এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • গোদার সম্পর্কে দু একটি কথা যা আমি জানি

    Jishnu Mukherjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৭ আগস্ট ২০২৪ | ১৭৩ বার পঠিত | রেটিং ৫ (২ জন)
  • জাক ডেমির ছবিতে কস্টিউম আসে দিওর থেকে। তা হতে পারে কারণ সে ছবি ফেয়ারি টেল। কিন্তু গোদারের ছবিতে আনা কারিনা ভাবতে পারেন না যে এতো দামী কস্টিউম হবে। ভিভরে সা ভি ছবিতে সবাই নিজেদের রোজকার ব্যবহার করা জামাকাপড় পরেন, শুধু আনা কারিনার জন্য একটি সোয়েটার ও স্কার্ট ভাড়া করা হয়। আলফাভিল ছবি শুটিং এর সময় অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে না তাও গোদার আর্টিফিশিয়াল লাইট ব্যবহার করেননি। প্রচুর ফুটেজ যাকে বলে আনিউজেবেল। কিন্তু তার মধ্যে বেশ কিছু ফুটেজ গোদার ব্যবহার করেন এবং তা ছবির বেশ কিছু মূল্যবান অংশের রূপ নেয়। ভিভরে সি ভি ছবি থেকেই গোদার ডিরেক্ট সাউন্ড ব্যবহার করতে শুরু করেন নয়েজ ও ডায়ালগ রেকর্ড এর জন্য। লে ক্যারাবিনে ছবিতে ডিরেক্ট সাউন্ডের টাকা না থাকলেও প্রতিটা রাইফেল, প্রতিটা এরোপ্লেন এর শব্দ তিনি আলাদা করে রেকর্ড করেন ও তারপর রিমিক্স করেন। যদিও টেকনোলোজি থেকে আসা নয়েজ গোদার ব্যবহার করতেন না, করতেন প্রকৃতি থেকে আসা নয়েজ। উন ফেম মারী ছবিতে ওরলি এয়ারপোর্টে একটি লম্বা ট্র্যাকিং শট ছিলো যাতে ক্যামেরা আওয়াজ করছিলো। সবাই বলে যে এয়ারপোর্টে এরকম নয়েজ হতেই পারে, কেউ খেয়াল করবে না। কিন্তু গোদার রাজী হলেন না, রিশুট করলেন। ভিভরে সা ভি ছবিতে যদিও ডিরেক্ট সাউন্ড কাজে লেগে যায়, নানার মৃত্যুর সময় ফাঁকা রাস্তায় দূরের হাসপাতালের ঘন্টা বেজে ওঠে।

    রিয়ালিজম এর উপর গোদার এর এতো নজর কারণ তাঁর মতে সিনেমা মুহূর্তকে ধরে রাখার জন্য তৈরী হয়েছে। এর ফলে মনে আসতেই পারে লুমিয়ের ব্রাদার্স এর ওয়ার্কার্স কামিং আউট অফ ফ্যাক্টরি। গোদার এও বলেন সিনেমার কাজ হলো ডেথ অ্যাট ওয়ার্ক কে পর্দায় ফুটিয়ে তোলা। যিনি ক্যামেরার সামনে অভিনয় করছেন,  আসল জীবনে তিনি বৃদ্ধ হবেন ও তাঁর মৃত্যু হবে। সিনেমা তাই  এ মিনিট অফ ডেথ অ্যাট ওয়ার্ক কে রেকর্ড করে।

    কিন্তু শুধু রিয়ালিসম দিয়ে গোদারকে ধরা যাবে না। দৈনন্দিন বাস্তব শিল্প হয়ে ওঠে গোদারের নিজস্ব অ্যাবস্ট্রাকশন দ্বারা। গোদার বলেন মিস্ত্রি কাজ করেন বস্তু নিয়ে আর গণিতজ্ঞ কাজ করেন পিওর আইডিয়া নিয়ে। গোদার দুটোই মেলাতে চান। তাই তাঁর ছবিতে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হঠাৎ থেমে যায়, সাউন্ডট্র্যাক হয়ে যায় নিস্তব্ধ। গোদার অনেকসময় টাকার অভাবে ভালো ভাবে শুট করতে পারতেন না, কিন্তু তিনি ফুটেজ ফেলতেন না বরং এডিট টেবিলে খারাপ ফুটেজ নতুন আইডিয়ার জন্ম দিতো। মাস্কুলা ফেমিনা ছবিতে পল ও ম্যাডেলিন এর গল্পে মাঝে মাঝেই হানা দ্যায় অন্য সব চরিত্র যাদের সাথে গল্পের সরাসরি কোন যোগাযোগ নেই। এই ছবিরই দুটি ট্যাবলো নিয়ে কথা বলবো।

    দুটি ট্যাবলোই ছমিনিট দীর্ঘ। প্রথম ট্যাবলো চারটি শটে বিভক্ত। প্রথম শটটি কয়েকসেকেন্ডের রাস্তার দৃশ্য, তার পরের শটটি বাস প্যালাডিয়াম এর সাত সেকেন্ড দীর্ঘ। তৃতীয় শটটি একটি ডান্স হলের, দৈর্ঘ্য ১৮ সেকেন্ড। ও চতুর্থ শটটি বোলিং আর্কেডে প্রায় সাড়ে পাঁচ মিনিট এর। মনে হতেই পারে এটি একটি স্ট্যাটিক শট, কিন্তু আদপেই তা নয়। শটটি শুরু হয় বারে পল, ম্যাডেলিন ও এলিজাবেথদের দিয়ে। তারপর মেয়ে দুজন উঠে গেলে একটি ব্লন্ড মেয়ে আসে ও পলকে বলে যে সে তার সাথে ছবি তুলতে ইচ্ছুক কিনা, পল রাজী হয়। ক্যামেরা তাদের দুজনকে ফলো করতে শুরু করে ও ফটো বুথে তারা ঢুকে গেলে ফটো বুথের বাইরে ক্যামেরা দাঁড়িয়ে থাকে, আমরা পর্দার ভিতরের কথোপকথন শুনতে পাই। মেয়েটি বলে ১৫০ফ্রাঙ্কস এর বিনিময়ে সে তার স্তনের ছবি দিতে রাজী। পল রাজী হয় না, পর্দা উঠে যায়, পল বেরিয়ে আসে। খানিকক্ষণ ঘোরার পর একটি রেকর্ড ইয়োর ভয়েস বুথে যায় ও ম্যাডালিনের প্রতি তার প্রেমের এক কাব্যিক নিবেদন রেকর্ড করে। তারপর বেরিয়ে আসে ও একজন ব্যক্তি ছুটে এসে তার পেটে ছুরি মারে।

    দ্বিতীয় ট্যাবলোটিও প্রথম ট্যাবলোর মতোই শুরু হয়। দুটি বাইরের দৃশ্য দিয়ে। একটিতে পল আছে যার দৈর্ঘ্য কয়েকসেকেন্ড ও আর একটি রাস্তার শট, দৈর্ঘ্য ১১ সেকেন্ড। তৃতীয় শটে পল লন্ড্রিতে ঢুকে তার বন্ধু রবার্টকে আবিষ্কার করে ও তার সাথে কথা বলে। এই শটটিওসাড়ে পাঁচ মিনিট দীর্ঘ। কিন্তু এটি গোদার লং টেকে না দেখিয়ে কম বেশি ১৫টি শটে ভাগ করলেন যাদের দৈর্ঘ্য ৫ থেকে ৫৮ সেকেন্ড। এই পার্থক্যর কোনো প্রত্যক্ষ কারণ নেই। যদিও ফর্মের দিক থেকে দেখতে গিয়ে এই পার্থক্যই সিনেমাটিকে একটি স্ট্রাকচার দিয়েছে।

    যদিও এই লন্ড্রির সিকোয়েন্স দিয়েই ট্যাবলোটি শেষ হচ্ছে না। এর পর ছটি শট আছে যাদের মোট দৈর্ঘ্য ৩৯ সেকেন্ড। শটগুলি দিন ও রাতের। প্রথম শটটি রাত্রিবেলা ক্যাফের ভিতর- ৫ সেকেন্ড। দ্বিতীয় শটটি ক্যাফের ভিতর থেকে রাস্তার দৃশ্য দিনের বেলার- ৬ সেকেন্ড। তৃতীয় শটটি রাতের বেলায় রাস্তায় একটি ট্র্যাকিং শট- ৭ সেকেন্ড। চতুর্থ শটটি দিনের বেলায় একটি কাপল ক্যামেরার দিকে এগিয়ে আসছে- ১১ সেকেন্ড। পঞ্চম শটটি রাতের বেলায় দোকানের জানালায় আলো জ্বলে উঠলো- ৫ সেকেন্ড। ষষ্ঠ শটটি বৃষ্টির পর দিনের বেলার রাস্তার দৃশ্য- ৫ সেকেন্ড।

    প্রথম শটের সাউন্ডট্র্যাকে আমরা শুনতে পাই পলের ভয়েসওভার " রাত্রি এতো একাকী ও ভয়াবহ যে কোনো দিন আসতে পারে না এরপর। দ্বিতীয় শটের শব্দে আমরা শুনতে পাই ক্যাথরিনের গলা, সে বলছে আমেরিকার বিজ্ঞানীরা ইনজেকশন এর মাধ্যমে এক ব্রেন থেকে অন্য ব্রেনে আইডিয়া প্রতিস্থাপন করতে পারে। যদিও তার কথার শেষ কিছু শব্দের মাঝেই আমরা পরের রাতের শটে চলে যাই যেখানে আমরা রবার্ট এর কথা শুনতে পাই, মানুষের বিবেক তার অস্তিত্ব নির্ধারণ করে না বরং তার সামাজিক অবস্থা তার বিবেকের রূপ নির্ধারণ করে। দিনের শট ফেরত আসে এলিজাবেথের কথায় যেখানে সে বলছে যে আজ থেকে কুড়ি বছর পর এমন বৈদ্যুতিক যন্ত্র আসবে যা মানুষকে যৌন আনন্দ দেবে। আনন্দ শব্দের উপরেই কাট আসে যেখানে রাতের শটে ম্যাডালিনের গলা শোনা যায় " এই মুহূর্তে আমাদের টেলিভিশন দাও" পরের শটে " আর গাড়ি দাও আর ফেরত নাও স্বাধীনতা। "

    অনেকের মনে হতেই পারে যে রাত্রি বেলার শট পলের একাকিত্ব, রবার্ট এর নৈরাশ্যর প্রতীক আর দিনের বেলার শট ক্যাথরিনের আশাবাদ, এলিজাবেথের ইউটোপিয়ান ভবিষ্যৎ এর প্রতীক, কিন্তু আমাদের এও মাথায় রাখতে হবে এই ছবি থেকেই গোদার "শট অ্যাজ ফিল্মড" এর ধারণায় মন্তাজ বদল আনবে যা পূর্ণ রূপ পাবে মেড ইন ইউ এস এ ছবিতে। গোদারের নিজস্ব ভাষায় যা 'চান্স'কে 'ফেট' এর রূপ দেবে রিয়ালিটি ও অ্যাবস্ট্রাকশন এর দ্বন্ধ এইভাবেই গোদারের ছবিকে রূপ দেয়।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে মতামত দিন