এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  বিবিধ

  • সত্যজিতের ঈশ্বর

    সম্বিৎ লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ২৩ নভেম্বর ২০২২ | ১০৮২ বার পঠিত
  • রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষে কিছু লেখা হয়নি, সত্যজিতের জন্মশতবার্ষিকীতেও না লিখলে বাঙালি নামে ঢ্যাঁড়া পড়ে যাবে। বাঙালি তো আইকন বলতে ওই দুজনকেই পেয়েছে। প্রথমজন ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছেন। দ্বিতীয়জনের ওপর একটু মানুষী আরোপ করা যাক। 

    আমার বাড়ি থেকে ঘন্টাখানেক দূরত্বে আছে ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, স্যান্টা ক্রুজ। সেখানে প্রোফেসর দিলীপ বসু ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন। দিলীপ বসুকে ইতিহাসের অধ্যাপক হিসেবে বাঙালি চেনে না। মানে যারা চেনে, তারা। সত্যজিতের অস্কার প্রাপ্তির কার্যকলাপে দিলীপ বসুর যোগাযোগ ছিল। যতদূর জানি, যে দলটি অ্যামেরিকা থেকে সত্যজিতের জন্যে অস্কার বহন করে নিয়ে গেছিলেন, তার নেতৃত্বে না হলেও, অন্যতম সদস্য হিসেবে দিলীপবাবু গিয়েছিলেন। অস্কার অনুষ্ঠানের পরে অড্রে হেপবার্নের উৎসাহে (অনুপ্রেরণা শব্দটা আর ব্যবহার করলাম না) আর অ্যাকাডেমি অফ মোশন পিকচার্সের সাহায্যে - অ্যাকাডেমি অফ মোশন পিকচার্স মানে যারা অস্কার দেয় - দিলীপবাবু ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, স্যান্টা ক্রুজে  Satyajit Ray Film and Study Center at UC Santa Cruz তৈরি করেন। ২০১৬ সালে দিলীপবাবু মারা যাবার আগে অবশ্য দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায় চলে যান বলে শুনেছি। স্টাডি সেন্টারের কী অবস্থা জানিনা, কিন্তু উনি তার জন্যে এন্ডাওমেন্ট জোগাড় করে গেছিলেন, কাজেই সেন্টারের এখনও চলা উচিত।

    আমি দিলীপ বসুর সত্যজিৎ কর্মকান্ড লিখতে বসিনি। আমার সঙ্গে দিলীপদার অল্পস্বল্প আলাপ ছিল। আমার স্ত্রীর দূরসম্পর্কের আত্মীয়ও তিনি। সে কথা জেনেছি বিয়ের পরে - বিয়েতে নেমতন্ন পাননি এই অনুযোগ জানিয়ে ফোন করায়। একবার রবীন্দ্রনাথ-সত্যজিৎ ইত্যাদি আলোচনায় উনি বলেছিলেন, সত্যজিৎ নাকি মনে করতেন রবীন্দ্রনাথ শেষবয়সে ঈশ্বর দেখেছিলেন। সত্যজিতের এই মনে করা সত্যজিতেরও শেষবয়সে। কারণে জীবনের শেষের দিকেই দিলীপ বসুর সঙ্গে সত্যজিতের পরিচয়। (জনান্তিকে বলে রাখি, শুনেছি দিলীপবাবুর বিয়ের ঘটকালিও সত্যজিতের করা। পাত্রী সত্যজিতের বন্ধুকন্যা।)

    নিজে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস না করলে অন্যে ঈশ্বর প্রত্যক্ষ করেছেন, এ কথা বলা সম্ভব নয়। কাজেই দিলীপবাবু ঠিক কথা বলছেন ধরে নিলে (মিছে কথা বলার কোন কারণ আমি খুঁজে পাচ্ছি না - তাও আমার মতন অকিঞ্চিৎকর লোককে এক ঘরোয়া আড্ডায়), এই কথাই প্রতিপন্ন হয় না কি যে সত্যজিৎ শেষ বয়সে ঈশ্বরে অস্তিত্বে বিশ্বাস করেছিলেন? সে কি তাঁর মানুষের প্রতি বিশ্বাস টলে যাচ্ছিল বলে? 

    ভেবে দেখলে এ এক সাঙ্ঘাতিক কথা। সত্যজিতের লেখায় বা ছবিতে - কোথাও ঈশ্বর বিশ্বাস-অবিশ্বাসের পরিচয় পাওয়া যায় না। সেই দিক থেকে দেখলে তিনি রবীন্দ্রনাথের মত হিউম্যানিস্ট ছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ একেবারে শেষবয়সে 'সভ্যতার সংকট' লেখার সময়েও মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারাননি। অথচ সত্যজিতের শেষের তিনটে ছবি দেখলে, আমার অন্ততঃ মনে হয়, মানুষের প্রতি বিশ্বাস ওনার টলে যাচ্ছিল। তখন কি তাহলে তিনি ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন, আগে না করলেও? সত্যজিতের অতিপ্রাকৃতে বিশ্বাস ছিল বলেই মনে হয়। ১৯২০ সালের অগাস্ট মাসে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশকে সুকুমার রায় এক চিঠিতে স্পষ্টই বলেছিলেন যে তাঁর মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে। একজন তেত্রিশ বছরের সফল ও খ্যাতিমান যুবকের পক্ষে এ কথা বলা খুবই আশ্চর্যের। সেই চিঠিতে সুকুমার তাঁর আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের ভিত নড়ে যাবার কথাও বলেছিলেন। এর তিন বছর পরে সুকুমারের মৃত্যু হয়। সত্যজিতের ওপর এই চিঠির প্রভাব ছিল। তাছাড়া সত্যজিতের ছোটগল্পগুলো অতিপ্রাকৃত ও আধিদৈবিকের প্রচুর ভিড়। ছবির মধ্যেও 'সোনার কেল্লা' আছে। 'গুপি গাইন' ধরছি না, ফ্যান্টাসি বলে। পরশপাথরও আধিদৈবিক। অবশ্য জাতিস্মরবাদ, পরশ পাথর ইত্যাদি গল্পলেখকদের ডিভাইস। শরদিন্দু জাতিস্মরের ডিভাইস ব্যবহার করেছেন ঐতিহাসিক গল্প লেখার জন্যে। জাতিস্মরতা ওখানে প্রধান নয়, ডিভাইস মাত্র। যদিও সোনার কেল্লায় জাতিস্মরতা বা পরশপাথরে পরশ পাথর দুইই গল্পের মূল, শুধু ডিভাইস নয়। পরশ পাথর যদি পরশুরামের গল্প বলে ডিসকাউন্টও করি, সোনার কেল্লা তো আপাদমস্তক সত্যজিত। যদিও অত গল্প থাকতে কেন পরশপাথরই বাছলেন, সে প্রশ্ন অবশ্য উঠতেই পারে।

    সত্যজিতের ইশ্বরবোধ নিয়ে কথা বলতে গেলে অবশ্যই 'দেবী'র কথা আসবে। সত্যজিতের অন্য সব ভাল ছবির মতনই দেবীতেও সত্যজিত, আমার মনে হয় না, কোন সোচ্চার স্টেটমেন্ট করেছেন। যদিও গল্পর প্লট রবীন্দ্রনাথের, প্রভাতকুমারকে তিনি লিখতে বলেন। অনেকে কারণ হিসেবে দেখান যে ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথ এই গল্প লিখলে গোলমাল হতে পারে এই ভয়ে হিন্দু প্রভাতকুমারকে প্লট দিয়ে দিয়েছিলেন। আমার সেটা একেবারেই বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়নি। ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথ বহু সময়েই পুজাআচ্চা, হিন্দু ধর্মের আচার-আচরণের নিন্দে করেছেন। 

    তোমার পূজার   ছলে তোমায়   ভুলেই থাকি।
    বুঝতে নারি   কখন্‌ তুমি   দাও-যে ফাঁকি ॥
    ফুলের মালা   দীপের আলো   ধূপের ধোঁওয়ার
    পিছন হতে   পাই নে সুযোগ   চরণ-ছোঁওয়ার,
    স্তবের বাণীর   আড়াল টানি   তোমায় ঢাকি ॥

    ... ইত্যাদি।

    একটা কথা এখানে বলে নেওয়া ভাল। আমি সত্যজিতের ধর্মাচরণ বা ব্যক্তি-সত্যজিতের ঈশ্বরভক্তি বা অভক্তি নিয়ে আলোচনায় উৎসাহী নই। আমি সেইটুকুতেই উৎসাহী যার প্রভাব শিল্পী-সত্যজিতের কাজের ওপর পড়েছে। সেই দিক দিয়ে, সত্যজিতের ঈশ্বরবোধ নিয়ে কোথায় বিশেষ আলোচনা দেখিনি। তাই লিখলাম। 
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ২৩ নভেম্বর ২০২২ | ১০৮২ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    চিড় - Sarthak Das
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • হজবরল | 185.220.101.61 | ২৩ নভেম্বর ২০২২ ১১:৪০514064
  • ঠাকুরবাড়ির মত রায়বাড়িও ব্রাহ্ম ছিল
  • :|: | 174.251.162.15 | ২৩ নভেম্বর ২০২২ ১১:৫১514065
  • অন্যরকম চিন্তা -- ভালো লাগলো। 
    রবীন্দ্রশতবর্ষের সময় এই পৃথিবীতে বোধহয় এসে পৌঁছাননি। তাই না-লেখার জন্য ঢ্যাঁড়া পড়বেনা বাঙালী তকমায়। 
    এই এক্সপ্রেশনটা একটু কেমন যেন -- "জনান্তিকে বলে" এর পরে "রাখি"-টা কি মিস হয়ে গেছে কোনও কারণে? 
  • ধ্যার বাল | 23.106.56.38 | ২৫ নভেম্বর ২০২২ ২১:০৬514154
  • আমার দাদুর দাদু সত্যজিতের দাদুকে চিনতো টাইপের লেকা।
  • সম্বিৎ | ২৬ নভেম্বর ২০২২ ০৯:২২514166
  • হক কথা।
  • Sobuj Chatterjee | ২৮ নভেম্বর ২০২২ ১৭:২৪514218
  •  'আগন্তুক'  দেখলে তো উনা র ঈশ্বর বিশ্বাসে সন্দেহ হয়! 
  • উজ্জ্বল | 146.196.33.215 | ২৯ নভেম্বর ২০২২ ০৫:৪২514229
  • সত্যজিৎ লিখেছেন , পথের পাঁচালী পূরস্কৃত হবার কিছুদিন আগে এক সাদা রঙের প্যাঁচা বা লক্ষ্মীপ্যাঁচা ওনার বাড়ির ছাদে এসে বসেছিল, তাড়ালেও উড়ে যায়নি | ঘটনাটাকে ঊনি গুরুত্ব দিয়েছেন | গল্পে শুধু নয় , নিজস্ব জীবনেও উনি  অতিপ্রাকৃত মানতেন মনে হয় |
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঝপাঝপ মতামত দিন