এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • শাপলা আর বালিহাঁসের খোঁজে

    Lama
    অন্যান্য | ২৩ মে ২০১২ | ৪২০২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Lama | 127.194.243.134 | ২৩ মে ২০১২ ০২:০৬552408
  • ছোটবেলার প্রায় সব গল্পই আমাদের দুই ভাইয়ের। কিন্তু একটা সময় ছিল যখন আমরা দুজন ছিলাম না। যে মূহুর্ত থেকে আমার স্মৃতি শুরু হয়েছে ঠিক সেই সময় আমি একটা বাঁশের কঞ্চি হাতে আমাদের কোয়ার্টারের পাশের একটা নাম না জানা গাছের ঝোপে দাঁড়িয়ে কি যেন বিড়বিড় করছিলাম। সামনের দীঘিতে অনেক শাপলা ফুল ফুটেছিল। সময়টা বোধ হয় দুপুর হবে। জেলখানার পাঁচিলটার দিকে তাকানো যাচ্ছিল না- চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছিল। আমি যে গাছগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে আছি তাদের পাতাগুলো সবুজ হলেও বোঁটাগুলো কালচে বেগুনি।

    ঝুমাদিদিদের বাড়ির সামনে দিয়ে একটা সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে কে যেন নিয়ে যাচ্ছিল। বাবা অফিস থেকে ফেরার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। একটা শনশন আওয়াজ হচ্ছিল। বাতাসের আওয়াজই হবে হয়তো- এত বছর পরও কানে লেগে আছে।

    সেদিনের পর থেকে স্মৃতিগুলো সব ছেড়াঁ ছেড়াঁ। সেসব সময় নিয়ে অজস্র লিখে ফেলেছি। তবু অনেক কিছুই লেখা হয়নি।

    লম্বা ট্রেনিং শেষ করে অন্য শহর থেকে মায়ের ফিরে আসা, মাকে দেখে আমার চিনতে না পারা এবং তজ্জনিত মায়ের চোখের জল মনে আছে। মনে আছে মায়ের নিয়ে আসা বই থেকে আমার প্রথম অক্ষর পরিচয়- সি ফর ক্যাট। মায়ের বাড়িআসার কদিন পর দিদার ফিরে যাওয়া। “ভাই আসবে” “ভাই আসবে” করে আমার উত্তেজনা। হঠাৎ এক সকালে উঠে মা-কে দেখতে না পেয়ে প্রথম মনখারাপ। কদিন পর বাবার হাত ধরে একটা ওষুধ ওষুধ গন্ধওয়ালা সাদা রঙের ঘরে ভাই দেখতে যাওয়া।

    তারপর থেকে স্মৃতিগুলো সবই অটুট। নিজের চার বছর বয়েসের জন্মদিনে কে কে এসেছিল আর কি কি খাওয়া হয়েছিল সব পুঙ্খানুপুংখ মনে আছে। সত্যিকথা বলতে কি, সেই থেকে অনেক কিছু একটু বেশিরকমই মনে আছে- মাঝে মাঝে নিজেরই আশ্চর্য লাগে।

    দীঘির পাড়ে টিলার ওপর সেই বাড়ি ছেড়ে এসেছি অনেককাল। প্রায় চল্লিশ বছর কত ঘুরলাম, কত দেখলাম। অর্ধেক পৃথিবী তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াল জীবন। আর চল্লিশ বছর স্বপ্নে ঘুরেফিরে গেল কত শাপলা ফুল, কালচে বেগুনি ডাঁটাওয়ালা সবুজ পাতা, বালিহাঁস আর একটা শনশন আওয়াজ- সম্ভবতঃ হাওয়ার।

    তারপর আর যাওয়া হয়নি। একটা বিয়েবাড়িকে উপলক্ষ্য করে এতদিন পর একটা সু্যোগ এসে গেল পুরনো শহরে একবার ফিরে যাবার।

    গেলাম। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, খুঁজতে খুঁজতে ঠিক সেখানেই গিয়ে হাজির হলাম। অনেককিছুই তো পালটে গিয়েছে, পুরনো মানুষরাও কেউ আর নেই যে রাস্তা চিনিয়ে দেবে।

    তবু গেলাম। খুঁজে বার করলাম। সেই দীঘির ধারে, সেই টিলার ওপর দাঁড়িয়ে তাজ্জব হয়ে দেখলাম সেই শাপলা ফুল আজও আছে। সেই কালচে বেগুনি বোঁটাওয়ালা গাছও। আর পরিষ্কার বুঝে গেলাম, শনশন আওয়াজটা হাওয়ারই।

    এই টইতে এবারের এই ফিরে যাওয়াটাকে ধরে রাখার ইচ্ছা রইল।
  • Abhyu | 138.192.7.122 | ২৩ মে ২০১২ ০২:১৪552425
  • লেখো - তোমার লেখা পড়তে ভালো লাগে।
  • hu | 22.34.246.72 | ২৩ মে ২০১২ ০২:২২552436
  • অসাধারন!
  • Tim | 108.249.6.161 | ২৩ মে ২০১২ ০২:২৪552447
  • বড়ো ভালো কাজ শুরু করলো। লামাদার মাথায় স্বর্গ হইতে পুষ্পবিষ্টি হবে।
  • ঝিকি | 229.83.85.197 | ২৩ মে ২০১২ ০৮:৪৪552458
  • ল্যামিদা কেয়বাত!
  • aranya | 154.160.98.31 | ২৩ মে ২০১২ ০৯:৩৩552469
  • জাদুলেখনী লামার,সরস্বতীর আশীর্বাদধন্য।
  • r2h | 78.46.93.195 | ২৩ মে ২০১২ ১১:৩০552480
  • .
  • Tim | 108.249.6.161 | ২৩ মে ২০১২ ১১:৩৭552491
  • হুতোদার শ্বেতপত্র? ;-)
  • | 24.96.65.234 | ২৩ মে ২০১২ ১৪:২৫552502
  • না না সবে জন্মেছে তো, এখনও কথা ফোটে নাই।
  • ঝিকি | 229.83.85.197 | ২৩ মে ২০১২ ১৪:২৭552409
  • হুতো ল্যামিদার কাজিন না?
  • kumu | 132.160.159.184 | ২৩ মে ২০১২ ১৪:৩২552416
  • কাজিন নয়,ভাই।
    হুতোই জন্মাল।
  • ঝিকি | 229.83.85.197 | ২৩ মে ২০১২ ১৪:৩৮552417
  • আমি জানতাম জ্যাঠতুতো-খুড়তুতো ভাই ☺
  • Lama | 127.194.229.17 | ২৪ মে ২০১২ ০০:০১552418
  • বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছি। আর কি করব তাই ভাবছি। পাশবালিশের ওয়াড়ের মুখে যে ফিতের ফাঁসটা আছে ওখানে একটা গিঁট পাকিয়ে দিলে হয় না? গিঁটটা পাকাতেই আরো একটা ফাঁস নিজে থেকে গজিয়ে গেল।। তখন খুব মজা হল। গিঁটের পর গিঁট লাগিয়ে চলেছি। হঠাৎ দেখি বাবা দাড়ি কামানো থামিয়ে হাসি হাসি মুখ করে আমার দিকে তাকিয়ে। আমাকে দেখে হাসল কেন বাবা? ভ্যাঁ।

    খুব নিবিষ্টমনে নিচের দিকে তাকালে বাদামি রঙের গম্বুজের মত কি একটা ঝাপসা চোখে পড়ে। কয়েকদিন ধরে বোঝার চেষ্টা করছি, জিনিসটা কি। একদিন বুঝতে পারলাম, ওটা আমার নিজের নাক।

    দীঘির জলে কেমন ঢেউ দেয়। ঢেউ দেখে দেখে বেলা কেটে যায়। দূরের জলকে কে যেন চিমটি কেটে দেয়। জলটা তখন ভাঁজ হয়ে যায়। ভাঁজটা আমার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। তারপর কখন যেন অন্য ভাঁজগুলোর সঙ্গে মিশে যায়। চেষ্টা করলে আমি ভাঁজ হতে পারব না ওরকম? বেশ মজা হবে।

    ডাইনিং টেবিলে বাবা। বাবার চেয়ারের ওপর বাবার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে আমি। পাশের ঘরে কারা যেন কাঠের টুকরো কাটছে। "ওয়্যারিং" কথাটা শোনা যাচ্ছে। আমাদের বাড়িতে নাকি কারেন্ট আসবে। কারেন্ট আসা মানে কি? যখন আসবে তখন দেখা যাবে।

    খুব আরামের একটা ঘুম ঘুমোচ্ছি। যেন অনেক দূর থেকে কয়েকটা গলা ভেসে আসছে "শঙ্খ, উঠ। উঠ। দেখ কে আইসে।"। খুব বিরক্ত লাগছে। যেই আসুক, আমাকে কেন উঠতে হবে। ঘুমটা আস্তে আস্তে ভেঙ্গে গেল। সামনে কয়েকটা চেনা মুখ- বাবা, দিদা, কর্মপিসি। সবার মুখ হাসি হাসি। দেখে মনে হচ্ছে সবাই চাইছে আমি কিছু বলি। একটা অচেনা মুখও আছে- কপালে টিপ। অচেনা মুখটাই সবচেয়ে উৎসুক- যেন আমি কি বলব তার ওপর মরণবাঁচন নির্ভর করছে। । না, ঠিক অচেনা নয়, আমি যখন শুধু শুয়ে থাকতাম তখন আমাকে কোলে নিত। এতদিন কোথায় ছিল? তীব্র অভিমান (প্রথমবার)। ভ্যাঁ

    টিপ পরা মুখটার চোখদুটো জলে ভরে এল। আর আমার মনে পড়ে গেল কবে যেন, কখন যেন আমি "ম্ম ম্ম ম্ম " করে এই মুখের মালিককে কিছু বলার চেষ্টা করেছিলাম।
  • hu | 22.34.246.72 | ২৪ মে ২০১২ ০০:১০552419
  • লামাদার হাত সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে দেওয়া হোক।
  • পাই | 138.231.237.4 | ২৪ মে ২০১২ ০০:১৪552420
  • সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে দিলে টাইপ করতে অসুবিধে হবেনা ?

    চলুক ! ঃ)
  • hu | 22.34.246.72 | ২৪ মে ২০১২ ০০:১৭552421
  • প্রথম দেখার স্মৃতি তো কারোর থাকার কথা নয়, তাই না? আমারও নিশ্চয়ই নেই। তবু মাঝে মাঝে মনে পড়ে একটা জানলা। যেন জানলার থেকে কিছুটা নিচে কোথাও শুয়ে আছি। তাই তেরছা মত একফালি আকাশ দেখা যায় সাদাটে রঙের। আমাদের বাড়ির জানলা নয়। দিদার বাড়িরও নয়। কে জানে কোথায় দেখেছিলাম!
  • hu | 22.34.246.72 | ২৪ মে ২০১২ ০০:১৮552422
  • বেশ তো! তালে সোনার টাইপরাইটার হোক।
  • Abhyu | 107.81.100.31 | ২৪ মে ২০১২ ০৮:৪০552423
  • সেই মনে পড়ে ছমাস পরেও ঐশ্বর্যা কেমন মাকে চিনে বিস্কুট খাওনোর চেষ্টা করেছিলো?
    লেখো, লামাদা।
  • একক | 24.99.234.252 | ২৪ মে ২০১২ ০৯:০৯552424
  • বাহ , বেশ নরম রঙের গদ্য. কন্ঠী ঘুঘুর তলপেটের মতো . আবার এসে পড়ব.
  • Lama | 127.194.239.137 | ২৫ মে ২০১২ ১৯:১০552426
  • এই জায়গাটার নাম কি যেন? চেনা চেনা লাগছে।

    বাগমা।

    হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে। এসব জায়গা পুরো জঙ্গল ছিল।

    আপনি তো অনেকদিন পর যাচ্ছেন দাদা, আমি তো ছোটবেলা থেকে এরকমই দেখছি।

    ওই ভাঙ্গা মাটির বাড়িগুলোর পাশ দিয়ে যাবার সময় একটু আস্তে কোরো তো, ছবি তুলব। এগুলো তো আমি ছোটবেলা থেকেই দেখছি। এতদিন কি করে টিঁকল? আশ্চর্য।

    একগুলো সেই বাড়িগুলো নয় দাদা। সেবারের দাঙ্গার পর গ্রামটা আবার তৈরি হয়েছিল। দু বছর আগে একবার দাঙ্গা হয়। তখন আবার পুড়িয়ে দিয়েছে।

    গোলমাল তাহলে এত বছরেও থামে নি।

    অনেক কমেছে। ঐ দেখুন টিলার মাথায় সি আরপি ক্যাম্প।

    হুমমম। আগের বার দাঙ্গা হয়েছিল উনিশশো আশিতে। বেশ কয়েকদিন ধরে দাঙ্গা চলার পর মিলিটারি নেমেছিল।

    ও বাবা। আমি তখন জন্মাই নি।

    এরপর গোকুলপুর আসছে, তাই না?

    হ্যাঁ। আপনার তো বেশ মনে থাকে।

    তা থাকে। দেখবে বাড়িটা ঠিক খুঁজে বার করে ফেলব।

    ওকি দাদা, আবার সিগারেট? বুঝেছি।

    কি বুঝলে?

    এত বছর পর ছোটবেলার বাড়ি দেখতে পাবেন, তাই এক্সাইটেড।

    ধরেছ ঠিক। তুমি কি পড়াশোনা এদিকেই করেছ?

    পড়াশোনা বেশি করা হয়নি দাদা। টেন পাশ। ক্লাস সিক্স পর্যন্ত এখানে। তারপর শিলঙে পড়তে পাঠিয়েছিল বাবা। উল্টোপাল্টা বন্ধু জুটিয়ে ফেললাম। তাই বাবা ফিরিয়ে এনে ড্রাইভারিতে লাগিয়ে দিল। এই গাড়িটা আমার বাবারই।

    শিলং খুব সুন্দর জায়গা। আমার মাসির বাড়ি ছিল।

    অনেক বছর পর শিলং গেলে আমারও এরকম লাগবে। মানে আপনার এখন যেরকম লাগছে।

    তোমার এখনকার কাজটা তোমার ভালো লাগে?

    হ্যাঁ হ্যাঁ। আসলে আমি মাত্র ক্লাস টেন পাস হলেও শিলঙে কিছুদিন ছিলাম তো। ইংরেজিটা বলতে পারি। আর ব্র্যান্ডেড জামাকাপড় পরি দেখতেই পাচ্ছেন। গাড়ি চালিয়ে বাবার কাছে ভালই টাকা পাই। আপনাদের থেকে আমার লাইফস্টাইল খুব একটা আলাদা নয়।

    হেহেহে। আমি আবার ইংরেজিটা বলতে পারি না।

    ঠাট্টা করছেন দাদা। আপনারা আইটি লাইনে আছেন, মাঝে মাঝেই বিদেশ যান। ওখানে গিয়ে বাংলা বলেন না নিশ্চোয়।

    আরে দুর। আমি আমেরিকা মাত্র একবার গেছি। আর আসলে পৃথিবীর প্রায় সব দেশে আমার কিছু না কিছু বন্ধু আছে। আমেরিকাতেও আছে। দোকানবাজারে আমার কথাগুলো তারাই বলে দেয়। আমাকে আর কষ্ট করে ইংরেজি বলতে হয় না।

    নদী এসে গেল দাদা।
  • সিকি | 132.177.245.52 | ২৫ মে ২০১২ ২১:২২552427
  • নিনা | 22.149.39.84 | ২৫ মে ২০১২ ২২:৪৯552428
  • উফ! বক্স রহস্য ভেদ না করাতে ও মেয়ের বিয়ের ব্যস্ততাতে আমার এই সোনার খনির সন্ধান পেতে দেরী হল----লামার হাতে সত্যি জাদু---সোনা লাগবে কিসে লামার বলা কথা যা শুনি তাই সোনা হয়ে যায়!
  • pepe | 175.91.215.154 | ২৬ মে ২০১২ ০০:৩৪552429
  • অসাধারণ
  • ranjan roy | 24.96.231.191 | ২৬ মে ২০১২ ২০:২০552430
  • গন্ধ, নাম-না-জানা কিন্তু ছোটবেলার চেনা মন কেমন করা গন্ধ লামার লেখায়, চলুক।
  • Debashis | 99.147.0.175 | ২৭ মে ২০১২ ১৬:৩৩552431
  • অসাম বস! গরুমারা থেকে ফিরেও কিছু লিখ ঃ)।
  • Lama | 127.194.237.69 | ৩০ মে ২০১২ ১৭:২৪552432
  • আস্তে আস্তে মনে পড়ে যাচ্ছে সবই। আরেকটু এগিয়ে একটা টিলা পড়বে। ওপরে যাবার একটা পায়ে চলা পথ আছে। টিলার ওপর কিসের যেন কয়েকটা সরকারি কোয়ার্টার, একতলা, টিনের চালওয়ালা ইঁট সিমেন্টের দেয়াল। এগুলোর মধ্যে একটাতে গিয়েছিলাম এক সন্ধ্যাবেলায়, মা বাবা, সপরিবারে অশোককাকু, কর্মকারজেঠু এঁদের সঙ্গে। দূরত্বটা যাদবপুর এইট বি থেকে থানা পর্যন্ত যতটা, ততটাই হবে- হেঁটেই গিয়েছিলাম। তখন বেশ হাঁটতে পারতাম। এদিকে আমার মেয়েটা একদম হাঁটতে চায় না। কিসের একটা নেমেন্তন্ন ছিল মনে আছে। উপলক্ষ্যটা কখনোই আমাদের জানানো হয় নি। আমার ধারণা, কারো বিবাহবার্ষিকী ছিল।

    টিলার পর আসবে নদী। নদীর ওপর ব্রিজ। কংক্রিটের সেতু, কিন্তু মাঝখানে দুটো জায়গায় লোহার পাত দিয়ে জোড়া আছে- গাড়ি গেলে ঢংঢং আওয়াজ হয়। ছোটবেলায় পিসির কাছে শুনেছিলাম কি সব মিলিটারি ব্যাপার আছে, যুদ্ধের সময় খুব অল্প সময়ের মধ্যে ব্রিজটাকে নেই করে দেওয়া যায়। দাঙ্গার পর ট্যাংক নেমেছিল। আমি তখন ক্লাস টু-তে পড়ি। ব্রিজটা খুব দুলেছিল।

    ব্রিজের ওপর উঠে ডানদিকে তাকালে চোখে পড়বে নদীর ওপর অনেকখানি জায়গা জুড়ে একখানা বালির চড়া- ধবধবে সাদা। যদি সবকিছু খুব পাল্টে না গিয়ে থাকে, তাহলে সেই চড়ার ওপর থাকবে বাঁশের তৈরি একটা ভাঙ্গাচোরা ঘর। আর নদীতে বাঁশের আঁটি ভাসিয়ে নিয়ে যাবে হেঁটো ধুতি পরা দীনহীন চেহারার কিছু লোক। ডানদিকে আরো দূরে আবছা একটা জলের ট্যাঙ্ক, তার চেয়েও দূরে একটা জঙ্গলের আভাস।

    এই নদীর ধারে বিকেলে হাঁটতে আসতাম। সাঁতার শেখার একটা ব্যর্থ চেষ্টাও হয়েছিল। একবার নদীর ধারে বিশাল একটা গোসাপ ধরা পড়েছিল, অনেকেই ভেবেছিল কুমীর। দাঙ্গার সময় নদীর ওপার থেকে মাঝে মাঝে হইহল্লা ভেসে আসত। সন্ধ্যেবেলায় আকাশে আগুনের লাল আভা। ১৪৪ ধারা জারি হত। মাইকে ঘোষণা হত "গুজবে কান দেবেন না, গুজব ছড়াবেন না।"। তবু মাঝে মাঝেই কারা যেন যখন তখন "আসছে রে" বলে চেঁচাত, আর কে আসছে না জেনেই স্থানীয় ছাপোষা লোকজন সুটকেস-ট্রাঙ্ক মাথায় করে ছুটত আর আছাড় খেয়ে পা মচকাত। মা শিখিয়ে দিয়েছিল, কেউ যদি সত্যিই আসে তাহলে যেন আসলামের পুকুরপাড়ে আনারসের ঝোপ বা পাটক্ষেতে লুকোই। সেই অশান্ত সময়ে একবার বিকেলে বেড়াতে গিয়ে নদীর জলে ভাসমান একটি কবন্ধ দেখার পর, বাবার কড়া নির্দেশে বিকেলের বেড়ানো বন্ধ হয়।
  • Lama | 127.194.234.206 | ৩০ মে ২০১২ ২০:৫১552433
  • এই নদী কোথা থেকে আসছে, আর কোথায় যাচ্ছে- এই নিয়ে কৌতূহল আমাদের বরাবরের। নৌকো করে যখন পিকনিকে যেতাম তখন ভাবতাম, আরেকটু এগিয়ে বা পিছিয়ে গেলেই তো নদীর উৎসটায় পৌঁছে যাওয়া যায়। শুধু বাবার একটু সহযোগিতার অভাবে সেটা কোনোদিন হয়ে উঠল না। বড় হয়ে বইতে পড়েছি- নদীটা শুরু হয়েছে ডম্বুর নামে একটা জলপ্রপাত থেকে, আর শেষ হয়েছে বাংলাদেশের মেঘনা নদীতে গিয়ে। কিন্তু সম্প্রতি উইকিম্যাপিয়াতে নদীর গতিপথ ধরে যেতে যেতে দেখলাম অনেকগুলো বাঁক ঘুরে একটা গভীর জঙ্গলের মধ্যে হারিয়ে গেছে নদী। হয়তো আমিই কোথাও ভুল করছি- খোঁজাটা ঠিকঠাক হচ্ছে না।

    ব্রিজ পেরিয়ে দুটো রাস্তা। একটা উঁচু, হাইওয়ে মত- সোজা চলে গেছে। অন্যটা বাঁ দিকে ঢালু হয়ে নেমে গেছে। আমি যাব উঁচু রাস্তাটা ধরে। ব্রিজের ঠিক শেষেই, একটু নীচু জমিতে একটা বটগাছ। বটগাছের পাশে একটা একতলা ইঁটের ঘর, টিনের চাল। ওটা একটা ক্লাবঘর। এই বটগাছের গায়ে তাপ্পিমারা পর্দা টাঙিয়ে সাদাকালো সিনেমা দেখানো হত আমাদের ছোটবেলায়। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দুটোই সিনেমা- সম্পূর্ণ রামায়ণ আর ঝনক ঝনক পায়েল বাজে।

    উঁচু রাস্তাটা ধরে কয়েক পা যেতে না যেতেই বাঁদিকে একটা স্কুল যার ইউনিফর্ম ছিল ক্যাটকেটে সবুজ জামা আর সাদা প্যান্ট, যেখানে আমি একদিনই মাত্র গিয়েছিলাম আর ডানপিটে ছেলেদের হাতে হেনস্থা হয়ে কেঁদেকেটে পিঠটান দিয়েছিলাম। উঁচু রাস্তাটার পাশ ঘেঁষে চলে গেছে একটা খাল। আর সেই খালের ওপর মাটি ফেলে যে যার নিজের বাড়ি যাবার জন্য ঢালু রাস্তা বানিয়ে নিয়েছে। তার ফলে খালটা আর খাল নেই, উঁচু রাস্তা বরাবর যেদিকে দুচোখ যায় ছোট ছোট পুকুরের রূপ নিয়েছে। দাঙ্গার সময় যখন রক্তমাংসে নদীর জল দূষিত হয়ে উঠল, তখন সরকার থেকে নদীর জলে স্নান করতে বারণ করা হল। সেই সময়টায় দুজন লোক দুটো বাচ্চা হাতিকে নিয়ে এসেছিল আমাদের বাড়ির সামনের পুকুরটায় স্নান করাতে। বড়রা সবসময় যা করে থাকে- হাতির দাপাদাপিতে রাস্তার ক্ষতি হচ্ছে, এই অপরাধে হাতিদের স্নানে বাগড়া দেওয়া হল। আর আমরাও অতি চমৎকার একটা অন্য ধরণের সার্কাস দেখা থেকে বঞ্চিত হলাম।

    স্কুলটা দেখতে পেলেই কেল্ল ফতে। স্কুলের ঠিক উল্টো দিকে যে ঢালু রাস্তাটা, ওটাই ছিল আমাদের বাড়ি যাবার রাস্তা।
  • Lama | 127.194.234.206 | ৩০ মে ২০১২ ২১:১৫552434
  • এই হাইওয়েটা হচ্ছে ঠিক সেই রাস্তা যেটা যুগে যুগে আমাদের দু ভাইয়ের মত কত ছেলের কল্পনাকে নাড়া দিয়েছে। কত কবি সাহিত্যিক এই রাস্তাটাকে নিয়ে কত কান্ডকারখানা করেছেন। কেউ তেপান্তরের মাঠে নিয়ে গেছেন, তো কেউ সোজা এই পথ বেয়ে চাঁদের বুড়ির কাছে পৌঁছে গেছেন।

    এই রাস্তা দিয়ে ট্রাক্টর যায়। যায় 'পাওয়ার টিলার' (কম ক্ষমতার ট্রাক্টর বা কলের লাঙ্গল- দু চাকার ঠেলাগাড়ির মত) যাকে আমরা বলি 'ঠ্যাকেঠ্যাকে'। মাঝে মাঝে যায় শুওর বা ভেড়ার পাল। অনেক মাইল দূরে কোথায় খনিজ তেলের খোঁজ পাওয়া গেছে, তার কাজ করতে যায় অতিকায় সব ড্রিলিং মেশিন। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের পোষা হাতি যায়, ভোটের সময় মিছিল যায়। আমরা দৌড়ে দৌড়ে সব দেখতে যাই। আমাদের চোখে সবচেয়ে আকর্ষনীয় হচ্ছে ভ্যাঁপোর ভাঁপোর ব্যান্ড বাজিয়ে বিয়েবাড়ির শোভাযাত্রা যাকে কোনো অজ্ঞাত কারণে আমরা বলি 'বদ্ধলোকের মিছিল'। এটা যখন যায় তখন বড়রাও কৌতূহলী হয়ে ওঠে, কিন্তু কৌতূহলটা লুকনোর চেষ্টা করে। আর দাঙ্গার পর গিয়েছিল এক ঝাক ট্যাঙ্ক- খড়খড় ঝনাৎ ঝন আওয়াজ তুলে।
  • শ্রাবণী | 134.124.244.107 | ৩১ মে ২০১২ ১০:১৬552435
  • দেখতে গেলে দুটো রঙের সুতো জড়িয়ে জড়িয়ে বোনা, তাতেই কোথায় যেন রামধনুর আভাস.....! খুব ভালো লাগছে।
  • Lama | 127.194.232.17 | ৩১ মে ২০১২ ২৩:১৩552437
  • সেই টিলাটা এসে গেল। পায়ে চলা রাস্তাটা আগের মতই আছে। কোয়ার্টারগুলোও আছে, তবে নতুন রং হয়েছে।

    তারপর ব্রিজ। ব্রিজের মাঝামাঝি দু জায়গায় লোহার পাতের জোড়- আছে। নদীর বুকে সাদা রঙের বালুচর- আছে। অনেক দূরে ধোঁয়াটে জঙ্গল আর জলের ট্যাঙ্ক- আছে। নদীতে ভেসে আসা বাঁশের আঁটি- নেই। বালির চরের ওপর ভাঙাচোরা কুঁড়েঘর- নেই।

    নদী মোটামুটি আগের মতই আছে, হতাশ করেনি। তবে নদীর ধারের ফাঁকা জায়গাগুলো আর আগের মত নেই। অনেক বাড়িঘর তৈরি হয়ে গেছে।

    ব্রিজের পর ক্লাবঘর আর বটগাছটা এখনো আছে। আর এক মিনিটেরও কম সময়ে এসে যাবে স্কুলটা।

    কিন্তু পুরো দু মিনিট কেটে যাবার পরও স্কুলটা দেখতে পেলাম না।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে মতামত দিন