এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  উপন্যাস

  • নিউনর্মাল করোনাকালীন পর্ব সাতচল্লিশ

    Anuradha Kunda লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ১৪ জুলাই ২০২৩ | ৩৯৭ বার পঠিত
  • হাওড়ার হাটে ছাপা নাইটি পার পিস একশো কুড়ি। হাতাওয়ালা না। আবার স্লিভলেসও না। শ্যামা যাদের কাছে নাইটি বিক্রি করে তারা হাতাওয়ালা নাইটিও পরে না। স্লিভলেসও পরে না। ম্যাগিহাতার মত সামান্য তিনকোণা বেরিয়ে থাকে কাঁধের থেকে। শ্যামা দেড়শো টাকায় বিক্রি করে। শাড়ি নেয় কিছু তাঁতের। বড়বাজার থেকেও নেয়। পাড়টা ঢালা। দু' শোতে নেয়।আড়াইশোতে বিক্রি করে। একটু ভালো ছাপা। তিনশো পাইকিরি। বিক্রির দাম সাড়ে তিনশো। মাঝে একটু দোকান খুলতে শুরু করেছিল। আড়ালে আবডালে ব্যবসা চালাচ্ছিল সবাই। শ্যামার কিছু সুরাহা হয়েছিল। শুধু মাস্ক বানিয়ে আর স্যানিটাইজার তৈরি করে আর হচ্ছে না। সবাই ঘরে ঘরে বানাচ্ছে। তাছাড়া এখন টিভিতে বলছে সার্জিকাল পরুন। এন নাইন্টিফাইভ পরুন। কাপড়ের মাস্ক আর বড়ঘরে কিনছে না। শাড়ি আর নাইটির সবসময়ই চাহিদা আছে। শ্যামা বেশি করে ঐ দুটো তুলে রাখে। ফুলছাপ নাইটি আর তাঁতের শাড়ি। লকডাউনে, আনলকে বিক্রি হবেই। করোনার সময়ে লোকে কী নতুন কাপড় পরবে না? শ্যামা হনহন করে হেঁটে বাড়ি ঢুকল।

    তিনটি নারীর সংসার এখন বস্তির ঘরে। শ্যামা, হরপ্রীত আর করুণা। টুপুর শ্যামার ঘরেই করুণার থাকার ব্যবস্থা করেছে। বাবলু এই তিন নারীর মধ্যে একটি পুরুষবালক। তার স্কুল নেই। চাল, ডাল, সয়াবিনের প্যাকেট নিতে সে মাসে একবার স্কুলে যায়। মালবিকার বাড়ির জন্য বাবলুর মাঝে মাঝে মন কেমন করে। ঐ বিশাল বাড়িটার আনাচে কানাচে সে ঘুরঘুর করতো। টুপুর তাকে ধরেবেঁধে খানিক পড়িয়েছিল। মামাটা ভালো ছিল বেশ। বাবলুকে দেখে হাসতো।মামী তো ঘুমিয়েই পড়ে থাকতো। ছাতে একা একা ঘুরে বেড়াতো বাবলু। ঐ বাড়ি থেকে চলে আসার পর নিজেদের ঘর ফাঁকা ফাঁকা লাগতো তার। ঠাকুমা নেই। ঘরটায় ফাঁকা তক্তপোষ। বাবলুর ঢুকতেই ভয় করতো। শ্যামা সারাদিন থাকে না। হরপ্রীত থাকে না। দুজনেই ফেরে রাত করে। বাবলুর একা থাকতে ভালো লাগতো না। বস্তিতে ঘুরে বেড়াত। একটু বড় ছেলেরা ধরে বেঁধে দুদিন বিড়িও টানিয়ে দিল। বাবলু ভয়ে কিছু বলতে পারেনি। 

    করুণা আসার পর থেকে বাবলুর চরে বেড়ানো বন্ধ হয়েছে। করোনা নাকী আবার শুরু হয়েছে। আবার লকডাউন হবে।তাহলে বাবলু কী আর স্কুলে যাবে না? অঙ্কের জন্যে একটা পাড়ার ছেলে ঠিক করেছে শ্যামা। সপ্তাহে দু' দিন বাবলু অঙ্ক করে। অন্যান্য সাবজেক্ট একটু বলে দেয়। পাঁচশো টাকা নেয় ধরে তার জন্য।  করুণা আসার পর থেকে বাবলুকে দুপুরে, সন্ধেতে বই হাতে নিয়ে করুণার কাছে বসতে হয়। শ্যামার হুকুম তবে সে বসেই থাকে। বসে বসে ঢোলে আর করুণার হাতের নিপুণ কাজ দেখে।

    কাঁথার ফোঁড় তোলে করুণা। এইসব শাড়ি, কুর্তা পিস যারা কেনে লকডাউনে তাদের উনিশবিশ হয় না। কালো, সাদা, লাল, হলুদে বিচিত্র সব ফোঁড় তুলে যায় করুণা। বাবলু হাঁ করে দেখে।
    শাশুড়ির তক্তপোষটা করুণাকে ছেড়ে দিয়েছে শ্যামা। একটা তোষক আর চাদর করুণা নিজেই এনেছে। তার আত্মসম্মানবোধ অতি প্রখর। সে থাকাখাওয়া বাবদ শ্যামাকে দুহাজার টাকা দেয়। দিনকালের তুলনায় সেটা কিছুই না।তবু দেয়। নাহলে সে থাকবে না। এর চেয়ে বেশি তার ক্ষমতা নেই। তবে শুধু সেলাই করে করুণার পোষায় না। সে লেখাপড়া জানে। শ্যামাকে সে বলেছে বস্তিতে বাবলুর বয়সী কয়েকটা ছেলেমেয়ে জোগাড় করে সে পড়াতে পারবে।  শ্যামা কয়েকজনকে বলেও রেখেছে। এখন বাবলুর জন্য একটা অ্যান্ড্রয়েড ফোন চাই শুধু। এখন সব অনলাইন চলছে। লেখাপড়াও। শ্যামার ফোন নিয়ে টানাটানি করে ছেলে। তার চেয়ে একটা ফোন দেওয়া ভালো।

    ভোটের পর নাকী লকডাউন হবে আবার। শ্যামার ভয় লাগছে। আটদফায় ভোট হচ্ছে এবার। তার আগে জমায়েত হচ্ছে। তাতে করোনা ছড়াচ্ছে না অবশ্য। হাওড়া হাট বসলে ছড়াবেই। সে শ্যামাও বোঝে। তার ধারণা ছিল করোনা একবার হলে আর হয় না। এবার কীসব সেকেন্ড ওয়েভ টয়েভ শুনছে। শ্যামা অত বোঝে না। সে শুধু জানে যে ছেলেটার জন্য বেঁচে তো থাকতে হবে। এর মধ্যে কোচবিহারের দিকে ভোটে গোলাগুলিও চলেছে, শুনেছে শ্যামা। কোন পার্টি আসবে কিছু বোঝা যায় না। ভোটের আগে লোক বাড়ি বাড়ি বলতে শুরু করেছে। শ্যামা একটু এড়িয়েই চলে। আগে জিতুক, তারপর সেদিকে ঢলে পড়বে ঠিক করেছে।

    সন্ধের বেশ খানিকটা পর তিনটি নারীর সংসার বেশ জমে ওঠে। এইসময়টা বাবলু খানিক ছাড় পায়। বিকেলে স্নানের অভ্যেস এখনো যায়নি শ্যামার।  পাঁচটায় স্নানে যায়। তারপর পাইকিরি জিনিস তুলে একবার গা ধোয়। হরপ্রীত খুব ভোরে স্নান করে সকালে বেরিয়ে যায় বলে। একমাত্র করুণা বাড়িতে থাকে ঘর আগলে। বাবলু এখন আগের মত ফ্যানাভাত ডিমসেদ্ধ খায় সকালে।বাবার কথা সে আর জিজ্ঞেস করে না। একবছরে অনেককিছু দেখে ফেলেছে সে। বাবা ছেড়ে চলে গেছে। স্কুল বন্ধ হয়েছে। ঠাকুমা মরে গেছে। শ্যামার করোনার সময়ে তাকে থাকতে হয়েছে হরপ্রীতের মালিকের বাড়ি। তারপর আবার বেড়ালছানার মতো ঘেঁটি ধরে শ্যামা তাকে মালবিকার বাড়ি নিয়ে যায়। এতকিছু একবছরে ঘটে গেলে ছেলেপুলে চুপ মেরে যায়। বড়ো হয় রাতারাতি।বাবলুরও তাই হয়েছে। যেহেতু বাড়িতে বাপ নেই এবং তিনটি নারী নিজেদের মতো করে থাকে, বাবলু কিছুটা নরমধাঁচের। সে ভাত রাঁধতে পারে। মাড় গালতে পারে। একদিন করুণা তাকে মাছের ঝোল রাঁধতেও শিখিয়ে দিল। পাড়াপড়শি তেমন মাথা ঘামায়নি। সুখনলালের না থাকাটা স্বাভাবিক হয়ে গেছে।
    ঘরে ঢোকার আগে পা কচলে ধুলো শ্যামা। মুখ হাত ধুয়ে আঁচল দিয়ে মুছলো।
    ভারি আশ্চর্য একটা কাঁথা বানাচ্ছে করুণা। এটা অর্ডারের কাঁথা। হরপ্রীত অর্ডার দিয়েছে। অমৃতসরে পাঠাবে সে। সবুজ সুতোতে খুদে খুদে ফোঁড়। নানারকমের সবুজ। কাঁচা হলুদ সবুজ। কচি কলাপাতা সবুজ। শ্যাওলা সবুজ। টিয়া সবুজ। সমুদ্র সবুজ। ঢেউ খেলানো শস্য ক্ষেত।  যেন হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। আর শস্য ক্ষেত ঘিরে সারি সারি মাথা। পাগড়ি আছে। পাগড়ি নেই। কাঁথাতে ইতিহাস আঁকা হচ্ছে অন্নদাতাদের।
    শ্যামা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। 
    করুণা সেলাই ছেড়ে উঠবে এখন। কন্ঠার হাড় বার করা মেয়েটার মুখে মায়া আছে বেশ। শ্যামা ভাবে। কথা তো বেশি বলে না মুখে। কিন্তু হাত চলে নিপুণ।
    করুণা পটল বাটা করেছে। রসুনের গন্ধটা আহামরি। ডালসেদ্ধ। আরেকটা টুপুর শ্যামার ব্যাগে টিফিন বাটিতে ঢুকিয়ে দিয়েছে, কুচো মাছের একটা ঝাল।
    হরপ্রীতের একটা ভাজা। তিন নারী ও একটি বালক।
    টিভি চলছে একটু জোরেই। জি টিভি হিন্দি। নীল বসনা সুন্দরী বেতের চেয়ারে বসে আছেন। সামনে হাঁটু গেয়ে সুদর্শন নায়ক। গান হচ্ছে, ও তেরে নয়না !
    শ্যামার মনে হচ্ছে, এ যেন কতদিনের অভ্যেস। দিব্যি আছে এখন সে। তার জীবনে কী সুখনলাল বলে কেউ ছিল আদৌ?
    মিটমিটে টিউবের আলোতে একটি ক্ষণিকের নিরাপত্তা বলয় তৈরি হয়েছে। ওরা চারজন তার উষ্ণতাটুকু গিলে নিতে চাইছে । তীব্রভাবে। ভাইরাস অর নো ভাইরাস। ওদের কিছু যায় আসে না। মানুষের ছোঁয়াটুকু থাকলেই হল।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ১৪ জুলাই ২০২৩ | ৩৯৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে মতামত দিন