লিপির ভালো লাগছিল এই নতুন ধরণের শনিবারগুলো- কত রকম ঘর দোর হয়; ঝাঁ চকচকে নতুন বাড়ি হয়তো - সে সব ঘরে ঢুকতেই রঙের গন্ধ পাওয়া যায়, নিঝুম সাদা দেওয়াল ড্যাবডেবিয়ে তাকিয়ে থাকে লিপিদের দিকে; আবার কিছু বাড়ি যথাবিহিত প্রাচীন, কাঠের মেঝেয় পেরেক উঠেছে, খেয়াল করলে দেওয়ালে হাইট চার্ট দেখা যায়- পেন্সিলের রেখা আবছা হয়ে এসেছে যদিও; পিছনের ঘাসজমিতে রঙ চটা কেনেল, লাল নীল বল, ঝুপসি গাছে লম্বাটে ফল ধরে আছে - কত কী ভেবে বাড়ি করে মানুষ, তারপর বেচে দেয়- ... ...
মাউন্ট বাউতে ভাল আছিস তাহলে? অ্যাবসিন্থ হাতে নিয়ে গুছিয়ে বসে জিজ্ঞেস করল ডিওয়েন। সেসব কতা বাদে হবে। আগে তোর কথা ক’ তো দেকি। শিকাগোর কতা। শুনেচি ওধারে নাকি সাদা আর কালোর মদ্দে কোন ফারাক নেই কো। বলতে গিয়ে একবার থমকাল ডিওয়েন। নেই আবার আছেও। সেরকম না হলে আমি আবার ফিরে এলাম কেন। তবে হ্যাঁ, সেগ্রিগেশন নেই সেটা ঠিক। স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে মুচকি হাসল সে। আমি যখন ট্রেনে করে যাচ্ছিলাম, ট্রেন যেই ইলিনয় ঢুকেছিল, আমি কি করেছিলাম বল তো একবার? কি? সিধা ঢুকে গেলাম সাদাদের কামরায়। একটা অদ্ভুত কথা কি জানিস, আমাদের এই দক্ষিণের শহরে থেকে থেকে আমরা ভাবি – যা কিছু সাদাদের, সব বুঝি ভাল। ওদের বাগানওলা বাড়ি, জামা কাপড় ধোপদুরস্ত, মেয়েরা হাঁটছে মাটির দু’ ইঞ্চি উপর দিয়ে – ওদের দিকে তাকালে পর্যন্ত গায়ের চামড়া খুলে নেবে। আর আমাদের নিগ্রোদের সব নোংরা, ভাঙাচোরা। অথচ ওই কামরায় ঢুকে কি দেখেছিলাম বল তো? কামরার মেঝেতে যত কাগজ, খেয়ে ফেলা উচ্ছিষ্ট, কি নেই! ঠিক আমাদের নিগ্রোদের কামরার মতই গন্ধ। সাদা মেয়েরাও বসেছিল সেই কামরায়, ওই নোংরার মধ্যেই। পা পুরোদস্তুর মাটিতে। They also piss and shit like us. ... ...
বৃত্তরৈখিকের শেষ পর্ব আজ। লেখকের কথায়ঃ "বৃত্তরৈখিককে উপন্যাস বলেছি, কিন্তু হয়তো ইতিহাসও বলা চলতো। মোটামুটি বিশ শতকের ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে সত্তরের দশকের গোড়ায় যাঁদের যৌবনের শুরু এবং পরবর্তী পঞ্চাশ বছরের মধ্যে বেড়ে ওঠা, বাংলাভাষী সেই মধ্যবিত্তদের একদলের ইতিহাস এই রচনার রসদ। পাঠযোগ্যতার খাতিরে একটা গল্পের বুননের চেষ্টা এতে আছে – উপন্যাস নামের আকাঙ্খা সেখানেই – সেটা কতটা মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছে পাঠকই তা বলতে পারবেন। কাহিনীর পাত্রপাত্রীদের পুর্ববর্তী প্রজন্মের কথা কোন কোন ক্ষেত্রে গল্পের খাতিরে এসে পড়লেও এই ইতিকথার প্রধান চরিত্ররা মোটামুটি ভারতের স্বাধীনতার সমবয়েসী। এবং এই স্বাধীনতার মতই আশাবাদিতা এবং নৈরাশ্য, আদর্শ এবং আদর্শচ্যুতি, মেধানিষ্ঠা এবং নিম্নগামী মেধা এখানে পাশাপাশি উপস্থিত।" ... ...
বেগুন ভাজার গন্ধে ঘরের পরিবেশ সহজ হয়ে আসছিল। টিউব লাইটের আলো ঘরময়, বারান্দার আলোর নিচে টবের ক্যাকটাস; কুন্তী, গুলগুলে সোফায় গোল্লা পাকিয়ে ঘুমোচ্ছিল, পুরোনো সব ছবির আড়াল থেকে মুখ বের করছিল গায়ে ছিট ছিট টিকটিকি- এই সব মুহূর্তগুলো অদ্ভূত- মিঠুর খিদে পাচ্ছিল আবার; মনে হচ্ছিল, যেন কিছুই ঘটে নি, যেন এ যাবৎ মৃত লোকজন বেঁচে বর্তে আছে- যেন অফিসফেরতা ট্রেন থেকে নেমে কমলালেবু, সন্দেশ কিনছে স্টেশনের কাছে, একটু পরেই বাড়ি ঢুকবে কড়া নেড়ে। বারান্দা থেকে মুখ বাড়ালেই যেন দেখা যাবে, মাণিক বেগুন বিক্রি করছে কুপি জ্বেলে। মুড়ি খাচ্ছে। মায়া জমছিল মিঠুর গলায়। ... ...
এই লোকটাকে আগেও দেখেছে পিয়েরে, প্রায় রোজই তো দেখে আজকাল। দেখে গা-পিত্তি জ্বলে যায় তার। ইস্ট ইন্ডিয়ার থেকে আসে এরা। মুখটা দেখ? বাইরে থেকে নতুন কেউ এসে গেঁড়ে বসার চেষ্টা করছে ভাবলেই রাগ হয় পিয়েরের। এমন নয়, যে তার কোনো কাজ মার যাবে, কিন্তু সব দেশ থেকে হাড়-হাভাতেগুলো এখানে এসে জমাবে, সেটাও তার ভাল লাগে না। এমনিতেই আজকাল নিগ্রোগুলোর বাড় বাড়ছে খুব। ট্রেমের দিকটা তো পুরোটাই ওদের দখলে। এই লোকটার চেহারা যদিও আলাদা। এদের মতন আরও দুই তিনজনকে দেখেছে মার্দি গ্রাঁর সময়। খুব ব্যবসা জমেছে এদের। হিন্দু জিনিস কিনতে লোকের উৎসাহ দিন দিন বাড়ছে। এই হিন্দুগুলো নিগ্রোদের থেকে আলাদা, শহরের সব জায়গায় পৌঁছে যায়। ওদের আসা-যাওয়ায় কোন বাধা-নিষেধ লাগেনি। হয়তো চেহারার জন্য। কাটা কাটা চেহারার মাজা রঙের এই লোকগুলো, হয়তো চোখের ওইরকম দৃষ্টি বা মাথার ওই গোল টুপির কারণে কেমন দার্শনিক বা শিল্পী স্বভাবের মনে হয়, কিন্তু আসলে খুব বজ্জাত। সেটা ঠিক বুঝতে পারে পিয়েরে, লোক চেনে তো। ফুটপাথে থুথু ফেলল পিয়েরে। ... ...
এই শহরে সবাই তেতে আছে সনতের মত- যেন প্রতিটি লোক জুয়াড়ি , যেন প্রতিটি লোক একটা হেরো ঘোড়ার ওপর নিজের জীবন বাজি ধরেছে,আর সেহেতু প্রতিটি সেকন্ডে নিজের নাড়ি ধরে হার্টবীট মাপছে, তারপর তেড়েফুঁড়ে শ্বাস নিচ্ছে যেন এই শেষবার। সবার ঘোলাটে চোখ, ছুঁচোলো ঠোঁট, নিঃশ্বাস নেয় ঘন ঘন- সনৎএর নিজেকে কানেকটেড মনে হয়। আজ সকালের বাসে লোকটা এনারসি, সি এ এ নিয়ে খুব চোপা করছিল, সনৎ কিছু বলে নি- জানলার বাইরে তাকিয়ে রাস্তা দেখছিল আপাতনিস্পৃহ, অথচ কান ছিল সজাগ- যেন লোকটার রেসের ঘোড়াকে চিনে নিতে চাইছে। মালটা হঠাৎ টপিক চেঞ্জ করে বিক্রম আর প্রজ্ঞান তুলতে ওর মাথা গরম হয়ে গেল। যেন লোকটা নিয়ম ভেঙে দুটো ঘোড়ার ওপর বাজি ফেলেছে - যার মধ্যে একটা সনতের -যার ওপর বাজি ধরার আর কারোর এক্তিয়ার নেই। নিজের ঘোড়ার পিঠ থেকে লোকটার হাত সরাতে মরিয়া হ'ল সনৎ-“মহাকাশের তুই কী বুঝিস?” ... ...
প্রথম যে কথা বলছিলো সে-ই শুরু করে আবার, ঠিকই, তবে এই সব পরিবর্তন আজকাল হয়েছে। একেবারে প্রথমের দিকে কিন্তু এখনকার ডাইনিং হলটায় শুধুমাত্র কয়েকটা বাচ্চাকে নিয়ে স্কুলটা শুরু করেছিলেন জয়িদি। তারপর বাস এলো। বাসটা আসার পর থেকে একটা দারুণ কাজ শুরু করলেন উনি, একেবারে জঙ্গলমহলের ভেতরের গ্রামগুলোর থেকে একটা একটা করে বাচ্চাকে ধরে নিয়ে এসে স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। আমরা স্কুলের বাসে গিয়েও দেখেছি কেমন সব গ্রাম। শুনেছি তখন জলধর নামে এক সাঁওতাল যুবক ছিলো জয়িদির সঙ্গে, সে নাকি পড়াতোও ভালো। কিন্তু সে চলে যাওয়ার পর থেকে আর নিয়মিত পড়াবার মতো ভালো লোক জোগাড় করা যায়নি। ... ...
সে হল এক ভীষণ বচসা। ভোরের খোঁজে পাখিরা ঘুমের থেকে উঠে উড়বার তোড়জোড় করছিল, আবার নিজের নিজের বাসায় গিয়ে ডানা গুটিয়ে ঘাপটি দিল। রাতের শেষে যে ক’জন মাতাল পথের ধুলায় লুটিয়ে পড়েছিল, অসময়ে খোঁয়ারি ভেঙে গালিগালাজ করতে করতে বাড়ির পথ ধরল। টেন্ডারলয়েনের মাথার উপর দিয়ে যাওয়া সেই সকালের রেল কেন যে মাঝপথে আটকে গেল, নিউ ইয়র্ক হেরাল্ডের তাবড় সাংবাদিক কিছুতেই সেটার হদিশ করতে পারল না। আমান্ডা গোল থামাতে মাঝখানে এসে পড়েছিল, আন্তোনিওর দাবড়ানিতে ছাদের থেকে মাকড়সার মত ঝুলে রইল। সেই দুই ষণ্ডা জোয়ান রুথের দুহাত ধরে চ্যাংদোলা করে আন্তোনিওর ঘরে নিয়ে যেতে চেয়েছিল, রুথের চোখের আগুনের গোলায় ওখানেই কাটা সৈনিক হয়ে মেঝেতে গড়িয়ে পড়ল। ... ...
শীতের বিকেলে বৃষ্টি হলে ঠান্ডা যেন চামড়া ফুটো করে হাড়ে ঢুকে যায় সটান, তার ওপর ভেজা ফুটপাথ শুকোতে অনেক সময় নেয়- রাতে শোয়ার জন্য একটা শুকনো জায়গা খুঁজছিল প্রফুল্ল। এমনিতে, মন্দিরের সামনের ফুটপাথে প্লাস্টিক পেতে শুয়ে থাকে। গতবছর একটা কম্বল পেয়েছিল - সেদিন কালীমন্দিরে শ্রাদ্ধ- প্রফুল্ল, কপিল, নাথু আর রঘুবীর ফুটপাথে বসে পিন্ডমাখা দেখছে- ন্যাড়া মাথা দুটো ফরসা ছেলে পুজো করতে করতে চোখ মুছছিল। কাজ মিটে গেলে ছেলেদুটো ওদের হাতে লাড্ডু দিল। তারপর টাকা, ধুতি আর কম্বল। গতবারের শীত এই কম্বলের নিচে দিব্যি কেটেছে; তারপর প্লাস্টিক মুড়ে রেখে দিয়েছিল। ... ...
গোবিন্দর শরীরে যে এত ঘুম জমে ছিল, সে নিজেও জানত না। দিনভর ঘুমাতে কসুর করেনি শুরুর ক’টা দিন। জাহাজের স্টকহোল্ডে কাজ করে শরীরখানা এমন দুমড়ে মুচড়ে যায়, সবসময় ঘুমের জন্য মুখিয়ে থাকে। দু’দিন এমনি গেল। তারপর বদনখান এমন ঝরঝরে হয়ে গেল, মোটে ঘুমই আসে না চোখে। শুয়ে থাকলে বরং গায়ে বেদনা। ওইটুকু তো ঘর, হাত-পা খেলানোর ঠাঁই নেই। পায়চারি করার পরিসর দূরস্থান। সে বেচারা কি করে? বিছানার উপরেই গ্যাঁট হয়ে বসে রইল রাতভোর। বন্ধ জানালার ফাঁক দিয়ে আলো ফুটল, ঘরের হলুদ আলোর সঙ্গে ছায়া ভুবন তৈরি করল। মানুষের মন বড় অদ্ভুত। জাহাজের জন্য মন আকুলি-বিকুলি করে উঠল গোবিন্দের। অথবা ঠিক জাহাজের জন্য নয়, শুধু একটু বাইরে যাওয়ার জন্য। একটু বাইরের আলো বাতাস, মানুষের মুখ, কারো সঙ্গে দু’টি কথা কইবার তরে পাগলপারা ছটফটানি। ঠিক যেমন একেকবার ফার্নেসে কয়লা ঢেলে গোটা শরীরখান শুকিয়ে যেত, আর ইচ্ছা হত দেয় এক ঝাঁপ মাঝদরিয়ায়, নিশ্চিত মরণ জেনেও, এখন তেমনি ধরা পড়ুক চাই যা খুশি হোক – বাইরে একদম যাওয়া চাই – এমন একটা বেপরোয়া ভাব তাকে গ্রাস করছিল। ... ...
মিনতি, মিনতির মতো মুখচোরা মেয়ে, সে-ও জিজ্ঞেস করেছে, কতো তাড়াতাড়ি? কতো তাড়াতাড়ি খাইয়ে দিতে হবে? তখনো ধৈর্য হারায়নি উৎপল, বলেছে আটটার মধ্যে। তখন লক্ষ্মীকান্ত বলেছে, ঠিক আছে, আমরা ছটার সময় পড়তে বসে যাবো, আটটার মধ্যে পড়া হয়ে যাবে। উৎপল তো কখনও এরকম জবাব দিতে শোনেনি ওদের, ও রেগেমেগে বলেছে, কী পড়তে বসে যাবো পড়তে বসে যাবো করছো, একজনও বসবে না ডাইনিং হলের চেয়ারে। তখন নাকি তিন-চারজনে মিলে একসাথে বলেছে, ঠিক আছে স্যর, আমরা মেঝেতে বসবো। আর তারপর আস্পর্ধা দেখুন, ক্লাস সেভেনের নবীন ঝাঁঝিয়ে উঠে বলেছে তখন, স্যরকেও কী মেঝেতে বসতে হবে ! বিশেষ কোরে নবীনের এই প্রশ্নে উৎপল খুবই আপসেট। আর সত্যি কথা বলতে কী, আমিও একটু শঙ্কিত। ... ...
হাঁ করে গিলছিল আলেফ আর বসির। রেলের ইস্টিশানে নেবে অবধি দেখেছে এই শহরের রঙ-ঢঙ। যেন রোজকার উৎসব লেগে আছে। পথে পথে রঙ্গ রসিকতা, নাচ গানের আওয়াজ, গ্রাহকের প্রতীক্ষায় পশরা সাজিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েরা, কিছুই চোখ এড়ায়নি তাদের। নিউ ইয়র্কের দশ-বিশ তলা ইমারত ওদের কাছে নতুন ছিল। কি তার চমক আর চেকনাই। আশবারি পার্কে দরিয়াপারের মেলা দেখে চুঁচড়োর দরগার বচ্ছরকার পরব ফিকে পড়ে গেছিল এ জন্মের মত। কিন্তু এই শহরের সাজ সহরত নকশা এমন, যেন চারদিকে আমোদের ভিয়েন বসেছে। এমন কোন রঙ তারা জানে না, যার কয়েক পোঁচ পড়েনি কোথাও না কোথাও। থেকে থেকে নিশেন উড়ছে। তাতে কত রকমের মুখ, জন্তু জানোয়ারের চেহারা দিয়ে চিত্র বিচিত্র করে রেখেছে। এই শহর তার উচ্ছল প্রাণ আর বেঁচে থাকার জীবন্ত ছবি নিয়ে শুরুতেই তাদের খুব টেনেছে। ... ...
যেন ট্রেনে উঠেছিল লিপি- হুইশল দিতে দিতে প্ল্যাটফর্মে ঢুকছে ট্রেন আর লিপি বার্থে উঠে বসছে, তারপর রেলের কামরা বদলে যাচ্ছে ওর বাপের বাড়ির পুরোনো ঘরদোরে - মলিন দেওয়ালে ঝুলে থাকা ছবি, ক্যালেন্ডার- খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে আলো ঢুকছে আর দেওয়ালে ছবি তৈরি হচ্ছে- বকুল গাছ, জবা, টগর, এই উঁচু নারকেল গাছ তারপর মেপল। লাল হলুদ ঝরা পাতার রাশ পেরোচ্ছিল ট্রেন খুব আস্তে, সে ট্রামে করে চলেছে এরকম মনে হচ্ছিল - তারপর একটা লম্বা ব্রিজে উঠল , স্পীড বাড়াল- ঝমঝম ঝমঝম ঝমঝম; ট্রেনের তীব্র গতিতে ভেঙে গেল বাপের বাড়ির দেওয়াল, ঘরদোর, দেওয়ালের ছবি- ... ...
দুপুরে খাওয়ার সময় পুলকেশও বসেন ওদের সাথে, এবং পুলকেশের বিশেষ অনুরোধে জয়মালিকাও। য়্যোরোপের গল্প হয়, পাঁচ জায়গায় সেমিনারে বক্তৃতা দিয়েছে জয়মালিকা, ধরণী মাতার আরাধনা যে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম আর ভারতের ইণ্ডিজেনাস পপুলেশনের দার্শনিক চিন্তার মহাসম্মিলনের ফসল, ভারতীয় ধর্মের শ্রেষ্ঠ প্রতীক, আদিবাসী ধর্ম আর ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মিলনস্থল, এ চিন্তা নাকি আলোড়ন তুলেছে যেখানে যেখানে গেছে ও সেখানেই। ও যে বক্তৃতা দিয়েছে তার ইংরিজি অনুবাদ, এক একটি কপি পাঁচ য়্যুরো হিসেবে একশো কপি – যা ও সঙ্গে কোরে নিয়ে গিয়েছিলো – সবই বিক্রি হয়ে গেছে ! এসব আলোচনা খুব একটা প্রভাব ফেলে না সোমেশ্বরের ওপর, ও মনে মনে ভাবছিলো জয়মালিকা কী বাচ্চাদের পাদুকাবিহীন ফাটা-পাগুলো লক্ষ্য করেছে আজ ! ... ...
দ্রুত খাচ্ছিল মিঠু, বাটি থেকে চিকেনের শেষ পিস প্লেটে তুলে মনে হল -বড় দ্রুত ফুরিয়ে গেল খাওয়ার সময়টুকু। এই আলো আঁধারি, চিনে খাবারের গন্ধ, লাল রেক্সিনের পুরু গদি- ছাত্রদের কোলাহল নেই, মা'র চিৎকার নেই, সনতের এখানে আসার সম্ভাবনাও নেই - তার আরো খানিকটা সময় থেকে যেতে ইচ্ছে হচ্ছিল। হাত তুলে একটা ভ্যানিলা আইস্ক্রীম আর থামস আপ চাইল মিঠু। প্র্যাকটিকাল ক্লাসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কোমর ধরে গিয়েছিল মিঠুর - তার ওপর ঝুঁকে স্লাইড চেক করা। ঢেকুর উঠল বার কয়েক। ফেরার সময় বাসের জন্য দাঁড়াতেও হল অনেকক্ষণ- সি এ এ নিয়ে মিছিল বেরিয়েছে আজ শহরে। ... ...
দুপুরের খাওয়া চল্লিশজন ছেলেমেয়ের জন্যে, ফাইফ সিক্স সেভেন আর এইট। পেট-ভরা ভাত দেওয়া হয় ওদের, সকালের মতো ফ্যানা-ভাত নয়, ফ্যান-গালা ভাত। আর মনে রাখবেন, ওদের পেট-ভরা মানে আপনাদের পেট-ভরা নয়। ভাত ওরা অনেক বেশি খায়, এবং যতটা খায় ততটাই দেওয়া হয়। আমার মনে হয় না পেট-ভরা নিয়ে কোন দুঃখ ওদের আছে। পেট ভরে। রোজই। তবে হ্যাঁ, তরকারির একটা মাপ আছে, সে মাপটা বুঝিয়ে দেওয়া আছে নিমাই আর সুনীলকে। সেটা যে যথেষ্ট নয়, তা আমরা সবাই জানি, নিমাই আর সুনীলও জানে। ... ...
তাদেরকে সাদাদের কামরা থেকে নাবিয়ে দিল না কেউ। টিকেট দেখতে এসে লালমুখো গুঁফো লোকটা অনেকক্ষণ চোখ সরু করে সবার চেহারা জরিপ করল। এরা নিজেদের জান পেটের মধ্যে সিঁধিয়ে বসে ছিল। ভাবটা যেন কিছুই হয়নি, কিন্তু বুক গুড়গুড় করছে। শেষ অবধি লোকটা জিগেস করল, হিন্দু? চেকার আসার আগেই পাঁচকড়ি চোখ বুজে হরিনামে ডুবে গেছিল। মোকসাদ মাথা নেড়ে সায় দিল। ফ্রম ক্যালকাট্টা। আর তুমি? লালমুখোর নজর ইরুবার দিকে। ইরুবা দাড়িতে হাত বুলিয়ে দাঁত বের করে বলল, হিন্দু ফ্রম কালকাত্তা। সে লোক ভুরু কুঁচকে দাঁড়িয়ে রইল। কি নাম তোমার? ইরুবা এত কিছু ভেবে রাখেনি। বলল, ইরুবা। কোথায় যাচ্ছো? নিউ অরলিন। সে লোক এবার ইরুবার কাঁধে এক থাবা মেরেছে। কথা বলছো যেন মিসিসিপির নিগার, আর ভেক ধরেছো হিন্দুর? মুহূর্তে ইরুবা দিল এক লাফ, যেন জলজ্যান্ত হনুমান .... ... ...
লম্বা লম্বা শিক লাগানো পেল্লায় তার কপাট। সেই শিক ধরে ভিতরে চোখ রাখল ফায়জল। সঙ্গে সঙ্গে যেন আলিবাবার গুহার মত এক আজব দুনিয়া চিচিং ফাঁক হয়ে চোখের সামনে হাজির। কি বনবন করে ঘুরছে সবাই। সঙ্গে গান করছে কেউ মিঠে সুরে। ছোট-বড়, রোগা-মোটা, বাচ্চা-বুড়ো সবাই চরকি-ঘোরান ঘুরতে ঘুরতে খলখল করে হাসছে। জীবনটা এত মজার, এসব না দেখলে বোঝাই যায় না। পায়ে পায়ে ভেতরে ঢুকে গেছিল ফায়জল, নিজেকে গুটিয়ে কারো সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি না করে। ভিতরে কত রকমের বাতি ঝুলছে। চলতে চলতে এক আয়নার সামনে গিয়ে তার চোখ কপালে। হুবহু তার মত একটা লোক, শুধু কেউ যেন হামান দিস্তা দিয়ে এমন পিষে দিয়েছে লম্বায় এক হাত আর চওড়ায় তিন হাত। পোশাক দেখে শুধু বুঝতে পারল, যে এটা তার নিজের সুরত। এমন সেই সিসার কেরামতি। এমনি অনেক সিসা দিয়ে একটা দেওয়াল মুড়ে রেখেছে। কোনখানে ফায়জল বেঁটে, তো কোথাও হিলহিলে লম্বা, আর এক জায়গায় সে হয়ে গেল বেলুনের মত গোল। যেন এখুনি হাওয়া বেলুন হয়ে উড়ে যাবে। আলেফ ডেকে না নিয়ে এলে সেখানেই বুঝি পুরো দিনমান কাটিয়ে দিত ফায়জল। ... ...
পরিবেশটা সহজ করার জন্যেই হোক বা অন্য যে কোন কারণেই হোক উৎপল ঘোষণা করে স্কুলের ছেলেমেয়েরা এখন একটা সাঁওতালি গান শোনাবে, এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সমবেত পরিবেশিত হয় ধারমু উদুঃক্ আকাৎ লেকা গানটি। গান শেষ হলে জয়মালিকা আবার তুলে নেয় মাইক। সে ছাত্রছাত্রীদের পরিবারের থেকে যারা এসেছে তাদের উদ্দেশে এবার বলে তোমাদের ছেলেমেয়েদের মানুষ করার দায়িত্ব নিয়েছি আমরা। তারা লেখাপড়া যেমন শিখবে সব ধরণের কাজও শিখবে তেমনি। এই যে আজ এখানে সামিয়ানা টাঙানো হয়েছে, মাইক লাগানো হয়েছে, এসব তোমাদের ছেলেমেয়েরাই করেছে। বড়ো বড়ো শহরের ছেলেমেয়েরা যেমন শেখে সেরকমই ভালো ইংরিজি আর বাংলা শেখাবার জন্যে আমাদের স্কুলে এখন কলকাতা থেকে এসেছেন সোমেশ্বর স্যর আর সম্ভৃতা ম্যাডাম। ... ...
আজ এই হেমন্তের সন্ধ্যায় হাসপাতালের সামনের ফুটপাথে সেই কুয়াশা তাকে আবার ঘিরে ধরেছিল- যে কুয়াশা তাকে এই ক'বছরে বারে বারে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে তার শৈশবে আর সে কখনও মা, কখনও বাবা , কখ্নও জেম্মার সঙ্গে কথা বলেছে ফোনে। আজ সে' উপায় ছিল না- তার শৈশবের শেষ যোগসূত্র এই হাসপাতালের চারতলার ঘরে নাকে মুখে নল নিয়ে শুয়ে ছিল তখন। হাসপাতালের কাচ দরজা খুলছিল, বন্ধ হচ্ছিল। নীল আলো জ্বালিয়ে অ্যাম্বুলেন্স এসে থামছিল পরপর। হিম নামছিল ফুটপাথে। সেই হিমের সঙ্গে হাসপাতালের চারতলা থেকে কুয়াশার মত মৃত্যুর ছায়া এসে মিশছিল যেন। ... ...