এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  উপন্যাস  শনিবারবেলা

  • সীমানা - ১৩

    শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ২৮৭৬ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • ছবি: সুনন্দ পাত্র


    ১৩

    আমি শিকলে ধরা নাহি দিব



    দুবরাজের ঘুম ভাঙল যখন তখন ভোর। বসন্তের কোকিল বৈশাখেও দিব্যি গান গায়, আর সেই গানের তীক্ষ্ণতায় নিমীলিত-চক্ষু আধো-জাগা-আধো-ঘুমে-আচ্ছন্নর চোখ খুলে যায়, দৃষ্টি কিন্তু নিবদ্ধ হয় না কোথাও। দুবরাজের মনে পড়ে গতকাল রাতে ঘুমচোখে শুয়ে থাকার মুহূর্তটি। কোথা থেকে প্রাণ-আকুল-করা একটি বাঁশিসঙ্গীত সেই যে কর্ণকুহরে প্রবেশ করল, সে আর ফিরে যাবার পথই খুঁজে পায় না যেন। দুবরাজ রাগ বোঝে না, তাল-মাত্রা জানে না, কিন্তু সেই বংশীধ্বনি আকুল করে তাকে। কখন যে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল মনে নেই তার, কিন্তু বৈশাখী কোকিলের কর্ণবিদারক ডাক সত্ত্বেও মনে হল সেই বংশীধ্বনিই স্থায়ী বসতি নিয়েছে তার কানে। বিছানা ছেড়ে উঠে জানলার সামনে দাঁড়ায় দুবরাজ।

    ভোরের লালচে আভা বাইরের জগৎকে মায়াময় করে তুলেছে যেন। সেই মায়াই বোধ হয় হাতছানি দিল দুবরাজকে। পরনের কাপড়খানা একটু টেনেটুনে গুছিয়ে-টুছিয়ে নেয় দুবরাজ, তারপর নিঃশব্দে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। গতকাল রাত্তিরে খাওয়া শেষ হলে মা চলে গেল বাড়ি, বলল, বাড়িটা একেবারে খালি রেখে আসাটা ঠিক হবে না। আকবর মামা পৌঁছিয়ে দিল মাকে। দুবরাজ তাই একাই এই ঘরে শুয়েছে কাল রাতে। এই ঘরের ঠিক পাশেই পুকুরটা। মামাবাড়ির এই পুকুরটা ছোটবেলা থেকেই ভারি প্রিয় ওর, সাঁতারও শিখেছে এই পুকুরে। ঘাটটা বাঁধানো ছিল না তখন, গত বছর বাঁধানো হল লাল সিমেন্ট দিয়ে। ঘাটের উপরেই আম গাছটা এখন বেশ বড় হয়ে গেছে, গাছ ভর্তি এসেছে বোল। গাছটার ঠিক নীচে কিছুক্ষণের জন্যে বসে দুবরাজ, ভোরবেলার এই হাওয়াটা ভারি আরামের। তারপর কী যে মাথায় ঢোকে তার, নিজের মনেই একটু হেসে উঠে দাঁড়ায়। আশপাশ থেকে ভাঙা টুকরো ঢেলা সংগ্রহ করে কতকগুলো। বেশ ঘুরে ঘুরে বেছে বেছে আনে, মনে মনে বলে, একটু চেপ্টা হলেই ভালো। তারপর আঁচলে সেগুলো নিয়ে ফিরে আসে ঘাটে। রাশিকৃত ঢেলা পাশে রেখে বসে দুবরাজ।

    এটা ওদের গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের প্রিয় খেলা। ঢেলাগুলো একটা একটা করে পুকুরের জলে এমন ভাবে ছুঁড়ে ফেলতে হবে, যেন ডুবে যাবার আগে সেগুলো লাফিয়ে লাফিয়ে ওঠে বেশ কয়েকবার। কার ছোঁড়া ঢেলা কতবার লাফিয়ে উঠল, সেটারই প্রতিযোগিতা। এই খেলার নাম ব্যাঙবাজি। ছোটবেলায় খুব পারদর্শী ছিল দুবরাজ এতে। এখন অনেক দিন খেলেনি। ওর বয়েসী মেয়েরা, যারা ওর সঙ্গীসাথী ছিল, তাদের প্রায় সবায়েরই বিয়ে হয়ে গেছে। হঠাৎ কী যে ঘটল আজ, এই ভোরের বৈশাখে আমের বোলের গন্ধে আকুল হয়ে লালচে-হয়ে-ওঠা সবুজ জলে একটা একটা করে ব্যাঙবাজি ফেলতে লাগল দুবরাজ।

    হঠাৎ দুবরাজের পিছন থেকে একটা ব্যাঙবাজি পুকুরে ছুঁড়ল কে, লাফাতে লাফাতে এগিয়ে চলেছে ঢেলাটা, তার সঙ্গে পিছন থেকে খুব জোরে জোরে কে যেন সহাস্য চিৎকার করে উঠল, চালাও পানসি বেলঘরিয়া!

    কে? – বলে পিছন ফেরে দুবরাজ। লুঙ্গি-পরা এক যুবক, মাথায় বড় বড় চুল, খালি-গায়ে জড়ানো গেরুয়া রঙের চাদরের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে তার ফর্সা শরীরের একটুখানি। যুবক তার দিকে সোজা তাকিয়ে বলল, কারটা জিতল?

    আমি দেখিনি, বলতে বলতে উঠে দাঁড়ায় দুবরাজ, তার কাপড়টা একটু ঝেড়ে নিয়ে ফিরে যাবার জন্যে পা বাড়ায়।

    এই বাড়ির মেয়ে? কই, দেখিনি তো এই ক'দিন, বাড়িটা হাত দিয়ে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে যুবক।

    আমার মামাবাড়ি, বলে দুবরাজ, কাল রাত্তিরে এসেছি, বলেই যাবার জন্যে পা বাড়ায়। তারপর এক পা এগিয়েই দাঁড়িয়ে পড়ে সে; একটু হাসে, কাল রাত্তিরে আপনি বাঁশি বাজাচ্ছিলেন? আমি শুনেছি – বলেই দৌড়িয়ে ফিরে যায় বাড়িতে।

    মেয়েটার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়েই থাকে নজরুল। বাড়িতে ঢুকে যায় দুবরাজ, তবুও আনমনা হয়ে তাকিয়েই থাকে সে। বেশ কয়েকদিন হয়ে গেল এই দৌলতপুরে এসে ওর পানসি ঠেকে গেছে, সত্যি কথা বলতে কি, এখন খানিকটা পানসেই ঠেকছে ওর এই দৌলতপুরের বাস। ঠিক এই সময়ে এই মেয়ে উদয় হল কোথা থেকে! সূর্যোদয়ের আগেই ঘুম ভেঙে একরাশ ঢেলা যোগাড় করে একা একা – সম্পূর্ণ একা – পুকুরের ধারে বসে ব্যাঙবাজি খেলে! আর, কাপড় ঝেড়ে উঠে যখন দাঁড়াল, আহা, কী দেখল নজরুল! এই মেয়ের একটুখানি হাসি, অল্প একটু কথা আর হঠাৎ পিছন ফিরে দৌড়িয়ে চলে যাওয়ার ভঙ্গী নজরুলকে মনে করিয়ে দেয়: তন্বী শ্যামা শিখরিদশনা পক্কবিম্বাধরোষ্ঠী!

    যেখানে বসেছিল মেয়েটি, সেখানেই বসে পড়ে নজরুল। কেমন যেন ওই মেয়ের সান্নিধ্যের আস্বাদ পায় সে। তারপর পাশে ফেলে যাওয়া একরাশ ঢেলা থেকে একটা একটা নিয়ে পুকুরের সঙ্গে খেলতে থাকে সে – ব্যাঙবাজি!

    কী ব্যাপার, করছেনটা কী কাজিসাহেব, পিছন থেকে পরিচিত গলার স্বর শুনে ঘুরে তাকায় কাজি। আকবর আলি দাঁড়িয়ে। তার বিস্ফারিত চোখ আর ঠোঁটে লেগে থাকা হাসির টুকরো দেখে হেসে ফেলে কাজিও, পাগল হয়ে গেছি ভাবলেন?

    আপনার কিছু কিছু পাগলামি আমি যে আগে দেখিনি তা তো নয়, বলে আলি, তবে আজকেরটা একটু বাড়াবাড়িই মনে হল। একা একা পুকুরপারে বসে ব্যাঙবাজি খেলছেন! আর বুবু আপনার চা নিয়ে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড খুঁজে বেড়াচ্ছে!

    কেন, পুকুরপারে এসে আমাকে চা দিয়ে যাওয়া বুবুর তো অভ্যেস আছে বলেই জানতুম।

    আছে, কিন্তু বুবুর স্থির বিশ্বাস আপনি পুকুরের দিকে এলে বাঁশির সুমধুর মূর্ছনা শোনা যাবেই। একটা অ্যাসোসিয়েশন, বুঝলেন তো? মানে, বাঁশি যখন নীরব, পুকুরপারে কাজিও তখন অনুপস্থিত! যাই হোক, আপনি খেলতে থাকুন, আপনার চা-টা আমিই নিয়ে আসি, বলেই বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে আলি।

    হাতে এক কেটলি চা আর দুটো কাপ নিয়ে আসে আকবর, পুকুরপারে নজরুলের পাশেই বসে পড়ে সে, চা ঢালে কাপে। নজরুল বলে, আপনার ভাগ্নীর সঙ্গে আলাপ হল।

    আপনার? কিভাবে? – আলির গলায় বিস্ময়, ওরা তো এসেছে কাল সন্ধ্যেবেলা, আমার সঙ্গেই এসেছে, আর তার পর থেকে তো আপনি সারাটা সময় আমারই সঙ্গে, ও তো আসেনি একবারও। অবিশ্যি রাতের খাওয়ার পর ওর মাকে আমি পৌঁছে দিতে গিয়েছিলাম ওদের বাড়ি, সেটুকু সময় আমি ছিলাম না, কিন্তু তখন তো অনেক রাত, ও তো শুয়ে পড়েছে তখন!

    তখন শুয়ে পড়েছে, হাসতে হাসতে বলে নজরুল, কিন্তু তার পর কি আর ঘুম থেকে ওঠেনি?

    যদি উঠেও থাকে, এত সকাল, এরই মধ্যে আলাপ হয়ে গেল আপনার সঙ্গে!– বুকের মধ্যে গুরগুর করতে থাকে আলি আকবরের।

    হল, বলে নজরুল, আমি জানতুম আমিই সূর্যোদয়ের আগে ঘুম থেকে উঠি। গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ আর শিষ্য কাজি নজরুল, এই দুজন। ঘুম-ঘুম চোখে চাদরটা গায়ে দিয়ে এই আমতলায় এসে দাঁড়িয়েছি, দেখি এক অপ্সরা খেলছে পুকুরের সঙ্গে। আমিও খেলতে গেলুম, পালাল আমাকে দেখে, এই দেখুন না, পড়ে-থাকা ঢেলাগুলো দেখায় নজরুল। জিজ্ঞেস করলুম, কে তু্মি? বলল, এ বাড়ির ভাগ্নী, আর তারপরেই দে ছুট।

    আনন্দ প্রায় চাপতে পারে না আলি, বলে, ভারি ভালো মেয়ে। মামাকে দেখে ভাগ্নীর রূপ ভাবতে যাবেন না যেন, আর তার পরেই জিভ কেটে বলে, আপনি তো দেখেইছেন।

    আলি ভাবেইনি এত তাড়াতাড়ি তার কল্পনা বাস্তব রূপ নেবে। ভোরের রূপ-গন্ধ মিশ্রিত স্বচ্ছ অবাধ ভাবনা
    ষোল-সতের বছরের একটা মেয়েকে শৈশবের খেলায় টেনে আনে যখন, তার রূপ বোধ হয় কাজির মতো এক কবির চোখেই ধরা পড়ে। ছোটবেলা থেকেই বড়দের মুখে শুনে আসছে গোধূলির আলোর আশ্চর্য সৌন্দর্যের কথা, বাংলা দেশে একে বলা হয় কনে-দেখা আলো। আজ আলি বোঝে, ভোরের, ব্রাহ্মমুহূর্তের, আলোর প্রতিফলন বোধ হয় শরীরের শুধু নয়, মনের সৌন্দর্যেরও বৃদ্ধিকারক। এ তো প্রায় ম্যাজিকের মতো। গতকাল দুপুরে বুবুর সঙ্গে হেনাকে নিয়ে কথা বলবার পর হঠাৎই ওর মনে পড়ে দুবরাজের কথা। দুবরাজকে যে নজরুলের পছন্দ হয়েছে সে বিষয়ে তো আর সন্দেহই নেই। এত অল্প সময়েই কাজ হাঁশিল!

    নিজেকে নিজের চিমটি কাটতে ইচ্ছে করে এবার আলির। সাবধান আলি, ধীরে। আরম্ভটা শুভ, শেষ পর্যন্ত এটাকে টেনে নিয়ে যেতে হবে।

    গ্রাম বাংলার পাড়া-গাঁয়ে লুচি ভাজা হয়ই না। আজ হবে ওদের বাড়িতে। অন্যদিন সকালের জলখাবার মানে ভাত। কোনদিন তখনই রান্না-করা, কোনদিন আবার আগের দিনের বাসি পান্তা ভাতের সঙ্গে চুনো মাছ আর চিংড়ির শুটকি পেঁয়াজ-মরিচ দিয়ে মেখে। গরম ভাত আর পান্তার মধ্যে কোন্‌টা খাবে?– কাজিকে জিজ্ঞেস করলে ও পান্তা ভাতই চায়। চানটান সেরে পুকুরপারে আমতলায় বসে একটা খাতায় কী যেন লিখছিল কাজি, বুবু হাজির। জিজ্ঞেস করল, কলকাতায় নাস্তা কর কী দিয়ে? কাজী বলল, তার কি ঠিক আছে কিছু? যেদিন যা পাই। আর, রোজ যে নাস্তা করিই তারই বা কী মানে?

    সে ঠিক আছে, কিন্তু, বুবুর প্রশ্ন, সবচেয়ে ভালবাস কী খেতে?

    কী খেতে? কখন? নাস্তায়? পুঁটিরামের লুচি।

    আকবরও তা-ই বলে। এমন লুচি নাকি দুনিয়ায় আর কেউ করতে পারে না। আমার বুবু ভালো লুচি করতে পারে। ও বলে, লুচির আসল হল ময়ান। ঠিক ঠিক ময়ান দিলেই লুচি ফুলবে, ভালো হবে। বুবু এখনই আসবে আজ। আজ তোমাকে লুচি খাওয়াব।

    খিদে যে বাড়িয়ে দিলে বুবু।

    আমি তোমায় অল্প করে গুড়-মুড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি। এখন তা-ই খাও। লুচি হলে বেশি করে খেও। ভালো জিনিসের জন্যে সবুর করতে হয়।

    কিছু একটা লিখছিল কাজি, এর মধ্যে একটা পুচকে এসে গুড়-মুড়ি আর এক ঘটি জল রেখে গেছে। খেয়েও নিয়েছে কাজি, তারপর নিমগ্ন হয়ে লেখার খাতায় ফিরে গেছে আবার। বেশ কিছুক্ষণ পর আলি আকবর আসে, আপনাকে ডাকতে এলাম কাজিসাহেব, বুবুর আদেশে আজ রান্নাঘরের সামনে বসে খাওয়া। লুচি নাকি গরম গরম খেতে হয়।

    বুবুরও বুবু যিনি তাঁর নাম আসমতুন্নেসা। আন্দাজে নজরুল বোঝে ইনিই সকালের অপ্সরাটির মা। নিজের থেকে আলাপ করতে আসেন না আসমতুন্নেসা, রান্নাঘরেই নিজেকে ব্যস্ত রাখেন।

    রান্নাঘরের উল্টোদিকের দাওয়ায় তিনটে পিঁড়ি পাতা হয়েছে, সামনে তিনটে থালা। নজরুল আর আকবর যখন পৌঁছল, আলতাফ আলি একটাতে বসে। বাকি দুটোতে নজরুল আর আকবর বসল। যতই আসমতুন্নেসা বুবু লুচিপটীয়সী হোন, এ-বাড়ির রান্নাঘরের কর্ত্রী এখতারউন্নেসাই। একটা ঝুড়িতে বেশ কয়েকটা লুচি নিয়ে প্রথমে এল এখতারউন্নেসা, তার পিছনে সকালে যে মেয়েটিকে দেখেছে নজরুল, সে এল একটা থালার উপর বসানো ছ'খানা বাটি নিয়ে। এক-একজনের থালায় খান পাঁচ-ছয় লুচি, আর প্রত্যেকের থালার পাশে দুটো করে বাটি সাজিয়ে দেওয়া হল। একটা বাটিতে ঘন করে রান্না করা ডাল আর অন্যটায় পটোল ভাজা। একটু ভালো করে মেয়েটিকে দেখার সুযোগ পায় নজরুল, বেশ ভালো একটা শাড়ি পরেছে সে, হালকা প্রসাধনের আভাসও আছে মুখে। যত লুচি প্রথমেই দেওয়া হয়েছিল জলখাবারের পক্ষে সেগুলোই ছিল যথেষ্ট, কিন্তু নিয়মিত লুচি খাওয়া এবং খাওয়ানোর অভ্যেস না-থাকার ফলে একটু বেশিই খাওয়া হল। নজরুল বলল, দুপুরে আর কিছু খাবে না সে।

    নজরুলদের খাওয়া হয়ে গেলে এখতারউন্নেসা বোঝে, যথেষ্ট লুচি পেলে আজ দুপুরে খেতে চাইবে না কেউই। সেই হিসেবে প্ল্যান বদলানো হয়। অতএব আরও পটোল, আরও ডাল এবং ভোজন উৎসব। সুবিধেটা হল, আজ
    খাওয়া-দাওয়ার পাট অনেক সকাল সকাল সারা। গ্রীষ্মের দুপুর এমনিতেই নিস্তব্ধ-নিঝ্‌ঝুম, বহু দূরে দূরে মাঝে মাঝে
    হয়তো-বা এক-আধটা ঘুঘুর ডাক, বাচ্চারা এবং তাদের মায়েরাও সব অন্তঃপুরে, নিদ্রিত। কাজি বাঁশিটা নিয়ে সন্তর্পণে বেরিয়ে গিয়ে পুকুরের ধারে আমতলায় গিয়ে বসে। বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে চোখ বুজে ফেলে সে।

    কতক্ষণ চোখ বুজে বাঁশি বাজিয়েছে জানে না কাজি, কিন্তু চোখটা যখন খোলে, দেখে সামনে বসে আছে আলি আকবর আর তার ভাগ্নী। সে বলে, কখন এলেন? কতক্ষণ বসে আছেন আপনারা?

    এই তো, আধ ঘন্টাটাক হবে বোধ হয়, হাসে আলি।

    আধ ঘন্টাটাক নিঃশব্দে বসে আছেন? পারেনও আপনি।

    কী করি বলুন, আলি বলে, গতকাল রাত্তিরে আমার এই ভাগ্নী নাকি আপনার বাঁশি শুনতে শুনতে ঘুমিয়েছিল, আজ যখন ঘুম ভাঙে তখনও সেই বাঁশির রেশ লেগেছিল কানে। আমরা তাই কথা বলে আপনার মূড নষ্ট করতে চাইনি। আমি তো জানি, আপনি কারো অনুরোধে কখনো বাঁশি বাজান না। গান গাইতে পারেন অনুরোধ করলে, কিন্তু বাঁশি তো আপনি কখনোই বাজাতে চান না যতক্ষণ না নিজের মূড আসে।

    সেটা ঠিকই, বলে কাজি, গানের ক্ষেত্রে গানের কথাও তো অনেক কিছুই বলে, কাজেই গায়কের নিজের কানে ঠিকঠাক মনের মতো সুর যদি না-ও লাগে, তবুও অনেক কথা বলা যায়। বাঁশি তো তা নয়, বাঁশি কথা না বলেই শোনায় কত কথা, সে কি শোনান যায় যখন-তখন? দুবরাজকে দেখিয়ে বলে, কাল ওর কানে কানে কী কথা বলেছিলুম বাঁশিতে, তা তো জানতুমও না আমি। ও যে কে, ও যে আছে, তা-ই তো জানতুম না তখন, তবুও কত কথা বলা হয়ে গেল, ঘুম থেকে উঠেও সে কথা শুনতে পেয়েছে ও।

    দুবরাজের মনে হয় তার গলায় একটা দলা মতো কী যেন আটকিয়ে আছে, বড্ড কান্না পায় তার, মাথা নীচু করে বসে থাকে সে। আলি আকবর হঠাৎ উঠে দাঁড়ায়, বলে, তোকে পৌঁছে দিয়ে গেলাম কাজির কাছে, তোর বাঁশি শুনতে হয় কবিতা শুনতে হয় গান শুনতে হয় যা আবদার ওর কাছেই কর, আমার কাজ আছে একটু, আমি এখন যাই। হনহন করে বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে সে।

    চমকে ওঠে দুবরাজ, মামা কি রাগ করল? মামা মামা বলে ডাকে সে জোরে। পিছন ফিরে তাকায়ও না আলি, শুধু হাতটা মাথার উপরে তুলে কেমন যেন না-বাচক নাড়াতে নাড়াতে চলে যায় সে। বিস্মিত, বোধ হয় একটু ভীত দুবরাজ স্তম্ভিত বাক্যহীনা বসে থাকে সেই দিকে চেয়ে।

    এই যে, শুনছেন, কী নাম আপনার, ভাগ্নী?– নজরুলের কণ্ঠস্বরে ফিরে তাকায় দুবরাজ।

    ভাগ্নী আমার নাম নয়। আমার নাম সৈয়দা খাতুন। ভাগ্নী আমি মামার, আপনার না। আমার ডাক নাম দুবরাজ।

    উঁহুঁ, ওর একটাও আমার পছন্দ নয়। তার চেয়ে ভাগ্নীই ভাল। ভাগ্নীই ডাকি আপনাকে?

    ভাগ্নী তো নয়ই, আর আপনি-আজ্ঞেও নয়।

    তাহলে তুমি?

    জানিনা, যান।

    আরে, না জানলে চলবে কেমন করে? আপনি বা তুমি, একটা পছন্দ তো করতেই হয়। কী হল তাহলে ফাইনাল, তুমি?

    হুঁ।

    আর নাম? ভাগ্নী?

    না। বললাম তো না।

    আজ সকালে তোমার মামাকে বলেছিলুম অপ্সরা। সেটা চলবে?

    না না, প্রবল মাথা নাড়ে দুবরাজ, ও নামটা ঠাট্টার।

    এবার তাহলে আমিই একটা নাম দিই। ঠাট্টা নয়, সীরিয়স নাম। কিন্তু যে নাম দেব আমি তাতে আপত্তি শুনব না। রাজি?

    দুবরাজ এ কথার কোন উত্তর দেয় না। নজরুলের দিকে চেয়ে থাকে সে। তার ঠোঁট ফোলা, দুচোখে জলের ধারা।

    নজরুল বলে, তুমি আমার নার্গিস, শুধু আমারই নার্গিস। বাঁশিটা পাশে রাখতে রাখতে উঠে দাঁড়ায় সে, তারপর তার শুকনো হাত দুটো দিয়ে অঝোরে বহতা চোখ দুটি মুছিয়ে দেয় পরম মমতায় পরম উষ্ণতায়।

    চোখ দুটি বুজে ফেলে মুখটা ঈষৎ তুলে পুতুলের মতো বসে থাকে নার্গিস। নিষ্পন্দ।

    এর পর আর কথা হয় না। কিছুটা সময় চুপচাপ। আরো একটু সময় কেটে গেলে নার্গিস উঠে পড়ে। ধীরে ধীরে উঠে বাড়ির দিকে চলে যায় সে।

    কোন কথা না বলে বসেই থাকে নজরুল।

    ***
    দৌলতপুরের এই বাড়িটা খুব যে ছোট তা নয়। নজরুলকে আলাদা একটা ঘর দেওয়া গেছে। সে ঘরে ঢোকে না কেউ, এমনকি আলি আকবরও নজরুলের জন্যে নির্দিষ্ট ঘরে ঢোকা এড়িয়েই চলে। বিকেলের দিকে নজরুল পুকুরের ধারে গিয়ে বসে যখন এ-বাড়ির ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা তখন সেখানেই আসে নজরুলের কাছে। রোজ বিকেলেই প্রায় জলসা লেগে যায় আমতলায়, গান আবৃত্তি বাঁশি বাজানো। দু-চারটে হ্যারিকেন যোগাড় হয়েছে কোথা থেকে। সেগুলো জ্বলে একটু অন্ধকার হতেই, সেই আলোতেই উৎসব। ইদানিং এ-পাড়ার কয়েকটা মেয়ে ঘুঙুর যোগাড় করেছে কয়েকজোড়া। সেগুলো পায়ে বেঁধে নাচও হয়। তবলা নেই, তবলার বদলে হাততালি আর মুখে বোল দিয়ে নাচও দেখিয়ে দেয় নজরুল। এই আসরে আকবরের ভাইরা কেউ কখনও আসে না, বাড়ির বউরাও নয়। বুবু এখতারউন্নেসা মাঝে মাঝে আসে। আজও এল। আর এল আর এক বুবু, আসমতুন্নেসা। আর, তাদের পিছনে, আকবর আলির সঙ্গে এ বাড়ির ভাগ্নী, দুবরাজ। একবার চোখাচোখি হল ওর কাজির সঙ্গে, দুবরাজ কি নার্গিস হয়ে গেল!

    তারপর, সারাটা সময় সবার পিছনে মাথা নীচু করে নার্গিস। চুপচাপ।

    আসর ভেঙে গেলে রাতের খাওয়া।

    বেশি রাত হয়নি, কিন্তু পাড়াগাঁর পক্ষে এই যথেষ্ট। সবাই প্রায় শুয়ে পড়েছে। তারই মধ্যে নজরুলের ঘরে টিমটিম করে জ্বলছে একটা আলো, বিছানায় বসে আপন মনে কিছু একটা লিখছে সে। ঘরে ঢোকবার দরজাটাও খোলা। পা টিপে টিপে নজরুলের ঘরের সামনে আসে আলি আকবর, বাইরের থেকে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করে, জেগে আছেন কাজিসাহেব?

    আছি, বলতে বলতে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে আসে কাজি, আকবরও ঢুকে আসে একই সঙ্গে। বলে, বসব?

    নজরুলের তক্তপোশের এক দিকে বসে আকবর, অন্য দিকে নজরুল।

    কোন ভনিতায় যাচ্ছি না, বলে আকবর, আমার ভাগ্নীকে বিয়ে করবেন?

    আমার সঙ্গে বিয়ে দেবেন আপনারা? চাল-চুলো নেই, কোথায় কখন থাকি তারও নেই ঠিক, নিজে কী খাব বউকে কী খাওয়াব – এসব ভাবিওনি কোনদিন, এমন পাত্রে কেউ দেয় মেয়ে?

    দেওয়ার সিদ্ধান্তটা সহজ নয়, তবে আপনি যদি সত্যি সত্যিই ভালোবেসে থাকেন ওকে, আমি চেষ্টা করে দেখতে পারি।

    আর ও? আপনার ভাগ্নী? – নজরুল বলে, ও রাজি কিনা জেনেছেন আপনি?

    আপনি চাইলে ও এক কাপড়ে আজ রাতেই বেরিয়ে যাবে আপনার সঙ্গে। এটাই বুঝেছি আমি। তাই নিজের থেকেই বলতে এলাম। কিন্তু ওর অভিভাবক তো ও নিজে নয়, এমনকি আমিও নই। মানে, আমি হয়তো অভিভাবকদের একজন, কিন্তু আমার কথাই সব নয়। আপনাকে জিজ্ঞেস করতে এলাম এই ভেবে, যে আপনি যদি উৎসুক থাকেন ওর মাকে আমি বুঝিয়ে দেব। মা আর আমি একদিকে হলে অন্যদের বোঝানোটাও সহজ হবে। তাই আমি এলাম আপনার মন বুঝতে।

    আমার মনে হচ্ছে, বলে নজরুল, আপনি আপনার ভাগ্নীর মন ঠিকই বুঝেছেন। এবার শুনুন আমার কথা। আপনার ভাগ্নীর আমি নতুন একটা নাম দিয়েছি। সে নাম ও নিয়েওছে। নতুন নামের সঙ্গে সঙ্গেই যা কিছু পুরোনো, যা কিছু জীর্ণ সব ছেড়ে দিয়ে ও এখন আমার সঙ্গে সম্পৃক্ত। ওকে কি এখন কেউ আর আমার থেকে আলাদা করতে পারবে?

    আসমতুন্নেসাকে বোঝাতে বেশি সময় লাগে না আকবরের। মেয়ের মন তো মা আগেই বুঝেছে। তা ছাড়া, এমন আকর্ষক চেহারা, এমন স্বাস্থ্য, এমন সুভদ্র কথাবার্তা – নজরুলকে ভাল না বেসে কে পারবে? তার উপর আকবর বলে, তুমি কতটা বুঝেছ আমি জানিনা বুবু, কাজি নজরুল ইসলাম পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিদের একজন, এই বাংলায় রবীন্দ্রনাথের পরেই ওর স্থান। সারা পৃথিবীতে ওর খ্যাতি হবে একদিন। এমন ছেলেকে জামাই হিসেবে পাওয়া যে কত বড় সৌভাগ্য – তোমার মেয়ে ভাগ্যবতী, এমন লোক ওর বর হবে ভাবতেও আমার রোমাঞ্চ হচ্ছে। মা রাজি, ভাইদের কারো কারো একটু বিরুদ্ধ মত থাকলেও হেসেই তা উড়িয়ে দিল আকবর। আর তা ছাড়া, আকবরও তো কম নয়, সে-ও গ্র্যাজু্য়েট, তার কথার একটা দাম নেই নাকি! আকবর বলে, আমার তো মনে হয়, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়েটা হয়ে যাক, ওই যে হিন্দুরা বলে না, শুভস্য শীঘ্রম!

    নজরুল কিন্তু অস্বস্তিতে আছে। এই যে বিয়ে-টিয়ে নিয়ে এত কথাবার্তা চলছে, ও জানাতেও পারছে না ওর কোন বন্ধুকে। ওর হাতে পয়সা-কড়ি যা সামান্য ছিল, সব শেষ, অথচ লজ্জায় সঙ্কোচে আলিকে বলতেও পারছে না সে কথা। কিছুদিন আগেই আলির হাতে মুজফ্‌ফর আর পবিত্রর নামে দুখানা চিঠি দিয়েছিল পোস্ট করে দেবার জন্যে – পোস্ট অফিসের স্ট্যাম্প লাগানো খাম ছিল ওর কাছে – কিন্তু দুজনের একজনও উত্তর দিল না! কী ব্যাপার, কে জানে! ওই রকম খাম পড়ে আছে আর একখানা, পবিত্রকে আর একটা চিঠি পাঠাবে আজ ও, হাঁটতে হাঁটতে পোস্ট অফিসে নিজেই যাবে পোস্ট করতে।

    আজ সারাটা দিনই কেটে গেল নজরুলের শুধু পবিত্রকে চিঠিটা লিখতে! লেখে আর কাটে বারবার, আশ্চর্য হয় ও নিজেই! শেষ পর্যন্ত দৌলতপুরের ঠিকানাটা লেখার পর, আর লেখা হল দুয়েকটা মামুলি খবরাখবর মাত্র। তারপর আর একটাই মাত্র বাক্য: এক অচেনা পল্লী-বালিকার কাছে এত বিব্রত আর অসাবধান হয়ে পড়েছি, যা, কোন নারীর কাছে কখনও হইনি।

    বিয়ের দিন স্থিরই হয়ে গেল, শুভস্য শীঘ্রম যেমন বলেছিল আকবর। জ্যৈষ্ঠ পেরিয়েই। আষাঢ়ের তেসরা। আসমতুন্নেসা মেয়েকে নিয়ে এখন এই বাড়িতেই থাকছে, বিয়ে মামাবাড়ি থেকেই হবে। নজরুলের আত্মীয়স্বজনদের খবর দেওয়া হবে কীভাবে, জানতে চাইলেন আলতাফ আলি। আমার কোন আত্মীয় নেই, বলে নজরুল, কুমিল্লার সেনগুপ্ত পরিবারই আমার আত্মীয়, বিরজাসুন্দরীই আমার মা, ওঁদের জানান। আলতাফ বলে, তাহলে কুমিল্লায় চলেই যাই, ওঁরা তো আমাদেরও আত্মীয়, বিশেষ করে আকবরের আর আমার। নজরুল বলে, যাবার আগে আমাকে বলবেন, আমি একটা চিঠি লিখে দেব মাকে।

    মা, তুমি না এলে আমার পক্ষে তো কেউ থাকছে না। তোমাকে আসতেই হবে – নজরুলের লেখা এই চিঠি নিয়ে রওনা হলেন আলতাফ আলি।

    কিন্তু সব কিছু কেমন যেন বদলিয়ে গেল এর পর। বিকেল-সন্ধ্যের জলসা অনিয়মিত হয়ে পড়ে, আকবর প্রায় দিবারাত্র সময় কাটায় নার্গিসের সঙ্গে, কাজির সঙ্গে কথা বলবার কেউ যেন আর নেই এ-বাড়িতে। হাঁসফাঁস করতে থাকে কাজি, তার মনে হয় ছুটে বেরিয়ে যায়, পালিয়ে যায় কোথাও, সে কি খাঁচায় বন্দী! এরই মধ্যে একদিন আলি আকবর আসে নজরুলের ঘরে, বিয়ের একটা নিমন্ত্রণ-পত্র সে লিখে নিয়ে এসেছে, নজরুলের সঙ্গে বসে সেটার চূড়ান্ত রূপ দেওয়া হবে। পাত্রের পিতৃপরিচয় আকবরের জানা নেই, নজরুল কি লেখাটা একটু দেখে দেবে? নজরুল জানায়, তাদের পৈতৃক বাসস্থান বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রাম, বাবা কাজি ফকির আহ্‌মদ কিছু আয়মা সম্পত্তির উত্তরাধিকারী ছিলেন। কাজির বন্ধুদের ঠিকানা লিখে নেয় আকবর, তাদেরও তো নিমন্ত্রণপত্র পাঠাতে হবে।

    ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, এক বুবু এখতারউন্নিসা ছাড়া ওর সঙ্গে কথা বলবার কেউ নেই। এই বুবুই কিন্তু ওর খাওয়ার সময় বসে থাকে সামনে, নানা গল্প করে, ওর খাওয়া হয়ে গেলে তবেই নিজে খায়। নজরুল একদিন মনের খেদে বলেই ফেলল বুবুকে, আজকাল তোমার ভাইকে দেখতেই পাইনা, ব্যাপারটা কি?

    জাননা?– বিস্ময় প্রকাশ করে বুবু, ও তো সব মোটা মোটা বই নিয়ে এসেছে, সকাল থেকে রাত্তির পর্যন্ত পড়িয়েই চলেছে ভাগ্নীকে!

    মোটা মোটা বই? কেন? – জিজ্ঞেস করে নজরুল।

    সে আমরা মুখ্যু মানুষ, জানব কীভাবে! ও বলে, এত বড় কবির সঙ্গে বিয়ে হবে, তার যোগ্য করে তুলতে হবে না?

    ওকে বারণ কর, বলে কাজি, মেয়েটা তো পাগল হয়ে যাবে।

    এর মধ্যে একদিন আকবরকে একা-একা পেল কাজি, বলল, কী এত বই পড়াচ্ছেন ভাগ্নীকে?

    শরৎ-বঙ্কিম, প্রাইড অ্যাণ্ড প্রেজুডিস, রোমিও অ্যাণ্ড জুলিয়েট।

    কী সর্বনাশ! কেন?

    এসব না পড়লে আপনার যোগ্য হবে কীভাবে? পরে তো আপনিই বলবেন, ঠকিয়ে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে মামারা।

    আমি নিজেই পড়েছি নাকি এত সব বড় বড় বই?

    আপনার কথা আলাদা। আপনি তো নিজেই লেখক। ও তো নিজে লিখবে না, আপনাকে ইনস্পায়ার করবে!

    তাই বুঝি?– ফ্যালফ্যাল করে কাজি চেয়ে থাকে আলি আকবরের দিকে।

    বিয়ের কয়েকদিন আগে পবিত্র গাঙ্গুলির একটা চিঠি পায় কাজি। এখতারউন্নিসা বুবু চিঠিটা দিয়ে গেল ওকে। পোস্ট অফিসে নিজে হেঁটে গিয়ে যে চিঠি পাঠিয়ে এসেছিল তার উত্তর। পাঁচুই জুনে লিখেছে পবিত্র, ভাই নুরু, এইমাত্র তোর চিঠিখানা পেয়ে আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছি। কারণ এই সুদীর্ঘ দিনগুলো কি ব্যাকুল প্রতীক্ষা নিয়েই না তোর চিঠির প্রতীক্ষা করে আসছিলুম।

    তার মানে, যে চিঠি দুটো আলি আকবরকে দিয়েছিল ও মুজফ্‌ফর আর পবিত্রকে পাঠিয়ে দেবার জন্যে, সে দুটো যায়ইনি! নাকি, পাঠানোই হয়নি!

    এবারের এই চিঠিতে কাজি খানিকটা লিখেছিল নার্গিসের কথা, ওর অচেনা পল্লী-বালিকার কাছে বিব্রত হয়ে পড়ার কথা। পবিত্র জিজ্ঞেস করেছে, বিয়ের দিন ঠিক হয়েছে? কবে? সত্বর পত্র দিস।

    তার মানে, যে বিয়ের চিঠি অত ঘটা করে নজরুলের সঙ্গে বসে লিখে নিয়ে গেল আলি, সে চিঠিও যথাসময়ে পাঠানো হয়নি। কী চায় আলি? বিয়েতে নজরুলের বন্ধুদের উপস্থিতি কি অনভিপ্রেত? কিন্তু, কেন? আলি কি কাজিকে ওর বন্ধুদের থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চায়?

    তবে হ্যাঁ, সম্ভবত সুপরিকল্পিত ভাবে অন্য বন্ধুদের দূরে রেখেও কুমিল্লার বাড়ি একেবারে খালি করিয়ে মা বিরজাসুন্দরী আর বাকি সবাইকে বিয়ের আগের দিন নিয়ে এল আলি নিজে। মন্দের ভালো! যে পরিবারকে একেবারে নিজের পরিবার বলে ধরে নিয়েছে কাজি, তারা তো অন্তত সবাই থাকবে!

    বিয়ের দিন সকাল থেকেই আকাশের বাঁধ ভেঙে নামল আষাঢ়। সারাদিন নার্গিসকে যে কোথায় লুকিয়ে রেখেছে সবাই মিলে! নজরুলের কেমন যেন ভালো লাগছে না। বিকেলের দিক থেকেই একে একে আসতে শুরু করে নিমন্ত্রিতরা। গ্রামের অভিজাতরা এলেন উপহার হাতে, এলেন বিয়ের উকিল আর সাক্ষীরা, দেন-মোহর ইত্যাদি ইসলামি প্রথা একে একে সাঙ্গ হল, ইজাব কবুলও হল।

    ইজাব কবুল! এ তো নার্গিস আর কাজির ব্যাপার। কবুল করল নার্গিস। সারাদিনে এই প্রথম নজরুল দেখল নার্গিসকে। নার্গিসকে সাজানো হয়েছে। তাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। কিন্তু তবুও ভারি সুন্দর। এবার তাহলে বাসর, নার্গিসের দিকে সোজাসুজি তাকায় নজরুল। আধ-বোজা চোখ নার্গিসের। একটু অপেক্ষা কর নার্গিস, আর একটুখানিক। তারপর আমি তোমার চোখ খুলিয়ে দেব। আমার নিজের হাতে। তোমার আধভেজা চোখের পাতা ছুঁয়ে যাবে আমার হাতের আঙুল। আর একটু অপেক্ষা নার্গিস!

    এবার আকদ, গম্ভীর একটা ঘোষণা হল। কে করল, বোঝা গেল না।

    নজরুল জানে ইজাব কবুল মানেই বিয়ে। বিয়ে তো কবুল হলই। কবুল করল তো নার্গিস।

    না না, আকদ আছে না? বিয়ের কণ্ট্র্যাক্ট, লিখিত কন্ট্র্যাক্ট আকদ। সেটা সই-সাবুদ হবে, তবে তো সম্পূর্ণ হবে বিয়ে, বলেন সাদাত আলি মাস্টার, নজরুলের পক্ষে সাক্ষী হবার জন্যে যাঁকে ডেকে আনা হয়েছে।

    লিখিত কন্ট্র্যাক্ট! সে কন্ট্র্যাক্ট পড়ল নজরুল। পড়তে পড়তে হোঁচট খায় সে। পড়ে আবার। এ কী কথা! বিয়ের পর নার্গিসকে সে দৌলতপুরের বাইরে নিয়ে যাবে না। তাকে থাকতে হবে দৌলতপুরেই! তার মানে? তাকে ঘর-জামাই বানিয়ে আটকে রাখতে চায় আলি আকবর?

    এই আকদ আমি সই করব না, বলে নজরুল। আমি চললুম। উঠে দাঁড়ায় সে, পা বাড়ায়।

    দৌড়িয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে আলতাফ আলি, রাগ কোরো না কাজি, রাগ কোরো না। তুমি যা চাও তা-ই হবে। যাও, বাসরে যাও। আমরা সব ঠিক করে নেব।

    ঠিক করে নেবেন মানে?

    ও আকদ কিছু নয়, ও সব কথার কথা। যাও তুমি, বাসরে যাও, আমি দেখছি, প্রায় জোর করেই কাজিকে পাঠানো হয় বাসরে, যেখানে সলজ্জ নার্গিস অপেক্ষা করছে তার জন্যে।

    নার্গিস, কাজি বলে, আমি এই মুহূর্তে চলে যাব এখান থেকে, এই মুহূর্তে। তুমি যাবে তো আমার সঙ্গে?

    এখন? এই রাত্তিরে? এই বৃষ্টির মধ্যে?

    আমাকে যদি চাও তাহলে এখনই নার্গিস। তুমি তো বলেছিলে আমার এক কথায় আমার সঙ্গে এক কাপড়ে বেরিয়ে যাবে দরকার হলে। সেই দরকার এখন এসেছে। তৈরি হও নার্গিস। আমার হাত ধর, আমরা যাই।

    তা হয় না গো, তা হয় না। একটু মাথা ঠাণ্ডা কর, আমায় দয়া কর।

    আর একটাও কথা বলে না কাজি, বেরিয়ে আসে। উন্মত্তের মতো সোজা গিয়ে ঢোকে যে-ঘরে বিরজাসুন্দরীরা আছেন। মা, আমি চললুম, বলে কাজি।

    চললুম মানে?

    চললুম মানে চললুম। নার্গিসকে আসতে বলেছিলুম আমার সঙ্গে, সে রাজি নয়।

    তুই যাবি কী করে? বাইরে এই বৃষ্টি, রাস্তাঘাট কাদায় পিছল, কীভাবে যাবি?

    কাদাবৃষ্টি আমাকে আটকাবে মা? তোমরা তালা দিয়ে এসেছ তো, চাবিটা আমাকে দাও।

    দাঁড়া, যাবিই যদি, বীরেনকে সঙ্গে নে। ও কুমিল্লার ছেলে, রাস্তাঘাট চেনে, এখানকার ভাষা বোঝে।


    ক্রমশ...

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ২৮৭৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আদরবাসামূলক মতামত দিন