পথেঘাটে মেয়ে মোটে নেই। গঙ্গার ঘাটে দেখেছিল হিন্দুঘরের মেয়েরা জলে ডুব দিয়ে নাইতে নেমেছে। এদিকটায় এসে দুই একটা মেয়ে দেখেছে, তাদের চলনবলন একেবারেই আলাদা। কী টকটকে গায়ের রং, তেমনি অদ্ভুত চুলের রং। চুল কার এমন লাল হয়! আমিনা তাজ্জব বনে যাচ্ছিল! এদের সবারই সাজগোজের ভারি বাহার, ছোট ছোট ফ্রক, বুকের আঁচলটুকু অবধি নেই। পায়ে চামড়ার জুতো, তাতেই বা কত কায়দা। আমিনা জুতো পরা কোনো মেয়ে কোনোদিন দেখেনি। এমন দুই-একজনকে কোনো ফিরিঙ্গির হাতে হাত গলিয়ে হিহি হাহা করতে করতে যেতে দেখল আজ। ওরা মেয়ে, কিন্তু যেন মেয়ে নয় – অন্য জগতের। এদেরই কি ওয়াহিদ বেবুশ্যে বলেছিল? তাদের গ্রামেও বদনাম হওয়া মেয়ে থাকে, কিন্তু তাদের সাজ পোশাকে না আছে রং, চলা ফেরায় না এই ঢং। ... ...
দেকো, সিবিল ওয়ার হইচিল এখেনে, তারপর যতেক নিগ্রো ছিল সবাইকে বেবাক আজাদ করে দিল। দিল তো? কিন্তু সাদাদের সেটা কদ্দিন সইবে বল দিকিন? সব তো ফিরিঙ্গিদেরই জাতভাই। যা দেছেল, সব কুটুকুটু করে ফেরত নিতে চায়। সেটা কীরকম? ফের জুতে দেবে ওদের? না, তা নয়, কিন্তু নতুন আইন করেছে সরকার, অনেক নিগ্রোদের ভোট থাকবে নাকো। ভোট? সেইটা কি এস্রাক ভাই? প্রশ্নটা জয়নাল করল, কিন্তু শব্দটা অজানা তাদের সবার। এই দেশের লোক তা আমাদের মতুন নয়কো, এরা নিজেদের পছন্দমত সরকার বানায়, তাকেই বলে ভোট। মাথা চুলকিয়ে এটুকুই বলতে পারে এস্রাক। যা বলেছিল তার বউ-বেরাদর। নিগ্রোদের আর পছন্দ করতে দেবে না, যা করবে সাদারা। ... ...
সুলভের সামনে কেউ নেই তখন। ভেতরে, মেঝে জুড়ে ভাঙা কাচ। দেওয়াল কাঁপছিল, দরজা, স্কাইলাইট – সব; ঘুলঘুলির সামনে পাখির বাসা মাটিতে ঠিকরে পড়তে তিনটে ডিমই ভাঙল। বাথরুমে ঢুকে কল খুলল প্রফুল্ল – লালচে জল চড়বড় করে পড়ছিল বালতির ভিতর। তারপর প্রফুল্লর চোখের সামনে কলের মাথা ফেটে ফিনকি দিয়ে জল বেরল, চিড় ধরল দেওয়ালে। পাশের স্নান করার খোপ থেকে জল বেরিয়ে আসছিল গব গব করে, মাথার ওপরে ছাদের আস্তর খসে পড়ল এইবার; জাহাজ তাহলে গলিতে ঢুকেছে – সাবান-মাখা, আদুল-গা প্রফুল্ল দৌড় মারল মন্দিরের দিকে। ... ...
অফিসের কাছাকাছি একটা ট্রাফিক সিগনালে রোজ দাঁড়াতে হয়। অভ্যাসের বশে দাঁড়িয়ে পড়ল সেখানে, অথচ আজ সিগনালের রঙ সবুজ। একশ’ কিলোমিটার স্পিডের রাস্তায় সবুজ আলোয় দাঁড়িয়ে পড়েই বুঝল – ভুল করেছে, তবু, শোধরানোর চেষ্টা করল না, দাঁড়িয়েই রইল, দাঁড়িয়ে রইল ঠায় – যেন সে চলচ্ছক্তিহীন; চোখ যতদূর যায়, ঢালা পিচরাস্তায় খণ্ড খণ্ড জলতল, বাষ্প উঠছে সেখান থেকে। পঙ্কজ তার ভাগ্যের কাছে নিজের হৃৎপিণ্ড বন্ধক দিয়ে বসে রইল – যা কিছু ঘটে যেতে পারে এই মুহূর্তে – হয়তো একটা কলিশন, হয়তো চুরচুর হয়ে যাবে গাড়ি, তালগোল পাকিয়ে যাবে পঙ্কজ নিজে – শেষ হয়ে যাবে সব। ... ...
নিজেদের জমি, নিজেদের শহর – যেখানে মাথার উপর ছড়ি ঘোরানোর জন্য কোনো সাদা লোক মজুত নেই, আসতে চাও না এমন একটা জায়গায়? যেখানে বাঁচার জন্য সারাক্ষণ বুকে পাথর নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হয় না, সাদা মেয়েদের দিকে চোখ তুলে চাইলে বেঘোরে মারা যাওয়ার কোন ভয় নেই। চাও না এমন একটা পিঠসোজা করা শান্তির জীবন? এভাবেই বলত ইশাইয়া। তার কথায় আগুনের ফুলকি থাকত, মুখে মুখে ছড়িয়ে যেত রঙমশাল। ... ...
শরতের আকাশে যথারীতি হাল্কা নীলের উজ্জ্বলতম শেড সকালের দিকে – ত্যারছা রোদ এসে জবার টবে পড়েছে আপাতত, ঘুরে ঘুরে অন্য গাছের কাছে যাবে বেলা বাড়লে। এই একফালি রোদটুকু যেন মিঠুর ডাস্টার – যেন ক্লাসরুমের ব্ল্যাকবোর্ডে বড় করে লেখা আছে ক্যান্সার, লেখা আছে মৃত্যু, হাড়গোড়, নরকঙ্কাল – এই সব আঁকা রয়েছে যেন – দুষ্টু ছাত্ররা যেমন শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে বোর্ডে অকথা-কুকথা লেখে – কোনো শিক্ষক রিঅ্যাক্ট করেন, কেউ নির্লিপ্ত মুখে মুছে দেন, যেন কিছুই হয়নি – সকালের এই রোদ, এই নীল রঙ হাতে নিয়ে মিঠু সব মুছে দেয়, নতুন কিছু লিখবে বলে চক নেয় হাতে; রোদ চড়া হলে ছাদের দরজা বন্ধ করে নিচে নামে। সিঁড়িতে ওর চটির শব্দ হতেই ছন্দা এসে ল্যান্ডিং-এ দাঁড়ায়, তারপর মিঠু শেষ ধাপে পৌঁছলে, ওর দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকায়। ছন্দার চোখে বিষণ্ণতা আর টেনশন চিরকালই, এখন সে’ চাহনিতে ভয়কে খুঁজে পাওয়া যাবে খুব সহজে। ইদানিং মা’র চোখে চোখ রাখলে প্রবল শোককেও চিনতে পারে মিঠু – সে যে তার মায়ের সামনে জলজ্যান্ত দাঁড়িয়ে, ছন্দা যেন তা বিস্মৃত হয়; ওর মনে হয়, ছন্দা যেন সিঁড়ির ধাপের নিচে দাঁড়িয়ে ঘোলা চোখে মিঠুর শব দেখছে। ... ...
রথে শুধু বাদশা নেই, আছে বেগমও। যদিও সবার মুখে মুখোশ, মেয়ে হলে তাদের আবার বুকের কাপড় আলগা। তোবা! তোবা! বেলুজ্জেরা তার মধ্যেই দু’হাত আসমানে তুলে নাচগান জুড়েছে। মাঝে মাঝে রাস্তার দু’ধারে মুঠো-মুঠো পুঁতি ছুঁড়ে দিচ্ছে। আলেফরা নিচু হয়ে পুঁতি কুড়াবে, না ঘাড় উঁচু করে ফর্সাপানা মেয়েছেলের কেচ্ছাকাণ্ড দেখবে? এত উৎসব, উত্তেজনা আর খাওয়া দাওয়ার ধূম কোনো বাপের জন্মে দেকিনিকো। রাতে বাড়ির পথ ধরে ওদের মুখে শুধু এই বুলি। মারদি গ্রাঁ দিনরাত মানে না, তেমনি চলছে যেন কারো কোনো ক্লান্তি নেই। ... ...
আমরা কোনো প্রশ্ন করি না কেন? কেন সব ঘাড় গুঁজে মেনে নিই? ততদিনে আমরা আর ক্রীতদাস নই, কিন্তু সে কেবল নামেই। মাথা ঝুঁকিয়ে কাজ করে যাওয়ার বাইরে কিছুই শিখিনি। রেভারেন্ড ওয়ালেস তার বক্তিমে থামিয়ে আমার দিকে সোজা চোখে তাকাল। কী বলতে চাইছ হে ছোকরা? আমার হাতে একটা বই ছিল, সেটার দিকে তাকিয়ে বলল, দু’পাতা পড়েই নিজেকে পন্ডিত ভাবছ বুঝি? শুনি তোমার বিদ্যের বহর। কী বলতে চাও? বললাম তো। যা দেখছি চারদিকে সব কিছুকে প্রশ্ন করতে হবে। আমরা এখানে ভগবানের কথা বলছি – জেসাস। সেটা কি মাথায় ঢুকেছে খোকা? তাকেও প্রশ্ন করো। চু-উ-প! ফেটে পড়েছিল রেভারেন্ড ওয়ালেস। আর একটা কথা না। আমার তখন রক্ত নবীন, হেঁকে উঠলাম, কেন চুপ করব? সাদাদের ভগবান নিয়ে আমাদের এত আহ্লাদ কিসের? দু’হাত দু’দিকে ছড়িয়ে জমায়েতের দিকে তাকিয়ে রেভারেন্ড ওয়ালেস বলে উঠল, দ্যাখো, এই জন্যেই কি আমরা নিগ্রো বাচ্চাদের পড়তে-লিখতে শেখাচ্ছি? আমার মাথায় তখন আগুন দপদপ করছে। আমিও সমানে চেঁচিয়ে বললাম, তুমি কিছুই শেখাচ্ছ না, সাদাদের বলে দেওয়া বুলি আওড়াচ্ছ। ... ...
স্মিতা এই অঞ্চলের পথঘাট চেনে না। ধনঞ্জয়কে সঙ্গে নেবে ভেবেছিল একবার; পায়েলও বলছিল – “এই বৃষ্টিতে যেও না দিদি।” শেষ অবধি একলাই বেরোল – একটা ট্যাক্সি নিয়ে সটান সাহেব-গলি। ধনঞ্জয় বলেছিল, “গলির ভেতরে একটা পোস্টাপিস আছে, ভাই বলছিল – ওখানে জিজ্ঞেস করলে কিছু জানা যেতে পারে।” ক্লাস সেভেন-এইট অবধি পঙ্কজরা এ’পাড়ার ভাড়া বাড়িতে, তারপর শহর বদলেছিল – স্মিতা এইটুকুই জানে। আজ এই বৃষ্টিতে অচেনা গলিঘুঁজিতে এলোপাথাড়ি ঘুরে সে পঙ্কজের অতীতকে খুঁজে পাবে না – নিজেও বোঝে। তবু সে সাহেব-গলিতে আসার ডিসিশন নেয় গতরাতে। ... ...
পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ ভারি হয়ে নেমে আসছিল বয়েজ হাইস্কুলের ওপরে। দু ঘন্টা ধরে সাহেবগলি বয়েজ হাইস্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে সাহিল - উঁচু পাঁচিল ঘেরা কম্পাউন্ড, জং ধরা সবুজ গেট বন্ধ রয়েছে। পেল্লায় গেট চোখে পড়তেই সাহিলের মনে হয়েছিল, একজন বুড়ো মানুষকে টুলে বসে থাকতে দেখবে।অথচ ধারে কাছে একজনও নেই। বস্তুত বিকেল চারটেয় একটা স্কুলের সামনে যা যা চোখে পড়ার- সে সব কিছুই দেখতে পাচ্ছে না সাহিল। উপরন্তু ঘন কালো মেঘ নেমে আসছিল মাথার ওপর- মনে হচ্ছিল, সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে । সাহিল ফটক ঝাঁকাল, জোরে জোরে ধাক্কা দিল ,তারপর সবুজ দরজার খুব কাছে গিয়ে কান পাতল- সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ ওদিকটা। বড় ফটকের একপাশে আয়তাকার ছোটো দরজা- ঠেলাঠেলি করেও খুলতে পারল না সাহিল। ... ...
রুথ উডবার্নকে মোকাবিলা করার জন্য তৈরি ছিল। তাই বলে গিরগিটিটা যে তার সাজঘরে অপেক্ষায় বসে আছে সেটা ভাবতে পারেনি। নাচ শেষ করে পোশাক ঝলমলিয়ে নিজের ঘরে ঢুকেই পেলো উডবার্নকে। তাকে দেখেই উডবার্ন নড়েচড়ে বসল, লাল বের করা জিভ বেরিয়ে এল এক হাত। আহা, এমন একটা নধর প্রজাপতি জিভের নাগালে আজ, সড়াত করে গিলে নেওয়াই শুধু বাকি। কথাতে কোনো রাখঢাক রাখেনি উডবার্ন। টাকা তো অনেক আছে, না চাইতেও পকেটে এসে জড়ো হচ্ছে। রুথের টাকায় কোনো লোভ নেই, চাই না মোটে। তাদের ক্ষতি করার কোনো ইচ্ছাই নেই। তার শুধু চাই রুথকে। ওই শরীরটি একবারটি না চাখলে তার অঙ্গ জুড়াবে না। ... ...
বারলেস্ক থিয়েটার উত্তেজনায় ফেটে পড়ছিল, থরথর করে কাঁপছিল প্রেক্ষাগৃহ, ছাদের থেকে ঝাড়লন্ঠন এই খুলে পড়ে বুঝি। বাতাসে উড়ছিল মাথার থেকে ছেড়ে দেওয়া টুপি, কারুর গুলি পাকিয়ে ছুঁড়ে দেওয়া ডলারের নোট, সমুদ্রের ঢেউয়ের মত আছড়ে পড়া উল্লাস। আক্রাম রুথকে হাওয়ায় ছুঁড়ে দিতেই, সে ডান পায়ের তর্জনীতে ভর করে মঞ্চে অবতরণ করে, তার প্রথাগত ভঙ্গিতে মঞ্চের সামনের ভাগে এসে পা তুলে দিল আকাশপানে, আর একই ঘূর্ণিটানে সবার চোখের দৃষ্টি টেনে নিয়ে ভেসে গেল মঞ্চের পিছনে। নাচের এই শেষ অংশে এসে দর্শককে সেই দুই মুশকো পাহারাদার আর আটকে রাখতে পারে না মোটে। ... ...
লরেল মুখ খুলল প্রথমে – “লুক, উই অল নো হাউ গ্যাব্রিয়েলা ট্রিটেড সীতা। আমরা এইচআর-কে ডিসক্রিমিনেশনের কেস হিসেবে ব্যাপারটা জানাতে চাই। আর স্টিভ বলছিল, গ্যাব্রিয়েলা সীতাকে কিছু স্যাম্পল হ্যান্ডল করতে দিয়েছিল, যেগুলো হ্যাজার্ডাস। স্টিভের কাছে লিস্ট আছে। আমরা জানি না কীভাবে অ্যাপরোচ করা উচিত। উই নিড ইয়োর হেল্প হিয়ার লিপি। প্লিজ একটা ড্রাফট করে দাও। লিপি এক সেকেন্ডও সময় নিল না, সঙ্গে সঙ্গে মাথা নাড়ল। “বোসো। লিখে দিচ্ছি। লিস্টটা আছে, স্টিভ?” “কাজকর্ম ফেলে কী হচ্ছে এখানে?” দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকেছিল গ্যাব্রিয়েলা – লরেল, স্টিভ, মেরির সুপারভাইজর। লিপির দিকে আঙুল তুলে বলেছিল – “ব্লাডি ইন্ডিয়ান, লোক খ্যাপাচ্ছ?” ... ...
শনিবার বাড়ি থেকে সরাসরি ডাক্তারের কাছে গিয়েছে মিঠু। বিপ্লব আর ছন্দা ওর সঙ্গে আজ; ফেরার পথে কেনাকাটা র প্ল্যান রয়েছে- পুজোর বাজার এখনই শুরু না করলে পরে বড় ভীড় হয়। আল্ট্রাসাউন্ড, এন্ডোস্কোপি হয়ে গিয়েছিল; টিস্যু স্যাম্পল কালেকশন হয়েছে । সমস্ত রিপোর্ট এখন গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্টের কাছে। আজও সেই কনকনে ঠান্ডা চেম্বার, অপেক্ষারত জনা পনের মানুষ, চশমা চোখে ছেলেটি আর তার কমপিউটার-ঘড়ির কাঁটা টিকটিক ঘুরছিল। -সেদিনও এতক্ষণ তোকে বসতে হয়েছিল? -হ্যাঁ "একা একা বসে ছিলি-ইশ, বড্ড স্লো না এই ডাক্তার" ছন্দা বিজবিজ করল। -স্লো কেন? যত্ন করে পেশেন্ট দেখেন- সময় লাগে। -বেশি দেরি হলে, আজ আর কেনাকাটা হবে না, সব বন্ধ হয়ে যাবে। শনিবার না? পাঁচ নম্বরে ডাক পড়ল মিঠুর। ডাক্তার আজ গম্ভীর। মাথা নামিয়ে মিঠুর রিপোর্ট দেখছিলেন। "সব রিপোর্ট এসে গেছে" এই বলে সামান্য থামলেন ডাক্তার "ভালো তো সব?" ছন্দা আগ বাড়িয়ে বলল। মুখ তুলে তাকিয়ে চশমা ঠিক করলেন ডাক্তার। ... ...
আপুনি তো সবই পেত্যক্ষ করেন মহারাজ। এবারটা আমাদের ক্ষেতির সন। এবার চুরি হল, তুফানে কত পসরা যে ভেইসে গেল – বলতে বলতে ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলল আবার পাঁচকড়ি। আমাদের একজনা ওই তুফানে কোতায় যে গেল – এই অবধি বলে পাঁচকড়ি গলা তুলে – ওরে ফয়জল রে! বলে কান্না শুরু করল। ফয়জল? কি হয়েছে ফয়জলের? সদ্য এসেচিল গো, সে জোয়ান মদ্দ এক ব্যাটাছেলে। ফয়জল আলি নাম। যে দিনকা এল, ব্যস ফিরে দিন এইয়া তুফান। আমরা সবাই বোর্ডওয়াকে দ্রব্য ফিরি করচি। ফয়জল আর ফেরল নাকো। ... ...
বিক্রম চাঁদে পৌঁছে গেলে, মিঠু ফিরে আসবে - এ ধারণা সনতের মনে বদ্ধমূল হচ্ছিল দিন দিন। ধারণার গোড়ায় কোনো শিকড়বাকড় নেই- সনৎ সেদিকে চোখ ঠেরেছিল বরং আগায় ঝুলে থাকা ফুল ফলের সম্ভাবনাকে আঁকড়ে ধরছিল- যতই সে' সম্ভার তার দিকে নুয়ে আসছিল; তাদের স্বাদে গন্ধে ক্রমশ সে গোড়ার কথা বিস্মৃত হচ্ছিল, চন্দ্রযানের লঞ্চিংএর জন্য নিজেও প্রস্তুত হচ্ছিল - একটা বড় উৎসবের আগে যা করে মানুষ। লঞ্চিংএর ডেট জুলাই মাসের চোদ্দোই । সনৎ ঐ সময় দুদিন ছুটি নিয়ে নিল। নিজের বিয়ের কথা মনে হচ্ছিল সনতের। যেন বিয়ের দিন ঠিক হয়েছে, কার্ড ছাপা হচ্ছে, সনৎ লজ্জা লজ্জা মুখে অফিসে ছুটির অ্যাপ্লিকেশন দিচ্ছে। সে ইদানিং সর্বত্র এই উৎসবের প্রস্তুতি দেখতে পাচ্ছিল যেন। ... ...
স্টিলের কালো তোরঙ্গ একটা। এমন নয়, যে তাঁর খোয়া যাওয়া বাক্সের সঙ্গে একেবারেই একরকম দেখতে। আসলে এতদিন জাহাজে যাত্রা করে তিনি এত ক্লান্ত ছিলেন আর এঁরা সকলে উপস্থিত হয়ে তার জিনিসপত্রের জিম্মা নিয়ে নিয়েছিলেন, তাই কালীপ্রসাদ অত খেয়াল করে দেখেননি। নাহলে চেহারায় অনেক অমিল আছে। এটি যেন কতকাল আগের তৈরি, এর শরীরে অনেক আঘাতের চিহ্ন আছে। কালীপ্রসাদের বাক্সটি ছিল নতুন। যখনই বাড়ি থেকে বাইরে পা দিয়েছেন, একটি বস্ত্র সম্বল করে, পদব্রজে ঘুরে বেড়ানো সন্ন্যাসীর আর কি লাগে? এইবার নেহাত এতদূরে যাত্রা, আবার কবে ফিরবেন ঠিক নেই। তাই নিজের সমস্ত অমূল্য গ্রন্থ সঙ্গে নিয়ে আসবার জন্যে তোরঙ্গ কেনা হয়েছিল। ... ...
সদর দরজা দিয়ে ঢুকে উঠোন, বড় চৌবাচ্চায় টাইম কলের জল আসছে- উঠোন থেকে দু ধাপ সিঁড়ি, তারপর দোতলার মতই টানা বারান্দা, পর পর ঘর- কোনো ঘরের দরজা খোলা- ফ্যানের হাওয়ায় পর্দা উড়ে আসছিল বারান্দার দিকে। পাশাপাশি দুটো বন্ধ দরজা একতলায়, বারান্দার দিকের জানলার পাটও ভেজানো। প্রফুল্ল তাকিয়ে আছে- কপাল বেয়ে ঘাম নামছে, মাথা চুলকোচ্ছে আর চোখ পিট পিট করছে; একটা দরজা খুলে গেল আচমকা - ফ্যানের হাওয়ায় পর্দা উড়ে গেল অনেকখানি- প্রফুল্ল তখন একটা মেয়েমানুষ দেখ্ল সেই ঘরে- স্রেফ শায়া পরা মেয়েমানুষ- ঘরের ভেতর থেকে বারান্দার দিকে আসছিল যেন। এক ঝলক দেখতে পেয়েছিল- প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বন্ধ হয়ে গেল কপাট । ... ...
ঘটনার এমন উল্টো টানে আব্দুল আর দামোদর সমান হতবাক। আব্দুলের জন্য ব্যাপারটা আরও মর্মান্তিক। পুলিশে ধরে নিয়ে যাচ্ছে শুনে এলা ছুটতে ছুটতে হাজির। বাড়ি ভাড়া মার যাওয়ার ভয়ে নয়, আব্দুলের এই বিপদ যে তারও। ক’দিনেই এমন জমে গেছিল দু’জনের। এমন তুখোড় মেয়েটা এই ঘটনায় একদম বোবা হয়ে গেছে, চোখ ছলছল করে দাঁড়িয়ে আছে। জালে ঘেরা গাড়ির বাইরে দাঁড়ানো এলাকে আবদুল সান্ত্বনা দিতে ছাড়েনি, কিন্তু তাতে কি হয়? একবার যদি আব্দুলকে আবার ব্রিটিশ শিপে চড়িয়ে দেয়, এই দেশের কোনো বন্দরে এসে লাগতে লাগতে বছর ঘুরে যাবে। অন্য কোনো দেশেও তো পাঠাতে পারে। সেটা এলাও বোঝে, আব্দুলও জানে। জানলেও মন কি মানে? সেই থেকে এক কথা আব্দুলের মুখে, গোবিন্দদা একটা পথ তো বাতলাও। আমাকে যে বেথেলহেমে ফিরতেই হবে। ... ...
গ্রীষ্মের রাতে নদীর দিক থেকে হাওয়া বাতাস খেলে যায় শহরের বুকে। মল থেকে বেরিয়ে তিনবারের চেষ্টায় সিগারেট ধরালো পঙ্কজ। পার্কিংএর দিকে হাঁটল। গাড়ির দরজা খুলতে যাবে, যেন হাওয়া ফুঁড়ে বেরিয়ে এল এক মূর্তি- ফাটা জুতো, মলিন জামা প্যান্ট, গোঁফ দাড়ি, লম্বা চুল- মুখ থেকে ভকভক করে দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে, একহাত পঙ্কজের দিকে এগিয়ে দিয়েছে, অন্যহাত পিছনে। পঙ্কজের হৃদয়ের বরফ আতঙ্কের উত্তাপে গলতে শুরু করেই আবার জমাট বেঁধে গেল। পার্কিং লটের আলোয় লোকটার চোখের দিকে তাকিয়ে তার মনে হল, যে নিরানন্দ জগত থেকে আগত একমাত্র মানুষ মনে হচ্ছিল নিজেকে , এ লোক সেই জগতেরই কেউ। এই আলোয়, এই নিয়ন সাইনের নিচে যাকে মানায় না। পঙ্কজের সামনে দাঁড়িয়ে হাত পাতল সেই লোক। ... ...