এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • পায়ের তলায় সর্ষেঃ অরুণাচলের দিকে

    সিকি লেখকের গ্রাহক হোন
    অন্যান্য | ০৩ ডিসেম্বর ২০১৮ | ১৮৬৩৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • সিকি | ০৩ ডিসেম্বর ২০১৮ ২০:৪৮381036
  • ১।
    সিকিম ভুটানের লম্বা ট্রিপ সেরে এসেছিলাম, সে প্রায় এক বছর হয়ে গেল। সিকিম ছাড়িয়ে, উত্তর পূর্ব ভারতে ঘোরার প্ল্যান মাথায় ছিল তারও আগে থেকে, সে নানা কারণে হয়ে ওঠে নি, সে গল্প তো আগেই করেছি, নতুন করে তাই আর বলছি না। স্বপ্ন ছিল মাথার মধ্যে, সাধ্য ছিল দূরত্বে। লজিস্টিকস। উত্তর পূর্ব ভারত বললে একসাথে সাতটা রাজ্যের নাম মনে আসে। সবকটা তো ঘোরা সম্ভব নয় একবারে, একটাও ঘুরতে গেলে এতদিনের ছুটির ব্যবস্থা করতে হবে – যে ছুটি আমাদের চাকরিতে পাওয়া সম্ভব নয়। এবং, সেই পরিমাণ পয়সাকড়ির জোগাড়।

    এই স্বপ্নের ইন্ধন জুগিয়েছিল বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মানুষ। তাদের কাউকে আপনারা চেনেন, কাউকে নয়। সে চিনিয়ে দেওয়া যাবে সময়মত, তার আগে বলি, স্বপ্নটা কেমন ছিল। ... নিতান্ত সীমিত জ্ঞান নিয়ে প্রথম ভেবেছিলাম, অরুণাচল প্রদেশ যাবো। তাওয়াং। সেলা পাস পেরিয়ে যেতে হয় সেখানে, খারদুং লা পাস বা গুরুদোংমার লেকের থেকে অনেকটাই নিচে তার উচ্চতা, ফলে সারাবছরই খোলা থাকে এই পাস।

    তাওয়াং যেতে হয় গৌহাটি থেকে। গৌহাটি পৌঁছনোর দু রকমের উপায় – এক, ট্রেনে মোটরসাইকেল তুলে দিয়ে এনজেপি বা গৌহাটিতে নামিয়ে নেওয়া ও সেখান থেকে চালানো, আর দুই, পুরোটাই মোটরসাইকেল চালিয়ে যাওয়া – সেই হিসেবে দিল্লি থেকে গৌহাটি পৌঁছতে লাগবে তিনদিন – গোরখপুর, শিলিগুড়ি, গৌহাটি। এখন, আমি যে দ্বিতীয় পন্থাটাই বেছে নেব, এ নিশ্চয়ই বলে দেবার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু এই শিলিগুড়ি পর্যন্ত দীর্ঘ রাস্তাটা বড্ড বেশি ন্যাড়াবোঁচা, বোরিং। সকাল থেকে একটানা রাত পর্যন্ত সাড়ে সাতশো কি আটশো কিলোমিটার চালিয়েই যাওয়া, চালিয়েই যাওয়া, এর থেকে কি মুক্তি নেই?

    মুক্তির একটা পথ পেলাম, এদিক ওদিক ট্র্যাভেলগ নাড়াচাড়া করতে গিয়ে। নেপাল। না, কাঠমান্ডু নয়, দিল্লি থেকে দুদিনে পোখরা পৌঁছে, সেখান থেকে লোয়ার মস্তাং ভ্যালি। মুক্তিনাথ মন্দির পৌঁছে আবার সেখান থেকে ফিরে আসা, তারপরে, সেখান থেকে পোখরা, কাঠমান্ডু, বিরাটনগর হয়ে শিলিগুড়ি ঢোকা পানিট্যাঙ্কি বর্ডার দিয়ে। দুদিনের রাস্তাটা সাতদিন লাগবে হয় তো, কিন্তু একটা নতুন জায়গা বেড়ানোও তো হবে। শিলিগুড়ি পৌঁছে গেলে তো সেখান থেকে তাওয়াং ঘুরে আসতে খুব বেশি হলে আর ছদিন লাগবে – সবশুদ্ধ দু সপ্তাহে হয়ে যাবে।

    সেই মত প্ল্যান বানানো শুরু করলাম। পড়াশোনা শুরু করলাম। কিছু টুকটাক কেনাকাটাও ছিল – সেগুলো আস্তে আস্তে করতে হল, একটা অ্যাকশন ক্যাম কিনলাম, একজোড়া গ্লাভস, বাইকে তেল ভরার বিশেষ নলযুক্ত ফানেল, ইত্যাদি এবং প্রভৃতি।
    এর মধ্যে ইনপুট আসতেই থাকল। বিসিএমটি সাইটের তাপস বললেন, আরে ভাই, তাওয়াং গিয়ে কী করবা? ওখানে তো এন্ডিগেন্ডি সবাই যায়। অরুণাচল ঘুরবে তো আনএক্সপ্লোরড অরুণাচলকে এক্সপ্লোর করো। মেচুকা যাও, টুটিং যাও, কিবিঠু যাও, সেই কিবিঠু থেকে পাহাড়ি রাস্তায় চার কিলোমিটার হাঁটলে পড়ে ডং নামে একটা গ্রাম, ভারতের ইস্টার্নমোস্ট পয়েন্ট, দেশের প্রথম সূর্য ওঠে ঐখানে – সেইখানে যাও।

    এসব বাড় খাওয়ালে কি কেউ স্থির থাকতে পারে? তাও আমার মত মাথায় ক্যারা-ওলা জনতা? অতএব ঝটপট আরও পড়াশোনা করে এইসব জায়গা আমার আইটিনেরারিতে ঢুকে গেল একে একে। তাপসের মাধ্যমে আরও দু একজনের রেফারেন্স পেলাম, তাঁদের ফোন করে আরও কিছু তথ্য জোগাড় করলাম।

    পাগল তো ছিলামই, ঝটিকা সফরে দিল্লি এসে আরও খানিক সাঁকো নাড়িয়ে দিয়ে গেল পাই। আরে, তুমি অরুণাচল যাচ্ছো, রোয়িং যাবে না? রোয়িং-মায়োডিয়া-আনিনি? সেইখানে মিশমিদের গ্রাম আছে, মিশমিদের কটেজে থাকবে না?

    তাও কি হয়? অতএব, তারাও আমার লিস্টে ঢুকল। রোয়িং, মায়োডিয়া, আনিনি। পাসিঘাট থেকে কোনদিকে কীভাবে যেতে হয় – সব টুকে নিলাম আমার গুগল ডকে। এইভাবে ঢুকল তেজু, পরশুরাম কুণ্ড, জয়রামপুর পেরিয়ে পাংসাউ পাস, স্টিলওয়েল রোডের শেষমাথা ভারতের তরফে, যার পর থেকেই শুরু হচ্ছে মায়ানমার ... এবং এর পরেও চিত্ত ভরিল না – মনে হল, এতটা গিয়ে শুধু শুধু অরুণাচল দেখেই চলে আসব? মেঘালয়টা যাবো না? সেই যে ডাউকি নদী? এমনই স্বচ্ছ তার জল, ব্রিজের ওপরে দাঁড়িয়ে নদীর নিচে পাথরদের পরিষ্কার দেখা যায় – আর নদীর অন্যপারেই যার বাংলাদেশ? ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে তামাবিল বর্ডার?

    ভ্রমণ পত্রিকার সম্পাদক মহাশ্বেতা আরও বাড় খাওয়ালেন, ফলে তারাও আমার লিস্টে ঢুকল। এত সব মণিমুক্তো ঢুকে গেল লিস্টে, যে টোটাল প্ল্যান গিয়ে দাঁড়াল সাড়ে ছয় সপ্তাহের।

    এ অসম্ভব। এতদিনের ছুটি কেউ দেবে না। কোম্পানিতে ম্যাক্সিমাম তিন সপ্তাহের ছুটি পাওয়া যায়, সে-ও বিয়ে করার জন্য।
    কিন্তু, অসম্ভব ভেবে বসে থাকা কি আমার কাজ? চেষ্টা না করে তো অসম্ভব বলতে পারব না।

    উপকার হল, না অপকার হল, জানি না – আগস্ট মাসের শেষাশেষি একটা ট্রেনিং নিতে চেন্নাই গেছিলাম সপ্তাহদুয়েকের জন্য, ফিরে এসে দেখলাম আমার রিপোর্টিং ম্যানেজার বদলে গেছে। নতুন একজন এসেছেন, বেশ গাবলুগুবলু ভদ্রলোক।

    এমনিতেই আমার প্রজেক্টের ফাইনাল গো লাইভ ছিল তিরিশে নভেম্বর, এর পর একমাসের পোস্ট লাইভ সাপোর্ট মিলিয়ে ডিসেম্বরের একত্রিশ পর্যন্ত প্রজেক্ট ছিল, আমি ঐ লাইভের পরে ডিসেম্বর মাসটাকেই টার্গেট করে রেখেছিলাম। সেই রকম প্ল্যান সাজিয়ে নতুন ম্যানেজারের কাছে গিয়ে এ-কথা সে-কথার পর, খুব রঙ চড়িয়ে বললাম, আমি মোটরসাইকেল রাইডার। দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার আমি হেলায় মোটরসাইকেলে চড়ে পাড়ি দিই টিই। ফিরে এসে ট্র্যাভেলগ লিখি, সেই ট্র্যাভেলগ বই আকারে ছাপে কলকাতার একটা নামকরা প্রকাশনা সংস্থা, আর আমি বইমেলায় গিয়ে সেই সব বইতে অটোগ্রাফ দিই।

    ভদ্রলোক খুবই ভালোমানুষ, একসাথে এতগুলো ওভারডোজ নেওয়া ওঁর পক্ষে একটু চাপই হয়ে যাচ্ছিল, ফলে ঢপ মারছি না সত্যি বলছি, এই বেসিক ব্যাপারটুকু মাথায় না এনেই দাবি শুনতে চাইলেন। বললাম, জানি, খুবই আনজাস্টিফায়েড দাবি, কিন্তু ইট ইজ মাই ড্রিম, প্রজেক্টও শেষ হয়ে যাবে, গো লাইভের পরে প্রজেক্ট ম্যানেজারের আর কী কাজ, বাকি সাপোর্ট তো ডেভেলপমেন্ট টিমই সামলে নিতে পারবে, আর পরের অ্যাসাইনমেন্ট আমি বরং জানুয়ারিতে এসেই নেব, ফির ও জিন্দগী হি কেয়া জিন্দগী হ্যায় জিসমে সপনা দেখনা মুশকিল হ্যায়, উসকো সাকার করনা মুশকিল হি নেহি, না-মুমকিন হ্যায় – পরের পর রসগোল্লা দিলাম, আর উনি গপাগপ খেয়ে নিলেন।

    ব্যাপারটাকে পাঁচ সপ্তাহে নামাতে হল, ফলে লিস্ট থেকে নেপাল বাদ গেল। নেপাল দিল্লি থেকে এমন কিছু দূরে নয়, ও পরে কখনও করে নেওয়া যাবে। প্রথমে নর্থ ইস্ট।

    এবং, আপনারা বললে বিশ্বাস করবেন না, এর পরেও আরও দুটো অলৌকিক রকমের ভালো ভালো ঘটনা ঘটল। এক, সেপ্টেম্বরের থার্ড উইকে জানা গেল আমার প্রজেক্ট অন্য কোনও এক ভেন্ডরের দেরির কারণে হোল্ডে চলে যাচ্ছে নভেম্বরের গোড়ায়, মানে সাময়িকভাবে স্থগিত, আবার জানুয়ারি মাসে শুরু হবে। মানে, নভেম্বর এবং ডিসেম্বর, দুটো মাস আমার হাতে সে রকম কোনও কাজ রইল না। আর দুই নম্বর ভালো ঘটনাটা হল, আমার প্রজেক্টের যে অনসাইট কাউন্টারপার্ট ছিল – অনসাইট প্রজেক্ট ম্যানেজার, ট্রাম্প বাবার অসীম দয়ায় তার ভিসা আর এক্সটেন্ড হয় নি, ফলে তাকে ফিরে আসতে হচ্ছে ভারতে, এবং সে এসে জয়েন করবে দিল্লিতেই। মানে, অফশোরে দু দুখানা প্রজেক্ট ম্যানেজার থেকে তো লাভ নেই, সেক্ষেত্রে আমি ছুটি নিতেই পারি, যতটা লম্বা চাই।

    অক্টোবরের চার তারিখে সে এসে জয়েন করা মাত্র, আমি ছুটি অ্যাপ্লাই করে দিলাম, এবং বিনা ফলো আপে ঠিক দুদিনের মাথায় সে ছুটি অ্যাপ্রুভডও হয়ে গেল। অজ্জিত হিংসে করল, বুনান হিংসে করল, তিতাস আবাজ দিল, সোসেন হেন ভালোমানুষও প্রচুর দুঃখ বিষাদ ইত্যাদি জানাল – আমি কেন এমন ছুটি পাই না – এইসব বলে, কিন্তু তাতে তখন আমার বয়েই গেছে।

    লম্বা জার্নি, প্রায় আটত্রিশ উনচল্লিশ দিনের প্ল্যান, গত প্রায় দেড় বছর ধরে আমি একটু একটু করে তৈরি হয়েছি, ফিনান্সিয়ালি, লজিস্টিকালি। বারবার ফিরে দেখলাম, শেষ মুহূর্তের বদল যা যা করবার, সবই করে ফেললাম প্ল্যানে, দেখলাম পাঁচ সপ্তাহের প্ল্যানে কষ্ট করে হলেও, তাওয়াংও এঁটে যাচ্ছে মোটামুটি। গেছোদাদা গৌহাটি থেকে অভয় দিল, ফলে তাওয়াং পেরিয়ে বুমলা পাস দেখার ব্যবস্থাও করে ফেলা গেল ঘরে বসেই।

    ধীরেসুস্থে কয়েকটা জায়গায় হোটেল বুকও করে ফেললাম। অরুণাচলের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবশ্য হোটেল খুঁজে লাভ হবে না, সেখানে গেলে আইবি, অর্থাৎ ইন্সপেকশন বাংলো, অথবা হোমস্টে-ই ভরসা, তাই প্রাথমিক কয়েকটা জায়গার বুকিং করে বাকিগুলো তখনকার হাতেই ছেড়ে রাখলাম। দেখা যাবে। আর যদি একান্তই না পাওয়া যায় – টেন্ট কিনেছি, তেমন দরকার হলে সেইসব জায়গায় আরামসে টেন্ট খাটিয়ে শুয়ে পড়া যাবে। কেশুয়ার খুব শস্তায় টেন্ট পাওয়া যায়, মজবুত এবং টেঁকসই।
    সবকিছুই হচ্ছিল, স্বপ্ন দেখারও কমতি ছিল না। অরুণাচলে ঘোরার জন্য পারমিট লাগে, মাত্র একশো টাকার বিনিময়ে অনলাইনে সেই পারমিট পেয়ে যাওয়া যায়, তাও পেয়ে গেলাম সময়মত, কিন্তু এই সময়েই, অন্য কোথাও কিছু একটা বেসুরে বাজল চরমভাবে।

    আর আমি, ভেঙেচুরে খান্‌খান্‌ হয়ে গেলাম।

    মানুষজীবনের বিভিন্ন ইমোশনের মধ্যে যা সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে পবিত্র – সেই সুন্দর অনুভূতি হঠাৎ একদিন আমার সামনে, পরিস্থিতিবিশেষে, এমন এক কুৎসিত, বিকৃত, কদর্য রূপ নিয়ে এসে দাঁড়াল, আমি সে রূপ সইতে পারলাম না। মুহূর্তের আঘাতে, মনে হয়েছিল যেন আমার মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে, আমি আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছি না, খেতে পারছি না, ঘুমোতে পারছি না, আমি কারুর চোখে আর চোখ রেখে কথা বলতে পারছি না – অফিসের গুরুত্বপূর্ণ কাজে ভুল হয়ে যেতে শুরু করল, এই আমি, যে-আমিকে নিজে এত ভালো করে চিনতাম, মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে সেই লোকটা নিজের চোখেই অচেনা ঠেকতে শুরু করল।

    ভয়ঙ্করভাবে ডিসওরিয়েন্টেড হয়ে পড়েছিলাম, অন্তত এক থেকে দেড় সপ্তাহ। সে সময়ের সম্পূর্ণ ব্যাখ্যানে আমি যাবো না, যেতে চাই না, তবে ধীরে ধীরে আঘাতের ব্যথা যখন সহনীয় হয়ে এল, নিচু হয়ে নিজের খান্‌খান্‌ হয়ে যাওয়া টুকরোগুলোকে একটা একটা করে তুলে জুড়তে গিয়ে দেখি, দু একটা টুকরো নিরুদ্দেশ। খুঁজে পাচ্ছি না। যে সিকি দিন রাত নেট ঘেঁটে একটা একটা জায়গার নাম ধরে ধরে তার সমস্ত ডিটেল খুঁজে বের করছিল, অফিসে বাড়িতে কাজের ফাঁকে ফাঁকে একটানা রিসার্চ করে যাচ্ছিল গন্তব্যগুলোর ওপরে – সে আর উৎসাহ পাচ্ছে না। সে ভাবছে, কী লাভ বেরিয়ে? কেন বেরোব আর? সে কাঁদছে, লুকিয়ে লুকিয়ে। মাথা কুটছে একলা অন্ধকার ঘরে। কাউকে বলা যায় না, কাউকে দেখানো যায় না সে আঘাত – সে সম্পূর্ণ নিজেকে আর খুঁজে পাচ্ছে না। বেরোনোর মন, বেড়ানোর মন, নতুন জায়গা দেখে আনন্দিত হবার মনটা পুরোপুরি উবে গেছে কোথাও, ভেতর থেকে আর বেরোনোর জন্য ডাক আসছে না।

    কী করব তা হলে আমি? সব তৈরি, কয়েকটা হোটেলের বুকিং, পারমিট, ছুটি, অফিসে প্রয়োজনীয় ব্যাকআপ – সমস্ত তৈরি, এমন সুযোগ হয় তো আর আসবে না, সব ছেড়ে দেব? সেটা কি আমাকে সামলে উঠতে সাহায্য করবে?

    দু তিন রাত। দু তিন রাত ভাবলাম। গেলে কী ক্ষতি বা লাভ, না গেলে কী ক্ষতি বা লাভ।

    কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ততদিনে দুর্গাপুজো মিটে গেছে, লক্ষ্মীপুজো পেরিয়ে কালীপুজো আসব-আসব করছে, এমনি একদিন এক একলা মুহূর্তে আবার জমা করা নিজের টুকরোগুলোর দিকে একবার ভালো করে তাকালাম। দেখলাম, কিছু টুকরো হারিয়েছে ঠিকই, কিন্তু কয়েকটা টুকরো রয়ে গেছে। তার একটা টুকরো বলছে, প্ল্যান করে পিছিয়ে আসার লোক আমি, সিকি, নই। এতদূর যখন এগিয়েছি, কাম হোয়াট মে, দ্য শো মাস্ট গো অন। ... মনের গহীন থেকে অন্য একটা টুকরো ঝিলমিলিয়ে উঠল, বলল, পালাও সিকি, এই শহর, এই দূষণ, এই জায়গা ছেড়ে পালাও কিছুদিনের জন্য। নিজেকে খুঁজে পেতে চাইলে, রাস্তাই একমাত্র রাস্তা। এইখান থেকে বেরিয়ে যেই তুমি ভোররাতের হাইওয়ে ছোঁবে, দেখবে ধীরে ধীরে তুমি নিজেকে খুঁজে পাচ্ছো আবার।
    তাই হবে। এ তো এর আগেও হয়েছে। অনেকদিন না বেরিয়ে মনে হত, সত্যিই কি বেরোতে পারব আবার, আছে কি সেই স্ট্যামিনা? তারপরে যখনই বেরিয়েছি, দিল্লির চৌহদ্দি পেরনো মাত্র মন বদলে যায়, তখন চলার নেশা পেয়ে বসে। তার পরে চলতেই থাকি, চলতেই থাকি, মানুষ দেখি, জায়গা দেখি, আমার ভেতরটা রঙে রঙে ভরে ওঠে। এবারেও নিশ্চয়ই তাইই হবে। সুতরাং, জার্নি ক্যানসেল করাটা কোনও কাজের কথা নয়, যেতে আমাকে হবেই। শো মাস্ট গো অন।

    যাত্রার তারিখ সতেরোই নভেম্বর। জোর করে নিজেকে তৈরি করতে লাগলাম। মোটরসাইকেলে দুচারটে খুচরো কাজ করবার ছিল, করিয়ে আনলাম একদিন করোল বাগ গিয়ে। শেষমুহূর্তে অফিসে কাজের চাপ তিনগুণ বেড়ে গেল, প্রজেক্ট বন্ধ হবার মুখে ম্যানেজারকে যে সব ঝাপটা সামলাতে হয় আর কি, সেইসব ঝড়ঝঞ্ঝা সামলে যাবার যখন একদিন বাকি, দেখলাম, মোটরসাইকেলটা একদিন সার্ভিসিং করানোর ছিল, সেটাই করা হয় নি।

    কী আর করা, পাড়ার দোকানে নিয়ে গিয়ে চেন টেন টাইট দিয়ে, ইঞ্জিন অয়েল আর কুল্যান্ট নতুন করে ভরে, চাকার পাংচার ইত্যাদি ভালো করে চেক করিয়ে নিয়ে ঘরে এসে ব্যাগ গোছাতে লাগলাম। এক ফাঁকে গিয়ে জেরিক্যানে পেট্রলও ভরে নিয়েছিলাম।

    দিল্লিতে এবারে ঠাণ্ডা পড়ে নি একেবারেই, তাই গরম জামাকাপড় সব ব্যাগেই ভরে নিলাম, পরবার জন্য একটা সোয়েটার রাখলাম শুধু।

    আগেরবারের ট্রিপে গোরখপুর যেতে গিয়ে খুব ভুগেছিলাম, নরককুণ্ডে গিয়ে মোটেও পোষায় নি, তাই এবারে ঠিক করেছি গোরখপুর থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার এগিয়ে কুশীনগরে দেহ রাখব প্রথমদিনে। বুদ্ধদেবও ওখানেই রেখেছিলেন। খুব শস্তায় বুকিং হয়ে গেছে ইউপি টুরিজমের রাহী পান্থনিবাস।

    অ্যালার্ম, ভোর সাড়ে তিনটেয়।
  • বাউণ্ডুলে বান্দা | ০৩ ডিসেম্বর ২০১৮ ২২:২২381060
  • এত মানসিক আঘাত সয়েও যে বেরিয়েছেন, এটা আমাদের অনেক বড়ো পাওয়া । চলতে থাকুন , সঙ্গে আছি ।
  • dd | 670112.51.3423.27 | ০৩ ডিসেম্বর ২০১৮ ২২:৩৩381071
  • বাবা রে বাবা।

    সে যাগ্গে, ঝটপট লিখো কিন্তু।
  • | 670112.193.563423.232 | ০৩ ডিসেম্বর ২০১৮ ২২:৪৬381082
  • হ্যাঁ প্রতিদিন যেন একটা করে আসে।
  • hu | 237812.56.0112.206 | ০৪ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৬:৪৯381093
  • সিকি, লাভিউ
  • Tim | 89900.253.8956.205 | ০৪ ডিসেম্বর ২০১৮ ১২:৫৩381104
  • পরের পর্বের অপেক্ষায়। যথারীতি গোগ্রাসে পড়ার মত লেখা।
  • সিকি | ০৪ ডিসেম্বর ২০১৮ ২৩:৩২381115
  • "সামান আপ খুদ রাখ লিজিয়ে না …"
    =======================

    সতেরোই নভেম্বর

    প্রথম দিনের বাঁধাছাঁদায় অনেকটা সময় লাগে। দীর্ঘদিনের অনভ্যাস। তার ওপর ন তলার ওপর থেকে সমস্ত লাগেজ পার্কিং পর্যন্ত নিয়ে আসা। এইবারে তাই এটুকু কাজ আমি আগে থেকেই এগিয়ে রেখেছিলাম – আগের দিন শুতে যাবার আগে, এক এক করে সবকটা লাগেজ নিচে নামিয়ে গাড়ির ডিকিতে রেখে দিয়েছিলাম, পরের দিন ডিকি থেকে বের করব এবং মোটরসাইকেলে লাগাব, তাতে সময় কম লাগবে। লাগেজ বলতে, মূলত দুদিকের দুটি স্যাডল ব্যাগ, পেছনে একটা টেল ব্যাগ, পিঠে একটা ব্যাগ, আর একটা টেন্ট, যেটা কোনও ব্যাগে ঢোকানো যায় নি। ও হ্যাঁ, আর গলায় ডিএসএলআর ক্যামেরা, এবং পিঠের ব্যাগের স্ট্র্যাপে আটকানো অ্যাকশন ক্যাম। প্রায় দেড় মাসের জন্য বাইরে ঘুরব, কাচাকুচির সুযোগ কম, ফলে প্রচুর জামাকাপড় নিতে হয়েছিল, সে সমস্তই স্যাডল ব্যাগে, টেল ব্যাগে পাংচার কিট, স্লিপিং ম্যাট, টেন্ট ল্যাম্প এবং অন্যান্য টুকিটাকি জিনিস। আর পিঠের ব্যাগে ল্যাপটপ, যাবতীয় চার্জার, পেট্রল ভরার লম্বা নলওলা ফানেল, এবং এক কৌটো চিঁড়েবাদামভাজা। আগের বারের ট্রিপের শিক্ষা – সিকিনী বানিয়ে দিয়েছিল আগের দিনই। খিদের মুখে বেশ কাজে লাগে।

    বাঁধা শেষ করে যখন ফাইনালি মোটরসাইকেলে স্টার্ট দিলাম, ঘড়িতে তখন বাজছে পাঁচটা দশ। সিকিনী এতক্ষণে নিশ্চয়ই আবার ঘুমিয়ে পড়েছে, তাই ওকে একটা হোয়াটস্যাপ মেসেজ করে দিয়ে আমি এগোলাম।

    নভেম্বরের ভোরে এখনও আলো ফোটে নি, রাস্তায় ট্রাফিকও নেই, ইতিউতি দু একটা লরি ছুটে চলেছে শুধু, মোটামুটি পনেরো মিনিটের মধ্যেই দিল্লি পেরিয়ে নয়ডা, আরও পাঁচ মিনিটের মাথায় যমুনা এক্সপ্রেসওয়ে ধরে ফেললাম। এক্সপ্রেসওয়ে শুরু হতেই বোঝা গেল ঠাণ্ডাটা শুধু দিল্লিতেই কম, আশেপাশে ভালোই আছে, এদিকে আমি সে রকম তৈরি হয়ে বেরোই নি আজকে, গরম জামা অবশ্যই আছে, কিন্তু সে তো ব্যাগে, দু লেয়ারের বানজি কর্ড দিয়ে বাঁধা, এখন খুলে বের করে আবার লাগাতে গেলে কিছু না হোক আবার কুড়ি মিনিট যাবে। আজকের দৌড় অনেকটা লম্বা – কুশীনগর। আটশো ছাপান্ন কিলোমিটার। প্রতিটা মিনিট এখানে দামী। অতএব, লাগুক খানিক ঠাণ্ডা, সকাল হলে, সূর্য উঠলেই ঠাণ্ডা কমে যাবে, এই ভেবে চলতে শুরু করলাম। তা ছাড়াও, লখনউতে তো থামার আছেই। সুকান্তদার সাথে এবারেও দস্তরখ্বানে লাঞ্চ করার কথা আছে, সেখানেই বরং জ্যাকেট বা উইন্ডচিটার বের করে নেওয়া যাবে।



    ঠিকঠাক স্পিডে চলে সওয়া নটা নাগাদ যমুনা এক্সপ্রেসওয়ে শেষ করে আগ্রা লখনউ এক্সপ্রেসওয়েতে পড়লাম। বাড়িতে ছোট করে আপডেট দিয়ে আবার চলার শুরু।

    গতবারের পর একটা বছর পেরিয়ে গেছে, লখনউ এক্সপ্রেসওয়েতে এখন টোলগেট বসেছে, মোটরসাইকেলের জন্য সেখানে দুশো নব্বই টাকার টোল দিতে হয়। তিনশো দুই কিলোমিটার লম্বা এই রাস্তায় ঠিক একশো কিলোমিটার দূরত্বে দু জায়গায় এখন পেট্রল পাম্প এবং খাবার জায়গা, রেস্টরুম ইত্যাদিও হয়েছে। আগের বারের মত পেট্রল ক্যারি করবার দরকার খুব একটা পড়ে না। আমিও তাই জেরিক্যানের পেট্রল জেরিক্যানে রেখেই প্রথম একশো কিলোমিটার পেরিয়ে মোটরসাইকেলে পেট্রল ভরে নিলাম। এখন সমস্ত উত্তরপ্রদেশ জুড়ে পেট্রলের দাম দিল্লির থেকে কম।

    তেল ভরে এগোতে যাবার মুখেই, আমার পাশ দিয়ে প্রচণ্ড হাইস্পিডে হুশ হুশ করে বেরিয়ে গেল দুটো মোটরসাইকেল – একটা ডমিনার ফোর হান্ড্রেড, আর একটা বুলেট পাঁচশো সিসি। চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই তারা ছোট হতে হতে অদৃশ্য হয়ে গেল। পেছনে লাগেজ বাঁধা, আমার মতই ট্র্যাভেলার।

    আরও প্রায় তিরিশ কিলোমিটার মত যাবার পর দেখতে পেলাম দুজনকে, মোটরসাইকেল রাস্তার ধারে লাগিয়ে সাইডের বেরিয়ারে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে। দুটো মোটরসাইকেলেরই পশ্চিমবঙ্গের নাম্বার। কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম, আলাপ হল। কথা মূলত একজনই বলছিল, তার দেখলাম খুবই অ্যাডভাইস দেবার শখ। বহরমপুরের ছেলে দুজন, এসেছিল রাজস্থান দেখতে, জয়পুর, জয়শলমীর। এ কথা সে কথার পর আমার গায়ে ডেনিমের জ্যাকেট দেখে বলল, একটা পার্সোনাল অ্যাডভাইস দেব?

    বললাম, দাও।

    তুমি রাইডার্স জ্যাকেট কেনো। শীত গ্রীষ্ম সব সময়েই কাজে দেয়, সেফটি গীয়ার হিসেবেও পাকাপোক্ত, এই দ্যাখো, আমি এই – এ-ই রাইডিং জ্যাকেট পরে আছি।

    খুবই মূল্যবান অ্যাডভাইস। যদিও আলাদা করে রাইডার জ্যাকেট আমার দরকার হয় না – এমনি জ্যাকেটের সাথেই আমার এলবো গার্ড ইত্যাদি আলাদা করে লাগানো থাকে। হুঁ-হাঁ বলে মাথা নাড়ালাম। তারপরে আরও দু চার মিনিট কথা হবার পর আবার তার পার্সোনাল অ্যাডভাইস পেল। মানে, কে কতটা দূরত্ব একদিনে কভার করে সেই নিয়ে কথা হতে হতেই বলল, একটা পার্সোনাল অ্যাডভাইস দেব? রাত্তিরে চালাও। রাতে ট্র্যাফিক কম থাকে, রাতে রোদ্দুরও থাকে না, অনেক কম সময়ে অনেকটা দূরত্ব এক রাতে মেরে দিতে পারবে।

    আমি দেখলাম, যাবার সময় হয়েছে। রাতে রাইড করার অন্যান্য অসুবিধেগুলো আমি তাকে বোঝাতে বসলে কথা বেড়ে যাবে, তার চেয়ে এইবারে এগোনোই বেটার। ঝটপট বিদায় নিয়ে আবার মোটরসাইকেলে স্টার্ট দিলাম। একটা নাগাদ লখনউ শহরে ঢুকে গেলাম।

    এক বছর পেরিয়ে আমার প্রথম লং ড্রাইভের আজ প্রথম দিন। গায়ে যথেষ্টই ব্যথা মালুম দিচ্ছে, যদিও দিল্লি থেকে লখনউ টোটাল সওয়া পাঁচশো কিলোমিটার এক্সপ্রেসওয়েতে মোট তিনবার দাঁড়িয়েছি, একবার পেট্রল ভরতে, একবার চিঁড়েভাজা খাবার জন্য, আর শেষবার পার্সোনাল অ্যাডভাইস শোনার জন্য, কিন্তু সেটা অবশ্যই যথেষ্ট ছিল না। বিশেষত উরুর ভেতর দিক জুড়ে একটা সাঙ্ঘাতিক ধরে-থাকা মত অনুভূতি আমাকে স্বস্তি দিচ্ছিল না, মানে, অনেকক্ষণ রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে যে রকম ঝিঁঝিঁ ধরার মত একটা ভাব হয়, সেই রকম হচ্ছিল। বোধ করি পায়ে মাংস জমেছে, এ তারই ফল, সীটে অতক্ষণ বসে থাকতে সমস্যা হচ্ছে।

    আয়োজন সামান্যই ছিল দস্তরখ্বানে। সুকান্তদার সাথেও সেই এক বছর বাদে দেখা – তো অনেক জমে থাকা গল্প করে এক প্লেট মাটন বিরিয়ানি, গলৌটি কাবাব দু প্লেট, আর শেষদিকে শাহী টুকরা শেষ করে উঠতে উঠতে প্রায় পৌনে তিনটে বেজেই গেল। দস্তরখ্বানের মালিক ভদ্রলোক আমাকে দেখে ঠিক চিনতে পেরেছেন, এক বছর আগে এখানেই তো খেয়েছিলাম। তিনি খুব উচ্ছ্বসিত আমি আবার মোটরসাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছি বলে, আমার সাথে সেলফি টেলফি তুললেন আর বললেন ফেরার পথেও যেন ওঁর দোকানেই দুপুরের খাবার খেয়ে যাই।

    এর পর বাকি থাকে আরেকবার তেল ভরে নেওয়া – আর তো সাড়ে তিনশো কিলোমিটার। একবার ভরলেই চলে যাবে। সুকান্তদার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এগোলাম হাইওয়ে ধরে, খানিকক্ষণের মধ্যেই লখনউ শহরের ভিড় কমে এল, আর আমি চলে এলাম বারাবাঁকির কাছে।

    বারাবাঁকিতে একটা বড়সড় ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে ডানদিকে বেঁকার ব্যাপার আছে, সেইখানে কেমন মনে হল পেছনের চাকায় হাওয়া কম লাগছে। এইখানে দাঁড়িয়ে নিজের পাংচার কিট বের করার কোনও মানে হয় না, খানিক এগোতেই একটা পাংচার সারানোর দোকান পেয়ে গেলাম। লোকটা বেশ সময় নিয়ে চেক করে বলল, না, পাংচার নেই, হাওয়া কমে গেছে, বলে হাওয়া ভরে দিল।

    আবার চলা। ফৈজাবাদ আসার মুখে সন্ধ্যে হল। ফৈজাবাদ জেলারই এখন তো নাম হয়ে গেছে অযোধ্যা। প্রসঙ্গত, লখনউ শহর জুড়ে দেখলাম এলাহাবাদ যাবার সমস্ত রাস্তায় সাইনেজ বদলে প্রয়াগরাজ করে দেওয়া হয়েছে। যোগীবিষ্ঠার অমর কীর্তি।

    যাই হোক, অযোধ্যা এল, সন্ধ্যে হল, এবং শীতভাবটা আবার ফিরে এল। তখন মনে পড়ল, লখনউতে একটা উইন্ডচিটার বের করার কথা ছিল, সারাদিনে শীত করে নি বলে আর সে-কথা মনেও পড়ে নি। অতএব, এখন এই অবস্থাতেই চালাতে হবে। গন্তব্য আর প্রায় একশো পঁচাত্তর কিলোমিটার।

    শীতে মোটরসাইকেল চালালে একটা ব্যাপার হয়, খানিকক্ষণ বাদে শরীর নিজেই একটা হীটিং সিস্টেম জেনারেট করে নেয়, ফলে পরের দিকে আর অতটা ঠাণ্ডা লাগে না। কিন্তু ঠাণ্ডা না লাগলে কী হবে, অযোধ্যা এসেছে, অঘটন না ঘটলে চলে? অতএব, ঘটল। ফুলস্পীডে চলতে চলতে হঠাৎ মনে হল আমার গা থেকে কী যেন একটা খসে রাস্তায় পড়ল, একটা ভোঁতা মতন আওয়াজ বেরোল। তড়িঘড়ি ব্রেক কষলাম, বুকে পিঠে হাত দিয়ে বুঝলাম, পিঠের ব্যাগটা ঠিক আছে, গলায় ঝোলানো ডিএসএলআরের ব্যাগটা, ক্যামেরাসমেত খসে পড়েছে রাস্তায়।

    সর্বনাশ করেছে। পেছন ফিরে তাকাতেই দেখতে পেলাম, একটু দূরেই পড়ে আছে ব্যাগটা রাস্তার ওপর, সাইডের বাউন্ডারি ঘেঁষে। এটা একটা বাইপাস, সামান্য এলিভেটেড রোড, ফলে বাউন্ডারি আছে। সাইডে পড়ায় অন্তত কোনও গাড়ির চাকার নিচে পড়ার চান্স নেই। পড়িমড়ি করে মোটরসাইকেল থেকে নেমে দৌড় মারলাম ক্যামেরার দিকে।

    নাঃ, ক্যামেরা অক্ষতই আছে বলে মনে হল, অবশ্য ভেতরে কিছু ভেঙে থাকলে জানা নেই। সন্ধে ছটা বাজে, এখন রাস্তায় দাঁড়িয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করার সময় নেই, গন্তব্যে পৌঁছতে হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, অনেকটা রাস্তা বাকি, সন্ধ্যে হলে এমনিতেই ভিজিবিলিটি কমে যায়, স্পিড কমাতে হয়। আপাতদৃষ্টিতে মনে হল ক্যামেরার কোনও ক্ষতি হয় নি, ব্যাগের ভেতরে থাকার জন্য অনেকটা কুশন পেয়েছে। মূলত, ব্যাগের যে স্ট্র্যাপটা, তার প্লাস্টিকের রিংটা একদিকে ভেঙে গেছে, ফলে ক্যামেরা ব্যাগশুদ্ধু আমার গলা থেকে খুলে বেরিয়ে পড়েছে রাস্তায়।

    পিঠ থেকে ব্যাগ খুলে তাতে ঠেসেঠুসে ঢোকালাম ক্যামেরাটা। মুশকিল হয়ে গেল … প্রথম দিনেই যদি গলায় ক্যামেরা ঝোলানোর প্রভিশনটা নষ্ট হয়ে যায়, তো এতগুলো দিন এইবারে ঘুরব কেমন করে?

    আবার স্টার্ট দিলাম মোটরসাইকেলে। একটু একটু করে দূরত্ব কমে আসছে। গোরখপুর এসে গেল, পঁচিশ কিলোমিটার … কুড়ি … আঠেরো … বারো … দশ কিলোমিটার আগে দেখলাম গোরখপুর ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেটের বোর্ড, আর সেখান থেকে জিপিএস আমাকে বলল ডানদিকের রাস্তায় ডাইভার্সন নিতে, একটা ঘুটঘুটে অন্ধকার, কিন্তু চওড়া রাস্তা। গোরখপুর বাইপাস। এই রাস্তা আর ঠিক পঞ্চাশ কিলোমিটার চললেই এসে যাবে আমার আজকের গন্তব্য, কুশীনগর।

    বাকি রাস্তায় আর বিশেষ কোনও অঘটন ঘটল না, গোরখপুর বাইপাস নির্বিঘ্নে পেরিয়ে কুশীনগরে ঢুকতেই আবার আলো ঝলমলে রাস্তা, হোটেল আর পাঁচ কিলোমিটার। একটু এগোতেই ডানদিকে দেখলাম বিশাল বড় তোরণ – তাতে লেখা আছে ভগবান বুদ্ধ পরিনির্বাণ স্থল, জিপিএস বলল, সামনে আরেকটু এগিয়ে ইউ টার্ন নিয়ে এসে এই তোরণের নিচ দিয়ে ডানদিকের রাস্তায় ঢোকো।

    ইউপি ট্যুরিজমের হোটেল স্পট করতে অসুবিধে হল না। সুবিশাল কম্পাউন্ড। রিসেপশনে একজন বেঁটেখাটো মাঝবয়েসী ভদ্রলোক বসে ছিলেন। নাম বলতেই রেজিস্টার মিলিয়ে নিয়ে বললেন, একশো তিন নম্বর কামরে মে চলা জাইয়ে, ইয়ে লিজিয়ে চাবি।

    একশো তিন নম্বরটা কোথায়? আর একজন কাউকে কি পাওয়া যাবে? অনেক লাগেজ আছে, পৌঁছতে হবে।

    উনি বোধ হয় প্রথমবার এই রকমের অনুরোধ শুনলেন, কেমন একটা ভ্যাবলার মতন দৃষ্টি দিয়ে বললেন, ইধার সে চলা জাইয়েগা, আপকা রুম মিল জায়েগা। আউর সামান আপ খুদ হি লে জাইয়ে না, আভি তো রাত হো গয়া না, লোগ কাঁহা মিলেগা?

    ঘড়ির দিকে তাকালাম, নটা তিন বাজে, রাত হো গয়া তো বটেই, সরকারি হোটেল আফটার অল। অগত্যা, সেখানেই ব্যাগ আর হেলমেট রেখে বাইরে এলাম, বানজির দড়িদড়া খুলে একটা একটা করে ব্যাগ আনতে হবে। পেট্রলের ক্যানদুটো আনতে হবে। সুবিশাল রিসেপশন এরিয়াতে তখন এক সুবিশাল বিহারী টুরিস্ট গ্রুপ রাতের খাবার সেরে বিশ্রম্ভালাপ করছে, রিসেপশনের লোকটিকেই বললাম, একটু ব্যাগ আর হেলমেট দেখুন, আমি বাকি সামান নিয়ে আসছি।

    মোটরসাইকেলের ক্যারিয়ার থেকে ব্যাগ খুলতে গিয়েই দেখলাম – ক্যারিয়ারের লোহার রড একটা জয়েন্টের কাছে ভেঙে দু টুকরো হয়ে গেছে। বাঁ দিকে। ডানদিকে একই জায়গায় ক্র্যাক ধরেছে, মানে আজ না হলে কাল ভাঙবেই। যদিও তাতে বড় কোনও সমস্যা নেই, কারণ ক্যারিয়ারদুটো এমনই মজবুত, তারা অন্যান্য জায়গায় সুন্দরভাবে রড ও স্ক্রু দিয়ে ব্যালান্সড ভাবে আটকানো, কিছু হবার চান্স নেই, তবুও, টেনশন তো একটা মাথার মধ্যে ঢুকলই।

    যে পরিশ্রম সকালে করতে হয় নি, সেইটা করতে হল সাড়ে আটশো কিলোমিটার উজিয়ে এসে রাত নটার পরে। রিসেপশনের লোকটি গ্যাঁট হয়ে বসে বসে দেখল, তবু একটি সাহায্য করার লোক পাওয়া গেল না। রাহী পথিক নিবাস হোটেলটি এতই বড় – পার্কিং এরিয়া থেকে একশো তিন নম্বর ঘরের দূরত্ব কিছু না হোক, চারশো মিটার, আমাকে এক এক করে ব্যাগ খুলে প্রতিটা ব্যাগ, পেট্রলের ক্যান, টেন্ট, সমস্ত বয়ে নিয়ে গিয়ে ঘরে ঢোকাতে হল। লাগেজ প্রচুর হয়েছে এবারের জার্নিতে। হয় তো সেটাই কারণ ক্যারিয়ারের একটা রড ভেঙে যাবার। গায়ের ব্যথা দ্বিগুণ হয়ে জানান দিচ্ছে।

    ঘর থেকে একটা চিমসে বোঁটকা গন্ধ বেরোচ্ছে। বাথরুমও পরিচ্ছন্ন নয়, তবে গীজারটা চলছে। টাওয়েল নেই। আমার তোয়ালে আছে অবশ্য, তবে হোটেলে এসে নিজের তোয়ালে ভেজাবো কেন?

    রেস্টুরেন্টে খেতে গেলাম, খেয়েদেয়ে ফিরে এসে একটি পেনকিলার গিলে, তেড়ে চান করলাম। এবং বিছানায় পড়ামাত্র ঘুম …

    … এসে যাবার কথা, কিন্তু ঘুম আসছে না। কী একটা যেন অস্বস্তি সমানে বিব্রত করে চলেছে মনকে, ঘুম আসতে চাইছে না। লম্বা জার্নির সবে প্রথম দিন শেষ হল, মনটা কোথায় খুশি-খুশি থাকবে, আগামী দিনের প্ল্যানগুলো নিয়ে স্বপ্ন দেখবে, কিন্তু মন খালি বলছে, কেন এলাম? কী লাভ হচ্ছে এইভাবে ঘুরে, শরীরকে কষ্ট দিয়ে?

    এপাশ ওপাশ করতে করতে, এক সময়ে বোধ হয় ঘুমিয়েই পড়েছিলাম। কাল শিলিগুড়ি পৌঁছনো আছে, দূরত্ব আজকের তুলনায় কম, সাড়ে ছশো কিলোমিটার মোটামুটি, হয় তো ওখানে গেলে একটু ভালো লাগতে পারে। দেখি …
  • Choli | 890112.171.013412.187 | ০৫ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:১৯381126
  • বেশ
  • Tim | 013412.126.562323.237 | ০৫ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:৩৪381137
  • পড়ছি। চলুক
  • গবু | 342323.191.3423.175 | ০৫ ডিসেম্বর ২০১৮ ০১:০২381037
  • চলছি। সাথে।
  • avi | 785612.40.127812.118 | ০৫ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৬:১৪381048
  • একদম আক্ষরিকভাবে সাথে চলছি সমান্তরালে। ডিমাপুর থেকে কোহিমা যেতে যেতে লেখাটা পড়ছি। টু গুড।
  • amit | 340123.0.34.2 | ০৫ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৮:১৯381052
  • জব্বর হচ্ছে। এই ট্রাভেলগ গুলো একটা নেশার মতো।

    তবে গোদা ডিসলর ক্যামেরা গুলো গলায় ঝুলিয়ে চালানোটা কি কমফোর্টেবলে ? সেফ ও নয় মনে হয়
  • স্বাতী রায় | ০৫ ডিসেম্বর ২০১৮ ১০:০৭381053
  • দারুণ লাগছে, সঙ্গে সঙ্গে মানসভ্রমণ করছি।
  • Izhikevich | 891212.185.5678.71 | ০৫ ডিসেম্বর ২০১৮ ১১:০০381054
  • সবই তো বুঝলুম, কিন্তু সিকি কী একটা হিন্ট দিয়েও চেপে গেলো - সেটা নিয়ে ভাবনা হচ্ছে।
  • | 453412.159.896712.72 | ০৫ ডিসেম্বর ২০১৮ ১১:১৪381055
  • দেখো গে কোন কুড়ি হয়ত টা টা করেছে, তাই দুঃখে ভেঙে পড়েছিল।
  • শঙ্খ | 2345.110.785612.250 | ০৫ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৬:৫৫381056
  • আশিকি সিকির সাসপেন্স সর্ষে
  • সিকি | ০৫ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৮:৪৩381057
  • জিও, এই নামটা একঘর হয়েছে :)
  • aranya | 3478.160.342312.238 | ০৭ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৬:২২381058
  • দারুণ
  • Suhasini | 90045.206.900.165 | ০৭ ডিসেম্বর ২০১৮ ১১:৪৩381059
  • ফাঁকিবাজ সিকি! কাল লেখেনি :-(
  • সিকি | 562312.19.4534.88 | ০৭ ডিসেম্বর ২০১৮ ১২:৩৯381061
  • আজ লিখব। সময় পাচ্ছিলাম না।
  • সুকি | 90045.205.012323.215 | ০৭ ডিসেম্বর ২০১৮ ২০:২২381062
  • পড়ছি, এমন লেখা গুলি খুব ভালো লাগে
  • সিকি | ০৭ ডিসেম্বর ২০১৮ ২৩:৪৮381063
  • ভোর সাড়ে পাঁচটায় ঘুম ভাঙামাত্র যেটা প্রথম মাথায় এল, সেটা হল, “যাবো না”। একেবারে ইচ্ছে করছে না তৈরি হতে, অসীম একটা শারীরিক আর মানসিক ফ্যাটিগ চেপে বসেছে। কাল রাতে একটা পেনকিলার খেয়েছিলাম, কিন্তু গায়ের ব্যথার বিশেষ উপশম তাতে হয় নি, সেটা একটা কারণ হতে পারে, কিন্তু সেটাই একমাত্র কারণ নয়। কেমন যেন মনে হচ্ছে এবারে আমার মন আমার শরীরের সাথে নেই, কিংবা উল্টোটা। আমি কি মনের কথা না শুনে ভুল করছি? সঙ্গে তো কেউ নেই, যাওয়া ক্যানসেল করে আবার ধীরেসুস্থে দিল্লি ফিরে গেলেই বা কী ক্ষতি? কেমন একটা কারণহীনতা বিশালভাবে চেপে বসছে মাথার মধ্যে, কিছুতেই এই সুবিশাল ট্রিপে যাবার পক্ষে কোনও সহজবোধ্য কারণ দিয়ে নিজেকে প্রবোধ দিতে পারছি না।

    দশ মিনিট এপাশ ওপাশ করার পরে দ্বিতীয় চিন্তাটা মাথায় এল, কাল ক্যামেরা পড়ে গেছিল, তার পরে আর খুলে দেখা হয় নি কী ক্ষতি হয়েছে ক্যামেরার।

    ভাবামাত্র তড়াক করে উঠে বসলাম, আর ঝটপট বিছানার পাশ থেকে টেনে নিলাম ক্যামেরার ব্যাগটা। এটাকে গলায় ঝুলিয়ে আর নেওয়া যাবে না। ব্যাগের দুদিকেরই আংটা ভেঙে গেছে। চেন খুলে ক্যামেরাটাকে বের করলাম। না, আস্ত আছে। লেন্স ক্যাপ খুলতে গিয়ে দেখি, সে আর খুলছে না। কী রকম অদ্ভুতভাবে অর্ধেক ভেতরে অর্ধেক বাইরে হয়ে লেন্সের ডগায় বেকায়দায় আটকে গেছে।

    খেয়েছে। লেন্স ক্যাপ না খুললে ছবি তুলব কী করে? … এক মিনিট বাদে মনে পড়ল, লেন্সের মুখে তো ইউভি ফিল্টার লাগানো, ক্যাপটা আটকে গেছের সেই ফিল্টারের ওপরে। ফিল্টারটা তো লেন্সের মুখে প্যাঁচ দিয়ে আটকানো, প্যাঁচ খুললাম, ক্যাপসমেত ফিল্টার খুলে এল, না, ভেতরে লেন্স একদম ইনট্যাক্ট আছে। একটা ছবি তুললাম, ছবি ঠিকঠাক উঠল। ক্যামেরা ঠিক আছে।

    তা হলে এই দাঁড়াল, ছবি তুলতে গেলে প্যাঁচ ঘুরিয়ে ফিল্টার খুলে ছবি তুলতে হবে, তোলা হলে আবার প্যাঁচ লাগিয়ে বন্ধ করতে হবে। … সে না হয় হল, কিন্তু ক্যামেরা পিঠের ব্যাগে থাকলে চলতে চলতে ছবি তুলব কী করে?

    আরও খানিকক্ষণ মাথা ঘামিয়ে ভেবে দেখলাম, ব্যাগের ঠিক মাঝামাঝি একটা হাতল আছে, শক্তপোক্ত কাপড়ের, ছিঁড়ে যাবার কোনও সমস্যা নেই। ওর মধ্যে দিয়ে স্ট্র্যাপটা গলিয়ে দিয়ে দুপ্রান্ত বেশ ভালো করে গিঁট দিয়ে নিলাম। হ্যাঁ, এইবারে ঠিক হয়েছে, এইবারে গলায় ঝুলবে। ছিটকে পড়ে যাবার ভয় নেই।

    ঝটপট তৈরি হয়ে নিলাম। সকালবেলায় একজনকে পেয়ে গেলাম, যে সানন্দে আমার ব্যাগপত্র পার্কিং অবধি পৌঁছে দিল। পার্কিংটা ঘর থেকে সত্যিই অনেকটা দূরে। জেরিক্যানের পেট্রল মোটরসাইকেলেই ভরে নিলাম, অন্তত গৌহাটি অবধি তো পেট্রল পাম্পের কমতি হবে না, রোজ জেরিক্যান আলাদা লাগেজ হিসেবে বইবার দরকার কি। থাক খালি জেরিক্যান মোটরসাইকেলের ক্যারিয়ারে আটকে।

    সাড়ে সাতটায় স্টার্ট করলাম, মোটামুটি পৌনে নটা নাগাদ উত্তরপ্রদেশ পেরিয়ে বিহার ঢুকলাম।

    পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ বা দিল্লি হরিয়ানার সাথে পূর্ব ভারতের একটা বেসিক তফাৎ আছে। সেটা হল – সকালবেলায় বাজার বসা। এটা উত্তর ভারতে, পশ্চিম ভারতে একেবারে দেখা যায় না – এই সংস্কৃতিটা শুরু হয় বিহার থেকে। রাস্তার ধারে সবজি আনাজ মাছ মাংস ফলমূল নিয়ে ঢেলে বাজার চলছে।

    আজকের দূরত্ব, গুগল ম্যাপ অনুযায়ী ৫৮৭ কিলোমিটার, খুব তাড়াতাড়িই হয়ে যাবার কথা, কিন্তু রাস্তায় যত সাইনেজ দেখছি, সর্বত্র শিলিগুড়ির দূরত্ব অন্তত নব্বই কিলোমিটার বাড়িয়ে লিখছে। এতটা তফাত কেন?

    ভাবতে ভাবতেই ক্রমশ এক এক করে পেরিয়ে এলাম গোপালগঞ্জ, মুজফ্‌ফরপুর। সেখান থেকে অল্প বাঁদিকে ঘুরে দারভাঙা জেলা। একটা ধাবায় ঢুকে দুপুরের খাওয়া সেরে নিলাম। ইয়াব্বড় মাছের পিস, আলুভাজা আর ফুলকপির তরকারি দিয়ে পেটপুরে খেলাম মাত্র আশি টাকা দিয়ে। আহা, সে পুরো অমৃত।

    খেয়ে উঠে বিশাল একটা আড়মোড়া ভেঙে আবার মোটরসাইকেলে স্টার্ট দিতে হল। এখনও সাড়ে তিনশো কিলোমিটার। গুগল ম্যাপের নেভিগেশনের হিসেবে। রাস্তার সাইনেজ বলছে চারশো পঁচাশি। কী কেস, কে জানে!

    ফোর্বসগঞ্জ, বিহারী উচ্চারণে ফরবিসগঞ্জ পেরোলাম। তারপরে এল আরারিয়া। সেইখান থেকে জিপিএস আমাকে বলল বাঁদিকের রাস্তা নিতে। নিলাম – আর সেই হল আমার দুঃখের শুরু। মোড়ের মাথায় একটা পুরোপুরি আবছা হয়ে যাওয়া দিকনির্দেশিকা সাইনেজ ছিল, কিন্তু সেটা পড়ার কোনও উপায় ছিল না। আমি বাঁদিকে টার্ন নিলাম। শিলিগুড়ি তখন মোটামুটি একশো পঁচাত্তর কিলোমিটার।

    দু চার কিলোমিটার বেশ সুন্দর রাস্তা। তারপরে হঠাৎ করে রাস্তাটা নেই হয়ে শুরু হল পাথর বিছানো পথ। মানে, রাস্তা তৈরি হবে, তার আগের কোনও একটা স্টেপ হিসেবে পাথর বিছিয়ে জমি বানিয়ে রেখেছে। হতেই পারে সামান্য একটু স্ট্রেচ খারাপ আছে, একটু এগোলেই ভালো রাস্তা পাবো।

    কিন্তু ভেবে ভেবে অনেকদূর চলে এলাম, খারাপ রাস্তার কোনও শেষ নেই। এদিকে আমার স্পিড নেমে এসেছে তিরিশের ঘরে, বিকেল হয়ে এসেছে, আলো কমে আসছে দ্রুত, আমি বুঝতে পারছি, আমি বিহারের একেবারে গ্রামদেশে ঢুকে পড়েছি। এখন আর ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। একবার মোটরসাইকেল দাঁড় করিয়ে জিপিএস স্ক্রোল করে দেখলাম, রাস্তা এটাই, একশো পঞ্চাশ কিলোমিটার কোনও একটা স্টেট হাইওয়ে।

    চলতে থাকলাম। অন্ধকার হল। অন্ধকার ক্রমশ গাঢ় হল। রাস্তার দুধারে গাছপালা, মাঝে মাঝে লোকালয়, সন্ধের বাজার, কোথাও রাস্তার অর্ধেক জুড়ে উঁচু ইঁটের প্ল্যাটফর্ম করা, সেইখানে বাজার বসেছে, অটো চলছে, সাইকেল পারাপার করছে, তার মধ্যে দিয়ে আমাকে চলতে হচ্ছে। খানিক বাদে আবার নিকষ অন্ধকার, কখনও ট্রাকের পেছনে, কখনও ডাম্পারের পেছনে, ওভারটেক করার মতও চওড়া রাস্তা নেই। হাইবীমেও আলো দেওয়া যাচ্ছে না, উল্টোদিক থেকে মাঝে মাঝেই গাড়ি আসছে, অবশ্য, দেশটার নাম ভারত, এখানে রাস্তায় নামা লোকের ৯০% হাই বীম আর ডিপারের নিয়ম জানে না, তার ওপর এ হল বিহারের গ্রাম, এখানে ওসব এক্সপেক্ট করাই উচিত নয়, অতএব, আমাকেও হাইবীমে হেডলাইট জ্বালিয়েই এগোতে হল। এক একবার গাড়ি আসছে উল্টোদিক থেকে, আমার চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে, গাড়ি থামিয়ে নিতে হচ্ছে কারণ সামনে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। দূরত্ব এদিকে কমছে খুব ধীরে ধীরে, কারণ আমি নিজেই ধীরে ধীরে চলছি, রাস্তা বলে কিছু নেই, মাঝে মাঝে টার দেওয়া, বাকিটা পুরো পাথর, নয় তো ইঁট, নয় তো কাদামাটি।

    এমনিই একটা স্ট্রেচে চলছি একটা ট্রাকের পেছন পেছন আর ভাবছি কখন ব্যাটাকে ওভারটেক করতে পারব, আচমকা আমার একটু পেছন দিকেই একটা মর্মভেদী আর্তনাদ কানে এল। তড়িঘড়ি পেছনদিকে তাকিয়ে দেখি সে মানে বিচ্ছিরি দৃশ্য। নিকষ অন্ধকারে এক আধমাতাল বুড়ো সাইকেল চালিয়ে আসছিল, তার চাকার নিচে চাপা পড়েছে একটা কুচকুচে কালো কুকুর। বুড়ো হয় তো এমনিতেই সন্ধেবেলায় চোখে ভালো দ্যাখে না, সে সাইকেল থামিয়ে “কা হো গইল বা” বলছে জড়ানো গলায়, এদিকে সাইকেলটা এমন সময়েই থামিয়েছে, তার সামনের চাকা কুকুরটার পেটের ওপর, কুকুরটার পেট ফেটে গেছে সাইকেলসমেত বুড়োর চাপে, বুড়ো কুকুরকে দেখতে পাচ্ছে না অন্ধকারে, এদিকে তারই পায়ের তলায় মৃত্যুযন্ত্রণায় কুকুরটা ছটফট করছে আর আর্তনাদ করছে।

    ট্রাকটা একটু সাইড হতেই আমি মোটরসাইকেল গলিয়ে দিলাম ডানদিক দিয়ে, সামনে অনেকটা ফাঁকা রাস্তা, কিন্তু স্পিড তোলার উপায় নেই, যতটা সম্ভব দ্রুত আমি এলাকাটা ছাড়িয়ে এলাম।

    সন্ধে ছটা নাগাদ আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম কাদাপাথরের স্তুপের মাঝে, কোথাও একটা ব্রিজ বানানো হচ্ছে, তার নিচ দিয়ে এদিক ওদিক রাস্তা গেছে। জিপিএস যেদিকে যেতে বলছে, সেদিকে আদৌ কোনও রাস্তা আছে কিনা বুঝতে পারছি না। কালন্তির শেষ সীমায় পৌঁছে গেছি তখন, শুধু আমাকে সচল রেখে জিপিএস জানাচ্ছে, শিলিগুড়ি আর মেরেকেটে পঞ্চাশ কিলোমিটার।

    সেইখানে একটা চায়ের দোকান ছিল। তার কাছে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ইসলামপুর-শিলিগুড়ি যাবার জন্য কোনদিকে? সে তিনটের মধ্যে একটা রাস্তা দেখিয়ে দিল। তিনটেই সামনের দিকে এঁকেবেঁকে এগিয়ে হারিয়ে গেছে অন্ধকারে।

    উদ্দিষ্ট রাস্তা ধরে এগোলাম, দেখলাম জিপিএসও এই রাস্তার কথাই বলছে। বেশ খানিকটা এগোবার পরে রাস্তাটা একটু চওড়া হল। জিপিএস বলল, তিন কিলোমিটার পরেই বাঁদিক।

    বাঁদিক নিয়ে ভালো রাস্তা পেলাম, এবং দেখলাম রাস্তার সাইডে ব্যারিকেডে লেখা আছে ওয়েস্ট বেঙ্গল পুলিশ। মানে, আমি পশ্চিমবঙ্গে ঢুকে পড়েছি? … অবশ্য অতটাও উল্লসিত হবার কিছু নেই, এই এলাকায় হাইওয়ে একটু বাংলা, একটু বিহার, আবার একটু বাংলা, আবার একটু বিহার, এইভাবে চলে। এগোতে থাকলাম।

    খানিক এগিয়ে দোকানপাট পেলাম এবং স্পষ্ট দেখলাম, সেখানে লেখা আছে, জেলা দার্জিলিং। মানে, ঐ অখাদ্য বিহারী স্টেট হাইওয়ে দিয়ে আমি সত্যিই শর্টকাট মেরে একদম শিলিগুড়িতে ঢুকতে পেরেছি? পূর্ণিয়া, কিষেণগঞ্জ, ইসলামপুর সমস্ত বাইপাস করে সোজা শিলিগুড়ি ঢুকে গেছি! জয়গুরু! আমার হোটেল আর পঁচিশ কিলোমিটার দূরত্বে, জিপিএস বলছে, সাড়ে সাতটায় আমি ঢুকে যাবো হোটেলে।

    মানে আর একঘণ্টা! পঁচিশ কিলোমিটার তো আমি তার আগেই পৌঁছে যেতে পারি। যাই হোক, এগোলাম, দু একটা লোকালিটি পেরিয়ে আবার নিকষ কালো একটা মসৃণ হাইওয়ে, সরু। ঐ আমাদের ওখানে, হুগলি চুঁচড়ো চন্দননগরের জিটি রোড যেমন সুন্দর বানিয়ে দিয়েছে, দুধারে রিফ্লেক্টর বসানো, সেই রকম রাস্তা। একটা মাইলস্টোন চোখে পড়ল, বাগডোগরা এয়ারপোর্ট, বাইশ কিলোমিটার।

    আচ্ছা! এটাই তা হলে বাগডোগরার রাস্তা। আগের বছর এই রাস্তাটা ভাঙাচোরা ছিল, আগের বছরেও শিলিগুড়ি আসার সময়ে এই রাস্তাটা আমি অন্ধকারে পেরিয়েছিলাম।

    রাস্তার অবস্থা এখন ভালোই, কেবল মাঝে মাঝে হঠাৎ স্পীড ব্রেকার লাগানো, আর সেগুলো কোনও মার্কিংও করা নেই আলাদা রঙে। দু একবার জোর ঝাঁকুনি খাবার পরে আমাকে আবারও স্পীড কমাতে হল। আর তখনই নিকষ কালো অন্ধকার ভেদ করে একটা ট্রাক এল উল্টোদিক থেকে, আর আমি এক ঝলক আলোতে দেখতে পেলাম, আমার দু পাশে চা-বাগান। আমি বুঝতেই পারি নি এতক্ষণ আমি চা বাগানের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি।

    বোধ হয় মুহূর্তের জন্য অন্যমনস্ক হয়েছিলাম, আচমকা সম্বিত ফিরল একটা স্পীড ব্রেকারে ঝাঁকুনি খেয়ে, স্পীড কমালাম সাথে সাথে, কিন্তু মনে হল একটা কিছু পড়ে যাবার আওয়াজ পেলাম পেছন দিক থেকে, আর আমার মোটরসাইকেলের সাথে সাথে ঘষটে চলেছে কিছু। তড়িঘড়ি মোটরসাইকেল থামিয়ে ঘাড় ঘোরাতেই চক্ষুস্থির।

    বাঁদিকের বানজি কর্ড আলগা হয়ে খুলে গেছে, একটি মাত্র পাকের ভরসায় বাঁদিকের স্যাডল ব্যাগ এবং তার সাথে বাঁধা টেন্ট, বাঁদিকের ক্যারিয়ার থেকে খুলে, মাটিতে ঘষটাচ্ছে।

    আমার সেই মুহূর্তে ডাক ছেড়ে চেঁচাতে ইচ্ছে করছিল রাগে। দেড়শো কিলোমিটার পাথর ইঁটের ওপর চালিয়ে তখন আমার সর্বাঙ্গে দ্বিগুণ ব্যথা, ঘাড় থেকে শুরু করে পায়ের পাতা অবধি, এই অবস্থায় এখন এই লাগেজ তুলে আমাকে বাঁধতে হবে?

    কিন্তু, কাজ যদি সেটুকুই থাকত, তা হলে তো কথাই ছিল না, লাগেজগুলো খসে পড়েছে এমনভাবে, বাঁদিকের সাইডস্ট্যান্ড গেছে ব্লক হয়ে, মানে স্ট্যান্ড না নামালে আমি নামতেই পারব না মোটরসাইকেল থেকে, আর স্ট্যান্ড গেছে লাগেজের নিচে ফেঁসে। আমার পায়ে অত জোর এখন আর নেই যে পায়ে করে লাগেজ সরিয়ে তার নিচ থেকে স্ট্যান্ড উদ্ধার করব।

    রাস্তায় একটাও লোক নেই। মাত্র সাতটা দশ বাজে। অগত্যা। অসাধ্যই সাধন করতে হল। প্রায় আড়ষ্ট হয়ে যাওয়া পা দিয়ে একতিল একতিল করে স্যাডল ব্যাগ সরিয়ে সাইডস্ট্যান্ড খালি করলাম, তারপরে সেটাকে পা দিয়ে নামালাম, তারপর নিজে নামতে পারলাম।

    কালো রঙের স্যাডল ব্যাগ। কালো রঙের ক্যারিয়ার। চতুর্দিকে ঘুরঘুট্টি অন্ধকার, আমার দু হাত দূরে মাঠ আছে না চা বাগান, তা-ও বুঝতে পারছি না। শেষমেশ মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে খানিক আলো হল। এক হাতে মোবাইল ধরে অন্য হাতে বানজি কর্ডের জট ছাড়ালাম, লাগেজ মুক্ত করলাম। তারপরে আবার তাকে ক্যারিয়ারের ওপর বসিয়ে, তার ওপর টেন্ট বসিয়ে আবার বানজি দিয়ে কষে ইড়িমিড়িকিড়ি বাঁধন। এতটাই অসম্ভব লাগছিল, পুরো কাজটা সারতে আধঘণ্টার ওপর লেগে গেল।

    শেষ করে দুতিন মিনিট দম নিলাম মোটরসাইকেলের গায়ে হেলান দিয়ে। কোমর, পা, পাছু একেবারে ব্যথায় জমে আছে। একমাত্র ভরসা, জিপিএস। সে বলছে, হোটেল আর মাত্র তেরো কিলোমিটার।

    স্টার্ট দিলাম। আর কোনও অঘটন ঘটল না, খানিক বাদেই বাগডোগরা এয়ারপোর্টের প্রবেশপথ, তার খানিক পরেই শিলিগুড়ি শহরের শুরু। হোটেলটাও লোকেট করতে এবার একেবারে অসুবিধে হল না, হিলকার্ট রোডের প্রায় ওপরেই হোটেল ভেঙ্কটেশ রিজেন্সি। দু তিনটে নেপালি যুবক চালায় মনে হল হোটেলটা। শিলিগুড়িতে পৌঁছেও বাংলায় কথা বলার তাই সুযোগ হল না।

    ছেলেগুলো খুবই হেল্পফুল। ঝটপট আমার সাথে হত লাগিয়ে লাগেজ খুলে ঘর অবধি পৌঁছে দিল। হোটেলটায় এক একটা ঘরের নাম ভারতের এক একটা রাজ্যের নামে। … এইটা আমার ঘরের নাম।



    শারীরিক আর মানসিক ক্লান্তির মধ্যে বসে বিশ্বাস হচ্ছিল না যে আমি আজ সত্যিই জার্নি শেষ করতে পেরেছি, মাথার মধ্যে তখনও খালি ধাক্কা মারছে ঐ মরতে চলা কুকুরের আর্তনাদ, আর উল্টোদিক থেকে আসা চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া গাড়ির হেডলাইট। কাল সকালে আবারও বেরোতে হবে? প্লিজ, না। পারছি না। এতটুকু এনজয় করতে পারছি না।

    রাতের খাবারের অর্ডার দিলাম। ছেলেটি এসে বলল, স্যর, বীয়ার ওয়াইন কিছু লাগলে বলবেন।

    না ভাই, ও সব আমার নন-ডিপ। তুমি শুধু রাতের খাবারটুকুই দাও।

    খেলাম, খেয়ে নিয়ে আবারও একটা পেনকিলার, কোনও লাভ হবে না জেনেও, খেলাম। এবং চমৎকার উচ্চমানের বাথরুমে ঢুকে চান করে, ফ্রেশ হয়ে, ঘুম। এসিটা বাড়িয়ে দিয়ে, চাদর মুড়ি দিয়ে।

    দুটো দিন গেল।
  • hu | 013412.160.452312.4 | ০৮ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:১২381064
  • পড়ছি
  • Tim | 780112.77.347812.2 | ০৮ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৩:১২381065
  • পড়ে ফেললাম।
  • avi | 7845.11.238912.58 | ০৮ ডিসেম্বর ২০১৮ ১১:৪৬381066
  • ওরেবাবা। আমি যখন কল করছিলাম দার্জিলিং থেকে নামার পথে, সিকিবাবু তখন নির্ঘাত লাগেজ বেঁধেই যাচ্ছে, বেঁধেই যাচ্ছে... আর রাস্তাটা নির্ঘাত নেপাল সীমান্তের সমান্তরালে গিয়ে একদম খড়িবাড়ির কাছে বড় রাস্তায় মিশলো। তার পরেই বাগডোগরা। আজ বিকেলেই ওই পথে যাব।
  • শঙ্খ | 5645.112.0178.135 | ০৮ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৪:৩৬381067
  • বেশ! তারপর?
  • সিকি | ০৯ ডিসেম্বর ২০১৮ ২২:০১381068
  • ঘুম হচ্ছে না আজকাল ঠিকঠাক। অ্যালার্ম বাজার আগেই তাই জেগে গেছি। উঠে শরীর নাড়িয়ে দেখলাম, না, ব্যথা একেবারে কমেনি ঠিকই, তবে এই তৃতীয় দিনে ইউজড টু হয়ে গেছি। খুব একটা অসুবিধে আর হচ্ছে না। মন যদিও সঙ্গ দিচ্ছে না এখনও পুরোপুরি, তবুও জোর করে নিজেকে বোঝালাম, গত দুদিন ছিল চূড়ান্ত বোরিং রাস্তা ধরে আসা। উত্তর প্রদেশ, বিহার, মাঝে আবার দেড়শো কিলোমিটার বিচ্ছিরি রাস্তা দিয়ে আসা। আজকের রাস্তা তো অমন নয়। সুন্দর রাস্তা, পাহাড়ের কোল ঘেঁষে, তদুপরি দিনের শেষে আজ আছে দেশি মুরগির ঝোল। এইবারে তো মনটকে একটু চাঙ্গা করো – তুমি অনর্থক দুঃখবিলাসী হয়ে যাচ্ছো, সিকি।

    আজ্ঞে হ্যাঁ, আজকের গন্তব্য গৌহাটি, এবং সেথায় আজ কোনও হোটেলবাস নয়, গুরুচণ্ডা৯-র অন্যতম গুরু b-এর নেমন্তন্নে আজ তাঁর বাড়িতেই ভোজন এবং বিশ্রামের পরিকল্পনা হয়েছে। সেখানে আরও কিছু চণ্ডালের আগমন সংবাদ পেয়েছি। গুলজার হবার একটা তুমুল চান্স আছে, সেটা হয় তো আমার পরের যাত্রার জন্য একটা বুস্ট আপ ডোজের কাজ করতে পারে।

    সাড়ে সাতটা নাগাদ ধীরেসুস্থে তৈরি হলাম। জিনিসপত্র নিচে নামিয়ে মোটরসাইকেলে ভালো করে লোড করা হল। গতকাল একটু বেশি কনফিডেন্সের বশে আমি দুদিকেই একটা করে বানজি কর্ড দিয়ে লাগেজ বেঁধেছিলাম, তার ফলে সন্ধেবেলায় ঐভাবে কর্ড লুজ হয়ে জিনিস উলটে পড়েছিল রাস্তার ওপর। আজ তাই আর কোনও রিস্ক নয় – প্রত্যেক দিকে দুখানা করে লম্বা লম্বা বানজি দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে নিলাম লাগেজ। ভালো করে নাড়িয়ে ঝাঁকিয়ে দেখে নিলাম, না, আজ আর কোনওভাবেই এই ইড়িমিড়িকিড়ি বাঁধন খোলার চান্স নেই।

    খিদে পেয়েছে। কাল রাতের চিকেন সেজওয়ান নুডল কাল রাতেই হজম হয়ে গেছে, পেটে কৃষ্ণগহ্বর তৈরি হয়ে গেছে। এদিকে সামনেই একটা ছোট্ট দোকান, সেখানে দেখতে পাচ্ছি গরম গরম পরোটা ভাজছে। অতএব, লাগেজসমেত মোটরসাইকেল রাস্তার পাশেই দাঁড় করিয়ে রেখে গুটিগুটি ঢুকলাম দোকানে। গোটাচারেক বড় বড় পরোটা নিঃশব্দে শেষ করে যখন জলের গ্লাসের দিকে হাত বাড়ালাম, তখন বাজে প্রায় সওয়া আটটা। চাপের কিছু নেই – আজকের দূরত্ব আরেকটু কম। সাড়ে চারশো কিলোমিটার। এখান থেকে আইআইটি গৌহাটি। রাস্তা যাবে আলিপুর দুয়ারের ওপর দিয়ে, সেইটা আরেকটা উৎসাহের কারণ, আলিপুর দুয়ার আমার জন্মস্থান। তখন আলিপুর দুয়ার ছিল জলপাইগুড়ি জেলার একটা মহকুমা, আজ সে নিজেই একটা জেলা। জন্মের কয়েক মাস পরেই বাবা ওখান থেকে বদলি হয়ে চলে আসে, আটাত্তরের বন্যার মরশুমে, আমার কোনও স্মৃতিই নেই।

    আজকের জার্নি অনেকখানি সুন্দর রাস্তা দিয়ে। প্রথমে সেভক ব্রিজ, সেটা পেরিয়ে চা বাগানের মধ্যে দিয়ে যাওয়া, বাঁ পাশে নীলচে পাহাড়ের শিল্যুয়েট। হিলকার্ট রোড পেরিয়ে শিলিগুড়ি শহরের প্রান্ত থেকে সেভক ব্রিজ পর্যন্ত রাস্তাটাই এত সুন্দর – ফরেস্টের মধ্যে দিয়ে যায়, ঝকঝকে নিটোল রাস্তা।

    সুন্দর রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে খানিকক্ষণের মধ্যে দিয়েই শুরু হল অল্প পাহাড়ী রাস্তা এবং তার পরেই এসে হাজির হল সেভক ব্রিজ। সোজা রাস্তা চলে গেছে গ্যাংটকের দিকে, আর ব্রিজ পেরিয়ে ডানদিকের রাস্তা আমার গন্তব্য। সে রাস্তা দিয়ে আমি গতবছরেই গেছি, কিছুই বদলায় নি। ব্রিজে খানিকক্ষণ দাঁড়ালাম, একটা মোটরসাইকেল গ্রুপ সেখানে দাঁড়িয়ে আছে, বাঙালিই সব, কলকাতা থেকে এসেছে, তেড়ে সেলফি এবং গ্রুপফি তুলছে – আলাপ হল, ও, তুমি একা, কতদিনে এসেছো, কোথায় যাবে, কীভাবে যাবে, ইত্যাদি দিল খুশ করে দেওয়া প্রশ্নের জবাব দেবার শেষে তাঁরা আমার সাথে ছবি তুলতে চাইলেন, অতএব, সেলফি স্টিক নাকের ডগায় ঝুলিয়ে আমাকেও দাঁত বার করতে হল। তারপরে টা টা করে আমি আমার রাস্তা ধরলাম। একে একে পেরিয়ে গেল ওদলাবাড়ি টি এস্টেট, ডামডিম, মালবাজার, চালসা, চাপড়ামারি, নাগরাকাটা – বড় নস্টালজিক অনুভূতি হয় এই রাস্তায় এলে, একসময়ে অনেক ঘুরেছি, তখন রাস্তা এত ভালো ছিল না, ছোট ছোট গঞ্জ সব আজ চমৎকার টাউন হয়ে গেছে। এর পর বানারহাট, বিনাগুড়ি পেরিয়ে বীরপাড়া থেকে শুরু হয়ে গেল আলিপুর দুয়ার জেলা।





    বীরপাড়ার খানিক পরেই পড়ে মাদারিহাট, জলদাপাড়া স্যাংচুয়ারির বাইরে দিয়ে রাস্তা, মাঝে মাঝে স্পীড ব্রেকার দেওয়া, এখান দিয়ে নাকি হাতি চলাচল করে। মাদারিহাটের পরেই হাসিমারা, এইখান থেকে জয়গাঁও ফুন্টশোলিংএর জন্য বাঁদিকে রাস্তা চলে যায়, আমি নিলাম ডানদিকের রাস্তা, যেটা দোমহানি হয়ে চলে যাচ্ছে আলিপুর দুয়ারের দিকে।



    কিন্তু না, আলিপুর দুয়ার শহরের ভেতর ঢোকার উপায় হল না, হাইওয়ে চলে গেছে শহরের বাইরে দিয়ে, তাই একটা তিন মাথা জংশন, যেখানে ডানদিকে তিরচিহ্ন দিয়ে লেখা আছে আলিপুর দুয়ার শহর, সেটাকে পেরিয়ে আমাকে সোজা বেরিয়ে যেতে হল আসাম ছোঁবার জন্য।



    বেলা একটা নাগাদ পশ্চিমবঙ্গ পেরিয়ে আসামে ঢুকলাম। এবং রাস্তার হাল খারাপ হল। এই হাইওয়ে পশ্চিমবঙ্গের স্ট্রেচটুকু চমৎকারভাবে মেনটেনড, কিন্তু আসামে তার বড়ই হতশ্রী দশা। বর্ডার লাগোয়া প্রথম এলাকাটির নাম শ্রীরামপুর। সেখানে একটি নিরিবিলি ধাবা পেয়ে মোটরসাইকেল থামালাম। উপস্থিত লোকজনের কৌতূহলী দৃষ্টি অগ্রাহ্য করেই ঢুকে জিজ্ঞেস করলাম, দুপুরের খাবার কী পাওয়া যাবে। ছেলেটি অনেক কিছুরই নাম বলল, কিন্তু তাতে নন ভেজ কিছু না থাকায় জিজ্ঞেস করলাম, মাছ মাংস কিছু পাওয়া যাবে না? – ছেলেটি ঘাড় নাড়ল, না, এটা ভেজু ধাবা।

    বেরিয়ে আসতে হল। চলতে চলতে লক্ষ্য রাখলাম, আর ধাবা পাওয়া যায় কিনা। ধাবা আছে অজস্র, ইন ফ্যাক্ট, আসামের এই অংশটা যেহেতু বর্ডার এলাকা, অসংখ্য, অসংখ্য ছোট ছোট ফুড জয়েন্ট মূলত উত্তর ভারতীয় রাজ্যগুলোর নামে। হরিয়ানা ধাবা, পঞ্জাব ধাবা, অথেন্টিক রাজস্থানী রসুই, ইউপি ধাবা – সবেতেই খুব যত্ন করে লেখা, শুদ্ধ শাকাহারী।

    ধুত্তেরি। পশ্চিমবঙ্গেই খেয়ে আসা উচিত ছিল। ভাবতে ভাবতেই দেখলাম একটা ধাবা টাইপের জয়েন্ট, সেখানে অহমিয়া ভাষায় লেখা ভেজ ও ননভেজ। মানে এটুকু লেখা অহমিয়া আর বাংলা দুটো ভাষাতেই এক রকমের। অহমিয়া লিপিতে মূল সমস্যা হয় চ, ছ এই দুটো অক্ষর নিয়ে। কখন যে এরা চ, ছ ইউজ করে আর কখন যে স, শ – সে আমার বুঝতে বেশ কষ্ট হয়েছিল, পুরোটা এখনও বুঝি নি। এই ধরুন কসমেটিক্সের দোকানে লেখা আছে কচমেটিক্‌চ, শপ্‌-কে লেখা হচ্ছে চপ, সিমেন্টকে চিমেন্ট, এদিকে দেবশ্রীর নাম অসমীয়াতেও দেবশ্রী। স্পন্দন, অহমিয়াতেও স্পন্দন। অহমিয়া বানানের গল্প পরে হয় তো আরও বলব, আপাতত জানাই, সরু সরু রাস্তাঘাটের শুরুতে ছোট বোর্ডে লেখা আছে প্রধানমন্ত্রী গ্রাম “চড়ক” যোজনা। মানে সড়ক যোজনা।

    তো, সে যাই হোক, ভেজ ও ননভেজ দেখে তো থামলাম। সেখানে সত্যিই মাছমাংস পাওয়া যায়। যদিও রাতে দেশি মুরগি আছে, তাও, চারটে পরোটা অনেকক্ষণ হজম হয়ে গেছে, অনেকটা যেতেও হবে – এইসব ভেবেচিন্তে আবারও চিকেনই অর্ডার করে দিলাম।

    ছেলেটি একটি বিসলেরির বোতল বের করে দিল ফ্রিজ থেকে। আমি, সাধারণত বোতল জল খাই না রাস্তায় বেরিয়ে, যেখানকার যা জল, সেটাই খাই। ছেলেটাকে তাই বললাম, ইয়ে নেহি চাহিয়ে, নর্মাল পানি দে দো।

    ছেলেটি কী বুঝল কে জানে, বোতলটা ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে আরেকটা বিসলেরির বোতল নিয়ে এসে মটাস করে ক্যাপের সীলটা খুলে ফেলল – আমি আবার হাঁ হাঁ করে থামালাম, কী মুশকিল, বললাম না, নেহি চাহিয়ে? আমি কিন্তু এর পয়সা দেবো না। নর্মাল জল দাও, নর্মাল।

    ছেলেটি চুপচাপ সেই বোতল ফিরিয়ে নিয়ে চলে গেল, এবং ফিরে এল আবার একটি নতুন বিসলেরির বোতল নিয়ে, সীলড, বলল, এইটা নর্মাল।

    আমি তখন মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছি – এ কী জনতা রে ভাই! খুব মাথা ঠাণ্ডা করে, আস্তে আস্তে, কেটে কেটে বললাম, বটল পানি নেহি চাহিয়ে – সামনের একটা টেবিলে জলের জাগ রাখা ছিল, সেইটা দেখিয়ে বললাম, ও পানি দে দো, নর্মাল পানি। বটল কা নেহি।

    খুবই চাপ। আমি বাংলায় বললে হয় তো বেটার বুঝত, কিন্তু আসামের এই মুহূর্তে যা হালচাল, বাংলা বলা কতটা সঙ্গত বুঝতে পারছিলাম না, তাই হিন্দিতেই স্টিক করে রইলাম। যাই হোক, চারবারের বার জলের জাগ এল। তার পর এল খাবার। খাবার ঠিকঠাকই ছিল, আলুভাজা, সম্ভবত স্কোয়াশের তরকারি – সেটা টাচ করতে পারলাম না। মাংসের ঝোলটা ঝালঝাল, উমদা একদম, কাঁচা পেঁয়াজ দিয়ে খেতে কী যে ভালো লাগছিল।

    খেয়ে উঠতে উঠতে আড়াইটে বাজল। b-কে এবং বাবাকে ফোন করে আবার মোটরসাইকেলে স্টার্ট দিলাম। এক এক করে বিভিন্ন নাম না জানা জায়গা পেরিয়ে গেল – চেনা জায়গা বলতে দেখতে পাচ্ছি, লেখা আছে বঙ্গাইগাঁও অয়েল রিফাইনারি, যার দূরত্ব ক্রমশ কমে আসছে।

    বঙ্গাইগাঁও এল বিকেল প্রায় চারটে নাগাদ। রাস্তা ভালো খারাপ মিশিয়ে, তার চেয়েও বড় উপদ্রব হল উল্টোদিক থেকে চলে আসা গাড়ি, যে যেমন পারছে চলছে। b-এর সাথে বার দুয়েক কথা হয়ে গেছে এর মধ্যে, জানিয়ে দিয়েছে আইআইটির কাছে কোন মার্কেটে পৌঁছে আমাকে ফোন করতে হবে। জিপিএসের টাইমলাইন অনুযায়ী আমার সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা পৌনে সাতটা নাগাদই পৌঁছে যাবার কথা।

    রঙ্গিয়া পেরোলাম, খানিক বাদে এল b-বর্ণিত একটা জংশন পয়েন্ট বাইহাটা। ততক্ষণে অন্ধকার হয়ে গেছে, ন্যাশনাল হাইওয়ে হওয়া সত্ত্বেও রাস্তাটা একেবারেই ওয়েল মেনটেনড নয়, জায়গায় জায়গায় খানাখন্দ, আর রাস্তায় আলো না থাকায় প্রায়ই সেইসব খন্দে মোটরসাইকেল পড়ে লাফিয়ে উঠছে, আমি ক্রমশ চিন্তা করে যাচ্ছি ক্যারিয়ারের ক্র্যাক না বেড়ে যায়, লাগেজ খুলে পড়বে না, সে আমি বার তিনেক মোটরসাইকেল থামিয়ে চেক করে দেখে নিয়েছি। কিন্তু ক্যারিয়ারের দুদিকেই ক্র্যাক ধরেছে। ডানদিকে তো রড দু টুকরোই হয়ে গেছে। স্ট্রাকচারের জন্য ভেঙে বেরিয়ে যাবার চান্স নেই। কিন্তু, তবুও …

    বাইহাটা চৈরালি (চারমাথার মোড় বোধ হয়) থেকে ডানদিক নিলাম। আইআইটি ক্যাম্পাস এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয়। গৌহাটি শহর ক্রমশ এগিয়ে আসছে, বাড়িঘরের সংখ্যা বাড়তে দেখেই আন্দাজ করছি।

    ফাইনালি, একটা মোড় থেকে আমাকে জিপিএস বলল বাঁদিকে বেঁকতে। বাঁদিকে একটা বাজার বসেছে, কিন্তু প্রচুর চেষ্টা করেও আমি বাজারের নাম কোনও সাইনবোর্ডে দেখতে পেলাম না। এটাই কি b-বর্ণিত সেই মার্কেট? কে জানে! ক্রমশ সেই বাজারও পেরিয়ে এলাম, ডানদিকে টার্ন, তারপর খানিক গিয়ে আবার ডানদিক – একেবারে জনমানবশূন্য। আইআইটি জাতীয় কোনও কিছুরই চিহ্ন নেই আশেপাশে। এদিকে জিপিএস দেখাচ্ছে একশো মিটার দূরেই আইআইটি, সেখানে অ্যাকচুয়েলি, দেখতে পাচ্ছি, জঙ্গল।

    খানিক এগোলাম, সামনে একটা দোকান। হিন্দি বলব, না বাংলা বলব, ঠিক করতে না পেরে শেষমেশ হিন্দিতেই জিজ্ঞেস করলাম, আইআইটিতে ঢোকার রাস্তা কোন দিকে। এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে ছিলেন, তিনিও খুব ভাঙাচোরা হিন্দিতে জানালেন, আইআইটির গেট তো অন্যদিকে, আমি হয় তো পেরিয়ে এসেছি, এটা তো আইআইটির পেছন দিক, আমি যদি পারি তো ও-ই সামনে যে বাঁক আছে, ঐখান দিয়ে যেন আবার ডানদিকে বেঁকে যাই, তা হলেই আইআইটির পেছনের গেট পাব।

    এগোলাম। ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। বাঁকের মুখে একটা আবছা হয়ে আসা সাইনবোর্ডে লেখা আছে ইন্ডিয়ান অয়েল বটলিং প্ল্যান্ট। কোথায় যাচ্ছি কে জানে – খানিক এগোতে দেখলাম একটা পাওয়ার সাবস্টেশন, আইআইটি। যাক, অন্তত আইআইটি চৌহদ্দিতে এসে পড়েছি। গিয়ে জিজ্ঞেস করতে আমাকে একজন চৌকিদার বাঁদিকের আরেকটা গেট দেখিয়ে দিলেন। বাঁদিকে তাকিয়ে দেখলাম, সেদিকে আরো একটা বিশাল গেট, সেখানে সিকিওরিটি বসে আছে।

    সিকিওরিটি তো বিশ্বাসই করতে চায় না যে আমি আইআইটিতে এসেছি, এই গেট দিয়ে কেউ আসে নাকি? ফ্ল্যাট নম্বর বলতেও বোঝে না। খানিক কনভিন্স করাবার চেষ্টা করার ফল হল এই – সে আমাকে আমাজনের ডেলিভারি এজেন্ট ঠাউরাল। আমি নাকি জিনিস ডেলিভারি করতে এসে ভুল গেটে পৌঁছে গেছি। সিকিওরিটির দোষ নেই – শেষে bকে ফোন করতে হল। সে তো ফোন পেয়ে পুরো হতবাক, তুমি ওখানে কী করে পৌঁছলে? ফোনটা সিকিওরিটিকে দাও, আমি কথা বলছি।

    ফোনটা স্পিকারে ছিল, আমি সিকিওরিটিকে ডাকলাম, মুগ্ধ হয়ে শুনলাম b পুরো চোস্ত অহমিয়া ভাষায় ফোনে সিকিওরিটির সাথে কথা বলছে। পুরোটাই বুঝতে পারছিলাম, যদিও এক বেলায় শিখে ওঠা সম্ভব নয় – এটুকু বুঝলাম সিকিওরিটি বলছে আপনি চিন্তা করবেন না স্যার, আমি একে বুঝিয়ে সুঝিয়ে মেন গেটে পাঠিয়ে দিচ্ছি, আপনি ঐখানে রিসিভ করে নেবেন, আর b বলছে, না না, ও অনেকদূর থেকে এসেছে, ওকে আর কোথাও পাঠাবেন না, পাঁচ মিনিট দাঁড়ান, আমি ওদিকে পৌঁছে যাচ্ছি, ওখান থেকেই আমি ওকে রিসিভ করে নিচ্ছি। ময় আসু, ময় আসু – এইরকম কিছু একটা বলল লাস্টে, মনে আছে।

    পাঁচ মিনিটের মধ্যেই প্রায় উড়ে উড়ে চলে এল b, তার পরে গেট খুলিয়ে আমাকে ক্যাম্পাসে ঢোকানো তো কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার। পার্কিংয়ে মোটরসাইকেল লাগিয়ে সেখান থেকে লাগেজ খুলে ওপরের ফ্ল্যাটে পৌঁছতে পৌঁছতেই এসে হাজির হয়ে গেল গেছোদাদা, আর তার খানিক পরেই দেবর্ষি দাস। শ্রীমতি b অনবরত সাপ্লাই দিতে থাকলেন চা, ডিমের চপ ইত্যাদি। মানে এর পরে জীবনের কাছ থেকে আর কীই বা চাইবার থাকতে পারে? অফ অল প্লেসেস, গৌহাটিতে জমে উঠল গুরুভাট। খানিকক্ষণের জন্য ভুলেই গেছিলাম যে রাতে আবার দেশি মুরগীর একটা গল্প ছিল। যতক্ষণে মনে পড়ল, ততক্ষণে বোধ হয় গোটাচারেক ডিমের চপ শেষ করে ফেলেছি।

    আমি আবার বেশি খেতে টেতে পারি না – বয়েস হচ্ছে তো। গেছোদাদাকে যেতে হবে খানিক দূর, তাই সে আগেই বিদায় নিল, দেবর্ষি রয়ে গেলেন, মিতভাষী লোকটির সাথে কথা বলে সুখ আছে। খাবার টেবিলে বসে দেখি দেশী মুরগী তো আছেই, সেটা মাত্র দশ পার্সেন্ট। তার সাথে তরিতরকারি, ভাজাভুজি, মাছ, শেষপাতে আবার চাটনি – একেবারে বিয়েবাড়ির খাবার। খেয়ে নিয়ে দেখি প্রায় ওঠার ক্ষমতা নেই।

    দেবর্ষি বিদায় নিলেন, এবং বাকিদের গুডনাইট করে আমিও অস্ত গেলাম। মন একটু ভালো লাগছে আপাতত। কাল অরুণাচলে ঢুকব। গেছোদাদা রুট সংক্রান্ত কিছু টিপস দিয়েছিল, সেগুলো ম্যাপ ট্যাপ দেখে মোটামুটি মুখস্ত করে নিলাম।

    এক ঘুমে রাত কাবার।
  • dd | 670112.51.7812.86 | ০৯ ডিসেম্বর ২০১৮ ২২:১৯381069
  • খামোখাই অ্যাতো রাস্তাঘাটের ছোবি কিসের জন্য? সে না হয় বই হয়ে বেরোলে তখোন দিও।

    এক্ষণে শ্রী ও শ্রীমতি b , গেছোদাদা, দেবর্ষি বাবু - এঁয়াদের ছবিও দিলেই পারো।

    আরে নানা, আপত্তির আবার কারন কি?
  • pi | 2345.110.564512.48 | ০৯ ডিসেম্বর ২০১৮ ২২:৪৩381070
  • এদের সংগে ভাট মনে পড়ে যাচ্ছিল।

    কিন্তু তুমি তেল চপচপে পরোটা খেয়ে জল খেলে? আর বাইরে সব জায়গায় জল খাও? তোমার তো লোহার পাকস্থলী হে!

    তবে আমার ঐ ত্রিপুরাসুন্দরীর ট্রেনজার্নি মনে পড়ল, সেই তোমার বাড়ির পাশে অনন্তবিহার না কোন স্টেশন থেকে উঠেছিলাম। আমি ট্রেনজার্নি এত ভালবাসি, কিন্তু ইউপি বিহারী স্ট্রেচ সত্যি বোরিং, আর স্টেশনের খাওয়ও খুব বাজে। ঐ উত্তরবঙ্গ থেকে সুন্দর জার্নি শুরু হয়!
  • সিকি | ০৯ ডিসেম্বর ২০১৮ ২৩:০১381072
  • আমি তো এমনিতে জল টল খাই না, খাই শুধু কিছু খাবার স্স্ময়ে, এই ধরো ভাত খেতে বসে দেড় বোতল জল খেয়ে ফেলি। বাকি সব খেয়েই জল খাই - চানাচুর, চপ, কাটলেট, পরোটা, ভাত, দুধ, ফল। আবার খাবার পরে খানিকক্ষণ জল না পেলে তেষ্টাটা গলাতেই মরে যায়, তারপর আবার অনেকক্ষণ জল না পেলেও চলে।

    ডিডিদা, লোকজনের ছপি তোলা হয় নি, সেটা bএর বাড়ি থেকে বেরোবার পরে মনে পড়েছিল :(
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি প্রতিক্রিয়া দিন