রাঢ়ের এই অঞ্চলের অতীতের ইতিহাস আমরা মঙ্গলকাব্যগুলোতে পাই। ... তারা কি দুর্যোধনের মত মারাত্মক? ব্যাপক সামাজিক ধ্বংস, হত্যালীলার নায়ক? মাহুদ্যা আর ভাঁড়ুদত্তের মধ্যে প্রথম জন কেমন যেন মাথা গরমের, আর দ্বিতীয় জন লোভী, কুচুটে। যারা ঝিল বোজাতে চায়, তারা ব্যাপকভাবে অন্ধকারের মানুষ এমনটা নয় কিন্তু! চরম ধ্বংসাত্মক মনোভাব এখানকার মানুষের তেমন নেই। উচ্চকিত মন্দ নেই, গড়পরতা ভাল, গড়পরতা মন্দ।” বলতে বলতে আচমকা হেসে ফেললেন তিনি। বললেন, “তোমরা যদি কখনও উপন্যাস লেখ, এই এলাকার পটভূমিতে মহৎ উপন্যাসের সাদা মানুষ কালো মানুষ নিয়ে মুশকিলে পড়বে। আপাদমস্তক “কালো” মানুষ বোধহয় আঁকতে পারবে না, যদি বাস্তব থেকে চরিত্র খোঁজো। আবার সব ভাল মানুষের পো যদি সেই লেখার চরিত্র হয়, তবে পাঠকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হবে না নিশ্চিত। কৃত্রিমতার অভিযোগ উঠতে পারে কিন্তু! ... ...
সৌম্য বলল, “এটাকে আসলে বলে ইন্টার্নালাইজড হোমোফোবিয়া। অনেক হোমোফোবিক মানুষ আসলে নিজেরাই গে বা লেসবিয়ান। নিজেদের ওরিয়েন্টেশনকে ঢাকতে এরা ওভার কম্পেনসেশন করে আরো বেশি বেশি হোমোফোবিক হয়ে যায়। এরা সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকে, যে যদি এরা কুইয়ার মানুষজনকে সাপোর্ট করে, তবে লোকে এদের কুইয়ার ভাববে। তুষারবাবুও তাদের মধ্যে একজন। তার সাথেই ছিল কনজারভেটিভ ভোটব্যাংক হারানোর ভয়। সব মিলিয়ে উনি ওই রকম হোমোফোবিক হয়ে উঠেছিলেন। তবে শুধু তুষারবাবু নন, মনে রাখিস আমাদের পলিটিশিয়ানদের অনেকেই এর শিকার। আমি ধরে ধরে এরকম বেশ কয়েকজন পলিটিশিয়ানের নাম বলে দিতে পারি। বিশেষত দিল্লি আর ব্যাঙ্গালোরের। আর আনন্দের মত এরকম অল্পবয়সী, আকর্ষক ছেলেরা এইসব হাই এন্ড ক্লায়েন্টদের গোপনে সার্ভিস দেয়, ফর সাম ক্যুইক ক্যাশ। অল গোজ ওয়েল যতক্ষণ না কোনও গোপন ক্যামেরায় কিছু রেকর্ড হয়ে যায়।” ... ...
সবার মুখের ওপর চোখ বুলিয়ে রজত বলতে থাকল, “পৃথাদেবীর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে ধারণা পেতে আমি ওঁর সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইলগুলো খুঁটিয়ে দেখা শুরু করলাম। সেটা করতে গিয়েই ইনস্টাগ্রামে দেখতে পেলাম তুহিন আর পৃথার মানালি বেড়াতে যাওয়ার ছবি। খুব আনন্দে ভরা ছবি সব। আর সেই সব ছবির মধ্যেই আমার চোখে পড়ল আরেকটা জিনিস। চৌঠা নভেম্বরের ছবিতে পৃথার হাতে ছিল ওদের বিয়ের আংটি, যে আংটির ছবি এই ঘরে টাঙানো ছবিতে রয়েছে। পাঁচই নভেম্বর আঙুল খালি। ছয় নভেম্বর ওই আঙুলে আবার আংটি ফেরত এল। কিন্তু এবার অন্য আংটি। তবে দেখতে অনেকটা আগেরটার মতনই। ফলে খুঁটিয়ে না দেখলে সবার চোখে চট করে ধরা পড়বে না। কী মহেশবাবু, ওই দিনই তো আপনাদের ইনফর্ম্যাল এনগেজমেন্ট ছিল, তাই না?” ... ...
অনেক দিন পর কবিতা বেরোল হাত থেকে। বেশ কয়েকবার কবিতাটা পড়ে কাজি নিজে। বেশ হয়েছে, ভালই হয়েছে!– নিজের মনেই বলে কাজি, তারপর ব্যাগ থেকে বের করে একটা লুঙ্গি। মাথা দিয়ে গলিয়ে দেয় লুঙ্গিটা, এবার জামাকাপড় বদলিয়ে পুকুরে নামবে সে। এমন সময় দ্রুতপদে দেখা যায় দুলিকে, সে আসছে পুকুরের দিকেই, নিশ্চয়ই তাকেই ডাকতে আসছে। একটু অপেক্ষা করে কাজি, দুলি এসে পৌঁছোয়, তাড়াতাড়ি আসায় একটু জোরে জোরে শ্বাস টানছে সে। কাজি বলে, আমি একটা ডুব দিয়ে আসি, তু্মি ততক্ষণ পড় এই কবিতাটা, খাতাটা দেয় দুলির হাতে। ... ...
দু’দিকে দুটো লোক – সামনে আর পিছনে দুটো হ্যাজাক ধরে আছে। মালকোঁচা মেরে পরা ধুতি বা গামছা, প্রায় আধ-ন্যাংটা কালোকোলো সন্ন্যাসীরা পরস্পরের এক হাত আর তাদের হাতের দণ্ড ধরে অর্ধ গোলাকৃতি একটা বেড় তৈরি করেছে। নাচছে ভূতের মত। মাঝে মাঝে – বল গঙ্গাধরের চরণের সেবা লাগি, বল তারকনাথের চরণের সেবা লাগি মহাদেব – ইত্যাদি শিবের নানান নাম করে টেনে টেনে বলে চলেছে। যেটা সবচে’ আশ্চর্য লাগে, তা সন্ন্যাসীদের অমন গলা ছেড়ে মহাদেব – ডাকও নয়, ছায়া-ছায়া ভূতুড়ে নাচও নয়। আশ্চর্য হল – সেই বেড়ের মাঝখানে আমাদের ক্ষুদিরাম মাস্টারমশাই যে! এবং তিনি নাচছেন! এগিয়ে – পিছিয়ে। তিনি তাড়াতাড়ি সামনে এগিয়ে পথ শেষ করতে চাইছেন, কিন্তু সেই উপবাসী, আধন্যাংটা সন্ন্যাসীরা – কোথা থেকে এত জোস পেল কে জানে, তারা কিছুতেই এগোতে দিতে চায় না। সামান্য পথ আসতেও তাই দীর্ঘ সময় লাগে। রাগী, ছাত্র-পেটানো অথচ ছাত্র-দরদী, স্নেহ বৎসল মাস্টারমশাই-এর সব গাম্ভীর্য ওই গাজনের সন্ন্যাসীরা ঘুচিয়ে দিয়েছে। ধুলো হয়ে উড়ছে হ্যাজাকের আলোয় – তাঁরই অটল গম্ভীর মুখোশখানা। ... ...
সৌম্য বলল, “ওয়েট ওয়েট। একটু ধৈর্য ধরুন। বলছি। তবে তার আগে বলি, আমন মানে হল শান্তি। তুহিন ওর ধাঁধায় আমাদের বলেছে যে যদি কখনো তদন্তের প্রয়োজন পড়ে তাহলে আমরা যেন আমনকে খুঁজি। খুঁজব কোথায়? সেটারও ক্লু ও দিয়ে রেখেছিল। বলেছিল জীবনে শান্তি খুঁজতে। আনন্দ শর্মা ওরফে আমন উঠেছিল জীবন লজেই। তুহিনের কোনও কারণে মনে হয়েছিল যে আমাদের হয়তো যখন তদন্তের প্রয়োজন হবে তখন আমাদের ক্লু দিতে ও আর এই পৃথিবীতে থাকবে না। কিন্তু ও সেই ব্যাপারে সিওর ছিল না। তাই পৃথাকে সব কিছু খুলে বলে নি ওকে মিছিমিছি চিন্তায় ফেলবে না বলে। কিন্তু ও যদি নিজের বিপদ বুঝেই ছিল তাহলে জীবন লজে গেল কেন?” ... ...
রজত যখন তুহিনদের বাড়ি গিয়ে পৌঁছল, তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামছে। তুহিনদের বাড়িতে এখনো একটা চাপা শোকের ছায়া। রজত চারিদিকে তাকিয়ে দেখল। ঘরটা প্রথম দিনের মতই আছে। শুধু দেওয়ালে ঝুলছে তুহিনের একটা হাসিমুখের বড় ছবি। গলায় রজনীগন্ধার মালা। রজত বসার খানিক পরে ঘরে ঢুকল পৃথা। আজকে পরনে একটা হাল্কা সবুজ রঙের চুড়িদার, সাদা ওড়না। চেহারায় শোকের ছায়া অনেকটা কম। সম্ভবত খানিক আগেই স্নান করে বেরিয়েছে। রজত লক্ষ্য করে দেখল, চুল থেকে এখনও অল্প অল্প জল ঝরছে। ... ...
একদিন ক্ষুদিরাম মাস্টারমশাইএর পাঠশালায় পড়তে গেলাম। তিনি গাঁয়ের ভেতর শিব মন্দিরের গায়ে একটা চাতালে পড়ান। আমাদের বাড়ির কাছাকাছি সেটা। তার আগে হাতেখড়ি হল ক্ষুদুবাবুর কাছে। পিসি আর কাকু আমায় নিয়ে গিয়েছিল ওঁর বাড়ি। নিশ্চয়ই সেটা সরস্বতী পুজোর দিন। আমার ঠিক মনে নেই। ঠাকুমা পিসির হাতে সিধে পাঠাল। একটা পাথরের থালায় আতপ চাল, আনাজ আর ষোলো আনা পয়সা। কাকুর হাত ধরে গেছি। আমার বগলে শ্লেট, হাতে পেনসিল। এরপর ওঁর কাছে একদিন আসন বগলে পড়তে গেলাম গ্রামের ভেতরের শিবতলায়। মাস্টারমশাই যেন স্বয়ং যমদূত! সেই যমদূত যদি ভিক্টিমের জাগ্রত অবস্থায় হাতে ডাঙশের বদলে মার্বেল গুলি আর মণ্ডা-মিঠাই নিয়ে যমপুরীতে নিয়ে যাবার জন্য আসে, তাহলেও ছেলের দল নির্ঘাৎ মাটিতে পায়ের আঙুল পুঁতে দিয়ে শরীরটা শক্ত করে পিছন দিকে ঠেলুনি দিয়ে পরিত্রাহি চিৎকার ছাড়ত “আমি যাব না গো–ওওওও” বলে! ছেলেদের গাধা থেকে ঘোড়া বানাবার জন্য আর শাসনে রাখার জন্য অভিভাবকেরা সেই যমদূতসম “মাস্টামশায়”-এর কাছেই পাঠাতেন। ... ...
জীবন লজের বাইরে দাঁড়িয়ে, দিব্যেন্দুকাকুর সাথে ফোনে কথা বলা শেষ করে, সিগারেট ধরিয়েছিল সৌম্য। ফাঁকা রাস্তা দেখে এক হাতে রজতের ঘাড়ে আঁকিবুঁকি কাটছিল। হঠাৎ একটা গাড়ি প্রচণ্ড জোরে কোথা থেকে এসে হুশ করে বেরিয়ে গেল। শেষ মুহূর্তে রজত সৌম্যকে ধরে এক ঝটকায় সরে না গেলে একটা বড়সড় অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে যেত। রজতের মুখ আতঙ্কে সাদা হয়ে গিয়েছিল। একটু সামলে নিয়ে বলল, “আমাদের কেউ খুনের চেষ্টা করছে।” সৌম্য মৃদু হেসে বলল, “এগুলো রাতের শহরে বড়লোকের বখাটে ছোঁড়াদের কাজ। রাত বাড়লে সবাই সলমন খান হয়ে যায়।” রজতকে এই বলে প্রবোধ দিলেও সাদা ইনোভার পাশের আঁচড়ের দাগটা সৌম্যর চোখ এড়ায়নি। অর্থাৎ কেউ এখন আর শুধু ওদের ওপর নজর রেখে ক্ষান্ত দিচ্ছে না, সরাসরি খুন বা আহত করার চেষ্টা করছে। ... ...
আম গাছটা খুঁজে পেতে যে অনেকটা সময় গেল এমন নয়। নজরুল অবাক হয়ে দেখে, এই যে ছ-সাত বছর বাদে সে ফিরে এসেছে দরিরামপুরে, কিছুই যেন বদলায়নি। এই আমগাছটা, এর সামনের পুকুরটাও তো ঠিক আগের মতোই আছে। এখানে বসে বসেই দূরে বিচুতিয়া বেপারীর বাড়িটা দেখা যায়, বাড়ির সামনের কাঁঠাল গাছটা একই রকম ভাবে দাঁড়িয়ে আছে, কোথায় গেল মাঝখানের এতগুলো বছর! নজরুলের মনে হয়, সে যেন স্কুলের পর ওই বাড়িটাতেই কোনরকমে বইখাতাগুলো রেখে দৌড়ে এখানে এসে বসলো এইমাত্র। সূর্য অস্ত যাবার আর বেশি দেরি নেই, লালচে আকাশের রং পুকুরের জলে পড়ে নিস্তরঙ্গ জলটারও রংও বদলিয়ে দিল। এরই মাঝে এক দঙ্গল কিশোরীর কলধ্বনিতে মুখর হয়ে ওঠে পুকুর-পার। ওরই মধ্যে শ্যামলা একটি মেয়ে, বন্ধুদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে বোধ হয় নজরুলের দিকে তাকিয়ে নিল একটা মুহূর্তের জন্যে। তার শিথিল বেণী থেকে কি খসে পড়ল একটা ছোট্ট মাথার কাঁটা? কবে যেন সেই ছোট্ট কাঁটাটাকে বুক-পকেটে ভরে নিয়ে যত্ন করে রেখে দিয়েছিল নজরুল তার ছোট টিনের বাক্সটায়। তারপর চুরুলিয়া-আসানসোল-শিয়ারশোল-কলকাতা-নৌশহরা-করাচি হয়ে আবার কলকাতায় যখন ফেরে নজরুল বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির বত্রিশ নম্বর কলেজ স্ট্রীটের ঠিকানায়, তখন ওর জিনিসপত্রের মধ্যে মুজফ্ফর আহ্মদের চোখে পড়ে যায় এতদিন-ধরে-যত্ন-করে-রেখে-দেওয়া ওই মাথার কাঁটা! ... ...
নিজের প্লেট থেকে চামচে করে চাউমিন তুলে সৌম্যর প্লেটে দিল রজত। খাবারের প্রথম গ্রাসটা একে অন্যকে বেড়ে দেয় ওরা। বহুদিনের অভ্যেস। আগে বেশ একটা প্রেম-প্রেম ব্যাপার ছিল। এখন সেটা এতটাই অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে, যে খাওয়ার শুরুতে এই কাজটা আপনাআপনিই হয়ে যায়। রজত চাওমিন মুখে পুরে বলল, “তোর অনুমানটাই ঠিক। তুহিন সেদিন পুরো সন্ধ্যেটা ঋকের বাড়িতে ছিল না। অন্তত একবার তো বেরিয়েইছিল। ওর কল লিস্ট থেকে জানা যাচ্ছে, যে সন্ধ্যে পাঁচটা পঞ্চান্নয় ওর ফোনে একটা কল আসে। দিল্লির নাম্বার। সাম আনন্দ মিশ্র। মিনিট পাঁচেক কথা হয়। তারপর তুহিনের ফোন থেকে ওই নাম্বারে আবার একটা ফোন যায়। সেটা সাতটা পনেরোয়। সেই ফোনটা যখন করা হয়, তখন তুহিনের টাওয়ার লোকেশন হাওড়া স্টেশনের কাছাকাছি। এইবার কল ডিউরেশন দু’মিনিটেরও কম। এর ঠিক পরেই ও পৃথাকে মেসেজ করে। এরপর অনেকক্ষণ কোনো কল রেকর্ড নেই। তারপর আবার তুহিনের ফোনে কল ঢোকে রাত দশটায়। লোকেশন ঋকের বাড়ি। ফোন এসেছিল ফুড ডেলিভারি বয়ের কাছ থেকে।” ... ...
শান্তার কবিতার বই বেরোল দু’বছর পর। তখন কবিতা আর সায়নে যাপন যুগপৎ চলছে। বেদনা ও আকুতি প্রতিদিন চোখ ধুয়ে দিয়েছে তার। যাকে দেখতে চায় আর খোলা আকাশের নীচে গায়ে গা লাগিয়ে সময় কাবার করে দিতে চায় অজস্র কথায় – তাকে দেখা হয় না। শূন্যে মিলিয়ে গেছে যেন! নীরব ছটফটানিতে সে চুরমার হয়। সান্ত্বনা বলতে পত্র-পত্রিকায় পেয়ে যাওয়া সায়নদীপের লেখাগুলো। একদিকে একটা সর্বগ্রাসী প্রেম সে অন্তরে লালন করেছে। অন্যদিকে প্রতিটি সামাজিক, দেশজ, বৈদেশিক আর প্রাকৃতিক ঘটনার অভিঘাতে ছটফট করেছে একা। ... ...
সৌম্য জিজ্ঞেস করলো, “কেন একথা বলছেন বলুন তো?” - কারণ খুঁজে বের করা তো আপনার কাজ। তবে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক যে কতটা ‘মধুর’ ছিল, সেটা আপনি বাড়ির কাজের লোকদের জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবেন। - তাই বুঝি? দু’জনের মধ্যে এই তিক্ততার কোনো বিশেষ কারণ ছিল কি? - বিশেষ আর কী? নিজের ওরিয়েন্টেশন লুকিয়ে বিয়ে করা, এটাই কি যথেষ্ট কারণ নয়? আপনার বন্ধু ছিলেন, এখন আর পৃথিবীতে নেই, তবুও বলছি, কাজটা কিন্তু তুহিনবাবু ঠিক করেননি। আর এই সবের পর যদি স্ত্রী অন্য কাউকে ভালোবেসে ফেলেন, তাকে কি দোষ দেওয়া যায়? আরে বাবা, বাড়িতে হাঁড়ি না চড়লে মানুষ তো খাবার বাইরে থেকে অর্ডার করবেই, তাই না? ... ...
আলি আকবর বলল, আমি তো কবে থেকেই বলছি খবরের কাগজে চাকরি করে আপনি আপনার প্রতিভার অপচয় করছেন। ছেড়ে দিন ওসব চাকরি, আপনার উচিত সর্বক্ষণের সাহিত্যসেবী হওয়া। নজরুল পেট চাপড়িয়ে বলল, কিন্তু মধ্যপ্রদেশ কি রাজি হবে? আফজালুল বলল, ঠিক আছে, আমি আপনাকে একটা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। আপনি যদি সাহিত্যের হোলটাইমার হন, আর আপনার যাবতীয় রচনা আমাকে দেন মোসলেম ভারত-এর জন্যে, আমি তাহলে আপনাকে প্রতি মাসে একশো টাকা দেবার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। প্রমিস! আপনার প্রতিভার তুলনায় এ-টাকাটা কিছুই নয় আমি জানি, কিন্তু আপনার মধ্যপ্রদেশ মনে হয় শান্ত থাকবে এতে। ... ...
“সেইটা বলা খুব মুশকিল, বুঝলি। এটাই হল এই বিষটার মজা। সাঙ্ঘাতিক টক্সিক এই বিষটা কোনও পরীক্ষায় চট করে ধরা পড়ে না। আর কতক্ষণে কাজ করবে সেটা নির্ভর করে কীভাবে আর কতটা প্রয়োগ করা হয়েছে তার ওপর। তবে যেহেতু কয়েক ঘণ্টা আগেও পার্টিতে ও একেবারে স্বাভাবিক ছিল, তাই অনুমান করা যেতে পারে বেশ খানিকটাই শরীরে ঢুকেছে। তবে বেশ খানিকটা মানে আবার কয়েক গ্রাম ভাবিস না যেন। একটা আলপিনের মাথায় যতটুকু ধরে ততটা রাইসিনই একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষকে মেরে ফেলতে যথেষ্ট। ওই পরিমাণ বিষ যদি ইনজেক্ট করা হয়, তবে তিন থেকে ছ’ঘণ্টার মধ্যে মৃত্যু হতে পারে।” ... ...
এখন পাড়ার ঠানদি বলিলেন, “ও হিদে! তোর খোকা হয়েছে।” শুনিয়া তাহার মুখ লজ্জায় রাঙা হইল।অথচ তাঁহার একান্ত ইচ্ছা একবার দৌড়িয়া গিয়া পুত্র ও স্ত্রীর মুখদর্শন করিয়া আসেন।রমনীরা তখন হাসিয়া উঠিয়াছে।তাহাতে তাহার লজ্জা অধিক বৃদ্ধি পাইল।সরিয়া যাইতে চাহিলেন।কিন্তু বাদ সাধিলেন তাঁহার মা।তিনি প্রসব পরবর্তী নিয়ম ও কর্মগুলি সমাধা করিতে ব্যস্ত ছিলেন।পুত্রকে ডাকিলেন, “হৃদয়, পরিস্কার হাতে একটা তাজা বাঁশের গা থেকে চোঁচ কেটে নিয়ে আয়।বাচ্ছার নাড়ি কাটতে হবে।” ... ...
মানসের কাছ থেকে যতটুকু জানা গেল, তা হল এই, যে শনিবার রাত ১১টা নাগাদ তুহিন আর ঋক পার্টিতে পৌঁছয়। তারপর যথারীতি হাই-হ্যালো, নাচ, ড্রিংক্স এসব চলছিল। সবাই বেশ ভাল মুডেই ছিল। কথা নেই, বার্তা নেই – কোথা থেকে ওই আমন শর্মা নামে ছেলেটা এসে তুহিনকে চুমু খেতেই পুরো সিচুয়েশন পাল্টে গেল। ঋক তো রেগে টং। তারপর খানিক কথা কাটাকাটির পর তুহিন আর ঋক দু’জন পার্টি ছেড়ে বেরিয়ে যায়। নাহ্, কোথায় গেছিল সেটা মানস জানে না। পার্টিতে তুহিনের হাতে গ্লাস ছিল, সে ব্যপারে মানস নিশ্চিত। কিন্তু কী খেয়েছে, কার থেকে খেয়েছে – তা মানস জানে না। ... ...
বর্ধমান ছাড়াবার পর নজরুল গান ধরেছে আবার, এমন সময় কামরায় উঠল তিন-চারজন বাউলের একটা দল। শান্তিনিকেতনের পথে রেলের কামরায় এই বাউলরা প্রায়ই ওঠে, আর উঠেই গান গায়। সঙ্গে থাকে তাদের একতারা, আর কোন কোন সময় পায়ে ঘুঙুরও। বাউল, ভিক্ষে করাই এদের পেশা, যাত্রীসাধারণেরও সেটা জানা। ফলে, ঠিক ঠিক চাইতেও হয়না ভিক্ষে, গান শেষ হলে অনেক যাত্রী নিজেরাই ডেকে সাধ্যমতো যা পারে, দেয়। আজ এই বাউলরা উঠে নজরুলের গান শুনে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। একটু পর, তাদের মধ্যে একজন গানের সঙ্গে একতারায় মৃদু আওয়াজ তোলে, ঘুঙুরের শব্দে তালও রাখে কেউ। নজরুল চোখ মেলে হাসে, তারপর চোখ বুজে গাইতে থাকে আবারও। ... ...
লম্বা-চওড়া, জিম করা সুদর্শন তুহিনকে একবার দেখে চোখ ফেরানো শক্ত ছিল। সবথেকে আকর্ষণীয় ছিল ওর চোখ দুটো। ভাসা ভাসা স্বপ্নালু। আর হাসলে গালে টোল পড়ত। সব মিলিয়ে মনে হত, যেন বলিউডের কোনও রোম্যান্টিক হিরো। ওরকম চেহারা আর ওই রকম ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড থাকলে যে কেউ অন্তত গোটা কতক প্রেম তো করতই। কিন্তু তুহিন ছিল লাজুক, একটু অন্তর্মুখী। সম্ভবত নিজের সেক্সুয়ালিটিকে অন্যদের, বিশেষত আগ্রহী মেয়েদের থেকে দূরে রাখতেই, নিজের চারপাশে একটা গণ্ডি টেনে রাখত তুহিন। তার জন্য কেউ কেউ ওকে অহংকারী ভাবলেও, সৌম্য অন্তত জানে, যে ও আদপেই ওরকম ছিল না। সৌম্যর সঙ্গে একটা সুন্দর বন্ধুত্বের সম্পর্ক শুরুতেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল তুহিনের। তবে একে অন্যের ওরিয়েন্টেশনের ব্যপারে জানতে সময় লেগেছিল আরো অনেকদিন। ... ...
ওলায় বসে জানলার কাচটা নামিয়ে দিল সৌম্য। এমনিতেই এসি ওর পছন্দ নয়, তার ওপর এই প্যানডেমিকের সময় মনে হয় একটু খোলামেলা থাকাই ভাল। সৌম্য ভেবেছিল তুহিনদের বাড়ি যেতে যেতে ও রজতের সাথে মায়ের এখানে আসার ব্যপারটা নিয়ে একটু কথা বলে নেবে। সোহিনীদেবী রজতকে চেনেন সৌম্যর বন্ধু এবং ওদের ডিটেক্টিভ এজেন্সি সৌরলোকের পার্টনার হিসেবে। তিনি জানেন, যে কাজের প্রয়োজনে রজতকে প্রায়ই সৌম্যর বাড়ি থেকে যেতে হয়। তাই সৌম্যর বাড়িতে সব সময়ই রজতের জন্য স্পেয়ার টুথব্রাশ, জামাকাপড়, ঘরে পরার পায়জামা, চপ্পল ইত্যাদি থাকে। কিন্তু রজত আর সৌম্য যে কাজের পার্টনারের থেকেও বেশি কিছু, সেটা ওঁর জানা নেই। ফলে, সোহিনীদেবী কলকাতায় এলেই রজতকে কিছু দিনের জন্য পাততাড়ি গোটাতে হয়। এবং প্রতিবারই এই নিয়ে একটা মন কষাকষি হয়। ... ...