এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক

  • মহাভারত -- অষ্টাদশ পর্ব

    শুদ্ধসত্ত্ব ঘোষ লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ৩০ আগস্ট ২০১২ | ১১১৯ বার পঠিত
  • - আড়ালে রাজার মাকেও লোকে ডাইনি বলে মহারাণী!

    সত্যবতীর কথা থামিয়ে দিয়েই বলে উঠলেন কুন্তী। সত্যবতী থেমে গিয়ে যখন তাকালেন, দেখলেন তাঁর দিকে একজোড়া আয়ত চোখ চেয়ে রয়েছে। সে চোখে কোন ছায়াই নেই। কিছুর ছায়া নেই। সে চোখের যেন কোনো অতীতই নেই।

    - আমি জানি আপনার উদ্বেগ কত যথার্থ। এও জানি, এ প্রাসাদে আমি যাঁদের অনুগ্রহে কদাপি বঞ্চিত হব না আপনি তাঁদের অন্যতম। তাই আপনার কথার মধ্যেই কথা বললাম বলে মার্জনা করবেন মহারাণী।

    তাহলে কুন্তীও জানে যে তিনি আর এই প্রাসাদে থাকছেন না। নাহলে কি আর...!

    - কিন্তু এই হস্তিনাপুরে পৌঁছবার দীর্ঘ্য রাস্তায় আমি শুধু এই প্রশ্নের উত্তরই খুঁজে এসেছি। দিবস-রাত্রি, সূর্য-চন্দ্র কেউই আমাকে কোনো উত্তর দেয়নি। সন্দেহ যদি লোকসমাজে থেকেই থাকে তাহলে তাকে মুছে দেওয়া সম্ভব না। শাসন যতই শক্তিশালী হোক না কেন তা মানুষের মনকে সম্পূর্ণ বশীভূত করতে পারবে না কোনোদিনও।

    সত্যবতীর দোলনাটি থেমে গিয়েছে। তিনি অত্যন্ত মন দিয়ে শুনছেন এই নারীর কথা।

    - যতদিন না আমার সন্তানেরা বড় হচ্ছে, তাদের চরিত্রগুণে জয় অরে নিতে পারছে হস্তিনাপুরবাসীকে ততদিন তাদের মাতৃকলঙ্ক যাবার নয়।

    লক্ষ করেছেন সত্যবতী। কুন্তী সন্তানদের নিজের সন্তান বলেই পরিচয় দিচ্ছে। তাহলে মাদ্রীপুত্ররা শুধুমাত্র জন্মের পরিচয়েই পরিচিত হবে না। কুন্তী তাদের সঙ্গে নিজ পুত্রের মতনই অন্তত লোকসমাজে আচরণ করবে। মনে?

    -আহা! মন কে জানে রাণী, মন কে জানে?

    আবার বলে ওঠে সত্যবতীর মন। শান্তনুর দুই সন্তান তাঁর কাছে প্রিয় না পরাশরের সন্তান? লোকসমাজ জানে না। তিনিও জানতে দিতে ইচ্ছুক ছিলেন না।

    - যে লোকসমাজ বিক্ষুব্ধ তাকে দণ্ড না দান দিয়েই জয় করতে হয়। আমি জানি। অতএব মহারাণীর আশীর্বাদ থাকলে আমি নিশ্চই তা পেরেও উঠবো।

    দণ্ড শব্দটা আবার খেয়াল করলেন সত্যবতী। এই তো! এই তো তাঁর ছায়া। ঋষি দুর্বাসা স্নেহধন্যা কুন্তী, এমন জনশ্রুতি তিনিও জানেন। সাম, দান, দণ্ড, ভেদের কথা ঋষিই শিখিয়েছেন। যেমন পরাশর তাঁকে শিক্ষা দিতেন কিছু। না, মনকে অন্য দিকে যেতে দিলে হবে না। সামনে অনন্ত সময়। বাণপ্রস্থের দিনগুলোতে না হয়...।

    সত্যবতী শ্বাস নিলেন বড় করে। বড্ড গুমোট লাগে এই কক্ষ আজকাল। সামনের বাগানের কৃত্রিম জলধারাতেও যেন হাওয়ার আরাম হয় না। কুন্তীও তাহলে জানে কাকে বলে অসুরনীতি! ভাল। এই বংশের উৎসেই তো আছেন শুক্রাচার্য্য কন্যা দেবযানী। মহারাজ যযাতির এক পুত্র পুরুর বংশ এ।

    পরাশর এবং দুর্ব্বাসার দুই শিষ্যা তাঁদের প্রতিটি চালেই এই অসুরনীতির শরণাপন্ন। দুর্ব্বাসা কুন্তীকে বলেছিলেন, অসুরদের গুরু শুক্রাচার্য্যের এই শিক্ষা রচিত হয়েছে বহু পুরাকালে। তখন অসুররা এই বিপুল দেশের বাসিন্দাও ছিল না। তাদের বাসস্থান ছিল অন্য স্থানে। সেখানে ক্রমাগত আক্রমণের মধ্যে পড়তে হয়েছে তাদের। সেখানে দেবেরাও ছিল। দেব-অসুরের মধ্যে ছিল মৈত্রী। বারেবারে আক্রান্ত হতে হতে তারা আরো নিরাপদ কোনো এক স্থানের উদ্দেশ্যে অভিযাত্রী পাঠায়। তারা অগ্রদূত। তারাই নিয়ে আসবে নিরাপদ এক স্থানের খোঁজ। যেখানে তাদের দেশ ছিল সেই দেশ থেকে সমুদ্র বরাবর অভিযাত্রীরা চলতে থাকে। আরো পূর্বে প্রথমে, তারপরে আরো দক্ষিণে তারা সপ্তসিন্ধুর দেশে এসে পৌঁছয়। সেই দেশকে তারা চিহ্নিত করে পাতাল বলে। সেই রাস্তা ধরে এসেছে বাকীরা। সহস্র সহস্র বছর ধরে চলেছে এই যাত্রা। স্থানের দখল নিয়ে একসময়ে নিজেদের মধ্যেও বেঁধেছে লড়াই। বন্ধুত্ব বদলে গিয়েছে শত্রুতায়। প্রীতির স্থানে এসেছে দ্বেষ। সেই দ্বেষ, সেই দ্বন্দ্বের কাহিনী রয়েছে অমৃতলাভের কাহিনীর মধ্যে। কোনো এক অজ্ঞাতকালে বজ্রায়ূধ ইন্দ্র, দেবেদের কোনো এক গোষ্ঠীপতি, দেবাসুর সমস্ত গোষ্ঠীকে সমবেত করেই সপ্তসিন্ধুকে বন্ধন করেছেন। জলের ধারায় বয়ে আসা পলিতে সিক্ত হয়েছে সে দেশ। কিন্তু তার অধিকার চলে যায় দেবগোষ্ঠীর কাছে। অসুররা বঞ্চিত হয় কৌশলে। আবারো আরেক যুদ্ধের সূচনা হয়। আচার্য্য বৃহস্পতির বংশধরেরা দেবেদের পুরোহিত হয়ে যান। অসুরেরা গুরু মানেন শুক্রাচার্য্যকে। বিরোধ চলতে থাকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। তারপরে তো কাল বয়ে চলেছে। প্রথম আগমনের শত্রুতা, অনভিজ্ঞতা অতিক্রম করে দেবাসুরের আগমনের আগে থেকেই যারা এখানে বাস করতো সেই অধিবাসীদের সঙ্গে শুরু হয়েছে সংমিশ্রণ। দেবকূলের বা অসুরকূলেরও সম্পূর্ণ বিশুদ্ধতা বজায় রাখা যায়নি। বিভিন্ন শাখার উদ্ভব হয়েছে। কেউ নিয়েছে বৃহষ্পতির শিক্ষা, কেউ শুক্রাচার্য্যের। গাঙ্গেয় নিজেও শুক্রাচার্য্য বংশের শিষ্য। রাজধর্ম শাস্ত্রের অন্যতম জ্ঞানী। দুর্ব্বাসা বলতেন, ইতিহাস পুরাণ আসলে অতীতের গাথা সঙ্কলন এবং তাকে অনুধাবন করার মাধ্যমেই আসলে অতীতকে জানা যায়। কুন্তী, দুর্ব্বাসার প্রণয়ভাগী এই নীতিজ্ঞান লাভ করেছিলেন, জেনেছিলেন পুরানোকে পাঠ করার পদ্ধতিও। প্রাক্তন মহারাণী সত্যবতীর উদ্দেশ্য বুঝতে তাঁর সমস্যা হবার কথা নয় তাই।

    হয়নি বলেই বুঝতে পারছেন সত্যবতীর মধ্যে তাঁর প্রতি সন্দেহ আর গাঢ় হয়েছে মাত্র। এই আচার্য্য তাঁর সন্তানদের নৃত্যশিক্ষা দেবার পাশাপাশি তাঁর উপরে নজর রেখে যাবে সারাদিন। কূলসঙ্ঘ তাঁকে আলাদা করে মাদ্রীর বিষয়ে বিড়ম্বিত করতে পারেনি যেমন ঠিক, তেমনই ঠিক তাঁর প্রতি সন্দেহও এ বিষয়ে নিরশন করেনি। ঐ সভার পরেও প্রতিটি ব্যাক্তিই এ বিষয়ে নিজের নিজের মতেই অটল থাকবেন একথা বলাই বাহুল্য। তিনিও তাই-ই করতেন। শতশৃঙ্গ বাসী ঋষিরা কি বললেন তাতে কি আসে যায়? তারা তো সত্যি দেখেনি মাদ্রী সহমরণে ইচ্ছুক হবার সময়কে। তাঁরা সহমরণ দেখেছেন। যখন দেখেছেন তখন মাদ্রী গাঢ় নেশাসক্ত। চোখদুটি ঢুলু ঢুলু। কখনো সখনো যখন খুলছেন তখন তা জবাফুলের মতন লাল। কুন্তী-মাদ্রীর চার পুত্র ছিল অন্যান্য ঋষিজায়া-কন্যাদের তত্ত্বাবধানে। একমাত্র যুধিষ্ঠির উপস্থিত ছিলেন অগ্নিদানের জন্য। সারাদিন যজ্ঞ শেষে বাকী পুত্ররা তখন ক্লান্ত-অবসন্ন-ক্ষুৎ-পিপাসা কাতর আশ্রমে বিশ্রাম করছিল। যুধিষ্ঠির, জ্যেষ্ঠ, শ্রান্ত শরীরে চিতা প্রদক্ষিণ করেছে অন্যের কাঁধে ভর দিয়ে। তাহলে? সেই বা জানবে কি? তাছাড়া জনমনে সন্দেহ হচ্ছে এই পুত্ররা বিভিন্ন ঋষির সন্তান আসলে। দেবঔরসে জন্ম নিয়ে ঠাট্টা তামাশা হচ্ছে, যেমন হয়। এমনকি রামায়ণ গাথায় যে পায়েস খাইয়ে রাণী কৌশল্যা এবং কৈকেয়ীকে গর্ভবতী করার কথা আছে তা নিয়েও লোকে তামাশা করে। কুন্তী নিজেও সখী বা ধাত্রীদের সঙ্গে কম রসিকতা করেছেন এ নিয়ে? নতুন ধানের পায়েস নিয়ে তিনি বলেননি প্রিয়সখী কলাবতীকে,

    -নে লো সই, পায়েস খেয়ে গর্ভবতী হ!

    তারপরে দুজনেই তামাশায় একে অপরের অঙ্গে ঢলে পড়েছেন হেসে আকুল হয়ে। ততদিনে পুরুষ সঙ্গ সম্পর্কে দুজনেরই অল্পবিস্তর অভিজ্ঞতা হয়েছে বই কি!তাছাড়া রাজঅন্তঃপুরের অন্যান্য বাসিন্দাদের থেকে জেনেওছেন বীর্য্যপানে গর্ভের সম্ভাবনা নেই। তাহলে? আজকে লোকেই বা তাঁকে ছাড়বে কেন? তিনি ছাড়ের আশা করেন না। এর থেকে নিস্তারের রাস্তাও তাঁর জানা নেই। অবশ্য এ নিয়ে তিনি খুব আকুলও না।

    কিন্তু সত্যবতীর সন্দেহ নিরশন না হলেও তাঁর চাল নিয়ে অবশ্যই চিন্তিত তিনি। পঞ্চপুত্রকে নিয়ে এসেছেন এই নগরে। পরিকল্পনা তাঁর আছে। কিন্তু তার জন্য পুত্রদের মন তাঁর বিরুদ্ধে বিষিয়ে দেবার সম্ভাবনাকে আগে নিকেশ করতে হবে। এই আচার্য্য যে সে কাজ করবেন না তার নিশ্চয়তা কই? সত্যবতীও কিছু ধোয়া তুলসীপাতা না। এর আগে একই খেলায় তিনি রাজমাতা অম্বিকা আর অম্বালিকাকে গৌণ করে রাখেননি কি? সন্তানদের মনে তাদের মাতাদের প্রতি বিষ বপন করেননি? তাদের জন্মব্যাধির জন্য এই মাতারাই দায়ী এমন কথা কে ছড়িয়েছে? নিজ পুত্রদেরকে রক্ষা করেছেন, রাজবংশকে রক্ষা করেছেন। বিচিত্রবীর্য্য কিম্বা কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ, যেই দায়ী হোক না কেন, কূলসঙ্ঘ সেদিন এই কারণেই শাসনের ভার নিয়ে নিতে চাইতে পারতো নিজের হাতে। গাঙ্গেয় শাসক হবেন না সকলেই জানে। তাহলে? সেই সময়ে রাণীদের বিরুদ্ধে তাঁর প্রচার সমবেদনা পেয়েছে জনগণ এবং কূলসঙ্ঘের একাংশের। সেদিন সুধন্যও ছিলেন না বিরোধ করার জন্য। এই রাজবংশকে নিরাপদ রাখার শুল্ক হিসেবে দুই রাজমাতাকে প্রাসাদের মধ্যেও প্রায় বন্দিনী করেই রেখেছিলেন। এমনকি আজও, তিনি নিজে যখন যাচ্ছেন বাণপ্রস্থে তখন এঁদেরকে নিয়েই যাচ্ছেন। যাতে রাজপ্রাসাদ অন্তঃপুরে থেকে কেউ তাঁর বা এই বংশের বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্রের অবকাশ না পায়। এই হল সত্যবতীর অসুরনীতি। এর বিরুদ্ধেও হয়তো তাঁকে লড়তে হবে। আজকে যত সাড়ম্বরেই তাঁকে আহবান করা হোক না কেন, তিনি জানেন আসলে এ সকলই তাঁকে বাজিয়ে দেখে নেবার ছল। এককালে এই প্রাসাদে রাণী হিসেবে যে যৌবনাগত যুবতী এসেছিল সেই যুবতী আজ প্রৌঢ়ত্বের সীমায় এসে কতটা বিপজ্জনক তা একবার দেখে নিচ্ছেন সত্যবতী। গান্ধারীর বিরুদ্ধে লড়াইতে মিত্র হিসেবে কতটা নির্ভর যোগ্য হবেন সেই সব বুঝে নিতেই এই সাক্ষাৎকার। কুন্তী প্রস্তুত। আচার্য্য চলে গিয়েছেন কক্ষ ছেড়ে। মহারাণী সত্যবতী অদূরেই উপবিষ্টা। অলকার সঙ্গে মন্ত্রণা চলছে তাঁর। সঙ্গে কি কি যাবে সে সকলের তালিকা শেষবারের মত দেখে নিচ্ছেন সত্যবতী। এর পরেই আসবে সেই মুহুর্ত। যখন এক সন্ধি হবে, কিন্তু সন্ধির পিছনে থাকবে পরস্পরের পরস্পরকে নিয়ন্ত্রণের বাসনা।

    মাদ্রী এই খেলাতেই মেতেছিল একদিন। রোগগ্রস্ত পাণ্ডুকে নিয়ে কুন্তীর সঙ্গে সেই খেলাতে সে জিততে চেয়েছিল। পাণ্ডুকে বশ করে কুন্তী ক্রমাগত পুরুষসঙ্গ করে চলেছে। জন্ম দিয়ে চলেছে সন্তানের। কুন্তীর সন্তান জ্যেষ্ঠ। রাজ্যাধিকারের প্রশ্নটি মীমাংসিত। কিন্তু কেন? বারেবারে কেন হার হবে মাদ্রীর? ঋষি বা রাজন্যের আতিথ্য করা এক পালিতা রাজকুমারী তাঁর চেয়েও সুখী হবে? তিনি শল্যাধিপতির ভগ্নী, তাঁকে বিয়ে করতে রীতিমত পণ দিতে হয়েছিল পাণ্ডুকে, গাঙ্গেয় সে পণ মেনে নিয়েই বিয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন, সেই মাদ্রী, মদ্রসুন্দরী পরাজিত হবে কেন বারেবারে? শোধ নেবার খেলায় মেতেছিলেন তিনি। এক পুরুষের সাহচর্য্য পেয়েছিলেন। সেও কুন্তীই আয়োজন করেছিল পাণ্ডুর আদেশে। তাতে কি শরীর শান্ত হয়? কুন্তী বহু সংসর্গ করবে আর তিনি এক?

    মাদ্রী বলতে পারেননি শরীর চায় বলে তিনি পুরুষ চান। পাণ্ডুকে সে কথা বলা যায় না। কুন্তীকেও না। একটি বার মাত্র সঙ্গমেই তো গর্ভ নিশ্চিত হওয়া অতি দুষ্কর কার্য্য। বারংবার সঙ্গমের মাধ্যমে সে হয়ে থাকে। যতবার সঙ্গম ততবার শরীরে জল পড়বে। শরীর বড় কাঁদে যে! একজনের সংসর্গ তো গর্ভ ধারণ করার পরেই ফুরিয়ে গিয়েছে। সন্তানের জন্মের কিছুকাল পর থেকে শরীর যে আবার কথা শুনছে না। কুন্তী মানবে না জেনেও মহারাজ পাণ্ডুকেই লালায়িত করেছেন শরীর দিয়ে। তাঁর যৌবন দিয়ে উত্তপ্ত করেছেন। রাজবৈদ্যের আদেশ ছিল মহারাজের উত্তেজনা নিষিদ্ধ। তা মৃত্যুর দরজার দিকে ঠেলে দেবে তাঁকে। জেনেও মাদ্রী তাঁকে স্তন, জঘন, নিতম্ব দিয়ে আঘাত করেছেন। পাণ্ডু যখন উত্থিতলিঙ্গ তখন সরে গিয়েছেন অসুখের দোহাই দিয়ে। অনেক কাকুতি-মিনতিতে রাজী হয়েছেন অঙ্কশায়িনী হতে। কিন্তু রমণে রাজী হননি। তার সঙ্গে শর্ত রেখেছেন আগে করে দিতে হবে তাঁর কাজ। তাঁর আরো পুরুষ চাই। চাই আরো সন্তান। তাঁর সন্তান সংখ্যা বাড়ুক কুরুকূলে। কুন্তীকে ছাপিয়ে যেতে চান তিনি। পাণ্ডু, কামতাড়িত রাজা গিয়েছিলেন কুন্তীর কাছে এই কর্মে। আবারো আদেশ করেছিলেন কুন্তীকে। কিন্তু কঠোর হয়েছিলেন কুন্তী। বংশরক্ষা হয়ে গিয়েছে। তার জন্য আছে যুধিষ্ঠির। রাজ্যাধিকারেও সে থাকবে। তাকে রক্ষা করার জন্য বলবীর্য্য সম্পন্ন দুই কুমার ভীমার্জুন রয়েছে। মাদ্রীর সান্তনার জন্য ফুটফুটে দুই কুমারের আগমন ঘটেছে। নকুল-সহদেব। তবে আর কেন? অধিক সন্তানের জন্ম হলে কূলে সম্প্রীতি হানি হতে পারে। এমনিতেই যুধিষ্ঠিরের অধিকার নিয়ে সমস্যা তৈরী করতেই পারেন ধৃতরাষ্ট্র। এর উপরে নিজের ঘরে অশান্তি ডাকা কেন? তাছাড়া এই সংবাদ কি সন্মান বাড়াবে মহারাজ পাণ্ডুর? স্ত্রী-র কামেচ্ছাকে সন্তুষ্ট করতে নিয়োগ? ধিক্কারের শেষ থাকবে হস্তিনাপুরে? কি ব্যাখ্যা দেবেন এতবার নিয়োগের? শাস্ত্র কি সমর্থন করবে এ কাজ? কাম বড় বিচিত্র! ততোধিক বিচিত্র যৌনতার ইচ্ছা। পাণ্ডু, ভোগে আসক্ত আজ-ও। কিন্তু অপরের ভোগ নিবৃত্তিতে অক্ষম। ব্যাধিগ্রস্ত। তবু মাদ্রী তাঁকে শরীর দিয়ে জ্বালাচ্ছে। তিনি মাদ্রীর কাছে অসহায়। নিজের কাছেও। আবার এই নারীর যুক্তির সম্মুখে দাঁড়াবার কোনো পথ নেই তাঁর। নতমস্তকে ফিরে গিয়েছিলেন মাদ্রীর কাছে। কুন্তী অনুমতি দিচ্ছেন না।

    অনুমতি? রাজা চাইছে রাণীর অনুমতি? পুরুষ চাইছে নারীর অনুমতি? ধিক্‌ পুরুষ! ধিক্কার মাদ্রী নিজেকেও দিয়েছেন। দিয়েছেন নিজের ভাগ্যকে। পাণ্ডুকে ক্লীব বলে গালাগালিও দিয়েছেন। বিফল মনোরথ পাণ্ডু, সামরিক শক্তিহীন পাণ্ডু, রাজসিংহাসন ত্যাগী পাণ্ডু ক্রমান্বয়ে সন্তপ্ত, হতাশ এবং শেষে ক্রুদ্ধ হয়েছেন। মাদ্রী যখন তাঁর শরীরের নিকটে এসে তাঁকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে শুইয়ে দিয়েছে তখন সকল কিছু রূপান্তরিত হয়েছে রমণেচ্ছায়। মাদ্রীর নেশাসক্তি বেড়েছে রাজধানী ত্যাগের পর থেকে আরো। যত নিজেকে নিয়ে হতাশ হয়েছেন তত বেড়েছে নেশা। তত বেড়েছে তাঁর বিভিন্ন বিক্ষেপ। এমনকি যে দুই সন্তানের জন্ম হয়েছে সেই দুই সন্তানকেও ভাল করে দেখভাল করেন না। বেশীরভাগ সময়েই ফলের থেকে তৈরী আসব পান করে থাকেন। সেই মত্ততা তাঁকে যেন আরো বেশী করে ক্ষিপ্ত করেছিল সেই দিন। পাণ্ডু, যে পেশীশক্তিতে একদিন কোদণ্ডে জ্যা রোপণ করতেন, মত্ত হস্তীর মাথায় এমন বাণ মারতেন যে সেই বাণ তার মস্তিষ্ক ভেদ করে চলে যেত নরমতম অংশে, তার মৃত্যুর কারণ হত, সেই পেশীশক্তিকে আবার অনুভব করলেন। গদাযুদ্ধে যেমন বিরোধীকে নতজানু করতে গিয়েও মহাবল বহু সময়ে গদা ফেলে দিয়ে খালি হাতে তাকে মাটিতে ফেলে নিষ্পেষণ করেছেন তার গোটা শরীর, তেমনই এক শক্তির স্রোত জেগেছিল তাঁর ভিতরে। নরম রমণীর শরীরকে নিষ্পেষণ করে তাকে বিছিয়ে নিয়েছিলেন শোবার জন্য। তার অন্তর্গত হবার জন্য। মাদ্রীর তখন ছুটে গিয়েছে নেশা। কিন্তু কামতাড়িত পুরুষ আর হস্তীর মধ্যে ফারাক কি? অনুরোধ-কাকুতি-মিনতি কিছুই শোনেননি পাণ্ডু। প্রবেশ করেছিলেন মাদ্রীর গর্ভে। কোনো সন্তান উৎপাদন করেননি পাণ্ডু, যদিও প্রচুর ভোগ করেছেন শরীর। সকল ভোগ তাঁর বয়ে গিয়েছে সময়ের ধারায়। চিহ্ন নেই তার আর কোনো। সন্তান নেই তাঁর। মাদ্রীকে গর্ভবতী করেই এর শোধ নেবেন। বিধিই হোক, কি মানুষ, যেই তাঁর দুর্দশার কারণ হোক, সকলকেই তিনি দেখিয়ে দেবেন কেন তিনি মহারাজ পাণ্ডু! রাজবৈদ্য কি ঈশ্বর নাকি? মাদ্রীর শিৎকার তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে যখন তখনই যেন এক বিষ্ফোরণ ঘটে গেল তাঁর ভিতরে। ঋষি সৌকল, অথর্বাচার্য্য বলেছিলেন মৃতদেহ পরীক্ষা করে যে আক্রান্ত হয়েছিল পাণ্ডুর হৃৎপেশী। মাদ্রীর শরীরেই লুটিয়ে পড়েছিলেন পাণ্ডু। না, বীর্য্যবদ্ধ করতে পারেননি গর্ভ। তাঁর শুক্র শুকিয়ে গিয়েছে রোগের প্রকোপে। রাজবৈদ্য বলেছিলেন এ কথা। পাণ্ডু বিস্মৃত হলেও তাঁর শরীরের বিষ্মরণের উপায় ছিল না। ভোলেনি মাদ্রীর শরীরও। রোগ প্রবেশ করেছিল সে শরীরেও।

    এরপরে? মাদ্রীকে মুক্তি দিয়েছেন কুন্তী। কুৎসিত রোগাক্রান্ত জীবনের চেয়ে মৃত্যু কি উপাদেয় না? প্রাক্তন হতে চলা মহারাণী সত্যবতী ভাবতেই পারবেন না কতটা উপকার করেছেন তিনি মাদ্রীর। বেঁচে থাকলে স্বামীঘাতীকে যে নির্যাতন সহ্য করতে হত, অপবাদ সহ্য করতে হত তার থেকেও মুক্তি দিয়েছেন কুন্তী তাকে। নিজের হতাশার পাঁকে দিনে দিনে ডুবে যাওয়ার থেকে মুক্তি দিয়েছেন মাদ্রীকে। এর কোনো দাম নেই না? নকুল-সহদেব তাঁকেই মাতৃজ্ঞানে তৃপ্ত। কোনো পক্ষপাত করেননি আবাল্য প্রকৃত পিতামাতৃস্নেহ বঞ্চিত কুন্তীভোজের পালিতা কন্যা। রাজপরিবারের বিধান না থাকলে, সংসারের বিধান না থাকলে দুজন জানতেও পারতো না তারা তাঁর সন্তান নয়। তাঁর এক বিসর্জিত সন্তানের শোককে তিনি এই দুই প্রাপ্ত সন্তানের পরিচর্য্যায় ঢেলে দিয়েছেন। তাঁরা তাঁর প্রাণাধিক। বড় তিন পুত্রের তারা নয়ননিধি। এর কোনো দাম নেই না? শুধু আছে কুন্তীর কৌশলের সমালোচনা? আছে তারই নিন্দা, যে আজন্ম বঞ্চনার শিকার হয়েও নিজে বঞ্চনাক্ষম? পারতেন না স্বামী আজ্ঞাকে যুক্তি দিয়ে ঠেকিয়ে মাদ্রীর একটি পুরুষসঙ্গও আটকাতে? মাদ্রীর গর্ভাবস্থায় নিজ ভগিনীর মতই স্নেহ করেছেন তাকে। তাঁর গর্ভাবস্থায় মাদ্রী করেনি এ কাজ। রাজকন্যা কর্মে অপটু, এই ছলের আড়ালেই থেকে গিয়েছে তার কুন্তীর প্রতি বিদ্বেষ। অন্যান্য ঋষিপত্নী বা কন্যারাই কুন্তীকে সাহায্য করেছেন তখন। কিন্তু কুন্তী কি বড়বোনের মতন গর্ভিণীর সকল সাধআহ্লাদের দিকে সতর্ক নজর রেখে চলেন নি? তাহলে? কই, মাননীয় কূলসঙ্ঘ, কুরুকূল জ্যেষ্ঠরা, কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ বেদ বিভাজক খ্যাতিমান ব্যাস কি জেনেছেন এসব? বলেছেন? এমনকি বিদুরও, তাঁর দুর্ব্বাসা উত্তর জীবনের একমাত্র পুরুষ যাকে তিনি স্বেচ্ছায় কামনা করেছেন, যার বুকে মাথা রেখে নীরবে অনুভব করতে চেয়েছেন প্রেম কি সেও কি এমন নীরব হত এই প্রসঙ্গে, যদি মনের কোণে কোথাও না থাকতো যে কুন্তীই আসলে পাণ্ডু আর মাদ্রীর মৃত্যুর জন্য দায়ী? অন্তত হলেও হতে পারে এমন? দায়? বেশ। সকল দায় তাঁর। তিনিই করেছেন সব। কে কি বললো তাতে তাঁর কিছুই যায় আসেনা। এমনকি সম্মুখে উপবিষ্ট ঐ বৃদ্ধা রমণীও কি ভাবলো বা বললো তাতে তাঁর কিছুই যায় আসেনা। তাঁর অসুরনীতিই তাঁর এবং তাঁর সন্তানদের রক্ষাকবচ এই নির্বান্ধব বিশ্বে। তিনি সন্ধি বা যুদ্ধ দুই-এর জন্যই প্রস্তুত।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ৩০ আগস্ট ২০১২ | ১১১৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভালবেসে মতামত দিন