এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • ranjan roy | 192.69.154.221 | ১২ জুন ২০১৫ ১৮:২১678513
  • ফেরারি ফৌজ
    ========
    [ আগের উপন্যাসে মেয়েদের দৃষ্টিকোণ থেকে সশস্ত্র বামপন্থী আন্দোলনের অন্তঃপুরের কিছু ছবি আঁকার চেষ্টা করেছিলাম। মনে হচ্ছে, তাহলে ছেলেদের দিক থেকে দেখাটাই বাকি থাকে কেন? তাই সাহস করে দুগ্গা বলে ঝুলে পড়লাম। এতে অবশ্যই আগের "অথ নকশাল বধ কথা'র কিছু অংশ থাকবে। দেখা যাক। বনত বনত বনি যাই, বিগড়ি বনত বনি যাই।]
  • ranjan roy | 192.69.154.221 | ১২ জুন ২০১৫ ১৮:২২678541
  • ফেরারি ফৌজ
    =========

    প্রথম ভাগ

    (১)

    রিক্রুট
    =====
    -- এই বাড়িটা?
    -- না, না। ওই হলদে দোতলা বাড়িটার পরেরটা, কোল্যাপসিবল গেটওলা ছাইরঙা।
    গ্রিলঘেরা বারান্দায় বসে একা একা গিটার নিয়ে টুং টাং করতে থাকা ভদ্রলোক বিরক্ত হন নি। বাইরে বেরিয়ে এসে বাড়ি দেখিয়ে দিয়ে স্মিত হেসে ফিরে গেলেন। আমি কিন্তু কিন্তু করে ধন্যবাদসূচক কিছু বলার উপক্রম করতেই মাথা নেড়ে ভেতরে চলে গেলেন।
    এবার আমার অবাক হওয়ার পালা। এই বাড়িটা? এতবড় পেল্লায় বাড়ি? ভদ্রলোক ভুল করেন নি তো?
    খাড়া চারতলা উঠে যাওয়া বাড়িটার গায়ে কোন সাইনবোর্ড নেই, কোল্যাপসিবল গেটটি ভেতর থেকে তালাবন্ধ।দেয়ালের গায়ে বাড়ির নম্বর লেখা। হাতেধরা চিরকুট থেকে সেটা মিলিয়ে নিয়ে বেল টিপে দিই। ওপাশে একটি সদ্য গোঁফের রেখা দেখা দেওয়া মুখ।
    -- কাকে চাই?
    --- বিমলেন্দুবাবু আছেন?
    ও গেটের ফাঁক দিয়ে একটি স্লিপ ও পেনসিল বাড়িয়ে দেয়।
    --- আপনার নাম পরিচয় লিখে দিন।
    বিনাবাক্যব্যয়ে বড় বড় করে লিখে দিই , নীচে বন্ধনীর মধ্যে --বাল্যবন্ধু। ছেলেটি মিলিয়ে যায়।

    অপেক্ষা করতে করতে চারদিক দেখতে থাকি। দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছর পর দক্ষিণ শহরতলীর এই পাড়াতে পা রেখেছি। ভিন রাজ্যের চাকরি থেকে রিটায়ার করে। এত বদলে গেছে এলাকাটা? আগে ঢাকুরিয়া পুল পেরোলে কোলকাতা বলা হত। আর দেদার মাঠঘাট পানা পুকুরে ভরা এই পাড়াগুলো ছিল উদ্বাস্তুদের জবরদখল কলোনি। এখন কোথাও সবুজের চিহ্ন নেই। বিমলেন্দুর এই বাড়িটাও ছিল জবরদখল জমিতে রাংচিতের বেড়া, চাটাইয়ের দেওয়াল ও টালির ছাদ দেওয়া একফালি ঘর।সেখানে এই?
    মনে পড়ে এক ধু ধু রোদ্দূর ঘেমো দুপুরে ওদের বেড়ার গায়ে গাছের ডাল দিয়ে তৈরি আগড়টা আস্তে আস্তে খুলে ওদের ঘরে উঁকি মেরেছিলাম। একটা তক্তপোষ, তাতে শুয়ে ওরা তিন ভাইবোন। একপাশে বড়দা, মাঝে বিমলেন্দু আর এপাশে ছোট বোন আশা। তিনজনে গায়ে গায়ে জাদুঘরের মমির মত শুয়ে। কেউ পাশ ফিরতে পারে না, তাহলে একজন
    ঠিক গড়িয়ে মাটিতে পড়ে যাবে। ঘরে পাখা নেই। তিনজনের মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে থাকি। সেই বিকেল ঘনিয়ে আসা আবছা অন্ধকারে চোখে পড়ে সদ্য কৈশোরের চৌকাঠ ডিঙোনো মেয়েটির বুক, নি;শ্বাসের সঙ্গে উঠছে নামছে।
    আমার কেমন ভয় ভয় করছিল। পা টিপে টিপে পালিয়ে আসি। আচ্ছা, ওই পাশটায় একটা বড় তালগাছ ছিল না? আর এক দুপুরে স্কুলে না গিয়ে আমরা ওই গাছটার তলায় ওদের বাড়ি থেকে আনা মাদুর পেতে শুয়ে বসে গল্প করে কাটিয়ে ছিলাম। ওটা বোধ্হয় কাটা পড়েছে।আমরাও তো তাই।
    আমরা সেই সত্তরের আঠেরো বছর বয়স। আমরা সেই সময়ের কাটা সৈনিক। আমি আর বিমলেন্দু। আমি অজ্ঞাতবাস থেকে বেরিয়ে কলমপেষা চাকুরিজীবি। কিন্তু বিমলেন্দু?
    সত্তরের দশকে সিপিআই(এম-এল) এর বাংলা -বিহার-উড়িষ্যা সীমান্ত কমিটির প্রমিজিং অর্গানাইজার বিমলেন্দু? বাঁকুড়া ডিস্ট্রিক্ট জেল এর দেয়াল টপকে দু'দিন বাদে ধরা পরা বিমলেন্দু?
    ও আজ পোষাক তৈরির কারখানার মালিক। টালির বাড়ির জায়গায় পাকা চারতলা।
    ,
    আমরা একই ক্লাসে পড়েছি, ফুটবল খেলেছি, নানান ছেলেমানুষি ঝামেলায় জড়িয়েছি, মনে মনে এর-ওর-তার প্রেমে পড়েছি। তারপর আঠেরো বছর বয়সে সত্তরের কালবৈশাখীর ঝাপটায় ছিটকে পড়েছি। ও রাঢ় বাংলার দক্ষ সংগঠক। আমি হিন্দি বলয়ে। ওর ধরা পড়ার খবর যুগান্তর পত্রিকায় পড়েছি। ৭৭ এর জরুরি অবস্থা উঠে গেলে সমস্ত রাজবন্দীদের সঙ্গে ছাড়া পাওয়ার খবরও পেয়েছিলাম।
    প্রকৃতির নিয়মে ঝড় থেমে গেলে এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে ভাঙা ডাল, শুকনো পাতা, পাখির বাসা।
    আমি হিন্দিবলয়ে ব্যাংকের কর্মচারী। ও লক্ষী কাটরা গণেশ কাটরা,কাটা কাপড় নিয়ে বসার শেষে মঙ্গলাহাটের পথ পেরিয়ে এখন রেডিমেড পোষাক বানায় বলে খবর পেয়েছি। আমি কি ওকে হিংসে করি? জানিনা।
    কিন্তু অদম্য কৌতূহলে দেখতে এসেছি একদা বিপ্লবের পথে পা বাড়ানো প্রান্তিক খেটেখাওয়া মানুষের দক্ষ সংগঠক কমরেড বিমলেন্দু কেমন করে একটি ছোটখাট পোষাক তৈরির ফ্যাক্টরির মালিক হয়ে উঠলেন।
    গেট খুলে গেল। চশমা চোখে দীর্ঘদেহী সুদর্শন সাফারি স্যুট পরা ভদ্রলোকটি একগাল হেসে আমাকে জড়িয়ে ধরেছেন, দামী সুগন্ধির অস্তিত্ব টের পাই, একটু যেন গুটিয়ে যাই।
    --আয়, আয়!
    --- তোর অফিসটাকে জেলখানা বানিয়েছিস কেন?
    --- আর বলিস না! সেলট্যাক্সের লোকজন এসে বড্ড বিরক্ত করে। আমি অনেস্ট ব্যবসা করি। ওদের খাঁই কী করে মেটাবো?
    উৎসাহের সঙ্গে ও দেখিয়ে চলে এক একটা বিভাগ। নীচের তলায় র' মেটেরিয়াল। কাটা কাপড়ের স্টক। দোতলায় ফিনিশড গুড্স। তিনতলায় ডিসপ্লে আর প্যাকিং। চারতলায় খাতাপত্তর হিসেবনিকেশ।
    আর তিনতলায় ওই ছোট্ট ঘরটায় আমার অফিস। এখানে গরম, চল ওখানে আরাম করে বসি, এসি চলছে। পরিচয় করিয়ে দেয় ছেলের সঙ্গে । জানায় ওর ব্র্যাণ্ডের নাম। পোষাক যায় কোলকাতার মলে, বেঙ্গালুরুতে, মুম্বাই, আমেদাবাদে আর বাংলাদেশে। ওর এসি অফিসে আয়েশ করে বসি। কফিতে চুমুক দিই।
    কথায় গল্পে বিকেল ফুরিয়ে কখন সাঁঝবাতি জ্বলে উঠেছে। ওর ছেলে এসে ঢোকে, হাতে পিতলের জ্বলন্ত প্রদীপ। খেয়াল হয় ঘরের কোণায় স্টিল এজ কোম্পানির তৈরি মজবুত সিন্দুক, তার উপরে গণেশ ও লক্ষ্মীঠাকুর। ছেলেটি ধূপকাঠি ধরিয়ে মূর্তিগুলোর সামনে গুঁজে দেয়। প্রদীপ তিনবার ঘুরিয়ে নীচুগলায় কিছু বিড়বিড় করে।
    তারপর ওর বাবার সামনে এসে দাঁড়ায়। বিমলেন্দু আমাকে দেখে , একমুহুর্ত থমকায়, ইতস্ততঃ করে।তারপর দুহাতের অঞ্জলি দীপশিখায় ছুঁইয়ে মাথায় ঠেকায়। ছেলেটি আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। আমি একটু হেসে মাথা নাড়ি। ওর চোখ দপ্‌ করে জ্বলে ওঠে।
    --আপনি চান না আমাদের কল্যাণ হোক? আমাদের কোম্পানির মঙ্গল চান না?
    বিমলেন্দু লজ্জা পেয়ে ওকে নিরস্ত করার চেষ্টা করে।
    আমি কথা না বাড়িয়ে বিমলেন্দুর অনুকরণ করি। ছেলেটির মুখের ভাঁজ মিলিয়ে যায়।

    এবার বিমল ছেলের সঙ্গে চোখের ইশারায় কিছু বলে। তারপর আমাকে বলে-- চল। আজ পার্ক স্ট্রিটে আমার সঙ্গে ডিনার খাবি। মোকাম্বোয়। তারপর তোকে বাড়ি পৌঁছে দেব।
    পার্ক স্ট্রিট? তাহলে তো মেট্রো ধরতে হবে। এখান থেকে রিকশ করে যাবো?
    তুই না আজীবন একই রকমের ল্যাবেন্ডিশ রয়ে গেলি। আমার গাড়িতে যাবি।
    তোর ছেলে?
    ওর আলাদা গাড়ি আছে, বন্ধুদের ঠেকে যাবে। ওকে ভুল বুঝিস না। ও ওইরকম, কিন্তু মনটা ভাল। আসলে বিজনেস অন্তঃপ্রাণ। আর আমি আজও ঠাকুরদেবতা মানি না। ভাগ্য মানি না। পুরুষকারেই বিশ্বাস করি। কিন্তু ওকে কষ্ট দিতে চাই না। একটাই ছেলে। শুধু ছেলে নয়, আমার বন্ধুও বটে। জানিস, আমরা নতুন নতুন ডিজাইনের খোঁজে প্রতি বছর ব্যাংকক যাই। সেখানে একটা পাড়া আছে। ওঃ, তুই তো এসব খবর রাখিস না। হিন্দিবলয়ের গাঁয়ে ছিলি? আচ্ছা, 'বাই বাই ব্যাংকক' সিনেমাটা দেখেছিস? আমার কাছে ডিভিডি আছে, নিয়ে যাস।
    ওর গাড়ি চলতে থাকে। অনেক গল্প শোনায়। কঠিন জীবনসংগ্রামের গল্প। কাঠুরে থেকে বণিকপুত্তুর হয়ে ওঠার গল্প। আমার একটু শীত শীত করে। কত কথা যে জিজ্ঞেস করব ভেবেছিলাম।
    সুখাদ্য-সুবচনের সঙ্গে দামী পানীয় আসে। লজ্জা পাই।
    --অ্যাই, আমার জন্যে এত খরচ করতে হবে না।
    --- ওরে! এটা হল গুরুদক্ষিণা। তুইই তো আমাকে ওপথে এনেছিলি, বুঝিয়েছিলি। আমি ছিলাম তোর প্রথম রিক্রুট!
    -- যত ফালতু কথা! আচ্ছা, বল তো আমরা কি ভুল করেছিলাম? আজ তোর কী মনে হয়?
    ও চুপ মেরে যায়। নখ খোঁটে।
    -- তা বোধহয় নয়। আমাদের মধ্যে কোন ফাঁকি ছিল না। তবে বড্ড বেশি আবেগ ছিল, যুক্তি আর বিশ্লেষণের ধার ধারেনি কেউ। জানিস, কানু সান্যালের সুইসাইডের খবরটা পড়ে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলেছিলাম বউ--ছেলে অবাক।
    --- সে কী রে!
    -- হ্যাঁ, বিপ্লবী আত্মহত্যা করবে? কেমন যেন হেরে গেছি মনে হল।
    দামী পানীয় এবার খেল দেখাচ্ছে। ও নাক টানছে।
    --আচ্ছা, তোর সেই বনবাসের দিনগুলোতে সবচেয়ে স্মরণীয় গল্প কোনটা ?
    -- কী রে শ্লা! চ্যানেলের রিপোর্টার হয়ে গেলি?
    --- আঃ, বল না!
    --চল, ফেরার পথে বলব।

    বাঁকুড়ার সাঁওতাল গ্রামে আছি। একদিন খারাপ খবর এল। এলাকার প্রভাবশালী বাম দলের দাপুটে সাঁওতাল নেতা জনা পঞ্চাশেক সশস্ত্র লোক নিয়ে আমাদের গ্রামের সীমানায় ডেরা লাগিয়েছেন। একটাই দাবি-- কোলকাতা থেকে আদিবাসী ক্ষেপিয়ে এলাকাকে অশান্ত করতে আসা দিকু ছেলেটিকে ওদের হাতে তুলে দিতে হবে। গাঁয়ের মোড়ল ওদের সঙ্গে তর্ক করছেন, কিন্তু আর কতক্ষণ?
    মেঝেনরা বলল- শোন, দিকু! তুর ভয় নাই। উয়াকে বুইলেছি আগে দিকুর কথা শুন। যদি বেঠিক লাগে তবে উকে ছেড়ে দিব। আগে শুন।
    আমি ওদের সামনে গেলাম। ভয় পেয়েছিলাম। অগত্যা। কী বলেছিলাম আজ মনে নেই। তবে কোন মার্ক্স-লেনিন নয়। বলেছিলাম আমরা গরীবের জন্যে কাজ করি। তোমরাও কর। তোমাদের সঙ্গে কোন শত্রুতা নেই।চল, একসঙ্গে কাজ করি। সুযোগ দিয়ে দেখ টুকুন।
    আমরা আন্দোলন না করলে কোলকাতায় লালবাড়িতে দিকুদের সরকার আমাদের মাঝি-মেঝেনদের কথা শুনবে কেনে?
    ওরা মারতে এসে বন্ধু হয়ে গেল।

    ড্রাইভার ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষেছে। সামনে একটা ছোটখাট জটলা। জানলা দিয়ে চোখে পড়ছে দুটো মেয়েকে মারছে জনা পাঁচেক লোক। কেউ কিছু বলছে না।
    আমি দরজা খুলে নামার চেষ্টা করতেই বিমলেন্দু হাত চেপে ধরে।
    --- পাগলামি করিস নে। ফালতু ঝামেলায় জড়াস না।
    -- সে কী! তুই একথা বললি?
    --- হ্যাঁ, দিনকাল পালটেছে।আমরা এখন আঠেরো নই, ষাটের দলে। যা করার আজকের আঠেরো করবে। ওদের কাজ আমরা কেন করব?

    বাড়ির দরজায় নামার সময় ওকে ধন্যবাদ দিতেই হাত চেপে ধরে বিমলেন্দু।
    -- ওকথা বলিস না রে! আমি যে তোর প্রথম রিক্রুট!
    আমি হেসে ফেলি। স্খলিত গলায় বলি-- সেসব কখনো হয়েছিল। দু'কুড়ি বছরেরও আগে। আজ আমি তোর রিক্রুট।
    ========================
  • ranjan roy | 192.69.53.140 | ১৪ জুন ২০১৫ ০১:১৪678552
  • ========================
    ২)
    ' এ পথে আমি যে গেছি বারবার'
    -------------------------------------
    এই যে কাকু, বাঘাযতীন নামবেন বলছিলেন না? এসে গেছে।
    কন্ডাক্টরের কথায় চটকা ভাঙে।হুড়মুড়িয়ে উঠে নামার উদ্যোগ করি।
    -- বেঁধে বেঁধে, বুড়ো মানুষ নামছে।
    মুচকি হাসি। কত বুড়ো হয়ে গেছি! অবশ্যি নন্দিতা বলে -সাতবুড়োর এক বুড়ো। কিছু লোক জন্মবুড়ো হয়। ছোটবেলা থেকেই বড়দের গল্প হাঁ -করে গেলে, বড়দের আদলে পাকা পাকা কথা বলে। এই ধরণের লোকগুলো খুব অ্যাটেনশন -সীকার হয়। তোমার দাদাটিও তাই।
    দাদার ন্যাওটা বোন এতটা নিতে পারে না।
    -- কী যে বল বৌদি! দাদা ছোটবেলা থেকেই অন্যরকম, আমাদের থেকে একটু আলাদা। একটু ভাবুক গোছের।
    --হ্যাঁ, হ্যাঁ, মাথায় সারাক্ষণ একটা ভাবের ঘুঘু ডাকছে।কিন্তু সংসার তো ভাবের ভেলায় ভেসে চলে না। দায়িত্ব নিতে হয়। তোমার এই গুণধর দাদাটি কোনদিন সংসার নিয়ে কিছু ভেবেছে? মেয়ে হবার সময় বাপের বাড়ি গেছি। হ্যাঁ, নিজের ইচ্ছেয়। কারণ ছত্তিশগড়ের গাঁয়ে গঞ্জে গাইনি কোথায়? তা দুমাস ধরে তোমার দাদা কোন টাকা পাঠায় নি। বাবা কিছু বলে নি, কিন্তু আমার তো একটা আত্মসম্মান আছে। শেষে আমাকে একটা কড়া করে পোস্টকার্ড লিখে টাকা আনাতে হল। বাবু মাইনে ঠিক সময়েই পেতেন, কিন্তু নিজের যে একটা বউ আছে সেটাই বোধহয় ভুলে যেতেন। এর চেয়ে বিয়ে না করে সারাজীবন কোন হোস্টেলে কাটালেই ভাল করত। মাস মাস টাকা দিয়ে খালাস।

    অবাক হয়ে চারদিকে তাকাই। কত দোকানপাট। কত পাকা বাড়ি। কামধেনু! অত বড় মিষ্টির দোকানটার কি চমৎকার নাম। আবার পাশেই বাঞ্ছারাম, ওদিকে সেনকো।
    না, এই বাঘাযতীনকে আমি চিনি না। হ্যাঁ, ওইদিকে একটা ঘুপচি মত দোকান ঢাকা স্টোর্স, আসল দার্জিলিং চা পাওয়া যায়। চিনতে পেরেছি।সেবার বিজয়গড় থেকে যাদবপুর হয়ে বিশাল মিছিল এই বাঘাযতীনেই শেষ হয়েছিল।
    কী যেন ছিল? হ্যাঁ, চীন বিপ্লব দিবস। তারিখটা ? নাঃ, কিছুতেই মনে পড়ছে না। সালটা? বোধ্হয় ১৯৬৮।
    তবে মাসটা ছিল অক্টোবর, আর নবমীপূজোর পরের দিন স্পষ্ট মনে আছে। কারণ রাতটা আমরা চারবন্ধু পূজোপ্যান্ডেলের তক্তপোষে শুয়ে কাটিয়েছিলাম। বাড়ি ফেরার ঝামেলা পোহাইনি। আমি বিমলেন্দু শংকর ও নান্তু। আর ছিল বুলু, আমাদের রাজনীতির সঙ্গে কোন যোগ নেই। কিন্তু পূজোকমিটির ভলান্টিয়ারদের হেড। মহা চ্যাংড়া।
    -- কী রে শংকর? এখান থেকেই সোজা মিছিলে যাবি? দাঁত মাজবি নে? বড় বাইরে যাবি নে? নাকি পানাপুকুরে কচুপাতায় কাজ চালিয়ে নিবি। আছিস মাইরি! আছোঁচা মুখে বিপ্লব? মাওদেবতা অপ্রসন্ন হয়ে শাপ দেয় যদি?
    সবাই হেসে ফেলে।
    -- যা, যা! নিজের চরকায় তেল দে!
    -- ঠিক বলেছিস! তোর কি রে? শালা আদার ব্যাপারী!
    --- প্রদীপস্যারের মালটাকে হাইজ্যাক করার তালে আছিস, তাতেই মন দে। নইলে ফালতু কিচেনে ফেঁসে যাবি।

    --- ও দাদু, সরে দাঁড়ান।সিগন্যাল হয়ে গেছে, দেখছেন না?
    অটো প্রায় গায়ের ওপরে। লাল কখন সবুজ হয়ে গেছে। আবার লাল হলে রাস্তা পেরিয়ে ঢাকা স্টোর্সের সামনের স্ট্যান্ড থেকে রিকশা নিতে হবে।
    সবাই অবাক হয়ে দেখছিল এই নতুন ধরণের বড় প্ল্যাকার্ড। হাত বদলে বদলে চারজন ছেলে এটাকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা গর্বিত বোধ করছিলাম। কমরেড ধরণী রায় আমাদের পিঠ চাপড়ে দিলেন।
    বললেন-এটা পলিটিক্যালি ম্যাচিওর বক্তব্য হয়েছে। কারা বানিয়েছে? ইস্তেহার" নামে একটা ছোট গ্রুপ।
    উনি ভুরু কোঁচকালেন। উনি 'দক্ষিণ দেশ' বলে একটা বড় নকশালপন্থী পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত। বিজয়গড়ের দিক থেকে বেশ কিছু ছেলে নিয়ে এই মিছিলে যোগ দিয়েছেন। ফলে সত্তর আশি জনের মিছিল দেড়শ লোকের।
    --- তোমরা রোববারে দক্ষিণ দেশ পত্রিকার অফিসে আমার সঙ্গে আলোচনায় বসবে।
    খানিকটা যেন হুকুমের সুর। সুর কেটে গেল। বললাম-- ভেবে দেখব।
    -- মানে?
    -- মানে আবার কি? দেখতে হবে এই রোববারে আমার কী কী কাজ আছে। আমাদের বসে ঠিক করতে হবে আপনার সঙ্গে আলোচনায় আমাদের স্ট্যান্ড কীহবে?
    -- এটাও ভাবতে হবে যে আমরা আদৌ 'দক্ষিণ দেশ' এর সঙ্গে আলোচনায় বসব কি না!
    বিমলেন্দু ফুট কাটে।
    --- অ্যাই! মুখ সামলে! কমরেড ধরণীদার সঙ্গে ভদ্রভাবে কথা বলবে!
    --- কিসের রোয়াব নিচ্ছেন কমরেড? কোন অভদ্রভাবে কথা বলেছি?
    দুটো ছেলে আমার কলার চেপে ধরেছে।
    --- শালা! দুদিনের যোগী! ভাত কে বলে পেসাদ!
    অসহায় ভাবে বন্ধুদের দিকে তাকাই। কোন ফল হয় না। বিমলেন্দুর চোখ দুটো জ্বলছে, কিন্তু ওকে চেপে ধরে রেখেছে অন্ততঃ চারজন। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি অন্ততঃ জনা কুড়ি ছেলে আমাদের চারপাশে একটা বৃত্ত বানিয়ে ফেলেছে।
    ভয় পেলাম। জানতাম বিজয়গড়ের ওই মোড়টা 'ডেমোক্র্যাসি' বলে কুখ্যাত কংগ্রেসি গুন্ডাদের দলের মুক্তাঞ্চল।
    পৃথ্বীশদা আর হিন্টু-লিন্টুকে নিয়ে এই কমরেড ধরণী রায়ই ওখানে বাম রাজনীতির ভরসা। ওরা দশটা বোম মারলে এরা অন্ততঃ ছটা মারে।ওরা লাল-সাদা দিয়ে বানায় তো এরা গন্ধক, নয়তো পিকরিক অ্যাসিড দিয়ে। সব লড়াকু মিলিট্যান্ট কমরেড্স। কিন্তু এই ভুল বোঝাবুঝি!
    কমরেড ধরণীই সামলালেন। বললেন--এখন মিছিল এগিয়ে যাবে। দশটার সময় যাদবপুরের মোড়ে পথসভায় আমি বম্তব্য রাখব। তারপর সুলেখার মোড়, শেষে বাঘাযতীনের মোড়ে পথসভা করে আজকের প্রোগ্রাম শেষ। দেরি করা চলবে না। আরো কাজ আছে। এসব প্রশ্নের মীমাংসা দক্ষিণ দেশ পত্রিকার অফিসে বসে আলোচনা করে হবে।
    কমরেড মাও বলেছেন যে এগুলো হল জনগণের মধ্যেকার মিত্রতামূলক দ্বন্দ্ব,- নোন-অন্তগোনস্তি োন্ত্রদি্তিওন।কিছু মনে কর না--তুমি কি দেশব্রতীর সঙ্গে আছ?
    -- আমরা কারো সঙ্গেই নেই, আবার সবার সঙ্গেই আছি।
    -- আমরা দেশব্রতী, দক্ষিণ দেশ দুটোই পড়ি।
    -- আমরা নতুন তো, তাই এসব বুঝতে চাইছি, মানে চেষ্টা করছি।
    আবার শ্লোগান শুরু হল।
    -- আমাদের মন্ত্র, জনগণতন্ত্র।
    নির্বাচন পথ নয়, নকশালবাড়ি সঠিক পথ!
    গান্ধীবাদী পথ নয়, নকশালবাড়ি সঠিক পথ!
    তোমার নাম আমার নাম, ভিয়েতনাম! ভিয়েতনাম!
    তোমার বাড়ি, আমার বাড়ি! নকশালবাড়ি, খড়িবাড়ি!
    দিকে দিকে কিসের সারা? মাও সে-তুং এর চিন্তাধারা!
    তোমায় আমায় দিচ্ছে নাড়া, মাও -সে-তুং এর চিন্তাধারা!

    -- গুরু! সিপিএমও বলে জনগণতন্ত্র, আমরাও বলি জনগণতন্ত্র। তফাৎ কোথায়?
    বিমল ফিস ফিস করে।
    -- বিকেলে খেলার মাঠে, তখন বলব।
    আমি ফিস ফিস করি।
    ওই তো শিবানীদি দেখছে, আমাদের বন্ধু হিমাদ্রির দিদি।
    আগে ওদের বাড়িতে খুব যেতাম। গতবছর পর্য্যন্ত। শিবানীদি চা করে খাওয়াতো। আমাদের সঙ্গে আড্ডা দিত। আমাকে একতু বেশি আশকারা দিত। কখনো সিগ্রেটের পয়সায় টান পড়লে নিজের ছোট্ট পার্স থেকে বের করে দিয়েছে।
    সেবার ছাদে একা পেয়ে বলেছিলাম-- শিবানীদি তুমি দারুণ ইয়ে!
    শিবানীদি চোখ পাকিয়ে বলল-- ইয়ে মানে?
    -- মানে তুমি খুব সুন্দর দেখতে।
    শিবানীদি আমাকে মন দিয়ে দেখে।
    -- ওসব অনেক শোনা আছে। নতুন কিছু বলবি তো বল।
    সাহস করে বলে ফেলি-- আমি তব মালঞ্চের হব মালাকর।
    শিবানীদি খিলখিল করে হেসে ওঠে। হাসতে হাসতে ওর আঁচল খসে পড়ে। আমি চোখ ফেরাতে পারি না।শেষে আঁচল সামলে তরতরিয়ে নীচে নেমে যেতে যেতে আমার গালে ঠোনা মেরে বলে--খুব বাড় বেড়েছিস, দাঁড়া, তোর ওষুধ দেখছি।
    আমি ভয়ে কাঁপি।
    এমন সময় নীচের থেকে ওর গলার স্বর শোনা যায়।
    -- চা হয়ে গেছে, নেমে আয়।
    কিন্তু তার অল্পদিন পরেই আমি চারজন বন্ধু নিয়ে সিপিএম এর বটগাছের ছায়া থেকে বেরিয়ে ধূ ধূ মাঠের মধ্যে দাঁড়ালাম।
    শিবানীদি কথা বন্ধ করে দিল। পাড়ায় পার্টি অফিসে এলসিএম এর কাছে রিপোর্ট করল আমরা ওর ভাইটাকে ফুসলাচ্ছি বলে। এ
    হিমাদ্রি একদিন লুকিয়ে দেখা করে বলল-- দিদির দোষ নেই। এল সি এম খিদিরপুর ডকে ভাল কাজ করে আগামী সরস্বতী পূজোর পর দিন ও দিদিকে বিয়ে করছে। দু'বাড়িতে পাকা কথা হয়ে গেছে।
    আমরা ছোটবেলার বন্ধুকে হারালাম।

    দুটো পথসভা মন্দ হল না।
    এবার বাঘাযতীনের মোড়। আমি ঢাকা স্টোর্সের কাকুর থেকে চেয়ে একটা টুল এনে রাস্তায় লাগিয়ে দিলাম। কমঃ ধরণী টুলের ঊপর উঠে দাঁড়িয়ে বক্তব্য রাখার আগে আমাকে নীচুগলায় বললেন-- যাও তো, দোকানটার থেকে চার আনার লজেন্স নিয়ে এস। গলা শুকিয়ে গেছে। আমায় চার আনা দিলেন। উনি দুটো পকেটে পুরে দুটো চুষতে চুষতে টুলের উপর উঠে দাঁড়ালেন। টের পেলাম আমারও গলা শুকিয়ে গেছে।
    টুলটা বড্ড ছোট, উনি বিব্রত মুখে ধুতি সামলে মাইক হাতে নিয়ে বলা শুরু করলেন--ব্ন্ধুগণ! আজ চীন বিপ্লব দিবস। আজকের গুরুত্ব--।
    তক্ষুণি বোমাটা ফাটল।
  • ranjan roy | 132.180.170.196 | ২১ জুন ২০১৫ ২৩:১২678563
  • ৩)
    সিগন্যাল কখন লাল হয়ে গেছে। দ্রুত পায়ে রাস্তা পেরিয়ে ঢাকা স্টোর্সের সামনে রিকশাওলাকে জিজ্ঞেস করি-- জোড়াবাগান কত নেবে?
    -- কোন জোড়াবাগানে যাবেন? জোড়া-মনসামন্দির ১৬ টাকা, পুকুরপাড়ে নামলে ১৫ আর নতুন পোস্টাপিসে নামলে ১৩।
    ও গড়গড় করে বলে যায়।
    কোথায় নামলে ঠিক হবে? হাতড়াতে থাকি।
    -- আই- ব্লক দিয়ে ঢুকে বিদ্যাসাগর কলোনির ভেতর দিয়ে নিয়ে চল। আরে বনশ্রী বলে একটা নতুন মাল্টিস্টোরি উঠেছে না, তার গায়ে একটা খুব বড় পুকুর--।
    -- বুঝজি বাবু ,বুঝজি! আর কইতে হইত না। হেই পুকুর আর নাই। কবে বুইজ্যা গ্যাছে। এখন আগাছা আর জঙ্গলে ভর্তি, গোটা পাড়ার জঞ্জাল ফেলনের জায়গা। তার দখল নিয়া দুই দলে ঝগড়া, বোম মারামারি। এখন মামলা চলছে।
    -- তুমি এত কথা জানলে কী করে?
    -- আমিও তো বিদ্যাসাগর কলোনির আইজ্ঞা! বাল্যকালে ওই পুকুরের জল খাইয়া তবে সাঁতরাইতে শিখছি।আপনে চিন্তা কইরেন না, আপনারে ঠিক নামাইয়া দিব। পনেরডা ট্যাহা দিবেন।
  • ranjan roy | 132.180.170.196 | ২২ জুন ২০১৫ ০০:২৭678574
  • বিদ্যাসাগর কলোনি। ছাঁচ ও দরমার বেড়া দেওয়া ছোট ছোট বাড়ি। টিনের দোচালা, চারচালা ও আটচালা। বেশির ভাগ বাড়ির জানলা গুলো ছোট, কিন্তু অনেক খানি বাগানের জমি। শিউলি জবা টগর ফুল, নিম আর নারকোল, সজনে ও কাঁঠাল। কিন্তু বেশির ভাগ ঘরে সন্ধ্যেয় হ্যারিকেন জ্বলে, একটু আর্থিক সংগতি থাকলে হ্যাজাকবাতি।
    বিজলি নেই কেন?
    কী করে থাকবে? বিদ্যুতের খুঁটি গুলো কী করে পোঁতা হবে? ঘরগুলোর সামনে রাস্তা নেই, অধিকাংশ গলিপথে পায়েচলার মাটির রাস্তাও নেই। সেগুলো সারাবচ্ছর হাঁটু জলে ডোবা। অধিকাংশ গলিতে বাঁশের সাঁকো। তার ওপর দিয়ে হেঁটেই সবাই বাঘাযতীন বাজারে যায়, ছেলেমেয়েরা রামগড়, বাঘাযতীন ও নাকতলার স্কুলে যায়। এই এলাকায় কোন রেশন দোকান নেই, গম পেষানোর কল নেই, কোন ডাক্তারখানা নেই। শুধু আই -ব্লক দিয়ে আর রামগড় দিয়ে ঢোকার রাস্তায় দুটো টিনের সাইনবোর্ডে লেখা "বিদ্যাসাগর উপনিবেশ"।
    এখানে ছেলেমেয়েরা বড় হয় ঐ সাঁকোর ওপর দিয়ে দৌড়ে চোর-পুলিশ খেলে। কখনও বড়দের অসাবধান হওয়ার খেসারত দিতে কোন ছোট বাচ্চা ঝুপ করে জলে পড়ে যায়। আর ওঠে না।
    মা-ভাই-বোন কাঁদে। দেহটি ডুব দিয়ে তোলা হলে আরও কাঁদে, এবার চিৎকার করে বুক চাপড়ে।
    অভিশাপ দেয় ভগবানকে , সরকার কে।যদিও ওদের মনে হয় যে এরা দুজনেই চোখ ও কানের মাথা খেয়েছে।
    তবু এখানে বৃহস্পতিবারে ঘরে ঘরে শাঁহ বাজে, লক্ষ্মীঠাকুর জল পায়, বাতাসা, নকুলদানা পায়। আর শনিবারে পূজো হয় শানিঠাকুরের।
    এরা পূজো দেয়, নজরানা দেয় পুলিশের সেপাইকে, থানার বড়বাউকে ছোটবাবুকে।
    এদের বড়রাও চোর পুলিশ খেলে। চাল আর কেরোসিন শুধু দুর্মূল্যই নয়, দুষ্প্রাপ্যও বটে। গত বছর কাশ্মীরে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের পর থেকে বাজারে যেন আগুন লেগেছে।
    আমেরিকার থেকে পাওয়া প্যাটন ট্যাংক নিয়ে পাকিস্তান গড়গড়িয়ে ঢুকল বটে, কিন্তু হাজি পীর গিরিপথে ভারতের বৈজয়ন্ত ট্যাংক বাধা দিতে শুরু করল। আমেরিকান প্লেনের সঙ্গে ভালই লড়ে গেল ফ্রান্স থেকে পাওয়া মিরাজ বিমান। কিন্তু যুদ্ধের দামামা থামলে দেখা গেল দু'পক্ষই আগের জায়গায়। তাশখন্দে গিয়ে ভারত ও পাকিস্তান সন্ধির টেবিলে বসল, পেছনে দাঁড়িয়ে রাশিয়া ও আমেরিকা। সবকিছু আগের মত হয়েও হল না।
    বিরোধী রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীরা অধিকাংশ ভারত রক্ষা আইনে গ্রেফতার হয়ে জেলে। র‌্যাশনের সামান্য দুমুঠো চালে লোকের পেট ভরে না। এবার শুরু হয়েছে চালের কর্ডনিং। এক জেলার চাল অন্য জেলায় যাবে না। গঙ্গার খালের ওপারে ২৪ পরগণা। সেখানে চাল অনেক শস্তা। তবে গাঁয়ের চাল শহরে ঢুকতে পারবে না। তাই খালের ওপর কাঠের পুলগুলোতে পুলিশ পাহারা। এরা চাল ধরে, তাই নাম চাল পুলিশ। গম পাওয়া যাচ্ছে বটে, কিন্তু বাঙালী সেদিন "হিন্দুস্থানী"দের মত রোটি/চাপাটি খেতে রাজি হয় নি।
    র‌্যাশনের চাল ব্ল্যাক হয়, খালের ওপারে গাঁয়ের থেকে শস্তায় থলি ভরে ভরে চাল ঢোকে কোলকাতায়।
    পুলিশ পয়সা নিয়ে ছেড়ে দেয়, কখনও না নিয়ে লক্‌ আপে পোরে।
    এভাবেই বিদ্যাসাগর কলোনির একটা বড় অংশ সামান্য মজুরির বিনিময়ে চালের চোরাকারবারে পদাতিক হয়ে যায়।
    আর বাবা, কাকা, দাদাদের পদচিহ্ন ধরে বাচ্চারাও ভর্তি হয় নারায়ণী সেনার বিগ্রেডে।
    এদিকের লোকজন ভয় করে বিদ্যাসাগরের ছেলেমেয়েদের। সবাই বিশ্বাস করে যে ওই এলাকায় ঘরে ঘরে বোমা তৈরি হয়। ছোট ছোট বাচ্চারাও নাকি বোমা বাঁধতে জানে! মশলার ভাগ জানে। সাদা আর লাল বা সাদা আর হলুদ। পটাশিয়াম ক্লোরেট আর মোমচাল বা আর্সেনিক সালফাইড। ।পটাসিয়াম ক্লোরেট আর গন্ধক অর্থাৎ সালফার।
    মাঝে মাঝেই কানফাটা আওয়াজ।
    আমরা মাথা নাড়তাম-- বিদ্যেসাগরে বোম বানাচ্ছে , তার টেস্টিং হচ্ছে। ওই যে তারসপ্তকে কড় কড় কড়াৎ --ওটা লাল আর সাদায় তৈরি। এর পরে যে গুমম্‌ গুউম্‌ করে মন্দ্রসপ্তকে বেজে উঠল-- ওটায় নিঘ্ঘাৎ গন্ধক।
    তাই রাতের অন্ধকারে নাকতলা স্কুলের গলিতে উঠতি বয়সের ক'টি ছেলে অচেনা লোকের কাছে সিগ্রেট ধরানোর আগুন চাইলে বয়স্ক লোকটি বলে ওঠেনঃ
    - বাপের বয়সি লুকের কাছে বিড়ির আগুন চাইতে লজ্জা করে না? কুন পাড়ার ছাওয়াল?
    ভ্যাবাচাকা খাওয়া দলের এক ছোকরার জিভে চটজলদি মিথ্যে জবাব-- বিদ্যাসাগরের।
    --- তাই কই! বিদ্যাসাগরের নাতিপুতি না অইলে এত গুণ কার?
  • aranya | 154.160.5.102 | ২২ জুন ২০১৫ ০৬:৪১678585
  • ভাল লাগছে
  • ranjan roy | 132.180.170.196 | ২২ জুন ২০১৫ ১৭:৪৩678596
  • রিকশা থেমে গেছে।
    -- এইখানেই নামবেন।
    নেমে চারদিকে তাকাই।একটা মাঠের মত, তার এককোণায় দুটো পাকা বাড়ি, পুকুর কই?
    রিকশাওলা হাসে। বাকি অংশে বুকসমান উঁচু নানান গাছগাছালি, আগাছা। একদিকে ডাঁই করা জঞ্জালের স্তুপ। বাতাসে দুর্গন্ধ। এক কোণে একটি ছোট খুঁটিতে হেলে থাকা নোটিস বোর্ডে 'আদালতের আদেশ' শব্দদুটো পড়া যাচ্ছে।
    এইডাই আপনের পুকুর। দ্যান, পনেরডা ট্যাহা দ্যান।

    গভীর কালো জল। পুকুর নয়, কাজলাদীঘি। দুই বিপরীত কোণে দুই ঘাটলা। একটা ঈশান কোণে আর একটা অগ্নিকোণে। অগ্নিকোণের ঘাটের কাছে দুটি বাড়ির কলাগাছ, নারকোল গাছের ছায়া। কদাচিৎ কেউ জল নিতে আসে। বাড়িদুটোর লোকজন নিজেদের আঙিনায় বসানো টিউবওয়েলের জল ব্যবহার করে। ফলে এদিকের ঘাটলার জল নিস্তরঙ্গ।
    ঈশানকোণের ঘাটলায় অন্য ছবি। সেখানে বিদ্যাসাগর কলোনির সীমানা পেরিয়ে জলে ঝাঁপাচ্ছে ছেলেমেয়ের দল। কিশোর কিশোরী থেকে শুরু করে যুবক যুবতী কেউ বাদ নেই। কয়েক ঘন্টা ধরে চিৎকার চেঁচামেচি হোহোহিহি আর ঝপাং ঝপাং শব্দে অশান্ত জল ও বাতাস। আর আছে নিষিদ্ধ সম্পর্ক জুড়ে নিজেদের ছোট ছোট দলের মধ্যে উচ্চগ্রামে খিস্তিখেউড়।এ ওকে তাড়া করা। এ নিয়ে পাশে স্নানরতা মেয়েদেরও কোন ভ্রূক্ষেপ নেই।
    কোথাও কোন গর্বিত বাপ তার বছর খানেকের ছোট বাচ্চাকে জলে ছুঁড়ে ফেলছে, পাড়ে দাঁড়িয়ে বাচ্চার মা তারস্বরে সোয়ামীর চোদ্দপুরুষ উদ্ধার করছে।
    আমোদগেঁড়ে বাপ একটুও না রেগে সাঁতরে গিয়ে জল খেতে থাকা বাচ্চ কে কোলে তুলে নিয়ে হা-হা হেসে উঠছে।
    মেয়েরা স্নান করে কাপড় কেচে গামছা নিংড়ে গায়ে জড়িয়ে ঘরমুখো হচ্ছে। কেউ কেউ সঙ্গে আনা পেতলের কলসি ভরে জল নিয়ে ফিরছে।
    আমার সাহস নেই। আমি সাঁতার জানি না। এর আগে কোলকাতার ফুটপাথে ক্রিকেট খেলে বড় হয়েছি।কখনও কোন দীঘি দেখিনি। কাউকে সত্যি সত্যি সাঁতার কাটতে দেখিনি।
    তাই অগ্নিকোণের ঘাটলায় দাঁড়িয়ে দূর থেকে ঈশানকোণের ঘাটলায় জীবনের উৎসব দেখি।লোভী লোভী চোখে।
    আচ্ছা, ছেলেদের সাঁতার কাটার ভঙ্গীটাকে ফ্রি-স্টাইল বলা যেতেই পারে। এর মধ্যে কেমন কায়দা করে জল টেনে নিয়ে মুখ দিয়ে হুস করে ছাড়ছে।
    কিন্তু মেয়েদের ভঙ্গীটাকে কী বলব? ওরা থুতনি অব্দি মুখটা ভাসিয়ে রাখে, হাত জলের তলায়। পা দুটো পেছনে সামান্য ওঠে, ঠিক যেন হাঁস জল কেটে তরতরিয়ে এগিয়ে চলেছে। কেউ কেউ আবার কলসি বুকে নিয়ে বেশ মজা করে সাঁতার কাটছে , দুজন হাত ধরাধরি করে ডুব মেরে নীচে গিয়ে দম ধরে থেকে খানিকক্ষণ পরে ভুস করে ভেসে উঠছে।
    আমার চোখে পলক পড়ে না।
    হঠাৎ চমকে উঠি। পাড়ের কাছ ধরে কম জলে সাঁতরে এসে আমাদের ঘাটের কাছে চলে এসেছে একটি মেয়ে। আমাকে খেয়াল করে নি। ভিজে কাপড়ে উঠে এসে কুলগাছের তলা থেকে কিছু তোপাকুল তুলে মুখে পুরে চুষতে থাকে ।
    আচমকা চোখ যায় ওর ঢেউয়ের দোলায় ক্রমাগতঃ দূরে সরে যাওয়া কলসিটার দিকে। একটা অব্যয়। ও আবার ঝাঁপিয়ে পড়ে দ্রুত সাঁতরে কলসিটা কে ধরে, মাথার খুলে যাওয়া ভিজে চুলে আলতো করে গিঁট দেয়। তখনই দেখতে পায় আমাকে। লজ্জা পেয়ে দূরে সরে যেতে যেতে আবার তাকায়, মুচকি হাসে।
    পদ্মানদীতে কলসি নিয়ে সাঁতরাচ্ছে কপিলা। কুবের লোভী চোখে দেখে কলসী নিয়ে সাঁতরাতে থাকা কপিলার ভারী বুক জলের ওপর দোলে, ডোবে আর ভাসে।
    কপিলা হেসে ডাক দেয় কুবেরকে-- ধর মাঝি ধর। আমারে না, আমার কলসীডারে ধর

    কাঁধে কারো ভারী হাতের চাপ। ঘোর কেটে ফিরে তাকাই--বাবা!
    --- কী দেখ বাপ?
    আমার গলায় থুতু শুকিয়ে যায়।
    বাবা আমাকে দেখলেন, চোখ কুঁচকে পুকুরের দিকে তাকালেন।
    তারপর বললেন-- এভাবে দেইখ্যা কি লাভ? পুরুষমাইনসে এইভাবে পাড়ে দাঁড়াইয়া তাকাইয়া সময় নষ্ট করে না। সোজা ঝাঁপাইয়া পড়ে। সে সাহস আছে?
    -- আমি যে সাঁতার জানি না।
    --কেউ মায়ের প্যাটে থাইক্যা সাঁতরাইতে শিখে নাই, আমিও না। কিন্তু পরে বানের সময় গঙ্গায় সাঁতরাইছি। কী কস্‌? শিখবি? ত' কাইল থেইক্যা সকাল দশটায় আমার সঙ্গে পুকুরে নামবি, সাতদিনে শিখাইয়া দিয়াম।
  • সিকি | ২২ জুন ২০১৫ ১৮:৩৭678607
  • ঠিক এইভাবে পাড়ার পুকুরে বাবার কাছে প্রথম সাঁতার শিখেছিলাম। দশদিনে।

    পড়ছি।
  • ranjan roy | 132.180.215.190 | ২৫ জুন ২০১৫ ১৬:১২678618
  • নাঃ, সাঁতার শেখা আর এ জীবনে হয়ে উঠল না। সাতদিনে কেন, সাতমাসেও না।বাবা চেষ্টার ত্রুটি করেন নি। দিনদশেক নিয়ম করে আমাদের তিন ভাই ও ভাইপোকে নিয়ে জলে নামতেন। ওই ঈশানকোণের ঘাটের দিকে।
    সবাই শিখে গেল, আমি ডাহা ফেল। বুকজলে যাই, মহাবাক্য স্মরণ করি যে মাথাটা সবচেয়ে ওজনদার। তাই মাথা যত জলের তলায় থাকবে পা তত ওপরে উঠবে। কিন্তু জলের নীচে যে অন্ধকার। অন্ধকারে আমার বড় ভয়। চারপাশের বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েরা কেমন নাক টিপে ডুব দিচ্ছে, পালা করে জলের নীচে দম ধরে থাকছে! আমি পারি না। প্রাণপণে জল ছেটাই হাত দিয়ে,ভান করি সাঁতরানোর। আসলে জলের নীচে পা দিয়ে হাঁটি।
    অভ্যেস খারাপ। বহুআগেই শিখে গেছি যে মূল টেক্স্ট না পড়েও পাস হওয়া যায়, শস্তা নোটস্ পড়ে, কিছু কায়দা শিখে।
    আমি চারপাশের জলে ঝাঁপানো বীরসিংহের সিংহশিশুদের কাছে হাসির পাত্র হয়ে উঠলাম। কেউ বলল-- খোকা, বেশি আগাইয়ো না। আগে কুমীর আছে, ঠ্যাঙে টান দিব।
    কেউ বাবাকে বলল-- অরে একটু গরম চা খাওয়ান।
    ক্রুদ্ধ পিতা সর্বসমক্ষে পুত্রকে চপেটঘাত করিয়া বলিলেন-- যা, বাড়িত যা। ব্যাডা আউয়াখানা!
    সাঁতার শেখানোর ক্লাসের শেখানেই ইতি।
    কিন্তু তৃতীয়দিন একটা ঘটনা ঘটল।
    বেলা এগারোটা নাগাদ পুকুরের দিক থেকে একটা হল্লার আওয়াজ। ও মাঝে মধ্যেই হয়, ঝগড়া মারামারি। যত্ত বিদ্যেসাগর কলোনির ছেলেছোকরার দল! এমন সময় কাজের মাসির মেয়েটি দৌড়তে দৌড়তে এলো-- তোমাদের বাড়ির ছোটছেলে ডুবে যাচ্ছে গো! শিগ্গির করে এসো!
    ব্যাপারটা বুঝতে লাগল কয়েক সেকেন্ড। ছোটভাই সাঁতার শিখেছে, মানে জলে ভাসতে শিখেছে। কিন্তু চিৎ সাঁতার শেখেনি।
    অল্পবয়েসি ছেলের দল বলল-- কী রে সুনন্দ ?বড় সাঁতার শিখেছিস! পুকুর এপার ওপার করতে পারবি? আমাদের মত? আচ্ছা, চল তবে।
    ওরা একসঙ্গে সাঁতরে এল ঈশানঘাট থেকে অগ্নি।
    -- বেশ, চল ফিরে যাই। পারবি?
    --পারব।
    কিন্তু মাঝপুকুরে এসে সুনন্দর হাত পাথরের মত ভারি, পায়ে যেন সিমেন্টের ঢালাই হয়ে গেছে। আর বুক হয়েছে কামারশালার হাপর।

    -- আমি পারছি না! ডুবে যাচ্ছি, বাঁচাও!
    দলের ছেলেগুলো কখন পৌঁছে গেছে নিজেদের ঘাটে। কিন্তু সুনন্দ যে মাঝপুকুরে, সমানে জল খাচ্ছে আর চেঁচাচ্ছে-- বাঁচাও, আমি পারছি না।
    কে বাঁচাবে? বড়রা কেউ এখনও স্নানে আসে নি। বাচ্চারা ভয় পেয়ে গেছে। আর আছে মেয়ের দল।
    কাজেই বাতাসে ভেসে এল এক সমবেত হায়! হায়! গ্যাছে গো গ্যাছে! ছ্যামড়াটা আইজ গ্যাছে।
    বাবা দৌড়ে এসে অগ্নিকোণের ঘাটে দাঁড়িয়ে পায়্জামা খুলে আন্ডারওয়ার পরা অবস্থায় জলে ঝাঁপ দিচ্ছেন দেখে চারদিকের হট্টগোল থেমে গেল। সবাই চুপ।
    কী আশ্চর্য, বাবা শেষমুহুর্তে দাঁড়িয়ে পড়লেন। যেন রেডি! অন ইয়োর মার্ক বলার পর স্টার্টারের পিস্তল থেমে গেছে।
    মা ডুকরে কেঁদে উঠলেন-- কী হইল? ঝাঁপ দেও!
    বাবা সেদিকে কর্ণপাত না করে হুংকার দিয়ে উঠলেন-- কিস্যু হয় নাই! দম ফুরায় নাই। পারবি, পারবি, আর একটু,ব্যস্ --আর একটু , অল্প বাকি, আর একটু।
    আর সেই গর্জনে জলে আধডোবা সুনন্দ পারছি না, পারছি না, বলেও হাত পা নাড়তে লাগল। মিনিট পাঁচেক। তারপর বুকজলে পৌঁছতেই ঘাটের থেকে কিছু ছেলে ওকে ধরে তুলে এনে পাড়ে ঘাসের ওপর শুইয়ে দিল।
    বাবা হাঁফ ছাড়লেন।
    সবার প্রশ্নের উত্তরে নিজের অদ্ভুত আচরণের ব্যাখ্যা দিলেনঃ
    আমি দেখলাম ঝাঁপ দিলেই ছেলে নিশ্চিন্ত হইয়া হাত-পা নাড়া ছাইড়া দিব আর তখনই জলে তলাইয়া যাইব। আমি এই ঘাট থেইক্যা ওর কাছে পৌঁছানোর আগেই। আর এই কাজলাদীঘির নিকষকালো জল, ডুব দিয়া দেখছি, চইখ্যে কিছুই দেখা যায় না।দুই বাঁশ গভীর। একবার তলাইয়া গেলে কোন আশা ছিল না। তখন আমি ওর লাইফফোর্সের উপর নির্ভর কইর্যা অরে ভরসা দিতে লাগলাম। বাপ্, পারবা, তুমি পারবা।
    বাড়িতে আনা হলে পরম মমতায় ছোটছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন-- সাবাশ ব্যাডা! তুমি পুরুষমানুষ, মাইগ্যা না।
    [ অপাঙ্গে বড়ছেলের দিকে দেখে বলায় সে বুঝে গেল কাকে মেয়েলি বা মাইগ্যা বলা হচ্ছে।]
    তবে একটা ভুল করছ। চিৎসাঁতার না শিইখ্যা দীঘি পারাপার -- ব্যাক্কলের কাম। দম ফুরাইলে চি`ৎ হইয়া ভাসন লাগে। আমি গঙ্গায় সান করতে গিয়া বানে পইর্যা চিৎ হইয়া হাত-পা ছাইড়া দম নিছি। দম ধইর্যা রাখা হইল আসল। জীবনের সর্বক্ষেত্রে কাজে লাগে।

    মন্ত্র তো এভাবে পেয়েছিলাম, তখন এর তাৎপর্য বুঝিনি। তাই গ্রহণ করিনি। হ্যাঁ, দম চাই সব ব্যাপারে। সাঁতার হোক, খেলাধূলো বা গানগাওয়া হোক, দম ধরে রাখার কৌশল জানা চাই। খালি উপুড় হতে নয়, মাঝে মাঝে চিৎ হওয়ারও দরকার। সেই কৌশল জানা চাই, সে জীবনযুদ্ধেই হোক কি প্রিয়সংগমে।
  • সিকি | ২৫ জুন ২০১৫ ১৬:২২678514
  • আদর্শ লোক। ফাটিয়ে হাততালি। তারপর?
  • মনোজ ভট্টাচার্য | 24.99.47.72 | ২৫ জুন ২০১৫ ১৭:০৩678525
  • রঞ্জনবাবু,

    একসঙ্গে লেখাগুলো পড়তে বেশ লাগল । এমন একটা সময়ের পথ ধরে হাঁটছেন - যেখানে আমরা সবাই আমাদের জীবনের সাক্ষ্য রেখেছি কোন না কোন ভাবে ! আপনি যখন লিখছেন দক্ষিণ কলকাতার - আমরা তখন উত্তর কলকাতায় ঐ একই ইতিহাস তৈরি করছি ! - সেই সময়ের নকশাল বা কংশাল কোথায় তাদের দিকচিহ্ন রাখল - তা তো প্রথম পর্বেই দেখিয়ে দিলেন ! তত্ত্বগত আলোচনা করে এখন আর লাভ লোকসান কিছুই নেই ।
    তবু আপনার লেখার মধ্যে দিয়ে একটা রাজনীতির নস্টালজিয়ার টান অনুভব করছি ! এবং স্বীকার করছি ভালো লাগছে ।

    মনোজ ভট্টাচার্য
  • Manish | 127.200.86.57 | ২৫ জুন ২০১৫ ১৮:১০678533
  • Ranjan ভীষন ভালো হচ্ছে। আমিওতো প্রায় ঐ এলাকাতে বেড়ে উঠেছি তাই নিজেকে খুব রিলেট করতে পাড়ছি।আমরাও পোলের ওপার থেকে লুকিয়ে চাল আনতাম উষা ব্রীজ দিয়ে। কিন্তু একটা লজ্জার ব্যাপার যে ঐ এলাকায় বেড়ে ওঠা সত্বেও তুমি সাতার শিখতে পরোনি।
  • | 77.98.72.126 | ২৫ জুন ২০১৫ ১৮:১৩678534
  • ভালো লাগছে রঞ্জন দা। হাত চালিয়ে...
  • ranjan roy | 132.180.215.190 | ২৫ জুন ২০১৫ ২২:৪৮678535
  • মনীশ,
    ঃ))।
    সবাইকে ধন্যবাদ।
    কিন্তু লেখালেখিতে আমার গুরু দময়ন্তীর কথা মেনে আমি মাঝখানে আর কোন রি-অ্যাক্ট করব না।
  • ranjan roy | 132.180.215.190 | ২৮ জুন ২০১৫ ১৩:৫৭678536
  • ৪)
    কেমন বাপের ব্যাটা রে তুই,!
    =================
    একদিনে ছোট ভাই সুনন্দ বেশ হিরো হয়ে গেল। দুদিন বাদেই দেখা গেল সে কাজলাদীঘিতে চিৎ হয়ে ভাসছে, উপুড় হচ্ছে, বিদ্যেসাগর কলোনীর ডানপিটেদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এপার ওপার করছে। এর পরে মেজছেলের পালা। সেও উৎরে গেছে।
    কিন্তু বড় ছেলে রমেন ?
    কৈশোর পেরিয়ে পুরুষ হওয়ার প্রবেশিকায় ডাহা ফেল। বাবার ছুটি ফুরিয়ে এসেছে। আর দুটো দিন, তারপরে ফিরে যেতে হবে ভিলাই। যেখানে বিশাল ইস্পাত কারখানায় আকরিক লোহা থেকে ইস্পাত তৈরি হয়। ব্লাস্ট ফার্নেস থেকে লাল গলিত লাভা স্রোতের মত লোহা গলে গলে পড়ে । রোলিং মিলে গিয়ে সেগুলো ঠান্ডা হয়ে দানবীয় রোলারে পিষে ইস্পাতের চাদরে বদলে যায়। তারপরে বিলেট মিল , মার্চেন্ট মিলে গিয়ে সেগুলো বাজারের চাহিদা অনুযায়ী নানান মাপে কাটা হয়ে ব্যবহার যোগ্য হয়। রেলের পাত, লোহার রড, লোহার তার ও স্টেনলেস স্টিল।
    এমন শক্তসমর্থ আবহাওয়ায় যে কাজ করে গর্বিত তার ছেলে এমন অপদার্থ! ব্যাটাছেলে এই বয়সে সাইকেল চালাবে, গাছে চড়বে আর পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে পড়বে।
    এ তো খালি কথাসরিৎসাগর! কাজের বেলায় ল্যাবেন্ডিশ।
    বাকি দুটো তো ছেড়েই দাও, সাইকেলটাও ঠিক করে চালাতে শেখেনি। বছর দুই আগে ভিলাইয়ে সাইকেল ধরিয়ে দিয়ে বলা হল সামনের মাঠে প্র্যাকটিস কর, ব্যালান্স ঠিক হলে তবে রাস্তায় চালাবি। তা সে তিনদিনের মাথাতেই সবার অজান্তে রাস্তায় চালাতে শুরু করল। দুবার বাঁক নিতে গিয়ে আছাড় খেয়ে পড়ে হাঁটুর নুনছাল তুলল, কিন্তু হ্যান্ডেলটি যে বেঁকে গেছে সেটা খেয়াল করল না। ফলে রাস্তায় নিজেদের মধ্যে হাহা-হিহি করতে করতে আসা তিন রাইকিশোরীর মুখোমুখি হয়ে তাল সামলাতে না পেরে সোজা ওদের মাঝখানে ধাক্কা মারল।
    আরে, ভুল হয়ে গেছে তো সরি বল আর সাইকেল চালিয়ে চোঁচা কেটে পড়। তা না, ব্যাটা পাক্কা আউয়াখানা , ওদের সামনে দাঁড়িয়ে রইল। একটা মেয়ে গিয়ে বাড়ি থেকে বাপ-দাদাকে ডেকে আনল।
    ওরা সব শুনে ওকে নিয়ে বাড়িতে হাজির।
    কী লজ্জা, কী লজ্জা!
    কপাল ভাল যে ওর পিঠে হাতের সুখ করে নি। করলে উনি আর কি করতেন!
  • মনোজ ভট্টাচার্য | 24.99.192.151 | ২৮ জুন ২০১৫ ১৬:৩৯678537
  • হে - হে - ! ছোটবেলায় সবে সাইকেল চালাতে শিখে - ঠিক এই ঘটনাই ঘটেছিল আমারও ! - নেহাত পাড়ার মধ্যে বলে কিছু হয় নি !
    আর একবার এক হরতালের দিন - সাইকেল নিয়ে ভিড়িয়েছিলাম এক পুলিশের গায় ! - খুব বাঁচা বেঁচেছিলাম সেদিনও !

    খুব মিল আছে !

    মনোজ
  • ranjan roy | 132.180.215.190 | ২৮ জুন ২০১৫ ১৭:৫৮678538
  • কানে আসে কিছু মন্তব্য, কিছু ঠাট্টা তামাশা, আর চোখা চোখা কাঠবাঙাল বিশেষণ-- আউয়াখানা, উরুম্বা, অলম্বুষ! (ঘটিতে এর কাছাকাছি মহাধুর, আতাক্যালানে, ন্যাকাষষ্ঠি!)
    বাবা কাল সন্ধ্যেয় বম্বে মেল ধরবে। বেশ! ধরুক গে! গেলেই ভাল। হ্যাঁ, ভদ্রলোক কখনো ছুটি বাড়িয়ে নেন না, সেটাই ভরসা। কিন্তু আজকের দুপুর তো আমার।
    উঠোনের এককোণাতে গোটাছয়েক কলাগাছ, একটার কাঁদি ক'দিন আগে নামিয়ে নেওয়া হয়েছে। একটা দা দিয়ে সেটা কুপিয়ে কুপিয়ে কেটে ফেলি। রাঙাকাকা জিজ্ঞেস করলে বলি--- ওখানটায় নতুন একটা চারা লাগানো হবে।
    জৈষ্ঠ্যের শেষ। ঝুম ঝুম গরমের দুপুর। মাটি থেকে ভাপ উঠছে। হাওয়ায় কাঁপন। রাস্তায় একটাও লোক নেই। বাড়িতে সব খেয়েদেয়ে গাঢ় ঘুমে । কাটা কলাগাছের গুঁড়ি নিয়ে আস্তে আস্তে আঙিনার পেছনের আগড় খুলে বেরিয়ে আসি। অগ্নিকোণের ঘাট। নিকষকালো জল। সামনে কিছু টগর ও শিউলিফুলের গাছে যেন কোলকুঁজো বুড়ির মত জলের উপর ঝুঁকে আছে। ঘাটের শেষে জলে পা দিই। আঃ, কী ঠান্ডা!
    পেছন ফিরে বাড়ির দিকে তাকাই। না , কেউ টের পায় নি।
    দুহাতে কলাগাছের গুঁড়ি নিয়ে জলে নামি। জলে ভাসাতেই আর কোন ভার নেই। ওটা কী হালকা হয়ে গেল। এবার বুক জল।
    হ্যাঁ, এখন সময় হয়েছে। সাবধানে হাত বদলে পেছন ফিরি। মাথার কাছে জলে ভাসা কলাগাছের গুঁড়ি দুহাতে ধরে জলের ওপর চিৎ হই। আর কী মজা! আমার শরীর হালকা হয়ে জলের উপর ভাসছে। হ্যাঁ, এমনি করেই কোথাও কোথাও হাওয়া ভরা রবারের টিউব দিয়ে সাঁতার শেখানো হয়।
    কোথায়? কোথায় আবার ? অ্যান্ডারসন ক্লাবে, ঢাকুরিয়া লেকে। শুনেছি তার জন্যে মোটা চাঁদা লাগে, আমাদের সাধ্যের বাইরে।
    ভাসছি, ভেসে চলেছি। হাওয়া নেই। সামনের একটা গাছ থেকে একটা মাছরাঙা ছোঁ মেরে জল থেকে কিছু তুলে উড়ে গেল। পা দিয়ে প্যাডল করছি, যেমন অন্যদের দেখেছি। ভারি মজা তো! একতু পরে চোখ তুলে তাকাই--কোথায় এলাম? ঈশানঘাট কতদূরে?
    ধুর! ওই তো আমাদের বাড়ি দেখা যাচ্ছে। আরে আমি ভুল প্যাডল করে খালি গোলগোল ঘুরছি, বেশি এগোতে পারি নি তো!
    ( তখন কি জানতাম যে সারাজীবন পথ হাতড়ে গোলগোল ঘুরে বেড়ানোই আমার ভবিতব্য!)

    আচ্ছা, আমাদের বাড়িতে কেউ এখনও টের পায় নি। কী আশ্চর্য, আমাকে নিয়ে কারো কোন মাথাব্যথা নেই? ঠিক আছে, ফিরব না শালা এরকম বাড়িতে। জোরে জোরে প্যাডল করে উল্টোদিকের ঘাটে উঠব। বিদ্যাসাগর কলোনিতে ঢুকে যাব। সেখানে কারো দোকানে কাজ নেব আর রাতে পড়ে প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে স্কুলের বেড়া টপকাবো।
    কাজ পাব না? পেটভাতায় কাজ করব। সাইকেল সারাই না হোক, কোন চায়ের দোকানে? বাসন মাজব, উনুন ধরাবো, চা বানাবো। তারপর টেবিলে টেবিলে চা দেব। কোন খেটে খাওয়া সাধারণ মজদূর, ধর এই কোন রিকশাওলা আমাকে একদিন খুশি হয়ে চার আনা বকশিস দেবে। যেমন সমরেশ বসুর গল্পে পুনিয়া বলে বাচ্চাটাকে দিয়েছিল। তবে ছেলেটাকে সন্দেহ করে মালিক উনুনের গরম শিক দিয়ে বেধড়ক ঠেঙিয়েছিল।
    আমি কি অমন মার সইতে পারব? আচ্ছা, আমি যদি বকশিস পেলে মালিককে আগেই জানিয়ে দিই? তাহলে তো আমাকে চোর ভাববে না।

    কোথা থেকে একটা আওয়াজ আসছে না? না, না, অনেকগুলো আওয়াজ। আলাদা, আলাদা--আবার একসঙ্গে। ওসব পাড়ার কিচ্যেন, এসব থেকে আমি বরাবরই দূরে থাকি।
    ---- আরে ওই তো! মাঝপুকুরে, কলার ডুম ধইর‌্যা ভাসতে আছে।
    -- রমেন, আগাইস না, ফির‌্যা আয়।
    -- না, না; ফিরতে হইব না। তুই যেমন জাইতে আছস তাই থাক। ঈশানঘাট আর বেশি দূর নাই। কলাগাছ্টারে শক্ত কইর‌্যা ধর, হাত ছাড়িস না।

    জোরে জোরে প্যাডল করতে থাকি। কতক্ষণ মনে নেই, মিনিট পনের হবে। হটাৎ আমার হাত থেকে কেউ ঝটকা দিয়ে কলাগাছের ভেলা কেড়ে নেয়। ভুস করে ডুবে ভেসে উঠি। কোমর জল, ঈশানঘাটে পৌঁছে গেছি। বাবা আমার হাত ধরে বলেন-- বাড়ি চল।
    আমরা পাড় ধরে হাঁটতে থাকি। দেড় পাক ঘুরে তবে আমাদের বাড়ির দোরগোড়া।
    আমার ভিজে কাঁধে হাত রেখে নরম স্বরে বলেন-- এইডা কী করতাছিলা?
    ---- সাঁতার শিখতাছিলাম। এইভাবে? একা একা? যদি হাতের থেইক্যা ভেলা ছাইড়া যাইতো তো আমরা টেরও পাইতাম না। ভরাদুপুরে কোন লোকজন নাই। বিকালে এইদিক ওইদিক খামোখা খোঁজাখুঁজি করতাম। তোমার মায়ের হার্ট ভাল না, বুকের চাপ বাড়ত।

    বাড়ি ঢুকলে মহিলারা কান্নাকাটি থামিয়ে গা- মুছিয়ে শুকনো জামাকাপড় দিলেন। তারপরে কাঁসার বাতিতে গরম দুধ। ওদিকে দাদু সবাইকে তড়পাচ্ছেন-- অরে কেউ কিছু কইতে পারবা না! অরে কেউ বুঝে না, শুধু আমি বুঝি।
    ভেতরের ঘর থেকে চাপা হাসির আওয়াজ আর কিছু টুকরো মন্তব্য ভেসে এল।
    -- দাদুর আল্লাইদ্যা নাতি।
    --অইব না, হিন্দু জয়েন্ট ফ্যামিলির কর্তার বড়ছেলের বড়ছেলে।
    ---- ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল! প্যাসিভ অ্যাগ্রেসিভ! মিচকা শয়তান!

    বাড়ির সবচেয়ে বৃদ্ধলোকটির ভয়ে কলাগাছ এপিসোড নিয়ে কেউ আর বেশি প্যাচাল পাড়লো না।

    কিন্তু সেই কালোজল সেই অতল দীঘি বয়ঃসন্ধি থেকে বহুদিন স্বপ্নে তাড়া করে বেড়ায়।
    অগ্নিকোণের ঘাটে নামতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে যাচ্ছি, কলার ভেলা জলের ধাক্কায় কয়হাত দূরে সরে গেছে। বাঁচার চেষ্টায় জলের উপর ঝুঁকে থাকা গাছগুলোর একটার ডাল জড়িয়ে ধরি। বাতাবিলেবুর গাছ। কাঁটায় হাত ছড়ে যাচ্ছে, আমি নিরুপায়।
    কিন্তু গাছ কোথায়? ও তো এক নারী, এলোকেশী, গুরুস্তনী। সে আমাকে ছোট বাছার মত করে দোল খাওয়ায়, ভয় দেখায়।
    -- দেব জলে ছুঁড়ে ? দিই ফেলে?
    তার স্তন আমার গাল ছুঁয়ে যায়, কিন্তু আমি ভয়ে শিউরে কুঁকড়ে উঠি।
    ঘুম ভেঙে যায়, বালিশ ঘামে ভিজে গেছে। কিন্তু-- এমন স্বপ্ন কেন দেখলাম? ওর মুখের আদল যে চেনা চেনা।
  • সিকি | ১৮ জুলাই ২০১৫ ১৮:১৬678539
  • রঞ্জনদার জন্য তুলে দিলাম।
  • ranjan roy | 132.180.196.74 | ১৮ জুলাই ২০১৫ ১৯:৫৪678540
  • ৫)
    নাঃ, বাড়িটার কিছু ভোল পাল্টেছে।
    বাগানের নারকোল গাছগুলো নেই। ওদের শেকড়ের চোরাগোপ্তা আক্রমণে নাকি পাঁচিলটা পড়ে গিয়েছিল। আছে সুপুরিগাছগুলো। তাতে সুপুরির গোছা ঝুলছে গলগন্ডের মত।
    বাগানে গোলাপগাছের সংখ্যা কিছু কমেছে। কোথায় সেই লতানে গোলাপগুলো আর সাদা-হলুদ গোলাপের দল? আর বাঁশদ্রোণী বাজার থেকে কেনা চৌ এন-লাই গোলাপ! চৌ এবং তাঁর নামে রাখা গোলাপ সবই কবে বিবর্ণ হয়ে ঝরে গেছে।

    গ্রিল দিয়ে ঘেরা ছোট্ট বারান্দায় জনা পাঁচেকের মত বসার জায়গা। সেখানে বসে চশমা চোখে খবরের কাগজ পড়ছেন আশির ঘর ছোঁয়া ভদ্রলোকটি।। বাগানের গেট খোলার শব্দে চোখ তুলে তাকালেন। বড় আয়ত চোখজোড়ার তীব্র চাউনি একমুহুর্তে নরম হয়ে এল। এক্গাল হেসে বললেন--আয়! আয়! চা খাবি তো। কোলকাতায় কবে এলি? বৌমা? ছেলেমেয়েরা? সব ভালো তো?
    রমেন বোকা বোকা হাসি হাসে। মাথা হেলিয়ে সায় দেয়।সহজ হবার চেষ্টা করে।
    বাড়িটায় সদ্য রঙ করা হয়েছে। কিন্তু এই গ্রিল দিয়ে ঘেরা বারান্দাটা? রোজ রাত্তিরে যেখানে নিয়ম করে গোদরেজের সাত লিভারের তালা ঝোলানো হয়, এটাই না?
    রমেন গ্রিলের দরজাটা দেখে, তালাটায় হাত বুলোয়, তারপর কাকার দিকে তাকায়।
    কাকা আস্তে করে মাথা নেড়ে অন্য দিকে তাকান। কেন যে রমেন সেইসব পুরনো দিনের কথা মনে করে রেখেছে? কি লাভ? খুঁচিয়ে ঘা করা? চার চারটে দশক তো পেরিয়ে গেল।

    হ্যাঁ, কোলকাতা তখন দুঃস্বপ্নের নগরী। সিদ্ধার্থ রায়ের কোলকাতা। তখনও এমার্জেন্সি ঘোষণা হয় নি। বিরোধীদের কন্ঠস্বর শোনা যায় না। কারণ পাকিস্তান কে সফল ভাবে দু'টুকরো করেছেন ইন্দিরা গান্ধী। পশ্চিম পাকিস্তানের ফ্রন্টে খানসেনাদের তাড়া করে লাহোরের ইছোগিল খাল পর্য্যন্ত পৌঁছে গেছল ভারতীয় ফৌজ। তবে ঢাকায় ইস্টার্ন কম্যান্ডের জেনারেল অফিসার ইন কম্যান্ডিং অর্জুন সিং অরোরার সামনে জেনারেল নিয়াজির আত্মসমর্পণ ও নব্বই হাজারের মত পাক সেনার যুদ্ধবন্দী হওয়ায় ভারতে নো-ননসেন্স ইমেজ সর্বজনস্বীকৃত। ইন্দিরা হয়ে উঠলেন এশিয়ার মূক্তিসূর্য।
    কিন্তু তার আগে ? অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিয়ে এবং
    কোলকাতা থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ব্রডকাস্টিং করার অনুমতি দিয়ে ইন্দিরা তখন গোটা ভারতের এবং বিশেষ করে বাঙালীদের নয়নের মণি।
    ইস্টার্ন ফ্রন্টে যুদ্ধ শুরু করার আগে দরকার ছিল নিজের ঘর ঠিক করা। বোমা-পাইপগান আর ছুরি নিয়ে পুলিশ ও জোতদারের গলাকাটার নেশায় মেতে ওঠা বালখিল্য বিপ্লবীদের শায়েস্তা করা। ফৌজ নামল বীরভূমে, নামল উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গ পর্য্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের বর্ডার জুড়ে। সামনে বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স, ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেলস্‌।
    সরানো হল বামেদের যুক্তফ্রন্ট সরকারকে, আরও কড়া ও প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ চাই। অল্পদিনের রাষ্ট্রপতি শাসনের পর এলেন সিধুবাবু। উনি নাকি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের দৌহিত্র ও ক্রিকেটার পঙ্কজ রায়ের ভাইপো! নিজেও ব্যাট ধরেন, দুঁদে ব্যারিস্টার।
    নকশাল দমনে উনি যুব কংগ্রেসের ছেলেদের হাতে অস্ত্র তুলে দিলেন। শুরু হল শহরে খোলাখুলি এনকাউন্টার। বারাসত-আমতলার পথে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে রইল আটটি কিশোরের মৃতদেহ। কানে পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করা হয়েছে।
    তারপর বাম-ডান সব দলগুলোকে একসঙ্গে নিয়ে জনসভা করে ঘোষণা করা হল যে বরানগর -সিঁথি এলাকা নকশাল মুক্ত করা হবে। বিশাল এলাকা জাল দিয়ে ঘিরে রাখল সিআরপির জোয়ানরা। বাইরের এলাকা থ্কেকে প্রফেশনাল কিলারদের এনে লেলিয়ে দেওয়া হল। কোন প্রেস ঢুকতে পেল না। ঘর ঘর থেকে টেনে বের করা হল দুঁদে নকশাল, খুদে নকশাল, হবু নকশাল, জবুথবু নকশাল সবাইকে। বাদ গেল না কচি-কাঁচা , মেয়েমদ্দ-বুড়োরাও। ঝাড়ে বংশে নিকেশ কর।
    মৃতদেহগুলোকে মুখে আলকাতরা মাখিয়ে ঠেলাগাড়ি করে গঙ্গার পাড়ে ডাম্প কর। লাশগুলো গঙ্গায় ফেলে দাও।
    যারা কপালজোরে পালিয়ে বাঁচল তারা বহুদিন সেই দিনের কথা মনে করে কেঁপে কেঁপে উঠত, ঘুমের ঘোরে চিৎকার করে উঠত।
    কয়েক মাস। কোলকাতায় নকশালদের পুলিশ মারা প্রায় থেমে গেল। পাড়ায় পাড়ায় সিপিএম-নকশালদের এলাকা দখল নিয়ে কৌরব-পান্ডব যুদ্ধও থিতিয়ে এসেছে। কিন্তু খাল কেটে কুমির আনা হয়েছিল। দিল্লির প্রতিনিধি যে যুব কংগ্রেসের হাতে রাইফেল তুলে দিয়েছেন। ছেলেছোকরাদের হাত নিশপিশ করছে।
    এবার সিপিএমকে পাড়া ছাড়া করলে কেমন হয়! গোটা পাড়ায় সব ক্লাবগুলো দখল হবে, স্কুলকমিটি দখল হবে। মেয়েগুলো হয় ভয়ে সিঁটিয়ে দোরে খিল দেবে নয় ফুলচন্দন দিয়ে বীরের অভ্যর্থনা করবে।
    যেমন ভাবা তেমন কাজ।
  • ranjan roy | 132.180.196.74 | ১৮ জুলাই ২০১৫ ২১:২৭678542
  • -নারকইলগাছ সবকয়টাই কাটা হইয়া গ্যাছে? শিকড়ে পাঁচিল ভাইঙ্গা দিছিল?
    -- কইতে পার। কিন্তু আরও কারণ ছিল। কইতাছি।
    সেইদিনগুলিতে এই পাড়ায় আমি সিপিএম হিসেবে মার্কামারা। যদিও আমার রাজনীতি ডালহৌসি পাড়ায়। কিন্তু ওরা পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করতে চাইছিল, বুঝতে পারিনি।এত বছর এই পাড়ায় আছি, একবার পূজোয় সেক্রেটারি হলাম। সেদিনের ছেলেগুলো। হাফপ্যান্ট পরা দেখেছি।ওদের বাবা কাকারা সম্মান করত, বিপদে আপদে পরামর্শ নিত। হাতে বন্দুক পেয়ে ছেলেগুলো কেমন অচেনা হয়ে গেল। ওদের চোখের ভাষা পাল্টে গেল।
    দত্তগুপ্তের ছোটছেলেটা, আরে যার ডাক নাম ভ্যাবলা। ওর বাবা কংগ্রেসি, কিন্তু কখনও-, সে যাকগে। ছেলেটা পুকুরপাড় থেকে বন্দুক দিয়ে টিপ করে আমাদের গাছের নারকোল পাড়ছিল। আবার বন্ধুদের মধ্যে লক্ষ্যভেদের কম্পিটিশন করছিল।আমি বকলাম। এটা কি করছ, যদি কারো গায়ে গুলি লেগে যায়? ওরা হেসে উঠল। বললাম-- সাপের পাঁচ পা দেখেছ? এইসব বেআইনি অস্ত্র নিয়ে--।
    একটা বেপাড়ার ছেলে বলল-শুনুন, বেশি আইন দেখাবেন না, ফুটুন তো! না পোষালে অন্য পাড়ায় যান।
    -- মানে? এখানে আমাদের নিজেদের বাড়ি!
    --তো বিক্কিরি করে দিন। খদ্দের আছে।
    আমি পরের দিন লোক ডাকিয়ে সব নারকেল গাছ কাটিয়ে ফেললাম। সাতদিন এমনই কেটে গেল।

    ভোর পাঁচটা। আশি পেরনো সরযূবালা কৃষ্ণের অষ্টোত্তরশত নাম নেওয়া শুরু করেছেন।
    "উপানন্দ নাম রাখে সুন্দর গোপাল,
    ব্রজবালক রাখে নাম ঠাকুর রাখাল।"
    বাইরের ঘরে মশারির ভেতরে স্কুলে যাওয়া দুইনাতি পাশ ফিরে শুলো।ওদের মার সকাল উঠেই দোক্তা দিয়ে পান সাজা শুরু করেছেন। এরপর উনুনে আগুন দিয়ে চায়ের জল চড়াবেন।
    সামনের দরজায় খটখট শব্দ।
    সাতসকালে কে এলো!
    সরযুবালা বারান্দায় এসে পাথর হয়ে গেলেন। ছয়টি ছেলে। দুজনের হাতে রাইফেল আর তিনজনের হাতে পাইপগান। একজন বাগিয়ে ধরেছে রামপুরি।কিন্তু ওদের নেতাটিকে উনি বিলক্ষণ চেনেন। পাড়ার পূজারি ব্রাহ্মণের ছেলে। চালু নাম বামনা বিভাস। কিন্তু গতবছর সামনের একটি নির্মীয়মাণ বাড়ির ভেতরে বোমা বাঁধার সময় কিছু বোমা ফেটে দুজন মারা যায়। বিভাস বেঁচে যায় --একটা হাত খুইয়ে। কোন পুলিশ কেস হয় নি। কাটা হাতে প্লাস্টিক সার্জারি করার খরচা তুলতে পাড়ায় জলসা হয়। শান্তিকাকু টিকিট কিনেছিলেন, শুনতে যান নি।
    বিভাস এখন কাটা হাতের সাপোর্টে ধরে রেখেছে একটি পাইপগান।
    -- দরজা খুলে দিন ঠাকুমা, তালা খুলুন।
    --কেন?
    -- ক্যান আবার কী! ভিতরে আসুম না? আমরা অতিথ!
    -- সাতসক্কালে! এমুন বেশে? কী কাম?
    -- কাম আছে। শান্তিদারে ডাকেন ।

    সরযুবালা কাঁপতে কাঁপতে ভেতরে গেলেন।
    --বৌমা! দ্যাখ আইয়া। আমার হাত পা কাঁপতে আছে। অরা তুমার শান্তিঠাকুরপোরে মারতে আইছে। সে তো ভেতরের ঘরে ঘুমাইয়া আছেন।
    বৌমার উপস্থিত বুদ্ধি প্রখর। ব্যাপারটা আঁচ করে ভেতরে গিয়ে ঠাকুরপোকে ঠেলে তুললেন।
    -- অরা সামনের গেটা আটকাইয়া রইছে। আপনে এক মিনিটের মইধ্যে পায়খানার পিছনের গলি দিয়া পিছনের বাড়ির পাঁচিল ডিঙ্গাইয় চাষীপাড়া দিয়া লায়েলকার মাঠে যান গিয়া। সেইখান থেইক্যা বাস ধইর‌্যা পার্কসার্কাসের বাড়ি। সময় নাই, লুঙ্গি-গেঞ্জি পইর‌্যাই যান গিয়া। ধরেন এই দশটা ট্যাহা।
    মা, এই নেন গেটের চাবি। আপনে ঘরের ভেতর বইয়া থাকেন। ঠাকুরপো যাওয়ার দশ মিনিট পরে বারান্দায় আইসা তালা খুল্যা দিবেন।
    বউমা গেলেন বারান্দায়।
    --কী ব্যাপার?
    --বৌদি, দরজা খুলেন।
    --ক্যান?
    --শান্তিদারে চাই।
    -- এইডা কী কথা? সাতসক্কালে বন্দুক লইয়া শান্তিদারে চাই! দরজা খুইল্যা দ্যন! এইডা কি মগের মুল্লুক!
    -- সাবধানে কথা কইয়েন বৌদি। এইডা আপনাগো সিপিএমের সরকার না। শান্তিদারে বাইর কইর‌্যা দ্যান।
    -- ঠাকুরপো নাই।
    --কোথায় লুকাইছে?
    --লুকাইব ক্যন? সেদিন পুলাপান! ভদ্রভাবে কথা কও। শান্তিঠাকুরপো কাইল রাত্রে বাড়ি ফিরে নাই।
    - --কই গ্যাছে?
    -- আমি কি জানি! পার্টির কাজে নানান জায়গায় যাইতে হয়।
    -- আমাদের কাছে খবর আছে যে উনি কাইল রাত্রে এইবাড়িতেই ঘুমাইছেন।
    -- আচ্ছা? আমি কী মিছা কথা কইতাছি?
    -- দরজা খুইল্যা দেন। মিছা কি হাছা আমরা পরীক্ষা কইর‌্যা দেখবাম।
    -- দাঁড়াও, তালার চাবি মা কই রাখছেন খুইজ্যা দেখি!
    অবশেষে সরযূবালা চাবি দিয়ে দরজা খুলে দিলেন। ওরা হুড়মুড়িয়ে বাড়িতে ঢুকল। দুটো দরজায় দুজন রাইফেল নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। পাইপগান বাহিনি একএকটা ঘরে ঢুকে মশারি তুলে তুলে দেখল। বাথরুম পায়খানা ছাদের চিলেকোঠা কিছুই বাদ গেল না।
    রাইফেল হাতে বেপাড়ার ছেলেটি বলল--চিড়িয়া ভাগল বা!
  • ranjan roy | 192.69.103.48 | ২৩ জুলাই ২০১৫ ১১:২৭678543
  • ভেতর থেকে কাজের মাসি চা নিয়ে এল।
    --এক চুমুক খেয়ে দ্যাখ, খাঁটি দার্জিলিং!
    -- বাঃ, পেলে কোথায়?
    -- বাঘাযতীনের মোড়,ঢাকা স্টোর্স।
    সেই ঢাকা স্টোর্স? রমেনের চোখের সামনে অর্ধশতাব্দী আগের কালো কালো নেগেটিভ ছবিগুলো আস্তে আস্তে ডেভেলপ হয়।
    শান্তিকাকু বুঝতে পারেন, সামান্য হেসে বলেন-- তিনি আর নেই। এখন ভাইপোরা বসে। কিন্তু বিজনেস ভাল বোঝে।
    সাইকেলে করে একজন এসে গণশক্তি দিয়ে যায়।না, ঠিক যায় না, দাঁড়িয়ে থাকে। শান্তি খেয়াল করলেন।
    -- ও, আজ মাসের পয়লা?
    তারপর ঘরের ভেতরে গিয়ে কিছু টাকা নিয়ে ফিরে আসেন। ভদ্রলোক রসিদ কেটে খুচরো মিলিয়ে চলে যান।
    শান্তি কাগজটা এগিয়ে দিয়ে হাসেন--নে, একটু নেড়েচেড়ে দ্যাখ। তোরা তো আজকাল এসব পড়িস না! তবু দেখ। মাগো বাংলা, হ্যাঁগো বাংলার চেয়ে সত্যিকথা একটু বেশিই পাবি।
    রমেন কাগজটা হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখে।
    -- পাতা দু'একটা কমেছে মনে হচ্ছে।
    -- হতে পারে। বিক্রি কমেছে, বিজ্ঞাপন কমেছে-- পাতার আর দোষ কি! তবে এই তো শেষ নয়, প্রথমবারও নয়। আগেও হয়েছে, ঘুরে দাঁড়িয়েছি। এরাও ঘুরে দাঁড়াবে।
    --- এরা দাঁড়াবে মানে? তুমি দাঁড়াবে না?
    -- আমি? আমি শেষ হয়ে গেছি। আশি বছর পেরিয়ে আর নতুন করে কিছু করা যায় না। এখন এরা কী চায় তাও বুঝি না আর কী চাওয়া উচিত তাও না। এখন বসে পড়েছি , তারপর শুয়ে পড়ব, শেষে চোখ বুঁজব।
    শান্তি শব্দ করে হেসে ওঠেন।
    -- হ্যাৎ! কী যে আবোলতাবোল বল!
    -- আবোলতাবোল না, এখনও মাথা চোখ কান ঠিকই কাজ করছে।
    -- সে তো দেখতেই পাচ্ছি। তাই জিগাইতাছি কী করন এখন?
    --কী কইলি? কী করন? তা হইলে ঢাকাইয়া চুটকিটা মনে কর! মনে আছে? না হিন্দিমিন্দি শিখ্যা ভুইল্যা গেছস?

    শান্তির চোখে দুষ্টু হাসি ঝিকমিক করে। সেই হাসি রমেনের মধ্যে সংক্রমিত হয়। সে ছোট বাচ্চার মত দুলে দুলে বলতে থাকেঃ
    'রামধন! কী করন?
    বাবু চন্দন পেহি।
    আচ্ছা? পেহ ! পেহ ! পেহ!'
    -- বুঝলি! আমার পার্টিও এখন জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব-টিপ্লব বলে না। শুধু আগামী ইলেক্শনে জিতে ক্ষমতায় আসতে হলে কার কার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতে হবে সেই অংক কষে চলেছে। পেহ! পেহ! পেহ! পাবলিকের যেন আর কোন সমস্যা নেই। তাই পাবলিকও ধীরে ধীরে--
    শান্তি কথাটা শেষ করেন না।
    রমেন প্রথম যৌবনে শোনা একটি গানের কলি গুনগুন করে-- আ অ্যাম বিগিনিং টু ফরগেট ইয়ু, লাইক ইয়ু ফরগট মি!
    --- তুমি মেম্বারশিপ রিনিউ করাও নি?
    --নাঃ!
    -- কেমন যেন ক্লান্ত লাগে। দলটা দিন দিন সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট হয়ে যাচ্ছে, শুধু নামে কমিউনিস্ট। ওই ক্ষমতায় আসলে একটু পেনশন বাড়াবে, মাগগিভাতা বাড়াবে, কন্ট্রোলে চাল-গম-চিনি দেবে, খেটে খাওয়া মানুষদের জন্যে একটু বীমা করে দেবে। লেবার ল' এর বজ্রআঁটুনি খানিকটা ফস্কা গেরো হবে। এর চেয়ে বেশি দূরে এদের চোখ যায় না। বৃটিশ লেবার বা জার্মানির সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের চেয়ে বেশি ছেড়ে দে, ওদের সমান কিছু করাও মুশকিল।
    -- এবার আমি উঠব। আমার আগের বইপত্তর কিছু আছে? থাকলে নিয়ে যাব।
  • ranjan roy | 192.69.103.48 | ২৩ জুলাই ২০১৫ ১২:৩১678544
  • --সেসব বই আজকে কোন কাজে লাগবে?
    শান্তির চোখে অপরিসীম ক্লান্তি।

    রমেন একটু সংকুচিত হয়। এই ভদ্রলোক একদিন হাতে ধরে অন্যরকমের বই পড়তে শিখিয়েছিলেন।
    এমিল বার্নসের পরে মরিস কনফোর্থের তিনটে ভল্যুম। জোর দিয়ে বলেছিলেন-- তিন নম্বরটা মন দিয়ে পড়। থিওরি অফ নলেজ, জ্ঞানতত্ত্ব। দর্শনের সার।
    বাংলাস্কুলের ছাত্তর রমেনের দাঁত ভেঙে গেল।সেই দেখে বাংলায় ইউরোপীয় ও ভারতীয় দর্শনের প্রাথমিক বই জোগাড় করে দিলেন।
    -- ভয় পাবি না। ছাপার অক্ষরে যারা এসব লিখেছে তারা নমস্য হলেও তোর আমার মতই মানুষ। খিদে পেলে সাপটে খায়, পেট খারাপ হলে কাপড়ে চোপড়ে হয়।
    রমেন হায়ার সেকেন্ডারি দেবে।ক্লাস এগিয়ে চলেছে, কিন্তু বাজারে কেশব নাগের অংকের বই পাওয়া যাচ্ছে না। রোজ তাগাদা দেয়।
    ও কাকা! আজও পেলে না? হোমটাস্ক করব কি করে?ক্লাসে প্রপার্টিজ অফ ট্রাংগল, সাইন ল, কোসাইন ল-- কী সব হয়ে যাচ্ছে, নাগাল পাচ্ছি না যে!
    অবশেষে অফিস পাড়া থেকে এল কেশব নাগ। খুলেই চক্ষু চড়কগাছ!
    -- এ যে ইংরেজিতে লেখা। আমি বুঝবো কি করে! আর আমি তো পরীক্ষার ফর্মে বাংলা মিডিয়ম লিখেছি। বোর্ডের পরীক্ষায় প্রবলেম হবে না?
    -- দূর! ইচ্ছে করে এনেছি। কলেজে গিয়ে সবই ইংরেজিতে পড়তে হবে, এখন থেকে অভ্যেস কর। অংক পরীক্ষাটা ইংরেজিতে দিবি, বুঝলি হাঁদারাম?
    --দু'দুবার সিআরপি রেইড করল। তাই সব বই সরিয়ে ফেলতে হল, এর বাড়ি, তার বাড়ি। তোর বই আমার বই-- সব। এমার্জেন্সি উঠলে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বাড়ি ফিরে আর কোন বইয়েরই হদিস পেলাম না।
    -- আচ্ছা, তুমি নাকি এমার্জেন্সিতে গৌরকিশোর ঘোষ ও জ্যোতি দত্তের সঙ্গে একই সেলে ছিলে? ওদের কথা একটু বল না! কেমন করে সময় কাটাতে? খুব আড্ডা দিতে?
    শান্তি হাসেন।
    -- একদিনে অত সব হবে না। তবে যদি এখানেই বাথরুমে গিয়ে মাথায় দু'ঘটি জল ঢেলে আমার সঙ্গে পাত পেড়ে বসে ভাত খেয়ে নিস তো কিছু বলতে পারি। খাবি তো বল? মৌরলা মাছের ঝাল রেঁধেছি।
    রমেনের মন এক আশ্চর্য বিষাদে ছেয়ে যায়। একদিন এই ছাদই তার স্বাভাবিক আশ্রয় ছিল। সকাল-বিকেল-রাত্তির যখনই বাড়িতে ঢুকবে তখনই আসনপিঁড়ি হয়ে বসে দু'থালা ভাত মেরে দেবে, এই তো দস্তুর ছিল। খাঁটি বাঙাল!
    কিন্তু এখন সময়ের সঙ্গে শেকড় কত জায়গায় ছড়িয়ে গেছে, ভাবলে অবাক লাগে। নাঃ, ওকে এবার উঠতে হবে।
    শান্তি বুঝতে পারেন। তাই আর এক কাপ চায়ের ফরমাস করেন।
    -- শোন, গৌরবাবু জমিয়ে গল্প করতে পারতেন। ব্রজদার গুল্পসমগ্র পড়েছিস? কোলকাতার লন্ডন হওয়ার গল্প এর কাছে লাগে না! তবে আমি জানতে চাইতাম ওঁর প্রথম জীবনের বামপন্থী পর্যায়ে রেলের ট্রেড ইউনিয়ন করার গল্প। জানিস তো, উনি দার্জিলিং আসাম বেল্টের ট্রান্স-হিমালয়ান রেলওয়ে ইউনিয়ন, চা-বাগানের শ্রমিক আন্দোলন এসবের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ওঁর সাগিনা মাহাতো চরিত্র সেই সময়ের অনুভবের ফসল।
    তারপর উনি কী করে কমিউনিস্ট পার্টি ছেড়ে এম এন রায়ের চ্যালা হলেন, মানে র‌্যাডিক্যাল হিউম্যানিস্ট আর কি! জানিস, শুধু বাঙালী বুদ্ধিজীবি শিবনারায়ণ রায় আর গৌরবাবু ন'ন, হিন্দিবলয়েরও কিছু ইন্টেলেকেচুয়াল এদের দলে ভিড়ে ছিলেন।
    -- হ্যাঁ, একজনের নাম জানি, কবি হীরানন্দ বাৎসায়ন ' অজ্ঞেয়'। আমি উঠছি, কিন্তু জ্যোতির্ময় দত্তের কথা কিছু বললে না? বুদ্ধদেব বসুর এই জামাইটি লোক কেমন?
    -- কেন, তুই জানিস না?
    -- আমি কী করে জানব? আমি তো তখন নাকতলার থার্ডস্কীম পাড়ায় নতুন তৈরি 'কবিতা ভবন' এর ছাদে সন্ধ্যেবেলায় বালব জ্বালিয়ে কিছু তরুণকে কবিতা পড়তে দেখতাম, অবশ্য দূর থেকে। আমাদের মত উচ্চিংড়ের দল তখন কাছে ঘেঁষতে পারে?
    -- লোক মন্দ ছিলেন না, বেশ আমুদে। তবে একবার আমার সঙ্গে লেগে গেল। হয়েছে কি, উনি বেশ আহ্লাদ করে বললেন-- এই যে সাদার মধ্যে লাল পোলকা ডট্‌ দেওয়া শার্টটি আজ পরেছি ওটা আমার মেয়ে শনিবার দিন দেখা করতে এসে দিয়ে গেছে। ওরই জামা, আমায় পরতে দিয়েছে। আমার হাড়পিত্তি জ্বলে গেল। বললাম-একদম ফালতু কথা বলবেন না, মশাই!
    কতকাল আগের কথা। আজকাল তো ছেলেরা হরদম এরকম শার্ট পরে।
  • de | 24.139.119.172 | ২৩ জুলাই ২০১৫ ১৪:৫৩678545
  • ভালো হচ্ছে। তারপর?
  • aranya | 154.160.226.94 | ২৩ জুলাই ২০১৫ ২০:৪৬678546
  • ভাল লিখছেন রঞ্জন-দা।
    মীনাক্ষি, জ্যোতির্ময় -কে দেখি মাঝেসাঝে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে
  • Manish | 127.214.43.155 | ২৪ জুলাই ২০১৫ ১১:৫৫678547
  • Ranjan, আমার এক কলিগ ছত্রিসগড়ে অম্বিকাপুরে posting পেয়েছে। জায়গাটা কেমন, মাও অধুষ্টিত কিনা জানতে চায়।
  • ranjan roy | 192.69.103.48 | ২৪ জুলাই ২০১৫ ১২:২৯678548
  • মনী্শ,
    না, না। চমৎকার জায়গা। এখন ওখানে কোন মাওবাদী আন্দোলন নেই। ও শুধু দক্ষিণ ও পশ্চিম বস্তারে আটকে আছে। অম্বিকাপুরে গরম খুব কম। সমুদ্রতল থেকে অনেক উঁচুতে। অনেক বেড়ানোর জায়গা আছে। পাহাড়, নদী, ঝরণা। রামগড় পাহাড়ে সীতবেঙ্গা গুফায় কালিদাসের সময়ের নাট্যশালা ! আর ৯০ কিমি দূরে মইনপাট বা কমলেশ্বরপুরে তিব্বতী রিফিউজিদের বসতি। ওখানে ইউথ হোস্টেল মুভমেন্ট থেকে প্রত্যেক বছর দূর্গাপূজোর সময় চারদিনের ট্রেকিং হয়, প্যারাসোলিং হয়। ফিশ পয়েন্ট, টাইগার পয়েন্ট হয়ে সেই তিব্বতীদের ক্যাম্পে শেষ।
    কোন ভয় নেই। আমার অনেক বন্ধুর বাপের বাড়ি ও শ্বশুরবাড়ি অম্বিকাপুর। আগে শুধু বাস চলত, এখন একটি ট্রেনও যাতায়াত করে। আমাকে কাজের সুবাদে বছরে দু-এক বার যেতে হয়।
    শীগ্গির জয়েন করতে বল।
    ও হ্যাঁ, এটা তোমার জন্যে। ওখানে পঞ্চশীল হোটেলের মালিক ভদ্রলোক "সাম্য" বলে একটি বামপন্থী লিটল ম্যাগ চালান। ভালো কোয়ালিটি। আর উনি মৃদুস্বভাবের নরম সরম ভদ্রলোক। আর উনি ভালো সংগীত পরিচালকও বটেন। বেশ কয়েক বছর গণনাট্য সংঘের শিবির বা ওয়ার্কশপে এসে সুর দিতেন ও গানের ট্রেনিং দিতেন।
  • Manish | 127.214.43.155 | ২৪ জুলাই ২০১৫ ১২:৪৬678549
  • Ranjan

    অনেক অনেক ধন্যবাদ।
  • ranjan roy | 192.69.53.253 | ২৭ জুলাই ২০১৫ ২০:৩৩678550
  • ৬)

    " আজ তোমারে দেখতে এলেম অনেক দিনের পরে"
    ==================================
    রিকশা থেকে নেমে থই পাই না। চাষীপাড়ার পুকুরের পাড় ঘেঁষে থকথকে কাদা আর কচুগাছের ঝোপের পাশ দিয়ে যে একচিলতে পায়ে চলা পথ ছিল সেটার কোন চিহ্ন নেই। একটা বেশ পাকাপোক্ত পিচঢালা রাস্তা, সাপের জিভের মত দুভাগ হয়ে গেছে। শংকরের বাড়িটা এখানেই কোথাও ছিল না? ওদের বাড়িটা ছিল ছোট, একটেরে। সামনে মথুর সর্দারের বাড়ি। সম্পন্ন চাষী পরিবার ।পাশের দু'তিনটে বাড়িও ওদেরই। গোটা পরিবারে মোট একুশটি ভোট। তাই ইলেক্শনের আগে মথুর সর্দারের ওজন বেড়ে যেত। কংগ্রেস , সিপিএম-- সবারই মিষ্টি মিষ্টি কথা। কিন্তু সে বাড়িটাও উধাও। একটা ক্লাবঘর। তাতে ঘাসফুলের চিহ্ন আঁকা। তবে ল্যাম্পপোস্টের গায়ে দু'একটা ছোট ছোট লালপতাকা বাঁধা, রোদে জলে কেমন ফিকে আর ঘাড় গুঁজে রয়েছে।
    ক্লাবের সামনে গুলতানি করা ছেলেদের জিগ্যেস করতেই দেখিয়ে দিল পাশের চারতলা ফ্ল্যাটবাড়িটা-- ওটাই মথুরপরিবারের। কিন্তু আমিতো খুঁজছি শংকরদের বাড়ি, যেটা মথুরদের পেছনে ছিল। সেটাও পাওয়া গেল। সেটা ভেঙেও ফ্ল্যাট উঠছে। কাঠামোটা দাঁড়িয়ে গেছে। তাতে দো'মেটের কাজ চলছে। শেষ হয়ে দখল পেতে অন্ততঃ একবছর।
    ততদিন শংকরের পরিবারও মথুর সর্দারদের অ্যাপার্টমেন্টের একটি ফ্ল্যাটে থাকছে।
    সিঁড়ি দিয়ে উঠে ফ্ল্যাটের গায়ে নেমপ্লেট দেখে বেল টিপতেই দরজা খুলে দিল এক সদ্য যৌবনের দেহলিতে কদম রাখা এক তরুণী। আমি সসংকোচে নাম বললাম। মেয়েটির ভ্রূপল্লবের ধনুকের ছিলায় টান পড়ল। একটু বিরক্ত মুখে বলল-- বাবা বাড়ি নেই। একটু বেরিয়েছে।
    -- কখন আসবেন?
    উত্তরে চোয়াল শক্ত হল।
    ( তা জেনে তুই কি করবি রে শালা?)

    আমি নিরুপায়।
    --- তোমার মা আছেন? একটু ডেকে দেবে? বলবে রমেনকাকু এসেছেন।
    মাঝবয়সী মহিলা এসে আমাকে দেখে নমস্কার করে বললেন -ভেতরে আসুন।
    সোফায় বসে জল আর বিস্কুট খেতে খেতে চারদিকে তাকিয়ে দেখি।
    ভদ্রমহিলা বুঝলেন।
    -- ও শ্রীকলোনী বাজারে গেছে, আধঘন্টা হল; এক্ষুণি এসে পড়বে। আপনাদের গল্প অনেক শুনেছি।আমি একটু রান্নাঘরে যাই। চা না কফি?
    যান্ত্রিক ভাবে শেষের অপশনটার নাম বলি। আর অনুরোধ করি ব্যস্ত না হতে।
    উনি সহজ ভঙ্গীতে হেসে বললেন- কোন সংকোচ করবেন না, খিদে পেলে বলবেন। কেক খাবেন? আমার মেয়ে বানিয়েছে। কাল আপনার বন্ধুর জন্মদিন ছিল। আজকের খবরের কাগজগুলো এই রইল। আর টিভি চালিয়ে দিচ্ছি। আমি আসি।
    অন্যমনস্ক ভাবে চ্যানেলগুলো ঘোরাই, বার্সেলোনার পুরনো ম্যাচ, ক্রিকেটে শচীন-সৌরভ-দ্রাবিড়ের গৌরবগাথা, মফঃস্বলের কলেজে শাসকদলের ছাত্র ইউনিয়নের রক্তচক্ষু। রাজনৈতিক নেতাদের বাঁধাগতের বিবৃতি।

    সেদিন বাংলা বন্ধ। নেতাজী সুভাষ রোডে ছ'নম্বর বাসের রুটে মোড়ে মোড়ে পিকেটিং। আজকে অফিস যাওয়া চলবে না, কাকু বাড়ি ফিরে যান।
    আমি, শংকর, বিমলেন্দু আরও কয়েকজন মহানন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছি। রথতলা থেকে সেকেন্ড স্কীম, সুর্যনগর, বাঁশদ্রোণী হয়ে নেতাজিনগর।
    বাস বিশেষ চলছে না। যে দুটো বেরিয়েছিল তারা গোটা দুই পেটো আর আধলা ইঁট পড়তেই সুড়সুড়িয়ে গড়িয়া ডিপোতে ঢুকে গেছে।
    কিছু ছেলে সাইকেলচারীদের চাকার হাওয়া খুলে দিচ্ছে।
    -- হাসপাতাল ? ওষুধের দোকান? রোগী কই? ওসব চালবাজি চলবে না। আসলে সাইকেল করে অফিস যাবেন! আরে এত বেশি প্রভুভক্ত কুকুর হবেন না। প্রতিবাদ করতে শিখুন। শিরদাঁড়া সোজা করুন। বাঙালী খালি তেল মারতে শিখেছে। এইজন্যেই আমাদের কিস্যু হয় না।
    সিগ্রেট ধরিয়ে তিনজনে ভাগাভাগি করে টানি।
    -- হ্যাঁরে, মেশোমশাই আজ কী করছেন?
    শংকর অন্যদিকে তাকায়। তারপরে কলকে ফাটানো গোছের ব্যোমটান দিয়ে সিগ্রেটটা প্রায় শেষ করে দিয়ে বলে-- বাবা, কাল রাত থেকেই রাইটার্সে রয়ে গেছে। আগামী কাল ফিরবে।
    -- কেন রে?
    -- আরে গতবারের ঘটনাটা মনে নেই? আমি বোঝালেও বুঝবে না। গোঁ ধরে বসে আছে।
    আমরা চুপ মেরে যাই।
    ওর বাবা বীরেশবাবু কংগ্রেসি ইউনিয়নের সদস্য। গত বাংলাবন্ধের দিনে ছেলের কথা না শুনে পায়ে হেঁটে নাকতলা থেকে রাইটার্সে গেছলেন ডিউটি করতে। ঢুকতে পারেন নি। গেটে বাম ইউনিয়নের কিছু পিকেটার্স ওঁকে আটকে দিয়ে দুয়ো দিয়েছিল। মুখে গালে থুতু দিয়ে নকশা করে বলেছিল-- চন্দনের ফোঁটা দিয়ে সাজিয়ে দিলাম।
    বীরেশবাবু বাড়ি ফিরে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। স্ত্রী কান্নাকাটি করেছিলেন। ডাকাবুকো বড় মেয়ে চেয়েছিল বাবাকে নিয়ে যাদবপুর থানায় যেতে। নতুন ওসি সীতেশ ঝা নাকি খুব কড়া! বীরেশ রাজি হন নি। বললেন-- ওরা যে আমার পাশের টেবিলে বসে! একসাথে চাকরি জয়েন করেছিলাম , সেই বছর কুড়ি আগে।
    আমরা ওঁর বাড়ি গিয়ে বলেছিলাম-- ছাড়ুন না মেশোমশায়! কত লোক সি এল নিচ্ছে, বাড়িতে বসে আছে। সন্ধ্যেবেলা পদ্মশ্রীতে সিনেমা দেখতে যাচ্ছে।
    উনি রেগে গেলেন।
    তোমরা বুঝবে না। তোমরা অন্ধ। নেহেরুর দেশগড়ার স্বপ্ন নিয়ে কিছু ভেবেছ? ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া পড়েছ? আর মেয়েকে লেখা চিঠিগুলো? না। তোমরা পড়বে মাওয়ের রেডবুক। যে চীন আমাদের দেশ আক্রমণ করল, পেছন থেকে ছুরি মারল, এখনও বারোহাজার বর্গমাইল জমি দখল করে রয়েছে সে তোমাদের প্যারাডাইস। আর সলিল চৌধুরিরও মাথা খারাপ। কী যেন একটা গান লিখেছে?
    বিমলেন্দুর ফাজিল স্বভাব। আমার চোখের ইশারা দেখেও দেখল না। দু'কলি গেয়ে উঠলঃ
    বলিষ্ঠ দুই হাতে তুলে নাও হাতিয়ার
    রক্তের নিশান ওড়াও।
    মহাচীন আর ভিয়েতনামের পথে আজ
    মুক্তির কদম বাড়াও।
    কারখানা প্রান্তরে নগরে ও বন্দরে
    গ্রামে গ্রামে বিপ্লবের---।

    -- থামো! ঢের হয়েছে।
    এক ধমকে ওকে চুপ করিয়ে দিলেন বীরেশমেশো।
    আমি বিরক্ত। বিমইল্যার যদি কুন আক্কল থাকে!

    উনি ক্লান্ত কন্ঠে বিড়বিড় করতে লাগলেন-- এগুলো গান নয়, লোক খ্যাপানো। ছেলেছোকরাদের মাথা খাওয়া। নিজে তো দিব্যি বোম্বে গিয়ে করে খাচ্ছেন। এদিকে এরা লেখাপড়ার পাট তুলে দিয়ে--।
  • ranjan roy | 192.69.53.253 | ২৭ জুলাই ২০১৫ ২১:১৩678551
  • কলিংবেলের আওয়াজটা কি বিচ্ছিরি! ক্যারক্যার করে বেজে উঠেছে। উঃ, একটা ডি ডং লাগালে ভালো হত না?
    বৌদি দরজা খুলে দিয়েছেন। দু'হাতে দুটো থলে নিয়ে শংকর ঢুকেছে। বেঁটে মানুষটি, তায় দুটো ভারি থলে। বেশ মজার দেখাচ্ছে।
    -- আজকে চারাপোনাই আনলাম। জ্যান্ত। আর কচুশাক এনেছি, নারকোল দিয়ে, ভালো কাটোয়ার ডাঁটা পেয়ে গেলাম।
    -- ওসব হবেখন। আগে দেখ কে এসেছে!
    ড্রইংরুমটা এল শেপের হওয়ায় ও আমাকে আগে খেয়াল করেনি। কয়েক সেকেন্ডের নৈঃশব্দ। ও চোখ কুঁচকে মন দিয়ে দেখছে।
    আমি বিব্রত। এসে কি ঠিক করিনি? ও কি খুশি হয় নি?
    ওর হাতের মুঠো আলগা হয়ে বাজারের থলিটা মাটিতে পড়ে গেল।

    স্খলিত পায়ে একটু টলমলিয়ে আমার দিকে এক'পা দু'পা করে এগিয়ে আসছে পাঁচফুটিয়া এক বালক চেহারার মানব, দাড়িগোঁফ নেই। কিন্তু মাথা ভর্তি কোঁকড়ানো সাদাচুল বলে দিচ্ছে বয়েসের হিসেব।
    --রমেন? তুই রমেন? কতকাল পরে!
    বৌদির চেহারায় টেনশন, প্রায় কান্না কান্না ভাব। দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে ওর পেছনে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। এর মধ্যেও খেয়াল হয় যে মহিলা স্বামীর চেয়ে ইঞ্চি দুই বড় হবেন।
    আমি সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াই। দু'পা এগিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরি। আমার পাঁচ নয় উচ্চতায় ওর মাথা আমার বুকের মধ্যে, কিছু অস্ফুট বিড়বিড় করে চলেছে।
    ওকে ধরে সোফায় বসিয়ে দিই। মহিলা এক গ্লাস জল ও একটা সাদা ট্যাবলেট ধরিয়ে দিয়েছেন। একটু একটু করে খাও, তাড়াহুড়ো কর না।
    আস্তে আস্তে ওর মুখের চেহারা স্বাভাবিক হয়।
    আমি হাসি। ওর দুই কাঁধে হাত রাখি। তারপর বলি-- কী রে শালা আধলা!
    বৌদি বলেন-- কী বললেন?
    -- কিছু না, তুমি যাও। একটু কড়া করে কফি বানিয়ে আন।
    তারপর আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে --আমার বৌয়ের সামনে বলিস না।
    পাঁচফুট হাইটের শংকর, তাই আমাদের দেওয়া ডাকনাম-আধলা বা আধলা ইঁট। ওর বাবা বীরেশবাবু ছিলেন মেরেকেটে চার এগার। তাই ভিড়ের মধ্যে চোখে পড়তেন না।
    একদিন আধলা অরবিন্দনগরের আড্ডায় অনুযোগ করল--রমেন, তোর ব্যবহারে বাবা দুঃখ পেয়েছে রে! বলেছে রমেন রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিগ্রেট খায়, আমার বলার কিছু নেই। কিন্তু আমাকে দেখে একটু আড়াল করলেও তো পারে! লুকোনোর চেষ্টাও নেই, ফুকফুক করে ধোঁয়া ছেড়েই চলে।
    -- কী করব বল? তোর বাবা যে ভিড়ের মধ্যে চোখে পড়ে না।
    সবাই হেসে ওঠে। শংকর অস্বস্তি লুকোয়।
  • ranjan roy | 192.69.53.253 | ২৭ জুলাই ২০১৫ ২৩:২৮678553
  • -- তারপর? এদ্দিনবাদে? কী মনে করে?
    -- কিছু না, দেখতে এলাম তোরা সব কেমন আছিস।
    শংকর অন্যমনস্ক হয়ে যায়।
    ---সবাই যেমন থাকে, তাই। আলাদা করে কী আর থাকবো?
    --- মেশোমশায় মাসিমা দুজনেই?
    -- আর কুসুমদি? তোর দিদি?
    শংকর আমার দিকে দশ সেকেন্ড তাকিয়ে থাকে, আমি চোখ সরাই না। তারপর দুজনেই হেসে ফেলি।
    সেই ষাটের দশকের শেষপাদে এই পানাপুকুর-বাঁশঝাড়-আমবাগান-শেয়ালডাকা কলোনিতে কুসুমদি হৈ-চৈ ফেলে দিয়েছিল। গোঁড়া মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে কুসুমদি পাড়ার উঠতি নায়িকা। ওর জন্যে ছেলেছোকরার দল নিজেদের মধ্যে মারপিট করে মরত। কুসুমদি সবাইকে অকাতরে প্রশ্রয় দিত।ওর চোখ কথা বলত, ওর হাসিতে এক মাদক গন্ধ টের পাওয়া যেত। শংকরকে ডাকতে কখনও অসময়ে ওর বাড়ি যেতাম না। কুসুমদির মুখোমুখি হতে চাইতাম না। মনের অগোচরে পাপ নেই, বন্ধুর দিদি যে!
    কুসুমদির বাস্তববুদ্ধি প্রখর ছিল। সামান্য বয়েস হতেই ও পাড়ারই নতুন সরকারি চাকরি পাওয়া একটু বোকাসোকা ছেলেটার সঙ্গে ইলোপ করে বোম্বে টোম্বে ঘুরে মালাবদল করে হাজির হল। সামাজিক মতে বিয়েটা হয়ে গেল। কিন্তু মেসোমশায় কেমন যেন নুয়ে পড়লেন।
    আর পাড়ার হিংসুটে ছেলেগুলোর জ্বালায় জামাইবাবু এ'পাড়া ছেড়ে ভবানীপুরে ভাড়াবাড়িতে উঠে গেলেন।
    তারপর শংকর একদিন আমাকে একলা ডেকে একগাদা চিঠিপত্র পড়তে দিল। নীল গোলাপি সাদা কাগজে লেখা অজস্র প্রেমপত্র। বলল দিদির ড্রয়ার পরিষ্কার করতে গিয়ে পেয়েছে, বাবা মাকে দেখায় নি। পুড়িয়ে ফেলার আগে শুধু একলা বন্ধু রমেনকে পড়তে দিয়েছে।
    আমি অবাক। কি সব গদগদ ভাষা! হাস্যকর। কিন্তু তারচেয়েও অবাক হলাম লেখকদের নাম দেখে। সবাইকে চিনি না। অনেককেই চিনি। সব বয়সের লোকজন রয়েছে। ছোটভাই থেকে কাকার বয়েসি। কিন্তু বুকে ধক করে লাগল একজনের চিঠি দেখে, উনি আমার একজন শ্রদ্ধেয় স্থানীয় কমরেড।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লড়াকু মতামত দিন