে টিভি-সিরিয়ালের জগতে এত গুরুত্বপূর্ণ, সে এই অনুষ্ঠান না দেখলে জানতেই পারতামনা। মঞ্চে যাঁদের দেখলাম, তাঁদের মধ্যে সবার উপরে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর। দিল্লিতে তখনও কুস্তিগীরদের ধর্ণা চলছে, কেন্দ্রীয় সরকারের দিল্লি পুলিশ তাঁদের ঠ্যাঙাচ্ছে, আর ক্রীড়া ও সম্প্রচার মন্ত্রী এসে মঞ্চ আলো করে বাণী দিচ্ছেন। তিনি সম্প্রচারের জগৎই বদলে দিচ্ছেন, অনূর্ধ উনিশ ক্রিকেট দলে ছিলেন, পরিচিতিতে এইসব বলা হল। খাঁটি ইংরিজিতে, আহা বেচারি বাংলা বোঝেননা। তিনিও প্রচুর ভালো-ভালো কথা বললেন ভাষণে। মিঠুন আর সত্যজিৎএর একই রকম প্রশংসা করলেন, রবীন্দ্রনাথকে রবিন্দরনাথ বললেন, নিজেরও পদবী ঠাকুর, তবু টেগোর বললেন, উচ্চারণটা শিখে নেবারও প্রয়োজন বোধ করেননি। বললেন অবশ্যই হিন্দিতে, পশ্চিমবঙ্গের সকল মানুষের হিন্দি জানার কথা, আর ওঁরা উচ্চারণ অবধি না জানলেও চলবে, এই বা কে না জানে। ... ...
ভারতীয় এবং পাশ্চাত্য মতে, শুদ্ধ সুর সাতটি। কোমল ধরলে বারোটি। সুর এই বারোটিই কেন, এ নিয়ে ফেসবুকের একটি গ্রুপে একটি প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলাম। সেখানে সংক্ষেপে লিখেছি। পুরো জিনিসটি এখানে লিখে রাখলাম, যদি কারো আগ্রহ থাকে তো পড়বেন। আঁক-টাক কষা আছে। অঙ্ক অপছন্দ হলে এর পরে আর এগোবেননা। আরও একটি কথা এখানে বলে রাখা দরকার। এই পুরো জিনিসটিই মূলত পাশ্চাত্য সঙ্গীততত্ত্বের নানা জায়গায় টুকরো-টাকরা করে পড়েছি। কিন্তু সেখানে অঙ্ক ছিলনা। হয়তো উচ্চতর শাস্ত্রে আছে। কিন্তু আমার বিদ্যে ততদূর গড়ায়নি। এছাড়া সঙ্গীত প্রযুক্তিতেও থাকা উচিত, কিন্তু তার তত্ত্বও আমার খুব কিছু পড়া আছে এমন না। ফলে এখানে যে অঙ্ক কষা হয়েছে, সবটাই আমার নিজের কষা। নিশ্চয়ই এর আগে কেউ কষে ফেলেছেন, কিন্তু জানা না থাকায় কৃতিত্ব দেওয়া গেলনা। আর যদি বাইচান্স না কষে থাকেন, তো আমি নিউটন। ... ...
এক রাজা। বোম্বাগড়ের। যিনি একাই ছাপ্পান্ন। সর্বত্র বিরাজমান, কিন্তু ধরাছোঁয়ার বাইরে। ছবির ফ্রেমে আমসত্ত্বভাজা হয়ে নিজেই ঝুলে থাকেন। বলিউডে তাঁর ছবি দেখা যায়, উত্তরাখণ্ডের গুহাতেও। মোনাকো থেকে রোমানিয়া, ইন্টারনেট থেকে টিভিতে সর্বত্র তাঁর ছবি আছে, কিন্তু সামনাসামনি কোনো সাংবাদিক তাঁকে চোখে দেখেননি। তিনি এমন স্টেশনে চা বেচেছেন, যা আর খুঁজে পাওয়া যায়না, এমন ইউনিভার্সিটি থেকে ডিগ্রি পেয়েছেন, যার খোঁজ করতে গেলে আদালত জরিমানা করে। তাঁকে নিয়ে কটু কথা বললে বিবিসিকেও ঠুসে দেওয়া হয়, তাঁর বিরুদ্ধে পোস্টার মারলে পুলিশ ধরে। তাঁর বিরুদ্ধে কথা বলা মানেই দেশদ্রোহ। কারণ তিনিই দেশ। তিনিই পরমাত্মা। তিনিই পরমেশ্বর। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে নিয়েই লিখেছিলেন, "আমরা বেগুনভাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে"। আজ রাজা আছেন, নিরবধিকাল থাকবেন, রোজ সকালে উঠে নমন করবেন। ... ...
বেশি ভ্যান্তারা করে লাভ নেই। মহারাষ্ট্র থেকে দিল্লি, বিহার থেকে বাংলা, উহাদের ছক একটাই, এবং সেটা খুব পরিষ্কার। সিবিআই-ইডি-গ্রেপ্তার দিয়ে আঞ্চলিক বিরোধী সরকারগুলোকে নড়বড়ে করে দাও। চাপে রাখো। সত্যিই দুর্নীতি থাকলে তো সোনায় সোহাগা, নইলে বানিয়ে নাও। তারপর, চাপে থাকতে-থাকতেই খেলে দাও দাঙ্গার তাস। একে হিটলারি মতে বলা হত ব্লিৎসক্রিগ। ঝটিকা আক্রমণ। নানা জায়গায় ঝড়ের গতিতে শত্রুর সামনের লাইনে ফুটো করে দাও। তারপর সামনে চলো। দেখবে শত্রু নালে-ঝোলে হয়ে পিছনে পড়ে আছে। ... ...
সব মিলিয়ে এ এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। শাসকের বিরুদ্ধে লিখলে, শাসক ক্ষেপে যায়, কখনও উপেক্ষা করে, এ দেখা জিনিস। অনেকবার দেখেছি। শাসক প্রতিবাদের প্রকরণও নির্ধারণ করে দিতে চায়, সেও দেখেছি। কিন্তু বিরোধী, প্রতিবাদ যাদের পক্ষে যাবার কথা, আঙুল উঁচিয়ে, "এইভাবে লিখুন বলছি, চোপ!" বলে চোখ রাঙাচ্ছে, এ জিনিস দেখা একেবারে নতুন। হয় কায়েমী কোনো স্বার্থ, কিংবা নিছক নির্বুদ্ধিতা, কিংবা দুটোই না থাকলে, এ জিনিস হওয়া কঠিন। এর মধ্যে কোনটা ছিল, বলতে পারবনা। কিন্তু এইসবের চক্করে ফাঁকতালে যেটা হল, সেটা হল, বগটুই কান্ডটাই কোথায় যেন হাওয়া হয়ে গেল। বছর খানেক পরে, সে নিয়ে আর কোনো আলোচনা নেই। সিবিআই 'মূল অভিযুক্ত'কে গ্রেপ্তার করেছিল, তিনি হেফাজতেই রহস্যজনকভাবে মারা গেছেন। সে নিয়েও বিশেষ কথাবার্তা দেখিনা। শাসক-বিরোধী কোনো দিকেই। ... ...
সত্যিকারের যুদ্ধই ধরুন। এই এখন একটা যুদ্ধ চলছে। রাশিয়া বনাম ইউক্রেন। সেখানে সৈন্যের অভাব বলে, উভয় পক্ষই প্রাপ্তবয়স্কদের ধরে বাধ্যতামূলকভাবে যুদ্ধে নামিয়েছে। প্রাপ্তবয়স্ক মানে, প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ। মহিলা নয়। কারণ, যুদ্ধ হল সিরিয়াস বিজনেস, সত্যিকারের 'খুনে-মানসিকতা' চাই। সেখানে মেয়েদের জায়গা নেই। আমেরিকায় এই বাধ্যতামূলক যুদ্ধে নামানোর পদ্ধতিটাকে বলে ড্রাফট। যেই আঠারো বছর হল, সমস্ত ছেলেকে সেনাবাহিনীর কাছে নাম লেখাতে হবে, যাতে দরকার হলেই তারা ডেকে নিতে পারে। মেয়েদের এটা করতে হয়না। বিশ্বের যে কটি দেশে এই বাধ্যতামূলক ড্রাফট আছে, তার মধ্যে হাতে-গোণা এক-আধটিই মেয়েদের ডাকে। বাদবাকি পুরোটাই ব্যাটাছেলেদের রাজত্ব। সত্যিই যদি যুদ্ধ বাধে, যেমন বেধেছিল ভিয়েতনামে, আমার ছেলে যুদ্ধে যেতে বাধ্য হবে, ওমুকের মেয়ে হবেনা। ... ...
আমি শিক্ষাবিশেষজ্ঞ নই। এবং আমার দৌড় কলকাতা থেকে সিঙ্গুর অবধি। সেটাও নেহাৎই মধ্যবিত্ত বৃত্তে। সেই বৃত্তে আমি কী দেখছি? আমার পরিচিত বন্ধুবান্ধবরা প্রায় কেউ তাঁদের ছেলেমেয়েদের রাজ্য বোর্ডের ইশকুলে পড়াননা। যাঁরা রাজ্য বোর্ডের শিক্ষক, তাঁরাও না। তার নিশ্চয়ই অনেক কারণ আছে। কিন্তু মোদ্দা কথা হল, কলকাতা থেকে সিঙ্গুর অবধি, এই যে তিরিশ কিলোমিটার এলাকা, স্যাম্পল সার্ভে না করেই বলতে পারি, যে, রাজ্য বোর্ডের ইশকুল গুলো মধ্যবিত্তের প্রথম পছন্দ তো নয়ই, বরং অগতির-গতি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেছে এবং যাচ্ছে। আমরা যে ইশকুলগুলোয় পড়েছি, যেগুলো নামী ইশকুল বলে জেনেছি, সেগুলো সমেত। দুর্নীতি, ইশকুল-বন্ধ করে দেওয়া, এই ব্যাপারগুলো দিয়ে এই দুচ্ছাইকরণ প্রক্রিয়াটাকে ক্রমশ ত্বরান্বিত করা হচ্ছে। ... ...
এইটুকু খালি জানা আছে, যে, শুদ্ধস্বরের সঙ্গে এবার লাগছিল কোমল ধা এবং নি। বেহালা এবং সেতার বাজছিল পরপর। বোঝা যাচ্ছিল, শুরুর স্বর স্রেফ চোখে-ধুলো-দেওয়া উদ্যোগপর্ব ছিল। আসলে সেই শুদ্ধস্বর ছিল প্রস্তুতি, আসলে যা হয়ে উঠবে চারুকেশী। বদলে যাচ্ছিল দৃশ্যায়ন। অনির্বাণ মাঝে-মাঝেই একটু-একটু সুজন হয়ে যাচ্ছিলেন, আর সুজন একটু-আধটু অনির্বাণ। আর নাটকের ঠিক মাঝখানে এসে, দেখা গেল, দুজন শারীরিক ভাবে জুড়ে গেলেন। পিছনে, যদ্দূর মনে করতে পারছি, সেই মুহূর্তেই বেহালা সিম্ফনী হয়ে গেল। সেও ভেঙে দেওয়া চারুকেশীতেই। পাশ্চাত্যে এই স্কেলটার নাম মেলডিক মাইনর। ঝপাঝপ মিলে গেল তারাও। ... ...