এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  উপন্যাস

  • নিউনর্মাল করোনাকালীন পর্ব উনপন্চাশ

    Anuradha Kunda লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ১৮ জুলাই ২০২৩ | ৪১৭ বার পঠিত
  • পর্ব পঁয়ষট্টি

    মোটামুটি একটা ছক কষে ফেলেছে। উড়িষ্যা সম্ভবত ঝড়ে বেশি আক্রান্ত হবে এবার। কিন্ত পশ্চিমবঙ্গের একেবারে দক্ষিণভাগ আম্ফানের রেশ এখনো কাটিয়ে উঠতে পারে নি, ইয়াশ এর তান্ডবের কিছুটা অন্তত তাদের ওপরে এসে পড়বেই। হেমপাড়া, শরৎপাড়া, মিশনপাড়া, দক্ষিণপাড়া। দুহাজারের ওপরে জনসংখ্যা। চারশো 'র বেশি পরিবার। প্রশাসন কিছুটা করছেন।আঞ্চলিক লোকেরাও। মশারি, শুকনো ফল, শুকনো খাবারের স্টক পাঠাবে ওরা আগেই। এক একেকটা প্যাকেট তৈরি হচ্ছে মেধাদের বাড়ির গ্যারাজে। ছাতেও কিছু। এক প্যাকেটে দু কেজি চাল, পাঁচশ ডাল, তিন কেজি তেল, চিনি। এইসব জিনিস প্যাকেট করতে সময় লাগে। রূপম এখন একা করছে। জাহিরের অভাবটা এইসময়গুলোতে স্পষ্ট। হা হা করে একটা খোলা হাসি হাসতো। তাপ্পিমারা জিনস আর সাদার ওপর কালো জেব্রা আঁকা টি পরা জাহিরের দেওয়ালে হেলান দেওয়া অবয়ব। ঝাঁকড়া চুল। ঈষৎ ফোলা চোখ, রাত্রিজাগরণ জনিত। সব অস্পষ্ট দেখতে পায় টুপুর বস্তাতে গুঁড়ো হলুদ, গুঁড়োদুধ, বিস্কিট আর স্যানিটারি ন্যাপকিনের প্যাকেট ঢোকাতে ঢোকাতে।
    জাহিরের চোখদুটো অরিজিৎ সিং এর মতো। লাগতো খানিকটা। চোখদুটো এখন নেই। জাহিরের যদিও দেহদান করা ছিল, কিন্ত শেষ পর্যন্ত ওর শরীরের কী হল কেউ জানে না। ওরা অনেক চেষ্টা করে জানতে পারেনি। ইলিনাও নয়। কেউ জানতে পারেনি। করোনাকালের এইটিই এক বৃহৎ ট্র্যাজেডি। শরীর তো সেই সর্বভূতেই যায়। ছাই। একহয় আগুনে। না হয় মাটিতে। তবু শেষযাত্রায় তাকে একটু সাজিয়ে দিতে ইচ্ছে করে।
    অথচ মৃত্যুর পরে শরীরে কোনো ভাইরাস থাকে না। কিন্ত ভয় থাকে। কেমন অদ্ভুত আতংক যেন তৈরি হয়েছে। জাহিরের স্বপ্নালু চোখ, খুব টানা ভ্রূ যেটা পুরুষের মধ্যে কম দেখা যায়, লম্বা আঁখি পল্লব, হাতের তিল সমস্ত মনে পড়লেই বিকল হয়ে যাচ্ছে ও। ইলিনা আন্টির কথা ভাবে না ও। ভাবতেই পারে না। যায় মাঝে মধ্যেই। তারপর মন থেকে কাট অফ করে দেয়। দম আটকে যায়।
    ও বাড়িতে জাহিরের কোনো ছবি নেই। ভাগ্যিস নেই। একজন কখনো দুজন আয়ার ভরসায় ইলিনা। প্রায় সারাদিন শুয়ে থাকেন। শবদেহ যেন। টুপুর বেশি কাছে যায়না। বাইরের পোশাক। ইচ্ছে করে গিয়ে ইলিনার হাতটি ধরে। ধরে না। একটা টুল নিয়ে দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে থাকে।
    যেমন এখন আছে। গ্যারাজে। প্যাকিং করতে করতে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ব্ল্যাংক হাতে ভরতে থাকে নুন। চিনি।
    কে বেঁচে থাকবে, কে থাকবে না, কতক্ষণ বেঁচে থাকবে কিচ্ছু জানা নেই।
    আরো একবার ঝড় এলে হুগলি নদী নোণাজলে ডুবে যাবে। ফ্লাড শেল্টার তৈরি হতে শুরু হয়েছে আবার। এই মানুনগুলির অভ্যেস হয়ে গেছে বাড়িঘর ডুবে গেলে শেল্টারে চলে যাওয়া। পরিবার, গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি সব কিছু নিয়ে উঠে যাবে। কিছু মরবে। কিছু টিকটিক করে বাঁচবে। রূপম একটা ঝাঁকুনি দেয় ওকে।
    অন্যদিকে পাঠাতে হবে মনকে। রিমোট কোথায়? হাতড়াচ্ছে ও। মালবিকাকে ঠিকঠাক দেখাশোনা করতে হবে। ঈশান আছে। দাদা। তার শরীর এখনো সম্পূর্ণ সুস্থ নয়। পোস্ট কোভিড ইফেক্ট থেকে গ্যাছে। ত্রিদিব। বাবাকে বাড়ি নিয়ে আসতে হবে।
    ভাবো। চিন্তাকে ইমিডিয়েটের মধ্যে কনফাইন করো। মাইন্ডফুল থিংকিং। ওনলি রেমেডি।
    আর কী কী করতে হবে? হিঙ্গলগন্জে জাহিরদের সেই বিশাল বাড়ি। দাদু। পাশে ঈদগাহর মাঠ। আর কখনো কী সেখানে যাওয়া হবে? রূপমের মুখটা পাল্টে জাহিরের মতো হয়ে যাচ্ছে কেন!
    বাড়িতে আপাতত দুটো তিনটে জরুরি কাজ। ফ্রিজ থেকে জল গড়াচ্ছে অবিরত।মেকানিক ডাকতে হবে। হলঘরের ডেস্কটপ অচল। সেটা ঠিক করালে মালবিকা অন্তত অনলাইনের ক্লাস নিতে পারবেন। মালবিকার ল্যাপটপ আপাতত দেবরূপের দখলে। তার নিজের ল্যাপটপ সর্বদা ঘাড়ে থাকে। ত্রিদিবেরটা পড়ে আছে। কিন্ত সেটা মালবিকার হাতে দেয় না টুপুর। যদি কিছু অপছন্দের চোখে পড়ে! মা কে আগলে রাখে সে। সে নিজেই এখন পক্ষীমাতা।তার অন্যমনস্ক হলে চলবে না। ইলিনা আন্টি শুয়ে থাকুন। দুচোখ ফ্যানে নিবদ্ধ। হাত বুকের কাছে। পাশে একটা কোলবালিশ। মাঝে মাঝে তার ওপর হাতটা আছড়ে পড়ে।
    পড়ুক।টুপুর ভাববে না।
    তোমার ওপর নাই ভুবনের ভার। ঈশান মাঝেমাঝেই বলে। প্যাকিং চলুক।
    জাহির একটা অ্যাপ বানাচ্ছিল। ডিজিটাল লার্ণিংএর। সাবজেক্ট ওরিয়েন্টেড।
    - তুই এইসব করছিস কেন জাহির? এগুলো তোর আমার মতো খাতাপিতা ঘরে মানায়। আমাদের ক' টা ছেলেপিলে এগুলো অ্যাফোর্ড করতে পারবে?
    - যারা পারবে তারা তো করুক। ভাই কিছু তো হোক।
    - ডোন্ট্যু থিংক ডিজিটাল লার্ণিং ইজ বেসিক্যালি ডিজিটাল ডিভাইড? তুই মানিস না প্রতীচি ট্রাস্টের রিপোর্ট?
    জাহির ওর অরিজিৎ সিং এর মতো চোখ তুলে বললো, না।
    বাহাত্তর পাতার রিপোর্ট বেরিয়েছে।অমর্ত্য সেনের প্রতীচি ট্রাস্টের। কিন্ত এটাও কলকাতা বেসড। সারা পশ্চিমবঙ্গ মানে শুধু কলকাতা ! দুহাজার কুড়ির এপ্রিল থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সার্ভে ভিত্তি করে রিপোর্ট। প্রাইমারি স্কুলের চল্লিশ শতাংশ ছেলেমেয়ে অনলাইন ক্লাস করতে পারেনি।
    ডিজিটাল ডিভাইডের দুটি কারণ দেখিয়েছেন ওঁরা। শিক্ষকরা। যাঁরা রিপোর্ট পেশ করেছেন।
    অ্যাফোরডেবিলিটি। আর নিয়মিত অ্যাক্সেসিবিলিটি। আনইটেরাপটেড ডেটা কী পাওয়া যাবে এদেশে যে ছেলেমেয়েরা পড়বে? ন্যাশনাল রিসার্চ কোঅর্ডিনেটর সাবির আহমেদ বলেছেন। কলকাতাতেই যদি এই হাল হয় তবে গ্রামে গন্জে কী হবে? আগে মিসিং ছেলেমেয়েদের এনরোলিং হচ্ছিল। এখন স্কুল মিসিং।
    - তুই ভাবিস না ইনস্টিটিউশনাল লার্ণিং খুব জরুরি? আমরা তো নিজেরাও সেই সিস্টেমের প্রডাক্ট।
    জাহিরের মুখ আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে সার্ফের প্যাকেটে। রাশীকৃত। জাহিরের মুখটা বাবলুর মতো হয়ে যাচ্ছে। শ্যামার ছেলে বাবলু। আজকাল ফ্যা ফ্যা করে ঘোরে নাকী।
    সেকেন্ড ওয়েভ পঞ্জাবে পিকে গেছে।তারপর মহারাষ্ট্রে। সূত্রার গাণিতিক মডেল বলেছে মিড এপ্রিলে চরমে পৌঁছাবে ইনফেকশন। পনেরো তারিখের পর।
    ওরা কী সব জানে ? মণীন্দ্র আগরওয়াল। আই আই টি। কানপুর। ইনফেকশন ট্র্যাজেকটরি দেখিয়েছেন।
    কক্ষপথ। সংক্রমণের পথ থাকে।সেই পথ ধরে মহাকাল এলো।
    বাবলুর মুখটা আবার পাল্টে রূপমের হয়ে গেছে।
    কী রে ! বারবার কী হচ্ছে তোর? নিউজ আপডেট দেখ। 

    শঙ্খ ঘোষ নেই !
    আজ একুশে এপ্রিল।
    টুপুর কিছু বললো না। তাকিয়ে আছে।
    সব মুখগুলো পাল্টে যাচ্ছে কেন? কে নেই? আজ কত তারিখ?
    রূপম দেখলো, ও বিড়বিড় করছে।
    -  পিতল মুখে শূন্যে ঝোলে সূর্য সারা দুপুর
    ঘরেতে তার তাপ পৌঁছায়, জ্বর হয়েছে খুকুর।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ১৮ জুলাই ২০২৩ | ৪১৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে মতামত দিন