বলতে বলতে, কী আশ্চর্য, দাদুর গলায় আক্ষেপ ঝরে পড়ে! আগের কথার রেশ টেনে বলেন – “তবু ভাতেরও অভাব কিছু মানুষের।” কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন দাদু। তারপর আবার বলতে থাকেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে, বিশ্বযুদ্ধের পরে পরে পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষের ছায়া বাংলার এই শস্যগোলাকেও গ্রাস করল।তারপর স্বাধীনতা লাভ। এদিকে স্বাধীনতার পঞ্চাশ -ষাট বছরেই অতিরিক্ত রাসায়নিক সার আর কীটনাশক মাটির গুণ অনেকটা নষ্ট করে দিলো। বড় বড় দেশী আর বিদেশি কোম্পানিগুলো মানুষকে কম শোষণ করল? কোটি কোটি ডলার লুঠ করে নিয়ে গেল। বেশি ফসলের আশায় চাষীরা তা দিল! কী করবে তারা? লোভের দেখানো পথের বাইরে আর কোনো বিকল্প তারা নিজেরা ভাবতে পারল না, কেউ ভাবাল না।” ... ...
আসল কারণটা অন্য। গতকাল ওই যে খিলাফৎ কমিটির নোটিশটা ছাপানো হয়েছিল, সেটার জন্যেই বন্ধ করল কাগজটা, রাগ আর সামলাতে পারল না। আপনি কি লক্ষ্য করেছেন ওই নোটিশ কাল বসুমতীতেও বেরিয়েছে? কই, তাদের তো বন্ধ করেনি। কিন্তু, সে যাই হোক, করেছে, ভালোই হবে। আজকের কাগজের জন্যে যে এডিটরিয়ালটা লিখেছিলাম – দুর্যোগের পাড়ি – সেটা মোসলেম ভারতে ছাপিয়ে দেবার ব্যবস্থা করছি। নবযুগকে আজ জুলুম করে বন্ধ করার খবরটা নিশ্চয়ই বেরোবে দুয়েকটা অন্য কাগজেও। যারা এতদিনেও নবযুগ পড়েনি, বাংলা খবরের কাগজের সেই পাঠকদেরও নবযুগের ব্যাপারে কৌতূহল বাড়বে। এখন যতদূর তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের কাগজটা আবার বের করা চাই। আমার তো মনে হয় একটু কষ্ট করে হলেও ওই দুহাজার টাকা আজই জমা দিয়ে দেওয়া উচিত। ... ...
মিষ্টির রসে ডুবে থাকা মাছি উঠে আসতে পারে না সেই রসকুণ্ড থেকে। ডানা, পা, শুঁড় রসে ভারি। নিয়তির হাতে নিজেকে সঁপে দিয়ে অন্ধের মতো এদিক ওদিক ঘোরে।আয়ু থাকলে সে বাঁচে আরও কিছুদিন। কিছুদিন আরও স্বাধীনভাবে জীবনকে নেড়েচেড়ে দেখে নেয়।কিন্তু তার দৃষ্টির ঘোরাফেরা একটা নির্দিষ্ট সীমায়, জীবনকালও সেই গণ্ডির ভেতরেই সীমাবদ্ধ। অধিকাংশ মানুষের জীবনই এই। এই অঞ্চলের মানুষও তার ব্যতিক্রম নয়, বরং নারীপুরুষ নির্বিশেষে সবাই একরকম। নিশ্চেষ্ট, উদ্যমহীন।খেয়েপরে অর্থ উপার্জন করার আত্মকেন্দ্রিকতার বাইরে হাজার অপমান আর অসম্মানেও তারা বোবা। চেনা ছকের বাইরেও যে জীবনের যে একটা উদ্দেশ্য থাকতে পারে এমন কথা তারা সম্ভবত চিন্তাতেই আনতে সক্ষম নয়। ... ...
আপনি যে একদিন বিখ্যাত হবেন তা আমার জানা ছিল, আমি মুজফ্ফর সাহেবকে বলছিলুম, আমার বিশ্বাস ছিল আপনি একদিন দেশবিখ্যাত এক লেটোশিল্পী হবেন। এখন তো দেখছি আপনি একজন দেশবিখ্যাত লেখক কবি এবং গায়ক, প্রায় ঠিকই ছিল আমার ধারণাটা। কিন্তু আপনি কি জানেন, ছেলেবেলায় আলাপ না হওয়া সত্ত্বেও আমি কেন আপনাকে মনে রেখেছি? আমার মায়ের কাছে শুনেছিলুম আমি নাকি এক ফকিরের আশীর্বাদে জন্মেছিলুম। ফকির মানে কী, আমি জানতুম না তখন। কিন্তু আপনার বাবা তো অজয়ের দুপারেই বিখ্যাত ছিলেন। আমি যখন শুনলুম তাঁর নাম ফকির আহ্মদ, কেউ না বলা সত্ত্বেও আমি ধরে নিলুম, ইনিই নিশ্চয়ই সেই ফকির, এঁর আশীর্বাদেই আমি জন্মেছি। ... ...
সত্যি কথা বলি কাজীদা, আস্তে আস্তে কেমন ভালই লেগে গেল শিবপুরকে। ননী জেঠুর অনুমতি নিয়ে আরও দুয়েকটা বাচ্চাকে পড়াই, হাতখরচের টাকা উঠে যায়। নানা মানুষের সঙ্গে মিশি, সাহিত্য সভায় যাই, লাইব্রেরিতে কিছু কাজের দায়িত্ব পাই, গান্ধি বিফল হলে যে লড়াই লড়তে হবে, তার আঁচ গায়ে লাগে, মিছিল-মিটিংয়েও যাই। পিংলার সঙ্গে তো সেইভাবেই বন্ধুত্ব হয়ে গেল একদিন। করাচির কথা, আপনার কথা সব শুনেছি। একদিন বলল আপনার ‘নবযুগ’-এর কথা। মাঝেমধ্যে গঙ্গা পেরিয়ে ‘নবযুগ’ কিনেও আনে। সেই ‘নবযুগ’ পড়িয়েছি একজনকে। আপনার সঙ্গে তিনি আলাপ করবেন। কাল আসবেন একবার? ... ...
খাপরার চালের প্লাস্টারহীন বাড়িটায় ঢুকে অবাক হল নজরুল। দরজা পেরিয়ে একটা উঠোন গোছের। ঝকঝক তকতক করছে উঠোনটা। উঠোনে দাঁড়িয়ে সোজা তাকালে একটা খোলা বারান্দা। সামনে, বাঁয়ে, ডাইনে। বারান্দায় বেশ কয়েকটা তোলা-উনুন। আর বারান্দার শেষে অনেকগুলো দরজা। খোলা কোনোটা, কোনোটা ভেজানো, আধ-খোলা কোনোটা বা। কোনও কোনও দরজার পাশের দেওয়ালে এমনকি হাতে-আঁকা আলপনা গোছের ছবিও দেখতে পাওয়া যায়। নজরুল বুঝল, একই সদর দরজা দিয়ে ঢুকে বারান্দা পেরিয়ে প্রত্যেকটা দরজা এক-একটা পরিবারের আলাদা আলাদা ঘরের। খোলা দরজা দিয়ে একটা ঘরের ভেতর চোখ গেল নজরুলের। মেঝেতে বঁটি পেতে সবজি কুটছে একটা মেয়ে। ... ...
কিছু ঠিকই, কিন্তু সেই কিছুটা কী? খুলেই দেখা যাক, বলতে বলতে বাটিটা তুলে নিয়ে চাপা দেওয়া থালাটা সরিয়ে দেয় নজরুল। এক বাটি আলুর দম, কড়া মশলায় বেশ লালচে দেখাচ্ছে। দে গোরুর গা ধুইয়ে – উচ্ছ্বসিত নজরুলের চিৎকৃত কণ্ঠস্বর শোনা যায়, মাহ্মুদের দোকান থেকে রুটি নিয়ে আয় শৈলজা, রাত্তিরের ডিনারটা জমে যাবে। তারপর মোহিতলালের দিকে ফিরে বলে, স্যার, ক’খানা রুটি আপনার জন্যে? ... ...
কাজী উত্তর দেবার আগেই উঠে দাঁড়ান ডঃ শহীদুল্লাহ্, বলেন, আমার এবার যাবার সময় হল। যাবার আগে একটা কথা তোমাকে বলি কাজী। আমার মনে হয় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এখন তোমার পরিচয় হওয়া দরকার। সুধাকান্তবাবু বলেছেন রবীন্দ্রনাথ নিজেও তোমার সঙ্গে পরিচিত হতে চান। কবে যে ওঁকে পাওয়া যাবে আমি ঠিক জানি না। শুনেছি, বিদেশ থেকে কয়েকদিন আগে ফিরেছেন। ইদানীং প্রায়ই বিদেশে যাচ্ছেন, কাজেই এর পরের বিদেশ যাত্রার আগেই ধরতে হবে। আমি যোগাযোগ করছি, এক-দেড় মাসের মধ্যেই ধরতে চাই। জোড়াসাঁকোয় নয়, চেষ্টা করব শান্তিনিকেতনে গিয়ে দেখা করতে, সেখানে উনি অনেক খোলামেলা। তুমি আমার সঙ্গে আসবে তো? ... ...
সেই আঠেরোশো পঞ্চাশ-টঞ্চাশ থেকে আমাদের এই বাংলার গ্রাম থেকে – আর বাংলাই বা বলি কেন – বিহার উড়িষ্যা বা এমনকি যুক্তপ্রদেশ থেকেও দলে দলে গরীব মানুষ কাজের সন্ধানে আসছে এই কলকাতা সহরে। এদের মধ্যে হিন্দু মুসলমান দু' দলই আছে। মুসলমানই বেশি বলে আমার মনে হয়, কারণ তারাই অপেক্ষাকৃত বেশি গরীব। কলকাতায় এরা সব থাকে কোথায়? প্রথম-প্রথম ফুটপাতে, আর তারপর নানা বস্তিতে। আমি শুনেছি ভদ্রলোকদের চাপে আঠেরোশো ছিয়াত্তর-টিয়াত্তরে কলকাতার কর্পোরেশন নানারকমের নাগরিক সুখ-সুবিধের ব্যাপারে সহরবাসী মানুষদের একটা অধিকার দিয়েছে। কী অধিকার? একটা কর্পোরেশন পরিচালক সমিতি, যার আসল নাম কাউন্সিল, তার সভ্য হওয়া। তার মানে কাউন্সিলর হবার অধিকার। এবং অবশ্যই, ভোট দিয়ে সেই কাউন্সিলার নির্বাচন করা। এই ভোটের অধিকার কিন্তু আছে মাত্র তিন ধরণের লোকের। ... ...
ঝড় বয়ে যাওয়ার পরে নিবিড় হতে সময় নেয়। রাস্তা বহুক্ষণ থরথর করে দোলে, কাঠের বাড়িরা ঠকঠক করে কেঁপে আতঙ্ক বজায় রাখে অনেক সময় ধরে। রাস্তার ধুলোর ঝড় ধীরে ধীরে থিতু হয়। এমনকি পথের পশুপাখিও গা ঝাড়া দেয় না ততক্ষণ। ওরা এই অবস্থায় পড়ে রইল, সেও কত মুহূর্ত, কত পল। হামলার শেষ প্রতিধ্বনি মিলিয়ে যেতেই আলেফ ঝটকা দিয়ে উঠে দাঁড়াল। তাদের নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে হবে। যেকোনো মুহূর্তে এমনই আরেকটা দল এসে যাবে, এরপর পালাবার উপায় না-ও হতে পারে। ... ...
খবর শুনে মা কাঁদল না, তবে পরের দিন আমাদের বস্তিতে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা হল। পেট পুরে খেল ওই দুজন লোক, তারপর চলে গেল। আমি ততদিনে সেকেণ্ড ক্লাশ, মানে ক্লাশ নাইন-এ উঠেছি। মা আমাকে বলল, আমাকে যুদ্ধে যেতে হবে। আর যেতে হবে মেসপটমা না কী বলে, সেই আরব দেশেই। শুধু আমাকে বলেই ক্ষান্ত হল না মা, বস্তির সবাই জানল পিংলাকে তার মা যুদ্ধে পাঠাবে। আমাদেরই বস্তির মাতব্বর গোছের একজন শুধু মাকে সাবধান করে দিল, এখনই কিছু কোরো না, কেউ যদি বলে দু পয়সা খরচ করলেই সে তোমার ছেলেকে যুদ্ধে পাঠাবার ব্যবস্থা করে দেবে, বিশ্বাস কোরো না তাকে। আঠের বছর অন্তত বয়েস না হলে যুদ্ধে নেয় না। আর তা ছাড়া সাহেবরা সব দেশের ছেলেদের নেয়, কিন্তু বাঙালিদের নেয় না যুদ্ধে। বাঙালিদের জন্যে শুধু ইশকুল আপিস আর কোর্টের কাজ, সাহেবরা বাঙালির হাতে বন্দুক দেবে না। ... ...
এই মত্ত জনতা মেয়েদের মধ্যেও চার্লসকে খুঁজে পেল। কিংবা মেয়ে সেজে চার্লস লুকিয়েছে কিনা, সেটা বুঝতেই যেন তাদের পোশাক খুলে চামড়া মাংস ঘেঁটে তারপর নিকেশ করল। নিউ অরলিন্সের রাস্তায় রক্ত জমাট বাঁধছিল। আগের কাল আর নেই, যে নিগ্রো মানেই নিরস্ত্র, পড়ে পড়ে মার খাবে। তাদের কাছেও আছে বন্দুক, ছোরা, লাঠি। জায়গায় জায়গায় খণ্ডযুদ্ধ। নিউ অরলিন্স জ্বলছিল। হই হই করে সাদাদের দল ছুটল ট্রেমে, ওখানে গেলেই পাবে চার্লসকে, কিংবা তাদের জাতভাইদের। একজন পুলিশকে শুইয়ে দিয়েছে কিনা একটা নিগ্রোর বাচ্চা! ... ...
সনতের ঘাড় মাথা পিঠ টনটন করছিল; চোখ লাল, মাথা ধরে আছে। কাল থেকে ডেস্কটপে ইসরোর সাইট আর টিভির স্ক্রিনে নজর রেখে যাচ্ছে অবিরাম। মন্টুর মা সকালে লুচি আর মোহনভোগ করেছিল, তারপর রান্না করে খাবার বেড়ে রেখে গেছে দুপুরে। এই মধ্যরাতে সেই বাড়া ভাত, আর মাছের ঝোল থেকে আঁশটে গন্ধ সনতের ঘরদোরে ছড়িয়ে পড়ছিল। পিঁপড়ে ধরেছিল বাসি লুচি, মোহনভোগে। গালে হাত বোলাল সনৎ – খোঁচা খোঁচা দাড়ি; ল্যান্ডিং হয়ে যাক, কালই সেলুন যাবে, চুল কাটবে, ফিটফাট হয়েই মিঠুর বাড়ি। ... ...
পথেঘাটে মেয়ে মোটে নেই। গঙ্গার ঘাটে দেখেছিল হিন্দুঘরের মেয়েরা জলে ডুব দিয়ে নাইতে নেমেছে। এদিকটায় এসে দুই একটা মেয়ে দেখেছে, তাদের চলনবলন একেবারেই আলাদা। কী টকটকে গায়ের রং, তেমনি অদ্ভুত চুলের রং। চুল কার এমন লাল হয়! আমিনা তাজ্জব বনে যাচ্ছিল! এদের সবারই সাজগোজের ভারি বাহার, ছোট ছোট ফ্রক, বুকের আঁচলটুকু অবধি নেই। পায়ে চামড়ার জুতো, তাতেই বা কত কায়দা। আমিনা জুতো পরা কোনো মেয়ে কোনোদিন দেখেনি। এমন দুই-একজনকে কোনো ফিরিঙ্গির হাতে হাত গলিয়ে হিহি হাহা করতে করতে যেতে দেখল আজ। ওরা মেয়ে, কিন্তু যেন মেয়ে নয় – অন্য জগতের। এদেরই কি ওয়াহিদ বেবুশ্যে বলেছিল? তাদের গ্রামেও বদনাম হওয়া মেয়ে থাকে, কিন্তু তাদের সাজ পোশাকে না আছে রং, চলা ফেরায় না এই ঢং। ... ...
দেকো, সিবিল ওয়ার হইচিল এখেনে, তারপর যতেক নিগ্রো ছিল সবাইকে বেবাক আজাদ করে দিল। দিল তো? কিন্তু সাদাদের সেটা কদ্দিন সইবে বল দিকিন? সব তো ফিরিঙ্গিদেরই জাতভাই। যা দেছেল, সব কুটুকুটু করে ফেরত নিতে চায়। সেটা কীরকম? ফের জুতে দেবে ওদের? না, তা নয়, কিন্তু নতুন আইন করেছে সরকার, অনেক নিগ্রোদের ভোট থাকবে নাকো। ভোট? সেইটা কি এস্রাক ভাই? প্রশ্নটা জয়নাল করল, কিন্তু শব্দটা অজানা তাদের সবার। এই দেশের লোক তা আমাদের মতুন নয়কো, এরা নিজেদের পছন্দমত সরকার বানায়, তাকেই বলে ভোট। মাথা চুলকিয়ে এটুকুই বলতে পারে এস্রাক। যা বলেছিল তার বউ-বেরাদর। নিগ্রোদের আর পছন্দ করতে দেবে না, যা করবে সাদারা। ... ...
সুলভের সামনে কেউ নেই তখন। ভেতরে, মেঝে জুড়ে ভাঙা কাচ। দেওয়াল কাঁপছিল, দরজা, স্কাইলাইট – সব; ঘুলঘুলির সামনে পাখির বাসা মাটিতে ঠিকরে পড়তে তিনটে ডিমই ভাঙল। বাথরুমে ঢুকে কল খুলল প্রফুল্ল – লালচে জল চড়বড় করে পড়ছিল বালতির ভিতর। তারপর প্রফুল্লর চোখের সামনে কলের মাথা ফেটে ফিনকি দিয়ে জল বেরল, চিড় ধরল দেওয়ালে। পাশের স্নান করার খোপ থেকে জল বেরিয়ে আসছিল গব গব করে, মাথার ওপরে ছাদের আস্তর খসে পড়ল এইবার; জাহাজ তাহলে গলিতে ঢুকেছে – সাবান-মাখা, আদুল-গা প্রফুল্ল দৌড় মারল মন্দিরের দিকে। ... ...
অফিসের কাছাকাছি একটা ট্রাফিক সিগনালে রোজ দাঁড়াতে হয়। অভ্যাসের বশে দাঁড়িয়ে পড়ল সেখানে, অথচ আজ সিগনালের রঙ সবুজ। একশ’ কিলোমিটার স্পিডের রাস্তায় সবুজ আলোয় দাঁড়িয়ে পড়েই বুঝল – ভুল করেছে, তবু, শোধরানোর চেষ্টা করল না, দাঁড়িয়েই রইল, দাঁড়িয়ে রইল ঠায় – যেন সে চলচ্ছক্তিহীন; চোখ যতদূর যায়, ঢালা পিচরাস্তায় খণ্ড খণ্ড জলতল, বাষ্প উঠছে সেখান থেকে। পঙ্কজ তার ভাগ্যের কাছে নিজের হৃৎপিণ্ড বন্ধক দিয়ে বসে রইল – যা কিছু ঘটে যেতে পারে এই মুহূর্তে – হয়তো একটা কলিশন, হয়তো চুরচুর হয়ে যাবে গাড়ি, তালগোল পাকিয়ে যাবে পঙ্কজ নিজে – শেষ হয়ে যাবে সব। ... ...
নিজেদের জমি, নিজেদের শহর – যেখানে মাথার উপর ছড়ি ঘোরানোর জন্য কোনো সাদা লোক মজুত নেই, আসতে চাও না এমন একটা জায়গায়? যেখানে বাঁচার জন্য সারাক্ষণ বুকে পাথর নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হয় না, সাদা মেয়েদের দিকে চোখ তুলে চাইলে বেঘোরে মারা যাওয়ার কোন ভয় নেই। চাও না এমন একটা পিঠসোজা করা শান্তির জীবন? এভাবেই বলত ইশাইয়া। তার কথায় আগুনের ফুলকি থাকত, মুখে মুখে ছড়িয়ে যেত রঙমশাল। ... ...
শরতের আকাশে যথারীতি হাল্কা নীলের উজ্জ্বলতম শেড সকালের দিকে – ত্যারছা রোদ এসে জবার টবে পড়েছে আপাতত, ঘুরে ঘুরে অন্য গাছের কাছে যাবে বেলা বাড়লে। এই একফালি রোদটুকু যেন মিঠুর ডাস্টার – যেন ক্লাসরুমের ব্ল্যাকবোর্ডে বড় করে লেখা আছে ক্যান্সার, লেখা আছে মৃত্যু, হাড়গোড়, নরকঙ্কাল – এই সব আঁকা রয়েছে যেন – দুষ্টু ছাত্ররা যেমন শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে বোর্ডে অকথা-কুকথা লেখে – কোনো শিক্ষক রিঅ্যাক্ট করেন, কেউ নির্লিপ্ত মুখে মুছে দেন, যেন কিছুই হয়নি – সকালের এই রোদ, এই নীল রঙ হাতে নিয়ে মিঠু সব মুছে দেয়, নতুন কিছু লিখবে বলে চক নেয় হাতে; রোদ চড়া হলে ছাদের দরজা বন্ধ করে নিচে নামে। সিঁড়িতে ওর চটির শব্দ হতেই ছন্দা এসে ল্যান্ডিং-এ দাঁড়ায়, তারপর মিঠু শেষ ধাপে পৌঁছলে, ওর দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকায়। ছন্দার চোখে বিষণ্ণতা আর টেনশন চিরকালই, এখন সে’ চাহনিতে ভয়কে খুঁজে পাওয়া যাবে খুব সহজে। ইদানিং মা’র চোখে চোখ রাখলে প্রবল শোককেও চিনতে পারে মিঠু – সে যে তার মায়ের সামনে জলজ্যান্ত দাঁড়িয়ে, ছন্দা যেন তা বিস্মৃত হয়; ওর মনে হয়, ছন্দা যেন সিঁড়ির ধাপের নিচে দাঁড়িয়ে ঘোলা চোখে মিঠুর শব দেখছে। ... ...
রথে শুধু বাদশা নেই, আছে বেগমও। যদিও সবার মুখে মুখোশ, মেয়ে হলে তাদের আবার বুকের কাপড় আলগা। তোবা! তোবা! বেলুজ্জেরা তার মধ্যেই দু’হাত আসমানে তুলে নাচগান জুড়েছে। মাঝে মাঝে রাস্তার দু’ধারে মুঠো-মুঠো পুঁতি ছুঁড়ে দিচ্ছে। আলেফরা নিচু হয়ে পুঁতি কুড়াবে, না ঘাড় উঁচু করে ফর্সাপানা মেয়েছেলের কেচ্ছাকাণ্ড দেখবে? এত উৎসব, উত্তেজনা আর খাওয়া দাওয়ার ধূম কোনো বাপের জন্মে দেকিনিকো। রাতে বাড়ির পথ ধরে ওদের মুখে শুধু এই বুলি। মারদি গ্রাঁ দিনরাত মানে না, তেমনি চলছে যেন কারো কোনো ক্লান্তি নেই। ... ...