এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • বাংলার বৃটিশ-পূর্ব ইতিহাসকে গ্রামীণদের দৃষ্টিতে দেখা

    বিশ্বেন্দু
    অন্যান্য | ২৪ জুন ২০১৩ | ৬১২৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • বিশ্বেন্দু | 125.187.39.204 | ২৪ জুন ২০১৩ ১১:৪৮612991
  • ম্যাক্সমুলর ডক্টরেট ছিলেন না

    জার্মানিতে উচ্চশিক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে ফ্রেডরিশ ম্যাক্সিমিলিয়ন মুলার ভাগ্যান্বষণে ব্রিটেনে হয়ে এলেন। তাঁর হাত ধরে শুরু হল ভারতের বুদ্ধিদাসত্ব যুগের। তিনি সংস্কৃত পন্ডিত। অথচ তাঁর সংস্কৃত শেখা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। এমত এক মানুষ, ভারতে না এসে, লন্ডনেই বেদ অনুবাদের সিদ্ধান্ত নিলেন। অনুবাদ করারমত সংস্কৃত শিখতে প্রয়োজন বেশ কয়েক দশক সময়ের ব্যাপ্তি। আর সবথেকে বেশি যেটি প্রয়োজন, সদগুরুর নির্দেশ। যিনি ভারত থেকে বহুদূরে বেড়ে উঠছেন, তার ক্ষেত্রে এই দুটি সূত্রই কঠোরভাবে প্রযোজ্য।
    তার প্রথম জীবনী লেখক স্ত্রী আর পুত্র বলছেন ১৯ বছর বয়সে ১৮৪৩এ লিপজিগ বিশ্ববিদ্যলয় থেকে তিনি ডক্টরেট উপাধি প্রাপ্ত হন। যদিও এই দাবি নিয়ে বহু মানুষ সংশয় প্রকাশ করেছেন(লায়েজ উইথ লং লেগ, প্রদোষ আইচ এবং এই প্রবন্ধ)। ১৮৪৬ তিনি ভাগ্যান্বেষণে লন্ডনে আসেন। জার্মান প্রেম-পরিণয়ের নভেল লেখেন, বেশ প্রচারও পায়। অথচ তিনি কার কাছে সংস্কৃত শিখেছেন সে তথ্যে জীবনীকারেরা চুপ। মুলার ভারতে আসেন নি। অথচ সংস্কৃত শিখেছেন। মুলার যখন ভারতউত্সুক, তখনও ভারতে সংস্কৃত কথ্য ভাষা ছিলনা। যে ভাষা কথ্য নয়, সে ভাষা শিখতে উপযুক্ত শিক্ষক সময় প্রয়োজন। এ তথ্য জানতে বা জানাতে জ্ঞানীগুণী পদার্থবিজ্ঞাণী হওয়ার প্রয়োজন হয় না। সেই শিক্ষা শুরু হয় শিশুকাল থেকেই। অনুবাদ করতে দুটো ভাষাতেই বিশেষজ্ঞ হতে হয়। ঋগ্বেদের তথাকথিত অনুবাদের পথ ধরে তৈরি হল ভারতবিদ্যার ধারা। মেকলের প্রধান পুরোহিত, ভাগ্যান্বেষী মুলার ক্রমে হয়ে উঠলেন ভারত বিশ্লেষণের কারিগর। তৈরি হল আর্যতত্ব।
    তো, গুরুমেকলের পথ ধরে মুলারের ভারতবিশেষজ্ঞের কাজ শুরু করলেন। মেকলের ১৮৩৫এর মিনিটের ছত্রে ছত্রে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি ঘৃণা পৃথিবী বিখ্যাত। মিনিটের তত্বকে ব্যজস্তুতি হিসেবে ভারতে বাস্তবে নামিয়ে আনলেন মুলার। মেকলের মুলার-অর্জন ভারতের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে যুগান্তকারী ঘটনা। মুলার আদৌ সংস্কৃত জানেন কীনা তা নিয়ে মেকলের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা ছিল না। তিনি চেয়েছিলেন এমন এক মানুষ যিনি ভারতকে শ্রদ্ধা জানাবার ছলে, ভারতকে দাস বানাতে দক্ষ। চেয়েছিলেন এমন একজন, যার রচনায় ভারত সম্বন্ধে অজস্র শ্রদ্ধা, আর মনে চরম অশ্রদ্ধার বীজমন্ত্র। যে বীজমন্ত্র সফলভাবে ছড়িয়ে দিতে পারবেন মেকলের তৈরি করা শিক্ষা নীতির উদ্বৃত্ত শহুরে ভারতীয়দের মনে(অন্য কোনও দিন সুযোগ পেলে আলোচনা করা যাবে)। মুলার তিনি ইওরোপজাত। মেকলে জানতেন তাঁর মিনিটেরমত, মনগড়া হলেও তার শিষ্যের আর্যতত্ব, ভারতীয় শহুরেরা বিনাদ্বিধায় মেনে নেবে। মুলারের কাছে অর্থদাতারা চাইছিলেন ভারতীয়রা যেন ৮০০০ বছরের সভ্যতার শেকড়ে ফিরতে না পারে। শুরু হল ভারত ব্যাজস্তুতি রচনা। বাস্তবে রূপায়িত হতে শুরু করল ঋগ্বেদ অনুবাদের বকলমে মুলারের আর্যতত্ব। প্রখ্যাত হলেন মুলার।
    সে সময় মুলারকে ভারতের উদ্ধারকর্তা হিসেবে তুলে ধরার প্রয়োজন ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের। ১৭৬৩ থেকে গ্রামে গ্রামে ফকির সান্ন্যাসি স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্যে ভারত স্বাধীণতা সংগ্রামের বীজ বেনা চলছে। ব্রিটিশদের আঁকড়ে ধরতে হচ্ছে শহরের মধ্যবিত্তদের। ইংরেজদের পথে ভারত শাসনের জন্য তৈরি করতে হচ্ছে তাদেরকে। মেকলেও, মুলারের ইমেজ সেই ভাবে সাজিয়েছেন। মুলারের ডক্টরেট করা আর সংস্কৃত জানা নিয়ে বহু মিথ্যের জাল বোনা হয়েছে। এই প্রবন্ধের শেষে আমরা তার ডক্টরেট উপাধি পাওয়া বিষয়টি অনুসন্ধান করব। আমাদের দুটো ঘটনা ঘুরে সেই প্রমাণে যেতে হবে।

    কোম্পানির খয়রাতি
    যতদিন না মুলার, মেকলের দেখা পেয়ে তাঁর মনগড়া আর্যতত্ব শোনাচ্ছেন ততদিন নব্য ভারতের ইতিহাস তৈরি হয় নি,(যদিও মিল ততদিনে তিন খন্ডে পরাধীন ভারতের ইতিহাস লিখে ফেলেছেন) ততদিন অসম্ভব উচ্চপারিশ্রমিকের বেদ অনুবাদেও কোম্পানি রাজি হয় নি, আর তার অর্থ কষ্টও কাটে নি।

    আরও আশ্চর্যের বিষয়, মুলারের সঙ্গে কোম্পানির যোগাযোগ হল এমন এক সময়ে যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঝাঁপ বন্ধ হতে বসেছে। সে তথ্য কোম্পানি ১৮৩৩ থেকেই জানে (পরে কোনও দিন সুযোগ হলে এই বিষয়টা নিয়েও আলোচনা করা যাবে)। মুলার জানেননা। কোম্পানি উঠে যাওয়ার ১৩ বছর আগে, একটি সাহিত্য অনুবাদ করতে মুলারকে কপালে চোখ তোলা পরিমানে অর্থ বরাদ্দ করছে প্রায় ঝাঁপ বন্ধ হতে বসা বানিয়া কর্পোরেট ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। কয়েক বছর পর সিন্দুকের ডালা চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে জেনেও, বিশ্বের প্রথম কর্পোরেট কোম্পানি মূলারকে চোখ কপালে তোলা অর্থ খয়রাতি করতে দিচ্ছে কেন? সেই প্রশ্নে কোনওদিন কারোর বিন্দুমাত্র খটকাও লাগে নি। কর্পোরেট জগতে অনুবাদের জন্য অর্থ দান খয়রাতিরই সামিল। কে অনুবাদ করছেন খগ্বেদ! যিনি একদিনের জন্যও ভারতে পদার্পণ করেন নি, আর সংস্কৃতজ্ঞাণ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কে অর্থ দিচ্ছে, যে কোম্পানি ভারতকে লুঠকরে ছিবড়ে করে ফেলেছে।

    মুলারকে কোম্পানি তার ঋগ্বেদ অনুবাদে(আদতে আর্যতত্ব) কত সাহায্য করেছিল! ১৮৫৩তে প্রতি পাতা অনুবাদের জন্য মুলার পেয়েছেন ৪ ডলার। “English Education, 1798-1902” পুস্তকে John William Adamson বলছেন যে বছর তিনি ঋগ্বেদ অনুবাদ শুরু করবেন, ইংলন্ডে পুরুষ শিক্ষকের গড় আয় ছিল বছরে ৯০ ডলার আর মহিলাদের ৬০ ডলার। ২০০০ সালে বছরে একজন ব্রিটিশ শিক্ষক আয় করতেন ১৮,০০০ ডলার থেকে ৩৬ হাজার ডলারেরমত। সে সময়ে থেকে অর্থাত ২০০গুণ বেশি। ম্যাক্স মুলার পেয়েছিলেন প্রতি পাতার জন্য ৪ ডলার করে। এডামসনের হিসেব ধরলে ২০১১র হিসেবে ৮০০ ডলার প্রতি পাতা। ৮০ টাকা ডলারে প্রতি পাতা ৬৪০০০ টাকা। ২০০ পাতার জন্য ১ কোটি ২৮ লক্ষ টাকা!!! আজ যত বড়ই কর্পোরেটিয় অনুবাদ প্রকল্প হোক না কেন, বিশ্বের সব থেকে মহানতম পুস্তক অনুবাদ করতে, এই পরিমান অর্থ বরাদ্দ হয় কী! ১৮৩৩এর সনদের পর বাণিজ্য অধিকারটুকুও ব্রিটিশ সরকার কেড়ে নিয়েছে। সে সময় কোম্পানি স্বপ্নেরও অতীত পরিমান অর্থ বরাদ্দে মুলারের স্বপ্ন কেন সাকার করছে, সে প্রশ্ন আজও ওঠে নি।

    এক পদ, দুই প্রখ্যাত
    মুলার ইংলন্ডে থাকাকালীন অর্থকষ্টে ছিলেন, যেমন ছিলেন অন্য দুই উইলিয়াম, কেরি আর জোন্স। অর্থকষ্ট থেকে মুক্তি পেতে আর্যতত্বের মশলা মাখানো নানান প্রকল্পের প্রস্তাব দিচ্ছিলেন নানান ব্যক্তি, সংস্থাকে। মুলার নজর ছিল কোম্পানির অন্দরে। ১৮৪৬এ প্রুসিয়ার কুটনীতিক ব্যারন ভন বুনসেন আর আর অক্সফোর্ডের সংস্কৃতর অধ্যাপক হোরেস উইলসন কোম্পানিকে আবেদন করেন ঋগ্বেদের অনুবাদের প্রকল্পে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসকে সাহায্য করতে। তখনও মেকলের সঙ্গে মুলারের দেখা হয় নি। মেকলের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর মুলর খগ্বেদ অনুবাদ আর আর্যতত্বে ভারতীয় মাথা মুড়োনোর বরাত পেলেন। অনুবাদের পর ওঠা ধন্য ধন্য রবে, মুলরের ধারণা হয়েছিল অক্সফোর্ড বিশ্বদ্যালয়ে সংস্কৃতের অধ্যাপক পদের জন্য তিনিই একমাত্র যোগ্য। আর কোম্পানির বরাভয়হস্ত তার মাথার পেছনে রয়েছে। তখন তিনি অক্সফোর্ডে আধুনিক ইওরোপিয় ভাষার অধ্যাপক। তাঁর শেষ স্বপ্ন, অক্সফোর্ডে সংস্কৃত ভাষার অধ্যাপক পদ অলঙ্করণ।
    তো আর্যতত্ব আর কোম্পানির দয়া সম্বল করে মুলার প্রখ্যাত আর ধনী হয়েছেন, সেই খ্যাতি অবলম্বন করে মুলর ঝাঁপ দিলেন অক্সফোর্ডের সংস্কৃত প্রফেসরির জন্য। এই পদটির সরকারি নাম বোডিন প্রফেসরশিপ অব সংস্কৃত। পদটি তৈরি হয়েছিল সংস্কৃত ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করে ভারতে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে। বোডিন, বম্বে নেটিভ ইনফ্যান্ট্রিতে ছিলেন। ১৮১১তে মারা যান। উইল অনুযায়ী তাঁর কন্যার মৃত্যুরপর(১৮২৭) সমস্ত সম্পত্তি অক্সফোর্ড পায়। শর্ত ছিল তার অর্থে যে অধ্যাপক পদ তৈরি হবে, তার মূল উদ্দেশ্য হবে ভারতে সংস্কৃত নানান শাস্ত্র ইংরেজিতে অনুবাদ করে খ্রিস্ট ধর্ম প্রচার প্রসার। এই পদে ১৮৩২এ এই প্রথম অধ্যাপক হোরেস উইলসন। ১৮৬০এ তিনি মারা যান।
    নতুন অধ্যাপকের বিজ্ঞাপন প্রকাশ হল। ১৮৬০এ সংস্কৃত অধ্যাপক পদের মাইনে ছিল বছরে ৯০০ থেকে ১০০০ পাউন্ড। সময়ের তুলনায় বেশ বেশি। মুলার তখন অক্সফোর্ডে টেলরিয়ান প্রফেসর অব মডার্ন ইওরোপিয়ন ল্যাঙ্গুয়েজ। মাইনে বছরে ৫০০ ডলার। সংস্কৃত অধ্যাপক পদের অর্ধেক। অধ্যাপক পদের জন্য মনিয়ের মনিয়ের উইলিয়ম আর ফ্রেড্রিশ ম্যাক্সিমিলিয়ন মুলার লড়া শুরু করলেন। মনিয়েরের তুলনায় ভারতে খ্যাতি বেশি মুলারের। ভারতীয়রা তাকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছের মানুষ হিসেবে জানে। ইংলন্ডে উল্টো। মনিয়ের কোম্পানির ঘরের মানুষ। মুলারের অর্থ সাহায্য পাওয়ার আগেই কোম্পানির অর্থ সাহায্যে ইংরেজি-সংস্কৃত অভিধান তৈরি করেন মনিয়ের উইলিয়ম। এই কাজে অর্থ বিনিয়োগ করেছেন সেক্রেটারি অব স্টেট অব ইন্ডিয়ার দপ্তর। যেসব আমলা কোম্পানি থেকে সরসারি সরকারে ভারত শাসনের কাজে প্রতিস্থাপিত হয়েছেন, তাঁদের সমর্থন পেয়েছেন মনিয়ের।
    মুলার, মনিয়েরসহ পাঁচজন কৃতি এই পদে আবেদন করেন। অন্য তিনজন ছিলেন গভর্মেন্ট কলেজ অব ক্যালকাটার সংস্কৃতের অধ্যাপক এডওয়ার্ড কাওয়েল(২৮মে, দ্য টাইমসএর খবর)। বেনারসের সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক ও প্রাক্তণ বডিন স্কলার রালফ গ্রিফিথ। বেনারসের এক কলেজের অধ্যক্ষ জেমস ব্যালেন্টাইন। শেষ পর্যন্ত এই তিনজনই আবেদন পত্র তুলে নেন। টিকে থাকেন দুজন প্রখ্যাত। তাঁর আবেদনে মনিয়ের বললেন তিনি এই পদটি পেলে ভারতে খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারে কাজ করবেন। মনিয়ের তার সমর্থকদের দিয়ে একটি প্রচারপত্রও বিলি করেন। পাল্টা লড়াই দেন মুলার। ২৯ অক্টোবর ১৮৬০এ মুলার দ্য টাইমসএ মনিয়েরের বিরুদ্ধে কলম ধরেন। সে সময় মনিয়ের লন্ডনে প্রখ্যাত ছিলেন সংস্কৃত ভাষার অধ্যাপকরূপে। মুলার বিখ্যাত, কিন্তু পরিচয় তিনি অনুবাদকমাত্র। অধ্যাপক নন। সংস্কৃততো পড়ানই না। সে সময় লন্ডনের উচ্চকুল এই নির্বাচনে বেশ মশগুল হয়ে ওঠে। (সূত্র http://en.wikipedia.org/wiki/Boden_Professor_of_Sanskrit_election,_1860)

    সদ্য থেঁতলে দেওয়া সিপাই স্বাধীণতা সংগ্রামের আঘাত তখনও দগদগে ঘা। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি জাতীয়করণ হয়ে ভারতে এসেছে ভিক্টোরিয়ার নামে চলা ব্রিটিশ সরকার। নতুন সরকার। নতুন ক্ষমতা। নতুন সমীকরণ। নতুন মুখ। পুরোনো পরিকল্পনার নতুন সাজ। নতুন সরকার আসার সঙ্গে সঙ্গেই ক্ষমতার নতুনতর সমীকরণটি সমাধান করে ফেল্লেন স্বদেশিয়প্রতিদ্বন্দ্বী, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রাক্তণ চাকর মনিয়ের উইলিয়মস, পরে স্যর। দুজনেরই উদ্দেশ্য দাতার উদ্দেশ্যকে আরও বেশি তুলে ধরে, ভারতে খ্রিস্টধর্ম প্রচার। ৭ ডিসেম্বর ১৮৬০এ অক্সফোর্ডের শেলডন থিয়েটারে সাড়ে পাঁচ ঘন্টার ভোটে ৬১০ জন মুলারের পক্ষে আর ৮৩৩জন উইলিয়মকে সমর্থন করলেন। মনিয়ের পেলেন ২৩০টি বেশি ভোট। জিতলেন। মনিয়ের ১৮৬০এ অক্সফোর্ডে বোডিন প্রফেসরশিপ অব সংস্কৃত অধ্যাপকের পদ দখল করলেন মুলারকে টপকে। অধ্যপক পদ পেয়ে তাঁর প্রথম বক্তৃতা ছিল, "The Study of Sanskrit in Relation to Missionary Work"। ১৮৮৭এ অবসর নিলেও জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মনিয়ের অক্সফোর্ডে সংস্কৃত পড়িয়েছেন বডিন প্রফেসররূপে। অক্সফোর্ডে ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউটও তৈরি করেছেন।

    মুলারও অক্সফোর্ডে ছিলেন। ১৯০০ সালে মৃত্যু পর্যন্ত মুলার, একদিনও সংস্কৃত পড়ান নি। ১৮৭৫এ মনিয়েরকে সাম্মানিক ডক্টরেট উপাধি দান করার সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ মুলার তার তুলনামূলক ভাষাতত্ব বিভাগে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন ছেঁদো যুক্তি দিয়ে, তিনি আরও সময় পড়াশোনায় ব্যয় করবেন। অক্সফোর্ড কর্তৃপক্ষ তার পদত্যাগপত্র স্বীকার করে সাম্মানিক উপ-অধ্যাপক(ডেপুটি প্রফেসর) হিসেবে বরণ করে। শেষ দিন পর্যন্ত সেই সম্মান বহন করেছেন। অক্সফোর্ডের প্রশাসকদের জুতো মেরে গরু দানে ক্ষিপ্ত মুলার, তাঁর এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রিয়তম বৌদ্ধিক সন্তান, আর্যদাসতত্বকে অস্বীকার করলেন(সুযোগ পেলে এটিও বারান্তরে আলোচনা করা যাবে)। প্রশ্ন ডক্টরেট উপাধি

    বহুকাল ধরে ম্যাক্স মুলারের জীবনের নানান ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষ করে তার সংস্কৃত শেখা আর ডক্টরেট উপাধি পাওয়া নিয়ে। মুলারের সংস্কৃত শেখা নিয়ে এই প্রাবন্ধিকের নতুন তথ্য খুঁজে বার করা খুবই মুশকিল। তাই বহুদিন ধরে তার উপাধিগুলোর দিকে নজর ঘোরানোর চেষ্টা ছিল। প্রথমে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে যাই। সেই সাইটে মহাফেজখানার সমস্ত কাগজপত্রের হিসেব পাওয়া যায়। সূত্র http://www.bodley.ox.ac.uk/dept/scwmss/wmss/online/1500-1900/muller/maxmuller.html।

    মনে পড়ল তাঁর স্ত্রী পুত্রের লেখা জীবনীতে রয়েছে তিনি লিপজিগ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট করেছেন, স্পিনোজার দর্শণ বিষয়ে। কোনও জীবনীতে তাঁর ডক্টরেটপত্রের অনুলিপি দেখি নি। এমনকী উইকিপিডিয়া অথবা ম্যাক্স মুলর ভবন-গেট্যে ইন্সটিটিউটের ওয়েবসাইটেও নয়। কেউই সেই প্রতিলিপিটা দেখাচ্ছেন না। অথচ এই উপাধির ওপর ভিত্তি করে মুলর অক্সফোর্ডে সংস্কৃত অধ্যাপকের পদে লড়াই করছেন।

    সরাসরি লিপজিগ বিশ্ববিদ্যালয়কে ইমেল করা গেল। উত্তর পাওয়া নিয়েও বেশ সন্দেহ ছিল। অবাক করে ৩০ আগস্ট লিপজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ প্রাবন্ধিককে একটা মেল পাঠালেন,
    Dear Biswendu Nanda.
    At the university archive of Leipzig is neither an entry in the book of promotion nor a promotion file of Friedrich Max (Maximilian) Müller. He was a student at the university from 1841 to 1844. There is an entry in the discharge register (with attended lectures) and two entries in the register of students. Enclosed you can find the corresponding digital copies.
    Yours sincerely
    Nicole Panser।
    সঙ্গে জুড়ে দেওয়া তিনটে নথি।
    প্রশাসনিক ইংরেজিতে অজ্ঞ প্রাবন্ধিক এর মানে জানতে কল্যানী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক, সুতনু ভট্টাচার্যের শরণাপন্ন হয়। তিনি জানান এর সাদা অর্থ, মুলর সেখানে ছাত্র ছিলেন, লেকচার শুনেছেন, কোনও পরীক্ষায় যোগ দেন নি। ডক্টরেট পাওয়া, স্পিনোজার দর্শণতো দূরস্থান।
    কেন এতদিন এই মিথ্যেটি ফলাও করে ভারতের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হল হল! প্রাবন্ধিক এর অর্থ খুঁজতে হয়রান। এবার পাঠকেরা এর কী মানে করবেন করুন।

    আর সুযোগ হলে এই প্রবন্ধের সঙ্গে সেই তিনটে নথি জুড়ে দেওয়া যাবে।
  • কল্লোল | 116.77.173.25 | ২৪ জুন ২০১৩ ১৪:০৫613054
  • বিশ্বেন্দু, খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ছি। থেমে যাবেন না।
  • ম্যামি | 69.93.210.6 | ২৪ জুন ২০১৩ ১৪:১৮613065
  • কল্লোল, বাকি কাজ তো পাঠককে করতে হবে।
  • lcm | 34.4.162.218 | ২৪ জুন ২০১৩ ১৪:২১613076
  • তথ্যসমৃদ্ধ। ভালো লাগল।
  • বিশ্বেন্দু | 125.187.39.204 | ২৪ জুন ২০১৩ ১৪:৫১613087
  • কলাবতী মুদ্রার বিশ্বেন্দুকে লিপজিগ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাঠানো ই-মেলএ এই তথ্য ফুটে উঠেছে। তাঁরা মেলের সঙ্গে তিনটি ডিজিটাল কপিও পাঠিয়েছেন, তা জার্মানে লেখা. সেগুলো এখোনো বুঝতে পারি নি. জার্মান জানা বন্ধু খুঁজছি.

    লিপজিগ বিশ্ববিদ্যালয় যে তিনটি ডিজিট্যাল ছবি পাঠিয়েছে সেগুলো কীভাবে এই পোস্টে দেব, যদি কেউ জানান। তবে যেখানে এই তিনটি কপির ছবি রয়েছে, সেই ব্লগের লিঙ্কটি দিলাম http://lokfolk.blogspot.in/2012/08/blog-post_3042.html

    লিপজিগের মেল উত্তর

    Re: WG: (Fwd) WG: Query from Indian Researcher -- AZ 7513.50/2012/924
    Thursday, August 30, 2012 11:28 AM
    From: "[email protected]"
    Add sender to Contacts
    To:[email protected]
    Message contains attachments
    3 Files (3897KB) | Download All
    · UAL_Film 517_Friedrich Maximilian Müller.jpg
    · UAL_Film 601_Friedrich Maximilian Müller_Nr. 181.jpg
    · UAL_Rep.01_16_07_C_005_Bd. 1_discharge register.JPG
    Dear Biswendu Nanda.
    At the university archive of Leipzig is neither an entry in the book of promotion nor a promotion file of Friedrich Max (Maximilian) Müller. He was a student at the university from 1841 to 1844. There is an entry in the discharge register (with attended lectures) and two entries in the register of students.
    Enclosed you can find the corresponding digital copies.
    Yours sincerely
    Nicole Panser
    Universitätsarchiv Leipzig
    Prager Str. 6
    04103 Leipzig
    Tel.: +49 341 9730200
    Fax: +49 341 9730219
    E-Mail: [email protected]
    Internet:
    ____________________________
    Aus Tradition Grenzen überschreiten
    600 Jahre Universität Leipzig

    ____________________________
    ---
    Zitat von Universitätsarchiv Leipzig <[email protected]>:

    >
    >
    >
    >
    > Von: Buschner [mailto:[email protected]]
    > Gesendet: Mittwoch, 29. August 2012 11:42
    > An: [email protected]
    > Betreff: (Fwd) WG: Query from Indian Researcher
    > Sehr geehrte Damen und Herren,
    > uns erreichte eine Anfrage zu dem Indologen Friedrich Max Müller. Die
    > Universitätsgeschichte (s.u.) erwähnt nur, dass er ein Brockhaus-Schüler
    > war. Der Anfrager möchte wissen, ob Friedrich Max Müller in Leipzig
    > promoviert hat. Für Ihre Hilfe wären wir Ihnen sehr dankbar.
    > Mit freundlichen Grüßen
    > Adelheid Buschner
    > "...Brockhaus war ein beliebter Lehrer und trat durch jene Vielseitigkeit
    > hervor, die seither die Leipziger Indologie ausgezeichnet hat. Einer seiner
    > ersten Schüler war Friedrich Max Müller (1823–1900);..." (Geschichte der
    > Universität Leipzig 1409-2009, Bd.1, S. 395)
    > ------- Weitergeleitete Nachricht / Forwarded message -------
    >
    > Von: <[email protected]>
    >
    > An: <[email protected]>
    >
    > Betreff: WG: Query from Indian Researcher
    >> Datum: Wed, 29 Aug 2012 08:32:24 +0000
    >> Guten Tag,
    >> könnten Sie dem Studenten aus Indien mit seiner Anfrage unten bitte
    > weiterhelfen, wenn Sie hier Informationen haben?
    >> Mit bestem Dank und Grüßen
    >> Isabelle Maringer
    >> University of Leipzig
    > International Centre
    > Goethestraße 6
    > D-04109 Leipzig
    > Phone: +0049 341 97 32020
    > Fax: +0049 341 97 32049
    >
    >
    >
    > Von: [email protected]
    > [mailto:[email protected]]
    > Gesendet: Dienstag, 28. August 2012 16:31
    > An: [email protected]
    > Betreff: WG: Query from Indian Researcher
    >
    > Friederike Rohland
    >
    > Universität Leipzig
    >
    > Leiterin Öffentlichkeitsarbeit
    >
    > Ritterstraße 26, 04109 Leipzig
    >
    > Telefon 0341 97-35031
    >
    > Telefax 0341 97-35009
    >
    > [email protected]
    >
    > [email protected]
    >
    > <http://www.uni-leipzig.de>
    >
    > Von: biswendu nanda [mailto:[email protected]]
    > Gesendet: Dienstag, 28. August 2012 12:05
    > An: [email protected]
    > Betreff: Query from Indian Researcher
    > Sir,

    > I am a research scholar from India, West Bengal, Kolkata.
    > I am doing my research on Bengal, India.
    > It was quoted from various source noted Indologist Max Muller obtained his p.hd degree from leipzig university.
    >> Some expressed doubt about the claim. one of them said he had not seen any record on max muller in the said university.
    >> can you clear the doubt.
    >> if max muller was the pupil of the said university, can you provide us any document of that!
    >> it will not only assist my research work but create a flutter in the indian media also.
    > expecting your reply soon,
    >
    > yours
    >
    > biswendu nanda
    >> research scholar of Kalaboti Mudra Folk Research Team, West Bengal, India
    >> --- Ende der weitergeleiteten Nachricht / End of forwarded message ---
    >> Universität Leipzig
    >> Institut für Indologie und Zentralasienwissenschaften
    >> Schillerstraße 6
    >> 04109 Leipzig
    >> Tel.: 0341-9737120
    >> Fax: 0341-9737148
    >----------------------------------------------------------------
    This message was sent using IMP, the Internet Messaging Program.
  • তাতিন | 132.252.251.244 | ২৪ জুন ২০১৩ ১৫:০২613098
  • ব্যাপক। তারপর?
  • dukhe | 212.54.74.119 | ২৪ জুন ২০১৩ ১৫:০৮613120
  • ও হ্যাঁ, ওপরেরটার ইঞ্জিরি অনুবাদ (গুগলের সৌজন্যে) -
    Mueller, Fridericus Maximilianus, Philos. et Philol. Orient. Cult. Seminar. Reg Philol. Sodalis Dr. phil. (born in Dessaviensis) Ph.D. 1843
  • বিশ্বেন্দু | 125.187.39.204 | ২৪ জুন ২০১৩ ১৫:২০613131
  • দুখেজ়ি,
    অবশ্যই করব। কিন্তু তার আগে যে লিঙ্কটি দিলাম, সেই লিঙ্কে যে তিনটি ছবি পাঠিয়েছে লিপজিগ, তার মানে আজও বের করতে পারি নি। সেইটা করতে পারলেই লিপজগকে পত্রাঘাত করব। সেই ব্যাপারে কেউ সাহায্য করবেন?
    হাত বাড়িয়ে রয়েছি।
    এপ্রসঙ্গে আরও একটি ফোড়ন।
    খবরটা পেয়ে খুব উত্তেজিত হয়ে বাংলার ডানহাতি বাঁহাতি সবকটি বহুল প্রচারিত সংবাদপত্রে এই বিষয়টি প্রকাশ করতে চিঠি পাঠিয়েছিলাম। আমার সুবিধে ছিল, আমি বছর দশেক আগে কলকাতায় খবর করতাম। ভেবেছিলাম বড় খবর হবে। পুরনো বন্ধুরা জানাল, তাদের সম্পাদকেরা বলেছেন, এ বিষয়টি এমন কিছু নয়, যা পাবলিক খাবে। সত্যি কথা বলেছিলেন সদ্য বন্ধ হয়ে যাওয়া কাগজের বিভাগীয় সম্পাদক। তিনি বাংলা ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন। বলেছিলেন এটি ছাপলে খবরের সঙ্গে যুক্ত সকলের চাকরি যাবে।

    সেই জার্মান স্ক্যানগুলো কেউ পাঠদ্ধার করতে পারবেন?
  • কল্লোল | 125.242.234.167 | ২৪ জুন ২০১৩ ১৫:৩৬612992
  • বিশ্বেন্দু। এখানে আমার এক জর্মন জানা বন্ধু আছে। তাকে জিজ্ঞাসা করতে সে পাঠিয়ে দিতে বলল।
    একটু সময় দিন। বাংলা বা ইংরাজিতে অনুবাদ করে দেবে।
  • কল্লোল | 125.242.234.167 | ২৪ জুন ২০১৩ ১৫:৩৮613003
  • বিশ্বেন্দু। আপনার উপরের পোস্টে উল্লিখিত "সদ্য বন্ধ হয়ে যাওয়া কাগজের বিভাগীয় সম্পাদক" কি রতন?
  • ম্যামি | 69.93.210.6 | ২৪ জুন ২০১৩ ১৫:৪৬613014
  • ডকুতে কী কী আছে সেটা ইংরেজি লিখে দিয়েছেন।
    He was a student at the university from 1841 to 1844. There is an entry in the discharge register (with attended lectures) and two entries in the register of students.
  • ম্যাক্সিমিন | 69.93.210.6 | ২৪ জুন ২০১৩ ১৫:৫২613025
  • At the university archive of Leipzig is neither an entry in the book of promotion nor a promotion file of Friedrich Max (Maximilian) Müller.

    প্রশ্ন হল, বুক অফ প্রোমোশন / প্রোমোশন ফাইল মানে কী?
  • Blank | 180.153.65.102 | ২৪ জুন ২০১৩ ১৬:০৪613036
  • প্রশ্ন হলো ৮০০০ বছরের ভারতীয় সভ্যতার মানে কি? হরপ্পা মোটামুটি ৩৫০০ bc মানে ৫৫০০ বছর আগের - এখনকার হিসেবে। ৮০০০ বছর এলো কোথা থেকে?
  • বিশ্বেন্দু | 125.187.39.204 | ২৪ জুন ২০১৩ ১৬:১৩613047
  • ধন্যবাদ কল্লোল! এর আগেই আমাদের ব্লগের সেই তিনটি ছবির লিঙ্ক দিয়েছি।

    সত্যি সত্যি সত্যি! লক্ষ্যভেদ করে ফেলেছেন! তবে যথেষ্ট সূত্র ছেড়ে গিয়েছিলাম। শুধু এটিই তাকে বলিনি, এর সঙ্গে বলেছিলাম বিদ্যাসাগর, রামমোহন, দ্বারকানাথ ইত্যাদিদের গ্রামীণদের আন্দোলনে বিশ্বাসঘাতকতা এবং ব্রিটিশ দাসত্ব পরিকল্পনা প্রথমে বাঙলায়, পরে ভারতে দায়িত্ব নিয়ে রূপায়িত করা নিয়ে লিখতে। ম্যাক্স মুলার ছিলেন এই প্রকল্পের বড় তাত্বিক অংশিদার। তবে ের আগে অনেকেই এই বিশ্বাসঘাতকতা বিষয়ে লিখেছেন, কিন্তু গ্রামীণদের এলেবেলে হিসেবে ধরে নিয়ে।

    আমরা দ্বিতীয় ইতিহাস নামে একটা ইতিহাসের টিকা করার কাজ করছি। অকাজও বলতে পারেন। কোনও তথ্যই নতুন নয়। ওই, গ্রামীণদের কথা শহরে বলা। আমরা জানি আমাদের কলমের প্রসাদ্গুন নেই। সব শহুরে বাঙ্গালিই লেখক। আমরা কেউ লেখক নই, যদিও শহুরে বাঙ্গালি। সেই ভুল ধারনাটুকু আমাদের নেই। আমরা যারা এই কাজটা করছি তাদের একটাই লক্ষ্য, কয়েকটা কথা বলে যাওয়া। শুধু কিছু প্রশ্ন তুলতে চাইছি। গ্রামীণদের কলমচি হতে চাইছি।
    এ প্রসঙ্গে একটি বেশ বড় লেখা ছাপ্লাম। দেখবেন। যদি মনেহয় বিতর্ক যোগ্য, তাহলে কিছু লেখা করা যাবে।

    আর শীর্ষকের নামটি উত্তেজনায় ভুল লিখেছি - হয় স্বাধীনতা-পূর্ব হবে নয় শুধু ব্রিটিশ হবে।

    সাংস্কৃতিক দাসত্ব প্রকল্প
    ম্যাক্স মূলারের দাসত্ব প্রকল্প ভাবনার বহু আগেই ভারতীয়দের চিন্তার দাসত্বের বেড়ি পরাবার কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। মিথ্যে ধর্ম এবং ধর্ম-সংস্কার আলোচনায় সেটি স্পষ্ট দেখতে পেয়েছি - মিথ্যে ধর্ম নিয়ে দারুন কিছু আলোচনা অন্য কোনও সময়ে করা যাবে। উপনিবেশের মদতে জমিদারি, গোমস্তাগিরি, বেনিয়ানিরমত হাজারো দালালগিরিতে নিযুক্ত শহুরে বাঙালিয়া। উচ্চমানের ইওরোপিয় সভ্যতার প্রতি আস্থাবান করে তোলার প্রকল্প নেওয়া হয়ে গিয়েছে কোম্পানির প্রত্যক্ষ মদতে। ব্রিটিশদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভারতীয় গুণীরা শিল্পপরিকাঠামো ভাঙার কাজে হাত দিলেন। অর্বুদ সম্পদ লুঠের কাজে সহায়ক হলেন। ভারতীয় শহুরে, গ্রামীণ, লৌকিক, আদিবাসী জ্ঞাণ-বিজ্ঞাণ ব্রিটিশের পায়ে লুটিয়ে দিলেন। নিয়ে এলেন সাম্রাজ্যবাদী প্রযুক্তি। প্রখ্যাতদের দুপয়সা লাভের সুযোগ করে দিল সাম্রাজ্য। সাংস্কৃতিক দাসত্ব প্রকল্প লুফে নিলেন অত্যধিক আগ্রহে।
    ভারতজোড়া সমাজে সমাজে জ্ঞাণচর্চার ইতিহাস বিকারের কাজ শুরু হল। ভারতের সমবায়ী সমাজগুলিকে একদেহে হিন্দোস্তান নামে দেগে দেওয়ার প্রচেষ্টার গুরুঠাকুর চার্লস গ্রান্ট। সেই তত্বও গলার্ধকরণ করলেন মহা মজায়। ১৭৭৮এ ভারতীয় সংস্কৃতি বর্ণনায় তিনিই প্রথম ভারতকে হিন্দুস্থান আর ভারতের নানান সমাজে ছড়িয়ে থাকা হাজারো ধর্ম, হাজারো সংস্কৃতিকে হিন্দুধর্ম নামে ছেপে দিলেন। গ্রামীণ ভারতীয়রা জানেন ভারতে ছড়ানো রয়েছে নানান সামাজিক, লৌকিক, আদিবাসী, এমনকী প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম। কারোরই খ্রিস্ট বা ইসলাম ধর্মের মত কেন্দ্রিয় ধারক শক্তি নেই। ভারতে ভগবৎ ভক্তি থেকে গুরু পরম্পরা অতীব শক্তিশালী।
    শুধু শৈব বা শাক্ত বা বৈষ্ণবধর্মেই নয়, নানান ধর্মীয় মতবাদে স্থানীয় সমাজের নিয়ন্ত্রণে সম্প্রদায় ভিত্তিক বহুত্ববাদের ভূমিকা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায়ে আবার রয়েছে নানান উপসম্প্রদায়। সমবায়ী ভারতজুড়ে প্রত্যেক সম্প্রদায়-উপসম্প্রদায়ের নিজস্ব সামাজিকতা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য গড়েতোলার স্বাধীণতা ছিল পূর্ণমাত্রায়। বহু স্থানেই এগুলির খুববেশি কেন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রণ নেই। স্থানীয় সাংস্কৃতির সঙ্গে মিলমিশ করে হাজার হাজার বছরের প্রণোদনায় গড়ে উঠেছে হাজারো সম্প্রদায়ের বিকশিত চেতনা। হাজার বছরের আগেও শংকরাচার্যেরমত ক্ষণজন্মা যুগপুরুষ ভারতের চার প্রান্তে বৌদ্ধ ধর্মের অনুরকণে মঠ তৈরি করেছেন। চেষ্টা করেছেন ভারতীয়দের এক ধর্মের অধীনে নিয়ে আসার। তাঁর অনুগামী অজস্র। কিন্তু ভারতের সব জনপদের জনসমষ্টি তাঁর অনুগামী হয়নি।
    যে ধর্মীয় আর সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ ভারতের সামাজিক শেকড়ে জাঁকিয়ে বসেছিল, তাকে শংকরাচার্যেরমত প্রতিভাশালী পুরুষও ভাঙতে পারেননি। তথাপি একদেহী এককেন্দ্রিক হিন্দু ধর্মের ধারণা গড়ে তোলা হল একদা জেসুইট পাদরিদের পরে চার্লস গ্রান্টের লেখার সূত্র ধরে এবং তার উত্তরসূরীদের রচনাতত্ব অনুসরণ করে। ভারতবর্ষের ধর্ম-সংস্কৃতি-দর্শণ সম্বন্ধে ইওরোপিয়দের আপ্তবাক্যসমূহ প্রকাশ হওয়া শুরু হল ধারাবাহিকভাবে। বিদ্যাসাগর বেদান্ত এবং সাংখ্যকে মিথ্যা দর্শণরূপে দেগে দিলেন। ধর্ম অনুসরণে একব্রহ্মের উপাসনায় আস্থাবান হলেন অনেকেই। নতুন ধর্মমত গড়ে তোলার চেষ্টা হল। এ সমস্ত প্রকল্প শুধুই শহুরে বাঙালিদের জন্য রচিত হল।
    কেননা বাঙলার গ্রামসমাজ স্বাধীণতা সংগ্রামী। গর্জে ওঠা বন্দুকের দিকে পিঠ না ফিরিয়ে, বুক চিতিয়ে দিচ্ছে মহা ঘৃণায়। সুখে আনন্দে থাকা ব্রিটিশ-উচ্চমধ্যবিত্ত শহুরে জোট, কোটি কোটি মানুষের, তিল তিল পরিশ্রমে আর জ্ঞাণে, হাজার হাজার বছর ধরে গড়ে তোলা গ্রামীণ ভারতের সাংস্কৃতিক, সামাজিক, উতপাদন আর বন্টন পরিকাঠামো ভেঙে দিল। সমাজের সমস্ত কাঠামো দুমড়ে, মুচড়ে গ্রামীণ ভারতের সর্বস্ব লুঠে উদ্বৃত্তে শহুরে মানুষজন ব্রিটিশ দাসত্ব প্রকল্পে সামিল হলেন।
    উপহারস্বরূপ ব্রিটিশ সাম্রাজ্য কাউকে তার বিনিময়ে চাকরি দিল, কাউকে দিল লাভের ব্যবসা-উদ্বৃত্তের খুদকুঁড়ো, কেউ পেলেন রাজা উপাধি। এর বিপরীতাত্মক পথে হেঁটে ব্রিটিশ দানবকে ধংস করার কাজে পুরোদস্তুর অস্ত্রযুদ্ধে সামিল হচ্ছিল সমগ্র গ্রামীণ ভারত। ব্রিটিশ সেনার অস্ত্রে বাঙলার তথা ভারতের মাটি রাঙা হয়ে উঠল। ধন্যহল ভারতভূমি। বাঙালি তথা পূর্বভারতের সমবায়ী সমাজ-সমষ্টির স্বাধীণতা সংগ্রাম রুখে লুঠকর্ম চালাতে নতুন ধরণের সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনা তৈরি করল ব্রিটিশ তাত্বিকসমাজ। ভারতের সংস্কৃতি আর ভারতের ধর্ম এককেন্দ্রিক। এমন এক ধারণা কৌশলে সুপ্রচারের ব্যবস্থা করল কোম্পানি সরকার। প্রচুর অর্থ ব্যয়ে তৈরি হল নানান প্রকল্প।
    এদেশে এই উদ্যমের অন্যতম প্রথমদিককার তাত্বিক চার্লস গ্রান্ট। গ্রান্ট ছিলেন ব্রিটিশ ইন্ডিয়া কোম্পানির চেয়ারম্যান। এই দাসত্বতত্ব প্রচারের কাজে এবং কোম্পানিকে সেবা করার উপহারস্বরূপ কোম্পানি তাকে সাদরে পার্লামেন্টে স্থান করে দেয়। কোম্পানির মদতে মালদায় রেশমগুটি চাষ করে অভূতপূর্ব অর্থের মুখ দেখেন চার্লস গ্রান্ট। লর্ড কর্নওয়ালিসের নজরে পড়ে বোর্ড অব ট্রেডএর সদস্যও হন। উপনিবেশের স্বার্থে তিনি সর্বপ্রথম ভারতেরমত বহুত্ববাদের দেশকে তাত্বিকভাবে এককেন্দ্রিকতায় বেঁধে দিলেন। প্রথমে চার্লস গ্রান্ট এবং তার পরের দিকের উইলবারফোর্স অথবা মেকলেরমত ঔপনিবেশিক তাত্বিকেরা নিদান দিলেন ভারতের প্রাচীণতম রচনাগুলিতেই পাওয়া যাবে ভারতের সমাজ-সংস্কৃতির পরিচয়।
    তথাকথিত হিন্দুদের ধর্ম খুঁজতে এংলো-প্রোটেস্টান্ট ধর্মের লাইন ধরে ভারতীয়রা আশ্রয় নিলেন প্রাচীণ নানান রচনার স্তবকে। বেদকে তুলে আনা হল ভারতের একধর্মীয় কেন্দ্রিয় শাস্ত্ররূপে। বলে দেওয়া হল, বেদই হিন্দুদের একমাত্র আকর গ্রন্থ। এই তত্ব মধ্যবিত্ত ভারত নির্বিবাদে গ্রহণ করল। অনেকেই ভেবে দেখল না, ভারতের অনেক সমাজ, যাকে ব্রিটিশরা হিন্দু সমাজ বলে দেগে দিয়েচ্ছে, অধিকাংশ সমাজেই বৈদিক বিধানের অস্তিত্ব নেই। অথচ ইংরেজদের প্রকল্পে বেদই হিন্দুত্ব অর্জনের একমাত্র মাপকাঠি। দাসত্ব প্রকল্প অনুসরণে খ্রিস্ট ধর্মের ভারতীয় সত্ভাই, ইংরেজদের দ্বারা পোষিত, ব্রাহ্মসমাজ উচ্চবর্ণের বাঙালি সমাজে বেদপাঠ আবশ্যিক করল। হিন্দুত্ব বা হিন্দুধর্ম অথবা হিন্দুধর্মের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া উপপল্লবগুলি অথবা ব্রিটিশদের হাতে তৈরি করা হিন্দুসংস্কৃতি আদতে একটি ঔপনিবেশিক তত্ব প্রকল্প, যা তৈরি করা হয়েছে শাসক মেট্রোপলিস আর শাসিত উপনিবেশের মধ্যে চলতে থাকা দ্বন্দ্বকে কিছুটা হলেও প্রশমিত করার উদ্দেশ্যে। শহুরে শিক্ষিত তথাকথিত উচ্চবর্ণীয় লুঠের সাথীদের সঙ্গে নিয়ে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি তৈরি করল নতুন এক ভারতীয় ঔপনিবেশিক সাংস্কৃতিক অধ্যায়, যার নাম হিন্দুত্ব অথবা হিন্দুবাদ।
    শাসনকে আরও সুদৃঢ় করতে, বহু সামাজিক ঐতিহ্যকে ব্রাহ্মণ্যবাদের সঙ্গে সম্পর্কিত করে তোলার কাজ শুরু হল। স্মৃতি এবং ব্রাহ্মণগুলিকে ভারতের চালিকাশক্তিরূপে দেখাবার উদ্যোগও নেওয়া হল। নানান বেদান্তকে ভারতের সমস্ত ধর্মের মৌলরেণুরূপেও ধরে নেওয়া হল। পশ্চিমের কেন্দ্রিভূত শাসন, ধর্ম আর সংস্কৃতির রেণুগুলি প্রয়োগ করতে ভারতীয় ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের আধার অস্বীকার করার উদ্যোগ নিল ব্রিটিশ। সমর্থন যোগাল চিন্তার দাসত্বে মাথা নত করে দেওয়া শহুরে ভারতীয়রা। হঠাতই জানাগেল ভারতে পুরাণ এবং হিন্দুধর্মের নিদানের ওপর নির্ভর করেই নাকি ব্রিটিশেরা গড়ে তুলেছে কেন্দ্রীভূত বিচার আর শাসন ব্যবস্থা। শাসন আর বিচার ব্যবস্থার পরিকাঠামো যতই নিপীড়নমুখী হোক না কেন, ভারতীয়দের মেনে নিতেই হবে। কেননা ভারতীয় শাস্ত্রের আপ্তবাক্যগুলিভিত্তি করেই তৈরি করা হয়েছে এই ব্যবস্থাটি।
    শাসনের সুবিধার্থে কেন্দ্রীভূত ঐক্যের ধারণাটি নতুন করে তুলে ধরা হল শহরের মানুষের সামনে। শহুরেরা সে সময়ের ইংরেজদের তৈরি আদর্শকে ভারতীয় আদর্শরূপে ভাবতে ভালবাসতে শিখেছে। রোপণ করা কেন্দ্রিকরণের আদর্শ পশ্চিমি মেট্রোপলিটনের সমাজ-সংস্কৃতির সঙ্গে মিলছে। শহুরেরা তা দেখতে পেয়ে বেশ আশ্বস্ত বোধ করল। উপনিবেশিক শক্তির আধারে কেন্দ্রিকরণেরমধ্যে থেকে, নিরাপত্তার ভাব খুঁজে পেল শহুরে ভারতীয়রা। বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য এই আপ্তবাক্যটি অনেক পরে আসবে, শেকড় গজাল এই সময়ে।
    উপনিবেশের লালনপালনে হিন্দুত্ব ক্রমশঃ একটি ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক গন্ডী ছাড়িয়ে রাজনৈতিক রং পরিগ্রহ করছিল। স্বাধীণতা যতই ত্বরান্বিত হচ্ছিল ততই ব্রিটিশদের দেখানো পথে হিন্দুত্বের আধারে একত্রিত হওয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষজন নিজেদের আত্মপরিচয়ের আন্দোলনে সামিল হচ্ছিলেন। শহুরে ইংরেজি শিক্ষিত উচ্চবর্ণ দেখল পশ্চিমি সভ্যতার ভিত্তিই খ্রিষ্টধর্ম।
    পশ্চিমি ধর্মতত্বের পথ ধরে ভারতের প্রত্যেক অঞ্চলের সনাতন সংস্কৃতিকে ইওরোপের সমাজের নানান দিকের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার প্রচেষ্টায় শহুরে ভারতীয়দের সম্মতি মিলল। ভারতের মন্দির তুলনা করা হল চার্চের সঙ্গে, নানান পান্ডুলিপি এমনকী বেদও হয়ে উঠল আমভারতীয়র আপ্তশাস্ত্র। তুলনীয়হল বাইবেলের সঙ্গে। পুজোর ইংরেজি করাহল ওয়ারশিপ – অথচ ওয়ারশিপ আর পুজা দুটি সম্পূর্ণ আলাদা বস্তু। যেমন ব্রহ্মর ধারণার সঙ্গে বাইবেল বর্ণিত গডের বিন্দুমাত্র মিলনেই। ব্রাহ্মণদের আর পুরোহিতদের একীভূত করার চেষ্টার ফলে ভারতের সানতন সংস্কৃতির নানান রেণুর সঙ্গে ইওরোপিয় ধর্মচর্চার পথ আর তত্ব মিলিয়ে গড়ে উঠল ইংরেজ আমলের ভারতীয় কেন্দ্রিভূত ধর্মচর্চা। হিন্দুত্ব রাজনীতির রাজনৈতিক পথ সুগম হল। চিন্তার দাসত্বে, বিদেশি তত্ব প্রশ্ন না তুলেই মানল শহুরে ভারত। ভারতীয় বুদ্ধিজীবিরা ইওরোপের তৈরি দাসত্বের ভাষায়, ইওরোপিয় ধর্মতাত্বিক দৃষ্টিভঙ্গী ধার করে, ভারতের নানান সাংস্কৃতিক রেণুগুলিকে তুলনা আর বিশ্লেষণ করে বিশ্বব্যাপী প্রচারও দিলেন।
    ব্রিটিশ রোপিত শহুরে হিন্দুত্বের ধারণার বাইরে আজও সনাতন ভারতে বহু বিকেন্দ্রিত ঐতিহ্যের সহাবস্থান রয়েছে অবলীলায়। এই সমাজের অনেকগুলিই বেদ অনুগামীও নয়, হিন্দুও নয়। প্রচলিত শহুরে সংস্কৃত ঐতিহ্যের সীমানার বাইরে গড়ে উঠেছে গ্রামীণ সমাজ। ইওরোপিয় সেমেটিক ধর্মের এককেন্দ্রিকতার বোধ ভারতীয় ঐতিহ্যে, সংস্কৃতিতে এমনকী ধর্মেও গড়ে ওঠেনি। সেমেটিক ধর্মে ভগবান, ভাগবানের তৈরি বিশ্ব, ভগবানের সঙ্গে মানুষের যে সম্পর্কের ভিত্তিতে ভারতের কেন্দ্রীকৃত নতুন ধর্মগুলোর ইওরোপিয় গড়ন গড়ে উঠেছে, তার সঙ্গে সনাতন ভারতীয় ধর্ম-সংস্কৃতির বিন্দুমাত্রও মিল নেই। কিন্তু সেদিনের নবজাগরণের অগ্রদূতেরা এই তত্ব বিনা তর্কে মেনে নিয়েছিলেন। ভারতীয় সংস্কৃতিতে দেব বা দেবীকে কেন্দ্র করে হাজারো পারস্পরিক বিরেধাভাষের লক্ষণ নিয়ে নানান এলাকায় নানান গল্প ছড়িয়ে রয়েছে। প্রতক্যেটি গল্পের আবার এলাকা ভেদে নানান সংস্করণও গড়ে উঠেছে হাজার হাজার বছর ধরে। কোনও সমাজ গল্পকে মান্য করে। কেউবা সেই গল্পগুলোকে স্মিত হেসে বর্জন করে। কিন্তু কেউই সেই গল্পগুলোকে ধর্মীয় সত্যতার আধার হিসেবে ধরেনা। সত্য অবস্থান করে শুধুই ভক্তের অন্তরে।

    ইওরোপের পদপ্রান্তে
    উনবিংশ শতকের বাঙলার নবজাগরণের উদ্গাতারা ভারতের অন্তরের দিকে না তাকিয়ে দাসত্বের ধর্মীয় ব্রিটিশ মডেলটি গ্রহণ করলেন নতমস্তকে। রাজা রামমোহন রায় ব্রিটিশদের প্রকল্পে মাথা নামিয়ে সরাসরি পৌত্তলিক ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার শুরু করলেন। ব্রিটিশদের শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করে তিনি আর তাঁর অনুগামীরা বহু অর্থ, খ্যাতি আর সামাজিক সম্মান পেয়েছেন। তার বিনিময়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে তিনি আর তাঁর অনুগামীরা এমন কিছু ফিরিয়ে দিতে চাইলেন, যা ভারতীয় শহুরে সমাজে বিরাজ করবে ভারত থেকে ব্রিটিশ চলে যাওয়ার বহুকাল পরও।
    তাঁর সময়ের আড়াইশ বছর পূর্বের(১৫৫৪খ্রি.) খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারক, ফ্রান্সিস জেভিয়ারের লেখনির পথ ধরে রামমোহন তোপদাগলেন ব্রাহ্মণ সমাজের বিরুদ্ধে। বললেন ব্রাহ্মণেরা একেশ্বরবাদের প্রবক্তা বেদকে, জনসাধারণের আওতা থেকে সরিয়ে রেখেছিল। তিনি উপনিবেশিকতাবাদীদের সেমেটিক পিওর ধর্মের বিকাশের পথ ধরে ভারতীয় ব্রাহ্মণদের সঙ্গে পুরোহিততন্ত্রের সমানতা দেখতে পেলেন। রামমোহন ব্রাহ্মণদের চতুর পুরোহিতরূপে বর্ণনা করলেন। বললেন ভারতীয় ধর্মগুলি পুরোহিততন্ত্রের বেড়াজালে জড়িয়ে রয়েছে। ভারতের ধর্ম বিকাশের সঙ্গে সরাসরি ইওরোপের খ্রিস্ট ধর্মের বিকাশের, ধর্মমুক্তির মিল দেখতে পেলেন আধুনিক ভারতের আধুনিকতম নাগরিক রাজা রামমোহন রায়। আলেকজান্দার ডাফকে লেখা এক চিঠিতে রামমোহন ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে অসামাজিক হওয়ার অভিযোগ আনলেন, …the rise and progress of Christianity in apostoloic times, and its corruption in succeeding ages, and then of Christian Reformation which shook off these corruptions…(and) that something similar might taken place in India, and similar reasults might follow form a reformation of the popular idoltry.
    উপনিষদ অনুবাদ করে তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বন্ধুদের আশ্বস্ত করে দেখাতে চাইলেন ভারতীয়রা পিওর রেলিজিয়ন এবং একশ্বেরবাদেও বিশ্বাসী। ভারতীয়রা ইওরোপিয় ধর্মতত্ব বিকাশির ধারায় ভারতীয় ধর্মমণ্ডলকে দেখালেন। শুধু কলকাতায় রামমোহন রায়ই নন, মহারাষ্ট্রে ব্রাহ্ম সমাজের অনুসরণে গড়ে উঠল প্রার্থনা সমাজ, মাধব গোবিন্দ রাণাডের উত্সাহে এবং ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়। ১৮৯৮ সালে মাদ্রাজে ন্যাশনাল সোসাল কংগ্রেসে তিনি বললেন, ভারতের দক্ষিণ প্রান্ত আর উত্তর প্রান্তের ব্রাহ্মণেরা একইভাবে উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে সমাজকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন করে রেখেছে। ব্রাহ্মণদের কবল থেকে দেশকে উদ্ধার করতে আহ্বান জানালেন রামমোহনের শিষ্য রাণাডে।
    ইংরেজ পরবর্তী কালে ভারতে ধর্মের উদ্দেশ্য এবং বিধেয় নিয়ে উনবিংশ শতকের এংলিসিস্ট আর ওরিয়েন্টালিস্টদের বিতর্ক এ প্রসঙ্গে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ইওরোপিয় এংলিসিস্টদের ভাষায় ভারত হিদেনদের দেশ। ভারতের গ্রামীণেরা দুর্ণীতিপরায়ণ, অসভ্য। শাসনের ক্ষেত্ররূপে নির্ভরযোগ্য নয়। এবং সে তত্ব-তথ্য হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিল ঔপনিবেশিক শাসকবৃন্দ। বছরের পর বছর ধরে বেড়ে চলছিল স্বাধীণতা সংগ্রামের বহর। ইওরোপের তুলনায় ভারতের সংস্কৃতি নিম্নমানের, জনগণ যুক্তি-বুদ্ধির ধার ধারে না, নৈতিকভাবে পচনশীল, পতনশীল, এই ঘৃণাপূর্ণ তত্বসহ, ভারতীয় সমাজের শিরদাঁড়া বেঁকানোর নানান তত্ব গেলানো গেল শহুরে ভারতীয়দের।
    ইওরোপের দৃষ্টিতে স্বাধীণতা সংগ্রামী গ্রামীণ ভারতকে, শহুরে জনসমাজের কাছে তুলে ধরতে, এর থেকে আর গুরুত্বপূর্ণ এবং সফল মতবাদের দেখা মেলেনি। চার্লস গ্রান্ট, উইলবারফোর্স অথবা মেকলের সঙ্গে সঙ্গে শহুরে ভারতীয়ও বিশ্বাস করতে শুরু করলেন ভারতের গ্রামীণ জনগণ দুর্ণীতি পরায়ণ, নোংরা, কুঁড়ে এবং এদের ভালরাখার একমাত্র নিদানই হল উপনিবেশিক লাঠি আর লুঠের শাসন। মুক্তিদিতে পারে একমাত্র খ্রিস্টধর্মবোধ আর সেমেটিজমএ বর্ণিত পিওর রেলিজিয়ন।
    এংলিসিস্ট, ইউটিলিটেরিয়ান জেমস মিল বা টমাস মেকলেরা এই পথ তৈরি করছেন। ভারত সংস্কৃতি বিদ্বেষের রামমোহনের তুমুল প্রচারে সরাসরি যোগ দিয়েছিলেন পৌত্তলিক বাগনাপাড়ার গোস্বামীদের অনুগামী বৈষ্ণব শিষ্য দ্বারকানাথ ঠাকুর এমনকী পথভেঙে পথ তৈরি করা বিদ্যাসাগরও। ব্রিটেনে বসে কোম্পানির বড়কর্তারা ব্যবসার দুর্দিনে হয়ত ভাবতেন, ভারতে অনেক হয়েছে অত্যাচার, এবার একটু ব্যবসার জন্য কোম্পানি শাসনের কঠোরতা ঢিলে দেওয়া যাক। লন্ডনে কোম্পানির কর্তারা ভারতের কর্মীদের উচ্চাশাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে বললেন। কোম্পানির উচ্চতমপদাধিকারিকেরা কেন্দ্রিয় দপ্তরে চিঠি লিখে তোপ দেগে তাদের হাত বেঁধে না রাখার কথা বললেন।
    খ্রিস্ট ব্যবসায়ীরা আর এংলিসিস্টরা সরাসরি পথে নেমে পড়লেন। হিদেনদের অস্ত্রের ঝনঝনানি না শেনালে স্বাধীনতাকামী গ্রামীণেরা সভ্য হয়ে উঠবেনা এই তত্বও বেশ কল্কে পেল শহরে, মেট্রোপলিটনেও। এই পথের আপাত বিরোধী ওরিয়েন্টালিস্টরা। অনেকসময়ই মনেহত, সত্যিই তারা হয়ত ভারতের সংস্কৃতির জন্য সরাসরি ভাবছেন, স্থানীয় ভাষা শিখছেন, পুরোনো দিনের নানান উজ্জ্বল তথ্য খুঁজে বার করছেন ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু ভারতের সংস্কৃতি বিশ্লষণে কিন্তু এই দুই শিবির মোটামুটি একই পখগামী। দুই পথের পথিকেরা একইভাবে ভাবছেন ব্রাহ্মণেরা ইওরোপিয় পাদ্রিদেরমতই পুরোহিত। ভারতের নানান অঞ্চলের ধর্মীয় জ্ঞাণচর্চায় এবং সামাজিকতায় পুরোহিততন্ত্রেরে প্রভাব অসামান্য। দুই শিবিরেরই ধারণা ভারতের সাধারণ মানুষ দুর্ণীতিপরায়ণ পুরোহিততন্ত্রের জন্যই। আর বেদকে শাস্ত্ররূপে দেখার চেষ্টা ছিল দুই পক্ষেরই। দুই পক্ষই উচ্চশ্রেণী শহুরে রাজনীতিতে বিশ্বাসী।

    ইংরেজদের ভারতভাগের ৪০০ বছর
    বাঙালিকে রেনেসাঁর ঝুলন্ত গাজর দেখাবার কয়েক দশক আগেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সরাসরি মদতে ১৭৬১সালে লুক স্কার্ফটন কোম্পানির অর্থ সাহায্যে লিখলেন, রিফ্লেকশনস অন দ্য গভর্ণমেন্ট অব ইন্দোস্তান এন্ড আ শর্ট স্কেচ অব দ্য হিস্টোরি অব বেঙ্গল। এই বইটি বিপুলভাবে ব্রিটেনে সাধারণের দ্বারা পঠিত হল। বিক্রি হল মুড়িমিছরিরমত। এর পূর্বে বহু ইওরোপিয়, এশিয় ভ্রমণকারী খ্রিস্টীয় ধারণা বলে ভারতকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন। সে সব তত্বগুলি ইওরোপে কল্কেও পেয়েছে। কিন্তু সরকারী মদতে সেই প্রথম ভারতে ব্রিটিশ লুঠ, শাসন আর অত্যাচারের বৈধতার শেকড় ছড়াল ব্রিটেনে। বইটির মাধ্যমে ব্রিটেনের জনগণ এবং রাজনীতিকেরা সদ্য ভারতীয় উপনিবেশের সমাজ-ধর্ম-সংস্কৃতির একটি ওপর ওপর ধারণা তৈরি করলেন। ভারত-দাসত্ব-প্রকল্পের যে পরিকাঠামো সন্তর্পণে গড়ে তোলা হচ্ছে, সেই পথ তৈরির দিনগুলোতেই ভারতীয় ধর্ম-সংস্কৃতি-সমাজকে ইওরোপিয়দের দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করলেন স্কার্ফটন।
    ১৬৩০এর হেনরি লর্ডএর দেখানো পথে স্কার্ফটন লিখলেন ভারতে ব্রম্মাই আইনের রক্ষক, ধর্ম সংস্থাপক। আম ভারতীয়দের একটি বই রয়েছে। নাম বিদম। বইটিতে ভারতের সব ধর্মীয় তত্ব আর সম্প্রদায়ের বর্ণনা আছে। তখনও পাশ্চাত্যে সব ভারতীয় ধর্ম পুস্তকের উদ্দেশ্যপূর্ণ অনুবাদের কাজ শুরু হয় নি। প্রায় উঠে যেতে বসা কেম্পানির অর্থ ব্যয়ে ম্যাক্স মুলারের বেদএর অনুবাদকার্যসহ শুরুহতে তখেনো এক শতাব্দ বাকি। লর্ডএর অনুসরনে স্কার্ফটন বলছেন তিনি সেই সময় ভারতের নানান এলাকায় নানান ধরনের বেদের সংস্করণ দেখতে পাচ্ছেন। এ সব অনাচার। এগুলি সব ব্রাহ্মণদেরই কুকীর্তি। ইওরোপীয় বাইবেল মডেল অনুসারে ভারতে বেদের একটিই সংস্করণ হওয়া প্রয়োজন।
    এই প্রবণতা থেকে শুরু হয়েছে শিল্পবিপ্লবীয় জ্ঞাণচর্চায় কেন্দ্রিকৃত স্ট্যান্ডারডাইজেশনের উদগ্র বাসনা। রামমোহনের ৫০ বছর পূর্বে স্কার্ফটন বললেন ভারতের সমস্ত পতনের দায় ব্রাহ্মণদেরই। পরে ম্যাক্স মুলার এ কথা সরাসরি বলবেন, চোখে আঙুল দিয়ে। ঔপনিবেশিকতার দর্শণ প্রচারে বিশ্বজুড়ে যার প্রভাব পরবর্তীকালে অসামান্য রূপ গ্রহণ করবে। তখনও ঔপনিবেশিকতত্বে হিন্দুত্বের ধারনা আসেনি। স্কার্ফটন বইতে যে ভারতীয় জেন্টু ধর্মের কথা বলেছেন – যে জেন্টু পরেরদিকে ভারতচর্চায় হিন্দু কথাটিতে রূপান্তরিত হবে এবং নানান গুরুত্বপূর্ণ ইওরোপিয় ঔপনিবেশিক দাসত্ব প্রকল্প নির্দেশকের হাতে পড়ে আজকের হিন্দুধর্মে রূপান্তরিত হবে। এর পর জন জেফানিয়ে হলওয়েলের লেখা ইন্টারেস্টিং হিস্টোরিক্যাল ইভেন্টস, রিলেটিভ টু দ্য প্রভিন্সেস অব বেঙ্গল, এন্ড দ্য এম্পায়ার অব ইন্দোস্তান(১৭৬৫-৬৭) পাঠকের মনকে হিন্দুধর্ম বিষয়ে স্কার্ফটনের বর্ণনার রঙকে বেশ কিছুটা উস্কে একটু বেশিই রাঙিয়ে দিল।
    ১৭৯৯তে এশিয়াটিক রেজিস্টার প্রকাশনায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হিস্টোরি অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়ায় অনামা এক লেখক, প্রথম ভারতীয় হিন্দুধর্মের সঙ্গে ব্রাহ্মণ্য ধর্মকে একাকার করে চিহ্নিত করবেন। তিনি সরাসরি বললেন, ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মূল চালিকা শক্তিই বেদ। এর মূল বক্তব্য অবিনাশী আত্মা আর ভগবান। তাঁরই হাতে পড়ে আগামীদিনে বেদ হয়ে উঠল অবশ্যপাঠ্য ভারতীয় ধর্মশাস্ত্র। স্কার্ফটনের প্রতিপাদ্যকে আরও একটু এগিয়ে গিয়ে নিদান দিলেন প্রাচীণকালে ভারতীয়রা বেদের একটিই সংস্করণ মান্য করতেন। ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের চক্রান্তে বেদের নানান সংস্করণরূপে বিকশিত হল। যার ফল অজ্ঞাণতা। এই উদ্ভুত অজ্ঞাণতাই ভারতের সমস্ত সর্বনাশের মূলসূত্র।
    জেমস মিলের হিস্ট্রি অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার পঞ্চম সংস্করণে ভারতত্ববিদ, অক্সফোর্ডের সংস্কৃত ভাষার অধ্যাপক হোরেস উইলসন বললেন ইওরোপের বীশ্ববিক্ষা আর ভারতীয়দের বীশ্ববিক্ষার মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য। ভারতীয়রা আজও উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছতে পারে নি। এই শিখর ব্রিটিশেরা অনেক আগেই ছুঁয়েছে। ইওরোপ মূলগত(পিওর) ধর্মীয় ভাবনার দ্বারা পরিচালিত। ভারতে ধর্মীয় পিওরিটি নেই, তাই ভারতীয় ধর্মে দুর্ণীতির ঘুণপোকা বাসা বেঁধেছে। ১৮২৮ ও ১৮৩২ সালে প্রকাশ হয়েছে এশিয়াটিক রিসার্চেসএর দুই খন্ড, প্রথমটি বৈষ্ণবস আর দ্বিতীয়টি শৈবজ। বৈষ্ণব গ্রন্থের মুখপাতেই ধর্মীয় সংস্কারগুলোর বিশদ রসালো বর্ণনা লেখা হচ্ছে পশ্চিমি পাঠকদের সামনে।
    প্রাচ্যবাদীরা ব্রাহ্মণদের ধর্মান্ধ আর দুর্ণীতির আধার রূপে বর্ণনা করলেন। ইংরেজ আমলের ভারততাত্বিক চার্লস গ্রান্টএর কথা আমরা আগেই বলেছি। অবজারভেশন অন দ্য স্টেট অব সোসাইটি এমং এশিয়াটিক সাবজেক্টস অব গ্রেট ব্রিটেনে র লেখক ভারতত্ববিদ গ্রান্ট আবার সরাসরি বেদ বিরোধী,ভগবত্গীতা অনুগামী। গ্রান্ট বলছেন ভারতের দুর্দশার সমস্ত কারণ ব্রাহ্মণেরা। তাদোর কৌম স্বার্থের জন্য তারা আমজনতাকে ধর্মের আফিম খাইয়েছে। ভগবত্গীতাই শুধু আলোর রশ্মি। ব্রাহ্মণদের দুর্ণীতিপরায়ণতা, অশ্লীলতাকে সমর্থন করতে বেদ রচিত হয়েছে। বেদের নানান কুসংস্কার ব্রাহ্মণেরা সমর্থন করে চলেছে। গ্রান্টের পুস্তকে হিন্দু ধর্ম, ব্রাহ্মণ্য ধর্ম আর পুরোহিততন্ত্রের সরলরৈখিক সমাধান টানারও চেষ্টা হয়েছে ঘটাকরে করে। রামমোহন আর ম্যাক্স মুলারের হাতে পড়ে এই ধারণা আরও বিকশিত হবে।
    সচেষ্টভাবে পরিকল্পনা মাফিক সংগঠণ তৈরি করে দাসত্ব পরিকল্পনার ভিতখোঁড়া শুরু হল এশিয়াটিক সোসাইটির মাধ্যমে। প্রতিষ্ঠাতা বিচারক ভারতত্ববিদ গুরু উইলিয়ম জোন্স। লন্ডনে কোম্পানির প্রখ্যাতদের বাড়িতে বাড়িতে ছাত্র পড়ানোর উঞ্ছবৃত্তি করতেন জোন্স। টিউশনির মাঝে কী করে প্রখ্যাত হবেন সেই চিন্তাটাও প্রবল ছিল! কাকতালীয়ভাবে বন্ধু জাইদএর সহায়তায় ইসলামিক আইন ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। এতেই ভারতে সুপ্রিম কোর্টের প্রধাণ বিচারপতি নিযুক্ত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন। গুরু উইলিয়ম জোন্সএর পদপ্রান্তে ভারতীয় মণীষার সাংগঠণিক দাসত্বের যুগের শেকড় রোপণ শুরু হল। সেই শেকড়ের বাড়-বড়ন্ত হবে মেকলের ভারতীয় দাসত্বের পরিকল্পনার উত্তরসূরী ম্যাক্স মুলারের তত্বে। স্বাধীণতার অর্ধশতাব্দ পরেও তাঁরা উজ্জ্বল। প্রচারের ঝড়ে ভারতের শহুরে মধ্যবিত্তকে বুঝিয়ে দেওয়া হল ব্রিটিশরাজ ভারত দখল না করলে এ দেশ পড়ে থাকত পশ্চাদপদতার অন্ধকারে। মুক্ত মননএর অধিকারী ব্রিটিশ শাসনে চরমতম আস্থা প্রকাশই বুদ্ধিমানের কাজ।
    এদিকে মূঢ়, ধর্মান্ধ, আর অসংস্কৃত গ্রামীণ ভারত কিন্তু ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে। শহুরে বিদ্যেবোঝাইবাবুমশাইরা ব্রিটিশদের বুদ্ধির দাসত্বের অনুগামী হয়ে বুঝে গেলেন, ভারত সামগ্রিকভাবেই ধর্মান্ধ এবং ভাগ্যবাদী। ভারতে জাতীয়তাবোধ নেই, সংস্কৃতিও নেই। আচার্য ম্যাক্স মুলার পরে বলবেন, ভারতীয় সংস্কৃতি বলে যদি কিছু থাকে, তাহলে তা এনেছে বৈদেশিক আর্যরা। সমস্ত ধ্রুপদী (ধ্রুপদী নাম পেল কেন কে জানে!) সাহিত্য-কলাকৃতি উদ্ধারের দায় বর্তাল ভারত উদ্ধারে আসা শাসক নব্য আর্য ইংরেজদেরই সদিচ্ছার ওপর। সোরা সরি বললেন, ইংরেজরা জেন্টু ভারতে পদার্পণ করেছিল বলেই ভারত তার হারানো সাহিত্যিক রত্নগুলি উদ্ধার করতে পারল। শহুরে ভারতীয়রা ইংরেজী বদান্যতায় গদগদ। ভারতের মনীষীদের ইংরেজ গুরুরা বোঝালেন একদিন অন্ধকারে থাকা, যোগ্যতাবিহীন ভারতীয়রা ভুলেই গিয়েছিল তাদের প্রাচীন সম্পদগুলি। উইলিয়ম জোন্স ভারতে না এলে যে কী হত! সমগ্র বাঙালি তথা ভারতীয়রাই রসাতলে যেত। দাসত্ব প্রকল্পের আন্যতম অধিপ্রকল্প ভারত উদ্ধার প্রকল্পে প্রথম ব্রিটিশ মসিহা হয়ে এলেন গুরু জোন্স।

    আত্মবিস্মৃতি
    ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্যতম বড় অংশিদার, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পোষিত নবজাগরণের অগ্রদূতেদের উদ্যোগে আবির্ভুত হল আত্মবিস্মৃত বাঙালি প্রকল্পটি। ভারতের নানান হারানিধি উদ্ধার করে ব্রিটিশরা ভারতকে বিশ্বজগতে স্থান দিলেন। বাঙালি ভাবল ইংরেজের পৌরুষপূর্ণ, সবল, সংস্কৃত হাত ধরে ভারত আবার জগতসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে। বাঙালির ইতিহাসবোধের ন্যুনতা প্রচার তখন থেকেই শুরু হয়েগিয়েছে। ব্রিটিশগুরুরা একস্বরে নিদান দিলেন বাঙালির, জাতিয়তা নেই, ইতিহাস নেই, বর্তমানের সংস্কৃতি নেই। এই ভাবনার অন্যতম ভারতীয় স্থপতি, ভারতের ওয়াল্টার স্কট, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ইংরাজদের অনুসরণে স্পষ্টভাষায় বাঙালির চোখে আঙুল দিয়ে, কাগজে কলম নেড়ে বুঝিয়ে দিলেন, বাঙালিদের ইতিহাসবোধটিকে নিয়ে নতুন করে ভাবা প্রয়োজন। সেটি লিখতে হবে, নতুন ভাবে, নতুন মর্মভেদী দৃষ্টিতে, নতুন কৃষ্টিতে। প্রমাণিত হয়ে গেল বাঙালি তথা ভারতীয়দের নিজস্ব কৃষ্টি, ভাবনা, জ্ঞাণ, সংস্কৃতি, প্রযুক্তি সব কিছুই ছিল অনাদি অতীতে। তার পর মহা শূণ্য। ভারত মুর্খদের দেশে পরিণত হয়েছে। ইওরোপিয়রা ভারতে মহান সভ্যতা নিয়ে এসেছে। অতীতের ভারত আর নেই। নতুন করে ভারতকে গড়ে তুলতে হবে।
    ততকালীন তথাকথিত শহুরে রেণেসাঁজাত বিপ্লবী যুবকবৃন্দকে প্রকারান্তরে বলে দেওয়া হল ভারতীয় হওয়ার বদলে ইওরোপিয় সহবত শিখতে, নিদেন পক্ষে ইওরোপের সমাজ, সংস্কৃতি চালচলন সম্বন্ধে ন্যুনতম জ্ঞাণ সঞ্চয় করে আধুনিক হতে। একহাতে ব্র্যান্ডি অন্যহাতে বাইবেল নিয়ে বালখিল্য বিপ্লবের মহড়া চলল বাঙলার বলাভাল কলকাতার অলিগলিতে। কলকাতা শহরের টগবগে যুবকদের লব্জে একটিই ভাষা- রিফর্ম, রিফর্ম, আরও রিফর্ম। সকলেরই মূল মন্ত্র সমকালীন ভারতকে ঘেন্না করা, সমকালীন সবকিছুই বাতিল করা। এমনকী বাঙলার প্রান্তে প্রান্তে যে সব গ্রামীণ স্বাধীণতা সংগ্রামীরা ব্রিটিশ সরকারের শেষ দেখতে চেয়ে নিজেদের জীবনপণ করে লড়াই করছিলেন, তাদের মূঢ়, অজ্ঞ, দরিদ্র, চন্ডাল বলে দেগেদিলেন নানান জ্ঞাণী ভারতীয়। তাদের মরনপণ লড়াইএর পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে, কখোনো বিশ্বাসঘতকতায়, ব্রিটিশদের হাতে হাত ধরে শহুরে ভারতীয়দের নতুন করে গড়ে তোলার চেষ্টা চলল। রিফর্ম আন্দোলনে, সাধের ব্রিটেন থেকে তাত্বিক ভিত্তি রূপদানে, বাঙলায় দলে দলে বরণ করে আনা হল ভারতকে প্রকাশ্যে ঘেন্নাপিত্তিকরে বিবৃতি দেওয়া ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পোষিত প্রখ্যাত ব্রিটিশ বুদ্ধিজীবিবৃন্দকে। মোটামুটি ঠিকই হয়েই গেল, তত্কালীন বাঙলাকে গালাগালিকরে যে ইওরোপিয়ই প্রকাশ্যে বিবৃতি দেবেন, তিনিই রিফর্মিস্ট আন্দোলনের গুরুঠাকুর হবেন। ব্রিটিশ প্রণোদিত ভারত তথা বাঙলার সাংস্কৃতিক গণহত্যা প্রকল্পের পৌঁছল চরম শিখরে। নিজের দেশে ইংরেজিশিক্ষিতরা ব্রিটিশ বনতে চাইলেন।
    মেকলের শালাবাবু চার্লস ই ট্রেভলিয়ন লিখলেন, " Familiarly acquainted with us by means of our literature, the Indian youth almost cease to regard us as foreigners. They speak of "great" men with the same enthusiasm as we do. Educated in the same way, interested in the same objects, engaged in the same pursuits with ourselves, they become more English than Hindoos, just as the Roman provincial became more Romans than Gauls or Italians..." ১৮৫৩র ২৩ জুন, হাউস অব লর্ডসএর সিলেক্ট কমিটিতে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের আগামীদিনের উদ্দেশ্য বর্ণনা করতে গিয়ে ট্রেভলিয়ন বললেন, the effect of training in European learning is to give an entirely new turn to the native mind. The young men educated in this way cease to strive after independence according to the original Native model, and aim at, improving the institutions of the country according to the English model, with the ultimate result of establishing constitutional self-government. They cease to regard us as enemies and usurpers, and they look upon us as friends and patrons, and powerful beneficent persons, under whose protection the regeneration of their country will gradually be worked out...( reports from (Select)committees thirty-two volumes)"
    ইওরোপিয় মডেলে বিদ্যালয় তৈরির মধ্যে দিয়ে শুধু নয়, বিদ্যালয় গড়ার বাইরেও ব্রিটিশ আর ব্রিটিশিয়দের সরাসরি উদ্যমে গড়ে উঠল ব্রিটিশ সভ্যতা অনুরাগী এক দল প্রথমে বাঙালি, পরে ভারতীয় নানান প্রদেশের বুদ্ধিজীবিরা আর তাদের উত্তরসূরীরা দার্শনিকভাবে ভারতীয় সভ্যতা, তত্কালীন ভারতের নানান দিক ধংস করতে, সরাসরি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রচারক রূপে ভারতের স্বাধীণতার পরেও দাস্যভাবে কাজ করে যাবেন। ১৮৪৬এ টমাস ব্যাবিংটন মেকলে যিনি কিছু বছর পরেই ভারতীয় সাম্রাজ্যকে যথাবিহিত সেবার জন্য ব্যারন উপাধি উপহার অর্জন করবেন, এডিনবরা ফিলজাফিক্যাল সোসাইটিতে এক বক্তৃতায় বললেন, "To the literature of Britain ... which has exercised an influence wider than that of our commerce and mightier than that of our arms ...before the light of which impious and cruel superstitions are fast taking flight on the Banks of the Ganges!"
    ইংরেজি লুঠেরা বাণিজ্য এবং সৈন্যবাহিনীর শস্ত্রের থেকেও ভারত বিজয়ী হয়ে উঠল ব্রিটিশ সাহিত্য। প্রথমে বাঙালি পরে সর্বভারতীয় সাহিত্যিকবৃন্দের কেউ ভারতের স্কট, কেউ শেলি, কেউবা আবার বায়রণ ছাপ পেয়ে মহা গর্ব অনুভব করছেন। স্বদেশে পিতাকে লেখা এক পত্রে মেকলে বললেন, কলকাতায় ইংরেজি বিদ্যালয়গুলি রমরম করে চলছে। হিন্দুদের ওপর এগুলির প্রভাব হয়েছে মারাত্মক। ব্রিটিশ সংস্কৃতিতে বাঙালির মানসিক আত্মীয়তা তাকে এতই আচ্ছন্ন করে ফেললন যে, তিনি ভাবতে শুরু করলেন শিক্ষিত ভারতীয়দের মধ্যে আগামীদিনে কোনও মূর্তিপূজক থাকবে না। তিনি এই(দাসত্ব) প্রকল্পকে দারুন এনজয় করছেন। মেকলের কথায় শুনি- “Our English schools are flourishing wonderfully। The effect of this education on the Hindus is prodigious...It is my belief that if our plans of education are followed up, there will not be a single idolator among the respectable classes in Bengal thirty years hence. And this will be effected without any efforts to proselytise, without the smallest interference with religious liberty, by natural operation of knowledge and reflection. I heartily rejoice in the project(Pivotal Issues of Indian Education - S K Kochar)”. বরাবরই সাম্রাজ্যের সঙ্গে ধর্মীয় প্রচারকেরা হাতধরাধরি করে এগিয়েছেন। ধর্মান্তর আর সাম্রাজ্য প্রসারণ দুটি হাত ধরাধরি করে এগোতে শুরু করে – ঠিক যেমন করে লাতিন আমেরিকায় সিআইএর অন্যতম সহচররূপে পাদ্রিরা পঞ্চম বাহিনীর করেছেন।
    ১৮৪০। বাঙলায় ইংরেজ প্রণীত দাসত্ব প্রকল্প মোটামুটি থানা গেড়ে বসার মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। কয়েক বছর আগে, ১৮৩৩এর ১০ জুলাই ভারতে আসা আগেই, ব্রিটিশ পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বুক চিতিয়ে মেকলে বলেছিলেন যে, ভারতীয়দের সঙ্গে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বন্ধুত্ব(হয়ত বলতে চেয়েছিলেন দাসত্ববন্ধন) বেশ মাখোমাখো হয়ে উঠেছে। এবার আর ইংলন্ড থেকে প্রশাসক নিয়ে আসার প্রয়োজন নেই, ভারতীয়রা নিজেদের মূঢ় গ্রামীণদের শাসনে উপযুক্ত হয়ে উঠছে। ভারতীয়দের সরাসরি ব্রিটিশ লুঠের সাথী বানাতে চাইছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্য। ভারতীয় people are everywhere perfectly competent to hold some share, not in every country an equal share, but some share of political power(সুত্রঃ ঐ)। এবার শাসন ক্ষমতায় অংশিদারিত্বের শুধু মান্যতা পাওয়ার জন্য সাম্রাজ্যকে সময় আর সেবা প্রদান জরুরী হয়ে উঠল। প্রথমে রামমোহন এবং পরে ততশিষ্য দ্বারকানাথের নেতৃত্বে একঝাঁক হিন্দু কালেজের যুবা মণীষী এগিয়ে এলেন।
    দাসত্ব প্রকল্প ইংরেজি জানা ভারতীয়দের মনেজগতে স্থায়িত্বের দিকে এগোবার গতিপেল জার্মান ম্যাক্স মুলারের আবির্ভাবে। তার সঙ্গে সাংস্কৃতিক গণহত্যা আর দাসত্ব প্রকল্পে সরাসরি আবির্ভূত হলেন আর এক ভাগ্য সন্ধানী পাদ্রি উইলিয়ম কেরি। বাঙলা বাজারে কেরি ইওরোপিয় জাতভাইদের বোঝালেন, চলনসই সংস্কৃত না শিখেও, শুধু বাঙালি সংস্কৃত জানা পন্ডিতদের সাহায্য নিয়ে এবং সেই সাহায্যের কথা বেমালুম চেপে গিয়ে নিজের কাজ বলে দাবি করে, কীভাবে ভারতীয় নানান সাহিত্য ইওরোপিয়তার দৃষ্টিতে অনুবাদের কাজ করা যায়। সংস্কৃত না জেনে, ব্যকরণ বই আর অভিধান হাতে চলনসই সংস্কৃত শিখে, বাঙালি পন্ডিতদের মেধাবলে নানান সংস্কৃত গ্রন্থের অনুবাদকর্ম করে বহু ইওরোপিয় ব্রিটিশ পন্ডিত উপাধি পেয়ে গেলেন। এই গ্রন্থগুলি উদ্ধারের কৃতিত্ব দাবি করে ভগিরথের মর্যাদা লাভ করলেন। অথচ এই গ্রন্থগুলি বাঙলায় পাওয়া যেত। পন্ডিতদের কন্ঠস্থও ছিল। টোলেও পড়ানো হত। বাঙালি হিদেন ব্রাহ্মণ পন্ডিতেরা বিন্দুমাত্র কৃতিত্ব পেলেন না। উপেক্ষিত থেকে গেলেন। দেশি পন্ডিতদের কৃতিত্ব গঙ্গা জলে ধুয়েমুছে গেল। প্রচারের সমস্ত আলো কেড়ে নিলেন ব্রিটিশাররা।
    যাঁরা এই ব্রাহ্মণদের পাশে দাঁড়াতে পারতেন, তারা তখন পারলে ততকালীন বঙ্গ সংস্কৃতি চুঁচি চিপে তার ওপর ব্রিটিশ সংস্কৃতির চকচকে গর্দভ চর্মটি পরিয়ে দিতে পারলেই বাঁচেন। গ্রান্ট, স্কার্ফটন, রামমোহন, কেরি আর জোন্সএরমত ইওরোপিয় ধর্মযাজক আর ব্রিটিশ বুদ্ধিজীবিদের লেখনীর প্রচারে প্রভাবে প্রভাবে ততদিনে মোটামুটি বাঙলা তথা ভারতীয় ব্রাহ্মণেরা এদেশিয় সমাজের চির শত্রু হয়ে উঠেছেন। তত্কালীন যুবকদের বাঙালি ব্রাহ্মণদের পাশে দাঁড়ানোর অর্থই ভারতের সংস্কৃতির পাশে এসে দাঁড়ানো। যাঁরা রিফর্মের দাবিতে সনাতন বাঙলার প্রতিটি কাঠামো ভাঙতে উঠেপড়ে লেগেছেন, তাদের কাছে ব্রিটিশদের প্রত্যেকটি তত্বই বেদবাক্য। Richard Fox Young বলছেন "To gain the ear of those who are thus deceived it is necessary for them to believe that the speaker has a superior knowledge of the subject. In these circumstances a knowledge of Sanskrit is valuable. As the person thus misled, perhaps a Brahman, deems this a most important part of knowledge, if the advocate of truth be deficient therein, he labors against the hill; presumption is altogether against him. (Resistant Hinduism: Sanskrit sources on anti-Christian apologetics in early nineteenth-century India, - Richard Fox Young)"
    শহুরে ভারতীয়দের মানসিক দাসত্বের বন্ধনে বেঁধে ফেলতে, ভারতীয়দের মননে, ভারত এবং বিশ্ব সম্বন্ধে সরাসরি ইওরোপকেন্দ্রিক ধারনা গড়ে তুলতে, ভারতের নতুন প্রতিমা তৈরির উদ্যেগ নিতে শুরু করল চলনসই সংস্কৃত জানা, না জানা ইওরোপিয়রা। এদের ভারত সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা ছিল না। সংস্কৃত বা ভারতের সমাজ সম্বন্ধে ছিল না শ্রদ্ধা-ভালবাসা। এরা অধিকাংশই, উপনিবেশের মাঠার তত্ব এবং খৃস্ট ধর্ম প্রচার করতে এসেছিলে। এদেরই দেখানো পথে, ভারতের সংস্কৃতি-অর্থনীতি-সমাজের বিশ্লষণ শুরু হল। এরা সকলেই ভারতের সংস্কৃতি আর ধর্মকে লুঠেরা অত্যাচারী শাসিতের দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখেছেন।
    উইলিয়াম কেরির উদাহরণ দিলেই বিষয়টি পরিস্কার হবে। অতিখ্যাত উইলিয়ম কেরির নামে একটি স্বেচ্ছাব্রতী সংস্থা – উইলিয়ম কেরি স্টাডি এন্ড রিসার্চ সেন্টার বাঙলায় একটি পুরস্কারও প্রবর্তন করেছিল কয়েক বছর আগে। অথচ বাঙলা, বাঙালিদের সম্বন্ধে একটুকুও শ্রদ্ধা ছিলনা কেরির। বাঙলা শেখা তাঁর ধর্ম প্রচারের হাতিয়ার ছিল। যেহেতু তিনি খ্রিস্ট ধর্ম, রাজার ধর্ম প্রচার করছেন, বাঙালিদের কাছে তিনি ধোওয়া তুলসিপাতা। তিনি যদি ভারতীয় হয়ে, ভারতীয় কোনও ধর্ম প্রচার করতেন, তাহলে তাকে ধর্মান্ধ হিসেবে দেগে দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা হতনা শহুরে ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালির। আজও তিনি ইংরেজ আমলের বাঙলা লেখনপর্বের অন্যতম জনক রূপে শ্রদ্ধা অর্জন করে চলেছেন। ১৭৯৭ সালে তার প্রকাশিত অবজারভেশনএ ভারতীয়দের প্রত্যেকটি প্রথার বিরুদ্ধে কঠোর বিষোদ্গার শুরু করেন। যে বাঙলায় কাজ করতে এসেছিলেন, সেই বাংলার বাঙালিদের সম্বন্ধে তার বক্তব্য "lacking in truth, honesty and good faith"। এঁর সঙ্গে বাঙলা বিদ্বেষী কোম্পানির ভারতের বড় কর্তা, গভর্নর জেনারেল কর্নওয়ালিশ নাম জুড়ে দিলে আরও সরেস হবে। কেরির তুলনায় এক পা এগিয়ে এই রাজপুরুষ ভারতীয়দের সম্বন্ধে বললেন, "Every native of Hindostan, I verily believe, is corrupt"। এঁদেরই পায়ে প্রণতিপাত করলেন রিফর্মিস্টরা, আজও যাঁদের সত্কর্ম ভারতের তথা শহুরে বাঙলার ঘরে ঘরে পুজিত।

    ভারত ঘৃণাতত্ব প্রকল্প
    যেসব ইওরোপিয় মণীষার ভারত বিরোধী বক্তব্যে আর প্রগতিশীল লেখনিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাঙলার দালাল-কামাল যুবকেরা রেনেসাঁ, রিফর্মিস্ট আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে জন রাস্কিন অন্যতম। রাস্কিনের বই নাকি কলকাতার বইএর দোকানে পড়তে পেত না। বাঙলা বাজারে আসা মাত্রই উধাও হয়ে যেত প্রায় প্রত্যেকটি বই। ভারত সম্বন্ধে কী বলছেন প্রায় তা না জেনেই, ততকালীন ব্রিটিশ বুদ্ধিজীবিদের লেখা পড়ে কীভাবে রিফর্মিস্ট আন্দোলনে নিবেদিতপ্রায় বাঙালিরা উদ্বুদ্ধ হতেন, সে সম্বন্ধে প্রচুর গবেষক, প্রত্যক্ষদর্শী, গাশিরশিরে, চোখে জল আসা বিস্তৃত বর্ণনা দিয়েছেন। স্বাধীণ ভারতে বহু মানুষ তাঁদের এই প্রতিবেদনে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। রাস্কিনের ভারতবিরোধী আদর্শ স্বাধীণতার অর্ধশতাব্দ পরেও, অনির্বাণ দীপের ন্যায় সতত প্রজ্জ্বলিত থেকেছে, অন্ততঃ শহুরে বাঙালিদের মানসপটে। ভারতের নবজীবনের অগ্রদূতদের গুরু, যার হাত ধরে বাঙলার দামালদের সমাজের বেটুপাত (অসমিয়া শব্দ। বাঙলা অর্থ মুখপাত) হচ্ছে, সেই রাস্কিন শুধুই ভারতীয় শিল্প সম্পর্কে কী বলছেন, একটু পড়ে নেওয়া যাক, অন্যান্য আরও কড়া কড়া নিদানগুলি, চরমতম বক্তব্যগুলি নাহয় নাই বলা গেল, অনেকেরই স্বপ্ন ধংস হতে পারে, "...the Indian will not draw a form of nature but an amalgamation of monstrous objects"। বাঙলার নবজাগরণের ইওরোপিয় গুরুঠাকুর আরও জানালেন, "To all facts and forms of nature it wilfuly and resolutely opposes itself; it will not draw a man but an eight armed monster, it will not draw a flower but only a spiral or a zig zag"। একই সুরে George Birdwood নিদান দেবেন, "...painting and sculpture as fine art did not exist in India."
    ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চাকুরে, জেমস মিল, যাঁর ১৮১৮তে প্রকাশিত ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাস পড়ে ভারতীয়রা ভারতকে জানতে উদ্বুদ্ধ হবেন, বাঙলার নবজাগরণের অগ্রদূতেরা নিজেদের আন্দোলনের দিশা ঠিক করবেন, আজও যিনি স্বাধীণতাকামীদের অন্যতম উদ্গাতা, তিনি ভারত সম্বন্ধে কী বলছেন একটু জানা যাক। তার মতে ভারতের সমাজ স্থিতিশীল, জড়তাবদ্ধ। এই সমাজে বিতর্কের অবকাশ ছিল না। সমাজে কোনও প্রযুক্তির বিকাশও দেখা যায় নি। ব্রিটিশরা এসে প্রথম ভারতকে খোলা জানালার পথ দেখাল। আজও সবাই ভারত সম্বন্ধে যা বলছেন, তিনি তখনও সেই কথা কম্বুকন্ঠে বলছেন- জাতব্যবস্থায় জড়িয়ে থাকা ভারতে ব্রিটিশেরা এসেছে উদ্ধারকর্তারূপে। তার হাত ধরেই ভারতের সমাজের প্রত্যেক স্তরের বর্তমান স্থিতিশীলতার অলঙ্ঘনীয়তম তত্ব জুড়ে বসেছে পশ্চিমি আর পশ্চিমবাদী লেখক আর বুদ্ধিজীবিদের লেখায়। ঔপনিবেশিক মানসিক দাসত্ব প্রকল্পের অন্যতম গুরু মিল, এখনও ভারতীয় পাঠ্যপুস্তকে তিনি প্রণম্য ভূমিকায় থেকে গিয়েছেন।
    ভারত সম্বন্ধে ঔপনিবেশিক ভিক্টোরিয় দৃষ্টিভঙ্গীর বাইরে বেরোতে পারেননি চার্লস ডারউইন। নিজে দাস প্রথার চরম বিরোধী হয়েও অ-ইওরোপিয়দের বিরুদ্ধে তাঁরকলম অন্যান্য সমকালীন তাত্বিকদের লেখা থেকে কোনও মতেই আলাদা বলা যাবেনা। প্রাকৃতিক নির্বাচনবাদের প্রবক্তা ডারউইনের প্রিমিটিভ বা স্যাভেজ রেস তত্বে বলছেন, “at some future period, not very distant as measured by centuries the civilized races of man will almost certainly exterminate, and replace, the savage races throughout the world.” ইওরোপিয় ঔপনিবেশিক উন্নয়ণবাদকে তিনি সর্থকদৃষ্টিতে দেখে বলছেন, এরফলে মানুষ(পড়ুন ইওরোপিয়), আর তার কাছাকাছি থাকা মানবেতর প্রজাতিগুলি- Negro or Australian and the gorillaকে কাছাকাছি আনবে। তবে হেগেল ভারত সম্বন্ধে যা বলেছেন তার পাশে ডারউইনকে রাখলে, ভারতীয়দেরকাছে সেই তত্ব, যথেষ্টই নিরামিষ বলে মনেহতেপারে।
    চিন্তনগুরু হেগেলের লেখনি নির্ভর করে মার্ক্স, মদ্যপান আর ডুয়েল লড়া ছেড়ে বামপন্থার আঁতুড় ঘরে প্রবেশ করবেন। চরমতমবামপন্থী হেগেল তাঁর লেখায় সাম্রাজ্যের সপক্ষে সওয়াল করেছেন। বললেন "If we had formerly the satisfaction of believing in the antiquity of the Indian wisdom and holding it in respect, we now have ascertained through being acquainted with the great astronomical works of the Indians, the inaccuracy of all figures quoted. Nothing can be more confused, nothing more imperfect than the chronology of the Indians; no people which attained to culture in astronomy, mathematics, etc., is as incapable for history; in it they have neither stability nor coherence।" উপনিবেশিত ভারতীয়দের ভাগ্য সম্বন্ধে তাকে স্পষ্ট বলতে হল, "The British, or rather the East India Company, are the masters of India because it is the fatal destiny of Asian empires to subject themselves to the Europeans." আজও বাঙলায় পূজিত, মহাত্মা হেগেল আফ্রিকিয়দের সম্বন্ধে(সেই ধারণা এশিয়দের সম্বন্ধেও বোধ হয় তাঁর ছিল) কী বলছেন, "It is characteristic of the blacks that their consciousness has not yet even arrived at the intuition of any objectivity, as for example, of God or the law, in which humanity relates to the world and intuits its essence...He [the black person] is a human being in the rough।"
    এই ঘৃণাভরা কৃষ্টির পথ ধরে গড়ে উঠবে সাম্রাজ্যের কেন্দ্র মেট্রোপলিটন থেকে আমদানি করে আনা গণতন্ত্রের ধারণা। উপনিবেশিক সময়ের মতই মানসিক দাসত্ব প্রকল্পে অবনত, ভারতীয়রা ভারতীয় সংস্কৃতি সম্বন্ধে বিষোদ্গার করা মহান আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব সম্বন্ধে আজও উচ্ছসিত। হেগেলের পথ ধরে ১৯৩০এ আরও এক আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব, ম্যাক্স ওয়েবার ভারতীয় দর্শণ আর সাহিত্য বিষয়ে বলবেন যে এগুলি material renunciationএর উপর ভিত্তি করে লেখা। তিনি ভারতীয় দর্শনের "world denying character" সম্বন্ধে সরাসরি আঙুল তুলবেন, বলবেন "Neither scientific, artistic, governmental, nor economic evolution has led to the modes of rationalization proper to the Occident."
    সর্বপ্রথম ইওরোপিয় ইতিহাসকে সার্বিক বিশ্বের সার্বজনীন ইতিহাসরূপে বর্ণনা করবেন হেগেলই। তার মতে ইওরোপ আর আমেরিকাই বিশ্বসভ্যতার পীঠস্থান। তিনি বলবেন, "universal history goes from East to West. Europe is absolutely the end of universal history. Asia is the beginning." এশিয়ার ইতিহাস নেই, বঙ্কিম কথিত বাঙলায় আজও পুজ্য এই শব্দবন্ধটির স্রষ্টা যে পরোক্ষে হেগেলই তা হয়ত অনেকেই জানি না। ইওরোপকে খেপিয়ে লাভনেই তাই আমরা বাঙালিরা চুপ থাকি- পরের গবেষণা প্রকল্পটি যদি হাতছাড়া হয়ে যায়! বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পড়তে যদি ডাক না পাই। আর যাঁরা বিদেশে থাকেন, প্রণম্য, তাঁরা ভিমরুলের চাকে কেনইবা ঢিল ছুঁড়বেন! বেশতো আছেন। করেকম্মে নানান বিশ্ববরেণ্য উপাধিপেয়ে দেশে-বিদেশে প্রায় পুজ্যপাদ।
    হেগেলমশাই সরাসরি উপনিবেশের শোষনের হাতিয়ার তুলেদিলেন শাসক ইংরেজদের হাতে। আরও একধাপ এগিয়ে বললেন (পরে তা শিষ্য মার্ক্সএর লেখাতেও পরোক্ষে উঠে আসবে), "Because history is the configuration of the Spirit in the form of event, the people which receives the Spirit as its natural principle…is the one that dominates in that epoch of world history…Against the absolute right of that people who actually are the carriers of the world Spirit, the spirit of other peoples has no other right।" শুধু পশ্চিম বা ইওরোপই নয়, নিজে যেহেতু জার্মান তাই জার্মান উদ্যমের কথা স্পষ্ট করে বলবেন তাঁর লেখায়, "The Germanic Spirit (Germanische Geist) is the Spirit of the New World (Neuen Welt), whose end is the realization of the absolute truth, as the infinite self-determination of liberty that has for its content its proper absolute form. The principle of the German Empire ought to accommodate the Christian religion. The destiny of the Germanic peoples is that of serving as the bearer of the Christian principle."
    জার্মান শব্দের স্থানে ব্রিটিশ শব্দটি প্রতিস্থাপন করে নিলেই ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কার্যকারিতা সম্বন্ধে প্রশ্ন তোলার ল্যাঠাটি চুকেবুকে যায়। সে সময়কার দামাল বাঙালিরা এঁদের দেখানো রাস্তার বাইরে গিয়ে ভাবতেই পারতেন না যে ভারত অথবা বাঙলা কখোনো ইংরেজ শাসন থেকে মুক্তি লাভ করতে পারে। স্বাধীণতা সংগ্রামী গ্রামীণরা শহুরে ইংরেজি শিক্ষিত, ব্রিটিশ পোষিত ততকালীন ব্রিটিশ রাজত্বের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণতম শহরের বাসিন্দা নয়। এঁরা গেঁয়ো মূঢ়, অজ্ঞ, অশিক্ষিত বাঙালি। ইওরোপিয় তত্ব মুখস্থ করে আধুনিক হয় নি। তাই অজ্ঞ। জান্তব প্রকৃতি দমন করতে না পেরে মহান ব্রিটিশদের রাজত্বের বিরুদ্ধে, লুঠেরা শাসনের অবসান চেয়ে স্বাধীণতা সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। কলকাতায় বসবাস করলে ইংরেজদের বাত্সল্যের কথা ঠিক বুঝত। স্বাধীণতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ত না।
    হেগেলকে সাম্রাজ্যবাদিতার পক্ষে সরাসরি দাঁড়িয়ে বলতে হয়, "By a dialectic which is appropriate for surpassing itself, in the first place, such a society is driven to look beyond itself to new consumers. Therefore it seeks its means of subsistence among other peoples which are inferior to it with respect to the resources which it has in excess, such as those of industry. This expansion of relations also makes possible that colonization to which, under systematic or sporadic form, a fully established civil society is impelled. Colonization permits it that one part of its population, located on the new territory, returns to the principle of family property and, at the same time, procures for itself a new possibility and field of labor." বিশ্বকলোনাইজেশন তত্বের বামপন্থী গুরুঠাকুর হেগেলের পরেই যার কথা ওঠে তিনি রাজা রামমোহন রায়। ভারতীয়দের ভাগ্য সরাসরি ইওরোপের প্রতিভূ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে চিরকালের জন্য বাঁধা এ কথাও হেগেল স্পষ্ট জানালেন, "The British, or rather the East India Company, are the masters of India because it is the fatal destiny of Asian empires to subject themselves to the Europeans." এশিয়রা, ইওরোপের সাবজেক্টমাত্র, তার বাইরে শুধুই শূণ্য।
    অন্যান্য ইওরোপবাদী লেখকের থেকেও আরও কয়েক কদম এগিয়ে হেগেল বলবেন ভারতীয়দের জড় মনের কথা, অসংলগ্ন মনের কথা, পরমার্থবাদী মনেরকথা, সঠিক ইতিহাস না থাকার কথা, যে কথা তার পরের নানান সাম্রাজ্যবাদী ভারতীয় এবং ইওরোপিয় লেখকেরা বলবেন কম্বুকণ্ঠে, ইওরোপিয় গুরুবাদী মানসিকতা অবলম্বন করে। "If we had formerly the satisfaction of believing in the antiquity of the Indian wisdom and holding it in respect, we now have ascertained through being acquainted with the great astronomical works of the Indians, the inaccuracy of all figures quoted. Nothing can be more confused, nothing more imperfect than the chronology of the Indians; no people which attained to culture in astronomy, mathematics, &c,, is as incapable for history; in it they have neither stability nor coherence. It was believed that such was to be had at the time of Wikramaditya, who was supposed to have lived about 50 B.C., and under whose reign the poet Kalidasa, author of Sakontala, lived. But further research discovered half a dozen Wikramadityas and careful investigation has placed this epoch in our eleventh century. The Indians have lines of kings and an enormous quantity of names, but everything is vague." এর উত্তরে কিচ্ছুটি বলা যাবে না। তিনি আন্তর্জাতিক বামপন্থী মার্ক্সএর গুরুঠাকুর। ভারতকে বিন্দুমাত্র না জেনে, তার বিরুদ্ধে চরমতম বিষোদ্গার করতে পারার মণীষা একমাত্র ইওরোপের একচেটিয়া। কোনও কালে কেউ নকল করতে পারার স্পর্ধাও দেখাতে পারবে না। হেগেলের লেখার সূত্র ধরে ভারতের অতীত বিশ্লষণ আজও হয়।
    ইওরোপিয় বুদ্ধিজীবিদের লেখা মনগড়া তত্বগুলির ওপর ভিত্তিকরে আজকের ভারতীয় বুদ্ধিজীবিরা তাঁদের বাঙলা তথা ভারতীয় ইতিহাসবোধের, বোধির, দর্শণের যে যুক্তিগুলি সাজাচ্ছেন তার অধিকাংশই ভুয়ো, একদেশদর্শী, অসম্ভব জাতিবিদ্বেষী। ভারতের পরাধীণতার যুক্তি সাজাতে মনগড়া তত্ব বানাতে হয়েছে নানান ইওরোপিয় তাত্বিক লেখকদের। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের লুঠকর্মের গতিশীলতা বজায় রাখতে যেসব কোম্পানি-কর্মচারী ভারতে আসত, অথবা ভাগ্যান্বেষীরা যারা ভারতে আসত লুঠকর্মে সংশ্লিষ্ট হয়ে, নিজেদের আর্থিক ভাগ্য ফেরাতে, এঁদের অধিকাংশই জানত না ভারতকে, আরও কম জানত নানান ভারতীয় ভাষা, তার থেকেও কম জানত সংস্কৃত, আরও কম জানতেন ভারতীয় সংস্কৃতি আর ধর্ম, যা শিখতে গেলে এক প্রজন্মও যথেষ্ট নয়। খ্রিস্টধর্মে গভীরভাবে বিশ্বাসী। হিদেন ভারতকে ঘৃণা করতে অত্যন্ত ভালবাসত। ঘৃণা উগরেও দিত প্রকাশ্যে। ভারতীয়দের সেই কথা স্পষ্ট বলত। রিফর্মিস্ট আন্দেলনে জড়িয়ে থাকা ভারতীয়দের মিষ্টিমিষ্টি সোনা মুখে সেই বিকৃত ঘৃণাপূর্ণ তথ্য গলার্ধকরণ করতে হত। সাধারণ ভারতীয়রাই নয়, আজকের দৃষ্টিতে পরমপুজ্যপাদেরাও সেই তথ্যগুলো গলার্ধকরণ করতেন অসীম আনন্দে। ততদিনে ভারতীয়রা ইওরোপিয় গুরুঠাকুরদের সেই তথ্য গলা পর্যন্ত বিশ্বাস করে বসে আছেন।
    প্রতিবাদ করবে কে! সেসময়কার অধিকাংশ বাঙালির ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক আর সামাজিক স্বার্থ সাম্রাজ্যের লুঠের অর্থের ওপর সরাসরিভাবে নির্ভরশীল। অনেকেই ব্রিটিশদের এই তত্ব অবিশ্বাস করলেও, ব্রিটিশদের তত্ব বা তথ্যের সরাসরি বিরোধিতা করতে পারতেন না। যেসব ইওরোপিয় সত্যিকারের ভারতীয় সভ্যতা সম্বন্ধে শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, তাদেরও ভারতীয় সভ্যতা নিয়ে ব্রিটিশ ঘৃণাপূর্ণ মেকলেবাদের দাসত্ব প্রকল্পের বিপক্ষে যাওয়ার ক্ষমতা ছিলনা। আর উপনিবেশের পরাধীন হিদেন জনগণের আবার ইতিহাসবোধ কী! আজও মেকলেবাদের ভারতীয় ধারকবাহকেরা ব্রিটিশ দর্শণের দ্বারা তৈরি শহুরে ভারতকে ইতিহাসবোধ ধার দেওয়ার জন্য উপনিবেশের পায়ে নতজানু। সেই ইতিহাস বোধের পথ বেয়ে ইংলন্ডের শিল্পবিপ্লব হয়েছে, তাই আজ ভারতকেও শিল্পের বিপ্লবে ভাসিয়ে দিতে হবে। ইংলন্ডের ধর্ম এককেন্দ্রিক, তাই ভারতের ধর্ম এককেন্দ্রিক এ কথা শুধু প্রমাণ করলেই হবে না তাকে সরাসরি প্রচার দিতেও হবে। তাই জাতি সমাজ নির্বিশেষে সমস্ত ভারতীয়ই হিন্দু ছাপ পেল, জাতপাত ঘৃণ্যবস্ত হয়েউঠন। শহুরে ইংরেজিবাদী ভারতীয়রাও মেনে নিলেন।
    ব্রিটিশ শিক্ষাপদ্ধতিতে শিক্ষিত ভারতীয়রা মনেপ্রাণে সাম্রাজ্যবাদী তত্ব মেনে নিয়ে তাদের জীবন শুরু করলেন। এমনকী সারা ভারত ভ্রমণ করে গ্রাম-ভারতের অমিত বৈচিত্র্য দেখে পরবর্তীকালে যিনি মহাত্মায় পরিণত হলেন, যুবা বয়সে সেই গান্ধীও বুয়র যুদ্ধে জেনারেল স্মাটসএর সঙ্গে দেখা করে দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাসকারী ভারতীয়দের সমর্থনের কথা বলবেন। "General Smuts, sir we Indians would like to strengthen the hands of the government in the war. However, our efforts have been rebuffed. Could you inform us about our vices so we would reform and be better citizens of this land?" উত্তরে জেনারেল বলললেন, "Mr. Gandhi, we are not afraid of your vices, We are afraid of your virtues"। ব্রিটিশ পদ্ধতিতে শিক্ষিত ভারতীয়রা কথায় কথায় পিথাগোরাস, আরকিমিডেস, গ্যালিলিও বা নিউটনে আপ্লুত, কিন্তু পাণিনী, আর্যভট্ট, খনা, ভাস্কর বা বরাহমিহিরের কৃতির কথা জানেননা, জানলেও ভাসাভাসা। পাশ্চাত্য দর্শনে একগলা জলে ডুবে বসে থাকা ইংরেজি শিক্ষিত ভারতীয়রা বৌদ্ধ দর্শণ, জৈন মিমাংসা বা অন্যান্য ভারতীয় দর্শন সম্বন্ধে প্রায় জানেন না বলেই চলে। দিলীপ কে চক্রবর্তী এদের সম্বন্ধে সরাসরি বলবেন "The model of the Indian past...was foisted on Indians by the hegemonic books written by Western Indologists concerned with language, literature and philosophy who were and perhaps have always been paternalistic at their best and racists at their worst..."
    এশিয়দের সমগ্র সভ্যতার সাহিত্য, ব্রিটিশদের এক তক্তায় রাখা হাতে গোণা কয়েকটি বইএর থেকেও ন্যুন বলেছিলেন দ্বারকানাথের সরাসরি পৃষ্ঠপোষক, দ্বারকানাথের বেলগাছিয়া বাড়ির বেলেল্লাপনার নিয়মিত অতিথি, ঔপনিবেশিক তাত্বিক চার্লস ব্যাবিংটন মেকলে। দ্বারকানাথ আদর করে মেকলেকে বেলগাছিয়া ভিলায়, লখনৌ থেকে নিয়ে আসা নাচবালাদের নৃত্য দেখাচ্ছেন- আর তথাকথিত গুমোট, নোংরা, সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় রাজধানীর মফঃস্বল এক শহরে বসিয়ে দামি দামি ইংরেজি ও ইওরোপিয় মদ্য আর সুরা পান করাচ্ছেন। একে ইংরেজ দৌর্দন্ডপ্রতাপ সিভিল সার্ভেন্ট, তায় আবার বেন্টিঙ্কের স্নেহধন্য, তার ওপর ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালিদের ভাষায় ইম্পেকেবল পারিরারিক রেকর্ডধারী। মেকলে তত্কালীন মধ্যবিত্ত বাঙালির ব্রিটিশ শিক্ষা পদ্ধতিতে ইংরেজি মাধ্যমে পড়ার সাধ মিটিয়ে দিয়েছিলেন কড়ায় গন্ডায়। সেই বোঝা আজও বয়ে চলেছে বাঙালিভারত। স্বাধীণতার পর সে পারদ আরও চড়েছে বই কমেনি।
    মেরেছ কলসির কাণা তাই বলেকী প্রেম দেবনা! তাঁর ভারত সংস্কৃতির প্রতি শতবিদ্বেষপূর্ণ মিনিট পড়েও তত্কালীন তাবড় তাবড় বাঙালি রেনেসাঁর প্রতিভূদের একটুকরোও রা কাড়ারও সাহস হয়নি। প্রত্যেকে নতমস্তকে গিলেছিলেন হয়েছিল সেইসব ঘৃণাপূর্ণ সুমধুর বাণীগুলি। সেইমত ভাবানো হয়েছিল। ইংরেজ আমলের ভারতের মুক্তিদাতারূপে খ্যাত রামমোহন, এমনকী তাঁর পৌত্তলিক শিষ্য দ্বারকানাথতো সরাসরি সেইমতনই ভাবতেন। পরে যে তত্ব প্রায় বিশ্বাস করে বসেছেন বাঙলার কয়েক সহস্রাব্দের সাধনায় গড়ে তোলা সার্বজনীন শিক্ষার পথ ভেঙে, অর্থিক সঙ্গতিসম্পন্ন মুষ্টিমেয়দের জন্য ইংরেজি শিক্ষার পথ গড়ে দেওয়া নমস্য বিদ্যাসাগরও। আজও শহুরে বাঙালি সেই তত্বেই বিশ্বাসপাত্রটি স্থাপন করেছে।

    মিলে পিতা-পুত্র
    "In May, 1823, my professional occupation and status for the next thirty-five years of my life, were decided by my father's obtaining for me an appointment from the East India Company।... immediately under himself।" ভারতের সঙ্গে শুরু হল প্রাবাদপ্রতীম জন স্টুয়ার্ট মিলের সম্পর্ক, শেষ হবে কোম্পানির অস্তিত্ব লুপ্ত হয়ে যাওয়া পর্যন্ত। বাবা, জেমস মিলের অবসরের পর জন মিল ইস্ট ইন্ডিয়া হাউসে প্রবেশ করলেন ১৭ বছরে। স্বাধীণতার পুজারী প্রবাদপ্রতীম জন মিল আদতে ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গোয়েন্দা বাহিনী প্রধান। তিনি ভারত শাসনের পীঠস্থান ইস্ট ইন্ডিয়া হাউসে বসে একচেটিয়া কোম্পানিটির ডেসপ্যাচ বিশ্লেষণ করে ভারতে কোম্পানির লুঠের ইতি-কর্তব্য ঠিক করে দিচ্ছেন। কীভাবে ভারত শাসন-শোষণ করা যাবে তাই নিয়ে তার তত্ত্ব। কীভাবে নানান ছলে ভারতীয়দের অধিকার হরণ করা যায়, কতটা লুঠ করা যায়, সে তত্বেরও পরিচালক তিনি।
    অন্যদিকে তিনি মুক্ত বাণিজ্য, স্বাধীণতা, নারীদের অধিকারএর সপক্ষে নিরন্তর লেখালেখি করে চলেছেন। ১৮২৮এ তিনি ভারতের ডেসপ্যচগুলির পরীক্ষক পদে অধিষ্ঠিত হলেন। ১৮২৮এর পর কোম্পানির রাজনৈতিক দপ্তরে স্থান পান – যা আদতে গোয়েন্দাগিরিই। এর পর ১৮৩৬ থেকে ১৮৫৬ তাঁর বিশ্লেষণের ওপর নির্ভর করেই তৈরি হত রাজন্যবর্গ শাসিত রাজ্যগুলির সঙ্গে কোম্পানির সম্পর্ক কী হবে তার নীতি। ১৮৫৭-৫৮তে সিপাহি স্বাধীণতা সংগ্রামের পর প্রধাণমন্ত্রী লর্ড পামারস্টোন পার্লামেন্টে কেম্পানি গুটিয়ে ফেলার আইন আনবেন, তখন মিলকে দায়িত্ব দেওয়া হয়, কোম্পানির স্বার্থ রক্ষায়। পারেননি। ২ সেপ্টেম্বর ১৮৫৮তে তিনি ইন্ডিয়া হাউস শেষ বারেরমত ত্যাগ করে যান।
    প্রখ্যাতরা মিলের কোন লেখা পড়ে তাঁকে গুরুঠাউরের পদে অধিষ্ঠিত করেছেন সে তথ্য তাঁরাই জানেন কিন্তু আমরা সাদা চোখে দেখছি, তিনি সরাসরি ভারতীয়দের পরাধীণতার পক্ষে লড়াই করেছেন। তিনি বললেন "...the conquerors and the conquered cannot in this case live together under the same free institutions।" আরও বললেন "...these less advanced people...must be governed as subjects." "And in the case of the British possessions it has the advantage, specially valuable at the present time, of adding to the moral influence, and weight in the councils of the world, of the Power which, of all in existence, best understands liberty." অন লিবার্টির লেখকের স্বাধীণতার কী সুন্দর কী অকাট্য যুক্তি। একদিকে একচেটিয়া কোম্পানির চাকরি করতে করতে তিনি লিখছেন মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীণতার কথা, অথচ কোম্পানি তাঁকেই নিযুক্ত করল ভারতে সবরকম স্বাধীনতার হরণের কাজে। তিনি স্বাধীণ ব্যবসা, লেজা ফেয়ারের পক্ষে, অথচ ভারতে তার অন্নদাতা, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যে ব্যবসা নীতি অনুসরণ করেছে, সেটি ঠিক তার মানসিক ভাবনার বিপরীত, একচেটিয়াপথে। এই তথ্যের সঙ্গে মনেরাখুন ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার বলছেন, ১৮৯১ থেকে ১৯০১ পর্যন্ত ভারতে কৃষিশ্রমিকের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে, বিশিল্পায়ণ আর কৃষির বাণিজ্যিকরণের জন্য।

    মহান এডমন্ড বার্কের ভারত
    A nation of concealers, a nation of dissemblers, a nation of liers, a nation of forgers,…if you turn them into a people of baniyans, the character of England, the character, which more than our arms and more than our commerce has made us a great nation, the character of England will be gone and lost – Edmond Bark
    বার্ক বর্ণিত অজ্ঞ, সুবোধ, Open-hearted, cabdid, liberal, plain, sincere কোম্পানি পদকর্তারা যাদের আদত উচ্চকোটির সিদ্ধান্তহণের অন্যতম প্রতিনিধি হেস্টিংস আর বোল্টস, তাঁরা সেসময় কোন নীতিতে দেশটাকে চালাচ্ছেন সে সম্বন্ধে বিনা মন্তব্যে দেশব্রতী সাহিত্যিক চণ্ডীচরণ সেনের নন্দকুমার ও শতবত্সর পূর্বের বঙ্গ সমাজ উপন্যাসের শরণাগত হওয়া গেল। পার্লামেন্টে হেস্টিংসের ইমপিচমেন্ট চলাকালীন দীর্ঘ সাত বছর সময় ধরে এডমন্ড বার্ক হেস্টিংসের শাসন পদ্ধতি আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে জোরালো বক্তব্য পেশ করেন। সেই বক্তব্যর ভিত্তিতেই আজও বহু গবেষক বার্ককে ভারতবন্ধুরূপে জ্ঞাণ করে থাকেন, কোম্পানির রাষ্ট্রীয় এককতন্ত্রিকতার বিরুদ্ধে বার্ককে ভারতের উদ্ধারকর্তা রূপে আজও সম্মানিত। বিচার চলার সময় পাশ্চাত্য সরকারগুলোতে ঘুষ গ্রহণ বিষয়টি আইনি, হেস্টিংস এমন মন্তব্য করায়, বার্ক হেস্টিংসকে সমর্থন জানিয়ে বললেন পারসিতে পেশকাশ অথবা নজরএর সঙ্গে আরও একটি কথা চালু রয়েছে তা হল রিশ্যত, যা আদতে ঘুষই। হেস্টিংসকে উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন, Let him(Hestings) run from law to law …. Let him fly where he will … Law thank God meets him everywhere…(F)ollow him where you will; lwt him have Eastern & Western Law; you find everywhere arbitary power and peculation of Govornors proscribed and horridly punished. ভালকথা। সুন্দর কথা। তৃতীয়বিশ্বের প্রজাদের আজও আপনি, বার্কমশাই প্রণম্যরয়ে গিয়েছেন।
    এত শ্রদ্ধাবনত হয়েও আজ বলা দরকার, তিনি ভারতকে সমকালীন ইওরোপিয় উপনিবেশের বুদ্ধিজীবিদের চোখে দেখতেন। মহানতম এডমন্ড বার্কএর ভারত সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গী তাঁর অন্যান্য প্রখ্যাততম স্বদেশিয় অথবা ইওরোপিয়দের থেকে, যারা সে সময়ে ভারতে মুক্তিদাতা ভগবানরূপে পুজ্য ছিলেন, বিন্দুমাত্র আলাদা ছিল না, বরং অনেকবেশি জোরালো ছিল। সমকালীন বাঙলা অথবা ভারত বিষয়ে বার্কের বিন্দুমাত্র সুস্থতম ধারণাটুকুও ছিল না। বাঙলার বিচার ব্যবস্থা বিষয়ে পার্লামেন্টের সিলেক্ট কমিটি অব হাউস অব কমন্সের সামনে তিনি ভারতের শাসন ব্যবস্থাকে ডেসপটিক, একচ্ছত্ররূপে নির্দেশ করলেন। তিনি বললেন ভারতীয় প্রজা মাত্রেই একচ্ছত্র রাজার অধীণ। ব্রিটিশরা ভারতে গিয়েছে ভারতীয়দের উদ্ধার করতে। এরা সকলেই শাসকদের মানসিক দাসত্বের অধীণ। They (the Indians) were familiarized to a system of rule more despotic. …It would be a task worthy (of) the benevolence of Britain to relieve those nations from the bonds of mental slavery. But if they should resist the lights of philosophy, if they should reject the proposed good, considering it as the greatest of ills, and declare that they ove their old constitution, arbitary and despotic as it is …. What must done? Men nust be governed by those laws which they love.
    অন্যদিকে ব্রিটেনকে সুন্দরতম, মুক্ততম আইনি ব্যস্থারূপে শংসাপত্র দিলেন, ভারতে শাসন করা ব্রিটেনের সন্তানদের নানান প্রশংসায় ভরিয়ে দিলেন। ইমপিচমেন্টের সাত বছরের বক্তৃতামালায় তিনি ধাপে ধাপে যুক্তিসাজিয়ে বললেন, অসভ্য, দুর্ণীতপরায়ণ ভারতীয়রা অপাপবিদ্ধ ব্রিটিশদের দুর্ণীতির পাঁকে টেনে আনছে, দুর্ণীতিতে ডুবতে সাহায্য করছে। ভারতে ব্যবসা করতে যাওয়া ব্রিটিশেরা সকলেই খুব সহজ সরল। ভারতীয় প্রশাসনের প্রভাবে দুর্ণীতি পরায়ণ হয়ে ওঠা হেস্টিংসের বিচার চাইছেন। হেস্টিংসের দুর্ণীতির সাথী কান্তবাবুরও উদাহরণ পেশ করেন। দুর্ণীতগ্রস্ত ভারতীয়দের থেকে আলোহাতে ভারতকে মুক্ত করতে যাওয়া ব্রিটিশ ব্যবসায়ী, প্রশাসকের সততা, মূল্যবোধ আর চরিত্র রক্ষা করতেই হবে। ...for the purpose of preserving the manners, characters, and virtues that characterize the people of England, তাই এই ইমপিচমেন্ট।
    তাঁর দীর্ঘ বক্তৃতায় ভারতশাসন করতে যাওয়া ব্রিটেনের একচেটিয়া ব্যবসায়ীদের প্রায় মুচলেকা দিয়ে সমকালের বাস্তবতাকে বার্ক এড়িয়ে গেলেন। তাঁর মতে ঘুষ দেওয়াটা আদতে পূর্ব দেশগুলির প্রথা। ব্রিটিশরা এই প্রথা থেকে মুক্ত। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষে দাঁড়িয়ে তিনি ঘোষণা করলেন কোম্পানির চাকরেরা দুর্ণীতিগ্রস্ত ভারতকে চেনেনা, তাই ঘুষ কাকে বলে আর উপহার কাকে বলে সেই পার্থক্যটাই তাদের অজানা। so little known in this country, that we can hardly get clear and specific technical names to distinguish(bribes). আরও বললেন, আদতে ঘুষ ব্যাপারটি vicious customs of the Eastমাত্র।
    বুক বাজিয়ে বললেন, ব্রিটেন ঘুষ সংস্কৃতি এবং নানানরকম দুর্ণীতির পাঁক থেকে একেবারেই মুক্ত, এবং এটিই ইংলন্ডের সার্বিক চরিত্র… Will venture to say that, if there is one thing which distinguishes this Nation eminently above another, it is that its Offices at home, both Judicial and in the State, are so managed that there is less suspicion of pecuniuary corruption attached to then than any similar Offices in any part of the Globe or that have existed in any time. তিনি এশিয়ার নানান দুষ্টকর্মপ্রথাগুলি থেকে ব্রিটেন আর ব্রিটেনবাসীকে বাঁচাতে আহ্বান জানান। তিনি বললেন হঠাত ব্রিটিশ নবোবরা ভারত থেকে অর্থ নিয়ে ব্রিটেনে ফিরে দেশটাকেই দুর্ণীতিগ্রস্ত করে দিচ্ছে। These people pour upon us every day. They not only bring with them the wealth, which they have acquired, but they bring with them into our country the vices by which it was acquired….all the corrupt wealth of India acquired by the oppression of our country foe the corruption of all the liberties of this, to fill the parliament with men, who are now object of its indignation. Today, the commons of Great Briten procecute the delinquents of India. Tomorrow the delinquents of India may be the Commons of Great Briten.
    সার্বিকভাবে সত্ ব্রিটিশদের থেকে তিনি ইমপিচমেন্টবিদ্ধ হেস্টিংসকে আলাদা করে ফেল্লেন। হেস্টিংসকে ভারতীয় প্রথার দাস বললেন, কোম্পানির অন্যান্য যুবা পদাধিকারীকে প্রশ্রয়পূর্ণ তিরস্কারে avarice বাক্যবন্ধটি উল্লেখ করে বললেন the avarice of age and the impetuosity of youth, এরা সকলে অজ্ঞ, সুবোধ(ইমম্যাচিওর), এবং অভিজ্ঞতাহীন। হেস্টিংসেরমত এরা সকলে ভারতীয় বানিয়াদের খপ্পরে পড়ে দুর্ণীতিগ্রস্ত হয়ে উঠছে। বানিয়াদের চরিত্র সম্বন্ধে এডমন্ড বললেন, (The baniyans) is generally chosen out of that class of natives who, by being habituated to misery and subjection, can submit to any orders, and are fit for any of the nasest Services… Thet are pawn without whim an Europian can do nothing…they have knowledge of the country; they have money’ and they have the arts of making money… the moment a company ‘s servant comes there, …they take possession of him…(I)t is not the Englishman, but it is that Black Banyan that is the Master. …(W)hile we are here boasring of British power, we are …nothing but the inferior tools and miserable instruments of the tyranny which now the lower part of the Ntives exercise. বার্ক বলেন ভারতে বানিয়ানদের সরাসরি নির্দয় দুর্ণীতি পঙ্কে পড়ে Open-hearted, cabdid, liberal, plain, sincere ব্রিটিশ জনগণ দুর্ণীতি পরায়ণ হয়ে উঠছে এমন এক দেশে গিয়ে, যে দেশটি a nation of concealers, a nation of dissemblers, a nation of liers, a nation of forgers,…if you turn them into a people of baniyans, the character of England, the character, which more than our arms and more than our commerce has made us a great nation, the character of England will be gone and lost.
  • সে | 203.108.233.65 | ২৪ জুন ২০১৩ ১৬:৪১613050
  • অসাধারণ টই। কিন্তু লাইপ্‌ৎসিগ্‌ ইউনিভার্সিটির পাঠানো ঐ স্ক্যান্ড্‌ ডকুমেন্টগুলো তো খুবই অস্পষ্ট কিছুই পড়া যাচ্ছে না।
    সাম্মানিক ডক্টরেট উপাধি কি খুবই অসম্ভব? হয়তো পরে কখনো দেওয়া হয়েছিলো এমন সম্ভবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় কি?
  • বিশ্বেন্দু | 125.187.39.204 | ২৪ জুন ২০১৩ ১৬:৪৯613051
  • সবার এত উত্তরে আমরা হতবাক।

    অবশ্যই লিপজিগ কি পাঠাচ্ছেন ইংরেজিতে জানিয়েছেন, কিন্তু সেই স্ক্যান তিনটিতে কী আছে জানতে পারলে ভাল হত।

    ৮০০০ বছর একটা ধারণা। আগামী দিনে যদি আরও বড় ভাবে বলতে পারি বলব। শুধু একটা কথা, আমরা এশিয়াকে দেখছি, বিশ্লেষণ করছি, পশ্চিমের জ্ঞানচর্চার মধ্য দিয়ে। পূর্বের সমস্ত জ্ঞানচর্চাকে, প্রযুক্তিকে অস্ত্রের জোরে ধংস করেছে পশ্চিম। আমাদের এই অঞ্চলে যারা জ্ঞানচর্চা করতেন তারা কমঠ বৃত্তি নিলেন, নিজেদের জ্ঞান রক্ষার জন্য। ফলে আমরা যারা সেই মেকলে, মূলার নির্দেশিত পথে পড়াশোনার মধ্যদিয়ে পৃথিবীকে দেখতে শিখছি, তারা সেই তথ্য, তত্ব বলছি, যা আমাদের শেখানো হয়েছে বছরের পর বছর ধরে। আমরা ৭৬ বা ৪২কে মন্বন্তর বলতে শিখেছি, কেউ কোনদিন গণহত্যা বলিনি। ভাবিওনি। ভারতের রেলকে মুক্তির দিশা হিসেবে দেখেছি, কিন্তু রেলপথে যে, মন্বন্তর হয়ে কোটি কোটি ভারতীয় উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে খুন হয়েছে, কাঁচামাল লুঠ হয়েছে, ব্রিটেনের তৈরি দ্রব্য প্রায় বিনা শুল্কে ভারতীয় বাজার ধংস করে দখল করেছে, সে বিষয়ে চুপ করেছিলাম। নুরেম্বার্গে ব্রিটিশদের পথ অনুসরন করে বাঙ্গালিরা জার্মানদের খুনি, গনহত্যাকারী বলেছি, কিন্তু ৪২এর কোটি কোটি বাঙ্গালী খুন করা মন্বন্তরী ব্রিটিশদের ছাড় দিয়েছি, আজও ব্রিটিশদের তৈরি যুদ্ধের ছবি দেখে মুক্তির স্বাদ গ্রহণ করি, ভাবি তারাই ভারতকে বাঁচাল। একদা ব্রিটিশরা, আজ আমেরিকানরা যে ভাবে ভারতকে দেখতে চান সেই ভাবে দেখছি।
    এবার ৮০০০ সালের পালা। ধরে নিলাম ৫৫০০ বছর পূর্বেই সরস্বতী-হরপ্পা সভ্যতা। এ নিয়ে পরে বিতর্ক হবে। ইতিহাসের তারিখগুলোকে আমাদের নতুন করে দেখতে হবে এই দাবিকে উঠছে। সেটিও ভুলে গেলাম। যদি ধরেই নি, ৫৫০০ বছর আগে যে সভ্যতা ড্রাই ডক বানাতে পারে, যে ওই রকম অকেন্দ্রিভুত একক বানাতে পারে, অসম্ভব উচ্চতা সম্পন্ন নগর বানাতে পারে, তাহলে তাকেতো এই নাগরিক অবস্থায় পৌঁছতে আরও সময় দিতে হয়। এই পশ্চিমী জ্ঞানচর্চা এই পূর্বের প্রযুক্তির আশেপাশে পৌঁছতে পারেনি। আজও পারেনি দিল্লি বা ধরের লোহার স্তম্ভ নকল করতে, আজো পারেনি ডোকরা কামারদেরমত জং ছাড়া লোহা তৈরি করতে, পারে নি মসলিনের মত কাপড় বুনতে, এরা ভারত আবিষ্কার করতে আমেরিকা আর ওয়েস্ট ইন্ডিজ় আবিষ্কার করে, ভারত কিন্তু ইয়োরোপে আফ্রিকায় ব্যাবসা করেছে অন্য দেশ আবিষ্কার না করেই। এরা করবে আমাদের ইতিহাসের সময় নির্ণয়!
    ৩০০০-৩৫০০ বছর আগে ইউরোপ শুধুই শূন্য। সেই শুন্যস্থান পুরনের ধাক্কা আর আমরা সইব না। তাঁরা সেই সম্পদের শুন্যস্থান পূরণ করেছে আফ্রিকা, আমেরিকা এশিয়া লুঠ করে। নাটের গুরু মুলারকে চিহ্নিত করেছি। এবার অন্যদের পালা। ভারতের ইতিহাসের নতুন সময় নির্ণয় করতে হবে।
  • Blank | 180.153.65.102 | ২৪ জুন ২০১৩ ১৬:৫০613052
  • ৮০০০ বছরের হিসেব টা কিন্তু পেলাম না
  • Blank | 180.153.65.102 | ২৪ জুন ২০১৩ ১৬:৫৪613053
  • ৫৫০০ বছর আগে ড্রাই ডক বানায় নি। ৫৫০০ হরপ্পার শুরু। হরপ্পা উন্নতির চরম সময় পৌছায় আরো হাজার খানেক বছর পরে। ৮০০০ বছর - এই ধারনার বেস টা কি?
  • সে | 203.108.233.65 | ২৪ জুন ২০১৩ ১৬:৫৫613055
  • বিশ্বেন্দুবাবু,
    Leipzig এর মোটামুটি কাছাকাছি বাংলা উচ্চারণ হবে "লাইপ্‌ৎসিগ্‌"।
    আপনার গবেষণার কাজ খুবই ইটারেস্টিং কিন্তু এমন খোলা পাতায় সব লিখছেন কেন? কেউ যদি আপনার এত পরিশ্রমের কাজ এখান থেকে টুকে অন্য কোথাও ছাপিয়ে দেয়?
  • ম্যাক্সিমিন | 69.93.210.6 | ২৪ জুন ২০১৩ ১৭:০০613056
  • একটি অভিযোগ
    After the election he wrote to his mother, "all the best people voted for me, the Professors almost unanimously, but the vulgus profanum made the majority".

    এই লাইনটি বাদ দিলেন কেন?
  • Blank | 180.153.65.102 | ২৪ জুন ২০১৩ ১৭:০৬613057
  • আরো একটা জিনিস ক্লীয়ার নয়। ৩০০০/৩৫০০ বছর আগে ইউরোপ শুন্য, এটার মানে কি? ২০০০ বছর আগে গ্রীক সিভিলাইজেশান শুরু হয়ে গেছে। আর মোটামুটি ৫৫০০ থেকেই ইউরোপে মানুষজন গ্রাম বানিয়ে বসবাস করছে। নিওলিথিক পিরিয়ডের ইঁটের বাড়ি, রঙীন মৃৎশিল্প, দেওয়ালে ছবি - সব ই পাওয়া যায় (৩০০০ বছর আগে)। সেখান থেকে ক্রমশঃ গ্রীস, রোমের মতন শহর কেন্দ্রিক সভ্যতায় উত্তরন।
    ভারতের দিক থেকে দেখলে হরপ্পা তো ছোট জায়গা মাত্র। বাকি ভারতের তখন কি হাল? সেটা কি শুন্য?
  • ম্যামি | 69.93.210.6 | ২৪ জুন ২০১৩ ১৭:০৮613058
  • এই জায়গাটার কথা বলছি -- ৬১০ জন মুলারের পক্ষে আর ৮৩৩জন উইলিয়মকে সমর্থন করেছিলেন।
  • বিশ্বেন্দু | 125.187.39.204 | ২৪ জুন ২০১৩ ১৭:৪৮613059
  • এই যুদ্ধটি খুব বিশদে লিখিনি। অন্য লেখা তৈরি করেছি বিশদে। উইকিতে বিশদে আছে। দ্বিতীয় ইতিহাসে এটি প্রাসঙ্গিক নয় বলেই এটি খুব বড় করে আসেনি।
    আসলে মূলার থেকে দূরে সরে গিয়েছিলাম। মুলারে ফিরে আসি। কিছুটা হয়ত

    মেকলে-মুলারের যৌথ উদ্যম
    জার্মানিতে উচ্চশিক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে ব্রিটেনে অভিভাসিত হয়ে আসা ফ্রেডরিশ ম্যাক্সিমিলিয়ন মুলারের হাত ধরে নতুন নতুন শৃঙ্গে উত্তোরণ হবে বাঙালি-ভারতীয় বুদ্ধি-দাসত্ব যুগের। রামমোহন, দ্বারকানাথসহ নানান ব্যক্তিবর্গ শুধু ভারতের প্রাণকেন্দ্র, কলকাতায় বসেই নয়, সুদূর লন্ডনে বেয়ে গিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন, সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের দেখানো পথে চলেই ভারতের তথা বাঙলার বাঁচামরা। কোম্পানির অর্থানুকুল্যে মুলারেরমত ভাগ্যান্বেষীরা সেই সুযোগটি কাজে লাগিয়েছেন পূর্ণমাত্রায়।
    শহুরে ভারত বিজয়ের পর থেকেই তিনি, মেকলে, কুড়ি বছর আঁতিপাঁতি অনুসন্ধান করছিলেন এমন এক মানুষের, যিনি ব্রিটিশের দাসত্ব-সাংস্কৃতিক গণহত্যাত্বকে ভারতীয়দের মনে চিরস্থায়ী রূপ দিতে পারবেন। তাঁর তত্বের মূল রেণুগুলি বসিয়েদিতে পারবেন ভারতীয়দের মনজগতে। স্বপ্ন সফল করতে ১৮৫৪ সালে ভাগ্যান্বেষণে লন্ডনে আসা ৩১ বছর বয়সী ভারতবিশেষজ্ঞ, ফ্রেডরিশ ম্যাক্সিমিলিয়ন মুলারকে খুঁজে পেলেন মেকলে। এতদিনের ঔপনিবেশিকতার অর্থনৈতিক তাত্বিক ভিত্তি রচনা হচ্ছিল, সেই ভিত্তির ওপরে সামাজিক মস্তিষ্ক প্রক্ষালন সৌধ রচনার কাজ শুরু হবে কোম্পানির অর্থানুকূল্যে। মেকলের ঘৃণাভর্তি ভারতবিরোধী তত্বের কুড় দিয়েই ভারত-দাসত্বস্বপ্ন স্বপ্ন সফল করতে উঠেপড়ে লাগলেন ম্যাক্সিমিলিয়ন মুলার। শুরু হল ভারতেই ভারত বিদ্বেষী প্রজাতি গড়ে তোলার তাত্বিক ভিত তৈরি প্রকল্প। টার্গেট শহুরে ভারতীয়দের মনোজগত। গুরুমেকলের ভাষায়- চেহারায় ভারতীয়, কিন্তু মনেপ্রাণে চিন্তাভাবনায় ইংরেজ। মেকলে অনুসৃত ভারতীয় শিক্ষা দান পদ্ধতিও রচনা হল। মেকলের আমলের শিক্ষাবিশেষজ্ঞ জে এন ফারকুহর(J.N Farquhar) মশাই লিখলেন, "The new educational policy of the Government created during these years the modern educated class of India. These are men who think and speak in English habitually, who are proud of their citizenship in the British Empire, who are devoted to English literature, and whose intellectual life has been almost entirely formed by the thought of the West, large numbers of them enter government services, while the rest practice law, medicine or teaching, or take to journalism or business"(Modern Religious Movements in India. – J N Farquhar).
    মেকলে যে সঠিক লোককেই সঠিক দায় দিয়েছেন তার প্রমাণ, একদা প্রাচ্যবাদী শব্দটির উদ্গাতা, উইলিয়ম জোন্সেরমতই শেষ বয়সে মুলারেরর দাবি ছিল তিনি নাকী ৩২টা ভাষার বিশেষজ্ঞ। ভারতত্ববিদরূপে পরিচয় পেতে জীবনের গড়েওঠা দিনগুলো থেকে মুলার খুবই চেষ্টা করেছেন। তার জীবনের উদ্দেশ্যগুলোর মুখড়া পাই “The Life and Letters of Friedrich Max Müller” বইটি থেকে। এটি 1902এ প্রথম প্রকাশিত হয় লন্ডনে। নিউইয়র্ক থেকে 1976এ নতুন করে ছাপা হয়। এই পুস্তকে মুলারের কয়েকটি দিনলিপি আর কয়েকটি চিঠির উল্লেখযোগ্য অংশ পাঠ করলে বোঝা যাবে মেকলের হাতে পড়ে, সেজেগুজে ভারতপথিকতার বাজারে আসার আগে পর্যন্ত মুলার কোন আর্থিক অবস্থায় পড়েছিলেন এবং কোন মানসিকতায় সেই কাজে প্রণোদিত হয়েছিলেন-
    ১. প্যারিসে বসবাসের সময় মুলারের দিনলিপি( April 10, 1845) “I get up early, have breakfast, i.e. bread and butter, no coffee. I stay at home and work till seven, go out and have dinner, come back in an hour and stay at home and work till I go to bed. I must live most economically and avoid every expense not actually necessary. The free lodging is an immense help, for unless one lives in a perfect hole… I have not been to any theatre, except one evening, when I had to pay 2 francs for a cup of chocolate, I thought ‘Never again’.”
    ২. প্যারিস থেকে মাকে লেখা December 23, 1845 তারিখের চিঠি “…instead of taking money from you, my dearest mother, I could have given you some little pleasure. But it was impossible, unless I sacrificed my whole future… I have again had to get 200 francs from Lederhose, and with the money you have just sent shall manage till January or February.”
    ৩. মাকে লেখা (April 15, 1847) চিঠিতে মুলার জানাচ্ছেন “I can yet hardly believe that I have at last got what I have struggled for so long… I am to hand over to the Company, ready for press, fifty sheets each year; for this I have asked £200 a year, £4 a sheet. They have been considering the matter since December, and it was only yesterday that it was officially settled.” “…In fact, I spent a delightful time, and when I reached London yesterday I found all settled, and I could say and feel, Thank God! Now I must at once send my thanks, and set to work to earn the first £100.”
    ৪. ১৯৬৭র ৯ নভেম্বরে তার স্ত্রীকে লেখা চিঠিতে মুলার বলছেন “…I feel convinced, though I shall not live to see it, that this edition of mine and the translation of the Veda will hereafter tell to a great extent on the fate of India, and on the growth of millions of souls in that country. It is the root of their religion, and to show them what that root is, I feel sure, the only way of uprooting all that has sprung from it during the last 3,000 years.”
    ৫. CHEVALIER BUNSENকে (August 25, 1856) লেখা চিঠি “India is much riper for Christianity than Rome or Greece were at the time of St. Paul. The rotten tree has for some time had artificial supports… For the good of this struggle I should like to lay down my life, or at least to lend my hand to bring about this struggle. Dhulip Singh is much at Court, and is evidently destined to play a political part in India.”
    ৬. THE DUKE OF ARGYLL. OXFORDকে লেখা( December 16, 1868) চিঠি “India has been conquered once, but India must be conquered again, and that second conquest should be a conquest by education. Much has been done for education of late, but if the funds were tripled and quadrupled, that would hardly be enough… A new national literature may spring up, impregnated with western ideas, yet retaining its native spirit and character… A new national literature will bring with it a new national life, and new moral vigour. As to religion, that will take care of itself. The missionaries have done far more than they themselves seem to be aware of.” “The ancient religion of India is doomed, and if Christianity does not step in, whose fault will it be?”
    ৭. On ১৭ এপ্রিস ১৮৫৫তে, Bunsen মুলারকে ধন্যবাদ জানিয়ে চিঠি লিখলেন “You have so thoroughly adopted the English disguise that it will not be easy for any one to suspect you of having written this ‘curious article.’ It especially delights me to see how ingeniously you contrive to say what you announce you do not wish to discuss, i.e. the purport of the theology. In short, we are all of opinion that your cousin was right when she said of you in Paris to Neukomm, that you ought to be in the diplomatic service!”
    ৮. মাকে লেখে চিঠি (September 1, 1847) “My rooms in London are delightful. In the same house lives Dr. Trithen, an orientalist, whom I knew in Paris, and who was once employed in the Office for Foreign Affairs in St. Petersburg. Then there are a great many other orientalists in London, who are mostly living near me, and we form an oriental colony from all parts of the world… We have a good deal of fun at our cosmopolitan tea-evenings.”

    মুলারের আর্যতত্বের রূপ ও বিকাশ
    ভারতবর্ষের ইতিহাস কাহাদের ইতিহাস। একদিন যে শ্বেতকায় আর্যগণ প্রকৃতির এবং মানুষের সমস্ত দুরূহ বাধা ভেদ করিয়া ভারতবর্ষে প্রবেশ করিয়াছিলেন, যে অন্ধকারময় সুবিস্তীর্ণ অরণ্য এই বৃহৎ দেশকে আচ্ছন্ন করিয়া পূর্বে পশ্চিমে প্রসারিত ছিল তাহাকে একটা নিবিড় যবনিকার মতো সরাইয়া দিয়া ফলশস্যে - বিচিত্র আলোকময় উন্মুক্ত রঙ্গভূমি উদ্‌ঘাটিত করিয়া দিলেন, তাঁহাদের বুদ্ধি শক্তি ও সাধনা একদিন এই ইতিহাসের ভিত্তিরচনা করিয়াছিল। কিন্তু, এ কথা তাঁহারা বলিতে পারেন নাই যে, ভারতবর্ষ আমাদেরই ভারতবর্ষ। আর্যরা অনার্যদের সঙ্গে মিশিয়া গিয়াছিলেন। প্রথম যুগে আর্যদের প্রভাব যখন অক্ষুণ্ন ছিল, তখনো অনার্য শূদ্রদের সহিত তাঁহাদের প্রতিলোম বিবাহ চলিতেছিল। তার পর বৌদ্ধযুগে এই মিশ্রণ আরও অবাধ হইয়া উঠিয়াছিল। এই যুগের অবসানে যখন হিন্দুসমাজ আপনার বেড়াগুলি পুনঃসংস্কার করিতে প্রবৃত্ত হইল এবং খুব শক্ত পাথর দিয়া আপন প্রাচীর পাকা করিয়া গাঁথিতে চাহিল, তখন দেশের অনেক স্থলে এমন অবস্থা ঘটিয়াছিল যে, ক্রিয়াকর্ম পালন করিবার জন্য বিশুদ্ধ ব্রাহ্মণ খুঁজিয়া পাওয়া কঠিন হইয়াছিল; অনেক স্থলে ভিন্নদেশ হইতে ব্রাহ্মণ আমন্ত্রণ করিয়া আনিতে হইয়াছে, এবং অনেকস্থলে রাজাজ্ঞায় উপবীত পরাইয়া ব্রাহ্মণ রচনা করিতে হইয়াছে, এ কথা প্রসিদ্ধ। বর্ণের যে শুভ্রতা লইয়া একদিন আর্যরা গৌরব বোধ করিয়াছিলেন সে শুভ্রতা মলিন হইয়াছে; এবং আর্যগণ শূদ্রদের সহিত মিশ্রিত হইয়া তাহাদের বিবিধ আচার ও ধর্ম, দেবতা ও পূজাপ্রণালী গ্রহণ করিয়া তাহাদিগকে সমাজের অন্তর্গত করিয়া লইয়া হিন্দুসমাজ বলিয়া এক সমাজ রচিত হইয়াছে; বৈদিক সমাজের সহিত কেবল যে তাহার ঐক্য নাই তাহা নহে অনেক বিরোধও আছে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পূর্ব ও পশ্চিম।
    শুধু রবীন্দ্রনাথের ওপর প্রভাবই নয়, আজও আর্য তত্ব ভারতীয় ঐতিহাসিক মহলে দেড়শ বছরের পূর্বের গ্লোরি নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আর্য তত্বের রূপ ও বিকাশ বিষয়ে ন্যুনতম আলোচনাটুকু শুরু করা যাক। ম্যাক্স মুলারের আর্য-দাসত্বপ্রকল্পের প্রধান বক্তব্য, ১৭৫৭র পর শাসক ব্রিটিশরা প্রাচীণ আর্যদের রক্তের উত্তরাধিকার সম্বলকরে ভারতে এসেছে তাদেরই ছেড়ে যাওয়া পুরোনো মাতৃভূমিতে। শাসক ব্রিটিশদের দেহে মনে অতীতের ভারত আক্রমণকারী, পুরন্দর আর্যদের ধী আর শ্রী বর্তমান। এই ভবঘুরে আর্যরাই ঘুরতে ঘুরতে ভারতে এসে বেদ রচনা করেছিল। সংস্কৃত ভাষায়। তাই পুরোনো গ্রীক, গল, আইরিশ, ওয়েলস, গথিক, ল্যাটিন এবং অন্যান্য ইওরোপিয় ভাষার সঙ্গে সংস্কৃতের নানান শব্দের আশ্চর্যজনক মিল। ভারতত্ববিদ গুরু জোন্সএর দেখানো পথ ধরেলেন মুলার, যদিও সমকালীল বুদ্ধিজীবিদের ওপর জোন্সএর দার্শনিক প্রভাব প্রতিপত্তিকে সহ্যকরতে পারতেন না। তাঁর ধারণা ছিল সাফল্যের পথের একমাত্র কাঁটা অন্য কেউ নয়, মৃত জোন্স, এমনকী ব্রিটিনে তাঁর একমাত্র সংস্কৃত জানা প্রতিদ্বন্দ্বী, হোরেস উইলসনও নয়।
    গুরু জোন্সএর দেখানো পথেই সংস্কৃত-পূর্ব ইন্দো-ইওরোপিয় ভাষার অস্তিত্ব কল্পিত হল। মুলার বললেন, এই ভাষার ব্যবহারকারীরা ক্যাসপিয়ান সাগর অঞ্চলের অধিবাসী। এরা ইরানে অভিবাসিত হয়ে আসে। সেখান থেকে ভারতে পদার্পণ করল তাদের ভাষা আর সংস্কৃতি নিয়ে। ভারতের সিন্ধুনদতীরে বসে তারা বেদ রচনা করতে শুরু করে। উপনিবেশিক দাসত্ব প্রকল্পে আপাদমস্তক ডুবে থাকা ভারতীয়দের আশ্বস্ত করে বললেন, সংস্কৃত বলার অর্থ পুরোনো কোনও ইওরোপিয় ভাষা অর্থাত ইন্দো-ইওরোপিয় শাখার ভাষা বলা, সেটি ইংরেজিও হতে পারে। ভারতীয়রা তাঁর তত্বে ধন্য হল। ভারতীয়রা ততদিনে সংস্কৃত ছেড়ে ইংরেজি ধরেছে। তিনি বললেন, ভারতীয়রা সংস্কৃত না বললেও সংস্কৃতের শাখা ভাষা, ইংরেজিতো ভারতীয়রা বলতে-লিখতে-পড়তে পারছে। মুলার বলেছেন ইংরেজি, ইন্দো-ইওরোপিয় ভাষাপরিবারেরই সদস্য। সংস্কৃতজানা আর ইংরেজি জানা একই কথা। ফলে ইংরেজি জানা শিক্ষিত ভারতীয়দের বিন্দুমাত্র সংস্কৃত না জানলেও তাঁরা অতীতের সঙ্গে নিজেদের মেলাতে পারবে।
    মেকলেরমত ভারতঘৃণাবাদীদের পথ ধরে, ভারতের সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ধর্মচর্চার ন্যুনতায় শুধু ব্রিটিশেরাই নয়, সে সময়ের দাসত্ব প্রকল্পের অধীন, ভারতীয়রাও আস্থাবান ছিলেন। মুলারতো ছিলেনই। ম্যাক্স মুলার নিজে খ্রিষ্ট ধর্ম প্রচারক। রামমোহনসহ রেনেসাঁজাত রিফর্মিস্টদের লেখাগুলিতে, ব্রিটিশ শাসকদের খুশি করতে, ভারতীয় সভ্যতা সংস্কৃতির প্রতি অসম্ভব ঘৃণা প্রকাশ পেয়েছে। দাসত্ব আর ঘৃণাতত্বের পানসিটি বেশ সুচারুরূপে চলছিল মুলারের হাত ধরে, তাঁরই নির্দেশে এবং এই কাজে মূলর বেশ সফলতাও অর্জন করেছেন। সমকালীন ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি ন্যুনতা আর তাচ্ছিল্য প্রচারের কাজতো পুরোদমেই চলেছে- এ কাজে ব্রিটিশদের বুদ্ধি আর মেধাসম্পদ কোনওটাই নতুনকরে বিনিয়োগের প্রয়োজন হয় নি।
    তাচ্ছিল্য প্রকল্পটি, দাসত্ব প্রকল্পের আরও একটি বন্ধুসম প্রকল্প। বিশেষ এই প্রকল্পটিতে তত্কালীন ইংরেজি শিক্ষিত শহুরে বাঙালিরাই যথেষ্ট ভাল কাজ করেছেন। একে দেখাশানা করতে যে দাসত্ব অভিমান প্রকাশ্যে প্রকাশ করার প্রয়োজন ছিল, সে বুদ্ধি আর বাস্তবতা ততদিনে বাঙালিদের মনে-মস্তিষ্কে চারিয়ে গিয়েছিল। শাসক ব্রিটিশরা বুঝতে পেরেছিল, একঝাঁক খ্রিস্টধর্ম প্রচারক আর মেকলেরমত বড় চাকুরে সিভিলিয়ানদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়, ভারতের সংস্কৃতির ন্যুনতা আবিষ্কার আর তাচ্ছিল্য প্রকাশভঙ্গীকে, সমকালীন ভারত(বাঙলা বললেই বোধহয় ভাল হয় – দাসত্ব প্রকল্পে ভারত অনেক পরে এসেছে) নতমস্কে স্বীকার ও মান্যতা দিতে বাধ্য হয়েছে।
    এত করেও দাসত্ব-প্রকল্পের নকল বুঁদির গড় রক্ষা আর হয় না। কোম্পানির দাসত্ব প্রকল্পের বুদ্ধিদাতাদের সামনে একটা বড়সড় জটিলতম ধাঁধাঁ সমাধান করার প্রয়োজন হয়ে পড়ল সাম্রাজ্যের স্বার্থেই। ভারতের অসম্ভব ধনী, ইওরোপিয়দের লব্জে তথাকথিত ধ্রুপদী সংস্কৃত সাহিত্যগুলি প্রকাশ হওয়া মাত্রই ব্রিটিশেরা বুঝতেই পারছিল, ভারতীয় সংস্কৃতি নিয়ে তাদের সযত্ন ঘৃণা ছড়ানোর হয়ত বৈধতা মিলবে না। ভারত ঘৃণাতত্বের পাশে তাদের আবিষ্কৃত(যেন ব্রিটিশরাই এসে প্রথম ভারতীয় সাহিত্য আবিষ্কার করল, তার আগে ভারতে এই সাহিত্য পঠিত হত না) ঐতিহ্যগত সাহিত্যের আকাশচুম্বী গুণাবলী দাঁড়াবে কোথায় ভেবেই মাথার ঘায়ে কুকুর পাগল! ভারতের ঐতিহ্যগত সাহিত্যগুলিকে পরোক্ষে ইওরোপিয়দের দ্বারা রচিত হিসেবে চালালেই হবে না বেদের প্রণয়নের সময় দেড় হাজার খ্রিপূর্বের বেশি দূর নিয়ে গেলেই ইওরোপের সংস্কৃতির ভান্ডাফোঁড়। এই দৃষ্টিভঙ্গী বিস্তার, প্রচার আর প্রসারে লুঠেরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সরাসরি অর্থ সাহায্যে, মুলারের আর্যতত্বের আর বেদ রূপায়ণের সময়ের বিকাশ।
    বাইবেলের পথ বেয়ে মুলারের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, মাত্র চার হাজার বছর আগে বিশ্বের উদ্ভব। খ্রিস্ট যাজক হিসেবে, বাইবেল অনুসরনে মুলারের বিশ্বাস বিশ্বসৃষ্টির দিনটি হল, ২৩ অক্টোবর, ৪০০৪ খ্রি.পূ.এর সকাল ৯টায়। এর ২৫০০ বছর পর খ্রিস্টপূর্বের ভয়ঙ্কর বন্যার বাইবেলিয় মিথ। ফলে ১৫০০ খ্রি.পূ. আগে ভারতেতো আর্য দখলদারির তত্ব দাঁড়ায়ই না। বিশ্ব যদি এই ৪০০৪ খ্রিস্টপূর্বে সৃষ্টি হয়, তাহলে বৈদিক সভ্যতাকে বিকাশের আর পরিপূর্ণতার কিছুটা সময়তো দিতেই হবে তাকে। ১৫০০ বছরের বেশি সময় দিলেতো অঙ্ক, জোতির্বিদ্যা, দর্শণে ভারতের আধিপত্যের তত্ব মেনে নিতে হয়। ভারতের সভ্যতা ন্যুনতম আট হাজার বছর অথবা তারও বেশি পুরোনো তা তাঁর বিশ্বাস ছিল না, আজও অনেক ভারতীয় বিশ্বাস করেন না। তাই ভারতীয়দেরও তিনি বিশ্বাস করতে দিতে চাননি যে, ভারতীয় সভ্যতার বিকাশ আর পরিপূর্ণতা হয়েছে, মুলারের চার হাজার বছরের দাসত্বের ভাবনার অনেক আগেই। আজও মুলারদের দেখানো পথ বেয়ে ইংরেজি শিক্ষিত ভারতীয়রা, দেশিয় ঐতিহ্যকে মিথ-মিথ্যা রূপে ঘোযণা করেন। তাই বেদ সংকলনের তারিখ তার আর তার ভারতীয় অনুগামীদের কাছে দেড় হাজার খ্রি.পূর্বের। গুরু জোনস যে তত্বকে অবয়ব দিয়েছেন, সেই অবয়বটি ম্যাক্স মুলারারের হাতেই বিকশিত হল এক নতুন বিদ্যা ইন্ডোলজি বা ভারতবিদ্যা নামে, আদতে যেটি সনাতনভারতবিরোধীবিদ্যা নামেই পরিচিতি হওয়া প্রয়োজন ছিল।
    আর্যতত্বটি মুলারের মনগড়া এক ভারতবিরোধী বিষমকাব্য। ঋকবেদে বলা হয়েছে সুদাস এবং দশ রাজার যুদ্ধের কথা। এই দশ রাজা- পাকত(Pakthas), বলন(Bhalanas), আলিনা(Alinas), শিব(Shaivas), বৈষ্ণি(Vishanins), শিম্যু(Shimyus), ভৃগু(Bhrigus), দ্রুহা(Druhyas), পৃথু(Prithus) আর পরশু(Parshus)। এই দশ রাজা ত্রিত্সু(Tritsus)র বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। মুলার পৃথু বা পার্থবদের বর্ণনা করলেন পার্থিয়ান, অথবা অনেকপরে যে দেশকে ইরান বলা হয়েছে(২৪৭খ্রিপূ-২২৪খ্রিপূ)। এদের পূর্বপুরুষেরা ইওরোপ থেকে ভবঘুরে হয়ে ইরানে বসবাসকরা শুরু করেন। পরশু অথবা পাশবরা হল আজকের পারসিরা। এই রাজাদের যদিও আর্য বলা হচ্ছে আদতে এরা সকলে বিদ্রোহী আর্য। এরা মাতৃতান্ত্রিক। এঁদের সুদাস যুদ্ধে পরাজিত করেন। পরে এদের বংশধরেরা ভারতের সিন্ধু উপত্যকায় এসে বসবাসকরতে শুরু করে, সংস্কৃত ভাষায় বেদ রচনা করেন। সংস্কৃত ভাষাটি ইওরোপের নানান ভাষারমতই পুরোনো। সংস্কৃতই একসময়ের ইওরোপিয়দের নিজেদের ভাষা। বললেন ইওরোপে বাইবেলের যে মর্যাদা, ভারতেও বেদের একই আসন- হয়ত তার থেকে একটু বেশিই হবে। সংস্কৃততে রচিত বেদকে হিন্দুদের (ভারতে কে হিন্দু কে জানে!) প্রধাণ ধর্মগ্রন্থ রূপে ঘোষণা করলেন।
    এর আগে গ্রান্ট, কোলব্রুক এসবই বলেছেন। কিন্তু তাঁরমত প্রখ্যাত ভারতত্ববিদের লেখনিতে এটি আকরের মর্যাদা পেল। তিনিও বিশ্বকে জানিয়ে দিলেন, বেদের শব্দগুলির আদত অর্থ তিনিই একমাত্র জানেন, বোঝেন। তিনি শব্দতত্বের ধারণাভিত্তি করে, বেদের প্রত্যেকটি শব্দ, নতুন অর্থে বিশ্লেষণ করলেন। বললেন, তাঁর অনুবাদ করা বেদের প্রার্থনা-শ্লোকগুলির অন্য অর্থ করার অর্থই হল বেদকে বিকৃত করা, যা হিন্দুধর্মের মূলভিত্তি নাড়িয়ে দিতে পারে। বললেন একমাত্র তাঁর কাছেই রয়েছে বেদকে অনুবাদ করারমত জ্ঞাণ। এক পার্সি ব্রাহ্ম বন্ধু, মালাবারিকে লিখলেন, accept the Veda as an ancient historical document, containing thoughts in accordance with the character of an ancient and simple-minded race of men, and you willl be able to admire it, and to retain the same of it, particularly the teaching of the Upanishads, even in these modern days. But discover in it “steam-engines and electricity, and Eyropian philosophy and morality”, and you deprive it of its true character, you destroy its real value, and you break the historical continuity that ought to bind the present to the past. Accept the past as a reality, study it and try to understand it, and you will then have less difficulty in finding the right way towards the future.
    তিনি মালাবারিকে আর এক চিঠিতে বললেন, Hindus to goback to the Veda to recover the lost purity of their tradition. তাঁর বক্তব্য, it is the fate of all the religions to form these thick crusts of superstition around them,...if you could tell your countrymen comething of what I have written in this lectures, it might bear some good fruit. জনৈক কর্নেন অলকটকে চিঠি লিখে অনুরোধ করলেন, to persue (his) friends in India to make a new start, i.e. to return to their encient philosophy in all its purity… please help the people of India to discover and recover the treasure of truith in their old Brahma-Sophy.
    শ্রুতি তাইই মুলার বেদকেই শুধু পুরাণের মান্যতা দিলেন, অন্যগুলি যা আদতে শ্রুতি নয়, স্মৃতি, যেমন শকুন্তলা অথবা হিতপদেশ, সেগুলিকে তাচ্ছিল্য করে আধুনিক আর সেকেন্ডারি টেক্সট – আধুনিক, অনুগামী শাস্ত্র আখ্যা দিলেন, excellent specimens of what story-telling ought to be. But all this literature is modern, secondary (Imagining hinduism: a postcolonial perspective - Sharada Sugirtharajah)। কোম্পানির অর্থানুকুল্যে ভারতত্ববিদের যে ক্ষমতার উচ্চতমস্থানটি তিনি পেয়েছেন, সেটি অন্য কাউকে ছাড়তে আর রাজি নন। ভারততত্ববিদ হিসেবে কেউ তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠুক, তাঁর না পসন্দ, এমনকী প্রয়াত জোন্সও যদি হয় তাহলেও তিনি তার বিরুদ্ধে আড় হয়ে দাঁড়াবেন। শুরু করলেন বৌদ্ধিক চাপের প্রক্রিয়া, বিশ্ব জনমত সৃষ্টির মাধ্যমে। কোম্পানির অর্থেই ভারতভাঙার উদ্যমী, এবং তাঁর স্বর্গতঃ দুই প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী, জোন্স আর কোলব্রুকের অনুবাদকর্মের ঐতিহ্য থেকে নিজেকে এক্কেবারে আলাদা করে নিয়ে বলে দিলেন, তাঁরা যা অনুবাদ করেছেন তা শুধু সাহিত্যিক ঔত্সুক্যজাগাতে পারেমাত্র, কিন্ত never become object of a life study। তিনিই একমাত্র সাচ্চা ভারততত্ববিদ যিনিই শুধুমাত্র ভারতের অক্ষহৃদয়, সংস্কৃতে রচিত বেদ নিয়ে চিন্তিত।
    বেদের বাইরে যাকিছু সংস্কৃতে রচিত হয়েছে তার কোনও কিছুকে তিনি পন্ডিতি আলোচনার যোগ্য বলে মনে করতেন না…The only original, the only important period of Sanskrit literature which deserves to become the subject of earnest study…is that period which preceded the rise of Buddhism, when Sanskrit was still the spoken language of India। সংস্কৃত ভাষায় বেদ ছাড়া তাঁর অন্যকিছুতেই যেন রূচি নেই। আদতে সংস্কৃত বেদ, মনগড়া আর্যতত্ব এবং ভারততাত্বিকরূপে বিশ্বে নিজের অবিসংবাদী প্রতিষ্ঠা আর তাঁর অর্থদাতা গুরুঠাকুরদের সেবা করতে এতই ব্যস্ত যে, তিনি জানতেই পারলেননা, প্রায় সংস্কৃতের বয়সী আর একটি ভারতীয় ভাষা, তামিলেও থিরুভায়মলি বা তামিল বেদেরও অস্তিত্ব রয়েছে। তাঁরমত ভারততত্ববিদ আদৌ জানতে পারলেননা, ভারতের কেনো ব্যক্তিত্বর তাঁকে বলারও সাহস হলনা, ইওরোপে বাইবেলেরমত বেদকে সমস্ত ভারতীয় সমাজ একবাক্যে তাঁদের বেদবাক্যরূপে স্বীকার করে নেয়নি। কেউ বেদকে মেনে আস্তিক হয়েছে, কেউ আবার বেদকে না মেনে নাস্তিক হয়েছে। ভারতে মুলারের মতে মহাভারত বা ভাগবত গীতারমত সেকেন্ডারি টেক্সটও শ্রুতির পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে- মহাকাব্যরূপে মহাভারত, নাট্যশাস্ত্র ইত্যাদি ভারতজুড়ে পঞ্চমবেদরূপে আজও ভারতজুড়ে স্বীকৃত।
    মুলারের আর্যতত্বের সুবাদে শাসক ব্রিটিশদের, ভারতীয়দের তুলনায় উচ্চশ্রেণীতে উত্তরণ ঘটাল। তাঁর তত্ব অনুযায়ী, ইওরোপিয়, উন্নতনাসা, উত্তল কপোল, সাদা চামড়া, পেটানো চেহারার আর্য ককেশাশিয় পূর্বপুরুষেরা ভারতে কালো চামড়ার মানুষদের দ্রাবিড়িয় সভ্যতা ধংস করে নিজেদের আর্য সভ্যতার ভিত্তিপ্রস্তর উত্তর-পশ্চিম ভারতে তৈরি করে দিয়ে গিয়েছে। সেই যুদ্ধে, কালো চামড়ার দ্রাবিড়িয় মানুষদের ইওরোপিয় আর্যরা, দাক্ষিণাত্যে ঠেলে দিয়েছে। উত্তর থেকে দক্ষিণে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া দ্রাবিড়িয়দের সভ্যতা ধংস করেই তৈরি হয়েছিল ভারতের আর্য সভ্যতার বীজ। তার আগে ভারতে ছিল শুধুই নিম্নস্তরের এক সভ্যতা। ঔপনিবেশিক ভারতে যেসব ব্রিটিশ শাসন করছেন তারা ককেশাসিয় আর্যদের উত্তরপুরুষ। আজকের ব্রিটিশরাই আরও এক উন্নত সভ্যতা বহন করে নিয়ে ভারতে এসেছে।
    ব্রিটিশ সরকারের উচ্চব্যয়ের(১ কোটি ২৮ লক্ষ টাকা) দাসত্ব প্রকল্পের ফল ফলল যথাবিহিত। মুলারের মনগড়া দাসত্বমূলক আর্যতত্ব ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকার সুচারুরূপে ব্যবহার করল নানান ভাবে। প্রথমে কোম্পানি, পরে ভারতকে জাতীয়করণ করা ব্রিটিশ সরকার বলল, ভারত উপনিবেশের একমাত্র কর্তব্য, প্রণত হতে হবে আর্যসম ব্রিটিশ সভ্যতার আধারে। নতুন আর্য ব্রিটিশরা এসেছে পুরোনো সভ্যতার পথ ধরে, ধংস হওয়া সভ্যতাকে নতুন রূপ দিতে। এই দেশকে নতুন করে ভেঙে গড়তে চাইছে তারা। যে কথা মার্ক্সও বলবেন। ব্রিটিশরা বয়ে নিয়ে এসেছে, আধুনিকতা আর ধর্মনিরপেক্ষতা নামে আর এক চমত্কার রঞ্জিততম ইওরোপসৃষ্ট জ্ঞাণ। বিশ্বে যত কিছু যুক্তিপূর্ণ, যা কিছু পার্থিব সবই ব্রিটিশ সভ্যতার আয়ত্বাধীণ। জাতপাতে বিভক্ত, ধর্মান্ধ, রাজনৈতিক হানাহানিতে রক্তাক্ত, দীর্ণ, গরীব, মূঢ়, নিরক্ষর, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, সভ্যতা ভুলে যাওয়া ভারতের একমাত্র উদ্ধারকর্তা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। সরকারিভাবে ব্রিটিশেরা। কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব-আমলা, মুলারের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক, মেকলের পরিকল্পনা ভিত্তি করে, দেশিয় সর্বজনীন শিক্ষার পরিবেশ-পরিকাঠামো ধংস করে, যে ইওরোপিয় বিদ্যার্জনের পদ্ধতি শেখানো হল, সেই বিদ্যার সূত্র ধরে দেশিয় দেহ নিয়ে শহুরে ইংরেজি শিক্ষিত ভারতীয়রা হয়ে উঠলেন মাথা নিচুকরে ইওরোপিয় তত্ব-তথ্য মেনে নিয়ে প্রশ্ন না করতে শেখা ভারতীয়-ব্রিটিশ।
    মেকলে-মুলারের যৌথ প্রকল্পের অমিত অর্থ আর অন্যান্য জাগতিক বুদ্ধিদাতারা, অতীত অভিজ্ঞতায় (রামমোহন-দ্বারকানাথ-বিদ্যাসাগরদের সঙ্গে শহুরে বাঙালিদের ইংরেজদের করুণাময় যুগল চরণে আত্মসমর্পণের ইতিহাস অনুসরণ করে) বুঝতে পেরেছিলেন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যপদে আস্থাবান, সাম্রাজ্যের সফলতায় প্রায়প্রণতিপ্রাপ্ত, সাম্রাজ্যের কর্তাদের লালন-পালনীয় ভূমিকায় কৃতজ্ঞায় জরজর, ব্রিটিশ তথা ইওরোপের বুদ্ধিবিভাষায় আনতভূমি, শহুরে বাঙালি বুদ্ধিজীবিদের খগ্বেদএর অনুবাদ, টিকালিখন, সংকলন এবং প্রকাশনার কাজ খাওয়ানো শুধু যে সময়ের অপেক্ষা তাই নয়, বাঙালিরা এই প্রচেষ্টার পর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সুফলে তাদের মাথা আরও নত করে দেবে আগামী কয়েক শতাব্দ। কোম্পানির বড়কর্তাদের আর তাদের বুদ্ধিদাতা সাঙ্গপাঙ্গদের, শহুরে বাঙালির দাসত্বের মানসিকতার আন্দাজে খুব একটা ভুল বেরোয়নি, তা জেনে গিয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ। এংলিসিস্ট আর ওরিয়েন্টালিস্টদের বিতর্কের সময় থেকেই বহু প্রচারের ঢক্কা নিদাদে শহুরে বাঙালির ঔপনিবেশিকতার সামনে মাথা ঝোঁকানোর দাসত্বের জমি ঘনকরে তৈরি হয়ে উঠেছে। কোটি কোটি রায়তের বহুসহস্রাব্দের তিল তিল কষ্টার্জিত সম্পদকে লুঠ করে রপ্তানি করা অর্থে, ব্রিটিশ কোম্পানির অর্থসাহায্যে তৈরি কুনাট্যসম এই দাসত্ব প্রকল্পের মূল স্থপতি, অন্যান্য ব্রিটিশারদেরমত, মুলারের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল ভারতীয়দের সামগ্রিক অযোগ্যতায়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রজাদের মনে জনগণমনঅধিনায়কতার দাসত্বের ধারণা প্রচারে ক্রমশঃ বাঙালি, পরে সনাতন ভারতও, সমগ্র আফ্রিকারমত খ্রিষ্ট ধর্মে আস্থাবান হয়ে পড়বে। ১৮৬৬তে স্ত্রীকে মুলার লিখছেন “It [the Rigveda] is the root of their religion and to show them what the root is, I feel sure, is the only way of uprooting all that has sprung from it during the last three thousand years।” এর দুবছর পর তিনি Duke of Argyle, Secretary of State for Indiaকে লিখবেন: "The ancient religion of India is doomed. And if Christianity does not take its place, whose fault will it be?"
    বেদ যে রেলিজিয়ন, সে তত্ব মুলার একা আবিষ্কার করেন নি, তার আগেও অনেক ইওরোপিয়ই এই প্রচারে পিতৃত্ব দাবি করতে পারেন। তাঁর আগে জোসুইট পাদরি থেকে গ্রান্ট সকলেই সেই কাজটি করেছেন। মুলার এই পুরোনো তত্বগুলিকে যথোপযুক্ত প্রচার আর স্থায়িত্ব দিয়েছিলেন! তার পূর্ববর্তী সময়ে এ তত্ব ততটা প্রচার পায়নি, যতটা মুলারের দক্ষতায়, ব্যক্তিত্বে মহীরুহ হয়ে উঠতে পেরেছে। বেদকে ধর্মশাস্ত্ররূপে হিসেবে ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে, কোম্পানির হয়ে আরও একটা বড় প্রচারের কাজ তিনি করলেন। ব্রাহ্মণদের সঙ্গে পুরোহিততন্ত্রকে এক করে দেওয়ার আধারশিলা পেশ করলেন। তার মত প্রখ্যাততম ইওরোপিয়র কলমে এই অনৃতভাষণ ভারতীয় সমাজত্ববিদ্যায় বিষবত হয়ে উঠল। এর আগে জেসুইটরা আবছা আলো দেখেয়েছেন। রামমোহনও সগর্বে পথ দেখিয়েছেন। কিন্তু রামমোহন ইওরোপিয় নন। জেসুইটরাও মুলারেরমত ক্যারিজমাটিক ছিলেননা। সরকারি দরাজ দান পাননি। ফলে তারা ভারতবিষতত্ব প্রচারের সুযোগ পায় নি। তাই বহুবছর ধরে কোম্পানি, পরে ব্রিটিশ সরকার, আর শহুরে ইংরেজিশিক্ষিত ভারতীয়রাই মুলারের পদপ্রান্তে আভূমি আনত হয়েছে, প্রণত হয়েছে। গুরু জোন্স, কোলব্রুক, লরেন্স অব আরবিয়াসৃষ্ট এশিয়াজুড়ে ছড়ানো দাসত্বজালের পথ ধরে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের ভারত লুঠের অর্থে পুষ্ট হয়ে, সাম্রাজ্যবাদের সপক্ষে আর খ্রিষ্ট ব্যবসায়ীদের দর্শনে ভাবিত হয়ে, ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনের সুফলতার প্রচারের অন্ততঃ দেড়শ বছর পরেও সাম্রাজ্যবাদী সফলতা মুলারের আর্যতত্বের বড় আভূষণ।
    মুলার আর্য ভারতের যে বিশ্লেষণ করেছেন, তাঁর রেশ আমরা পাই কয়েকবছর আগেও রাজা রামমোহনের জীবনী, Sophia Dobson Colletএর সম্পাদনায় আর সংগ্রহে, The Life And Letters Of Raja Rammohun Royতে। দ্বিতীয় সংস্করণটি সম্পাদনা আর প্রকাশ করেন কার্সিয়াংএর হেমচন্দ্র সরকারমশাই, ১৯১৪তে। বেশি কথা না বলে সম্পাদকের কথামৃতটুকুই উদ্ধার করা যাক- The history of India falls into three broad, clearly marked divisions. There are the early days of exuberent vitality, creative vigour, many sided progress, stretching far into the dim past the India of the Rishis, of the Upanishads, of the Buddhist gospel of love and service, the India of the epics and the schools of philosophy. We might denote the whole of this long period by the one comprehensive name of Ancient India. This was followed by a long era of gradual decline, of intellectual and spiritual stagnation, of moral and social degradation, of superstition and servitude a veritable dark age which might be called Mediaeval India. Since contact with the West awakened the country from this long deathlike slumber, a fresh career of honour and distinction, of intellectual power and spiritual grandeur, of social regeneration and national progress has been ushered in. This new era has been significantly called the Rammohun Roy epoch; for he it was who heralded this era embodying as he did the purest and loftiest aspirations of New India in his own wonderful life and giving inspiring expression to them with his prophetic voice. রামমোহনের জীবনীর টিকা লিখতে গিয়ে হেমচন্দ্র আদতে মুলারের তিন যুগের তত্বই নতুন করে তাঁর পাঠকদের সরবরাহ করছেন এবং স্পষ্টতঃই জানাচ্ছেন ইংরেজরা না এলে এই অন্ধকার দশা থেকে ভারতের উন্নতি সম্ভব হতনা। সম্পাদকের মতে, স্বতঃসিদ্ধভাবেই রামমোহন ইংরেজদের হাত ধরেছিলেন।
    আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা, মুলার রামমোহনসৃষ্ট ব্রাহ্মসমাজের কাজকর্ম নিয়ে বেশ উতসাহিত ছিলেন। মুলার প্রকাশ্যেই চাইতেন ব্রাহ্মরা নিজেদের খ্রিস্টিয় ব্রাহ্ম অথবা খ্রিস্টিয় আর্য হিসেবে ঘোষণা করুক। মুলারের আশাছিল এর পরই ব্রাহ্মরা চার্চ অব ইংলন্ডের সদস্যপদ গ্রহণ করবে। তিনি জানতেন, কেশব সেন ব্রিটিশ শাসনকে মানতেন। কেশব সেন মনেকরতেন, ভারতে কোম্পানি, পরে সরকারি শাসন কোনও সাধারণ মানুষের কর্ম নয়, এটি ভগবানেরই উদ্দিষ্ট কর্ম। পরমকর্তার নির্দেশেই ভারত উপনিবেশ তৈরি হয়। মুলারের প্রকল্পের সঙ্গে রামমোহন-কেশবীয় ভাগবত ভাবনা বেশ মিলে যায়।
    পুস্তকের অবয়ব বাড়ার আশংকায় সরস্বতী-হরপ্পা সভ্যতার বিশদ বর্ণনায় প্রবেশ না করেও বলাযায়, ৩০,০০০ কিমি অঞ্চলব্যাপী সভ্যতায় সরস্বতীর অস্তিত্ব প্রমাণিত। সেই স্বরস্বতী নদী পাতালবাসী হয় ১৯০০ খ্রিস্টপূর্বে, মুলারের হিসেবমত আর্যদের বেদ রচনার চারশ বছর পূর্বেই। সে সময়টিতেই সরস্বতী-হরপ্পা সভ্যতার ধংসকাল। তাহলে আর্যদেরতো হরপ্পা সভ্যতার মানুষদের সঙ্গে লড়াই করারই সুযোগ ঘটেনি। যে স্বরস্বতী নদীর কথা বেদে লেখা রয়েছে, সেই সরস্বতীতো আনেক কাল আগেই পাতালগামিনী। সরস্বতী সভ্যতার মাটি খুঁড়ে যে সব কঙ্কাল পাওয়া গিয়েছে, তাতে আর একটি মিথকে সহজেই মিথ্যা বলা যেতে পারে যে, আর্য আর দ্রাবিড় দুই সভ্যতার যুদ্ধ। এই যুদ্ধ আদপে ঘটেনি। জলের অভাবেই এই সভ্যতার বিলয় ঘটার সম্ভাবনা প্রবল। সরস্বতী-হরপ্পা সভ্যতা পশ্চিম থেকে পূর্বের দিকে সরে এসেছিলমাত্র।
    ১৮৮২তে কেম্ব্রিজে ভারত সংস্কৃতি বিষয়ে ধারাবাহিক বক্তৃতা দিয়েছিলেন ম্যাক্স মুলার। ভারতত্ববিদ্যার অন্যতম পোষক মুলারের, সমকালীন ভারত সম্বন্ধে ঘৃণা উদ্রেকী ধারণা ছিল। তার একদা পৃষ্ঠপোষক, মেকলের পথ ধরে, ততকালীন সময়ের ভারতীয় সমাজকে নিন্দায় ভরিয়ে দিয়ে, সমকালীন ভারতীয়দের বললেন, কয়েক হাজার বছরের পুরোনো ভারত নিয়ে তিনি বেশি ভাবিত, সে সময়ের ভারতীয় সমাজ, সংস্কৃতি নিয়ে তাঁর বিন্দুমাত্র উত্সাহ নেই। ভারতীয় ছাত্রদের তিনি নতুন করে ভারতের সনাতন ধর্মকে প্রসাধিত (পিওর) করার আহ্বান জানালেন। ১৮৭৮এর সেক্রেড বুক অব দ্য ইস্টএর মুখবন্ধে তিনি বলছেন ...The Priestly influence was at work, even before there were priests by profession, and when the priesthood had once become professional, its influence may account for much that would otherwise seem inexplicable in the sacred codes of the ancient world। তার লেখায় ব্রাহ্মণত্ব আর পুরোহিততন্ত্র একাকার। তিনিই ঠিক করে দিলেন ভারতের সমস্ত নষ্টের গোড়া ব্রাহ্মণেরা, নাহলে ব্রিটিশদের চাতুরি, সম্পদ লুন্ঠন আর জ্ঞাণ সাবড়ানো, সবই প্রায় ধরা পড়ে যায় যায় অবস্থা। এখন ব্রাহ্মণদের দুষ্কৃতিরূপে দেগে দিলে সোনায় সোহাগা। দুশতকের ব্রিটিশিয় কুকর্মগুলো পর্দার পেছনে চলে যাওয়ার একটা সুযোগ পায়। বাস্তবে তাইই হয়েছে।

    আর্য তত্বের বিসর্জনের রাজনীতি
    মুলার সম্বন্ধে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ টিকা প্রকাশ করা প্রয়োজন। ভারতে নতুন সরকার আসার সঙ্গে সঙ্গেই ক্ষমতার নতুনতর সমীকরণটি ঝট করে সমাধান করে ফেল্লেন তাঁর স্বদেশিয়প্রতিদ্বন্দ্বী মনিয়ের উইলিয়মস। মনিয়ের ১৮৬০এ অক্সফোর্ডে বোডিন প্রফেসরশিপ অব সংস্কৃত পদ দখল করলেন, মুলারকে টপকে। আর মুলারকে স্বান্ত্বনা পুরস্কার দেওয়া হল তুলনামূলক দর্শণের অধ্যাপকরূপে, পরে সাম্মানিক উপাধিও দেওয়া হয়য়। এসবে মুলার এতই ক্ষিপ্ত হন যে তাঁর নতুন প্রভুদের শিক্ষাদিতে তাঁর প্রিয়তম সন্তান, আর্যতত্বকে অস্বীকার করতেও বাধেনি। তিনি সপাটে বললেন, আই হ্যাভ ডিক্লেয়ার্ড এগেন অ্যান্ড এগেন, দ্যাট আই সে আরিয়ান আই মিন নায়দার ব্লাড, নর বোনস, নর হেয়ার, নর স্কাল, আই মিন সিমপ্লি দোজ স্পেল অ্যান আরিয়ান লাঙ্গুয়েজ, ... টু মি অ্যান এথনোলজিস্ট হু স্পিক্স অফ আরিয়ান রেস, অ্যান্ড হেয়ার, ইজ এজ গ্রেট এজ সিনার এজ আ লিঙ্গুইস্ট হু স্পিক্স অব আ ডোলিকোসেফালিক, ব্রাকিসেফালিক ডিক্সনারি, অর ব্রাকিসেফালিক গ্রামার(max muller, biographies of worlds and the home of the ariyans, 1888, 120pg.)।
    তবে তাঁর নিজস্ব এই তত্ব খারিজে তত্কালীন আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ঘটনাগুলোরও ভূমিকা রয়েছে। উনবিংশ শতকে ১৮৭১এর আগে জার্মানি ছিল ছোট জমিদারিত্বের সমাবেশ। জার্মান জাতিরাষ্ট্র বলতে আজ আমরা যা বুঝি উনবিংশ শতকে তার ধারেপাশে ছিল না। জার্মান মানচিত্রে বিন্দুরমত কয়েকটি জমিদারি ছড়িয়েছিল। ইওরোপের সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলো – বিশেষ করে অস্ট্রিয়া আর ফ্রান্স, ভারতেরমতই জার্মানিকে দুই ভাগে ভাগ করে নেপোলিয়নের সময়ের ত্রিশ বছরের যুদ্ধের সময় থেকেই। মাঝে মাঝেই জার্মানির প্রজাদের অবাঞ্ছিত মনে করে এই দুই রাষ্ট্র তার সেনাবাহিনী নিয়ে ঢুকে পড়ত জার্মানির মানচিত্রের মধ্যে। সে সময় প্রত্যেক জার্মান প্রজা মনে করতেন তার রাষ্ট্র আর সে শুধুই কয়েকটি শক্তিশালী রাষ্ট্রে হাতের পুতুলমাত্র। ক্রমশঃ এই অপমানবোধ জনগণেরমধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এবং সেই মানসিকতা আগামীদিনে ইওরোপের শুধু নয়, বিশ্বের ইতিহাসের নির্নায়ক হয়ে ওঠে। এমত শূণ্যতার মানসিক অবস্থায় জার্মান বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি আদেখলেপনাকে বাড়িয়ে তোলে। নিজেদেরকে তারা ভারতের জনগণেরমত প্রায়পরাধীণ ভাবত। জার্মানি সংযুক্তির পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য এবং ভাইসরয়ের পরামর্শদাতার বক্তিব্য ছিল – সংস্কৃতের মধ্যে একটি জাতির সৃষ্টি হল। হামবোল্ট, ফ্রেড্রিক এবং উইলহেম শ্লেগেন, শোপেনহাওয়ারএরমত বহু চিন্তাবিদেরা ভারতের প্রাচীণ সাহিত্য এবং দার্শণিক ঐতিহ্য থেকে নিজেদের কাজের অনুপ্রেরণা অর্জন করতেন। শকুন্তলা প্রথম অনুবাদ হয় জার্মানে। প্রায় পরাজিত জার্মান জনগণের কাছে আর্য শব্দটি তখন অতীব আদরের। আর্য শব্দের মধ্যে দিয়ে তারা তাদের পুরোনো সভ্যতার রেশ খুঁজে পাচ্ছে। এই শব্দটি তখন জার্মান রাজনীতিকদের সবথেকে প্রিয় বিশেষ করে বিসমার্কের।
    এই প্রায়পরাধীণতার প্রেক্ষিতে দুই সমকালীন জার্মান কার্ল মার্ক্স আর ম্যাক্স মুলার ভাগ্য ফেরাতে ব্রিটেনে অভিবাসিত হলেন। ১৮৫৭এর ভারতীয় অভিজ্ঞতার পর ব্রিটেন ইওরোপে মেপেমেপে পা ফেলতে শুরু করে। ১৮৭১এ জার্মানির সংযুক্তিকরণের পরে ব্রিটেনে প্রায় প্রতিদিন জার্মানির সংযুক্তিকরণকে উপলক্ষ্য করে বিষবাষ্পের জাল বোনা হতে শুরু করে। ব্রিটেনে যতকিছু জার্মান সবকিছুকেই সন্দেহের নজরে দেখা হতে শুরু করে। সংযুক্তিকরণের পর ব্রিটেনে সব থেকে ঘৃণিত ইওরোপিয় রাজনীতিকের নাম হল বিসমার্ক। সেই সময় ম্যাক্স মূলার শুধু ব্রিটেনেই নয় সামগ্রিক ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে এক অতীব পরিচিত নাম। ব্রিটিশ রাষ্ট্রে আর্য তত্বের ভিত্তি প্রদান করেছেন। ব্রিটিশ বিনিয়োগে প্রখ্যাত হওয়া মূলারের পক্ষে এমন কোনও অবস্থান গ্রহণ বিপজ্জনক হবে যদি তাকে ব্রিটিশ রাজনীতিক আর প্রশাসকেরা জার্মান জাতীয়তাবোধের সঙ্গে একাত্মকরে দেখে। তাই তিনি সে সময়কার জার্মান জাতীয়তাবাদী রাজনীতির অন্যতম প্রধাণ শব্দ আর্যত্ব থেকে বেশ কিছুটা দূরেই থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন। এর অন্যতম ফল হয় ম্যাক্সমুলারের হাতেই কন্যাসম আর্য তত্বের বিনাশ।
    কষ্টার্জিত খ্যাতি বজায় রাখতে মূলার হাওয়া মোরোগের ভূমিকা পালন করে এসেছেন বরাবরই। কেরিয়ারের প্রথম থেকেই অর্থবান হওয়া, প্রখ্যাত হওয়া আর বারংবার সংবাদশীর্ষে থাকাটাই প্রথমতম লক্ষ্য ছিল। প্রাথমিকভাবে আর্যতত্ব তাকে খ্যাতি এনে দিলেও, যখন তিনি দেখলেন আর্যতত্ব তার সফলতম কেরিয়ারে প্রশ্নচিহ্ন তুলেদিতে পারে, তখনই বিন্দুমাত্র চিন্তা না করেই যে তত্বে তার বিশ্ব জয়, সেই তত্বকেই বিসর্জন দিতে বিন্দুমাত্র কষ্ট হয় নি।

    মুলারের তত্বে বাঙালি কুঠারাঘাত
    আচার্য সুনীতিকুমার আর্য তত্বে আড় হয়েছিলেন। সুনীতিকুমারের বহু পূর্বেই প্রায় ভুলে যাওয়া এক ভারতপথিক অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ কলম তুলে নিয়েছিলেন এই ছদ্মভারতবন্ধুর সর্বনাশী তত্ব বিরোধিতায়। ভারত সংস্কৃতির উত্সধারা-য় তিনি বলছেন, উনবিংশ শতকের মধ্যভাগে ম্যাক্সমূলার আর্য বলিয়া একটি জাতির ধুয়া তোলেন। এই জাতিকে তিনি গৌরবর্ণ ও বিশিষ্ট সুসভ্য বলিয়া পরিচয় দেন। আর তাঁহার এই অভিমত সাধারণে বিশেষ আদৃত হইয়া পড়ে। ম্যাক্সমূলার বলেন যে এই আর্য জাতি নানান দলে দক্ষিণে, দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং পশ্চিমে সভ্যতা বিস্তার করিতে করিতে ভারতবর্ষে, পারস্যে, আর্মেনিয়ায় এবং য়ুরোপের নানান দেশে ছড়াইয়া পড়ে। ইহারই সঙ্গে আর একটা মতবাদের খুব প্রতিবাদ চলে। ফলে ভাষা এক হইলেও জাতিও এক হইবে টিকিল না। শেষে ১৮৯১ খ্রীঃ ম্যাক্সমূলার নিজে যে ভ্রান্তির অবতারণা করিয়াছিলেন তাহার প্রায়শ্চিত্ত করিয়া লেখেন – to me an ethnologist who speaks of an Aryan race, Aryan blood, Aryan eyes and hair, is as great sinner as a linguist who speaks of a dolichocephalic dictionary or a brachycephalic grammar. It is worse than a Babylinian confusion of tongues, it is downright theft – কিন্তু তথাপি আজও জাতিতত্ববিদগণ আর্য জাতিরূপ মতবাদের মোহ ছাড়িতে পারেন নাই।
    ভূপেন্দ্রানাথ দত্ত লিখছেন ভারতীয় সমাজ পদ্ধতিতে বলছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত ভাষার অধ্যাপক জার্মান বংশোদ্ভব মাক্স মূলর এই জাতীয় ভাষাভাষী আর্য নামধারী একটা মনুষ্যজাতির কল্পনা করেন। কিন্তু তিনি পরে ইংরেজ এবং উত্তর ইওরোপিয় পন্ডিতদের বিরুদ্ধ-সমালোচনায় বাধ্য হইয়া বলিলেন আমি আর্য অর্থে একটা মনুষ্য জাতিকেই বুঝি না, একটা ভাষাকেই বুঝি। ভুপেনবাবুর প্রথম ভুল মুলার অক্সফোর্ডে সংস্কৃত অধ্যাপক ছিলেন না, তিনি তুলনামূলক ভাষাবিদ্যার অধ্যাপক ছিলেন, এ বিষয়ে কয়েক স্তবকপূর্বে আমরা বিশদে আলোচনা করেছি। দ্বিতীয় ভুল, মুলার কোনও সমালোচনায় কান দেওয়ার মানুষ ছিলেন না। মুলার যে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন, ভুপেনবাবুর এই মন্তব্যও আদতে ভুপেনবাবুর মহত্বের পরিচায়ক।
    কিন্তু এখানেই ইওরোপে দাসত্বতত্বের সমাধি ঘটল না। মুলার নিজের আর্যতত্বগলার্ধকরণ করলেও নতুন মোড়কে আর্যতত্বকে বিশ্বের পাতে দিতে এগিয়ে এলেন এ এল ব্যশম, দ্য ওয়ান্ডার দ্যাট ওয়াজ ইন্ডিয়া পুস্তক নিয়ে। ভারতের বাইরেই শুধু নয়, ভারতেও বহু পাঠশালে এই পুস্তকটি আজও সযত্নে পঠিত হয়। এমনকী যে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ মুলারের তত্বে খড়গহস্ত, সেই আর এস এস নিয়ন্ত্রিত ভারতীয় বিদ্যভবনেও দ্য ওয়ান্ডার দ্যাট ওয়াজ ইন্ডিয়া পুস্তকটি আজও সর্বমান্য ভারতত্বের প্রাথমিক পাঠরূপে। ব্যশম পুস্তকের ইন্দো-ইওরোপিয়ন এন্ড আরিয়ান অধ্যায়ে বললেন, দ্য ইনভেডর্স অব ইন্ডিয়া কলড দেমসেলভস আর্যজ, আ ওয়ার্ড জেনারেলি এংলিসাইজড ইন্টু আরিয়ান(নজরটান সম্পাদকেদের)। তিনি আরও বললেন বিদেশাগত পুরোহিতেরা ছিলেন চমত্কার ছন্দোবদ্ধ বাক্য সৃষ্টি করার অধিকারী এবং তারাই পুজার মন্ত্রগুলি তৈরি করেছিলেন। এমং দ্য মেনি পিপল হু এনটার্ড ইন্ডিয়া ইন দ্য সেকেন্ড মিলেনিয়ম বিসি ওয়াজ আ গ্রুপ অব রিলেটেড ট্রাইবস হুজ প্রিস্টস হ্যাড পার্ফেক্টেড আ ভেরি এডভান্সড পোয়েটিক টেকনিক, হুইচ দে ইউজড ফর কম্পোজিশন হমস টু বি সাঙ ইম প্রেইজ অব দেয়ার গডজ এট স্যাক্রিফাইস।
    ব্যশমের উত্তরে এল ডি কাল্লা, তাঁর দ্য হোমল্যান্ড অব দ্য আরিয়ানস গ্রন্থে বললেন, হাউ আর উই একাউন্ট ফর দ্য ফ্যক্ট দ্যাট ইন্ডিয়া হুইচ ইজ সাপোসজড টু বি দ্য লাস্ট হোম অব দ্য আরিয়ান রেস প্রোডিউসেস দ্য ফার্স্ট অর দ্য মোস্ট এনসিয়েন্ট রেকর্ড অব দ্য আরিয়ানস, দ্য লাইক অব হুইচ ইজ নট প্রোডিউজড বাই দেম ইন দেয়র হোমস ইন ইওরোপ অর ইন এশিয়া আউটসাইড ইন্ডিয়া. কাল্লার তোলা এই প্রশ্ন অনেকেই আজ করছেন, কিন্তু আজও আর্য দাসত্বতত্বের প্রভাবে সব প্রশ্নই পিছনে চলে যাচ্ছে। এই আর্যতত্বের বিরুদ্ধে সুহৃদকুমার ভৌমিকমশাই কলম ধরেছেন। আদতে আর্য মানে কী তা জানতে যে কোনও ভারতপ্রেমীর সুহৃদবাবুর আর্য রহস্য পুস্তকের সঙ্গে সঙ্গে অমূল্যচরণ, ভূপেন্দ্রনাথ, অথবা সুনীতিকুমারের রচনাগুলি পাঠ অবশ্য কর্তব্য, তবেই শহুরে বাঙালির আর্যতত্বভ্রমের ওপর কিছুটা হলেও ছেদ পড়লেও পড়তে পারে।

    আর্য ব্রিটিশ প্রকল্প
    মুলার তার মেকলে নির্দেশিত আর তার প্রাণের কাছের দাসত্ব প্রকল্প শুরু করছেন এমন সময়ে, কোম্পানির বকলমে ইংরেজ সভ্যতা ভারতের ঐহিক আর পারমার্থিক সম্পদ লুঠ করে ছিবড়ে করে দিয়ে নিজের সাধের অর্থ আর পেশিভিত্তিক গণতন্ত্রের(যে গণতন্ত্রে ভারত লুঠের কান্ডারী নবোবরা নির্বাচিত হন অপরিমিত অর্থ ব্যয়ে) মুখপাত ঘটিয়েছে, মানুষমারা, সনাতন সভ্যতা, সমাজ ধংসের মুখপাত তৈরি করা শিল্পবিপ্লবের পথ মজবুত করেছে। কোম্পানির অত্যাচারে কোটি কোটি বিহারী-বাঙালি খুন হওয়া ছিয়াত্তরের মন্বন্তর তখন ইতিহাস, কিন্তু ছিয়াত্তরের পথ বেয়ে, রেলপথ তৈরির প্রচেষ্টায় ১৮৭৮এ তৈরি হয়েছে কয়েকশ মন্বন্তরের মর্মন্তুদ গণহত্যার পরিবেশ। অমানবিক শর্তে আনা পুঁজি আর প্রায় বিনামজুরিতে মন্বন্তরের পর ত্রাণের লোভ দেখিয়ে, পাতা রেললাইন ধরে মন্বন্তরের পর মম্বন্তরে, ইওরোপিয়দের বয়ে আনা রোগে ঠান্ডা মাথায় খুন হচ্ছেন কোটি কোটি নিরপরাধ ভারতীয়, ব্রিটিশদের সভ্যতার আর তার তাদের সাম্রাজ্যের নিষ্পেষণের চাকা চালু রাখতে, আর কোম্পানির বশংবদ ভারতীয় বন্ধুদের ধনী হওয়ার পথ খোলা রাখতে।
    পলাশির পর কেটে যাওয়া একশ বছর ধরেই গ্রামীণ পূর্বভারতের শয়ে শয়ে বিদ্রোহে, সোনার পাথরবাটি গণতান্ত্রিক উপনিবেশ, উপড়ে যেতে বসেছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রধান দেশটির ভিত্তি প্রস্তর। যখন গণতান্ত্রিক ব্রিটিশ সরকার ভারত জাতীয়করণের পরিকল্পনা করছে, ঠিক সেই সময়, মুলারের বিশ্বজয়ী ঋগ্বেদের অনুবাদকর্ম। মুলার নাকি স্পষ্ট দেখেছেন ঋগ্বেদে বলা হয়েছে আর্যরা ভারত ছেড়ে আরও পশ্চিম অর্থাত ইওরোপের দিকে চলে গিয়েছে। ইংরেজরা, ইওরোপিয় আর্য আর ভারতীয়রা, ভারতীয় আর্য। তখনও দাদাভাই নৌরজি বা রমেশ দত্ত ব্রিটেনের সাম্রাজ্যমাহাত্ম্যনির্মাণকে লড়াই দেওয়ার জন্য আসেননি, অথবা গদর পার্টিও বিদেশে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে প্রচারের কোমর বাঁধেনি। দু দশক পরেই দাদাভাই বা দত্তজর ছুঁড়ে দেওয়া অস্বস্তিকর প্রশ্নগুলির উত্তরে, মুলারের তত্ব ধার করে ব্রিটিশ সরকার বলবে কে কার সম্পদ লুঠ করে! কে কার পণ্যদ্রব্য লুঠ করে! ইংরেজ আর ভারতীয়, সকলেই একই আর্য ঐতিহ্যের অংশিদার। ইওরোপ থেকে অভিবাসিত হয়ে এসে এই ইংরেজদের আর্য পূর্বপুরুষ একদা সিন্ধুতীরে পর্ণকুটীরে বেদ রচনা করেছিলেন। ভারতীয়রা তখন ছিল বিম্মৃতির অতলে – বেদ রচনা করে ভারতকে উদ্ধার করল আর্যরা। বহুকাল কেটে যাওয়ার পর পুরোহিত-ব্রাহ্ণণ্য চক্রান্তে ভারত সেই ঐতিহ্য ভুলে গিয়েছে। আজ ব্রিটিশ এসেছে ভারতোদ্ধারে। তাই ভারতের ব্রিটিশ বন্দনা করা, লুঠের কার্যের বিরোধিতা বন্ধ করা প্রাথমিক কর্তব্য। পরে যতই প্রাক্তণ পৃষ্ঠপোষকদের প্রতি রাগের জেরে, তাঁরই তৈরি আর্যতত্ব অপ্রমাণ করার চেষ্টা করুননা কেন, মুলারের সঙ্গে আজও আর্যদাসত্বতত্ব অঙ্গাঙ্গীণভাবে জড়িয়ে রয়েছে।
    ৩০ বছর তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতবিদ্যা পড়িয়েছেন আর গবেষণা করেছেন। কিন্তু জার্মানিতে মুলার যখন বিদ্যালয়ের ছাত্র তখন বেনারসের এক চিত্র দেখে ভারতে আসার, ভারতকে জানার একটি সচেতন প্রচেষ্টা তৈরি হয়। পরে ব্রিটিশদের অর্থে, সমর্থনে আর্যদাসতত্ব খাড়া করে অপরিমিত অর্থ রেজগার করলেন, তখন কিন্তু আর ভারতে আসার চাড় দেখা যায়নি। কোম্পানি, পরে সরকারি ঢক্কানিনাদে ততদিনে তিনি প্রবাদপ্রতীম ভারততত্ব বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছেন। ভারতে না গেলেও তাঁর সম্মানে বিন্দুমাত্রও ঘাটতি পড়ে না। ঘাটতি পড়ে না কেননা শাসক সিভিলিয়ান আমলারা সকলেই তাঁর ছাত্র। ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা আমলারা সকলেই তাঁর দার্শণিক তত্ব প্রয়োগ করতে অতিমাত্রায় উত্সুক। ভারতের ভাবী প্রশাসক, আইসিএসদের অক্সফোর্ডএ ভারত সংস্কৃতি বিষয়ে পাঠ নিতে হত। এখানে তিনি ইম্পিরিয়াল সিভিল সার্ভিসের(পরে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস) চাকুরেদের ভারতীয় সংস্কৃতির মূল সূত্রগুলি পাঠ দিতেন। সিভিলিয়ানদের আর ইংরেজি শিক্ষিত ভারতীয়দের ওপর মুলারের প্রভাব আজও রয়েছে। আগেই দেখেছি মুলার সোজাসুজি বিশ্বাস করতেন, তত্কালীন ভারতীয় সংস্কৃতির ন্যুনতায় আর অতীতের ভারতীয় সম্পদের গরীমায়। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাসটুকু তিনি চারিয়ে দিতেন আগামী দিনের ব্রিটিশ সরকারি চাকুরেদের ওপর।
    মুলারের লেগাসি আজও বিদ্যমান। প্রবাদপ্রতীম শিক্ষকের দর্শণ থেকে পাঠ নিয়ে, আজও সিভিল সার্ভিসের আমলারা চেষ্টা করেন অজ্ঞ গ্রাম্য মূঢ় ভারতবাসীকে জ্ঞাণ বর্ষণ করে ইওরোপিয় সংস্কৃতির যোগ্য করে তোলার। এঁদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে এক বাঙালি কবি বলেবেন, এই সব মূঢ় মুখে তুলে দিতে হবে ভাষা বা ঐ জাতীয় কিছু একটি লব্জ, অথবা এর কিছু আগে পরেই আর এক ধর্মীয় মহাপুরুষ অজ্ঞ, মুর্খদের সঙ্গে গ্রামীণদের সরাসরি সমীকরণ ঘটালেন এবং মহত্ব প্রকাশ করে তিনি বললেন এই মুর্খ, অজ্ঞ, চন্ডাল সকলেই তাঁর ভাই। শহুরে ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালিরা কেউই বোধহয় মনে রাখেননি, ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতায় আযুত অজ্ঞ, মুর্খ গ্রামীণ, তাদের মূঢ় মুখে ভাষা না প্রকাশ করে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন।
    মুলারের পথ বেয়ে আর এক খ্রিস্ট যাজক ভাষার ভিত্তিতে উত্তর আর দক্ষিণ ভারতের বিভেদ বয়ে আনবেন তাঁর নাম Bishop Robert Caldwell। কডওয়েল দ্রাবিড় ভাষার তত্ব রচনা করলেন। তবে তিনি স্বীকার করছেন এই তত্ব, “not only of considerable moment from a philological [linguistic] point of view but of vast moral and political importance।” ‘moral and political’, বলতে তিনি আদতে বুঝিয়েছেন খ্রিস্টিয় যাজক আর ঔপনিবেশিকদের স্বার্থ রক্ষা। দ্রাবিড় ভাষার কৌলিন্য রক্ষায় কডওয়েল সরাসরি আশ্রয় নিলেন মুলারের আর্যতত্বে। ঔপনিবেশিক এই তত্বের পথ বেয়ে তিনি আর্য-দ্রাবিড় সংঘর্ষের তত্ব রচনা-প্রচার করলেন। এবং আজও দ্রাবিড় ভাষা আন্দোলনে তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারী খ্রিস্ট যাজকদের ভূমিকা চেখে পড়ার মত।

    প্রশ্ন মূলরের সংস্কৃত জ্ঞাণ
    বড় প্রশ্ন, শিক্ষক ছাড়া ইওরোপে বেদ অনুবাদেরমত সংস্কৃত শিক্ষা তিনি কোথায় পেলেন। আর কার কাছেইবা সেই জটিলতম ভাষাটি শিখলেন। ভারতে ইওরোপিয়দের সংস্কৃত শিক্ষার ইতিহাস বলছে সংস্কৃত বিশেষজ্ঞ হাইনরিশ রথ গোয়ায় সংস্কৃত শিখেছিলেন। কিন্তু তিনি ইওরোপে সংস্কৃত শিক্ষা দেননি। পূর্বশ্রমে রথ, জেসুইট পুরোহিত ছিলেন। পরে তিনি আগ্রাতে জেসুইট কলেজের প্রধানও হন। তিনি দীর্ঘ ছবছর ধরে সংস্কৃত শেখেন। কথিত, ভারতে বেনারসের ব্রাহ্মণদের সঙ্গেও তিনি অনর্গল সরাসরি সংস্কৃত ভাষায় নানান শাস্ত্র বিচার করতেন। রথ পানিণীর ব্যকরণ অনুসরণে একটি সংস্কৃত সরল ব্যকরণ প্রনয়ণ করেন। সেই ব্যকরণ পুস্তকটি ভ্যাটিকান পুস্তকাগার থেকে অকালে হারিয়ে যায়। ১৯৮৮তে এটি নতুন করে খুঁজে পাওয়া যায় সেখানেই। প্রায় সব ভারততত্ববিদ স্বীকার করেছেন, এতদিন যত ইওরোপিয় পন্ডিত যত সংস্কৃত ভুলেভরা ব্যকরণ লিখেছেন, তার তুলনায় রথেরটি যথেষ্টই উত্তম। অস্যর্থ তিনি যথেষ্ট পরিমানে সংস্কৃত জানতেন।
    অতীতের ভুলেভরা সংস্কৃত ব্যকরণ পড়ে যে সব ইওরোপিয় ইওরোপে সংস্কৃত শিখেছেন দাবি করছেন তাদের লেখা পড়িয়েই আজকাল ভারতে সংস্কৃত শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। সেসময় ভারতে বাসকরা বহু ইওরোপিয় সংস্কৃত জানতেন আর সংস্কৃত সাহিত্যও অনুবাদ করেছেন বলে দাবি করেছেন। আদত কথা হল তাদের অধিকাংশই কলকাতার কাছাকাছি থাকা নানান বিদ্যাকেন্দ্র থেকে পন্ডিত ধার করে বিভিন্ন সংস্কৃত পুঁথি অনুবাদ করেছেন। এঁরা কোনও দিনই সঠিকভাবে সংস্কৃত শেখেননি, যে শিক্ষা ভিত্তি করে এরকম জটিল এক ভাষায় রচিত জটিলতম প্রযুক্তি-ধর্ম-সাহিত্যকর্মগুলির অনুবাদকর্ম করা চলে। বিশ্বের অনেকেই বিশ্বাস করেন অনুবাদের প্রাথমিক শর্ত হল দুটি ভাষাতেই সমান অধিকার থাকা, চলনসই ভাষা জানা বলে কিছু হয় না। অনুবাদে সামান্য হলেও দুটি ভাষাতেই ন্যুনতম সাহিত্য সৃষ্টিরও ক্ষমতা প্রয়োজন। লেখকের সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষমতার কথা দূরে সরিয়ে রেখেই বলা যাক, যারা সংস্কৃত থেকে নানান ইওরোপিয় ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন, তাঁদের কী এই দুটি ভাষার অন্যতম, সংস্কৃততে কী সেই ন্যুনতম দক্ষতা ছিল! মুলারেরমতই ভারতে পদার্পণ না করা আর এক সংস্কৃত বিশেষজ্ঞ, মনিয়ের মনিয়ের-উইলিয়মস ১৮৫৪তে একটি মোটামুটি চলনসই সংস্কৃত অভিধান তৈরি করেন। মুলার কিন্তু সেই অভিধানটিও পড়তে পাননি। তিনি কলকাতাবাসী উইলসনের অভিধান অনুসরণ করছিলেন। উইলসন ভিষগ ছিলেন। রসায়নে দক্ষতার জন্য তিনি কলকাতার টাঁকশালে চাকরি পান। ১৮১৯এর শেষের দিকে কলকাতার পণ্ডিতদের সাহায্যে তিনি একটি অভিধান রচনা করেন। এই অভিধানটিই শেষ পর্যন্ত অনুসরণ করেন ম্যাক্স মুলার। কয়েকদিন তিনি উইলসনের কাছে সংস্কৃতও শেখেন। মুলার স্পষ্ট জানিয়েছেন, উইলসন বেশ খারাপ সংস্কৃত জানতেন। চালুনির আবার ছুঁচের বিচার।
    ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আদত উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয়রা যেন আর বাইবেলিয় জুডা-খ্রিস্টিয় ধারণায় গড়ে ওঠা ইওরোপিয় সভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়। বাইবেল অনুযায়ী বিশ্বের বিকাশ সর্বাধিক ৪০০০ বছরের। অর্বাচীণ ভারতীয় সভ্যতার বিকাশ এর আগে হতেই পারে না এই ধারণাটি ভারতীয়দের মনে গেঁথে দেওয়া উদ্দেশ্য ছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রভূত অর্থ ব্যয় করে মুলারেরমত পন্ডিত পোষার প্রয়োজন হয়। তখনও সরস্বতী-হরপ্পা সভ্যতায় রাখালদাসের হাত পড়ে নি। তাহলে কী হত কে জানে! কিন্তু আমলাদের হাত ধরে, শিক্ষকদের হাত ধরে ততদিনে ইংরেজি শিক্ষিত ভারতীয়দের মানসে মুলারের আর্যদাসত্ব প্রকল্পের মূল ধারণাগুলি থানা গেড়ে বসেছে। বুদ্ধিমান মুলার তার পৃষ্ঠপোষক অর্থদাতাদের দেয় অর্থ, সুদে আসলে উসুল করে দিয়ে ছিলেন। তিনি একই সঙ্গে ইংরেজি সমাজকে ধ্রুবতারা করে নেওয়া ভারতীয়দের, ইংরেজদের দ্বারা পদদলিত হওয়ার আকাশ চুম্বি আশাকেও বিমুখ করেন নি। বিংশ শতকে দাঁড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালগুলোতে ভারতীয় ভাষা নয়, ছাত্রছাত্রীদের ইংরেজিসহ অন্যান্য ভাষা সাম্মানিকস্তরে পড়ার ঝোঁক থেকেই দাসত্ব প্রকল্পের সার্থকতা প্রমাণিত।
    ১৮৮৫তে মুলার কলকাতায় আর এক তথাকথিত সংস্কৃত বিশেষজ্ঞ চার্লস উইটকিনসকে এক চিঠিতে জানান, সংস্কৃত শেখার পক্ষে তার বয়সটা একটু বেশিই। উইটকিনস ছিলেন আর এক চালবাজ, ধড়িবাজ। মনুস্মৃতিরমত এক গুরুত্বপূর্ণ এক শাস্ত্র অনুবাদে তাঁর নাম রয়েছে। পুরোটাই ধাপ্পা। কলকাতার বাড়িতে সংস্কৃত পন্ডিত রেখে অনুবাদের কাজ করাতেন, আর সেই অনুবাদ প্রকাশ করতেন নিজের নামে। শহরে তিনি আসেন ভাগ্যান্বষণে। তার উদ্দেশ্য ভারতে অর্থাত বাঙলায় যথেষ্ট অর্থ অর্জন করে, ইংলন্ডে ফিরে, অন্যান্য নবোবদেরমতই পার্লামেন্টে একটি আসন দখল করা(শুধুই ভারতীয়রাই তাহলে ভোট কেনেন না, গণতন্ত্রের পীঠস্থানেও ভোট কেনা বেচা হয়, নিদেনপক্ষে গণতন্ত্রের পীঠস্থান লন্ডনে এককালে তো হতই। সে যুগে পার্লামেন্টের ১০ শতাংশ এমপি ছিলেন ভারতে লুঠের অথবা ঘুষের অর্থে বড়লোক। অর্থাত বড়লোক আর এমপিত্বর সমীকরণ, সমীভবন হল)। তার হিসেব ছিল ২০ থেকে ২৬ হাজার পাউন্ড হলে এই কার্যটি সমাধা হতে পারে।

    মিথ্য তত্ব, মিথ্যা তথ্য
    ম্যাক্স মুলার এবং তাঁর বুদ্ধিজীবি বন্ধুবান্ধব ভারতের গুণগানের ছলে, ভারত সংস্কৃতির অপপ্রচারের হাত ধরাধরি করে আর এক ভারতবিদ্যা বিশারদ রূপে নিজেকে জাহির করা উইলিয়ম জোন্স একটি বিপজ্জনক তত্ব খাড়া করে দিয়ে যান। তার মতে এককালে ভারতে সংস্কৃত পড়তেন ব্রাহ্মণরা। কোম্পানির অর্থে বিখ্যাতরা সমবেতভাবে প্রচার চালান, ভারতীয়দের মধ্যে অব্রাহ্মণদের বেদ বা সংস্কৃত পড়া নাকী সরাসরি নিষেধ ছিল। ব্রাহ্মণেতরদের সঙ্গে এক পাতে বসতেন না ব্রাহ্মণেরা। তাদের ছোঁয়াচও নাকী অষ্পৃশ্য ছিল। এছাড়াও সেই সময়কার ভারতে বেদপাঠ, সংস্কৃত পাঠও প্রায় উঠে গিয়েছিল। একমাত্র ব্রিটিশদের হাত ধরেই নতুন করে সংস্কৃত শিক্ষা ভারতে শুরু হয়েছে। ব্রিটিশ এসেছে আধুনিকতা নিয়ে, তাই ভারতদেশে অচল অজর জাত ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে। ব্রিটিশদের প্রচারের পথ বেয়ে, দেশে থেকেও প্রায় বিদেশি রামমোহন পর্যন্ত ভুলেগেলেন ব্রাহ্মণ আর পুরোহিততন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য। সংস্কৃত শিক্ষায় উদ্যোগী সরকারের বিরুদ্ধে রামমোহন বললেন দু হাজার বছরের পুরোনো তত্ব আর ভারতীয়দের ছাত্রদের মাথায় প্রবেশ করিয়ে লাভ কী, বরং সে সময়কার নানান ব্রিটিশ তত্ব পাড়ানো যাক।
    রামমোহনের অন্যতম অন্তরঙ্গ বন্ধু উইলিয়ম এডাম বিপরীত অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। এডামএর বাঙলা-বিহারের শিক্ষা সমীক্ষায় পাই, উচ্চ পাঠশালাগুলিতে বটু আর শিক্ষকদের অধিকাংশই তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষজন। উচ্চবর্ণ আর নিম্নবর্ণের বটু পাঠশালে একসঙ্গে পাঠ নিত। সংস্কৃতও পড়ানো হত। নাটোর থেকে ত্রিহুত, বাঙলা বিহারের গ্রামীণ সন্তানেরা সংস্কৃত পড়তেন। বিশ্ববিদ্যলয়সম কেন্দ্রগুলিতে ভ্রমণ করে তিনি লিখছেন তাদের পাঠ্যসূচীসমূহ। যদিও এডামের শিক্ষা সমীক্ষার আগেই রামমোহন বিলেতে প্রয়াত হন, তবুও তাঁরমত উচ্চকোটির বাঙালির দেশজ বাস্তবতা সম্পর্কে হয় অজ্ঞাণতা না হয় অবজ্ঞা পরের দিকে মারাত্মক অবস্থা ধারণ করেছে যখন দ্বর্থহীনভাষায় রামমোহন দেশজ পাঠ পড়ানোর বিরুদ্ধে সরাসরি রায় দিলেন।
    মুলারের ভাবানুগামীদের প্রণীত উচ্চ পাঠশালায় পাঠ্য ইতিহাস বইতে স্পষ্ট লেখা রয়েছে ১৫০০ অব্দে আর্যরা ভারত আক্রমণ করে এবং এই আর্যদের বিক্রমে সরস্বতী-হরপ্পা সভ্যতা ধংস হয়। আজও ভারতীয় বহু বিশেষজ্ঞ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের রচিত এই ইতিহাসটি পোষণ করেন। অথচ বিগত একশ বছর ধরে সরস্বতী-হরপ্পা সভ্যতা ধংসাবশেষ থেকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে যে, আর্যতত্ব আর আর্যদের সভ্যতা আক্রমণের ধারণাটিই তৈরি করা। মুলারেরমত সাম্রাজ্যবাদীরা আর্য-মিথ তৈরি করেছিলেন কোম্পানির অর্থানুকূল্যে। আদতে মুলার আর কোম্পানির পরে ব্রিটিশ সরকারের সাংস্কৃতিক দালালেরা শহুরে ভারতীয়দের ব্রিটিশ পদপ্রান্তে অবনত করতেই এই মনগড়া তথ্যের মায়াজাল তৈরি এবং এটি সাড়ম্বরে বিশ্ব জুড়ে প্রচারও করেন। সেই প্রচারকে আরও জোরদার করতে মুলারবাদী বহু প্রবীণ বুদ্ধিজীবি বাঙালিও এই প্রচার-প্রণতির পুরস্কারের পেয়েছেন তথাকথিত ব্রিটিশ রাজকীয় সংস্থাগুলিতে সাম্মানিক পদ অলঙ্করণ করে। আদতে এই প্রচার ব্রিটিশারদের মনোজগতের গভীরে প্রবেশ করে, রিপন থেকে কার্জন, আরউইন থেকে মাউন্টব্যাটেন এবং উপনিবেশের তস্য তস্য আমলা-চাকুরেরা সকলেই সমগ্র ভারতবাসীকে মনে করতেন ব্রিটিশের দাস, ইওরোপের দাস। যে সব বুদ্ধিজীবি ইওরোপিয় সভ্যতাকে সমর্থন সমর্থন করেছেন তাদেরও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ছেড়ে কথা বলেনি।
    স্বাধীণতার পরপরই দুধরণের মানুষ অশ্রদ্ধার ভারত দেশটি থেকে ব্রিটিনে অভিবাসিত হলেন। এঁদের একাংশ ভারতীয় আর একাংশ ব্রিটিশ। অতীতের কোম্পানি আমলা-নবোব থেকে শুরু করে ভারত স্বাধীণতার পরে ব্রিটিশ অথবা ব্রিটিশ অনুগামী দেশিয় সিভিলসার্ভেন্টসরা ব্রিটেনে গিয়ে কী করেছেন তা স্পষ্ট- তারা চেষ্টা করেছেন সাম্রাজ্যের বাতসল্যের করুণাঘণমূর্তিটিকে বিশ্বের সামনে সাজিয়েগুজিয়ে রাখতে। চাকুরিকালে তাঁরা যে অর্থ আর সম্মান উপার্জন করেছেন ভারত থেকে, তাতে সেইটুকু ফিরিয়ে দেওয়ার প্রণোদনায়, তাদের এই মূর্তি নির্মাণের প্রচেষ্টা বোঝাযায়। অন্য আর এক ভারতীয়, সাধারণতম ভারতীয়দের করদানের অর্থে ভারতে বিনাব্যয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করে, তাঁদের স্বপ্নের দ্বিতীয় কর্মস্থল, ব্রিটেনে(নতুন সময় আমেরিকায়) অভিবাসিত হলেন। ব্রিটিশ নুন খেয়ে, চাকরিবাকরি করে, ঘোমটার আড়ালে যতটা পারা যায় প্রাক্তণ উপনিবেশকে ছদ্ম-গালাগালি আর মেট্রোপলিটনে গলাগলি করলেন, লম্বাচওড়া কেরিয়ারও তৈরি হল। এক জীবনে মোটামুটি যতটুকু পাওয়ার ততটুকু তাদের পাতে উপহার দিয়ে, তাদের কেরিয়ারে ভিত্তিভূমির ভিত্তিপ্রস্তর গভীর থেকে গভীরে যেতে শুরু করল। বিশ্বের সবথেকে প্রার্থিততম সম্মান, পুরস্কারগুলিও এই মানুষেরা দখল করলেন একেএকে। সাম্রাজ্য না থেকেও সাম্রাজ্যভাবনা প্রচারের কাজে এরা অনেকেই সাম্রাজ্যের পিঠচাপড়ানি পেয়ে কেরিয়ার গড়েছেন- পোড়া ভারতে কে আর কেরিয়ার নষ্ট করে।
  • বিশ্বেন্দু | 125.187.39.204 | ২৪ জুন ২০১৩ ১৮:১৪613060
  • সে-র উত্তরে
    আমরা কপিরাইট মানি না... ভারতের মানুষ কোনদিনই কপিরাইটে বিশ্বাস করেন নি, এমনকি ইংরেজদের আগের সময়ের শহুরে মধ্যবিত্তরা পর্যন্ত। আমরা যা লিখি তার অধিকাংশ গ্রামীণদের, কিছু গ্রামীণদের প্রতি শ্রদ্ধাপূর্ণ শহুরেদের তত্ব জেনে, ভাষ্য শুনে, কিছু পড়ে লেখা...আমাদের কোনও অধিকার নেই তাকে আমাদেরই বলে চালানোর... আমরা কলাবতী মুদ্রায় নানান জ্ঞান, সামাজিক অবস্থান, তত্বের টিকা, ভাষ্য রচনা করি এবং সঙ্গে নানান তথ্য সংকলন করি...
    ভারতই বোধহয় একমাত্র দেশ, যে সঙ্কলক আর টিকাকারদের লেখকদের সমান, কখনো কখনো বেশিই মর্যাদা দিয়েছে, অন্তত ব্রিটিশ পূর্ব সময় পর্যন্ত। তার পরে সব হেঁটমুন্ডঊর্ধ্বপদ। ভরত, মল্লিনাথ, রামনাথ, বাৎস্যায়ন, সায়নাচার্য, শার্ঙ্গদেব হয় সঙ্কলক, নয় টিকাকার, নয় ভাষ্যকার।
    আমাদের লেখা ছাপানোর অনুমতির দরকার নেই। কষ্ট করে সূত্র উল্লেখ করে লেখাটা ছাপিয়ে দিলেই হবে। তারপরে জানালে লাগে। ব্যাস। আমরা লেখক নই, বিশেষজ্ঞ নই। কেউ যদি তাদের লেখায় তথ্য গ্রহণ করেন, তাতেই আমাদের কাজ হয়েছে মনে করব।
    যে লেখাগুলো করি, সেগুলো গ্রামের মানুষের কাছে শেখা। আমরা গ্রামের মানুষের কথা বলি না, তারা আমাদেরকে দিয়ে তাদের কথা বলিয়ে নেন। আমরা যারা সবজান্তা গামছাওালা মধ্যবিত্ত, সব কথারই শেষ নিদান দিয়ে থাকি। তার বিপরীতে আমরা মনেকরি, ইংরেজি শিক্ষিত শহুরে মধ্যবিত্তের বেঁচে থাকার জন্যই এই যাপনগুলো, তত্বগুলো শিখে নেওয়া দরকার। তারা এবং উচ্চবিত্তরা এই পৃথিবীকে ধংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। যেমন তারা বড্ড অসহিষ্ণু, তেমনি তাদের নানান তত্ব বড্ড বালখিল্য। সেগুলির বিপক্ষে এই কথাগুলো শহুরেরা জানতে বুঝতে পারলে বোধহয় একটু শান্তি পাবেন, অনেক অজানা জানতে পারবেন।

    ৮০০০ বছরের বিষয়ে বলি, আসলে বিশ্বের ইতিহাসের শুরু সেকুলার শতাব্দ, খৃস্টাব্দ এটাই প্রশ্ন করছি, পশ্চিমের জ্ঞানচর্চার ভিতকেই প্রশ্ন করছি। তার সময় চিহ্নিত করাকে মান্যতা দেবইবা কেন? অন্য অনেকে ভারতের সময় জ্ঞাপনী নিয়ে কাজ করছেন। হরপ্পা বোধয় এই আলোচনায় খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। দ্বিতীয় ইতিহাসেতো নয়ই, শুধু সরস্বতী- হরপ্পার উল্লেখ ছাড়া। আমি এবিষয়ে বিন্দুমাত্র বিশেষজ্ঞ নই, যে আস্তিন গুটিয়ে তর্ক করতে পারব।
  • ম্যাক্সিমিন | 69.93.210.6 | ২৪ জুন ২০১৩ ১৮:২৯613061
  • ম্যাক্সমুলার Leipzig University থেকে পিএইচডি ডিগ্রি করেছিলেন একথা স্ত্রীপুত্র ছাড়া আর কে বলেছেন? স্ত্রীপুত্রই বা কোথায় বলেছেন? উইকি লিখেছে

    He entered n 1841 to study philology, leaving behind his early interest in music and poetry. Müller received his degree in 1843. His final dissertation was on Spinoza's Ethics. গ্রাজুয়েট কোর্সেও ডিসারটেশন থাকতে পারে।
  • বিশ্বেন্দু | 125.187.39.204 | ২৪ জুন ২০১৩ ১৮:৪৪613062
  • http://www.goethe.de/ins/in/lp/uun/mxm/enindex.হটম লিঙ্কএ বলা হচ্ছে

    Max Mueller was born on 6th December in the year 1823 in Dessau, a small town in eastern Germany. Max Mueller entered the Leipzig university at the age of 18 and went on to complete his doctoral thesis on Spinoza’s ethics in 1843.
  • সে | 203.108.233.65 | ২৪ জুন ২০১৩ ১৮:৫৭613063
  • বিশ্বেন্দুবাবু,
    বুঝলাম।
    তখনকার দিনে তো এত বেশি ধাপে ধাপে অর্গ্যানাইজ্‌ড্‌ পদ্ধতিতে পড়াশোনা হতো না। আঠেরো বছর বয়সে ডক্টরেট কিন্তু সেক্ষেত্রে অসম্ভব নয়। হয়ত কিছু নথি হারিয়ে গেছে। স্ক্যান করে সবকিছু রাখা যেত না। দুটো বিশ্বযুদ্ধ ঘটে গেছে এরপরে। তার ঝড়ঝাপটাতেও নথি হারাতে পারে। ইলেক্‌ট্রনিক্যালি কিছুই তখন জমিয়ে রাখা যেত না।
  • বিশ্বেন্দু | 125.187.39.204 | ২৪ জুন ২০১৩ ১৮:৫৮613064
  • বিশ্ববিদ্যালয়ের চিঠিতে বলছে, At the university archive of Leipzig is neither an entry in the book of promotion nor a promotion file of Friedrich Max (Maximilian) Müller. He was a student at the university from 1841 to 1844. There is an entry in the discharge register (with attended lectures) and two entries in the register of students.

    বিশ্বেন্দু কিন্তু কোনোদিন কলেজের বাইরে পড়ে নি, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছায়াও মাড়ায়নি।
    তাই সে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক সুতনু ভট্টাচার্যকে প্রশ্ন করে ছিল যে এই ইংরেজির মানে কি? তিনি এর আগে মঞ্জুরি কমিশনের পূর্বাঞ্চলের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি দপ্তরি ইংরেজির মানে অনেক বেশি জানবেন, অন্ততঃ বিশ্বেন্দুর থেকে। স্পষ্ট বলেছিলেন, এর একটাই মানে, ম্যাক্স মুলার শুধু ছাত্রই ছিলেন, কোন পরীক্ষা দেন নি। তাহলে তার ডিসারটেশনএর সুযোগ আসছেই বা কোথা থেকে।

    যদি ধরেই নেওয়া যায়, ডিসারটেশনই তিনি করবেন, তাহলে গেটে ইন্সটিটুট ম্যাক্স মুলার ভবনের ওয়েবসাইটে doctoral থিসিসএর কথা এল কেন? doctoral থিসিস আর ডিসারটেশন কি এক?

    বিশ্বেন্দু জানে না।
  • ম্যাক্সিমিন | 69.93.210.6 | ২৪ জুন ২০১৩ ১৮:৫৯613066
  • আরেকটা জায়গাতেও পেলাম। Sara Abraham and Brannon Hancock, research students at University of Glasgow. Gifford lecture series.
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে প্রতিক্রিয়া দিন