এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • বাপসোহাগী

    Ishani
    অন্যান্য | ২২ জানুয়ারি ২০১৫ | ৬৫০৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Ishani | 69.92.136.14 | ২৪ জানুয়ারি ২০১৫ ১৮:৫৮657799
  • যদিও আমি গত ২২ বছর ব্যাঙ্গালোরে , এই আবাসনে তখন আমরা সবে এসেছি | বাড়ি বদল করে | ফেব্রুয়ারী ২০০২ | আমার এক প্রতিবেশী এল. বৈদ্যনাথন | নিষ্ঠাবান পালঘাট তামিল ব্রাহ্মণ | "এল" টা যে কী, আজও জানি না | সকাল হলে পুজোআচ্চা . ফেরতা দিয়ে ধুতি , কপালে "রসকলি" , ফিল্টার কফি আর ইডলি -সম্বর | বেলা বাড়লে সাহেব সেজে জি ই -র বড়সাহেব | সম্পন্ন পরিবার | আলাপ হল অর স্ত্রী রানী আর ছেলে রোশনের সঙ্গে | রোশন আমার বড় ছেলে আকাশের চেয়ে বছর দুইয়ের বড় | শুনলাম, একটি মেয়েও আছে | সেদিন দেখিনি |

    দেখলাম বেশ কিছুদিন পরে | সে বছরের দিওয়ালি পার্টিতে | সন্ধেবেলা আবাসিকেরাই একটু হইচই করে , বাচ্চারা একসঙ্গে বাজি পোড়ায় , একসঙ্গে রাতের খাওয়া , হাউজি খেলা |

    মেয়েটি প্রতিবন্ধী | শারীরিক এবং মানসিক | অন্যরকম হাঁটাচলা , অন্যরকম কথা বলা | মানে কথা বলে ..আমি বুঝি না | আন্দাজে আন্দাজে উত্তর দিই | আমার ছেলেরা কিন্তু দিব্যি কথা চালিয়ে যায় ওর সঙ্গে | শিশুরা ঠিকই শিশুদের কথা বোঝে ! মনের জটিলতা কম বলেই হয়ত !

    রানী একটু এলোমেলো স্বভাব | খুব একটা মেয়েকে আগলে রাখতেও দেখলাম না | তাজ্জব হয়ে গেলাম বাবাকে , মানে বৈদ্যনাথনকে দেখে | এবং শুনে | আমার সঙ্গে মেয়ের আলাপ করাচ্ছে |

    -- আম্মু , প্লীজ মিট ঈশানী আন্টি
    -- হাই আম্মু
    -- ঈশানী , প্লীজ কল হার দুর্গা | দ্য মোস্ট পাওয়ারফুল গডেস | আই ওয়ান্ট মাই ডটার টু গ্রো আপ লাইক হার |

    লোকটা বলে কী ! মেয়েটির হাঁটায় জড়তা , কথা অস্পষ্ট , অসংলগ্ন আচরণ | আমি একটা দুটো কথা বলে সরে আসি | একটু কি অস্বস্তিও ছিল ?

    আমার আর এক প্রতিবেশিনী ঊষা বলে, " অবাক হয়ো না | আমরাও ওকে দুর্গা বলেই ডাকি |আজকাল | যখন জন্মাল , পঙ্গু | মাংসের পুঁটুলি | হাত পা বাঁকা , জট পাকানো , মুখ দিয়ে লালা ঝরে..| অথচ প্রথম সন্তানকে দ্যাখো..কী ফুটফুটে ..কী সুন্দর ! আমাদের দেখে ভয় করত | কারো যেন এমন দুর্ভাগ্য না হয় ! রানী মুখ ফিরিয়ে দেখতেও চাইত না | কিন্তু বৈদ্যনাথন ? সে বাড়ি থেকে কাজ করার আর্জি জানালো | না হলে মেয়েটা তো মরে যাবে ! আর্জি মঞ্জুর হল | ও কাজ করছে বাড়ি থেকে আর নিত্যদিন ওই মেয়েকে কোলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ডাক্তারদের দরজায় দরজায় ঘুরছে | মেয়েকে মায়ের যত্নে স্নান করাচ্ছে, খাওয়াচ্ছে, হাতে পায়ে মালিশ করছে , অনর্গল গল্প করছে, গান করছে, ভোলাচ্ছে , চোখের জল আর মুখের লালা মুছিয়ে দিচ্ছে | মেয়ে শুধু বাপকে চেনে আর বাপ মেয়েকে | ঈশানী , এত ভালোবাসা , নিছক কর্তব্য আর দায়িত্ব পেরিয়ে এত ভালোবাসা যে কোনো বাবা এমন প্রতিবন্ধী মেয়েকে দিতে পারে ...আগে দেখিনি | আমার দুটি সুস্থ সন্তান... আমি লজ্জায় মাথা নীচু করে থাকি | ও যা করে, আমি কি মা হয়েও তার একটি তিলও করতে পেরেছি ?"

    -- আর দুর্গা ?

    -- সে তো .. কী আশ্চর্য কান্ড ঈশানী ...সে একটু একটু করে হাঁটে , নিজে নিজে জলের দুধের গ্লাস ধরতে শেখে , জড়িয়ে জড়িয়ে হলেও...মুখে বুলি ফোটে | তার যত কথা ...বাবার সঙ্গে | এই যে এখন দেখছ, এখন কিন্তু ও স্কুলেও যায় | স্প্যাসটিক সোসাইটির স্কুলে | এখন বৈদ্যনাথন আবার নিয়মিত অফিসে জয়েন করেছে | তবে ২৪ ঘন্টা ওর চোখ আর মন ছুঁয়ে থাকে মেয়েকে |

    দুর্গা এখন দিব্যি হাঁটে | ওর কথাও আমি বুঝতে পারি | এখন বুঝি...বোঝার মন তৈরী করে নিতে জানতে হয় | দুর্গা গান শেখে | ভারতীয় মার্গসঙ্গীত | দুর্গা ছবি আঁকে , হাতের কাজ করে | স্পেশাল স্কুলে যায় |

    এখন কাজের সূত্রে ওরা ছ'মাস করে আমেরিকায় থাকে | ছ'মাস করে ব্যাঙ্গালোরে | বৈদ্যনাথন বলল সেদিন, " আই হ্যাভ ফাউন্ড আ স্প্লেনডিড স্কুল ফর হার দেয়ার | সী ইজ ডুইং রিয়ালি ওয়েল |"

    ঝকঝক করছিল বৈদ্যনাথনের দু 'চোখ | অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছে বাপ-বেটিতে | হয়ত অনেকটাই পথ এখনও পেরোনো বাকি | আমি প্রথম যখন দেখি ওকে, তখন সে নিতান্ত বালিকা | এখন প্রায় কুড়ি | এই আবাসনে তা আমার থাকাও তো হল ১৩ বছর | সেই তখন থেকেই দেখছি |

    এই দীপাবলিতে দরজায় ঘন্টি বাজল সন্ধেবেলা | দরজা খুলে দেখি একরাশ মেওয়া , চকোলেট আর অপূর্ব হাতে বানানো মাটির ডিজাইনার পঞ্চপ্রদীপ সাজিয়ে দুর্গা আর তার বাবা | আমাকে উপহার দিতে এসেছে |

    দুর্গার মুখে লেগেছিল ঠিক আমাদের চেনা প্রতিমার সৌন্দর্যের ঘামতেল |

    আর ওর বাবাকে দেখে আমার চোখে ভেসে উঠছিল একটা অন্য মুখের ছবি | সেও খুব চেনা | মমতায় , স্নেহে ... খুব চেনা |

    সে মুখ যীশুখ্রিস্টের |
  • Ishani | 69.92.136.14 | ২৪ জানুয়ারি ২০১৫ ১৮:৫৮657800
  • যদিও আমি গত ২২ বছর ব্যাঙ্গালোরে , এই আবাসনে তখন আমরা সবে এসেছি | বাড়ি বদল করে | ফেব্রুয়ারী ২০০২ | আমার এক প্রতিবেশী এল. বৈদ্যনাথন | নিষ্ঠাবান পালঘাট তামিল ব্রাহ্মণ | "এল" টা যে কী, আজও জানি না | সকাল হলে পুজোআচ্চা . ফেরতা দিয়ে ধুতি , কপালে "রসকলি" , ফিল্টার কফি আর ইডলি -সম্বর | বেলা বাড়লে সাহেব সেজে জি ই -র বড়সাহেব | সম্পন্ন পরিবার | আলাপ হল অর স্ত্রী রানী আর ছেলে রোশনের সঙ্গে | রোশন আমার বড় ছেলে আকাশের চেয়ে বছর দুইয়ের বড় | শুনলাম, একটি মেয়েও আছে | সেদিন দেখিনি |

    দেখলাম বেশ কিছুদিন পরে | সে বছরের দিওয়ালি পার্টিতে | সন্ধেবেলা আবাসিকেরাই একটু হইচই করে , বাচ্চারা একসঙ্গে বাজি পোড়ায় , একসঙ্গে রাতের খাওয়া , হাউজি খেলা |

    মেয়েটি প্রতিবন্ধী | শারীরিক এবং মানসিক | অন্যরকম হাঁটাচলা , অন্যরকম কথা বলা | মানে কথা বলে ..আমি বুঝি না | আন্দাজে আন্দাজে উত্তর দিই | আমার ছেলেরা কিন্তু দিব্যি কথা চালিয়ে যায় ওর সঙ্গে | শিশুরা ঠিকই শিশুদের কথা বোঝে ! মনের জটিলতা কম বলেই হয়ত !

    রানী একটু এলোমেলো স্বভাব | খুব একটা মেয়েকে আগলে রাখতেও দেখলাম না | তাজ্জব হয়ে গেলাম বাবাকে , মানে বৈদ্যনাথনকে দেখে | এবং শুনে | আমার সঙ্গে মেয়ের আলাপ করাচ্ছে |

    -- আম্মু , প্লীজ মিট ঈশানী আন্টি
    -- হাই আম্মু
    -- ঈশানী , প্লীজ কল হার দুর্গা | দ্য মোস্ট পাওয়ারফুল গডেস | আই ওয়ান্ট মাই ডটার টু গ্রো আপ লাইক হার |

    লোকটা বলে কী ! মেয়েটির হাঁটায় জড়তা , কথা অস্পষ্ট , অসংলগ্ন আচরণ | আমি একটা দুটো কথা বলে সরে আসি | একটু কি অস্বস্তিও ছিল ?

    আমার আর এক প্রতিবেশিনী ঊষা বলে, " অবাক হয়ো না | আমরাও ওকে দুর্গা বলেই ডাকি |আজকাল | যখন জন্মাল , পঙ্গু | মাংসের পুঁটুলি | হাত পা বাঁকা , জট পাকানো , মুখ দিয়ে লালা ঝরে..| অথচ প্রথম সন্তানকে দ্যাখো..কী ফুটফুটে ..কী সুন্দর ! আমাদের দেখে ভয় করত | কারো যেন এমন দুর্ভাগ্য না হয় ! রানী মুখ ফিরিয়ে দেখতেও চাইত না | কিন্তু বৈদ্যনাথন ? সে বাড়ি থেকে কাজ করার আর্জি জানালো | না হলে মেয়েটা তো মরে যাবে ! আর্জি মঞ্জুর হল | ও কাজ করছে বাড়ি থেকে আর নিত্যদিন ওই মেয়েকে কোলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ডাক্তারদের দরজায় দরজায় ঘুরছে | মেয়েকে মায়ের যত্নে স্নান করাচ্ছে, খাওয়াচ্ছে, হাতে পায়ে মালিশ করছে , অনর্গল গল্প করছে, গান করছে, ভোলাচ্ছে , চোখের জল আর মুখের লালা মুছিয়ে দিচ্ছে | মেয়ে শুধু বাপকে চেনে আর বাপ মেয়েকে | ঈশানী , এত ভালোবাসা , নিছক কর্তব্য আর দায়িত্ব পেরিয়ে এত ভালোবাসা যে কোনো বাবা এমন প্রতিবন্ধী মেয়েকে দিতে পারে ...আগে দেখিনি | আমার দুটি সুস্থ সন্তান... আমি লজ্জায় মাথা নীচু করে থাকি | ও যা করে, আমি কি মা হয়েও তার একটি তিলও করতে পেরেছি ?"

    -- আর দুর্গা ?

    -- সে তো .. কী আশ্চর্য কান্ড ঈশানী ...সে একটু একটু করে হাঁটে , নিজে নিজে জলের দুধের গ্লাস ধরতে শেখে , জড়িয়ে জড়িয়ে হলেও...মুখে বুলি ফোটে | তার যত কথা ...বাবার সঙ্গে | এই যে এখন দেখছ, এখন কিন্তু ও স্কুলেও যায় | স্প্যাসটিক সোসাইটির স্কুলে | এখন বৈদ্যনাথন আবার নিয়মিত অফিসে জয়েন করেছে | তবে ২৪ ঘন্টা ওর চোখ আর মন ছুঁয়ে থাকে মেয়েকে |

    দুর্গা এখন দিব্যি হাঁটে | ওর কথাও আমি বুঝতে পারি | এখন বুঝি...বোঝার মন তৈরী করে নিতে জানতে হয় | দুর্গা গান শেখে | ভারতীয় মার্গসঙ্গীত | দুর্গা ছবি আঁকে , হাতের কাজ করে | স্পেশাল স্কুলে যায় |

    এখন কাজের সূত্রে ওরা ছ'মাস করে আমেরিকায় থাকে | ছ'মাস করে ব্যাঙ্গালোরে | বৈদ্যনাথন বলল সেদিন, " আই হ্যাভ ফাউন্ড আ স্প্লেনডিড স্কুল ফর হার দেয়ার | সী ইজ ডুইং রিয়ালি ওয়েল |"

    ঝকঝক করছিল বৈদ্যনাথনের দু 'চোখ | অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছে বাপ-বেটিতে | হয়ত অনেকটাই পথ এখনও পেরোনো বাকি | আমি প্রথম যখন দেখি ওকে, তখন সে নিতান্ত বালিকা | এখন প্রায় কুড়ি | এই আবাসনে তা আমার থাকাও তো হল ১৩ বছর | সেই তখন থেকেই দেখছি |

    এই দীপাবলিতে দরজায় ঘন্টি বাজল সন্ধেবেলা | দরজা খুলে দেখি একরাশ মেওয়া , চকোলেট আর অপূর্ব হাতে বানানো মাটির ডিজাইনার পঞ্চপ্রদীপ সাজিয়ে দুর্গা আর তার বাবা | আমাকে উপহার দিতে এসেছে |

    দুর্গার মুখে লেগেছিল ঠিক আমাদের চেনা প্রতিমার সৌন্দর্যের ঘামতেল |

    আর ওর বাবাকে দেখে আমার চোখে ভেসে উঠছিল একটা অন্য মুখের ছবি | সেও খুব চেনা | মমতায় , স্নেহে ... খুব চেনা |

    সে মুখ যীশুখ্রিস্টের |
  • সে | 188.83.87.102 | ২৪ জানুয়ারি ২০১৫ ১৮:৫৯657801
  • পরে কখনো।
  • 1978 | 127.194.208.43 | ২৪ জানুয়ারি ২০১৫ ২০:১৩657802
  • আর এগারটা লোহার আলমারি ও তার বাইরের সমপরিমাণ ১৫০০০ এর অনেক বেশি বইয়ের প্রায় কিছুই কালের করাল কবল থেকে রক্ষা করা যায়নি এক প্রজন্মের মধ্যে জেনে ঠিক রাগ নয়, দূ;খ নয়, ক্রোধ হয়। প্রচণ্ড অন্ধ হতাশ নিস্ফল ক্রোধ। এই সময় হাতের নাগালে ভঙ্গুর কিছু থাকা সর্বনাশের।
  • Arindam Chakrabarti | ২৪ জানুয়ারি ২০১৫ ২১:৪৪657803
  • এটা মন ভালো-খারাপের টই
  • Abhyu | 85.137.13.15 | ২৪ জানুয়ারি ২০১৫ ২৩:১৩657804
  • আলাদা করে কিছু লেখার নেই। গভীর কৃতজ্ঞতা জানাই দুজনকেই এতো গভীর লেখাগুলোর জন্যে।

    সে, আমাকে একটা মেল করবেন? আপনার বাবা কি "লেখক সমবায়"এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন?
  • ranjan roy | 24.96.184.141 | ২৪ জানুয়ারি ২০১৫ ২৩:২৩657805
  • সে,
    সত্যি ছড়িয়েছি। হ্যাঁ, গড়পারের বারীণ সাহা। প্রবাদপ্রতিম। বইটি "তেরো নদীর পারে"।
  • ranjan roy | 24.96.184.141 | ২৪ জানুয়ারি ২০১৫ ২৩:৩২657806
  • [ আমি আমার "বাঙালবাড়ির কিসসা"র শেষ চ্যাপ্টারটা তুলে দিলাম। আগে এখানে লিখিনি।]
  • ranjan roy | 24.96.184.141 | ২৪ জানুয়ারি ২০১৫ ২৩:৩৩657807
  • সরি,পিডিএফ বা এস টি এম এই পাতায় এলো না।
  • lcm | 118.91.116.131 | ২৫ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:১০657809
  • দুরন্ত! ব্যাথাতুর বিষয় দুজনের ফুরফুরে সোনার কলমে --
  • Pi | 122.79.37.135 | ২৫ জানুয়ারি ২০১৫ ১১:৩৫657810
  • লেখাগুলো চুপ করিয়ে দেয়।
  • Ishani | 69.92.140.146 | ২৫ জানুয়ারি ২০১৫ ১৮:০১657811
  • সাধনদা আমার পিসতুতো দাদা | কিন্তু বয়সে আমার বাবার চেয়ে বড় | বাবার সবচেয়ে বড় পিসিমার বড় মেয়ের বড় ছেলে | ছোট থেকে দেখে এসেছি , বাবা ডাকে "মামু", আর সাধনদাও উল্টে বাবাকে ডাকে "মামু" | সাধনদাদের , মানে আমার সেই লাবণ্য পিসিদের বাড়ি ছিল নিউ আলিপুরে | কী সুন্দর বাগান ঘেরা ধবধবে সাদা তিনতলা বাড়ি | নাকি চারতলা ? মনে নেই ! বাড়ির সকলকে মনে আছে | তার অন্যতম কারণ ..ছোট থেকে শুনে এসেছি, এই একটা বাড়ি..যে বাড়ির সব ছেলেমেয়েই লেখাপড়ায় উজ্জ্বল | সাধনদার পোশাকী নাম দেবব্রত | দেবব্রত বসু | যারা সংখ্যাতত্ত্বের চর্চা করেন, তাদের কাছে নামটা হয়ত খুব অপরিচিত নয় |

    একটি ছোট্ট ঘটনা দিয়ে শুরু করি | আমি তখন খুব ছোট | এই বছর পাঁচ --ছয় | আমাদের একটা নিয়মিত ব্যাপার ছিল, রাতের খাওয়াদাওয়া কোনো কোনো দিন তাড়াতাড়ি চুকে গেলে ভবানীপুর থেকে নিউ আলিপুর গিয়ে গল্পগুজব করা | সে এক এত হইহুল্লোড়ের বাড়ি , যে আমিও ঘুমকে ‘টা টা বাই বাই’ করে ও বাড়িতে গ্যাঁট হয়ে বসে গল্প গিলতাম | গিলতাম ..এই কারণেই বলছি, যে ও বাড়িতে আমার সমবয়েসী তেমন কেউ ছিল না | অর্ধেক কথা বুঝি, বাকিটুকু বুঝি না..কিন্তু ও বাড়িতে এত আদর পাই যে যাবার নামেই হামলে পড়ি |

    সেদিন শুনলাম, এবার খেলার সঙ্গী পাব | সাধনদা আর কল্যাণী বৌদি এখন বিদেশ ফেরত নিউ আলিপুরে | আমার তখন ওদেরকে খুব ভাসা ভাসা মনে আছে | শুনলাম সাধনদার মেয়ে চুমকি ..সে আমার চেয়ে অল্প ছোট আর ছেলে শান্ত তখন হয়ত বছর দুই হবে | সেদিন আমাদের ও বাড়িতেই নেমন্তন্ন | বাচ্চা বলতে তিনজন | আমি , চুমকি, শান্ত | খানিকক্ষণ চুমকির সঙ্গে খেলা করার পর টেবিলে আমাদের আগে খেতে দেওয়া হল | শান্তর গলায় বিব বাঁধা | কী একটা ঘ্যাঁট দেওয়া হয়েছে খেতে | সে যা না খাচ্ছে , মাখছে আর ছড়াচ্ছে বেশি | কল্যাণী বৌদি আড্ডায় মশগুল | মাঝেমাঝে এসে আমাদের পরিবেশন করে যাচ্ছে | বড়পিসি বলল, " এই দ্যাখো, শান্ত কিছুই খাচ্ছে না | কল্যাণী , ওকে খাইয়ে দিলে তো পারতে |"
    কল্যাণী বৌদি বলল , " ওভাবেই ঠিক শিখে যাবে মা | আপনার ছেলে বলে দিয়েছে , যেন বেশি আহ্লাদ না দিই | ছেলে তো , সংসারে যুদ্ধ করে বাঁচে হবে | এ নাকি তারই প্রস্তুতি |"
    এ কথা হয়ত এভাবে বলেনি..কিন্তু মোটের ওপর বক্তব্য তাই | মানে শান্ত ..তুমি স্বাবলম্বী হও | ছোট বলেই মাথা কিনে নাওনি | ওদিকে চুমকি ? সে লাল টুকটুকে ফ্রক পরা জাপানি পুতুল একটা | একেবারে সাহেব পাড়ার দোকানে কাচের শো কেসে যেমন | সে টেবিলে বসে বসে আমাকে ছবির বই দেখাচ্ছে | আর তার বাবা তাকে গোল্লা পাকিয়ে পাখিয়ে ভাত আর কাঁটা বেছে মাছ খাইয়ে দিচ্ছে | আদর করে, ভুলিয়ে ভালিয়ে | আমি নিজে নিজে খাই তখন | বড়পিসী বলল , " ওই দ্যাখো , মেয়ে সন্তানের বুঝি স্বাবলম্বী হতে নেই ? কোন শাস্তরে লেখা আছে রে সাধন ?" সাধন দা..এখনো ছবির মতো ভাসে চোখে..একটা ফিকে বাদামী পাঞ্জাবি আর সাদা পায়জামা পরা...পুরু কাচের চশমার আড়ালে ঝকঝকে দুটি চোখে বড়পিসিকে বলছে , " জন্ম ইস্তক তো পরের ঘরে ওর বসত মা | অন্তত কিছু ছোট ছোট খুশি যদি ওকে দিতে পারি ! যদি ওকে এটুকু বোঝাতে পারি..এটাই ওর নিজের জায়গা ..."

    আমি কিছুই বুঝলাম না | শুধু ফেরার পথে বাবাকে এক ঠ্যালা মেরে বললাম, " তুমি আমাকে কক্ষনো খাইয়ে দাও না ! সাধনদা কীই ই ই ভালো ! "

    চুমকি ,শান্ত বড় হল | লেখাপড়া শিখল | দুজনেই বিদেশ চলে গেল | বৌদি আর সাধনদা কলকাতায় | মাঝেমধ্যে ছেলেমেয়ের কাছে যায় | চুমকির বিয়ে হল এক বিদেশীর সঙ্গে |

    আমার নিজেরও ততদিনে বিয়ে হয়ে গেছে | চুমকির কথা একদিন কী প্রসঙ্গে উঠতে ঠাকুমা বলল , " সাধন আর কল্যাণীর তো চোখের মণি ওই মেয়ে | সত্যি কিন্তু ! কী হতভাগা বাপ তুই, অমন ফুটফুটে মেয়েটাকে ফেলে চলেই গেলি ?"
    আমি অবাক হলাম |
    -- মানে ?
    -- মানে আবার কী ! ও তো পালিতা কন্যা | সাধনের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বউ মেয়ের জন্ম দিয়েই মারা যায় | ওই চুমকির মা | তা ওর জন্মদাতা বাপ বাচ্চাটাকে অনাথাশ্রমে দিয়ে সন্নিসি হবার ফিকির খুঁজছে | তখন সাধনের বিয়ে হয়েছে মাত্র মাসখানেক | সম্বন্ধ করে | সাধন বন্ধুকে বলেছিল, 'বাচ্চা বিলিয়ে দিয়ে বিবাগী হবে ? তুমি কি পাগল হলে ?'
    বন্ধু বলল, " অত যদি দরদ, তুমি নাও না | নেবে ?"
    সাধনদা তোয়ালে জড়ানো বাচ্চাটাকে কোলে তুলে সটান হাজির করেছিল বাড়িতে | বড়পিসির পায়ের কাছে কার্পেটের ওপর শুইয়ে দিয়ে সব ঘটনা জানিয়েছিল | বড়পিসি বলেছিল , " কল্যাণী যা বলবে...তাই | "

    কল্যাণী কিছুই বলেনি মুখে | একরত্তি মেয়েটাকে বুকে তুলে নিয়েছিল |”

    তার চার বছর পর শান্ত | কেউ একটি দিনের জন্য চুমকির ভাঁড়ারে এক তিল কমতি আদর ভালোবাসা দেয়নি | দাদু-ঠাকুমা-কাকা-পিসি-মা -বাবা ..কেউ না | শান্ত সারা জীবন জেনে এসেছে , দিদি ওর রোল মডেল |

    চুমকিকে বড় হবার পর জানানো হয়েছিল সব কথা | চুমকি নাকি বলেছিল, " আমি এই বাবার মেয়ে | এই মায়ের মেয়ে | আর সব অচেনা | চিনতে চাই না |"

    চুমকি ছিল | শান্ত ছিল | কিন্তু সাধনদা আর কল্যাণী বৌদির স্নেহের পাল্লা ঝুঁকে থাকত চুমকির দিকেই | আমি একবার আমার মাকে বলেছিলাম, " অথচ দ্যাখো, শান্ত তো নিজের ছেলে ! "

    মা বলেছিল, " সন্তান যখন মায়ের গর্ভে আসে, মা খুশি হয় ঠিকই ; কিন্তু সে খুশি ছাপিয়ে থাকে নিজের শরীরের অস্বস্তি, অসুস্থতা , ভয় , দুশ্চিন্তা | সে নিজেকে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকে ভয়ে আর ভাবনায় | কিন্তু নারী যখন যে মুহূর্তে সন্তানের জন্ম দেয়, তার মুখ দেখে ..তখন তার নিজের অস্তিত্ব , ত্রিভুবন তার কাছে তুচ্ছ হয়ে যায় | ওই 'দেখার ক্ষণ' থেকে স্নেহের জন্ম | কল্যাণী যখন চুমকিকে বুকে তুলে নেয় , সেই মুহূর্তে ও মা হয়েছে | তার আগে তো নয় | তাই শান্ত যেমন, চুমকিও তাই |"

    -- আর সাধনদা ?

    --সাধনমামু সেই বিরল প্রজাতির মানুষ , যার হৃদয়ের মাপ আকাশের চেয়েও বড় | যে নীল আকাশের নীচে বড় নিশ্চিন্তে থাকা যায় |"

    অনেক পরে ..সাধনদা অ্যালজাইমারের শিকার | বৌদি হুইল চেয়ারে | ছেলে মেয়ে বিদেশে | আমি বলেছিলাম, "ইস , দুজনে..এই অবস্থায় একা একা..."

    বাবা অবাক হয়ে বলেছিল , "একা নয় তো ! চুমকি তো এখানেই | কলকাতায় | সংসার , স্বামী, ছেলেপুলে ..সব ওখানে | শান্ত আসে যায় ..| কিন্তু চুমকি থেকে গেছে | ও বাবাকে ছেড়ে মা ফেলে থাকতেই পারে না | শুধু .....সাধন মামু এখন আর কাউকেই চিনতে পারে না , কথা বলতে পারে না | এখন চুমকি সাধন মামুর মা হয়ে গেছে | রোল রিভার্সাল | বাপসোহাগী মেয়ে এখন বুড়ো -ছেলে অন্ত প্রাণ !"

    চলে গেছে দুজনেই | বেশ কয়েক বছর হল | সাধনদা আর কল্যাণী বৌদি |

    আমি এখনো চোখ বুজলেই দেখি , লাল টুকটুকে ফ্রক পরা জ্যান্ত পুতুল এক হাতে রং পেন্সিল ঘসছে ছবির বইয়ে , অন্য হাতে পাকিয়ে রাখা তার বাবার পাঞ্জাবির খুঁট | তার লাল টুকটুকে হাঁ-মুখে গোল্লা পাকানো ভাত আর মাছ |

    আমি চোখ বুজে ভাবি , আমি চোখ খুলে ভাবি , আমি নি:শ্বাস ফেলে ভাবি ...শুধু জন্ম দিলেই বাবা -মা হওয়া যায় না | বাবা মা হয়ে উঠতে জানতে হয় | আর শুধু জানলেই হয় না...বুকের মধ্যে আদিগন্ত নীল এক অনন্ত আকাশও লালন করতে হয় |
  • Abhyu | 85.137.13.15 | ২৫ জানুয়ারি ২০১৫ ১৯:১৭657812
  • http://en.wikipedia.org/wiki/Debabrata_Basu
    বাসু'স থিওরেম অন কমপ্লিট সাফিশিয়েন্ট স্ট্যাটিস্টিকস অ্যাণ্ড অ্যান্সিলিয়ারি স্ট্যাটিস্টিকস যে কোনো আন্ডারগ্র্যাডকেও জানতে হয়। আমাদের ওটা পড়িয়েছিলেন অরূপ বোস, আরেক দিকপাল। প্রমাণটা এতো এক্সাইটিং ছিল যে অরূপদা পর্যন্ত বলেছিলেন - স্মার্ট, ভেরি স্মার্ট। বাসুর কোনো পেপার তোমরা ব্ড় হয়ে পড়লে দেখবে ওনার প্রুফগুলো অসাধারণ।
    (বাসুর আরেকটা গল্প অন্য টইতে লিখবো, কিন্তু প্রথমবার ওনার কাজ দেখে এতো ভালো লেগেছিল যে না লিখে পারলাম না, রসভঙ্গ করার জন্যে দুঃখিত)
  • Ishani | 69.92.140.146 | ২৫ জানুয়ারি ২০১৫ ১৯:২৯657813
  • অভ্যু ,

    রসভঙ্গ হয়নি তো ! আমি ভাবছিলাম, কেউ হয়ত পড়ছেন এই লেখা... যিনি সাধনদার নামের সঙ্গে পরিচিত | এই বসু পরিবারের মতো এত সর্বাংশে ও সর্বার্থে শিক্ষিত , পরিশীলিত পরিবার আমি সত্যিই খুব কম দেখেছি | এবং তজ্জনিত মুগ্ধতাবোধ আজও একই রকম অম্লান |
  • Abhyu | 85.137.13.15 | ২৫ জানুয়ারি ২০১৫ ১৯:৪৪657814
  • তখন এম স্ট্যাট ফাইনাল ইয়ার। পাঁচ বছর স্ট্যাটিস্টিকস পড়ে এক কথায় মুগ্ধ হবার বয়স চলে গিয়েছে। সেকেন্ড কোর্স অন সার্ভে স্যাম্পলিঙ চলছে। ততদিনে স্যাম্পল সার্ভে বলতে বুঝি ভেরিয়েন্স অফ এস্টিমেট আর এস্টিমেট অফ ভেরিয়েন্স - হ্যাট, হ্যাটের উপর হ্যাট এই সব!
    অরিজিত বাবু (চক্রবর্তী) পড়াতে এসে একটা গল্প বললেন। আই এস আইয়ের পিছন দিকে একটা অফিসে ভারত সরকারের সেন্সাসের ডেটা অ্যানালাইজ করা হত, সেখানে এক ভদ্রলোক দেখলেন উনি যতবারই ভেরিয়েন্স ক্যালকুলেট করেন, দেখেন যে মিনের ভেরিয়েন্স সবচেয়ে কম হচ্ছে। ব্যাপারটা কি রকম? বুঝবার জন্যে উনি এলেন সি আর রাওয়ের কাছে। রাও বললেন তুমি যাও ডি বাসুর কাছে। বাসু শুনেই আন্দাজ করলেন যে এর মধ্যে কমপ্লিট সাফিশিয়েন্ট স্ট্যাটিস্টিকসের কোনো একটা ভূমিকা আছে। এই ভাবেই জন্ম নিল ডিশিশন থিওরেটিক অ্যাপ্রোচ টু সার্ভে স্যাম্পলিং। আমার জিনিসটা খুব এক্সাইটিং লেগেছিল, তখনই স্মল এরিয়া এস্টিমেশন জিনিসটা মনে ধরে যায় - তারও দশ-পনের বছর পর এখন ঐ লাইনে আমি অল্প কাজ করছি।
  • Abhyu | 85.137.13.15 | ২৫ জানুয়ারি ২০১৫ ১৯:৪৭657815
  • ঈশানীদির কথায় উৎসাহ লিখে দিলাম অন্য গল্পটাও। JKG ও অন্যান্যদের মুখে ডি বাসুর কথা শুনেছি - ওনার মত "সর্বাংশে ও সর্বার্থে শিক্ষিত , পরিশীলিত" ব্যক্তি খুব কম ছিলেন।
  • se | 188.83.87.102 | ২৫ জানুয়ারি ২০১৫ ২২:৫২657816
  • হোক, আরো ।
  • NINA | 83.193.157.237 | ২৬ জানুয়ারি ২০১৫ ০৪:০০657817
  • অপূর্ব্ব টই ---- চলুক চলুক------
  • TaCh | 81.252.246.44 | ২৬ জানুয়ারি ২০১৫ ০৮:২৩657818
  • D Basu আমাদের inference পড়িয়ে ছিলেন। বড় ভালো পড়াতেন।
    অরিজিত বাবুর নাম Arijit Chowdhury, চক্কত্তি নয়।
    চলুক ---
  • Abhyu | 85.137.13.15 | ২৬ জানুয়ারি ২০১৫ ০৮:৩৭657820
  • খুব সরি, অরিজিত চৌধুরী http://www.isical.ac.in/~achau/
  • TaCh | 81.252.246.44 | ২৬ জানুয়ারি ২০১৫ ০৮:৪৭657821
  • শুনেছি, D Basu এর আরেক নাম ছিলো Mr. Counter Example। উনি নাকি instant counter example জেনারেট করতে পারতেন। তাই নাকি ওনাকে সকলে সমিহ করতেন।
  • :) | 127.194.202.97 | ২৬ জানুয়ারি ২০১৫ ১১:২২657822
  • ISI টই হাইজ্যাক করছে। কালো হাত ইত্যাদি ...
  • TaCh | 81.252.246.44 | ২৬ জানুয়ারি ২০১৫ ১৮:২২657823
  • সমীহ
  • Ishani | 69.92.141.191 | ২৬ জানুয়ারি ২০১৫ ২০:২৭657824
  • আগে বাপের কথা বলি | তারপর তার সোহাগী মেয়ের কথা |

    ছেলেটা লেখাপড়ায় ভালো ছিল | স্কটিশ চার্চ কলেজিয়েট স্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিকে ১৯৭০ সালে নবমস্থান অধিকার | প্রাপ্ত নম্বর ৯০১ | সে ছিল পুরোপুরি তার মায়ের ছেলে | বাবা , বিধবা নি:সন্তান জ্যাঠাইমা ছিলেন বটে, কিন্তু তার খাওয়া , খেলা , পড়াশুনো সবকিছু মা-কেন্দ্রিক | বাবা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাপ্লায়েড ফিজিক্সের ছাত্র ছিলেন | এই ছেলেটিরও ফিজিক্সে অনুরাগ | ছেলেটি যখন ক্লাস নাইনে পড়ে , তার পায়ের তলার জমিটা কেমন নড়বড়ে হয়ে গেল | একেবারে আচমকা | তার মায়ের হৃদযন্ত্র বিদ্রোহ করে কাজকর্ম বন্ধ করে দিল | মায়ের বয়স তখন ত্রিশের কোঠায় | মায়ের আর শখ পূরণ হল না | ছেলের নাম খবরের কাগজে ছাপা হবে , সে দেখবে ... খুব সাধ ছিল | ছাপা হল নাম, শুধু দেখা হল না | আর ছেলেটা ? সে এক ঝটকায় বড় হয়ে গেল | মৃত্যু মানুষকে কত তাড়াতাড়ি পরিণতমনস্ক করে দেয়, তাই না ? এরপর বাড়িতে বাবা আর বিধবা জ্যাঠাইমা | ছেলেটা সেন্ট জেভিয়ার্স থেকে ফিজিক্সে প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হল | প্রথম শ্রেণী পেল স্নাতকোত্তর স্তরেও | তারপর গবেষণার কাজ শুরু হতে হতেই অধ্যাপনার চাকরি জুটে গেল স্কটিশ চার্চ কলেজে | অগত্যা পার্ট টাইম রিসার্চ | এর মধ্যে আবার প্রেম এসে গুনগুন করে গেছে কানে কানে | সহপাঠিনী | আশাপূর্ণা দেবীর দৌহিত্রী | নভেম্বর ১৯৮০ তে বিয়ে হয়ে গেল | মেয়েটিও তখন গবেষণা করে |

    একটি কন্যাসন্তান জন্মাল | ২৭ শে মে , ১৯৮৪ তে | মেয়ের নাম রাখা হল "অচিরা " | রবীন্দ্রনাথের "শেষ কথা" খুব প্রিয় গল্প ছিল দম্পতির |

    এবার কন্যাপ্রসঙ্গ | বাচ্চাটি বড় হল | বাড়িতে অনেক দিন বাদে শিশুর হাঁটে চলে , কথা বলা | দাদু , বড় দিদা, মা আর বাবা | সে সকলের চোখের মণি |
    একটু বড় হয়ে ভর্তি হল ভারতীয় বিদ্যাভবনে | সে লেখাপড়ায় ভালো |

    কিন্তু যখন মাত্র ৮ বছর বয়স, মাত্র ক্লাস থ্রী ..তার মায়ের কী যে হল ..ভীষণ কাশি | রোগ সারে না | ডাক্তার, বদ্যি | নির্জীব হয়ে যায় দিনে দিনে |

    সেদিন অচিরার স্কুলে স্পোর্টস | তার মা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল , "আজ নাই বা গেলি |" যা:, তাই হয় ? কত্তগুলো প্রাইজ বাঁধা ! অচিরা ফিরে এসে মাকে দেখতে পায়নি | অনেক প্রাইজ এনেছিল দু'হাত ভ'রে |

    আমি এই পরিবারের সঙ্গে ভীষণভাবে জড়িয়ে আছি ১৯৮০ সাল থেকে | এই মৃত্যুসংবাদ পেলাম ব্যাঙ্গালোরে বসে | মনে আছে , খুব কাঁদছি ফোনে, তখনও দাহ হয়নি..আমাকে অচিরার বাবা বলেছিল, "কষ্ট পেও না | সব ঠিক আছে | আমিও ঠিক আছি | "
    আমি বলেছিলাম, "কিন্তু টিংকি (অচিরার ডাকনাম ) ?"
    -- আমি তো আছি |
    -- এত কচি বয়সে মা ছাড়া...
    -- কচি ...তা একটু ..বলতে পারো | আমি মাকে আর একটু বেশি পেয়েছিলাম | আর ছ 'বছর বেশি | ভেবো না | ও ঠিক থাকবে | তুমি তো আসবে, তখন দেখেই বুঝতে পারবে |

    গিয়ে বুঝলাম ... একজন পুরুষমানুষ একই সঙ্গে কী করে বাবা -মা দুইই হতে পারে | মেশোমশাই পুরোনো কথা বলে হা হুতাশ করেন , জ্যাঠাইমা আঁচলে চোখ মোছেন , টিংকি গা ঘেঁসে এসে দাঁড়ায় ড্রয়িং খাতা নিয়ে | আর ওর বাবা ? দশ হাতে দুই বুড়ো বুড়ি আর এক অবোধ শিশুকে সামলিয়ে কলেজের খাতা দেখে, নোট তৈরী করে | মেয়ের কোনো আয়া নেই , কাজের মাসি নেই দেখাশুনো করার , ঘরে পড়ানোর দিদিমনিও নেই |

    এরপর দুটি অবধারিত মৃত্যু | দুই বৃদ্ধ বৃদ্ধার | শুরু হয় বাপ-বেটির সংসার | আমি কলকাতায় গেলেই সরেজমিনে দেখে আসি | খুঁত খুঁজে পাই না | অচিরার মামার বাড়ি থেকে ওকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল | মানুষ করবে বলে | এরা দেয়নি | ফলে সম্পর্ক ওদিকেও খুব ক্ষীণ |

    অচিরার বালিকা থেকে নারীত্বে উত্তরণ ...এই দীর্ঘ সময়ে তার যাবতীয় সংশয় আর প্রশ্ন , তা শারীরিক হোক বা মানসিক..উত্তর যুগিয়েছে তার বাবা | সে কোনো বান্ধবীর কাছে, কোনো পাড়ার দিদি বা মাসির কাছে যায়নি | তার বাবা তার "সব-পেয়েছির দেশ "| তার কাছে "আমার বাবা সব জানে"|

    অচিরা ঝকঝকে রেজাল্ট করে ভর্তি হয় প্রেসিডেন্সি কলেজে | তারপর স্নাতকোত্তর স্তর | তারপর টি আই এফ আর -এ পি এইচ ডি | এখন পোস্ট ডক্টরাল ফেলোশিপ নিয়ে আমেরিকায় | এখনও বিয়ে করেনি | করবে কিনা জানি না | পড়াশুনো নিয়ে মজে আছে | বাবা যায় ওর কাছে | ও আসে দেশে |

    তার মুখে কোনদিন কোনো অভাববোধের কথা শুনিনি | শুধু একবার.. যখন সে আমার কাছে এসেছিল | এম.এস . সি পরীক্ষার পর | দিন দশেকের ছুটিতে | বলেছিল, " তুমি আমাদের সেই অন্যরকম বাড়িটা দেখেছ, তাই না ? যখন বাড়িতে..কত লোক ! যখন সবাই ছিল ?"

    আমার বাবা একবার প্রসঙ্গক্রমে বলেছিলেন, "একা হাতে একটি আট বছরের কন্যাসন্তানকে কীভাবে বুকে আগলে রেখে বড় করা যায়... অরূপ দেখিয়ে দিল | "

    অচিরা এখন বিদেশে | তার বাবা ...পরিচয় দিয়েই দিই | স্কটিশ চার্চ কলেজের পদার্থবিদ্যার সদ্য-অবসর নেওয়া অধ্যাপক অরূপ রায় |

    অরূপদা যখন অচিরার কাছে যায় .. সে একরকম | কিন্তু অন্য সময়ে ?

    আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম , "খুব একা লাগে ? টিংকি অত দূরে ..."

    -- একা লাগবে কেন ? কলেজ ছিল যতদিন, নিয়মিত প্রতি সপ্তাহে যেতে পারতাম না..এখন পারি.. ওখানে একটা ছোট ঘর আছে আমার | ওদের মধ্যে খুব ভালো থাকি | ওখানে আমার অনেক সন্তান |

    কোথায় ? আমলাশোল | যে গ্রাম আর তার উন্নয়ন বারবার সংবাদপত্রের শিরোনামে উঠে এসেছে এক সময়ে | অরূপদা সেই গ্রামের বাচ্চা বুড়ো নির্বিশেষে সকলের "বাবা "| নিজের সঞ্চয়ের সিংহভাগ , বৌদির যা কিছু টাকাপয়সা ..সব আমলাশোলে ব্যয় হয়েছে | সেখানে শবর শ্রেণীর অগুন্তি শিশু আজ পেট ভরে ভাত খেয়ে পাঠশালায় পড়ে | আমলাসলে আজকাল সত্যিকারের সূর্য ওঠে | সকাল হয় | রোদ্দুরে ভেসে যায় উঠোন , ঘর, দুয়ার | এই মানুষটির জন্য |

    আর অচিরা | অচিরাকে তার বাবা জন্মের পর থেকে একটিবারের জন্যও নাম ধরে ডাকেনি | "মা"কে কি নাম ধরে ডাকে কোনো ছেলে ?

    অচিরা তাই তার বাবার "মা "| সেই চোদ্দ বছর বয়সে হারিয়ে যাওয়া মা |

    অচিরা তাই স্বদেশে থাকুক বা বিদেশে ...ও বাড়ির সারা ঘর বারান্দা জুড়ে যে কী ভীষণ "মা -মা" গন্ধ ভেসে বেড়ায় ! সে গন্ধ পায় তার বাবা | বছরভ'র |

    আর আমি যখন যাই...আমিও |
  • Arindam Chakrabarti | ২৬ জানুয়ারি ২০১৫ ২০:৩৭657825
  • দুর্দান্ত। তবে যদি খুব ভুল না করি তাহলে অরূপ রায় একসময়ের দিন বদল পালার একজন সৈনিক ছিলেন।
    লৌহ মানব বোধহয় এদেরই বলে।
  • byaang | 132.167.87.185 | ২৬ জানুয়ারি ২০১৫ ২০:৪৫657826
  • আমি স্যারের ছাত্রী ছিলাম একানব্বই সাল থেকে তিরানব্বই অব্দি। স্যারের ক্লাস করা ছিল একটা অভিজ্ঞতা বটে। মানুষটা ছাত্রছাত্রীদের থেকে শ্রদ্ধা আদায় করে নিতে জানতেন। এই একটি মানুষের সামনে কলেজের বাঘা বাঘা বিচ্ছুরাও একদম মাটির মানুষ হয়ে যেত। এমনি ছিল স্যারের ব্যক্তিত্ব। ফিজিক্স প্র্যাক্টিকাল ক্লাসে বহু জিনিস এত সুন্দর করে হাতে ধরে শিখিয়েছিলেন যে আজও ভুলি নি।
    ঈশানী, স্যারকে আমার প্রণাম জানাবেন।
  • Ishani | 69.92.141.191 | ২৬ জানুয়ারি ২০১৫ ২০:৫২657827
  • একটি ভুল হয়েছে | অচিরার জন্ম ২৫ শে মে , ১৯৮৪ .

    হাঁটাচলা *
  • Ishani | 69.92.141.191 | ২৬ জানুয়ারি ২০১৫ ২১:০১657828
  • আমি অরূপদার প্রথম ছাত্রী | আমি বলি, আমার ওপর দিয়েই হাত পাকানো | শুধু চড় , কানমলা , গাঁট্টাই যা বাদ | তা ছাড়া ...বকুনি আর কী যে অত্যাচার ..কী বলব | অবশ্য আমিও অত্যাচার কম করিনি | মাস্টারমশাই হিসেবে দেখিনি কখনও | আত্মীয় বলেই ভাবি | যিনি আত্মার প্রিয় | আমি এবং আমার মা বাবাও | আর এও জানি, যখন আমার বাবা মা থাকবেন না..কলকাতায় ওটাই আমার "বাপের বাড়ি " আর আবদার অত্যাচারের জায়গা |

    নিশ্চয়ই জানাবো | কিন্তু ..ব্যাং ..মানে কেমন একটা শোনাচ্ছে না ! আমি তো আপনার পোশাকী নাম জানি না |
  • kiki | 125.124.41.34 | ২৬ জানুয়ারি ২০১৫ ২৩:২৮657829
  • সবচেয়ে বিচ্ছু মেয়ে বলো, ঠিক চিন্তে পারবেন মনে হয়।:P
  • সে | 188.83.87.102 | ২৭ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:০৮657831
  • অরূপ রায়ের ক্লাসে আমিও পড়েছি। খুব রাগী ছিলেন। চোখে চশমা, এক মুখ গোঁফদাড়ি। বেশ ভয় পেতাম। এখন অন্যরূপে চিনলাম।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে মতামত দিন