"মায়ের নাম মহামায়া, এও তাঁহার এক মহা-মায়া। এই মায়াতে অন্ধ হইয়াই অপক্কবুদ্ধি পণ্ডিতগণ ভ্রান্তসিদ্ধান্ত-কূপে পড়িয়া আত্মহারা হয়েন, বুঝিয়া থাকেন মায়া কেবল জড়-জগতের উপাদান বই আর কিছুই নহে এবং যিনি সেই মায়ায় আশ্রয়ভূতা মূলরূপা পূর্ণব্রহ্ম-সনাতনী, তিনিও মায়া। তিনিও যদি মায়া, তবে আর 'মহামায়া' নাম কেন? মায়া আর মায়াবী যদি একই পদার্থ, বীজ আর বৃক্ষ যদি একই বস্তু, তবে আর অবস্থার বৈষম্য কেন? নামের ভেদ কেন? স্বরূপেরই বা পার্থক্য কেন? ফলতঃ সেই মহাশক্তির মায়াংশ লক্ষ্য করিয়া শাস্ত্র যেখানে তাঁহার উল্লেখ করিয়াছেন, সেখানেও 'মহামায়া' নাম দিয়াছেন। আবার যেখানে ব্রহ্মস্বরূপ লক্ষ্য করিয়া উল্লেখ করিয়াছেন, সে স্থানেও 'মহামায়া' বলিয়াই কীর্ত্তন করিয়াছেন। উভয়স্থলেই মহৎ শব্দ মায়ার বিশেষণ। তবে বিশেষ এই যে, মায়াংশে কর্ম্মধারয় সমাস অর্থাৎ যিনি মহতী মায়া তাঁহারই নাম মহামায়া, আর ব্রহ্মাংশে বহুব্রীহি সমাস অর্থাৎ মহতী মায়া যাঁহার তিনিই মহামায়া। লূতা (গুটি পোকা) যেমন তন্তুবয়ন কার্য্যের প্রতি নিজেই নিমিত্ত কারণ এবং নিজেই উপাদান কারণ অর্থাৎ তাঁহার সূত্রজাল বিস্তাররূপ কার্য্য তাহারই ইচ্ছাক্রমে ঘটিতেছে, এইস্থানে সে নিমিত্ত কারণ। আবার সে সূত্রসৃষ্টি তাহারই শরীর হইতে উৎপন্ন হইতেছে, এইস্থানে সে উপাদান কারণ। তদ্রূপ এই জগৎ-কার্য্যের প্রতি সেই মহাশক্তি নিজেই নিমিত্ত কারণ এবং নিজেই উপাদান কারণ অর্থাৎ যখন সেই ইচ্ছাময়ী নিজ আনন্দময় সত্য সঙ্কল্পে ব্রহ্মাণ্ডসৃষ্টির ইচ্ছা করিয়াছেন তখনই তিনি নিমিত্ত-কারণ। আবার যখন আত্মবিভূতিরূপিণী মায়ার বিস্তার করিয়া তাহা হইতে এই প্রপঞ্চ চরাচর বিরচিত করিয়াছেন তখনই তিনি উপাদান-কারণ। এই নিমিত্ত-রূপ অংশ শক্তি বা ব্রহ্ম, উপাদান-রূপ অংশ মায়া। সৃষ্টি-প্রক্রিয়াতেও জীবদেহে ব্রহ্মাংশ আত্মা, মায়াংশ অন্তঃকরণ। গুটিপোকার দৃষ্টান্তেই মায়ার আর একটি অবস্থা আছে- নিজসূত্ররচিত জালে নিজে বদ্ধ হইয়া আবার সমস্ত সূত্র আত্মসাৎ করিয়া কিছুকাল সেই সূত্র মধ্যে বেষ্টিত অথচ সমাহিত হইয়া থাকে, কালক্রমে সেই সূত্রাবরণ মধ্যেই তাহার স্বরূপের পরিবর্ত্তন ঘটিতে থাকে। কিছুদিন পরে সেই গুটিপোকাই আবার প্রজাপতি-রূপ ধারণ করিয়া নিজ সূত্র-গর্ভকোষ বিদীর্ণ করিয়া সেই সুন্দরাদপি-সুন্দরতম বিচিত্র দেহটি লইয়া স্বচ্ছ সূক্ষ্ম পক্ষপুট বিস্তারপূর্ব্বক নির্ম্মুক্ত-জীবনে স্বচ্ছন্দ হৃদয়ে পরমানন্দে অনন্ত আকাশকক্ষে উড্ডীন হইয়া যায়, পৃথিবীতে কেবল সেই বিদীর্ণ সূত্রকোষটি মাত্র পড়িয়া থাকে। মায়াংশ মনও তদ্রূপ নিজ-রচিত সংসারসূত্রে নিজে বদ্ধ হইয়া সেই সংসারেই আকৃষ্ট এবং পিষ্টপেষিত হইয়া আত্মসংযমপূর্ব্বক সংসারের সমস্ত স্নেহ মায়া মমতা নিজবশে আনিয়া সংসারগর্ভে বদ্ধ থাকিয়াই সেই বিশ্বগর্ভধারিণী বিশ্বেশ্বর-হৃদিচারিণীর চারুচরণাম্বুজ চিন্তায় সমাহিত হইলে ত্রৈলোক্যের অজ্ঞাতসারে অন্তরে অন্তরেই তাহার রূপান্তর ঘটিতে থাকে। তখন কাল পূর্ণ হইয়া আসিলে নিজবলে সংসার মায়াকোষ বিদীর্ণ করিয়া সেই কালভয়হারিণী মহাকালমোহিনীর কৃপাকটাক্ষ-লাভে বিবেক বৈরাগ্য দুইটি পক্ষ বিস্তার করিয়া নিজদেহরূপ সমুজ্জ্বল জ্যোতির্ম্ময় আত্মাটি লইয়া মনোরূপিণী শুদ্ধ সাত্ত্বিকী নির্ম্মলা মায়া তখন প্রজাপতি (শক্তি বলে ব্রহ্মাণ্ডপতি) সাজিয়া বিদ্যারূপে ব্রহ্মাণ্ড অতিক্রম পূর্ব্বক মহাবিদ্যার সচ্চিদানন্দধাম লক্ষ্যে অনন্ত আকাশকক্ষে অসীম উর্ধ্বে ধাবিত হয়, দাবানলের সূক্ষ্ম শিখা সূর্য্য-মণ্ডলে মিশিয়া যায়, কক্ষচ্যুত সৌদামিনী তখন সেই জ্যোতির্ম্ময়ী আনন্দঘন-কাদম্বিনীর অঙ্গে বিলীন হয়। মনের এই ভগ্ন পিঞ্জর পাঞ্চ-ভৌতিক দেহটি মাত্র সংসারে পড়িয়া থাকে, মায়ার এই তত্ত্বজ্ঞানাত্মক অবস্থার নামই বিদ্যা। এই বিদ্যাবলে যাঁহাকে লাভ করা যায় তিনিই সেই ভবারাধ্যা সাধক-সাধ্যা মহাবিদ্যা। সাধক! তিনিই সংসারে সার্থক বিদ্যা উপার্জ্জন করিয়াছেন, যাঁহার বিদ্যা লৌকিক অর্থ ধনের জন্য বিড়ম্বিত না হইয়া পরমার্থ-ধন মহাবিদ্যার জন্য নিরন্তর ব্যাকুল। অকুল সমুদ্র সংসারে পড়িয়া যিনি কুলকুন্ডলিনীর ঘাটে নৌকা বাঁধিতে পারিয়াছেন, ভবপারান্তর-যাত্রার বিদ্যায় তিনিই পণ্ডিতকুল -চূড়ামণি। তাই বলি সাধক! মা ত তোমার, আমি কি তবে মা-হারা? ত্রিজগতের মা থাকিতেও আমার কি মা নাই? তবে বল মা! তুমি ত সাধকেরই মা। আমি যে মুর্খাদপি মূর্খতম সিদ্ধিসাধন-বিবর্জ্জিত, আমার উপায় কি হইবে? মহাবিদ্যার সন্তান হইয়াও অবিদ্যাঘোরে অন্ধ হইয়া মা! আমি ঘোর মূর্খ, আমার গতি কি হইবে? সংসারের প্রবৃত্তি-ভাটায় এ নৌকা ভাসিয়া যায়, কিছুতেই আর রাখিতে পারিলাম না, নিবৃত্তির-উজানে টানিবার সাধ্য নাই- না মা। ভাসিতেও আর পারিল না! একে এই ক্ষুদ্র নৌকা, তায় আবার নয়টি ছিদ্র, অবিরল সমুদ্রের জল উঠিয়া ভরিয়া গেল, আর দাঁড়াইবার স্থান নাই, এইবার ডুবিলাম, জন্মের মত ডুবিলাম, ধরাধর-কুমারী! মা! আমায় ধর-ধর, এ ক্ষীণ দুর্ব্বল হস্তে আর বল নাই! মা! তুমি একবার ঐ বরাভয়ের উভয় হস্ত বাড়াইয়া দাও, দয়াময়ি! একবার ফিরিয়া চাও! অজ্ঞান অনাথ শিশুর এ অকুল সমুদ্রে মা আমার 'আমার' বলিতে আর কেহ নাই! মা! কুলকুন্ডলিনি মাগো! মা হইয়া একবার কোলে তুলিয়া লও! এ নৌকা জন্মের মত ডুবিয়া যাক্। শাস্ত্র বলে, বিদ্যাবলে তোমায় লাভ করা যায়, তাই তুমি মহাবিদ্যা। আমি বলি, অবিদ্য সন্তানকে যদি উদ্ধার করিতে না পার তবে তুমি কিসের মহাবিদ্যা? আমার বিদ্যায় আমি ত ডুবিলাম, এইবার তোমার বিদ্যায় উদ্ধার করিয়া মহাবিদ্যা নামের পরিচয় দাও, এ পাপাত্মার অধঃপাতের বিদ্যার অভিমান ঘুচিয়া যাক্। জয় জননি মহাবিদ্যে! আমার সাধ্য থাক বা না থাক তুমিই জগতের সাধনার সাধ্য ধন।
সাধক! মায়ামূর্ত্তি মনঃশক্তি যখন সংসারপাশ মুক্ত হইয়া সেই মুক্তকেশী মহাশক্তির তত্ত্বলক্ষ্যে ধাবিত হয় তখন তাহার নাম যেমন বিদ্যা, আবার সে তত্ত্ব ভুলিয়া যখন সাংসারিক স্ত্রীপুত্রাদি বিষয়রসে উন্মত্ত হয় তখন তাহার নাম তেমনই অবিদ্যা। এই স্থানেই শাস্ত্র বলিয়াছেন-
মার্কণ্ডেয় পুরাণে-
জ্ঞানিনামপি চেতাংসি দেবী ভগবতী হি সা।
বলাদাকৃষ্য মোহায় মহামায়া প্রযচ্ছতি॥
তয়া বিসৃজ্যতে বিশ্বং জগদেতচ্চরাচরম্।
সৈষা প্রসন্না বরদা নৃণাং ভবতি মুক্তয়ে॥
সা বিদ্যা পরমা মুক্তে র্হেতুভূতা সনাতনী।
সংসারবন্ধহেতুশ্চ সৈব সর্ব্বেশ্বরেশ্বরী॥
অপিচ।
এবং ভগবতী দেবী সা নিত্যাপি পুনঃ পুনঃ।
সম্ভূয় কুরুতে ভূপ! জগতঃ পরিপালনম্॥
তয়ৈতন্মোহ্যতে বিশ্বং সৈব বিশ্বং প্রসূয়তে।
সা যাচিতা চ বিজ্ঞানং তুষ্টা ঋদ্ধিং প্রযচ্ছতি॥
ব্যাপ্তং তয়ৈতৎ সকলং ব্রহ্মান্ডং মনুজেশ্বর।
মহাকাল্যা মহাকালে মহামারী-স্বরূপয়া॥
সৈব কালে মহামারী সৈব সৃষ্টি র্ভবত্যজা।
স্থিতিং করোতি ভূতানাং সৈব কালে সনাতনী॥
ভবকালে নৃণাং সৈব লক্ষ্মী র্বৃদ্ধিপ্রদা গৃহে।
সৈবাভাবে তথাঽলক্ষ্মী র্বিনাশায়োপজায়তে॥
স্তুতা সংপূজিতা পুষ্পৈ র্ধূপগন্ধাদিভিস্তথা।
দদাতি বিত্তং পুত্ত্রাংশ্চ মতিং ধর্ম্মে তথা শুভাম্॥
কিঞ্চ-
এতত্তে কথিতং ভূপ দেবীমহাত্ম্যমুত্তমং।
এবংপ্রভাবা সা দেবী যয়েদং ধার্য্যতে জগৎ॥
বিদ্যা তথৈব ক্রিয়তে ভগবদ্বিষ্ণুমায়য়া॥
তয়া ত্বমেষ বৈশ্যশ্চ তথৈবান্যে বিবেকিনঃ।
মোহ্যন্তে মোহিতাশ্চৈব মোহমেষ্যন্তি চাপরে॥
তামুপৈহি মহারাজ শরণং পরমেশ্বরীং।
আরাধিতা সৈব নৃণাং ভোগস্বর্গাপবর্গদা॥
রাজন্! সেই দেবী ভগবতী নিত্যা হইয়াও এই (পূর্ব্বোক্ত) রূপে পুনঃ পুনঃ অবির্ভূতা হইয়া জগতের পরিপালন করিতেছেন। তৎকর্ত্তৃক এই বিশ্ব মোহিত হইতেছে এবং তিনিই বিশ্ব প্রসব করিতেছেন। তিনিই প্রার্থিতা এবং তুষ্টা হইয়া ত্রি-জগতের ঋদ্ধি এবং বিজ্ঞান প্রদান করিতেছেন। হে মনুজেশ্বর! মহাপ্রলয়কালে মহামারী স্বরূপা সেই মহাকালী কর্ত্তৃক এই নিখিল ব্রহ্মাণ্ড ব্যাপ্ত হইয়াছে। কালে তিনিই মহামারী, কালে তিনিই সৃষ্টিস্বরূপিণী, আবার কালে সেই অনাদি সনাতনীই সর্ব্বভূতের স্থিতিকারিণী। অভ্যুদয়কালে তিনিই মানবের গৃহে বৃদ্ধিপ্রদায়িনী লক্ষ্মীরূপিণী, আবার অভাবকালে তিনিই মানবের বিনাশের নিমিত্ত অলক্ষ্মীরূপিণী। (এ স্থলে আশঙ্কা হইতে পারে যে, জীবের নিয়তি অনুসারেই যদি তিনি অভ্যুদয় এবং অভাবকালে লক্ষ্মী এবং অলক্ষ্মীরূপে মঙ্গল এবং অমঙ্গলের বিধান করেন, তবে আর উপাসনা কেন? সেই আশঙ্কা নিরসনের জন্যই আবার বলিতেছেন) তিনি স্তুতা এবং পুষ্প ধূপ গন্ধাদির দ্বারা পূজিতা হইলে সকাম সাধকের পক্ষে বিত্ত ও পুত্রাদি এবং নিষ্কাম সাধকের পক্ষে মঙ্গলময়ী ধর্ম্মবুদ্ধি প্রদান করেন।
পরবর্ত্তী অধ্যায়ে আবার বলিয়াছেন, রাজন্! কীর্ত্তনীয় বস্তুত্তম দেবীমাহাত্ম্য এই তোমার নিকটে কীর্ত্তন করিলাম, যৎকর্ত্তৃক এই জগৎ ধৃত হইতেছে, সেই দেবী এইরূপ অলৌকিক-প্রভাবা। তৎকর্ত্তৃক মায়া মোহ বিস্তার দ্বারা যেমন জগৎ ধৃত হইতেছে, আবার সেই ভগবতী বিষ্ণুমায়া কর্ত্তৃক বিদ্যাও (তত্ত্বজ্ঞানও) তদ্রূপই সম্পাদিত হইতেছে। মহারাজ! সেই ভুবনমোহিনী মায়ার প্রভাবেই তুমি এবং এই বৈশ্য ও অন্যান্য বিবেকিগণ মোহিত হইয়াছেন, হইতেছেন এবং ভবিষ্যদ্বিবেকিগণও মোহিত হইবেন। সেই পরমেশ্বরীর শরণাপন্ন হও, তিনিই আরাধিতা হইলে মানবের ভোগ স্বর্গ এবং অপবর্গ (মুক্তি) প্রদান করেন। এ স্থানেও ঋষি শক্তিতত্ত্বের দুইটি অংশই লক্ষ্য করিয়াছেন। সংসার-বন্ধন সময়ে মায়ারূপ কীর্ত্তন করিয়াছেন, আবার সংসারবন্ধন মোচনের জন্য আরাধনার সময়ে তাঁহার ব্রহ্ম স্বরূপেরই নির্দ্দেশ করিয়া বলিয়াছেন, শরণং পরমেশ্বরীং, সৈষা প্রসন্না বরদা নৃণাং ভবতি মুক্তয়ে, সম্মোহিতং দেবি! সমস্তমেতত্ত্বং বৈ প্রসন্না ভুবি মুক্তিহেতুঃ।"
(মহামায়া-তত্ত্ব প্রসঙ্গে তন্ত্রাচার্য্য শ্রীযুক্ত শিবচন্দ্র বিদ্যার্ণব ভট্টাচার্য্য মহোদয়)