এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  বিবিধ

  • পৌরাণিক ঘরওয়াপ্‌সি ও হরে দরে কশ্যপ গোত্র

    Sourav Mitra লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ১৮ মার্চ ২০১৯ | ৩৩৭৪ বার পঠিত
  • পৌরাণিক ঘরওয়াপ্‌সি ও হরে দরে কশ্যপ গোত্র

    সৌরভ মিত্র

    ধরা যাক, অতি খাজা একখানা প্রবন্ধ পড়তে পড়তে মুখ থেকে অজান্তেই একটি শব্দ বেরিয়ে এল, -‘জঘন্য’। বেজায় সমস্যা এই তৎসম শব্দটিকে নিয়ে। এর ব্যুৎপত্তিগত অর্থ কিনা ‘জঘনভব’ বা ‘জঘনতুল্য’ [জঘন + য (যৎ)]। কিন্তু, সেই শব্দের অর্থ শেষ অবধি ‘নিকৃষ্ট’, ‘নিন্দনীয়’ বা ‘কুৎসিত’-এ দাঁড়াল কেন, - সে এক রহস্য! ‘জঘন’ শব্দটি বেদে ব্যবহৃত।[1] সেখানে বলা হয়েছে, –‘বুদ্ধিমান অশ্বের জঘনদেশে পুনঃ পুনঃ আঘাত করে তাকে যুদ্ধে নিযুক্ত কর।’

    যাই হোক, বোঝা গেল যে বৈদিক বা ছান্দস ভাষায় ‘জঘন’ শব্দটির একটি অর্থ ‘কটিদেশ’। এরপর পঞ্চতন্ত্রে পাওয়া গেল ‘জঘন’ হল (নারীদেহের) নিতম্ব-পরিসর[2]। বাৎসায়ন, দামোদর গুপ্ত, জয়দেব, প্রমুখের রচনা আপাতত বাদ থাকুক, কারণ সেখানে অন্য কোনও অর্থ খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা কম। এরপর ধর্মমঙ্গল[3] কাব্য অবধিও ‘জঘন’ শব্দটির অর্থের কিছু পরিবর্তন হয় নি। তা হলে ‘জঘন্য’ বা ‘জঘন-তুল্যতা’ নিন্দনীয় হবে কেন?

    উত্তর মিলল মনুসংহিতায়। এই আইনগ্রন্থটিতে নারীর স্থান কহতব্য নয়। ইহলোকে পুরুষকে দূষিত করা নাকি নারীদের স্বভাব![4] নারী রূপ বা বয়সের কোনও বাছবিচার করে না, পুরুষ পেলেই তাকে ভোগ করার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে![5] এমনকি, নিজের মা বোন বা মেয়ের সাথেও নাকি সেই কারণে একা থাকতে নেই![6]

    আর না এগোনোই ভাল। যাই হোক, যে শাস্ত্রকারগণ নারী সম্বন্ধে এমন ‘উচ্চ’ ধারণা পোষণ করতেন, নারীর অঙ্গবিশেষের প্রতি তাদের (অন্ততঃ প্রকাশ্য) দৃষ্টিভঙ্গী কেমন হবে –তা বলাই বাহুল্য! ফলে, সংহিতার অষ্টম অধ্যায়ে গিয়ে বলে বসলেন, উচ্চবর্ণের কন্যাগমনকরী ‘জঘন্যো’-জাতির লোকেরা বধ্য বা বধযোগ্য হবে।[7] ‘জঘন্য’ (বা ‘জঘন্যো’) শব্দের অর্থ এখানে নিম্নবর্ণ, শুদ্র। আর শুদ্র মানেই তো হীন, নীচ, সুতরাং-। আপাত ভাবে মনে হয়, যেন একটি মাত্র শব্দের মাধ্যমে প্রথমে নারীজাতি, তারপর এই ভূখণ্ডের পনেরো আনা মানুষকেই নিকৃষ্ট, নিন্দনীয় বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু, বিষয়টি কি এতই সরল, এতই একপেশে?

    মনুসংহিতাকে ‘স্বয়ম্ভূ মনুর রচনা’ বলে দাবী করা হয় বটে, কিন্তু এই মনু মোটেই ‘স্বয়ম্ভূ’ নয়। মনুসংহিতা বা মনুস্মৃতির কোনও প্রাচীনতর সংস্করণ থাকতেও পারে, তবে যে সংস্করণটি পাওয়া যায়. সেটি খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে পুষ্যমিত্র শুঙ্গের ব্রাহ্মণ্যবাদী বিপ্লবের পর তারই ‘নির্দেশে’ লেখা হয়েছিল। সেখানে প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে লেখা রয়েছে ‘ভৃগু কর্তৃক রচিত’। তবে ‘নারদস্মৃতি’ অনুসারে সুমতি ভার্গব নামের জনৈক ব্রাহ্মণ মনু ছদ্মনামে এই আইনগ্রন্থটির সংকলন করেছিলেন/ লিখেছিলেন।[8] এমনকি, স্বয়ং ভীমরাও আম্বেদকরও একই কথা বলেছেন।[9]

    এই সুদীর্ঘ ‘হিন্দু প্রতিক্রিয়া যুগে’র[10] এক ‘নায়ক’ শঙ্করাচাৰ্য্য। তিনি আজীবন প্রতিপক্ষ মীমাংসা দর্শন, সাংখ্যদর্শন ও সামগ্রিক ভাবে বৌদ্ধদর্শন-কে খণ্ডন করার প্রচেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলেন। ‘নারী নরকের দ্বার’ -এই কুখ্যাত ভাষ্যটি তারই। ব্রহ্মানন্দ গিরি, যিনি বিখ্যাত তন্ত্রজ্ঞ হওয়ার পাশাপাশি (জনশ্রুতি অনুসারে) কালীঘাট মন্দিরের মূর্তির রূপদানকারী, নিজের রচনায় এই কারণে শঙ্করাচাৰ্য্যকে ব্যাপক তিরস্কার করেছেন।[11]

    তবে একথাও ঠিক যে ‘নরক’ শব্দটির অর্থ একতরফা ভাবে ‘নিন্দনীয় নিকৃষ্ট স্থানবিশেষ’ ধরে নেওয়া-ও খুব গোলমেলে বিষয়। শব্দটির অর্থোদ্ধারের জন্য নীচের তালিকাটি দেখুন।

    ‘ন’ : ‘না-করণ’ ও/ বা ‘অন-করণ’ (শেষ করা ও/ বা শুরু করা)। ধ্বনিটির/ শব্দটির অর্থের ধাঁচ অনেকটা ইংরেজি ‘vindication’-এর মতো, ‘সূচনা’ ও ‘খণ্ডন’ উভয়েই যার অর্থ।) উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ‘ন’ শব্দের অর্থ যখন ‘বিত্ত’, ‘রত্ন’ বা সধবার লৌহবলয়’ (যার থেকে ‘নোয়া’ শব্দটি এসেছে, যা চলমান বৈবাহিক জীবনের প্রতীক) তখন তা ‘অন-করণ’-গুণ প্রকাশ করে।[12] আবার সমাসের পূর্বপদে, যেমন ন-কুল, ন-পুংসক, ন-ক্ষত্র, ইত্যাদি ক্ষেত্রে তা ‘না-করণ’ গুণ প্রকাশ করে।[13]

    ‘নর’ : ‘ন রহে বা রক্ষিত হয় (র) যেখানে’ বা ‘ন কে রক্ষাকারী (র)’। ‘নর’ শব্দের উৎস ‘√নৃ’ ধাতু। যার অর্থ ‘প্রাপণ’[14] (deliverance), উদ্ধার, নিষ্কৃতি, নিস্তরণ, মুক্তি, রক্ষা, রায় বা মতামত প্রদান, ইত্যাদি। যার মধ্যে উল্লিখিত ক্রিয়াগুলির গুণ/ বৈশিষ্টগুলি রহে বা রক্ষিত হয়, সে-ই হল ‘নর’। ‘প্রকৃতিবাদ’ অভিধানে শব্দটির ব্যুৎপত্তি দেওয়া হয়েছে ‘লওয়া, পাওয়া + অ’। এক কথায়, ‘নর’দের মধ্যে বিভিন্ন পরস্পরবিরোধী বা/ এবং বহুমুখী গুণের/ বৈশিষ্টের সমাহার থাকে। (স্মর্তব্য, ‘নর’ শব্দের একটি অর্থ হল ‘শঙ্কু’; যে আকার একদিক থেকে সংকোচনশীল, আবার বিপরীত দিক থেকে প্রসারণশীল।)... যে কর্মযজ্ঞে এই ‘বহুমুখী গুণধারী/ বৈশিষ্টধারী জনগণ’-কে বা তাদের ‘মেধা’-কে নিযুক্ত করা হয়, তাকে ‘নরমেধ যজ্ঞ’ বলা হয়!

    ‘নরক’ : ‘নর-করণ (ক) হয় যেখানে’। ব্যুৎপত্তিগত দিক থেকে শব্দটি অষ্টাধ্যায়ী বর্ণিত ‘উনাদি সূত্র’ অনুসারে ‘√নৃ (প্রাপণ) + অক’ –এই পথে গঠিত হয়েছে। এর অর্থ ‘ক্লেশ-প্রাপক’।[15] এই তথাকথিত ‘ক্লেশ’-এর স্বরুপ কী? – এক কথায় বলতে গেলে, ওপরে ‘নর’ শব্দার্থের ব্যাখ্যায় যে ‘পরস্পরবিরোধী বা/ এবং বহুমুখী গুণ’-এর কথা বলা হয়েছে, কর্ম রূপে তার টানাপোড়েনের ক্লেশ! নরক নাকি ‘পাপভোগস্থান’। তাহলে পাপ কী? – অপাদানবাচ্যে ‘√পা + প’। ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’ অনুসারে ‘পালককে পালন করে যে/যা’! যে ব্যবস্থায় প্রতিপালিত বস্তু (উদাহরণ হিসেবে, সন্তান বা অন্য কোনও সৃষ্টি) প্রতিদানে তার পালক-কে (পিতা বা সৃষ্টিকারী) পালন করে (শ্রদ্ধা, সেবা বা বিক্রয়মূল্যের দ্বারা)’, তাকে ‘পাপ’ বলে। ঘটনাচক্রে, বৌদ্ধযুগ পরবর্তি ভারতে বাণিজ্যযোগ্য বা উদ্বৃত্ত উৎপাদনকেই দণ্ডনীয় পাপ বলা হয়েছিল। (‘ত্রিশূলে ত্রিশূলে চরণচিহ্ন দিয়ে যাও’ নিবন্ধে বিষয়টি ব্যাখা করা হয়েছে।) ‘পাপ’-এর স্বরূপ তাহলে বোঝা গেল।

    হিন্দুধর্মে এত জাতবিচার, শূদ্র ও দলিত জনজাতির প্রতি এত অবিচারের জন্য হামেশাই প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যগুলিকে দায়ী করা হয়। কিন্তু, সেটা কতদূর ঠিক? দেখা যাক এই সাহিত্যগুলিতে কী পাওয়া যায়;-

    · ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য শূদ্র বর্ণের মধ্যে কোনও ভেদ নেই। পূর্বে ব্রহ্ম থেকে সৃষ্ট ব্রাহ্মণ দ্বারাই জগৎ পূর্ণ ছিল। তারা ভিন্ন ভিন্ন কাজে নিযুক্ত বা প্রযুক্ত হয়ে ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য শূদ্র নামে অভিহিত হয়েছে।[16]

    · সমস্ত বর্ণই একে অপরের জ্ঞাতি।[17]

    · দেব, মুনি, দ্বিজ (দৈহিক জন্মের পর জ্ঞান অর্জন হেতু যার দ্বিতীয় জন্ম হয়েছে), রাজা (ক্ষত্রিয়?), বৈশ্য, শূদ্র, নিষাদ, পশু (‘যে অবিশেষে দেখে’, ত্রিসন্ধ্যাজপ ইত্যাদি পালন করে), ম্লেচ্ছ ও চাণ্ডাল (চণ্ডাল থেকে জাত) – এই দশ প্রকার ব্রাহ্মণ হয়।[18]

    · অথর্ব্ব বেদে প্রার্থনা করা হয়েছে, -হে মানবজাতি, তোমাদের জলগ্রহণ, খাদ্যগ্রহণ একসাথে হো’ক।[19]

    · আপস্তম্ভ ধর্মসূত্র অনুসারে, আর্য্যাদের তত্ত্বাবধানে শূদ্রের রান্না করাই নিয়ম।[20]

    · এটি তো সবাই জানে, অর্থাৎ, মানুষ শূদ্র হয়ে জন্মায়। উপনয়ন (গলায় সুতো ঝোলানো নয়, বিদ্যালাভ অর্থে) করে হয় দ্বিজ। দ্বিজ বেদ পাঠ সম্পন্ন করে হয় বিপ্র। সাধনার মাধ্যমে ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করলে ব্রাহ্মণ হয়।[21] সুতরাং, শুধু ব্রাহ্মণ কোনও বংশপরিচয় ছিল না, তা ছিল বৃত্তিপরিচয়।

    · ব্রহ্মতত্ত্ব জানে না, এদিকে গলায় পৈতে দিয়ে যে ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণত্বের গর্ব করে, তাকে ‘পশু ব্রাহ্মণ’ বলা হয়। তার গলার পৈতে আর গরু-ছাগলের গলার দড়ি সমতুল্য।[22]

    · আপস্তম্ভ ধর্মসূত্র অনুসারে, ধর্মাচরণ (বা উপযুক্ত আচরণ) করলে ‘জঘন্য’ বর্ণের মানুষ ‘উচ্চবর্ণ’ প্রাপ্ত হয়, আবার উপযুক্ত আচরণ না করলে উচ্চবর্ণও ‘জঘন্য’-এ পরিণত হয়।

    আসলে বৌদ্ধযুগের পতনের পর বৈদিক হিন্দুধর্মের ব্যাপক restructuring করে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুধর্ম সৃষ্টি করার সময় বৈদিকধর্মের উদার দৃষ্টিভঙ্গিগুলো বাদ দিয়ে, জন্মগত জাতিভেদ প্রথা চালু করে সামাজিক hegemony-কে পাকাপোক্ত ভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। -যাতে সমাজের শৃঙ্খলা বেশ কড়া হাতে ধরে রেখে সম্ভাব্য কোনও ‘দ্বিতীয় বৌদ্ধযুগে’র আগমন ঠেকানো যায়।

    হ্যাঁ, বৌদ্ধদের প্রতি ব্রাহ্মণদের আক্রোশ কিছুটা বেশিই ছিল। নারদপুরাণে বলা হয়েছে, নিজের চরমতম বিপদের দিনেও যদি ব্রাহ্মণ কোনও বৌদ্ধের বাড়িতে প্রবেশ করে, তা হলে কয়েক শো বার প্রায়শ্চিত্তেও তার নিস্তার নেই।[23] কোনও ক্ষত্রিয়, বৈশ্য বা শূদ্রবংশের মানুষ ব্রাহ্মণকে মান্যিগণ্যি না করলেই তাকে ‘রাক্ষসযোনি প্রাপ্ত’ বলে দাগানো হত![24]

    প্রশ্ন উঠতেই পারে, বৌদ্ধযুগের পতনের পর বৈদিক হিন্দুধর্মকেই প্রতিষ্ঠা না করে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুধর্মকে প্রতিষ্ঠা করা হল কেন? – এর মূল কারণ বৈদিক সমাজের চতুর্বণাশ্রমিক গঠন। সেই সমাজে শূদ্রের অধিকার ছিল খুবই সীমিত, বৈশ্যের ছিল অর্থ-শক্তি ও ক্ষত্রিয়ের ছিল পেশীশক্তি। অপরদিকে ব্রাহ্মণ তার বিদ্যার দাপট বা সম্মানের বিনিময়ে শূদ্রের শ্রম, বৈশ্যের অর্থ বা ক্ষত্রিয়ের পেশীশক্তিকে নিজের প্রয়োজন মতো ব্যবহার করত। (বৈদিক ব্রাহ্মণ মানেই সবাই যে সন্ন্যাসীতুল্য হবে, তা নয়)। কিন্তু সেই র্বণাশ্রম ছিল কর্মভিত্তিক। এই ব্যবস্থায় রাজধর্ম বা রাষ্ট্রধর্ম বদলে গেলে বৈশ্য বা ক্ষত্রিয়দের ক্ষমতার বিন্যাসে কিছু হেরফের হতে পারে, তারা সম্পূর্ণ ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ে না। কিন্তু, এমন পরিস্থিতিতে সমস্যায় পড়ে বিদ্যাজীবীরা। কারণ, বিদ্যার ‘বিনিময় মূল্য’ তার ব্যবহারিক প্রাসঙ্গিকতার ওপর নির্ভর করে। কিছুটা সরল করে বললে, সামগ্রিক ভাবে সেই সময়ের দর্শনকে ধর্মবিশ্বাসের থেকে আলাদা করা প্রায় অসম্ভব ছিল। তখন (মূলতঃ) বৌদ্ধ দর্শনের চর্চা তার নিজস্ব উচ্চতা লাভ করে ফেলেছে, এর পাশাপাশি রাজধর্ম বা রাষ্ট্রধর্ম হিন্দু থেকে বৌদ্ধে পরিণত হওয়ায় তার প্রাসঙ্গিকতা ও পৃষ্ঠপোষকতা দুইই বেশি ছিল। এর ফলে ব্রাহ্মণের বস্তুগত ক্ষমতা ক্রমশঃ হ্রাস পেতে পেতে তলানিতে গিয়ে ঠেকে।

    এরপর পুষ্যমিত্র শুঙ্গ, যে কিনা নিজে ব্রাহ্মণ ছিল, মৌর্য্য তথা বৌদ্ধ যুগের অবসান ঘটালে ব্রাহ্মণ তার হৃত ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করতে একপ্রকার মরিয়া হয়ে ওঠে। বৌদ্ধদের প্রতি হিংসাপরায়ণ হয়ে, নতুন করে আইন লিখে, যথেচ্ছ পরিমাণ ফতোয়া জারি করে ক্ষমতা সুনিশ্চিত করতে চায়।

    কিন্তু, ততদিনে সমাজে আরেকটি পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। তা হল ব্যবসায়ী বা শ্রেষ্ঠীশ্রেণীর উদ্ভব ও রমরমা। বৈদিক হিন্দুযুগে সমাজ ছিল মূলতঃ ভাববাদী, বাণিজ্যের প্রভূত উত্থানে সমাজ কিছুটা হলেও (আধুনিক পরিভাষায় বললে) পুঁজিবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। আর কে না জানে, পুঁজিবাদের জমি শক্ত হলে সামাজিক নিরাপত্তার (Social Security) ভিত আলগা হয়। ফলে, ঠিক যেমন আধুনিক যুগে পুঁজিবাদী বা আধা-পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বীমা বা ‘Insurance’ খুব জরুরী হয়ে ওঠে,[25] তেমনই আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নিরাপদ করতে পরিবারের সামাজিক পদমর্যাদাকে থিতু করার উদ্যম দেখা যায়। -আগে যে বর্ণাশ্রম কর্মভিত্তিক ছিল, তাকে জন্মভিত্তিক করে ফেলা হয়। ক্ষত্রিয়তা ততদিনে বহুলাংশেই জন্মভিত্তিক হয়ে পড়েছিল, আর সঙ্গত কারণে বৈশ্যদেরও এই নতুন ব্যবস্থায় খুব একটা আপত্তি থাকার কথা ছিল না। জন্মভিত্তিক বর্ণাশ্রমে যেহেতু কর্মগুণে উচ্চ বর্ণ প্রাপ্তির কোনও সম্ভাবনা ছিল না, তাই অচিরেই তা জাতিভেদ প্রথা সৃষ্টি করে ফেলে। দুর্ভাগ্যের শিলমোহর শূদ্রদের কপালে পাকাপাকি ভাবে পড়ে যায়।

    এ’কথা প্রমাণিত যে, পুরাণগুলি বৌদ্ধযুগের পতনের পর থেকেই লেখা শুরু হয়েছিল। অর্থনৈতিক দিক থেকে বৌদ্ধ রাজারা ছাড়াও বৌদ্ধমঠগুলির মূল পৃষ্ঠপোষক ছিল ‘শ্রেষ্ঠী’ নামে পরিচিত বণিক শ্রেণীর মানুষজন। কে জানে, হয়তো শ্রেষ্ঠীদের উপার্জনে কোপ মারার মাধ্যমে ও (ফলাফলস্বরূপ) বৌদ্ধমঠগুলির সম্পদে হ্রাস করার উদ্দেশ্যেই হয়তো সার্বিকভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর (ভগবত পুরাণে) ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞার কথা বলা হয়েছিল!

    এত চেষ্টা করেও যখন শেষরক্ষা হয় নি। জন্মভিত্তিক বর্ণাশ্রমে সমাজের নীচুতলার মানুষের কোনও উত্থানপথ ছিল না। সুতরাং, যা ‘সাম্যের কথা’ বলে, তারা সেই ধর্মের দিকে তাদের ঝোঁক কমার কথাও নয়। কিন্তু শূদ্র না থাকলে উচ্চবর্ণদের সেবা করবে কে! সম্ভবতঃ কিছুটা শূদ্রদের আটকাতে/ ফেরাতে, কিছুটা উচ্চপদধারী বৌদ্ধদের ফিরিয়ে এনে দলভারী করার তাগিদে তখন আবার ‘গৌতম বুদ্ধ বিষ্ণুর নবম অবতার’ -জাতীয় প্রচার শুরু হয়ে যায়। (কথিত আছে, এই প্রচার শুরু হয় আদি শঙ্করাচার্য্যের আমলে) ভাবখানা এই, - বৌদ্ধ তো হিন্দুরই অংশ, সুতরাং আলাদা করে বৌদ্ধধর্মের অস্তিত্ব অর্থহীন!

    একই ধরণের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছে জৈনধর্মের সঙ্গেও। কখনও বলা হয়েছে, স্বয়ং কৃষ্ণ নাকি তীর্থাঙ্কর নেমিনাথের মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, - পৌরাণিক কালপঞ্জীর হিসেবেও যে দাবী অবান্তর শোনায়! কখনও বলা হয়েছে প্রথম তীর্থাঙ্কর ঋষভনাথ নাকি বিষ্ণুর অবতার![26] ভগবতপুরাণ (১.৩.১৩) অনুসারে ঋষভনাথ নাকি তার মধ্যে অষ্টম অবতার। আর সেখানে বিষ্ণুর অবতারের সংখ্যা দশের পরিবর্তে চব্বিশ! এছাড়া মার্কণ্ডেয়পুরাণ, ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ, স্কন্দপুরাণ ও বিষ্ণুপুরাণেও ঋষভনাথের উল্লেখ আছে।

    প্রশ্ন হল, এর সমস্তটাই কি তথাকথিত ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি’র লক্ষণ? ইতিহাস তেমন কথা বলে না! চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের আমলে জৈন সমাজের প্রধান ছিলেন ‘ভদ্রবাহু’ নামের এক সন্ন্যাসী। এই সময়ে প্রায় বারো বছর ব্যাপী দুর্ভিক্ষের কারণে একদল অনুগামীসহ দাক্ষিণাত্যে (কর্ণাটকে) চলে যান। ভদ্রবাহুর এক শিষ্য স্থূলভদ্র ও তার অনুগামীরা অবশ্য মগধেই রয়ে গিয়েছিলেন। (পরবর্তিকালে স্থূলভদ্রের অনুগামীরা ‘শ্বেতাম্বর’ সম্প্রদায়ে পরিণত হয়।)

    এরপর দাক্ষিণাত্যের জৈনরা ‘লিঙ্গায়েত শৈব’দের দ্বারা এবং মগধকেন্দ্রিক জৈনরা ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু ও বৌদ্ধদের দ্বারা প্রভাবিত ও আক্রান্ত হতে শুরু করে। (হ্যাঁ, বৌদ্ধদের দ্বারাও জৈনরা আক্রান্ত হয়েছিল।)

    গুপ্তযুগ অবধি জৈনদের ‘নির্গ্রন্থ’ বলা হত। মনে রাখা দরকার, শুঙ্গ থেকে গুপ্তযুগের মধ্যবর্তী সময়ে বহু শতাব্দী ধরে ‘শ্রুতি’ হিসেবে চর্চিত হিন্দু দর্শনের রচনাগুলির পাশাপাশি বিভিন্ন পুরাণ সহ মনুসংহিতাকে ‘গ্রন্থে’র আকারে লিখে ফেলা হয়েছিল (বেদ ও মহাকাব্যগুলি ‘লেখা’ শুরু হয়েছিল আরও আগে), আর সম্ভবতঃ জৈনরা সেই কাজ তখনও করে ওঠে নি। -এই কারণেই হয়তো ‘নির্গ্রন্থ’ নামকরণ।

    এদিকে ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ অনুসারে ‘গ্রন্থ’ শব্দটির অন্য দুটি অর্থ হল ‘ধন’/ ‘বিত্ত’ ও ‘সন্ধিস্থাপন’ (স্মর্তব্য, প্রাণীদেহের সন্ধিগুলিকে ‘দেহগ্রন্থি’ বা ‘গ্রন্থি’ বলা হয়)। সুতরাং এই ‘নির্গ্রন্থ’ নামকরণের অন্য দুটি সম্ভাব্য কারণ থাকতে পারে;

    (১) যেহেতু জৈন দর্শন সন্ন্যাস ও ত্যাগনির্ভর, সুতরাং জৈনদের ধন বা বিত্ত বলতে কিছুই থাকত না (দিগম্বররা তো পোশাক অবধি ত্যাগ করেছিল)।

    (২) জৈন দর্শন ও ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু দর্শনের মধ্যে এতটাই বিভেদ বা মতানৈক্য ছিল যে সেই যুগে জৈনদের সাথে হিন্দুদের কোনও রকম সন্ধি বা আপস সম্ভব ছিল না।

    যাই হোক, ‘দিব্যাবদান’ নামক বৌদ্ধ গ্রন্থে পাওয়া যায়, মৌর্য্যযুগে পুণ্ড্রবর্ধনের জৈনরা তাদের মন্দিরের দেওয়ালে একটি বিতর্কিত ছবি এঁকেছিল। গৌতম বুদ্ধ জনৈক জৈন সন্ন্যাসীর চরণাগত, –এই ছিল ছবিটির বিষয়। এমন ঘটনায় ক্রুদ্ধ হয়ে সম্রাট ‘ধর্মাশোক’ পাটালিপুত্রের আঠারো হাজার জৈন ধর্মাবলম্বীদের হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

    অবশ্য, ‘দিব্যাবদান’-এর এডয়ার্ড ক্যয়েল ও আর. এ. নীল-এর সম্পাদনায় রোমান হরফে সংস্কৃত ভাষায় ১৮৮৬ সালে প্রকাশিত সংস্করণের টিকা ও সেটি অনুসরণ করে অধ্যাপক উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্যের লেখা ‘বাংলার বাউল ও বাউল গান’ জাতীয় কয়েকটি গ্রন্থে জৈনদের পরিবর্তে ‘আজীবিক’দের হত্যার কথা বলা হয়েছে। তবে সম্ভবতঃ এই ধারণা সঠিক নয়। কারণ, আজীবিক ও জৈন পৃথক দুটি ধর্ম তথা দর্শন[27], এবং চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের সমসাময়িক ভদ্রবাহুর রচিত ‘কল্পসূত্র’ নামক জৈন গ্রন্থ অনুসারে ‘পোংডবর্ধনীয়া’ বা ‘পুণ্ড্রবর্ধনীয়’ প্রকৃতপক্ষে ‘গোদাস-গণ’[28] নামক জৈন সম্প্রদায়ের একটি শাখা। আজীবিকদের সাথে এর কোনও সংযোগ নেই।

    যাই হোক, দাক্ষিণাত্যে সপ্তম শতাব্দীর শৈব কবি সুন্দরমূর্তি, সম্বন্দর, আপ্পার ও মণিক্কবচকর জৈনদের শৈবধর্মে পরিচিত করেন। তাদের প্রভাবে নাকি বহু জৈন রাজা শৈবধর্ম গ্রহণ করেছিল। অষ্টম শতাব্দীতে পাণ্ড্যবংশের রাজা কুন পাণ্ড্যন নাকি আট হাজার জৈন সন্ন্যাসীর প্রাণদণ্ডের নির্দেশ দিয়েছিলেন। উত্তর আরকটের তিভাতুরের দেওয়ালে এই গণহত্যার চিত্র খোদিত রয়েছে ঠিক, কিন্তু যেহেতু কোনও জৈন গ্রন্থে এই ঘটনার উল্লেখ নেই, তাই তার সত্যতা বিষয়ে কিছু মতভেদও আছে।

    একাদশ (অথবা দ্বাদশ) শতাব্দীতে চালুক্যদেশের হৈহয়রাজবংশীয় জৈন রাজা বিজ্জলের প্রধানমন্ত্রী বাসব[29] প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী হয়ে জৈন ধর্মাবলম্বী জনগণকে ‘লিঙ্গায়েত শৈব’[30] ধর্মে ধর্মান্তরিত করতে শুরু করেন। সেই সময়ে বহু জৈন মন্দির ধ্বংস করা হয়।

    দ্বাদশ শতাব্দীতে হৈসল প্রদেশের রাজা বিষ্ণুবর্ধন নিজে জৈনধর্ম ত্যাগ করে হিন্দুধর্ম গ্রহণ করেন এবং রাজ্যবাসীদের তার পথ অনুসরণ করার নির্দেশ দেন। কথিত আছে, তার আমলে ধর্মত্যাগে অস্বীকারকারী জৈনদের জীবন্ত অবস্থায় গরম তেলে ফেলে দেওয়া হত।[31]

    এরপর মাহমুদ গজনি ও মহম্মদ ঘোরির ভারত আক্রমণ। এমনিতেই বিগত কয়েক শতাব্দী ধরে জৈনরা তখন ক্রমহ্রাসমান, ফলে মুসলমান শাসনের শুরুর দিকেই আত্মরক্ষার স্বার্থে তাদের পক্ষে হিন্দুদের সাথে প্রায় লীন হয়ে যাওয়া ছাড়া বিশেষ কোনও উপায় হয়তো ছিল না।

    যেখানে জৈন দর্শন সৃষ্টিকর্তা বা ধ্বংসকর্তা হিসেবে কোনও ঈশ্বরেরও ধারণা অবধি বর্জন করেছিল, সেখানে জৈন ধর্মাবলম্বীদের ঠাকুরঘরে হিন্দু পৌরাণিক দেবদেবীর পূজার চল শুরু হয়। সমগ্র রাজপুতনায় হিন্দু রাজাদের স্থাপিত বহু দূর্গের ভেতরে অবস্থিত জৈন মন্দিরগুলিতে হিন্দু দেবদেবীর মূর্তির উপস্থিতি এই ‘আত্মরক্ষার স্বার্থে হিন্দুদের সাথে লীন হওয়া’র প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষ প্রমাণ তো বটেই। আবার মানভূম-পুরুলিয়া বা রাঢ়ের পশ্চিমাঞ্চলেও (বঙ্গদেশের যে অঞ্চলে জৈনধর্ম সবচেয়ে বেশি বিস্তার লাভ করেছিল) ব্রাহ্মণ্য ধর্মের/ সংস্কৃতির ‘প্রভাবে’ জৈন মন্দিরগুলিতে হিন্দু দেবদেবী পূজার চল দেখা যায়। সত্য বলতে কী, এই অঞ্চলে জৈন মন্দিরগুলিই হিন্দু মন্দিরে পরিণত হয়েছে! যেই কারণে পুঞ্চার পাকবিড়রা গ্রামে মহাবীর মূর্তির পূজা হয় ‘কালভৈরব’ রূপে, পুরুলিয়ার বেগুনকোদরের শিবলিঙ্গের পাশে পূজিত হয় জৈন তীর্থাঙ্করের মূর্তি, বাঁকুড়াতেও জৈন মূর্তি ‘ভৈরব’ হিসেবে পূজিত হয়। মানভূমের জৈনরা তাদের স্বকীয়তা হারাতে হারাতে ‘সরাক’ নামের খুব ছোট একটি সম্প্রদায়ে পরিণত হয়।[32]

    এই সমস্ত ঘটনার পাশাপাশি বেদব্যাসের মহাভারতের শল্যপর্বে ও কাশীদাসী মহাভারতের[33] গদাপর্বে একটি অদ্ভুত আখ্যান পাওয়া যায়। সেখানে দেখা যায়, কোনও এক নিদারুণ দুর্ভিক্ষের সময় নাকি সারস্বত মুনির নেতৃত্বে গোমতী নদীর তীরে অন্নসত্র খুলে, ষাট হাজার বৌদ্ধকে বেদপাঠ শুনিয়ে, পৈতে ধারণ করিয়ে ধর্মান্তরিত করা হয়েছিল।[34]

    মহাভারতে বৌদ্ধধর্মের উল্লেখ অবিশ্বাস্য শোনাতে পারে। কিন্তু, ‘অতি প্রাচীনকালে রচিত’ - এমন একটি ধারণা প্রচলিত থাকলেও মহাভারত প্রথমবার ‘লেখা’ হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী নাগাদ, মৌর্য্যযুগে।[35] ঘটনাচক্রে, মহাভারতের ভাষাতেও অভিজাত সংস্কৃত ভাষার পরিবর্তে প্রাকৃত ও ‘মিশ্র বৌদ্ধ সংস্কৃত’ ভাষার প্রভাব বেশি। অবশ্য মহাভারতের অপেক্ষাকৃত আধুনিক সংস্করণগুলিতে এই ‘ঘরওয়াপ্‌সি’র ঘটনাটি বৌদ্ধদের পরিবর্তে ‘বেদজ্ঞান বিস্মৃত’দের সাথে ঘটেছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে বলে রাখা ভাল, রামায়ণ লেখা হয়েছিল আরও পরে, দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষভাগে। চতুর্থ শতাব্দীতে (গুপ্তযুগে) কালিদাসের পরবর্তি সময়ে তা ভট্টি ও কুমারদাস নামক দুই কবির হাতে সংশোধিত ও পূনর্লিখিত হয়।[36] তাই রামায়ণে ভাষার সংহতি, শব্দের সুনির্দিষ্টতা, ভাষারীতির স্বাতন্ত্র তুলনামূলক ভাবে বেশি স্পষ্ট।

    শুধু মহাভারত নয়, ভবিষ্যপুরাণেও এই ‘ঘরওয়াপ্‌সি’ বা ধর্মান্তকরণের উল্লেখ আছে। এই পুরাণটির রচনাকাল ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রথমভাগের আগে নয় বলেই মনে হয়। কারণ, তাতে ‘মরুস্থলে’ (‘মেরুস্থলে’ বা ‘মেরুপ্রদেশে’ নয়) ‘মহামদ’ (মহম্মদ?) নামের এক ‘শিষ্যশাখা’ (সাহাবী?) সহ বিরাজ করার কথা বা মরুস্থলের রাজা ও নিবাসীরা সেই মহাদেবের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করার কথা বলা আছে।[37] যদিও গোরক্ষপুর গীতাপ্রেসের ভবিষ্যপুরাণের হিন্দি অনুবাদে এই শ্লোকদুটির উল্লেখ থাকলেও তাদেরকে অনেকটাই ‘ভিন্ন অর্থে’ ব্যখ্যা করা হয়েছে।

    যাই হোক, ভবিষ্যপুরাণ অনুসারে মহর্ষি কর্ণের উদ্যোগে ‘মিশ্রদেশ’[38] বা মিশর থেকে উদ্ভূত কশ্যপগোত্রের ‘ম্লেচ্ছ’রাও বেদ পাঠ, শিখা ও উপবিত ধারণের মাধ্যমে ব্রাহ্মণ্যধর্মে পুনঃপ্রবেশ করে।[39]

    ওপরের অনুচ্ছেদটি পড়ে একটি খটকা জাগতে পারে। - ম্লেচ্ছদের ‘কশ্যপ গোত্র’ বলা হচ্ছে কেন? - ‘ম্লেচ্ছ’ শব্দের বর্তমান অর্থ যাই হোক না কেন, যাবতীয় শূদ্র ও ‘অব্যক্তভাষী’ (যারা সংস্কৃতে কথা বলে না) মানুষকেই ম্লেচ্ছ বলা হত। হরিবংশপুরাণ ও মনুসংহিতা অনুসারে ‘বেদাচারবহিষ্কৃত’ ও মেদিনীকোষ অনুসারে ‘বেদবাহ্য দুরাচার’ মাত্রেই ম্লেচ্ছ। আর কে জানে, শূদ্রেরই বেদপাঠ নিষিদ্ধ ছিল। আর ‘শক্তিসঙ্গমতন্ত্রে’র ‘প্রাণতোষী’ অধ্যায়ের ‘হর-পার্বতী সংবাদ’ অংশ অনুসারে শূদ্রজনের গোত্র হল কশ্যপ।

    এই ‘হর-পার্বতী’র কথোপকথনের মাধ্যমে দেশের পঁচাশি শতাংশ মানুষের গোত্র পরিচয় প্রকাশ পাওয়ার ঘটনা থেকেই ‘হরে দরে কশ্যপ গোত্র’ –প্রবাদটির উৎস। অবশ্য, কশ্যপগোত্রের মানুষজন বহুক্ষেত্রেই মানসম্মান খুব কম পেয়েছেন। কশ্যপপত্নী সরমার প্রিয়পাত্রদের বা ‘সারমেয়’দের তো কুকুরের সমার্থক বানিয়ে ফেলা হয়েছে!... তবে বলে রাখা ভাল, ‘ক্কুকুর’ বা ‘কুকুর’ শব্দের অর্থ শুধুই ‘dog’ নয়। মনুষ্যজগতের ক্ষেত্রে শব্দটির অর্থ ‘হেয় ব্যক্তি’ (সূত্র: ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’)। এছাড়া ভাগবতপুরাণে (৯.২৪.১৯) ‘দশার্হ’ দেশের যদুবংশীয় রাজা অন্ধকের পুত্রের নাম বা মতান্তরে, অন্ধকের বংশধরদেরকেই ক্কুকুর বা কুকুর বলা হয়েছে!

    যাই হোক, ঘরওয়াপ্‌সি-তে ‘ওয়াপ্‌স’ আসা যাক। এই বিষয়ে সমস্ত উদ্যোগকে ছাপিয়ে গিয়ে ছিল আদি শঙ্করাচার্য্য। আনন্দগিরির ‘শঙ্করদিগ্বিজয়’, চিদ্ধিলাস যতির ‘শঙ্করবিজয়’, ব্রহ্মানন্দের ‘লবুশঙ্করবিজয়’, তিরুমল্প দীক্ষিতের ‘শঙ্করাচ্যুদয়’, ইত্যাদি গ্রন্থের কিংবদন্তি অনুসারে অষ্টম শতাব্দীর শুরুর দিকে তিনি অদ্বৈতদর্শনের মাধ্যমে ‘বস্তুবাদী’ সাংখ্যদর্শন ও বৌদ্ধ দর্শনকে ব্যাপকভাবে খণ্ডন করার পাশাপাশি উত্তর-পশ্চিম ভারত, মধ্য ভারত ও দাক্ষ্যিণাত্যে কয়েক কোটিরও বেশি ‘বিকৃত’ বৌদ্ধকে ব্রাহ্মণ্যধর্মে ফিরিয়ে আনেন! তবে বঙ্গদেশ সহ পূর্ব ভারতে এর প্রভাব তেমনভাবে পড়ে নি।

    শশাঙ্কের শাসনকালে (৫৯০ হতে ৬২৫ খ্রিস্টাব্দ) বাংলায় উত্তর ভারতীয় ব্রাহ্মণদের আনাগোনা শুরু হলেও আঠারো পুরুষ ধরে চলা পাল রাজবংশের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলায় বৌদ্ধধর্ম টিকে ছিল বহাল তবিয়তেই। বরং বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্যধর্মে ‘যৌথ প্রভাবে’ তান্ত্রিক ধর্মের উদ্ভব ও বিকাশ হয়। ‘ব্রহ্মক্ষত্রিয়’ (যাঁরা আদিতে ব্রাহ্মণ ছিলেন, পরে ক্ষত্রিয়ের পেশা গ্রহণ করেন) সেন রাজবংশের আমলে বৌদ্ধ, তান্ত্রিক ও ব্রাহ্মণ্য ধর্ম মিলেমিশে এক ‘পৃথক হিন্দুধর্মে’র সৃষ্টি হয়। (হয়তো সেই কারণেই আজও বাঙালি হিন্দু ও উত্তর ভারতীয় হিন্দুদের মধ্যে আচার আচরণে বেশ কিছু তফাৎ থেকেই গিয়েছে।)

    কিন্তু, দূর্ভাগ্যজনকভাবে কৌলিণ্যপ্রথা ও বিভিন্ন রাজ অনুগ্রহের কারণে যে সেনবংশের দৌলতে বাংলায় ব্রাহ্মণ্য আধিপত্য বৃদ্ধি পেয়েছিল, পশুপতি মিশ্র নামের এক ব্রাহ্মণ এগারো লক্ষ টাকার ঘুষের বিনিময়ে বখতিয়ার খলজীর হতে সেনবংশের পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সেনযুগের পর সুলতানি শাসনকালে বাংলার ‘মুণ্ডিতমস্তক’ (ন্যাড়া) বৌদ্ধদের অপরাংশ পরিণত হয় ‘নেড়ে মুসলমানে’।

    *****

    [1] ‘আ জঙ্ঘন্তি সান্বেষাং জঘনাঁ উপজিঘ্নতে। অশ্বাজনি প্রচেতসোহশ্বান্ সমৎসু চোদয়॥’ - ঋগ্বেদ ৬.৭৫.১৩। কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক হলেও উল্লেখ্য যে ‘নিযুক্ত করা’ বা ‘প্রেরণ করা’ অর্থে ব্যবহৃত ‘চোদয়’ শব্দটি এসেছে ‘√চুদ’ ধাতু থেকে। শব্দটি বর্তমান বাংলাভাষায় ইতর শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয় বটে, কিন্তু সূক্ষ্ম বিচার করলে বোঝা যায় সেখানেও মূল/ আদি অর্থ প্রায় অপরিবর্তিতই রয়েছে। ঘটনাচক্রে, সভ্যজনের দ্বারা আপাতনিন্দিত শব্দটি কিন্তু গায়ত্রী মন্ত্রেও উপস্থিত। -‘...ভর্গো দেবস্য ধীমহি ধিয়ো য়ো নঃ প্রচোদয়াৎ’ (ঋগ্বেদ, ৩.৬২.১০)।

    [2] ‘...পরমসুখং জঘনচপলায়াঃ’ –পঞ্চতন্ত্র।

    [3] ‘জঘনে জঘনে যুগ্ম বদনে বদন। নাগর নাগরী কোলে নিদ্রায় মগন॥’ –ধর্মমঙ্গল।

    [4] সূত্র: ‘নারদস্মৃতি’, সম্পাদনা ও অনুবাদ নারায়ণচন্দ্র স্মৃতিতীর্থ, কলিকাতা সংস্কৃত কলেজ।)

    [5] ‘নৈতা রূপং পরীক্ষন্তে নাসাং বয়সি সংস্হিতিঃ। সুরূপং বা বিরূপং বা পুমানিত্যেব ভুঞ্জতে॥’ - মনুসংহিতা, ৯.১৪।

    [6] ‘মাত্রা স্বস্রা দুহিত্রা বা ন বিবিক্তাসনো ভবেৎ।...’ - মনুসংহিতা, ২.২১৫।

    [7] ‘উত্তমমাং সেবামানস্তু জঘন্যো বধমর্হতি।’ - মনুসংহিতা, ৮.৩৬৬।

    [8] সূত্র: ‘নারদস্মৃতি’ - সম্পাদনা ও অনুবাদ নারায়ণচন্দ্র স্মৃতিতীর্থ, কলিকাতা সংস্কৃত কলেজ।

    [9] ‘As to the age of Manu I have given references to show that Manu Smriti was written by Sumati Bharagava after 185 B.C. i.e. after the Revolution of Pushyamitra.’ (সূত্র: Writings and Speeches of Dr. Bhimrao Ramji Ambedkar, Volume-3)

    [10] ‘... হিন্দুযুগ হচ্ছে একটা প্রতিক্রিয়ার যুগ– এই যুগে ব্রাহ্মণ্যধর্মকে সচেষ্টভাবে পাকা করে গাঁথা হয়েছিল। দুর্লঙ্ঘ্য আচারের প্রাকার তুলে এ কে দুষ্প্রবেশ্য করে তোলা হয়েছিল। একটা কথা মনে ছিল না, কোনো প্রাণবান জিনিসকে একেবারে আটঘাট বন্ধ করে সামলাতে গেলে তাকে মেরে ফেলা হয়। যাই হোক, মোট কথা হচ্ছে, বিশেষ এক সময়ে বৌদ্ধযুগের পরে রাজপুত প্রভৃতি বিদেশীয় জাতিকে দলে টেনে বিশেষ অধ্যবসায়ে নিজেদেরকে পরকীয় সংস্রব ও প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ রক্ষা করবার জন্যেই আধুনিক হিন্দুধর্মকে ভারতবাসী প্রকাণ্ড একটা বেড়ার মতো করেই গড়ে তুলেছিল– এর প্রকৃতিই হচ্ছে নিষেধ এবং প্রত্যাখ্যান। সকলপ্রকার মিলনের পক্ষে এমন সুনিপুণ কৌশলে রচিত বাধা জগতে আর কোথাও সৃষ্টি হয় নি। এই বাধা কেবল হিন্দু মুসলমানে তা নয়। তোমার আমার মতো মানুষ যারা আচারে স্বাধীনতা রক্ষা করতে চাই, আমরাও পৃথক, বাধাগ্রস্ত।...’ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (‘হিন্দুমুসলমান’)।

    [11] তথ্যসূত্র: ‘পঞ্চ ‘ম’কার’, ‘পাঁচকড়ি রচনাবলী’, ২য় খণ্ড - পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়।

    [12] সূত্র: ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ (১৯৩২) – হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়।

    [13] ‘নভ্রাণ্নবেদানাসত্যা-নমুচি-নকুল-নখ-নপুংসক-নক্ষত্র-নক্রু-নাকেষু প্রকৃত্যা।’ অর্থাৎ, ‘নভ্রাট্, নপাত্, নবেদা, নাসত্য, নমুচি, নকুল, নখ, নক্ষত্র, নক্রু ও নাক শব্দে নঞ্-এর প্রকৃতিভাব হয়।’ - সূত্র: পাণিনীয় অষ্টাধ্যায়ী, ৬.৪.৭৫। আবার অষ্টাধ্যায়ীতেই বলা হয়েছে (৬.৪.৭৩) ‘নলোপো নঞঃ’ বা ‘উত্তরপদ পরে থাকলে নঞ্-এর নকার লোপ পায়’। যেমন ‘গুণ-মান’, ‘বেগ-বান’, ‘বামন, ‘গমন’, ‘দর্শন’, ইত্যাদি শব্দে ‘ন’ ‘অন-করণ’ গুণ প্রকাশ করে।

    [14] সূত্র: ‘ধাতুপারায়ণ’ (১৮৭২) - বন্দ্যোপাধ্যায়ি শ্রীযুক্ত লালকমল বিদ্যাভূষণ।

    [15] সূত্র: ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ (১৯৩২) – হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়।

    [16] ‘ন বিশেষোহস্তি বর্ণনাং সর্ব্বং ব্রাহ্মমিদং জগৎ। ব্রহ্মণ্য পূর্ব্বসৃষ্টং হি কর্ম্মাভিঃ বর্ণতাং গতম্॥’ – মহাভারত, শান্তিপর্ব্ব (১২.১৮৮.১০)।

    [17] ‘তস্মাদ্বর্ণা ঋজবো জ্ঞাতিবর্ণাঃ’ – মহাভারত।

    [18] ‘দেবো মুনির্দ্বিজো রাজা বৈশ্যঃ শুদ্রো নিষাদকঃ। পশু ম্লের্চ্চোহপি চাণ্ডালো বিপ্রা দশবিধাঃ স্মৃতাঃ॥’ – ৩৬৪ নং সূত্র, অত্রিসংহিতা।... মোট কুড়িটি ‘স্মৃতি সংহিতা’ বা আইনগ্রন্থ/ সামাজিক সংবিধানের সন্ধান পাওয়া যায়। যথা: মনু সংহিতা, অত্রি সংহিতা, বিষ্ণু সংহিতা, হরিত সংহিতা, যাজ্ঞবল্ক্য সংহিতা, পরাশর সংহিতা, ব্যাস সংহিতা, উশনা সংহিতা, অঙ্গিরা সংহিতা, যম সংহিতা, আপস্তম্ভ সংহিতা, সস্বৰ্ত্ত সংহিতা, কাত্যায়ন সংহিতা, বৃহস্পতি সংহিতা, শঙ্খ সংহিতা, লিখিত সংহিতা, দক্ষ সংহিতা, গৌতম সংহিতা, শতাতপ সংহিতা ও বশিষ্ঠ সংহিতা।

    [19] ‘ওঁম্ সমানী প্রপা সহবোহন্ন ভাগাঃ সমানে যোক্ত্রেসহবো যুনজ্‌মি।’ - অথর্ব্ববেদ ৩.৩০.৬।

    [20] ‘আর্য্যাধিষ্ঠতা বা শূদ্রা সংস্কর্ত্তার স্যুঃ’ – আপস্তম্ভ ধর্মসূত্র ২.২.৩.৪।

    [21] ‘জন্মনা জায়তে শূদ্রঃ সংস্কারাৎ দ্বিজ উচ্যতে। বেদ পাঠে ভবেৎ বিপ্রঃ ব্রহ্ম জানাতি ব্রাহ্মণঃ॥’

    [22] ‘ব্রহ্মতত্ত্বং ন জানাতি ব্রহ্মসূত্রেণ গর্ব্বিতঃ। তেনৈব স চ বিপ্রঃ। পশুরুদাহৃত।’ –অত্রিসংহিতা।

    [23] ‘বৌদ্ধলয়ং বিশেৎ যস্তু মহাপদ্যপি বৈদ্বিজঃ। তস্যচ নিস্কৃতি নাস্তি প্রায়শ্চিত্ত শতৈরপি॥’ –নারদ পুরাণ ১.১.১৫.৫০

    [24] ‘এবং হি বৈশ্যশূদ্রাণাং ক্ষত্রিয়াণাং তথৈব চ। যে ব্রাহ্মণান্প্রদ্বিষন্তি তে ভবন্তীহ রাক্ষসাঃ॥’ – মহাভারত, ৯.৪১.২১

    [25] Capitalist বা Semi-Capitalist Economy-তে Insurance-এর গুরুত্ব বিষয়ে আরও জানতে হলে ২০১৫ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারিতে ‘The Fiscal Times’-এ প্রকাশিত Mark Thoma-এর ‘Why Social Insurance Is a Necessary Part of Capitalism’ ও www(dot)nakedcapitalism(dot)com-এ প্রকাশিত Yves Smith-এর ‘The 7 Biggest Myths and Lies About Social Security’, ইত্যাদি লেখাগুলি দেখা যেতে পারে (ইন্টারনেটে লভ্য)। ঘটনাচক্রে, বর্তমান বিশ্বে পুঁজিবাদের বৃহত্তম পৃষ্ঠপোষক বিশ্বব্যাংক তার সুবিধাভোগী সমস্ত দেশকে নাগরিকদের সামাজিক নিরাপত্তা ‘নিশ্চিত’ করার জন্য তাদের ‘কর-পরিকাঠামো’য় (Tax Structure) ‘Overlapping Generations Model’ কার্য্যায়ন করার নির্দেশ দিয়েছে। সংক্ষিপ্ত করে বললে, মরিস্ অ্যালে ও পল স্যামুয়েলশান প্রণিত এই ‘Overlapping Generations Model’-এ দেশের জনসংখ্যাকে প্রথমে ‘নবীন’ (বয়স: ০-২০), ‘কর্মরত’ (বয়স: ২১-৬০) ও ‘অবসৃত’ (বয়স: ৬০-এর বেশি) –এই তিন ভাগে ভাগ করা হয়। ধরে নেওয়া হয় ‘কর্মরত’রাই মূল করদাতা। তাদের প্রদেয় কর থেকেই রাষ্ট্র বা নিয়ামক সংস্থা ‘নবীন’দের মৌলিক চাহিদার পূরণ ও ‘অবসৃত’দের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। ‘কর্মরত’রা এই যুক্তিতে অন্যদের জন্য কর দেবে, যে অতীতে তারা যখন ‘নবীন’ ছিল তখন তাদের মৌলিক চাহিদার পূরণ হয়েছে আগের প্রজন্মের ‘কর্মরত’দের করের টাকায় ও ভবিষ্যতে তারা যখন ‘অবসৃত’ হবে তখন তাদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে পরের প্রজন্মের ‘কর্মরত’দের করের টাকায়। ... তবে এই model-টির সবচেয়ে বড়ো পূর্বশর্ত হল প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে অর্থনীতির স্থিতাবস্থা। বড়সড় কোনও আর্থিক মন্দা, যুদ্ধ বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটলে model-টি ভেঙে পড়বে। তখন সমসাময়িক ‘কর্মরত’দের শ্যাম ও কুল দুই-ই নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল! আর তাছাড়া দ্রুত বর্ধমান বা গড় আয়ু বাড়তে থাকা কোনও জনসংখ্যায় এই ধাঁচা প্রয়োগ করলে (যদি অনুপূরক হারে আয় না বাড়ে, তাহলে) প্রদেয় করের হার ক্রমশঃ লাগামছাড়া হয়ে ওঠার ঝুঁকিও থাকে।

    [26] তথ্যসূত্র: ‘Indian Philosophy’ by Dr. Sarbapalli Radhakrishnan. ... আশ্চর্য্য বিষয় হল, ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলে ‘ঋষভদেব’-এর উল্লেখ পাওয়া যায়! (ঋষভদেব মোটেই ‘বৃষ প্রভু’ বা ‘ষাঁড়-দেবতা’ নয়। ষাঁড় অর্থে যে ‘ঋষভ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়, সম্ভবতঃ তার ব্যুৎপত্তি ভিন্ন, সেখানে ‘ঋষভ’ শব্দটি ‘বৃষভ’ শব্দের অপভ্রংশ। আর দেবতা অর্থে ‘ঋষভ’ শব্দটি √ঋষ্ ধাতু থেকে জাত। - সূত্র: ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’।) বহু পণ্ডিতদের মতে, তিনিই জৈনদের প্রথম তীর্থাঙ্কর ঋষভনাথ। তিনি নাকি প্রভুত্বকারীদের (ইন্দ্রের) ‘দুহিতৃপতি’। (এই ‘দুহিতৃপতি’ শব্দটির ‘জামাই’ ছাড়াও একটি বিকল্প অর্থ হল, ‘যাদের দোহন করা হয়, তাদের নেতা বা পরিচালক’।) পৌরাণিক মতে, এই ঋষভনাথ নাকি ঈক্ষ্বাকুবংশীয়! (তথ্যসূত্র: ‘পৌরাণিকা’ – অমল কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়।) তবে ঋগ্বেদে যে ভাষায় ‘ঋষভদেব’-এর উল্লেখ আছে, তার ক্রিয়াপদের ব্যবহার দেখে মনে হয় তিনি যেন সমসাময়িক নন (‘...ঋষভদেবের ন্যায় এমন এক মহৎ দেবতাকে প্রেরণ করুন...’)। তাহলে ঋষভনাথ বা জৈন ধর্ম ঠিক কতটা প্রাচীন? হেনরিখ জ়িমার, হারমান জেকবি, অধ্যাপক জর্জ বুলার, ড. হরনেল, অধ্যাপক বিদ্যালঙ্কার, পণ্ডিত সুখলাল সাংভি, প্রমুখের মতে জৈনধর্মই ভারতের প্রাচীনতম বিদিত ধর্মবিশ্বাস এবং সিন্ধু উপত্যকায় এই ধর্মের ব্যাপক প্রচলন ছিল। তাঁদের মতে, হরপ্পায় পাওয়া ‘কায়োৎসর্গ’ পুরুষমূর্তি, পদ্মাসনে উপবিষ্ট মূর্তি, সর্পমস্তক মূর্তি, ইত্যাদি জৈনধর্মের পরিচায়ক! (সূত্র: ‘Naming God God, - The Contemporary Discussion Series’ by Robert P. Scharlemann) প্রখ্যাত জার্মান প্রচ্যবিদ ও ভাষাতাত্ত্বিক হেইনরিখ জ়িমারের (১৮৯০-১৯৪৩) ‘Philosophies of India’ নামক বইটিতে দেখা যায় ‘…there is truth in the Jaina idea that their religion goes back to a remote antiquity, the antiquity in question being that of the pre-Aryan, so-called Dravidian period, which has recently been dramatically illuminated by the discovery of a series of great Late Stone Age cities in the Indus Valley. dating from the third and perhaps even fourth millennium B.C.’ – (এ যে কেঁচো খুঁড়তে সাপ!) দ্রাবিড় সিন্ধু সভ্যতায় যদি জৈনধর্মের অস্তিত্ব থাকে, তাহলে সেই জৈনধর্মের তীর্থাঙ্করকে আর্য্যরা তাদের বেদে এত সম্মান দেখাবে কেন? সাহেবদের শেখানো ইতিহাস অনুসারে তো ওই দ্রাবিড় সভ্যতা ধ্বংস হয়েছিল ‘বহিরাগত’ ও ‘শত্রু’ আর্য্যদের আক্রমণে!

    [27] জৈন বা বৌদ্ধদের মতো বৈদিক ধর্মের আরেকটি প্রতিবাদী ধর্মমত হল ‘আজীবিক’। প্রাচীন ভারতের মধ‍্য গাঙ্গেয় অঞ্চলে ছোট ছোট কিছু জনগোষ্ঠী হিসেবে ধর্ম প্রচলিত ছিল। মৌর্য্য যুগে এই ধর্ম সারা ভারতবর্ষের পাশাপাশি সিংহলেও প্রচারিত হয়। কথিত আছে, রাজা বিম্বিসার তার জীবনের একটা সময়ে আজীবিক ছিলেন। হিউ-এন-ৎসাঙের বর্ণনা অনুসারে তাম্রলিপ্ততেও বহুসংখ্যক আজীবিক ছিলেন। তবে আজীবিকরা দর্শনগত ভাবে ‘নিয়তিবাদী’ ছিলেন, আর এটিই জৈন ও বৌদ্ধদের সাথে তাদের অন্যতম মূল পার্থক্য। মহাবীরের সমসাময়িক (খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী) আজীবিক সম্প্রদায়ের একজন গুরু ছিলেন ‘গোশাল মংখলিপুত্ত’ (সংস্কৃতে ‘মক্ষলিপুত্র’)। আজীবিকরা প্রায় চতুর্দশ শতাব্দী অবধি এদেশে টিকে ছিল, তবে শেষদিকে তারা সম্পূর্ণভাবে বিকৃত তন্ত্র, কালো যাদু, ইত্যাদির চর্চায় লিপ্ত হয়ে পড়েছিল। (তথ্যসূত্র: ‘History and Doctrines of the Ajivikas, a Vanished Indian Religion’ by Arthur Llewellyn Basham)

    [28] ভদ্রবাহুর এক শিষ্য গোদাস এই ‘গোদাস-গণ’ নামক জৈন সম্প্রদায়টির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বঙ্গদেশে জৈন ধর্মের আগমন এদের মাধ্যমেই ঘটেছিল। এই ‘গোদাস-গণ’ সম্প্রদায়ের স্থানভিত্তিক চারটি শাখা ছিল, ‘তামলিত্তিয়’ বা ‘তাম্রলিপ্তক’ (তমলুক, মেদিনীপুর), ‘কোডিবর্ষীয়অ’ বা ‘কোটিবর্ষীয়’ (দিনাজপুর), ‘পোংডবর্ধনীয়া’ বা ‘পুণ্ড্রবর্ধনীয়’ (বগুড়া) ও ‘দাসীখব্বডিয়’ বা ‘দাসীখর্বটিক’ (সম্ভবতঃ মানভূম-পুরুলিয়া)।

    [29] হৈহয় রাজবংশের রাজা বিজ্জলের উপাধি ছিল ‘মহামণ্ডলেশ্বর’। তার প্রধানমন্ত্রীর নাম ছিল বলদেব। বলদেবের মৃত্যুর পর তার ভাগ্নে ও জামাই বাসবকে রাজা বিজ্জল প্রধানমন্ত্রীর পদে নিয়োজিত করেন। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীনই বাসব লিঙ্গায়েত ধর্মমত প্রচার করতে শুরু করেন। কথিত আছে, এই ধর্মপ্রচারের জন্য রাজার অনুমতি ছাড়াই তিনি রাজকোষের অর্থ যথেচ্ছ ব্যায় করতে শুরু করেন। বিষয়টি বিজ্জলের কানে আসামাত্র তিনি বাসবকে শাস্তি দেতে উদ্যত হন। তখন বাসব সদলবলে পলায়ন করলে রাজা তার পশ্চাদ্ধাবন করেন। এই অবস্থায় বাসবের শিষ্যরা বিজ্জলকে আক্রমণ করে ও পরাস্ত করে। পরিস্থিতির চাপে রাজা বিজ্জল বাসবকে প্রধানমন্ত্রীর পদে পুনর্বহাল করলেও দুজনের মধ্যে বিশ্বাসের যথেষ্ট অভাব রয়ে গিয়েছিল। এরপর নাকি স্বয়ং বাসব-ই যড়যন্ত্র করে বিজ্জলকে হত্যা করে। (তথ্যসূত্র: ‘বিশ্বকোষ, দ্বাবিংশ খণ্ড’ – শ্রী নগেন্দ্রনাথ বসু কর্তৃক সংকলিত ও সম্পাদিত।)

    [30] লিঙ্গায়েত শৈব ধর্ম মূলত দক্ষিণ ভারতে প্রচলিত থাকলেও পাণিনি, মেগাস্থিনিস, প্রমুখের রচনায় শিশুনাগ, নন্দ, মৌর্য্য ও শুঙ্গ রাজাদের আমলে উত্তর ভারতেও এই ধর্মের উপস্থিতির কথা জানা যায়। লিঙ্গায়েত ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা ‘বাসবেশ্বর’ (রাজা বিজ্জলের মন্ত্রী, বাসব) বৈদিক ভক্তিবাদের সঙ্গে তান্ত্রিক মতবাদ যুক্ত করেছিলেন। তিনি জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ হলেও, ব্রাহ্মণ্যবাদের অত্যাচার তাঁর সহ্য হয়নি৷ তাই তিনি হিন্দু ধর্মের চতুর্বর্ণ বা জাতিভেদ প্রথা সহ হোম, যজ্ঞ, জ্যোতিষ, বলি, ইত্যাদি বেশ কিছু নিয়মনীতি প্রত্যাখান করেন। কথিত আছে, বিশেষ কোনও স্থান, নদী বা জলাশয়ের ‘আরোপিত পবিত্রতা’কে লিঙ্গায়েতরা অস্বীকার করত। আবার ঋতুস্রাব সহ বিভিন্ন বস্তু/ বিষয়ের ওপর ‘আরোপিত অপবিত্রতা’কেও তারা বর্জন করেছিল। এই দর্শনকে ‘শূন্যসিদ্ধান্ত’ বলা হয়। সময়ের সাথে সাথে উত্তর ভারতের বহু ক্ষেত্রেই লিঙ্গায়েত ও ‘বীরশৈব’ বা সাধারণ শৈব ধর্মের পার্থক্য মুছতে থাকলেও দক্ষিণ ভারতে (মূলতঃ কর্ণাটকে) লিঙ্গায়েত ধর্ম আজও তার স্বাতন্ত্র বজায় রেখেছে। সাধারণ ভাবে লিঙ্গায়েত শৈব ধর্মকে হিন্দু ধর্মেরই একটি শাখা হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু, দীর্ঘদিনের আন্দোলনের পর ২০১৮ সালে (শিখ, বৌদ্ধ, ইসলাম, খ্রিস্টান, ইত্যাদির মতো ‘ধর্মীয় সংখ্যালঘু’দের অন্তর্গত) পৃথক একটি ধর্ম সম্প্রদায় হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ... তবে এই লিঙ্গায়েতরা একটা সময় জৈন ধর্মাবলম্বিদের প্রতি এতটা খড়গহস্ত হয়ে পড়েছিল কেন, -তা সত্যিই রহস্যময়!

    [31] তথ্যসূত্র: ‘Jainism: An Indian Religion of Salvation’ by Helmuth von Glasenapp.

    [32] তথ্যসূত্র: ‘Glimpses of the history of Manbhum’ by Subhash Chandra Mukhopadhyay.

    [33] ‘কাশীদাসী মহাভারত’ নামে যা আমাদের কাছে পরিচিত, তার সম্পূর্ণটা কাশীরাম দাসের রচনা নয়। প্রকৃতপক্ষে, তিঁনি ‘আদিপর্ব্ব’ থেকে শুরু করে ‘বিরাটপর্ব্ব’ অনুবাদ সম্পন্ন করে ‘বনপর্ব্ব’-এর অনুবাদ শুরু করার পর অকালে দেহত্যাগ করেন। তবে তাঁর রচনাক্রম পর্বগুলির সাথে অনুক্রমিক নয়। তাঁর মৃত্যর পর ‘জিত ঘটক’ নামের একজন কবি ‘বনপর্ব্ব’-এর অনুবাদ সম্পূর্ণ করেন। কাশীদাসী মহাভারতের বাকি পর্বগুলি অন্যান্য কবিদের রচনা। তাঁদের সবার পরিচয় জানা যায় না। তবে কাশীরাম দাসের সমসাময়িক ও পরবর্তী নন্দরাম দাস, দ্বিজ গোবর্ধন, দ্বিজ অভিরাম, ঘনশ্যাম দাস, রামলোচন, দৈবকীনন্দন, কৃষ্ণানন্দবসু, অনন্ত মিশ্র, চন্দন দাস, কুমুদদত্ত, জয়ন্তীদেব, ষষ্ঠীবর, প্রমুখ কবিদের রচিত বিভিন্ন পর্বের খন্ড খণ্ড বেশ কিছু পুঁথি উদ্ধার করা গেলেও তাঁদের পূর্ণাঙ্গ মহাভারত পাওয়া যায় নি। (সূত্র: অক্ষয়কুমার কয়াল, যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, প্রমুখের বিভিন্ন প্রবন্ধ/ নিবন্ধ।)

    [34] ‘ষষ্টির্মুনিসহস্রাণি শিষ্যৎবং প্রতিপেদিরে। সারস্বতস্য বিপ্রর্ষের্বেদস্বাধ্যায়কারণাৎ॥ মুষ্টিং মুষ্টিং ততঃ সর্বে দর্ভাণাং তে হ্যুপাহরন্। তস্যাসনার্থং বিপ্রর্ষের্বালস্যাপি বশে স্থিতাঃ॥’ – মহাভারত, ৯.৫২.৫১-৫২

    [35] সূত্র: ‘সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষার ক্রমবিকাশ’ – পরেশচন্দ্র মজুমদার।

    [36] সূত্র: ‘সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস’ – ড. সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।

    [37] ‘এতস্মিন্নন্তিবে সেত্দচ্ছ আচার্যেন সমন্বিতঃ। মহামদ ইতিখ্যাতঃ শিষ্যশাখা সমন্বিত॥ নৃপশ্চৈব মহাদেবং মরুস্থল নিবাসিম্ম।...’ – ভবিষ্যপুরাণ, ৩.৩.৩.৫-৬।

    [38] ‘মিশ্রদেশ’কে ‘মিশর’ ভেবে বসা কতটা যুক্তিযুক্ত? - সংস্কৃত ও প্রাচীন বাংলাভাষায় মিশরকেই মিশ্রদেশ বলা হত। উদাহরণ স্বরূপ, ১৯০৯ সালে প্রকাশিত সত্যচরণ শাস্ত্রীর ‘ভারতে অলিকসন্দর’ (আলেকজ়ান্ডার) নামক বইয়ের একটি অংশে দেখা যায়, সেখানে আলেকজ়ান্ডার বলছেন, ‘...ফিনিসীয় নৌশক্তির সাহায্যে, আমরা সামুদ্রিক আধিপত্য লাভ করিতে সমর্থ হইব। তখন মিশ্রদেশ অধিকার আমাদের সহজসাধ্য হইবে। মিশ্রদেশ বিজয়ের পর গ্রীসের বা আমাদের দেশের ভাবনা আর ভাবিতে হইবে না। তখন পারস্যের সমস্ত নৌশক্তি এবং ইউফেটিস (ইউফ্রেটিস) পর্য্যস্ত সমস্ত দেশ, আমাদের আজ্ঞানুসারে পরিচালিত হইবে।...’

    [39] ‘মিশ্রদেশোদ্ভবা ম্লেচ্ছো কাশ্যপেন সুশাসিতাঃ। সংস্কৃতাঃ শূদ্রবর্ণাচ্চ ব্রহ্মবর্ণমুপাগতা॥’ - ভবিষ্যপুরাণ, প্রতিসর্গ ৪.২১।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ১৮ মার্চ ২০১৯ | ৩৩৭৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • বিপ্লব রহমান | 340112.231.126712.75 (*) | ১৮ মার্চ ২০১৯ ০৫:৩৩49632
  • ধর্ম বর্ণ জাত পাতের নামে শোষণের এক জীবন্ত ইতিহাস! অনেক কিছু শিখছি।

    আরো লিখুন।
  • Sourav Mitra | 671212.193.124512.237 (*) | ১৮ মার্চ ২০১৯ ০৮:৩৩49633
  • অর্জিত বিদ্যার প্রাসঙ্গিকতা নষ্ট বা ধর্মকে আশ্রয় করে আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রচেষ্টার তত্ত্বটিকে আকাশকুসুম মনে হলে চলুন ঝটিকা সফরে যাওয়া যাক বিখ্যাত (অথবা কুখ্যাত) দ্বিজাতি তত্ত্বের শুরুর দিনগুলিতে।
    কয়েকটি হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠন যে তত্ত্বের জন্মদাতা, তাকে আপন করে ফেলল কিনা মুসলিম লিগ! এর কারণ কি শুধুই ধর্ম? – না। ইতিহাসবিদ বদরুদ্দীন উমরের মতে, ইংরেজী শিক্ষাব্যবস্থাকে সামগ্রিকভাবে এদেশের হিন্দু জনগোষ্ঠী যতটা আপন করেছিল, সামগ্রিকভাবে মুসলমানরা ততটা আপন করে নেয় নি। ফলে, ইংরেজ আমল থেকেই রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বড়ো বড়ো বাণিজ্যক্ষেত্রগুলিতে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি সংখ্যায় ‘ইংরেজি-জানা’ হিন্দু চাকরিরত ছিল। হিন্দুদের মধ্যে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে গিয়েছিল। আর সেই তুলনায় মূলতঃ মাদ্রাসায় শিক্ষিত ‘ইংরেজি-না-জানা’ মুসলমান জনগণ এই ব্যাপারে অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছিল। (ব্যতিক্রম অবশ্যই ছিল, কিন্তু সংখ্যাগত ভাবে তা নগণ্য।) দেশ স্বাধীন হলেও এই পরিস্থিতি বদলের সম্ভাবনা ছিল কম।
    এই আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার সঙ্গে ধর্মের মিশেল দিয়ে শুরু হয় ‘পাকিস্তান আন্দোলন’, যার ফলশ্রুতিতে দেশভাগ। কিন্তু, জল এখানেই থেমে থাকে নি। সেই আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার সূত্র ধরেই তারপর পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশের জন্ম। - এবার ইংরেজির বদলে উর্দুভাষা জানা না-জানা আর হিন্দু-মুসলমানের বদলে পাঞ্জাবিআনা-বাঙালিস্বত্ত্বা রইল বিভাজনের কেন্দ্রে।
  • অজিত | 124512.101.89900.213 (*) | ০৫ জুলাই ২০১৯ ০২:১৪49634
  • খুব ভালো লাগলো আপনার লেখাটি।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে মতামত দিন