এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  নাটক

  • ছড়ানো ছেটানো কথা ও ঘটনা।

    সে
    নাটক | ২০ আগস্ট ২০১৩ | ২৭৩৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • সে | 203.108.233.65 | ২০ আগস্ট ২০১৩ ১৮:৪৫619814
  • ছড়ানো ছেটানো সব ঘটনা।
    ক্রমানুসারে সাজাতে গেলে পেরে উঠব না। কিছু লোকের নাম ও পরিচয় পাল্টে লিখতে হবে। এখন কয়েকটা টইতে অনেকে যা যা লিখেছেন সেসব দেখেই সাহস বললে সাহস, উৎসাহ বললে উৎসাহ- সেটা।

    টিবি
    টিবি রোগটার থেকেও টিবি এই শব্দটা ভূতপ্রেতের চেয়েও ভয়ঙ্কর ছিলো আমার অভিজ্ঞতায়। খুব অল্প বয়েস থেকেই এমনকি হয়ত অক্ষর পরিচিতির আগে থেকেই জানি টিবি একটা ছোঁয়াচে রোগ, কাশির সঙ্গে গলা দিয়ে রক্ত উঠতে উঠতে রক্তবমি করতে করতে লোকটা মরে যায়। কেমন করে জানলাম? নিশ্চয় কেউ বলেছিলো । আত্মীয় পরিজন বা কাছের কারোর মৃত্যু অথবা মরে যাওয়ার সঙ্গে সরাসরি অভিজ্ঞতা তেমন হয় নি। তাও খুব ভয়ে থাকতাম। বাড়ির মধ্যেই জনা চারেক টিবি রুগি। এদের দুজনের রোগ সেরে গেছল বলেই জানতাম কিন্তু অন্য দুজনের মাঝে মধ্যেই রোগের লক্ষণ ফিরে দেখা দিত। তখন চিকিৎসা শুরু হয়ে যেত। এরা দুজন আমার বাবা ও পিসিমা। ফুসফুসের রোগ, ঘুষঘুষে জ্বর, খকখক করে শুকনো কাশি, কেউ যেন শুনতে না পায় বাড়ির চৌহদ্দীর বায়রে। আবছা মনে পড়ে সন্ধেবেলায় বাবাকে বা পিসিমাকে ধীরে ধীরে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দোতলার সিঁড়ি দিয়ে নীচে সদর দরজার সামনে যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে ট্যাক্সি। ট্যাক্সি যাবে ডাক্তারখানায়। দিলখুশা ষ্ট্রীট লোয়ার রেঞ্জ এলাকায় ডঃ অরুণ নন্দীর চেম্বারে। আরো জানতাম এক্স রে। প্রকান্ড খামের মধ্যে করে আসতো বুকের এক্সরের ছবি ও রিপোর্ট। সেই এক্সরে র ছবি আলোর সামনে ধরলেই পাঁজরের কঙ্কাল। ডাক্তার বলেছে দুটো লাঙ্স্ই অ্যাফেক্টেড বেড রেস্ট চাই স্ট্রেপটোমাইসিন চলবে এখন ইঞ্জেকশান। আলাদা ঘর সেখানে সব কিছু আলাদা - প্রায় সকলেরই যাওয়া মানা। আরো কতো নতুন শব্দ শিখে ফেলি - লাইজল (লাইসল কে ওমনি শুনতাম সে বয়েসে), ফিনাইল, স্পুটাম পজিটিভ, স্পুটাম নেগিটিভ, মান্তু টেস্ট, চেস্ট স্পেশালিস্ট। এই শব্দগুলো খুব গোপন, এত গোপন যে খেলার সাথীদের সঙ্গেও বলা চলে না। ওরা যদি জানতে পায় ঘোর বিপদ ঘনিয়ে আসবে- সে বিপদ কেমন তা সম্পূর্ণ অজানা।
    পিসিমার অসুখ বেড়ে গেলে আমরা বাচ্চারা ওদিকটায় যেতাম না । পাড়ার লোকও কিছু টের পেত না কিন্তু বাবার অসুখ হলে তখন তো লুকোনোর উপায় নেই। অফিস কামাই হচ্ছে অফিস থেকে লোকেরা আসত খোঁজ নিতে। সেসব সমস্যা এড়ানোর ব্যবস্থা পাড়ার ডাক্তারবাবুকে দিয়ে সর্দিজ্বর বা ব্রঙ্কাইটিসের প্রেসক্রিপ্শান ও সার্টিফিকেট। অফিসের লোক এলে বাবা হয়ত তখন ঘুমোচ্ছে না , তবুও - উনি এখন ঘুমোচ্ছেন বলে তাদের সরিয়ে দেওয়া হতো।
    ফুলের মতো নিষ্পাপ সত্যবাদী শিশু হবার বয়েসেই মিথ্যাচারে এক্স্পার্ট্ হয়ে উঠছিলাম। তবু বিপদ কাটে নি।
    ঠাকুরমার ছিলো বোন টিবি। তা সেরেও গেছলো কিন্তু হাড়ের যা ক্ষতি হয়ে গেছল তার জেরে ওঠা বসার খুব কষ্ট হতো লাঠি (এই লাঠির ও হিস্ট্রি আছে) হাতে ঠুক ঠুক করে ধীরে ধীরে হাঁটতেন। বড়জোর সত্তর বছর বয়েস তখন ঠাকুরমার কিন্তু মনে হতো যেন আদ্যিকালের বদ্যিবুড়ি। এরই মধ্যে স্কুলে ভর্তি হলাম - বছর পেরোতে লাগল একটার পরে একটা। অনেক ঘটনার মধ্যে টিবি নিয়ে এই ঘটনাটা অনেক দিন অবধি মনে এমন গেঁথে ছিলো । তখন বাড়িতে অ্যাক্টিভ ভাবে আক্রান্ত টিবি কারো নেই আমিও এক্কেবারে ছোটোটি নই ক্লাস থ্রি। ঠিক হয়েছিলো স্কুলের পরে আমাদেরই স্কুলের বোর্ডিংয়ে (ক্রেশ ঠিক নয়, ক্রেশ ছিলো না স্কুলে) কয়েক ঘন্টা করে থাকবো। তাতে স্কুল থেকে দুপুরে বাড়ি নিয়ে আসবার একটা ঝামেলা ছিলো সেটা এড়ানো যাবে। এসব কোনো ব্যতিক্রমী ব্যাপার নয়, আমার আগেও কয়েকজন বাচ্চাকে এভাবেই ডেইলি বেসিসে (ডে বোর্ডিং) রাখা হয়েছে। ডে বোর্ডিং হলেও দুপুরের খাওয়া দাওয়া ঘুমোনো চান সবই বোর্ডিং এর নিয়ম মতো। শুধু তফাৎ হচ্ছে যে বিকেলে বাড়ি ফিরে আসব রাত্রেও ঘুমোবো বাড়িতে। হালকা নীলরঙের চামড়ার সুটকেসে জিনিস ভর্তি করে সতরঞ্চি তোষক বালিশ চাদর প্যাক করে আমাকে বোর্ডিংয়ে দিয়ে এলো বাবা মা। সেটাই প্রথম দিন। আমার মনে কোনো দুঃখ নেই। জানিই তো বিকেল হলেই বাড়ি ফিরব। কিন্তু বিকেল পেরিয়ে সন্ধে হতে চলল ।ঢং ঢং করে ঘন্টা বাজতেই বোর্ডিয়ের নতুন বন্ধুরা খেলা শেষ করে দুড়দাড় টিফিন খেতে চলে গেল। আমি ঠায় অপেক্ষা করছি, কেন নিতে আসছে না মা - তারই মধ্যে আবার ঝমঝমিয়ে প্রচন্ড বৃষ্টি। বোর্ডিঙের হলদে বাল্বগুলো জ্বলে উঠে কেমন মনমরা দুঃখ দুঃখ আবহাওয়া। অন্ধকারে বেঞ্চিতে বসে তখন ভয়ে দুশ্চিন্তায় গলা ছেড়ে কাঁদতে চাই অথচ কেমন একটা লজ্জা দ্বিধা পেয়ে বসেছে যা বুঝিয়ে বলবার নয়।
    মা এলো আরেকটু পরে হনহনিয়ে। কাঁপছে। মাকে ওভাবে কাঁপতে দেখে আমার বুকধড়ফড়। কেউ কি মরে গেছে বাড়িতে হঠাৎ? বাবা? আর কেউ? গলা বুজে আসছে ভয়ে কিন্তু বাইরে থেকে আমার দিকে তাকিয়ে সেসব হয়ত আঁচ করা যেত না। মা আমার কাছে এসে আমার হাত টেনে ধরে প্রায় হিড়্হিড়্ করে টেনে নিয়ে গেল রাস্তায়। সেখানে তুমুল বৃষ্টি - জলও জমতে শুরু করেছে মধ্য - উত্তর কলকাতার রাস্তাগুলোয়। রেইনকোট পরা এক রিক্সাওয়ালা আমাদের নিয়ে চলল বাড়ি। ফিরবার পথেই শুনলাম মায়ের দেরি করে নিতে আসার কারণ।
    বোর্ডিঙে খবর পৌঁছে গেছে আমরা টিবিরুগিদের বাড়ির লোক। এসব জেনেশুনে এমন বাড়ির বাচ্চাকে ডে বোর্ডিঙে রাখতে পারবে না কর্তৃপক্ষ। তাদের অফিসেই মা একঘন্টা ধরে যুক্তি দিয়ে তর্ক করে যাচ্ছিলো।তবু যেই কে সেই -ওরা যুক্তি শুনেও ডিসিশান পাল্টায় নি। আমায় বোর্ডিং থেকে তাড়িয়ে দিলো বাবা টিবিরুগি ছিলো বলে। আমার তোষক বালিশ সুটকেস জিনিষপত্র পরে মা বাবা গিয়ে নিয়ে আসবে। আমরা বাড়ি ফিরলে এই নিয়ে অনেক আলোচনা হলো - কেন বাপের অসুখ থাকলে তার সন্তানকে বোর্ডিং থেকে তাড়াবে এই নিয়ে। এই করতে করতে রাত হয়ে গেল। রান্না হয় নি। অত রাতে আবার কে রান্না চড়াবে এই বর্ষার দিনে? বৃষ্টি কমে গেছে রাস্তার জলও নেমে গেছল তাই বাবার সঙ্গে ছাতা নিয়ে একটু হেঁটে বিমলা হিন্দু হোটেল থেকে মাছের ঝোল ভাত তরকারি কিনতে গেলাম। বোর্ডিং থেকে আমাকে তাড়ানোয় আমার কোনো দুঃখ লজ্জা কিছুই হয় নি কেবল মন আনন্দে ফুরফুর করছে - যাক বাবা কেউ মরে তো যায় নি, যা ভয় পেয়েছিলাম সন্ধেবেলায়!
    ভাত কিনে বাড়ি ফিরতে রাস্তার বাঁ হাতি একটা স্বাস্থ্য কেন্দ্রের পাশে নিরোধের বিজ্ঞাপন। তারপাশে বাবা মা ভাই বোন চারজনের ছবি ও হলদে ব্যাকগ্রাউন্ডে লেখা "ছোটো পরিবার, সুখী পরিবার"। আমার কি হোলো কে জানে হাসতে হাসতে জোরে জোরে বললাম - টিবি পরিবার সুখী পরিবার।
    শুনে বাবাও ফস্ করে হেসে ফেলেছিলো হঠাৎ। কিন্তু তারপরেই গম্ভীরমুখে বলেছিলো, ছিঃ অমন বলতে নেই।
  • aranya | 154.160.98.31 | ২১ আগস্ট ২০১৩ ০২:০৫619825
  • কষ্টের লেখা। ভাল লাগল, শেয়ার করছেন বলে।
    আরো লিখুন।
  • সে | 203.108.233.65 | ২১ আগস্ট ২০১৩ ১৫:৪৮619836
  • ধর্মসম্মেলন
    ধর্মসম্মেলন গোছের ব্যাপারগুলো যে অনেক জায়গাতেই এখনো হয়ে থাকে এইটা জানা ছিলো না ১৯৮৮র জুন জুলায়ের আগে। এই ব্যাপারগুলো কেমন হয় তা চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করবার কোনো তাগিদও কখনো অনুভব করিনি। সে যাইহোক স্থান কাল পাত্রপাত্রীদের নাম বদলিয়ে অভিজ্ঞতাটা লিখেই ফেলি।
    ১৯৮৮র জুন মাসে একটা শহরে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের ধর্মসম্মেলনের আয়োজন হয়েছিলো। এনিয়ে কোনো বিজ্ঞাপন চোখে পড়েনি খবরের কাগজগুলোতে বা রাস্তায় কোনো পোস্টার ও দেখা যায় নি। কিন্তু যাঁরা নিমন্ত্রিত ছিলেন এই সেমিনারমূলক অনুষ্ঠানে তাঁরা জমায়েত হচ্ছিলেন দেশ বিদেশ থেকে। ইন্টারনেট - মোবাইল ফোন বা পেজার তো দূরের কথা তখন কম্পিউটার ই মোটামুটিভাবে দুর্লভ বস্তু ছিলো সাধারন মানুষের কাছে। তা সত্ত্বেও সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে যে ধর্মসম্মেলন হচ্ছে। যে শহরে সম্মেলন হচ্ছিলো সেখানে গোটা দুই ইউনিভার্সিটি যাতে দেশি বিদেশী মিলিয়ে স্টুডেন্ট প্রচুর। বিদেশীদের মধ্যে কিছু বাংলাদেশি ছাত্র (এরা ধর্মভীরু নয় একেবারেই) জানতে কৌতুহলী হয়েছিলো যে এই সম্মেলনে তাদের দেশ থেকে কে বা কারা আসছেন অংশগ্রহণ করতে। জনা পাঁচেক স্টুডেন্ট পৌঁছে গেল শহরের অন্যপ্রান্তে নামকরা হোটেলে যেখানে সম্মেলনের প্রতিনিধিদের থাকবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অল্প খোঁজ করতেই নিজের দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। চারজন এসেছিলেন বাংলাদেশ থেকে। এঁদের প্রত্যেকেরই সাজ পোশাক ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে যেমনটি হবার তেমনটি। কথাবার্তা গম্ভীর, সংযত কিন্তু যথেষ্ট আলাপি। প্রথম পর্যায়ের আলাপ পরিচয় হয়ে গেল। ছাত্ররা উৎসাহে সাহসে ভর করে এঁদের একদিন নিমন্ত্রণ ও করে ফেললো নিজেদের ডেরায়। যদিও এঁদের প্রত্যেক দিনই অনেক সেমিনার মিটিং থাকে তবুও তারই ফাঁকে একটু সময়ও বের করে ফেললেন এই মোল্লারা। ঠিক হয়ে গেল যে দুদিন পরে দুপুরবেলা মাংস আর ভাতের নিমন্ত্রণ। এর বেশি ছেলেরা আর কীই বা আয়োজন করতে পারবে তাদের গরীবখানায়। সিম্পল কিন্তু আন্তরিকতায় পূর্ণ।
    শবনম বলে একটি ছাত্রীকে গিয়ে ধরল ছাত্রদল। তার রান্নার হাত এদের সবার মধ্যে মন্দের ভালো। যদিও এরা অনেকেই বিশেষ রান্নাবান্না করে না তবুও বড়ো বড়ো প্রেসার কুকার ভাতের হাঁড়ি এসমস্তই যোগাড় হয়ে গেল। চারজন মোল্লা ও আরো গোটা দশেক স্টুডেন্ট সব মিলিয়ে চোদ্দ পনেরজনের খাবার। শবনম তার আরেকজন বন্ধুকে রাজি করিয়ে এনেছে রান্নায় সাহায্য করতে। হালাল করা মোরগ চারটে ছাড়িয়ে পিস্ করছে ছেলের দল। হার্ড ড্রিংক্সের বোতল (সবই খালি), সিগারেট, অ্যাশ্ট্রে সব হাওয়া করে দেওয়া হয়েছে ঐ এলাকা থেকে। সাদা ভাত হবে না ঘিভাত হবে এই নিয়েও একচোট তর্কাতর্কি হয়ে গেল। যে ঘরটায় খাবার ব্যবস্থা সেখানে একটা ক্যাসেট প্লেয়ার ও স্পীকার। দেয়ালের পোস্টারে আলো করে রয়েছেন ব্রুক শীল্ড্স ও স্যামান্থা ফক্স । সেই পোস্টার সব খুলেও ফেলা যাচ্ছে না ছিঁড়ে গেলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। তখন খুঁজে পেতে ওয়াইল্ড লাইফ (বনের মধ্যে হরিণ),গাছের ডালে ম্যাকাও, এইসব পোস্টার (একই সাইজ) যোগাড় করে সেগুলো দিয়ে ব্রুক শীল্ড্স্ ও সামান্থা ফক্সকে ঢেকে দেওয়া হলো। ইংরেজি গানের ক্যাসেট সব সরিয়ে ফেলা হলো।
    এখন বেলা বাড়ছে অতিথিদের নিয়ে আসতে হবে। এঁরা রাস্তাঘাট একেবারেই চেনেন না। শবনম ও শবনমের বন্ধুর বয়ফ্রেন্ড দুজনেই এই অনুষ্ঠানে খুব লীডারগিরি করছিলো। ওরা দুজনে তখন প্রায় বেরিয়ে পড়ছে অতিথিদের আনতে যাবার জন্যে। হুট্ করে শবনম বললো ও ও যাবে। রান্না প্রায় শেষ হয়েই এসেছিলো সেটা অন্যদের দায়িত্বে দিয়ে শবনম ও অন্য দুজন বেরিয়ে পড়ল। হোটেলে পৌঁছে দেখা গেল অতিথিরা দরজার বাইরে অপেক্ষা করছেন। ওঁরা চারজন ও শবনমেরা তিনজন মিলিয়ে মোট সাতজন তাই দুটো ট্যাকসি লাগবে। দুটো ট্যাকসি ডেকে এনে দরজা খুলে দুজন অতিথি ঢুকবার পরে শবনম যেই ঢুকতে গেছে, অন্যপাশের (রং সাইডে) দরজা খুলে অতিথিদ্বয় বিনাবাক্যব্যয়ে বেরিয়ে গিয়ে রাস্তায় দাঁড়ালেন। ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটে গেল যে শবনম বুঝতেই পারেনি যে কি হোলো। বাকি চারজনে এদিকে অন্য ট্যাক্সিতে উঠে পড়েছে। তারা পিছন ফিরে দেখে এই অবস্থা। এদিকে শবনম ঐ দুই ভদ্রলোককে প্রশ্ন করছে- কি হোলো? কোনো অসুবিধে হচ্ছে? ট্যাক্সির সীট খারাপ?
    অতিথিরা মুখ খোলেন না, শবনমের দিকে তাকাতেও পারেন না। নিজেদের মধ্যে নীচুস্বরে কীসব যেন বললেন। এদিকে ঐ ছাত্রদুটি এগিয়ে এলো অসুবিধা জানতে। জানা গেল যে কোনো মোল্লাই মহিলার সঙ্গে এক গাড়িতে যাবেন না। এমনকি মহিলাটির সঙ্গে বাক্যালাপ ও করবেন না। তাহলে উপায়? তখন শবনম ও দুই বন্ধু চলল সামনের ট্যাক্সিতে ও অতিথিরা চারজনে পেছনের ট্যাক্সিতে ওদের ফলো করতে করতে।
    শবনম খুবই অপমানিত ফীল করেছিলো, ওদের সঙ্গে যেতেও চায় নি একাই আলাদা ফিরতে চেয়েছিলো। কিন্তু বন্ধুরা ওকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে গেল।
    এবার পৌঁছবার পরে অতিথি আপ্যায়ন ও ভোজ। অতিথিরা আরো কিছু কথা গুজগুজ করে শবনমের বন্ধুদের বলেছিলো সম্ভবত তাদের আপত্তি আছে মহিলারা থাকলে এবং মহিলাদের সঙ্গে একত্রে খাবার খেতে বসায়। ডেরায় ফিরে তাই শবনম ও তার বান্ধবীকে প্রায় জোর করেই একটা ঘরে বন্ধ করে দেয় ছেলেগুলো এবং দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দেয়। মেয়েরা কিন্তু এতে দমে নি। তিনতলার জানলা দিয়ে অনেক কসরৎ করে বেরিয়ে পাইপ টাইপ বেয়ে হাত কনুয়ের ছাল ছড়ে যাওয়া সত্ত্বেও নীচে পৌঁছয় নিরাপদে এবং চুপচাপ পৌঁছে যায় রান্নাঘরে। সেখানে তখন কেউ ছিলো না সকলেই অতিথিদের সঙ্গে আলাপ করতে মশগুল। ওরা তখন শুকনোলঙ্কার পাউডারের প্যাকেট পুরো খালি করে দেয় তৈরী রান্নার পাত্রে এবং ভালো করে মিশিয়ে দিয়ে চুপচাপ সেখান থেকে চলে যায়।
    এর অব্যবধিকাল পরে দুই বান্ধবীই তাদের ফঙ্গবেনে বয়ফ্রেন্ডদের ত্যাগ করে।
  • cb | 209.67.203.141 | ২১ আগস্ট ২০১৩ ১৬:৪০619847
  • লাস্ট প্যারাটা বাদ দিলে গল্পটা আগে শুনেছি। রাশিয়ায় বোধহয় ঘটনাটা।
  • de | 190.149.51.67 | ২১ আগস্ট ২০১৩ ১৭:৩২619858
  • দুটো দু'রকমের লেখা।
    দুটোই ভালো লাগলো -- আপনি ভালো লেখেন!

    আমার ঠাকুরদাদা টিবিরোগী ছিলেন -- বেঁচে থাকতে বড় কষ্ট পেয়েছিলেন আত্মীয়দের ব্যবহারে!
  • siki | 127.213.246.167 | ২১ আগস্ট ২০১৩ ২২:০৭619869
  • পাঠপ্রতিক্রিয়া জানাতে একটু দেরি হল।

    পড়লাম। প্রথম ঘটনার খুব কাছাকাছি দিয়ে তো আমি নিজে গেছি, অনুভব করতে পারছি।
  • pi | 118.22.237.164 | ২১ আগস্ট ২০১৩ ২২:২৪619880
  • সে দা, আরো লিখুন ।
  • nina | 78.34.162.175 | ২২ আগস্ট ২০১৩ ০৬:০১619891
  • খুব ভাল লগ দুটো লেখাই।
  • | 24.97.11.82 | ২২ আগস্ট ২০১৩ ২০:৪৪619902
  • প্রথমটা পড়ে খারাপ লাগল। বেশ খারাপ।

    দ্বিতীয়টা আমিও শেষ প্যারা বাদ দিয়ে পড়েছি অন্য বাংলা ফোরামে, অনেক আগে। তবে শেষ প্যারা পড়ে মনে বেশ ফুত্তি হল।
  • সে | 203.108.233.65 | ২৩ আগস্ট ২০১৩ ১৫:৩৭619815
  • কর্পোরেশন ষ্ট্রীট
    কর্পোরেশন ষ্ট্রীট ও ওয়েলেসলি ষ্ট্রীটের মোড়ের মাথাতেই রাস্তার দক্ষিণ দিকের যে উঁচু বাড়িটা, সম্প্রতি তারই দোতলায় গোটা পাঁচেক ঘর ভাড়া নিয়ে বসবাস শুরু করল এক পরিবার।
    নতুন পরিবারটা জিনিসপত্র খুবই কম এনেছিলো সঙ্গে করে- সাকুল্যে তিনটে বেতের ঝাঁপি। বাসনকোসনও সামান্য। মোট দুটো ঘোড়ার গাড়ীতে করে বলতে গেলে প্রায় নিঃশব্দেই এসে উপস্থিত হয়েছিলো হেমন্তের এক দুপুরবেলায়।বাড়ির কর্তাব্যক্তি বলতে রুক্ষ চেহারার এক মাঝবয়সী অবাঙালী পুরুষমানুষ, সঙ্গে ফিরিঙ্গি চেহারার শান্তশিষ্ট মেয়েমানুষ যার গায়ে একটিও গয়না নেই পরণের শাড়িও অত্যন্ত সাধারন মানের। আঁচ করা যাচ্ছিলো যে ইনিই এ পরিবারের গিন্নি এবং পেছন পেছন একপাল ছেলেপুলের দল। ছেলেমেয়েদের বয়্সে উনিশ কুড়ি থেকে শুরু করে একেবারে ছোটোটা নদশ বছরের মতো। আশ্চর্যের কথা হচ্ছে আসবাব এরা এক টুকরোও বয়ে আনে নি।
    এ এলাকায় বাঙালী অবাঙালি ফিরিঙ্গি সাহেব মিলিয়ে পাড়াপাড়া ভাবটা কম ও সামনের রাস্তা দিয়ে সর্বক্ষণই গাড়ি ঘোড়া লোকজন মুটে ফেরিওয়ালাদের যাতায়াত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কিছুকাল শুরু হলেও কলকাতা সে ব্যাপারে মোটামুটি নির্লিপ্তই ছিলো, যদিও জাপানি বোমা পড়তে পারে কিনা এই আশঙ্কায় ক্রমশঃ হাওয়া গরম হচ্ছিলো । গায়ে পড়ে আলাপ করতে আসা বা পরোপকারী কোনরকম প্রতিবেশীরই মুখোমুখি হতে হলো না প্রথম দিকটায়। দোতলার যে পাঁচটি ঘর নিয়ে এরা থাকতে শুরু করে দিলো তাতে রান্নাঘর বলে কিছু নেই। উত্তরে কর্পোরেশন ষ্ট্রীটের দিকটায় বারান্দা - তাতেই এক কোণে কাপড় টাঙিয়ে পর্দা মতন করে তোলা উনুনে কয়লার আঁচে রান্না করে ফিরিঙ্গি গিন্নি। বড়ো মেয়ে বেঁটে ও কালো, বাপের মতো থ্যাবড়ানো মুখ, সুশ্রী বলা চলে না কোনো দিক দিয়েই - সে ই ঘরের কাজে সাহায্য করে বরাবর। সকলের কাপড় কাচে, ঘর মোছে, ছোটো ছোটো ভাই বোনেদের সামলে রাখে। তার নাম এমিলি।
    বারান্দার মাঝামাঝি কাঠের পার্টিশান। পার্টিশানের ওপারে ঐ দোতলাতেই আরো এক ভাড়াটে পরিবারের বসবাস। এরা যখন প্রথম আসে তখন ওপাশের ভাড়াটেরা বাইরে কোথাও গিয়েছিলো। সপ্তাখানেক পরে তারা ফিরে আসতে কাঠের পার্টিশানের পাশ দিয়ে গলা বাড়িয়ে সে বাড়ীর বাঙালী গিন্নির সঙ্গে এবাড়ীর গিন্নির আলাপ হলো সামান্যই। কেউই কারো কথা বোঝে না। সমস্যা ভাষার। এই গিন্নি অ্যাংলোবার্মিজ। প্রায় এক মাস ধরে অনেক কষ্ট সহ্য করে কখনো স্টীমারে কখনো গাড়ি করে কখনো বা পায়ে হেঁটে সেই রেঙ্গুন থেকে এসেছে এরা প্রাণে বেঁচে থাকতে এই কলকাতা শহরে। এখানে এসে প্রথমে উঠেছিলো এক অল্প পরিচিত গোয়ানীজ ভদ্রলোকের বাড়ীতে। তাঁরই চেনাশোনায় এই বাড়ী ভাড়া পাওয়া গেছে।
    রেঙ্গুন থেকে কলকাতা- এই দীর্ঘ পথযাত্রায় খুব কষ্ট পেয়েছে ছোটো দুটো ছেলেমেয়ে, তারা আট ও নবছরের।আরেকজন মনের মধ্যে দুঃখ চেপে রেখে চুপচাপ বারান্দার কোণে বসে হাতুড়ি দিয়ে যখন কয়লা ভাঙে তখন বারবার করে ছোটো মেয়েটার কথা মনে পড়ে যায় - যাত্রাপথের গোড়ার দিকেই কয়েকদিনের জ্বরে বাচ্চা মেয়েটা মারা গেল কিনা। কিন্তু সেসব ভাবতে বসলে সংসার চলবে কেমন করে? গিন্নি সিনথিয়া উনুনে আঁচ দেয়। কয়লার ধোঁয়ায় চোখ জ্বালা করে। গৃহকর্তা ব্যালবিনো আথাইডকে আজ পোর্টে যেতে হবে মাল নিয়ে আসতে- খবর এসেছে যে রেঙ্গুন থেকে পাঠানো বাক্স এসে পৌঁছে গেছে কলকাতা। এখন শুধু উদ্বেগ যে বাক্সের মধ্যের ঠুনকো জিনিসটা অক্ষত রয়েছে কিনা। এ পরিবারের একমাত্র উপার্জনের সামগ্রী - একটা গ্র্যান্ড পিয়ানো। পিয়ানোর মাস্টারি করেই ব্যালবিনো সংসার চালিয়ে এসেছে এ যাবদকাল।
  • kiki | 69.93.197.88 | ২৪ আগস্ট ২০১৩ ১৬:০৭619816
  • তারপর , তারপর?
  • সে | 203.108.233.65 | ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৩ ১৪:২৫619817
  • ওপরের গল্পটা পরে কন্টিনিউ করা যাবে।

    এখন অন্য একটা ঘটনা বলতে ইচ্ছে করছে।

    ছোটোবেলায় আমরা যে পাড়াটায় থাকতাম সেখানে বাস করত একটি ব্রাহ্ম পরিবার। কতজন ফ্যামিলি মেম্বার ছিলো সেখানে জানতাম না। শুধু ওবাড়ির একটি ছোটো ছেলে ছিলো প্রায় আমার সমবয়সী। পরে একই বছরে আমরা মাধ্যমিক পরীক্ষা দিই। কিন্তু সেতো অনেক পরের কথা।
    তখন আমার বয়স বড়োজোর পাঁচ বা ছয় হবে এক শনিবারের সন্ধ্যেয় ওদের বাড়ীর সামনেটায় বিরাট ভীড়। ভীড় কিন্তু শান্ত - কোনো চেঁচামেচি হৈচৈ নেই। বাবাও ওদিকে গেল। আমরা বাড়ীর বাচ্চারা ও মেয়েরা বারান্দায় উপুড় হয়ে বা জানলা দিয়ে ঝুঁকে ঝুঁকে দেখে বুঝতে চেষ্টা করছিলাম ভীড়ের কারন। কিছুক্ষণ পরে বাবা ফিরে এসে জানালো ঐ বাড়ীর একটি ইয়াং ছেলে কিছুক্ষণ আগে অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। ঐ ছোটো ছেলেটির কাকা। বাইকে চালিয়ে যাচ্ছিলো, বাসের সঙ্গে ধাক্কা লাগে এবং সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়। এর আগেও পাড়ার কোনো বাড়ীতে কোনো মানুষের মৃত্যু হলে চেঁচিয়ে কান্নার আওয়াজ পেয়েছি কিন্তু এরা চেঁচিয়ে কাঁদে নি। খুব শান্তভাবে দুঃখের প্রকাশ করেছিলো। এর পরে মা ও অন্যান্য মেয়েরা ঐ বাড়ীতে গেল ওদের পাশে - শোকের সময় যেমন যায় প্রতিবেশীরা।
    এর পরের কদিনে জানা গেল যে ছেলেটি একা ছিলো না বাইকে, ওর পেছনে একটি মেয়েও ছিলো। মেয়েটির বিশেষ চোট লাগে নি গায়ে। সে ই নাকি ঐ অ্যাক্সিডেন্টের পরে ছেলেটির সঙ্গে হসপিটাল অবধি গেছল যেখানে ছেলেটিকে মৃত ঘোষনা করা হয়। এর পরে কেন জানিনা ঐ "মেয়েটিকে" নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গেছল পাড়ায়। আরো জানা গেল যে মেয়েটি ঐ মৃত ছেলেটির বান্ধবী, ওদের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছল, ওদের বাড়ীতে নাকি বিয়ের আগেই মেলামেশা করায় কোনো বাধা নেই। সেদিন ওরা দুজনে মিলে নিজেদের বিয়ের জন্যেই কেনাকাটা করতে বেরিয়েছিলো।
    মেয়েটিকে এর পরে ছেলেটির বাড়ীতে দেখা গেছল একদিন। ছেলেটির "কাজ" এর দিন। সেটাও কোনো এক রবিবার।
    তার দু এক দিন পরেই আবার খবর পেলাম এবার মেয়েটিও মারা গেছে। ঠিক অ্যাক্সিডেন্টে নয় - সুইসাইড করেছে।
    সবাই খুব আহা উহু করতে লাগল এমন ভাবে দু দুটো তাজা প্রাণ পর পর অ্যাক্সিডেন্টে ও সুইসাইডে মারা যাওয়ায়।
    ছেলেটি নাহয় বাসে চাপা পড়েছিলো কিন্তু মেয়েটা কেন এমন ভুল করতে গেল? হবু বর মরে গেলেই কি জীবন এভাবে শেষ করে দিতে হয়? না না, এ খুব অন্যায়। সবাই খুব আফশোস করেছিলো তখন - আহারে ওরা দুজনকে কি ভালোই না বাসত , তবু এভাবে আত্মহত্যা করা খুব খারাপ। বেঁচে তো থাকতে পারত। আরো কতো কীই তো করবার আছে জীবনে। এত অপচয় মেয়ে নেওয়া যায় না।
    এর কদিন পরে আরেকটা খবর এসেছিলো। সেই খবরের পরে মেয়েটির মৃত্যু নিয়ে কেউ আর আহাউহু করে নি। কেউ না। গোটা পাড়ায় সবাই কেমন চুপ হয়ে গেছল। তখন ইংরিজি খুব কম জানতাম কত কথার মানেও বুঝতাম না। শী ওঅজ ক্যারিইং। শুধু এই বাক্যটিই সবাইকে চুপ করিয়ে দিলো। কী এমন জিনিস শী মানে ঐ মেয়েটি বইছিলো আত্মহত্যার আগে বুঝতে অনেক সময় অনেক বছর লেগেছিলো। কিন্তু এই একটি বাক্যই তখনকার মতো বুঝিয়ে দিয়েছিলো যে আত্মহত্যা জাস্টিফায়েড।
  • sp | 105.172.68.149 | ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৩ ১৫:৪৭619818
  • লেখাগুলো বেশ ভালো লাগলো। দ্বিতীয় গল্পটা Date:21 Aug 2013 -- 03:48 PM অনেক আগে গুরুতেই পড়েছি মনে হয় তবে সেটা অনেক সংক্ষিপ্ত ছিল এবং cb যেমন বললেন গল্পের পটভূমি রাশিয়াই ছিল। আপনি আরো লিখুন।
  • সে | 203.108.233.65 | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৩ ১৫:০৮619819
  • এই লেখাটা একটু আগে ভাটিয়ালিতে লিখেছি, কিন্তু যাতে হারিয়ে না যায় তাই এখানেও থাকুক।

    আজ শনিবারের বাজার হাত প্রায় ফাঁকাই বলা চলে। একটা ঘটনার আই উইটনেস ছিলাম সেটা এখন লিখব। কিন্তু তার আগে সতর্কীকরণ - এই লেখাটা পড়ে গা গুলোতে পারে, বা অন্য কোনো অস্বস্তি অসুবিধা, ইঃ। কাজেই অসুবিধা থাকলে না পড়তেই অনুরোধ করছি। খুব গ্রাফিক কিন্তু।

    এটা "ধর্ষণের ঘটনা" নাকি "প্রায় ধর্ষণের ঘটনা" এই নিয়ে মতপার্থক্য থাকতে পারে। কিন্তু এটা স্বচক্ষে দেখা কান্ড। গুছিয়ে লিখবার চেষ্টা করছি।
    তখন বাম জমানার শাসন তুঙ্গে। পাড়ায় পাড়ায় লাল পতাকা। এমনকি পার্টি অফিসটাই ছিলো ল্যান্ডমার্ক। এমনি শহরতলীর* একটা পাড়া দিয়ে সন্ধের মুখে যাচ্ছিলাম। তো দেখি হাল্কা আকারের ভিড়। ভিড়্টা দেখেই স্বভাবত কৌতুহল হল। কিসের ঝামেলা হচ্ছে সেটা মুখ বাড়িয়ে দেখে নিতে গিয়ে দেখি একটা নিম্ন মধ্যবিত্তটাইপ বাড়ির মুখে কান্ডটা ঘটছে। সবাই উঁকি ঝুঁকি মারছে। দরজার সামনেই সিঁড়ি এবং মূল গন্ডগোলটা ঐ সিঁড়িতেই। তো ঠেলেঠুলে আরেকটু ভেতরে গেলাম। মারাত্মক কিছু চেঁচামেচি তেমন হচ্ছিলো না কিন্তু সিঁড়িতে বেজায় অন্ধকার। তখনো বিকেলের আলো অল্প ছিলো, কিন্তু অন্ধকার অন্য কারণে, সিঁড়িতে প্রচুর মহিলা ও লোক ভিড় করে ঝুঁকে রয়েছে। একটা অল্পবয়সী মহিলাকে চুলের মুঠি ধরে চড় মারছে একটা লোক। তাতে দেখলাম বাকি জনতার (যারা সিঁড়ির ওপরের ধাপে, সেখানে আবার প্রচুর মহিলারাও বর্তমান) বেশ সায় আছে। মহিলা দেখলাম ছাড়াবার চেষ্টা করছে কিন্তু চুলের মুঠি লোকটার হাতে। মহিলা চেঁচাচ্ছে। লোকটাও মারতে মারতে মহিলাকে তুই তোকারি করে গালি তো দিচ্ছেই আবার এও বলছে দেখবি? আমার **** দেখবি? দেখাবো? তোকে এখন রেপ করব, ইঃ
    প্রথমটায় আমি ভেবেছিলাম যে এটা পারিবারিক ঝগড়া। মহিলা ঐ লোকটার বৌ। পাশের একজনকে জিগ্যেস করলাম কেসটা কি? ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স? বৌকে পেটাচ্ছে? - না না বৌ ফৌ নয়। ও তাহলে চুরি ফুরির কেস? চোর ধরা পড়েছে? তাহলে পুলিশে দিন এভাবে মারবার কি দরকার? তো লোকটা এবং পাশের একজন বলল, না চুরি ফুরিও নয়। মেয়েটা ঐ বাড়িতেই কোনো একটা ভাড়াটের আত্মীয়, এবং যে পেটাচ্ছে সে ও আশেপাশের ফ্ল্যাটে ভাড়াটে। শুধু তাই নয় পেটানোর দায়িত্বে যে লোকটা সে এই এলাকার কাউন্সিলার।
    কাউন্সিলার বলেই যে সে মহিলাটিকে পেটাবে এবং, সর্বসমক্ষে রেপ করতে চাইবে এটা আমার মাথায় ঠিক রেজিস্টার করছিলো না।
    এদিকে সেই কাউন্সিলার তখন মেয়েটাকে শুইয়ে উল্টে ফেলেছে। সিঁড়ির ওপরের দিকের ধাপে মেয়েটার পা এবং মাথা (মাথাটায় চুলের মুঠি কাউন্সিলারের হাতে) চারপাঁচ ধাপ নীচে। ফলে সে চিৎ অবস্থায় এবং তাকে হিড় হিড় করে নামিয়ে আনছে কাউন্সিলার (চেহারা দেখে ভিড়ের মধ্যে মনে হলো বয়স আন্দাজ এই ধরুন তিরিশ বত্রিশ বছর, দোহারা চেহারা মাথার সামনে অল্প টাক, নামটাও জেনে নিয়েছিলাম - এখনও মনে আছে নাম ও পদবী)।
    এবার কাউন্সিলার মেয়েটাকে মারবার নতুন পদ্ধতি নিলো। বুকে খামচাতে লাগল। যেটা আগে লিখিনি সেটা হচ্ছে যে মেয়েটা পরেছিলো সালোয়ার কামিজ। কোনো চাদর ছিলো না। মাথা নীচে পা ওপরে হওয়ায়, সালোয়ারটা বেশ অনেকটাই গুটিয়ে গিয়ে পা প্রায় হাঁটু অবধি দেখা যাচ্ছে এবং কামিজ ও উল্টে গিয়ে পেট দেখা যাচ্ছে। মেয়েটা যেই বুকে হাত চেপে রাখবার চেষ্টা করছে কাউন্সিলার অমনি চুলের মুঠিতে হ্যাঁচকা টান মারছে। টান খেলেই মেয়েটার হাতদুটো মাথায় চলে যাচ্ছে তখন কাউন্সিলার বুকে খামচাচ্ছে। আবার কোমরের বেল্ট খুলে ফেলল।
    এই ঘটনায় মেয়েটির পক্ষে একজনকেও দেখলাম না। সবচেয়ে আশ্চর্য লেগেছিলো যেটা সেটা হচ্ছে ঐ বাকি মহিলারা যারা ভিড় করে দেখছিলো তাদের দিকে দেখে। তারা কাউন্সিলারকে বলছে আরো মারুন, উচিৎ শিক্ষা দিন, ওকে রেপ করাই উচিৎ, ইঃ। বাকিরা দর্শক। এবার আরো গ্রাফিক। কাউন্সিলার এবার চুলের মুঠি ছেড়ে মেয়েটার কামিজ ছিঁড়ে দিলো। তখন কে যেন বলল, হয় কাউন্সিলার নয়ত অন্য কেউ, ব্যাস এবার আর পালাতে পারবে না।
    কাউন্সিলার নিজের প্যান্টের বোতাম/চেন খুলতে শুরু করেছে আর কি ভিড় কি ভিড় কি বলব। সবার সামনে জনসমর্থনে লোকটা রেপ করতে প্রস্তুত। আমি আর থাকতে না পেরে পাশের একজনকে বললাম এসব কি হচ্ছে? তো লোকটা বলল, মেয়েটার শিক্ষা হওয়া দরকার, বুঝলেন? প্রচন্ড বদমাইস মেয়ে। এটা ভদ্র পাড়া - ওর স্বভাব চরিত্র ঠিক নয়। ওকে পাড়া থেকে তাড়াতেই হবে।
    আমি পেছনের বিপুল ভিড় ঠেলে বেরিয়ে আসলাম। তার একটু পরেই দেখি মেয়েটাও প্রায় দৌড়েই (জানিনা কিভাবে ম্যানেজ করেছিলো) পালিয়ে যাচ্ছে। কাউন্সিলারকে কিন্তু আর দেখলাম না। তখন রাস্তার আলোয় দেখলাম, মেয়েটার কাপড়চোপড় বিদ্ধস্ত কিন্তু সেই অবস্থাতেই সে জোরে জোরে হেঁটে কোথায় যেন চলে গেল।
    আরেকটু হেঁটে দেখলাম পুলিশ স্টেশন, মেয়েটা উল্টোদিকে গিয়েছিলো থানার দিকে যায় নি। অবশ্য থানায় গেলেও ওর কি হাল হতো আমি জানি না। কারন কেস লেখাতে গেলে তো বোধহয় সাক্ষী ফাক্ষি তো লাগে। কে দিতো সাক্ষী?
    আমি আজও জানি না যে এটা রেপ কি রেপ নয়। আরো অদ্ভুত এতোগুলো লোক এবং মহিলারা কিকরে এটাকে সমর্থন করছিলো।

    রেপ যে শিক্ষা দেবার অন্যতম পদ্ধতি সেই জ্ঞানলাভ তখনই হয়ে গেল।
    এই ঘটনাটা এক দিল্লীবাসী লেখক/সাংবাদিক বন্ধুকে গল্প করেছিলাম। তার লেখার হাত খুব ভালো এবং সে এটা নিয়ে লিখতেও চেয়েছিলো ফিকশান। কিন্তু সম্ভবত লেখেনি। তখন দিল্লীর গ্যাং রেপ নিয়ে হাওয়া গরম ছিলো সে প্রসঙ্গেই এই ঘটনাটা মনে পড়ে গেছল।
    তো সে যখন লেখেনি আমিই লিখে ফেললাম। (সাহিত্যগুণ না থাকলেও ঘটনাটা রেজিস্টার্ড থাকুক কোনও একটা কোণে)।

    *শহরতলীর সেই পাড়াটির নাম লিখলাম না। সেই পাড়ার কেউ এই লেখা পড়লে তার সেন্টিমেন্টে আঘাত লাগুক এটা চাই না।
  • সে | 203.108.233.65 | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৩ ২২:১৯619820
  • ফলোআপ

    এই ঘটনাটা ঘটে যাবার পরে যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মথরে কৌতুহল নিয়ে আমি উল্টো পথে হেঁটে মেয়েটা (ভিক্টিম) যেদিকে গেছল সেইদিকে হাঁটা দিই। বাড়িটার সামনে থেকে ভিড় ফির পাতলা হয়ে গেল। খানিকটা হেঁটে গিয়ে দেখলাম ফুটপাথের ওপরে রাস্তার সাইডে বসে আছে। পা দুটো রাস্তায়। জামাকাপড় ছেঁড়া- ব্রেসিয়ার অনেকটাই দেখা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা জানা না থাকলে চোখ বুজে বলে দিতাম কোনো রাস্তার পাগলি। আমার যেটা জানতে ইচ্ছে করছিলো সেটা হচ্ছে যে ও এখন কী করবে বা কোথায় যাবে? একটু তফাতে দাঁড়িয়ে ওয়াচ্‌ করলাম মেয়েটা একটা ভিখিরি মহিলার সঙ্গে কথা বলছে। ওদের পাশ দিয়ে লোকেরা হেঁটে যাচ্ছে কারো ভ্রূক্ষেপ টুক্ষেপ নেই। তার ওপরে বাস গাড়ি সাইকেল রিক্সা এসবের আওয়াজ। যা বুঝতে পারলাম মেয়েটার কানের একটা দুল হারিয়েছে ঐ ধস্তাধস্তি মারধোরের সময় - ভিখিরি মহিলা সেটাই ওকে পয়েন্ট আউট করে দিচ্ছে। কিন্তু মেয়েটা সম্ভবত আরো কিছু হারিয়েছে যেটার জন্যে ওর উদ্বেগ বেশি। যেটা দুলের চেয়েও বেশি দামি। এভাবে তো বেশিক্ষণ ওয়াচ করা যায় না তবে ওখান থেকে চলে যাবার আগে ওদের কথাবার্তা ভাসা ভাসা যা কানে এসেছিলো সেটা হচ্ছে যে মেয়েটার একটা বাচ্চা আছে যাকে ওখানে ফেলে আসতে হয়েছে। মেয়েটা ঐদিকে যেতে চাইছে এবং ভিখিরি বলছে - এখন গেলে কি আর দেবে? আবার মারবে। ওদিকে যেও না।
    কিন্তু এই ফলো আপের সঙ্গে রেপ (প্রায় রেপ) এর সম্পর্ক কোথায়? এটা তো প্রসঙ্গান্তরে চলে যাচ্ছি। কিন্তু এটাও বুঝতে হবে যে ঘটনা ও ফলোআপ "রেপ বা প্রায় রেপ" নিয়ে কোনো মৌলিক প্রবন্ধ নয়।
    সেদিনের মতো ঘটনার সেখানেই ইতি। আমার কেবল চিন্তা হতে থাকে ও এখন কোথায় যাবে? রাত হয়ে গেছে। কোথায় থাকবে রাত্রে? রাস্তা কি নিরাপদ রাত্রিবাসের জন্যে? যে বাচ্চাটাকে ফেলে এসেছে তারই বা কী হবে? এতো গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জনের মতো (অতিরঞ্জিত হচ্ছে হয়ত)। যেটা বুঝতে পেরেছিলাম সেটা হচ্ছে যে রেপ (প্রায় রেপ) নিয়ে মেয়েটা তেমন কন্‌সার্ন্‌ড নয়, বেশি কন্‌সার্ন্‌ড যা ফেলে এসেছে সেটা ফেরৎ পেতে। সেই কারণেই ঐ বিপদের মুখে আবারো যেতে প্রস্তুত। আরো চিন্তা হয় যে ওর কাছে তো টাকা পয়সা কিছুই নেই ছেঁড়া কাপড়জামা দিয়ে আরো লোকজনকে প্রোভোক না করে ফ্যালে। রক্তাক্ত ক্ষতগুলোয় রাস্তা ফুটপাথের ধুলোয় ইন্‌ফেক্শান না হয়ে যায়। একটা টেট্‌ভ্যাক কি নেওয়া উচিৎ নয়? খালি পা। রাস্তায় কতোরকম ভাঙা টিন কাচ নোংরা জার্ম।
    তবু আমি দাঁড়াইনি আর। কিন্তু কৌতুহল ছিলো। তাই আবারো মাসছয়েক পরে ঐ পাড়ায় যাই ঘটনা চক্রে এবং কাউন্সিলারের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়।
  • সে | 203.108.233.65 | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৩ ২৩:২০619821
  • মাসছয়েক নয়, মাস আষ্টেক পরে।
    ঐ এলাকাটা তখন দ্রুত প্রোমোটারদের হাতে চলে যাচ্ছে। শেষ মেয়েটিকে ফুটপাথের যেখানে বসে থাকতে দেখেছি তার থেকে একশো গজ মত দূরে একটা চালাঘর/বস্তি তখন ভাঙা হয়ে গেছে, তৈরী হচ্ছে বহুতল। গ্রাউন্ড ফ্লোরটা পার্কিং স্পেস। বহুতলটা আন্ডার কন্‌স্ট্রাক্‌শান তাই গ্রাউন্ড ফ্লোরে প্রচুর সিমেন্টের বস্তা, বালির বাস্তা। সেখানেই জোরালো ডুম জ্বালিয়ে চলছে ব্যায়াম/জিম্‌ন্যাস্টিকের ক্লাস। ছোটো ছোটো বাচ্চারা আসন করছে, পিরামিড তৈরী করছে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে কিছু লোক দেখছে। আমিও দাঁড়িয়ে যাই। ফলোআপের ইচ্ছে ছিলো না তবুও ঘটনাচক্রে ফলোআপ হয়ে গেল। ঐ অস্থায়ী ব্যায়ামাগারের এক পাশে চৌকি পাতা যেখানে যুবতী মায়েরা বাচ্চাদের ব্যায়াম দেখছে ও গল্প করছে। বাবারা বাইরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে চা ও গুলতানি। ক্লাস শেষ হলেই প্রত্যেকে নিজ নিজ বাচ্চা নিয়ে ফিরে যাবে। আমারো চা তেষ্টা পায় এবং পাশেই চায়ের দোকানে চা নিতে গিয়ে তার কয়েক গজ দূরে একটা দর্জির দোকানের সামনে কাউন্সিলারকে দেখে চিনতে একটুও অসুবিধা হয় না। সে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দোকানের ভেতরে এক মহিলার সঙ্গে কথা বলছে - ঠিক খদ্দের মনে হয় না। আমি চায়ের দোকানদারের সঙ্গে খুচরো আলাপ করে জানতে পারি কাউন্সিলার সম্প্রতি বিয়ে করেছে। ওর বৌ ঐ দোকানের মালিক কিংবা কাজ করে (ঠিক কনফার্ম করতে পারছি না)। একটু কায়দা করে তার হাতে চকচকে সোনার আংটি (টিপিক্যাল বিয়ের আংটি) দেখতে পাই। কিরকম নির্লজ্জ মতন লাগে পুরো পরিবেশটা।
    আটমাস আগে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা নিয়ে কারো কোনো হেলদোল নেই। যেন কিছুই ঘটে নি। তারপরে ছিলো আরো বেশি নাটকীয় আশ্চর্য হবার পালা। চা খেয়ে ফিরবার মুখটায় দেখি ব্যায়ামের ক্লাস ভেঙে গেছে সেই মেয়েটা। হ্যাঁ সেই মেয়েটা একটা পুঁচকে ছেলেকে নিয়ে ব্যায়ামের ক্লাস থেকে বেরিয়ে আসছে। মাত্র কয়েকমাস আগের ঘটে যাওয়া ঘটনার কোনো চিহ্ন কোনো রেশ নেই অভিব্যক্তিতে। মেয়েটা বাচ্চাটাকে নিয়ে চায়ের দোকানের পাশেই পানের দোকানে দাঁড়ালো তখনই আমি দোকানের আলোয় ওর মুখটা ভালো করে দেখে নিলাম। ভুল দেখছি নাতো? না কোনো ভুল নেই। একটা বাবলগাম বা টফি কিনে ছেলেটার হাতে ধরিয়ে দিলো। তারপরে গট্‌গট্‌ করে সেই বাড়িটার দিকে যেখানে ভয়ঙ্কর ঘটনাটা ঘটেছিলো সেদিকে চলে গেল দুজনে। আমি এমন অবাক হয়ে গেছলাম যে মুখ পুরো হাঁ। দোকানদার আমাকে বলছে- কী দেখছেন? নষ্ট মেয়েছেলে। লাজ লজ্জা বলে কিছু নেই।
    আমিও একটু কৌতুহলের ভাণ করি - কেন? এরম বলছেন কেন?
    - ওর ওপরে যা হয়েছে সেসব আপনাকে বলতে পারবো না। তার পরেও এ পাড়ায় থাকে কি করে বুঝি না। যার লজ্জা নেই তার কিছু নেই। বুঝলেন তো। বেহায়া।

    রেপ সংক্রান্ত ফলো আপ এইখানেই সমাপ্ত।
  • সে | 203.108.233.65 | ১৩ নভেম্বর ২০১৩ ১৩:৩৯619822
  • তুলে রাখলাম। পরে লিখব।
  • কুমড়োপটাশ | 198.155.168.109 | ১৩ আগস্ট ২০১৬ ২৩:২১619823
  • রাতব্যাপী প্রোজেক্ট
    --------------------
    চাকরিজীবনের একটা সময়ে খুচরো প্রোজেক্টের কাজের জন্য ডাক পড়ত আমার। অধিকাংশ সময়েই কাজগুলো থাকত অফিস টাইমের বাইরে, হয় শনিরোববার, নয়ত রাতের দিকে। এরকম সব কাজের মধ্যে বেশ কয়েকটা করতে হয়েছিল কোলকাতার পার্কস্ট্রীট চৌরঙ্গী এলাকায়। ওসব এলাকায় গিজগিজ করছে অসংখ্য কোম্পানীর হেড অফিস কি মেঝ অফিস। সবসময় লম্বা সাইজের প্রোজেক্ট মেলেনা, এবং বড়োবড়ো কাজগুলো কেমন করে যেন আমার সুযোগ হয়না পাবার। আমার লাইনে যারা সব ছিল তারা সকলেই আমার সিনিয়র এবং তারা বছরের অধিকাংশ সময়েই নামকরা কোম্পানীর বিগবাজেটের লম্বা প্রোজেক্টের কাজে ব্যস্ত থাকত। সেসব প্রোজেক্ট কোনো কোনোটা বিদেশে, যেগুলো বিদেশে নয় সেগুলোও কোলকাতা থেকে দূরে দূরে। কোলকাতার মধ্যেও যে বিগবাজেটের প্রোজেক্ট থাকত না তেমন নয়, কিন্তু সেসব জায়গায় ঢুকবার জন্য নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করার একটা ব্যাপার থাকে, তদ্বির করতে হয় প্রপার চ্যানেলে। সে যাই হোক, একদিন বিকেলের দিকে আমার এক সিনিয়র বলে দিলেন ঝট করে বেরিয়ে পড়তে ক্লায়েন্টের অফিসে। অবশ্যই ট্যাক্সি করে। তখন প্রায় পাঁচটা মত বাজে। আগে শিক্ষা হয়ে গেছে, তাই ব্যাগে সবসময় শদুয়েক টাকা রাখি ট্যাক্সিখরচ বাবদ। ট্যাক্সি করে ছুটে চললাম পার্ক স্ট্রীটের দিকে।
  • কুমড়োপটাশ | 198.155.168.109 | ২২ আগস্ট ২০১৬ ০৩:৩৭619824
  • একটা সাতআটতলা অফিসবাড়ীর টপ ফ্লোরে জাপানী কোম্পানীর অফিস। সন্ধে হয়ে গেছে। পার্কস্ট্রীটের ওয়ানওয়ে টুওয়ের চক্কর এবং বিকেলের ট্র্যাফিক সামলে ঝড়ের বেগে উপস্থিত হলাম ক্লায়েন্ট সাইটে। সেদিন বেস্পতিবার। অফিসে কোনো রিসেপশন ডেস্ক চোখে পড়ল না। জাপানী সাহেবেরা একে একে বেরিয়ে যাচ্ছে কাজের শেষে। প্রায় পুরো ফ্লোরটাই অফিসস্পেস। কাকে জিগ্যেস করব বুঝতে পারছি না, এদিকে সাহেবরাও বেরোনোর সময় আমাকে একবার করে দেখে নিচ্ছে। একবার এগিয়ে গিয়ে একজনকে "এক্সকিউজ মী" বলতে গেলাম, সাহেব একটু থমকে আমাকে দেখে নিয়ে ভেতর চলে গেল। তারপরেই একজন ভারতীয় মুখের দেখা পেলাম। সাহেব তাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে। এক বাঙালী ছোকরা। সে সাহেবকে জাপানী ভাষায় কীসব বলতে সাহেব চলে গেল, ছেলেটি হাসিমুখে আমার সামনে এসে বলল, আপনি এসে গেছেন? আসুন এদিকে আসুন, আসলে এখন অফিস ছুটি হয়ে যাচ্ছেতো, একটু বসুন, আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আসছি।
    এই বলে, সে আমাকে একটা ঘরের ভেতরে নিয়ে গেল। সেঘরে একটাই চেয়ার এবং অনেক তার এবং গোটা দুয়েক সার্ভার।
    আমি বসে বসে অপেক্ষা করছি তো করছিই, পাঁচ মিনিট গেল, দশ মিনিট গেল, কেউ আর আসে না। এদিকে আমাদের কোম্পানীর কিছু নিয়ম আছে, এইরকম টুকটাক কাজের জন্য কোথাও গেলে প্রতিটি ঘন্টার হিসেব রাখতে হবে। এমনকি আধঘন্টা বেশি হলেও বিলিং সেভাবে হবে। মনে মনে ভাবছি, এইযে বসিয়ে রেখে চলে গেল ছেলেটা, ও কি জানে বিলিংএর নিয়ম? এইসমস্ত ভাবছি, এরমধ্যে সে ফিরে এসেছে। বলল, সবাই চলে না গেলে তো আপনার সঙ্গে বসতে পারছিনা, সাহেবরা কে কখন ডাকবে কিছু ঠিক নেই। আজ আপনাকে কিছু করতে হবে না। কিছু করতে পারবেনও না। সব কাজ আরম্ভ হবে শুক্রবার রাত্তির থেকে, চলবে শনিবার অবধি, কি চাইলে রোববারেও আসা যেতে পারে।
    এইসব বলবার পরে সে আমাকে কাজের লিস্ট হাতে ধরিয়ে দিল। ছেলেটির নাম সত্যব্রত। আমার কিছু জিনিস দেখে নেবার ছিল ওদের সিস্টেমের মধ্যে। সেসব দেখতে দেখতে মোটামুটি একটা সময়ের এস্টিমেট করলাম, মোটামুটি কতক্ষণ সময় লাগতে পারে। যদিও অনেক ক্ষেত্রে সময় একটু বেশিই লেগে যায়।
    আমি যখন সিস্টেম দেখছিলাম, সে আমার পাশে ছিল, চুপচাপ সব দেখছিল, মাঝেমধ্যে দুয়েকটা কথা বলছিলাম আমরা। জানা গেল ঐ কোম্পানীর কোলকাতা অফিসের টেকনিক্যাল কাজকর্ম সে নিজেই করে। ঐ সার্ভার দুটোও, ওরই দায়িত্বে। আরো একটা সার্ভার নাকি কিছুদিন পরে আসবে, সে নিয়েও ছেলেটি খুব উদ্বিগ্ন। রাত প্রায় আটটা বাজে, এবার আমার ফেরার পালা। আগামীকাল অফিসে গিয়ে আলোচনা করতে হবে সিনিয়র কারো সঙ্গে। কাজটা আমি একাই করব নাকি অন্য কেউ সঙ্গে থাকতে চায়, সেটা জানতে হবে।
    সত্যব্রত বলল, সে এই অফিসের কাছেই থাকে, দুমিনিটের হাঁটা পথ। যতক্ষণ দরকার সে আমার সঙ্গে থাকতে পারবে। ওখান থেকে বেরোলাম আমরা একসঙ্গেই। যে প্রশ্নটা বেশ কিছুক্ষণ ধরেই মাথায় ঘুরঘুর করছে, সেটা আর চেপে রাখতে পারলাম না। আচ্ছা, আপনি নিজেই এই কাজটা করছেন না কেন? কাজটা তো মারাত্মক কিছু শক্ত নয়, তার ওপরে সমস্ত সিস্টেমই তো আপনার দায়িত্বে। শুধুশুধু এত টাকা খরচ করে আমাদের দিয়ে এটা করাচ্ছেন কেন?
    সত্যব্রত অল্প একটু হাসল, বিষন্ন সেই হাসি। বলল, সেসব বলব আপনাকে পরে। আসছেন তো কাল?
  • কুমড়োপটাশ | 198.155.168.109 | ২২ আগস্ট ২০১৬ ০৪:১৭619826
  • শুক্রবার অফিসে গিয়ে সিনিয়রকে সমস্ত রিপোর্ট করলাম। সিনিয়র খুব খুশি। বলল, আজ সন্ধেবেলাটা তুমি ম্যানেজ করে নাও, সেরম কিছু ঝাড় যদি নামে তবে শনিবার আমি যাব।
    এটুকু শুনলে আমি ভরসা পাই। এসমস্ত কাজে হাতেখড়ি হচ্ছে সরাসরি ক্লায়েন্ট সাইটে গিয়ে গিয়ে। ছোটোছোটো কাজ বলে কোন টিমের বালাই নেই। টেকনিক্যাল কাজ বলে টাইমিংটাও অন্যরকম। শুক্রবার সন্ধে সাতটায় কাজ শুরু হবে। শেষ কখন হবে সেটা আমরা জানি না। আবার আমার সিনিয়র রাতের দিকে আসতে চায় না, সে আসবে শনিবারে, কেননা তাহলে দেখানো যায় ছুটির দিনে কাজ করেছে, তাতে ঘন্টার হিসেব বেড়ে যায়। কথায় কথায় এসব মেনশন করলে ডিরেক্টর ইম্প্রেস্ড হয়, কর্মজীবনে উন্নতি হয়। এসব ট্যাকটিক্স অনেক পরে জেনেছি। কিন্তু শুক্রবার সারাটাদিন অফিস করবার পরে আমায় যে সন্ধে সাতটা থেকে অনির্দিষ্টকাল ক্লায়েন্টসাইটে কাজ করে যেতে হবে সে নিয়ে আমার নিজের তেমন চিন্তা নেই। চিন্তা হচ্ছে অন্য ব্যাপারে, কাজটা আমি পারব তো? আমার টানা সকাল থেকে অফিস করে, সন্ধেয় বাড়ি না ফিরে কাজ করায় ওয়ার্ক লাইফ ব্যালেন্স নামক যে বস্তুটা শিখেছি সেটার সত্যাসত্য যাচাই তো হচ্ছেই, উপরন্তু আরো অনেক উটকো চিন্তা মাথায় আসে। শুক্রবারের সারাটা রাত পার্কস্ট্রীটের মত জায়গায়, একটা ফাঁকা অফিসের মধ্যে কীকরে কাটাবো? ভূতটুতের ভয় নয়, কিন্তু শত হলেও আমিতো একটা মেয়ে, ভূতের চেয়েও বেশি ভয়ের অপশনতো বাদ দেওয়া যায় না। তাও ভরসা, ঐ ছেলেটা থাকবে সঙ্গে। যদি ঘুম পায় রাত্রে, তাহলে কী করব? খিদে পেলে নাহয় কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
    সন্ধে সাতটার বেশ আগেই পৌঁছই জাপানী কোম্পানীর অফিসে। আমাকে বাদ দিয়ে অফিসে মাত্র দুজন। একজন সত্যব্রত। সে গম্ভীর হয়ে আছে। অন্যজন এক জাপানী সাহেব। বিরাট অফিস স্পেসের মধ্যে একটা জায়গায় বসে কম্পিউটারে কীসব কাজ করছে মনোযোগ দিয়ে। আমায় দেখতে পেয়েছে কিনা বুঝলাম না।
    আমার কাজটা সার্ভাররুমে গিয়ে করবার দরকার নেই। যেকোনো একটা ওয়ার্কস্টেশনে বসেই করতে পারব। কীকী স্টেপ মোটামুটি লিখে এনেছি সঙ্গে করে। সাতটার পরে যখন আর কেউ থাকবে না, তখন আমার কাজ শুরু হবে। নীচে গমগম করছে পার্কস্ট্রীট, এদিকে এই অফিসে কোনো শব্দই নেই প্রায়। অধিকাংশ লাইট নেবানো। আমার বসার জায়গার কাছে তবু লাইট জ্বলছে। জাপানী সাহেবের দিকটায় লাইট নেই, কেবল কম্পিউটারের স্ক্রীন থেকে যেটুকু আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে, তাতেই দেখতে পাচ্ছি তার চশমার কাঁচ জ্বলজ্বল করছে। মেটালিক ফ্রেমের চশমা। পুরু কাঁচ। চোখ দেখা যায় না। খুব বেশি মাইনাস পাওয়ার হলে ওরকম হয়।
    সত্যব্রত আমাকে ডেকে বলে, চলুন কফি খেয়ে নিই, কিচেনে চলুন, এখনোতো বেশ খানিকটা সময় আছে হাতে।
  • কুমড়োপটাশ | 198.155.168.109 | ২২ আগস্ট ২০১৬ ০৫:২৮619827
  • কিচেনটা মোটামুটি বেশ বড়ো সাইজের। তার মধ্যে একটা অংশে রান্নাবান্না করবার ব্যবস্থা আছে, দেয়ালে কাবার্ড। সেখানে চা কফি চিনি দুধ বিস্কুটের কৌটো। একটা ফ্রীজ। একধারে মেঝেয় স্ট্যাক করে রাখা জলের বোতল। প্লাস্টিকের। বোঝা যাচ্ছে মিনারাল ওয়াটার, কিন্তু চেনা ব্র্যান্ড নয়। বিসলেরি কি অন্য ভারতীয় ব্র্যান্ড আমি চিনি, এগুলো অন্য।
    ঘরের অন্যদিকের দেয়ালে একটা হোয়াইট বোর্ড এবং তাতে লিখবার জন্য নানান রঙের মার্কার পেন। মধ্যিখানে একটা বড়ো টেবিল ঘিরে গোটা আষ্টেক চেয়ার। সত্যব্রত ইলেকট্রিক কেটলিতে জল চাপিয়ে দিল, তারপরে কাবার্ড খুলে বলল, একটা দামী কফি আছে, খাবেন? বাইরের জিনিস, সাহেবরা নিয়ে আসে।
    আমার তখন যেকোনো কফি হলেই চলে, কিন্তু সত্যব্রত বলে চলে যে এই কফি নাকি দুনিয়ার বেস্ট কফি, সাহেবরা খুব তারিয়ে তারিয়ে খায়। জলের বোতলগুলো দেখিয়ে বলে, সেগুলোও বাইরে থেকে আনানো। সাহেবরা ইন্ডিয়ান মিনারাল ওয়াটার পর্যন্ত খায় না। প্রত্যেক উইকেন্ডে চলে যায় সিঙ্গাপুরে, কি ব্যাংককে। শুক্রবার বিকেল থেকেই সেইজন্য ফাঁকা থাকে অফিস, খুব কম লোক আসে। বড়োসাহেবেরা তো কাঁচা বাজার পর্যন্ত এখানে করে না।
    সত্যব্রত এইসব বলে যাচ্ছে, এদিকে হঠাৎ আমার কী মনে হল, বললাম, চা নেই?
    হ্যাঁ, চা ও আছে। কেন? কফি খান না আপনি?
    আমতা আমতা করে বললাম, দেখুন, কফি খাই, কিন্তু আপনি যেই বললেন ইম্পোর্টেড দামী কফি, তখন একটু ভয় ভয় করল। শুনেছি ইন্দোনেশিয়া না কোথায় যেন খুব দামী একধরণের কফি পাওয়া যায়, তবে সেটা নাকি বেড়াল বা বাঁদরে কফি বিন গিলে ফেলবার পরে, তাদের গু থেকে বের করে..., মানে আমি সঠিক জানিনা যদিও, তাও কফির ব্যাপারে রিস্ক নিতে চাই না আরকি।
    সত্যব্রত হাঁ হয়ে আমার কথা শুনছিল। মনে হল হয়ত বিশ্বাস করেওছে। তারপর বলল, তাহলে আমিও চা খাব এখন, কফির প্যাকেটে কী লেখা থাকে সেসবতো জানিনা।
    চা পাতা ভিজছে কাপের মধ্যে, এমন সময়ে আঁ আঁ করে প্রচণ্ড একটা চিৎকার শোনা গেল অফিস স্পেস থেকে। সাহিত্যের ভাষায় একেই বোধহয় আর্ত চিৎকার বলে। আমি চমকে উঠি। খেয়াল হয় সেই জাপানী সাহেব ছাড়া আরতো কেউ ছিলনা অফিস স্পেসে। কোনো বিপদ হলো না তো? তড়িঘড়ি চেয়ার থেকে উঠে পড়েছি, কিন্তু কী করব এখন বুঝতে পারছি না। সত্যব্রত ঝপ করে কিচেনের দরজার কাছে চলে যায়, তারপর অফিস স্পেসের দিকে উঁকি মেরে জাপানী ভাষায় কিছু বলে, বুঝতে পারিনা।
    এরপর, আমার দিকে তাকিয়ে বলে, ও কিছু না, খেলা শেষ, এতক্ষণ খেলছিলো কম্পিউটারে, এবার জিতেছে। জিতলেই ওরকম চেঁচায়। ও এখন চলে যাবে। চলুন। আমরা এখন কাজ শুরু করি।
    চায়ের কাপ হাতে নিয়ে যখন অফিস স্পেসে ঢুকলাম, তখন সেখানে আর কেউ নেই। আবছা শুনতে পাই লিফটের দরজা বন্ধ হল ঘড়ঘড় শব্দে লিফট নেমে যায়।
  • d | 144.159.168.72 | ২২ আগস্ট ২০১৬ ১১:০৮619828
  • পড়ছি
  • Ekak | 53.224.129.47 | ২২ আগস্ট ২০১৬ ১১:২৬619829
  • কোপি লুয়াক । ইচ্ছে আছে খেয়ে দেখার একবার অন্তত :)
  • কুমড়োপটাশ | 198.155.168.109 | ২২ আগস্ট ২০১৬ ১৪:৩৮619830
  • কাজের লিস্ট দেখতে ছোট হলেও তার মধ্যে প্যাঁচ আছে। যা বোঝা যাচ্ছে, অন্ততঃ দুবছর কি তারও বেশি সময় ধরে এই সফটওয়্যারে কোনো সার্ভিসিং হয় নি। বিভিন্ন ইন্টারভ্যালে গোছা গোছা প্যাচ রিলিজ করেছে সফটওয়্যার কোম্পানী। তার কোনোটাই ইম্পলিমেন্ট করা হয়নি সিস্টেমে। এখন কয়েকশো প্যাচ পর্যায়ক্রমে অ্যাপ্লাই করতে হবে। সিস্টেমে নানারকমের ডেভালাপমেন্ট ইত্যাদি হয়েছে ক্রমাগত, সেসবের মুখোমুখি হতে হবে এখন, সিস্টেম কখন যে কনফ্লিক্ট আপত্তি ব্যাগড়বাঁই করবে সেসব আঁচ করা যাচ্ছে না। আমি নিজেই খুব টেনশনে রয়েছি, তার ওপর সত্যব্রত সম্ভবত আমাকে দারুণ একটা এক্সপার্ট ভেবে রয়েছে মনে হচ্ছে। অন্ততঃ, যেরকম ভক্তিভরে আমার দিকে তাকাচ্ছে তাতে আমার এ সন্দেহ অমূলক নয়। খুব শ্রদ্ধাসহকারে আমার কাছে পার্মিশান চাইল, পাশে বসে একটু দেখবে কেমন করে কাজ করি আমি। এরকম করে বললে বারণ করা যায় না, অথচ আমি নিজেই এসব প্রথম করছি। কাগজে যেসমস্ত স্টেপ লিখে এনেছিলাম সাহস করে সেইমত কাজ শুরু করে দিলাম। কাজ শুরুর আগে জিগ্যেস করলাম, সিস্টেমের একটা ব্যাকাপ নেওয়া আছে তো? সত্যব্রত হাসিমুখে জানালো যে ব্যাকাপ নেওয়া হয় নিয়মিত, সে নিজেই এই কাজটা করে থাকে দায়িত্ব সহকারে। ব্যস, আর চিন্তা নেই। সাহস করে ঝাঁপিয়ে পড়লাম প্যাচ আপগ্রেড করতে। কয়েকশো প্যাচ একসঙ্গে একটা কিউয়ে দেওয়া যায় না, তারপরে প্যাচের অনের রকমফের আছে, ডিপেনডেনসি আছে, তাই অল্প অল্প করে খেপে খেপে কাজ হতে লাগল। এতে সময় খানিকটা বেশি লাগবে ঠিকই, কিন্তু এছাড়া অন্য কোনো উপায়ও নেই।
    প্রত্যেক খেপ চালিয়ে দেবার পরে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়, ইষ্টদেবতার নাম জপ করা যেতে পারে সেই সময়ে, যেন কোনো এরর্ না আসে। এরর্ এলে যে কী হবে তা আমাদের দুজনেরই অজানা।
    সাড়ে আটটা নাগাদ সত্যব্রত বলল, আপনি কিছু খাবেন? খাবার এনে দেবো? নীচে রোলের দোকান আছে, বা যদি অন্য কোনো খাবার চান?
    আমি চিন্তা করি, কী খাবো? খিদে একদম নেই, আজ রাতের মধ্যে কাজ শেষ হবে কিনা জানিনা। তাই মিথ্যে করে বলি, না, আমি বিকেলে পেটভরে খেয়েই তারপর এসেছি, কিছু লাগবে না আমার।
    তখন সে আমতা আমতা মুখ করে পার্মিশান চায় আমার কাছে, তাহলে আমি বাড়ি থেকে খেয়ে আসি? দুমিনিটের হাঁটা পথ।
    অফিস স্পেসের একটা জানলার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে, ঐখান থেকে দেখা যায় আমার বাড়ি, এখন অন্ধকারে দেখা যাবে না, কাল দেখাবো।
    সত্যব্রত খেতে চলে যায়, আমি কম্পিউটার স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে থাকি আর কাগজের টুকরোয় নোট করি এক এক করে, প্যাচ নাম্বার অ্যাতো অ্যাপ্লায়েড সাকসেসফুলি।
  • কুমড়োপটাশ | 198.155.168.109 | ২২ আগস্ট ২০১৬ ১৫:৩৭619831
  • ঝ্যারঝ্যারঝ্যারঝ্যার, ঝ্যারঝ্যারঝ্যারঝ্যার, দুমদুম, ঝ্যারঝ্যারঝ্যারঝ্যার, দুম্, ... হঠাৎ করে ঘুমটা ভেঙে গেল। একটু বেশি পরিমানে প্যাচ কিউয়ে দিয়েছিলাম এবার সাহস করে। তারপরে স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে টেবিলে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম নিজেই টের পাইনি। সেই সকাল সাতটায় বেরিয়েছিলাম বাড়ি থেকে। প্রথমে ধাতস্থ হতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল। কোথায় আমি? হ্যাঁ, মনে পড়েছে জাপানী কেমিক্যাল কোম্পানীর অফিসে বসে প্যাচ আপডেট করছি। স্ক্রীনের দিকে তাকাতেই মাথাটা ঘুরে গেল, রিটার্ণ কোড ফোর, এরর্ কোড! আবার সেই শব্দ ঝ্যারঝ্যারঝ্যারঝ্যার, দুমদুম, ঝ্যার্, কোত্থেকে আসছে আওয়াজটা? দরজাটা অনেকদূরে। সেদিকেই শব্দের উৎস। কে ধাক্কা দিচ্ছে দরজায়? কটা বাজে এখন? ওরে বাবা দশটা বেজে গেছে এতক্ষণ। কাঁচের দরজা। ধাক্কা দিয়ে ভেঙে ফেললে কী হবে?
    আধা অন্ধকার অফিস স্পেস দিয়ে টেবিল চেয়ারের সঙ্গে সংঘর্ষ বাঁচিয়ে দরজার কাছাকাছি পৌঁছলাম। ঘষাঘষা কাঁচ, বাইরে আলো কম, তাতে দেখতে পাচ্ছি একজন দাঁড়িয়ে আছে বাইরে। পুরুষ। তার বাঁহাতে কিছু একটা রয়েছে, ডানহাতে সে ধাক্কা দিচ্ছে দরজায়। কাঠের ফ্রেমে ধাক্কা দিলে দুমদুম আওয়াজ হচ্ছে, কাঁচের ওপর যখন মারছে তখন ঝ্যারঝ্যারঝ্যারঝ্যার হচ্ছে। কে এই লোকটা? ভেতরে আলো কম, হয়ত সে আমায় ভালো করে দেখতে পায় নি। একটু সাইডে গিয়ে উঁকি মেরে দেখলাম, টিশার্ট পরা। সত্যব্রততো ছাইরঙা সুট পরে। পরপর দুদিন ঐ পোশাকেই দেখেছি, তাছাড়া তার কাছে চাবি আছে নিশ্চয়, সে এরকম ধাক্কাধাক্কি করবে কেন? চুলোয় যাক আমার প্যাচ আপগ্রেড। এই সমূহ বিপদ থেকে বাঁচব কীকরে? লুকিয়ে থাকব? নাকি পুলিশ ডাকব? টেলিফোন কোথায় এ অফিসে? পুলিশের ফোন নম্বরই বা কী? একশ? না না, একশো তো ফায়ার ব্রিগেড, নাকি অ্যাম্বুলেন্স? আবার ঝ্যারঝ্যারঝ্যারঝ্যার, দুমদুম। পা ঘষে ঘষে দরজার কাছাকাছি যেতেই সেই ছায়ামূর্তি আমায় দেখতে পেয়ে গেল। তারপরে বলল, আমি সত্যব্রত, দরজাটা খুলে দিন।
    হাতল ঘুরিয়ে দরজা খুলতেই, সে ভেতরে ঢুকে বারবার সরি বলতে লাগল। চাবিটা তাড়াহুড়োয় নিয়ে যেতে ভুলে গেছল। বাড়ি গিয়ে চান চান করে টিশার্ট পাজামা পরে খেয়ে দেয়ে এসেছে। আসবার সময় আবার বুদ্ধি করে রাস্তার দোকান থেকে তড়কা রুমালি রুটি কিনে এনেছে আমার জন্যে। খাব না বলেছি বলে কি সত্যিই না খেয়ে থাকতে দেবে নাকি আমাকে সে? খেতে আমাকে হবেই।
    আমার মন মেজাজ ভালো নেই। বললাম, রাখো এখন খাবার, এদিকে প্যাচ আপগ্রেডে এরর্ দিয়েছে।
  • কুমড়োপটাশ | 198.155.168.109 | ২২ আগস্ট ২০১৬ ১৯:৪০619832
  • সত্যব্রত ভয়ানক মিইয়ে গেল। বলল, তাহলে এখন কী করবেন আপনি?
    কী করব সেটা আমি নিজেও ভালো করে জানিনা, তবে সেটা ক্লায়েন্টকে বুঝতে দিতে নেই। গম্ভীরভাবে বললাম, দেখছি।
    সবার আগে চোখেমুখে জলের ঝাপটা দেওয়া দরকার, অসম্ভব টায়ার্ড লাগছে। এক কাপ ব্ল্যাক কফি খেলে ঘুমটা কেটে যেতে পারত, কিন্তু কফি খাওয়াটা নিরাপদ নয়। বাথরুম কোন দিকে?
    সত্যব্রতকে জিগ্যেস করি, মেয়েদের টয়লেটটা কোনদিকে বলোতো?
    মেয়েদের বলেতো আলাদা কোনো টয়লেট নেই, তবে আপনার অসুবিধে হবে না।
    সে টয়লেট দেখিয়ে দেয়। পরে বলেছিল, যে ঐ অফিসে সব কর্মচারীই পুরুষ। যাইহোক, হাতমুখ ভাল করে ধুয়ে নবোদ্যমে এরর্ কারেক্ট করতে উদ্যোগী হলাম। মনে হল, হয়ত এররটা এলিমিনেট করতে পেরেছি। তারপরে ফের যেই আপগ্রেড চালালাম, মিনিট দুয়েকের মধ্যে আবার এরর দিল। মাথা ঠাণ্ডা রাখা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। এখন একমাত্র উপায় সফ্টওয়্যারের ওয়েবসাইটে গিয়ে এরকম সম্ভাব্য সমস্যার সমাধান কিছু আছে কিনা খুঁজে বের করা। সেটার জন্য নির্দিষ্ট লগিন দরকার, দরকার কোম্পানীর নিজস্ব ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড। সত্যব্রতর কাছে সেসব চাইতে সে আকাশ থেকে পড়ল। এরকম কথা যেন সে জীবনে কোনোদিনো শোনেনি। এতো মহা মুশকিলে পড়া গেল। যত বলি, তুমি একটু তোমাদের কাগজপত্র ডকুমেন্টেশন খুঁজে দেখো নিশ্চয় পেয়ে যাবে, ততই সে কাঁদোকাঁদো হয়ে বলে, বিশ্বাস করুন আমার কাছে কিচ্ছু নেই, ওরা আমাকে কিচ্ছু দেয় না, কেবল সিস্টেম স্টার্ট আর শাটডাউন করতে পারি আর ব্যাকাপ নিতে জানি।
    এবার একটু কড়া হয়ে বললাম, চলো সার্ভাররুমে, ওখানে এককোণে কিছু কাগজপত্র পড়েছিল কাল দেখলাম মনে হলো।
    সত্যব্রত বলল, ওসব কাগজে এরকম কিছু নেই, আপনি আমাকে বিশ্বাস করুন, যে ইউজার আইডি পাসওয়ার্ড আপনি খুঁজছেন সেটা জাপানের টেকনিক্যাল টিমের কাছে থাকতে পারে, জাপানে একবার ফোন করব?
    জাপানে! সেখানে এখন তো গভীর রাত, তার ওপরে এতক্ষণে তো শনিবার হয়ে গেছে। একটা ইমেল করলেও করতে পারো।
    সত্যব্রত কিছুতেই ইমেল করতে চাইল না, ওদের অফিসে যখন তখন জাপানে ফোন করাটা নাকি জলভাত। তবে গভীর রাতের ব্যাপারটা মাথায় ঢোকানোর পরে ওর উৎসাহে কিছুটা ভাঁটা পড়ল। তখন নিমরাজি হতে হতে অবশেষে আমরা সারভার রুমের দিকেই এগোলাম এবং মিনিট পনেরো খোঁজাখুঁজি করবার পর কাঙ্খিত জিনিস পাওয়া গেল। তারপর আরো কিছুক্ষণ সলিউশান খোঁজা ও অবশেষে আবার একটু একটু করে কাজ এগোতে লাগল।
  • কুমড়োপটাশ | 198.155.168.109 | ২২ আগস্ট ২০১৬ ২০:২৮619833
  • একটা সময়ে রুমালি রুটি ও ঠান্ডা তড়কা অমৃতের মত লেগেছিল সেকথা অস্বীকার করবার কোনো স্কোপ নেই। তড়কায় ঝাল ছিল তাই সত্যব্রত কিচেনের ফ্রিজে মিষ্টি কিছু আছে কিনা খুঁজতে লাগল। ফ্রিজে ফুডের চেয়ে বেভারেজের পরিমানই বেশি। সমস্তই অ্যালকোহলিক বেভারেজ। ফুড বলতে ফ্রুট ছিল দুরকম। গোটা চারপাঁচ গামা সাইজের গাঢ় গোলাপী জামরুল এবং আরেকটা নাম না জানা ফল তার খোসার বাইরে কাঁটাকাঁটা মত। বোঝাই যাচ্ছে ইম্পোর্টেড ফ্রুট, কিন্তু সপ্তাহখানেরের বাসী। জামরুল চেনা ফল, কিন্তু মিইয়ে গেছে। বলা যায় না, হয়ত গুণে গেঁথে রাখে, যার জামরুল সে যদি সোমবার এসে দেখে একটাদুটো কমে গেছে, তার ফল ভালো নাও হতে পারে।
    মোটকথা, সারারাতের পরিশ্রমে একটা সিস্টেমে প্যাচ আপগ্রেড সাকসেসফুলি কম্পলিটেড, বাকি আছে আরো দুটো সিস্টেম, কিন্তু আসল ঝামেলাগুলো আমরা মেরে এনেছি। দুনম্বর সিস্টেমে প্যাচ আপগ্রেড বসিয়ে দিলাম, নিজের মতো চলুক কিছুক্ষণ। শনিবারের সকাল। একটু বাড়ী থেকে ঘুরে আসা দরকার। দাঁত না মাজলে বিচ্ছিরি লাগে। ঘন্টা তিনেকের ব্রেক নিলাম আমরা। আমরা দুজনেই নটা সাড়ে নটার মধ্যে আবার ফিরে আসব এই অফিসে। ফাইনালি সত্যব্রতকে বললাম, তোমাকে তুমি তুমি করে বলে ফেলেছি, কিছু মনে করোনিতো?
    সত্যব্রত লাজুক হেসে বলে, আমার বয়স কত জানেন? ডিসেম্বরে চব্বিশ পূর্ণ হবে। তিন বছর আগে একজনকে ভালোবেসেছিলাম। আপনি সেদিন জিগ্যেস করছিলেন না, যে এসব কাজ নিজে করিনা কেন? পড়াশোনা কন্টিনিউ করা হয়নি। যাকে ভালোবাসলাম সে খৃষ্টান ক্যাথলিক। এদিকে আমরা হিন্দু। বাবা ওসব শুনে বাড়ী থেকে বের করে দিল। বিকম পড়ছিলাম, পড়া বন্ধ হল। চাকরিটা জোগাড় করলাম আর বিয়ে করলাম। বাড়ীর সঙ্গে আত্মীয় স্বজন কারো সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ নেই আমার। একটা মেয়ে হয়েছে আমাদের, দুবছর বয়স। প্রায় ছমাস আগে আমিও কমিউনিয়ন জয়েন করেছি, এখন আমিও ক্যাথলিক।
    তুমি কি সুন্দর জাপানী ভাষা বলো।
    না না, ওতো কয়েকটা ছোটোখাটো কথাবার্তা শিখে নিয়েছি। লিখতে পারি না, খুব অল্প কিছু পড়তে পারি। এরাতো নিজেদের মধ্যে নিজেদের ভাষাতেই কথা বলে, আমার জন্যে আলাদা করে ইংরিজি বলবে কেন? তা ও বলে। কিন্তু এই চাকরিটা আমাকে টিঁকিয়ে রাখতেই হবে, আর সেইজন্যেই আমি জাপানী কথাগুলো শুনে শুনে শিখে নিই।
  • কুমড়োপটাশ | 198.155.168.109 | ২২ আগস্ট ২০১৬ ২১:১১619834
  • আমরা ফিরে আসবার কিছুক্ষণ পরেই আমার অফিসের সেই সিনিয়রটি ক্লায়েন্ট সাইটে এসে উপস্থিত। সিদ্ধেশ্বর রায়। সঙ্গে আরেকজন এসেছে, সে সুধাব্রত, অন্য ডিপার্টমেন্টের লোক, আমাদের ডিপার্টমেন্টে আসতে চায়, তাই কাজ শিখছে। সুধাব্রত এসেছে শ্রীরামপুর থেকে, মোটরবাইকে। সিদ্ধেশ্বর দমদমে থাকে। বোঝাই যাচ্ছে যে পথে কোথাও সিদ্ধেশ্বরকে পিক আপ করে নিয়েছে সুধাব্রত।
    আমার কাজ কর্মের প্রোগ্রেস ওদের দেখালাম। সত্যব্রত ওদেরকে কফি অফার করল। এবং কফির নাম উঠতেই অবধারিতভাবে আমি সত্যব্রতর দিকে তাকিয়েছি, আমাদের দুজনের চোখের কোণেই অল্প হাসির চিহ্ন ছিল, সেটা নজর এড়ায়নি সিদ্ধেশ্বরের। হয়ত কারণটা বুঝে উঠতে পারেনি, কিন্তু কফির অফার প্রত্যাখ্যান করল ওরা দুজনে। বদলে ঠাণ্ডা জল খেতে চাইল। বলল, নাঃ এগারোটা বাজতে চলল, এখন আর কফি খাবো না, একটু পরেই লাঞ্চ করব।
    সত্যব্রত জল আনতে কিচেনের দিকে যায়, সিদ্ধেশ্বর আমার দিকে ইঙ্গিতপূর্ণ চোখের ইশারা করে বলে, বাঃ ক্লায়েন্টকে বশ করে ফেলেছো তো, আরো কাজ ফাজ আছে কিনা জেনে নাও, বড়ো কোনো প্রোজেক্টের স্কোপ যদি থাকে একে ম্যানেজ করে জেনে নাও। এই লোকটার পাওয়ার কীরকম? ইনফ্লুয়েন্স করতে পারবে ওপরমহলে?
    সিদ্ধেশ্বরের কথার কী জবাব দেব আমি? জল নিয়ে সত্যব্রত এসে গেছে এরমধ্যেই। সিদ্ধেশ্বর লাঞ্চের জন্য তাড়া দেয় সকলকে, যেন লাঞ্চ করতে আসাটাই আজ ওর এখানে আসবার মূল উদ্দেশ্য ছিল। আমরা সবাই মিলে একটা রেস্টুরেন্টে যাব। বিলের টাকা রিএমবার্স করবে অফিস, বা আরো গভীরে খতিয়ে দেখতে গেলে ক্লায়েন্টের থেকেই কাটা হবে টাকাগুলো। সত্যব্রতকে সঙ্গে নেবার জন্য যুগপৎ পেড়াপিড়ি করতে থাকে সুধাব্রত ও সিদ্ধেশ্বর। অনেক বাছবিচারের পরে সাড়েবারোটা নাগাদ পিটার ক্যাটের দোতলায় একেবারে সিঁড়ি ঘেঁষে একটা টেবিল আমরা দখল করতে সক্ষম হই। রেস্টুরেন্ট খুঁজতে পরিশ্রম হয়েছে বিস্তর, অতএব প্রথমেই ঠাণ্ডা বিয়ার অর্ডার দিলো সিদ্ধেশ্বর, অবশ্যই আমাকে বাদ দিয়ে। আমার জন্য পেপসি। সত্যব্রত সঙ্কুচিত বোধ করছে। চীয়ার্স টিয়ার্স বলে গ্লাসে ঠোকাঠুকি করে বিয়ারের গ্লাসে দীর্ঘ চুমুক দিয়ে সফেন গোঁফে সিদ্ধেশ্বর সোজা প্রশ্ন করল সত্যব্রতকে, তারপর সত্যব্রতবাবু? আপনি কি যাদবপুর না খড়গপুর?
    সত্যব্রত বুঝতে পারেনি প্রশ্নটা। একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। সুধাব্রত সঙ্গত করে সিদ্ধেশ্বরের সঙ্গে, কেন শিবপুর আর দুর্গাপুরটা বাদ দিলে কেন সিধু?
  • কুমড়োপটাশ | 198.155.168.109 | ২৩ আগস্ট ২০১৬ ০০:৪৭619835
  • সত্যব্রত যেন শুনতে পায় না প্রশ্নটা। একটু দূরে কোনো একটা টেবিলের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সে বসেছে আমার মুখোমুখি, সিদ্ধেশ্বের পাশে। কিন্তু ওরা কি ওকে এত সহজে ছেড়ে দেবে? সত্যব্রতকে অন্যমনস্ক দেখে আমি তড়বড়িয়ে উত্তর দিই, ভবানীপুর!
    সিদ্ধেশ্বর যেন ঘৃণায় আমাকে শেষ করে দিতে চায়।
    কীরকম ক্যাবলার মতো কথা বলছে দ্যাখ!
    সিদ্ধেশ্বর আমার ঐ "ভবানীপুর" বলে ফেলার প্রসঙ্গে সুধাব্রতকে এটা বলল। ও এর আগেও নানান জায়গায় আমাকে হেয় করবার চেষ্টা করেছে, আজ নতুন কিছু নয়। আমার একজিকিউটিভ ডিরেক্টর অরুণাভদার বিশেষ প্রিয়পাত্র এই সিধু, ওকে কেউ ঘাঁটায় না। কিন্তু আমিও দমবার পাত্র নই। সত্যব্রতকে যেন ও অপমান করতে না পারে, ফাঁদে ফেলতে না পারে সেটার চেষ্টা আমায় করতেই হবে। সুধাব্রত এখন সিধুর হ্যাঁয়ে হ্যাঁ নায়ে না করে তাল দিয়ে যাবে নিজের স্বার্থে। তাবলে সত্যব্রতকে প্যাঁচে ফেলে অপমান করবার যে চেষ্টাটা সিধু করছে সেটা হতে দেওয়া যায় না। সত্যব্রত সারাদিন জাপানীদের সঙ্গে কাজ করে, জাপানী ভাষাও কিছুটা শিখেছে, কিন্তু বাঙলা ভাষার এই প্যাঁচে ফেলা পরিবেশে সে নতুন তো বটেই, এরকম অফিস কালচারও দেখেনি আগে। ও কতক্ষণ অন্যমনস্ক হবার ভাণ করে সময় কাটাবে?
    আমি আরো জোর দিয়ে বলি, হ্যাঁ ভবানীপুর, সুধাব্রত যেমন শ্রীরামপুর।
  • কুমড়োপটাশ | 198.155.168.109 | ২৩ আগস্ট ২০১৬ ০১:৩৮619837
  • সত্যব্রত এবার শুনতে পেয়েছে আমার কথা। কী যেন ভাবছিল সে এতক্ষণ, এবার যেন সম্বিৎ ফিরে পেয়েছে এমনিভাবে বলল। হ্যাঁ, আমাদের বাড়ী ভবানীপুরে।
    সিধু এবার বলে, তাহলেতো আপনার বাড়ী থেকে অফিস তেমন কিছু ডিসট্যান্স নয়। কাছেই।
    সত্যব্রত বলে, না না এখন ভবানীপুরে থাকি না, এই কাছেই থাকি, এখান থেকে হেঁটে দুমিনিট।
    ওয়েটর এসে অপেক্ষা করছে মেইন কোর্স কী কী অর্ডার করা হবে সেটা জানতে।
    সিধু এবং সুধাব্রত কিছু বলবার আগেই সত্যব্রত বলল, যদি কিছু মনে না করেন, আমার একটা আর্জেন্ট কাজ মনে পড়ে গেছে, এখন না গেলে দেরি হয়ে যাবে। সরি, আমি এখন লাঞ্চটা করতে পারছি না।
    তারপরে আমাকে বলে, আপনি লাঞ্চের পরে চলে আসুন, আমি ততক্ষণে অফিসে পৌঁছে যাব।
    সত্যব্রত চলে যায়। সিধু কটমট করে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। যেন দোষটা আমারই। তারপরে বলে, কী বলেরে লোকটা? ও এই পার্কস্ট্রীটে থাকে? ঢপ মারছে না তো?
    সুধাব্রত বলে, সেরকমই তো বলল। কেন থাকতে পারে না? অসুবিধাটা কোথায়?
    তোর কোনো আইডিয়া আছে এখানে ফ্ল্যাটের ভাড়া কত?
    কত?
    একটা জিনিস হতে পারে। কোম্পানী ওকে ফ্ল্যাট দিয়েছে। শুনলিনা, বলছিল ভবানীপুরে বাড়ী। পয়সাওয়ালা হবে।
    আমরা খেতে থাকি। একটু পরে সিধু আবার দেবব্রতর কথা তোলে, দেখলি কোত্থেকে পাস করেছে সেটা কীরকম ডজ করে এড়িয়ে গেল।
    বাদ দে না...
    বাদ ই দিচ্ছি। কিন্তু একটা মিনিমাম ডিসেন্সী নেই দেখলি তো? পিকিউলিয়ার একটা।
    এবার আমার দিকে ফিরে সিধু বলে, শোনো, মন দিয়ে শুনে নাও, ওকে বুঝিয়ে বাঝিয়ে তোমাকে আরো প্রোজেক্টের স্কোপ বের করতে হবে। জানতে হবে ওদের ইম্পলিমেনটেশনগুলো কারা করে।সেসব কাজ আমাদের পেতে হবে।
    কী বলব আমি ওকে গিয়ে?
    "কী বলব আমি ওকে?" সিদ্ধেশ্বর আমাকে ভ্যাঙায়। শিখিয়ে দিতে হবে নাকি? জেনে নেবে এর পরে আর কীকী কাজ আছে, ছোটো বড়ো।
    চাইনীজ ফুড বিস্বাদ লাগতে থাকে আমার জিভে। সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছে একজন ওয়েটার দুটো পাত্রে খাবার নিয়ে। খাবারগুলো তখনও যেন রান্না হয়ে চলেছে, যেন তখনও জ্বলছে তাওয়ার ওপর যেমন হয়। আমি হাঁ করে দেখি সেগুলো। এরকম ডিশ আমি আগে কখনো দেখিনি। অজান্তেই মুখ দিয়ে কথা বেরিয়ে পড়ে, ওমা! ওগুলো কী?
    কোনগুলো?
    ঐযে নিয়ে যাচ্ছে, খাবারগুলো যেন এখনো রান্না হচ্ছে, ওগুলোকে কী বলে?
    আহা, ন্যাকা! ওগুলোকে কী বলে?
    আবার আমাকে ভ্যাঙায় সিদ্ধেশ্বর।
    এতবছর জার্মানীতে ছিলে আর সিজলার কাকে বলে জানো না?
    না! জানিনা। এবং আমি জার্মানীতে ছিলাম সেটা কে বলেছে তোমাকে?
    জার্মানীতে নয়? তাহলে কোথায়? ওহো! রাসিয়া। ওখানে এসব খাবার পাওয়া নাও যেতে পারে। ওখানে ভডকা খেতে তো? খেতে না?
    এই সিধু, থাম না।
    সুধাব্রত ক্ষীণ চেষ্টা করে সিধুকে থামাতে।
    আমি ঠিক কথা বলবার মতো অবস্থায় নেই। খাওয়া মাথায় উঠেছে।
    সুধাব্রত বলে চলেছে সিধুকে, শোন, লাঞ্চের পর কী প্ল্যান তোর? ওতো (আমাকে দেখিয়ে) বাকি প্যাচগুলো ইম্পলিমেন্ট করবে, তুই এখন সোজা বাড়ি যাবি নাকি আমার বাড়ী যাবি? আমার বৌ আজ বাড়ী নেই, বৈদ্যবাটি গেছে। এক কাজ করি, পার্ক স্ট্রীট থেকে একটা বোতল নিয়ে নিই। কী খাবি বল? ভডকা না রাম?
    সিধু চুপ করে তাকিয়ে থাকে সুধাব্রতর দিকে। একটু পরে বলে, তারপর?
    তারপর আবার কী? কাল তো রোববার। বাড়ীতে ফোন করে বলে দে।
    দাঁড়া ভাবতে দে আগে।
    ভেবে নে।
    আমার আর ওখানে বসতে ইচ্ছে করে না। সমস্ত ইচ্ছাকে একত্র করে আমি উঠে দাঁড়াই। বলি, আমার এখনো অনেকটা কাজ বাকি আছে, প্লীজ এক্সকিউজ মী!
    আমি ওদের পার্মিশান বা উত্তরের অপেক্ষা করি না, গটগট করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাই। কানে আসে সিধু বলছে, কীরকম চুল কেটেছে দ্যাখ, ছোট্ট ছোট্ট, মেয়েদের চুল হবে লম্বা, তা না এইটুকুটুকু চুল, দেখলেই রাগ ধরে।
    উত্তরে সুধাব্রত কী বলে শোনা যায় না। বাইরে বেরিয়ে আমি রাস্তা ক্রস করে উল্টোদিকের ফুটপাথ ধরে পূর্বদিকে হাঁটতে থাকি ক্লায়েন্ট সাইটের দিকে।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে মতামত দিন