দীঘায় ছিলাম একটি হোটেলে। মালিকের নাম শ্রীনাথ জানা। তাঁর তিনটি ঘর। সামনে খাওয়ার ব্যবস্থা। শস্তার হোটেলে। ঘরের মাসিক ভাড়া ৬৫ টাকা। তো সেই হোটেলওয়ালা ছিল গাঁজাখোর। আর তার ছিল একটি টাট্টু ঘোড়া। সেই ঘোড়ার ছিল একটি পালক। তার নাম ভানু। ভানু ছিল সবহারা এক মানুষ। উঞ্ছবৃত্তি করে দিন কাটত তার। আর সেই ঘোড়া সে পালাত মাঝে মাঝে, তাকে তখন খুঁজতে বের হতো সে। আসলে খোঁজার নাম করে ঘোড়ার মালিকের কাছ থেকে টাকা আদায় করাই ছিল যেন কাজ। আমি শীতে যখন যাই, জানালার পাশে সেই শাদা ঘোড়া নিঃঝুম দাঁড়িয়ে থাকত। তারপর একদিন সে উধাও। ... ...
‘মাঠ ভাঙে কালপুরুষ’ ছাপার জন্য আমি ঝাড়গ্রাম কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্ক থেকে ২০০০ টাকা ঋণ নিয়েছিলাম। সেই ঋণ দুবছর কয়েক মাস ধরে সুদসহ শোধ করেছিলাম। তখন মাইনে পেতাম শ’পাঁচেক টাকা। আমি তখন একেবারেই অচেনা এক নবীন লেখক। অমৃত পত্রিকায় লেখার সুযোগ পেয়েছি সদ্য। গল্প যা বেরিয়েছে, লিটল ম্যাগাজিনে। কবিপত্র, অনুক্ত, পরিচয়, সংক্রান্তি---ইত্যাদি পত্রিকায়। লিখে উপার্জন হয়ই না প্রায়। বই ছিল ৭ ফর্মা মানে ১১২ পাতার। অ্যান্টিক নামের একটি মূল্যবান কাগজে লেটার প্রেসে ছেপে বেরিয়েছিল সেই বই। খুব সম্ভবত সুকিয়া স্ট্রিটের হরিপদ পাত্রের ছাপাখানা সত্যনারায়ন প্রেসে কম্পোজ হয়েছিল। আমি এইসব কথা বলছি এই কারণে যে সেই লেটার প্রেস, অ্যান্টিক কাগজ, সীসের অক্ষর, কাঠের গালি এখন হারিয়ে গেছে। এক একটি খোপে এক এক অক্ষর। ই-কার, আ-কার, উ-কার, এ-কার সব আলাদা আলাদা খোপে। কম্পোজিটরের সব মুখস্ত থাকত। কী দ্রুতই না সিসের অক্ষর সাজিয়ে সাজিয়ে গোটা বই নির্মাণ করে ফেলতেন। হ্যাঁ, সেই লেটার প্রেস, সেই ছাপাখানা উঠে গেছে। ... ...
শ্যামলবাবুর সঙ্গে মেশা আমার জীবনের এক মহার্ঘ স্মৃতি। তা ছিল অম্ল এবং মধুরতায় মেশানো। প্রথমে শ্যামলবাবু ধরেই নিয়েছিলেন আমার দ্বারা তেমন লেখা হবে না। বন্ধুরাই বলে। আর শৈবাল বলে। একদিন তো আমাকে বলেই বসলেন, লেখা অভ্যাস করো, প্রতিদিন লেখো, তবে তুমি এদের সঙ্গে মেলামেশার উপযুক্ত হয়ে উঠবে। ভয় করতাম খুব। একদিন তুষার সমীরের সঙ্গে সন্ধ্যায় গিয়েছি শ্যামলদার বাড়ি। ওরাই টেনে নিয়ে গিয়েছিল। পান করা হল। শ্যামলদা আমাকে নিয়ে পড়লেন। আমার কাছে কুলটিকরির খবরাখবর নিলেন। হাটের খবর, চালের দর, সবজির দর ইত্যাদি। সুবর্ণরেখা এবং ডুলং নদীর কথা শুনলেন। তিনি বললেন বিদ্যাধরীর মৃত্যুর কথা। দক্ষিণ ২৪ পরগনায় যা দেখেছিলেন। তাঁর রাখাল কড়াই, চন্দনেশ্বরের মাচানতলায় ইত্যাদি গল্পে আর কুবেরের বিষয়আশয় উপন্যাসে যা আছে। ... ...
তার গ্রাম মৌচুরিয়ার সেই বন্ধুর নাম বুধন টুডু। বুধন নকশাল ছিল। কলকাতার বাবুদের সঙ্গে বেলপাহাড়ির দিকে বিপ্লব করতে গিয়েছিল। বাবুরা কেউ ধরা পড়েছে, কেউ ফিরে গেছে বাড়ি। বুধনকে পুলিস খুঁজছিল অনেকদিন। কিন্তু পাত্তা করতে পারছিল না। সে খুব বুদ্ধিমান। বার বার পুলিশকে ধোঁকা দিয়েছে। ধরতে পারলে জেলে ঢুকিয়ে দেবে। মেরেও ফেলতে পারে। সে কোথায় থাকে, কোথা থেকে গ্রামে ফেরে, তা পুলিশের খোঁচড় বুঝে উঠতেই পারে না। তার দেড় বিঘে জমিন আছে চাষের। সেই জমিই তাকে টেনে এনেছিল গ্রামে। ধান কাটার সময় গত অঘ্রানে এসেছিল। তখন পুলিস টের পায়নি। যখন খবর গিয়েছিল, সে কাজ সেরে পালিয়েছিল। এই বর্ষার দিনে চাষের টানে আবার ফিরে এসেছিল। গ্রামের চাষিবাড়ির ছেলে, প্রায় ভূমিহীন বুধন। জমি পাবে ভাত পাবে, তাই শহরের বাবুবাড়ির ছেলেদের কথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বাড়ি ছেড়েছিল। বিপ্লবের স্বপ্ন ভেঙে গেছে। বাবুবাড়ির ছেলেরা ফিরে গেছে শহরে। ... ...
আমার ক্যাম্প অফিসে। করণ্ডায়। মানুষের মুখের কথা বলি। যে মুখগুলি মনে আছে তার ভিতরে প্রধান মুখটি নিখিল প্রধানের। নিখিলবাবুকে আমি প্রথম যখন দেখি আমি তখন ২৩, তিনি ৫০। তিনি সেটেলমেন্টের ডি-গ্রুপ কর্মচারী। উপরওয়ালা স্যার, বাবুদের কাছে পিয়ন। এখন পিয়ন শব্দটি ধীরে ধীরে অবলুপ্ত হচ্ছে। কর্মচারীদের প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ —চার শ্রেণীতে ভাগ করে সেইভাবেই অভিহিত করা হয়। এর অন্যথা হলে প্রতিবাদ হয়। প্রতিবাদ এবং সংগঠিত থেকে তাঁরা কিছুটা সম্মান আদায় করে নিয়েছেন। তবে এখনো সামান্য হোমগার্ড জেলার এস,পি, র বাড়ির বাজার করেন কি না, জামা কাপড় কাচেন কি না, ফাই ফরমাস খাটেন কি না জানি না। হয়তো বদল হয়েছে, হয়তো বদল হয়নি, এ ঘটনা সামান্য কনস্টবলের মুখে শোনা। ... ...
বাড়ি ফিরেছি একটু রাতে। বেরিয়েছিলাম আবার আড্ডা মারতে। ফিরছি যখন তখন দেখি লকাই( আমার লেখায় আগে এসেছে লকাই) সব ছোট ফ্লাগগুলো এক জায়গায় জড় করছে। ওপর থেকে ছিঁড়ে পড়েছে যেগুলো। বাকীগুলো ছিঁড়ে নামাচ্ছে। কেউ দেখছে না। আলো ঝলমল আমাদের পাড়ায় একটু দুরেই হুল্লোড় করছে কিছু ছেলে। আমি লকাইকে বললুম - কেন জড় করছিস এগুলো? কাল বেচে দিবি বলে? লকাই ফুল লোডেড থাকে সব সময়। কালও ছিল। কেঁদে ফেললো লকাই। বললো - কাকু, কাল এগুলো পা দিয়ে পাড়িয়েই সবাই যাবে। আমার দেশের ফেলাগের একটা দাম নেই। ... ...
আমি গেছি দূর মফঃস্বলে চাকরি করতে। তখন যা দিন, মোবাইল ফোন কেন সেই মফঃস্বলে ইলেকট্রিকের আলো ছিল না, পোস্ট অফিস ছিল না। চিঠি ফেলতে ভিন গাঁয়ে যেতে হত। চিঠি দিলে একমাস আগে কলকাতা পৌঁছত না। বাস থেকে নেমে এক ঘন্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট হাঁটতে হত অফিস মানে হল্কা ক্যাম্পে পৌঁছতে, এমনই সে জায়গা। ছোটনাগপুরের মালভূমির লেজা সেই অঞ্চল। তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্রের একটি কন্যা। বয়স তার আড়াই তিন। সে তার ঠাকমাকে বলল, ছেলেধরা নিয়ে গেছে বাবুজিকাকাকে। হারিয়ে গেছে, আর ফিরবে না। শিশু যা শোনে তাই বলে। তাকে যা বলে ভয় দেখান হয়, সেও তাই বলে ভয় দেখায় ঠাকমাকে। মা তখন পিতামহী। মায়ের ঘুম আসে না। ছুটিতে বাড়ি এলে জিজ্ঞেস করে মা রাধারানি, কী খাই, কেমন জায়গা। ডাল আলু সেদ্ধ আর কুঁদরি পোস্ত ? মাছ হয় না? মাংস ? সকাল বিকেল মুড়ি, কেন পরোটা লুচি করে দিতে পারে না ? জানেই না মা ওসব। আমাদের দেশটা আসলে খুব গরিব। গ্রামটা আরো গরিব। শুনতে শুনতে মা চুপ। বুঝতে চাইছিলেন দেশটাকে আমার চোখ দিয়ে। ধরা গলায় বললেন, তুই বরং চাকরি ছেড়ে দিয়ে আয়, অন্য কিছু দেখ। না, চাকরি আমার কাছে আশীর্বাদ হয়ে এসেছে, দেশটাকে আমি চিনতে পারছি দিনে দিনে। মা চুপ করে থাকলেন, অবশেষে বললেন, দেশ সব জায়গা থেকে চেনা যায়। জমি মাটি মানুষ না চিনলে বড় হওয়া যায় না। মা বলল, বড় হবি তুই ? কী করে, প্রমোশন কবে হবে ? প্রমোশন না মা, লিখতে চাই, গল্প লিখছি, শুনবে? আমি কী বুঝব, কিন্তু তুই যদি নিজে বুঝিস হচ্ছে, তবে ছাড়বিনে, ধরে রাখবি, ছাড়বিনে একদম। মন্ত্র পেয়ে গিয়েছিলাম। ... ...
আমি একটি গল্প লিখে নিয়ে নকুলদাদের কাছে গেলাম। নকুলদার বস্তিবাড়িতে রবিবার সকালে সাহিত্যের আড্ডা হত। সেই আড্ডায় একদিন সুবিমল মিশ্র এলেন। দুটি গল্প শোনালেন। আমি শিহরিত। তখন তাঁর হারাণ মাঝির মড়া… প্রকাশিত হয়েছে একাল প্রকাশনীর বই হিশেবে। একালের আড্ডায় আর আসতেন গল্পকার, ডাক্তারির ছাত্র কৃষ্ণ মণ্ডল, দিলীপ সেনগুপ্ত, অজু মুখোপাধ্যায়, যিশু চৌধুরী, আমার স্কুলের বন্ধু রণজিৎ দত্ত এবং অতি নবীন লেখক তপনজ্যোতি মিত্র। রণজিৎ এবং তপনজ্যোতি যাদবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ত। এই সময়ে আমি একটি গল্প লিখেছিলাম মৃত্যুর প্রতীক্ষায়। কিছুই হয়নি এখন বুঝি। সেই গল্প ছাপাও হয়নি। এরপর ‘একটি আত্মহত্যার বিবরণ’। সেই গল্প অনেকের পছন্দ হয়েছিল। ছাপা হলো একাল পত্রিকায়। ... ...
১৯৭১-এ ভয়ের বাতাবরণ কেটেছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে। বরুণ সেনগুপ্ত লিখলেন সাতক্ষীরে অভিযানের কথা। আমরা সাতক্ষীরের লোক। বাড়ির সকলে হুমড়ি খেয়ে বরুণ সেনগুপ্তর প্রতিবেদন পড়লাম। বাঙালি লড়াই করছে স্বাধীনতার জন্য। ছেড়ে আসা মাটি, দেশ, গ্রাম, ভিটে কেমন ছিল তা আমার অজানা ছিল। ১৯৬৫ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের পর দুই দেশে বৈরিতা আরও বেড়েছিল। পূর্ববঙ্গের খবর আসা ক্রমশ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। খবরের কাগজ এবং রেডিও খবর দিতে লাগল। পাকিস্তান ভেঙে যাচ্ছে। উদ্বাস্তু স্রোত আসছে সীমান্ত পার হয়ে। আমি তখন কী করব কী করব ভেবেই দিন কাটাচ্ছি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শামিল হতে চাই। একটা দেশ স্বাধীন হবে। সেই দেশটি আমার পিতৃকুল, মাতৃকুলের দেশ। ... ...
বিশ্বরূপা থিয়েটারের সেই বাড়ি জুড়ে ছিল শিশিরকুমারের স্মৃতি। আমি দেখেছি কী অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন অভিনেতারা, কলাকুশলীরা শিশিরকুমারকে। শিশিরকুমারের দুই খাস অনুচরকে আমি দেখেছি। একজন তাঁর খাস চাকর রামচরণ। আমরা বলতাম রামচরণদা আর একজন তাঁর খাস ড্রেসার গোবিন্দ অধিকারী। আমাদের গোবিন্দ কাকা। এমনই প্রভাব ছিল শিশিরকুমারের যে বিশ্বরূপার তদানীন্তন মালিকদের দুজন, দক্ষিণেশ্বর সরকার এবং রাসবিহারী সরকারকে সকলে বলতেন মেজবাবু আর ছোটবাবু। বড়বাবু? নৈব নৈব চ। সেটা একমাত্র শিশিরকুমারের প্রাপ্য। প্রত্যেকদিন, কেউ না কেউ একবার শিশিরকুমাররের নাম নিতেনই। একটা শ্রদ্ধার জায়গা, সেই সময়েই আমার মনে ঢুকে গেছিল সে সব শুনে। ... ...
ইন্দ্র বিশ্বাস রোডের বাসাবাড়ি ছিল প্রায় এক মেসবাড়ি, জংশন ষ্টেশন। তখনো পূর্ব বঙ্গের লোকের আসায় বিরাম নেই। এপারে এসে আমাদের ফ্ল্যাটে সাময়িক আশ্রয় নিয়ে বাসা খুঁজে কাজ খুঁজে চলে যেতেন। অত ভীড়ে পড়ব কোথায় ? কে পড়া দেখায়? সকলেই কথা বলছে, হাসছে, গল্প করছে। ক্লাস নাইনে সায়েন্স পেলাম। নাইন থেকে টেনে উঠতে গিয়ে সেকেন্ড কলে পাস করলাম। খুব খারাপ। ভয়ে আমার বউদির ভাই গটুদা, যে দিল্লি থেকে পাস করে কলকাতায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ত আমাদের ফ্ল্যাটে থেকে, এক বুদ্ধি দিল। প্রগ্রেস রিপোর্টের নম্বরের কালি ব্লেড ঘষে তুলে বেশি নম্বর লিখে দেওয়ার কাজ দুজনে মিলে করলাম। এবং ধরা পড়ে গেলাম বাড়িতে। ... ...
পঁচাত্তরে চাকরী পেলাম আমি। বন্ধুদের মধ্যে সবচেয়ে শেষে। উনআশি তে বিয়ে করলাম শম্পাকে। আশীর মাঝামাঝি মনে হয়। তখন আমাদের ফ্লাটেই আড্ডা মারতাম সবাই। এক রবিবার সকালে হঠাৎ ঘনঘন "পেটো"র শব্দ। একেবারে আমাদের ফ্লাটের সামনে। রাস্তার ধারের ঘরে বাবা থাকতেন। স্পিন্টার ঢুকে এল ঘরে। বাইরে থেকে চিৎকার করে কে বললো - জানলা বন্ধ করে দিন। আমাদের ফ্লাটে তখন বন্ধুরা সবাই। বেশ কিছুক্ষন পর অবস্থা শান্ত হলে বেরিয়ে শোনা গেল মিল্কডেয়ারীর ভাঙা বোতল আর স্ক্রাপ কে পাবে তাই নিয়ে দু দল কংগ্রেসী দের মধ্যে ঝামেলা। তখন বোতলে দুধ দেওয়া হত। বড় বড় দুধের গাড়ি বেরতো ভোরের আলো ফোটার আগেই। ... ...
সেই প্রথম চিত্রকরের ঘরে প্রবেশ। রঙের ভিতরে প্রবেশ। তাঁর সেই ঘরখানিতে ছিল যেন রঙিন বাতাস। আমাদের বন্ধুর দাদা শ্যামল বরণ বালক লাল্টু ওই ঝিলের জলে ডুবে গিয়েছিল ক’বছর আগে, তার নামে একটি পাঠগার করব, শুধু ছোটদের বই থাকবে সেখানে, তিনি যদি একটি ছবি এঁকে দেন বা পোস্টার। তিনি তো এঁকে দিলেন, পয়লা বৈশাখের সকালে এসে উদ্বোধন করলেন সেই পাঠাগার। আমাদের সঙ্গে মিশে গেলেন বালকের মতো। সেই আমার প্রথম আড্ডা বড় মানুষের সঙ্গে। ... ...
আমি গেলেই ডাকতেন, ও খোকা, মিত্তিরবাবুর বাড়ির ছেলে না ? হ্যাঁ, বলতে তাঁর একের পর এক প্রশ্ন ধেয়ে আসত আমার দিকে। “ভাত খেয়েচ? কী দিয়ে ভাত খেলে ? মাছ খেইলে ? কী মাছ। মাছের কালিয়ায় কি ফুলকপি ছিল। টমটমের চাটনি ছিল কি ? ক্ষীর খেয়েচ কাঁটাল দিয়ে। মাংস কবে খেয়েচ খোকা…” এখন বুঝতে পারি ক্ষুধার্ত মানুষের জিজ্ঞাসা ওসব। গরিব কাহার পাড়ার মানুষের না ছিল জমি, না ছিল কাজ। অন্ন সংস্থান হবে কী করে ? ভোটো কাহার রিকশা করেছিল, তা তার নিজের না অন্য কারোর টাকায় কেনা তা জানতাম না। গ্রামের বাঁড়ুজ্যে বামুনের সঙ্গে ভোটো কাওরার খুব বিবাদ ছিল। রিকশায় চেপে তিনি এক টাকা ভাড়া হলে আট আনা দিতেন। আট আনা বাকি থাকল। বাকিটা শোধ দিতেন না। বাঁড়ুজ্জ্যে মশায়ের ছেলেদের নাম ছিল, ধরুন, অমলকিশোর, বিমলকিশোর, কমলকিশোর, কুনালকিশোর...। ভোটো কাহার কী করল, তার ছেলেদের নাম সব বদলে অমলকিশোর, বিমলকিশোর...। করে দিল। সেই নামে ডাকা শুরু করল। বাঁড়ুজ্জ্যে মশায় রেগে কাঁই। একদিন বেজায় খাপ্পা হয়ে রাস্তায় ঝগড়া, তাঁর ছেলের নামে নিজের ছেলের নাম রেখেছে কেন ভোটো ? ভোটো উদাসীন হয়ে জবাব দিয়েছিল, নাম কি কারোর নিজের সম্পত্তি। মেয়ের নামও বাঁড়ুজ্জ্যে মশায়ের মেয়ের নামে রেখেছিল, ছায়া, মায়া... ... ...
পক্ষীরাজের বয়েস হচ্ছিল। কলকব্জা গুলো বিগড়োচ্ছিল একে একে। এর মধ্যে অনিমেষ একটা বাস কিনে ফেলেছে৷ ৩বি /৩ডি ৩ডি/১ হয়ে সেই বাস আমাদের পাড়া থেকেই ছাড়ে রোজ৷ পক্ষীরাজ আর চলতে পারলো না ছিয়ানব্বুই এর গোড়া থেকেই৷ স্থায়ী ঠিকানা হল দত্তবাগান মোড় এর পেট্রল পাম্প৷ অনিমেষ ভাবে থাক ওখানেই। বিক্রী করবে না৷ কিন্তু লোক আসতে থাকে ওর কাছে। পক্ষীরাজকে স্ক্রাপ হিসেবে কিনতে চায় তারা। অনিমেষ রাজী হয় না৷ তারপর একদিন আসেন এক কালোয়ার। অনিমেষ তাকেও বলে ও বিক্রী করবে না পক্ষীরাজকে। সেই কালোয়ার ভদ্রলোক তখন এমন একটি কথা বলেন অনিমেষকে যে অনিমেষ তাঁকেই বিক্রী করে দেয় নিজের পক্ষীরাজকে। উনি বলেছিলেন - স্যার, আপনি তো এই গাড়িটাকে নিজের বাড়ির লোকের মত দেখেন। তো আপনার বাড়ির কেউ মারা গেলে কী তাকে বাড়িতেই রেখে দেন? ... ...
আমরা, পাড়ার বন্ধুরা বেনারস গিয়েছিলাম চুয়াত্তর সালে। প্রায় এগারোজন। ফেরার সময় টাকাপয়সা শেষ। মোগলসরাই থেকে হাওড়া - দিল্লি জনতা এক্সপ্রেসের জেনারেল কামরায় ফিরছি। মোগলসরাই পেরিয়েই এক মোষ কাটা পড়লো ট্রেনে। ট্রেন আর চলেই না। জল ফুরিয়ে গেছে। প্রচন্ড গরম। কামরাটা ফুটছে গরমে। গার্ডসাহেব বললেন ঘন্টা দুয়েকের আগে ছাড়বেনা ট্রেন। আমাদের বললেন - মাঠ পেরিয়ে সামনের গ্রামে চলে যান। জল পেয়ে যাবেন। গাড়ি ছাড়বেনা। নিশ্চিন্তে যান।আমরা তো চললামই। আমাদের সংগে আরো জনা পঞ্চাশ লোক। সবার হাতে ওয়াটার বটল। ... ...